৩৫. বিগ ব্যাং

৩৫. বিগ ব্যাং

…আমরাও নক্ষত্ৰচুৰ্ণ..

গ্লাইডারে বাবার পাশে আরাম করে বসল হিল্ডা। প্রায় মাঝরাত এখন। উপসাগরটার দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে। দুয়েকটা তারা হালকাভাবে মিটমিট করছে উজ্জ্বল আকাশে। ডকের নিচে শান্ত ঢেউগুলো এসে পড়ছে পাথরের ওপর।

হিল্ডার বাবাই নীরবতা ভাঙলেন।

এটা ভাবলে অদ্ভুত লাগে যে মহাবিশ্বের ক্ষুদে একটা গ্রহে বাস করি আমরা।

হ্যা…

সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলা বেশ কটি গ্রহের একটি হচ্ছে এই পৃথিবী। সম্ভবত পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণ আছে।

গোটা মহাবিশ্বেই সম্ভবত একমাত্র তাই না?

সেটা অসম্ভব নয়। কিন্তু এটাও সম্ভব যে মহাবিশ্ব প্রাণে পরিপূর্ণ। মহাবিশ্ব এতো বড় যে কল্পনাও করা যায় না। একটি বস্তু থেকে আরেকটি বস্তু এতো দূরে যে যে আলোক-মিনিট আর আলোক-বর্ষ দিয়ে মাপা হয় এই দূরত্ব।

আলোক-মিনিট আর আলোকবর্ষ আসলে কী?

এক মিনিটে আলো য দূরত্ব অতিক্রম করে সেটাই আলোক- মিনিট। এবং সেটা কিন্তু নেহাত কম নয়, তার কারণ শূন্যের ভেতর দিয়ে আলো সেকেন্ডে ৩০০,০০০ কিলোমিটার গতিতে ছোটে। তার মানে, এক আলোক-মিনিট হলো ৩০০,০০০-র ৬০ গুণ অর্থাৎ ১ কোটি ৮০ লাখ কিলোমিটার। এক আলোক-বর্ষ হলো প্রায় ১০,০০০ কোটি কিলোমিটার।

সূর্য কত দূরে?

আট আলোক-মিনিটের চেয়ে সামান্য বেশি দূরে। জুন মাসের গরম কোননা দিনে যে-সূর্যরশ্মি এসে আমাদের মুখটাকে উত্তপ্ত করে তোলে তা মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে আট মিনিট ধরে ছোটার পর তবেই আমাদের কাছে পৌঁছায়।

বলে যাও…

আমাদের সৌর জগতের সবচেয়ে দূরের গ্রহ পুটো রয়েছে আমাদের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ আলোক-ঘণ্টা দূরে। একজন জ্যোতির্বিদ যখন তার দূরবীণের ভেতর দিয়ে পুটোর দিকে তাকান তখন কিন্তু তিনি আসলে সময়ের দিক থেকে পাঁচ ঘণ্টা পেছনে তাকান। আমরা এভাবেও বলতে পারি যে পুটোর ছবি এখানে আসতে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে।

ব্যাপারটা ভিজুয়ালাইজ করা কঠিন, তবে মনে হয় আমি বুঝতে পারছি।

 তা বেশ। তবে কথা কী জানিস, আমরা এই পৃথিবীর বাসিন্দারা কিন্তু আমাদের পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সবে মাত্র পরিচিত হতে শুরু করেছি। আমাদের সূর্যটা ছায়াপথ (Milky Way) নামে পরিচিত গ্যালাক্সির ৪০০ বিলিয়ন তারার একটা। এই গ্যালাক্সিটা দেখতে একটা বিশাল চাকতির মতো আর আমাদের সূর্যটা রয়েছে। সেটার ইস্কুপের মতো পেঁচালো বেশ কিছু বাহুর একটিতে। পরিষ্কার শীতের রাতে আকাশের দিকে তাকালে তারার একটা চওড়া ফিতা দেখতে পাই আমরা। তার কারণ তখন আমরা আসলে গ্যালাক্সিটার কেন্দ্রের দিকে তাকাই।

আমার মনে হয় সেজন্যেই সুইডিশ ভাষায় ছায়াপথটাকে শীতের সড়ক বলে।

ছায়াপথে যে-তারাটা আমাদের সবচেয়ে কাছের পড়শী সেটা রয়েছে চার আলোক-বর্ষ দূরে। হয়ত দূরের ঐ দ্বীপটা থেকেও ব্যাপারটা এ-রকম। কল্পনা কর যে ঠিক এই মুহূর্তে এক নক্ষত্র পর্যবেক্ষক বিয়ার্কলের দিকে তাক করা একটা শক্তিশালী দূরবীণ চোখে লাগিয়ে বসে আছে-তো, সেই লোকটি ঠিক চার বছর আগের বিয়ার্কলে-কে দেখতে পাবে। হয়ত যে দেখবে এগারো বছর বয়েসী একটি মেয়ে গ্লাইডারে বসে পা দোলাচ্ছে।

অবিশ্বাস্য।

অথচ এটা কিন্তু বললাম সবচেয়ে কাছের তারাটার কথা। পুরো গ্যালাক্সিটা-সেটাকে নীহারিকা-ও (nebula) বলে-৯০,০০০ আলোক বর্ষ চওড়া। অন্যভাবে বললে, গ্যালাক্সি-র এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আলো ছুটে যেতে ৯০,০০০ বছর লাগে। ছায়াপথের যে-তারাটা আমাদের সূর্য থেকে ৫০,০০০ আলোক-বর্ষ দূরে সেটার দিকে যখন আমরা তাকাই তখন আমরা আসলে ৫০,০০০ বছর পেছন দিকে তাকাই।

আমার ছোট্ট মাথার পক্ষে আইডিয়াটা বড্ড ভারি।

তো, মহাশূন্যের দিকে তাকানোর একটাই অর্থ আর তা হলো সময়ের দিকে পেছন ফিরে তাকানো। মহাবিশ্বটা ঠিক এই মুহূর্তে কীরকম সেটা আমরা কখনোই জানতে পারি না। আমরা কেবল জানতে পারি তখন সেটা কেমন ছিল। হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরের তারার দিকে যখন আমরা মুখ তুলে তাকাই তখন আসলে আমরা মহাশূন্যের ইতিহাসে হাজার হাজার বছর পেছনে চলে যাই।

রীতিমত ধারণার অতীত একটা ব্যাপার এটা।

তবে আমরা যা দেখি তার সবই আলোক তরঙ্গ হিসেবে চোখের সঙ্গে মিলিত হয়। আর এই আলোক তরঙ্গগুলো মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে ছোটার সময় কিছু সময় নেয়। বজ্রকে দিয়ে একটা তুলনা দেখাতে পারি আমরা এটার সঙ্গে। বাজ পড়ার আওয়াজ শোনার আগেই বিজলীর চমক নজরে পড়ে আমাদের। তার কারণ, শব্দতরঙ্গের গতি আলোক তরঙ্গের গতির চেয়ে কম। যখন আমি বজ্বের আওয়াজ শুনি তখন আমি এমন একটা জিনিসের আওয়াজ শুনি যেটা খানিকক্ষণ আগে ঘটে গেছে। তারার বেলাতেও ব্যাপারটা একই। যখন আমি হাজার হাজার আলোক-বর্ষ দূরের কোনো তারার দিকে তাকাই তখন আমি এমন একটা ঘটনার গুরু গুরু মেঘের গর্জন দেখতে পাই যেটা ঘটেছিল সময়ের হিসেবে হাজার হাজার বছর আগে।

হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।

কিন্তু এতোক্ষণ আমরা কেবল আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সি নিয়েই কথা বলেছি। জ্যোতির্বিদরা বলেন মহাবিশ্বে এ-ধরনের প্রায় একশো বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে আর এ-সব গ্যালাক্সির প্রতিটিতে রয়েছে প্রায় একশো বিলিয়ন তারা। ছায়াপথের সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সিকে আমরা বলি অ্যান্ড্রোমিডা নেবুলা। আমাদের গ্যালাক্সি থেকে ওটা ২০ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। তার মানে, সেই গ্যালাক্সি থেকে আমাদের কাছে আলো এসে পৌঁছাতে বিশ লক্ষ বছর লাগে। কাজেই, আকাশের অনেক উঁচুতে যখন আমরা অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিটাকে দেখি তখন আমরা ২০ লক্ষ বছর পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই নীহারিকায় যদি কোনো চতুর নক্ষত্র পর্যবেক্ষক থেকে থাকে-আমি এমনকী কল্পনাও করতে পারি যে ঠিক এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর দিকে তার দূরবীণ তাক করে বসে আছে-তাহলে কিন্তু সে আমাদের দেখতে পাবে না। বরাত ভালো হলে সে দেখবে চ্যাপ্টা মুখো নিয়ান্ডারথালদের।

আশ্চর্য ব্যাপার তো।

সবচেয়ে দূরের যে-সব গ্যালাক্সির কথা বর্তমানে আমাদের জানা আছে সেগুলো রয়েছে দশ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। এ-সব গ্যালাক্সি থেকে যখন আমরা সংকেত পাই তখন আমরা আসলে মহাবিশ্বের ইতিহাসে দশ বিলিয়ন বছর পিছিয়ে যাই। আমাদের নিজেদের সৌর জগতের যা বয়স, এইসময়টা তার প্রায় দ্বিগুণ।

তোমার কথা শুনে মাথা ঝিম ঝিম করছে আমার।

সময়ের দিক থেকে এতো পেছনের দিকে তাকানোর ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করা যদিও যথেষ্ট কঠিন, তারপরেও জ্যোতির্বিদরা কিন্তু আমাদের বিশ্বচিত্রের জন্যে আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আবিষ্কার করেছেন।

কী সেটা?

দৃশ্যত কোনো গ্যালাক্সি-ই কিন্তু সেটা যেখানে রয়েছে সেখানে থাকে না। মহাবিশ্বের সমস্ত গ্যালাক্সি প্রচণ্ড গতিতে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমাদের কাছ থেকে সেগুলো যত দূরে ততোই দ্রুত সরে যাচ্ছে সেগুলো। তার মানে হচ্ছে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যেকার দূরত্ব সারাক্ষণ-ই বেড়ে চলেছে।

ব্যাপারটা কল্পনা করার চেষ্টা করছি।

একটা বেলুনের গায়ে তুই যদি কিছু কালো চিহ্ন এঁকে দিস তাহলে বেলুনটা ফোলানোর সময় চিহ্নগুলো একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর ক্ষেত্রেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটছে। আমরা বলি, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে।

তার কারণ কী?

বেশিরভাগ জ্যোতির্বিদই এ-ব্যাপারে একমত যে প্রসারণশীল মহাবিশ্বের মাত্র একটাই ব্যাখ্যা আছে; ১৫ বিলিয়ন বছর আগে একবার মহাবিশ্বের সমস্ত জিনিস তুলনামূলকভাবে ছোট্ট একটা জায়গাতে জড়ো হয়েছিল। সেটার ঘনত্ব এতোই বেশি ছিল যে মহাকর্ষের কারণে তা ভয়ংকর উত্তপ্ত হয়ে উঠে। শেষ পর্যন্ত তা এতোই গরম আর এতো ঘনসন্নিবদ্ধ হয়ে ওঠে যে সেটা বিস্ফোরিত হয়। এই বিস্ফোরনকে আমরা বলি বিগ ব্যাং (Big Bang)।

কথাটা চিন্তা করতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে আমার।

 বিগ ব্যাং-এর কারণে মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু চারদিকে ছিটকে পড়ে এবং ধীরে ধীরে তা ঠাণ্ডা হলে সেগুলো থেকেই তৈরি হয় তারা, গ্যালাক্সি, চাঁদ আর গ্রহগুলো…

কিন্তু তুমি যে বলছিলে মহাবিশ্ব এখনো প্রসারিত হচ্ছে?

হ্যাঁ বলেছি আর বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগের সেই বিস্ফোরণটার কারণেই এটা প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের কোনো সময় নিরপেক্ষ ভূগোল নেই। মহাবিশ্ব একটা ঘটনা। মহাবিশ্ব একটা বিস্ফোরণ। গ্যালাক্সিগুলো মহাবিশ্বের ভেতর দিয়ে প্রবল গতিতে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে ছুটে যাচ্ছে।

কাজটা কি ওগুলো অন্তহীনভাবেই করে যাবে?

সে-রকম একটা সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আরেকটাও আছে। তোর হয়ত মনে আছে যে অ্যালবার্টো আর সোফি দুটো শক্তির কথা বলেছিল যে-শক্তির কারণে গ্রহগুলো সূর্যকে অনবরত প্রদক্ষিণ করে যায়।

সেই শক্তি দুটো হচ্ছে মহাকর্ষ আর জড়তা, তাই না?

ঠিক এবং একই ব্যাপার গ্যালাক্সিগুলোর বেলাতেও প্রযোজ্য। কারণ মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হয়ে চলেছে ঠিকই, কিন্তু মহাকর্ষ বলও কাজ করছে অন্য দিকে। এবং কয়েক বিলিয়ন বছর পর একদিন সেই বিশাল বিস্ফোরণের শক্তিটা দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করলে মহাকর্ষ সম্ভবত গ্রহ নক্ষত্রগুলোকে আবার একসঙ্গে বেঁধে ফেলবে। তখন আমরা পাবো একটা উল্টো বিস্ফোরণ, একটা তথাকথিত সঙ্কোচন। কিন্তু মহাজাগতিক বস্তুগুলোর মধ্যে দূরত্ব এতোই বেশি যে ব্যাপারটা ঘটবে স্লো মোশনে চালানো একটা চলচ্চিত্রের মতো। একটা বেলুন থেকে বাতাস ছেড়ে দিলে যা ঘটে তার সঙ্গে হয়ত ব্যাপারটাকে তুলনা করতে পারিস তুই।

সবগুলো গ্যালাক্সি কি আবার আঁটোসাটো একটা নিউক্লিয়াসের মধ্যে জড়ো হয়ে পড়বে?

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছিস। কিন্তু তারপর কী হবে?

তারপর আরেকটা বিগ ব্যাং হবে আর মহাবিশ্বটা আবার প্রসারিত হতে শুরু করবে। কারণ একই প্রাকৃতিক নিয়মগুলোইতো বহাল রয়েছে। তো, এরপর আবার নতুন নতুন তারা আর গ্যালাক্সির জন্ম হবে।

তোর চিন্তাশক্তির প্রশংসা করতে হয়। জ্যোতির্বিদরা মনে করেন মহাবিশ্বের ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দুটো চিত্র রয়েছে। হয় মহাবিশ্ব অন্তহীনভাবে প্রসারিত হতে থাকবে আর তাতে করে গ্যালাক্সিগুলো দূর থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে, নয়ত মহাবিশ্ব আবার সংকুচিত হতে শুরু করবে। মহাবিশ্ব কত ভারি আর বিশাল সেটার ওপরই নির্ভর করবে কী ঘটবে। আর ঠিক এই ব্যাপারটি জানারই কোনো উপায় খুঁজে পাননি এখন পর্যন্ত জ্যোতির্বিদরা।

কিন্তু মহাবিশ্ব যদি এতোই বড় হয়ে থাকে যে সেটা আবার সংকুচিত হতে শুরু করবে তাহলে হয়ত আগেও বহুবার এটার সম্প্রসারণ আর সংকোচন ঘটেছে।

সে-রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছানোটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। কিন্তু এই বিষয়ে এসে তত্ত্বটা বিভক্ত হয়ে গেছে। এমনও হতে পারে যে মহাবিশ্বের প্রসারণটা এমন একটা ব্যাপার যা কেবল একবারই ঘটবে। কিন্তু সেটা যদি একেবার অন্তহীনভাবে প্রসারিত হতে থাকে তাহলে সব কিছু কোত্থেকে শুরু হয়েছিল সে-প্রশ্নটা আরো বড় হয়ে দেখা দেয়।

ঠিকই তো, কোত্থেকে এলো এটা, মানে সেই সমস্ত জিনিস যা হঠাৎ করে বিস্ফোরিত হল?

একজন খ্রিস্টান-এর পক্ষে বিগ ব্যাং-কে সৃষ্টির আসল মুহূর্ত হিসেবে দেখাটাই স্বাভাবিক, বাইবেল আমাদের বলে যে ঈশ্বর বলেছিলেন লেট দেয়ার বি লাইট! তোর হয়ত আরো মনে আছে যে অ্যালবার্টো খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করার সময় খ্রিস্টধর্মের একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছিল। সৃষ্টির খ্রিস্টিয় বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এটাই কল্পনা করে নেয়া ভালো যে মহাবিশ্ব কেবল প্রসারিত হয়েই চলেছে।

তাই?

প্রাচ্য ইতিহাসকে দেখে আবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। অন্য কথায়, ইতিহাস অন্তহীনভাবে আবর্তিত হতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতে একটা প্রাচীন তত্ত্ব আছে যে জগৎ অনবরত কুণ্ডলী পাকাচ্ছে এবং আবার সেই জটমুক্ত হচ্ছে আর এভাবেই ভারতীয়দের ভাষায় ব্রাহ্মণ-এর দিন আর ব্রাহ্মণ-এর রাত্রি হচ্ছে পালাক্রমে। এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই ধারণাটি সবচেয়ে ভালোভাবে খাপ খায় এক শাশ্বত আবর্তনশীল প্রক্রিয়ায় প্রসারিত ও সংকুচিত এবং আবার প্রসারিত হওয়া মহাবিশ্বের ধারণার সঙ্গেই। মনে মনে আমি একটা বিশাল মহাজাগতিক হৃৎপিণ্ডের কথা ভাবি যেটা স্পন্দিত হয়েই চলেছে, হয়েই চলেছে…

আমার মনে হয়, দুটো তত্ত্বই একই রকম অভাবনীয় আর একই রকম এক্সাইটিং।

এবং এদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে শাশ্বত সম্পর্কে সেই বিশাল প্যারাডক্সের, যেটার কথা সোফি তার বাগানে বসে ভেবেছিল একবার: মহাবিশ্ব হয়। সব সময়ই ছিল আর নয়ত সেটা হঠাৎ করেই এসে হাজির হয়েছে শূন্য থেকে…

উহ!

 নিজের কপালে একটা চাপড় বসালো হিল্ডা হাত দিয়ে।

কী হলো?

মনে হলো, কোনো পোকা এইমাত্র কামড় দিলো।

সম্ভবত সক্রেটিস তোকে খোঁচা মেরে জীবন সম্পর্কে সচেতন করতে চাইছিলেন।

.

লাল কনভার্টিবলে বসে সোফি আর অ্যালবার্টো মহাবিশ্ব সম্পর্কে হিল্ডাকে বলা মেজরের কথা শুনছিল।

খানিক পর অ্যালবার্টো জিগ্যেস করলেন, খেয়াল করেছে, আমাদের ভূমিকা পুরোপুরি উল্টে গেছে?

কোন অর্থে

আগে ওরাই আমাদের কথা শুনেছে এবং আমরা ওদেরকে দেখতে পেতাম না। এখন আমরা ওদের কথা শুনছি, কিন্তু ওরা আমাদের দেখতে পাচ্ছে না।

শুধু তাই নয়।

কীসের কথা বলছো?

আমরা যখন শুরু করি তখন অন্য বাস্তবতা সম্পর্কে জানতাম না আমরা, জানতাম না যে হিল্ডা আর মেজরেরর অস্তিত্ব রয়েছে। এখন ওরা আমাদের বাস্তবতার কথা জানে না।

প্রতিশোধ বড় মধুর।

 তবে মেজর আমাদের জগতে নাক গলাতে পারতো।

আমাদের জগৎ তো আসলে তারই আবিষ্কার।

 আমরাও যে ওদের জগতে নাক গলাবো সে-আশাটা এখনো ছাড়িনি আমি।

কিন্তু তুমি জানো সেটা অসম্ভব। সিন্ডেরেলায় কী হয়েছিল মনে নেই? সেই বোতলটা ছাড়াবার চেষ্টা করছিলে তুমি, দেখেছি আমি।

সোফি কথা বলল না। মেজর বিগ ব্যাং-এর কথা বলছেন, সোফি বাগানের সেদিকটায় তাকিয়ে আছে। কথাটার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যা তার মনে একটা চিন্তার সূত্রপাত ঘটালো।

গাড়িটার ভেতর হাতড়ে কী যেন খুঁজতে লাগল সে।

কী করছো? অ্যালবার্টো শুধোলেন।

কিছু না।

গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট খুলে একটা রেঞ্জ পেয়ে গেল সে। সেটা শক্ত করে ধরে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো সে গাড়ির ভেতর থেকে। গ্লাইডারটার কাছে গিয়ে হাজির হলো সে, দাঁড়ালো গিয়ে একেবারে হিল্ডা আর তার বাবার সামনে। প্রথমে সে হিল্ডার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল, কিন্তু বৃথাই। শেষে সে রেঞ্জটা মাথার ওপর তুলে সাঁই করে নামিয়ে আনলো হিল্ডার কপাল বরাবর।

উহ্! আর্তনাদ করে উঠল হিল্ডা।

এরপর সোফি মেজরের কপালে আঘাত করল, কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না।

কী হলো? তিনি জিগ্যেস করলেন।

 মনে হলো কোনো পোকা কামড় দিলো এইমাত্র।

সম্ভবত সক্রেটিস তোকে খোঁচা মেরে জীবন সম্পর্কে সচেতন করতে চাইছিলেন।

ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল সোফি, ঠেলতে চেষ্টা করল গ্লাইডারটাকে। কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেটা। নাকি এক মিলিমিটার খানেক নড়াতে পারল সে ওটাকে?

হিম ঠাণ্ডা একটা বাতাস আসছে, হিল্ডা বলল।

না তো, বাতাসটা তো খুবই মোলায়েম।

না, শুধু তাই না। কিছু একটা আছে এর মধ্যে।

 তা সেটা কী হতে পারে বলে মনে হয় তোর?

অ্যালবার্টো আর তার গোপন পরিকল্পনার মনে আছে তোমার?

কী করে ভুলি!

ওরা স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছিল গার্ডেন পার্টি থেকে। যেন একেবারে বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিল ওরা…

…একেবারে বাতাসে।

 গল্পটাতো শেষ করতে হতো কোথাও। ওটা তো স্রেফ আমি যা লিখেছিলাম তাই।

তা ঠিক, হা, কিন্তু তার পরে যা ঘটেছিল তা নয়। ধরো যদি ওরা এখানে থেকে থাকে…

তুই কি সত্যিই তাই বিশ্বাস করিস?

আমি সেটা টের পাচ্ছি, বাবা।

সোফি দৌড়ে ফিরে গেল গাড়িটার কাছে।

ইম্প্রেসিভ, রেঞ্জটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে গাড়িটায় সোফি উঠে বসতে অসন্তুষ্টির সুরে অ্যালবার্টো বললেন। অসাধারণ প্রতিভাধর তুমি, সোফি। স্রেফ বসে বসে দেখো, কী হয়।

.

মেজর হিল্ডাকে আলিঙ্গন করলেন।

ঢেউ-এর রহস্যময় খেলাটা শুনতে পাচ্ছো তুমি?

হ্যাঁ। কাল কিন্তু নৌকোটা পানিতে নামাতেই হবে।

কিন্তু তুমি কি বাতাসের অদ্ভুত ফিসফিসানি শুনতে পাচ্ছে? দেখো, পপলার গাছের পাতাগুলো কীভাবে কাঁপছে?

গ্রহটা সজীব, তুই তো জানিস…

তুমি লিখেছিলে কিছু কথা প্রচ্ছন্নভাবে আছে।

 লিখেছিলাম বুঝি?

আমার মনে হয় এই বাগানেও প্রচ্ছন্নভাবে কিছু আছে।

 প্রকৃতি রহস্যে ভরা। কিন্তু আমরা কথা বলছিলাম আকাশের তারাদের নিয়ে।

শিগগিরই পানিতেও তারা দেখা যাবে।

তা ঠিক। যখন তুই ছোট ছিলি তখন অনুপ্রভা (phosphorescence) সম্পর্কে ঠিক এই কথাই বলতি। এক হিসেবে ঠিকই বলতি তুই। একটা তারার ভেতর যে সব জিনিস এক সময় মিলেমিশে গিয়েছিল, অনুপ্রভা আর অন্য সব অরগ্যানিজম সে-সব জিনিস দিয়েই তৈরি।

আমরাও?

হ্যাঁ, আমরাও নক্ষত্ৰচুৰ্ণ।

কথাটা সুন্দর তো।

রেডিও টেলিস্কোপ যখন বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা আলোকরশ্মির খোঁজ পাবে তখন বিগ ব্যাং-এর পরে মহাবিশ্ব দেখতে কেমন ছিল তার একটা চিত্র পাওয়া যাবে। আকাশে আমরা যা দেখি তার সবই হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বছর আগের মহাজাগতিক জীবাশ্ম। জ্যোতিষি কেবল যে-কাজটা করতে পারে তা হলো অতীত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা।

কারণ নক্ষত্রপুঞ্জগুলোর আলো আমাদের কাছে পৌঁছুবার অনেক আগেই, সেগুলো পরস্পরের কাছ থেকে দূরে চলে গেছে। ঠিক?

এমনকী দুই হাজার বছর আগেও নক্ষত্রপুঞ্জগুলোকে এখনকার চেয়ে যথেষ্ট অন্যরকম দেখাতো।

সেটা তো জানতাম না।

পরিষ্কার রাত হলে মহাবিশ্বের বহু মিলিয়ন এমনকী বহু বিলিয়ন পুরনো ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে পারি আমরা। কাজেই, এক অর্থে আমরা আমাদের বাড়িতে যাচ্ছি।

বুঝতে পারছি না কী বলতে চাও।

তোর আর আমার শুরুও বিগ ব্যাং থেকে, কারণ মহাবিশ্বের সমস্ত জিনিসই একটি অরগ্যানিক সত্তা। আদিম এক যুগে একবার সমস্ত বস্তু এমন একটা অসম্ভবরকমের বিশাল পিণ্ডর মতো হয়ে একসঙ্গে জড়ো হয়েছিল যে একটা পিনের মাথার ওজনই ছিল বেশ কয়েক বিলিয়ন টন। এই আদিম পরমাণু-টি বিস্ফোরিত হলো প্রচণ্ড মহাকর্ষের কারণে। ব্যাপারটা ছিল এমন যেন কিছু একটা একেবারে নেই হয়ে গেল। যখন আমরা আকাশের দিকে তাকাই তখন আমরা আমাদের নিজেদের দিকেই ফিরে তাকানোর চেষ্টা করি।

কী অসাধারণভাবে বলা হলো কথাটা।

মহাবিশ্বের সমস্ত তারা আর গ্যালাক্সি একই জিনিস দিয়ে তৈরি। সেটার খানিকটা এক সঙ্গে জড়ো হয়েছে, কিছু এখানে, কিছু ওখানে। এক গ্যালাক্সি থেকে আরেক গ্যালাক্সির দূরত্ব বহু বিলিয়ন আলোকবর্ষ হতে পারে। কিন্তু তাদের সবারই উৎস এক। সব তারা আর সব গ্রহই একই পরিবারের সদস্য।

হা, বুঝতে পারছি।

কিন্তু এই জাগতিক বস্তুটা কী? বহু বিলিয়ন বছর আগে যে-জিনিসটা বিস্ফোরিত হলো সেটা কী ছিল? কোত্থেকে এলো সেটা?

এটা একটা বড় প্রশ্ন।

এমন একটা প্রশ্ন যার সঙ্গে আমরা সবাই গভীরভাবে জড়িত। কারণ আমরা নিজেরাও সেই জিনিস দিয়ে তৈরি। বহু বিলিয়ন বছর আগে যে-আগুন জ্বালানো হয়েছিল, আমরা সেই বিশাল আগুনেরই একটা স্ফুলিঙ্গ।

এটাও কিন্তু একটা সুন্দর কথা।

অবশ্য, এ-সব ব্যাপার বা কথাবার্তার গুরুত্বকে যেন আমরা অতিরঞ্জিত করে না ফেলি। হাতের মধ্যে স্রেফ একটা পাথর ধরাটাই যথেষ্ট। কমলার আকারের সেই পাথরটা দিয়েও যদি মহাবিশ্ব তৈরি হতো, তাহলেও সেটা একই রকম অচিন্তনীয় এবং অবোধ্য থেকে যেতো। প্রশ্নটা একই রকমের দুয়ে থেকে যেতো: পাথরটা কোত্থেকে এসেছিল?

.

হঠাৎ করে লাল কনভার্টিবলের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল সোফি। আঙুল তুলে দেখাল উপসাগরটার দিকে।

নৌকোটা একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই,বলল সে।

ওটা বাধা আছে। তাছাড়া, আমরা দাঁড়গুলো তুলতে পারবো না।

চেষ্টা করে দেখি? শত হলেও, এখন মিডসামার ঈভ।

 অন্তত পানি পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে।

গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে বাগানের ভেতর দিয়ে ছুটল দুজন।

ধাতব একটা আংটার সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা দড়িটা খোলার চেষ্টা করল দুজন। কিন্তু একটা প্রাভও তুলতে পারল না তারা।

মনে হচ্ছে পেরেক দিয়ে গাঁথা, অ্যালবার্টো বললেন।

অনেক সময় আছে আমাদের হাতে।

সত্যিকারের দার্শনিক কখনো হাল ছেড়ে দেন না। আমরা যদি শুধু…এটাকে ঢিলে করে দিতে পারি… আকাশে এখন আরো বেশি তারা, হিল্ডা।

হ্যাঁ, গ্রীষ্মের রাত এখন সবচেয়ে অন্ধকার।

তবে শীতকালেই কিন্তু ওগুলো বেশি জ্বল জ্বল করে। লেবাননে চলে যাওয়ার আগের রাতটার কথা মনে পড়ে তোমার? সেদিন ছিল নববর্ষের প্রথম দিন।

সেদিনই তোর জন্যে দর্শনের একটা বই লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি। ক্রিস্টিয়ানস্যান্ডের একটা বড় বইয়ের দোকান আর লাইব্রেরিতেও গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু কিশোর-কিশোরীদের উপযোগী কিছুই ছিল না ওদের কাছে।

ব্যাপারটা যেন এ-রকম যে সাদা খরগোশের মিহি লোমগুলোর একেবারে ডগায় বসে আছি আমরা।

বহু আলোকবর্ষ দূরে রাতের বেলা কেউ বসে আছে কিনা ভাবছি।

নৌকোটা নিজে নিজেই বাঁধন-আলগা হয়ে গেছে।

তাই তো!

বুঝতে পারছি না আমি ব্যাপারটা। নিচে গিয়ে নিজে দেখে এসেছিলাম আমি তুমি এখানে আসার আগে।

তাই?

সোফি যে অ্যালবার্টোর নৌকোটা ধার করেছিল, সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। তোমার মনে আছে কীভাবে লেকের মধ্যে এলোমেলোভাবে ভাসছিল ওটা?

আমি বাজি ধরে বলতে পারি এবারও সেই কাজটা করেছে।

যাও, আরো ঠাট্টা করো আমাকে নিয়ে। সারা সন্ধ্যা জুড়েই আমার মনে হয়েছে কেউ রয়েছে এখানে।

আমাদের একজনকে সাঁতার কেটে যেতে হবে ওটার কাছে। আমরা দুজনেই যাবো, বাবা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *