1 of 2

৩৫. তার নাম তোতা মিঞা

খবরটা এনেছিল একটি দশ-এগারো বছরের ছেলে। তার নাম তোতা মিঞা, সে নিজেই বলে, আমার নাম সাব, তোতা মিঞা, আমি ইসকুলে কেলাস ফোরে পড়ি। তার পরনে একটা ঢোলা খাঁকি হাফ প্যান্ট, সেটা তার নিজের নয়, প্রাপ্তবয়স্ক কারুর তা বোঝাই যায়, গায়ের রং পদ্মপাতার মতন, চোখ দুটি টানাটানা, তার মুখে এখনো শৈশবের দুধ-লাবণ্য লেগে আছে। যদিও সে কথা বলে বেশ জোর দিয়ে, দায়িত্বের সঙ্গে, মাঝে মাঝে চঞ্চলভাবে পিছন ফিরে তাকায়, যেন এই কয়েক মাসের অভিজ্ঞতায় সে অনেক বয়স্ক হয়ে উঠেছে।

এমনই দিনকাল যে এইটুকু একটি বালকের কথাও সহজে বিশ্বাস করা যায় না। দিন দিন। নিত্যনতুন সংবাদ আসছে যে দেশের মধ্যে অনেক শিক্ষিত ভদ্রলোকও জালিমদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, নামে শান্তি কমিটি গড়লেও গণ-হত্যায় সম্মতি দিতে তাদের কোনো বিবেকের বাধা নেই। এখন পাকিস্তানী আর্মি মোকাবিলা করছে সীমান্ত মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে। আর দেশের অভ্যন্তরে শান্তি কমিটির নেতৃত্বে আল বদর, জামাতে ইসলামী, আল শামস, মুজাহিদ, রাজাকার, ইপকাফ ইত্যাদি সশস্ত্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, এরা অত্যাচারীদের সহচর।

হরিণা এবং ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে এরকম একটি শান্তি কমিটির মিটিং-এর ইস্তাহার এসে পৌঁছেছে কোনো ক্রমে। শান্তি কমিটির এই মিটিংটি হয়েছিল লাকসামে, মে মাসের গোড়ার দিকে। তাতে বলা হয়েছে যে (১) তথাকথিত মুক্তিবাহিনী এবং তাদের তহবিল সংগ্রহ, সদস্যভুক্তি ইত্যাদি গোপন কার্যক্রমের বিস্তৃত বিবরণ, তথ্যাদি যথাশীঘ্র কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটিকে জানানো হোক। যারা মুক্তি বাহিনীর জন্য চাঁদা আদায় করছে এবং যারা চাঁদা প্রদান করছে, তাদের একটি তালিকা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কাছে পেশ করা হোক। (২) লাইসেন্স ছাড়া সমস্ত বন্দুক, রাইফেল ও অন্যান্য সাজসরঞ্জামের খোঁজ জানানো হোক। (৩) ইউনিয়ন শান্তি কমিটিকে পুনরায় অনুরোধ জানানো হল যে, মালি, মেথর, পেশাদার ধোপী, জেলে এবং নাপিত ছাড়া সকল হিন্দুকে উৎখাত করা হোক। (৪) পাকিস্তানে আশঙ্কামুক্ত হয়ে সকল বৌদ্ধ যাতে বাস করতে পারে সেজন্য তাদের সব রকম সুযোগসুবিধা দেওয়া হোক। (৫) অধুনালুপ্ত ও বে-আইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের যে সব সদস্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেছে, তাদের এই মর্মে সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা দিতে বলা হোক যে, (ক) অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের বিভক্তির জন্য এবং কার্যত ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্য কাজ করে এবং (খ) উক্ত রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে শ্রেণীভিত্তিক ঘৃণা ছড়ায়। তাদের মধ্যে জাতিসত্তাগত বা প্রদেশগত সংঘর্ষে উৎসাহিত করে এবং তারাই পাকিস্তানের সর্বাত্মক ক্ষতি করার জন্য দায়ী! (৬) সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন সমূহের সামরিক লোকদের ও প্রাক্তন সামরিক ব্যক্তিদের তালিকা পেশ করা হোক। (৭) সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিসারবৃন্দ ও কারখানার শ্রমিকদের কাজে যোগদানের জন্য উৎসাহিত করা হোক। ইত্যাদি।

ইস্তাহারটি পড়ার পর মুক্তি বাহিনীর কেউ কেউ যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি শুরু করলেও অনেকেরই মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে যায়। অনেকেরই বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন রয়ে গেছে দেশের মধ্যে, তাঁদের ওপর কী ধরনের অত্যাচার হচ্ছে কে জানে! এমনও শোনা যাচ্ছে যে প্রতিদিন নাকি ছয় থেকে বারো হাজার মানুষ খুন হচ্ছে বাংলাদেশে। এরচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড আর কী কোথাও ঘটেছে পৃথিবীতে? শান্তি কমিটির নাম নিয়ে এমন হিংসা ও অত্যাচারের ঘটনা আর কি কখনো দেখা গেছে ইতিহাসে? এদের তালিকায় যাদের নাম ওঠে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না!

কয়েকজন সেই ইস্তাহার দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে, কয়েকজন দাঁতে দাঁত চেপে বলেছে, একবার স্বাধীনতা আসুক, তারপর ঐ খুনি দালালদের প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া হবে রমনার ময়দানে।

বালক তোতা মিঞার কাহিনী সেইজন্যই প্রথমে বিশ্বাস করা যায়নি। সে যদি গুপ্তচর হয়? তাকে হয়তো সেনাবাহিনী থেকে পাঠানো হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ফাঁদে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যারা এই বয়েসী বালকদের বেয়নেটের খোঁচায় ছিন্নভিন্ন করতে পারে, তারা এই রকম একটি বালককে দিয়ে যে-কোনো জঘন্য কাজ করাতেও দ্বিধা করবে না।

তোতা মিঞা সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে এসে সোজা ঢুকে পড়েছিল সেক্টর কমান্ডারের তাঁবুতে। আর কোথাও গেল না, সে সেক্টর কমান্ডারের কাছেই প্রথমে এলো কী করে, কে তাকে ঐ তাঁবু চেনালো? সে এসেছে ছুটতে ছুটতে। সেক্টর কমান্ডারের পায়ের কাছে বসে পড়ে সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, সাব, সাব, দুইশো জন ধরা পড়ছে! আপনেরা অগো বাঁচান! অগো মাইরা ফেলাবে!

তার বক্তব্য এই যে, ফারিয়াবাজারে বাত্যাগী বাঙালীদের একটা বড় দলকে আটক করে বেখেছে পাকিস্তানী সৈন্যরা। ওদের গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেইজন্য আশ্রয়ের আশায় ওরা রওনা হয়েছিল ভারত সীমান্তের দিকে।

পাকিস্তান সরকার এখন সারা বিশ্বে প্রচার করতে চাইছে যে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা পুরোপুরি শান্ত, ভারতের শত উস্কানিতেও এখন দেশ ছেড়ে আর কেউ ভারতে যেতে চাইছে না, বরং ভারতের শরণার্থীরাই ফিরে আসছে দলে দলে। এই প্রচারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য তারা যথাসম্ভব বড়ার সীল করে দিচ্ছে, উদ্বাস্তুদের স্রোত দেখলেই বন্দী করছে কিংবা গুলি করে শেষ করে দিচ্ছে। সুতরাং কারিয়াবাজারে দুশো জনের একটি দলের ধরা পড়ার ঘটনা খুবই বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু অবিশ্বাস্য লাগে ছেলেটির নিখুঁত বর্ণনা দেবার ভঙ্গিটি সে একটা কাঠি নিয়ে নরম মাটিতে একে দেখিয়ে দেয়, এইটা হাই স্কুল, এই বাড়িতে রয়েছে ৫৪ জন পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্য, তাদের দলপতি একজন মেজর। আর স্কুলবাড়ির পাশে চারখানা দোকানঘর আর একটা ফাঁকা বাড়িতে রাখা হয়েছে বন্দীদের। মধ্যের এই দুটি ঘরে আছে নারী ও শিশুরা। দু’দিন ধরে তাদের কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। সৈন্যরা সবাইকে একসঙ্গে মারছে না। কাল বিকেলে বারোজন বন্দীকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল খানিকটা দূরের একটা আমগাছ তলায়। তারপর সৈন্যরা রাইফেল নিয়ে টারগেট প্র্যাকটিস করেছে। কাল মাঝরাতে স্কুলবাড়ির ছাদ থেকে একটি তরুণী সারা গায়ে আগুন লাগা অবস্থায় লাফিয়ে পড়েছে নিচে।

সেক্টর কমান্ডার বারবার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করেন, তোরে কে পাঠাইছে এখানে? তুই বর্ডার ক্রশ করলি ক্যামনে?

তোতা মিঞা সরল চোখে প্রত্যেকবার একই উত্তর দেয় যে, তাকে কেউ পাঠায়নি। সে নিজেই এসেছে। বর্ডারে তাকে কেউ আটকায় নি। তবে তার বাবা সেনাবাহিনীর অধীনে বাবুর্চির কাজ করে। সেই জন্য সে সব কিছু নিজের চোখে দেখেছে। সে জানে যে লম্বা-চওড়া খান সেনারা মুক্তির নামে ভয় পায়। মাত্র চুয়ান্ন জন খান সেনার সঙ্গে এতবড় মুক্তিবাহিনী লড়াই করে জিততে পারবে না? তারা গিয়ে না বাঁচালে ঐ বাঙালীদের একজনেরও প্রাণে বাঁচার আশা নেই।

সেক্টর কমান্ডার এবং তাঁর চার পাঁচজন সহকারী অনেক জেরা করেও তোতা মিঞার কাছ থেকে আর অন্য কোনো কথা বার করতে পারলেন না। ছেলেটির কথা সত্যি হলে ঐ বন্দীদের উদ্ধার করার জন্য একটা অ্যাকশানে যাওয়া উচিত। আর যদি ফাঁদ হয়?

সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের আক্রমণাত্মক উদ্যমে কিছুটা ভাটা পড়েছে। পঁচিশে মার্চের পর যে স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তাতে অনেক জায়গায় পাকিস্তানী বাহিনী আকস্মিক আঘাতে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। এখন তারা শক্তি সংহত করেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দুটি নতুন ডিভিশন এনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সীমান্তের সর্বত্র। এ দিকে মুক্তিবাহিনীর হাতে যথেষ্ট অস্ত্র নেই, প্রয়োজনীয় সরবরাহ নেই, খাদ্য নেই, এই অবস্থায় শুধু মনোবল নিয়ে তারা কতটা লড়তে পারে? মুক্তিবাহিনীর প্রাণহানির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছিল। সেই জন্য কিছুদিন অ্যাকশন স্থগিত রাখা হয়েছে। চিন্তা করতে হচ্ছে নতুন স্ট্র্যাটেজি।

আজও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে পৃথিবীর কোনো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। ভারতের কাছ থেকে যতখানি সাহায্য পাওয়া যাবে আশা করা গিয়েছিল, তা প্রায় কিছুই পাওয়া যায়নি। ভারত শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে বটে, মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্তের এপার থেকে তৎপরতা চালাতে বাধা দেয়নি। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানীদের মুখোমুখি হতে আগ্রহী নয়। ভারত সরকার সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে চায় না। পাকিস্তান সরকার প্রথম থেকেই ভারতকে মুসলমানের শত্রু বলে চিহ্নিত করে এসেছে। ভারত যুদ্ধে নেমে পড়লে কি বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের সমর্থন পাবে? শুধু সেনাবাহিনীকে পরাজিত করলেই তো যুদ্ধে জেতা যায় না! তা ছাড়া, ভারত যুদ্ধে ব্যাপৃত হলে সারা বিশ্বে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী প্রচারই সত্য বলে গণ্য হবে। সকলেই বলবে, ভারত নিজের স্বার্থে পাকিস্তান ভাঙতে চাইছে।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে জেতার ক্ষমতাও কি আছে ভারতের? চীন যে-কোনো সময় আবার আক্রমণ করতে পারে বলে ভারতীয় বাহিনীর একটি বিশাল অংশ চীন সীমান্তে মোতায়েন করা আছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সীমান্তেও সতর্ক পাহারা দিতে হচ্ছে। পূর্ব ভারতে মিজো-নাগা বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে অনবরত, পশ্চিমবাংলাতেও নকশালপন্থীদের দমন করার জন্য সৈন্যবাহিনী নামাতে হয়েছে। ভারত এখন নিজের ঘর সামলাবে, না বাংলাদেশকে মুক্ত করতে আসবে?

কয়েক দিন আগে মুক্তিযুদ্ধের উচ্চ পর্যায়ের সেনানীদের একটা গোপন কনফারেন্স হয়ে গেছে কলকাতার থিয়েটার রোডে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এবং প্রধান সেনাপতি এম ওসমানী। সেখানে নানান আলোচনা ও তর্কবিতর্কের মধ্যে ঠিক হয়েছে যে এলোমেলো ভাবে যুদ্ধ করে আর কোনো লাভ হবে না। দুর্ধর্ষ ও সুশৃঙ্খল পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে লড়তে গেলে বাংলাদেশ বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরও পুরোপুরি নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে, সম্মুখ সমর এড়িয়ে জোর দিতে হবে গেরিলা যুদ্ধে, তার জন্য চাই উপযুক্ত ট্রেনিং। সমগ্র বাংলাদেশকে ভাগ করা হল এগারোটি সেক্টরে, সেইসব সেক্টর কমান্ডারের অধীনে কতগুলি সাব সেক্টর ও ট্রপস থাকবে ও নিধারিত হল।

এইসব সত্ত্বেও অনেকেই হতাশার মনোভাব চাপা দিতে পারেননি। বাংলাদেশ কি তা হলে আর একটি ভিয়েৎনাম হতে যাচ্ছে? কতদিন চলবে এই গেরিলা যুদ্ধ, পনেরো বছর? কুড়ি বছর? সাধারণ মানুষের মনোবল কতদিন অটুট থাকবে?

শুধু হতাশা নয়, তার থেকে বেরিয়ে আসে তিক্ততা। কেউ কেউ আড়ালে প্রশ্ন তুললো, শেখ মুজিব সাতই মার্চের মিটিং-এ স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে বসলেন, কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রামের যে দীর্ঘ প্রস্তুতি লাগে, তা তিনি জানতেন না? যুব সমাজের মধ্যে সামরিক ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের ব্যবস্থা করেননি কেন? একবার তিনি বলে ফেললেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, তবু তিনি সংগ্রামের বদলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতা পাওয়ার আশায় পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় অবস্থায় কাটালেন, সেই সুযোগে ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ব্যাটেলিয়ানের পর ব্যাটেলিয়ান সৈন্য আনিয়ে নিলেন এদিকে। সংগ্রাম। পরিচালনার জন্য শেখ মুজিবের কি আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়া উচিত ছিল না আগেই? তিনি প্রথমেই ধরা দিয়ে বসলেন? আওয়ামী লীগের নেতারাও সকলেই চলে গেলেন কলকাতার নিরাপদ আশ্রয়ে! আর বাংলাদেশের জ্বলন্ত যৌবন, স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ছাত্রসমাজ, সমাজতন্ত্রে। দীক্ষিত রাজনৈতিক কর্মী, ই পি আর, পুলিশ আর সামরিক বাহিনীর লোকেরা, যারা প্রথম থেকেই পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, তারাই শুধু রণাঙ্গনে জলকাদার মধ্যে প্রাণ দেবে?

কলকাতার কনফারেন্স সেরে নিজের এলাকায় ফিরে এসেছে এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম। এখন কিছুদিন সীমান্ত পেরিয়ে অ্যাকশন, অ্যামবুশ বন্ধ রেখে তিনি তার বাহিনীটি গুছিয়ে নিতে চান। এরই মধ্যে এসে পড়লো তো মিনা নামের এই বিস্ময়কর বালক এবং তার রোমহর্ষক কাহিনী। একবেলার মধ্যেই তোতা মিঞার কথা ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত ক্যাম্পে।

সিরাজুল প্রথম থেকেই তোতা মিঞাকে বিশ্বাস করেছে। সে নিজেতোকে নাস্তা খাইয়ে অনেক গল্প করেছে তার সঙ্গে। তারপর সে তোতার হাত ধরে ছুটিয়ে নিয়ে গেছে মেজর সাহেবের কাছে। সে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছে তার বক্তব্য। সে বলতে চায় যে, সবাই তোতাকে সন্দেহ করছে, কিন্তু এর উল্টো দিকটা তারা ভেবে দেখছে না কেন? শেখ মুজিবের আহ্বানে এই দেশটা আজ কতখানি বদলে গেছে যে একটি এগারো বছরের বালকও দেশপ্রেমিক হয়ে উঠেছে, সে বিপদের পরোয়া না করে ছুটে এসেছে সীমান্ত পেরিয়ে। রাজাকার, আল বদরদের বিরুদ্ধে এই বালকই তো এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ। যে-দেশ এরকম ছেলের জন্ম দিতে পারে, সে-দেশ কিছুতেই পরাধীন থাকতে পারে না। দুশো জন বন্দীকে বাঁচাবার জন্য এই বালকের প্রাণ কেঁদেছে, আর আমরা কি এতই কাপুরুষ যে তাদের উদ্ধার করার জন্য ছুটে যাবো না!

সিরাজুলের মতামতের একটা বিশেষ মূল্য আছে। পর পর কয়েকটি অ্যাকশানে সে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছে। মাত্র দু সপ্তাহ আগেই সে রামগড় করেরহাট রোডের চিকনছড়ায় একটা সাংঘাতিক কাণ্ড করেছিল। ঘন বনঘেরা পাহাড়ী পথ, সেখান দিয়ে পাক আর্মি শক্তি সমাবেশ করছিল রামগড়ের দিকে। উদ্দেশ্য ছিল তাদের সাপ্লাই লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। কিন্তু পাক আর্মির তীব্র সার্চ লাইট ও গোলাবর্ষণের জন্য কিছুতেই কাছে এগোনো যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে সিরাজুল কী করে যেন সেই সড়কের ওপর ঝুঁকে পড়া একটা গাছের ওপর গিয়ে বসেছিল সারাদিন। সন্ধের মুখে সে একটা মাইক্রোবাসের ওপর লাফিয়ে পড়ে, তাতে ছিল একজন কাপ্টেন ও বেশ কয়েকজন অফিসার, সিরাজুল এল এম জি চালিয়ে সবাইকে খতম করে দেয়। মাইক্রোবাসটা রাস্তা জুড়ে পড়ে থাকে, দিনের পর দিন ঐ পাকিস্তানী সৈন্যদের মৃতদেহ সরাতেও কেউ আসেনি!

সিরাজুল দাবি ধরে বসলো, সে কারিয়াবাজারে বন্দীদের মুক্ত করার জন্য একটা অভিযান পরিচালনা করতে চায়। মেজর রফিকুল ইসলাম শেষ পর্যন্ত এই অভিযানে একটি দল পাঠাতে রাজি হলেন, কিন্তু সিরাজুলকে তিনি যেতে দিতে চান না। সিরাজুল দক্ষ সাঁতারু বলে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং-এর জন্য নির্বাচিত হয়েছে, তার এখন কোনো অ্যাকশানে না যাওয়াই উচিত, যদি সে কোনো কারণে আহত হয়ে পড়ে! সিরাজুল সে কথা শুনতেই চাইলো না। সে বললো যে, সে যদি এরকম একটা অ্যাকশানে আহত হয়ে পড়ে, তা হলে বুঝতে হবে, সে বড় কোনো ট্রেনিং-এর যোগ্যই না!

আজকের অভিযানের দলটিও নির্বাচন করতে চায় সিরাজুল। পয়তাল্লিশ জন ট্রেইনড় গেরিলার সঙ্গে সিরাজুল বেছে নিল বাবুল চৌধুরীকেও।

সন্ধে থেকেই প্রবল বর্ষণে তাদের পুকুর কাটা সার্থক হয়েছে বটে, কিন্তু এই দুর্যোগের মধ্যে যুদ্ধ পরিচালনা করা সহজ কথা নয়। প্রায় কারুরই পায়ে জুতো নেই, অতিকষ্টে কিছু রবারের চটি সংগ্রহ করা গেছে। কাঁধে দু ইঞ্চি মটরি, রকেট লঞ্চার, এল এম জি কিংবা রাইফেল আর পায়ে রবারের চটি! বেশ কয়েকজনের গায়ে জামাও নেই, যদিও এখানে বৃষ্টি পড়লে বেশ শীত শীত করে।

এই বৃষ্টির মধ্যে চতুর্দিক এক্কেবারে মিশমিশে অন্ধকার। আকাশের দিকে তাকালে মনেই হয় যে কোনোদিন সেখানে চাঁদ-নক্ষত্রের আলো থাকে। দিক হারাবার ভয় পদে পদে। একটি এগারো বছরের বালকের কথার ওপর ভরসা করে তারা এগোচ্ছে।

তোতা মিঞাকে সিরাজুল রেখেছে নিজের পাশে। এক সময় তার কাঁধ চাপড়ে সিরাজুল বললো, দ্যাখ ছ্যামড়া, তুই যদি রাস্তা ভুল করোছ, তাইলে আমরা তো মরুমই, তুইও পুটুস কইরা মইরা যাবি!

তোতা মিঞা বালিকার মতো সুরেলা গলায় বললো, না সাব, আমি ভুল করুম না। একেবারে নাক বরাবর রাস্তা।

তারপর সে বেশী উৎসাহিত হয়ে বললো, সাব, বৃষ্টি হইছে তো আরও ভালো হইছে। এই রাত্তিরে খান স্যানারা নাকে ত্যাল দিয়া ঘুমাবে ‘ইনসানাল্লা,আইজ সব কয়টা খতম হবে!

সিরাজুলের মনটা একটু খচখচ করে। সে নিজের দায়িত্বে এতগুলি মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে এনেছে! তোতা যদি সত্যিই স্পাই হয়? সে নিজেই বলেছে যে তার বাবা আর্মি ক্যান্টিনের বাবুর্চি, তার বাবার প্রাণের ভয় দেখিয়ে ছেলেকে গুপ্তচর হতে বাধ্য করা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এইটুকু ছেলে কি এত নিখুঁত অভিনয় করতে পারে? যদি ফাঁদও হয়, তবু যেতে হবে, মুক্তিবাহিনী এমনি এমনি প্রাণ দেবে না, যেকজন পাকিস্তানী সেনাকে সম্ভব মেরে তারপর মরবে।

দু’শো জন বাঙালীকে ওরা বন্দী করে রেখেছে। যদি তাদের মধ্যে মনিরা থাকে? খানসেনাদের হাত থেকে কোনোক্রমে ছাড়া পেলে মনিরা কি সীমান্তের দিকে পালিয়ে আসবার চেষ্টা করবে না? এই সম্ভাবনাই সিরাজুলকে আরও উদ্দীপ্ত করে তোলে।

সামনেই একটা সরু খাল। গতকালও এই খালটা প্রায় শুকনোই দেখে গেছে সিরাজুল, কিন্তু আজকের বৃষ্টিতে কতখানি পানি জমেছে তার ঠিক নেই। খালের ও ধারেই পাক সেনারা ওঁত পেতে আছে কি না তাই বা কে জানে!

সিরাজুল মাটির দিকে টর্চ জ্বাললো। তার পিছনের বাহিনীকে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়ে সে অপেক্ষা করলো খানিকক্ষণ। খালের ওপারে কোনো সাড়া শব্দ নেই। বৃষ্টির জন্য টর্চের আলোও ওপার পর্যন্ত পৌঁছয় না।

মিনিট পাঁচেক পর সে টর্চের আলো বাবুল চৌধুরীর মুখের ওপর ফেলে বললো, তুমি আগে। নামো, তুমি আগে খাল পার হয়ে দেখে আসো!

বাবুল চৌধুরীর হাতে একটা রাইফেল। ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে এসে সে মাত্র দু’দিন রাইফেল ছোঁড়া প্র্যাকটিস করেছে, তার আগে জীবনে কখনো অস্ত্র ধরেনি। শহুরে মানুষ সে, জলকাদায় চলাচল করতে অভ্যস্ত নয় একেবারেই। সে তবু একটুও দ্বিধা করলো না, খালে নেমে পড়লো।

সিরাজুল চাপা গলায় আদেশ দিল। শব্দ করবা না!

বাবুল চৌধুরীর পরনে একটা প্যান্ট ও হাওয়াই শার্ট, দুটোই কাদালেপা, তার খালি পা, সে বকের মতন এক পা তুলে তুলে এগোতে লাগলো। টর্চ নিবিয়ে দিল সিরাজুল।

খালের জল বাবুলের হাঁটু ছাড়ালো না। তবে তলায় এমনই কাদা যে পা গেঁথে যায়, অন্য পা ফেলার সময় ব্যালান্স রাখা শক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সে একবারও আছাড় খেল না। খালের অন্য পাড়ে এসে সে মিনিট খানেক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সামনে কিছু দেখা যায় না, পেছনে সিরাজুলের দলটাও যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে, এই রণক্ষেত্রে বাবুল একা। দূর থেকে একটা গুলি এসে তাকে বিদ্ধ করলে সে চিরকালের মতন হারিয়ে যাবে।

বাবুল আবার খাল পেরিয়ে ফিরে এসে বললো, পানি বেশী নাই, ওপারেও এনিমি ট্রেঞ্চ নাই। ক্লিয়ার!

তোতাকে নিয়ে এবার প্রথম খালে নামলো সিরাজুল। তোতার কাঁধটা সে প্রায় খিমচে ধরে আছে। ছেলেটাকে সে অবিশ্বাস করতে পারে না, তবু দেখতে হবে যেন ছেলেটা এই পর্যন্ত এসে কোনোক্রমে পালিয়ে না যায়।

খালপাড়ের উঁচু বাঁধের আড়াল দিয়ে সবাই কোমর পর্যন্ত মাথা ঝুঁকিয়ে এগোতে লাগলো এক পা এক পা করে। সিরাজুল সবার আগে, অন্যরা খানিকটা দূরত্বে। যদি কোনো ফাঁদ থাকে, সিরাজুল নিজে তাতে ধরা পড়লেও অন্যদের জানিয়ে দেবে।

একসময় দু’ একটি বাড়িঘরের চিহ্ন দেখে বুঝতে পারা গেল, তারা কারিয়াবাজার গ্রামের সীমান্তে এসে পৌঁছেছে। পাকবাহিনী যে-গ্রামে বা শহরে আশ্রয় নেয়, সেখানকার প্রান্তবর্তী বাড়িগুলো পুড়িয়ে দিয়ে সামনেটা খোলা রাখে। এখানেও সে কাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি।

সিরাজুল তোতাকে জিজ্ঞেস করলো, এবার ইস্কুলবাড়ি কোন দিকে?

তোতা বললো, আমাগো ইস্কুলে আমি চক্ষু বুইজ্যাই যাইতে পারি, সাব। আর বেশি দূর নাই।

সিরাজুল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চার পাশটা একবার দেখে নিল। বৃষ্টি অনেক কমে এসেছে। অন্ধকার চোখে সইয়ে নিয়ে এখন দূরের কিছু কিছু গাছপালা ও বাড়ি দেখা যায়। কোথাও কোনো আলো জ্বলছে না। হয়তো এ গ্রামে অন্য কোনো মানুষজন নেই। কিংবা হানাদার বাহিনী যেখানে এসে থানা গেড়েছে, সেখানকার কোনো গৃহস্থই এত রাতে আলো জ্বালার সাহস পাবে না। কিন্তু পাক সেনারা যেখানে রয়েছে, সেখানে নিশ্চিত আলো জ্বলবে, বাইরে সেন্ট্রি থাকবে। কোথায় সেই আলো।

তোতার মাথার চুল মুঠো করে ধরে সিরাজুল মনে মনে বললো, ওরে বিচ্ছু, যদি তুই বিশ্বাসঘাতক হস, তোরে আগে আমি নিজে কচুকাটা করবো!

অন্ধকে যেমন ভাবে পথ দেখায়, সেইভাবে সিরাজুলের হাত ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো তোতা মিঞা। এই দিকটায় বেশ কিছু ছাড়া ছাড়া বড় গাছ, মনে হয় যেন একটা ফলের বাগান, তার কিনারায় এসে তোতা বললো, ঐ দ্যাখেন সাব, ইস্কুল!

‘শ পাঁচেক গজ দূরে ইস্কুলবাড়িটার গেটের সামনে দাউ দাউ করে জ্বলছে দুটো মশাল। পরপর সার দেওয়া পাঁচখানা ট্রাক ও একটি বাস। কোনো সেন্ট্রিকে দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে, কিন্তু বাড়িটার ভেতর থেকে মানুষের গলার মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে। তার মধ্য থেকে কি ফুটে উঠছে কোনো স্ত্রীলোকের তীক্ষ্ণ কান্নার আওয়াজ? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দূর থেকে কান্নার শব্দ ও হাসির শব্দ অনেক সময় একই রকম শোনায়।

এই জায়গাটা বেশ সুবিধেজনক, বড় বড় গাছগুলোর আড়াল পাওয়া যাবে। এই এগারো। বছরের বালকটি কি যুদ্ধনীতি বোঝে যে ঠিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাদের এই বাগানের মধ্য দিয়ে। নিয়ে এসেছে? এ পর্যন্ত কোনো ফাঁদের আভাস পাওয়া যায়নি। আর দ্বিধা করার কোনো মানে হয় না; ঐ গাড়িগুলো দেখেই বোঝা গেছে যে ঐ বাড়িতে পাক সেনারা রয়েছে। এরপর হয়। মারো নয় মরো! যে কটি শত্রসৈন্যকে খতম করা যাবে, সেই কয়েক পা এগিয়ে যাওয়া হবে স্বাধীনতার দিকে।

বন্দীরা কোথায়? এখান থেকে গোলাগুলি চালালে তাদেরও গায়ে লাগবে না তো? তোতা। আঙুল তুলে যে দোকানঘরগুলি দেখিয়ে দিল, সেগুলি ইস্কুলবাড়ির বেশ কাছাকাছি। একটু দূরে একটা একতলা বাড়ি।

সিরাজুল তার বাহিনীকে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিল ডানদিকে। আর দেরি করা যাবে না। তোত যদি বিশ্বাসঘাতক হয়, তা হলে যে-কোনো মুহূর্তে পেছন দিক থেকে এসে পড়বে পাকবাহিনী। সিরাজুল সবাইকে বলে দিল একসঙ্গে আক্রমণ চালাতে হবে শুধু স্কুলবাড়িটার ওপর, ওখানে পাক সেনাদের আটকে রাখতে পারলে বন্দীরা পালাবার সুযোগ পাবে। গাড়িগুলি দেখেই সিরাজুল শত্রুপক্ষের শক্তি অনেকটা আন্দাজ করে নিয়েছে, এখানে সিরাজুলরা বেশীক্ষণ। যুদ্ধ চালাতে পারবে না, পাকিস্তানী সৈন্যরা একবার স্কুলবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারলে তাদের আর জয়ের আশা নেই।

সিরাজুল নিজেই প্রথম মটরি চার্জ করলো। সঙ্গে সঙ্গে গর্জন করে উঠলো এল এম জি ও রাইফেল। একটা রকেট সোজা গিয়ে পড়লো স্কুলবাড়ির ছাদে। মর্টারের গোলায় আগুন ধরে গেল একটা ট্রাকে।

পাকিস্তানীরা সত্যিই অসতর্ক ছিল, প্রথম দু তিন মিনিট তাদের দিক থেকে কোনো প্রতিআক্রমণ এলো না। শুধু চিৎকার-চাচামেচি, আগুনের শিখায় পরিষ্কার দেখা গেল কয়েকজন খানসেনা খালি গায়ে শুধু জাঙ্গিয়া পড়ে দৌড়োচ্ছে।

মুক্তিবাহিনীর সবাই গোলাগুলি চালাতে চালাতে তারস্বরে বলতে লাগলো, বন্দীরা পালাও! বন্দীরা পালাও!

সবকটা দোকানঘর ও পাশের একতলা বাড়িটা থেকে ভেসে এলো আর্তকান্নার রব। প্রত্যেকটি দরজা বাইরে থেকে তালাবন্ধ, তারা দরজা ভেঙে বেরুতে পারছে না।

এর মধ্যেই পাক সেনারা শুরু করলো পাল্টা গোলাবর্ষণ। তারা বুঝতে পেরেছে যে মুক্তিযোদ্ধারা বন্দীদের মুক্ত করার জন্যই এসেছে, সেই জন্য তারা দোকানঘরগুলোর দিকেও ফায়ারিং করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ যে দৌড়ে গিয়ে দরজাগুলো খুলে দেবে তারও উপায় নেই, সামনের ফাঁকা জায়গাটা পেরুতে গেলেই ব্রাশ ফায়ারের মধ্যে পড়তে হবে।

স্কুলবাড়িটার জানলা ভেঙে লাফিয়ে বেরিয়ে আসছে পাক সৈনিকরা। সিরাজুল তার এল এম জির লক্ষ্য স্থির রেখে শেষ করে দিচ্ছে এক একজনকে। স্কুল বাড়িটার পেছন দিক থেকেও এগিয়ে আসছে একটা টুপ, মটার দিয়ে ঠেকানো হচ্ছে তাদের। আর সময় নেই, আর সময় নেই, আর ঠেকানো যাবে না, এরপর আর পালাবার সুযোগও পাওয়া যাবে না! এখনই সিরাজুলের রিট্রিট অর্ডার দেওয়া উচিত।

চাইনীজ মেশিনগান থেকে ঝড়ের মতন গুলি বর্ষণ হচ্ছে মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটাতে, পাকিস্তানী সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীকে কিছুতেই আমবাগান ছেড়ে বেরুতে দেবে না। তা হলে কি বন্দীদের মুক্ত করা যাবে না? পাক বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ের ক্ষমতা নেই সিরাজুলদের, তাতে তাদের অনর্থক শক্তি ক্ষয় হবে। কিন্তু মনিরা, বন্দীদের মধ্যে যদি মনিরা থাকে?

হঠাৎ একজন লম্বা চেহারার লোক ছুটে গেল বন্দীদের ঘরগুলির দিকে। সিরাজুল দেখলো, সেই লোকটি বাবুল চৌধুরী। লাইট মেশিনগানের গুলিবৃষ্টির মধ্যে সে ছুটে যাচ্ছে একেবেঁকে। ও কি পৌঁছোতে পারবে? সেদিকে মনোযোগ দেবার উপায় নেই, সিরাজুল তার মটরি চার্জ করলো পাক সেনাদের দিকে।

পরের মুহূর্তেই তার পাশ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল তোতা মিঞা। বাবুল চৌধুরী দোকানঘরগুলোর কাছে পৌঁছে গেছে, তীরের মতন ছুটে গিয়ে তোতা তাকে দেখিয়ে দিচ্ছে মেয়েদের ঘর দুটো। বাবুল রাইফেলের বাঁট দিয়ে মেরে মেরে তালা ভাঙার চেষ্টা করছে। আঃ, ও এত বোকামি করছে কেন, তালার ওপর গুলি চালাতে পারছে না?

বন্দীরা বেরিয়ে আসছে হুড়মুড় করে। এবার ওরা গুলি খেয়ে পোকামাকড়ের মতন মরবে। পাকবাহিনীর আক্রমণ ওদিক থেকে ফেরাতেই হবে। দ’ জন পাক সৈন্য অনেকখানি এগিয়ে গেছে বাবুল চৌধুরীর দিকে, সিরাজুল আর দ্বিধা করলো না। আমবাগান ছেড়ে সে বেরিয়ে এলো বাইরে, তার দেখাদেখি আরও কয়েকজন, লাফাতে লাফাতে তারা চাচাতে লাগলো,আয় শালারা! হিম্মৎ থাকে তত আয়!

শেষ ঘরের দরজাটাও খুলে দিয়েছে বাবুল চৌধুরী। তখনই সেই ঘরের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলো দু’ জন পাক সৈন্য। তাদের রাইফেল তোলার সুযোগ দিল না সিরাজুল, তার এল এম জি-র মুখ সেদিকে ঘুরিয়ে সে হুংকার দিয়ে উঠলো ইসানাল্লা,আজ সব কয়টা জানোয়ার খতম এরপর সিরাজুল যা করতে গেল, সেটা যুদ্ধ নয়, পাগলামি মুক্তিবাহিনীর ফায়ারিং পাওয়ার সহ্য করতে না পেরে পাক সৈন্যরাই রিট্রিট করে আশ্রয় নিচ্ছে স্কুলবাড়িটার পেছন দিকে, মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়ে গেছে, এখনই ফিরে যাওয়ার প্রকৃষ্ট সময়, তবু সে সবকটি পাক সৈন্যকে হত্যা করার জন্য ধেয়ে যেতে চায়। সেকেন্ড ইন কমান্ড হাসমত এসে তাকে টেনে ধরলো এবং সেই হুইশল বাজিয়ে দিল।

এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে অনেকগুলো লাশ। দু তিন জায়গায় আগুন জ্বলছে, এরই মধ্যে দিয়ে পিছু হঠতে হঠতে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিবাহিনী। পাক সেনা ছাড়াও বন্দীদের মধ্যে মারা পড়েছে বেশ কয়েকজন। বাবুল আর সিরাজুল দু জনেই এরই মধ্যে দেখে নিচ্ছে চেনা কোনো মুখ আছে কি না সেই নিহতদের মধ্যে। এক জায়গায় তাদের দু’জনেরই চোখ আটকে গেল।

শেষের কয়েক মিনিট তোতা মিঞার ওপর আর নজর রাখা হয়নি। শেষ রক্ষা করতে পারলো না ছেলেটা। হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে আছে সেই বালক, বুকের গর্ত দিয়ে এখনও বেরিয়ে আসছে রক্ত, তার চোখ দুটি নিষ্পলক, কী সরল ও সুন্দর সেই চোখ।

রাইফেলটা অন্য একজনকে দিয়ে বাবুল চৌধুরী দু হাতে কোলে তুলে নিল সেই বালকের নিস্পন্দ শরীর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *