৩৫. দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। আর রাত গড়িয়ে সকাল।

কিন্তু তবু অন্যদিনের সকালের চেয়ে আজকের সকালের যেন অনেক অফাৎ। আজ দাসু জমাদারের ঝাটার শব্দ যেন অন্যদিনের চেয়ে মৃদু। আজ চিৎকার কম। সবাই যেন সন্ত্রস্ত। সচকিত। ভেতর বাড়িতে সৌদামিনীর গলায় ঝাঝ নেই তেমন। আজও ঘোড়ার ডলাই-মলাই চলছে আস্তাবলে। কিন্তু চাপড়গুলো যেন একটু আস্তে। ঘোড়াগুলোও যেন বুঝতে পেরেছে। তারাও পা ঠোকে আস্তে-আস্তে।

তোষাখানায় বংশীর কাছে গেল ভূতনাথ। জ্বরটা কমেছে একটু। কিন্তু চিৎপাত হয়ে তেমনি শুয়ে আছে। ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আজ খেতে ইচ্ছে করছে কিছু?

বংশী বললে—ছোটবাবু কেমন আছে আগে তাই বলুন শালাবাবু, সারারাত ছোটবাবুকে স্বপ্ন দেখেছি আজ্ঞে।

মধুসূদন বললে—শশী ডাক্তারকে তো আবার ডাকতে গিয়েছে সরকারমশাই।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে–ছোটবাবু কেমন আছে জানো তুমি?

মধুসুদন বললে—শশী ডাক্তারের ওষুধে কাজ হবে না! কী বলেন, শালাবাবু।

সত্যিই শশী ডাক্তার ধন্বন্তরি বটে! বুড়ো মানুষ, কিন্তু কাল রাত্রে ঘণ্টা তিনেক নিজে রোগীর পাশে থেকে চাঙা করে দিয়ে গিয়েছেন ছোটবাবুকে! গায়ের ব্যথা অনেক কম।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আর পুলিশ কখন গেল?

মধুসুদন বললে—শেষকালে পুলিশের বড় সাহেব কাল এল।

-কখন?

—রাত তখন প্রায় তিনটে। মেজবাবু ডেকে পাঠালেন। সারা রাত্তির আমরা কেউ ঘুমোইনি হুজুর, লোচন নাগাড়ে তামাক সেজে গিয়েছে, আমি আর বিধু সরকার ঠায় দাঁড়িয়ে, ভেতরে হাসি-গল্প হচ্ছে, খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে, সেই রাত্তিরে গাড়ি বেরলো-সরকার মশাই সেই রাত্তিরে আবার খাজাঞ্চীখানার দরজা খোলে।

-কেন?

-টাকা-কড়ি তো নেয় ওরা। হয় তো সিধে নিয়ে গেল কিছু… গুলুম যখন, তখন গঙ্গাযাত্রীদের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, সরকারমশাই-এর আর শোয়া হলো না, ভোরবেলাই বাজারে চলে গেল মাছ আনতে, থানায় সিধে পাঠাতে হবে। মেজবাবু তখন বললে-আলমারি খোল্।

ভূতনাথ চলে আসছিলো। হঠাৎ মনে পড়লো আর একটা কথা!—চুনীদাসীর খবর কিছু জানে মধুসূদন?

—সে জানবার আর সময় পেলাম কই শালাবাবু। এখন যাচ্ছি–বাজারে যাবো, অমনি চাঁদনীটা টপ করে ঘুরে দেখে আসবো।

মধুসূদন চলে যেতেই বংশী বললে—ছোটমা কী বললে শালাবাবু?

পটেশ্বরী বৌঠানের কথা ভূতনাথেরও অনেকবার মনে হয়েছে। কাল অমন করে বরানগর যেতে-যেতেও যাওয়া হলো না, তারপর আর একবার দেখা হওয়া উচিত ছিল। চিন্তার কাছে শুনেছিল আবার নাকি সেই ছাইভস্ম খেয়েছে। এখন সারারাত উপোস করার পর কেমন আছে কে জানে!

চোরকুঠুরির ধারে গিয়ে একবার দাঁড়িয়েছিল ভূতনাথ। ছোট দরজাটার ওপাশের বারান্দায় তখন সিন্ধু আর গিরির গলার শব্দ আসছে। কেমন যেন লজ্জা সঙ্কোচ হয়। ভর-সকাল বেলা। পুবমুখো বারান্দা। রোদে একেবারে ছেয়ে গিয়েছে। এমন সময় কখনও যায় নি ভূতনাথ। অতগুলো চোখের সামনে দিয়ে হুট হুট করে ছোটবৌঠানের ঘরে যাওয়া। কে কী বলবে! তা ছাড়া বংশী নেই আজ। বংশী থাকলে সে ঠিক সময়-সুযোগ বুঝে টুক করে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দেয় বৌঠানের ঘরে। আশে-পাশে চিন্তারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

বংশী বললে—আজকে কী খাবো শালাবাবু?

ভূতনাথ বললে-জল-সাবু খালি। আমি কাল চিন্তাকে বলে দিয়েছি।

–দেখুন তো, কে এসব করে, ওদিকে ছোটবাবুর অসুখ, ছোটমা’র কী অবস্থা কে জানে, আর আমি রইলাম পড়ে, আমার আবার জল-সাবু হ্যান্-ত্যান-মাস্টারবাবু থাকলে একটা বড়ি দিয়ে দিতেন আর সব সেরে যেতে আজ্ঞে এক দণ্ডে।

ভূতনাথ বললে-কপালের গেরো বংশী—তুই কি করবি বল?

বংশী বললে—আপনি আজকের দিনটা কোথাও আর বেরোবেন না শালাবাবু—ছোটমা কখন কী করে।

ভূতনাথ তা জানতত। তবু না বেরিয়েও উপায় ছিল না।

বংশী বললে—যদি বেরোন, তো শীগগির-শীগগির কিন্তু বাড়ি ফিরবেন হুজুর।

—যাবো আর আসবো, বার-শিমলেয় যেতে কতটুকু আর পথ। হেঁটে গেলেও বেশি সময় লাগবার কথা নয়। সুবিনয়বাবুর চিঠি পেয়ে না-যাওয়াটা উচিত নয়। লিখেছিলেন—চাকরির একটা সন্ধান হয়েছে। এসে একটা চিঠি নিয়ে যেতে হবে। ঠিকেদারের কাছে কাজ। বাড়ি তৈরির ঠিকেদার। সেই কাজ তদারক করা, দেখা। লোকজন খাটানো। হিসেবপত্তোর রাখা। এই সব।

কিন্তু আজো মনে আছে সেদিন সুবিনয়বাবুর মুখে যে উল্লাস দেখতে পেয়েছিল ভূতনাথ, তা আর কখনও দেখে নি। মুমুষু সুবিনয়বাবু। চুপচাপ শুয়ে থাকেন। শহরের প্রান্তে এসে বসবাস করছেন। চাকরবাকর, কর্মচারি সমস্ত ঐশ্বর্য-আড়ম্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও যেন এতটুকু দুঃখ নেই। মাঝে-মাঝে গান করেন। হয় একলা, নয় তো জবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে।

জবা গান গাইতে-গাইতেই হঠাৎ থেমে যায়। বলে—বাবা ভাত চড়িয়ে এসেছি, পুড়ে গেল বোধ হয়, দেখে আসি।

সুবিনয়বাবু বলেন—দুজন লোকের খাওয়া, অত ব্যস্ত হয়ে–না মা।

জবা বলে—বা রে, দুজন লোক বলেই তো ভালো করে রান্না করা দরকার!

সুবিনয়বাবু বলেন—বাবা-মা’র কাছে বলরামপুরে মানুষ হয়েছে কিনা, আর আমার মাও খুব রাঁধতে ভালোবাসতেন, বুঝলে ভূতনাথবাবু! বলরামপুরে যখন ছোটবেলায় ছিলাম, কত রকম রান্না যে খেয়েছি মায়ের, বাবা ছিলেন ভোজনরসিক-জবাকে নিজের হাতে সব শিখিয়েছিলেন আমার মা।

মাঝারি বাড়ি। তবু পরিপাটি করে সমস্ত গুছিয়ে রেখেছে জবা। রাতারাতি এতখানি ঐশ্বর্য থেকে এমন মধ্যবিত্ত পর্যায়ে নেমে আসতে জবারও যেন কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়। কত সহজ করে নিয়েছে নিজেকে। সাবান দিয়ে কাপড় কেচে শুকোতে দেয় উঠোনের দড়িতে। ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে ঘরগুলো।

জবা বলে—অমন হাঁ করে দেখছেন কী, নিন, এগুলো নিঙড়ে মেলে দিন দড়িতে?

বাইরের কাজ করবার জন্যে একজন ঝি আছে শুধু বাড়িতে। বাজারটা করে নিয়ে আসে। ফাইফরমাশ খাটে। তারপর সন্ধ্যে হবার আগেই সে নিজের বাড়ি চলে যায়। একদিন নিজের জলটা যে নিজে গড়িয়ে খেতে পারতো না, তার এই পরিবর্তন দেখে বাক হয়ে যেতে হয়।

সুবিনয়বাবু বলেন—মা, এবার উপাসনার ব্যবস্থা করো, পাচটা বাজতে চললো যে।

উপাসনা ঘরে আস্তে-আস্তে ধরে নিয়ে এসে বসাতে হয় সুবিনয়বাবুকে! এই ঘরটাই বড়। মাঝখানে বেদীর ওপর গালচে পাতা হয়। ধুপ-ধুনো জ্বেলে দেয় জবা। তারপর সুপবিত্র গিয়ে বসে একধারে। মাঝখানে জবা। আর তার পাশে ভূতনাথ।

সুবিনয়বাবুর ইঙ্গিতে জবা গান ধরে–

তার নাম পরশ রতন
পাপী-হৃদয় তাপ হরণ—
প্রসাদ তার শান্তিরূপে ভকত হৃদয়ে জাগে–
তারপর সুবিনয়বাবু প্রার্থনা শুরু করেন–

নমঃ সম্ভবায় চ ময়োভলায় চ। সেই সুখকরকে নমস্কার করি। কল্যাণকরকে নমস্কার করি। কিন্তু কল্যাণকর শুধু সুখকর নন, তিনি যে দুঃখকর। দুঃখের আঘাত থেকে আমাদের মনকে ভয়ে ভয়ে কেবলই বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করলে জগতে আমাদের অসম্পূর্ণভাবে বাস করা হয়। যিনি সুখকর, তাঁকে প্রণাম করো এবং যিনি দুঃখকর তাকেও প্রণাম করো-তাহলেই যিনি শিব, যিনি শিবতর তাঁকেই প্রণাম করা হবে…

শুনতে শুনতে এক-একবার চোখ খুলে দেখে ভূতনাথ। সুপবিত্র চোখ বুজে আছে। আবারও চোখ বোজা। কেমন যেন লজ্জা হয়। ভূতনাথও চোখ দুটো বুজে নির্বিকার হয়ে শোনে তখন।

তারপর উপাসনার শেষে জবা বলে—সুপবিত্র, এবার তুমি বাড়ি যাও।

সুপবিত্রর বোধ হয় যাবার ইচ্ছে হয় না। বলে—এখনও তো রাত হয় নি বেশি—আর একটু থাকি না।

জবা বলে—তা হোক, বেশি রাত করো না, তোমার শরীর ভালো নেই।

সুপবিত্র বলে—আজকাল তো আমি একটু ভালোই আছি।

-কই ভালো আছছ, দিন-দিন চেহারা কী হচ্ছে দেখছে, আয়নাতে চেহারাটা ভালো করে দেখে একবার।

আর বাক্যব্যয় না করে সুপবিত্র চলে যায় অবশেষে।

কিন্তু চলে যাবার পরেই যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায় জবা। মুখ দেখে বোঝা যায় কেমন যেন চিন্তিত। বলে—এত রাত্রে সুপবিত্রকে একলা ছেড়ে দেওয়া উচিত হলো না–যা ভুলো মন।

ভূতনাথ বলে—একবার দেখে আসবো বাড়িতে পৌচেছে কিনা?

জবা যেন এই প্রশ্নই চাইছিলো। বলে—দেখে আসুন না, বেশি তত দূর নয়, চট করে যাবেন আর আসবেন, শুধু জিজ্ঞেস করবেন বাড়িতে পৌচেছে কিনা।

সুবিনয়বাবু হঠাৎ ডাকেন—মা—

জবা তাড়াতাড়ি ছুটে আসে—আমাকে ডাকছিলেন বাবা?

-রাত হয়ে যাচ্ছে, ভূতনাথবাবুকে তুমি এখনও ছাড়লে মা?

জবা হেসে ওঠে—রাত কোথায় বাবা, ভূতনাথবাবু পাড়াগাঁয়ের ছেলে, অন্ধকারে বেড়ানো ওঁর বেশ অভ্যেস আছে।

ভূতনাথ বলে—না, রাত তো বেশি হয়নি।

জবা ডাকে। বলে–আসুন তো আমার সঙ্গে।

ঘরের বাইরে এসে বলে—আপনি তো আসেন আমার সঙ্গে দেখা করতে—তবে বাবার কাছে বসে থাকেন যে দিনরাত? চলে আসুন।

তারপর জবা নিয়ে আসে তার নিজের ঘরে। বলে—শুধু শুধু বসে থাকলে চলবে না—এই কাপড়টা ধরুন তো। জবা নিজের বিয়ের জন্যে জামা তৈরি করছে। কাপড় কিনেছে। জামাগুলো নিজের হাতে তৈরি করছে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করে—আর বাকি রইল কী কী?

জবা বলে—সুপবিত্রর জন্যে বাবা যা যা দেবেন সব তো হয়ে গিয়েছে। তা ওর তো পছন্দ বলে কোনো জিনিষ নেই, আমাকেই সব করতে হয়েছে–কিন্তু আমার জিনিষগুলোই এখনও হয়ে উঠলো না সব।

-কিন্তু আর তো মাত্র মাস দু’এক বাকি!

জবা বললে—আর একটা কাজ বাকি—বাবা সব নাম-ঠিকানা দিয়েছেন—সেইটে দেখে একটা লিস্ট করতে হবে—আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলকে নেমন্তন্ন করে আসা। ওটা আপনাকেই করতে হবে, কিন্তু।

ভূতনাথ বললে—আমাকে তো দিলেই আমি করি।

—সব কাজ কি আপনার মুখের কাছে এগিয়ে দিতে হবে নাকি? সারাদিনই তো আপনার ছুটি, সকালে খেয়ে-দেয়ে চলে আসলেই পারেন?

-আমাকে তো এতদিন বলেনি।

—সব কাজের কথা বলতে হবে আমাকে? নিজেরই তো আপনার বোঝা উচিত। আমি কোন্ কাজটা কখন করি বলুন তো? সারাদিন দেখছেন তো সংসার নিয়ে ব্যস্ত, তারপর বাবারও কত কাজ করতে হয় আমাকে—এগুলোও যদি আপনি না করেন, তাহলে আমার আর কি উপকার হলো?

ভূতনাথ বললে—এতদিন স্পষ্ট করে বলোনি তো-আমার এ-বাড়িতে ঘন-ঘন আসাটা তোমার ভালো লাগবে কিনা তাই-ই তো জানতাম না।

লাগবে, লাগবে, লাগবে, ভালো লাগবে। গলা বাড়িয়ে এ-কথাটা না বললে যেন বোঝেন না আপনি। এদিকে এত সেয়ানা হয়েছেন আর এটা বুঝতে পারেন না?

-এবার থেকে জানা রইল।

—হ্যাঁ, জেনে রাখুন, আর ভুলে যাবেন না যেন কখনও, আপনি এলে কত কাজ করিয়ে নিই দেখেন না, সুপবিত্র তো ওই রকম, বাবাও তো দেখছেন অসুস্থ, অন্য একটা লোক নেই যে, সাহায্য করে। আপনি এলে উপকার হয় এ তো সহজ কথা!!

—আমি তো বলেই রেখেছিলাম, আমাকে দিয়ে তোমার কখনও কোনো উপকার হলে আমি ধন্য হয়ে যাবো।

–কিন্তু সেটা কি আমাকে চিৎকার করে বলতে হবে—ওগো আমার একটা উপকার করে দিয়ে যান আপনি।

–না বললে আমি বুঝবে কী করে?

—না বলতে তো আমার অনেক কথাই বুঝেছিলেন—আর এটা বুঝবেন না?

-তবু মুখ থেকে শুনতে ভালো লাগে তো!

জবা বললে—এই তো সেদিন, সুপবিত্রর তিন দিন দেখা নেই, ভাবছিলাম অসুখ-বিসুখ হলো নাকি—এমন তো কখনও করে না, একবার করে রোজ আসেই উপাসনার সময়টা। আমি একলাই বা কার সঙ্গে যাই—কই, আপনার তো দেখে আসা উচিত ছিল?

ভূতনাথ চুপ করে রইল। তারপর বললে—তা একবার শুধু মুখ ফুটে বললেই পারতে।

—আমি বলবো কেন, আপনার তো বুঝে নেওয়া উচিৎ ছিল।

-কিন্তু সকলের বুদ্ধি কি সমান হয় জবা, নইলে সবাই তো এম-এ. পাশ করে ল’ পাশ করতে পারতো সুপবিত্রবাবুর মতন! আর তোমার মতন স্ত্রী পেতো! বলে হো-হো করে হেসে উঠলো ভূতনাথ।

জবা কিন্তু হাসতে পারলো না। জামা সেলাই করতে করতে হঠাৎ মুখ তুলে বললে—আমি কি সুপবিত্রর তুলনা করেছি?

ভূতনাথ বললে—তুমি করবে কেন, তুলনা করছি আমিই কথাটা হঠাৎ মনে এল কিনা!

জবা বললে—হঠাৎ এমন ধারা কথা মনে আসাও তো ভালো নয় আপনার!

ভূতনাথ বললে—ঠিক বলেছো জবা, কিন্তু মন তত বোঝে না।

জবা আবার সেলাই-এর দিকে মন দিয়ে বললে—মনকে বশ করতে শিখুন—ভালো হবে তাতে।

ভূতনাথ বললে—আমার ভালো হয়ে আর দরকার নেই জবা, আর তা ছাড়া এ-সংসারে সকলেরই যদি ভালো হয় তো খারাপ হবে কার?

-খারাপ বুঝি কারো-না-কারোর হতেই হবে?

ভূতনাথ বললে—নিশ্চয়ই, নইলে ভালোরও তো একটা শেষ আছে। সব ভালোগুলো সবাই কুড়িয়ে-বাড়িয়ে নেবার পর, কারোর ভাগ্যে তো খারাপগুলোই পড়ে থাকবে—আমি সেই দলে।

জবা আবার হাসলো। বললে—ভালো মেয়ে শুধু আমি একলাই নই ভূতনাথবাবু, খুঁজলে আমার মতো অনেক মেয়েই পাবেন।

ভুতনাথ বললে—যখন বুঝতেই পেরেছে কথাটা, তখন বলি— ততো ভাললাতে আমার দরকার নেই।

জবা প্রথমটায় কিছু বললে না। তারপর খানিক থেমে বললে—আপনি সত্যিই একটা বিয়ে করে ফেলুন।

ভূতনাথ বললে—আর যে-জন্যেই আসি, উপদেশ শোনবার জন্যে তোমার কাছে আসি না কিন্তু জবা।

জবা বললে—কিন্তু তা ছাড়া তো আর উপায়ও দেখছি না কোনো!

ভূতনাথ এবার জোরে হেসে উঠলো। বললে—উপায় খুঁজতে যেন তোমায় মাথার দিব্যি দিয়েছি আমি।

জবা কিন্তু হাসলো না। বললে—তবে আজ আপনাকে খুলেই বলি ভূতনাথবাবু, সুপবিত্রকে বাইরে থেকে যা বোঝেন ও তা নয়, সব বোঝে। শুধু কথা বলে কম, কিন্তু অত প্রখর অনুভূতি বুঝি কম মানুষেরই আছে। আপনাকে যা বললাম ওকেও যদি তাই বলতাম—ও বোধহয় আত্মহত্যা করতে কিম্বা হয় তো সন্ন্যাসী হয়ে যেতে—কিম্বা পাগল-ওকে আপনি জানেন না ঠিক…

ভূতনাথ এবার চুপ করে রইল।

কিন্তু সুপবিত্রর কথা বলতে গিয়ে জবাও যেন আত্মহারা হয়ে যায়। হাতের ছুঁচ আপনিই কখন থেমে আসে। মনে হয় যেন নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলে চলেছে জবা। সামনে ভূতনাথ রয়েছে এ-জ্ঞান আর নেই তখন। বলে—একদিন ওর সঙ্গে ভালো করে কথা বলিনি বলে ও তিনরাত ঘুমোয়নি, জানেন—ওর মা’র কাছে শুনেছি, সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরেছে, কেউ জানে না, তিন দিন খায়নি পর্যন্ত—শেষে যখন ডেকে পাঠালুম, তখন দেখি উস্কোখুস্কো চুল, চোখ লাল। বললাম—এতদিন আসোনি কেন? ও কিছু কথা বললে না। বললাম—এমন পাগলামি করলে কি সংসারে বেঁচে থাকা চলে? দুঃখ সইতে হবে, কষ্ট করতে হবে, তবে তো জীবন! জীবন সুন্দর বটে, কিন্তু জীবন তো আবার নিষ্ঠুরও এতে অল্পে মন-খারাপ করলে চলবে কেন? বিশেষ করে পুরুষমানুষ না তুমি?

—তবু ওর মুখ দিয়ে কথা বেরুলো না।

জবা আবার বলে—ও এমনি, ঠিক এমন ধরনের পুরুষমানুষ আজকালকার যুগে অচল, তবু এমন নিষ্ঠাও কারো দেখিনি। এমন করে সত্যিকারের ভালোবাসা, এমন একাগ্রতা কার আছে ভূতনাথবাবু?

ভূতনাথও দেখেছে। অনেকদিন হঠাৎ সুবিনয়বাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখেছে—সুবিনয়বাবু হয় তো নিজের ঘরে শুয়ে-শুয়ে বই পড়ছেন। আর ওদিকে জবা নিজের সেলাই নিয়ে ব্যস্ত, আর সুপবিত্র একমনে জবার মুখের দিকে চেয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। কোনো দিকে খেয়াল নেই। যেন বাইরের জ্ঞান লোপ পেয়েছে। এমনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কথা নেই বার্তা নেই। একজন শুধু চুপচাপ কাজ করে চলেছে আর একজন একমনে তাকে দেখছে।

জবা বলে—এ ওর স্বভাব, ভালোবাসা বোধ হয় এক-এক জনের স্বভাব থাকে, ওরও তাই।

ভূতনাথ বললে—সুপবিত্রকে তো বুঝলুম—কিন্তু তোমার কথা! তুমিও কি…।

জবা হঠাৎ বলে—ওই যাঃ, তরকারি চাপিয়ে এসেছি উনুনে, দেখে আসুন তো কড়ায় জল আছে কিনা, জল যদি শুকিয়ে গিয়ে থাকে তো একটু জল দিয়ে আসবেন।

 

আজ কিন্তু ভূতনাথকে দেখেই জবা বললে-বাবার চিঠি পেয়েছিলেন তো?

ভূতনাথ বললে–হ্যাঁ, তাই তো এলাম।

জবা বললে—ওপরে যান, বাবা আপনার একটা চাকরি না করে দিয়ে আর ছাড়বেন না।

সুবিনয়বাবুর ঘরে যেতেই ভূতনাথ দেখলে তিনি তারই প্রতীক্ষা করছেন। বললেন—এসে গিয়েছো ভূতনাথবাবু, এসো এসো, তোমার কথাই ভাবছিলাম।

সুবিনয়বাবু খানিক থেমে বললেন—আমার চিঠি পেয়েছিলে তো ভূতনাথবাবু? রূপচাঁদবাবু নিজে এসেছিলেন এখানে। বলছিলেন—লোক আমার এখনি চাই—বড় সদাশয় লোক, তোমার কোনো কষ্ট হবে না।

ভূতনাথ বললে—কী বলে যে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো, আমার বড় অভাব চলছিল।

-সে কি ভূতনাথবাবু, তোমাকে কাজ খুঁজে দেওয়া আমার একটা কর্তব্য যে—ব্রজরাখালবাবুকে আমি নিজে কথা দিয়েছিলাম। তা ছাড়া আমার কাছে এতদিন তুমি একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলে! আর এ-কাজও বিশেষ শক্ত নয়, তবে বাইরে বাইরে ঘঘারাঘুরি করতে হবে, বাড়ি তৈরি হচ্ছে, সেই সব তদারক, চুনসুরকির হিসেব রাখা—কখনও এ-সব কাজ করেছো ভূতনাথবাবু?

–না, আপনার কাছেই আমার প্রথম চাকরি।

–করতে পারবে তো? হিসেব রাখতে হবে রাজ-মিস্ত্রীদের কাজের। আর বাড়িও তো একটা নয়, চারিদিকেই বাড়ি তৈরি হচ্ছে।

—আপিসটা কোথায়?

—কাজ তোমায় ভবনীপুরেই করতে হবে, ওই সব অঞ্চলেই বাড়ি তৈরি হচ্ছে কিনা, আগে তো ও সব অঞ্চল বাদা জঙ্গল ছিল, এখন দেখবে কেবল সব উকিল ব্যারিস্টারদের বাড়ি। চেনা যাবে

কিছু, নতুন-নতুন রাস্তা হচ্ছে, শহর বাড়ছে যে, লোকও কত বাড়ছে দেখো না কলকাতার, তা ছাড়া ট্রাম হয়ে যাতায়াতেরও

সুবিধে হয়েছে। তা এ-কাজ পারবে তো তুমি?

—আমি আপনার আশীর্বাদে সব কাজই পারবো।

–তা হলে আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি নিয়ে যাও।

জবা এল।

সুবিনয়বাবু বললেন—দুটো জিনিষ সম্বন্ধে আমার শেষ কর্তব্য ছিল মা, একটা ভূতনাথবাবুর চাকরি, সেটা হলো—আর বাকি রইল তোমার বিয়েটা—তা সেটারও আর দেরি নেই। তারপরে আমার সংসারের ওপর আর কোনো কর্তব্য নেই—তখন আমি ছুটি নেবো মা। এবারের মাঘোৎসবই হয় তো আমার জীবনের শেষ উৎসব।

জবা বললে—বাবা–

রাস্তায় বেরিয়ে ভূতনাথ একবার ভাবলে আজ বৃহস্পতিবার, বারবেলা। আজ হয় তো না যাওয়াই ভালো। কাল সকালে গেলেই চলবে। সেই কোথায় ভবানীপুর। সে তো কাছে নয়!

 

ওদিকে কলকাতা আর এদিকে ভবানীপুর।

নতুন শহর গড়ছে এদিকে। সব বাড়ি নতুন। সব রাস্তা নতুন। শহর যেন আর এক সভ্যতার জন্ম দিয়েছে এখানে। বিংশ শতাব্দীর নবজাতক এ। ওদিকে গঙ্গার ধারে-ধারে লম্বা-লম্বা চিমনিওয়ালা যত কল-কারখানার সঙ্গে এ-শহরের যেন কোথায় যোগ আছে। এইখানে যেন রাত্রে বিশ্রাম করতে আসে ওপারের ধূলি-ধূসর ভাবনাগুলো। আর হাইকোর্টের কূট-বিচার শেষ করে নথিপত্রগুলো এখানে এসে বুঝি জিরিয়ে নেয় একটু। বাড়ির সামনে নেমপ্লেট-এ মালিকদের নাম-ধাম পরিচয়টীকা। কেউ ব্যারিস্টার, কেউ ইঞ্জিনীয়ার, কেউ নতুন ব্যবসায়ী, কেউ দালাল। বড় গঙ্গার জেটিগুলো জাহাজে-জাহাজে ভর-ভরাট। পাট আর ধান, গালা আর তুলো সব এসে জমেছে জাহাজে। খাজাঞ্চীখানার কেরানীদের কলমের আর কামাই নেই বুঝি। মনে হয়-খাজাঞ্চীখানাগুলো বড়বাজারেই থাক আর যেখানেই থাক, তার চাবিগুলো যেন আজকাল আসে এখানে। এই ভবানীপুরে। ভবানীপুরের নতুন পাড়ায়।

কে চিনতে পারবে সেদিনের সেই গোবিন্দপুরকে! কোথাকার কে ভুবনেশ্বর ব্রহ্মচারী। কে তার জামাই ভবানী দাস। সেই ভবানী দাসই বুঝি কালীঘাটের সেবায়েত হালদারদের পূর্বপুরুষ। আজ সেই ভবানী দাস এলেও হয় তো চিনতে পারবে না তার নামের এই জায়গাকে।

ভূতনাথ বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে এক-একটা অসমাপ্ত বাড়ির মাথায় উঠে এক-একবার চেয়ে দেখে। যেদিন প্রথম এখানে এসেছিল তার সঙ্গেও এ-শহরের আজ কোনো মিল নেই। দিনের বেলায় এ-পাড়ায় ইঞ্জিনীয়ারের গজ ফিতে, কন্টাক্টারের হিসেব আর কুলি-মজুরের গাঁইতি আর রাত্রে অর্ধসমাপ্ত ভবানীপুর যেন একটা স্বপ্নের মতন। সাইকেল-এ চড়ে সন্ধ্যেবেলা ফেরবার সময়ে ওদিকে চাইতে চাইতে যায় ভূতনাথ। বৌবাজারের বনেদীয়ানা নেই এখানে, কিন্তু শৃঙ্খলা আছে। মেদ নাই, কিন্তু স্বাস্থ্য আছে। এ-পাড়ার বাড়িগুলোর মতো, বাড়ির অধিবাসীরাও যেন অন্যরকম। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা ফর্সা ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে। পুরুষরা কেউ পরে চাপকান, কোটপ্যান্ট। স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ সব। রাস্তার নতুন টেলিফোন টেলিগ্রাফের পোস্টগুলো পর্যন্ত যেন সভ্যভব্য। বনেদীয়ানা না থাক, কিন্তু সুরুচি তত আছে। বেশ লাগে ভূতনাথের।

রূপচাঁদবাবু লোক ভালো। বলেছিলেন—মাইনের সম্বন্ধে আপনাকে কিছু বলেছেন সুবিনয়বাবু?

ভূতনাথ বলেছিল—আমার কাজ দেখে যা খুশি দেবেন।

খুশিই হয়েছিলেন রূপচাঁদবাবু। ইট-চুন-সুরকির হিসেব রাখা, রাজমিস্ত্রীদের হাজরে রাখা, কাজ তদারক করা—এই সব কাজ। কোথা থেকে কোথায়। ঝাঁ-আঁ করছে দুপুর, তারই মধ্যে হেঁটে হেঁটে শহর পাড়ি দেওয়া। তবু জীবিকার জন্যে সব করতে হয়।

খুশি নিশ্চয়ই হয়েছিলেন রূপৰ্চাদবাবু। নইলে সাইকেল কিনে দিলেন কেন! বললেন—সাইকেলটা শিখে নিন, এতে কাজের সুবিধে হবে।

দু’চাকার গাড়ি। কিন্তু যেন বিশ্বজয় করা যায় দুটো চাকার দৌলতে। সকালবেলা বেরিয়ে পড়ে ভূতনাথ বড়বাড়ি থেকে। তারপর দুপুরবেলা শুধু খেতে যাওয়া। আবার দুটো মুখে দিয়েই চলে আসা ভবানীপুরে। তারপর সন্ধ্যেবেলা গড়াতে গড়াতে কোনোদিন বা যায় জবাদের বাড়ি-বার-শিময়ে। তখন শরীরটা একটু ক্লান্ত হয় বটে, কিন্তু তবু বেশ লাগে। পুরুষ মানুষ, কাজ না করতে পেলে কেমন যেন আরো বেশি ক্লান্ত মনে হয়।

সেদিন এক কাণ্ড ঘটে গেল।

বড়বাড়িতে ঢুকছে এমন সময় ব্রিজ সিং বললে—শালাবাবু, মাস্টারবাবু আ গিয়া!

–মাস্টারবাবু? যেন বিশ্বাস হয়নি ভূতনাথের। বললে— ব্ৰজরাখালবাবু।

সত্যিই ব্রজরাখাল। আস্তাবল-বাড়ির ওপরের ঘরটা খোলা। ভেতরে আলো জ্বলছে তো! তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরের সামনে যেতেই দেখলে—এ আর এক ব্ৰজরাখাল।

ব্ৰজরাখাল তখন আরো অনেকের সঙ্গে কথা বলছে। সেই কদমদা রয়েছে, নিবারণ রয়েছে, শিবনাথ রয়েছে। ভূতনাথকে দেখে শুধু একবার বললে—এসো বড়কুটুম—বলে আবার সামনের ভদ্রলোকদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলো।

ভূতনাথ দেখতে লাগলো–ক’ বছর আগেকার ব্রজরাখালের সঙ্গে আর যেন কোনো মিল নেই। আরো উজ্জ্বল হয়েছে গায়ের রং। সমস্ত মাথার চুল কামানো। একটা বাসন্তী রং-এর মোটা পাঞ্জাবী পরা। মোটা কাপড়।

কদমদাকে বলছে—আমার দ্বারা তোমাদের কী কাজ হবে বলো?

কদমদা’ বললে—দেশের লোকের মনের অবস্থা যা হয়েছে, তা তো আপনাকে বললাম। লর্ড কার্জনের, সেই বক্তৃতা থেকেই শুরু বলা চলে—এখন ওঁরা যা করতে চান, তা তত বুঝেছেন, একটা ‘ফেডারেশন হল তৈরি করবেন, ন্যাশনাল কংগ্রেসও ওই পথেই পা দিয়েছেন, কিন্তু অনুশীলন পার্টির মতে অন্য পথ ধরতে হবে–সশস্ত্র বিপ্লব।

ব্ৰজরাখাল বললে—আমি ওতে রাজি নই কদম। সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গে আমার সব কথা হয়ে গিয়েছে। তোমরা যদি সেই আশাতে ডেকে নিয়ে এসে থাকো, তত ভুল করেছে, রাজনীতিতে আমি থাকবো না—বরং তোমাদের ক্লাব থেকে আমার নামটা কেটেই দিও।

কদম চুপ করে রইল।

ব্ৰজরাখাল বললে—রাজনীতি ছাড়া কি আর কাজ নেই? বোমা আর পিস্তলের মধ্যেই কি মোক্ষ লুকিয়ে আছ কদম? শেষ পর্যন্ত তুমিও কি ওই পথ ধরবে? মনে নেই তোমাদের সেকাহিনী? বাগবাজারে যেবার প্লেগ হলো, সিস্টার নিজে নামলেন রাস্তার দমা পরিষ্কার করতে? বস্তির মধ্যে ছেলেমেয়েরা মরছে। একটা আট বছরের ছেলে মুমূষু অবস্থায় সিস্টারের কাপড় ধরে কেঁদে উঠলো—’মা, মা, মাতাজী গো—’। সিস্টার আর ধরে রাখতে পারলেন না নিজেকে। স্বামী সদানন্দ ছিলেন কাছে, তিনি ছিনিয়ে নিয়ে এলেন সিস্টারকে। কিন্তু সিস্টারের কেবল মনে হতে লাগলো কেন তাকে তিনি বাঁচাতে পারলেন না! তার কি ভালোবাসার কিছু অভাব ছিল? ভালোবাসা দিয়ে কি তবে মৃত্যুকে জয় করা যায় না! সাবিত্রী-সত্যবানের গল্প কি তবে মিথ্যে?

কথা বলতে-বলতে ব্ৰজরাখালের চোখ দুটো জ্বলতে লাগলো। বলতে লাগলো ব্রজরাখাল—একদিন আমারও এমনি হয়েছিল কদম, ফুলদাসীর মৃত্যুর কথা তোমার মনে আছে—আমিও ঠিক এই কথাই ভেবেছিলাম। ভেবে কূল-কিনারা না পেয়ে লোকালয় ছেড়ে আলমোড়ায় চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে এই প্রশ্নই কেবল করেছি অন্তর্যামীকে! কিন্তু আজ আমাকে এর উত্তর দিলেন সিস্টার নিবেদিতা নিজে। সিস্টার নিবেদিতারও এমনিই হয়েছিলো সেদিন, সেই ১৮৯৯ সালে।

নিবারণ বললে—কী বললেন তিনি?

ব্ৰজরাখাল বললে তিনি যা বললেন, তোমাদের তা মনে লাগবে না ভাই, তবু বলি—সেদিন সিস্টার দিক খুঁজে না পেয়ে এই প্রশ্নই করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দকে—কী সে ত্যাগের মন্ত্র? কোন্ ত্যাগ জীবন-ত্যাগের চেয়েও বড়? সুযোগ বুঝে বিবেকানন্দ বুঝিয়ে দিলেন তাঁকে—’ভালোবাসার ঊর্ধ্বে যে কর্ম তাকে চিনতে শেখো, সৃষ্টির আনন্দে নিঝরিত স্রষ্টার যে প্রেম, তাই-ই তাঁর কর্ম’—তখন সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ নিবেদিতা বললেন— আমাকে সেই ব্ৰতেই দীক্ষা দিন আপনি।

ব্রজরাখালের কথার শব্দ যেন গান হয়ে ভাসতে লাগলো বাতাসে। ভূতনাথ চুপ করে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। কান পেতে শুনতে লাগলো সে গানের সুর।

–তারপর সেই দীক্ষা, কী কঠোর সে ব্ৰত। অতি প্রত্যুষে ওঠা, দিনে একবার আহার, আরো কত কী! তারপর এল দীক্ষা নেবার দিন! নিবেদিতাকে অপরিগ্রহ, শৌচ আর ব্রতনিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করতে হবে! আজীবন রক্ষা করতে হবে সে ব্রত। হোমের আগুনে সর্বস্ব তাঁর আহুতি দিতে হবে। হোমের আগুনে ঘি, ফুল-ফল বেলপাতা, দুধ সব আহুতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্র পাঠ হলো—“যিনি সমস্ত বাসনা কামনা ত্যাগ করেছেন, যিনি বীতক্রোধ, অদ্বেষ্টা, সর্বভূতে ব্ৰহ্মদর্শী, দান, শৌচ, সত্য আর অহিংসাই যার জীবন, তিনিই ধন্য, তিনি ঈশ্বরে লগ্নচিত্ত, তাঁর সমস্তই ঈশ্বরে অপিত…”। তারপর নিবেদিতা সাষ্টাঙ্গে গুরুকে প্রণাম করলেন। বিবেকানন্দ তার কপালে ভস্মতিলক পরিয়ে দিলেন। সে তো ভস্ম নয়, সে বুঝি নিবেদিতারই জীবনের দগ্ধাবশেষ। তারপর গান হলো—“হে অগ্নি, হে পাবক, হে অমৃত, হে বনস্পতি, হে প্রাণ, নৈঃশব্দের সাক্ষী হে দৃলোক, হে গুরু, এই দেখো আমার পার্থিব যা কিছু এই অগ্নিতে আহুতি দিলাম, আহুতি দিলাম আমার অহংকে। হে অগ্নি আমায় গ্রাস করো— হরি ও তৎসৎ, হরি ওম্ তৎসৎ…’

কথা শেষ করে ব্রজরাখাল বললে—আজই সিস্টার নিবেদিতার মুখে এই গল্প শুনে আসছি কদম। এই রকম দশ-বারোটা ছেলে হলেই চলবে–তাহলেই একটা নেশন উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে।

তারপর হঠাৎ বললে—আজ তা হলে তোমরা এসে কদম— রাত হচ্ছে।

—কখন আবার তাহলে দেখা হচ্ছে বড়দা’?

ব্ৰজরাখাল বললে—দেখা করার কি আর দরকার আছে আমার সঙ্গে?

কদম বললে—তবু যদি কিছু প্রয়োজন হয়?

—তাহলে বেলুড়ে যেও, এ ক’দিন তো আছিই, তারপর কোথায় থাকবে জানি না।

উঠলো সবাই। সবার চোখ যেন ছল ছল করছে। আস্তে আস্তে সবাই ব্ৰজরাখালের পায়ের ধুলো নিয়ে চলে গেল। সবাই চলে যাবার পর ব্রজরাখাল একবার চাইলে ভূতনাথের দিকে। এতক্ষণ ভূতনাথ অভিভূতের মতন চেয়ে ছিল। কথা বলার সাহস হচ্ছিলো না।

ভূতনাথের পিঠে একটা প্রচণ্ড চাপড় মেরে হেসে উঠলো ব্ৰজরাখাল-তারপর কী খবর তোমার বড়কুটুম?

ভূতনাথ কী উত্তর দেবে ভেবে পেলে না। এতদিন যার জন্যে অপেক্ষা করে আছে ভূতনাথ, আর শেষে এই তার পরিণাম।

ব্ৰজরাখাল জুতো জোড়া পায়ে দিয়ে বললে—কথা বলছে না যে বড়কুটুম—হলো কী?

ভুতনাথ শুধু বলতে পারলো-তুমি চললে নাকি?

—হ্যাঁ বড়কুটুম, চললুম।

–থাকবে কোথায়? খাবে কোথায়?

ব্ৰজরাখাল বললে—এখানে থাকতে তত আসিনি, আর খাবো বেলুড়েই।

—আবার কবে আসবে ব্ৰজরাখাল?

—আর তো আসবে না আমি—বলে সেই সৌম্য হাসি হাসতে লাগলে ব্রজরাখাল।

—তা হলে, বেলুড়ে তোমার দেখা পাওয়া যাবে?

—দেখা করতে যেও না তুমি বড়কুটুম—দেখা হয় তো পাবে না আর।

-কেন?

—এতদিন পরে দীক্ষা নিলুম বড়কুটুম, আগে নিইনি, কিন্তু এখন কেন নিয়েছি তা তত শুনলে।

গেট পর্যন্ত চলতে চলতে আর কোনো কথা বললে না। ব্ৰজরাখাল। ভূতনাথও চলতে লাগলো সঙ্গে-সঙ্গে।

গেট-এর কাছে আসতেই ব্রিজ সিং সেলাম করলে ব্ৰজরাখালকে। স্মিত হাসি দিয়ে ব্রজরাখাল তাকে আপ্যায়ন করলো। তারপর রাস্তায় পড়েই ব্ৰজরাখাল বললে—এবার তুমি ফের বড়কুটুম।

ভূতনাথ তবু একটু যেন দ্বিধা করতে লাগলো।

ব্ৰজরাখাল আস্তে-আস্তে চলতে লাগলো সামনের দিকে। তার যেন কোনো দিকে ভ্রক্ষেপ নেই। পেছন ফিরে একবার তাকালেও না সে।

ভূতনাথের চোখ ফেটে কান্না আসতে লাগলো। ব্ৰজরাখাল এমন নিষ্ঠুর হতে পারলে কেমন করে! কোথা থেকে কোন্ শক্তি সে আহরণ করেছে! কোন্ মন্ত্র সে পেয়েছে। ভালোবাসার কোনো মুল্যই নেই তার কাছে। না কি ভালোবাসার ওপরে, অনেক ওপরে, ভালোবাসাকে ছাপিয়ে যে পরম কর্মচেতনা তাকে চিনতে পেরেছে। সিস্টার নিবেদিতা যা পেয়েছিলেন?

ভূতনাথ দৌড়ে গিয়ে আবার ব্রজরাখালকে ধরলে।

-কী? আবার কী চাও বড়কুটুম?

—আমায় তো কিছু বলে গেলে না?

—কী বলবো তোমাকে? কী শুনতে চাও? থামলো ব্ৰজরাখাল একবার।

—যা তোমার খুশি!

–কী বললে খুশি হবে?

–যা হোক কিছু, আমার পাথেয় হয়ে থাকবে।

—তবে বলি—আশীর্বাদ করি—তোমার কল্যাণ হোক।

ভূতনাথ চুপ করে রইল।

—খুশি তো?

মাথা নাড়লে ভূতনাথ।

তারপর ব্রজরাখাল আবার বনমালী সরকার লেন দিয়ে তেমনি ধীর মন্থর গতিতে চলতে লাগলো। একবার পেছন ফিরে তাকালো না পর্যন্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *