৩৫
‘বজ্জাতের ধাড়ি।’ কে. গুপ্ত বনমালীর দিকে তাকায়। ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি। হুট করে সময় বুঝে চারু কেমন কেটে পড়ল দ্যাখ।’
বনমালী কথা না বলে হিসাবের খাতায় চোখ রাখল।
‘কি মশাই, আপনি চুপ করে বসে আছেন কেন।’
শিবনাথ কিছু বলতে না পেরে কে. গুপ্তর দিকে তাকিয়ে ছিল, তাই এই প্ৰশ্ন।
‘কি ব্যাপার?’ হাসতে চেষ্টা করল শিবনাথ
‘ব্যাপার তো আপনাকে নিয়েই।’ ঝাঁকড়া চুল সমেত মাথাটা নেড়ে গুপ্ত দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরালে। দেশলাইটা চারু রায় ভুলে ফেলে গেছে।
‘সে জন্যেই তো আপনাকে ডাকছিলাম।’ এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে কে. গুপ্ত ঘুরে শিবনাথের দিকে সোজা হয়ে বসল। হুব্লার কথা শুনে ওই-তো এতক্ষণ বেশি নাচানাচি করছিল। চারু।’
‘কি রকম?’ শিবনাথ ঢোক গিলল।
‘কিরে বনমালী, বল না কি বলছিল। তোর নুন পেঁয়াজের হিসাব এখন রাখ্।’
‘আমার কি গরজ। তুমি বল। এক বাড়িতে আছ তোমরা।’
কে. গুপ্ত খুব করে কেশে হাতের সিগারেটের ছাই ঝাড়ল। কাশল কি হাসল মুখটা নোয়ানো বলে ঠিক বোঝা গেল না। মুখ তুলে বলল, ‘হুবলার রিপোর্ট শুনে চারু আমায় বলে–দ্যাট জেন্টেলম্যান মাস্ট বি এনাদার বেকার।’ ক্রাইসিস পিরিয়ড আরম্ভ হয়েছে। ইস্কুলের চাকরি করে আর কত মাইনে পাবেন মহিলা। হ্যাঁ, আপনার স্ত্রীর কথা বলছিল চারু। বলতে বলতে শালা হুট করে বলে কিনা এই বেলা তুমি একটা অ্যাটেম্পট নাও গুপ্ত, হয়তো ভদ্রলোক রাজী হবেন, হ্যাঁ আপনি। বলল, বস্তি লাইফের ইতর ও জঘন্য দিকটা যেমন আছে, তেমনি একটা হোপ, আলোর দিকটাও থাকবে। এভ্রি ক্লাউড হ্যাঁজ্ ইটস্ সিলভার লাইনিং। মানে অশিক্ষিতা নিপীড়িতা মেয়ে যেমন থাকবে, তেমনি শিক্ষিতা উন্নতমনা, যিনি এদের পথ দেখিয়ে নেবেন, তার জন্য মেয়ে চরিত্রের পার্ট করার স্কোপ তার মায়া-কানন বইতে আছে। তুমি একবার নক্ কর গুপ্ত। বহু ভদ্রঘরের মেয়ে আজ অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে এই কনসার্ন সেই কনসার্নের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে নানা বইয়ে নামছে। এন্ড দে আর আর্নিং এ লট। বলল, শোভাবাজারের বিখ্যাত নাগ বংশের কে এক নগেন ডাক্তারের স্ত্রী সিনেমায় নেমে দু’মাসের মধ্যে লিনটন স্ট্রীটে বাড়ি কিনল, গাড়ি কিনল এবং স্বামীর জন্যে হ্যারিসন রোডের ওপর এত বড় ডিসপেন্সারী খুলে দিল! শোভাবাজারের কানাগলির নগেন ডাক্তারের কাছে মাগনা চিকিৎসা করাতেও কেউ ঘেঁষত না। এখন তারই বা কত নামডাক, কী অসাধারণ হাতযশ। তুমি একবার বুঝিয়ে বল গুপ্ত তোমাদের শিবেন্দ্রলালবাবুকে।’
‘আমার নাম শিবনাথ।’ শিবনাথ গম্ভীর হয়ে বলল।
‘অই একই কথা। টার্গেট ঠিক আছে। এতক্ষণ লাফালাফি করছিল চারু। আপনাকে আসতে দেখেই চুপ মেরে গেল। মানে দায়ের কোপ আপনার মাথায় আমাকে বসাতে বলে শালা সুরসুর করে কেটে পড়ল আর কি।’ কথা শেষ করে কে. গুপ্ত মুখের এমন ভঙ্গি করে হাসল যে, শিবনাথ না হেসে পারল না।
‘তা সিনেমায় আজকাল বহু ভদ্রঘরের মেয়েরা নামছেন। নিন্দার কিছু নেই। অবশ্য এতে যোগ দেওয়া না দেওয়া ব্যক্তিগত রুচির উপর নির্ভর করে। আমার স্ত্রী সম্পর্কে প্রস্তাব দিতে বন্ধুকে আপনি কিছু বললেন না?’ শিবনাথ একটা চোখ ছোট করে কে. গুপ্তর দিকে তাকায়। ‘আমার বয়ে গেছে। তা ছাড়া সময় পেলাম কই। কথাটা তুলেই হারামজাদা আপনি আসার সঙ্গে সঙ্গে পিঠ দেখাল দেখলেন তো।’
এতক্ষণ পর হিসাবের খাতা থেকে মুখ তুলে বনমালী হাসল।
‘এবার জিজ্ঞেস করুন না শিববাবু, বন্ধুর ওপর আমাদের গুপ্ত আজ এত খাপ্পা কেন।’
‘কি ব্যাপার।’ শিবনাথ অস্ফুটে বলল এবং একটা কিছু অনুমানও করল। কে. গুপ্ত হঠাৎ কথা বলে না।
বনমালী বলল, ‘আজ সকালে গুপ্ত ঘোলপাড়ায় গিয়েছিল। কিরণ নাকি পষ্টাপুষ্টি বলে দিয়েছে কে. গুপ্ত যেন ওবাড়ি না ঢোকে। অমল রাগ করে।’
‘কেন, চারুবাবু কি সেখানে ছিলেন না?’ শিবনাথ আড়চোখে কে. গুপ্তকে দেখে পরে বনমালীর দিকে তাকায় ও ঠোঁট টিপে হাসে। ‘এটা তো গুপ্তবাবুকে ইনসাল্ট করা হয়েছে।’
চারু ছিল না মানে? কি হে গুপ্ত বল না। চারু কাল রাত্রেও ওখানে ছিল। সাকালে কে গুপ্ত গিয়ে দেখে বিছানার ওপর গোল হয়ে বসে তিনজন মানে চারু অমল আর কিরণ চা- রুটি ডিমের বড়া খাচ্ছে আরামসে, আর খুব গল্পগুজব করছে।’
শিবনাথ চুপ করে রইল।
কে. গুপ্ত আধোবদন। যেন কি ভাবছে। আঙুলের ফাঁকে সিগারেটটা জ্বলছে।
‘খাওয়া-দাওয়া নেই। উপোস থাকে গুপ্ত। তা ওদের কি উচিত ছিল না অন্তত একটা বিস্কুট এক কাপ চা খাইয়ে তারপর ধীরেসুস্থে সেখানে যাতে আর সে না যায় বলে দেওয়া। কিরণটা নাকি বেড়ালের মত চোখ করে গুপ্তকে ধমক দিয়ে উঠেছিল।’
‘কিরণের কিচ্ছু দোষ নেই। সব ওই চারুর চালাকি। যেভাবে শিখিয়েছে সে কিরণকে। কে. গুপ্ত শিবনাথকে বোঝাল, ‘বুঝলেন মশাই, কিরণ আমাকে ভিতরে ভিতরে ভীষণ লাইক করে। এবাড়িতে থাকতে আমি ওর চোখ দেখে টের পেয়েছিলাম। আফটার অল সী ইজ নট এ ব্যাড গার্ল।’
অল্প হাসল শিবনাথ।
‘তা আপনি জিজ্ঞেস করুন না ওর কমিশনের কি হল।’ বনমালী হাসল। ‘আসল ব্যাপারের কি।
বনমালীর কথায় শিবনাথ প্রশ্ন করল, ‘তা কিরণের সঙ্গে কিছু কন্ট্রাক্ট হয়েছে কি চারুবাবুর? লেখাপড়া? প্রথম বইয়ে নামছে, আগাম এত টাকা? অমল রাজী আছে তো?’
‘ওই তো চালাকি মশাই, চারু বলছে দেরি হবে। বলছে এখনই সে কথাটা তুলছে না। বলছে, হয়তো সে এভাবে এখন কথা তুলবেই না। এবং এ-দুটি স্বামী-স্ত্রীর জীবনের ওপর তার কেমন একটা পার্সোন্যাল ইন্টারেস্ট জন্মে গেছে। শুনুন মশাই শুনুন। মায়া। একটা সফ্ট কর্নার সৃষ্টি করছে তার বুকে অমল সেদিন ঘোলপাড়ার ঘরে গিয়ে। কি না! চারুকে টিপ করে প্রণাম করে নাকি বলেছে গোঁয়ার অমল, আপনি আমার বড় ভাই, অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়ে আমাদের রক্ষা করেছেন, কাজেই আপনাকে অবিশ্বাস করব না, আমি কিরণকে আপনার হাতে ছেড়ে দিচ্ছি, যা-খুশি তা করুন।’
হঠাৎ এত উদার? কেন, চারু কি তখনই পকেট থেকে আর এক গোছা নোট তুলে অমলের হাতে গুঁজে দিয়েছিল নাকি?’ শিবনাথ কে. গুপ্তর চোখের দিকে তাকায়।
‘আরে মশাই, শেষ করতে দিন। নোট দেবে কেন। এবাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনজন পঞ্চাননতলায় গিয়ে রিকশায় চেপেছিল।’
‘একটা রিকশা?’ যেন কি প্রশ্ন করতে গিয়ে শিবনাথ আবার খানিকটা হাসল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মশাই, আপনারা আর তো সঙ্গে ছিলেন না কেউ যখন ওরা ঘোলপাড়ায় যায়। আমি ছিলাম। সব তো চোখে দেখা।’
‘তারপর?’
‘আর কি, রিক্শায় উঠেই চারু কিরণের কোলের উপর হাত রাখল।’
‘অমল দেখতে পায়নি?’
‘মশাই, আপনার মাথায় কিছু নেই। দেখতে পেয়েই তো কিরণের মুখের দিকে অমল তকিয়েছিল। আর কিরণও তখন এমনভাবে অমলের দিকে তাকায় যে দ্বিতীয়বার অমল চোখ খোলেনি। রুমাল চাপা দিয়েছিল চোখে।
‘এখন সেই অবস্থায় আছে। কিরণ ধমক দেয় আর অমল কাঁদে। রিশার সেই ঘটনার পর থেকেই অমলটা বদলে গেছে। হাঁকডাক নেই। হাঁকডাক করবে কি। কিরণের চোখের দিকেই তাকাতে পারে না। ঘোলপাড়ার বাড়িতে নেমেই কিরণ রাত্রে চারুকে আর আমাকে খাওয়ার নেমন্তন্ন করল। দেখুন, কেমন চালাক মেয়ে। এখানে থাকতে এসব কিছুই বোঝা যাচ্ছল না।’
শিবনাথ ফ্যালফ্যাল করে কে. গুপ্তর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
বনমালী হেসে উঠল।
‘সাবাস মেয়ে।’
শিবনাথ খুব করে হাসল।
‘তা তোমার ওপর কিরণ আজ হঠাৎ অত চটল কেন। কাল বেসামাল কিছু করতে গিয়েছিল নাকি।’
‘তুই থাম্ রাস্কেল, তোর এই মগজে কিরণকে বোঝার দরকার নেই।’ বনমালীর দিকে না তাকিয়ে কে. গুপ্ত শিবনাথকে বোঝায় : ‘একসঙ্গে তিনটা পুরুষকে হাতে রেখে ঠাণ্ডা মাথায় চলার মেরিট ওই মেয়ে রাখে। আমি স্যাঙ্গুইন। কিরণ আমাকে অপছন্দ করে না।
‘কিন্তু তাড়াল তো শেষ পর্যন্ত।’
কে. গুপ্ত এবারও বনমালীর দিকে তাকায় না। ‘এটা চারুর চালাকি। বুঝলেন মশাই। কিরণকে দিয়ে ওই শালা বলিয়েছে স্বামী আর ও নিজে অন্য পুরুষের তার ঘরে ঢোকা নিষেধ।
‘চারু এখন তোমাকে আমল দিতে চাইছে না আর কি।’ বনমালী মোটা গলায় হাসল। ‘তা না দিক। তার পয়সা আছে আমি হিংসা করবার কে। কিন্তু আমায় ঠকানো কেন। আমার পাওনাটা মিটিয়ে দে, আপদ চুকে যাক।’
তা কিরণ যদি সিনেমায় না নামে তো আপনার কমিশন পাওয়া যাবে কি?’ শিবনাথ আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল। যদিও এসব আলোচনায় আর বেশিক্ষণ লেগে থাকা তার ইচ্ছা করছিল না।
‘মশাই, চারুই এখন নামতে দিচ্ছে না। বুঝলেন তো হারামজাদার ইন্টারেস্ট কোন্ দিকে। ধর্মের বোন। স্কাউড্রেলটা আমাকে বুঝিয়ে গেল এভাবে। আর ওদিকে হারামজাদী ওই বুলি ঝেড়ে অমলকে ব্লাফ দিচ্ছে। ধর্মের দাদা।’
‘তোমার নসিবই খারাপ গুপ্ত, যেদিকে হাত বাড়াও পয়সা ওঠে না, ওঠে ছাই।’
‘যাকগে আমি এখন চলি, কাজ আছে।’ শিরনাথ বেঞ্চ ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করতে গুপ্ত আবার হাত চেপে ধরল।
‘তা উঠছেন তো মশাই, কিন্তু সে-কথার কি হল?’
‘কোন্ কথা?
‘ঐ যে চারু বলছিল?’
‘ননসেন্স।’ অস্ফুটে বলল শিবনাথ। কিন্তু এই পাগলের কথায় রাগ প্রকাশ করতে যাওয়া নির্বুদ্ধিতা চিন্তা করে সে অগত্যা মুখের হাসি ধরে রাখল। ‘তা হুব্লার মুখে আমাদের ঝগড়ার খবর পেয়ে চারুবাবু কি আমার স্ত্রী সম্পর্কেই কেবল বললেন। কেন রমেশ রায়ের পরিবার ছাড়া বাড়িতে কি আমার চেয়ে আর সকলের আর্থিক অবস্থাই ভাল যাচ্ছে, না ভালর দিকে? এবং তাদের ঘরেও তো বয়স্থা মেয়ে আছে।’
‘কে আছে বলুন? চেহারাটা এখানে একটা বড় ফ্যাক্টার ভুলে যাচ্ছেন নাকি। আর যদি বলেন যে, চেহারা বা বয়সের দরকার নেই তো আমি দেখছি আপনার কথামতন মাস্টারের স্ত্রী, কি নাম, দ্যাট্ বেলিড-ওয়োম্যান, মাদার অব এইটিন চিলড্রেন লক্ষ্মীমণিকে চারুর বইয়ে নামাতে হয়, কাধমোটা ডাক্তারনীকে, প্রমথদের ঘরের আশি বছরের খনখনে বুড়ীকে। আপনি হাসছেন। অথচ এদিকে জানেন আপনি, হাজার রাত জেগেও যার কোমরে ব্যথা নেই, হাজার পাতে খেয়েও যার হাঁড়ি চাটা স্বভাব গেল না, দ্যাট হোর্–কমলা এখান থেকে সরে ড়ৈছে। সুনীতিটাকে ভাগিয়ে নিয়ে গেল ‘বাইরের একটা ছোকরা। প্রীতি, হ্যাঁ ভুবনের ড্যালৌসী-চষা মেয়ে সিনেমায় নামবে না। জানি না ওটার ছোট বীথিটা সাজগোজ করে হালে কোথায় বেরোতে আরম্ভ করেছে। এই তো হল গিয়ে ইয়াং ফেসেস, মানে যারা নামবে, যাদের নামানো উচিত। অল্প বয়স হলেও বিধু মাস্টারের থ্যাবড়া নাকের মেয়ে দুটো, কি ওঘরের বাচ্চা বৌটা, কি যেন নাম, রং ফর্সা হলে হবে কি, কপালটা উঁচু, খরগোসের কানের মত কান হিরণকে তো আর এ-বইয়ে নামিয়ে চারু লস দিতে পারে না, কাজেই—’
‘একবার তো বন্ধু কাঁচকলা দেখিয়েছে, আবার কেন। ভদ্রলোক কাজে বেরোচ্ছেন আর তুমি তাঁকে ধরে রেখে আগরবাগর বকছ।’
‘তুই চুপ কর সোয়াইন। তোর সঙ্গে কথা বলছিল না। এ লাইনের তুই বুঝিস কি।’ কে. গুপ্ত মাটিতে থুথু ফেলে পরে শিবনাথের দিকে চোখ ফেরায়। ‘কাজেই এবাড়ির রকমসকম দেখে এবং এই মাত্তর হুব্লার রিপোর্ট পেয়ে চারু যে আমাকে প্রেস করবে আপনার কানে কথাটা তুলবে খুবই স্বাভাবিক। বলুন।’
‘ননসেন্স, ইডিয়েট।’ শিবনাথ আর একবার মনে মনে আওড়ে ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি ঝুলিয়ে দিলে। ‘তা তো বুঝলাম, তা কি আর বুঝি না। চেহারাটা একটা ফ্যাক্টার। ‘তা অবশ্য আমি খুব বেশি দেখিনি তাঁকে, কিন্তু তা হলেও আপনার হয়ে–হ্যাঁ বেবির মা সম্পর্কে চারুবাবু কিছু চিন্তা করছেন না যে বড়? বেশ সুন্দর চেহারা মহিলার। তা ছাড়া অনেক দিন আপনার-
শিবনাথ থামতে কে. গুপ্ত মাথা নাড়ল।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন, চুপ করছেন কেন। তাছাড়া আমি অনেকদিন বেকার, আমার স্ত্রী কিছু করেন না, এই তো? তা বেকারকে বেকার বলতে অত হেসিটেট করছেন কেন। হা-হা।’
হেসে কে. গুপ্ত বনমালীর দিকে ঘাড় ফেরায়। বনমালীর এদিকে এখন চোখ নেই। শতচ্ছিন্ন ময়লা কুটকুটে কাপড় পরা একটি মেয়ে–মেয়ে না, কাদের ঘরের বৌ। সম্ভবত পাশের কোন বস্তিতে থাকে, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বনমালীকে ধারে এক পয়সার গুড দিতে পীড়াপীড়ি করছে। কিন্তু বনমালী অটল। ‘ধারে বিক্রি নেই, ধার দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।’ বলে সে দ্বিতীয়বার মুখ খোলেনি।
যুবতী বৌটি শেষটায় লজ্জা পেয়ে মাটির দিকে মুখ করে চুপ করে রইল।
‘আরো গাধা দিয়ে দে–’ কে. গুপ্ত মস্ত বড় একটা ঢোক গিলল। ‘এক পয়সার গুড ওমনি গেলে তোর দোকান কিছু ফেল পড়বে না। কি বলেন?’
শিবনাথ কিছু বলল না।
‘আজ আর ধার দেবার ক্ষমতা নেই আমার।’ বনমালী হিসাবের খাতায় মন দিতে দিতে বলল, ‘বাপরে বাপ, ধারের খদ্দেরের কামড়ানিতে মরলাম। এ কোন্ রাজ্যে আছি।’
‘রামরাজ্যে আছিস হারামজাদা।’ কে. গুপ্ত ধমকে উঠল। ‘আমাদের মত ধারে খাওয়া খদ্দেররা এখানে আছে বলে তুই বেঁচে আছিস। আমরা ছাড়া আর কোন্ রাজা বাদশা তোর দোকানে আসে তেজপাতা আর শুকনো লঙ্কা কিনতে। কি বলেন মশাই।’
শিবনাথ দেখল বৌটি ডাগর চোখ আড় করে কে. গুপ্তকে দেখছে। মন্দ না। রং খুব ফর্সা না হলেও চোয়াল ও চিবুকের গড়নটা অদ্ভুত। লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলল শিবনাথ।
‘আরে দিয়ে দে হারামজাদা। এক পয়সার গুড গেলে তোর কারবার কিছু লাটে উঠছে না। আপনিও বলুন না মশাই। বনমালী এখন পাষাণ্ড হবে কেন।’ কে. গুপ্ত কনুই দিয়ে শিবনাথের হাঁটুতে গুঁতো দেয়। ‘লোক বুঝে সময়মত ধারটার না দিলে আমরাই বা তোমাকে ভাল চোখে দেখব কেন।
বনমালী কথা বলল না বা খাতা থেকে চোখ তুলল না এবং বৌটিও নড়ল না।
‘আপনার কাছে একটা পয়সা আছে?’ কে. গুপ্ত শিবনাথের দিকে তাকাল।
‘আছে।’ শিবনাথ পকেট থেকে একটা ফুটো পয়সা তুলে কে. গুপ্তর হাতে দিল।
‘এই নে হারামজাদা তোর দাম। আপনি নিয়ে নিন। দে, ওজন করে দিবি।’ পয়সাটা বনমালীর দিকে ছুঁড়ে কে. গুপ্ত হাত ঝাড়ল।
বনমালী গম্ভীরভাবে এক পয়সার গুড একটা কাগজে জড়িয়ে বৌটির হাতে তুলে দিয়ে পয়সাটা বাক্সে ফেলল। বৌটি আর একবারও কে. গুপ্তর দিকে না তাকিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল।
‘কেমন দেখলেন মশাই?’
শিবনাথ কে. গুপ্তর প্রশ্নের উত্তর দিল না। কে. গুপ্তর ঘাড় ঘুরিয়ে আম গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকার ধরন দেখে তার হাসি পাচ্ছিল। ‘খাসা মেয়েটি, কার বৌ কে জানে।’ কে. গুপ্ত ঘাড় ফিরিয়ে লম্বা নিশ্বাস ছাড়ল।
‘দশ নম্বল বস্তির সুকুমার নন্দীর স্ত্রী।’ বনমালী খাতা থেকে মুখ তুলল। ‘আগে তালতল য় ছিল। হুঁ উকিল। ট্রামের তলায় পড়ে ঠ্যাং কেটে এখন এখানে সস্তা ঘরে এসে বাসা বেঁধেছে। ওকালতি করত মানে কাছারির বটগাছের পাতা গুনত।’
‘তা কি আর বুঝি না।’ কে. গুপ্ত গলা খুলে হাসল। ‘যার নেই পুঁজিপাটা সে আসে বেলেঘাটা। যত সব ঘাটের মড়া এসে মাথা গুঁজেছে খালধারে। তা, আমি ভাবছি অন্য কথা।’ গুপ্ত শিবনাথের দিকে তাকায়। ‘কিরকম আনগ্রেটফুল মেয়েটা দেখলেন? আপনার কাছ থেকে পয়সাটা চেয়ে পর গুড়ের দাম মেটালাম। কিন্তু একবার এদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ তুলে চেয়েই দেখল না।’
শিবনাথ না হেসে পারল না।
‘লজ্জা পেয়েছে আর কি।’ বনমালী নরম গলায় বলল, ‘হুট করে তুমি শিববাবুর কাছ থেকে পয়সা চেয়ে নিয়ে গুড়ের দাম দেবে সুকুমারের বৌ ভাবতে পারেনি।’
‘ভাবতে পারেনি কিন্তু হাত পেতে গুডটা তো নিয়ে গেল।’ ভেংচি কেটে কে. গুপ্ত খিঁচিয়ে উঠল। ‘তুই এক বজ্জাত আর ওই মাগি আর এক বজ্জাত। দুনিয়াটাই স্বার্থপর, বুঝেছেন মশাই, হাত বাড়িয়ে আমি আপনার কাছ থেকে নিতে পারলাম, কিন্তু আপনার দিকে তাকাতে আমার লজ্জা। আসলে ওটা হল গিয়ে ওর ভ্যানিটি। চেহারাটা একটু ভাল কিনা।’
যেন কি একটু সময় চিন্তা করল শিবনাথ। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘আপনার অনুমান হয়তো মিথ্যা না। কি একটা বইয়ে পড়েছিলাম যুবতী নারী যত খারাপ অবস্থায় থাকুক, পরপুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে আমি গরিব, তিনি বিত্তশালী এসব চিন্তা করে না বরং তার আগে সে অন্য কিছু ভাবে।’
‘বলুন, থামছেন কেন! ‘
‘পুরুষটি আমার যুগ্যি কি অনুপযুক্ত এই বোধটাই, অর্থাৎ এই ইন্দ্ৰিয়গত চেতনাতেই মেয়েরা আগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আমি সেক্স-এর কথাই বলছি।’
‘বলুন মশাই, বলুন। নারী-চরিত্র সম্পর্কে এসব ভাল ভাল কথা মানে সেক্সোলজির মারপ্যাঁচগুলো বনমালী হারামজাদাকে একটু বুঝিয়ে দিন! আমিও তো এককালে এসব বইটই পড়তাম। এখন আর শালার কিচ্ছু মনেও নেই। অভাবে অভাবে মাথাটা থেঁতলে গেছে। ভয়ানক দেমাক বৌটার। নিজের ইয়ুথ, অঢেল রূপ সম্পর্কে তিনি ওভার কনশাস আমি না হয় চুল দাড়ি লম্বা রেখে জামাকাপড় ছিঁড়ে না খেয়ে সুঁটকি লেগে একটা খচ্চরে পরিণত হয়েছি। কিন্তু, কিন্তু আপনার দিকে তো ও একবার তাকাতে পারত। তা ছাড়া পয়সাটা আপনার পকেট থেকেই গেল।’
শিবনাথ চুপ করে রইল।
‘কি যেন প্রশ্ন করছিলেন আমাকে?’ চিন্তা করতে কে. গুপ্তর তখনি মনে পড়ল। ‘অ, বেবির মাকে সিনেমায় নামানোর কথা। অ্যাদ্দিনে তবু আপনি জিজ্ঞেস করলেন। চারু সাহস পায় নি।
শিবনাথ তৎক্ষণাৎ বলল, ‘না, আপনি সেদিন বলছিলেন কিনা। বেবি একটু বড় হলে ওকে কোনো বইয়ে নামাবেন।’
‘তা তো বলছিই, আমার সেই প্ল্যান বদলে ফেলেছি আপনি বুঝলেন কি করে। বেবি আমার মেয়ে। ডটারের ওপর ফাদারের রাইট বেশি। কাজেই ওকে দিয়ে আমি যা খুশি করাব। ইউ উইল সি।’
বুদ্ধি করে শিবনাথ প্রশ্ন করল : ‘বেবির মা বুঝি রাজী হচ্ছেন না।’
‘আলবত রাজী থাকতে হবে।’ কে. গুপ্ত চোখ পাকিয়ে উঠল। ‘বেবি সম্পর্কে মাই ডিসিশন ইজ ফাইন্যাল।’
লম্ব চুলে শীর্ণ হাত বুলিয়ে কে. গুপ্ত মাথার এক গোছা শুকনো চুল পটপট টেনে তুলে ফেলল। একদলা থুথু ফেলল মাটিতে। ইয়ার্কি?’
কে. গুপ্তর মরা মাছের মতো সাদা ফ্যাকাশে চোখে রক্তের ছিটা দেখা গেল। শিবনাথ নীরব।
‘মশাই, তিনি আই-সি-এস-এর বোন হতে পারেন। কিন্তু আমিও আমার সুদিনে, কি বলব, হ্যাঁ রুপোর থালায় ভাত খাইয়েছি, সিল্ক আর সোনা দিয়ে মুখের হাসি নিভতে দিইনি। আজ দুর্দিনে আমার সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ।’
ঠোঁট টিপে হাসল শিবনাথ।
কি একটু চিন্তা করে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আপনার শালা, হুঁ, যিনি আই-সি-এস, জীবিত আছেন কি?’
‘হ্যাঁ, এখনো সার্ভিসে আছেন। আলিপুরে বাসা। ‘
শিবনাথ ইতস্তত না করে বলল, ‘দিনকতক তিনি, মানে আপনার ওয়াইফ সেখানে গিয়ে থাকলেই পারেন। অন্তত আপনার কিছু একটা সুবিধা না হওয়া পর্যন্ত। নিশ্চয়ই শ্যালক সরকারী চাকুরে। মোটা মাইনে পান। বোনকে দিনকতক রেখে খাওয়াতে তাঁর কষ্ট নেই।’
‘তাই বলি মশাই, ধর্মের বুলি আওড়ে কিরণ অমলকে ঠকাচ্ছে আর ধর্মের বুলি শুনিয়ে আই-সি-এস নবারুণ মিত্তির আমায় জব্দ করল।’
‘কি রকম?’ শিবনাথ প্রশ্ন না করে পারল না।’
‘ভোলাগিরির শিষ্য নবারুণ। সনাতন হিন্দু ধর্ম মেনে চলে। পতিই সতীর গতি। সুতরাং কে. গুপ্ত বস্তিতে কষ্ট করবে আর বোন গিয়ে সেখানে বসে পরম সুখে ভাত খাবে এটা ভাইয়ের পছন্দ না। দুঃখটা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই শেয়ার করে নিক।’
‘গুড আইডিয়া।’ শিবনাথ না হেসে পারল না। ‘তা নবারুণ আপনাকে অথবা আপনার ওয়াইফ ও ছেলেমেয়েদের অসুবিধার কথা ভেবে মাঝে মাঝে কিছু পাঠায় তো। পাঠিয়েছে এ পর্যন্ত কিছু টাকাপয়সা?’
‘নট এ ফার্দিং।’ কে. গুপ্ত মাথা নেড়ে হাত পেতে বলল, ‘দিন একটা বিড়ি দিন মশাই।’
‘আমি বিড়ি খাই না।’ শিবনাথ একটা সিগারেট তুলে কে. গুপ্তর হাতে দিল।
‘আইডিয়া তো আর নবারুণের মাথায় আসেনি। এসেছিল তার স্ত্রীর মাথায়। এ ডেঞ্জারাস ওয়োম্যান।’ সিগারেট ধরানো শেষ করে কে. গুপ্ত বলল, ‘আমার সার্ভিস চলে যাওয়ার পর, মানে হ্যাঁ তারও মাস তিনেক পর, যখন ভাড়া চালিয়ে আর পার্ক স্ট্রিটের বাড়ি ধরে রাখতে পারলাম না, সেখান থেকে উঠে গিয়ে আলিপুরে সবাই দিনকতক ছিলাম। হরিল। কী রকম চেহারা করে রেখেছিল নবারুণের স্ত্রী আমাদের দেখে। মশাই সাত রাতও ঘুমোতে পারেনি। পাছে আমরা মাসের পর মাস সেখানে পড়ে খাই এই দুশ্চিন্তায়। তারপর বুঝি একসময় হঠাৎ মাথায় ভোলাগিরির বুদ্ধি এল, অর্থাৎ আমি একলা দিনকতকের জন্য নারকেলডাঙ্গার একটা টিনের ঘরে স্টোভে পাক করে খেয়ে সার্ভিসের চেষ্টা করব শুনেই স্ত্রীর ডিকটেশন অনুযায়ী নবারুণ পরদিন বোনকে, হ্যাঁ আমার স্ত্রী সুপ্রভাকে ডেকে বলে দিল : এটা খারাপ দেখায়। তা ছাড়া আমাদের মনোহরপুকুরের মিত্র পরিবারে এমন দৃষ্টান্ত আজ অবধি কোনো মেয়ে রাখেনি। দেড় হাজার টাকার মাইনে চাকুরে জামাই যেমন আছে, তেমনি চাকরি হারিয়ে দশ টাকা এর-ওর-তার কাছ থেকে কর্জ করতে বেরিয়ে কোলকাতার রাস্তার ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে জামাই-এর সংখ্যাও কম না এ বাজারে। কিন্তু কোনো মেয়েই বাপের বাড়ি এসে পড়ে থেকে স্বামীর হীনতা দীনতার পরিচয় দেয়নি, দিচ্ছে না। বরং হ্যাঁ, রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে লোকের স্ত্রীও যখন মনোহরপুকুর রোডে বেড়াতে আসে, স্বামী এই করছে সেই করছে বড়াই করেই বাপের বাড়ি এবং পাড়া মাত করে রাখে–হ্যাঁ, এরা বুদ্ধিমতী।’
‘তাহলে তো আর বেবির মার সেখানে থাকা চলে না।’ শিবনাথ মন্তব্য করল।
‘মশাই হরিবল, অবিলিভেবল, আপনি ইমাজিন করতে পারবেন না নবারুণের ওয়াইফ, হ্যাঁ, ওই পেত্নীর মত রং, খ্যাংরা কাঠির মত খিটখিটে দেখতে লিলিটা কত বড় সেফিশ, কি ভয়ঙ্কর তার আত্মপরজ্ঞান। গড়।’
‘কি করেছিল?’
বড় নখ সমেত শুকনো শিরা বার করা হাতটা শিবনাথের চোখের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে কে. গুপ্ত বলল, ‘একসঙ্গে খেতে বসে দেখতাম আমার ছেলেমেয়েদের এই এত টুকুন করে, একটুকরো ডিম, ওয়ান এইট্থ অব এন এগ্। আর ওর ছেলে ও মেয়েটাকে দিত আস্ত পুরো একটা ডিম। আমরা না বুঝতে পারি তাই আলুর সঙ্গে মিশিয়ে দিত। এমন পাজী বজ্জাত সেফিশ দ্যাট ডটার অব্ এ বিচ্, মশাই।’
‘তা ওর স্বামীর রোজগারের টাকা ওর ছেলেমেয়েকে তো একটু দেবেই।’ বনমালী মন্তব্য করল।
বনমালীর কথায় কান না দিয়ে কে. গুপ্ত শিবনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাই ভাবি। ক’দিন আর আমরা ছিলাম শালার বাসায় আলিপুর। প্রথম দিনই নবারুণের স্ত্রীর এই কাণ্ড দেখে আমি তাড়াতাড়ি খাওয়া ফেলে উঠে বাথরুমে ঢুকে চোখে জল দিয়েছিলাম মনে আছে। আর ভাবলাম তখন, আমার ছেলেমেয়েদের মাই ছাড়াবার পর সাত আট বছর কি শীত কি গ্রীষ্ম এক কাপ দুধে আস্ত এক একটা ডিম ভেঙে খাইয়ে প্রত্যেকটিকে বড় করে তুলেছি। ভীষণ কান্না পেয়েছিল সেদিন।’
‘তা আর কি করবেন কষ্ট করে। দিন চিরকাল মানুষের সমান যায় না।’ শিবনাথ চট করে বলল, ‘এখন কষ্ট যাচ্ছে, আবার হবে। আবার হয়তো ওরা–’
হ্যাঁ ডিম খাবে দুধ খাবে।’ কে. গুপ্ত গাছের পাতার দিকে তাকাল। ‘রোদ হেলে গেছে, দিন তবে আর একটা বিড়ি।’
শিবনাথ সিগারেটের প্যাকেটটা আর পকেট থেকে বার করল না। একটু চুপ করে থেকে পরে প্রশ্ন করল : ‘তা আপনার স্ত্রী তো লেখাপড়া নিশ্চয়ই জানেন। তিনি যদি–
‘বলুন থামলেন কেন।’ কে. গুপ্ত ঘাড় বাঁকা করল। রুক্ষ লম্বা চুলগুলোর নিচে আবার হাতের আঙুল ঢুকিয়ে পটপট চুল ছিঁড়তে লাগল।
‘না, পুরুষদের হুট করে চাকরি হচ্ছে না, কিন্তু নানা অফিসে নানা জায়গায় মেয়েরা আজকাল যেন একটু বেশিই চান্স পাচ্ছে। সুতরাং–’ শিবনাথ থামল।
‘মশাই, সেদিক দিয়েও জব্দ হয়েছে আমার কপাল।’ কপালে আঙুল ঠুকল কে. গুপ্ত। বনমালী ও শিবনাথ কথা বলল না।
ইংরেজি চিঠিপত্র আমার চেয়েও ভাল লেখে বেবির মা, তেমনি বাংলার ওপর দখল। কিন্তু হলে হবে কি। ঐ যে বললাম–বংশ। নবারুণের মত ওর মাথার মধ্যেও উঁচু মানী বংশের লম্বা লম্বা পোকা কিলবিল করছে। মশাই, আমি কি আর সাধে ঠেকেছি। বড়বাজারে এক মেড়োর গদিতে চিঠিপত্র লিখে বিশ-পঁচিশ ত্ৰিশ যাহোক মাসে পাওয়া যাবে ঠিক হতে আমি নারকেলডাঙ্গায় একলা একলা থাকব মনস্থ করে কোঠা নিয়েছিলাম, কিন্তু নবারুণের বদমায়েশ বৌটার জন্যে সেই প্ল্যান যখন ভেস্তে গেল, অগত্যা সবাইকে নিয়ে এখানে এসে উঠলাম। উঁহু, কিছুতেই রাজী করাতে পারলাম না। মিত্র বংশের মেয়েরা বাপ ভায়ের সংসারে থাক কি স্বামীর ঘরে যাক, আজ অবধি কেউ চাকরি করতে নামেনি, সুতরাং তিনিও পারবেন না। কি সিনেমায় নামার কথা? এটম বম্ব ফাটবে মশাই আজ আমার ঘরে, যদি আমি এই প্রস্তাব নিয়ে ওর কাছে যাই।’
‘বাস্, তবে আর কি। এখন বসে বসে আঙুল চোষো।’ বনমালী হাত নেড়ে গুড়ের মাছি তাড়াতে লাগল।
শিবনাথ কথা বলল না।
কুকুরটা আবার এক ফাঁকে এসে জুতোর পচা সুখতলাটা মুখে তুলে নিয়ে ছুটে পালাল। ‘তাই মনে মনে ভাবি, অভাগা যেদিকে চায়, কি জান একটা বাংলা কবিতা আছে, সমুদ্র শুকিয়ে যায়। আমারও মশাই সেই অবস্থা। সুযোগ বুঝে নবারুণ এই কাণ্ডটা করল, সুবিধা পেয়ে চারু ধর্মতত্ত্ব শোনায় আর ঘরের তিনি–বললাম তো সব।’ কে. গুপ্ত একটা নিশ্বাস ফেলল।
‘আচ্ছা আমি চলি।’
‘শুনুন, শুনুন।’
কে. গুপ্ত চেষ্টা করল কিন্তু শিবনাথ হাত ধরতে দিল না। হাত ধরবে বুঝতে পেরে সতর্ক হয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। এতক্ষণ বক্তৃতা করার পর গুপ্ত আসল কথাটা মুখ থেকে ছাড়বে শিবনাথের তা-ও বুঝতে কষ্ট হল না। ঠোঁট টিপে হাসল সে। ‘বলুন।’
‘হবে আনা দুয়েক? আছে সঙ্গে কিছু খুচরো?’ কে. গুপ্ত অক্লেশে বলে ফেলল।
‘আজ নেই।’ শিবনাথ পরিষ্কার ভাবে মাথা নাড়ল। চলে আসত সে। কিন্তু একটু আগে হুক্লার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তার আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা এবং রুচি ও সিনেমা সম্পর্কে নানারকম আলোচনার প্রতিশোধ নেবার চরম মুহূর্ত উপস্থিত চিন্তা করে শিবনাথ হঠাৎ গলা বড় ক’রে বলল, ‘মশাই, রোজ রোজ কি আর দানখয়রাত করা চলে, আমরা তো আর কিছু রাজা জমিদার নই, খেটে খেতে হয়। চলি।’
‘আহা সে কি আর বুঝি না।’ কে. গুপ্ত অল্প হাসল। ‘সেই জন্যই তো টাকা আধুলি চাইতে পারি না, ঐ দু’এক আনা–দিন।’
‘আমার কাছে নেই।’ শিবনাথ হাঁটতে আরম্ভ করল।
‘দিন দিন।’ কে. গুপ্তও উঠে শিবনাথের সঙ্গে চলল। ‘চারটে পয়সা আপনার কাছে নেই আমি বিশ্বাস করি না।’ বলে হাসল কে. গুপ্ত।
‘তা কি আর নেই, কিন্তু আমার তো খরচ আছে, সিগারেট ফুরিয়েছে, চা খেতে হবে।’ শিবনাথ জোরে পা চালাতে চেষ্টা করল।
‘দিন মশাই দিন।’
শিবনাথ কথা না বলে হাঁটে। কে. গুপ্ত লম্বা পা ফেলে তার সঙ্গে এগোয়। ‘বনমালী হারামজাদাকে সেই সকাল থেকে বলে বলে পারলাম না আদায় করতে এক মুঠো মুড়ি দুটো বাতাসা। বলে ফুরিয়ে গেছে। অথচ আমি জানি মসুরডালের ঝাঁকাটার পাশে কালো হাঁড়িটায় কমসে কম অন্তত সের দশেক মুড়ি আছে। এমন কসাই শালা। দিন স্যার।’
শিবনাথ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এভাবে ভিক্ষা করে ক’দিন চলবে? আমার কাছে এখন বিশেষ কিছু নেই। আপনি কাইন্ডলি সরে যান।’
কে. গুপ্ত করুণ ভাবে তাকায়।
‘আরে মশাই আপনি দেখছি চারুর মতন বনমালীর মতন শক্ত হয়ে গেছেন। ওরা এমন হতে পারে। এবাড়িতে থাকে না। কিন্তু আপনি তো–দু’জন একটা উঠোনের ওপর আছি, এক পাতকুয়ার জল পেটে পড়ে! আমি স্টার্ভ করছি, আপনার কি একটুও কষ্ট হয় না।’ কে. গুপ্ত শিবনাথের হাত ধরল। ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে দেয় শিবনাথ
‘কি মুশকিল। আরো দু’দিন আপনাকে আমি পয়সা দিয়েছি। আজ অবধি সেগুলি রিটার্ন করেননি।’ শিবনাথ আর না বলে পারল না।
‘হ্যাঁ, তা করিনি মনে আছে। দ্যাট্ ডু আই অ্যাডমিট।’ ক্ষয়ে যাওয়া নোংরা দাঁতগুলি বার করে কে. গুপ্ত বলল, ‘লেট মাই সান ডাই, লেট মাই ডটার বি কিডন্যাপড বাই দ্যাট রাসক্যাল্–হ্যাঁ, ক্ষিতীশ, লেট মাই ওয়াইফ, দ্যাট্ প্রাউড ওয়োম্যান, কমিট সুইসাইড,–তখন। সব দিক থেকে আমি পরিষ্কার হয়ে গিয়ে, বুঝলেন, দেন আই উইল বি এবল্ টু আর্ন! আর সেদিন আমি আপনাদের সকলের ঋণ শোধ করব, হ্যাঁ, টেক্ ইট ফ্রম মি। দিন স্যার আজ যা হয়।’
‘পাগল পাগল।’ শিবনাথ বিড়বিড় করে উঠল। ‘ইউ গো।’
কিন্তু কে. গুপ্ত নাছোড়বান্দা। আবার হাত বাড়িয়ে শিবনাথের হাত ধরতে চেষ্টা করল। শিবনাথ এক মুহূর্ত চারদিকে তাকিয়ে দেখে নেয়। কেউ কোথাও নেই। তারপর আর ইতস্তত না করে শক্ত কঠিন হাতে লোকটার হাড় বেরিয়ে পড়া শুকনো ঘাড় ধরে প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিল। টাল সামলাতে না পেরে কে. গুপ্ত রাস্তার ওপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
‘উঃ।’
একটা মনকাঁটা ফুটল কে. গুপ্তর বাঁ হাতে। ডান হাত দিয়ে কাঁটাটা টেনে বার ক’রে ফেলল যদিও।
‘আপনি দেখছি ভয়ানক ক্রুয়েল মশাই, হার্টলেস।’
‘গায়ে হাত দেওয়া কেন?’
‘আমি আপনার হাত ধরেছিলাম। আমি কি আপনার হাত ধরতে পারি না?’
‘না।’
‘আমি আপনার নেডোর নেবার।’ কে. গুপ্ত রীতিমত চিৎকার করে উঠল।
‘তা আমি অস্বীকার করি না।’ শিবনাথ গম্ভীর হয়ে উত্তর করল : ‘তা’ হলেও আপনার এখন যা পজিশন এই অবস্থায় প্রতিবেশীর গায়ে হাত রেখে কথা বলা চলে না।’
‘মশাই, তাই বলুন। একটু বেটার পজিশনে আছেন সেই অহংকার। তা আমিও বলি, আমার হরস্কোপ অলরেডি পাঠানো হয়ে গেছে। হ্যাঁ, বেবির মুখে শুনলাম, কাল সুপ্রভা ওটা কাঠের বাক্স থেকে খুঁজে বার করে মিত্রদের গুরুদেব ভোলাগিরির কাছে পাঠিয়েছে। মশাই, আমারও এদিন থাকছে না। এখন উপার্জনের ক্ষেত্রে শনির দশা চলছে। কিন্তু কাটাব। ঠিক কাটিয়ে উঠে আপনাদের মতন দু’দশটা কেরানীকে দু’পকেটে ঢুকিয়ে আবার নিজের খাসকামরায় বসে আরামসে হুইস্কি টেনে সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে মান্থলি দু’হাজার ড্র করব। দ্যাট্ ডে উইল কাম এগেন।’
‘ভাল।’ মাথাটা নেড়ে শিবনাথ লম্বা পা ফেলে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল।
৩৬
খুব মুশকিলে পড়ল সেদিন রুচি ময়নাকে নিয়ে। বাড়িতে তবু যা-হোক কেঁদেছে, বাপের ধমক খেয়ে আবার চুপ করেছে। রাস্তায় বেরিয়ে ময়নার কান্না থামতে চায় না।
বেশ বড় মেয়ে। রুচির স্কুলে এই বয়সের মেয়েরা স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষার জন্যে তৈরি হচ্ছে। প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর প্রায় ষোল বছরের একটি মেয়ের হাতে লাল মলাটের বর্ণবোধ আর একটা ভাঙা শ্লেট যেমন বিসদৃশ ঠেকছিল, তেমনি ওর অবুঝ অশ্রান্ত কান্না। খেলনা হারিয়ে শিশু যেমন কাঁদে। ব্যাপার কি?
রুচি প্রথমটায় কিছু বলল না।
বাস্-এ উঠে শুঁড়া ফার্স্ট লেনের সাবিত্রী চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় রুচি তার সঙ্গেই বেশি কথা বলছিল। আর একজন টিচার। হাওড়ার কোনো মেয়ে স্কুলের। রোজ এ পথে চলতে ফিরতে এই অঞ্চলের দু চারজন শিক্ষয়িত্রীর সঙ্গে রুচির পরিচয় হয়েছে। সাবিত্রী একজন। অবশ্য দেখা হলে যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা হয় তাদের সঙ্গে এমন না। বরং একই ধরণের প্রশ্ন, এক বিষয় নিয়ে আলোচনা, যেমন : সাড়ে দশটা বেজে গেছে? না আরো তিন মিনিট বাকি। বাবাঃ কী ভিড় আজ বাস্-এ দেখছেন! পরশু যেন কিসের ছুটি? পাব্লিক হলিডে তো? কি রান্না করলেন আজকে? কপির ডালনা কাঁচা মুগ ডাল। না, মাছ আর সস্তা হবে না। আপনাদের ওধারটায় অসুখ-বিসুখ কমেছে কি? কমছে বাড়ছে কিছু বোঝ যাচ্ছে না। রেশনিং উঠে যাচ্ছে কি? উঠলে বাঁচি। কি আজ আবার মুখ ভার কেন আপনার, কর্তার সঙ্গে রাগারাগি হয়েছে বুঝি? যতদিন না নিমতলায় যাচ্ছি রাগারাগি বন্ধ হবে না আমাদের মত লোকের সংসারে। অঢেল থাকতো, নাকে মুখে গুঁজে দশটায় বেরিয়ে মেয়ে ঠেঙাতে যেতে না হত, ঘরে থেকে এটা-ওটা রান্না করে ধুয়ে মুছে বিছানাপাটি পরিষ্কার রেখে ছেলেমেয়েকে আদর করে কর্তার ঘরে ফেরা তক সংসার আগলে রাখতে পারতাম তো স্বামীর মেজাজ ভাল থাকত। এখন হয়েছে তার উল্টো। কাজেই ঝগড়া। আপনার বুঝি ওই একটি মেয়ে? আপনার? দুটি। আবার কবে? –রক্ষা করুন মহাশয়। ছট্কুর সময় হাসপাতালে থেকেই অপারেশন করিয়ে এসেছি, আপদ যাক্। আপনার হেলথ এফেক্ট করেনি? এখন পর্যন্ত তো দেখছি না–হি-হি। আপনি?–কি করবেন ঠিক করলেন? সাহস পাচ্ছেন না। ছট্কুর সময় এক দুধের পিছনে আমাকে পনরবিশ টাকা হাতে ধরে গয়লাকে মাস মাস দিতে হয়েছিল। উঃ কী যে লাগত মিসেস রায়–মনে হত আমার এত কষ্ট করে রোজগার করা টাকা জলে ফেলে দিচ্ছি। হ্যাঁ, তবে কি বলবেন মেয়েকে উপোস রেখে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। না, তা করব কেন। ইচ্ছা হ’ত তিন পো’র জায়গায় দু’সের দুধ খাওয়াই রোজ। বলুন কোন্ মার এই ইচ্ছা না। হ্যাঁ, আগে পারত, তাদের বুকেও তখন দুধ জিনিসটার অভাব ছিল না। আজ বলুন মিসেস রায়, আমার আপনার বুকে ক’ছটাক দুধ থাকে। বেলা ন’টায় কাঁচা মুগ ডাল আর ভাত খেয়ে সারাদিন আড়াই শ’ মেয়েকে তৈমুরলঙের বাবার জীবনী শিখিয়ে ল. সা. গু., গ. সা. গু. কষিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে সেই দু’খানা ঠাণ্ডা রুটি আর একটু বেগুন পালং খেয়ে যাদের দুধ শুকিয়ে গেছে, তারা তাদের অপারেশন করে রিস্ক দূর করা ছাড়া উপায় কি?
‘উপায় কি।’গম্ভীর অস্পষ্ট ভঙ্গিতে রুচি হাওড়ার স্কুলের টিচার সাবিত্রী চ্যাটার্জির দিকে তাকিয়ে হাসল। তার সেই হাসি মিলিয়ে যেতে না যেতে আর একটা স্টপেজে ওঠে ইলা সেন। শুকনো সাদা কব্জিতে একটা কালো ব্যান্ড-পরা ঘড়ি। চোখে রোদ ঠেকাবার কালো চশমা। ‘কটা বাজলো, কটা বাজে মিসেস রায়।’ বোঝা গেল নিজের ঘড়িটা চলছে না।
রুচির হাতঘড়ি তেল মাখাতে দোকানে দিয়ে রাখা হয়েছে। পয়সার অভাবে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না।
সাবিত্রী চ্যাটার্জি তৎক্ষণাৎ নিজের কব্জির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দশটা পনের মিস সেন।’ ইলা সেন একটু অনুকম্পার চোখে রুচির দিকে তাকাল। কাজেই সেদিনকার মত বৌবাজারের স্কুলের ইলা সেনের সঙ্গে রুচি আর কথাই বলতে পারল না। কিন্তু আলাপ থেমে থাকে না। ‘আপনার স্বাস্থ্য কিন্তু এখনি ভেঙে পড়েছে মিস সেন।’
‘স্বাস্থ্য দিয়ে কি হবে?’ ইলা সেন কচিপাতা রং এক টুকরো রুমাল দিয়ে মুখ মুছল। চোখের কালো ঠুলিটা সরালো।
‘বাঃ বিয়ে-টিয়ে করবেন না? এইভাবে কাটবে জীবন?’
‘বিয়ে করে কি হবে?’ ইলা সেন ঠোঁট বাঁকা করল। ‘এ-দেশে ইস্কুলের মাস্টারি করে মেয়েদের বিয়ে? তারপর যখন সিকি দু’আনি হতে থাকবে? রক্ষা করুন মহাশয়।’ রোগা পাংশুটে গলাটাকে আর একটু ভেঙে ইলা সেন রুচির পাশে বসা মঞ্জু সহ রুচির দিকে তাকিয়ে এমন কুৎসিতভাবে হাসল যে, রুচি সেদিকে তাকাতে সাহস পেল না। এক গাদা পুরুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে ইলা রড ধরে ঝুলছিল আর হাসছিল আর বাসের ঝাঁকুনিতে তার হাসি খানখান হয়ে ভেঙে কাঁচের টুকরোর মত চারধারে ছড়িয়ে পড়ছিল।
‘আপনি আমার চেয়ে চালাক। আমার চেয়েও সেয়ানা। আমি এখন ঠেকে শিখে সিকি দু’আনির রাস্তা বন্ধ করেছি। আপনি দেখছি–’
রুচির কপাল ভাল। সাবিত্রী চ্যাটার্জির কথা শেষ হবার আগে বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ায়। শেয়ালদা। এই ধরনের আলোচনা বাড়তে বাড়তে অধিকাংশ দিনই এমন একটা স্তরে গিয়ে পৌঁছায় যে রুচির দু’কান গরম হয়ে ওঠে তখন। চুপ করে থাকে। চুপ করে থেকে অত্যন্ত সতর্ক চোখে সহযাত্রী পুরুষদের কানে কথাগুলি গেল কি না লক্ষ্য করতে চেষ্টা করে। আজও করত। কিন্তু দরকার পড়ল না। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে ইলার হাসি ও সাবিত্রীর মুখ বন্ধ হল। রুচি তাড়াতাড়ি মঞ্জু ও ময়নার হাত ধরে টুপ করে নেমে পড়ল।
এখন রুচির মেজাজ প্রসন্ন হবার কথা। কিন্তু আজ তা আর কপালে জুটল না। ময়না তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
এই বেলা রুচি না বলে পারল না।
‘তোমার যদি ইস্কুলে যেতে এত অনিচ্ছা তো বাড়িতে তা বাবাকে ভাল ক’রে বলনি কেন। এত বড় মেয়ে প্রাইমারি ক্লাশে ভর্তি হ’তে যাচ্ছ, যেখানে যাবে, যে স্কুলে পড়বে লজ্জা করবেই–আমি বুঝতে পারছি না তুমি এত কাঁদাকাটা করে কেন লেখাপড়া শিখতে এলে।’
জলভরা চোখে ময়না রুচির দিকে তাকায়। কালো স্থির চাউনি। বলতে কি, রুচি যেন একটু চমকে উঠল। সবটাই বর্ণবোধ না। সবটুকু নির্বোধ কান্না নয়।
রাস্তার দিকে তাকিয়ে ময়না চোখ মুছল। লাল ফোল-ফোলা চোখের দিকে তাকিয়ে রুচির মনে হ’ল এই কান্না আজ হঠাৎ তৈরী নয়। যেন এর আগেও ও কেঁদেছে। তার চোখের কোলে কালি দেখে রুচি নরম গলায় আস্তে আস্তে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কাঁদছ কেন?’
‘আপনাকে বলে কি হবে।’
‘আহা আমাকে বলতে আপত্তিই বা কেন? আমি তোমার মা’র বয়সী প্রায় হব। অনেক ছোট তুমি আমার চেয়ে। কি হয়েছে বলো।’
‘রুণু–।’ মুখ নীচু করল ময়না।
রুচি হঠাৎ কথা বলল না। একটু ভাবল। কেননা কাল রাত্রে মুখ্যত তাদের পাশের ঘরের কে. গুপ্তর ছেলের বিষয় নিয়ে শিবনাথের সঙ্গে তার বেশ খানিকটা ঝগড়া হয়েছে। তারপর আর এটাকে রুচি পাঁচটা কথা চিন্তা করে অবশ্য বাড়তে দেয়নি। কে. গুপ্তর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সবটা ব্যাপারই সে পাশ কেটে দাঁড়ানোর মতো হয়ে শুনে এসেছে। সত্য মিথ্যা যাচাই করতে নিজে থেকে একটা প্রশ্নও করেনি।
তাছাড়া ভদ্রমহিলার কথাবার্তা রুচির ভাল লাগেনি। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলা এবং প্রায় পনেরো মিনিট ধরে তার বাপের বাড়ির মনোহরপুকুর রোডের এক মিত্র বংশের সুনাম গৌরব মর্যাদা ও লক্ষ্মীশ্রীর বর্ণনা সেরে সুপ্রভা কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ঘরে ঢোকার পর রুচিকে বসতে বলা হয়নি। বলে বসাবে এমন জায়গাও ছিল না। সুপ্রভার মলিন শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে রুচি কথা শুনছিল।
পিতৃবংশের বর্ণনা শেষ করে বেবির মা চোখ নামাল।
‘এত বড় ঘরের মেয়ে এভাবে কেন কষ্ট পাচ্ছে নিশ্চয় তার কোনো কারণ আছে।’ বলে বেবির মা সাদা শীর্ণ বাঁ হাতখানা তুলে চোখের সামনে মেলে ধরে রেখা দেখেন। হাতের রেখা দেখতে রুচি মেয়েদের এই প্রথম দেখল। হাত দেখা হয়ে গেলে সুপ্রভা সেটা নামিয়ে আস্তে আস্তে নিজের চোখের উপর রাখেন। চোখ ঢেকে দেন।
রুচি অস্বস্তি বোধ করছিল।
এভাবে আরো দু’মিনিট কাটে।
তারপর হাত সরিয়ে সুপ্রভা আবার কড়িকাঠের দিকে তাকান। সেদিকে চোখ রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে বললেন, ‘কাজেই আমি বিদ্রোহ করব না। এই দুঃখের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে গুরুদেব রুষ্ট হবেন। আমার স্বামী পাগল। আমার মেয়ে চায়ের দোকানে কাজ করছে, আমার ছেলে হাসপাতালে শুয়ে আছে। থাকুক। অদৃষ্টে থাকলে রুণু ফিরে আসবে, না থাকলে আসবে না। শুনছি ওর গাড়ি চাপা পড়া নিয়ে নানারকম গল্প তৈরী হয়ে গেছে। বলাই-এর মেয়েটাকে ডাকিয়ে ছিলাম। আসেনি। সম্ভবত বলাই আসতে দিচ্ছে না। আমি ময়নাকে কাঁদতে শুনেছি।’ সুপ্রভা একবার থামলেন।
কাজেই, হ্যাঁ, আপনাকে ডেকে বললাম, এ বাড়িতে শিক্ষিতা বলতে আর কোনো মেয়ে নেই। অর্থাৎ আমার অক্ষমতা, আমার অসহায়তা, আমার দৈন্য বুঝতে পেরে অন্তত মুখের সহানুভূতি জানাবে এমন কেউ আছে কিনা এখানে জানি না। নেই। সন্ধ্যেবেলা পাশের ঘরের কোন্ বুড়ী খনখনে গলায় বলছিল, মা একবার কি ছেলেটাকে গিয়ে হাসপাতালে দেখে আসতে পারে না? কতটুকুন আর রাস্তা শেয়ালদা। শুনলাম। শুনে চুপ করে রইলাম। হেঁটে যাব সে-ক্ষমতা আমার নেই। এই স্বাস্থ্য নিয়ে হাঁটতে গেলে আমি মাথা ঘুরে যাব ট্রাম-বাসের তলায়।
সুপ্রভা বোধ করি এই প্রথম রুচির দিকে তাকিয়েছিলেন।
‘না, কেবল ট্রামে-বাসে চড়তে আজ আমার লজ্জা করে যদি বলি তাহলে হয়তো মিথ্যা বলা হবে। আমার বাইরে মুখ দেখাতেই লজ্জা করে। পারব না। এখানে এসে অবধি আমি এ বাড়ির সদর কোন্টা, উঠে গিয়ে একবার চোখ মেলে দেখিনি। দেখব না। নরকপুরীতে এসেছি। গুরুদেবের ইচ্ছা না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে নড়তে পারব না। উঠে গিয়ে নিজে থেকে বেরোবার রাস্তা দেখব সেই দম্ভ, সেই স্পর্ধা আমি রাখি না।’
অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল রুচি।
‘আমায় ডেকেছেন কেন?’
এত দুঃখের মধ্যেও সূক্ষ্ম সলজ্জ একটা হাসি সুপ্রভার ঠোঁটে উঁকি দিয়েছিল যেন। সঙ্কোচ।
‘আপনাকে বোন একটু কষ্ট করতে অনুরোধ জানাব। লজ্জা করে। আপনার সময়ের অভাব। স্কুলের খাটুনির পর বাড়ি ফিরে আবার সেই রাঁধাবাড়া। কখন যে কাল আপনি
রুচির দু’কান গরম হয়ে উঠেছিল।
‘বলুন কি করতে হবে।’
‘একবার সময় করে হাসপাতালে যদি রুণুকে কাল দেখে এসে আমায় বলতে পারেন ও কেমন আছে।’
রুচি চুপ করে ছিল।
‘যদি আপনার সময় হয়। আপনার কাজের ক্ষতি আমি করতে চাই না। এই নিন ভাই।’
.
সুপ্রভার ডান হাতে একটা দু’আনি।
রুচি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকয়ে দেখছিল।
‘বেবির কাছ থেকে চেয়ে আমি রেখে দিয়েছিলাম। না, এতে আপনার লজ্জার কিছু নেই। তাছাড়া আমি, আমার কানেও এসেছে, খুকির বাবার এখন চাকরি নেই। সামান্য একটা প্রাইভেট স্কুলে আছেন আপনি–’
‘পয়সাটা রেখে দিন। আমাকেও শেয়ালদা পর্যন্ত বাস-এ যেতে হয়। তারপর অবশ্য আর বাস লাগে না। হেঁটে একটু এগিয়ে গেলেই আমার স্কুল। কাজেই বাস-এর জন্যে অতিরিক্ত পয়সা আপনাকে দিতে হবে না। কাল স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখি যদি সময় পাই–’
‘আচ্ছা, একটা রাখুন তো। আমার জন্যে একটা কাজ করছেন। আপনার ছোট্ট মেয়েটাকে কি একটা কমলালেবু খেতে দিতে পারি না আমি। না বোন, রাগ করবেন না, আপনি শিক্ষিতা। আমার হয়ে আপনাকে এই কাজটুকু করার জন্য কিছু মনে করবেন না বলেই আমিও বলতে সাহস পেলাম। আহা, পয়সাটা কোথায় পড়ল দেখুন তো ভাই—’
হাত থেকে পয়সাটা বিছানার ওপর কোথাও পড়ে যেতে সুপ্রভা পাশ ফিরে ঘাড় কাত করে যখন সেটা তালাস করেন, রুচি সেই ফাঁকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
একটা ভাল কিছু করতে যাওয়ার দম্ভ নিয়ে সে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে কে. গুপ্তর স্ত্রীর কাছে গিয়েছিল। সেখানে বিপদের পুরোপুরি সর্বনশের আগুনের ওপর শুয়ে মনোহরপুকুর রোডের বনেদী মিত্রবংশের মেয়ে সুপ্রভা অনুকম্পার চাপ চাপ বরফপিণ্ড লোকের মাথায় তুলে দেবে বলে অপেক্ষা করছে রুচির আগে জানা ছিল না।
বাকি রাত রুচি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোল। আজ সকালে উঠেও রুণুর কথা সে ইচ্ছা করেই ভুলে থাকতে চেয়েছে, যেমন শিবনাথ গোড়া থেকেই আছে। অবশ্য রুচির কারণটা স্বতন্ত্র। কেননা, যখনই প্রতিবেশীর দুঃখে মনে মনে সমবেদনা প্রকাশের চেষ্টা করেছে রুচি একটা দু’ আনি–ক্ষয় পাওয়া ধারগুলো, ফ্যাকাশে বিবর্ণ, পিতলের মুদ্রাটি তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আর মহিলার কথাগুলো মনে হয়েছে। ‘খুকির বাবার চাকরি নেই শুনছি। প্রাইভেট স্কুলে চাকরি করে যৎসামান্য আয় আপনার। আহা, কাজ সেরে ফিরে এসে বিকেলে আবার সেই হাঁড়ি খুন্তি। কী কষ্টের জীবন, আমি, একলা আপনার কথা বলছি না–আপনাদের, বাংলা দেশের স্কুল টিচারদের কথা বলছি। অত্যন্ত পুয়র মাইনে। অথচ বেচারাদের দিয়ে কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছে। সত্যি বড্ড মায়া হয়।’
কথা শেষ করে সুপ্রভা কড়িকাঠ দেখছিলেন। আর রুচি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল ওধারে হাঁড়ি-খুন্তিতে ধুলোর পলস্তারা পড়েছে। উনুনটা যেন কবে থেকে মাথা-ভাঙা হয়ে এখন পাঁচ-ছ’টি সদ্যোজাত শাবক সমেত মল্লিকার ঘরের ভাজা মাছ চুরি করে খাওয়া ও বাড়িশুদ্ধ লোকের মুখঝামটা খাওয়া সুন্দরী ‘করবী’-র আশ্রয়-স্থলে পরিণত হয়েছে।
একটি ঘরের ভাঙা উনুনের ওপর সাতদিন ধরে বিড়াল চরছে দেখলে অন্য সময় রুচির বুক হাহাকার করে উঠত। কিন্তু কাল আর তা হল না। বরং ডানদিকের ঠোঁট দুটো ঈষৎ চেপে সে ‘আচ্ছা চলি, রাত বেশি হয়েছে’ বলে বেরিয়ে এসেছে। অর্থাৎ এভাবে সে অহঙ্কারী প্রতিবেশিনীর ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে।
এখন ময়নার মুখে ‘রুণু’ নাম শুনে রুচি আবার চমকে উঠল।
‘ও তো হাসপাতালে।
‘আমি হাসপাতালে যাব। কাছেই।’
কি একটু ভেবে রুচি বলল, ‘কিন্তু তোমার বাবা তো তোমাকে তা বলেনি। যাচ্ছ স্কুলে। সত্যি কি না? তাছাড়া–’, রুচি থামল। ময়না আবার চোখে আঁচল তুলেছে। হাতের বর্ণবোধটা ছিটকে নিচে মাটিতে পড়ল।
‘ছি ছি কী মেয়ে তুমি, বার বার বই ফেলে দিচ্ছ!’ রুচি বিরক্ত হয়ে নুয়ে বইটা তুলে আবার ময়নার হাতে গুঁজে দিলে। ‘তা ছাড়া এখন তোমাকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাই, তা তো হয় না। দশটা কুড়ি। এগারোটায় আমায় ক্লাশ, এসো।’ শেয়ালদা স্টেশনের ঘড়ি দেখা শেষ করে রুচি ময়নার দিকে তাকাতে অবাক হয়ে গেল। টাই-স্যুট পরা বড় বেশি মার্জিত পরিচ্ছন্ন একটি ছেলে। যুবক ঠিক না, কিশোরও নয়। সবে গোঁফের রেখা উঁকি দিয়েছে। দিচ্ছিল। কিন্তু নির্মম হয়ে তার ধারগুলোতে এখন থেকেই যেন ও ক্ষুর চালাতে আরম্ভ করেছে, রুচির অনুমান করতে কষ্ট হল না। মাথায় কালো কোঁকড়া চুল। কিন্তু সেখানেও ধারগুলো ওপর থাক ফেলে ফেলে নিয়মিত নানারকম যন্ত্রপাতি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে রুচি যেন ভিতরে ভিতরে একটু যন্ত্রণা অনুভব করল।
কিন্তু রুচির চেহারার ভাবান্তর লক্ষ্য করতে একটুও সময় নষ্ট না করে পার্ক স্ট্রীটের সন্তোষ পকেট থেকে সিগারেট কেস্ তুলে সিগারেট বার করল। সিগারেট ধরিয়ে সে ময়নার দিকে কটমট করে তাকায়।
‘কী অদ্ভুত মেয়ে তুমি। দু’দিন পার করে এসেছ রুণুকে দেখতে?
ময়না কথা বলছে না। কান্না থামিয়ে চোখ মুছছে। ‘কাল বিকেলের দিকে একবার সেন্স ফিরে এসেছিল। দু’বার ‘ময়না’ ‘ময়না’ ডেকেছিল রুণু। আর তুমি বাড়িতে চুপটি করে বসে আছ!’
ময়না এবারও নীরব। অধোবদন।
‘বেবি গিয়ে কি তোমায় বলেনি?’ রুচির দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরে যেন তাকে রীতিমত উপেক্ষা করে সন্তোষ ময়নার মুখোমুখি দাঁড়ায়। ‘কথা বলছ না কেন। কী, রুণু তোমায় ভালবাসত তো,–অথবা যদি বলি তুমি সাংঘাতিকভাবে রুণুর প্রেমে পড়েছিলে, কথাটা কি মিথ্যে বলা হবে? আমি সব জানি। রুণু আমায় সব বলত। আমার বুম ফ্রেন্ড ও। আমরা এক জায়গায় থেকে বড় হয়েছি। ক’দিন আর ওরা পার্ক স্ট্রীট ছেড়ে কুলিয়া-টেংরার বস্তিতে গেছে!’
বড় বড় জলের ফোঁটা ময়নার গাল বেয়ে চিবুকের কাছে এসে জমতে লাগল।
সন্তোষ, যেন খুব উত্তেজিত অস্থির হয়ে আছে, একটু চুপ থেকে আরো দু’ একটা টান দিয়ে এতবড় সিগারেটটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পকেট থেকে সুন্দর একটা রুমাল বার করে ঠোঁট মুছল।
আমার কথার উত্তর দাও। জান, কাল সারারাত আমার ঘুম হয়নি। কাল বিকেলেও যখন তুমি এলে না, আমি, রুণুর তো জ্ঞান নেই, এদের–আমার অন্য বন্ধুদের কাছে বলেছি যে, তুমি কতবড় ইনসিন্সিয়ার, হ্যাঁ, প্রেমের ব্যাপারে। রুণু পাগলের মত ভালবেসেছিল–কিন্তু তুমি,–তোমার ভালবাসায় ফাঁক ছিল, ফাঁকি ছিল –এ্যাম আই নট্ ট্রু? উত্তর দাও। চুপ করে কেবল কাঁদার কোন অর্থ হয় না। ময়নার হাত ধরে সন্তোষ জোরে ঝাঁকুনি দিল। সন্তোষের ওপাশে দাঁড়িয়েছিল আর দু’টি ছেলে। সমবয়সী। সন্তোষের মত ওদেরও চক্চকে জুতো, রঙিন টাই, দামী কোট প্যান্ট, পরনে।
‘আহা লাগবে।’ দুটি ছেলে এক সঙ্গে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। ‘মারধর করিস নে।’
সব শুনে দেখে রুচি হতভম্ব। একটা কথাও সে বলছিল না। কিন্তু এখন আর চুপ করে তাকতে পারল না।
‘তোমরা কে?’
‘আমার নাম সন্তোষ। এরা আমার ফ্রেন্ড। জীবন, অসিত। আমরা পার্ক স্ট্রীটে থাকি।‘
‘ময়নাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’
‘হাসপাতালে। ক্যাম্বেল হাসপাতালে রুণু আছে। বাড়িয়ালা ওকে গাড়ি চাপা দিয়েছে।’
‘আমি জানি। শুনেছি।’ রুচি আস্তে আস্তে বলল, ‘এখন ও কেমন আছে?’
সন্তোষ এ-প্রশ্নের জবাব দিল না। পাশের আর একটি ছেলে রুচির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কে–আপনাকে তো চিনতে পারছি না।’
‘ইনি একজন স্কুল মিসট্রেস। কুলিয়া টেংরার সেই বস্তিতেই থাকেন।’ রুচির হয়ে সন্তোষ বন্ধুর প্রশ্নের জবাব দেয় এবং এবারও সে রুচির দিকে তাকায় না, ময়নার সঙ্গে কথা বলে ‘উত্তর দাও। আমি জানতে চাই, তোমার মনে কি আছে।’
‘বাবা আসতে দিচ্ছে না।’ ময়না এই প্রথম জলভরা বড় বড় চোখ মেলে সন্তোষের দিকে তাকায়।
‘আসতে দিচ্ছে না, পালিয়ে আসতে পারিনি?’ সন্তোষ মুখ খিঁচিয়ে উঠল। ‘হি ইজ ডাইং আর বাড়িতে বসে তুমি সুখের ভাত খাচ্ছ!’ এত জোরে সন্তোষ কথা বলছিল যে, আশে পাশে রাস্তার লোক দাঁড়িয়ে পড়ে এখন। রুচির ভীষণ লজ্জা করছিল। দু-একজন এদিকে তাকিয়ে পর্যন্ত গেল।
‘তুই বুঝতে পারছিস না সন্তু–বস্তিতে থাকে, লেখাপড়াও তথৈবচ, ফরোয়ার্ড মেয়ে না। হয়তো বাপ ভয় দেখিয়েছে।’
‘দেখিয়েছে তা আমি জানি।’ বন্ধুর দিকে না চেয়ে সন্তোষ বলল, ‘আমি বেবির মুখে সব শুনলাম কাল। বাড়িওয়ালা গাড়িচাপা দিয়েছে রুণুকে, কিন্তু রটাচ্ছে অন্য রকম।’
‘আমার তো মনে হয়, লোকটা টাকা দিয়ে ময়নার বাবার মুখ বন্ধ করেছে। না হলে ময়না তো ঘটনার সময় ছিল। ওই তো একমাত্র উইটনেস।’ আর একটি বন্ধু মন্তব্য করল।
‘তা করুক টাকা দিয়ে ওর বাবার মুখ বন্ধ।’ সন্তোষ মাথা ঝেঁকে উঠল। ‘কিন্তু তাই বলে ওর কি উচিত চুপ করে থাকা? লভ্–এন্ড দিস ইজ হার ফার্স্ট লভ্। অসভ্য মেয়ে, মূর্খ মেয়ে।’ যেন সন্তোষ আবার ময়নার হাত ধরতে যায়। বন্ধুরা তাকে বাধা দিলে। ময়না চোখে আঁচল গুঁজল।
রুচি রীতিমত অপ্রস্তুত। অস্থির চোখে আর একবার সে স্টেশনের ঘড়িটা দেখল। বলাই তার সঙ্গে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়েছে। রাস্তায় এভাবে সন্তোষ ও তার বন্ধুদের উদয় হবে এবং ময়নাকে ধরে তারা হাসপাতালে রুণুর কাছে নিয়ে যেতে চেষ্টা করবে, সে ধারণা করতে পারেনি। অবশ্য রুণুকে দেখতেই ময়না অবিশ্রাম কাঁদছিল। এই অবস্থায় এখন তার কি করা উচিত রুচি ভাবতে লাগল।
‘কাল থেকে এ অবধি আমি তেত্রিশটা বাস এটেন্ড করেছি। টেংরার, বেলেঘাটার। হ্যাঁ, এই স্টপেজে দাঁড়িয়ে। কত লোক নামল, কত লোক উঠল। কত মুখ দেখলাম। এন্ড ইউ ডিড নট টার্ন আপ। রাস্কেল মেয়ে।’
‘থাক, এসে গেছে যখন, আর গালিগালাজ করিসনে, ও তো এসেছেই ওর লাভারকে দেখতে।’
‘না আসেনি।’ সন্তোষ উত্তেজিত হয়ে বন্ধুদের দিকে তাকাল। ‘তোরা দেখছিস ওর হাতে বই শ্লেট। উনি স্কুলে চলেছেন বাড়ির ‘টিচার’টির সঙ্গে। আমি কি মিথ্যা বলছি। আপনি চুপ করে আছেন কেন?’ সন্তোষ রুচির দিকে ঘাড় ফেরায়। ‘আমি তো দেখলাম, বাস থেকে নেমেই আপনি ওকে স্কুলে নিয়ে যেতে টানাটানি করছিলেন। বলুন, আপনি ময়নাকে ডাকছিলেন কিনা।’
রুচি লজ্জিত, স্তব্ধ।
‘ষড়যন্ত্র করে ওদের সেই বাড়িওয়ালা সমস্ত ঘটনা গোপন করার চেষ্টা করেছে অসিত, বুঝলি। কাল একবার আমি ও-পাড়ায় গিয়েছিলাম ময়নার খোঁজে। বাড়ির দরজা আগলে বসে থাকে একটা মুদি। আমি ময়নার কথা জিজ্ঞেস করতেই রাস্কেলটা বলল, এখানে নেই, ময়নার বাবা ময়নাকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।’
‘তুই বাড়িতে ঢুকলি না কেন?’
‘না, রুণু নেই। তাছাড়া রুণুর বাবা হ্যাঁ, কে. গুপ্ত কোন সময়েই আমাকে ভাল চোখে দেখে না। মুদি দোকানের সামনেই তখন বসা ছিল। চোখ লাল করে আমায় বলল–ভাগ্ এখান থেকে। যত সব বখাটে ছেলে। আমি আর করি কি, ফিরে এলাম। ভদ্রলোকের মাথা এখন আর ঠিক নেই, আমি জানি। তারপর বেবির মুখে তো সবই শুনলাম।’
‘মুদিটা স্পাই। কে বাড়িতে ঢুকেছে না ঢুকেছে, সেদিকে কড়া নজর রাখছে, কি বলিস?’ অসিত হাসল।
‘তা ও নজর রাখুক না-রাখুক, তাতে কিছু আসে যায় না।’
সন্তোষের আর এক বন্ধু জীবন গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি শুধু ভাবছি সেই বাড়িঅলার কথা। কত বড় ব্রু,’কত বড় বদমায়েস। সকলের আগে ওই হারামজাদাকে শিক্ষা দেওয়া দরকার।’
‘শুনছি তো বস্তির ধারেই ওর বাংলো।’
জামার আস্তিন গুটিয়ে অসিত তার ডান হাতটা ঢিল ছোঁড়ার মতন শূন্যে নেড়ে বলল, ‘আমার তো এখনি ইচ্ছা করছে শালাকে গিয়ে দু’ঘা বসিয়ে দিয়ে আসি।’
‘তা হয়তো বসানো যায়, কিন্তু আমার মাথায় এখন সেই চিন্তা নেই।’ সন্তোষ গম্ভীরভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘আই অ্যাম থিংকিং অব দিস স্টুপিড় গার্ল।’ সন্তোষ ময়নার দিকে আবার কটমট করে তাকায়। ‘হার্টলেস, আমি বলব। রুণু তোমায় ভালবাসত–ভালবাসার এই রিয়োয়ার্ড, কেমন? সত্যি, ও গাড়ি চাপা পড়েছে বলে আমার যত বেশি না দুঃখ হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি লাগছে তোমার ব্যবহারে।’ সন্তোষ থামল। ময়না চোখ থেকে কাপড় সরাল। নিথর নিস্পন্দ মূর্তি। এক সেকেন্ড কি তারও একটু বেশি সময় স্থির অপলক চোখে সন্তোষের মুখের দিকে তাকিয়ে পরে তার হাত ধরে ময়না রীতিমত আর্তনাদ করে উঠল। ‘আমি রুণুকে দেখতে এসেছি সন্তোষ, তুমি আমায় ওর কাছে নিয়ে চল। রুণুকে দেখতে না পেয়ে আমি যে কত কেঁদেছি, তুমি জান না। চল এখন চল।’ ময়নার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছিল। যেন সন্তোষের চোখের কোনায় জল দাঁড়িয়েছে। সুন্দর রুমালটা দিয়ে সে চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, ‘তুমি এদের, আমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস কর, আজ সারা সকাল আমি কী বলেছি। হ্যাঁ, খুব খারাপ রিমার্ক করেছি তোমার সম্পর্কে।’ ময়নার ঘাড়ের ওপর এবার কোমলভাবে হাত রাখল সন্তোষ। ‘আমি সব সহ্য করতে পারি ময়না, প্রেমের অপমান সহ্য করতে পারি না। আজ আমাদের পার্ক স্ট্রীটের কোনো মেয়ে হলে আর তার লাভার যদি এভাবে হাসপাতালে শুয়ে থাকত ও তাকে দেখতে না পেত তো পটাসিয়াম সায়নাইড মুখে দিয়ে সুইসাইড করত। অবশ্য তুমি ততটা ফয়োয়ার্ড না আমি বেশ বুঝতে পারি। যে পরিবেশে তুমি আছ, তাতে তা না হবারই কথা, তোমাকে খুব দোষও দিচ্ছি না। তুমি মনে রেখো, তোমার ও রুণুর প্রেমের ব্যাপারে আমি প্রথম থেকেই খুব ইন্টারেস্টেড। রুণুকে জিজ্ঞেস করে দেখো। রাতদিন ও আমার কাছে তোমার গল্প করত; ওকি, বেণীটা খুলে গেল কেন? থাক আর কেঁদো না।’
‘আমি যাব, আমায় তুমি নিয়ে চল।’
‘ময়না!’ রুচি ডাকল।
‘আপনি যান, আপনি স্কুলে চলে যান, ময়না আমার সঙ্গে হাসপাতালে যাচ্ছে।’ সন্তোষ ঘাড় ফেরায়।
‘এভাবে এখন ওকে আমি ছেড়ে দিতে পারি না।’ রুচি একটু শক্ত গলায় উত্তর করল। ‘ওর বাবা আমার সঙ্গে ওকে স্কুলে পাঠিয়েছে, আজ ওর এ্যাডমিশন নেবার কথা।
‘হেল্ উইথ এ্যাডমিশন, হেল্ উইথ ইউর লেখাপড়া।’ নাটকীয় ভঙ্গীতে শরীরে একটা ক্ষিপ্র মোচড় দিয়ে সন্তোষ রুচির দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ‘আপনার শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে–আপনার,–আপনার জীবনে প্রেমের রক্তকমল কোনদিনই ফোটেনি, তাই বোধ করি আজ এ অবস্থায় এখন এখানে আমাদের সামনে একথা বলতে পারছেন মিসেস। যান, আপনি চলে যান।’ বলে আর অপেক্ষা না করে সন্তোষ ময়নার হাত ধরে বাঁ দিকের পেভমেন্ট ধরে দ্রুত হাঁটতে লাগল। সন্তোষের সঙ্গীরাও চলে যাচ্ছিল। কি ভেবে তারা ঘুরে দাঁড়ায়। রুচির দিকে তাকিয়ে যেন তাকে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গীতে অল্প হেসে অসিত বলল, ‘যান, আপনি আপনার স্কুলে চলে যান। পরের চাকরি করছেন, নিজের সংসার আছে, খামোকা এ-ব্যাপারে আমরা আপনাকে টানব না।’
‘হয়তো আমরা থানা-পুলিশ করতে পারি। পারিজাতকে শিক্ষা দিতেই হবে। জানি না, শেষ পর্যন্ত সন্তোষের কি ইচ্ছা–তবে–’ বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে জীবন বলল, ‘প্রেমের ব্যাপারে সে অত্যন্ত সিরিয়স, সেন্টিমেন্টালও বলতে পারেন–আমাদের সকলের চেয়ে বেশি। এ জন্যই ওকে এত ভাল লাগে। ম্যাট্রিকে গত বছর ও ফেল করল, কিন্তু পরীক্ষায় পাস করাই তো মানুষের জীবনের বড় কথা নয়। রবি ঠাকুরের ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী ছিল না জানেন। তেমনি সন্তোষও এগজামিনের খাতায় পার্টস দেখাতে পারেনি। কিন্তু যেখানে দেখাবার, সেখানে সে দেখিয়েছে। আপনার জানবার কথা নয়। সন্তোষ একটা প্রেমের উপন্যাস লিখেছে। বস্তির মেয়ে ময়না এবং পার্ক স্ট্রীটের ছেলে রুণুকে অবলম্বন করেই অবশ্য গল্প। সিনেমার এক প্রডিউসারকে বইটা অলরেডি দেখানো হয়ে গেছে। সম্ভবত একসেপটেড হবে। আর কি; তবেই সন্তোষ জীবনের একটা ধারা খুঁজে পেয়ে গেল। পেয়েই গেছে। আমার ত মনে হয়, পরীক্ষায় ফেল করাটাই ওর জীবনে আশীর্বাদ’
বন্ধুর কথা থেমে গেল। ওধার থেকে সন্তোষ চিৎকার করে ডাকল, ‘এই জীবন অসিত! ওখানে দাঁড়িয়ে তোরা কি বকর বকর করছিস। অত্যন্ত একঘেয়ে ষ্টীরিওটাইপ্ড শিক্ষয়িত্রী- জীবন যার, তাকে ভালবাসার তত্ত্ব বুঝিয়ে লাভ কি–তোরা আচ্ছা ছেলেমানুষ, চলে আয়, আমাদের অনেক কাজ।’
ওরা চলে গেল।
‘মা চল।’ মঞ্জু ডাকছিল।
‘চল মা।’
মঞ্জুর হাত ধরে রুচি সাবাধানে রাস্তা পার হ’ল। উল্টো দিকের ফুটপাথে উঠে বনমালীকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে ভীষণ চমকে উঠল। মাথায় একটা লাল গামছা জড়ানো। রোদ ঠেকাতে কি? হাতে দুটো বনস্পতির টিন। দু বগলে পাঁচ-ছটা কাগজের বাক্স। দাঁত বের করে বনমালী, রুচির দিকে না যদিও, মঞ্জুর দিকে চেয়ে হাসি। ‘খুকি বুঝি মা’র সঙ্গে ইস্কুলে চলেছিস। আমি বড়বাজার থেকে মাল কিনে ফিরছি।’ ইত্যাদি সংক্ষেপে দু-একটা কথা সেরে ব্যস্ত হয়ে সে রাস্তার ওপারে বেলেঘাটার বাসস্ট্যান্ডের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল।
রুচি সবটা বিষয় তার স্কুলের একজন মিসট্রেস বন্ধুকে বলতে তিনি বললেন, ‘আপনি খামকা চিন্তা করছেন। আপনার দোষ কি। আপনাদের বাড়ির বলাইবাবুকে গিয়ে বলবেন, তার মেয়েকে নিয়ে যা যা ঘটেছে। তিন-তিনটে যোয়ান ছেলের সঙ্গে গায়ের জোর বা মুখের তর্ক কোনটাতেই আপনি পারেন না, পারা উচিত না। কাজেই এখানে আপনাকে দোষ দেওয়া মিছা।
উপদেশ পেয়ে রুচি কিছুটা শান্ত হ’ল।
.
হল, কিন্তু আজ এই প্রথম বেঞ্চের ওপর চুপচাপ বসে থাকা শান্ত মার্জিত স্নিগ্ধ-চক্ষু বর্ণাঢ্য পোশাকে সজ্জিত শহরের উনিশটি মেয়েকে তৈমুরলঙের জীবনী পড়িয়ে শোনাবার সময় বারো ঘর এক উঠোনের উগ্র উলঙ্গ ছবিটা মনে করে সে বড় বেশি চমকে উঠল। হ্যাঁ, সেই বাড়ির কমলা এক বিবাহিত ভদ্রলোকের সঙ্গে চলে গেছে, সুনীতি পালিয়েছে এক কুৎসিত ব্যাধিগ্রস্ত ছেলের সঙ্গে, নিরক্ষরা ময়না কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল হাসপাতালে তার মুমূর্ষু প্রেমিককে দেখতে। সেই বাড়ির বাসিন্দা রুচি। যেন ভাবতে বিস্ময় লাগে। এরা কি জানে, এই কচি নিরীহ নিষ্পাপ মুখগুলি সুন্দর চোখ মেলে অসহায়ের মত যারা তাকিয়ে আছে তাদের একান্ত শ্রদ্ধার পাত্রী রুচিদির দিকে, তিনি কোথায় কোন্ নরক থেকে বেরিয়ে এসেছেন ওদের লেখাপড়া শেখাতে! অভিমানে রুচির দুচোখ এক সময় ভারী হয়ে উঠল। কিন্তু ভাবনার সেখানেই শেষ না। আর একটা ভাবনা, আরো কতকগুলি কথা রুচির মনে অনেকক্ষণ ধরে উঁকি ঝুঁকি মারছিল। টিফিনের ঘণ্টায় লাইব্রেরীর এক কোনায় বসে কৌটা থেকে মঞ্জুকে খাবার বের করে দিয়ে রুচি পার্ক স্ট্রীটের পরীক্ষায় ফেল করা সন্তোষ ও তার বন্ধুদের কথা ভাবতে লাগল। আপনার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। প্রেমের রক্তকমল কোনদিনই আপনার জীবনে ফুটল না। একঘেয়ে শিক্ষয়িত্রী-জীবন। ময়নাকে বাধা দেবার আপনি কে? ভাবল রুচি, আর ক্লান্ত বিষণ্ণ চোখ মেলে জানালার বাইরে কড়ি-গাছটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শিবনাথের অনেকদিন চাকরি নেই। মোক্তারামবাবু স্ট্রিটের বাসা ছেড়ে আজ কত দিন হয়ে গেল তারা আঠারো টাকা ভাড়ার বস্তির টিনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আজকের মত এমন মন খারাপ তার কোনদিন হয়নি–দুর্দমনীয় আত্মধিক্কারে তার শরীর মন আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে।
৩৭
সন্ধ্যা হব হব করছে। রমেশের চায়ের দোকানে এইমাত্র আলো জ্বালা হয়েছে। রমেশ নিজেই চিমনিটা ঘষে মুছে পরিষ্কার ক’রে এবং আরো খানিকটা তেল লণ্ঠনে পুরে সলতে কেটে পরে তাতে আগুন ধরিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে এসে শিবনাথের পাশে বসল। শিবনাথের সামনে টেবিলের ওপর একটা শূন্য চায়ের বাটি। চা শেষ ক’রে সে সিগারেট ধরিয়েছে। শিবনাথ চিন্তান্বিত, চেহারা দেখে বেশ বোঝা যায়। এইমাত্র বাইরের একটি লোক বসে চা খাচ্ছিল। এবং সম্ভবত বাইরের লোকের সামনে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করছিল বলে লোকটি বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত রমেশ শিবনাথ দু’জনই চুপ ক’রে ছিল। হাত ধুয়ে রমেশ এসে পাশে বসতে শিবনাথ বলল, ‘ইচ্ছে ছিল শালার মাথায় চাটি বসিয়ে দিই। স্ত্রী নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি আমি সহ্য করতে পারি না।’
‘ওর মাথার ঠিক নেই বলছি তো। কি বলছিল আপনাকে?’ রমেশ বিড়ি ধরায়। ‘আমার স্ত্রীর সিনেমায় নামবার ইচ্ছা আছে কিনা। তবে তার ফ্রেণ্ড চারু রায়কে বলে এখুনি কন্ট্রাক্ট সই করিয়ে দেয়।’
শিবনাথের কথা শুনে রমেশ অল্প শব্দ করে হো-হো করে হাসল। ‘রসিক বটে। কে. গুপ্ত পাগল হলে কি হবে এমনিতে রসজ্ঞান টনটনে।’
‘একেবারে গলায় ধাক্কা দিয়ে কাঁটাঝোঁপের ওপর ফেলে দিয়েছিলাম, এত রাগ হয়েছিল লোফারটার প্রস্তাব শুনে।’
‘বেশ করেছেন। জুতো মারবেন শালাদের। যতসব বেকার বাউন্ডুলে। ঘাটের মড়ারা এখানে এসে উঠেছে, বাড়িভাড়া দিচ্ছে না, দোকানে বাকি রাখছে, এদিকে কিছু বলতে গেলে বাবুদের অপমান।’
রমেশ আরো কিছুক্ষণ বিড়ি টেনে পরে শিবনাথের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, ‘এটা কে. গুপ্তর ওই শালা বন্ধু সিনেমার লোকটার উস্কানি। বুঝলেন না। কোনরকমে শুনে ফেলেছে আপনি বেকার। তারপর মাছির মত এসে জুটেছে।’
‘আমার স্ত্রী এখনো সার্ভিসে আছেন এটা ভদ্রলোকের বোঝা উচিৎ।’.
‘সিনেমার লোক কি আর ভদ্রলোক হয় মশাই, টাকার গরমে সব শালা পাজী বদমায়েস দাজ বনে যায়। ‘
‘না না, চারুবাবুর দোষ নেই। সব বদমায়েসী কে. গুপ্তর, আমি টের পেয়েছি। এসব বলে খাতির দেখিয়ে আমার কাছে পয়সা ধার চেয়েছিল। ফলে উল্টো ফল হ’ল।’
‘একটি পয়সাও ধার দেবেন না।’রমেশ চোখ বুজল। বিড়িতে শেষ টান দিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘সেই জন্যই বলছিলাম, আপনি চান্স নষ্ট করবেন না। অর্থাৎ বেশিদিন ইয়ে থাকাটা পারিবারিক শান্তির দিক থেকেও ভাল না। আপনি ভাববেন না যে, কালকে রাতে আপনারা স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া করেছেন শুনে আজ আমি একথা বলছি। আমার সঙ্গে মল্লিকার রোজ ঝগড়া খিটিমিটি বেধেই আছে। পারিজাত, তার স্ত্রীর সঙ্গে কেমন মাথা ফাটাফাটি করে সেদিন টের পেয়ে এসেছেন। সেসব কিছু না। আসল হ’ল এই বুঝেছেন। এই থাকলে স্ত্রী কোনমতেই পুরুষের অবশ থাকে না।’ রমেশ দু’আঙুলে টাকা বাজাবার ইঙ্গিত করল।
‘তা তো বটেই।’ শিবনাথ গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
‘আপনি চলে যান। আপনাকে টুইশনি দিতে যদি পারিজাতের স্ত্রী আপত্তিও করে, আপনাকে অন্যভাবে সুবিধা করে দেবে সে। আপনি আজ তার একটু উপকার করতে পারলে এ তল্লাটে কোনদিন আপনার মার নেই। চাকরি করুন চাই না করুন।’
শিবনাথ আবার চিন্তান্বিত হল।
অর্থাৎ এই ব্যাপার নিয়েই সে বিকেলে রমেশের সঙ্গে পরামর্শ করতে ছুটে এসেছে। পরিজাত তাকে ডেকেছে। ব্যাপারটা ঘটেছে অবশ্য রুচির জন্য। সকালে ও বলাইর মেয়ে ময়নাকে নিয়ে স্কুলে যায়। কিন্তু রাস্তায় শেয়ালদা নেমেই ময়না দু’তিনটে ছেলের সঙ্গে রুণুকে দেখতে হাসপাতালে চলে যায়। ময়না হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেনি। কোথায় গেছে, কেউ বলতে পারে না। সম্ভবত সেই তিনটি বখাটে ছেলেই ওকে কোথায় আবার নিয়ে গেছে। রুচি কেবল মঞ্জুকে নিয়ে ঘরে ফিরেছে। বলাইর কাছে ঘটনাটা বলতেই সে তিন লাফ দিয়ে বারো ঘরের মস্ত উঠোন পার হয়ে শিবনাথের ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকে রুচিকে এবং সেই সঙ্গে শিবনাথকে অপমান করতে চেয়েছিল। অবশ্য তা আর করতে পারেনি কেননা, তার আগেই শিবনাথ দরজার পাল্লা দুটো বন্ধ করে দেয়। বলাই রাগে ফুলতে ফুলতে এবং শিবনাথ ও তার স্ত্রীকে যাচ্ছে-তাই গালিগালাজ করতে করতে ছুটে বাড়ি থেকে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেছে। ঠিক তখন পারিজাতের সরকার মদন ঘোষ গিয়ে শিবনাথকে খবর দেয়। বাবু তাকে এখনি যেতে ডাকছেন।
‘কি ব্যাপার?’
মদন ঘোষ কিছু বলতে পারেনি। কেবল কে. গুপ্তর ঘরের দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে চুপ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।
ব্যাপারটা কে. গুপ্তর ছেলে সম্পর্কে শিবনাথের বুঝতে একটুও কষ্ট হয়নি। এবং তাকে এসব কিছুতেই পেত না যদি আজ হাসপাতালে রুণুর সঙ্গে ময়নার দেখা হওয়ার ব্যাপারে রুচিও অংশত জড়িত না থাকত।
মূর্খ বলাইর ব্যবহারে রুচি ভয় পেয়ে গেছে। যদিও এ-ব্যাপারে ও কিছুই না। এমন সময় মদন ঘোষকে পাঠিয়ে পারিজাতের ডাক। এখনই দেখা করা যুক্তিসঙ্গত কিনা শিবনাথ প্রশ্ন করতে গম্ভীর মুখ করে রমেশ বলেছে, ‘না, এ-ব্যাপারে যে আপনার স্ত্রী কিছুই না, পারিজাত একজনের কাছে আগেই খবর পেয়েছে। স্ত্রী সম্পর্কে আপনার ভাবনা নেই।’
‘কে লোকটা। কার কাছে খবর পেল?’
‘বনমালী।’
‘ও তখন কি শেয়ালদায় ছিল।’
রমেশ মাথা নাড়ল।
‘দোকানের মাল কিনে ফিরছিল বনমালী।’ শিবনাথ অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়।
ময়না ও রুণুর ব্যাপার নিয়ে বলাই তার স্ত্রীকে অপমান করেছে এবং কাল তাদের একটা সামান্য কাঁচের গ্লাস ভাঙা নিয়ে কে. গুপ্ত শিবনাথের স্ত্রী সম্পর্কে বিশ্রী কথাবার্তা বলেছে। অবশ্য তার দরুন সে কে. গুপ্তকে কিভাবে গলাধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল, সে ঘটনাও শিবনাথকে পুরোপুরি বলতে হ’ল।
সেই সূত্রেই রমেশ টাকাপয়সা, সঙ্গতি, সহায় সম্বল, নিজের খুঁটির জোর রাখা নিয়ে এতক্ষণ শিবনাথকে বোঝাচ্ছিল।
‘ধরুন পারিজাত যদি কোনো ব্যাপারে আপনার একটু সাহায্য চায়, আমি বলব নিশ্চয় আপনার এগিয়ে যাওয়া উচিত।’
কিসের সাহায্য, কোন্ বিষয়ে শিবনাথ পরিষ্কার বুঝতে না পেরেও খুব বেশি অস্বস্তি বোধ করল না। যেন কিছুটা আন্দাজ করেই চুপ করে রমেশের মুখের দিকে তাকিয়ে সে আরো কি বলে অপেক্ষা করে।
আপনি কি পারিজাতের ওখানে গিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ,’ রমেশ বলল, ‘এই তো ফিরলাম। ইলেকশনের ব্যাপারে দুটো শলাপরামর্শ করতে ডেকেছিল। আপনি যান। আমাকে বলছিল আপনার সঙ্গে দেখা হলেই পাঠিয়ে দিতে।’
শিবনাথ চুপ করে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল। রমেশ বলল, ‘মান ইজ্জত, সম্ভ্রম সুখ সব থাকে পকেটে দুটি পয়সা থাকলে। ব্ল্যাক মার্কেট, মিছে কথা। আরে মশাই, চারিদিকেই যখন ভেজালের বাজার, আমার মধ্যেও একটু-আধটু ভেজাল রাখতে হবে বৈকি। না হলে বাঁচব কি করে এই দুর্দিনে। চিন্তা করে দেখুন।’
শিবনাথ ঘাড় নাড়ল। ‘তাতো বটেই, কে কাকে এখন–’ সে থামল।
‘সাচ্চা থেকে থেকে অমলটা নিজের স্ত্রীকে বেশ্যা বানাল শুনলেন তো।’ রমেশ বলল। এই গল্প শিবনাথই করেছে একটু আগে রমেশের কাছে। ঘোলপাড়ায় চারু কেমন আদরে আছে। আর এত করেও কে. গুপ্ত কিরণের হাতে গলাধাক্কা খেল। কারণ বেচারার পয়সা নেই।
‘তবে আর কি। সংসারে মানুষের আগে কি দরকার চারদিক দেখে শিখেছেন যখন, চান্স এলেই আগে নিজের খুঁটি জোরদার করতে কারো দিকে তাকাবেন না, এই আমার শেষ পরামর্শ।’ হিস হিস করে রমেশ কথা বলছিল। তেমনি হিস হিস শব্দ হচ্ছিল দূরের একটা করাত কলের। তৃপ্তি-নিকেতনের চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুলিয়ে বেবিকে এবং ক্ষিতীশকে আজ একবারও দেখল না শিবনাথ।
রমেশ বলল, ‘রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ পারিজাত কলকাতা থেকে ফিরবে আর একটু অপেক্ষা করুন। আর একটু চা খাবেন?
তৃপ্তি-নিকেতন।
তেমনি উর্বশী-হেয়ার কাটিং সেলুন। সন্ধ্যাবাতি লাগানো হয়েছে। এইমাত্র একটি খদ্দেরের মুখ কামিয়ে ক্ষুর ধুয়ে সাফ্ করে পাঁচু তোয়ালে দিয়ে হাত মুছছিল। যতক্ষণ খদ্দের ছিল আর একটা চেয়ারে উপবিষ্ট বিধু মাস্টার কথা বলছিল না।
হাত মোছা শেষ করে পাঁচু দরজায় এসে সিগারেট ধরাল। পাঁচু বাইরে রাস্তার দিকে চেয়ে সিগারেট টানছে লক্ষ্য করে বিধু মুখ খুলল। একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, না, মন ঠিক ক’রে ফেলেছি। তুমি কালই আরম্ভ করে দাও পাঁচু।’
‘আমি লুকিয়ে ছাপিয়ে ব্যবসা করব না। আমি চিটিংবাজ নই। তোমায় বললাম মাস্টার লোক জানাজানি হবে। এখন তুমি নিজে ভেবে দ্যাখ। কারবারে নেমে আমি লোক ঠকাতে ‘রাজী নই।’
‘না, আমি ঠিক করেছি।’ মাস্টার দাড়ির জঙ্গলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘নিত্য অভাব সহ্য হয় না পাঁচু–পেটে খেতে পাই না তো সুনাম ধুয়ে জল খাব নাকি। তুমি আরম্ভ করে দাও। কালই সাইনবোর্ডটা লিখিয়ে ফেল।’
পাঁচু ঘুরে দাঁড়ায়।
কাটা ঠোঁট খুলে হেসে বলে, ‘আমায় যখন তুমি মালিশের ব্যবসায় নামতে সাহস দিচ্ছ, আমিও তোমার সুবিধাটা আগে দেখছি। তাই তো বলছি, এই চান্স নষ্ট করো না।’
‘না না ঠিক আছে।’ মাস্টার ঘাড় নাড়ল। ‘একটা আধলা ধার দেয়ার ক্ষমতা নেই তো কোন্ হারামজাদাকে আমি তোয়াক্কা করব। আমার পায়া আমাকে শক্ত করতে হবে, খেয়ে বাঁচতে হবে।’
পাঁচু বেঝাল, ‘দরকার হলে তুমি বারো ঘরের আস্তানা গুটিয়ে ফেল। ছেলেমেয়েরা রোজগার আরম্ভ করলে কী দরকার তোমার ওই পচা বস্তিতে পড়ে থাকবার। একটু ভাল বাড়িতে–’
‘তুমি?’
‘আহা আমার কথা তো হচ্ছে না। আমি শালা কারবার শুরু করে তো কিছু আর রাজা হয়ে যাচ্ছি না। এটা আরম্ভ করছি তোমাদের দশজনের সুবিধার কথা ভেবে। গভর্নমেন্ট যেমন গাঁয়ে গাঁয়ে কুটির-শিল্প খুলে দেশের বেকার কমাবার প্ল্যান করছে। না হলে আমার শালা কি। কারবার খুলে লাখপতি হব না। আমি ওই শালা দিশিই টানব আর বস্তির ঘরেই থাকব।
একটু চুপ থেকে মাস্টার হাসল।
‘তা আমি জানি। তুমি–তোমার মধ্যে আমি চিরকালই প্লেইন লিভিং এন্ড হাই থিংকিং জিনিসটা লক্ষ্য করে আসছি। রমেশের মতন নিত্যনতুন ধুতিজামা জুতোমোজা পর না। তবে হ্যাঁ খাওয়া–তোমার ঘরে খাওয়াটা অনেকদিন ধরেই রমেশের ঘরের চেয়ে ভাল হয়। হুব্লা বলেছিল কাল আবার কাছিম এনেছিলে। খুব প্রোটিন ফ্যাট্ আছে ওতে। আই লাইক ইট্।’
পাঁচু কথা বলল না।
‘সেই কয়লাচোর বলাইও আজ আমাকে ঠাট্টা করে। আমার ঘরের হাঁড়ি তিনদিন চালের মুখ দেখছে না। কেবল মাসকলাই।’
পাঁচু চুপ করে সিগারেট টানে।
মাস্টার জীর্ণ ময়লা খুঁট দিয়ে একটা চোখের কোনা মুছল।
‘লোকের খাওয়া পরা নিয়ে যারা এভাবে ঠাট্টা করে তারা কতখানি পশু নরাধম একবার চিন্তা করে দ্যাখো পাঁচু।’
পাঁচু এবারও কিছু বলল না।
‘থাকবে না। এসব ভ্যানিটি থাকে না। মানুষের আত্মম্ভরিতা স্ট্যান্ড করতে পারে না, একজন আছে মাথার ওপর। গড়। শেখর ডাক্তার একদিন আমাকে ইন্সাল্ট করেছিল আজ তার ঘরের দুরবস্থা দ্যাখো।’
‘বললাম তো, আর বক্তৃতায় কি হবে। চান্স যখন এসে গেছে এইবেলা কামড়ে ধরো। নাও, বাড়ি যাও, আমি দোকান বন্ধ করব।’
হ্যাঁ, তোমার আবার ইয়ের সময় হয়ে পড়ে। না, তোমার আর ইতস্তত করতে হবে না। তুমি সাইনবোর্ড টাইনবোর্ড লিখিয়ে ঠিকঠাক করে নাও। আমি রাজি আমি আজই গিয়ে ওদের বোঝাব। দারিদ্র্যের সঙ্গে আর মিতালী না।’ ব’লে বিধু মাস্টার তখনই চেয়ার ছেড়ে ওঠে না। দোকানের বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে চুপ করে ভাবে। দূরে করাতকলের হিস হিস শব্দ হয়। এত রাত্রেও সেই ঢাউস মাছিটা নর্দমা থেকে উঠে এসে বিধু মাস্টারের দাড়ির এক জায়গায় চুপ করে বসে আছে। পাঁচু দেরাজ টেনে চাবির গোছা বার করল।
.
আর সন্ধ্যা ঝুলছে ‘সুরমা-লজে’–মিহির ঘোষালের বাড়িতে। তাঁর পরলোকগত স্ত্রীর নামে এ বাড়ীর নামকরণ। মিহিরবাবু কাল বীথিকে বলছিল। না হলে বীথি জানত না সুরমা কে, কি সম্পর্ক ওর এ বাড়ির সঙ্গে।
এইমাত্র সন্ধ্যা হয়েছে।
কালি-ঝুলি-মাখা লণ্ঠনের লালচে শিখা,–চারদিকে করাতকল, সুরকিকলের হিসহাস ভুভাস আওয়াজ, অফুরন্ত মশার গান আর কুকুরের ঘেউ-ঘেউ ও মোষের গাড়ির ক্যাচর ক্যাচর শব্দ নিয়ে এখানে সন্ধ্যা আসে না। বীথি পরশু দেখেছে, কাল দেখেছে, আজও দেখল। দেখল এবং অনুভব করল নিবিড় শান্ত পরিচ্ছন্ন দিবাবসানটি।
বাগানে পায়চারি করছিল বীথি। অদূরে সামনে একটি বেতের টিপয় রেখে দুটো ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে মিহির আর তার এক বন্ধু।
বীথির কোলে টুটুল। ঘুমিয়ে পড়েছে।
যেন এইবেলা ঘরে ঢুকে শিশুকে ঘুম পাড়াতে যাবে বীথি। কিন্তু মিহির কথা বলছিল বলে চট্ করে আর সে সরতে পারে নি। মিহির প্রশ্ন করছে, আর পায়চারি করে করে বীথি আস্তে আস্তে কথাগুলোর উত্তর দিচ্ছে।
মিহিরকে এ দু’দিনে যা-হোক সহ্য হয়ে গিয়েছিল বীথির। কিন্তু তার বন্ধুর সামনে আড়ষ্টতা, লজ্জা এবং অপরিচিত একটা ভয় কোনমতেই কাটাতে পারছিল না।
‘তোমাদের সেই বাড়িতে কি অনেক লোক?’ বন্ধু প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ।’
‘না তোমার সে-বাড়িতে থাকা সম্ভব না।’ মিহির বলল, ‘না না আমাদের সমাজ এখনো এ ধরনের কাজকে স্বাভাবিক বলে নিতে পারছে না। সত্যি তো। এখানে আমার বাড়িতে রাত্রে থাকা সেটা–’ মিহির থামল।
বীথি ঘাড় হেঁট করে জুতোর ডগা দিয়ে একটা ঘাসের শিষ ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করছিল। আর প্রায়ান্ধকার সেই মাঠে বীথির পা, ঘাসের শিষ ও জুতোর ডগা ছুঁয়ে ছুঁয়ে লঘুপক্ষ প্রায় চোখে দেখা যায় না সাদামতন ছোট্ট প্রজাপতিটা তখনো উড়ছিল। সেই বিকেল থেকে উড়ছে।
‘তবে কি ঠিক করলে?’ মিহিরের বন্ধু এবার প্রশ্ন করল। ‘তোমার গার্ডিয়ানদের তরফ থেকে কোন আপত্তি আছে কি না?’
বীথি আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল।
মিহির বলল, ‘না, তা নেই।’ বলে টিপয়ের ওপর থেকে সিগারেটের টিনটা কাছে টেনে নিল। পাখিরা ডাকছিল। হ্যাঁঙ্গারফোর্ড স্ট্রীটের ওপর বিস্তীর্ণ জমি নিয়ে মিহিরের বিরাট বাড়ির পিছনেও বড় বাগান। শেষ সীমানায় সারিবদ্ধ বড় বড় কড়ি ও বাঁশ গাছ দাঁড়িয়ে আছে বলে সেদিক থেকে রাজ সন্ধ্যায় এমনি সহস্র পাখির কিচিরমিচির ভেসে আসে। অবশ্য এখনি ওরা চুপ করবে।
‘তোমাদের ফ্যামিলিতে ক’জন মেম্বার?’ অন্ধকারে মিহিরের বন্ধুর ভ্রূ কুঞ্চন দেখা গেল না।
‘অনেক।’ মিহির সিগারেটের রাশি রাশি ধোঁয়া ছড়িয়ে শুকনো মোটা গলায় বলল, ‘শুনলাম ওর ওপরে তলায় আরো অনেক ভাইবোন।’
তালুর গায়ে জিহ্বা ঠেকিয়ে মিহিরবাবুর বন্ধু অনুচ্চ সহানুভূতিসূচক শব্দ করল।
‘ব্লান্ডার–দেয়ার লাইজ দি কজ অব অল আনহ্যাপিনেস মিজারিস মিসফরচুনস্ পোর্ভাটি–ডেস্ট্রাকশন। এমনি তো এখনো এদেশে আর্লি ম্যারেজের সংখ্যা বেশি।’
মিহির আর কথা বলল না।
বীথি আর ঘাসের বুকে পা ঠেকাল না।
‘এক কাজ করো–’যেন কি একটা প্রস্তাব দিতে গিয়ে মিহিরের বন্ধু চুপ করল।
‘কিছু করতে হবে না।’ মোটা খসখসে গলায় মিহির বলল, ‘ওবাড়ি ছেড়ে দাও–বারোঘরের বারোভূতের আড্ডায় তোমাদের থাকা উচিত না। তোমরা শহরে চলে এসো। সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’
‘আমরা আগেও কোলকাতায় ছিলাম।’
‘হ্যাঁ, তুমি তো বলছিলে দুপুরবেলা। বাদুড়বাগান না কোথায়?’
‘বৌবাজার।’
‘দ্যাট উইল বি গুড। নিজেরা রোজগার করবে, একটু ভালভাবে থাকবে খাবে এতে আবার কার এত কথা শোনার ধৈর্য। তোমার দিদির আজ ক’বছর যেন টেলিফোনে?’
‘তিন।’
‘উঁহু–দ্যাট ইজ নট এ গুড জব। এত ভাল চেহারায় এমন ওয়ান্ডারফুল ফিগারে আরো ভাল সম্ভ্রান্ত কাজের দরকার তোমার বোনের।’
আজ বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় প্রীতি এখানে হয়ে গেছে। ছোটবোনের নতুন কর্মস্থল ও কাজের রকমটা দিদি হয়ে তার একবার দেখা কর্তব্য-বিবেচনা করেই প্রীতি এসেছিল।
মিহির তাকে যথোচিত সম্বর্ধনা করে চা ও প্লেটভর্তি মিষ্টি খাইয়ে ছেড়েছে। বীথির দিদিকে মিহিরের বন্ধু দেখেনি। সে পরে এসেছে।
‘ওর চেয়ে নিশ্চয়ই আরো টল্ হবে ওর দিদি?’ মিহিরের বন্ধু প্রশ্ন করল।
মিহির তাতে কান না দিয়ে বলল, ‘ইউ ডু দ্যাট–বুঝলে বীথি, শহরতলি ছেড়ে আবার তোমরা ভিতরে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করো। আমি তোমাদের বাড়তি বাড়ি ভাড়া সম্পর্কেও কনসিডার করব, আজ ফিরে গিয়ে দিদি ও মাকে বলবে। এইবেলা ঘর খুঁজে নাও।’
বীথি ঘাড় নাড়ল। আর দাঁড়াল না। টুটুলকে নিয়ে ঘরে উঠে গেল। এবং একটু পর যখন বেরিয়ে এল দেখা গেল হাতে ওর ছোট ব্যাগ।
বীথি মাঠে নেমে ফটকের রাস্তাটুকু পার হয়ে বেরিয়ে যেতে মিহির একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। পিছনের বাগানে পাখির কিচিরমিচির থেমেছে।
যেন অনেকটা নিজের মনে কথা বল মিহির : ‘ওর প্রয়োজন টাকার, আমার প্রয়োজন স্নেহের–যত্নের–আন্তরিক সেবার। কী আশ্চর্য অসংলগ্নতা!
মিহিরের বন্ধু অনেকক্ষণ কথা বলল না।
মিহির আবার আশ্চর্যভাবে,–যেন নিজের সঙ্গে কথা বলল।
‘আশ্চর্য সাহস! বাপ মা ভাইবোনের মুখের ভাত জোগাড় করতে খুঁজতে খুঁজতে কোথায় এসে কি করে একটা কাজ জোগাড় করল তো!’
যেন আর চুপ থাকতে পারল না, অল্প হেসে বন্ধু এবার ইজিচেয়ার থেকে মাথা তুলল। ‘তবে কি বলতে চাও ও নিজে এখানে খুঁজেপেতে এই পোস্ট ক্রিয়েট করল। তোমার দিক থেকে কোন গরজ ছিল না-তোমার বাচ্চাটিকে দেখাশোনা করবার?’
‘ইয়েস–আই ওয়ান্টেড এ প্রফেসন্যাল নার্স।’ মিহির ভারি গলায় বলল, ‘এখন দেখছি একেবারে কচি অসহায়, অদ্ভুত রকমের র’–নভিস। আমার এক ডাক্তার বন্ধু জোগাড় করেছে। মেয়েটির সংসারের অবস্থা শুনলাম, শুনে আর না করি কি করে?’
বন্ধু আবার একটু সময় কথা বলল না। তারায় ভর্তি আকাশটার দিকে তাকিয়ে কি ভাবে, পরে আস্তে আস্তে বলল, ‘উঠি চলি। বড্ড মিস্ করলাম। বড়টিকে দেখতে পারলাম না।’ বলে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বন্ধু টিন থেকে একটা সিগারেট তুলে তাতে অগ্নিসংযোগ ক’রে বিদায় নিল। চলে যাবার সময় বন্ধু ফটকের কাছে গিয়ে খুক্ করে যেন একটু কাশল–কাশল কী হাসল বুঝতে না পেরে মিহির চমকে উঠল। এবং যদি হেসেই থাকে তার কারণ কি, একলা বাগানের অন্ধকারে ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে মিহির একটু সময় চিন্তা করল একটুক্ষণ। তারপর আর কিছু ভাবল না। ধীরে গম্ভীর গলায় রঘুনন্দনকে ডাকল। পুরোনো চাকর অর্থাৎ সুরমার আমলের বুড়ো দীনদয়ালকে মিহির ছাড়িয়ে দিয়ে এই নতুন হিন্দুস্থানী ভৃত্যকে সম্প্রতি বহাল করেছে। রঘুনন্দন এসে সামনে দাঁড়তে মিহির হিন্দীতে প্রশ্ন করল, ‘নীলাঞ্জনবাবু যখন কুঠিতে ঢোকে তুমি বলনি আমি বাথরুমে ছিলাম?’
‘জি হ্যাঁ।’ রঘুনন্দন মাথাটি কাঁধে ঠেকাল।
একটু সময় কি ভাবল মিহির। তারপর শক্ত গম্ভীর গলায় বলল, ‘এর পর থেকে আমাকে জিজ্ঞেস না করে কোনো আদমিকে কোনো বাবুলোককে ভিতরে ঢুকতে দেবে না।’
‘বহুৎ আচ্ছা।’ রঘুনন্দন আবার কাঁধে মাথা ঠেকাল। ভৃত্য চলে যাবার পরও মিহির বাগানের অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে থাকে। ভাবে।
সন্ধ্যা নেমে রীতিমত রাত হয়ে গেছে আর এক জায়গায়। হ্যাঁ খালধারে। পাগলাডিঙির পারঘাটার কাছে। একটা তেলেভাজার দোকানে। টিম টিম করে কেরোসিনের ডিবি জ্বলছে। দোকানের ভিতর অনেকটা জায়গা জুড়ে বাঁশের মাচা খাটানো। এবেলা আর উনুন ধরানো হয়নি। সকালের ভাজা ঠাণ্ডা ফুলুরী, বেগুনি এবং আরও দু’এক পদ খাবার সাজিয়ে মাচার ওপর দোকানের মালিক হরিপদ দত্ত বসে আছে। ক্ষিতীশের বন্ধু। হরিপদর সঙ্গে ক্ষিতীশের একটু আত্মীয়তার রেশও আছে। ডিগবয়ে ক্ষিতীশের যে মামা চাকরি করে হরিপদ তার শালা। ক্ষিতীশের যেমন মন চাইছে না তার দাদা অর্থাৎ রমেশের চায়ের দোকানে থাকতে, তেমনি হরিপদও ভগ্নিপতির সুপারিশে পাওয়া ডিগবয় অয়েল কোম্পানীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে স্বাধীন ব্যবসা করতে। এই তেলেভাজার দোকান খোলা ছাড়া এখানে এসে আর বিশেষ কিছু সুবিধে করে উঠতে পারল না সে। দোকানের ভিতরে একধারে দু’টো বাঁশ আড়াআড়ি করে পোতা। একবার কয়লার দোকান আরম্ভ করবে বলে কাঁটা ঝোলাবার জন্য বাঁশ দুটো পোঁতা হয়েছিল। আগাম টাকা দিতে পারেনি বলে গুদাম থেকে কয়লা আর আসেনি।
বাঁশের মাচটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একটি কেরোসিন কাঠের বাক্স। বাক্সের উপর ক্ষিতীশ বসে আছে চুপ করে। তার চেহারায় উত্তেজনা, অস্থিরতা এবং কিছুটা বিমৰ্ষতাও।
.
বাক্সটার পিছনে একটা ছোট জলচৌকির ওপর চুপ করে বসে আছে বেবি। মাচা থেকে অনেক নিচুতে বসা বলে রাস্তা কি দোকানের চৌকাঠে দাঁড়িয়েও বেবিকে দেখা যায় না। তা ছাড়া ওর মুখটা দরজার বিপরীত দিকে বেড়ার দিকে ঘোরানো। ভিতরে ঢুকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বেবির একটা চোখ বোজা। যেন সেই চোখ দিয়ে ও ঘুমোচ্ছে। আর একটা চোখ খোলা। স্থির পলকহীন তার চাউনি। বেড়ার গায়ে চোখটা মেলে ধরে দুটো টিকটিকির শিকার ধরে খাওয়া দেখছিল ও এতক্ষণ। অত্যন্ত বিমর্ষ এবং গম্ভীর ওর মুখখানাও। দু’পা এগোলে প্রকাণ্ড ঝিল। হরিপদর দোকানের সামনে একটা শিশু অশ্বত্থ গাছ। হরিপদর মাচায় বসে তা চোখে পড়ে। পশ্চিম আকাশের শুক্লা সপ্তমীর চাঁদ ঝুলছে। ফিনফিনে জ্যোস্নায় খাল ও ঝিলের জল চিকচিক করছিল। আর ছিল দমকা হাওয়া। সেই হাওয়ায় খালধারের ধুলো উড়ছে, গাছের পাতা ঝরছে, হরিপদর দোকানের কিরোসিনের ডিবিটা বার বার নিভে যাচ্ছে। একবার আলো নিভে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ হরিপদ আর আলো জ্বালেনি। ভূতের মত চুপ করে মাচার ওপর বসে বিড়ি টানছিল। ক্ষিতীশ অবশ্য সিগারেট টানছিল। দু’জনের একজনের মুখেও তখন কথা ছিল না। মশার কামড়, নাকি হাওয়ার ঝাঁপটায় হঠাৎ দরজার বাঁশটা পড়ে ‘যেতে ভয় পেয়ে বেবি অস্ফুট আর্তনাদের মত ‘উঃ’ করে উঠল।
ঝাঁপ বন্ধ করে দে হরিপদ।’ ক্ষিতীশ বলল, ‘রাত হয়েছে তেলেভাজা আর খাবে কে।’ হরিপদ কথা না বলে আলো জ্বালে। তারপর উঠে আধখানা ঝাঁপ নামিয়ে দিয়ে ডিবেটা তার আড়ালে রাখে। বাতির শিখা আর নড়ে না।
‘নে এইবেলা ভাল করে বুঝিয়ে বল্, আর বসে থাকবি কত। আমি দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরি, রাত হল।’
‘তুই বোঝা হরিপদ, তুই বুঝিয়ে কাঠের পুতুলের মুখে রা ফোঁটা। আমার সঙ্গে তো উনি ভাসুর সম্পর্ক পাতিয়েছেন।’
না, আমার বোঝানোয় চলবে কেন।’ মিনমিনে গলায় হরিপদ বলল, ‘তোমার জিনিস তুমি দেখবে।
ক্ষিতীশ বেবির দিকে ঘাড় ফেরায়।
কালি জমে সলতের গায়ে ঝুল জমেছিল। আর একবার আলো জ্বালতে হরিপদ আঙুলের টোকা দিয়ে সেটা ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার পর আলোটা এখন বড় মোটা হয়ে জ্বলছে। মাচার ওদিকটা ভাল দেখা যাচ্ছে। বেবির সামনে একটা শালপাতার ঠোঙা। তাতে এতগুলি তেলেভাজা। তেমনি পড়ে আছে। একটাও বেবি মুখে তোলেনি?
ক্ষিতীশ একটু সময় সেদিকে চেয়ে থেকে পরে হরিপদর দিকে ঘাড় ফেরাল।
‘আমি বুঝিয়ে বুঝিয়ে জিহ্বা ভোঁতা করেছি। এখন তোমার বোঝাও। যদি একটু চৈতন্য হয় নবাবজাদীর।’
‘এই বেবি!’
বেবি মুখ নিচু করে ছিল।
হরিপদ মোটা গলায় বলল, ‘ক্ষিতিশ কি বলছে শোন্।’
ক্ষিতীশ আর একটা সিগারেট ধরাতে দেশলাইয়ের কাঠির প্রচণ্ড শব্দ করল। বারুদের গা ঠিকরে তার চোখের কাছে আগুন ছুটে যায়। তেমনি প্রচণ্ড শব্দ করে দেশলাইটা হরিপদ দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ক্ষিতীশ বলল, ‘মা’র মাথায় ছিট। বাপটাকে বলা যায় রাস্তার পাগল। আর যে জন্যে তিনির মন নড়ছে না, পা সরছে না,–ভাই। তা ভায়ের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে পারিজাত। হ্যাঁ, বাড়িওলা। এই ঠ্যাং নিচে বেঁচে থাকলেও ঘরে শুয়ে থাকতে হবে, হাঁটতে হবে না। তারপর?’
হরিপদ বলল, ‘পেট চালাতে তোমাকে চাকরি করতেই হবে। চায়ের দোকানে হোক আর দুধের দোকানে হোক।’
‘বাড়িউলি মাসীর পাল্লায় পড়তে হবে’, ক্ষিতীশ নাকের বিকট শব্দ বার করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল। ‘এখানে এই হালে রমেশ রায়ের দোকানে থাকলে গোল্লায় যেতে বেশিদিন লাগবে না। আমার কথা ফলে কিনা তুই চেয়ে দ্যাখ হরিপদ।’
একটা ঢোক গিলল হরিপদ। কথা বলল না। ফ্রকের ছেঁড়া অংশে বেবির মেরুদাঁড়ার কাছাকাছি পিঠের চামড়ায় এতবড় একটা মশা হুল ফুটিয়ে বসে আছে, রক্ত টানছে। বেবি নড়ল না। ক্ষিতীশ দেখল, তাড়াল না। দূর থেকে হরিপদ আর সেটা দেখে না।
‘তোর তো একটা মত দিতে হবে। না হলে–’ হরিপদ থামল।
বেবি তেমনি বেড়ার দিকে তাকিয়ে। বোজা চোখটাও এখন খোলা।
‘না-ই বা হবে কেন।’ ক্ষিতীশ গলা ঈষৎ চড়াল। ‘অর্থাৎ পেটে ক্ষিদে মুখে লাজ। বেশ ক্ষিদে আছে, আমি টের পাই। আজ ক’মাস নেড়েচেড়ে দেখলাম তো।’
‘কি কথা বল্ না।’ হরিপদ একটা বড় ধমক দিল।
বেবির নাকের পাশটা একটু চিকচিক করে উঠল।
‘ঢং।’ ক্ষিতীশ নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়াল। ‘মত। মত চাইছি আঠারো বছর হয়নি বলে। পুলিশে গোলমাল করবে রাস্তাঘাটে। নাবালিকা, কিন্তু হিন্দু আইন-মতে সাবালিকা হয়েছে কিনা তুই একবার লাটসাহেবের মেয়েকে গোপনে জিজ্ঞেস কর্ না হরিপদ।’
কথা না কয়ে হরিপদ বিড়ি ধরাল।
‘বেশ তো, থাক্। বারো ভূতের সেই বাড়িতে থাকবি আর রমেশের দোকানে চা বানিয়ে পাড়ার লোককে খাওয়াবি। এই যদি তোর সুখের জীবন কামনার হয় বল্। হ্যাঁ, পষ্টাপষ্টি জানিয়ে দে, আমি সরে যাই। আমার রাস্তা দেখি।’
বেবি ক্ষিতীশের দিকে এই প্রথম মুখ ফেরাল। নাকের ধারটা আর চিকচিক করছে না। ‘তুমি ভীষণ মারধর করবে। তুমি যখন রাগ করবে কাণ্ডজ্ঞান থাকবে না। আমার সাহস হয় না।’
‘হবে, হয়। দূর দেশে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী হয়ে থাকার স্বাদ আলাদা। তখন কি আর এই ক্ষিতীশ ক্ষিতীশ থাকবে।’ হরিপদ পোড়া বিড়িটাকে আর একটা কাঠি জ্বেলে আগুন ধরায়।
‘রমেশ তোর গায়ে হাত দিল বলে, কুত্তি।’ ক্ষিতীশ আবার ক্ষেপে উঠল–’বলছি একবার হাওড়া না হয় শেয়ালদার টিকিট কেটে তো আগে ট্রেনে ওঠা যাক। ওই ছেঁড়া ফ্রক পরে পাঁচজনের চা বানানোর চেয়ে অসম্মানজনক হবে না এটা, তোর মাথায় আসে না? আর নোংরাভাবে জীবন কাটানোর ইচ্ছে থাকলে বল অন্য সুরে কথা বলি।’
.
বেবি নীরব নত-নেত্ৰ।
একটা জলের ফোঁটা এসে নাকের ডগায় ঠেকেছে। হু হু করে ঝিলের হাওয়া ঢুকছিল বলে হরিপদ বাকি আধখানা ঝাঁপও নামিয়ে দিল। পাগলাডিঙির ফাঁড়ি থানায় তখন ন’টার বেল বাজছে।
৩৮
নিভৃত কক্ষে দু’জনের আলোচনা হচ্ছিল। কি নিয়ে আলোচনা বুঝবার উপায় নেই। প্ৰায় ফিফিস্ করে তারা কথা বলছে। পারিজাতের সুদৃশ্য টেবিলের একধারে রক্ষিত সবুজ টুপিপরা একটা ল্যাম্প জ্বলছে। দেয়ালের ঘড়ির দিকে একবার চোখ তুলে শিবনাথ তাকিয়ে দেখল এগারোটা দশ। কিন্তু রাত গম্ভীর হ’ল বলে সে বিন্দুমাত্র ব্যস্ততা বা চঞ্চলতা প্রকাশ করছে না। বরং আজও স্থির সংযত হয়ে পারিজাতের মুখের দিকে তাকিয়ে তার শেষ প্রস্তাব শুনল। শুনে মাথাটা একটু দুলিয়ে অল্প হেসে সে পারিজাতকে আবার যেন কি বোঝাতে পারিজাতের চোখ দুটি উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ‘দ্যাট্স রাইট। ঠিক আছে। তা’ হলে আপনি,–আপনাকে আমি আর ধরে রেখে কষ্ট দিই না। যান এইবেলা ঘরে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়ুন–অনেক রাত হ’ল।’
‘না, তেমন আর কি রাত।’ শিবনাথ আরো দু’মিনিট স্থির হয়ে বসে থেকে কি একটু চিন্তা করে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। পারিজাতও চেয়ার ছেড়ে উঠল
‘আপনার সঙ্গে টর্চ নেই? সরকার মহাশয়কে কি বলব আলোটা নিয়ে রাস্তাটা একটু দেখিয়ে দিক–’
শিবনাথ ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘না না, কিছু দরকার হবে না। কতটুকু রাস্তা। তাছাড়া বেশ জ্যোৎস্না আছে।’
বারান্দা এমন কি সিঁড়ি পর্যন্ত পারিজাত শিবনাথের সঙ্গে এল।
‘আর আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।’ শিবনাথ বলল।
‘আচ্ছা, গুড নাইট।’ পারিজাত হেসে উত্তর করল।
‘গুড নাইট।’
আজ পারিজাতের ড্রাইংরুম ছাড়া আর কোন কামরায় আলো নেই। বাড়িটাও বড় বেশি চুপচাপ। পুরো আড়াই ঘণ্টা শিবনাথ এখানে কাটিয়েছে। একবারও দীপ্তির গলার স্বর বা শিশুদের করলব শোনা যায়নি। না, ওরা এখানেই নেই। কেন নেই কোথায় গেছে শিবনাথ জানে। পারিজাত সবই তাকে বলেছে। বস্তুত পারিজাত যে এমন অন্তরঙ্গ হতে পারে শিবনাথের আগে ধারণা ছিল না। অবশ্য মাত্র একদিনের আলোচনার পর দীপ্তিও খুব অন্তরঙ্গ হতে পেরেছিলেন। শিবনাথ তার পরিচয় পেয়েছে। কিন্তু তাঁর স্বামী পারিজাত লোকের সঙ্গে আরো বেশি আত্মীয়তা এবং বন্ধুত্ব করতে পারেন। জানেন। শিবনাথ তার একাধিক প্রমাণ পেল। পৃথিবীর সকল লোকের সঙ্গেই পারিজাত তা করে কিনা শিবনাথের মনে প্রশ্ন জাগল এবং যাদের সঙ্গে সেটা সম্ভব হয় না, তাদের মধ্যে কি কি ত্রুটি আছে বা থাকতে পারে, প্রকাণ্ড কলাপসিবল গেট পার হয়ে রাস্তায় নামতে নামতে শিবনাথ চিন্তা করল। হয়তো অন্যদিন পারিজাতের কম্পাউন্ডের বাইরে এসে ঘাড় ফিরিয়ে সে বাংলোর একটা নির্দিষ্ট কক্ষের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলত। কিন্তু আজ আর শিবনাথ তা করল না। করার প্রয়োজন বোধ করল না। বরং ঘরে গিয়ে কতক্ষণে সে রুচির সঙ্গে মিলিত হবে এবং ভয়ঙ্কর জরুরি কথাগুলি তাকে জানাবে, সেই তাগিদ লম্বা লম্বা পা ফেলে সে রীতিমত ছুটতে লাগল। কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যার দিকে রমেশের সঙ্গে কথা বলার পর এমনি ব্যস্ত চঞ্চল হয়ে সে পারিজাতের সঙ্গে দেখা করতে ছুটে এসেছিল। কিন্তু তখনকার ব্যস্ততার মধ্যে উদ্বেগ ছিল, উৎকণ্ঠা ছিল এবং অজানিত একটা ভয়, আশঙ্কা। এখন আর তা না। একাটা নিশ্চিন্ততা, তৃপ্তি, সন্তোষ এবং যাকে বলে ‘মনের জোর’ নিয়ে সে স্ত্রীর কাছে যাচ্ছে। রায়সাহেবের আমবাগানের চৌহদ্দি পার হল শিবনাথ। তাদের পাড়ার খোয়া-ঢালা অসমান পথ এসে গেল। ডান দিকে করাতকল। বাঁ দিকে রমেশের চায়ের দোকান। দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। হয়তো বনমালীর দোকানও এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। শিবনাথ ভাবল। মাথা-ভাঙা নিষ্পত্র কাফেলা গাছের গুঁড়ির কাছে এক জায়গায় ঠাসাঠাসি করে দাঁড় করানো এতগুলো ঠেলাগাড়ি দেখে সে চমকে উঠল। অবশ্য গাড়িগুলি দাঁড় করিয়ে রাখার মধ্যে চমৎকার একটা শৃঙ্খলা ও মিল ছিল। দৈর্ঘ্যে প্রস্থেও সবগুলি গাড়ি সমান। ঠেলার দঙ্গল পার হয়ে শিবনাথ বাদাম গাছের তলায় এসে গেল।
‘কে?’
‘আমি গুপ্ত।’
পদক্ষেপ আরও দ্রুত এবং দীর্ঘ করবার জন্য শিবনাথ প্রস্তুত হয়, কিন্তু কে. গুপ্ত বাধা দিল। শিবনাথের হাত ধরল না, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’হাত দু’দিকে প্রসারিত করে দিয়ে বলল, ‘এক সেকেন্ড স্যার,–আপনার জন্য একটা ব্রিলিয়ান্ট নিউজ নিয়ে বসে আছি।’
পাগল না, লম্বা চুল দাড়ি এবং ছেঁড়া ঝুল বার হাওয়া সার্টে কে. গুপ্তকে ভূতের মত দেখাচ্ছিল। হাঁটু অবধি সার্টের তলায় আর কোন কাপড়চোপড় আছে বলেও মনে হল না। শীর্ণ শুকনো লম্বা পা দুটোকে দুটো কাঠ বলে মনে হচ্ছিল। জায়গাটা এখন খুবই নির্জন। চাঁদ হেলে পড়াতে জ্যোৎস্নাও মরে এসেছে। দুটো জোনাকি পোকা গাছের কাণ্ড ঘিরে নাচানাচি করছিল। শিবনাথের গা-টা কেমন সিরসির করে উঠল। কিন্তু ভীরু সে নয়। দু’হাতে মুষ্টি দৃঢ়বন্ধ করে গম্ভীর ভাবে বলল, ‘রাস্তা ছেড়ে দিন। আমার তাড়াতাড়ি আছে।’
‘তা আছে আমি অস্বীকার করছি কিনা আগে কোনদিন করেছি।’ আগের মত গলায় ততটা শ্লেষ নেই, বরং স্বরটা করুণ। কারণ বুঝতে পেরে শিবনাথ নিজের মনে হাসল। ‘না তা আর অস্বীকার করবেন কি ক’রে। বলুন আপনার ব্রিলিয়ান্ট খবর।’
‘ডাক্তার পালিয়েছে। এইমাত্র একটা ঠেলার ওপর লটবহর চাপিয়ে চুপিচুপি পাড়া ছেড়ে সরে গেল।’
‘কোন্ ডাক্তার?’
‘শেখর মশায়, শেখর ডাক্তার। দ্যাট মেটিরিয়ামেডিকা–স্পেশালিস্ট–আমাদের সুনীতির বাবা গো।’
‘হঠাৎ?’
কে. গুপ্ত নাকে হাসল।
‘মশায় আপনি,–আপনাকে এসব খবর দিয়েও সুখ নেই। কেন পালিয়েছে বুঝতে পারছেন না? পথেঘাটে মাঠে সবাই এখন শেখরকে আঙুল দেখিয়ে বলছে তার মেয়ে সিফিলিস রুগীর সঙ্গে পালিয়ে গেছে–হ্যাঁ হা, ডাক্তারের মেয়ে ভি-ডি পেসেন্টের সঙ্গে পালানো, একেবারে সংঘাতিক ব্যাপার যে! তার এ-তল্লাটে প্র্যাকটিস করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে এখান থেকে সরে গিয়ে শেখর তো বুদ্ধিমানের কাজই করেছে।’
‘মানে বারো ঘরের আর একটি ঘর খালি হ’ল। ভাল। প্রভাতকণার চিৎকারে আপনার আর মাথা ধরবে না।’ শিবনাথ এই প্রথম শব্দ করে হাসল। ‘শুনলাম আপনার খবর, এই বেলা দয়া করে রাস্তাটা ছাড়ুন।’
কিন্তু কে. গুপ্ত সরে দাঁড়ানো বা হাত গুটাবার কোন লক্ষণ দেখাল না। ‘মশাই, হাম্বাগটা রাতদিন এপিডেমিক ইয়ার এপিডেমিক ইয়ার করে খুব লাফাত, হ্যাঁ, বোগাস ওষুধ মানে স্রেফ জল খাইয়ে লোকের পয়সা লুটার ফিকিরে ছিল, কেমন হল তো,–কন্যারত্নটি তার ঘরেই এপিডেমিক রেখে বেরিয়ে গেল। নসিব। আমরা লম্ফঝম্ফ করলে হবে কি, যা লেখা আছে তা খণ্ডন করা যায় না, অ্যাম আই রং, বলুন?’
‘হ্যাঁ, খুব হয়েছে, সরে দাঁড়ান।’
‘রিয়্যালি, আপনি সর্বদাই এমন চটে থাকেন। এখন তো পয়সা চাইছি না বা আপনার গায়ে হাত দিচ্ছি না, তবে কেন–’
‘কেন, আরো কোন মজাদার খবর আছে নাকি? চট করে বলে ফেলুন।’ শিবনাথের ইচ্ছা নেই এত রাত্রে আর ওর সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে।
মুহূর্তকাল শিবনাথের ঘাড়ের ওপর দিয়ে সামনের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে কে. গুপ্ত পরে থুতনি নামায়। ‘আচ্ছা, আপনি তো ওদিক দিয়েই এইমাত্র এলেন, মানে রমেশের দোকানের পাশ দিয়ে, দোকান-খোলা দেখলেন?
‘আমি তাকাইনি।’ বিরক্ত হয়ে শিবনাথ বলল। তারপর কি ভেবে প্রশ্ন করল, হঠাৎ এত রাত্রে চায়ের দোকান? কি ব্যাপার?’
‘না, বেবির আসবার কথা। এখনো আসছে না। বারোটা প্রায় বাজে, কি বলেন।’
‘হবে।’ নিস্পৃহ গলায় শিবনাথ উত্তর করল ‘আমি ঘড়ি দেখিনি, আপনি কাইন্ডলি একটু পাশ কেটে দাঁড়ান। ‘
না সরে বরং আর একটু ঘন হয়ে এসে দাঁড়াতে চেষ্টা করল গুপ্ত। শিবনাথ সতর্ক হয়। ‘না না, আমি আপনার হাতটাত আর ধরব না। বাপরে বাপ, তখন যা অর্ধচন্দ্রটা দিলেন, মনে আছে।’ কে. গুপ্ত মৃদু গলায় হাসল। ‘না, বেবির কথা জিজ্ঞাসা করছিলাম কেন, ও এসে আমায় কিছু পয়সা দিয়ে যাবার কথা। ক্ষিতীশ নাকি আজ ওকে একটা টাকা দেবে বলেছে! এখন বুঝতে পারছি না টাকাটা পেল কি পেল না। আর আসছেই না বা কেন। সেই কখন থেকে এখানে বসে আছি।’
‘দু’পা এগিয়ে দেখুন না দোকান খোলা কি বন্ধ, বেবি সেখানে আছে কি নেই।’
গুপ্ত মাথা নাড়ল।
‘আমি শালা ওখানে গিয়ে এখন ঘুরঘুর করলেই ক্ষিতীশ হারামজাদা টের পেয়ে যাবে বেবির কাছে কিছু চাইছি। বুঝলেন না? তখন আর ওকে পাইটিও ছোঁয়াবে না।’
‘তাই নাকি, বেশ মজা তো।’ শিবনাথ ঠাট্টার ভঙ্গিতে হাসল। ‘আপনার মেয়ে, বাপকে এক আধটু দিয়ে থুয়ে থাক ক্ষিতীশের বুঝি ইচ্ছা না?’
‘আরে মশাই, সেকথাই তো বলছিলাম। অথচ দেখুন, বেবির মা কিছু চেয়েছে, টের পেলে রমেশ ক্ষিতীশ দুই হারামজাদা একেবারে দানসত্র খুলে বসে। এক কাপ চায়ের জায়গায় তিন কাপ চা, একটা বিস্কুট চাইলে চারটে বিস্কুট, এত এত চিনি, বোতল ভর্তি কেরোসিন, কয়লা কাঠ। আমি কি টের পাই না, খুব টের পাই। কিন্তু আমার বেলায় –কে. গুপ্ত হাতের বুড়ো আঙুলটা নাড়ল।
‘কেন আপনার সঙ্গে রমেশ ক্ষিতীশের ঝগড়া আছে নাকি বেবির ওখানে যাওয়া নিয়ে, ইদানীং আপত্তি করেছিলেন কিছু?’
‘নেভার! আমি এ-সম্পর্কে আজ পর্যন্ত একটা কথাও বলিনি। না মশাই না, সেসব কিছু না। সেই সেক্স, হি-হি।’ কে. গুপ্ত ছেলেমানুষের মত হেসে উঠল। ‘বেবির মা যদি টিনের সমস্ত বিস্কুটও খেতে চায়, ক্ষিতীশ আপত্তি করবে না। এক টুকরোর জন্য আমি হাত বাড়ালেই শালা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে। তেমনি ওর দাদাটি।’
‘বুঝলাম, সরুন, রাস্তা দিন।’
‘যেমন তখন।’ কে. গুপ্তর হাসি ও কথা বন্ধ হল না। ‘গুড কিনতে এসেছিল মাগীটা। চাইতেই হুট করে আপনি পয়সাটা পকেট থেকে বার করে দিলেন, তারপর আমি যখন পয়সা চাইলাম, সুন্দর একটি গলাধাক্কা, হি-হি।’
‘ননসেন্স।’ শিবনাথ গুপ্তর একটা হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল এবং দ্রুত হাঁটতে আরম্ভ করল।
‘রাগ করলেন নাকি, অফেন্স নিলেন? আমি একজাম্পল হিসাবে কথা বললাম শুধু–শুনুন, শুনুন।’ গুপ্ত পিছন থেকে ডাকে।
‘চুপ রাস্কেল।’ শিবনাথ ঘাড় ফিরিয়ে গর্জন করে উঠল। নুয়ে মাটি থেকে কি একটা তুলে নেয়। ‘আর এক পা এগোলে এই ইট দিয়ে আমি তোমার মাথা ভেঙে দেব। পাগল বদমায়েস।’
ইটের ভয়ে গুপ্ত আর অগ্রসর হয় না।
‘বাপরে বাপ। একটুতে এমন ভায়লেন্ট হয়ে ওঠেন। আমি শালা পেনিলেস, কিন্তু আপনি দেখছি একেবারেই হার্টলেস–ক্রুয়েল।’
কে. গুপ্তর কথাগুলো শিবনাথের কানে যায় না। ততক্ষণে সে ফিকে জ্যোৎস্নার সঙ্গে দূরে মিলিয়ে গেছে। হাওয়ায় একরাশ শুকনো পাতা ঝুরঝুর করে কে গুপ্তর মাথায় পিঠে ঝরে পড়ে।
৩৯
রুচি ধড়মড় করে উঠে বসল। আলো জ্বালল। দেখা গেল শিবনাথের মুখে হাসি।
‘কি ব্যাপার?’
‘সেসব কিছুই না।’
‘ময়না কোথায়? হাসপাতালে ওরা ওকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে থেকে বেরিয়ে ছোঁড়াগুলো থানায় ডাইরী করতে সাক্ষী হিসাবে ময়নাকে নিয়ে গেছে এরকম কিছু আভাস দিলে কি পারিজাতবাবু? আমি বাড়ি ফিরতে না ফিরতে বলাই যেমন রাগারাগি করল, আর ওদিকে রায় সাহেবের ছেলে সরকারকে পাঠিয়ে তোমার ডেকে নিয়ে গেল। ভাবলাম–কি জানি।’
‘আরে দূর পাগল। হ্যাঁ, কথাটা বলল বটে পারিজাত। সেরকম কিছু হলেও পারিজাত ঘাবড়াতে না। একসঙ্গে তিনটে থানার ছোট ও বড় দারোগার মুখ বন্ধ করার মত তার টাকা আছে।’
‘শিবনাথ বিছানার একপাশে বসল। ‘শোন বলছি। খুব মজা হয়েছে। এমনভাবে সবটা ঘটনার মোড় ফিরবে পারিজাতও ভাবেনি। আমায় ডেকে নিয়ে ব্যাপার বলল। ওয়ান্ডারফুল! ‘ শিবনাথ সিগারেট ধরাতে পকেটে দেশলাই খোঁজে। রুচি এইমাত্র আলো জ্বেলে দেশলাই হাতে নিয়ে বসে আছে। শিবনাথের হাতে সেটা তুলে দিয়ে বলল, ‘তা পারিজাতের মামলা ভালর দিকে যাক কি খারাপের দিকে, তাতে আমাদের অবশ্য খুব একটা না ভাবলেও চলে। ওর টাকা আছে যখন সব অবস্থাতেই সে নিরাপদ। আমার ভয় নেই ছেলেগুলোকে নিয়ে। আমি ময়নাকে তখন হাসপাতালে যেতে নিষেধ করেছিলাম, এটার না অন্য অর্থ ধরে নিয়ে ওরা পারিজাতকে জব্দ করার জন্য থানায় আমার নামটাও রিপোর্টে ঢুকিয়ে দেয়। আমি পারিজাতের দলের ‘
শিবনাথ সিগারেট টানতে টানতে শব্দ না করে হাসে।
‘রুণুর ব্যাপার শুনে আমার প্রথমটায় অবশ্য খুবই কষ্ট হয়েছিল। হ্যাঁ, কাল। কিন্তু তারপর, তুমি নিষেধ করেছিলে বলে না, অনেকগুলো কারণে অ্যাকসিডেন্টের সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব মাথায় নিতে পারলাম না।’
শিবনাথ তথাপি নিঃশব্দে হাসে।
রুচি সেটা লক্ষ্য করেই যেন একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘সবচেয়ে বড় কথা এ ব্যাপার নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবার এবং ছুটোছুটি করার মতন সময় আর আমার একেবারেই নেই। দশটা-পাঁচটা ইস্কুলে পড়ালে হয়। ইস্কুল থেকে এসেও ঘরের এটা ওটা করতে হয়, দেখতে হয়, পরের দিন বাজার খরচের পয়সা রাখলে আমার ইস্কুলে যাবার পয়সা, মঞ্জুর দুপুরের দুধ-সুজিটুকুন এবং রাত্রে যাহোক তিনটে মুখের অন্তত দু’খানা রুটি ও একটু ডাল- তরকারি যোগাড় রাখার চিন্তা নিয়ে যার ঘুমোতে যেতে হয়, তার পক্ষে আদর্শ টাদর্শ রক্ষা করা হয় না। বললেই চলে–অন্তত এই অবস্থায় মানুষ পারে না।’
শিবনাথ এবার শব্দ করে হাসল।
‘অর্থাৎ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলতে চাইছ, যার স্বামী বেকার, তার পক্ষে পরোপকার করতে যাওয়াও বিপদ,–হ্যাঁ, হা পরের ভাল করতে এখন আর আমার নিষেধ না, আমাদের আর্থিক অবস্থাটাই বড় রকমের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই তো?’
‘যাকগে, এসব কথা দিয়ে কি হবে। রাত হয়েছে। তুমি খাবে না?’
না কি মহিলা কাল বাস্ভাড়া সেধেছিল পর থেকে এ ব্যাপারে তোমার মন খারাপ? রুচি চুপ করে রইল। বিকেলে আজ বলাই যখন গণ্ডগোল করেছিল, কথায় কথায় রুচি শিবনাথকে রুণুর মা’র ব্যবহারের কথাটা বলে ফেলে। যার জন্য রুণুকে দেখেতে যাওয়ার ব্যাপারে সে খুব বেশি একটা উৎসাহবোধ করছিল না। ভেবেছিল স্কুল থেকে ফেরার পথে সময় পেলে একবার দেখে আসবে এবং ময়নাও তখন তার সঙ্গে হাসপাতালে যাবে।
‘কি, কথা বলছ না যে?’ শিবনাথের ঠোঁটে আবার সেই শব্দহীন সুক্ষ্মহাসি।
‘কি আর বলব।’ রুচি চোখ তুলল। ‘আমার কথা হচ্ছে, ভাল করার মধ্যে যেমন থাকতে পারলাম না, তেমনি মন্দ কিছুতে আমি নেই, সেটাই চাইছি। ময়নাকে হাসপাতালে যেতে দেব না, এ ধরনের ইচ্ছা আমার কোন সময়েই ছিল না। সেই ছেলেগুলো না উল্টো বুঝে আমাকেও ষড়যন্ত্রের মধ্যে জড়ায় সে ভয় করছিলাম।’
‘কিসের ষড়যন্ত্র, কোথায় ষড়যন্ত্র।’ শিবনাথ মাথা নাড়ল। ‘সেকথাই তো তোমার বলতে তাড়াতাড়ি ছুটে এলাম। বড় মজার ব্যাপার হয়েছে, রুচি।’
‘কি?’
‘আদর্শের কথা বলছিলে না? হা হা, যার আদর্শ রাখবার কথা, সে-ই সব নড়চড় করে দিলে, আমি তুমি করব কি?’
‘কি রকম?’ রুচি একটা বড় ঢোক গিলল। ‘কার কথা বলছ?’
‘তোমার সেই ময়না।’ শিবনাথ সিগারেটে টান দিয়ে জ্বলন্ত টুকরোটা জানালার বাইরে অন্ধকার উঠোনে ছুঁড়ে ফেলল। সারা বাড়ি আজ নীরব। যেন সব ক’টা ঘর ঘুমে থমথম করছে! শিবনাথ নিচু গলায় বলল, ‘খবর নিয়েছ কি! ময়না এতক্ষণে ঘরে ফিরেছে।’
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না–কেন, শেষ পর্যন্ত কি করেছে ও?’ রুচি অস্বস্তিবোধ করছিল।
‘অবশ্য আর একটা আদর্শ রাখতেই ও এমনি করল। না, ময়নার দোষ নেই। তাছাড়া শেষ পর্যন্ত যা ও করেছে, আমি তো প্রশংসাই করি।’
‘পরিষ্কার করে সব খুলে বল তো কি ব্যাপার? তুমি এত কথা কা’র কাছে শুনলে। ময়নার সঙ্গে তোমার দেখা হল কখন–সেই ছেলে তিনটি কি–’
‘বলছি, সব বলছি শোন, এত অস্থির হলে চলবে কেন।’ শিবনাথ আবার সিগারেট ধরাতে চায়, কিন্তু রুচির চোখে চোখ পড়তে নিবৃত্ত হয়। ‘আমার সঙ্গে ময়নার বা রুণুর বন্ধুদের দেখা হয়নি। সব পারিজাতের কাছে শুনলাম। কি যেন নাম ছেলে তিনটির? সন্তোষ, জীবন, অসিত। এরা সব মস্ত বড় বড় লোকের ছেলে। সন্তোষের বাবা ভিয়েনায় পাশকরা প্রকাণ্ড বড় ইঞ্জিনিয়ার, অসিতের বাবা কলকাতার নামকরা ব্যারিস্টার, জীবন ছোঁড়ার বাবা কেবল এই শহর বলে না, তুমি বলতে পার–ইন্ডিয়ার মধ্যে ওয়ান অফ দি বেস্ট হার্ট-স্পেশালিস্টস। হ্যাঁ, যেমন নাম, তেমনি তাঁর পয়সা। ডক্টর মধুসূদন নাগ।
‘তারপর?’
‘এবং তিনি পারিজাতের একজন বিশেষ বন্ধু।
রুচি হাঁ করে শিবনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিল। বলল, ‘মধুসূদন, নিশ্চয়ই পারিজাতের সময়বয়সী নন, যার এত বড় ছেলে জীবন। আমি তো দেখেছি।’
‘তাই বলে কি তিনি পারিজাতের বন্ধু হতে পারেন না! তা তুমি ধরেছ ঠিক। সিনিয়র লোক। আসলে মধুসূদনের সঙ্গে পারিজাতের বাবার–হ্যাঁ, আমাদের রায় সাহেবেরই বন্ধুত্বটা, কিন্তু অন্য দিক থেকে তিনি এখন পারিজাতের বিশেষ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। বলছি।’
শিবনাথ আর ইতস্তত না করে নতুন সিগারেট ধরাল।
‘ডক্টর নাগ তিনজনকে পাকড়াও করলেন সার্কুলার রোডের ওপর। ওরা তখন ময়নাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্বেল হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিল। ঠিক তখন নিজের গাড়িতে করে মধুসূদনও সেদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন। আর দুটি ছেলে এবং একটি মেয়ের সঙ্গে জীবনকে এভাবে হঠাৎ রাস্তায় দেখে তিনি অবাক। গাড়ি থামিয়ে তাদের কাছে ডাকলেন। তাদের লীডার সন্তোষের মুখে সব শুনে মধুসূদন মাথা নাড়লেন–জিহ্বায় কামড় দিলেন : ‘তোমরা ছেলেমানুষ। ভেতরের খবর কিছু জান না। জানবার কথাও নয়। পারিজাতের সঙ্গে আমার–আমাদের একটা নতুন সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ, আমি পলিটিক্সের কথা বলছি। খুব সামনেই ইলেকশন। আজ পারিজাতবাবু ওঁর এলাকা থেকে রিটার্ন হন, এই আমাদের সকলের ইচ্ছা এবং চেষ্টাও। কেন–আমাকে এখন তোমরা প্রশ্ন করবে না।’
মধুসূদন চোখ বুজে ছেলেদের বুঝিয়েছেন। ‘রাজনীতি অত্যন্ত প্যাঁচালো জিনিস।’
‘ওরা বুঝি বলছিল, পারিজাত একটি ছেলেকে গাড়ি চাপা দিয়ে, সেটা এখন চেপে যাচ্ছে?’ রুচি প্রশ্ন করল।
শিবনাথ ঘাড় নাড়ল। ‘সন্তোষের ইচ্ছা ছিল তখনি থানায় গিয়ে সব ব্যাপার ফাঁস করে দেয় এবং খবরের কাগজে রিপোর্ট পাঠায়।’
‘ডক্টর নাগ বাধা দিলেন?’
না দিয়ে উপায় ছিল না, কেননা, এভাবে পারিজাতবাবু এখন এক্সপোজড় হয়ে পড়লে, ইলেকশনে অপজিট পার্টিগুলো এটাকে সুন্দরভাবে কাজে লাগাবে।’
‘সন্তোষের দল তাই মেনে নিলে?’
‘বলছি, হুট্ করে কি তরুণের দল তা মানতে চায়। সন্তোষ মধুসূদনের প্রস্তাব শুনে মাথা নেড়ে বলছিল—আপনার যুক্তি একদিক থেকে সত্য, জ্যেঠামশাই। আপনারদের পার্টির ইন্টারেস্টে আমরা হয়তো এটাকে ওভারলুক করব। কেননা, অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। ধরে নিলাম, ইচ্ছা করে তিনি রুণুকে গাড়িচাপা দেননি এবং এটা সত্য, কলকাতা শহরে রাতদিন বহুলোক এভাবে চাপা পড়ে কেবল ইনজিওরড না, মারাও যাচ্ছে। সব সময় যে গাড়ি চালায়, তার দোষ না-ও হতে পারে। কিন্তু একে এখন আমরা কি বলে বোঝাই। ও তো রাজনীতি বুঝবে না। দেখুন কেমন কাঁদছে।’
‘ময়নার কথা বলছিল বুঝি সন্তোষ।’ রুচি অল্প হাসল।
‘হ্যাঁ’–শিবনাথও ঠোঁট টিপল। বলছিল, ‘জ্যেঠামশাই, রুণুর জন্যে আমি যত না বেশি মুভড় হয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি লাগছে এর অবস্থা দেখে, আমার চোখে রীতিমত জল আসছে।’ রুমাল দিয়ে চোখ মুছে সন্তোষ পরে ডক্টর মধুসূদনকে বলে, ‘আমি অত্যন্ত সেন্টিমেন্টাল, হ্যাঁ, লভ এফেয়ার্সে, আবার তেমনি কড়া। রুণু হয়তো বাঁচবে না, কিন্তু এই কোমল মেয়েটির প্রেম এভাবে ধূলিসাৎ করে দিলেন আপনাদের পারিজাতবাবু, তার জন্য তিনি কি ক্ষতিপূরণ দেবেন, এটাই আমার এখন জিজ্ঞাস্য–কি বলিস তোরা, জীবন, অসিত?’ শুনে জীবন মাথা নেড়েছিল।
‘কি বললেন ডক্টর নাগ তার উত্তরে?’ রুচি সকালে ছেলেটির আরও পরিচয় পেয়েছিল। শেষে শিবনাথকে বলল, ‘দু’-দু’বার তিনি ম্যাট্রিকে ফেল করে এখন সিনেমার জন্যে প্রেমের গল্প লিখছেন।’
‘তা, কার কোন্ দিকে প্রতিভা, তুমি বলতে পার না রুচি। এই ছেলেই যে একদিন নামকরা একজন নভেলিস্ট বা নাট্যকার না হবেন, তা তুমি কি বলে।’
রুচি চুপ করে রইল।
‘যাকগে, এখন ডক্টর নাগ–হ্যাঁ, তাই তো বলি রুচি, জিনিয়স যাঁরা, তারা ছোট বড় সব বিষয়ই এমন সুন্দরভাবে টেল করতে পারেন, যা হয়তো কোনদিন আমরা কল্পনাও করতে পারি না। যখন সমস্যার সমাধান হয়ে গেল তখন ভাবি কত না সহজ, কত বেশি স্বাভাবিক। পারিজাত আমায় সে কথাই তখন বলছিল। রুণুর কথা শুনেই মধুসূদন ময়নার দিকে তাকান এবং গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে তার মাথায় তা রেখে একটু চুপ করে থেকে পরে আস্তে আস্তে বুঝিয়েছেন,–প্রেম কখনো মরে না। আকাশ বাতাস ধুলো বালি ঘাস ফুল পশু পাখি পোকামাকড় শরতের রোদ শ্রাবণের ধারা চৈত্রের শুকনো পাতা, এমন কি এখানে শহরের এই রুক্ষ গরম পেভমেন্টের চলমান কলমুখর জীবনস্রোতের মধ্যে সে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকে যদি তুমি তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাও। তোমার বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছার মধ্যেই তার প্রাণ, তার স্পন্দন। রুণু যদি না-ও বাঁচে।’
‘এত সব কঠিন কথা ময়না বুঝল?’
‘বোঝালেই বোঝে। তেমন করে তুমি বোঝাতে পারব কি!’ শিবনাথ পায়চারি করছিল। রুচির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অত্যন্ত বড়লোক, তাই এত উদার মন আর কি ফ্রি কথাবার্তা। ময়নার হাত ধরে বললেন, এই যে আমাদের সন্তোষ, তোমার ভালবাসার কান্না দেখে এইমাত্র চোখের জল ফেলল, সেই জলের ফোঁটার মধ্যে প্রেম নতুন করে জীবন পেল,–জিজ্ঞেস কর ওকে একবারটি। কেমন হে সন্তোষ?
‘তারপর?’ রুচি এবার শব্দ ক’রে হেসে ফেলল।
‘না, না, হেসো না। কথা হচ্ছে যে কেমন চমৎকারভাবে তিনি মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিলেন সেটা একবার চিন্তা কর।’
‘জিজ্ঞেস করেছিল ময়না সন্তোষকে তা?’
‘তা আর জিজ্ঞেস করতে হয় না। কোন মেয়েই করে না। বলতে কি সন্তোষের দিকে ওর তাকানো দেখেই তো ডক্টর নাগ বুঝে ফেলেছিলেন।’
‘হার্ট-স্পেশ্যালিস্ট কি না।’ রুচি মন্তব্য করল।
কাজেই মামলার সেখানেই অর্ধেক নিষ্পত্তি।’ শিবনাথ হাসল। ‘বাকিটা চুকল হাসপাতালে রুণুর বেড়-এর পাশে। ডক্টর নাগ মুমূর্ষু ছেলেটিকে একবার দেখে আসতে তাদের হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন যদিও। কিন্তু ময়না সেখানে গিয়ে কি দেখল। তুমিও ইমাজিন করতে পার। এতটুকু মেয়ে। তার কল্পনা কতদূর যেতে পারে, নিজের মনের ওপর কন্ট্রোলই বা কতটা, হ্যাঁ ধৈর্য সাহস বিচারবুদ্ধির প্রশ্নও আছে। অক্সিজেনের চোঙ লাগানো ফুলে ওঠা রুণুর বিকৃত চেহারা দেখে ময়না ভয় পেয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল। সন্তোষ জীবন ওরা ওকে তাড়াতাড়ি হাসপাতাল থেকে বাইরে নিয়ে আসে।’
‘ও বুঝি ভেবেছিল বারো ঘরের উঠোনে পাড়ার রাস্তায় কপি ক্ষেতে রুণু যেমনটি ছিল এখনও তার সেই চেহারা আছে, অবিকল সেরকমই গিয়ে দেখতে পাবে।’
‘একজ্যাক্টলি সো।’ শিবনাথ মাথা নাড়ল। ‘এবং হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে ময়না বলছিল সেখানে ওষুধের গন্ধটাই তার অসহ্য লাগছিল, না হলে আরো কিছুক্ষণ সে থাকতে পারত। শুনে সন্তোষ তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে বৌবাজারের মোড় থেকে একটা গোলাপের তোড়া কিনে নিয়ে যায়। সেটা ময়নার হাতে তুলে দিয়ে বলছিল, এটা ততক্ষণ শুঁকতে থাক হাসপাতালের বিশ্রী অষুধবিষুধের গন্ধগুলো নাক থেকে সরে যাক।’
রুচির হাসি ঘরের সিলিং পর্যন্ত পৌঁছতে, মুখে কাপড় চাপা দিয়ে তা দমন করল।
‘হ্যাঁ,’ শিবনাথ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তুমি একবার ভেবে দেখ, জীবন ও মৃত্যু সামনে দাঁড়িয়ে যখন হাত বাড়িয়ে একটি মেয়েকে ডাকে তখন কার দিকে ছুটে যাওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক,–আর ওই বয়সে, যখন প্রথম ফুল ফোঁটার স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করে, পাখির গান শুনে চমক ওঠে।’
রুচি কিছুক্ষণ কথা বলল না। চুপ করে জানালার অন্ধকার দেখে। যেন হঠাৎ কি ভাবছিল সে।
‘কথা বলছ না কেন। ময়না কি ভুল করেছে? তাকে তুমি দোষ দিতে পার না।’
শিবনাথ রুচির শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়।
‘যাকগে, গল্প তো শেষ হল। গণ্ডগোল যখন মিটেছে আপদ গেছে। জামাকাপড় ছাড়, হাত মুখ ধুয়ে নাও।’ রুচি শিবনাথের জন্যে ঠাঁই করে দিতে উঠে দাঁড়ায়।
শিবনাথ অবাক হবার ভান করে বলল, ‘গল্প শেষ মানে? অর্ধেক তো হ’ল। বাকি আধখানা শুনবে না? গল্পের যেখানে ক্লাইম্যাক্স, কাহিনীর মধ্যমণি হয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁর কথাই যে এখনো বলা বাকি।’ বলে শিবনাথ মিটি মিটি হাসে।
‘কার কথা, কে আবার এ গল্পের মধ্যমণি হয়ে আছে?’ রুচি ফ্যালফ্যাল্ করে স্বামীর দিকে তাকায়।
‘তুমি ‘
‘তার মানে?’ রুচি প্রথমটায় স্তম্ভিত। তারপর সামলে নিয়ে হেসে বলল, ‘তুমি কি এতক্ষণ পারিজাতের বাংলোয় ছিলে? কিছু খেয়েটেয়ে আসনি তো! ও বুঝেছি, দীপ্তি খুব ঘটা করে চা-টা খাইয়ে দিয়েছে, তাই মাথা খারাপ করে এখানে এসে আবোলতাবোল বকছ, কেমন?’
‘তাই। শিবনাথ গম্ভীর হয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘এই বেলা তুমি খেতে দাও। আস্তে আস্তে সব বলছি।’
এ-ঘরের খাওয়া শেষ হতে রাত একটা বাজল। কেরোসিন ফুরিয়েছে। তাই আর হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব হ’ল না। কিন্তু তা বলে দু’জনের আলাপ বন্ধ নেই। অত্যন্ত জরুরি বিষয়। মশারির অন্ধকারের মধ্যে বসে দু’জন কথা বলছিল।
‘ডক্টর নাগ বিকেলে চা খেতে নেমন্তন্ন করলেন এদিকে সন্তোষের দলকে আর ওদিকে পারিজাতকে। একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। সেটা দূর না হওয়া পর্যন্ত বুড়ো নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। কখনো জীবনের দিকে কখনো অসিতের দিকে এবং বেশির ভাগ সময় ময়না ও সন্তোষের দিকে তাকিয়ে টাকপড়া মাথা নেড়ে তিনি বোঝালেন : ‘পারিজাত একটা ভুল করেছে। কিন্তু সেই তুলনায় সে কতটা ভাল করেছে তা কি দেখতে হবে না। কুলিয়া-টেংরার জঙ্গল ময়লা মশা-মাছির মধ্যে নিজে বাস করে সে জায়গাটা ডেভলাপ করার জন্যে চেষ্টা করছে। রাস্তা, পাকা ড্রেন, ইলেকট্রিক–সব হবে। স্কুল, লাইব্রেরী, ক্লাব, এমনকি ও-পাড়ায় একটা হাসপাতাল খোলার স্কীমও সে নিয়েছে। এখন কোন্ এক কে. গুপ্তর ছেলে অন্ধকার রাস্তায় অসাবধানে চলতে গিয়ে তার গাড়ির তলায় চাপা পড়েছে বলে যদি তোমরা হইচই আরম্ভ ক’রে দিতে তো বাস্তবিক সেটা অত্যন্ত দুঃখের হত। হ্যাঁ ব্যাপারটা হাশ্ আপ্ করতে চাওয়ার উদ্দেশ্য জেল-জরিমানা এড়ানো নয়, একটা বড় প্রজেক্ট, কতগুলো সুন্দর স্কীম নষ্ট না হয় সেটাই আসল কথা। দুষ্ট লোক বিরোধী দল এর সুযোগ নিয়ে কী না করতে পারে।’
‘কি বললে ওরা, ছেলেরা?’
ছেলেরা তখন চুপ ছিল। অসাবধানে চায়ের বাটি ঠোঁটের কাছে তুলতে গিয়ে ময়না এতটা চা নিজের শাড়িতে ফেলে দিতে সন্তোষ পকেট থেকে রুমাল বার করে তাড়াতাড়ি তা মুছে দিতে ব্যস্ত ছিল। পারিজাত বলছিল, যদি জখম হওয়ার ফলে রুণু সারাজীবনের জন্যে ক্রিপ্প্লড্ হয়ে থাকে বা মারা যায় তো সে যে-কোন এমাউন্ট, হ্যাঁ, ক্ষতিপূরণ হিসাবে কে. গুপ্ত বা তার স্ত্রীকে দিতে প্রস্তুত আছে।’
‘এটা ভাল প্রস্তাব।’ রুচি বলল, ‘যাকগে, তা এর মধ্যে আমার প্রসঙ্গ আবার কখন উঠল বলছ না তো?’
বলছি,’ শিবনাথ মৃদু হাসল। ক্ষতিপূরণের কথা উঠতে সন্তোষ মুখ তোলে। স্মার্ট ছেলে। হেসে পারিজাতের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তা আপনি এ-ব্যাপার নিয়ে যা খুশি তা করুন, আমাদের আর এখন অন্য কোন ডিমান্ড নেই কেবল একটি ছাড়া।’ শুনে পারিজাত হেসে বলছিল, ‘বেশ তো সেটা কি বল, আমি এখনই পূরণ করি।’ ডক্টর নাগ হাসছিলেন। কেননা, সন্তোষ এর আগেই তার দাবির কথা তাঁকে জানিয়ে রেখেছিল। এবার ডক্টর নাগ পারিজাতের কাছে সন্তোষের আসল পরিচয় দেন। সাহিত্যিক। গল্প উপন্যাস লিখছে। রাজনীতিটিতির চেয়ে শিল্প-সংস্কৃতির দিকে ঝোঁক বেশি। সেই চাইছে পারিজাতের পাড়ায় মেয়েদের যে সমিতিটা আছে, সেটা অর্গানাইজ করার ভার তাকে দেয়া হোক। কেবল মেয়েদের জন্যে না, ছেলেরাও তাতে থাকবে। ওটাকে সে আরো বড় করবে সুন্দর করবে। কেবল ক্যারম, ‘লুডো খেলা, খানকয়েক বই ও সেলাই রান্নার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যাপক অর্থে কালচারাল এসোসিয়েশন বলতে যা বোঝায়, দীপালি-সঙ্ঘকে সেরকম একটা কিছুতে রূপ দেয়া তার ইচ্ছা।’
‘ভারি তো উৎসাহ সঙ্ঘের জন্যে!’ রুচি খুক করে হাসল। ‘পার্ক স্ট্রীটের ছেলেরা কুলিয়া- টেংরার বস্তি পাড়ায় এসে সমিতি করবে?’
শিবনাথ রুচির হাতে চাপ দেয়।
‘উৎসাহের মূলে কে বুঝতে পারছ না?’
‘কে?’ প্রশ্ন করে পরক্ষণে রুচি বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল এবং রীতিমত শব্দ করে হাসল। ‘খুব স্বাভাবিক, অষ্টপ্রহর ময়নার সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ না হলে পাওয়া যাচ্ছে না যে।
শিবনাথের গলায় চাপা হাসি।
‘ওই তো বয়স প্রেম করার, প্রেমের জন্যে যে-কোন অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে এতবড় লোকের ছেলের আটকাচ্ছে না।’ একটু থেমে শিবনাথ বলল, ‘তা হলেও আমি,–আমার খুব ভাল লাগছে ছেলেটিকে পারিজাতের মুখে শুনছি পর থেকে।’
‘পারিজাত রাজী আছে?’
‘নিশ্চয়। এই সমিতি মারফত নাইট স্কুল হবে, ফ্রি রিডিং রুম হবে, চেরিটেবল ডিসপেন্সারী খোলা হবে, কুড়িটা চরকা আসছে; শাকসব্জি এবং ফুলের চাষের মডেল, বাগান করার জন্যে সন্তোষ পারিজাতের কাছে তিন বিঘা নিষ্কর জমি পর্যন্ত অলরেডি চেয়ে ফেলেছে
‘আর? কৃষি-সংস্কৃতি সমাজ-সেবা সব রকমের কাজে হাত দেবে দেখছি।’
‘নিশ্চয়।’ শিবনাথ রুচির হাসিতে যোগ না দিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘গান্ধীজয়ন্তী, রবীন্দ্রজয়ন্তী ইত্যাদি থেকে আরম্ভ করে বছরের একেবারে সবচেয়ে ছোট ফাংশানটাও সে এসে গেলে পর আর বাদ দিতে দেবে না, ম্যাজিক ল্যান্টার্নের সাহায্যে সাধারণ স্বাস্থ্য-রক্ষা, ডিসিপ্লিন, নার্সিং, সেফটি ফার্স্ট, সিভিক সেন্স ইত্যাদি নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় পাড়ার লোককে বক্তৃতা শোনাবার ব্যবস্থা থাকবে, হাতে লিখে কাগজ বার করা হবে, ছবি আঁকার, নাচের গানের গল্প কবিতা লেখার কম্পিটিশন, ডিবেটিং ক্লাব–অতটুকুন ছেলে কী না করতে চাইছে!’
রুচি মুখ থেকে আঁচল সরায়। অন্ধকারে শিবনাথ দেখল না, অনুভব করল।
‘তুমি সবটাই ঠাট্টা ক’রে উড়িয়ে দিতে চাইছ। ডক্টর নাগ সিরিয়স, পারিজাত সিরিয়স।’
‘আহা, ঠাট্টার কি শুনলে।’ গম্ভীর হয়ে গেল রুচি। ‘তা ময়নার তো এই সবে বর্ণবোধ আরম্ভ হয়েছে, ছেলেদের দিকটা সন্তোষ চালিয়ে নিতে পারবে মেয়েদের দিকটা চালাবার মতন তেমন উপযুক্ত কেউ আছে কিনা, ভাবছিলাম,–ছেলেমেয়ে নিয়ে যখন সমিতি।’
‘কেন, তুমি?’ রুচির হাতে হাত রাখল শিবনাথ
‘ঠাট্টা রাখ।’ হাত সরিয়ে নিলে রুচি।
‘মোটেই ঠাট্টা না।’ শিবনাথ আর স্ত্রীর হাত ধরতে চেষ্টা করল না। ‘পারিজাত বলছিল ডক্টর নাগের সামনে দাঁড়িয়ে সন্তোষ রীতিমত বক্তৃতা করছিল তখন। শেয়ালদা স্টেশনে ময়নাকে নিয়ে তোমার সঙ্গে একদিকে যেমন ঝগড়া করেছে, তেমনি অন্যদিকে দেখেছে সে তোমার শান্ত শ্রী কল্যাণী মূর্তি। তখনই আইডিয়াটা তার মাথায় এসেছিল। আর্টিস্ট ছেলে। বলছিল ময়না ও রুণুর প্রেম থেকে সে আবেগ উন্মাদনা পাচ্ছে, আর তোমাকে সকালবেলা এতটা সামনাসামনি দেখেছে পর থেকে সে পেল প্রেরণা শক্তি। এ-পাড়ায় এসে তোমাদের মধ্যে একটা কিছু না করা পর্যন্ত স্থির থাকতে পারছে না। পারিজাতকে সন্তোষ বলছিল : রুণুর ব্যাপারে উত্তেজিত হয়ে বারো-ঘরের বাড়ির সেই টিচারটিকে আমি হঠাৎ দুটো কটুকথা বলে ফেলেছি, তখন আমার মাথায় আর এক ঝোঁক ছিল, ময়নাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম পর একটু করে সেই সুন্দর শান্ত পরিচ্ছন্ন মুখখানা আবার ভীষণ মনে পড়তে লাগল। আমার অনুতাপ হচ্ছিল।’
একটু থেমে শিবনাথ বলল, ‘এবং ময়নাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোমার সম্পর্কে আরো নানারকম প্রশ্ন করল সে, কোন্ ইস্কুলে এখন তুমি আছ, কি রকম মাইনে টাইনে পাও আর কোন কাজ কর কিনা, বাড়িতে পুষ্যি ক’টি। ভয়ঙ্কর শ্রদ্ধা হচ্ছিল তোমাকে দেখে এবং
‘তারপর?’ হঠাৎ রাগটা প্রকাশ করল না রুচি। যেন দাঁতে দাঁতে ঠেকিয়ে হাসছে, তেমনি গলার সুর বার ক’রে বলল, ‘পারিজাত কিছু বলেছে তার উত্তরে?’
‘আমি অলরেডি ঠিক করে রেখেছি। তাঁকে সমিতির সেক্রেটারি করা হবে। বললেই রাজী হবেন। আমার বাড়ির একজন রেস্পেক্টবল ভাড়াটে। তা ছাড়া তাঁর স্বামী শিবনাথবাবুর সঙ্গে আমার ইদানীং আলাপ পরিচয় হয়েছে। সুতরাং তাঁকে খুব সহজেই পাওয়া যাবে আশা করছি।’ ডক্টর নাগকে এই এসিওরেন্সই দিলে পারিজাত।
রুচি কথা বলল না।
মশারির ভিতরটা থমথম করছিল। বাইরের মশককুলের ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না।
‘সন্তোষ বলছিল ইদানীং একটা ইংরেজি ফিল্মে একজন স্কুল মিট্রেসকে নাকি সে দেখেছে। তিনি অবশ্য খুব বড় লোকের মেয়ে ছিলেন। কোনরকম টাকা পয়সা না নিয়ে গরিব ছেলেমেয়েদের কেবল ইস্কুল নয়, বাড়িতে গিয়েও পড়াতেন। চিরকুমারী ছিলেন। তাঁর প্রেমিক যুদ্ধে মারা যান। পরে তিনিও যুদ্ধে চলে যান। সেখানে তাঁর কাজ ছিল আহত মুমূর্ষু সৈনিকদের সেবা শুশ্রূষা করা। সন্তোষ অভিভূত হয়েছিল মেয়েটির একদিকে স্নেহ মমতা প্রেম আর একদিকে ত্যাগ তিতিক্ষা সহিষ্ণুতা মাখা স্নিগ্ধ চোখ দু’টি দেখে। তার খুব ইচ্ছা, ডক্টর নাগকে বলছিল, এরপর সে যে বইয়ে হাত দেবে এরকম একটা চরিত্র থাকবে। বলতে কি, কমলাক্ষী গার্লস স্কুলের টিচারকে দেখেছে পর থেকে, এখন আর কল্পনা মিশিয়ে মূর্তি তৈরী না, পারিজাত যদি এলাও করে, তবে তাঁকে নিয়ে সে আরো বড় কাজ, ভাল কাজে হাত দিতে পারে, হ্যাঁ এতক্ষণ যেসব কাজের কথা বললাম। মোটের ওপর তোমাকে দেখে সন্তোষ খুব ইনস্পিরেশন পাচ্ছে।’
‘বখাটে ছেলে।’ রুচি রাগ করেও রাগ করতে পারল না! ‘ও এসব বলল পারিজাত তোমায় বলল বুঝি। রাত বারোটা পর্যন্ত সেখানে বসে থেকে এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করে এলে, রাজী হয়ে এসেছ?’
‘সব নিয়ে সব সময় রাগারাগি করলে তো আর দুনিয়া চলে না।’ শিবনাথ অল্প হাসল। ‘বলতে কি ট্যুইশনির জন্যে সেদিন যখন প্রার্থী হয়ে পারিজাতের বাংলোয় গিয়েছিলাম, করুণা, অনুকম্পা ছিল তার চোখে, কথায়। আজ দেখলাম পারিজাত সম্পূর্ণ বদলে গেছে। কত ইন্টিমেট, কী ভীষণ ইন্টারেস্ট তার আমাদের সম্পর্কে।–হ্যাঁ, রাত বারোটা পর্যন্ত সেখানে বসে আমি কেবল বাজে গল্প করে এসেছি। শোন, তুমি যে সেই নতুন স্কুলের চাকরির জন্যে পিটিশন পাঠিয়েছিলে, পারিজাত কাল সেখানে চিঠি দিচ্ছে। কুড়ি টাকা না। আরো দশ অর্থাৎ প্রায় ত্রিশ টাকা বেশি মাইনে। সে স্কুলের সেক্রেটারি পারিজাতের হাতের লোক। কেমন, গল্পের ক্লাইম্যাক্সে এসে গেছি তো?’
‘তোমার? তোমার একটা কিছু সুবিধাটুবিধার কথা বলেছে তো?’ রুচি আবার দাঁতে দাঁত ঠেকিয়ে হাসল।
‘আমার সম্পর্কে ভাবতে হবে না।’ গম্ভীর গলায় শিবনাথ বলল, ‘তোমাকে নিয়েই এতক্ষণ কথা হচ্ছিল, তোমার জন্যে–’
শিবনাথ থামল।
‘কি বল। চুপ ক’রে গেলে কেন?’ রুচি চাপা নিশ্বাস ফেলল। ‘শোন, আমার জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না, তোমার পারিজাতবাবুকে বলবে আমার চাকরির ব্যাপারে তিনি যেন কোনরকম রেকমন্ডেশন লেটার-টেটার না পাঠান। তুমি কি শোবে না?’
‘এত রাগ করছ তুমি।’
‘নিশ্চয়ই। আমাকে দিয়ে দীপ্তিরাণীর পদসেবা করাতে তোমার চোখে ঘুম নেই। তাই বলছিলাম ক’ বাটি চা আজ খেয়ে এসেছ তাঁর হাতে। খুব কড়া চা ছিল, কেমন না! গরম হয়ে এসে আমাকে জ্বালাতন করছ। সমিতির সেক্রেটারি হবে। যদি ফের আর কোন দিন–
‘এই, শোন।’ শিবনাথ স্ত্রীর হাত ধরল।
উত্তেজনায় রুচি কাঁপছিল।
‘চিরকাল কি তুমি আমাকে এমন উপেক্ষা করবে, আমার কথার কোনো দাম নেই?’ শিবনাথ শক্ত স্থির গলায় বলল, ‘দীপ্তি ছিল না। ও-বাড়িতে সে নেই।’
‘কোথায় গেছে?’
‘তা জানা যায়নি। তবে সেই ব্যারিস্টার প্রাইভেট টিউটার মন্টু ব্যানার্জির সঙ্গে যে যাচ্ছে একথা দীপ্তি স্বীকার করে গেছে। আজ সকালে উঠে পারিজাত বিছানায় রেখে যাওয়া দীপ্তির লেখা একখানা চিঠি পেল।’
‘বাচ্চাগুলো?’ রুচির গলা দিয়ে হঠাৎ স্বর ফুটছিল না। ‘শেষ পর্যন্ত ভদ্র মহিলা পালিয়ে গেল!’
‘তাতে পারিজাত একটুও বিচলিত না। হ্যাঁ, সেকথাও আমায় বলছিল। অত্যন্ত শক্ত নার্ভ। ছেলেমেয়েগুলোকে বালিগঞ্জে আজ দুপুরে পারিজাত তার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে! এখানে থাকলে কাঁদাকাটি করবে বলে। ওখানে দাদুর কাছে নাকি ওরা ঠাণ্ডা থাকবে!
‘আর কি বলছিল? তা হলে পারিজাতবাবু আজ নানাভাবে ডিস্টার্বড্! ছি ছি দীপ্তি—’
‘কিচ্ছু না। বললাম তো, অন্যরকম ছেলে সে। একটু দুঃখ করা, দীর্ঘশ্বাস ফেলা, কি স্ত্রীর এই কাজের জন্যে কোন রকম আক্রোশ পোষণ করা, উঁহু আমি এসবের বিন্দু বিসর্গও তার মধ্যে দেখলাম না। বরং হেসে বলল, সে স্বাভাবিকভাবেই এটাকে নিয়েছে, এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদ যে, সামনে ইলেকশন আসছে, এখন কাজ করার জন্যে অফুরন্ত সময় পাবে, এনার্জি পাবে। স্ত্রী যতদিন কাছে ছিল সে ভীষণ অসুখী ছিল, বিব্রতবোধ করত পদে পদে।’
রুচি চুপ।
‘কাজেই দীপ্তির উৎসাহে আমার আর সেই লোভে তোমাকে সমিতিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছি,–নিশ্চয় এ ধারণা এই ভুল বিশ্বাস এখন তোমার ভাঙল।’
‘আমি কি জানি, আমি কি জানতাম যে রায়সাহেবের ছেলের বৌ আর ওখানে নেই। তোমার তো আগেই বলা উচিত ছিল। এত বড় ঘটনা।’
‘এটা একটা ঘটনাই না। হ্যাঁ পারিজাতের চোখে। কাজেই আমরাও এটার কোনরকম ইম্পর্টেন্স দিচ্ছি না। এখানে কাজ বড়। পুরো তিন ঘণ্টা আলাপের মধ্যে পাঁচমিনিটও নিজের স্ত্রীর কথা অর্থাৎ এই ব্যাপার নিয়ে পারিজাত আমার সঙ্গে কথা বলেনি। তুমি শুনলে বিশ্বাস করবে? সবটাই ছিল ময়না রুণু ডক্টর নাগ সন্তোষ সমিতি এবং তোমার কথা,–’
রুচি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
‘বলো।’ একটু অসহিষ্ণু গলায় শিবনাথ বলল, ‘সন্তোষ অবশ্য প্রস্তাব দিয়েছে যে, যদি রুণু মারা যায়, তবে তার নামেই সমিতির নামকরণ হবে। এখন না। পরে। পারিজাত রাজী হয়েছে। কাল পরশু একটা ফর্ম্যাল সেরিমনি ক’রে তোমাকে সমিতির সেক্রেটারিশিপ দেওয়া হচ্ছে। বলো, কথা বলছ না যে। উত্তর দাও। কাল সকালে পারিজাতকে গিয়ে আমার কথা দিয়ে আসতে হবে।’
যদি ঘরে আলো থাকত তো শিবনাথ দেখতো রুচির ঠোঁটে এই প্রথম সূক্ষ্ম হাসি উঁকি দিয়েছে। আস্তে আস্তে বলল, ‘নিছক শো যখন হচ্ছে না, রিয়েলি ওরা কিছু করতে চান, আমি কনস্ট্রাকটিভ কাজের কথা বলছি, তো আমার আপত্তি নেই। তবু আমাকে আর একটু চিন্তা করতে দাও।
‘আমায় বাঁচালে, আঃ।’ শিবনাথ স্ত্রীকে বেষ্টন করে তার কপালে দীর্ঘ চুম্বন এঁকে দিলে। দূরে কোথাও একটা রাতজাগা পাখি ডেকে উঠল। বাইরে নিঝুম নিঃসাড় উঠোনে সম্ভবত রমেশ রায়ের কুকুরটা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল। আর শোনা যায় প্রমথদের ঘরে খনখনে বুড়ির গলা : ‘হরি হরি! মেয়ের দুঃখে বারোঘরের ভিটে ছেড়ে দিয়ে প্রভাতের হাত ধরে ডাক্তার কোথায় গিয়ে উঠবে কে জানে।’
‘দেশান্তরী হয়েচে দিদি, দেশ ছেড়ে গেল–হি হি।’ পাশের ঘরে মল্লিকা হেসে জবাব দেয়। ‘কুচুটে কুলোকের জায়গা এবাড়িতে নেই, তোমায় কি আমি আগেই বলিনি।’
শিবনাথের কানের কাছে মুখ নিয়ে রুচি বলল, ‘হাসপাতালে রুণুকে দেখতে গিয়ে ওষুধের গন্ধ ময়নার সহ্য হ’ল না, শেষটায় সন্তোষের কিনে দেওয়া গোলাপ শুঁকে
‘একেবারে ছেলেমানুষ। ওকে দোষ দেওয়া যায় কি। সবুজ কচি লতা অন্ধকারে মরা ডাল ছেড়ে আলোর দিকে নতুন শাখাটা পেলে জড়িয়ে ধরে, তুমি কি দেখনি। তা ছাড়া এমন একটা আর্টিস্ট ছেলের পাল্লায় পড়েছে।’
‘তাও বটে।’ রুচি আর হাসল না। ‘কিন্তু সন্তোষের সব কথা শুনে সত্যি এখন আমার মন্দ লাগছে না। সুন্দর আইডিয়া। কত আর বয়স! তখন তো কথাবার্তা শুনে চালচলন দেখে মনে হয়েছিল বুঝি গুণ্ডা, একেবারে বাজে ছেলে। প্রগ্রেসিভ আউটলুক আছে, কাজের ছেলে হবে মনে হচ্ছে।’
‘তোমার সঙ্গে থাকলে আরো ভাল হবে। তাই তো বার বার বলছিল আমাকে পারিজাত। ‘