৩৫
মইনুল ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করল মহিতোষ নেই। সে ঘড়ি দেখল। ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে। এত ভোরে সাধারণত ঘুম থেকেই ওঠেন না মহিতোষ। কিন্তু আজ কোথায় গেলেন? গতরাতে খুব যন্ত্রণা করেছেন। বলেছেন, এখানে আর থাকবেন না। চলে যাবেন ভুবনডাঙা। সেখানে তাঁর বাড়ি-ঘর আছে। মা আছে, স্ত্রী আছে। সেসব ছেড়ে কেন শুধু শুধু এখানে পড়ে থাকবেন? মইনুল যতটা সম্ভব বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু লাভ হয়নি। মহিতোষের মন তাতে গলেনি। বরং পাগলামিটা যেন একটু বেড়েই গিয়েছিল। তবে এ ধরনের পাগলামি যে তিনি সবসময়ই করেন তা নয়। বেশির ভাগ সময়ই থাকেন শান্ত, চুপচাপ। তখন তার সাড়া শব্দ মেলে না। মইনুল যা বলে, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। কিন্তু হঠাৎ হঠাত্র যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তখন তাকে সামলানো খুব মুশকিল। গতকাল ছিল তেমনই একদিন। রাতে অনেক চেষ্টা করেও কিছু খাওয়ানো যায়নি। মাঝরাত অবধি জেগে ছিলেন। নানা বায়না ধরেছেন। খামখেয়ালি করেছেন। এসব কারণে মইনুলও ঠিকঠাক ঘুমাতে পারেনি। অথচ আজ সকাল সকাল তাকে অফিসে যেতে হবে। রাতে ঘুম না হলে দিনভর বড় ক্লান্ত লাগে।
মইনুল বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে গেল। বের হয়ে দেখল সদর দরজাটা হাট করে খোলা। তার মানে বাইরে বেরিয়েছেন মহিতোষ। প্রশ্ন হচ্ছে, এত ভোরে তিনি কোথায় গেছেন? তা ছাড়া তার শরীরের অবস্থাও বেশি সুবিধার নয়। এই অবস্থায় খুব বেশি দূর পথ একা একা যেতে পারবেন বলেও মনে হয় না। বরং রাস্তাঘাটে পড়ে থাকলে বিপদ। কখন কোন গাড়ি-ঘোড়ার নিচে চাপা পড়েন, কে জানে!
আজকাল মাঝেমধ্যে বিরক্তও লাগে মইনুলের। তারপরও সে তাকে ছেড়ে যায় না। লোকটার প্রতি একটা মায়া যেমন তার রয়েছে, তেমনি ঢাকা শহরে এমন বিনা ভাড়ার বাসায় থাকতে পারার সুযোগটাও তো কম কিছু নয়। ফলে তরুর প্রস্তাব শুনে সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গিয়েছিল সে। সমস্যা হচ্ছে, এখন মাঝেমাঝে খুবই বিরক্ত লাগে। যেমন আজ।
মইনুল ঘর থেকে বের হলো। সে ভেবেছিল মহিতোষকে আশপাশেই কোথাও খুঁজে পাবে। কিন্তু পেল না। তাকে পেল বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরে রমনা পার্কে। পার্কে একটা বেঞ্চিতে তিনি বসে আছেন। মইনুল তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি অপরাধীর ভঙ্গিতে মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে বাবা।
মইনুল ভেতরে ভেতরে একটু উত্তপ্তই হয়ে ছিল। ভেবেছিল আজ কঠিন কিছু কথাই তাকে শোনাবে। কিন্তু প্রথমেই তার এমন অসহায় আত্মসমর্পণ দেখে আর কিছু বলতে পারল না সে। বরং নরম গলায় বলল, এখানে কী করছেন আপনি?
কী যে করছি!’ বলে মাথা চুলকালেন মহিতোষ। তারপর বললেন, সারারাত ভাবছিলাম দিনে কিছু একটা করব। খুব জরুরি কোনো কাজ। এইজন্য বুঝলা, ঘুম থেকে উঠেই কাজটা করতে বের হইছিলাম। কিন্তু তারপর আর কিছুই মনে করতে পারছিলাম না।’
আপনার বাইরে কী কাজ? কোনো কাজ থাকলে আমাকে বলবেন।
হুম। তোমারেই তো বলব। তুমি ছাড়া আর কাকে বলব? তুমি ছাড়া তো আমার আর কেউ নাই বাবা।’ মইনুলকে ইদানীং তুমি করেই বলেন মহিতোষ। তাকে দেখে চট করে বোঝার উপায় নেই যে তিনি মাঝেমধ্যেই গুরুতর ভুল করে ফেলেন। খুব প্রয়োজনীয় বিষয়াদি ভুলে যান। তার সঙ্গে বেশ কিছুদিন থাকলে ব্যাপারটা লক্ষ করা যায়। যেমন মইনুল এই মুহূর্তে বুঝতে পারছে যে মহিতোষ তাকে চিনতে পারেননি। কিন্তু তিনি এটুকু বুঝতে পারছেন যে মইনুল তার কাছের কেউ। যে তার দেখাশোনা করে। কিন্তু তার সঙ্গে নিজের সম্পর্কটা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নন। এ কারণে নিজের কাছেই একধরনের অপরাধবোধে। ভোগেন তিনি। নিজের এই সমস্যাটা তিনি বুঝতেও পারেন। ফলে যতক্ষণ তার ভাবনা, চেতনা ঠিকঠাক কাজ করে, ততক্ষণ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন নিজের এই ভুলগুলোকে শুধরে নিতে। এখন যেমন করছেন।
মইনুল বলল, কী করতে এসেছিলেন এখানে? মনে পড়েছে?
মহিতোষ ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়লেন। নাহ। মনে পড়ছে না। আসলে হয়েছে। কী, তুমি তো জানোই, আমার ব্রেন স্ট্রোকের মতো হইছিল। তো ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু খুব খারাপ রোগ। সে একই সঙ্গে আমার শরীর আর ব্রেন, দুটারই ক্ষতি করে গেছে। দেখো না, শরীরের এক অংশ ঠিকঠাক নড়াতে পারি না? তেমনি ব্রেনেরও কিছু অংশ বোধহয় কাজ করে না। বুঝলা? তুমি কিন্তু কিছু মনে করো না বাবা।
মইনুল কিছু মনে করল না। বিষয়টা সে জানে। কিন্তু মানুষটা যখন তার এই অক্ষমতা বুঝতে পেরে সেটা পুষিয়ে দেয়ার জন্য সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেন, তখন তার খুব মায়া লাগে। সে বলে, এখন চলেন তাহলে?
“কোথায়?
‘কোথায় আবার? বাসায়?
মহিতোষ চট করে কোনো উত্তর দেন না। সম্ভবত মইনুলের কথা বুঝতে পারছেন না তিনি। এমনও হতে পারে যে মইনুলের পরিচয় কী, সেটিও ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারছেন না। ফলে আন্দাজে কথা বলার চেষ্টা করছেন। অনুমান করার চেষ্টা করছেন যে মইনুলের সঙ্গে তার কোনো একটা সম্পর্ক রয়েছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। চলো। বাসায় চলো।’ মহিতোষ তটস্থ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। তার ডানপাশে বেঞ্চিতে একটা ক্র্যাচ রাখা। তিনি সেই ক্র্যাচ নিতে ভুলে গেছেন। মইনুল সেটি তুলে মহিতোষকে ধরতে সাহায্য করল। তারপর বলল, আপনি কি কোনো পোস্ট অফিস খুঁজছিলেন? বা পোস্ট বক্স?
মহিতোষ চমকে উঠলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই তো মনে পড়েছে। তুমি কী করে বুঝলে?
মইনুল জবাব দিল না। মহিতোষ বললেন, “দেখেছো, এই ব্রেন স্ট্রোকটা আমার কী অবস্থা করেছে! ঘর থেকে বের হয়েছি চিঠি পাঠাব বলে, কিন্তু তারপর গেছি ভুলে। সেই সকাল থেকে এখানে বসে বসে মনে করার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না।’
‘কোথায় চিঠি পাঠাবেন?
মহিতোষ এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তিনি সন্ত্রস্ত গলায় বললেন, আচ্ছা বাবা, একটা কথা বলো তো…।’
কী কথা?
মহিতোষ সাত-পাঁচ নানা কিছু ভেবে শেষে দ্বিধাজড়িত গলায় বললেন, তুমি কী করে বুঝলে যে আমি চিঠি পাঠানোর জন্য এখানে এসেছি? আমি কি তোমার ড্রয়ার থেকে খাম নিয়ে এসেছি?’
“হুম, তা এনেছেন। তবে সেটার জন্য না। ওই যে, আপনার পাশেই বেঞ্চিতে চিঠিটা পড়ে আছে।’
মহিতোষ সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে চিঠিটা তুলে নিলেন। তারপর বললেন, ‘আশপাশে কোথাও পোস্ট বক্স আছে?
‘আছে। ওই যে, ওইখানে গেটের কাছেই একটা পোেস্ট বক্স আছে।’
চলো। চলো। তাহলে ওখানেই চিঠিটা ছেড়ে আসি। আচ্ছা, রেজিস্ট্রি করে পাঠালে আরো তাড়াতাড়ি যেত না চিঠি? তাহলে মিস হওয়ার সম্ভাবনাও তো কম। থাকে তাই না?
মইনুল কথা বলল না। সে মহিতোষকে নিয়ে পোস্ট বক্সের কাছে গেল। মহিতোষ খুব যত্ন করে বাক্সে চিঠি ফেললেন। ফেলার আগে দু হাত জড় করে বিড়বিড় করে কী যেন পড়লেন। তারপর বললেন, চলো চলো। পরের চিঠিটা কিন্তু রেজিস্ট্রি করে পাঠাব, বুঝলা? আমার তো কিছু মনে থাকে না। পথ-ঘাটও ভুলে যাই। তুমি কিন্তু আমাকে একদিন পোস্ট অফিসে নিয়ে যাবা? বুঝলা বাবা?
‘জি।
বাসায় ফিরে মহিতোষ ঘুমালেন। তার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। কিছু খেয়ে জানালার পাশে দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। এই সময়টা খুব অদ্ভুত। চোখের সামনে কত কত কথা, দৃশ্য, ছবি, গল্প আসে আর যায়। সমস্যা আছে সেসব তিনি ধরতে পারেন না। আগে পারতেন। কোনো একটা নির্দিষ্ট ঘটনা বা দৃশ্য দেখে তিনি সেই সময়টার কথা বিস্তারিত মনে করতে পারতেন। কিন্তু এখন আর পারেন না। এখন কেবল খুব দ্রুতগতির ট্রেনের মতো স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে চলে যায়। তিনি অনেক চেষ্টা করেও সেগুলোকে আলাদা করে ধরে রাখতে পারেন না। বুঝতে পারেন না ট্রেনের কম্পার্টমেন্টগুলোর আলাদা নাম বা নম্বর। সেগুলো তার কাছে কেবল প্রবল বেগে ছুটে চলা ধূসর ট্রেন আর তার দুর্বোধ্য শব্দ হয়েই থাকে।
তবে কিছু বিষয় যে এমন দ্রুত, এমন গতিশীল হয়ে যেতে পারে, এটা তিনি মেনে নিতে পারেন না। এই যেমন পারুর কথা, মায়ের কথা। অঞ্জলি আর চারুর কথা। এমনকি অরবিন্দু মেসোর কথাও। বেশ কিছুদিন আগে অরবিন্দু মেসোর ঠিকানা থেকে একটা চিঠি এসেছিল। পাঠিয়েছে তাঁর ছেলে। সেই চিঠি পড়ে তিনি বুঝেছিলেন, কেন এতদিন তার কোনো চিঠিরই উত্তরই অরবিন্দু মেসো পাঠাননি। তিনি মারা গেছেন। আর তাঁকে পাঠানো চিঠি তার বাড়ির মানুষের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছায়নি। বা পৌঁছালেও তারা সেসব খুলেও দেখেনি। কিংবা উত্তর দেয়ার। প্রয়োজন বোধ করেনি। অরবিন্দু মেসোর মৃত্যুর খবর শুনে থ হয়েছিলেন মহিতোষ। মানুষটা আর নেই! ওই মমতায় থইথই মানুষটা! বুকের ভেতর তীব্র একটা চিনচিনে ব্যথা তাকে যেন আড়ষ্ট করে রাখল কয়েকটা দিন। তবে সেই চিঠিতে একটা স্বস্তির খবরও ছিল। অঞ্জলিরা তার অপেক্ষায় থেকে থেকে অবশেষে সীমানা পেরিয়েছে। কে জানে, কলকাতায় তারা কেমন আছে? নিশ্চয়ই ভয়ানক দুশ্চিন্তার জীবন কাটাচ্ছে তারাও! পারু আর তার অপেক্ষায় প্রতিটি প্রহর কাটছে অপরিসীম যন্ত্রণায়। তারপরও খানিক নিশ্চিন্ত বোধ করেন মহিতোষ। অন্তত নিজের পরিবারের মানুষের কাছে তো তারা আছে!
রাতে তিনি মইনুলের কাছে এলেন। তারপর বললেন, আমাকে কি তুমি আরো একটা খাম দেবে বাবা?
মইনুল তার টেবিলের দেরাজ থেকে একটা সরকারি হলদেটে খাম বের করে দিল। মহিতোষ আরো একখানা চিঠি লিখেছেন। তিনি সেই চিঠিখানা যত্ন করে ভাঁজ করে খামে ঢোকালেন। তারপর জিভ দিয়ে ভিজিয়ে খামের আঠায় মুখ বন্ধ করলেন। মইনুল বলল, “এখন অবধি কতগুলো চিঠি ছেড়েছেন আপনি?
এই কথায় মহিতোষ যেন আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। তিনি থতমত খাওয়া ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো বাবা?”
না। রাগ করব কেন?
‘এই যে তোমার কাছ থেকে যখন-তখন বলে, না বলে কত খাম নেই!
‘উঁহু, রাগ করিনি। কিন্তু এত খাম দিয়ে আপনি কী করেন? এত চিঠিই বা আপনি কাকে লেখেন?
মহিতোষ এই প্রশ্নের জবাব দেন না। চুপচাপ বসে থাকেন। হঠাৎ ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়। মইনুল মোমবাতি জ্বালায়। দূরে কোথাও থেকে যেন ট্রেনের হুইসাল ভেসে আসে। মুহূর্তের জন্য মহিতোষের নিজেকে ভুবনডাঙার মানুষ বলে মনে হয়। মনে হয় এই তার ঘর। ওই যে বাইরে বারান্দা। বারান্দার বাইরে উঠান। তার ওপারে পুকুর। শিউলি ফুলের গাছ। কিন্তু মানুষ? মানুষগুলো কোথায়? তিনি তখন বিড়বিড় করে বলেন, ‘আমি তো সবাইকেই চিঠি লিখি। কিন্তু কেউ তো আমাকে
কখনো চিঠি লেখে না। কেউ না। একটা চিঠিরও কেউ উত্তর লেখে না।
মইনুল অন্ধকারেই মহিতোষের গা ঘেঁষে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। তারপর গাঢ় গলায় ডাকে, স্যার?
হুম?
‘চিঠি লিখলে তাতে তো ঠিকানা থাকতে হয়। আপনার কোনো চিঠিতেই তো ঠিকানা থাকে না স্যার।
‘ঠিকানা? মহিতোষ যেন স্বগতোক্তি করেন। যেন তিনি বুঝতে পারেন না মইনুল কী বলছে।
হুম। ঠিকানা। ঠিকানা ছাড়া যদি কেবল কারো নাম লিখে দেন, তাহলে সেই চিঠি কি কারো কাছে পৌঁছায়?
‘পৌঁছায় না?
না। এই যে আপনি এতদিন ধরে কেবল পারুর নাম লিখে ডাক বাক্সে চিঠি ফেলে আসেন, সেই চিঠি তো কারো কাছে পৌঁছায় না। ঠিকানা ছাড়া চিঠি কি কোথাও যায়?
‘ওহ! তাও তো কথা…।’ বলে চুপ করে থাকেন মহিতোষ। তারপর উঠে দাঁড়ান। তারপর দেয়ালে ভর দিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসেন বাইরে। সেখানে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ভেতর খুব ডুবে যেতে ইচ্ছে হয় তার। এই জনমে আর কখনো কারো ঠিকানা জানবেন না তিনি? কেউ জানবে না তার ঠিকানা? আচ্ছা, মানুষ মরে গেলেও তো তার ঠিকানা থাকে। কারো কারো কবরের ঠিকানা। কারো কারো চিতার ঠিকানা। প্রয়াণ ও প্রস্থানের ঠিকানা। কিন্তু তার? তার তো কোনো ঠিকানা নেই। না জীবনের, না মৃত্যুর। তাহলে এ কেমন জীবন তার? এ কেমন। মানুষ তিনি?
মহিতোষের বিছানার ওপর পড়ে থাকে তার লেখা চিঠির মুখবন্ধ খামখানা। মোমের মৃদু আলোয় সেই খামখানাকে কেমন অদ্ভুত দেখায়। যেন ওই ঠিকানাবিহীন খামটা এক টুকরো ঝরে পড়া হলুদ পাতা। পাতাটা মৃত, ফ্যাকাসে, প্রাণহীন। ঠিক মহিতোষের মতোই। ওই যে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়। তার সামনে সীমাহীন অন্ধকার। কিন্তু পিঠজুড়ে মোমের বিবর্ণ আলো। ওই আলোটুকু যেন তাকেও বিছানায় পড়ে থাকা ঠিকানাবিহীন ওই খামটার মতোই নির্বাক, অর্থহীন, নিষ্প্রাণ করে রাখে। অথচ বুকে জমে থাকে এক সমুদ্র অনুভব, আক্ষেপ আর যন্ত্রণার কথকতা।
৩৬
কামাল বসে আছে চেয়ারে। তবে সে পা তুলে রেখেছে টেবিলে। তার মুখ গম্ভীর। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, একবার গেছিলাম মোড়লগঞ্জ। মোড়লগঞ্জ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের নাম ছিল শশিভূষণ ধর। মস্তবড় দাবা খেলোয়াড়। তো তার সঙ্গে কলিকাতা থেকে দাবা খেলতে আসছে তার স্ত্রীর বড় ভাই। তিনিও বিখ্যাত দাবাড়। খেলায় দশ মিনিটের মধ্যে শশিভূষণের মন্ত্রী ধরা। এমন কোনো মানুষ নাই যে ওই অবস্থা থেকে মন্ত্রী বাঁচায়। হয় মন্ত্রী শেষ, না হইলে রাজা। সবার মন খারাপ। গাঁয়ের এত বড় গর্ব হেরে যাবে। ঠিক এইসময় কী হইল জানস?”
কামাল কথা বলল না। সে পাথরের মূর্তির মতো স্থির বসে আছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, যখন কেউ আর তার কোনো বাঁচার আশা দেখতেছে না। নিশ্চিত পরাজয়, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি মুচকি হেসে ঘোড়া চাললেন। আরে খোদা, এমন চাল কেউ কারো বাপের জন্মেও দেখে নাই। এক সঙ্গে ওই লোকের চাইরটা পাওয়ার ধরা। মন্ত্রী, রাজাসহ। কলিকাতার বাবুর খেলা ওইখানেই শেষ। হা হা হা।
কথা শেষ করে কামালের দিকে তাকালেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি ভেবেছিলেন কামাল তার হাসিতে যোগ দেবে। কারণ শেষ কিছুদিন যেভাবে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখ থেকে দাবার খুঁটি উল্টে দিয়ে কামাল তাদের বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে, তাতে তার আনন্দিত হওয়ারই কথা। অভাবনীয় এক ঘটনা ঘটিয়েছে সে। তার মাথার ওপর ঝুলতে থাকা বিপদের খড়গটাকে স্রেফ বুদ্ধির জোরে আশরাফ খাঁর মাথার ওপর টানিয়ে দিয়েছে। বিষয়টা ভাবতেই ভারি ফুরফুরে একটা অনুভব হয় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার।
আজ আশরাফ খাঁকে পুলিশ থানায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর মহিতোষের বাড়ির ভাঙা মন্দিরের গর্ত থেকে পাওয়া রুস্তমের জামা-কাপড় তাঁকে দেখানো হয়েছে। এসব খবরই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কাছে আছে। তিনিও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন সুযোগটাকে কাজে লাগানোর। এমন সুযোগ আর এ জীবনে আসবে না। আর এসবই সম্ভব হয়েছে কামালের কারণে। রুস্তমের ঘটনায় যখন তিনি দিশেহারা। যখন ওই বিপদ থেকে মুক্তির আর কোনো উপায় আছে বলে মনে হয়নি। ঠিক তখুনি কামাল যেন তার তূণ থেকে একের পর এক তীর বের করতে লাগল। সেই তীরের আঘাতে আশরাফ খাঁ এখন ধরাশায়ী প্রায়। এই আনন্দ তিনি লুকাবেন কী করে!
সমস্যা হচ্ছে, তার এই আনন্দে কামাল যোগ দিচ্ছে না। বরং সে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, ‘এ কামাল। কী হইছে তোর? এখন কি আর এমন গম্ভীর হইয়া বইসা থাকনের সময়? এখন হইল আনন্দ করনের সময়।’
কামাল তার পা জোড়া টেবিলের ওপর থেকে নামাল। তারপর বলল, একটা বিপদ ঘটে গেছে দুলাভাই।’
কী বিপদ?’ আঁতকে ওঠা গলায় জিজ্ঞেস করলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।
‘আমরা যে রুস্তমরে খুন করছি। খুন করে তার লাশ ডুবাই দিছি ভূবনডাঙার পানিতে, এইটা একজন দেখছে।’
কী!’ যেন চিৎকার বেরিয়ে এলো জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মুখ থেকে।
হুম। গম্ভীর গলায় বলল কামাল। শুধু তা-ই না, আমরা জানিও না যে সেই লোকটা কে! শুধু এইটুক জানি, সে আমাদের সবাইরে দেখছে।
‘এই কথা তুই আমারে এতদিন বলস নাই কেন?
কারণ আপনারে আরো দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাই নাই। আমরা এতদিন চেষ্টা করছি লোকটারে খুঁজে বের করতে। কিন্তু পারি নাই। আর পারি নাই বলেই শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলাম।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যেন ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। গত কয়েকটা দিন তিনি আনন্দে হাওয়ায় ভাসছিলেন। মনে হচ্ছিল, অবশেষে তার দুর্দিন বুঝি। ফুরাল। ওই তো জেগে উঠেছে সুদিনের সূর্য। তার সেই সুদিনের সূর্য হলো কামাল। তার বুদ্ধিতেই যা করার করেছেন তিনি। এমনকি পুলিশের মনে উল্টো সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে ভাঙা মন্দিরের সেই গর্তে রুস্তমের জামা কাপড় রেখে আসা পর্যন্ত। কিন্তু শেষ অবধি কামাল তাকে এ কী খবর শোনাল?
কামাল ঘটনা খুলে বলল। তারপর খানিক সময় নিয়ে বলল, এই কথাটা আপনারে আরো আগেই বলা উচিত ছিল। কিন্তু আপনি এমনিতেই এত দুশ্চিন্তা করেন যে আরো দুশ্চিন্তা দিতে ইচ্ছা হয় নাই। ভাবছি যদি আমরাই সমস্যাটার সমাধান করতে পারি। বা অন্য কোনো উপায় বের করতে পারি।’
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কথা বললেন না। ঘরের পরিবেশটা মুহূর্তেই যেন থমথমে হয়ে গেল। কামাল বলল, ‘ওই দিন সন্ধ্যার ওই ঘটনার কারণেই আমি খুব চিন্তিত হয়ে গেছিলাম। তবে এতে একটা ভালো ব্যাপারও হইছে।
ভালো কী ব্যাপার?
‘ওই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই আশরাফ খাঁরে ফাঁসানোর এই সব বুদ্ধি মাথায় আসছে। আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকলে মরণ কামড়ই দিতে হয়। আমি সেই চেষ্টাই করছি। বাকি দেখা যাক ভাগ্যে কী আছে!’
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কথা বললেন না। দীর্ঘসময় চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘লোকটা কে আছিল, কিচ্ছু বোঝস নাই?
‘নাহ। তখন অন্ধকার হয়ে গেছিল। তা ছাড়া সে আমাদের থেকে বেশ দূরে ছিল। দৌড়ে হঠাৎ পানিতে পড়ল। প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত খুঁজলাম আমরা। কিন্তু…।’ কথা শেষ না করেই থামল কামাল। তারপর আবার বলল, ‘তবে, আমার মনে হয় না, ওই লোক কারো কাছে কিছু মুখ খুলব না। যদি খুলতই, তাহলে এর মধ্যেই খুলত। এতদিনেও যেহেতু কিছু হয় নাই। আমার ধারণা সামনেও কিছু হবে না। তা ছাড়া জানের মায়াতো সবারই আছে।
‘তারে যদি না-ই চিনস, তাইলে আর জানের মায়ার প্রশ্ন আসে কীভাবে? সে যদি পুলিশের কাছে গিয়া গোপনে সাক্ষী দেয়?
‘সাক্ষী দিলেই হয়ে গেল? প্রমাণ লাগবে না? তার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?
এই কথায় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যেন খানিক আশ্বস্ত হলেন। তবে অস্বস্তিটা পুরোপুরি কাটাতে পারলেন না। তার মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা কু-ডাক। ডেকে যাচ্ছে। তিনি বললেন, কিন্তু সারাক্ষণ একটা টেনশন না? কখন কে কাকে কী বলে ফেলল, এই টেনশন নিয়া থাকা যায়?
‘এইজন্যই তো আমরা বোঝার চেষ্টা করছি, লোকটা কে!
‘কিন্তু বুঝবি কীভাবে?
এই প্রশ্নে এসে কামাল প্রতিবারই থমকে যায়। লোকটাকে খুঁজে পাওয়ার আসলে কোনো উপায়ই নেই। এ কদিনে তারা বেশ কবার ওই জায়গাটাতে গিয়েছে। কিন্তু ঘাস-লতাপাতায় ছাওয়া অত বড় জায়গাজুড়ে এমন কিছুই তারা পায়নি যে তা দিয়ে লোকটাকে শনাক্ত করা যাবে। এখন বিষয়টা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এমনও তো হতে পারে যে লোকটা তাদের কাউকে চেনেওনি। এমনিতেই তখন অন্ধকার ছিল। তা ছাড়া প্রাণভয়ে ভীত হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছিল সে। ফলে তার পক্ষেও তো চট করে কাউকে চেনার কথা নয়। মূলত এই যুক্তিটুকুর ওপর ভর করেই কামাল নিজেকে আশ্বস্ত করতে চাইছে। কিন্তু সেটি পুরোপুরি পারছে বলে তার নিজেরই মনে হচ্ছে না।
তবে পরদিন রাতে একটা ঘটনা ঘটল। দেলু ছুটতে ছুটতে কামালের সামনে হাজির হলো। কামাল বলল, কী হয়েছে দেলু? এই অবস্থা কেন?
‘দেলু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, একটা ঘটনা ঘইটা গেছে।
কী ঘটনা?
‘ওই জায়গায় আমি একটা জিনিস পাইছি।’
‘কোন জায়গায়?
‘যেইখানে সেইদিন রাইতে ওই লোকটারে আমরা ধাওয়া দিছিলাম। কিন্তু ধরতে পারি নাই।
কামাল শুয়েছিল বিছানায়। সে চট করে শোয়া থেকে উঠে বসল। তারপর বলল, মানে কী! কী পাইছিস?
দেলু তার হাতখানা কামালের সামনে নিয়ে এলো। তার হাতে একখানা প্রায় নতুন কিন্তু ছেঁড়া স্যান্ডেল। সে সেই স্যান্ডেলখানা দেখিয়ে বলল, আমি আইজ সন্ধ্যায়ও ওইখানে গেছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা কাটা গাছ আড়াআড়ি মাটিতে পইড়া আছে। সেই গাছের নিচে ঢুইকা আছে এই স্যান্ডেলখান। আরেকখান অবশ্য পাই নাই। লোকটা যখন নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়া পড়ছে, তখনই মনে হয় পানিতে ভাইসা গেছে। আর এইখান আটকাই ছিল গাছের নিচে।
“ওহ! হতাশ ভঙ্গিতে বলল কামাল। তারপর স্যান্ডেলখানা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল সে। দেলু বলল, এইটা কি কোনো কাজে লাগবে?
কামাল স্যান্ডেলখানা তার ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে দিতে দিতে বলল, এই স্যান্ডেল দিয়ে আমি কী করব দেলু? এই স্যান্ডেল যদি ওই লোকের হয়েও থাকে, তা সেইটা কি কোনোভাবেই বোঝা সম্ভব যে কে এই স্যান্ডেল পায়ে দিত?
না…। তা তো সম্ভব না। মানুষ কি মানুষের পায়ের দিকে তাকাই থাকে?
‘থাকলেও কী? তোমারে যদি আমি বলি যে আজ থেকে এই গাঁয়ের সবাইর পায়ের দিকে সারাক্ষণ তাকাই থাকবা। আর দেখবা, কে কোন স্যান্ডেল পায় দেয়। পরে জিজ্ঞেস করলে তুমি বলতে পারবা?
দেলু মাথা চুলকাল। তারপর হাল ছেড়ে দেয়া ভঙ্গিতে বলল, না। সেইটা তো আর সম্ভব না। এই জিনিস কি আর মনে রাখা সম্ভব?
হুম। সম্ভব না।
দেলু চলে গেলে প্রচণ্ড বিরক্ত লাগতে লাগল কামালের। সে কিছুতেই এই দমবন্ধ পরিস্থিতিটা মেনে নিতে পারছে না। কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই একটা উপায় আছে, যে উপায়টা তাকে খানিকটা হলেও বিরাম দেবে। একটু শান্তিতে ঘুমানোর অবকাশ দেবে। কিন্তু যে জীবন সে বেছে নিয়েছে, সে জীবনে যেন কোনো বিশ্রাম নেই। বিরাম নেই। নিশ্চিন্ত নিঃশ্বাস নেই। সারা রাত জেগে রইল সে। তবে শেষ রাতের দিকে আচমকা বিছানা ছেড়ে জেগে উঠল কামাল। তারপর ঘুম থেকে ডেকে ওঠাল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে। বলল, দুলাভাই, একটা কাজ করতে হবে।’
কাঁচা ঘুম ভেঙে জেগে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, ‘কী?’
রুস্তমের বউর সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে।’
‘রুস্তমের বউ?’
হুম।
দু হাতে চোখ ডলে এবার উঠে বসলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি তাঁর শ্যালককে খুব ভালো করেই চেনেন। মেয়ে মানুষের প্রতি এর ভয়ানক দুর্বলতা। এই মুহূর্তে সে যদি আবার রুস্তমের স্ত্রীর দিকে নজর দেয়, তবে তা মোটেই ভালো কিছু হবে না। তিনি কাশি দিয়ে গলার শ্লেষ্ম পরিষ্কার করতে করতে বললেন, ‘ঘটনা কী কামাল? তোর মতলব কী?’
মতলব বলতেছি। তার আগে বলেন, ওই মেয়ে কী করে? একবার শুনছিলাম, সেও মাঝেমধ্যে আশরাফ খাঁর বাড়িতে কাজ করে?
হুম।
তার সঙ্গে আমার কথা বলার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন না?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া মন দিয়ে কামালের পরিকল্পনা শুনলেন। শুনতে শুনতে তার মুখ আকৰ্ণবিস্তৃত হাসিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি বিগলিত গলায় বললেন, আমি কালই ব্যবস্থা করতেছি। তুই মানুষ না রে কামাল, তুই একটা…।’
ইবলিশ! হা হা হা।’ বলে হাসতে লাগল কামাল। সে জানে, তার সামনে এখন সবচেয়ে বড় সুযোগ হলো আশরাফ খাঁকে পুরোপুরি ধসিয়ে দেয়া। সে যদি এই কাজটি ঠিকঠাক করতে পারে, তাহলে আর চিন্তা নেই। বাকি বিষয়টা কোনো না কোনোভাবে সামলে নেয়া যাবে। তার আগে আসল কাজটাই করতে চায় সে। উত্তেজনায় বাকি রাতটুকুও ঘুম হলো না কামালের। যেভাবেই হোক রুস্তমের বউকে টোপটা গেলাতেই হবে। যদি সে গেলে, তবে এই টোপের কারণেই ঘটনা পুরোপুরি হেলে পড়বে তাদের দিকে।
.
আশরাফ খাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল বুধবার রাতে। এই গ্রেপ্তারের পেছনে অদ্ভুত এক ঘটনা আছে। রুস্তমের স্ত্রী আছিয়া হঠাৎ সোমবার দুপুরে থানায় এলো। স্বামীকে হারিয়ে সে পাগলপ্রায়। পুলিশ এর আগেও তাকে এটা-সেটা নানা কিছু জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু সে বেশি কিছু জানে না। ফলে তার কাছ থেকে আশানুরূপ তথ্যও পায়নি পুলিশ। কিন্তু আজ থানায় এসে সে পুলিশকে চমকে যাওয়ার মতো এক তথ্য দিল। ওসি কাইয়ুম হোসেন বললেন, “এই কথা আপনি আগে বলেননি কেন?
‘ভয়ে।
কার ভয়ে?
‘আশরাফ খাঁর ভয়ে।’
ঘটনা আবার খুলে বলেন।
আছিয়া ঘটনা একবার বলেছে। কিন্তু ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারেনি। ফলে সে এবার নিজের কথাগুলো গুছিয়ে নিল। তারপর বলল, একদিন রাইতে উনি বাড়ি আসলেন।
“উনি মানে কী? রুস্তম?
‘জি।
তারপর?
‘দেখি ওনার চোখে-মুখে ভয়। আমি বললাম, কী হইছে? উনি সহজে বলতেই চাইলেন না। শেষ পর্যন্ত অনেক পীড়াপীড়ির পর ঘটনা বললেন।
কী ঘটনা?
মহিতোষ মাস্টারের যে বাড়ি কিনছেন আশরাফ খাঁ। সেই বাড়ির পেছনে একখান ভাঙা মন্দির আছে। ওই মন্দির খুঁড়তে গিয়া একটা কলসি পাইছিল সে। সেই কলসিভর্তি অনেক সোনার গয়না। বালা, বিছা, বাজু। সে তো সহজ-সরল মানুষ। সরাসরি গিয়া ঘটনা কইছে আশরাফ খাঁর কাছে। তার কয়দিন পর থেকেই সে উধাও। আবার সেই কলসির গর্তের মধ্যেই তার জামা কাপড় পাওয়া গেল। বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল আছিয়া। ঘটনা শুনে কাইয়ুম হোসেন চুপ করে গেলেন। অন্তত এতদিনে রুস্তমের অন্তর্ধানের ঘটনার একটা যুক্তিসংগত কার্যকারণ পাওয়া গেল। কিন্তু আশরাফ খাঁর মতো মান্যগণ্য লোককে কোনো প্রমাণ ছাড়া গ্রেপ্তার করা যায় না।
ফলে পরদিন রাতেই তার বাড়িতে আবারও তল্লাশি চালানো হলো। পুলিশের উদ্দেশ্য ছিল প্রমাণ সংগ্রহ। তা তাদের উদ্দেশ্য সফলও হলো। আশরাফ খাঁর বিছানার নিচে পাওয়া গেল বহু পুরনো আমলের একখানা বালা। এই বালা প্রচলিত কোনো সোনার গহনা নয়। বরং এত মোটা আর এই ধরনের অলংকরণ আজকাল দেখাই যায় না। ফলে ওসি কাইয়ুম সেই বালা নিয়ে গেলেন সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পরীক্ষাগারে।
সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রমাণ হলো যে এটি সাধারণ কোনো সোনার বালা নয়। বরং এর ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। আশরাফ খাঁ নিশ্চয়ই কোনো গুপ্তধন পেয়েছেন।
গুপ্তধন পেলে প্রথমেই তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হয়। এবং ওই সম্পত্তিতে পূর্বপুরুষের মালিকানা, বিক্রি, হস্তান্তর, উত্তরাধিকার আইনসহ নানা তথ্য-প্রমাণ পেশ করতে হয়। এই সব প্রমাণের ভিত্তিতে প্রচলিত আইন সিদ্ধান্ত নেয় যে ওই সম্পত্তির মালিকানা কী হবে! প্রক্রিয়াগুলো জটিল ও আইননানুগ। পুলিশের ধারণা, সম্ভবত এসব কারণেই আশরাফ খাঁ সে পথে যাননি। বরং কাউকে কিছু না জানিয়ে পুরো বিষয়টিই লুকিয়ে রেখেছেন তিনি। আর খুন করে গুম করে ফেলেছেন রুস্তমকে। কারণ এই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিল সে।
পুলিশ মোটামুটি এমন একটি দৃশ্যকল্প তৈরি করল। বিষয়টি নিয়ে পত্রপত্রিকায়ও লেখালেখি হলো। যেহেতু এই ধরনের ঘটনা জনমনে ভীষণ চাঞ্চল্য তৈরি করে। ফলে পত্রিকাগুলোও এই সংবাদ লুফে নিল।
আশরাফ খাঁর বড় ছেলে শফি অবশ্য নানাভাবে চেষ্টা করল তার বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। কিন্তু ঘটনা তখন অন্যদিকে মোড় নিল। ওসি কাইয়ুম হোসেন তাকে ডেকে বললেন, আপনাকে একটা কথা বলি শফি সাব?’।
‘জি?
আপনার বাবা একা কিন্তু এত বড় ঘটনা ঘটান নাই। এটা তাঁর একার পক্ষে সম্ভবও না। নিশ্চয়ই এর সঙ্গে আরো কেউ জড়িত আছে। আর সেই আরো কেউটা কিন্তু সবার আগে হতে পারেন আপনিই। কি পারেন না?
শফি কথা বলল না। সে ওসির ইঙ্গিত বুঝতে পারছে। ওসি বললেন, কিন্তু আমরা এখুনি আপনাকে গ্রেপ্তার করছি না। আগে আপনার বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। দেখি উনি কী তথ্য দেন। তারপর বাকি ব্যবস্থা।
শফি আর কিছু বলল না। তবে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে বড় কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার তার বাবা। কিন্তু এর থেকে মুক্তির কোনো উপায়ও তার জানা নেই। সে নম্র, ভদ্র মানুষ। কারো সাতে-পাঁচে নেই। কিন্তু এই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করবে কে?
শফি অবশ্য বিপদ থেকে উদ্ধার পেল না। বরং এই মামলা আরো ঘনীভূত হলো। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আশরাফ খাঁকে স্থানান্তরিত করে নিয়ে যাওয়া হলো ঢাকায়। সেখানেই তাঁর মামলা চলবে। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থ, বয়স্ক আশরাফ খাঁ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
৩৭
মহিতোষ বসেছিলেন বারান্দায়। বাইরের ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। তার মন খানিকটা খারাপ। মইনুল বলার পর থেকে তিনি আর চিঠি পাঠাতে যাননি। বরং নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছে। মনে হচ্ছে, আসলে কী ভেবে এতগুলো দিন ঠিকানাবিহীন চিঠি পাঠিয়েছিলেন পারুকে? তার মাথা কি কাজ করছে না? নাকি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছেন তিনি?
যতক্ষণ সুস্থভাবে চিন্তা করতে পারেন, ততক্ষণ কতকিছু মনে হয়। তবে সেই মনে হওয়াটা পুরোপুরি যন্ত্রণাদায়ক। তিনি একভাবে তার জীবনের চূড়ান্ত পরিণতি মেনে নিয়েছেন। দিনশেষে হিসেব-নিকেশের যে বাটখাড়ায় মানুষ জীবনটাকে মাপে, তাতে নিক্তিটাকে সবসময় নিজের দিকেই দেখতে চায়। আর সে কারণেই প্রাপ্তির চেয়ে আক্ষেপের পাল্লাটাই ভারি থাকে বেশি। মহিতোষ সম্ভবত এই একটা জায়গায় এসে তার জীবনটাকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আর পেরেছেন নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করতে যে, এই জীবনে তার প্রাপ্তির পাল্লা ফুরিয়েছে। এখন কেবল অপ্রাপ্তি আর অপূর্ণতার গল্প। আর কখনোই তিনি পারুকে দেখতে পাবেন না। শুধু পারুই নয়, তার পরিবারের কাউকেও না। এটি অবশ্য একদিক দিয়ে ভালো। মানুষ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন, রুঢ় বাস্তবতাকেও স্বাভাবিক বলে ভাবতে শুরু করে। নিজের জীবনের অভাবনীয় সব দুর্ভাগ্যকেই অমোঘ-অনিবার্য নিয়তি হিসেবে মনে করে ও মেনে নিতে থাকে, তখন তার অপ্রাপ্তি ও আক্ষেপ, কষ্ট ও ক্লেশের অনুভূতি কিছুটা হলেও লাঘব হয়ে যায়।
মহিতোষের ধারণা, তার ক্ষেত্রেও তেমন কিছুই ঘটছে। আজকাল ভয়ংকর অপ্রাপ্তি, যন্ত্রণা, আক্ষেপ এসবই স্বাভাবিক বলে ধরে নেন তিনি। এমনকি, এর অন্যথা হলেই বরং অবাক হন। বিচলিত বোধ করেন। তখন মনে হতে থাকে, হঠাৎ এমন কেন হলো?
আজও তেমন হচ্ছিল। ভোরের দিকে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে। মইনুল তাকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠাল। তিনি ঘুম ঘুম চোখে বললেন, কী হয়েছে?
‘আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে। আপনি কি দয়া করে দরজাটা বন্ধ করে দেবেন?
মহিতোষ বললেন, আচ্ছা।
মইনুল চলে গেলেও তিনি অবশ্য উঠলেন না। যেমন ছিলেন, তেমন শুয়েই রইলেন। তারপর বেশ খানিকটা সময় চলে গেল। তখন ঘড়িতে কটা বাজে মহিতোষ জানেন না। তবে আকাশ মেঘলা বলে চারপাশটা কেমন অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ঘরের ভেতরটা আরো ঘনিভূত হয়ে আছে। দরজায় শব্দটা শুনতে পেলেন তখুনি। কেউ একজন কড়া নাড়ছে। কিন্তু মহিতোষের মোটেই বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। লোকটা চাইলেই ভেজানো দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে পারে। কিন্তু সে তেমন কিছু করছে না। বরং এক নাগাড়ে দরজায় কড়া নেড়ে যাচ্ছে। অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠতে হলো মহিতোষকে। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তিনি দরজা খুললেন। দেখলেন কাজের মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। সে দাঁত কেলিয়ে বলল, “আপনে ঘুমাইতেছিলেন?
মহিতোষ জবাব দিলেন না। কেউ যদি কাউকে গভীর ঘুম থেকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করে, আপনি ঘুমাচ্ছিলেন? তখন আর বলার কিছু থাকে না। তিনিও কিছু বললেন না। চুপচাপ বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন। সমস্যা হচ্ছে, ঘুমের মধ্যেই তিনি টের পেলেন আবারও কেউ দরজায় নক করছে। মহিতোষ অবশ্য এবার আর উঠলেন না। এমনকি চোখ মেলে তাকালেনও না। কাজের মেয়েটি নিশ্চয়ই দরজা খুলে দেবে। তা সে দিলোও। তবে তার আগে বেশ খানিকটা সময় নষ্ট করল। বাইরের আগন্তুক মানুষটি ততক্ষণে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। এ বাড়িতে ওই এক কাজের লোক আর মইনুল ছাড়া তেমন কেউ একটা আসে না। তাহলে এই অসময়ে আবার কে এলো? প্রশ্নটা মাথায় এলেও কোনো কৌতূহল বোধ করলেন না। মহিতোষ। তিনি আবারও খানিক ঘুমিয়ে নিতে চান।
কিন্তু ঘুম আর হলো না তাঁর। বন্ধ চোখের ওপার থেকেই তাঁর মনে হলো কেউ একজন যেন তার বিছানার দিকে এগিয়ে আসছে। তারপর সন্তর্পণে, খুব সাবধানী পা ফেলে এসে দাঁড়াল তার পাশে। মহিতোষের চকিতে একবার মনে হলো কী যেন একটা চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে বাতাসটা তিনি টেনে নিচ্ছেন বুকের ভেতর, সেই বাতাসেও যেন ওই ধরতে না পারা অনুভবটা ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষটা তার বিছানার পাশে বসল। আর সঙ্গে সঙ্গেই মহিতোষের মনে হলো একটা স্নিগ্ধ, শীতল সুবাস যেন চারপাশের হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে। এই গন্ধটা তার চেনা। তিনি চট করে চোখ মেলে তাকালেন। আবছা অন্ধকারে তিনি মানুষটাকে দেখলেন। মশারির গা ঘেঁষে ওপাশে বসে আছে। একটা মেয়ের ছায়ামূর্তি। মেয়েটার পরনে শাড়ি। জানালার চৌকাঠের পটভূমিকায় ভেসে উঠেছে তার আবছায়া মুখ। লম্বা বাঁশির মতো নাক। চিবুকের আদল। শীর্ণ গ্রীবা। খোঁপা করা চুল। আর তার গায়ের সেই গন্ধ। এই গন্ধ, ওই ছবি, ওই আদল সবই মহিতোষের চেনা। তিনি চট করে উঠে বসলেন, ‘পারু!
পারু এখানে? পারু?
মহিতোষ জানেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন। কিংবা এ তার বিভ্রমাত্মক মন ও মগজের খেলা। তারপরও তিনি উঠে বসলেন। তারপর হাত বাড়ালেন মশারির দিকে। মেয়েটা অকস্মাৎ তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। তারপর ডাকল, বাবা।
মহিতোষের হঠাৎ মনে হলো, পৃথিবী মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে। চারপাশে কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। ঘূর্ণন নেই। গতি ও গন্তব্য নেই। এই মহাবিশ্বের সকলই স্থির ও অনড় হয়ে আছে। পৃথিবীর সকল শব্দ থেমে আছে ওই ছোট্ট শব্দটাতে। কিন্তু তিনি জানেন, এও মিথ্যে। এইখানে কেউ বসে নেই। ওই ছবিটা তার কল্পনা। এই ঘটনাটি স্বপ্ন। তার অবচেতন মস্তিষ্ক বিভ্রম তৈরি করেছে। ওই শব্দটাও। ফলে তিনি মৃদু হাসলেন। নিজের মন ও মস্তিষ্ককে উপহাস করলেন। তার ঠোঁটের কোনায় লেগে থাকা ওই এক চিলতে হাসি যেন জানিয়ে দিল, আমাকে বিভ্রান্ত করা আর অত সহজ নয়। আমি মহিতোষ। জীবন আমাকে নিয়ে যতটা খেলেছে, যতটা যুদ্ধ ও যন্ত্রণায় পুড়িয়েছে, তাতে আমাকে ভেঙে চুরমার করে দিলেও আর কাঁদানো সম্ভব নয়। আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেললেও আর আমার যন্ত্রণা কাতর চিৎকার শোনা সম্ভব নয়। বরং আমার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা এই হাসিটুকু শত যন্ত্রণায়ও জীবনকে উপহাস করে যাবে। সব হারানো কারো আর হারানোর ভয় থাকে না। ভয় থাকে প্রাপ্তির। মহিতোষ তো সেই প্রাপ্তির প্রত্যাশাকে বিসর্জনই দিয়ে দিয়েছেন। এ জগতে তাহলে আর ভয় কীসে তার? তারপরও জীবন এমন করে বারবার তাকে ভোলাতে চায়। সর্বহারা মহিতোষকে নিঃস্ব করতে চায় বারবার। কিন্তু মহিতোষ আর হারলেন না।
তিনি তার সকল শক্তি সঞ্চয় করে, সকল মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতাকে একীভূত করে যেন জাগিয়ে তুললেন তার অবচেতন ইন্দ্ৰীয়কে। তারপর সত্যি সত্যি চোখ মেলে তাকালেন। তারপর হাত বাড়িয়ে দেখলেন, না, ওখানে কেউ বসে নেই। মশারির গা ঘেঁষে ওপাশের জায়গাটা ফাঁকা। শূন্য। ঘরের কোথাও কোনো চেনা ঘ্রাণ নেই। কোনো স্নিগ্ধ, শীতল, আপন সুবাস বয়ে বেড়াচ্ছে না। কেবল মহিতোষের ঠোঁটের কোণে ওই হাসিটুকু লেগে আছে। নিজেকে বহুকাল পর। আজ আবার তার জয়ী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওই মায়া, প্রাপ্তির মোহ কিংবা বিভ্রমের কাছে তিনি হেরে যাননি। বরং তিনি তার জীবনের অলঙ্ঘনীয় অপ্রাপ্তির পাণ্ডুলিপিটাকে মেনে নিতে পেরেছেন।
কিন্তু তারপরের সময়টা ক্রমশই হয়ে উঠতে লাগল অদ্ভুত, অসহনীয়। তিনি ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়াতেই মনে হলো গেটের বাইরে যেন কেউ একজন রিকশা থেকে নামল। আর সঙ্গে সঙ্গেই সেই চেনা, সেই স্নিগ্ধ, শীতল সুবাসটা যেন ধীরে ধীরে তার বুকে এসে বিঁধতে লাগল। কে ওখানে? কে?
পারু নয় তো?
ভাবনাটা মাথায় আসতেই নিজের ওপর চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে গেলেন মহিতোষ। এ কী করছেন তিনি? সবকিছু জেনে বুঝেও কেন নিজের মন ও মগজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এমন কেন হচ্ছে তার? খেতে বসে আচমকা মনে হলো, তার ঠিক পেছনে, ঘাড়ের কাছটাতে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ের ঘ্রাণটাও টের পাচ্ছেন তিনি। কে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে? পারু!
ঝট করে পেছনে তাকালেন মহিতোষ। সেখানে কেউ নেই। কাজের মেয়েটা রান্না করে দিয়ে চলে গেছে। তাহলে এই অসময়ে কে থাকবে এই ঘরে? কেউ না। বিরক্ত, বিক্ষুব্ধ মহিতোষ নিজেকে বিশ্রি গাল বকে উঠে গেলেন খাবার টেবিল থেকে। আজ আর কিছু খাবেনই না তিনি। এমন হলে হয়! নিজেকে এতবার এতভাবে বোঝানোর পরও প্রতিটা মুহূর্ত যদি ক্রমশই ওই প্রবল বিভ্রমের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হতে থাকে, তাহলে তার ওই চিন্তা ও চৈতন্যের ক্ষমতাটা আর কী থাকল?
তিনি থম মেরে বসে রইলেন সারাটা দিন। কিন্তু তার কেবলই মনে হতে লাগল, ঘরের ভেতর কেউ পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে। মৃদু শব্দে ডেকে যাচ্ছে, বাবা, তুমি ঘুমাবে না? দুপুর তো হয়ে এলো।
মহিতোষ যাবেন না যাবেন না করেও ঘরে ফিরে গেলেন। তিনি জানেন, ঘরে কেউ নেই। তাকে কেউ ডাকেনি। এসবই তার কষ্ট কল্পনা। তারপরও তিনি এদিক-সেদিক চোরা চোখে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। যেন কেউ বুঝতে না পারে যে তিনি কাউকে খুঁজছেন? কিন্তু কে বুঝবে? এই ঘরে তো কেউ নেই। তার মানে, তিনি আসলে মনে মনে ভাবছেন যে এখানে কেউ না কেউ থাকতেও পারে!
অসহায়, সন্দিগ্ধ মহিতোষ শুয়ে পড়লেন বিছানায়। তারপর চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। আর ঠিক তখুনি তার মনে হলো, ওই গন্ধটা বুঝি আবার ফিরে আসছে। কেউ একজন এসে বসেছে তার পাশে। তারপর মৃদু স্বরে ডাকছে, বাবা!
মহিতোষ জানেন, এমন কিছু হয়নি। ওখানে এমন কেউ নেই। তিনি তারপরও চোখ মেলে তাকালেন। এবং দেখলেন, সত্যি সত্যি কোথাও কেউ নেই। না পারু, না পারুর গায়ের ঘ্রাণ। স্মৃতির গন্ধ। শব্দ। কোথাও কেউ নেই। কিছু নেই।
তবে এই থাকা না থাকার লুকোচুরি খেলা চলতেই থাকল। একটা স্বপ্ন কিংবা কল্পনার ধোঁয়াশা সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখতে চাইল তাকে। আর তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন সেই আচ্ছন্নতার ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে। কিন্তু পুরোপুরি পারলেন না। এই যেমন মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে গেল। শরীরজুড়ে কেমন অস্বস্তি। জ্বর এলো বোধহয়। কপালটা যেন পুড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে মাথাব্যথাও। কিন্তু সেসব ছাপিয়েও একটা কোমল হাতের সস্নেহ স্পর্শ টের পেলেন তিনি। মনে হলো কেউ একজন আলগোছে তার মাথাটা কোলে টেনে নিয়েছে। তারপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চুলে, মাথায়। আর দুপুর, সন্ধ্যার সেই মায়াময় ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে তার বুকজুড়ে। মেয়েটা প্রায় ফিসফিস করে ডাকল, বাবা?
মহিতোষ জানেন এটা স্বপ্ন, এটা বিভ্রম। তারপরও তিনি সাড়া দিলেন, ‘পারু?
‘হ্যাঁ, বাবা।
‘তুই কখন এলি?
কখন এলাম মানে? আমি তো এখানেই ছিলাম।
‘এখানেই ছিলি?
হুম।
“ও’।
‘কেন, তুমি আমাকে দেখতে পাওনি?
কী জানি! পেয়েছি হয়তো।’
‘তোমার কী হয়েছে বাবা? তুমি এমন করে কথা বলছ কেন?
‘আজকাল কী যে হয়েছে, সব ভুলে যাই। এলোমেলো হয়ে যায় সব। সবকিছুই মনে হয় এই আছে, এই নেই। কী করি বল তো?
‘কিছু করতে হবে না। তুমি এভাবে আমার কোলে শুয়ে থাকো। আর আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।’
মহিতোষ কথা বললেন না। তিনি জানেন এটা সত্যি না। তারপরও তার ভালো লাগছে। লোভ হচ্ছে এই পারুর সঙ্গে আরো খানিক কথা বলতে। আরো খানিক তার সঙ্গ পেতে। এই আশ্চর্য মায়াময় আচ্ছন্নতায় ডুবে থাকতে। পারু বলল, তোমার কি কষ্ট হচ্ছে বাবা?
উঁহু।
মাথাব্যথা করছে?
‘এতক্ষণ করছিল, এখন আর করছে না।
‘আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি বলে? পারু মিষ্টি করে হাসল।
মহিতোষ এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। কারণ তিনি জানেন পারু নামের কেউ এখানে বসে নেই। তার মাথায়ও কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে না। অথচ কী
অদ্ভুত, তিনি সেই হাতের স্পর্শ পাচ্ছেন। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে তার মাথাব্যথাটা ক্রমশই উবে যাচ্ছে। পারু বলল, তোমার গায়ে তো অনেক জ্বর বাবা। মাথায় জল দিয়ে দেব?
‘জল?
হুম।
‘কিন্তু এ ঘরে তো বালতি নেই। কী করে দিবি?
‘আমার বালতি লাগবে না বাবা।
‘তাহলে?
‘আমি এমনি এমনিই দিতে পারব।’
‘এমনি এমনি কী করে?
তুমি শুয়ে থাকো। আমি হাত বাড়ালেই জল চলে আসবে।
মহিতোষের হঠাই নিজের ওপর রাগ হতে লাগল। এখন কি তবে তার কল্পনার অলীক এই সৃষ্টি তার মাথায় জলও ঢালতে শুরু করবে? তারপর কী হবে? তারপর কি তিনি ঘুম ভেঙে দেখবেন যে তার মাথা ভেজা? চুল বেয়ে টুপটাপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে! কী হচ্ছে এসব? তিনি কি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছেন?
নিজেকে এত অসহায়, এত অসাড় আর লাগেনি মহিতোষের। ভেতরে ভেতরে একটা তীব্র চাপা ক্ষোভ, একটা ভয়ানক অক্ষমতা তাকে বেপরোয়া করে তুলতে লাগল। যেন প্রচণ্ড ঢেউয়ের মতো সেই ক্ষোভ সবকিছু ভেঙেচুড়ে তছনছ করে দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তিনি ঝট করে উঠে বসলেন। চারপাশে অন্ধকার। জানালার ফাঁকে বাইরের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলো দেখা যাচ্ছে। তিনি সেই আলোটুকুর দিকে তাকিয়ে আছেন। মহিতোষের হঠাৎ কান্না পেতে লাগল। মনে হলো রাতের এই অন্ধকার, এই নিস্তব্ধতা গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনি চিৎকার করে কাঁদবেন। ভেঙে ফেলবেন তার চারপাশে যা কিছু আছে সব।
তিনি অবশ্য কাঁদলেন না। কেবল উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। তবে তাও পারলেন না। মাথা ছুঁয়ে থাকা মশারিটাকে অকস্মাৎ দু হাতে খামছে টেনে ধরে ছিঁড়ে ফেলতে লাগলেন। টুকরো টুকরো করে ফেলতে লাগলেন সর্বশক্তিতে। যেন তার সকল অক্ষমতা, আক্রোশ, অপ্রাপ্তি তিনি মিটিয়ে নিতে চাইছেন ওই অন্ধকারের ওপর, ওই জালের মতো নরম কাপড়টুকুর ওপর। যেন নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে চাইছেন এই অসীম অসহায়ত্বের ক্রোধে।
.
পরদিন ভোর হলো। দুপুর হলো। হলো বিকেলও। মহিতোষ প্রবল আতঙ্কে কাঠ হয়ে বসে রইলেন। এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলেন না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণহীন হতে দিলেন না। যেন কোনোভাবেই আর ওই হ্যালুসিনেশনের কাছে পরাস্ত হবেন না তিনি। মুহূর্তের জন্যও কেউ আর তাকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। না কোনো স্বপ্ন, না কোনো গন্ধ, কিংবা অন্যকিছু। তিনি এখন এই সব থেকে মুক্ত, স্বাধীন। নিজেই নিজের ভাবনার নিয়ন্ত্রক। এই নিয়ন্ত্রণ আর কিছুতেই হারাবেন না তিনি। সকালে মইনুল অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিল, তার কী হয়েছে?
মহিতোষ জবাব দেননি। তবে তার লাল টকটকে চোখ আর বিছানা দেখে মইনুল আর কিছু বলেনি। চুপচাপ অফিসে চলে গেছে সে। কারণ মইনুল জানত, ওসব নিয়ে কথা বলতে গেলে হয়তো অফিসের সময়টাও মাটি হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং রাতে বাসায় ফিরে যা করার করবে।
সন্ধ্যার দিকে মইনুল ফিরল। তবে মহিতোষ দরজা খুললেন না। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে মইনুলের কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। তারপরও চুপচাপ বসেই রইলেন। কারণ, মইনুলের কড়া নাড়ার শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই সেই গন্ধটা আবার আসতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে একটা মৃদু, স্নিগ্ধ সুবাস ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘরময়।
মহিতোষ প্রথমে কিছুতেই গন্ধটাকে স্বীকার করতে চাইলেন না। কয়েকবার ডানে বাঁয়ে মাথা নেড়ে যেন অগ্রাহ্য করতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। বরং সেটি ক্রমশই আরো তীব্র, আরো সর্বপ্লাবী হয়ে উঠল। মহিতোষ এবার নিজের নাক চেপে ধরলেন। তারপর মুখ। আজ আর কোনো বিভ্রমের কাছেই তিনি পরাজিত হবেন না। নিজেকে সমর্পণ করবেন না। কিন্তু দরজার শব্দটা বেড়েই চলছে। অস্থির হয়ে পড়েছে বাইরের মানুষটা। মহিতোষ শেষ অবধি উঠে গিয়ে দরজাটা খুললেন।
ঘরের মৃদু আলো খোলা দরজা দিয়ে ত্যারচাভাবে বাইরে গিয়ে পড়েছে। সেই আলোতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার পরনে শাড়ি। কাঁধে ব্যাগ। তার পেছনেও কেউ রয়েছে। সম্ভবত রিকশা বা স্কুটারওয়ালা। সে ভারী ভারী ব্যাগ এনে রাখছে বারান্দায়। মহিতোষের একবার মনে হলো মেয়েটাকে তিনি চেনেন। কোথায় যেন এর আগে দেখেছেন। আবার পরক্ষণেই মনে হলো, না চেনেন না। এটাও তার বিভ্রমই। কিংবা ওই স্বপ্ন বা কল্পনার খেলা। কিন্তু ওই খেলার কাছে তো তিনি পরাজিত হবেন না।
মহিতোষ দরজার পাল্লা দু খানা টেনে বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। এই মুহূর্তে মেয়েটা কথা বলে উঠল। বলল, আমি তরু। আমায় চিনতে পারছেন না?
তরু? মহিতোষ যেন স্বগোতোক্তি করলেন। নামটা তার চেনা চেনা লাগছে। মুখটাও। কিন্তু চট করে কেন যেন মনে করতে পারছেন না। তরু ম্লান গলায় বলল, ‘আপনি সত্যি আমায় চিনতে পারছেন না?”
মহিতোষ বুঝতে পারছেন না তার কী করা উচিত। তিনি কি দরজা থেকে সরে দাঁড়াবেন?
মেয়েটি বলল, কী হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ?
বলেই এক পা সামনে এগিয়ে মহিতোষের কপালে হাত রাখল সে। আর সঙ্গে সঙ্গেই মহিতোষের মনে হলো, তিনি মেয়েটিকে চিনতে পেরেছেন। এই মেয়েটিই তাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। থাকতে দিয়েছিল। নিজের বাবার মতো আগলে রেখেছিল। অথচ তাকেই তিনি চিনতে পারছেন না!
মেয়েটি নরম গলায় বলল, আপনি কেমন আছেন?
মহিতোষ এই প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। এর অবশ্য কারণও আছে। তিনি এতক্ষণে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে তার মাথা খারাপ হতে শুরু করেছে। ফিরে আসতে শুরু করেছে সেই বিভ্রম। না হলে মেয়েটির কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনের ওই দৃশ্যটা তিনি দেখতে পেতেন না।
মেয়েটি বলল, কী হলো? আপনি কি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না?
মহিতোষ তবুও চুপ করে রইলেন। তিনি জানেন তার সামনে কিছুই নেই। না মেয়েটি। না তার পেছনের দৃশ্যটা। এসবই মিথ্যে, মায়া। তিনি আবারও ডুবে যাচ্ছেন সেই ঘোরে। সেই বিভ্রান্তির সুতীব্র ধোয়া তাকে ক্রমশই আচ্ছন্ন করে ফেলছে। শত চেষ্টা করেও ওই আচ্ছন্নতা থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত রাখতে পারছেন না।
যদি পারতেনই তবে ওই দৃশ্যটা অন্তত দেখতে পেতেন না তিনি। কে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে? মেয়েটার পেছনে? শীর্ণ, ফ্যাকাশে, রোগা একটা মেয়ে। কে সে?
মহিতোষ কয়েকবার মাথা নাড়ালেন। চোখের পলক ফেললেন। হাতের তালুতে মাথার দু পাশ চেপে ধরলেন। তারপর খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দরজার পাল্লাটা টেনে বন্ধ করে দিলেন। নিশ্চয়ই আবারো চোখে ভুল দেখছেন তিনি। কী আশ্চর্য, সবকিছু এত জীবন্ত, এত বাস্তব! দেখে অবিকল সত্যের মতো মনে হয়। কিন্তু মহিতোষ জানেন, যে মিথ্যে সত্যের মতো, তার চেয়ে ভয়ানক কিছু আর নেই। ভাগ্যিস এবার অন্তত নিজেকে সংযত করতে পেরেছেন তিনি। প্রতিবারের মতো লোভী হয়ে ওঠেননি। তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। তারপর বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন। এবার দরজায় খিল এঁটে দিতে হবে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দরজাটা খুলে গেল। মহিতোষ যারপরনাই অবাক হলেন।
এ কী কাণ্ড! মেয়েটি বন্ধ দরজাটা অবধি খুলে ফেলল। তবে কি সত্যি সত্যিই এ তরু? কিন্তু তরু হলে তার পেছনের মেয়েটি কে? সে তো এখনো আছে। উধাও হয়ে যায়নি। তাহলে তিনি যা দেখছেন তা কি সত্য? কিন্তু সেটি কী করে হয়?
পেছনের মেয়েটা খানিক রোগা, ফ্যাকাশে, মলিন হলেও দেখতে হুবহু পারুর মতো। তবে সে কথা বলছে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেয়েটির কোলে সম্ভবত একটি শিশু। মহিতোষ চাইছেন দরজাটা আবার বন্ধ করে বেহদিতে। দু হাতের তালুতে ভালো করে চোখ রগড়ে তার চোখের সামনের এই মিথ্যে দৃশ্যটাকে মুছে ফেলতে। কিন্তু পারছেন না। তার ভেতরের লোভটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। শত চেষ্টা করেও সেটিকে তিনি দমন করতে পারছেন। মহিতোষের মনে হলো, সেই ঘ্রাণটাও আবার ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
বিরক্ত, বিহ্বল, বিচলিত মহিতোষ খানিক সরে গিয়ে তরুকে ঘরে ঢোকার জায়গা করে দিলেন। কিন্তু তার চোখ আটকে রইল পেছনের দৃশ্যটার ওপর। এক মুহূর্তের জন্যও যেন চোখের পলক ফেলতে পারলেন না তিনি। মেয়েটি এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন প্রাচীন কোনো পাথরের মূর্তি। অনড়, অবিচল। কে মেয়েটি? তার কোলের ওই শিশুটিই বা কে? অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েটিকে দেখতে পারুর মতো মনে হচ্ছে। তারচেয়েও অবাক করা ব্যাপার হলো সে অকস্মাৎ তাকে ডাকল। তবে তার সেই ডাক এত বিবর্ণ। এত মান। যেন তা শুনতেই পেলেন না মহিতোষ। মেয়েটি প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘বাবা!’
মহিতোষ কী করবেন বুঝতে পারছেন না। মেয়েটি আবার বলল, বাবা।
যেন এই একটি শব্দ সে তার বুকের গহিন কোনো কুঠুরি থেকে বহু কষ্টে, শ্রমে, চেষ্টায় খুঁড়ে বের করেছে। যেন এমন ভারী, এমন কঠিন ও ওজনদার শব্দ আর পৃথিবীতে নেই। যেন ওই শব্দের ভার সে বইতে পারছে না। মহিতোষ জানেন, এসবই তার কল্পনা। এসবই মিছে ভাবনা। তিনি ঘুরে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। তারপর শুয়ে পড়লেন বিছানায়। বালিশের পাশে রাখা কাঁথাটা টেনে মাথা মুড়িয়ে নিলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ততক্ষণে কেউ একজন তার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি মানুষটার উপস্থিতি টের পাচ্ছেন। তার সুবাস বুকের ভেতরটা ওলটপালট করে দিচ্ছে।
মহিতোষ ঝট করে কথাটা সরিয়ে দিলেন মাথার ওপর থেকে। মেয়েটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বিছানার পাশে। তার কোলের শিশুটি আর নেই। হাত দু খানা শরীরের দু পাশে ঝুলে আছে। সেই হাতের আঙুলগুলো থরথর করে কাঁপছে। মহিলোষ কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি কি হাত বাড়িয়ে মেয়েটিকে ধরবেন? নাকি ধরতে গেলেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে!
মহিতোষকে অবশ্য কিছু করতে হলো না। তার আগেই মেয়েটি ডাকল, বাবা।’
তার গলা বুজে আসছে। মহিতোষ হঠাৎ আবিষ্কার করলেন মেয়েটি কাঁদছে। তার শরীর কাঁপছে। সে দু হাতে তার মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। প্রবল ঝড়ে উপড়ে পড়ার আগে শিকড়হীন বৃক্ষ যেমন কেঁপে ওঠে। মেয়েটি তেমন করে কাঁপছে। যেন এখুনি সমূলে উপড়ে পড়বে সে। সে এবার চিৎকার করে ডাকল, বাবা, ও বাবা। বাবাগো…।’
মহিতোষ কী করবেন জানেন না। মেয়েটি যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে তার ওপর। কান্নায় তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি কি মেয়েটিকে ধরবেন? নাকি ধরতে গেলেই সে আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে। মহিতোষ হঠাৎ উঠে বসলেন। অদৃশ্য হলে হবে। তারপরও তিনি তাকে ধরবেন। মহিতোষ হাত বাড়িয়ে মেয়েটিকে ধরলেন। কী অদ্ভুত, মেয়েটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল না! উধাও হয়ে গেল না। বরং তার বুকে আছড়ে পড়ল পাড়ভাঙা ঢেউয়ের মতো। স্বপ্ন কি এমন হয়? এমন সত্যি, এমন স্পর্শময়, গভীর?
মেয়েটি হড়বড় করে বলল, বাবা, বাবা। আমি পারু বাবা। আমি পারু। ও বাবা, আমি পারু।
মহিতোষের কী হলো, কে জানে! তিনি ফাসফেঁসে গলায় বললেন, তুমি কি এখন চলে যাবে মা?
পারু অবাক চোখে তাকাল। তারপর বলল, কোথায় যাব বাবা?
‘যেখান থেকে এসেছে।’
‘কোথা থেকে এসেছি?
‘তাতো জানি না।’ মহিতোষ দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে কথাটা বললেন।
পারু বলল, তোমার কী হয়েছে বাবা?
‘আমার?
হুম।
‘আমার কী হয়েছে?
কী হয়েছে আমায় বলো? আমায় বলো বাবা। পারু যেন বাবাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে বুকের ভেতর। যেন সে শুষে নিতে চায় বাবার সকল দহন ও দুঃখ, বিষ ও বিষাদ। তার বিনিময়ে নিজের সবটুকু নিঃশেষে দান করে দিতে চায়। কিন্তু দুঃখ ছাড়া আর কি-ই বা দেয়ার আছে তার?
মহিতোষ অপ্রকৃতম্ভের মতো বিড়বিড় করে বলেন, “তুমি কি আমার সঙ্গে আরেকটু থাকবে মা?
‘আমি তোমার সঙ্গেই থাকব বাবা। আমি আর কোথাও যাব না।’
‘কোথাও যাব না?’ মহিতোষ যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। এই মেয়েটি কি সত্যি? তা কী করে হয়! নিশ্চয়ই তিনি আবারও স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু এই স্বপ্ন এত বাস্তব কেন?
মেয়েটি ভেজা গলায় বলল, আমি সারাজীবন তোমার সঙ্গে থাকব বাবা। সারাজীবন। আর এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যাব না আমি। বাবা, ও বাবা…।’
মহিতোষ কথা বললেন না। চুপ করে রইলেন। তিনি মেয়েটির শরীরের স্পর্শ টের পাচ্ছেন। তার কান্না ও কম্পন অনুভব করতে পারছেন। তারপরও সবকিছুই কেমন অপার্থিব, অবাস্তব লাগছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, কিন্তু আমার যদি ঘুম ভেঙে যায়?
‘ঘুম ভেঙে গেলে কী হবে বাবা?
‘এই স্বপ্নটা আর থাকবে না।’
‘এটা স্বপ্ন না বাবা। পারু এবার মরিয়া হয়ে উঠল। সে দু হাতে বাবার কাঁধ শক্ত করে ধরে বলল, ও বাবা, এটা স্বপ্ন না। এটা সত্যি। তুমি দেখো, এই যে আমি, আমি পারু। তুমি আমায় দেখো, এই যে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে আছি। ও বাবা, এটা সত্যি। এটা সত্যি বাবা। পারু কাঁদে। তার সেই কান্নার শব্দ মহিতোষের বুকের ভেতর কেমন অচিনপুরের রাগিণী হয়ে বাজতে থাকে। সেই সুর বড় সকরুণ। বড় ব্যথাতুর। তারপরও মহিতোষ বলেন, “আমি বোধহয় সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি মা। আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না। আমার কী যে হলো!’
কী হলো তোমার?
কী হলো, তাতো জানি না। কিন্তু তোমাকে আমার সত্যি বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তুমি সত্যি সত্যি আমার পারু…।’
পারু আতঙ্কিত গলায় বলল, আমি সত্যিই তোমার পারু বাবা। এই যে দেখো, আমাকে ধরে দেখো, আমি পারু।’ সে বাবার হাত দু খানা তার হাতের ভেতর শক্ত করে ধরে। সে বাবার গালের সঙ্গে তার গাল চেপে ধরে। তার চোখের জলে ভিজে যেতে থাকে মহিতোষের গাল। সে দু হাতে সেই গাল চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে, বাবা, আমি স্বপ্ন না বাবা। এই যে দেখো, আমি স্বপ্ন না। আমি সত্যি।
মহিতোষ জবাব দেন না। তার এত অসহায় আর এলোমেলো লাগে। মনে হয়, এসবই মিথ্যে। এসবই মোহ। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, এ তো সত্য হতেও পারে। যদি সত্যি হয়? তাহলে তিনি কী করবেন? মহিতোষ হঠাৎ ফিসফিস করে, তুমি সত্যি?
‘আমি সত্যি বাবা। এই যে দেখো। আমি তোমাকে ধরে রেখেছি দেখো।
মহিতোষ কী বলবেন জানেন না। তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। তারপরও তিনি বলেন, “তুমি বরং আর একটুখানি থাকো মা। আর একটু খানি। তারপর চলে যেও?’
‘আমি কোথায় যাব বাবা?
“তাতো জানি না।’ মহিতোষ বিড়বিড় করে বলেন।
পারু হঠাৎ মহিতোষের কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে লাগল, বাবা, ও বাবা, বাবা।
মহিতোষের তাতে বিকার হয় না। তিনি একঘেয়ে গলায় বারবার স্বগোতোক্তি করতে থাকেন, আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। তোমাকে আমার সত্যি সত্যিই পারুর মতো মনে হচ্ছে গো মা। মাগো, আমার তোমারে সত্যি সত্যি পারুর মতো মনে হচ্ছে। এমন কেন হচ্ছে গো মা? ও মা। মাগো। মহিতোষ অকস্মাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। তার সেই কান্নায় ভেসে যেতে থাকে রাতের অন্ধকার। অদেখা অনুভবের অতলস্পর্শী জীবন। পারুর চোখের জলের সঙ্গে যেন মিশে যেতে থাকে সেই জল। যেন এই জীবন ও যন্ত্রণার সবটুকু ভাসিয়ে দিতে চায় জনম দুঃখী দুই প্রাণ।
পারু শক্ত করে তার বাবাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে। যেন এক অবোধ শিশুকে তার মা পৃথিবীর সব ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে আড়াল করে দিতে চাইছে। নিয়ে যেতে চাইছে দূর কোনো পৃথিবীর দেশে। যেখানে আর কোনো দুঃখ ও দহন নেই। কষ্ট ও ক্লেদ নেই। জীবনযন্ত্রণা নেই। সেখানে কেবলি অদ্ভুত মায়াময় ঘ্রাণ আছে। আর আছে মন ও মানুষের স্পর্শ। সুবাসিত স্মৃতি। সেই স্মৃতি আশ্চর্য সম্মোহন ছড়ায় জীবনজুড়ে। মানুষ সেই সম্মোহনে ঝুঁদ হয়ে থাকে। ভেসে যেতে থাকে বুকের গহিন। মহিতোষও যেন ক্রমশই ঝুঁদ হয়ে যেতে থাকেন সেই আশ্চর্য সম্মোহনে।
এই সম্মোহন কাটানোর সাধ্য মানুষের নেই।
৩৮
খবরটা রাতারাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রুস্তমের গুম কিংবা খুনের ঘটনায় আশরাফ খাঁ গ্রেপ্তার হতে পারেন, এই কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেনি। ফলে আশরাফ খাঁ গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গাঁয়ের মানুষ সতর্ক হয়ে গেল। সতর্ক হয়ে গেল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া সম্পর্কেও। এতদিনে এসে তারা যেন বুঝতে পারল, জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আসলে এক মুহূর্তের জন্যও বদলাননি। বরং তিনি। অপেক্ষায় ছিলেন সঠিক সময়ের। সেই সময় আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার কূটকৌশল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এসবই ছিল তার পূর্বপরিকল্পনার অংশ। নাহলে আশরাফ খাঁর মতো একজন মানুষকে এত সহজে ঘায়েল করা সম্ভব নয়।
ফলে গ্রামজুড়ে একটা চাপা উত্তেজনা বয়ে যেতে লাগল। সঙ্গে তীব্র আতঙ্ক। এই আতঙ্কের বাতাবরণ যাকে ঘিরে আবর্তিত হলো, তিনি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। যেন। একটু এদিক-সেদিক হলেই কিংবা কেউ তার বিপক্ষে গেলেই আরো ভয়ানক কোনো বাণে তিনি তাকে বিদ্ধ করবেন। এই ভয়ে কেউ আর মুখ খুলল না। নিজেদের সন্দেহের কথাও জানাল না। এতে করে কয়েক গাঁয়ের মধ্যে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তবে তার এই প্রভাবের পেছনে যে আসল মানুষ, সেই কামাল রইল লোকচক্ষুর আড়ালেই। কারণ সে জানে, সামান্য ভুল হলেই ষড়যন্ত্রের ইট পাথরে গড়া তাদের এই মিথ্যে ঘরখানা ভেঙে যেতে পারে।
সমস্যা হচ্ছে, এছাহাকের সঙ্গে তার একটু দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সেদিন সন্ধ্যায় তাকে ওভাবে চড় মারার পর থেকে। যদিও এছাহাক মুখে কিছু বলেনি। তারপরও কামালের মনে হলো বিষয়টা নিয়ে এছাহাকের সঙ্গে কথা বলা দরকার। তার মাথা থেকে বিষয়টা দূর করে দেয়া উচিত। তা ছাড়া, লোকটা বয়সেও তার থেকে অনেক বড়। দেখতে আরো বড় লাগে। এমন একজন মানুষকে ওভাবে সবার সামনে চড় মারা মোটেই ঠিক হয়নি। তা ছাড়া সে এ বাড়িতে বহুবছর ধরে কাজ করে। বলতে গেলে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ডান হাত সে। তার সঙ্গে অমন আচরণ কোনোভাবেই সংগত নয়। কিন্তু ওই মুহূর্তে কিছুতেই নিজেকে সংবরণ করতে পারেনি সে।
সেদিন রাতেই এছাহাককে ডাকল কামাল। বলল, “কেমন আছেন এছাহাক ভাই?
এছাহাক মৃদু হাসল। বলল, এখন তো আমাগো দিন। নিজেগো দিনে। নিজেরা ভালো না থাকলে হয়?
‘এইটাই হলো আসল কথা এছাহাক ভাই। কিন্তু নিজেদের এই দিন তৈরি করার জন্যই কিন্তু এত কষ্ট করতে হয়েছে। এত বুদ্ধি, পরামর্শ, ষড়যন্ত্র। তাই না? . এছাহাক কাঁচুমাচু গলায় বলল, “ঠিক বলছেন ভাই। আর আপনে না হইলে
এইগুলা কোনোদিন সম্ভব হইত না। ভূঁইয়া সাব ঠিকই বলে।
কী বলে?
বলে আপনে হইলেন হিটলারের ব্রেন।
কথা কিন্তু ঠিক না।
‘ঠিক না কেন?
হিটলারের শক্তি ছিল। বুদ্ধি অত ছিল না। বুদ্ধি থাকলে তার ওই দশা হতো না। বুদ্ধি ছিল ব্রিটিশদের। বুঝলেন?
এছাহাক অবশ্য অত কিছু বোঝে না। সে বলল, এখন কী করবেন?
“সেইজন্যই তো আপনারে ডাকছি ভাই।’
‘আমারে?’ যেন অবাক হলো এছাহাক। আমারে কেন? আপনাগোর এতসব বিষয়ের মধ্যে আমি কি করব?
‘আপনি কী করবেন মানে? দুলাভাই কী বলে, জানেন?
কী?
‘সে বলে, এছাহাক হইল আমার আসল শক্তি। তার মতো একজন মানুষ আমি আর খুঁইজা পাইলাম না।
এছাহাক লজ্জাবনত ভঙ্গিতে বলল, “ধুর। কী যে বলেন? ভূঁইয়া সাব আমারে একটু বেশিই পছন্দ করেন। এই জন্য বাড়াই বাড়াই বলেন। আমি যখন ছিলাম না, কয়েকদিন অসুস্থ ছিলাম। তখন মতি মিয়া, দেলু আরো কতজন আছিল। তারা সবাই ভূঁইয়া বাড়ির জন্য জান প্রাণ দিয়া কাজ করব। একরত্তি ছাড় দেব না।’
তা দেব না। কিন্তু সবাই তো আর এছাহাক না। পাকা জহুরি আঁটি হীরা চিনতে ভুল করে না। আপনে হইলেন আমার দুলাভাইর খাঁটি হীরা, বুঝলেন?
এছাহাক এবার আর জবাব দিল না। তবে বিগলিত ভঙ্গিতে হাসল। কামাল হঠাৎ এছাহাকের হাত জোড়া তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, আপনি আমার ওপরে রাগ কইরেন না ভাই। আমি ওই দিনের ঘটনার জন্য লজ্জিত। এই যে ভাই, আপনার হাত ধরে বলছি। আমার ওইসময় মাথার ঠিক ছিল না।’
‘ছি ছি ছি। এইটা আপনি কী করতেছেন কামাল ভাই!’ এছাহাক তটস্থ ভঙ্গিতে সরে গেল। তারপর বলল, “ওই সময় কারো মাথার ঠিক থাকে? তা ছাড়া আমারও ভুল ছিল। আমি যদি সঙ্গে সঙ্গে পানিতে নাইমা যাইতাম। তাইলে তো আর এই সব হইত না। ভুলটা আমারই। আপনি একলা মানুষ। এতদিক সামলাইতেছেন। আপনের তো মাথা ঠিক থাকনের কথা না ভাই। আপনি আসার পর তো আমিও ঝাড়া হাত-পা। আর কোনো কাজ নাই। ঝামেলা নাই। ফুল বাবু হইয়া ঘুইরা বেড়াইতেছি।’ বলে হাসল এছাহাক। তার সেই হাসিতে কামাল নিশ্চিন্ত হলো। সত্যি সত্যিই মানুষটার মন বড় ভালো। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এত উপেক্ষা, অপমান, অবমূল্যায়নের পরও ভূঁইয়া বাড়ির প্রতি যে নিবেদন সে দেখিয়ে যাচ্ছে তা বিরল। হয়তো এমন নিঃস্বার্থ, নির্ভেজাল ভালোবাসায় কৃতজ্ঞ মানুষগুলোর জন্যই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মতো মানুষেরা এমন প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন। এরাই তাদের শক্তির ভীত।
সে বলল, ‘কিন্তু এছাহাক ভাই, আসল সমস্যারই তো কোনো সমাধান হলো।!’
কী সমস্যা?
মহিতোষ মাস্টারের জমি আর মন্দিরের জিনিস, গুপ্তধন?
এই কথায় ঝিম মেরে গেল এছাহাক। তার চোখে মুখেও চিন্তার রেখা। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, আমার জীবনে কোনোদিন নিজেরে এত বড় বোকা আমার লাগে নাই কামাল ভাই। মনে হইতেছে এমন একটা গোলকধাঁধায় পড়ছি যে যেই গোলক ধাঁধা থিকা বের হওনের কোনো পথ নাই।’
হুম। এইটা নিয়ে দুলাভাইর খুবই মন খারাপ। সে এত কিছু করল। এই যে আমরা একটা জান পর্যন্ত শেষ করলাম। কার জন্য? কীসের জন্য? ওই গুপ্তধনের জন্যই তো? নাকি?
হুম।
‘অথচ সেইটারই কোনো খোঁজ নাই। আশ্চর্য কাণ্ড! মাথায়ও কিছু খেলছে না। হতাশ ভঙ্গিতে বলল কামাল।
‘আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানেন? এছাহাক বলল।
কী?’
মনে হয়, ওই জিনিসই মনে হয় আছিল না। পুরাটাই ভূঁইয়া সাব আর মতি, দেলুর চোখের ভুল। অনেক সময় হয় না যে আমরা চোখ ভুলভুলাইয়া দেখি?
কিন্তু আসলে তো ঘটনা তা না। দুলাভাইর কাছেই তো এক জোড়া বালা ছিল, তাই না? সেইখান থেকে একটা দিয়েই তো খাঁ সাবরে ধরাই দিলাম।
‘এইটাই কথা। কিন্তু জিনিস তাইলে গেল কই? আর এখন তো পুলিশও জানে ঘটনা। সুতরাং যদি আসলেই খাঁ সাবের বাড়িতে বা আশপাশে কোথাও থাইকা থাকে, পুলিশ তা খুঁইজা বাইর কইরা ফেলব। বা এতদিনে করত।
হুম। এইটাই এখন চিন্তার বিষয়। আমি এইজন্যই পুলিশরে বিষয়টা জানিয়েছি। যাতে অন্তত আমরা না পেলেও অন্য কেউও এইটা ভোগ করতে না পারে। এই জিনিস এখন কেউ বিক্রিও করতে পারবে না। কারণ দেশবাসী জানে, পত্রপত্রিকায় খবর হইছে। ফলে কেউ কোথাও বেচতে নিলেই সে ধরা পড়ে যাবে।
কথা আসলেও সত্য। এটা কামাল পরিকল্পনা করেই করেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আশরাফ খাঁর বাড়ি বা তার আশপাশের কারো কাছেও ওই জিনিসের সন্ধান পায়নি পুলিশ। তাহলে জিনিসগুলো গেল কোথায়?
দীর্ঘ সময় এই নিয়ে নানা কথাবার্তা হলো। শেষ পর্যন্ত এছাহাক বলল, এক কাজ করলে কেমন হয় কামাল ভাই?
কী কাজ?
‘ওইখানে আশরাফ খাঁর যত লোক পাহারায় ছিল। তারপর ভূঁইয়া সাব যত লেবার দিয়া কাজ করাইছে, সবাইরে আলাদা আলাদা ডাইকা কথা বলা যায়।
‘তাতে লাভ?
ধরেন, আগে তো বিষয়টার গোপনীয়তার জন্য চাইলেও সবাইরে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায় নাই। এখন তো আর সেই সমস্যা নাই। এখন ওই জিনিসের কথা সবাই জানে। তো কেউ যদি সত্যি সত্যিই ওগুলা পেয়ে লুকাই রাখে, তাহলে তার একমাত্র সুযোগ হলো কারো কাছে অল্প-বিস্তর পয়সায় জিনিসটা বিক্রি করে দেওয়া। মানে হস্তান্তর করা। নাহলে যতদিন হাতে থাকবে, ততদিনই বিপদ। তাই না? সুতরাং কারো কাছে যদি ওইটা থাইকাও থাকে, সে কিন্তু এই সুযোগটা হারাইতে চাইব না। আর ওইখানে যারা কাজ করছে, তারা ছাড়া আর কে নেবে ওই জিনিস?
এছাহাকের কথা দারুণ পছন্দ হলো কামালের। সে বেশ খানিকটা সময় চুপচাপ এছাহাকের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আপনেরে খামোখাই দুলাভাই এত পছন্দ করে না, বুঝলেন এছাহাক ভাই? আপনে কিন্তু বুদ্ধিমান লোক।
এছাহাক সলজ্জ হাসল। কামাল বলল, আপনি, মতি আর দেলু তাহলে এই কাজটা করবেন। যেহেতু আমি কারো সামনে যেতে চাই না।’
এছাহাক সম্মতি জানাল। তবে আশরাফ খাঁর ঘটনায় পুরো গ্রামবাসী এমনভাবে চুপসে গেছে যে তারা কেউই আর কোনো বিষয়েই মুখ খুলতে চায় না। এমনিতেই এ গাঁয়ে পুলিশ আসার ঘটনা বিরল। তা ছাড়া থানা-পুলিশ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ভীতিও রয়েছে। ফলে শেষ কিছুদিনে পুলিশের আনাগোনা, তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ এখানে যেভাবে চলেছে, তাতে গাছের পাতা পড়ার শব্দেও যেন মানুষ আঁতকে ওঠে। এছাহাক, মতি মিয়াদের চেষ্টা তাই তেমন কোনো কাজেই লাগল না। তবে এর মধ্যেও সেই সন্ধ্যায় রুস্তমের লাশ ডুবিয়ে দেয়ার ঘটনা দেখে ফেলা অচেনা সেই ছায়ামূর্তিকে নিয়ে মনে মনে তীব্র এক অস্বস্তির কাঁটা বয়ে বেড়াতে লাগল কামাল। এছাহাককে সেকথা বললও সে। এছাহাক অবশ্য তাকে আশ্বস্ত করল। বলল, ভয়টা যে আমার ছিল না, তা না কামাল ভাই। আমারও ছিল। কিন্তু এতদিনে এত ঘটনা ঘইটা যাওনের পরও যেহেতু সে কোনো উচ্চবাচ্য করতেছে না। তার মানে আর করবোও না। আপনি একটা জিনিস তো বুঝতেছেন?
কী?
‘গাঁয়ের লোক আইজকাল ভূঁইয়া সাবরে কী পরিমাণ ভয় পায়?
হুম।
আপনের কি মনে হয়, এরপরও ওই ব্যাটা মুখ খুলব? সে জানে না, যদি মুখ। খোলে তাইলে তার কী দশা হইব?”
কথা অবশ্য মিথ্যে নয়। পরিস্থিতি এখন যেভাবে তাদের পক্ষে চলে এসেছে, তাতে ওই বিষয় নিয়ে মুখ খোলা যে ভালো কিছু নয়, বরং নিজের পায়ে নিজের কুড়াল মারার মতোই আত্মঘাতী, তা কারোই না বোঝার কথা না। ফলে অন্তত এই একটি জায়গাতে হলেও খানিক নিশ্চিন্ত বোধ করতে লাগল। কামাল। তার মনে হয়, আর যা-ই হোক, লোকটা অন্তত ভয়ে হলেও কখনোই তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে না।
.
তবে এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। ফরিদ বেশ কিছুদিন আর বাড়ি থেকে বের হলো না। যতটা পারল আছমার সঙ্গে সময় কাটানোর চেষ্টা করল। এতে আছমাও ভীষণ খুশি। খুশি নুরুন্নাহার এবং ওহাব ডাক্তারও। এতদিন পর এসে তাদের মনে হতে লাগল যে শেষ পর্যন্ত ভাগ্য বোধহয় তাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে। অন্তত এই যে এত এত যন্ত্রণা, ক্ষত, দুঃসহ স্মৃতি তা ভুলে ফরিদ এবং আছমা পরস্পরকে পরস্পরের নির্ভরতার জায়গা হিসেবে খুঁজে পেতে শুরু করেছে।
জগতে মানুষ শেষ অবধি যা খোঁজে, তার নাম ওই আশ্রয়ই। সে চায় তার একটুকরো নির্ভার আশ্রয় থাকুক। প্রবল দহন দিনের শেষে, ঝড়-ঝঞ্ঝা, যুদ্ধ যাতনা শেষে যার ছায়াতে জিরাবো ভেবে ফিরে আসার ইচ্ছে হয়। তেমন একটা আশ্রয়ের আক্ষেপ ও অনুসন্ধানে কেটে যেতে থাকে মানবজীবন। আছমা যেন ফরিদের জন্য তেমন মায়াময় নির্ভরতার আশ্রয়ই হয়ে উঠতে পেরেছে। ফলে সেদিন ওই প্রায় মাঝরাতে জলে ভেজা আতঙ্কিত ফরিদ যখন বাড়ি ফিরল, তখন ভয় পেলেও এরপর আছমা কিংবা এ বাড়ির সবাই খুশিই হলো। কারণ, পরদিন থেকে ফরিদ পুরোপুরি ঘরকুনো হয়ে গেল। এমনকি খুব প্রয়োজন না হলে নিজের ঘর থেকেও বের হয় না সে। বিষয়টাতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন নুরুন্নাহার। এই সময়ে তিনি আমাকে ঘরের কোনো কাজই করতে দিতে চান না। সবসময়ে পরিপাটি হয়ে থাকতে বলেন। এমনকি ফরিদ আর আছমার খাবারটা অবধি তিনি তাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসেন। এতে অবশ্য আছমার খানিক লজ্জা লজ্জা লাগে। তবে সে মাকে তা বুঝতে দেয় না।
সেদিন আছমা হঠাৎ আবিষ্কার করল, মা বাজারে গিয়ে নিজে পছন্দ করে তার জন্য দু খানা শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছেন। সেই শাড়ির রং কটকটা লাল। শাড়ি জোড়া আছমার হাতে দিতে দিতে নুরুন্নাহার বললেন, এখন থিকা ঘরেও তুই এই নয়া শাড়ি পরবি।
আছমা অবাক গলায় বলল, ঘরেও নয়া শাড়ি পরব কেন?
আমি বলছি এইজন্য পরবি। আর এই নে।’ বলে আছমার হাতে একটা কাগজের প্যাকেট তুলে দিলেন।
আছমা বলল, ‘এগুলা কী?
‘নিজের চেহারার দিকে চাইয়া দেখসস? কাকলাইসের মতো হইয়া গেছে। এখন থিকা এইগুলা মুখে মাখবি। তোর চেহারা ছবি তো খারাপ না। তাইলে এমন আউলা-ঝাউলা হইয়া থাকস কেন?
‘তুমি ভাবছ যে সে আমার সাজগোজ পছন্দ করে? করে না। সে এইগুলা একদম পছন্দ করে না।
‘তোর পেটে আমি হইছি? না আমার পেটে তুই হইছস?
‘কেন?
‘পুরুষ মানুষ কী পছন্দ করে আর কী করে না, তা আমার চাইতে তুই বেশি জানস?
আছমা কথা বলল না। মনে মনে সে মায়ের এই আচরণে খুশিই হয়েছে। কিন্তু বাইরে প্রকাশ করছে না। নুরুন্নাহার বললেন, “পুরুষ মানুষ ভাব ধরে যে তারা এইগুলা পছন্দ করে না। কিন্তু আসল কথা হইল, তারা মাইয়া মানুষের সাজগোজ পছন্দ করে। অত্যন্ত পছন্দ করে। সবচেয়ে বেশি কী পছন্দ করে জানস?
‘কী?
কাজল আর লিস্টিক। তারা চায় মাইয়া মানুষের চোখভর্তি কাজল থাকবে। আর ঠোঁটভর্তি লিবস্টিক থাকবে।
‘কেন? কাজল আর লিস্টিক থাকলে কী হয়?
কাজল থাকলে হয় মায়া। কাজল দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে খটমটা মাইয়া মানুষরেও মায়া মায়া লাগে। আর পুরুষ মানুষ মাইয়া মানুষের ওই মায়াতেই বান্ধা থাকে।
‘আর লিবস্টিক?
‘ওইটা তোর আমারতন বোঝন লাগব না। ওইটা জামাইরতনই বুঝিস। সে-ই বুঝাই দেব।’ বলে মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেলেন নুরুন্নাহার। আছমা সামনাসামনি হাসলেও মায়ের কথায় ভারি অবাক হলো। মা এত কিছু ভাবে! এত কিছু খেয়াল করে? আসলে মা হতে হলে জীবনের এমন অনেক গোপন অলিগলিরই খোঁজ জানতে হয়। আচ্ছা, সে কি কখনো মা হতে পারবে?
এই প্রশ্নটা আছমাকে খুব ভাবায়। থমকে দেয়। কষ্টও। ফরিদ কখনোই তার সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার আগ্রহ দেখায়নি। সে নিজ থেকে যে বারদুয়েক চেষ্টা করেনি, তা নয়। কিন্তু ওই চেষ্টাটুকুতে ভারি লজ্জা, আড়ষ্টতা। নিজেকে কেমন অপাঙক্তেয়, অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হয়। কিন্তু জগতের সকল মেয়েই চায়, কেউ তাকে চাইবে, তার আরাধনা করবে। তাকে অর্জন করতে চাইবে সর্বস্ব দিয়ে। এই অহম কিংবা সহজাত প্রবণতাটুকুই বোধহয় মেয়েদের আরো বেশি সুন্দর, আরো প্রার্থিত করে রেখেছে পুরুষের কাছে। কিন্তু তার ভাগ্যটা এমন কেন?
আছমা জানে, মাও খুব করে চায়, ফরিদ আর তার মধ্যে যে বরফের মতো শক্ত ও শীতল সম্পর্ক রয়েছে তা গলে তরল হোক। তারা ঘনিষ্ঠ হোক। তাদের ঘরে নতুন অতিথি আসুক। কিন্তু ফরিদ যেমন নির্লিপ্ত, তাতে আমার ভারি সঙ্কোচ হয় উপযাচক হয়ে বারবার ফরিদের কাছে নিজেকে নিবেদন করতে।
তবে সে মায়ের দেয়া শাড়ি পরে। একটু সেজেগুজেও থাকে। এই এতদিন বাদে নিজেকে কেমন নতুন বউ বউ মনে হয় তার। তা ফরিদও যেন এই অবসরে আছমাকে আগের চেয়ে একটু অন্যচোখে দেখে। সে ঘর থেকে একদম বের হয় না। কখনো কখনো আছমার আদর-আবদার বিনা বাক্যব্যয়ে মেনেও নেয়। বিষয়টাতে আছমা যে সন্দেহাতীত রকম খুশি, তা নয়। কারণ সে উপলব্ধি করে। ফরিদের ভেতর অন্য কিছু একটা চলছে। কিছু একটা লুকাচ্ছে সে। কিন্তু এটুকু মেনে নিয়েই সে ভাবে, এই প্রাপ্তিটুকুও তো অকিঞ্চিৎকর কিছু নয়। বরং যেকোনো কারণেই হোক, ফরিদ এই কদিন ধরে তাকে যে মনোযোগ দিচ্ছে, যে ভালোবাসা কিংবা ঘনিষ্ঠতার সুযোগ দিচ্ছে, তা এর আগে কখনোই দেয়নি।
ফরিদ অবশ্য সেই সন্ধ্যার বিষয়টা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। ঘটনাটা তার চোখে, মগজে এমনভাবে গেঁথে আছে যে শত চেষ্টা করেও তা সে ভুলতে পারে না। এ কারণেই যতটা সম্ভব অন্য কিছুতে ডুবে থাকতে চাইছে সে। যাতে আর সব কিছু ভুলে থাকতে পারে। পারুর যন্ত্রণা, রুস্তমের নিথর পা, যমের মতো তাড়া করে আসা এছাহাক, মতি মিয়াদের ভুলে থাকতে চায় সে। আর তার সেই ভুলে থাকা চেষ্টার একমাত্র অবলম্বন আছমা। যেন আছমার কাছেই খানিক শান্তি ও স্বস্তি মেলে। আশ্রয় ও উপশম মেলে। এই আশ্রয় আর উপশমটুকু ভারি দরকার। জীবনের মুহূর্মুহূ আঘাতে ভীষণ ক্লান্ত, অবসন্ন সে।
তা আছমা তাকে ওই আড়ালটুকু দেয়ও। সে তাকে শিশুর মতো আগলে রাখে। আবার প্রেমিকার মতো প্রবল ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে চায়। মুহূর্তের জন্যও আর কোনো ছায়া পড়তে দেয় না তার ঝাবিক্ষুব্ধ ভাবনার আকাশে। ফরিদও চেষ্টা করে তার সঙ্গে সহজ হতে। আর সব ক্ষত ও ক্ষতি ভুলে আদ্যোপান্ত ডুবে থাকতে। তা বেশ খানিকটা যেন পেরেও ওঠে। কিন্তু সেদিন হঠাৎ করেই বজ্রপাতের মতো সংবাদটা এলো। রুস্তমকে হত্যা বা গুমের অপরাধে আশরাফ খুঁকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। খবরটা তাকে জানিয়েছেন ওহাব ডাক্তার। তিনি সেদিন বাড়ি ফিরে অসহায় ভঙ্গিতে সবাইকে খবরটা দিলেন। তার কণ্ঠে রাজ্যের বিষাদ। আশরাফ খাঁকে ভারি পছন্দ করেন তিনি। এবং তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করেন না যে এমন কোনো কাজ কস্মিনকালেও আশরাফ খাঁর পক্ষে করা সম্ভব।
ঘটনা শোনার পর থেকেই অস্থির হতে শুরু করল ফরিদ। তার বারবার কেবল মনে হতে লাগল, আশরাফ খাঁর মতো একজন মানুষের বিনা অপরাধে কিছুতেই এমন ভয়ংকর শাস্তি হতে পারে না। এটা ঘোরতর অন্যায়। অপমানজনকও। সে জানে, রুস্তমের প্রকৃত খুনি কারা। নিজ চোখে তাদের দেখেছে সে। কিন্তু এই কথা কিছুতেই প্রকাশ করা যাবে না। তাহলে কেবল সে একাই নয়, বিপদে পড়বে আছমাদের পুরো পরিবারও। আর এটা সে কোনোভাবেই হতে দেবে না। এমনতিই তার জন্য অপরিসীম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে তাদের।
কিন্তু যে মানসিক যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হচ্ছে, এর থেকে মুক্তি মিলবে কী করে? সেদিন মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল ফরিদের। সেই ঘুম ভাঙা ফরিদ যেন অন্য এক মানুষ। সে আছমাকে ডেকে ওঠাল। সন্ত্রস্ত আছমা ফরিদের অবস্থা দেখে বলল, কী হইছে আপনের? দুঃস্বপ্ন দেখছেন?
ফরিদ বলল, তুই মামা-মামিরে ডাক।
‘এত রাইতে তাদের কেন ডাকব?’।
‘আমি বলছি এইজন্য ডাকবি। ডাক।
ফরিদের ভাবভঙ্গি দেখে আছমা ভয় পেয়ে গেল। সে উঠে বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে এলো। ওহাব ডাক্তার ফরিদের গা ঘেঁষে বসলেন। তার কপালে হাত দিয়ে দেখলেন, জ্বর আছে কী না! নেই। কিন্তু প্রচণ্ড উদ্ৰান্ত লাগছে তাকে। আজকাল ছেলেটাকে নিয়ে সারাক্ষণই ভয়ে থাকেন তিনি। এই ভয়ের কারণ অবশ্য আছমা। এই যুগে তার মতো এমন সাদাসিধে ভালো মানুষ বড় বিরল। নিজের ক্ষতি হলেও সে অন্যের উপকার করতে চায়। বুকের ভেতর অগুনতি কষ্ট চেপে রেখেও অন্যের আনন্দে হেসে যায়। ফরিদ আর পারুর ঘটনায় যে কষ্ট সে পেয়েছে, হারানোর যে তীব্র যন্ত্রণা তাকে অনুভব করতে হয়েছে, তাতে তার প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু তাতে সে হয়ইনি। বরং প্রচণ্ড সহানুভূতি ও সংবেদনশীলতা অনুভব করেছে তাদের প্রতি। সমস্যা হচ্ছে, মানুষের সকল ক্ষমতাই সীমিত। সে কোনোকিছুই তার সামর্থ্যের বাইরে করতে পারে না। আছমাও না। ফলে এই যে এত এত দহনের দিন আর কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে অবশেষে সে খানিক ছায়া পেল, খানিক স্বস্তি পেল–এইটুকুও যদি শেষ অবধি হারিয়ে যায়, তবে তা সইবার সাধ্য তার থাকবে না। এই কঠিন সত্যটা বোঝেন বলেই ওহাব ডাক্তারের ভয় হয়। কারণ তিনি জানেন, আছমার পুরো জগৎজুড়েই একজন মাত্র মানুষ। সেই মানুষটা ফরিদ। তাকে ঘিরে তার সকল আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য।
ফরিদ তাকে দেখেই বলল, মামা, আমি একটা কথা বলব আপনারে। খুবই জরুরি কথা। কিন্তু এই কথা এখনই কাউরে বলা যাবে না।’
ওহাব ডাক্তার ভারি অবাক হলেন। এত রাতে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কী জরুরি কথা বলবে ফরিদ?
ফরিদ সাবধানী চোখে এদিক-সেদিক তাকিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘ঘটনা খুবই মারাত্মক। গোপনও। আর সাবধান, এই কথা অন্য কেউ জানলে বিরাট বড় বিপদ। কিন্তু কথাটা আমি আর আমার মধ্যে আটকে রাখতে পারছি না। এখন আমি আপনারে বলব। তারপর আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন এরপর আমি কী করব?
এই মাঝরাতে ফরিদের এমন কথা শুনে ওহাব ডাক্তার ঘাবড়ে গেলেন। তিনি বললেন, “তোর কী হইছে ফরিদ? তুই কি দুঃস্বপ্ন দেখছিস?
ফরিদ বলল, না মামা। আমি দুঃস্বপ্ন দেখি নাই। আমি যা দেখছি তা সত্য।
কী সত্য?
‘রুস্তমরে কে খুন করছে, এই কথা আমি জানি। আমি নিজ চোখে দেখছি।
‘কী!’ প্রায় আঁতকে ওঠা গলায় বললেন ওহাব ডাক্তার।
‘জি মামা। আমি নিজ চোখে দেখছি এছাহাক আর মতি মিয়া রুস্তমের বস্তাবন্দি লাশ ফেলছে পানিতে।
ঘরের সবাই হতভম্ব ভঙ্গিতে ফরিদের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ফরিদ অবাস্তব, অবিশ্বাস্য কোনো কথা বলছে। যেন এসব স্বপ্নে দেখেছে সে। ফরিদ বলল, আমি জানি, আপনাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। হয়তো ভাবছেন যে আমি আবোলতাবোল বকছি। বা স্বপ্ন দেখেছি। আমার মাথার ঠিক নাই। কিন্তু মামা, ঘটনা সত্যি। ওই দিন যে আমি মাঝরাতে ওইরকম ভয় পেয়ে পানিতে ভিজে বাড়িতে ফিরছিলাম, এই কারণেই ফিরছিলাম। আমি ভাবছিলাম, এই কথা আমি কাউরে বলব না। তাইলে আপনারাও বিপদে পড়বেন। কিন্তু আশরাফ খাঁর জেলে যাওয়ার ঘটনা শোনার পর থেকে আমি আর শান্তি পাচ্ছি না মামা। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।’
ফরিদ থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। কেবল আছমা এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়াল। বাবা-মা সামনে থাকা সত্ত্বেও সে ফরিদের মাথার ভারটা নিয়ে নিল তার শরীরে। দু হাতে শক্ত করে তার কাধ ধরে রাখার চেষ্টা করল। ওহাব ডাক্তার বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘ঘটনা কী হইছে খুলে বল?
ফরিদ ঘটনা খুলে বলল। সবশুনে থম মেরে রইলেন তিনি। ফরিদ বলল, ‘এখন আমি কী করব?
‘তুই কিছু করবি না ফরিদ। একদম কিছু না। তুই কিছু দেখস নাই। শোনস নাই। ওই দিন ওই খানে কিছু ঘটেও নাই। এইটা আমার মাথার কিড়া। এই যে আমার মাথা ছুঁইয়া বল, তুই কাউরে কিছু বলস নাই। বল। বল।’ নুরুন্নাহার প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে কথাগুলো বললেন।
ফরিদ অবশ্য তার কথার জবাব দিল না। ওহাব ডাক্তার বলল, তুই কি বুঝতে পারতেছিস না, ঘটনা কোনদিকে যাইতেছে? কী হইতেছে?
‘আমি অতকিছু বুঝতে চাই না মামা। এই ঘটনা তো জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ঘটাইতেছে। এটা তো পানির মতো পরিষ্কার। সে ইচ্ছে করেই খা সাবরে ফাসাল। তার কারণেই আজ আমার এই দশা। আপনি বলেন, তার কারণেই সবকিছু হয় নাই? সে না হলে পারুদেরও এই গ্রাম ছাড়তে হতো না। এতগুলা মানুষের আজকের এই পরিণতি হতো না। এই সবকিছুর মূলে সে।’
ওহাব ডাক্তার কথা বললেন না। তিনি কিছুতেই চাইছিলেন না এখানে পারু বা মহিতোষ মাস্টারের কোনো প্রসঙ্গ আসুক। সেটা এই ঘরের কেউই চায় না। তারা সকলেই চায়, গত কিছুদিনের ফরিদই স্থায়ী ফরিদ হয়ে থাকুক। কিন্তু ফরিদ সেই প্রসঙ্গও আনল। সে বলল, যা যা ঘটছে, তার সবকিছুর জন্য সে-ই দায়ী। আর কত? তারে তো এবার থামাতে হবে মামা। না হলে সে সবকিছু শেষ করে দেবে। এইটা তো হতে পারে না। তারে যেকোনোভাবেই হোক থামাতে হবে…।’
ফরিদ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই বাইরে উঠানে যেন কারো পায়ের শব্দ শোনা গেল। ওহাব ডাক্তার ভীত চোখে ফরিদকে চুপ করতে ইশারা করলেন। কিন্তু খুব সতর্কভাবে এগিয়ে আসা পায়ের শব্দগুলো এই নিঃসীম অন্ধকার আর নিস্তব্ধতায় বড় কানে বাজতে লাগল। কানে বাজতে লাগল হিংস্র শিকারির আগমনে ভীত সন্ত্রস্ত হরিণের মতো জড়সড়, উৎকর্ণ হয়ে থাকা মানুষগুলোর বুকের শব্দও।
৩৯
পৃথিবী মানুষকে আশ্চর্য গভীর কিছু অনুভূতি দিয়েছে। এই অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা মানুষের নেই। মানুষ তাই প্রায়ই এই অনুভূতিগুলোকে অপার্থিব বলে অভিহিত করে; অন্যকে বোঝাতে চায়। কিন্তু সে জানে না, সত্যি সত্যিই ওই অনুভূতির অস্তিত্ব পৃথিবীর বাইরে আর কোথাও আছে কি না। পারুরও তেমন মনে হচ্ছে। তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, ওইখানে সত্যি সত্যি বাবা বসে আছেন। ওই যে বারান্দায় হেমন্তের আগমনী গান শোনানো শীত শীত ভোরবেলার রোদ এসে পড়েছে। সেখানে একখানা টেবিল। টেবিলের পাশে চেয়ার। সেই চেয়ারে বসে আছেন মহিতোষ। তার সামনে একখানা চায়ের পেয়ালা। তাতে কুয়াশার মতো ধোঁয়া উড়ছে। গ্রিলের ফাঁক গলে এক চিলতে আলো এসে পড়েছে সেখানে। সেই আলোর মাঝে হাত রেখে তাকিয়ে আছেন মহিতোষ। পারু আলতো করে ডাকল, ‘বাবা?
মহিতোষ ফিরে তাকালেন। তার চোখে মুখে অদ্ভুত এক আভা। অবিশ্বাসও। তার কেবলই মনে হচ্ছে এই স্বপ্ন ভেঙে যাবে। তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখবেন পারু নেই। এ সবই তার কল্পনা। গত পনেরদিন ধরেই এমন মনে হচ্ছে তার।
সেদিন রাতে কীসব যে ঘটে গেল! মহিতোষ তার কিছুই বুঝতে পারেননি। একটা আধ ঘুম আধো জাগরণের মতো ব্যাপার। সেই আধো ঘুম আধো জাগরণে তিনি কী সব অলৌকিক ঘটনার মুখোমুখি হলেন! পারু তার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর বসল। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরল। কাদল। বাবাকে শুষে নিতে থাকল বুকের ভেতর। কিন্তু মহিতোষ জানতেন, এসবই স্বপ্ন। এর কিছুই সত্যি নয়। আর খানিক বাদেই সাবানের রঙিন বুদবুদের মতো সব মিলিয়ে যাবে। তিনি দেখবেন কোথাও কিছু নেই। না পারু। না তার ওই স্পর্শ। ঘ্রাণ। ছায়া। কিছুই না।
কিন্তু পারু গেল না। সে বরং আরো গাঢ়, মূর্ত, স্পর্শময় হয়ে উঠতে লাগল। তার চোখের জল ছুঁয়ে দিতে লাগল মহিতোষের গাল। তার কান্না ও কম্পন গভীর আশ্লেষে কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল মহিতোষের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। কুয়াশার যে গাঢ় চাদর জড়িয়ে ছিল তার মন ও মগজে, সেই চাদরটাকেও যেন ক্রমশই দূরে সরিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু মহিতোষের ভয় তাতে কাটল না। এক অবর্ণনীয় সংশয় ও সন্দেহে, সত্য-মিথ্যা, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে কেটে যেতে লাগল মুহূর্ত। তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। বাইরে কাক ডাকতে শুরু করেছে। চারদিক থেকে ভেসে আসতে শুরু করেছে ফজরের আজানের শব্দ। ঠিক সেই মুহূর্তে গভীর তন্দ্রাচ্ছন্নতা থেকে চোখ মেলে তাকালেন মহিতোষ। রাতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন তিনি নিজেই জানেন না।
জানালার কাছটাতে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। স্থির, অবিচল। ভোরের প্রথম আলোয় ক্রমশই প্রতিভাত হয়ে উঠছে তার অবয়ব। যেন বহুদিন পর চোখ মেলে তাকালেন মহিতোষ। যেন বহুদিন পর ঘুম ভাঙল তার। তিনি নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন ওই ছায়ামূর্তিটার দিকে। তার চোখের কোলজুড়ে ক্রমশই জমে উঠতে লাগল জলের ফোঁটা। ওই ফোঁটাটুকু কখন যে অশ্রু হয়ে টুপ করে ঝরে পড়ল, তা তিনি টেরই পেলেন না। মহিতোষের কেবল মনে হতে লাগল, এই যে অনন্ত সময়, এই সময় বোধ হয় মহাকালের পথে লীন হয়ে যেতে যেতে আচমকা থমকে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। এই সময়টুকু কেবলই তার। বেঁচে থাকার কিংবা মৃত্যুর। হতে পারে এটুকুই তার জীবন। এটুকুই তার অশেষ অবশেষ।
তিনি ধীরে উঠে বসলেন। তারপর বসে রইলেন দীর্ঘ সময়। সত্যি সত্যিই ওখানে পারু? ভোরের আলো ঝাঁঝালো হতে শুরু করেছে। পারু দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো। তার ঘোর এখনো কাটছে না। বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যি সত্যিই সে বাবার কাছে। তরু তাকে সত্যি সত্যিই এখানে নিয়ে এসেছে। রূপকথার গল্পের মতো এই গল্পটাও যদি মিথ্যে হয়?
এমন কত কী ভাবনা সারাটা রাত তাকে এক ফোঁটা ঘুমাতে দেয়নি। সে ঢাকায় ফেরা অবধি তরুর কাছে কত কী শুনেছে! বাবার কথা, ফরিদের কথা। মায়ের কথা, চারুর কথা। বাবাই সেসব বিভিন্নসময়ে তরুকে বলেছিলেন। কিন্তু তরুর কাছে সেসব শুনতে শুনতে প্রতিটি মুহূর্ত পারুর কেবল নিজেকে অভিশপ্ত আর অপরাধী মনে হয়েছে। মনে হয়েছে এই মানুষগুলোর জন্য তার এই জীবনের সবটুকু নিঃশেষে বিসর্জন দিলেও কিছুই দেয়া হবে না তার। কিন্তু জীবন তো তাকেও কম শাস্তি দেয়নি! কম প্রায়শ্চিত্য হয়নি তারও!
পারু তাই নিষ্পলক জেগে রইল। তার কেবল মনে হয়েছে, সে ঘুমালেই যদি তার চোখের সামনে থেকে সবকিছু হারিয়ে যায়! উবে যায় এই সব অপার্থিব প্রাপ্তি আর অনুভবের মুহূর্ত! এই যে সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ছিল, তার গায়ের ঘ্রাণ, শরীরের স্পর্শ পাচ্ছিল, তার সবই যদি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়? সে যদি জেগে উঠে দেখে অন্য কোনো জগতে তার বসবাস?
মহিতোষ আচমকা ঘুমিয়ে গেলেও এমন নানা ভাবনায় জেগে রইল পারু। আর এক মুহূর্তের জন্যও বাবাকে হারাতে চায় না সে। চোখের আড়াল করতে চায় না। কিছুক্ষণ পর পরই তাকিয়ে দেখে, বাবা আছেন তো ওখানে? ওই দৃশ্যটা সত্যি তো? পারু আরো একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। আর সঙ্গে সঙ্গেই চমকে গেল সে। বাবা বসে আছেন বিছানায়। তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন! কতক্ষণ এভাবে বসে আছেন তিনি? পারু ত্বড়িৎ ঘুরল।
বাবা কি এবার তাকে চিনতে পারবেন? সে তরুর কাছে সব শুনেছে, আজকাল মাঝেমধ্যেই অনেক কিছু ভুলে যান মহিতোষ। কখনো কখনো চট করে মানুষও চিনতে পারেন না। আলাদা করতে পারেন না বাস্তব আর কল্পনা। পারুও তা গতরাতে টের পেয়েছে। কিন্তু এই ঘোর কি আর কখনোই কাটবে না?
মহিতোষ আচমকা ডাকলেন, মা।
পারুর মনে হলো সে কেঁপে উঠেছে। তার শরীর বেয়ে আশ্চর্য এক শিহরণ বয়ে গেল। এই কণ্ঠে শেষ কবে এভাবে ডেকেছিলেন বাবা? মনে করতে পারে না পারু। গতরাতের ওই মানুষটাকে ভারি অচেনা লেগেছিল তার। মনে হয়েছিল বাবার মতো দেখতে অন্য কোনো মানুষ। কিন্তু এখনকার এই কণ্ঠ, এই ডাক তার আজন্মের চেনা। অনুভবের গভীর অবগাহন।
পারু দাঁড়িয়ে রইল স্থির, অনড়। নিঃশব্দও। যেন বাবার ওই ডাকটা সে আরো একবার শুনতে চায়। কিংবা আরো অসংখ্যবার। মহিতোষ তাকে অবাক করে দিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, আমার কী জানি হয়েছে, বুঝলি পারু? মনে হয় পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছি।’
পারু কথা বলল না। সে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। মহিতোষ বললেন, সবকিছুই কেমন সত্য-মিথ্যা মনে হয়। জীবনে সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় কি জানিস?
পারু চুপ করেই রইল। বাবা কি আরো অসুস্থ হয়ে গেছেন? না হলে এমন ভঙ্গিতে কথা বলছেন কেন তিনি? এমন সুস্থ, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে? যেন কিছুই হয়নি। যেন রোজ এভাবে পারুর সঙ্গে কথা বলেন। মহিতোষ বললেন, সবচেয়ে কষ্টকর হলো মানুষ যখন সত্য-মিথ্যা আলাদা করতে পারে না। জীবনে সত্য-মিথ্যাকে আলাদা করতে না পারার চাইতে কষ্টকর আর কিছু নাই।’ বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন মহিতোষ। নিচু হয়ে পায়ে জুতো গলালেন। বললেন, এই যে তোকে আমি দেখছি, আমার একবার মনে হচ্ছে এটা সত্যি। আরেকবার মনে হচ্ছে কল্পনা। কী করি বল তো? এমন হলে বাঁচা যায়?
পারু কী করবে বুঝতে পারছে না। মহিতোষ ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। পারু হতভম্ব হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। কী করছে বাবা? মহিতোষ তার কাছে গিয়ে জানালার পর্দাটা পুরোপুরি সরিয়ে দিলেন। ভোরের ঝলমলে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল পুরো ঘর। সেই আলোতে পারু আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল তার সামনে। আরো বাস্তব। মহিতোষ তার ডান হাতখানা পারুর দিকে এগিয়ে দিলেন। তার হাত কাঁপছে। যেন তিনি তার সংশয় দূর করতে পারছেন না। পারু রাজ্যের বিস্ময়, দ্বিধা নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। মহিতোষ তার কাঁপা কাঁপা হাতে পারুর গাল ছুঁয়ে দিলেন। তারপর মাথা। চুল। তারপর পারুর হাতখানা ধরতে ধরতে বললেন, বাবা হয়েছি বলেই এত কষ্ট পেতে হবে? এত কষ্ট… এত কষ্ট…।’ মহিতোষ শেষের শব্দগুলোও স্পষ্ট বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারলেন না। তার আগেই একটা সর্বপ্লাবি জলোচ্ছ্বাস যেন বুকের ভেতর থেকে উথলে উঠল। তারপর ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাকে। তিনি প্রায় বুজে আসা গলায় বললেন, ‘তুই মিথ্যে হলে হ। তবুও আমাকে একটু জড়িয়ে ধর মা। শক্ত করে জড়িয়ে ধর।
পারু বাবাকে জড়িয়ে ধরল। যেন সে সেই ছোট্ট পারু। যেন সে কোনো অন্যায় করে বাবার বুকে মুখ লুকাতে চাইছে। বাবা তার সেই সব অন্যায় মুহূর্তেই ভুলে গিয়ে তাকে কাছে টেনে নেবেন। তারপর প্রগাঢ় ভালোবাসায় আগলে রাখবেন। তা মহিতোষ রাখলেনও। তিনি পারুর মাথায় হাত রাখলেন। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের সঙ্গে। তারপর আচমকা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন, মা রে। মা গো…ও মা… মা…’। তার সেই কান্নায় যেন তুলোর মতো ভেঙে পড়তে লাগল আকাশ। যেন খানখান হয়ে গেল ভোরের নির্জনতা। আর বুকের ভেতর জমে থাকা বরফের পাহাড় গলে গলে বেরিয়ে আসতে লাগল দু চোখ। বেয়ে। পারু ছোট্ট পাখির মতো ডুবে যেত চাইল বাবা নামের বিশাল এই বটবৃক্ষের। বুকের কোটরে। যেন এই কোটর থেকে আর কখনো কোথাও যেতে চায় না সে। রয়ে যেতে চায় জনম জনম।
দূরে দরজার ফাঁকে তখন জেগে আছে আরো একজোড়া চোখ। সেখানে ভোরের আলো এখনো পৌঁছায়নি। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। কিন্তু সেই অন্ধকারেও চোখ মুছল তরু। তার মনে হলো এই জীবনে এমন সুন্দর, এমন অপার্থিব দৃশ্য আর সে দেখেনি। দেখবেও না কোনোদিন।
.
তারপরের সময়গুলো যেতে লাগল দ্রুত। পারু তার নির্দয় নির্বাসন আর অভিশপ্ত জীবনের যন্ত্রণার গল্প যতটুকু পারল লুকিয়ে-চুরিয়ে বলল বাবাকে। কিন্তু তার সবটুকু নিতে পারলেও পারুর ওই সন্তানটিকে যেন শত চেষ্টায়ও গ্রহণ করতে পারলেন না। মহিতোষ। তবে সেটি পারুকে বুঝতে দিলেন না। তাকে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না। প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তরু অবশ্য নানাভাবে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল। কিন্তু মহিতোষের আড়ষ্টতা তাতে কাটল না। আর তার এই আড়ষ্টতা ক্রমশই ছুঁয়ে যেতে লাগল পারুকেও। এত দুঃসহ যন্ত্রণার অপেক্ষা ফুরিয়ে যে দর্শন হয়ে উঠেছিল অপার্থিব আনন্দের উপলক্ষ, তা যেন ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে পড়তে লাগল। তারা দুজনই সংকুচিত হয়ে যেতে থাকল পরস্পরের কাছ থেকে।
আড়ষ্ট পারুর ফরিদের কথা জিজ্ঞেস করতেও সংকোচ হয়। যেন এ জীবনের কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই তার। পাওয়ারও নেই। যেন সকল অধিকার-আবদার বিসর্জন দিয়েছে সে। তবে পারুকে কিছু না বললেও বেশকিছুদিন পর মহিতোষ হঠাৎ তরুকে ডাকলেন। তারপর এটা-সেটা বললেন, মইনুল ছেলেটাকে বেশ কিছুদিন হয় দেখি না।
উনি তো আপনাকে বলেই গেলেন।
‘তাই?
হুম।
মনে পড়ছে না। কী বলে গেছে?
‘উনার সিলেটের জাফলংয়ে চাকরি হয়েছে। তাড়াহুড়া করে চলে যেতে হলো।
‘ওহ। আমার মাথায় আজকাল কিছু আসে না। আচ্ছা মা, এখন আমি কী করব বলো তো মা?
ফরিদের কাছে কি খবরটা পাঠাবেন? তার তো জানা দরকার যে পারু এখানে…।’ খুব ইতস্তত করে কথাটা বলল তরু।
মহিতোষ জবাব দিলেন না। চুপ করে বসে রইলেন। তরু বলল, আপনাকে তো বলেছি, শেষবার যখন ফরিদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, তখন সে বলেছিল যে বাড়ি যাচ্ছে। ভুবনডাঙা। তারপর থেকে তো আর কোনো খোঁজ নেই…।’
মহিতোষ বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘কী জানি! কোনো চিন্তাই ঠিকঠাক গুছিয়ে করতে পারছি না।’
ফরিদকে কি একটা চিঠি লিখবেন আপনি?
‘কী লিখব?
‘পারুর কথা। ওর সন্তানের কথা।
মহিতোষ আবারও চুপ করে রইলেন। দীর্ঘসময়। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। পরের দুটো দিন কারো সঙ্গেই কথা বললেন না তিনি। তবে মাঝে মাঝে পারুর সন্তানটিকে আড় চোখে দেখেন। নিজের সঙ্গে একটা অবচেতন যুদ্ধে যেন শামিল হন। কিন্তু সেই যুদ্ধে প্রবল ওই বাধার কাছে বারবার পরাস্ত হতে থাকেন। একটা প্রচণ্ড অস্বস্তি সারাক্ষণ তাড়া করতে থাকে। গুটিয়ে রাখে। নির্ভার হতে দেয় না।
অনেক ভেবে দিনতিনেক বাদে অবশেষে নিজেই চিঠি লেখেন ফরিদকে। মাত্র দুই লাইনের চিঠি।
‘ফরিদ, পারুকে খুঁজিয়া পাইয়াছি। সে এখন আমার কাছেই আছে। তুমি পত্র পাওয়া মাত্র ঢাকায় চলিয়া আসিবা। আমরা তরুর কাছেই আছি।
ইতি- মহিতোষ মাস্টার।
বি.দ্র. পারু আর তোমার একটি কন্যাসন্তান হইয়াছে। তুমি আসিলে তাহার নাম রাখা হইবে।
মহিতোষ চিঠি পাঠালেন কলকাতাতেও। যদ্রুত সম্ভব তিনি অঞ্জলিদের কাছে ফিরে যেতে চান। কিন্তু পারুর বিষয়টা কী হবে সে বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। অন্তত এই অবস্থায় পারুকে নিয়ে কলকাতা যাওয়া সম্ভব নয়। সেখানে আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। তারা পারুকে এভাবে কিছুতেই গ্রহণ করবে না। তা ছাড়া, ফরিদের সিদ্ধান্তেরও বিষয় আছে। তবে একটা বিষয় মহিতোষ আবিষ্কার করলেন, পারুর সঙ্গে কোথায় যেন তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যে পারুর জন্য তিনি। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটেছেন। যে পারুকে তিনি ভুবনডাঙায় কিংবা রতনপুরে রেখে এসেছেন, সেই পারু আর এই পারুর মধ্যে যেন বিস্তর ব্যবধান। এই পারুকে তার সেই ছোট্ট পারু বলে আর মনে হয় না। মনে হয়, এ অন্য এক মানুষ। মাত্র। অল্পকিছু সময়, এই সময়টুকুতে জীবন এমন বদলে যেতে পারে?
মহিতোষ বারান্দার কোনায় চেয়ারটাতে বসে সারাক্ষণ এমন কত কী ভাবেন! আর চোরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। মাঝে মাঝে পারুর জন্য তার আশ্চর্য এক ধরনের কষ্ট হয়। তবে সেই কষ্টটা রতনপুর স্টেশনের আগ অবধি পারুর জন্য। যেন সেই পারুই এখনো তার বুকের ভেতর সযত্নে সঞ্চিত আছে। সময়ে-অসময়ে সে কনকনে ঠাণ্ডা হিম হাওয়ার মতো বুক কাঁপিয়ে ধেয়ে আসে। তখন অবর্ণনীয় হাহাকারের মাতম বয়ে যায়। সেই হাহাকার তিনি বয়ে বেড়াতে থাকেন অহর্নিশ। তারপর চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো এই পারুকে দেখেন। তার জন্যও কষ্ট হয়। কিন্তু এই কষ্টের ধরনটা যেন আলাদা। এখানে শীর্ণ, দুঃখী, ক্লান্ত পারুর জন্য তার কষ্ট হয়। যে জীবনযন্ত্রণার ভারে ন্যুজ, পর্যদস্ত। একটা ঝলমলে রঙিন ফুল হঠাৎ শুকিয়ে ম্লান হয়ে গেলে তাকে দেখে যেমন কষ্ট হয়, তেমন। এই কষ্ট মনের চেয়েও বেশি চোখের।
কিন্তু ওই যে ওই পারু, যে ভুবনডাঙায় বাবার বুকের কাছে আশ্চর্য মায়ার স্পর্শ হয়ে লেগে থাকত, তার জন্য বুক ভেঙে যায় মহিতোষের। কান্না পায়। মনে হয়, জীবন কি ওই সময়টা তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে না? কে জানে, হয়তো তিনি ফিরে পেতে চান আগের সেই নিজেকেও। এই সর্বগ্রাসী সময় তাকেও তো কম কেড়ে নেয়নি। তিনিও তো আগের সেই মানুষটি আর নেই। এ এক অন্য মহিতোষ। অন্য পারু। অন্য জীবন। সময় এমনই, আড়ালে-আবডালে শুষে নিতে থাকে কত শত জীবনের ঘ্রাণ, বেঁচে থাকা প্রাণ।
.
মাস কেটে গেলেও মহিতোষের চিঠির জবাব আর আসে না। না অঞ্জলির। না ফরিদের। চিন্তিত মহিলোষ আবার চিঠি পাঠান। আবার। তারপর একদিন জবাব আসে তার কাছে। ভুবনডাঙা থেকে চিঠি এসেছে। কিন্তু সেই চিঠি পড়ে তার মনে হতে থাকে জীবন তার নিষ্ঠুর খেলা এখনো শেষ করেনি। বরং এ যেন শুরু অন্য এক জীবনের। সেই জীবন আরো ভয়ংকর। আরো যন্ত্রণাময় অন্ধকারের।