মাস কয়েক পর–মাস তখন চৈত্র। বেশ গরম পড়েছে। অপরাহ্লাবেলায় আরোগ্য-নিকেতনের বারান্দায় সেতাবের সঙ্গে মশায় দাবায় বসেছিলেন।
মশায় ক্রমাগত হারছিলেন। বাঁ হাতে ডান হাতের কজিটি ধরে বসে চাল ভাবছিলেন। হঠাৎ বললেন– নাঃ, মাত ঠেকানো যাবে না। আমার হার।
সেতাব বললে—তোর হল কী বল দেখি?
মশায় হাসলেন।
–খেলায় মন নেই একেবারে? কী হয়েছে আজকাল? কেবল নাড়ি দেখছিস। বাঁ হাতে ডান হাতের নাড়ি ধরেই বসে থাকিস! হঠাৎ শঙ্কিত হয়ে সেতাব বললে—জীবন?
মশায় হেসে বললেন– না, কিছু না। তবে ভাল লাগে না রে আর, তাই দেখি। কিন্তু নাঃ, কিছু পাই না।
সেতাব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উদাস হয়ে বসে রইল। দাবা সাজাতে ভাল লাগল না।
বাড়ি থেকে এই মুহূর্তে বেরিয়ে এল সীতা। সেই নার্স মেয়েটি। চায়ের বাটি হাতে এসে বাটি দুটি নামিয়ে দিয়ে বললে–চললাম দাদু। আজ সন্ধে থেকেই ডিউটি।
—এসো। সস্নেহে পিঠে হাত দিয়ে মশায় বললেন–কাল কখন আসবে?
–সকালে স্নান করে ঘুমিয়ে নিয়ে তারপর আসব।
–চল, বিনয়ের ওখানে যাবার পথে একবার ককে দেখে যাব।
মেয়েটি চলে গেল।
সেতাব ঘাড় নেড়ে উৎসাহ প্রকাশ করে বললে–হাসপাতালের ডাক্তার কদ্রু বেটাকে খুব বাঁচালে।
–নিশ্চয়। কেউ ভাবে নি—এ অপারেশন করে ডাক্তার ওকে বাঁচাতে পারবে। চারু বাবু হরেন এরাও ভাবে নি। চারুবাবু তো বলেছিলেন, হাত পাকিয়ে নিচ্ছে বুড়োর উপর ছুরি চালিয়ে, নিক। কদ্রু বেটাও মলে খালাস। স্ট্রাঙ্গুলেটেড হার্নিয়া এখানে অপারেশন হয়?
–হয় সবই, চাই সাহস আর আত্মবিশ্বাস। তা প্রদ্যোত ডাক্তারের আছে।
স্ট্রাঙ্গুলেটেড হার্নিয়া হয়েছিল কর। প্রথমটায় পেটের দরদ বলে ক নিজের ঘরেই। পড়ে ছিল। কিশোর খোঁজ পেয়ে তাকে জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। অপারেশন না করলেও ক মরত। প্রদ্যোত কারুর কথা শোনে নি, সে অপারেশন করেছে; এবং কৰ্ম্ম বেঁচেছে। ধীরে ধীরে সেরে উঠছে সে। মশায় রোজ একবার করে দেখে যান ককে। প্রদ্যোতের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়, সে হেসে নমস্কার করে বলে—আপনার কদ্রু ভালই। আছে। একদিন বলেছিল—ওর হাত দেখে ওকে একটু বলে যান যে ভাল আছে। নইলে ও বিশ্বাস করে না যে ও ভাল আছে। এমন রোগী পাওয়া ভাগ্যের কথা?
সেতাব আবার ছকে খুঁটি সাজাতে আরম্ভ করে বললে–তুই কিন্তু ওই মেয়েটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করছিস জীবন।
ওই সীতা মেয়েটির কথা বললে সেতাব। ওই মেয়েটির সঙ্গে কয় মাসেই মশায়দের সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ শুধু মশায়ের সঙ্গে নয়, মশায়গিন্নির সঙ্গেও।
মশায় হাসলেন–বাড়াবাড়ির ওপর কি মানুষের হাত আছে রে? দাঁতুকে দোষ দিতাম। লোভ-লোভ-লোভ। এও দেখছি মায়া, মায়া; মায়া ছাড়াবার উপায় নাই। ছাড়ব ভাবতে গেলে অন্তর ছটফট করে আরও নিবিড় পাকে জড়িয়ে পড়ে।
মশায় উদাস দৃষ্টি তুলে আকাশের নীলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সেতাব স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এতটা মাখামাখি সেতাবেরও একটু কটু ঠেকে। সেই সূত্র থেকে এ যেন শত সহস্র লক্ষ পাকে জড়িয়ে পড়ল জীবন। জীবন যদি যুবা হত, এমনকি প্রৌঢ়ও হত এবং জীবন যদি জীবনমশায় না হত তবে লোকে তার দুর্নাম রটাত। তবুও লোকে প্রশ্ন করে এত কিসের মাখামাখি বলতে পার? সেতাবকেই প্রশ্ন করে। জীবন মশায়কে রক্ষা করবার জন্যই সে বলে—এটাও বোঝ না বাপুঃ ছেলেপুলে নাতিনাতনী সব যখন ছাড়লে তখন ওটা এসে পড়ল, ওরাও জড়িয়ে ধরলে আর কি! লোকে তবুও ছাড়ে না। বলেনার্সটার্সদের জাতফাত তো সব গোলমেলে ব্যাপার। সেতাব বলে—সে বাপু আগেকার কালে ছিল—একালে নয়। জীবনের স্ত্রীও মেয়েটিকে ভালবেসেছে। আতর-বউ ভালবেসেছে সেটা তো কম নয়। নিত্যই মেয়েটি একবার করে আসে। আতর-বউকে বই পড়ে শোনায়। আতর-বউয়ের দুঃখের কাহিনী শোনে। এসব জেনেও সেতাবের মনে সন্দেহ হয় যে, মেয়েটি অত্যন্ত সুচতুরা; সে এই বৃদ্ধদম্পতির জীবনের শূন্যতার সুযোগ নিয়ে তাদের দোহন করছে। টাকা-পয়সাও নেয়, এঁরাও—অন্তত জীবনওদেয়!
শেষ বয়সে জীবনের ভাগ্যটা যেন ফিরে গেল। জীবনের নামডাক আবার অনেকটা ফিরে এসেছে। রামহরি লেটকে বাঁচিয়ে সূত্রপাত হয়েছিল, তারপর এই শশাঙ্কের বউয়ের রোগে। জীবনের চিকিৎসা দেখে লোকে অবাক হয়ে গিয়েছে। ডাক্তারেরা বলেছিল যক্ষ্মা, জীবন বলেছিলেন যক্ষ্মা নয়। অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছে। মাস দেড়েকের মধ্যেই সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয়েছে শশাঙ্কের স্ত্রী। সে কী পরিশ্রম আর সে কী নিষ্ঠা বৃদ্ধ জীবন মশায়ের নিজের হাতে ওষুধ তৈরি করেছেন। নিয়মিত একদিন অন্তর ভোরবেলা উঠে দু মাইল পথ হেঁটে গিয়ে জীর্ণ ঘরখানির সামনে দাঁড়িয়ে ডাকতেন–মা!
মরি বোমি ঠিক উপস্থিত থাকত। হাসিমুখে বলত—আসুন বাবা।
—মা উঠেছেন?
–মা আপনার সেই ভোরে উঠে বসে আছেন। জপ সারা হয়ে গেল।
সাদা থান-কাপড়-পরা শীর্ণ ক্লান্তদৃষ্টি গৌরাঙ্গী মেয়েটি প্রসন্ন হেসে মাথায় একটু কাপড় টেনে দিয়ে অভ্যর্থনা করে বলত-কেন কষ্ট করে এলেন বাবা? ওষুধ পাঠিয়ে দিলেই হত। আমি ভাল আছি বাবা।
ভাল তো থাকবেই মা। রোগ তোমার জট পাকিয়েছে কিন্তু কঠিন তো নয়। তার ওপর তোমার সহ্যগুণ, সেই জোরে শরীরের চেয়ে মন বেশি ভাল আছে। হাতটা যে দেখতে হবে। সেইজন্যে এলাম।
লজ্জিত হত মেয়েটি। মধ্যে মধ্যে বলত—আমাকে বাঁচাবার জন্যে এত কষ্ট কেন করছেন, আমি লজ্জা পাই। আমার জীবন যাবার নয়। আমি গেলে কষ্টভোগ করবে কে?
মশায় উত্তর দিয়েছিলেন—সুখ-দুঃখের সংসার মা। যত সুখ, তত দুঃখ। এই সইতেই জন মা।
হেসে সে বলেছিল—তাই বটে বাবা, যত তেতো তত মিষ্টি। না পারা যায় গিলতে, না পারা যায় ওগরাতে।
–ঠিক বলেছ মা। আমাকে দেখ। তবু মা সংসারে মৃত্যুকামনা করতে নেই। আবার মরণকে ভয় করে পিছন ফিরে সংসার আঁকড়ে ধরে কাঁদতেও নেই। দুটোই পাপ।
—সেই পাপের ভয়েই তো বাবা। নইলে—
মশায় একদিন বলেছিলেনপাপ তোমার নেই মা। কিন্তু অন্যায় কিছু আছে। রাগ কোরো না আমার ওপর।
চমকে উঠেছিল মেয়েটি–কী অন্যায় বাবা?
–মা, আত্মা—যাকে নিয়ে মানুষের এত, তিনি হলেন দেহাশ্রয়ী। দেহ নইলে তিনি নিরাশ্রয় নিরালম্বতার আর কিছু থাকে না। সেই দেহকে একটু যত্ন কর তুমি। যে মন্দিরে দেবতা থাকেন, সে মন্দিরের অযত্ন হলে দেবতা থাকবেন কী করে? দেহকে পীড়া দিয়ে তাকে অকালে চলে যেতে বাধ্য করলে—সেও যে এক ধরনের আত্মহত্যা হয়। শরীরের একটু যত্ন নিতে হবে।
শশাঙ্কের স্ত্রী সে কথা পালন করেছে।
কোনো কোনো দিন সকালে যেতে না পারলে, বৃদ্ধ মশায় দুপুরের রোদ মাথায় করেই গিয়েছেন।
শশাঙ্কের স্ত্রী সেরে উঠেছে। ভাইপোর ঘরে আবার ফিরে গিয়েছে। ফিরিয়ে নিয়ে যাবার আগে ভাইপোটি পিসিকে শহরে নিয়ে গিয়ে এক্স-রে করিয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে তবে নিয়েছে। এক্স-রেতে জীবন মশায়ের কথাই সত্য হয়েছে। আজও মধ্যে মধ্যে মরি বোষ্টমি ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে ভিক্ষার পথে এসে জয় গোবিন্দ বলে তাঁর কাছে দাঁড়ায়। ঝুলির ভিতর থেকে বের করে দেয় কিছু মিষ্টান্ন। অভয়া মা, কালীমায়ের প্রসাদ পাঠিয়েছেন বাবা।
আরও সত্য হয়েছে জীবন মশায়ের কথা। দাঁতু ঘোষাল মরেছে। হাসপাতাল থেকে ভূতের ভয়ের জন্য দাঁতু জোর করে চলে এসেছিল। জুটেছিল শশীর সঙ্গে। কদিন পরেই বিপিনের শ্ৰাদ্ধ হল সমারোহের সঙ্গে। সেই শ্রাদ্ধে দাঁতু খেয়ে এল, সে খাওয়া বিস্ময়কর।
তারপরই সে পড়ল।
শেষ চিকিৎসা তার জীবনমশায়ই করেছেন। সে অন্য কাউকে ডাকেও নি। মশায়কেই ডেকেছিল। শশীই এসেছিল ডাকতে।
মশায়ের দুটি হাত ধরে কেঁদেছিল।
মশায় বলেছিলেন–আমি কী করব তু? কেই বা কী করবে? হাসপাতাল থেকে তুই শ্ৰাদ্ধের খাওয়ার লোভে পালিয়ে এলি?
দাঁতু অস্বীকার করে বলেছিল-–গুরুর দিব্যি, না। ঈশ্বরের দিব্যি করে বলছি। ভূতের ভয়ে। হাসপাতালের ডাক্তারের বাড়িতে পর্যন্ত–
—দাঁতু! তিরস্কারের সুরে মশায় বলে উঠেছিলেন–দাঁতু!
—দাঁতু চুপ হয়ে গিয়েছিল এক মুহূর্তে। মশায় বলেছিলেন—সে তুই। ডাক্তারের রান্নাঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে তুই ভূত সেজে মাংস চেয়েছিলি। আমি জানি। দোষ তোর নয়, এ লোভ তোর রিপু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুই ছাড়তে পারবি নে। তোর ইতিহাস আমি জানি, তাই এত জোর করে বলেছিলাম–দাঁতু এতেই তোকে যেতে হবে। হাসপাতালের ডাক্তার জানে না তোর ইতিহাস, হয়ত আমার মত বিশ্বাস করে না, তাই বলেছিল তোকে বাঁচাবে।
দাঁতু ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিল।
মশায় বলেছিলেন—ভয় কী? মরবে তত সবাই একদিন। আমিও মরব। মানুষ জন্মায় সে কী হবে, তার কত সুখ কত দুঃখ এ কেউ বলতে পারে না, সবই তার অনিশ্চিত, নিশ্চিত কেবল একটি কথা—সে মরবে একদিন। আর বয়স তো কম হল না। সাহস কর, ভগবানের নাম নে। মরণকে যত ভয় করবি তত কাঁদতে হবে। ভয় করিস নে, দেখবি মরণই তোর সত্যিকারের সুখ। এ ভাঙা জরা দেহ-এ দিয়ে করবি কী? পালটে ফেল। পালটে ফেল।
দাঁতু অনেকক্ষণ কেঁদে তারপর বলেছিল—এবার আমাকে বাঁচাও, আর লোভের খাওয়া খাব না আমি। দেখো।
মশায় হেসেছিলেন, বলেছিলেন চেষ্টা আমি করব। তবে বলাই ভাল রে দাঁতু! দেহে আর তোর কিছু নাই। নাড়িতে বলছে
—ছি-ছি-ছি! ছি-ছি-ছি!
মশায়ের কথার মাঝখানেই দাঁতু চিৎকার করে উঠেছিল–মৃত্যুর সময়েও মশায় উপস্থিত ছিলেন। প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জ্ঞান ছিল দাঁতুর, শুধুই কেঁদেছিল, চোখ দিয়ে অনর্গল ধারে জল পড়েছিল। মশায় একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন কী হচ্ছে তোর?
ঘাড় নেড়ে দাঁতু ক্ষীণ কণ্ঠে বলেছিল—জানি না। ভয় লাগছে।
সেই বহুকালের—সেই আদিকালের সেই পুরনো কথা। মহাভয়, মহাভয়! মহা অন্ধকার! মহাশূন্য! নিশ্বাস নেবার বায়ু নেই। দাঁড়াবার স্থান নাই! কিছু নাই! কেউ নাই—আমি নাই।
ক্ষণেকের জন্য মশায়কেও যেন তার ছোঁয়াচ লেগেছিল। গভীর স্বরে তিনি ডেকে উঠেছিলেন–পরমানন্দ মাধব হে! সেতাবও ছিল মশায়ের সঙ্গে। দাঁতু তারও পাঠশালার সহপাঠী। দেখতে গিয়েছিল। সেতাব মশায়ের হাতখানা চেপে ধরেছিল।
সেই অবধি জীবনের সময় ভাল চলেছে। উপার্জনও বেড়েছে। সেতাবের ধারণা, এই সীতা মেয়েটি এইসব দেখেশুনেই এমন করে আঁকড়ে ধরেছে মশায়কে, আলোকলতার মত। আকাশপথে এসে বুড়ো শালের মাথায় পড়ে তাকে ছেয়ে ফেলেছে, তার রস শোষণ করছে। এই কারণেই সেতাব সন্তুষ্ট নয়। সে বলে। আজও বললে—তবুও বলব জীবন, বাড়াবাড়ি লোকের চোখে ঠেকছে। কোথাকার কোন বংশের কী ধরনের মেয়ে, তার ঠিক নাই। আর তোর হল মশায়ের বংশ!
হেসে মশায় বললেন–মশায়ের বংশের অবস্থাটাও ওই মেয়েটির মতই সেতাব। কী তফাত আছে বল? আর—হুঁ। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু হঠাৎ থেমে গেলেন।
কথা বন্ধ করে মশায় যেন উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন—কে কাঁদছে নয়? সেতাব?
—কাঁদছে? হ্যাঁ। কার অসুখ ছিল? হ্যাঁ, কাঁদছেই তো!
মশায় উঠলেন। বললেন–ছক তোল সেতাব, একবার দেখি। বৃদ্ধ সেতাব এসব বিষয়ে নিরাসক্তির কোঠায় পৌঁছেছে। সে আর একবার বললে—কার কী হল? বলেই কোটা তুলে নিলে।
—বোধহয় মতি কর্মকারের বাড়িতে কারও কিছু হয়েছে। ওর মায়ের সেই ব্যাপার থেকে ওরাই শুধু আমাকে ডাকে না। কথায় কথায় হাসপাতালে ছোটে দেখি।
অন্য কারও বাড়িতে অসুখ থাকলে অবশ্যই তিনি জানতেন।
মশায়ের তার জন্য ক্ষোভ নাই। মতির উপর রাগ করেন না। তিনি জানেন তার চেয়ে কেউ ভাল জানে না যে, তারা যে তাকে ডাকে না, আসে না সেটা অবিশ্বাসের জন্য নয়। ডাকে না লজ্জায়। মতির মা তার নিদান ব্যর্থ করে বেঁচেছে সেই লজ্জায় তাকে ডাকতে পারে না। মতি পর্যন্ত তার সামনে আসে না। আড়াল দিয়ে হাঁটে। কিন্তু হল কী?
মশায় তাড়াতাড়ি জুতো পরে বেরিয়ে পড়লেন। খানিকটা গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। মতির মা-ই কি তবে গেল? না–।
কান্না মতির বাড়িতেই বটে। কিন্তু সকলের কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে উঠেছে মতির মায়ের কণ্ঠস্বর।-ওরে বাবা রে! আমার এ কী সৰ্বনাশ হল রে! তোমাকে আমি ছাড়ব না রে। তুমি আমার নাতিকে বাঁচিয়ে দিয়ে যাও। নইলে কেন তুমি আমাকে বাঁচালে রে?
মশায় দ্রুত হেঁটে মতির বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
এই মুহূর্তেই হাসপাতালের ডাক্তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। মশায়ের সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হয়ে গেল। পিছনে পিছনে বাড়ি থেকে পাগলিনীর মত বেরিয়ে এল মতির মা। খুঁড়িয়ে চলেও ছুটে এসে সে হাসপাতালের ডাক্তারের সামনে দাঁড়াল। নানা-না। তুমি বাঁচিয়ে দিয়ে যাও। বাঁচিয়ে দিয়ে যাও। পায়ের উপর আছড়ে পড়ল সে, হাসপাতালের ডাক্তার। দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। বললেন– ছাড় ছাড়, পথ ছাড়।
চিৎকার করে উঠল মতির মা—তবে আমাকেও মেরে দিয়ে যাও। বিষ দাও। মরণের ওষুধ দাও।
জীবনমশায় গম্ভীর স্বরে বললেন– মতির মা!
মতির মা তার মুখের দিকে চেয়ে নতুন করে বিলাপ শুরু করবার চেষ্টা করলে। কিন্তু জীবনমশায় সেই গম্ভীর কণ্ঠেই বললেন–ওঠ, চুপ কর। সবেরই একটা সীমা আছে। কিন্তু হল কী? কার অসুখ করেছিল?
চিৎকার করেই মতির মা কী বলতে গেল। মশায় বললেন–এমন করে নয় মতির মা–এমন করে নয়। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধরে বল।
এবার হাসপাতালের ডাক্তার বললেন– মতির বড় ছেলেটি মারা গেল।
—আঃ, ছিঃ ছিঃ ছি! মশায় বলে উঠলেন। বার-তের বছরের যে পাথরে গড়া ছেলের মত শক্ত ছিল! কী হয়েছিল?
—বোধহয় ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। মাত্র দুদিন জ্বর। হঠাৎ হার্টফেল করল। ডাক্তার বলছিলেন, কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে আবার মতির মা চিৎকার করে আর্তনাদ করে উঠল—ওরে আমার সচল-বচল ছেলে রে, অসুরের কড়ি সেই ছেলে আমার।
বুক চাপড়াতে লাগল মাথা ঠুকতে লাগল।-ওরে তুমি আমাকে কেন বাঁচালে রে? কেন বাঁচালে রে?
হাসপাতালের ডাক্তার বিব্রত হয়ে উঠলেন। ওদিকে তার সাইকেল পাংচার হয়ে গেছে। চারপাশে লোক জমেছে। মৃদু গুঞ্জনে তারা বলছে—কী রকম? রোগে তাকাতেই পারে নাইনা কি?
জীবনমশায় ডাকলেন মতি!
মতি দুই হাতে মাথা ধরে বসে ছিল। এবার সে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল—ডাক্তার জেঠা, আপনাকে দেখালে হয়ত আমার
জীবনমশায় বাধা দিয়ে বললেন– না। আমাকে দেখালেই বাঁচত কে বললে? সংসারে ডাক্তার-বৈদ্যতে রোগ সারাতে পারে, মৃত্যুরোগ সারাতে পারে না বাবা।
মতির মা আবার চিৎকার করে উঠল। আমি কী করব গো? আমাকে বলে দাও।
কী করবে? সহ্য করবে। সংসারে যখন বহু সংসার হয় তখন মুক্তি নিতে হয়—নয় সইতে হয়। সংসারে মৃত্যু অবিরাম। বিরাম নাই। মৃত্যুর কাছে বালক বৃদ্ধ নাই। কী করবে? সইতে হবে।
—আমাকে বাঁচালে কেন গো? আমাকে বাঁচালে কেন?
–এই শোক তোমার কপালে ছিল বলে। তা ছাড়া তুমি বাঁচতে চেয়েছিলে মতির মা।
কে একজন বলে উঠল—এ তো চিরকালের নিয়ম গো। সংসারে প্রবীণ মানুষ মৃত্যুশয্যা পেতে যদি উঠে বসে, তবে সে শয্যেতে আর কাউকে শুতে হবে। মাসুল দিতে হবে।
নীরবে জীবনমশায় অগ্রসর হলেন, তাঁর সঙ্গে হাসপাতালের ডাক্তার। হঠাৎ তিনি বললেন–এখানে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া তো এখন নাই, আমি সন্দেহ করি নি। আমাকে বলেও নি। আজ বললে–কয়েকদিন আগে মামার বাড়ি গিয়েছিল। সেখান থেকেই এনেছে।
জীবন ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–রোগীর রোগ-বর্ণনায় ভুল, চিকিৎসকের ভ্রান্তি, ওষুধ অপ্রাপ্তি, এসব মৃত্যু-রোগের উপসর্গ না হোক–হেতু। নইলে চিকিৎসাবিজ্ঞান-আমাদের বলে আয়ুর্বেদ পঞ্চম বেদ। বিজ্ঞান বেদ এ তো মিথ্যা নয়। মিথ্যা এমনি করেই হয়। মৃত্যু আসে। অবশ্য একালের রোগপরীক্ষার উন্নতি আরও হবে। তখনকার কথা বলতে পারি না। তবে এইটুকু বলতে পারি, ভ্ৰান্তি মানুষের হবেই।
একটু চুপ করে থেকে প্রদ্যোত বললে—নাড়ি দেখে আপনি বুঝতে পারতেন ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া?
—এ ক্ষেত্রে হয়ত পারতাম না। পারলেও বাঁচাতে পারতাম না।
–ওটা ঠিক কথা নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ অচিকিৎসায় অকালে মরছে।
–হ্যাঁ তা মরছে।
এরপর দুজনেই নীরবে পথ হাঁটতে লাগলেন। মশায় ভাবছিলেন ডাক্তারের কথাই। মরে, অকালে অচিকিৎসায় অনেক লোক মরে। এ স্বীকার আজ করতেই হবে।
হঠাৎ হাসপাতালের ডাক্তার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললেন, কিন্তু মতির মাকে আজ আপনি যে কথাগুলি বললেন– সে আমার বড় ভাল লাগল। ঠিক কথা মশায়, জীবনে যখন সময় আসে তখন মুক্তি নিতে হয়। আমার শাশুড়ির দিদিমা আছেন। তিন কুলের সব গিয়েছে, কেবল তিনি আছেন। আমি গেলেই তিনি বলেন, তুমি তো ডাক্তার! আমার কান আর চোখ দুটো সারিয়ে দাও তো। এই মতির মা! আপনি ওকে যা বলেছিলেন—অপারেশন না হলে তাই হত। মরত বুড়ি। কিন্তু আপনি ওকে গঙ্গাতীরে যেতে বলায় ওর সে কী কান্না তখন। আমার পায়ে ধরে বলে আমাকে বাঁচান। এ রোগে আমি মরতে পারব না। এ অপঘাত মৃত্যু। এতে মরে আমি শান্তি পাব না। আমার গতি হবে না।
—ওটা ছলনা ডাক্তারবাবু। মানুষ যেখানে অতি মায়ায় অতি মোহে বদ্ধ হয়, মৃত্যুভয়ে কাতর হয়, তখন নানা ছুতোয় বলে—আমি এই জন্যে বাঁচতে চাই, বাঁচাও আমাকে। মৃত্যুভয়
যে মানুষের একটা বড় লজ্জা! তাই ঢাকে।
–ঠিক বলেছেন, এমনি কথাই আমাকে বলেছিল মতির মা। বলেছিল—আর সাধ আমার একটি আছে। বড় নাতির বউ দেখতে সাধ আছে।
মশায় একটু হাসলেন-মতির মা আবারও অসুখ করলে নতুন সাধের কথা বলে বাঁচবে। কিন্তু ছেলেটির যাওয়া বড় মর্মান্তিক। বড় সবল স্বাস্থ্য ছিল ছেলেটার। একজন বলশালী লোক হত। স্কুলে পড়ত; বাপের কামারশালে বাপকে সাহায্য করত; হাতুড়ি পিটত। ওকে দেখলেই মনে পড়ত মঙ্গলকাব্যের বালক কালকেতুকে।
অকালমৃত্যুর চেয়ে মর্মান্তিক আর কিছু নাই। একে রোধ করাই এ সংসারে সবচেয়ে বড় কল্যাণ। সবচেয়ে সুখের। মৃত্যু এইখানে মৃত্যু, বৃদ্ধ বয়সে সে অমৃত!
হাসপাতালের ডাক্তার বললেন– আজকের কথা চিরদিন মনে থাকবে আমার। আমি বড় বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম।
–না–না-না। আপনি কেন বিব্রত হবেন? আপনি তো চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। আপনি কী করবেন?
হাসপাতালের সামনে এসে পড়েছিলেন তারা। ডাক্তারের চাকর ভিতর থেকে ছুটে এসে ফটকটি খুলে দিল। ডাক্তারের স্ত্রী বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বোধ করি সবিস্ময়ে দেখছে। দূরে হাসপাতালের কাছাকাছি ছোট কোয়ার্টারটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সীতা। সেও দেখছে।
ডাক্তার আহ্বান জানালেন–আসুন। একটু বসবেন না? অনেকবারই এসেছেন হাসপাতালে, এখনও আসেন; ককে দেখে যান। আমি কখনও ডাকি নি, একটু বসবেন না আজ আমার বাসায়?
মশায় হাত জোড় করে বললেন– আজ নয় ডাক্তারবাবু। আসব অন্যদিন।
প্রদ্যোত একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বললে—আপনার কাছে হয়ত আমার ত্রুটি হয়ে থাকবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে আমি ইচ্ছে করে করি নি। আপনার চিকিৎসাপদ্ধতি আর আমার পদ্ধতিতে অনেক প্রভেদ। আমার মত ছেড়ে আপনার মতে আমি বিশ্বাস করতে পারি নি। তাতে আমাকে বিব্রত হতে হয়। আমার চিকিৎসা করা চলে না। তবে হামতির মায়ের নিদান হকার কথা শুনে আর ওর সেই কান্না দেখে আমার রাগ হয়েছিল। আজ অবশ্য দেখলাম—মতির মা মরলেই ওর পক্ষে ভাল হত। কিন্তু আমরা তো ঠিক ওই চোখে দেখি না।
হেসে মশায় বললেন––জানি। আমরা সেকালে ওই চোখেই দেখতাম। বিশেষ করে পরিণত বয়সের রোগী হলে, আর রোগ কঠিন হলে রোগের যন্ত্রণা উপশমের চেষ্টাই করতাম, মৃত্যুর সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম না। বলে দিতাম, ইঙ্গিতেও বলতাম, স্পষ্ট করে বলতাম, আর কেন? অনেক দেখলে, অনেক ভোগ করলে, এইবার মাটির সংসার থেকে চোখ ফিরিয়ে উপরের দিকে তাকাও। সাধারণ মানুষ আকাশের নীলের মধ্যে তো ধরবার কিছু পায় না, তাই বলতাম তীর্থস্থলে যাও, সেখানকার দেবতার মন্দিরের চূড়ার দিকে তাকিয়ে বসে। থাক। তবে অবশ্য যে প্রবীণ, যে বৃদ্ধ বয়সেও বহুজনের আশ্রয়, বহুকর্মের কর্মী, তাকে বাঁচাতে কি আর মরণের সঙ্গে লড়ি নি? লড়েছি।
প্রদ্যোত ডাক্তার বললে–অন্যদিন হলে তর্ক করতাম। আজ করব না। আমার নিজেরই দিদিশাশুড়ির কথা বললাম। আমরাই বলি, বুড়ি গেলেই খালাস পায়। সেও পায়—হয়ত আমরাও পাই।
মশায় বললেন–তা হয় বৈকি। ওটা আবার সংসারের আর একদিক। সুস্থ জীবন–রঙে রসে ভরপুর জীবন জীর্ণ বস্তুকে সহ্য করবে কেমন করে?
প্রদ্যোত বললে—কয়েকটা কেসেই আমি আপনাকে হাত দেখতে দিই নি। আমার ভয় হত, আপনি কী পাবেন–কী বলে দেবেন। আপনার হাত দেখাকে আমার সময় সময় ভয় লাগে। বিশেষ করে অহি সরকারের নাতির অসুখে।
—ও আপনি অদ্ভুত বাঁচিয়েছিলেন। অদ্ভূত চিকিৎসা করেছেন। আমি প্রথম নাড়িতে মৃত্যুর যেন পায়ের সাড়া পেয়েছিলাম। আমি বার বার হাত দেখেছিলাম কেন জানেন? মৃত্যুকে পিছন হঠে চলে যেতে দেখলাম।
অবাক হয়ে প্রদ্যোত তাকিয়ে রইল মশায়ের মুখের দিকে। কথাটা সে জানে না নয়—কিন্তু সে কথাকে এইভাবে সে প্রকাশ করত না, এমন করে সে অনুভব করে না।
–আজ চলি তা হলে।
–আর একটা কথা। রানা পাঠকের কথা।
—রানা বাঁচবে না ডাক্তারবাবু। রানা সে কথা জানে। সে এক অদ্ভুত মানুষ। সে তো ভয়। করে না মরতে। আপনাদের এখানকার অদ্ভুত চিকিৎসায় বাঁচতে পারত। কিন্তু সে বলে কী জানেন—ভাল হলেও সে-আমি আর হব না। অক্ষমের শামিল হয়ে বাঁচতে হবে, লোকে ভয়ে পাশে বসবে না। ছেলেপিলে ভয় করবে। সে বাঁচা বাঁচতে এত কষ্ট, এত খরচ করব কেন? তার। চেয়ে যা-হয় আপনি করুন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন–আর তো রানা আমাকেও দেখায় না। ওষুধপত্র সব ছেড়ে দিয়েছে সে। এখন দেবস্থানের ওষুধ খাচ্ছে।
মশায় ভাবতে ভাবতেই বাড়ি ফিরলেন। রানাকে যদি বাঁচাতে পারতেন।
রানাকে সারাতে পারত প্রদ্যোতরা। হ্যাঁ, পারত। তাদের চিকিত্সও ছিল কিন্তু সে চিকিৎসার তাঁর আয়োজন নাই। আর এতখানি শক্তিও ছিল না; না–ছিল না।
এ চিকিৎসাশাস্ত্র বিপুল গতিবেগে এগিয়ে চলেছে। অণুবীক্ষণ যন্ত্র খুলে দিয়েছে দিব্যদৃষ্টি। বীজাণুর পর বীজাণু আবিষ্কৃত হচ্ছে। রোগোৎপত্তির ধারণার আমূল পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আজ সবই প্রায় আগন্তুক ব্যাধির পর্যায়ভুক্ত হয়ে গেল। সবের মূলেই বীজাণু। বীজাণু, জীবাণু, কৃমিজাতীয় সূক্ষ্মকীট–তারপর আছে ভাইরাস। খাদ্যে জলে বাতাসে তাদের সঞ্চরণ। মানুষের দেহে তাদের প্রবল বিস্তার। তাদের শাস্ত্রে পড়েছিলেন দক্ষযক্ষে রুদ্রমূর্তি শিবের ক্রোধ নিঃশেষে হয়েছিল জ্বরের সৃষ্টি; নানান আকার, নানা প্রকার; আচার্যেরা তাদের প্রকৃতি নির্ণয় করে নামকরণ করেছিলেন। চন্দ্র দেবতার উপর দক্ষ প্রজাপতির অভিশাপ থেকে যক্ষ্মার উৎপত্তি হয়েছিল। অতি রমণ দোষই যক্ষ্মার আক্রমণের বড় কারণ বলে ধরতেন। আজ খাদ্যাভাব যক্ষ্মার প্রধান কারণ। প্রতিটি জ্বরের কারণ আজ ওরা অণুবীক্ষণে প্রত্যক্ষ করছে। কত নূতন জ্বর! এই তো কালাজ্বর ধরা পড়ল তাঁর আমলেই।
কালাজ্বরের ওষুধ ব্রহ্মচারী সাহেবের ইনজেকশন। প্রন্টুসিল, সালফাগ্রুপ, তারপর পেনিসিলিন, টেরামাইসিন, ওষুধের পর নতুন ওষুধ। শুনছিলেন সেদিন হরেনের কাছে। পেনিসিলিন চোখে দেখেছেন। বাকিগুলি দেখেন নি। আরও কত ওষুধ বেরিয়েছে—তিনি হয়ত শোনেন নি। আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মি দিয়ে চিকিৎসা।
রক্ত, পুঁজ, থুতু, মলমূত্র, চামড়া পরীক্ষা।
ব্লাডপ্রেসার পরীক্ষা।
এক্স-রে পরীক্ষা। যক্ষ্মায় আক্রান্ত শ্বাসযন্ত্র চোখে দেখা যায়। তেমনি ওষুধ।
টি-বিতে স্ট্রেপ্টোমাইসিন শক্তিশালী ওষুধ। স্ট্রেপ্টোমাইসিন ছাড়াও পি-এ-এস বলে একটা ওষুধ বেরিয়েছে বলে শুনেছেন। দুটোর একসঙ্গে ব্যবহারে নাকি আশ্চর্য ফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া-অস্ত্র-চিকিৎসার কথা শুনেছেন।
অকস্মাৎ একটা পুরনো কথা মনে পড়ে গেল।
গুরু রঙলালের কাছে কলেরার প্রেসক্রিপশন আনতে গিয়ে মৃত্যুভয়ত্রস্ত মানুষদের প্রসঙ্গে বলেছিলেন মৃত্যু যেন দু হাত বাড়িয়ে উন্মাদিনীর মত ভয়ঙ্করী মূর্তিতে তাড়া করে ছুটেছে; মানুষ পালাচ্ছে; আগুন-লাগা বনের পশুর মত দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটেছে।
রঙলাল ডাক্তার বলেছিলেন—শুধু পালানোটাই চোখে পড়ছে তোমার; মানুষ তার সঙ্গে অবিরাম লড়াই করছে দেখছ না? পিছু হঠেই আসছে সে চিরকাল কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে তাসে নি। নূতন নূতন অস্ত্রকে উদ্ভাবন করছে, আবিষ্কার করছে। সে চেষ্টার তো বিরাম নাই তার। মৃত্যুকে রোধ করা যাবে না, মৃত্যু থাকবেই। কিন্তু রোগ নিবারণ সে করবে। পরিণত বয়সে যোগীর মত মানুষ দেহত্যাগ করবে। চিকিৎসকের কাছে এসেই বলবে—আর না; ছুটি চাই। ঘুমুতে চাই। পুট মি টু স্লিপ প্লিজ!
জীবন সেদিন মনে মনে বলেছিল–হ্যাঁ। নিদ্ৰা নয়, মহানিদ্রা।