1 of 2

৩৫. ড্রাইভার শ্রীকৃষ্ণ

৩৫

সকাল বেলা গিরিশদার ড্রাইভার শ্রীকৃষ্ণ একটি চিঠি নিয়ে এসে হাজির। গিরিশদা লিখেছেন, আমি সাবীর মিঞার বাড়িতে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি চলে এসো। দিগা পাঁড়ে খুব অসুস্থ। কালকে লাড্ডুয়ার হাটে এক বাঙালি তান্ত্রিকের কাছে খবর পেলাম। সে নাকি দিগার কাছেই এসে আছে দিনকয় হল। বাজার করতে এসেছিল লাড্ডুয়ার হাটে। সাবীর মিঞাও যাবেন। ভুচু জীপ নিয়ে আসছে সাবীর সাহেবের বাড়ি।

গিরিশদার গাড়িটা পেয়ে ভালই হল। অফিসে একচক্কর ঘুরে সাবীর সাহেবের দোকানে পৌঁছল পৃথু। বাজারটাজার সবই উনি করিয়ে রেখেছেন দিগার জন্যে। চাল, ডাল, নানারকম আনাজ। হেসে বললেন, বনক্ষেতির ফসল সাধু দরবেশদের সেবাতে লাগবে এইই তো ভাগ্যর কথা। নইলে বনক্ষেতির জমিদারী আমার আছে কী করতে?

ঝিংকু ডাক্তারকে সঙ্গে নেবে নাকি?

গিরিশদা শুধোলেন।

লাভ কী? দিগা যে অ্যালোপ্যাথী ওষুধও খাবে না, ছুঁচও নেবে না।

সাবীর সাহেব বললেন, তবে কি নাসিরুল্লা হাকিমকেই সঙ্গে নেব? জড়ি-বুটি, তেল-মলম সব ইস্তেমাল করে মারীজের ইলাজ করা তাঁর কাছে বাচ্চোঁ ক্যা খেল্‌।

দিগা, রামভগোয়ানের চেলা; সে কি আর মহম্মদের খিদ্‌মদ্‌গারের পেশ করা হাকিমি দাবাঁইয়ে নেবে?

সেও এক কথা বটে। যে রাম। সেইই রহিম এ কথা রাম আর রহিমের খিদমদগাররাই যে মানতেই চান না।

সাবীর সাহেব বললেন। খেদোক্তির মতো।

তা যা বলেছেন। এই চেলারাই নিজেদের মধ্যের ভেদ দিয়ে গুরুদের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিল। ওল রোড্‌স লীড টু রোম, এ কথা বুঝলে তো হয়েই যেত।

গিরিশদা বললেন।

সব ভগয়ানই যে এক এ কথা বুঝতে পারে ক’জন? বেশির ভাগ ধর্মই তো মন্ত্র, নৈবেদ্য, নেমাজ আর তলঁকিতে এসেই ঠেকে গেল, উপচার ছাপিয়ে উঠে উপাসিতর পায়ে গিয়ে পুজো তো পোঁছল না।

সাবীর সাহেব বললেন, পথের দিকে চেয়ে।

কথাবার্তা হচ্ছিল সব সাবীর সাহেবের দোকানে বসেই। ওয়াজ্জু মহম্মদ, বড় ছেলে, ছিল না। সে গেছে পোস্টাফিসে, ভোপাল থেকে আসা বন্দুক ছাড়াতে। সে এলেই সকলে রওয়ানা হতে পারেন।

পৃথুরা গিয়ে পৌঁছতে না পৌঁছতেই একপ্রস্থ চা এবং পান হয়ে গেছে। মসজিদের পাশের দোকানের মোষের রক্তের মতো লাল খয়ের দেওয়া ছোট ছোট করে ত্রিকোণ পান। চায়ের দোকানের চায়ের রঙও মোষের রক্তর মতো লাল। কী যে মেশায় চায়ে, কে জানে। এবং মিষ্টিও ভীষণ বেশি। সঙ্গে ভোপাল থেকে আনানো জর্দা। কথায় বলে, উজ্জ্বয়িন-এর বাঈজী, মালোয়াঁর রাত, আর ভোপালের খানা। জর্দাও বেহেতরীন। যেমন খুশ্‌বুদার; তেমনই নাশার।

এমন সময় এক খদ্দের এসে ঢুকল। একটি বাইগা যুবক। কোনও দূর জঙ্গলের গাঁ থেকে হেঁটে এসেছে ধুলো পায়ে। সে রাবারের হাওয়াইয়ান চপ্পল নেড়েচেড়ে পছন্দ করল একজোড়া ঘোর সবুজ রঙ চপ্পল।

কর্মচারী দুতিনজন থাকা সত্ত্বেও সাবীর সাহেব ক্যাশবাক্সর সামনে বসেই তার সঙ্গে কথা চালাচালি করতে লাগলেন। পৃথু আর গিরিশদা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, ওঁকে জুতো-বিক্রির সুযোগ দিয়ে। প্রায় মিনিট দশেক রাম্‌দা-রম্‌দির পর যুবকটি লোহার নাল-লাগানো মোষের চামড়ার তাগড়া একজোড়া নাগরাতে রফা করল, চপ্পল ছেড়ে দিয়ে। তারপর নতুন জুতো-জোড়া তার ধুতির কোণায় বেঁধে নিয়ে, কাঁধে ফেলে হাঁটা দিল বাজারের দিকে। নতুন জুতো-জোড়া সে পথের ধুলোয় নষ্ট করতে রাজি নয়।

যুবকটি চলে গেলে গিরিশদা সাবীর সাহেবকে শুধোলেন, এই নইলে দোকানি! গাহক এসে চাইল চপ্পল, বেচলেন নাগরা। অথচ নাগরাতে মুনাফা নিশ্চয়ই অনেকই বেশি।

সাবীর সাহেব হাসলেন। বললেন, বিলকুল গলদ বাত। নাগ্‌রাতে মুনাফা তিন টাকা, চপ্পলে পাঁচ টাকা। ইস্পিসাল্‌ চপ্পল যে এ।

তবে? নাগরা বেচলেন কেন?

সাবীর মিঞা হেসে বললেন, খদ্দের কী জানে, তার কিসে প্রয়োজন?

মানে?

গিরিশদা অবাক হয়ে শুধোলেন।

কোনও খদ্দেরই তার আসলে কী যে চাই, তা জানে না। দোকানিরই দায় তা জানার। যে-দোকানী খদ্দেরের পক্ষে কোনটা ভাল, কোনটা নয়, তা না জানে, তার দোকান করাই বৃথা। গাহ্‌ক আকর মাঙ্গেকা আঁম তো উস্‌কো বেচেগা ইমলি। নেহী তো দুকানদারী ক্যা?

মতলব?

গিরিশদা আরও অবাক হয়ে শুধোলেন।

ব্যাপারটা হচ্ছে, দোকানি যদি সৎ না হয়, ইমানদার না হয়; তবে তার দোকানে খদ্দের আর ফিরে আসবে না। এই ছেলেটা, থাকে গুঙ্গর বস্তিতে। বাস থেকে নেমেও তাকে ছ’ কিলোমিটার পথ, জঙ্গলে পাহাড়ে হেঁটে তবে বস্তিতে পৌঁছতে হবে। যদি হাওয়াইয়ান চপ্পল দিতাম তবে শীতের দিনের শুকনো নালা টপকাতে গিয়ে, নয়তো বর্ষার দিনের কাদার মধ্যে, তার চপ্পল হয় ছিঁড়ে পড়ে থাকত, নয় গেঁথে থাকত। নাঙ্গা পায়েরমে ঘর পৌঁছকে উ গালি দেথা সাবীর মিঞাকো। কিন্তু যে-জুতো তাকে দিলাম, সেই জুতো পরে দু বছর পাথরে-জঙ্গলে লাথি মেরে মেরে লাফিয়ে লাফিয়ে হেঁটে বেড়াবে ও। তারপর ছিঁড়ে গেলে আবার আমারই দোকানে আসবে জুতো কিনতে। গাহক কতটুকু জানে তার পক্ষে কী ভাল, আর কী ভাল নয়?

বিলকুল্‌ সাহী বাত্।

বললেন, গিরিশদা।

পৃথু ভাবছিল, একেই বলে সেল্‌সম্যানশিপ। ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটগুলোতে এই সব মানুষদের ডাক পড়বে না কোনওদিনও বক্তৃতা করার জন্যে। কিন্তু “মাঙ্গেকা আম ঔর্‌ বেচেগা ইম্‌লি” যে-কোনও কোম্পানির সেল্‌সম্যানেজারদের মূলমন্ত্র হতে পারত; হওয়া উচিত ছিল হয়তো। নিজের প্রডাক্ট এবং নিজের ডিসক্রেশান্-এর উপর কতখানি বিশ্বাস থাকলে যে একজন “সেল্‌সম্যান” এমন দম্ভভরে কথা বলতে পারেন তা ভেবেও ও পুলকিত হল। খেলার ছলে একটা মস্ত বড় কিছু শিখে ফেলল পৃথু, সাবীর সাহেবের কাছ থেকে। এই দোকানে বসে।

সাবীর সাহেবের ছেলে ওয়াজ্জু এল পোস্টাফিস থেকে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভুচুও তার জীপ নিয়ে। সাবীর সাহেব বললেন, অব, চলা যায়। রাত কা খনা আজ হিঁয়াপরই। বড়া ইম্‌দা বটের মিলাথা আজ। সুব্বে সুব্বে। ইমরান, লেকে আয়া থা। মাসস্‌ত নেহি, মালুম হোতা কী মছ্‌লিই হ্যায়। বিরিয়ানী ভি বনে গা। ঔর ফির্‌নী। দিন্‌ভর্‌ দিগাকো দেখ্‌ভাল করকে লওট্‌কে হিঁয়া আয়েগা সব্‌ মিল্‌কর। মজা আ যায়েগা। সাচ্‌মুচ্‌।

কীসে যে মজা না আসে সাবীর মিঞার তা উনিই জানেন। সব সময়ই ওপেন-হাউস। বর্ষার রাতে ভূনা-খিচরি ঔর্‌ বটি-কাবাব, শীতের দিনে বিরিয়ানী আর মুর্গ-মুসল্লম্‌, সঙ্গে আন্ডেকা রোশান্‌, হালৌয়া, গরমের দিনে রুহ্-আফ্‌জা শরবৎ; খস্‌স্‌-গন্ধী। নিদেন পক্ষে আলুকা ভাত্তা বা বায়গন ভাত্তা থাকলেও সাবীর মিঞার ‘মজা আ যায়েগা’তে কোনও রকম কমতি পড়ে না। ভাল ন্যাংড়া আম, লিচু, তরমুজ, ফুটি, পেঁপে; ফলেরই বা কতরকম কায়দা। ফল পেশ করবার কায়দা। জীবনকে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সাবীর মিঞার মতো ভালবাসতে খুব কম লোককেই দেখেছে পৃথু। সমস্ত জীবনটাকেই, তাঁর জীবনের যা-কিছু সম্পদ তার সবটুকু নিঃশর্তে নিরন্তর দোস্ত-বিরাদরদের কাছে ঈশ্বর আর গুলাব-ভরা রেকাবিতে করে পেশ করে যাচ্ছেন উনি। ক্লান্তি নেই কোনও। দিনের পর দিন। এই-ই নমকহারাম আর বদতমিজদের দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে যদি আদৌ হয়, তবে সাবীর মিঞার মতোই। বাঁচতে হয়। সুবাসাম্‌ হাঁটুমুড়ে বসে নেমাজ পড়া থেকে, তার বিবি-বাচ্চাদের এবং দোস্ত-বিরাদর্‌দের খিদ্‌মদ্‌মারী পর্যন্ত সব কিছুতেই এক বিশেষ স্টাইল আছে মানুষটার। এমন ওরিজিনাল মানুষ বেশি দেখাই যায় না। পৃথিবী এমন প্রোটোটাইপেই গিজগিজ করে। প্রোটোরা, এক-খড়্গ-গণ্ডারের মতো দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে সমাজের সব তলাতেই।

ভুচু, জীপটাতে, গিরিশদার গাড়ি থেকে দিগা পাঁড়ের শামান সব তুলে নিচ্ছিল শ্রীকৃষ্ণর সঙ্গে হাত লাগিয়ে। ডাকু মগনলালের সঙ্গে টক্করের পর থেকেই কোথাওই যেতে হলে সঙ্গে যন্ত্র নিয়ে যেতে হয় পৃথুর এবং ভুচুর। থুড়ি ডাকু শের সিং এবং সাঁওয়ার। কখন যে কী হয়, কে বলতে পারে? সব সময়ই কোনও কিছু ঘটার আশঙ্কায় মন দুরদুর করে। খুব ভাল লাগে পৃথুর। মনের মধ্যে পাকা ফোঁড়ার মতো এক সুখের দপদপানি অনুভব করে। বুকের মধ্যে সুখের মতো ব্যথা বাজে এক ধরনের। আবার সেই আলখাল্লা-পরা বুড়ো। তার হাত থেকে নিস্তার নেই। জীবনটা বড়ই একঘেয়ে, মানডেন হয়ে গেছিল। বাল্মীকির চেয়ে রত্নাকর অনেকই ইন্টারেস্টিং মানুষ। তাই-ই কবি পৃথু, ডাকু শের সিং-এ রেজারেকটেড হয়ে আনন্দে ঘন হয়ে থাকে।

সামনের মোটরের ব্যাটারীর দোকানের আজ দশ বছর পুরল। খনাপিনা চলছে। দোকানটা বেদানন্দর ছিল। সে শিকারে গিয়ে জীপ উল্টে মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। এখন ভাইয়েরা চালায়। বেদানন্দর সঙ্গে ভাব ছিল ওদের সকলেরই। মাঝে মাঝে শামীম এবং ভুচুদের সঙ্গে শিকারেও যেত সে।

মাইকে গান বাজছে। একই রেকর্ড। সেভেনটি-এইট রেকর্ড বার বার তুলে তুলে দিচ্ছে। “লাউরী বিনা চাট্‌নী/ ক্যয়সে বনী,/ক্যায়সে বনীইইই/ ক্যায়সে বনীইই/ লউরী বিনা চট্‌নী/ ক্যায়সে বনীইই।”

কথাটা সিলাউরী অর্থাৎ শিলনোড়া অথবা লউরী বা ধনেপাতা কোনটা যে, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে, গানের সুরটা ভারী ভাল। কোনও সিনেমার গান হবে। কতদিন সিনেমা দেখে না! সিনেমার গান যদি হয়, তাহলে ভুচুর গারাজের মেকানিকরা বা কুক্‌ লছ্‌মার সিং অথবা ড্রাইভার অজাইব সিংরাই নির্ভুল বলতে পারবে, কোন সিনেমার গান।

ভুচু বলল, অব্‌ চলা যায় সাবীর সাহাব।

হাঁ। চলিয়ে না। ম্যায় তো বিলকুল তৈয়ার।

চালিয়ে।

বলে, গিরিশদাও উঠলেন। শ্রীকৃষ্ণকে বাড়ি গিয়ে খেয়ে নিয়ে আবার এখানেই ফিরে আসতে বললেন সন্ধের পর। জীপটা স্টার্ট করেই ভুচু ড্যাশবোর্ড খুলে বলল, পৃথুদা, পান।

সাবীর সাহেব বললেন, আররে ভুচু। ঈ ক্যা? গুরু গুরু; চেলা চিনি!

গিরিশদা হেসে উঠলেন সাবীর মিঞার কথাতে। অন্যরাও।

পান খাওয়ার ব্যাপারে চেলা, গুরুকেও ছাড়িয়ে গেল সত্যিই। গুরু এখনও গুড়ের পর্যায়েই রয়ে গেল, চেলা একধাপ এগিয়ে গিয়ে চিনি হয়ে গেল।

সাবীর সাহেব বললেন, এ ভুচু। ম্যায় বুড্‌হা পুরানা আদমী। তোরা গাড্ডী, টিকিয়া-উড়ান্‌ মৎ চালানা। ইয়াদ রাখ্‌না।

ঠিক হ্যায়। ঠিক হ্যায়। বলে, আশ্বস্ত করল সাবীর সাহাবকে ভুচু। ভুচুর এই-ই দোষ। মিঞাবেচারি সাবধানী মানুষ। ভয় পান। তাছাড়া, পুরনো জীপ, মেটাল ফেটিগ বলেও তো কথা আছে একটা। কিন্তু কে কার কথা শোনে! সাবীর মিঞাকে কোনওমতে জীপে বসাতে পারলেই একেবারে টিকিয়া-উড়ান্‌ সে চালাবেই চালাবে। এই-ই একটা খেলা ভুচুর। মানে, এতই জোরে চালাবে যে, তার টিকি থাকলে টিকিটা মাথার উপর খাড়া হয়ে হাওয়ার তোড়ে হাওয়ার সওয়ার হয়ে উঠতে-নামতে থাকত। এমন গাড়ি চালানোকেই বলে “টিকিয়া-উড়ান্‌” চালানো।

গিরিশদা বললেন, যাচ্ছি রোগীকে দেখতে, অথচ কোনও ওষুধপত্রই নিয়ে যাচ্ছি না। তবে যাচ্ছি কি করতে আমরা? না ডাক্তার, না ওষুধ! স্রিফ্‌ সকল্‌ দিখানেকে লিয়ে?

ভুচু বলল, মুনেশ্বরের কাছে রিপোর্ট যা পেলাম বাঙালি তান্ত্রিকের, তাতে দিগার অসুখ তো বটেই, আমাদেরও কারও কোনও গোপন অসুখটসুখ থাকলে তাও সেরে যাবে তার সংস্পর্শে এসে।

মানে?

সাবীর সাহেব বললেন।

মানে, খুবই খতরনাগ্‌।

মানে?

এবার পৃথু শুধোল।

মুনেশ্বর বলেছে ইয়ে বাঙালি সাধ্বু, সাধ্বু নেহি হ্যায়, হর বাঙ্গালিকা মওত্‌ হ্যায়! পুরা জাত্‌কো বে-ইজ্জৎ করকে ছোড়্‌ দেগা। ইনোনে। দিগা মহারাজকোভি সত্যনাশ করকে ছোড়েগা। হায় ভাগোয়ান!

সে কী? এত কথা তো মুনেশ্বর আমাকে বলল না। যত কথা কি তার তোমারই সঙ্গে? মাইনে দেব আমি, আর মনিব হলে তুমি।

সব কথা সবার জন্যে নয় যে গিরিশদা। আপনি হচ্ছেন মুনেশ্বরের মুনিব। আর আমি হচ্ছি বেগর, পড়ে-লিখে সামান্য একজন মোটর মিস্ত্রি। আমার আর মুনেশ্বরের লেভেলটা এক কিনা; তাই-ই আমাদের দোস্তির সম্পর্ক। তান্ত্রিকের সঙ্গে একজন ভৈরবী ছিল। ভেবে দ্যাখো, কী কেলো। দিগার এবার চরিত্র বলে আর কিছুই থাকবে না।

তা ঠিক। পৃথু ভাবছিল। একেই তো চরিত্র ব্যাপারটাই হাওয়ার মতো থাকলেও প্রমাণ করা যায় না, দেখা যায় না যে আছে; আর না-থাকলেও তাই-ই। চরিত্র হচ্ছে মোস্ট ইনট্যান্‌জিবল অফ ওল্‌ ইন্‌ট্যান্‌জিবল্‌ অ্যাসেটস্।

ভুচু বলল, বুঝলেন গিরিশদা, আপনার ছেড়ে-দেওয়া, গান-বাজনার জবরদস্ত সমঝদার মিষ্টি দেখতে কাকগুলো এবারে দিগা পাঁড়ের চরিত্র নিয়ে মরা কাতলামাছের জিরিজিরি কানকোর মতো ছিনিমিনি খেলবে। ছিঃ! ছিঃ! এমন একজন সাধকের শেষে এই-ই পরিণতি হল! লেহ লট্‌কা।

গিরিশদা বললেন, তাই-ই বলো। তাই-ই তুমি দিগার অসুখ। দিগার অসুখ। বলে পাগল হলে। ভুচুর হঠাৎ দিগার উপর এত প্রেম উথ্‌লালো যে কেন এখন তা বুঝতে পারছি। প্রেম কি দিগারই প্রতি, না ভৈরবীর প্রতি? পামেলা কি জানে?

ভুচু বলল, এই জন্যেই গিরিশদা, আপনাকে কোনও মেয়ে ভরসা করে বিয়ে করতে পারল না। না-করে অবশ্য আমাদের ভালোই করেছে। বউদি থাকলে তো বউদির জায়গা আর আমরা নিতে পারতাম না! সব সময় এমন অবারিত দ্বার।

তা তো বুঝলাম। কিন্তু তোমার ভৈরবী সন্দর্শনে যাওয়ার সঙ্গে আমার বিয়ে না-হওয়ার সম্পর্কটা যে কী তা বুঝলাম না বাছা!

‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো-তাই, মিলিলে মিলিতে পারে সোনা।’

বলেই ভুচু, গীয়ার চেঞ্জ করে, জীপকে টপ-গীয়ারে ফেলেই টিকিয়া-উড়ান চালিয়ে দিল, অ্যাকসিলারেটরকে শেষ প্রান্ত অবধি পা দিয়ে ঠেসে চেপে ধরে।

সকলেই হো হো করে হেসে উঠল।

ক্রমশ জোর হতে-থাকা এঞ্জিনের গোঁ গোঁ শব্দের মধ্যে সাবীর মিঞার করুণ কণ্ঠস্বর ডুবে গেল, এ! এঃ! ভুচু—এ ভুচু— এ বাব্বা ভুচু, জারা আইস্তা, তোরা গোড় লাগি বাবা। জারা আইস্তা। ইত্‌না বদ্‌তমিজ হোতে চল্‌তা ঈয়ে ছঁওড়াপুতান্!

পানের পিকে দুই কষ ভরে ভুচু ফিচিক করে হেসে, ঘাড় ঘুরিয়ে এক ঝলক চেয়ে সাবীর মিঞার ভয়ার্ত দু চোখের ডিমার-ডিপারের খেলা দেখে পুলকিত হয়ে পিচিক করে পানের পিক ছুঁড়ল হাওয়ায়। তরল, পলাশ-রঙা আবীরের মতো সেই পিক উড়ে গিয়ে পথপাশের শালচারাদের রাঙিয়ে দিল।

লাম্‌-সাম্! লাম্‌-সাম্। লাম্‌-সাম্।

চেঁচিয়ে উঠলেন সাবীর মিঞা। প্রায় আর্তনাদেরই মতো শোনাল তা।

সকলে আবারও হেসে উঠল।

এই লাম্‌-সাম্‌ কথাটার সঙ্গে ইংরিজি ল্যাম্প-সাম-এর কোনওই সম্পর্ক নেই। কথাটির মানে ঠিক যে কী, তা সাবীর মিঞা ছাড়া আর কেউই জানেন না। সাবীর মিঞার কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, অনেকদিন আগে উইলী হৌস্ বলে একজন প্রকাণ্ড লম্বা-চওড়া মোটাসোটা জার্মান শিকারি নাকি এখানে শিকারে এসে সাবীর মিঞাকে দোস্ত করেন। জঙ্গলের পথে কেউ জোরে জীপ চালালেই হৌস সাহেব নাকি ড্রাইভারের পিঠে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় কষিয়ে বলতেন; লাম্‌-সাম্‌ লাম-সাম্। আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষায় যেমন বলে, “পোলে-পোলে”। লাম্‌-সাম্ কথাটার মানেও নাকি আস্তে আস্তে। তবে কথাটা আদৌ জার্মান কি না, তা ওরিজিনাল সাবীর মিঞা অথবা কোনও ওরিজিনাল জার্মানের পক্ষেই বলা সম্ভব।

ধূলিধূসরিত হয়ে ওরা সকলে যখন দিগার কুঁড়েতে পৌঁছল তখন সকাল দশটা। দূর থেকে দেখা গেল দিগা সেই বড় কালো পাথরটার উপরে আধশোয়া হয়ে বসে একজন লাল লুঙিপরা বড় বড় চুল-দাড়িওয়ালা লোকের মুখের দিকে চেয়ে তার বাণী শুনছে।

ভুচু স্বগতোক্তি করল, পৃথুদা। কেস খুবই খারাপ।

গিরিশদা বললেন, এইই নাকি দিগার ভয়ানক অসুখ? এ সবই ভুচু এবং মুনেশ্বরের গভীর চক্রান্ত! দিগার কিছুই হয়নি আদৌ! দেখেছ পৃথু! আমার একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল আজ সকালে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

কার সঙ্গে?

পৃথু শুধোল।

মণি চাকলাদারের সঙ্গে।

সেকি দাদা? আদায় আর কাঁচকলায় ভাব?

জীপটা পার্ক করতে করতে ঠাট্টার গলায় বলল, ভুচু।

সবটাতে ইয়ার্কি মেরো না। যা বোঝে না, তা নিয়ে কথা বোলো না।

হঠাৎ চটে উঠে গিরিশদা বললেন ভুচুকে।

কিসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট গিরিশদা?

পৃথু শুধোল। এবার।

সুধন্য ও সুতপার বেড়াল শোনবার নেমন্তন্ন ছিল আমার।

একটা যুগান্তকারী উপন্যাস লিখছেন মণিবাবু। বুদ্ধদেব বসু, কমল মজুমদার সকলকে নাকি ফ্ল্যাট করে দেবেন।

তা, আপনি হঠাৎ…?

আগামী সংখ্যায় আমার একটি দীর্ঘ কবিতা ছাপাচ্ছেন মণিবাবু। সঙ্গে নেপাল গাঙ্গুলির স্কেচও থাকবে। মণিবাবু বলেছেন, রাজযোটক ব্যাপার।

সত্যি?

পৃথু বলল।

কবিতাটির কী নাম দিয়েছেন? মানে, এই দীর্ঘ কবিতাটির?

“লাড়ুয়া হাটের লক্‌ড়া”। ভাল হয়নি? কী বলো পৃথু?

দারুণ! পৃথু বলল। খুউব ওরিজিনাল।

ভুচু জীপ থেকে নামতে নামতে বলল, গিরিশদা! শেষে আপনার কবিতার জিনিয়াস্‌ লকড়াতেই এসে থেমে গেল। লকড়া তো নেকড়ে বাঘ, তাই না? আমি কিন্তু যদি কোনওদিনও কবিতা লিখি তো বাঘকে নিয়েই লিখব। লকড়া-ফকড়ার মতো অ্যানিম্যাল নিয়ে একেবারেই নয়। লিখব :

“বন্‌ক্ষেতিকা বাঘোয়া চলে টাঁড়োয়া টাঁড়োয়া। কভী না দেখিন্‌থী বাঘিনীয়া। দিখ্‌কে বিলকুল ফাঁসোয়া তির্‌ছি নজরসে ধড়্‌কায়া বড়া দোস্তী ভইল্‌ হাটচান্দোয়াতে চাক্‌লাদার ঔর বোসোয়া…”

আঃ! কী ফাজলামি হচ্ছে ভুচু। সত্যিই বাড়াবাড়ি করছ তুমি!

পৃথু বিরক্ত হয়ে বলল।

গিরিশদা আহত হয়ে চাইলেন ভুচুর দিকে।

জীপ থেকে নামতে নামতে পৃথু ভাবছিল, গিরিশদার মতো বুদ্ধিমান, বিদ্বান, বিচক্ষণ প্রত্যেক সুস্থমস্তিষ্ক এবং চমৎকার ভারসাম্যসম্পন্ন মানুষেরও কিছু কিছু দুর্বোধ্য দুর্বলতা থাকেই, যা তাকে মানুষ হিসেবে হাস্যাস্পদ করলেও, সেই সঙ্গে মানুষ হিসেবে হয়তো পূর্ণতরও করে তোলে। হাস্যস্পদ কে নয়? কেউ যদি ভাবে যে, সে নয়; সে মূর্খ। তার বেঁচে থাকার মজাও বোধহয় ফুরিয়ে গেছে। পৃথু তো নিজেকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি হাসে। এবং মজাও পায়। যে মানুষকে নিয়ে হাসির কিছুমাত্রও আর থাকে না, তিনি আদৌ মানুষ কি না সে সম্বন্ধে গভীর সন্দেহই জাগে। মানুষ যেহেতু দেবতা নয়; কোনও মানুষই নয়; কোনও কোনও ক্ষেত্রের অপূর্ণতাই প্রত্যেক মানুষকে তাই পূর্ণতা দেয়।

বোধহয়।

দিগা, জীপের শব্দ শুনেই উঠে বসেছিল। এবার আস্তে আস্তে পাথর থেকে নীচে নেমে এল। কালো একটি নেপালী কাঠবিড়ালীর মতো। হাতজোড় করে মাথা নিচু করে নমস্কার করে সকলকে বলল, আইয়ে! আইয়ে? পাধারীয়ে!

ওঁর হাঁটা দেখে বোঝা গেল সে, অসুস্থ সে সত্যিই হয়েছিল। এখনও দুর্বল আছে।

জীপ থেকে ভুচু শামানগুলো নামাচ্ছিল। পৃথু গিয়ে হাত লাগাল।

ভুচু বলল, যাও তো আরাম করে রোদে বোসো গিয়ে। আজ ফেনাভাত খাব। গিরিশদাকে বলো, রাঁধবে। ভাল করে ঘি ঢেলে, ফারসট্‌ক্লাস করে।

গিরিশদা কেন? সাবীর সাহেব থাকতে…সাবীর সাহেব খনা-মাস্টার আর গিরিশদা পীনা-মাস্টার।

আরে! দিগা কি খাবে নাকি সাবীর সাহেবের হাতে?

অ্যাই! অ্যাই তো! এই জন্যেই তোমাদের রামভগয়ান শেষে পবননন্দনের সঙ্গে হাত মিলোলেন। তোমাদের হিন্দুধর্মের সব ভাল, মানুষকে তোমরা মানুষের মর্যাদা যে দিলে না এতেই সব গড়বড় হয়ে গেল। এক গামলা দুধে এক ফোঁটা চোনার মতো। দ্যাখো তো আমি খ্রীশ্চান, সাবীর মিঞা মুসলমান, দিগা রামপন্থী, তোমাদের এই নতুন বাঙালি তান্ত্রিক, সে হয়তো অন্য কোনও পন্থী। কিন্তু ভেদাভেদ জাতবিচার তোমাদের হিন্দিদের মতো আর কারওই নেই। এই করেই ডুবে গেলে তোমরা।

হয়তো তাই-ই…

পৃথু বলল।

ভুচু গলা চড়িয়ে জিগ্যেস করল গিরিশদাকে, এই যে গিরিশদা! ফারস্ট-ক্লাস ফেনাভাত রাঁধতে পারবেন তো!

নতুন চাল এনেছে কি সাবীর ভাই?

গিরিশদা শুধোলেন।

হ্যাঁ। হ্যাঁ। একদম বেফিক্কর, থাকুন। নতুন চাল, নতুন আলু, নতুন কাঁচা লঙ্কা, নতুন কাঁচা পেঁয়াজ, নতুন মুসরির আর মুগের ডাল, ডব্‌কা নতুন গোন্দ ছুঁড়ির গায়ের রঙের মতো চেকনাই-লাগা কালো নতুন বায়গন। আর কী নতুন চাই আপনার?

কিসের ভাত্তা খাবে? আলুর না বায়গনের?

ভাত্তা?

ভুচু হঠাৎই চুপ করে গেল।

কী হল তোমার?

একটা কথা বলি? গুস্তাফি মাফ করেন তো বলি।

ন্যাকামি না করে বলেই ফেলো।

ভাত্তাই যদি বানাবেন নিজে হাতে গিরিশদা তো আপনার মণি চাকলাদারের ভাত্তাই বানান। ফেনাভাতের সঙ্গে জমে যাবে। তবে কাঁচা লঙ্কা ভেঙে দেবেন বেশি করে। বড় মেয়ে মেয়ে মিষ্টি স্বাদ ভদ্রলোকের।

হঠাৎ মণি চাকলদারের সম্বন্ধে তোমার এমন বিরূপতা ভুচু, কী ব্যাপার?

গিরিশদা, ঠাণ্ডা মেজাজেই বললেন। কবিতা-টবিতা নিয়ে তুমিও পড়েছ নাকি?

বিরূপতার কোনওই কারণ নেই। কবিতা-ফবিতার মতো মেয়েলি ব্যাপারের মধ্যেও আমি নেই। অমন দুর্মতি আমার যেন কখনও না হয়! তবে, বিশ্বাস করুন! কিছু কিছু লোক তো পৃথিবীতে আছে, তাদের প্রথম দিন দেখামাত্রই তাদের ওপর একটা জাতক্রোধ জন্মে যায়? মনে হয়, এই লোকগুলোকে এক্ষুনি অপদস্থ করি, সকলের সামনে অপমান করি, নিছক চেহারা দেখেই। কেন যে এমন হয় তা বলতে পারব না। কিন্তু হয়। আপনার হয়? আপনার মণি চাকলাদার সেই লোকদের মধ্যে একজন।

তুমি সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাও।

গিরিশদা গম্ভীর মুখে বললেন।

আমারও কিন্তু এমন হয় গিরিশদা! আমি লক্ষ করেছি। যাকে চিনি না পর্যন্ত, যার সঙ্গে আমার কোনও স্বার্থর সংঘাত নেই, যে লোক বরং অনেক উপকারই করতে পারে আমার তেমন তেমন লোককেও দেখা মাত্রই মনে হয় অপদস্থ করি; অসম্মান করি। সত্যিই হয় এমন।

পৃথু বলল।

তুমিও সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাও।

ভুচু দিগার কুঁড়ের ভিতর সেঁধিয়ে যেতে যেতে পৃথুকে বলল, আমার দলে তাও একজন পেলাম, পৃথুদা।

ইতিমধ্যে সেই তান্ত্রিকের সঙ্গে দিগা সকলকে পরিচয় করিয়ে দিল। তান্ত্রিকের দিকে ভাল করে চেয়েই একেও পৃথুর সেই প্রথম-দর্শনেই অপছন্দর লোক বলে মনে হল। লোকটা ভাল হিন্দি বলে। নামেই বাঙালি; পৃথুদেরই মতো। বাঙালি বাঙালি হচ্ছেন আর কী! আসলে, বাঙালি নয়। এদেশি হয়ে গেছেন। মনে হল বহুদিন এদিকেই আছেন।

গিরিশদা শুধোলেন, মশায়ের নিবাস?

দক্ষিণ-বাংলা। ওয়েস্ট বেঙ্গলের জয়নগর-মজিলপুর। নাম শোনেননি? কত মহাপুরুষের আদি নিবাস সে জায়গা।

তা হবে। আমরা তো দাদা বহু পুরুষ এদিকেই।

বুঝতেই পারছি। চেহারা, ভাব-ভঙ্গি দেখেই। নইলে কি আর এত আকাট হন। রিয়্যাল বাঙালি হলে অনেকেই কালচারড রিফাইনড হতেন। রিয়্যাল বাঙালিরা বরাকরের আর মেদিনীপুরের এ পাশে থাকেন না।

গিরিশদা জবাবে কিছু বললেন না। মুখ দেখে বোঝা গেল যে, রেগেছেন।

পৃথু বলল, আপনিই বা এতদূরে এসে পড়লেন কী করে? রিয়েল বেঙ্গল ছেড়ে? কলকাতা থেকে তো এ জায়গা বহুতই দূর।

দূর ভাবলেই দূর! না ভাবলেই নয়। তাছাড়া, এসে পড়তে দোষ কোথায়। রিয়েল বেঙ্গলের রয়্যাল-বেঙ্গল বাঘও কত দূরে দূরে চলে এয়েছে। মন তো আলোর চেয়েও অনেক বেগে দৌড়য় কি না! আলো দৌড়য় সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল, আর মন পৌঁছে যায় অনন্ত দূরত্বে। সেই এক সেকেণ্ডেরও অনেকই কম সময়ে।

এমন সময় ভুচু ফিরে এল।

ভুচুকে তীক্ষ্ণচোখে দেখলেন তান্ত্রিক। তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হঠাৎ বললেন, মনে পড়ে?

ভুচু থতমত খেয়ে বলল, লেহ লট্‌কা আঃ আঃ…আমাকে…?

হ্যাঁ। সে কী? মনে পড়ে না আমাকে?

কই? না তো!

সেই যে দেখা হয়েচেল।

কবে? কোথায়?

কবে? সেকি আজকের কতা! কতযুগ আগে। দেখা হয়েচেল, বেন্দাবনে।

বেন্দাবনে?

হ্যাঁ গো। তা না হলে আর বলচি কী?

না। না তো।

ভুচুর মত ছেলেও হকচকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। তারপর সামলে নিয়ে দিগাকে শুধোল, কী হয়েছিল দিগা তোমার?

ও কিছু না, একটু বুখার।

একটু বুখার?

তান্ত্রিক বললেন। মরে ভূত হয়ে যেত মহ্যায় আমি না থাকলে। সাক্ষাৎ মাইই আমাকে পাটিয়ে দিয়েছিলেন সময় মতো। ডাকাতদের হাত থেকেও বাঁচাত কে ওকে?

ডাকাত? কোন ডাকাত?

পৃথু শুধোল। ভুচুও চমকে উঠে তাকাল।

কোন ডাকাত কী করে জানব? ডাকাত নিয়ে তো সাধনা করিনি আমি। ভূত প্রেত, যোনি-সাধনা এই সবই বিষয় আমার। সেই জগতেই আমার বাস। এই জগতের খোঁজে প্রয়োজনই বা কী? তবে যারা এসেছিল, তারা ডাকাতদের কুলোপুরোহিত এক্কেবারে সব পেডিগ্ৰীড্‌ ডাকাত মহ্যায়! চকচকে জীপ গাড়ি, চকচকে সব আগ্নেয়াস্ত্র; ইয়া-ইয়া গোঁফ। আপনাদের দিগা পাঁড়েকে গুলিতে একেবারে ভেজে দিয়ে চলে যেত।

তারপর?

গিরিশদা শুধোলেন।

তারপর আর কী! ভাগ্যিস আমার সঙ্গে কারণবারি আর ভৈরবী ছেল। এই দুই দিয়েই তাদের বশ করলাম। ভৈরবীকে ফেরৎ দিয়ে গেল সকালে; একেবারে প্রেতিনী করে। তাও ঠিক ছিল। আমি তাকে “শুদ্ধ করে নিতাম। কিন্তু কাল তাদেরই সঙ্গে লাড়ুয়ার হাটে গেছিলাম। হারামির বাচ্চারা হাটে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ভৈরবীকে নিয়ে ইচ্ছে করে হারিয়ে গেল। হাওয়া হয়ে গেল মহ্যায়। ভৈরবী আমার বাগনান-এর মেয়ে। মোটে কুড়ি বছর বয়স। তাকে কি আর পাব? সেও হয়তো পুত্‌লী বাঈ-এর মতো কোনও ডাকু-রানী হয়ে যাবে। কী কুক্ষনে যে মহ্যায় আপনাদের মধ্যপ্রদেশে এয়েছিলাম। আমার ভৈরবীর মধ্যপ্রদেশই এরা হাপিস করে ছেড়ে দেবে। সাধনপীঠই গায়েব হয়ে গেল তো সাধনা করব কী নিয়ে। কী চিত্তির! কী চিত্তির!

লোকটার চেহারা, কথাবার্তা, লাল চোখের দৃষ্টি, পা ফেলার ভঙ্গি সবকিছুর মধ্যেই এক ধরনের অশালীনতা ছিল। পৃথু ওর দিকে চুপ করে চেয়ে রইল। পৃথুর মুখে বিরক্তি ফুটে উঠতে লাগল। চোখাচোখি হল ভুচুর সঙ্গে পৃথুর। ভুচুর চোখ বলল, তান্ত্রিক সম্বন্ধে : “খচ্‌রা নাম্বার ওয়ান্। হুঁশিয়ার! ডেঞ্জারাস স্পেসি।” ভুচু বলল, ডাকাতরা ক’জন ছিল? তাদের সম্বন্ধে একটু বলুন তো শুনি!

কেন? আমি কী পুলিসের ইনফর্মার মহ্যায়? আপনারাও কি পুলিসেরই লোক? আমার কোন দায়? পারবেন ভৈরবীকে উদ্ধার করে দিতে? তবে আর এত পিটির পিটির প্রশ্ন কেন?

কিছু মনে করবেন না সাধুবাবা।

মেয়েটার মানে, আপনার ভৈরবীর কী হল তা নিয়ে আপনার কোনও মাথা ব্যথাই নেই মনে হচ্ছে। নইলে, আপনি এমন জমিয়ে…

অবাক হওয়া গলায় বললেন গিরিশদা। এদেশে মেয়েছেলের অভাব কী মহ্যায়? নতুন ভৈরবী জুটোতে আবার কতক্ষণ? মন্ত্রতন্ত্র সবই জানা আছে। যখন খুশি উঠিয়ে আনব। তবে হ্যাঁ, রিয়েল-বেঙ্গলের ভৈরবী এখানে পাব না। তাই-ই বলচি, মাথার ব্যথার কোনও উপশমের উপায় যখন নেই তখন কোনও বুদ্ধিমান লোকই মাথার-ব্যথায় কষ্ট পান না। কিছুমাত্র করার না থাকলেও কিছু করতে যাওয়াটা পরম মুর্খামি।

হায় রাম!

দিগা বলল; জোরে শ্বাস ফেলে।

ঘোর কলি এখন। কলির লক্ষণ চারদিকেই পরিষ্কার। এবার আমার যাওয়ার সময় হল। এখানের ডেরা তুলে চলে যাব অন্য জায়গায়।

যাবে কোথায় বাছা আমার? কলি কী পাথর যে, এক জায়গায় পড়ে থাকবে? ভাইরাস ইনফেকসানের মতো তা তোমার সঙ্গে সঙ্গে যাবে মূর্খ!

তান্ত্রিক বলল।

ভুচু বলল, এই যে কলি-কলি করছ তুমি দিগা, এর লক্ষণ কী?

পৃথু বলল, তোমাদের খ্রীস্টানদের সেই গল্প আছে না, ডিল্যুজ এল, বন্যা, বন্যা; বন্যায় চারদিক ভেসে গেল, ন্যুহা নৌকো বানিয়ে সব প্রাণীর এক-এক জোড়া করে তাতে নিয়ে ভেসে পড়লেন। এই পোড়া, পাপী পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলে নতুন পৃথিবীতে যাতে প্রাণ থাকে তাইই…,

দিগা বলল, রামরাজ্য আর কলিযুগের লক্ষণ একেবারেই উল্টো। রামরাজ্যের বর্ণনা আছে রামচরিতমানসে :

সব উদার সব পর উপকারী। বিপ্র চরণ সেবক নরনারী। এক নারী ব্রত রত সব ঝারী। তে মন বচ ক্ৰম পতি হিতকারী।

আরে মানেটা বলবে তো!

অধৈর্য গলায় ভুচু বলল।

মানে হল, যেখানে সবাই উদার, সবাই পরোপকারী, নর-নারী সকলেই ব্রাহ্মণচরণের সেবা করে, সমস্ত পুরুষই এক নারীতে, মানে যার যার পত্নীতে আসক্ত। নারীরাও প্রত্যেকে মনে, কর্মে ও বচনে পতির হিতকারী! সেইই হল রামরাজ্য!

গিরিশদা বললেন, আহা! মরি মরি। এমন রাজ্য দিগা পাঁড়ে তোমার স্বপ্নেই আছে; স্বপ্নেই থাকবে। আর কলিযুগের ব্যাপারটা কেমন শুনি? ব্রাহ্মণ হলেই তার পায়ে পুজো করতে হবে এ একটা কথা হল? এখানে তোমার এই তান্ত্রিক জয়নগর-মজিলপুরী রিয়েল-বেঙ্গলি বন্ধু আর তুমি ছাড়া আমরা সবাইই তো অব্রাহ্মণ। দুজন কায়স্থ, আমি আর পৃথু। সাবীর সাহেব মুসলমান। আর ভুচু খ্রীস্টান। আমরা কি সবাইই অমানুষ? যত সব ইমাজিনারী স্টেট অফ অ্যাফেয়ার্স, “উইশফুল থিংকিং”-এর জগত তোমাদের।

ইংরিজি শব্দগুলোর মানে না বুঝতে পেরে দিগা বোকার মতো চেয়ে রইল গিরিশদার মুখে।

গিরিশদা বলল, থাকগে, কলি যুগের বর্ণনাটা শোনাও তো এবার।

বলেই, ভুচুকে বললেন, ও ভুচু বাইরে গাছতলায় একটা কাঠের উনুন করো। আমাদের হাতের রান্না এই ব্রাহ্মণ কী খাবেন?

মোটেই না। মোচ্‌লা কেরেস্তানের ছোঁয়া খাবই বা কেন?

লেহ্ লট্‌কা। ভুচু বলল।

তারপর চোখ দুটো ছোট করে তান্ত্রিককে বলল, আপনার কী স্যার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেশি আছে কিছু আমাদের চেয়ে! দু’ পেয়ে মানুষই তো আপনি আরেকজন, না কি? না হয় হলেনই রিয়েল-বেঙ্গলি!

দু’পেয়ে আমি নিশ্চয়ই। তবে মানুষ আলাদা হয় পায়ের নাম্বারে নয়; মগজের ঘিলুতে। যা বোঝেন না, তা নিয়ে কতা বলবেন না মহ্যায়।

দিগা কলিযুগের বর্ণনা দিল :

“বাদহিঁ শূদ্র দ্বিজত্ব সন, হম তুম্ব সে খাটি।

জানহি ব্ৰহ্ম সো বিপ্রবর, আঁটি দেখারহিঁ ডাটি।”

মানেটা! মানেটা!

অধৈর্য গলায় ভুচু বলল।

শূদ্র ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা করে, এই আপনারা যেমন করছেন, ভাবখানা; আমি তোমার চেয়ে কম কিসে? হাম কিসীসে কম নেহি। সকলেরই ধারণা কলিকালে এইরকমই হয়, তখন মানুষ মনে করে যে, যে ব্রহ্মকে জানে, সেই-ই ব্রাহ্মণ। এ কথা বলে, সগর্বে চোখে রাঙায়।

ভুচু এবার তান্ত্রিককে নিয়ে পড়ল।

বলল, এবার আপনি কিছু বাণী-টানি দিন স্যার। আমরা সব স্পয়েল্ট-বেঙ্গলি, এমন রিয়েল, রয়্যাল বেঙ্গলির দেখা তো রোজ রোজ পাই না। তবে, আপনার লাইনটা ভাল। কারণবারি, মেয়েছেলে; ভোগের লাইন। ভোগের মধ্যে দিয়েই ভগবানকে ভাগ করে খান আপনারা।

ধর্ম বা ধর্মর আলোচনার এক্তিয়ার সকলের জন্যে নয় বৎস! এ বালখিল্যদের ক্রীড়াভূমি নয়। এতে প্রবেশ করার আগে শুদ্ধ হতে হয়।

কী? সেদ্ধ?

আঃ। কেরেস্তান! সেদ্ধ নয়, শুদ্ধ। চুপ করো তুমি!

আরে বাবা! ও পৃথুদা! এ যে চোখও রাঙায় দেখি।

গিরিশদা বললেন, তান্ত্রিককে শান্ত করে; এবার আপনি আমাদের কিছু বলুন জয়নগর স্যার। একটু আগেই বললেন যে আপনার সাধনাতে কারণবারি আর যোনির জয়জয়কার। কিছু শুনিয়ে আমাদের মতো অর্বাচীন বালখিল্যদের ধন্য করুন। আপনাদের রকম সকম…

কী বলব! কাদের বলব! উলুবনে মুক্তো ছড়ানো।

যাই-ই হোক, রোজ তো আর দেখা হবে না। বলুন কিছু।

শুনুন তাহলে, সামান্যই বলি। পান করার ব্যাপারে আমাদের শাস্ত্র বলেনঃ

“পীত্বা পীত্বা পুনঃ পীত্বা যাবৎ পততি ভূতলে॥

উথ্বয় চ পুনঃ পীত্ব পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে॥”

মানে কী হল?

দিগার ভাষা ল্যাটিন আর আপনারটা তো জার্মান।

ভুচু বলল।

তান্ত্রিক চোখ লাল করে একবার তাকালেন ভুচুর দিকে তারপর বললেন, একটু বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু। পান-পাত্রর পর পান-পাত্র, চোঁ চোঁ করে খেয়ে যাবে কারণবারি।

আহা!

সাবীর মিঞা বললেন, এই মামলাতে আমারও কিছু পেশ করার ছিল :

“দস্ত এ সাকী সে (অগর্‌) শরাব মিলে

শ হঁজোকা মুঝে শাবাব্‌ মিলে

খুম্‌ পেখুম্‌ ভরকে ম্যাঁ পিঁউ জাহিদ্‌

আচ্ছি হো, ইয়া খরাব মিলে।

দস্ত্‌এ সাকী সে (অগর্‌) শরাব মিলে…

কেয়াবাৎ! কেয়াবাৎ! করে উঠল পৃথু আর ভুচু।

এবার তান্ত্রিক বললেন, এটা আবার কী ভাষা? মানে কী?

গিরিশদা বললেন, আমি এর তর্জমা করে ফেলেছি বাংলাতে। শোনাই?

জরুর। জরুর। বললেন, সাবীর সাহেব।

“প্রিয়া যদি গোলাপ-কুঁড়ি হাতে/

দেয় আমাকে রঙীন সুরা ঢেলে/

শতবারের হজযাত্রার পুঁজি আমার ঠিকই এক লহমায় মেলে।/

ভালমন্দর বিচার করে কেবা?

দেয় যদি সে নিজের হাতেই ঢেলে।” প্রিয়া যদি গোলাপ-কুঁড়ি হাতে/ দেয় আমাকে রঙীন সুরা ঢেলে

ওয়াহ! ওয়াহ!

ভুচু বলল, এবার স্যার, আপনারটার মানে বলুন। মিস্টার তাঁন্‌তি।

মিস্টার তাঁন্‌তি নয়। আমি তান্ত্রিক। আমার পুরো নাম রূপক চক্রবর্তী।

ওই হলো। বলুন মানেটা। মিস্টার চক্রবর্তী।

পানের পর পান করে যাবে। সুরাপান করতে করতে ভূতলে পতিত না-হওয়া পর্যন্ত বারংবার পান করতেই থাকবে। পান করতে করতে মাটিতে পড়ে গেলেও সেখান থেকে উঠে পড়ে পুনরায় পান করতে থাকবে। এইরকম করলে তবেই, বৎস, তোমার আর পুনর্জন্ম হবে না। তোমার আত্মা চিরমুক্ত হবে।

ভুচু বলল, আরও কিছু শোনান ফাদার।

ফাদার নই আমি। বলেছি আপনাকে, আমি তান্ত্রিক। আমার ক্রোধের কারণ ঘটাবেন না। বিপদ হবে।

না। না। আর কিছু বলব না। কিন্তু বলুন।

শুনুন : তবে হজম করতে পারবেন তো?

“মাতৃযোনি পরিত্যাজ্যং সর্বযোনিশ্চ তাড়য়েৎ।

দ্বাদশাত্বাধিকা-যোনিং যাবৎ ষষ্ঠাং সমাপয়েৎ।

প্রত্যহং পূজয়েদ যোনিং পঞ্চতত্ত্বৈ বিশেষতঃ।

যোনিদর্শনমাত্রেন তীর্থ কোটিফলং লভেৎ॥”

এই বম্‌-শেল শুনে পৃথুর মুখ লাল হয়ে উঠল। গিরিশদা চঞ্চল হয়ে উঠলেন। সাবীর মিঞা উৎসুক। ভুচুও বোকা-বোকা।

মানে কী?

ভুচু বলল।

ভুচু আর সাবীর মিঞা কিছুমাত্র বুঝতে পারেনি।

মানে হচ্ছে, হিন্দীতেই বললেন তান্ত্রিক; কেবলমাত্র মাতৃযোনি পরিত্যাগ করিয়া অন্য সমস্ত কুলযুবতীর যোনিতেই তাড়না প্রশস্ত। বারো বছরের বেশি বয়সী হলেই চলবে, সেই সব কুলযুবতীদের যোনিপীঠে সাধক নিজের ষাট বছর বয়স পর্যন্ত পঞ্চতন্ত্র দ্বারা যথাবিধানে পূজা করিবে।

যোনিপীঠ দর্শনমাত্রই কোটিতীর্থ দর্শনের লাভ হয়।

এই মহামারণ স্তোত্র শুনিবামাত্র বৃক্ষতলে, প্রস্তরাসীন বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মনুষ্যগণের বাক্‌রোধ হইয়া গেল।

প্রথমে ভাঙা গলায় কথা বললেন, সাবীর মিঞা। বললেন, পইলে কিসীসে বাঁতায়া নেহী থা মুঝে। ধরম্ হো তো অ্যায়্‌সা। ম্যায় তো হিন্দুই বন্ যায়ে গা।

তওবা! তওবা! ঈ ক্যা গুনাহ্ কী বাত কর রহে হেঁ আপ্‌?

বলেই ভুচু বকে দিল সাবীর মিঞাকে।

তারপর গিরিশদাকে বলল, কত বছরে রিটায়ার করলেন আপনি দাদা চাকরি থেকে?

আটান্ন।

এখন কত বয়স হল?

মাত্র দু’ বছর আছে দাদা। টাইম ইজ রানিং আউট। যা যা করার দু’ বছরের মধ্যে করে ফেলুন। কোটিতীর্থলাভের সুযোগ আপনার আর বেশি বাকি নেই।

তুমি এক থাপ্পড় খাবে আমার কাছে ছোক্‌রা।

ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন গিরিশদা। পৃথুরও রাগ হচ্ছিল। কিন্তু কার উপরে যে রাগটা করবে তা বুঝতে পারছিল না। খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে, কিংকর্তব্যবিমূঢ়; তাই-ই হয়েছিল ও। এমন শ্লোক যে সত্যিই কোনও শাস্ত্রে আছে হিন্দুদের তা বিশ্বাস হচ্ছিল না। মিনমিন করে ও বলল, এ কোন শাস্ত্র আওড়ালেন চক্রবর্তী মশায়?

কেন? যোনিতন্ত্রম। যোনিতন্ত্রম-এর দ্বিতীয় পটল থেকে।

1 Comment
Collapse Comments
পর্দা করা ফরজ December 15, 2022 at 12:01 pm

শেষ দিকটা জঘন্য

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *