৩৫
পোড়া মাংসের স্বাদটা আজও জিবে লেগে আছে হেমাঙ্গর। সঙ্গে একটা পাশ্চাত্য স্যালাড ছিল। ছিল ভেটকি মাছ, টমেটো আর ধনেপাতা দিয়ে রান্না একটা বিচিত্র পদ। তন্দুরী রুটিটা হয়েছিল টাটকা পাঁউরুটির চেয়ে নরম। সবই দারুণ। তবু পোড়ানো মাংসের ফরাসী আইটেমটা আজও হেমাঙ্গকে লোভাতুর করে রেখেছে। সঙ্গে ছিল রশ্মির চমৎকার দন্তপঙ্ক্তি আর আধ খোলা ঠোঁটের হাসিটিও।
খাওয়ার টেবিলে রশির কয়েকজন ভ্রূ উঁচু, উন্নাসিক, ইংরিজি মাধ্যম বন্ধু ও বান্ধবীও ছিল। ছিলেন রশ্মির সুপুরুষ, রাশভারী, সংলাপ-বিমুখ বাবা এবং একজন বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও আধুনিকা মা। না, এঁরা কেউ হেমাঙ্গকে তাচ্ছিল্য করেননি। বরং তাকে বেশ একটু খাতিরই করা হচ্ছিল। একটু বেশীই যেন। তার কারণ বোধ হয় এই যে, হেমাঙ্গ ঠিক তাদের মতো নয়। একটু গেঁয়ো, একটু সংকুচিত।
হেমাঙ্গর বাঁ-পাশে-বসা রশ্মির মা একটু চাপা স্বরে বলে ফেললেন, জানেন তো, রশ্মি একরকম ইউ. কে-তেই মানুষ। এবার গিয়ে সিটিজেনশিপ নিয়ে নেবে।
তাতে হেমাঙ্গর কিছুই যায় আসে না। সে ভেটকি মাছের চমৎকার স্বাদে প্রায় সম্মোহিত অবস্থায় বলল, ইউ. কে. ভাল জায়গা। ভালই হবে।
আজকাল ওসব দেশে খুব রেসিস্ট মুভমেন্ট হচ্ছে। তাই ভয় পাই।
হেমাঙ্গ একটা তন্দুরী রুটি ছিঁড়ে মাছের ক্কাথটিতে ডুবিয়ে তুলে মুখে দেওয়ার আগে বলল, তা বটে।
এ দেশে থেকেই বা কী হল বলুন! ও দেশে বরং লেখাপড়াটা হবে। পি-এইচ ডি করে ওখানেই প্রফেসরশিপ নিয়ে নেবে। আমরা একা হয়ে যাবো।
সঙ্গে যান না!
যাবো? আমাদের যে এখানে অনেক বিষয়সম্পত্তি। রশ্মির বাবা বিদেশে থাকতে রাজি নন।
এক চামচ ফ্রায়েড রাইস নিল হেমাঙ্গ, তারপর বলল, আপনি?
সত্যি কথা বলতে কি আমার এ দেশ একটুও ভাল লাগে না। ও দেশে থাকলে একটুও বোর হই না।
হেমাঙ্গ ভদ্রমহিলার দিকে একবার তাকাল। দারুণ পেন্ট করা মুখ এবং প্রচুর রূপটানে বয়সটা বোঝা যায় না। মেয়েটি মায়ের উল্টো। রূপটানের বালাই-ই নেই। হেমাঙ্গ চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, সেটা ঠিক কথা। ওসব দেশে এন্টারটেনমেন্টের অভাব নেই।
আমার তো পায়ে হেঁটে হেঁটে লন্ডনে ঘুরে বেড়াতে বেশ লাগে। উইক এন্ডে কান্ট্রি সাইডে চলে যেতাম। কী যে ভাল লাগত!
হ্যাঁ। কান্ট্রি সাইডটা খুবই ভাল।
ভদ্রমহিলা সামান্য বিস্মিত হয়ে বলেন, আপনি গেছেন নাকি?
হেমাঙ্গ লজ্জিত হয়ে বলে, শর্ট একটা কোর্স করতে গিয়েছিলাম।
ওমা? কই, রশ্মি বলেনি তো আমাকে!
হেমাঙ্গ একটু থতমত খেয়ে বলে, ওটা কোনও ঘটনাই নয়। বিলেত, আমেরিকা আজকাল অনেকের কাছে জলভাত।
তাই বুঝি?
আমি একজন স্মাগলারকে জানি, প্রতি সপ্তাহে লন্ডন যায়।
যাঃ, বানিয়ে বলছেন!
ঠিক আছে, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো।
ভদ্রমহিলা বিস্মিত হয়ে বললেন, সত্যিই যায়?
কখনো-সখনো হয়তো এক-আধটা সপ্তাহ ফাঁক থাকে। কিন্তু খুব ঘন ঘন যায় জানি। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলার ছাড়াও যায় ব্যবসাদার, ট্র্যাভেল এজেন্টের লোক, কুরিয়ার সার্ভিসের লোক।
বোধ হয় ঠিকই বলছেন আপনি। এত আজেবাজে লোক যায় বলেই বোধ হয় ওরা আর বিদেশীদের পছন্দ করছে না।
যে আজ্ঞে।
রশ্মি একটু ঘুরে, তিনটে চেয়ারের দূরত্বে বসে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খাচ্ছিল। একবার চোখাচোখি হতে একটু হাসল রশ্মি। বলল, কেমন খাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। মা, ওঁকে একটু দেখেশুনে খাওয়াও।
হেমাঙ্গ মৃদু হেসে বলল, দারুণ!
রক্ষা এই যে, এ বাড়িতে ডিনারের আগে ককটেল ছিল না। সাধারণত এসব ঘ্যাম বাড়িতে ওটা থাকেই। তবে হেমাঙ্গকে একবার রশ্মি জিজ্ঞেস করে নিয়েছিল, আপনি কি ড্রিংক করবেন? আমাদের অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে।
হেমাঙ্গর পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডে মদের কোনও ভূমিকাই নেই। ফলে সে জিনিসটা কখনও উপভোগ করে না। দুর্ভাগ্যবশত তাকে অবশ্য বিভিন্ন পার্টিতে যেতে হয় এবং ভদ্রতা রক্ষার্থে হাতে গেলাসও ধারণ করতে হয়। এক বা দু চুমুক খেয়ে সে গেলাসটা গোপনে কোনও ফ্লাওয়ার ভাস-এর পিছনে বা টেবিলের তলায় বা পদার আড়ালে জানালার তাকে রেখে দেয়। সে বেশ উদ্বেগের গলায় বলে ফেলল, না, আমি ড্রিংক করি না। আপনাদের কি ককটেলও আছে না কি আজ?
রশ্মি হেসে ফেলল, বলল, না। বাবা একটু রক্ষণশীল মানুষ। বাড়িতে ওসব পছন্দ করেন না। তবে কেউ চাইলে দেওয়া হয়।
বাঁচা গেল।
ককটেল ছিল না বলেই বেশ নিশ্চিন্ত মনে ডিনারটাকে উপভোগ করতে পারছিল হেমাঙ্গ। এরকম ডিনার সে বহুকাল খায়নি। কিন্তু প্রশ্ন হল, খাওয়াটা আদৌ হচ্ছে কেন? একটা উপলক্ষ তো থাকবে? এই উপলক্ষটাই ধরতে পারছে না হেমাঙ্গ।
একবার সে আলগোছে রশ্মির মাকে জিজ্ঞেস করল, আজ কি আপনাদের কোনও অকেশন আছে?
অকেশন! না তো!
এই জন্মদিন-টন্মদিন!
রশ্মির মা তাঁর চড়া লিপস্টিক চিরে হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন, ওসব কিছু নয়। রশ্মি ফ্রান্সে রান্না শিখেছিল কিছুদিন। মাঝে মাঝে রাঁধে আর সবাইকে খাওয়ায়।
রান্না কি কোনও মেয়ের হবি হতে পারে?
কেন হবে না বলুন তো!
মেয়েরা রাঁধতে ভালই বাসে না।
সব মেয়ে কি সমান? রশ্মি একটু আলাদা ধরনের। এমন কি ওর সঙ্গে আমারও মেলে না।
রশ্মি যে একটু আলাদা তা ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারছে হেমাঙ্গ। এরকম দুর্দান্ত ব্যাকগ্রাউন্ড, এরকম দারুণ সুন্দরী, তবু কোনও দেমাক নেই। কিংবা থাকলেও সেটা ঠুনকো বা বোকা দেমাক নয়। রশ্মি বেশ একটু অন্যরকম। হেমাঙ্গর মেয়েদের সম্পর্কে অনীহার ভাবটা কি রশ্মি কাটিয়ে দিচ্ছে!
এসব সেই গত রবিবারের কথা। আজ বুধবার। পোড়া মাংসের আশ্চর্য স্বাদ আর গন্ধটা কেন আজও আবিষ্ট করে রেখেছে হেমাঙ্গর নাক আর জিবকে?
সেদিন ডিনারের পর বাড়ি ফিরতে না-ফিরতেই চারুশীলার ফোন, কি রে, কিরকম হল?
হেমাঙ্গ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, তোর রান্নার নাকি প্রশংসা করে সবাই! ছোঃ। রান্না কাকে বলে তা আজকের ডিনারটা খেলে বুঝতে পারতিস। অধোবদন হয়ে থাকতে হত।
নিজে বেঁধেছে?
আলবাৎ। ফরাসি দেশে গিয়ে পয়সা খরচ করে রান্না শিখে এসেছে। তোদের মতো গুচ্ছের মশলা দিয়ে টাগরায় জ্বালা-ধরানো রান্না নয়। এসব রান্না কিরকম জানিস, জিবে শান্তি, পেটে শান্তি, মনে শান্তি।
তোর তো দেখছি স্ট্রোক হয়েছে।
তার মানে?
লাভ-স্ট্রোক। শেষ অবধি একটা রাঁধুনীর প্রেমে পড়লি নাকি?
রান্না জিনিসটাকে মিনিমাইজ করছিস? রান্নাও যে একটা আর্ট তা জানিস? আজকাল সব ম্যাগাজিনে আর পেপারে কত রকম রান্নার রেসিপি ছাপা হয় দেখিস না? বড় বড় হোটেলের শেফরা কত মাইনে পায় জানিস? শুনলে মাথা ঘুরে যাবে। রান্না মোটেই ফেলনা জিনিস নয়।
চারুশীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুই পেটুক তা জানি। কিন্তু ওই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তোকে কেউ হাত করে ফেললে সেটা আমাদের পক্ষে খুবই দুঃখের ব্যাপার হবে। তোকে যা বলে দিয়েছিলাম সেটা খোঁজ করেছিলি?
কী বলেছিলি?
ওরা বামুন না কায়েত?
ওই নিয়েই থাক। বামুন-কায়েত জেনে কী হবে? চোরের মন কেবল বোঁচকার দিকে। রশ্মি আমার একজন ভাল বন্ধু। আর কিছু নয়।
কবে দেখাবি?
দেখাবো মানে? দেখানোর কী আছে?
তোর যা অবস্থা দেখছি তাতে মনে হয়, গতিক সুবিধের নয়। ছাইক্লোন হতি পারে।
শ্রীকান্ত থেকে কোট করলি নাকি? একটু-আধটু বই-টই পড়ছিস তাহলে?
আমি তো পড়িই! তুই যে কিছুই পড়িস না। এই পিসটা বোধ হয় তোর পাঠ্য বইতে ছিল, তাই ধরতে পারলি।
গল্প উপন্যাস পড়ে অকাজের লোকেরা। আমার অত ফালতু সময় নেই। আর ওইসব গল্প উপন্যাস পড়েই তো তোর মাথাটা গেছে। সব জায়গায় প্রেমের গন্ধ পাচ্ছিস। তুই একটা যা-তা।
গল্প উপন্যাস পড়লে তোর নিরেট মগজেও বুঝতে পারতিস যে, তুই অলরেডি রশ্মি রায়ের জালে আটকা পড়ে গেছিস। গল্প উপন্যাস মানুষকে অনেক বেশী কনশাস করে তোলে। যাক গে, আসল কথাটা বল। মেয়েটাকে কবে দেখাবি?
দেখানোর কিছু নেই, বললাম তো।
আচ্ছা ছোটলোক বটে তুই, কেল্পনও ভীষণ। তোকে যে এত খাওয়াল, তোর কি উচিত নয় ওকেও নেমন্তন্ন করে একদিন খাওয়ানো?
এ কথায় হেমাঙ্গ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, কেন, আমি খাওয়াতে যাবো কেন?
ওটাই যে ভদ্রতা। দুনিয়াটা চলছে লেনদেনের ওপর। শুধু একতরফা খেয়ে এলেই হল?
পার্টি দিতে হবে বলছিস?
হবে না? তুই কী রে!
ঠিক আছে, কোনও ভাল হোটেলে নিয়ে গিয়ে একদিন খাইয়ে দিলেই হবে।
এই না হলে তোকে দুনিয়ার পয়লা নম্বর গবেট বলা হয় কেন?
কেন, প্রস্তাবটা কি খারাপ?
ও তোকে বাড়িতে ডেকে যত্ন করে রেঁধে খাওয়াল, আর তুই ওকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবি? এটা কি বিলেত? না কি তুই মস্ত বড় সাহেব হয়েছিস?
হেমাঙ্গ অসহায়ভাবে বলল, তাহলে কি করব? বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে নেমন্তন্ন করলে হাজারটা কথা উঠবে। কুমারী সুন্দরী মেয়ে বলে কথা! জবাবদিহি করতে জেরবার হবে আমার। আর এ বাড়ির রাঁধুনী হল ফটিক, সেই রান্না আমার মতো সহনশীল মানুষ খেতে পারে, কিন্তু রশ্মি পারবে কি?
তোকে আর বোকা বুদ্ধি খাটাতে হবে না। রশ্মিকে নেমন্তন্ন করবি আমার বাড়িতে।
তোর বাড়ি? অ, বুঝেছি। এই ফাঁকে দেখে নিতে চাস তো?
দেখলে কি তোর ভাগে কম পড়বে?
নেমন্তন্ন যদি নিতে না চায়? যদি না আসে?
তোর বলার ভাগ বলবি, তারপর আমি বুঝব। ওর ফোন নম্বরটা আমাকে দে। তুই আগে নেমন্তন্ন করবি, তারপর আমিও বলব।
তুই কিন্তু ব্যাপারটা পাকিয়ে তুলছিস। আমি ব্যাচেলর মানুষ, আমি ওকে নেমন্তন্ন না করলেও কিছু যায় আসে না। এই পাল্টা নেমন্তন্ন মানেই সম্পর্কটাকে আরও ঘুলিয়ে ভোলা।
তোর মাথা! এ যুগে কেউ অত সহজে আছাড় খায় না। বিলেত-ঘোরা মেয়ে, খুব সোজা পাত্রী নয়। আর তুই বোকা হলেও সেয়ানা।
আরও একটা প্রবলেম আছে। তুই যা রাঁধিস তা কি ও খেতে পারবে?
চাটবে। তবে ভয় নেই, আমার রান্নার লোক আছে।
তা জানি। তার রান্না খাওয়াবি? তার হাতে হাজা নেই তো?
মুকুন্দ সদাচারী মানুষ, তোর মতো ম্লেচ্ছ নয়। সাহেবী রান্নাও জানে। আমিও ওকে হেল্প করব। তোর ভয় নেই।
এ পর্যন্ত হয়ে ছিল। কিন্তু কঠিন হল, রশ্মিকে নেমন্তন্ন করাটা। একটা আচমকা লজ্জা আর সংকোচ বাধা দিচ্ছিল হেমাঙ্গকে। পাল্টা নেমন্তন্নটা কি ঠিক হচ্ছে? চারুদি একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে তুলছে না তো! শেষ অবধি অবশ্য সে দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে ফোনটা করে ফেলেছিল। আশ্চর্যের বিষয় রশ্মি এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল। সামনের রবিবার সন্ধেবেলায় চারুশীলার বাড়িতে সে সানন্দে যাবে।
পৃথিবীর সব ঘটনার রাশ তার হাতে নেই। অনেক সময়ে ঘটনা ঘটে যায়, মানুষকে তা মেনে নিতে হয় মাত্র। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী এবং অভ্যাসবশে হেমাঙ্গ ভগবান মানে, কিন্তু তার জীবনে কোনও ধর্মাচরণ নেই। মাঝেমধ্যে সে ভগবানের ওপর নির্ভর করে। এখনও তার জীবনে এক সংকটমুহূর্ত। ভগবানের ওপর ভর করা ছাড়া তার আর উপায় নেই। পোড়া মাংসের স্বাদ তাকে পেড়ে ফেলেছে বটে, কিন্তু সে সেই সম্মোহন কেটে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ঘটনার গতিক তার সুবিধের ঠেকছে না।
আজ কিছু কেনাকাটা করলে কেমন হয়? জিনিসপত্র কিনলে তার মনটা ভাল হয়ে যায়।
অফিস থেকে বেরিয়ে বেশ খানিকটা ঘুরে সে প্রায় হাজার টাকা দামের এক জোড়া জুতো কিনল। জুতো কিনতে তার যে কেন এখনও এত ভাল লাগে! জুতোর মধ্যে কোন্ আনন্দ লুকিয়ে থাকে কে জানে বাবা!
দামটা একটু বেশী পড়ে গেল, কিন্তু জুতো জোড়া এতই ভাল যে পায়ে দিয়েই একটা চমৎকার আরাম বোধ করল সে। জুতো তৈরির কলাকৌশলও এত অত্যাধুনিক হয়ে যাচ্ছে যে, সূক্ষ্ম সাইকোলজির সঙ্গেও জুতোর যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে গেল বুঝি। পায়ে দিলেই মন অবধি ভাল হয়ে যায়।
নতুন জিনিস কিনে এনে সে সেটা প্রথম দেখায় ফটিককেই। ফটিক বুঝদার সমঝদার মানুষ নয়। তবে সে যা-ই দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়, অবাক হয়। তারিফ করার ধরনটাও তার আলাদা রকমের।
আজ জুতো দেখে ফটিক বলল, এ খুব জম্পেশ জিনিস বলেই মনে হচ্ছে। হেসে-খেলে পাঁচ-সাতটা বছর চলে যাবে।
আহা, টেকার কথা হচ্ছে না, জিনিসটা কেমন বলল।
এ তো জুতো বলে চেনাই যায় না, যেন এক জোড়া জাহাজ। এতে কোনও কলকজা লাগানো নেই তো দাদাবাবু?
আরে না। জুতোয় কলকজা আসবে কোত্থেকে?
কি জানি, আজকাল সবকিছুতেই বড্ড কলকব্জা লাগানো থাকে। দই-ঘোঁটার কল, সরবতের কল, আটা-ময়দা মাখার কল। তার ওপর তোমার ওই বাক্স-উনুন—উঃ রে বাব্বা, কী অশৈলী কাণ্ডই যে হয় ওতে!
ফটিকের সঙ্গে কথা বলে একটা আরাম হয় হেমাঙ্গর। ফটিকের ভিতরে সভ্যতা ঢোকেনি, শহর ঢোকেনি, বিজ্ঞান বা সাহিত্য ঢোকেনি। ফটিক নিষ্কলুষ আছে। তাকে শিক্ষিত বা চালাক-চতুর করে তোলার বৃথা চেষ্টা কখনও করে না হেমাঙ্গ। বরং ফটিকের সরলতা আর বিস্ময় সে নিজেই শিখে নেওয়ার চেষ্টা করে।
ফটিকদা, জুতো জোড়া একটু পায়ে গলিয়ে দেখ, কী আরাম!
ফটিক শিহরিত হয়ে বলে, পায়ে দেবো! আমার কি মাথা খারাপ হল নাকি? শুনলেও পাপ!
আরে দূর! পাপ কিসের? জুতো তো পায়েরই জিনিস। পরে দেখই না একবার।
মরে গেলেও পারবো না। কী বলল না তুমি দাদাবাবু!
হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তোমাকে আর মানুষ করা গেল না। আচ্ছা, তোমার জুতো নেই?
তা থাকবে না কেন? এক জোড়া রবারের জিনিস আছে। হাওয়াই চটি।
চটি! শীতকালেও?
খুব ভাল জিনিস। শীত গ্রীষ্মে সমান পরা যায়।
ফটিকের সঙ্গে তার যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে সেটাকে খুবই উপভোগ করে হেমাঙ্গ। সারা দিন তার মেলামেশা কিছু টাকার কুমিরের সঙ্গে। তারা হচ্ছে টাকা-সর্বস্ব মানুষ। সারা দিন টাকার কথা শুনতে শুনতে হেমাঙ্গর একটা মানসিক ক্লান্তি আসে। তার আত্মা ক্লিষ্ট হয়। টাকার হিসেব কষতে কষতে সে নিজেকে বুড়ো বলে ভাবতে শুরু করে। তাই বাড়িতে এসে যখন ফটিককে দেখে তখন একটা আনন্দিত বিস্ময় ঘটে তার। এই তো একটা মানুষ যার প্রয়োজন এত কম, এত অল্প নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে যা প্রায় অবিশ্বাস্য। বাঁচতে ফটিকেরও কিছু টাকার দরকার হয় বটে, কিন্তু ফটিকের মধ্যে টাকা-সর্বস্বতা নেই। এরকম লক্ষ লক্ষ মানুষ ছড়িয়ে আছে ভারতবর্ষে, যাদের অবস্থা ফটিকের চেয়েও খারাপ। কিন্তু ফটিকের চরিত্রে লোভ জিনিসটাই দেখতে পায় না হেমাঙ্গ। কাছাকাছি এরকম একটা লোক থাকলে অকারণেই ভাল লাগতে থাকে।
বুধবার রাত্রিটা ভাল ঘুম হল না হেমাঙ্গর। নানা সম্ভাবনা ও তজ্জনিত দুশ্চিন্তায় তার মাথাটা গরম। তার নিশ্চিন্ত একক জীবনে চোরাপথে কি সিঁদ কাটা হচ্ছে? রশ্মি রায় কি ঢুকে পড়ছে তার সংসারে? বিডন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে একা থাকতে এসে তবে কি লাভ হল তার?
বৃহস্পতিবার সকালে সে ফটিককেই জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, ফটিকদা, যদি হুট করে আমার একটা বিয়েটিয়ে হয়ে যায় তাহলে কেমন হয় বললা তো?
বিয়ে! সে তো খুব ভাল জিনিস। তখন বউদিদি রান্নাবান্না করে দেবেন, ঘরদোর সামলাবেন, বাড়িটা সরগরম রাখবেন।
বউ কি শুধু রান্না করে আর ঘর সামলায়?
আমাদের ঘরের বউ ওরকমই হয়। বউ এলে কাজ করে।
ধরো যদি কাজ করতে না হয়?
বউয়ের আর কোন উপযোগ আছে তা ভেবে পেল না ফটিক। সবেগে মাথা চুলকে বলল, বাবুদের বাড়িতে বউরা কাজ করে না বটে, কিন্তু তাতে আধিব্যাধি হয়। গতর তো পুষে রাখবার জিনিস নয়।
হেমাঙ্গ একটু হাসল, তুমি একটি বেশ লোক ফটিকদা। মনে মুখে ফাঁক নেই।
ঘটনাবিহীন বৃহস্পতি কাটল, শুক্র গেল। শনিবার চারুশীলা ফোন করল রাতে, এই কিম্ভূত, কালকের কথা মনে আছে তো?
আছে।
তুই রশ্মিকে নিয়ে আসবি।
না, রশ্মি নিজেই চলে যাবে বলেছে।
তুই আনলে ভাল হত না?
না, হত না।
তাহলে তুই সকাল সকাল আসবি। এ বাড়িতে ও তো কাউকে চেনে না। লজ্জা পাবে।
লজ্জা পাবে! সে জিনিস নয় রে। এ অন্য ধাতুতে গড়া।
তা হোক। তোর নিজেরই উচিত ওকে রিসিভ করা।
ঠিক আছে ভাই, যাবো।
বিকেল চারটের মধ্যে চলে আসবি।
বড্ড আর্লি হয়ে যাচ্ছে না?
হোক। শরৎকালে বেলা তাড়াতাড়ি শেষ হয়।
তোর সব ব্যাপারেই বড় বাড়াবাড়ি।
এ কথা খুবই ঠিক যে, সব ব্যাপারেই চারুশীলার কিছু বাড়াবাড়ি আছে। টাকা জিনিসটাকে সে ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো লাগাম ছেড়ে। রবিবার দিন সে তার বিদঘুটে আর্কিটেকচারের বিশাল ঘরখানা নতুন করে সাজিয়েছে। ঝাড়পোঁছ পালিশে ঘরখানা আয়নার মতো ঝকঝক করছিল। পুরনো কিছু আসবাব হয়তো-বা জলের দরে নীলামঘরে বেচে দিয়ে সে কয়েকটা নতুন ধরনের আসবাব কিনেছে। একখানা গ্লাসটপ নতুন পেল্লায় সেন্টার টেবিলও লক্ষ করল হেমাঙ্গ। যথাযোগ্য জায়গায় প্রচুর পরিমাণে রজনীগন্ধার স্টিক সাজানো। একটি মনোরম সুগন্ধী স্প্রে করা হয়েছে সারা ঘরে।
হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এটাকেই বাড়াবাড়ি বলে, তা জানিস?
চারুশীলা গম্ভীর মুখে বলল, মোটেই বাড়াবাড়ি নয়। এটুকুর দরকার ছিল।
টুকু? হেমাঙ্গ চোখ কপালে তুলে বলে, এটাই যদি তোর কাছে টুকু হয়, তাহলে খানি হয় কিসে? সোফাসেট নতুন কিনলি বুঝি?
কিনলাম।
কত পড়ল?
তা দিয়ে তোর কী দরকার? তুই যে গুচ্ছের জিনিস কিনে ঘরটা জঙ্গল বানাচ্ছিস?
তোর কেনা আর আমার কেনায় তফাত আছে। আমি ডেকোরেশনে বিশ্বাস করি না।
এ যুগে ডেকোরেশনেরই দাম। ডেকোরেশন জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে।
তোর মাথা। খাওয়ার আয়োজনও বোধ হয় রয়্যাল স্টাইলেই হবে? একটা মেয়ের জন্য এত!
একটা মেয়ে কেন? আজ আমি কয়েকজনকে নেমন্তন্ন করেছি।
সভয়ে হেমাঙ্গ বলে, কাকে?
চারুশীলা মুখ টিপে হেসে বলে, ভয় নেই, বাড়ির কাউকে নয়। আমার বান্ধবী আর তাদের বরেরা। খাওয়ার ঘর দেখে যা।
খাওয়ার ঘরেও দেখা গেল, চারুশীলা টাকা ছড়িয়েছে। দেওয়ালে বিশাল প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর ওয়ালপেপার সদ্য লাগানো। বড় দেওয়াল বলে দৃশ্যটা খুলেছে চমৎকার। মাঠ, ঘাট, ক্ষেত, ধানের মড়াই, কুঁড়ে ঘর। প্রমাণ সাইজই বলা যায়। তবে গ্রামীণ দৃশ্যে কেন একটি আধুনিক মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তা হেমাঙ্গ বুঝতে পারছিল না। মেয়েটা একটু চেনা-চেনাও।
একে চিনিস? মনে পড়ে? এ হল ঝুমকি! এদের বাড়ির সবাই আজ আসবে।
হেমাঙ্গর ভুল ভাঙল। মেয়েটা ছবির নয়, রক্তমাংসের। একটু হেসে এগিয়ে এল, কেমন আছেন?
হেমাঙ্গ এই মেয়েটার মধ্যে সেই ভেজা, ভীতু মেয়েটার একটা আদল পেল মাত্র। শুধু আদলটুকুই। আজকের ঝুমকি অন্যরকম। তেজী চাবুকের মতো চেহারা। একটু রোগার দিকে। মুখখানা যেন খুব যত্ন করে কেটে কেটে তৈরি করা।
হেমাঙ্গ বলল, আপনি কেমন আছেন?
মেয়েটা জবাব দিল না। ঘাড় হেলিয়ে হাসল। হাসিটা খুবই ভাল। পৃথিবীতে ভালরও কি শেষ নেই? ভালর পরও আরও ভাল, আরও ভাল—এটা কি ভাল?