৩৫. খায়বার ও ওয়াদিল কুরা যুদ্ধ (মুহাররম, ৭ম হিজরী)

যুদ্ধের কারণ (سَبَبُ الْغَزْوَةِ):

খায়বার ছিল মদীনার উত্তরে আশি (৮০) কিংবা ষাট মাইল দূরত্বে অবস্থিত একটি বড় শহর। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন সেখানে একটি দূর্গ ছিল এবং চাষাবাদেরও ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে সেটি একটি জন বসতি এলাকায় পরিণত হয়েছে। এখানকার আবহাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য তেমন উপযোগী নয়।

হুদায়বিয়াহর সন্ধির ফলে রাসূলে কারীম (ﷺ) যখন আহযাব যুদ্ধের তিনটি শক্তির মধ্যে সব চাইতে শক্তিশালী দল কুরাইশদের শত্রুতা থেকে মুসলিমগণকে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত মনে করলেন, তখন অন্য দু’টি শক্তি ইহুদী ও নাজদ গোত্রসমূহের সঙ্গেও একটি সমঝোতায় আসার চিন্তাভাবনা করতে থাকলেন। উদ্দেশ্য ছিল এ সকল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শত্রুতা ও বৈরীভাব পরিহারের মাধ্যমে মুসলিমগণের শান্তি ও স্বস্তিপূর্ণ নিরাপদ জীবন যাপন এবং ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে অধিক পরিমাণে আত্মনিয়োগ।

যেহেতু খায়বার ছিল বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারী ও কোন্দলকারীদের আড্ডা, সৈনিক মহড়ার কেন্দ্র এবং প্ররোচনা, প্রবঞ্চনা ও যুদ্ধের দাবানল সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু সেহেতু এ স্থানটি সর্বাগ্রে মুসলিমগণের মনোযোগদানের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এ প্রসঙ্গে এখন একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে, খায়বার সম্পর্কে মুসলিমগণের যে ধারণা তা যথার্থ ছিল কি না, এ ব্যাপারে মুসলিমগণের ধারণা যে যথার্থ ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কারণ, এ খায়বারবাসী খন্দক যুদ্ধে মুশরিক শক্তিগুলোকে সংগঠিত করে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে লিপ্ত হতে সাহায্য এবং উৎসাহিত করেছিল। তাছাড়া, মুসলিমগণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য এরাই বনু কুরাইযাহকে সর্বতোভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অধিকন্তু, এরাই তো ইসলামী সমাজের পঞ্চম বাহিনীভুক্ত মুনাফিক্বদের সঙ্গে, আহযাব যুদ্ধের তৃতীয় শক্তি বনু গাত্বাফান এবং বেদুঈনদের সঙ্গে অনবরত যোগাযোগ রেখে চলছিল এবং নিজেরাও যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। তাঁরা তাদের এ সমস্ত কার্যকলাপের মাধ্যমে মুসলিমগণের একটা চরম অস্বস্তিকর অবস্থা ও অগ্নি পরীক্ষার মধ্যে নিপতিত করেছিল। এমন কি নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র তারা করেছিল। এ সমস্ত অস্বস্তিকর অবস্থার প্রেক্ষাপটে অন্যন্যোপায় হয়ে মুসলিমগণ বার বার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ সকল যুদ্ধের মাধ্যমে কোন্দল সৃষ্টিকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের নেতা ও পরিচালক সালামাহ বিন আবিল হুকাইক এবং আসির বিন যারেমকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। অথচ শত্রুমনোভাবাপন্ন ইহুদীদের শায়েস্তা করার ব্যাপারটি মুসলিমগণের জন্য ততোধিক প্রয়োজনীয় ছিল।

কিন্তু এ ব্যাপারে যথাযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণে মুসলিমগণ যে কারণে বিলম্ব করেছিলেন তা হচ্ছে, কুরাইশ মুশরিকগণ ইহুদীদের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী যুদ্ধভিজ্ঞ ও উদ্ধত ছিল এবং শক্তি সামর্থ্যে মুসলিমগণের সমকক্ষ ছিল। কাজেই কুরাইশদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার পূর্বে ইহুদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে শক্তি ও সম্পদ ক্ষয় করাকে নাবী কারীম (ﷺ) সঙ্গত মনে করেন নি। কিন্তু কুরাইশদের সঙ্গে যখন একটা সমঝোতায় আসা সম্ভব হল তখনই ইহুদীদের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়ার অবকাশ তিনি লাভ করলেন এবং তাদের হিসাব গ্রহণের জন্য ময়দান পরিস্কার হয়ে গেল।

 খায়বার অভিমুখে যাত্রা (الْخُرُوْجُ إِلٰى خَيْبَرَ):

ইবনু ইসহাক্ব সূত্রে জানা যায় যে, হুদায়বিয়াহ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলে কারীম (ﷺ) পুরো যিলহাজ্জ মাস এবং মুহাররম মাসের কয়েক দিন মদীনায় অবস্থান করেন। অতঃপর মুহাররম মাসেরই শেষভাগে কোন এক সময়ে খায়বার অভিমুখে যাত্রা করেন। মুফাসসিরগণের বর্ণনা রয়েছে যে খায়বারের ব্যাপারে আল্লাহর যে ওয়াদা ছিল তা নিম্নে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

‏(‏وَعَدَكُمُ اللهُ مَغَانِمَ كَثِيْرَةً تَأْخُذُوْنَهَا فَعَجَّلَ لَكُمْ هٰذِهِ‏)‏ ‏[‏الفتح‏:‏ 20‏]‏

‘আল্লাহ তোমাদেরকে বিপুল পরিমাণ গানীমাতের ও‘য়াদা দিয়েছেন যা তোমরা লাভ করবে। এটা তিনি তোমাদেরকে আগেই দিলেন।’ [আল-ফাতহ (৪৮) : ২০]

এর অর্থ ছিল হুদায়বিয়াহর সন্ধি এবং অনেক গণীমতের সম্পদ এর অর্থ ছিল খায়বার প্রসঙ্গ।

 ইসলামী সৈন্যের সংখ্যা (عَدَدُ الْجَيْشِ الْإِسْلاَمِيْ):

যেহেতু মুনাফিক্বগণ এবং দুর্বল প্রকৃতির মুসলিমগণ হুদায়বিয়াহর সফর হতে বিরত থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র সঙ্গ লাভের পরিবর্তে নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করেছিল সেজন্য আল্লাহ তা‘আলা নাবী (ﷺ)-কে তাদের সম্পর্কে নির্দেশ প্রদান করে বলেন,

‏(‏سَيَقُوْلُ الْمُخَلَّفُوْنَ إِذَا انطَلَقْتُمْ إِلٰى مَغَانِمَ لِتَأْخُذُوْهَا ذَرُوْنَا نَتَّبِعْكُمْ يُرِيْدُوْنَ أَن يُبَدِّلُوْا كَلَامَ اللهِ قُل لَّن تَتَّبِعُوْنَا كَذَلِكُمْ قَالَ اللهُ مِن قَبْلُ فَسَيَقُوْلُوْنَ بَلْ تَحْسُدُوْنَنَا بَلْ كَانُوْا لَا يَفْقَهُوْنَ إِلَّا قَلِيْلًا‏)‏ ‏[‏الفتح‏:‏ 15‏]‏‏.‏

‘তোমরা যখন গানীমাতের মাল সংগ্রহ করার জন্য যেতে থাকবে তখন পিছনে থেকে যাওয়া লোকগুলো বলবে- ‘আমাদেরকেও তোমাদের সঙ্গে যেতে দাও। তারা আল্লাহর ফরমানকে বদলে দিতে চায়। বল ‘তোমরা কিছুতেই আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না, (খাইবার অভিযানে অংশগ্রহণ এবং সেখানে পাওয়া গানীমাত কেবল তাদের জন্য যারা ইতোপূর্বে হুদাইবিয়াহর সফর ও বাই‘আতে রিযওয়ানে অংশ নিয়েছে) এমন কথা আল্লাহ পূর্বেই বলে দিয়েছেন। তখন তারা বলবে- ‘তোমরা বরং আমাদের প্রতি হিংসা পোষণ করছ।’ (এটা যে আল্লাহর হুকুম তা তারা বুঝছে না) তারা খুব কমই বুঝে।’ [আল-ফাতহ (৪৮) : ১৫]

কাজেই রাসূলে কারীম (ﷺ) যখন খায়বার অভিযানের কথা ঘোষণা করলেন তখন ইরশাদ করলেন যে এ অভিযানে শুধু সে সকল ব্যক্তি অংশ গ্রহণ করতে পারবেন যাঁরা প্রকৃত জিহাদের জন্য আগ্রহী। এ ঘোষণার ফলে তাঁর সঙ্গে শুধু সে সকল লোকই যাওয়ার জন্য যোগ্য বিবেচিত হতে পারেন যাঁরা হুদায়বিয়াহর বৃক্ষের নীচে বাইয়াতে রিযওয়ানে শরীক হয়েছিলেন। তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন মাত্র চৌদ্দশত জন।

ঐ সময়ে আবূ হুরাইরাহও (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় আগমন করেছিলেন। এ সময় সিবা’ বিন ‘উরফুতাহ ফজরের জামাতে ইমামত করছিলেন। সালাত সমাপ্ত হলে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) তাঁর খিদমতে উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁর খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। অতঃপর আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিতির জন্য খায়বার অভিমুখে যাত্রা করলেন। তিনি যখন খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হলেন তখন খায়বার বিজয় পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। রাসূলে কারীম (ﷺ) সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)-এর সঙ্গে আলোচনা করে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ)ও তাঁর বন্ধুগণকেও গণীমতের অংশ প্রদান করেন।

 ইহুদীদের জন্য মুনাফিক্বদের ব্যস্ততা (اِتِّصَالُ الْمُنَافِقِيْنَ بِالْيَهُوْدِ):

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খায়বার অভিযানের প্রাক্কালে মুনাফিক্বগণ ইহুদীদের সাহায্যার্থে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মুনাফিক্ব নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই খায়বারের ইহুদীগণের নিকট এ মর্মে সংবাদ প্রেরণ করে যে, ‘এখন মুহাম্মাদ (ﷺ) তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করতে যাচ্ছেন। অতএব, তোমরা হুশিয়ার হয়ে যাও এবং উত্তম প্রস্তুতি গ্রহণ কর। দেখ, তোমরা ভুল কর না যেন। উত্তম প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাক, ভয়ের কিছুই নেই। কারণ, এক দিকে তোমাদের যেমন সংখ্যাধিক্য রয়েছে, অন্যদিকে তেমনি অস্ত্রশস্ত্র এবং মাল সামানও অধিক রয়েছে। কিন্তু মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জনবল যেমন সামান্য, অন্যদিকে তেমনি তিনি প্রায় রিক্তহস্ত তাঁর অস্ত্রশস্ত্র খুব সামান্যই আছে।’

খায়বারবাসী যখন এ সংবাদ অবগত হল তখন বনু গাতফানের সাহায্য লাভের জন্য তারা কেননা বিন আবিল হুক্বাইক্ব এবং হাওয়া বিন ক্বায়সকে সেখানে প্রেরণ করল। কারণ, বনু গাত্বাফান ছিল খায়বারবাসীগণের মিত্র এবং মুসলিমগণের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্যকারী। বনু গাতফানের নিকটে তারা এ প্রস্তাবও পাঠাল যে, যদি তারা মুসলিমগণের বিরুদ্ধে জয়লাভে সক্ষম হয় তাহলে খায়বারের উৎপন্ন দ্রব্যের অর্ধেক তাদের দিয়ে দেয়া হবে।

 খায়বারের পথ (الطَّرِيْقُ إِلٰى خَيْبَرَ):

খায়বার যাওয়ার পথে রাসূলে কারীম (ﷺ) পর্বত অতিক্রম করেন। অতঃপর (ইসরকে ‘আসারও বলা হয়) ‘সাহবা’ নামক উপত্যকা দিয়ে গমন করেন। এরপর রাজী নামক উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছেন। (এ রাযী’ কিন্তু ঐ রাযী’ নয় যেখানে আযাল ও ক্বারাহর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বনু লাহইয়ান গোত্রের হাতে আট জন সাহাবী (রাযি.) শাহাদাত বরণ করেন, যায়দ ও খুবাইব (রাঃ)-কে বন্দী করা হয় এবং পরে মক্কায় শাহাদতের ঘটনা সংঘটিত হয়।)

রাযী’ হতে মাত্র একদিন ও একরাত্রির ব্যবধানে বনু গাত্বাফানের জনবসতি অবস্থিত ছিল। যুদ্ধ প্রস্তুতি সহকারে বনু গাত্বাফান খায়বারবাসীগণের সাহায্যার্থে খায়বার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু পথের মধ্যে তাদের পিছন দিক থেকে কিছু শোরগোল শুনতে পেয়ে তারা ধারণা করল যে, তাদের শিশু ও পশুপালের উপর মুসলিমগণ আক্রমণ চালিয়েছে, এ কারণে তারা খায়বারকে মুসলিমগণের হাতে ছেড়ে দিয়ে পিছন ফিরে চলে।

এরপর রাসূলে কারীম (ﷺ) যে দুজন পথ- অভিজ্ঞ ব্যক্তি যাঁরা সৈন্যদের পথ প্রদর্শনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন- তাঁদের মধ্যে এক জনের নাম ছিল হুসাইল- তাঁদের নিকট থেকে এমন এক পথের খোঁজ জানতে চাইলেন যে পথ ধরে মদীনার পরিবর্তে তার উত্তরদিক দিয়ে সিরিয়ার পথ ধরে খায়বারে প্রবেশ করা যায়। নাবী কারীম (ﷺ)-এর এ কৌশল অবলম্বনের উদ্দেশ্য ছিল শাম রাজ্যের দিকে ইহুদীদের পলায়নের পথ রোধ করা এবং বনু গাত্বাফান থেকে ইহুদীদের সাহায্য প্রাপ্তির পথ বন্ধ করে দেয়া।

একজন পথ-অভিজ্ঞ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ‘আমি আপনাকে সে পথ দিয়ে নিয়ে যাব।’ অতঃপর আগে আগে চলতে থাকলেন। চলার এক পর্যায়ে তাঁরা এমন এক জায়গায় পৌঁছেন যেখান থেকে একাধিক পথ বাহির হয়ে গেছে। তিনি আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ), এ সকল পথ ধরে গিয়ে আপনি গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে পারবেন।’

নাবী (ﷺ) বললেন, ‘প্রত্যেকটি পথের নাম বলে দাও।’

তিনি বললেন, ‘এটির নাম হাযান (কঠিন এবং কর্কশ)। নাবী (ﷺ) এ পথ ধরে যাওয়া পছন্দ করলেন না। দ্বিতীয় পথটির নাম বললেন, ‘শাশ’ (বিযুক্তকরণ এবং চাঞ্চল্যকর) নাবী কারীম (ﷺ) এটাও গ্রহণ করলেন না। তিনি তৃতীয়টির নাম বললেন, ‘হাতিব’ (কাষ্ঠ সংগ্রহকারী) নাবী কারীম (ﷺ) এ পথ ধরে চলতেও অস্বীকার করলেন।

হুসাইল বললেন এখন অবশিষ্ট থাকে আর একটি মাত্র পথ। উমার (রাঃ) বললেন, এ পথটির নাম কী? হুসাইল বললেন, ‘এ পথের নাম ‘মারহাব’। নাবী কারীম (ﷺ) এ পথ ধরে চলা পছন্দ করলেন।

 পথিমধ্যস্থ ঘটনাবলী (بَعْضُ مَا وَقَعَ فِي الطَّرِيْقِ):

সালামাহ বিন আকওয়া’ (রাঃ) বলেছেন যে, নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে একত্রে খায়বার অভিমুখে পথ চলতে থাকলাম। রাতের বেলা আমরা চলছিলাম। এক ব্যক্তি ‘আমিরকে বললেন, ‘হে ‘আমির! তোমার কিছু অসাধারণ কথা কাহিনী আমাদের শুনাচ্ছ না কেন? ‘আমির ছিলেন একজন কবি। এ কথা শুনে তিনি বাহন থেকে অবতরণ করলেন এবং নিজ সম্প্রদায়ের প্রশংসা সম্পর্কে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। কবিতার চরণগুলো ছিল নিম্নরূপ :

اللهم لولا أنت ما اهتديـنا ** ولا تَصدَّقْنا ولا صَلَّيـنـا

فاغـفر فِدَاءً لك ما اقْتَفَيْنا ** وَثبِّت الأقدام إن لاقينـا

وألْـقِينْ سكـينة عــلينا ** إنا إذا صِــيحَ بنا أبينــا

وبالصياح عَوَّلُوا عــلينا **

অর্থ : হে আল্লাহ! যদি তুমি অনুগ্রহ না করতে তাহলে আমরা হিদায়াত পেতাম না, সদকাহ করতাম না, সালাত আদায় করতাম না, আমরা তোমার নিকট উৎসর্গকৃত হলাম, তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও। যতক্ষণ আমরা তাকওয়া অবলম্বন করি এবং যদি যুদ্ধ করি তখন আমাদের কদম মযবুত করে রেখ এবং আমাদের উপর শান্তি বর্ষণ কর। যখন আমাদের ভয় প্রদর্শন করা হয় তখন যেন আমরা অটল হয়ে যাই এবং চ্যালেঞ্জকালীন অবস্থায় আমাদের প্রতি লোকেরা আস্থা রেখেছেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কবিতা আবৃত্তিকারী কে?’

লোকেরা বললেন, ‘‘আমির বিন আকওয়া।’

নাবী কারীম বললেন, ‘আল্লাহ তার উপর রহম করুন।’

সম্প্রদায়ের একজন বললেন, ‘এখন তো তাঁর শাহাদত কার্যকর হয়ে গেল। আপনি তাঁর অস্তিত্বের মাধ্যমে আমাদের উপকৃত হওয়ার সুযোগ কেন দিলেন না।[1]

সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) জানতেন যে যুদ্ধের সময় রাসূলে কারীম (ﷺ) কারো জন্য বিশেষভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তার অর্থই ছিল তাঁর শহীদ হওয়ার ব্যাপারে সুনিশ্চিত হওয়া।[2] খায়বার যুদ্ধে আমেরের ব্যাপারে এ সত্যটি প্রমাণিত হয়েছিল। এ জন্যই সাহাবীগণ আল্লাহর নাবী (ﷺ)-এর দরবারে আরয করলেন যে কেন তাঁর দীর্ঘায়ুর জন্য প্রার্থনা করা হল না যাতে আমরা তাঁর অস্থিত্বের দ্বারা ভবিষ্যতে আরও উপকৃত হতে পারতাম।

খায়বারের সন্নিকটে সাহাবা নামক উপত্যকায় নাবী (ﷺ) আসরের সালাত আদায় করলেন। অতঃপর সামান পত্র চাইলেন। কিন্তু শুধু আনা হল ছাতু এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশে তা মাখানো হল। নাবী (ﷺ) এবং সাহাবাবৃন্দ (রাযি.) সে খাবার খেলেন। এরপর নাবী কারীম (ﷺ) মাগরিব সালাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। অবশ্য সালাতের প্রস্তুতি হিসেবে শুধু কুলি করলেন। সাহাবীগণও (রাঃ) কুলি করলেন। অতঃপর নতুনভাবে অযু না করে সালাত আদায় করলেন।[3] পূর্বের অজুকেই যথেষ্ট মনে করলেন। অতঃপর এশা ওয়াক্তের সালাতও আদায় করলেন।[4]

অগ্রযাত্রার এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনী খায়বারের এত নিকটে গিয়ে উপস্থিত হলেন যে, সেখান থেকে শহর পরিস্কারভাবে দেখতে পাওয়া গেল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাহিনীকে থেমে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করায় তারা থেমে গেলেন। অতঃপর তিনি এ পর্যায়ে প্রার্থনা করলেন,

اللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعِ وَمَا أَظْلَلْنَ ، وَرَبَّ الأَرَضِينِ السَّبْعِ وَمَا أَقْلَلْنَ ، وَرَبَّ الشَّيَاطِينِ وَمَا أَضْلَلْنَ ، وَرَبَّ الرِّيَاحِ وَمَا ذَرَيْنَ ، فَإِنَّا نَسْأَلُكَ خَيْرَ هَذِهِ الْقَرْيَةِ وَخَيْرَ أَهْلِهَا ، وَنَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ أَهْلِهَا وَشَرِّ مَا فِيهَا، اقدموا بسم الله

অর্থঃ হে আল্লাহ্‌! সপ্ত আকাশ এবং যার উপর এর ছায়া রয়েছে তাদের প্রভু এবং সপ্ত জমিন ও যাদের সে উঠিয়ে রয়েছে তাদের প্রভু এবং শয়তানসমূহ এবং যাদেরকে তারা ভ্রষ্ট করেছে তাদের প্রতিপালক আমরা আপনার নিকট এ বসতির মঙ্গল, এর বাসিন্দাদের মঙ্গল এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে তার মঙ্গল প্রার্থনা করছি। এ বসতির অনিষ্টতা, এখানে বসবাসকারীদের অনিষ্টতা এবং এখানে যা কিছু আছে তার অনিষ্টতা হতে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (এরপর বললেন) চল, আল্লাহ্‌র নামে সামনে অগ্রসর হও।[5]

[1] সহীহুল বুখারী খায়বার যুদ্ধ অধ্যায় ৬০৩ পৃঃ, সহীহুল মুসলীম যী কারাদ যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খন্ড ১১৫ পৃঃ।

[2] সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১১৫ পৃঃ।

[3] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬০৩ পৃঃ।

[4] মাগাযী আলওয়াকেদ্দী, খায়বার যুদ্ধ ১১২ পৃঃ।

[5] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩২২ পৃঃ

 খায়বার অঞ্চলে ইসলামী সৈন্যদল (الْجَيْشُ الْإِسْلاَمِيْ إِلٰى أَسْوَارِ خَيْبَرَ):

যে প্রভাতে খায়বার যুদ্ধ আরম্ভ হয় মুসলিম সৈন্যদল তার পূর্ব রাত্রি খায়বারের সন্নিকটে অতিবাহিত করেন। কিন্তু ইহুদীগণ এ ব্যাপারে কোন খবর পায় নি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিয়ম ছিল, কোন সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ পরিচালনা করতে চাইলে সেখানে গিয়ে রাত্রি যাপন করতেন এবং সকাল না হওয়া পর্যন্ত আক্রমণ পরিচালনা করতেন না। এ প্রেক্ষিতে রাত যখন শেষ হওয়ার উপক্রম হল তখন অন্ধকার থাকা অবস্থায় তিনি ফজরের সালাত আদায় করলেন। অতঃপর ঘোড়সওয়ার মুসলিম সৈন্যগণ খায়বার অভিমুখে অগ্রসর হলেন। এদিকে খায়বারবাসীগণ তাদের প্রাত্যহিক কাজের ন্যায় আজও চাষাবাদের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি নিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু অগ্রসরমান মুসলিম সৈন্যদের হঠাৎ দেখতে পেয়ে তারা শহরের দিকে দৌড় দিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করে বলতে থাকল যে, ‘আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর সৈন্য সহকারে এসে গেছেন। নাবী কারীম (ﷺ) এ দৃশ্য দেখে বললেন, ‏(‏اللهُ أَكْبَرُ، خَرِبَتْ خَيْبَرَ، اللهُ أَكْبَرُ، خَرِبَتْ خَيْبَرَ، إِنَّا إِذَا نَزَلْنَا بِسَاحَةِ قَوْمٍ فَسَاءَ صَبَاحُ الْمُنْذَرِيْنَ‏) ‘আল্লাহ আকবর, খায়বার ধ্বংস হল, আল্লাহ আকবর খায়বার ধ্বংস হল। যখন কোন সম্প্রদায়ের ময়দানে অবতরণ করি যাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয় তাদের সকাল মন্দ হয়ে যায়।[1]

[1] সহীহুল বুখারী খায়বার যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খন্ড ৬০৩-৬০৪ পৃঃ।

 খায়বারের দুর্গসমূহ (حُصُوْنُ خَيْبَرَ):

খায়বারের জনবসতি দুটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। একটি অঞ্চলে নিম্নলিখিত পাঁচটি দূর্গ ছিল,

১. নায়িম দূর্গ, ২. সা’ব বিন মু’আয দূর্গ, ৩. যুবাইরের কেল্লা দূর্গ, ৪. উবাই দূর্গ, ৫. নিযার দূর্গ।

এসবের প্রথম তিনটি দূর্গের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে নাত্বাত বলা হত। অবশিষ্ট দু’টি দূর্গের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল শাক্ব নামে প্রসিদ্ধ ছিল।

খায়বারের জনবসতির দ্বিতীয় অঞ্চলকে কাতিবাহ বলা হত। এর মধ্যে মাত্র তিনটি দূর্গ ছিল,

১. ক্বামূস দূর্গ, (এটা বনু নাযীর গোত্রের আবুল হুক্বাইক্বের দূর্গ ছিল)। ২. ওয়াতীহ দূর্গ, ৩. সুলালিম দূর্গ।

উপরি উল্লেখিত ৮টি দূর্গ ছাড়াও খায়বারের ছোট বড় আরও কিছু সংখ্যক দূর্গ এবং ঘাঁটি ছিল। কিন্তু শক্তি সামর্থ্য ও নিরাপত্তার ব্যাপারে এ সকল দূর্গ পূর্বোক্তগুলোর সমপর্যারের ছিল না। তুলনামূলকভাবে এ দূর্গগুলো ক্ষুদ্রাকারের ছিল।

 মুসলিম সেনা শিবির (مُعَسْكَرُ الْجَيْشِ الْإِسْلاَمِيْ):

খায়বার যুদ্ধ প্রথম অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় অঞ্চলের দূর্গ তিনটিতে যোদ্ধাদের আধিক্য থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ ছাড়াই মুসলিমগণের হাতে আত্মসমর্পণ করেছিল।

নাবী কারীম (ﷺ) সৈন্যদের শিবির স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচন করলেন। এ প্রেক্ষিতে হুবাব বিন মুনযির (রাঃ) আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এ কথাটা বলুন যে আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে এ স্থানে শিবির স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন না যুদ্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হিসেবে আপনি এটা করছেন? এটা কি আপনার ব্যক্তিগত অভিমত?

নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘না, এটা হচ্ছে নেহাত একটি অভিমতের ব্যাপার। যুদ্ধের জন্য সুবিধাজনক মনে করেই করা হচ্ছে।’

হুবাব বিন মুনযির (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এ স্থানটি নাত্বাত দূর্গের সন্নিকটে অবস্থিত এবং খায়বারের যুদ্ধ-অভিজ্ঞ সৈনিকগণ এ দূর্গে অবস্থান করছে। সেখান থেকে তারা আমাদের সকল অবস্থা ও অবস্থানের খবর জানতে পারবে, কিন্তু আমাদের পক্ষে তাদের কোন অবস্থার খবর সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। অধিকন্তু, আমরা তাদের নৈশকালীন আক্রমণ থেকেও নিরাপদে থাকব না। তাদের তীর আমাদের নিকট পৌঁছে যাবে কিন্তু আমাদের তীর তাদের নিকট পৌঁছবে না। তাছাড়া, এ স্থানটি খেজুর বাগানের মধ্যে নিচু ভূমিতে অবস্থিত। এ স্থানে রোগ ব্যাধি সংক্রমণেরও আশঙ্কা থাকবে। এ সকল অসুবিধার প্রেক্ষাপটে আপনি এমন কোন স্থানে শিবির স্থাপনের ব্যবস্থা করুন যাতে আমরা এ সকল ক্ষতিকর অবস্থা থেকে মুক্ত থাকতে পারি।’ রাসূলে কারীম (ﷺ) বললেন, ‘তুমি যে পরামর্শ দিলে তা যথার্থ।’ অতঃপর তিনি স্থান পরিবর্তন করে শিবির স্থাপনের নির্দেশ প্রদান করলেন।

অগ্রযাত্রার এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনী খায়বারের এত নিকটে গিয়ে উপস্থিত হলেন যে, সেখান থেকে শহর পরিস্কারভাবে দেখতে পাওয়া গেল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাহিনীকে থেমে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করায় তাঁরা থেমে গেলেন। অতঃপর তিনি এ পর্যায়ে প্রার্থনা করলেন,

‏(‏اللهم رَبُّ السَّمٰوَاتِ السَّبْعِ وَمَا أَظْلَلْنَ، وَرَبُّ الْأَرْضِيْنَ السَّبْعِ وَمَا أَقْلَلْنَ، وَرَبُّ الشَّيَاطِيْنَ وَمَا أَضْلَلْنَ، وَرَبُّ الرِّيَاحِ وَمَا أَذرِيْنَ، فَإِنَّا نَسْأَلُكَ خَيْرَ هٰذِهِ الْقَرْيَةِ، وَخَيْرَ أَهْلِهَا، وَخَيْرَ مَا فِيْهَا، وَنَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ هٰذِهِ الْقَرْيَةِ، وَشَرِّ أَهْلِهَا، وَشَرِّ مَا فَيْهَا، أَقْدِمُوْا، بِسْمِ اللهِ‏)‏‏.‏

অর্থ : হে আল্লাহ! সপ্ত আকাশ এবং যার উপর এর ছায়া রয়েছে তাদের প্রভূ এবং সপ্ত জমিন ও যাদের সে উঠিয়ে রয়েছে তাদের প্রভূ এবং শয়তানসমূহ এবং যাদেরকে তারা ভ্রষ্ট করেছে তাদের প্রতিপালক আমরা আপনার নিকট এ বস্তির মঙ্গল, এর বাসিন্দাদের মঙ্গল এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে তার মঙ্গল প্রার্থনা করছি। এ বসতির অনিষ্টতা, এখানে বসবাসকারীদের অনিষ্টতা এবং এখানে যা কিছু আছে তার অনিষ্টতা হতে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (এরপর বললেন) চল, আল্লাহর নামে সামনে অগ্রসর হও।[1]

[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩২২ পৃঃ।

 যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং খায়বার বিজয়ের সুসংবাদ (التَّهيؤُ لِلْقِتَالِ وَبَشَارَةُ الْفَتْحِ):

যে রাত্রিতে নাবী কারীম (ﷺ) খায়বার সীমানায় প্রবেশ করলেন তখন তিনি বললেন,

(‏لَأَعْطِيَنَّ الرَّايَةَ غَدًا رَجُلاً يُحِبُّ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَيُحِبُّهُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ، ‏[‏يَفْتَحُ اللهُ عَلٰى يَدَيْهِ ‏]‏‏)‏

‘আগামী কাল আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে পতাকা প্রদান করব, যিনি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ভালবাসা রাখেন এবং যাঁকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালবাসেন।’

রাত্রি শেষে যখন সকাল হল তখন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হলেন। প্রত্যেকেরই আশা পতাকা তাঁর হাতেই আসবে। রাসুলে কারীম (ﷺ) বললেন, আলী ইবনু আবূ তালেব কোথায়? সাহাবীগণ (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! তাঁর চোখের পীড়া হয়েছে’’।[1]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘তাঁকে ডেকে নিয়ে এসো।’ তাঁকে ডেকে আনা হল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ মুখ থেকে লালা নিয়ে তা তাঁর চোখে লাগিয়ে দিয়ে দু‘আ করলেন। তিনি এমনভাবে আরোগ্য লাভ করলেন, যেন তাঁর পীড়াজনিত কোন যন্ত্রনা ছিল না। অতঃপর তাঁর হাতে পতাকা প্রদান করা হল। তিনি আরয করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমি তাদের সঙ্গে ঐ সময় পর্যন্ত যুদ্ধ করব যে, তারা আমাদের মতো হয়ে যাবে।’’

নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,

‏(‏اُنْفُذْ عَلٰى رِسْلِكَ، حَتّٰى تَنْزِلَ بِسَاحَتِهِمْ، ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى الْإِسْلَامِ، وَأَخْبِرْهُمْ بِمَا يَجِبُ عَلَيْهِمْ مِنْ حَقِّ اللهِ فِيْهِ، فَوَاللهِ، لَأَنْ يَّهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلًا وَاحِدًا خَيْرٌ لَّكَ مِنْ أَنْ يَّكُوْنَ لَكَ حُمْرُ النِّعَمِ‏)‏‏.‏

‘শান্তির সঙ্গে চল এবং তাদের ময়দানে অবতরণ কর। অতঃপর তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দাও এবং ইসলামের মধ্যে আল্লাহর যে সমস্ত প্রাপ্য রয়েছে যা তাদের কর্তব্য সে সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত কর। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের মাধ্যমে যদি এক জনকেও হিদায়াত দেন তাহলে তোমাদের জন্য তা লাল উটের চাইতেও উত্তম হবে।[2]

[1] সেই অসুখের কারণে তিনি পিছনে পড়েছিলেন, অতঃপর গিয়ে সৈন্যদের সঙ্গে মিলিত হলেন।

[2] সহীহুল বুখারী খায়বার যুদ্ধ ২য় খন্ড ৯০৫-৬০৬ পৃঃ, কোন কোন বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, খায়বারের একটি দূর্গ বিজয়ে একাধিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আলী (রাঃ)-কে পতাকা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হচ্ছে সেটাই যা উপরে উল্লেখিত।

যুদ্ধের শুরু এবং নায়িম দূর্গ বিজয় (بَدْءُ الْمَعْرِكَةِ وَفَتْحُ حِصْنِ نَاعِمٍ):

উল্লেখিত ৮টি দূর্গের মধ্যে সর্ব প্রথম নায়িম দূর্গের উপর আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। কারণ, অবস্থানগত দিক এবং যুদ্ধ কৌশলের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপারে এ দূর্গটি ছিল প্রথম শ্রেণীর ও সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ, অধিকন্তু, এটি ছিল মারহাব নামীয় সে পরাক্রান্ত ও পরিশ্রমী ইহুদীর দূর্গ যাকে এক হাজার পুরুষের সমকক্ষ মনে করা হতো।

আলী বিন আবূ ত্বালিব (রাঃ) মুসলিম সৈন্যদের নিয়ে এ দূর্গের সামনে গিয়ে পৌঁছে ইহুদীদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। তারা এ দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল এবং তাদের সম্রাট মারহাবের পরিচালনাধীনে মুসলিমগণের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য অবস্থান গ্রহণ করল। প্রথমে মারহাব প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মুসলিমগণকে আহবান জানাল।

যার অবস্থা সম্পর্কে সালামাহ বিন আকওয়া বর্ণনা করেছেন যে, ‘যখন আমরা খায়বারে পৌঁছলাম তখন ইহুদী সম্রাট মারহাব স্বীয় তরবারী হস্তে আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করে গর্বভরে বলল,

قد عَلِمتْ خيبر أني مَرْحَب ** شَاكِي السلاح بطل مُجَرَّب

إذا الحروب أقبلتْ تَلَهَّب **

অর্থ : ‘খায়বার অবহিত আছে যে, আমি মারহাব অস্ত্রে সজ্জিত বীর এবং অভিজ্ঞ, যখন যুদ্ধ ও সংঘাত অগ্নিশিখা নিয়ে সামনে আসে।’

এ প্রেক্ষিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আমার চাচা ‘আমির এগিয়ে এসে বললেন,

قد علمت خيبر أني عامر ** شاكي السلاح بطل مُغَامِر

‘খায়বার জানে যে, আমি ‘আমির, অস্ত্র সজ্জিত, বীর এবং যোদ্ধা।’’

অতঃপর উভয়ে উভয়ের প্রতি আঘাত হানে। মারহাবের তরবারী আমার চাচার ঢালে গিয়ে বিদ্ধ হয়। ‘আমির তাকে নীচ হতে মারার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর তরবারী ছোট থাকার কারণে তিনি ইহুদীর পায়ের গোছার উপর আঘাত হানেন। কিন্তু সে আঘাত মারহাবের পায়ে না লেগে তাঁর নিজের হাঁটুতেই এসে লাগে। নিজের তলোয়ারে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েই অবশেষে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। নাবী কারীম (ﷺ) নিজের দুটি আঙ্গুল একত্রিত করে দেখিয়ে তাঁর সম্পর্কে বলেন যে,

‏(‏إنَّ لَهُ لَأَجْرَيْنِ ـ وَجَمَعَ بَيْنَ إِصْبَعَيْهِ ـ إِنَّهُ لَجَاهِدٌ مُجَاهِدٌ، قَلَّ عَرَبِيٌّ مَشٰي بِهَا مِثْلَهُ‏)

‘তিনি দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবেন। তিনি বড় পরিশ্রমী যোদ্ধা ছিলেন। অল্প সংখ্যকই তাঁর মতো কোন আরব জমিনের উপর চলে থাকবে।[1]

যাহোক, ‘আমির (রাঃ)-এর আহত হওয়ার পর মারহাবের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য আলী (রাঃ) গমন করেন।

সালামাহ বিন আকওয়া বর্ণনা করেন, ‘ঐ সময় আলী একটি কবিতার এ চরণ আবৃত্তি করছিলেন,

أنا الذي سمتني أمي حَيْدَرَهْ ** كلَيْثِ غابات كَرِيه المَنْظَرَهْ

أُوفِيهم بالصَّاع كَيْل السَّنْدَرَهْ **

অর্থ : আমি সেই ব্যক্তি আমার মাতা যার নাম রেখেছিলেন হায়দার (বাঘ) বনের বাঘের মতো ভয়ংকর, আমি তাদেরকে ‘সা’ এর বিনিময়ে বর্শার দ্বারা তাদের মাপ পূর্ণ করে দিব।

অতঃপর তিনি মারহাবের মাথার উপর তরবারী দ্বারা এমনভাবে আঘাত করলেন যে, সে সেখানে স্তুপ হয়ে গেল। এভাবে আলী (রাঃ)-এর হাতে বিজয় অর্জিত হল।[2]

যুদ্ধের মাঝে আলী (রাঃ) ইহুদীদের দূর্গের নিকট পৌঁছলেন তখন একজন ইহুদী দূর্গের উঁচু স্থান থেকে উঁকি দিয়ে দেখার পর জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে? আলী (রাঃ) বললেন, ‘আমি আলী বিন আবূ ত্বালিব।’

ইহুদী বলল, ‘সে গ্রন্থের শপথ! যা মুসা (আঃ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল, তোমরা সুউচ্চে রয়েছ।’

এরপর মারহাবের ভাই ইয়াসের এ কথা বলে বাহির হল, ‘কে এমন আছে যে, আমার সামনে আসবে?’

তার এ আহবানে যুবাইর (রাঃ) ময়দানে অবতরণ করেন। তাঁকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেখে তাঁর মা সাফিয়্যাহ (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার পুত্র কি শহীদ হয়ে যাবে?’

নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘না, বরং তোমার ছেলে তাকে হত্যা করবে।’ কিছুক্ষণের মধ্যে আল্লাহর রাসূলের উক্তি সত্য প্রমাণিত হল, যুবাইর (রাঃ) ইয়াসিরকে হত্যা করলেন।

এরপর নায়িম দূর্গের নিকট উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ইহুদী নিহত হয়। অবশিষ্ট ইহুদীগণ হতোদ্যম হয়ে পড়ে যার ফলে মুসলিমগণের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে তারা অক্ষম হয়ে পড়ে। কতগুলো সূত্র থেকে জানা যায় যে, এ যুদ্ধ কয়েক দিন যাবত অব্যাহত ছিল এবং মুসলিমগণকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দূর্গ থেকে মুসলিমগণের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তারা নিরাশ হয়ে পড়েছিল। এ কারণে অত্যন্ত সঙ্গোপনে তারা এ দূর্গ পরিত্যাগ করে সা’ব নামক স্থানে চলে যায়। ফলে নায়িম দূর্গ মুসলমানদের দখলে চলে আসে।

[1] সহীহুল বুখারী খায়বার যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খন্ড ১২২ পৃঃ। যী কারাদ ইত্যাদি যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খন্ড ১১৫, সহীহুল বুখারী খায়বার যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খন্ড ৬০৩ পৃঃ।

[2] মারহাবের হত্যাকারীর নামের ব্যাপারে অনেক মত বিরোধ রয়েছে, তাছাড়া এ তথ্যের মধ্যেও মত বিরোধ রয়েছে যে কোন দিন তাকে হত্যা করা হয়েছিল এবং কোন দিন এ দূর্গ জয় করা হয়েছিল। সহীহাইনের বর্ণনা করেছি তা বুখারীর র্বণনাকে প্রধান্য দিয়ে স্থির করেছি।

 সা’ব বিন মু’আজ দূর্গ বিজয় (فَتْحُ حِصْنِ الصَّعَبِ بْنِ مُعَاذُ):

অত্যন্ত সুরক্ষিত ও মজবুত দূর্গ হিসেবে নায়িম দূর্গের পরেই ছিল সা’ব বিন মু’আয দূর্গের স্থান। মুসলিমগণ হুবাব বিন মুনযির আনসারী (রাঃ)-এর নেতৃত্বাধীনে এ দূর্গের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং তিন দিন যাবত তারা অবরোধ করে রাখেন। তৃতীয় দিবসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ দূর্গের উপর বিজয় লাভের জন্য বিশেষ ভাবে প্রার্থনা করেন।

ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, আসলাম গোত্রের শাখা বনু সাহামের লোকজন, রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন, ‘আমরা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়েছি, আমাদের সহায় সম্পদ বলতে কিছু্ নেই।’ নাবী কারীম (ﷺ) প্রার্থনা করলেন,

‏(‏اللهم إِنَّكَ قَدْ عَرَفْتَ حَالَهُمْ، وَأَنَّ لَيْسَتْ بِهِمْ قُوَّةٌ، وَأَنْ لَّيْسَ بِيَدِيْ شَيْءٌ أُعْطِيْهِمْ إِيَّاهُ، فَافْتَحْ عَلَيْهِمْ أَعْظَمَ حُصُوْنِهَا عَنْهُمْ غَنَاءً، وَأَكْثِرْهَا طَعَامًا وَوَدَكًا‏)

‘হে আল্লাহ! তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে আপনি সব চাইতে বেশী জানেন, আপনি অবশ্যই অবগত রয়েছেন যে, তাঁদের সহায় সম্পদ কিছু নেই এবং আমার নিকটেও এমন কিছু নেই যা দিয়ে আমি তাঁদের সাহায্য করতে পারি। অতএব, ইহুদীদের এমন এক দূর্গের উপর তাঁদেরকে বিজয় দান করুন যা তাঁদের জন্য সকল দিক দিয়ে ফলোৎপাদক হয় এবং যেখান থেকে অধিক খাদ্য ও চর্বি হস্তগত হয়।’

এরপর সাহাবীগণ (রাঃ) প্রবল পরাক্রমে আক্রমণ পরিচালনা করলেন এবং মহান আল্লাহ সা’ব বিন মোয়ায দূর্গের উপর মুসলিমগণকে বিজয় প্রদান করলেন। খায়বারে এমন কোন দূর্গ ছিল না যেখানে এ দূর্গের তুলনায় অধিক খাদ্য ও চর্বি ছিল।[1]

আল্লাহ তা‘আলার দরবারে দু‘আ করার পর নাবী কারীম (ﷺ) যখন এ দূর্গে আক্রমণ পরিচালনার জন্য মুসলিমগণকে নির্দেশ প্রদান করলেন তখন আক্রমণকারীদের মধ্যে বনু আসলাম অগ্রভাগে ছিল। এখানেও দূর্গের সামনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষ হয়। অতঃপর সূর্যাস্ত যাওয়ার পূর্বেই দূর্গটি মুসলিমগণের দখলে আসে। এ দূর্গের মধ্যে মুসলিমগণ কিছু মিনজানীক ও দাববাব[2] যন্ত্রও প্রাপ্ত হন।

ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনায় যে কঠিন ক্ষুধার আলোচনা করা হয়েছে তার ফল হচ্ছে লোকেরা (বিজয় অর্জন হতে না হতেই) গাধা যবেহ করল এবং চুলায় চাপিয়ে দিয়ে তা রান্নার আয়োজন করল। রাসূলে কারীম (ﷺ) যখন এ ব্যাপারটি অবগত হলেন তখন গৃহপালিত গাধার মাংস খেতে নিষেধ করে দিলেন।

[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৩২ পৃঃ।

[2] কাষ্ঠ নির্মিত এবং সুরক্ষিত গাড়ীর ন্যায় নীচে কয়েকজন মানুষ প্রবেশ করে দেওয়ালের নিকটে পৌঁছে শত্রু হতে আত্মরক্ষা করে দূর্গের দেওয়াল ফুটো করতো তাকে দাববাবা বলা হত। বর্তমানে ট্রাঙ্ককে দাববাবা বলা হয়। মিনজানীক এক প্রকার যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা বড় বড় প্রস্তর নিক্ষেপ করা হয়, যাকে তোপ বলা যেতে পারে।

 যুবাইর দূর্গ বিজয় (فَتْحُ قِلْعَةِ الزُّبَيْرِ):

মুসলিমগণ কর্তৃক নায়িম এবং সা’ব দূর্গ বিজয়ের পর নাযাত এর দূর্গসমূহ থেকে বাহির হয়ে ইহুদীগণ যুবাইর দূর্গে একত্রিত হল। এটি ছিল পর্বতের উঁচু চূড়ায় অবস্থিত একটি সুসংরক্ষিত দূর্গ। সেখানে যাওয়ার পথ ছিল এতই দুর্গম এবং কষ্টকর যে ঘোড়সওয়ার তো নয়ই, পদাতিক বাহিনীর পক্ষেও তা ছিল একটি দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ জন্য রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) নির্দেশ দিলেন এর চতুর্দিকে অবরোধ সৃষ্টি করতে। তিন দিন পর্যন্ত এ অবরোধ অব্যাহত থাকল। এরপর একজন ইহুদী এসে বলল, ‘হে আবুল কাসেম! আপনি যদি এক মাস পর্যন্ত এ অবরোধ অব্যাহত রাখেন তবুও তাদের কোন ভয় থাকবে না। তবে সেখানে তাদের পানীয় পানির সমস্যা রয়েছে। কারণ পানির ঝরণা রয়েছে নীচে জমিনে। রাতের বেলা এরা দূর্গ থেকে বেরিয়ে এসে পানি পান করে এবং সংগ্রহ করে নিয়ে দূর্গে ফিরে যায়। কাজেই আপনার আক্রমণ থেকে তারা নিরাপদেই থাকছে। যদি আপনি তাদের পানি বন্ধ করে দেন, তাহলে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।’ এ কথা জানার পর নাবী কারীম (ﷺ) তাদের পানি বন্ধ করে দিলেন। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে ইহুদীগণ দূর্গের বাইরে বেরিয়ে এসে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সংঘর্ষে কয়েকজন মুসলিম শহীদ হন এবং আনুমানিক দশ জন ইহুদী নিহত হয়। দূর্গ মুসলিমগণের দখলে এসে যায়।

 উবাই দূর্গ বিজয় (فتْحُ قِلْعَةِ أُبَيٍّ):

যুবাইর দূর্গের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ইহুদীগণ উবাই দূর্গে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। মুসলিমগণ এ দূর্গেও অবরোধ সৃষ্টি করেন। এ দূর্গের দুজন বীর ও পরিশ্রমী ইহুদী যোদ্ধা দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান দিয়ে একের পর এক ময়দানে অবতরণ করে। এরা দু জনেই মুসলিম বীরদের হাতে নিহত হয়। দ্বিতীয় ইহুদীর হত্যাকারী ছিলেন লাল পট্টিধারী বিখ্যাত তেজস্বী বীর আবূ দোজানা সাম্মাক বিন খারশাহ আনসারী (রাঃ)। দ্বিতীয় ইহুদীকে হত্যা করার পর তিনি অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে দূর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তার সঙ্গে ইসলামী সৈন্যগণও দূর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। দূর্গের অভ্যন্তরে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ বেধে যায় এবং বেশ কিছুক্ষণ ধরে তা চলতে থাকে। কিন্তু ইহুদীগণ মুসলিম বীরদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে দূর্গ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে নিযার দূর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেটি ছিল প্রথম অঞ্চলের শেষ দূর্গ।

 নিযার দূর্গ বিজয় (فَتْحُ حِصْنِ النِّزَارِ):

এটি ছিল এ অঞ্চলের সব চাইতে শক্ত ও মজবুত দূর্গ। ইহুদীদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও এ দূর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা মুসলিমগণের পক্ষে সম্ভব হবে না। এ জন্য তাদের মহিলা ও শিশুদের নিয়ে তারা এ দূর্গ মধ্যে অবস্থান করছিল। পূর্বোল্লিখিত চারটি দূর্গের কোনটিতেই মহিলা ও শিশুদের রাখা হয় নি।

মুসলিমগণ এ দূর্গটিও অবরোধ করলেন এবং প্রবল চাপ সৃষ্টি করে চললেন। কিন্তু যেহেতু দূর্গটি একটি উঁচু পর্বত চূড়ায় অত্যন্ত সুরক্ষিত অবস্থানে ছিল সেহেতু দূর্গের মধ্যে প্রবেশ লাভের কোন সুযোগ মুসলিম সৈন্যরা করে নিতে পারছিলেন না। এদিকে দূর্গের বাহিরে এসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সাহস ইহুদীদের ছিল না। তবে দূর্গের অভ্যন্তর ভাগ থেকেই তারা মুসলিমগণের উপর প্রবলভাবে তীর ও পাথর নিক্ষেপ করে আসছিল।

নিযার দূর্গ জয় করা যখন খুব আয়াসসাধ্য মনে হল তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিনজানীক যন্ত্রটি ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিলেন। কয়েকটি কামানের গোলা আঘাত হানার ফলে তাদের দেয়ালে বেশ বড় আকারে ফাটল সৃষ্টি হয়ে যায়। সে ফাটলের পথ ধরে মুসলমানেরা দূর্গ মধ্যে প্রবেশ করতে সক্ষম হন এবং ইহুদীদের সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এ যুদ্ধে ইহুদীরা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করার পর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দূর্গ ছেড়ে পলায়ন করে। তারা প্রাণভয়ে এতই ভীত হয়ে পড়ে যে, তাদের মহিলা ও শিশুগণকে পিছনে রেখেই পলায়ন করে এবং তাদেরকে মুসলিমগণের দয়ার উপর ছেড়ে যায়। সুরক্ষিত নিযার ঘাঁটি দখলের ফলে খায়বারের প্রথম অর্ধেক অর্থাৎ নাত্বাত ও শিক অঞ্চলের সকল অংশই মুসলিমগণের দখলে চলে আসে। এ অঞ্চলে আরও কিছু সংখ্যক ছোট ছোট দূর্গ ছিল। কিন্তু অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ঘাঁটিগুলো মুসলিমগণের দখলে চলে যাওয়ার ফলে ইহুদীরা ছোট খাট দূর্গগুলো পরিত্যাগ করে এবং পরবর্তী পর্যায়ে খায়বার শহর পরিত্যাগ করে দ্বিতীয় অঞ্চলে অর্থাৎ কাতীবার দিকে পলায়ন করে।

 খায়বারের দ্বিতীয়ার্ধের বিজয় (فَتْحُ الشَّطْرِ الثَّانِيْ مِنْ خَيْبَرَ):

নাত্বাত ও শাক্ব অঞ্চল বিজয়ের পর রাসূলে কারীম (ﷺ) কাতীবা, অতীহ এবং সালালিম অঞ্চলের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। সালালিম বনু নাযির গোত্রের এক প্রসিদ্ধ ইহুদী আবুল হুক্বাইক্বের দূর্গ ছিল। এদিকে নাত্বাত ও শাক্ব অঞ্চলের বিজিত ইহুদীগণ এখানে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং এ দূর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অধিকতর শক্তিশালী এবং সুদৃঢ় করেছিল।

এ তিনটি দূর্গের কোনটিতে যু্দ্ধ হয়েছিল কিনা সে ব্যাপারে যুদ্ধ বিশারদগণের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, কোমুস দূর্গ বিজয়ের জন্য যুদ্ধ করা হয়েছিল এবং বর্ণনাভঙ্গী থেকে এটা বুঝা যায় যে, যুদ্ধের মাধ্যমেই এ দূর্গের উপর মুসলিমগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ দূর্গ স্বেচ্ছায় সমর্পণের ব্যাপারে মুসলিমগণের সঙ্গে ইহুদীদের কোন কথাবার্তা হয়নি।[1]

কিন্তু ওয়াক্বিদী স্পষ্টভাবে দুটি শব্দে প্রকাশ করেছেন যে, এ অঞ্চলের দূর্গ তিনটি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মুসলিমগণের হাতে সমর্পণ করা হয়। সম্ভবত কোমুস দূর্গটি নিয়ে প্রথমাবস্থায় যুদ্ধ হয় এবং তারপর আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। তবে অন্য দুটি যুদ্ধ ছাড়াই মুসলিমগণের হাতে সমর্পণ করা হয়।

অতঃপর মুসলিম বাহিনী কাতীবা গমণ করে সেখানকার অধিবাসীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবরোধ সৃষ্টি করেন। এ অবরোধ চৌদ্দ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। অবরোধ কালে ইহুদীগণ সে সময় পর্যন্ত দূর্গ হতে বাহিরে আসে নি যে পর্যন্ত না রাসূলে কারীম (ﷺ) মিনজানীক যুদ্ধ ব্যবহারের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এ যুদ্ধ ব্যবহারের আশঙ্কায় যখন তারা বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে পড়ল তখন সন্ধির মনোভাব ব্যক্ত করল।

[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৩১, ৩৩৬-৩৩৭ পৃঃ।

 সন্ধির কথাবার্তা (الْمُفَاوَضَةُ):

ইবনু আবিল হুক্বাইক্ব সর্ব প্রথম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এ বলে সংবাদ প্রেরণ করে যে, ‘আমি কি আপনার নিকট আগমণ করে আপনার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারি? নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ’’।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র হ্যাঁ সূচক উত্তর লাভের পর সে তাঁর খিদমতে উপস্থিত হয়ে এ শর্তের ভিত্তিতে সন্ধি করল যে, দূর্গের মধ্যে যে সকল সৈন্য অবস্থান করছে তাদের জীবন রক্ষা করতে হবে, তাদের পরিবারবর্গকে তাদের সঙ্গে থাকতে দিতে হবে (অর্থাৎ তাদেরকে দাসাদাসী বানানো যাবে না), পরিবার পরিজনসহ তাদের খায়বার জমিন ছেড়ে বাইরে যেতে দিতে হবে। তাদের সম্পদাদি, যথা- বাগ-বাগীচা, সোনাদানা, অশ্ব, যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য লৌহবর্ম ইত্যাদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট সমর্পণ করবে। শুধু সে কাপড়গুলো তারা সঙ্গে নিতে পারবে যা মানুষের লজ্জা নিবারণ ও জীবন ধারণের প্রয়োজন হবে।[1]

রাসূল কারীম (ﷺ) বললেন,‏(‏وَبَرِئَتْ مِنْكُمْ ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ رَسُوْلِهِ إِنْ كَتَمْتُمُوْنِيْ شَيْئًا‏)‏ ‘যদি তোমরা আমার নিকট থেকে কিছু গোপন কর তাহলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) দায়িত্ব মুক্ত হবেন।’

ইহুদীগণ এ সকল শর্ত মেনে নেয়ার ফলে মুসলিমগণের সঙ্গে তাদের সন্ধি হয়ে গেল।[2] এ সন্ধির ফলশ্রুতিতে আলোচ্য দূর্গ তিনটি মুসলিমগণের অধিকারে এসে যায় এবং এভাবে খায়বার বিজয় সম্পূর্ণ হয়।

[1] কিন্তু সুনানে আবূ দাউদের মধ্যে এ কথা উল্লেখিত হয়েছে যে, এ শর্তের উপর তিনি সন্ধি চুক্তি করেছিলেন যে, খায়বার ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় নিজ নিজ সওয়ারীর উপর যে পরিমাণ সম্পদ নিয়ে যাওয়া সম্ভব তা নিয়ে যাওয়ার অনুমতি তাদের দেয়া হবে। দ্র: আবূ দাউদ ২য় খন্ড পৃঃ।

[2] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৩৬ পৃঃ।

 ওয়াদা ভঙ্গের কারণে আবুল হুক্বাইক্বের দু’ ছেলের হত্যা (قَتْلُ اِبْنَيْ أَبِيْ الْحُقَيْقَ لِنَقْضِ الْعَهْدِ):

আবুল হুক্বাইক্বের দু’ ছেলে এ সন্ধি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে অনেক সম্পদ গোপনে সরিয়ে নেয়। তারা একটি চামড়াও উধাও করে দেয় যার মধ্যে অনেক সম্পদ এবং হুয়াই বিন আখতাবের অলঙ্কারাদি ছিল। হুয়াই বিন আখতাব মদীনা হতে বনু নাযিরের বিতাড়নের সময় এ সকল অলঙ্কারাদি সঙ্গে এনেছিল।

ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনায় আছে যে, যখন কিনানাহ বিন আবিল হুক্বাইক্বকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট নিয়ে আসা হল, তখন তার নিকট বনু নাযিরের সম্পদ গচ্ছিত ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন তখন সে তার জানার ব্যাপারটি সরাসরি অস্বীকার করে বলল যে, এ গচ্ছিত সম্পদের স্থান সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। এরপর একজন ইহুদী এসে বলল যে, ‘আমি কেনানকে প্রতিদিন এ বিজন প্রান্তরের কোন এক স্থানে ঘোরাফিরা করতে দেখি।’

ইহুদীর এ কথার প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিনানাহকে বললেন, ‏(‏أَرَأَيْتَ إِنْ وَجَدْنَاهُ عِنْدَكَ أَأَقْتُلُكَ‏؟‏‏)‏ ‘এ কথা বল যে, যদি এ গচ্ছিত সম্পদ আমরা তোমার নিকট থেকে বাহির করে নিতে পারি তাহলে তোমাকে হত্যা করব কি না?’

সে বলল, ‘জী হ্যাঁ’।

সাহাবীগণ (রাঃ) সেই প্রান্তর খননের নির্দেশ দিলেন। অতঃপর সেখান থেকে কিছু সম্পদ পাওয়া গেল।

অবশিষ্ট সম্পদ সম্পর্কে নাবী কারীম (ﷺ) তাকে জিজ্ঞাসা করলে আগের মতোই সে অস্বীকার করল। ফলে তার শাস্তি বিধানের জন্য তাকে যুবাইরের হস্তে সমর্পণ করা হল এবং এ কথাও বলা হল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত সম্পদ আমাদের হস্তগত হবে না ততক্ষণ শাস্তিদান অব্যাহত থাকবে।

যুবাইর (রাঃ) চকমকি পাথর দ্বারা তার বক্ষে আঘাত করতে থাকেন যার ফলে জীবন মরণ সন্ধিক্ষণের অবস্থা সৃষ্টি হল তার। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুহাম্মাদ বিন মাসলামার হস্তে তাকে সমর্পণ করেন। তিনি মাহমুদ বিন মাসলামাহর হত্যার বদলাস্বরূপ তার গ্রীবা কর্তন করে তাকে হত্যা করেন। (মাহমুদ ছায়ায় বিশ্রাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে নায়িম দূর্গের দেয়ালের পাশে বসেছিলেন। এমনি সময়ে এ ব্যক্তি তাঁর উপর একটি চাক্কির পাট নিক্ষেপ করে তাঁকে হত্যা করে।)

ইবনুল কাইয়্যেমের বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, রাসূলে কারীম (ﷺ) আবুল হুক্বাইক্বের দু’জন ছেলেকে হত্যা করেছিলেন। ঐ দুজনের বিরুদ্ধে সম্পদ গোপন করার সাক্ষ্য দিয়েছিল কিনানাহর চাচাত ভাই। এরপর রাসূলে কারীম (ﷺ) হুয়াই বিন আখতাবের কন্যা সাফিয়্যাহকে বন্দী করেন। সে ছিল কিনানাহ বিন আবিল হুক্বাইক্বের স্ত্রী এবং তখনো সে নববধূ ছিল এ অবস্থায় তার বিদায় দেয়া হয়েছিল।

 গণীমতের মাল বন্টন (قِسْمَةُ الْغَنَائِمِ):

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইচ্ছা করেছিলেন খায়বার হতে ইহুদীদের বিতাড়িত করতে এবং সেই শর্তেই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। কিন্তু ইহুদীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আরয পেশ করল এ জমিন তাদের থাকতে দেয়ার জন্য। তারা বলল, ‘আমাদের এ জমিনে থাকতে দিন, আমরা এর দেখাশোনা করব। কারণ, এ জমিন সম্পর্কে আপনাদের তুলনায় আমদের দক্ষতা এবং অভিক্ষতা অনেক বেশী। এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং সাহাবীগণ (রাঃ)-এর নিকট এমন দাস ছিল না যারা এ জমিন দেখাশোনা এবং চাষাবাদ ও বুননের কাজকর্ম করতে পারবে। তাছাড়া, সাহাবীগণ (রাঃ)-ও এমন অবসর ছিল না যে, তাঁরা এ সকল কাজকর্ম করতে পারবেন। এ কারণে নাবী কারীম (ﷺ) এ শর্তে খায়বারের ভূমি ইহুদীদের হাত ছেড়ে দিলেন যে সমস্ত ক্ষেত খামার ও বাগ-বাগিচার উৎপাদনের অর্ধাংশ ইহুদীদের দেয়া হবে এবং তিনি যতদিন চাবেন ততদিন এ ব্যবস্থা বজায় থাকবে (যখন প্রয়োজন বোধ করবেন তখন তাদের বিতাড়িত করা হবে) উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ)-কে নিয়োজিত করা হয়।

খায়বারের লব্ধ সম্পদ ছত্রিশ অংশে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়। এর প্রতি অংশ পুনরায় একশত অংশে বিভাজন করে বন্টনের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে মোট সম্পদ বন্টন করা হতো তিন হাজার ছয়শ অংশে। এর মধ্য হতে অর্ধেক অর্থাৎ এক হাজার আটশ অংশ ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং সাহাবীগণের (রাঃ)। সাধারণ মুসলিমগণের মতোই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাত্র একটি অংশ গ্রহণ করতেন। অবশিষ্ট এক হাজার আটশ অংশ (অর্থাৎ দ্বিতীয়ার্ধ) রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) মুসলিমগণের সামাজিক প্রয়োজন এবং আপাৎকালীন সময়ের জন্য পৃথক করে রাখতেন। খায়বারের লব্ধ সম্পদ এ কারণে আঠার শত অংশে বন্টনের ব্যবস্থা ছিল যে, হুদায়বিয়াহয় অংশগ্রহণকারীদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এটা ছিল এক বিশেষ দান। উপস্থিত অনুপস্থিত সকলের জন্যই অংশের ব্যবস্থা ছিল। হুদায়বিয়াহয় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিল চৌদ্দ শত। খায়বার আসার সময় এরা দুশ ঘোড়া সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। যেহেতু আরোহী ছাড়া ঘোড়ারও অংশ নির্ধারিত ছিল এবং প্রতিটি ঘোড়ার জন্য দু’টি অংশ ধার্য ছিল। সেহেতু লব্ধ সম্পদ আঠারশ অংশে বন্টন করা হয়েছিল। দুইশ ঘোড়সওয়ারকে তিন তিন অংশ হিসেবে ছয়শ অংশ এবং বারশ পদাতিককে এক এক অংশ হিসেবে বার শত অংশ সর্ব মোট আঠারশ অংশে বন্টনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।[1]

খায়বারের যুদ্ধ লব্ধ সম্পদের আধিক্যের কথা সহীহুল বুখারীর আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে প্রমানিত হয়েছে। তিনি এ কথাও বলেছেন, যে পর্যন্ত না খায়বার বিজয় করতে আমরা সক্ষম হয়েছিলাম সে পর্যন্ত পরিতৃপ্তি হতে পারিনি। অনুরূপ প্রমাণ আয়িশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসেও পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘যখন খায়বার যুদ্ধে মুসলিমগণ বিজয়ী হলেন তখন আমরা বললাম এখন পেট পুরে খেজুর খেতে পারব।[2]

[1] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৩৭-১৩৮ পৃঃ, ব্যাখ্যাসহ ।

[2] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬০৯ পৃঃ।

 জা’ফর বিন আবূ ত্বালিব এবং আশয়ারী সাহাবাদের আগমন (قُدُوْمُ جَعْفَرَ بْنِ أَبِيْ طَالِبٍ وَالْأَشْعَرِيِّيْنَ)

সেই যুদ্ধের মধ্যে জা’ফর বিন আবূ ত্বালিব (রাঃ) খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আশয়ারী মুসলিমগণ অর্থাৎ আবূ মুসা (রাঃ) এবং তাঁর বন্ধুগণ (রাঃ)।

আবূ মুসা আশয়ারী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমরা যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে অবগত হলাম তখন আমাদের সম্প্রদায়ের পঞ্চাশ জন লোকসহ আমার ভাই ও আমি হিজরতের উদ্দেশ্যে একটি নৌকা করে যাত্রা করলাম খিদমতে নাবাবীতে পৌঁছার জন্য। কিন্তু আমাদের নৌকাটি নাজ্জাশীর দেশে নিয়ে গিয়ে আমাদের নামিয়ে দিল। জা’ফার (রাঃ) এবং তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে সেখানেই আমাদের সাক্ষাত হয়। তিনি বললেন যে, রাসূলুল্লাহ আমাদের এখানে প্রেরণ করেছেন, আপনারাও আমাদের সঙ্গে অবস্থান করুন। এ প্রেক্ষিতে আমরাও তাঁদের সঙ্গে অবস্থান করলাম এবং খিদমতে নাবাবীতে সে সময় পৌঁছতে পারলাম যখন তিনি খায়বার বিজয় করেছেন। নাবী কারীম (ﷺ) জা’ফার (রাঃ) ও তাঁর বন্ধুদের এবং আমাদের সঙ্গে আগত নৌকার আরোহীদের জন্যও গনীমতের অংশ নির্ধারণ করেছিলেন।[1] এছাড়া যাঁরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন নি তাঁদের জন্য কোন হিসসা নির্ধারণ করা হয় নি।

জা’ফার (রাঃ) যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হলেন তখন তিনি তাঁকে খোশ আমদেদ জানিয়ে চুম্বন করে বললেন, ‏ (‏وَاللهُ مَا أَدْرِيْ بِأَيِّهِمَا أَفْرَحُ‏؟‏ بِفَتْحِ خَيْبَرَ أَمْ بِقُدُوْمِ جَعْفَرَ‏)‏‏ ‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না যে, আমার অধিক আনন্দ কিসের, খায়বার বিজয়ের না জাফরের আগমনের? [2]

এটা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এ সকল লোকজনকে নিয়ে আসার জন্য রাসূলে কারীম (ﷺ) ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী (রাঃ)-কে নাজ্জাশীর নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁকে বলে পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি যেন ঐ সকল লোকজনকে তাঁর নিকট পাঠিয়ে দেন। ফলে নাজ্জাশী দুটি নৌকা করে তাঁদের মদীনার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন। এরা ছিলেন সর্বমোট ষোল জন। অধিকন্তু, কিছু সংখ্যক মহিলা এবং শিশুও ছিল সে দলে, আর অন্যান্য যাঁরা ছিলেন তাঁরা এর পূর্বেই মদীনায় ফিরে এসেছিলেন।[3]

[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৪৪৩ পৃঃ, ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৪৮৪-৪৮৭ পৃঃ।

[2] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৩৯ পৃঃ।

[3] তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ১২৮ পৃঃ।

সাফিয়্যাহর সঙ্গে বিবাহ (الزَّوَاجُ بِصَفِيَّةَ):

পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে, সাফিয়্যাহর স্বামী কিনানাহ বিন আবিল হুক্বাইক্ব স্বীয় অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে মুসলিমগণের হাতে নিহত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী সাফিয়্যাহকে বন্দী মহিলাদের দলভুক্ত করা হয়। এরপর যখন এ বন্দী মহিলাদের একত্রিত করা হয় তখন দাহয়াহ বিন খলীফা কালবী (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর নাবী! বন্দী মহিলাদের থেকে আমাকে একটি দাসী প্রদান করুন।’

নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‏(‏خُذْ جَارِيَةً مِّنَ السَّبِيِّ غَيْرِهَا‏)‏ ‘তাদের মধ্য থেকে একজনকে মনোনীত করে নিয়ে যাও।’ তিনি সেখানে গিয়ে তাদের মধ্যে থেকে সাফিয়্যাহ বিনতে হুয়াইকে মনোনীত করেন। এ প্রেক্ষিতে এক ব্যক্তি নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! বনু কুরাইযাহ ও বনু নাযীর গোত্রের সাইয়েদা সাফিয়্যাহকে আপনি দাহয়াহর হাতে সমর্পণ করলেন, অথচ সে শুধু আপনার জন্য শোভনীয় ছিল।

নাবী (ﷺ) বললেন, ‘সাফিয়্যাহসহ দেহয়াকে এখানে আসতে বল।’

দাহয়াহ যখন সাফিয়্যাহকে সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হলেন তখন তিনি বললেন, ‘বন্দী মহিলাদের মধ্য থেকে তুমি অন্য একজনকে দাসী হিসেবে গ্রহণ কর।’

অতঃপর নাবী (ﷺ) নিজে সাফিয়্যাহর নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁকে মুক্ত করে দিয়ে তাঁর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। তাঁর এ মুক্ত করাকে বিবাহে তাঁর জন্য মাহর নির্ধারণ করা হয়।

মদীনা প্রত্যাবর্তন কালে সাদ্দে সাহবা নামক স্থানে পৌঁছলে সাফিয়্যাহ (রাঃ) হালাল হয়ে গেলেন। তখন উম্মু সুলাইম (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর জন্য তাঁকে সাজগোজ ও শৃঙ্গার সহকারে প্রস্তুত করে দিলেন এবং বাসর রাত্রি যাপনের জন্য প্রেরণ করলেন। দুলহা হিসেবে তাঁর সঙ্গে সকাল পর্যন্ত অবস্থান করলেন। অতঃপর খেজুর, ঘী এবং ছাতু একত্রিত করে ওয়ালীমা খাওয়ালেন এবং রাস্তায় দুলহা দুলহানের রাত্রি যাপন হিসেবে তিন দিন তাঁর সঙ্গে অবস্থান করলেন।[1] ঐ সময় নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর মুখমণ্ডলের উপর শ্যামল চিহ্ন দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ওটা কী?

তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার খায়বার আগমনের পূর্বে আমি স্বপ্নযোগে দেখেছিলাম যে, চাঁদ তার কক্ষচ্যুত হয়ে এসে পড়ল আমার কোলের উপর। আল্লাহ তা‘আলাভ জানেন, আপনার সম্পর্কে আমার কোন কল্পনাও ছিল না। কিন্তু আমার স্বামীর নিকট যখন এ স্বপ্ন বৃত্তান্ত বর্ণনা করলাম তখন তিনি আমার মুখে এক চপেটাঘাত করে বললেন, ‘মদীনার বাদশাহর প্রতি তোমার মন আকৃষ্ট হয়েছে।[2]

[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৪ পৃঃ, ২য় খন্ড ৬০৪-৬০৬ পৃঃ,, যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৩৭ পৃঃ।

[2] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৩৭ পৃঃ, ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৩৬ পৃঃ।

 বিষাক্ত বকরির ঘটনা (أَمْرُ الشَّاةِ الْمَسْمُوْمَةِ):

খায়বার বিজয়ের পর যখন রাসূলে কারীম (ﷺ) নিরাপদ হলেন এবং তৃপ্তিবোধ করলেন তখন সালাম বিন মুশরিকের স্ত্রী যায়নাব বিনতে হারিস উপঢৌকন হিসেবে বকরির ভূনা মাংস তাঁর নিকট প্রেরণ করে। সে বিভিন্ন সূত্র থেকে জিজ্ঞাসার মাধ্যমে জেনে নিয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বকরির মাংসের কোন কোন অংশ অধিক পছন্দ করেন। তাকে বলা হয়েছিল যে, তিনি রানের মাংস অধিক পছন্দ করেন। এ জন্য সে রানের মাংসগুলো ভাল ভাবে বিষ মিশ্রিত করেছিল এবং অবশিষ্ট অন্যগুলোতেও বিষ প্রয়োগ করেছিল। অতঃপর সে মাংসগুলো নাবী কারীম (ﷺ)-এর সামনে এনে রাখা হলে নাবী কারীম (ﷺ) রানের মাংসের টুকরোটি উঠিয়ে তার কিছু অংশ চিবুনোর পর মুখ থেকে বের করে তা ফেলে দিলেন এবং বললেন,‏ (‏إِنَّ هٰذَا الْعَظْمُ لَيُخْبِرُنِيْ أَنَّهُ مَسْمُوْمٍ‏)‏‘এ হাড্ডি আমাকে বলছে যে এর সঙ্গে বিষ মিশ্রিত করা হয়েছে।’

এরপর নাবী কারীম (ﷺ) যায়নাবকে ডাকিয়ে নিয়ে তাকে যখন বিষয়টি জিজ্ঞেস করলেন তখন সে বিষ প্রয়োগের কথা স্বীকার করল। তিনি তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এমন কাজ করলে কেন? সে উত্তরে বলল, ‘আমি চিন্তা করলাম যে, এ ব্যক্তি যদি বাদশাহ হন তাহলে আমরা তাঁর থেকে নিস্কৃতি লাভ করব, আর যদি তিনি নাবী হন তাহলে তাঁকে এ সংবাদ জানিয়ে দেয়া হবে এবং তিনি বেঁচে যাবেন। তার এ কথা শুনে নাবী কারীম (ﷺ) তাকে ক্ষমা করলেন। এ সময় নাবী (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিলেন বিশর বিন বারা’ বিন মারুর (রাঃ)। তিনি এক গ্রাস গিলে ফেললেন। ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।

এ মহিলাকে নাবী (ﷺ) ক্ষমা করেছিলেন কিংবা হত্যা করেছিলেন সে ব্যাপারে বর্ণনাকারীগণের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। মত পার্থক্যের সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, নাবী (ﷺ) প্রথমে মহিলাকে ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু যখন বিশর (রাঃ)-এর মৃত্যু সংঘটিত হয়ে গেল তখন তাকে হত্যার বিনিময়ে হত্যা করা হল।[1]

[1] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৩৯-১৪০ পঃ, ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৪৯৭ পৃঃ, মূল ঘটনা সহীহুল বুখারীতে বিস্তারিত এবং সংক্ষিপ্ত দুভাবে বর্ণিত হয়েছে ১ম খন্ড ৪৪৯ পৃঃ, ২য় ৬১০ ও ৮৬০ পৃ: ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৩৭ ও ৩৩৮ পৃঃ।

 খায়বার যুদ্ধে দু’দলের প্রাণহানি (قَتْلٰى الْفَرِيْقَيْنِ فِيْ مَعَارِكِ خَيْبَرَ):

খায়বারের বিভিন্ন সংঘর্ষে সর্ব মোট শহীদ মুসলিমগণের সংখ্যা ছিল ষোল জন। বনু কুরাইশের চার জন, বনু আশজা’র এক জন, বনু আসলামের এক জন, খায়বার অধিবাসীদের মধ্যে হতে এক জন এবং বাকীরা অন্যান্য আনসার গোত্রের। তাছাড়া আঠার জনের কথাও বলা হয়ে থাকে। আল্লামা মানসুরপুরী ঊনিশ জনের কথা উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তিনি লিখেছেন যে, আমি অন্বেষণ করে তেইশ জনের নাম পেয়েছি। যানীফ বিন ওয়ায়েলার নাম শুধু ওয়াক্বিদী উল্লেখ করেছেন। তাবারী বলেছে্ন শুধু যানীফ বিন হাবীবের নাম। বিশর বিন বারা বিন মারুরের মৃত্যু হয়েছিল যুদ্ধশেষে সে বিষ মিশ্রিত মাংস খাওয়ার ফলে যা যায়নাব ইহুদীয়া পাঠিয়েছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট উপঢৌকনস্বরূপ। বিশর বিন আব্দুল মুনযির সম্পর্কে দুটি বর্ণনা রয়েছে। ১. তিনি বদর যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন, ২. খায়বার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। আমার মতে প্রথম মতটি অধিক শক্তিশালী ও সমর্থনযোগ্য।[1] অন্য পক্ষ অর্থাৎ ইহুদীগণের মৃত্যুর সংখ্যা ছিল তিরানব্বই।

[1] রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ২৬৮-২৭০ পৃঃ।

 ফাদাক (فَـدَك):

খায়বারে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য মুহায়্যিসা বিন মাসউদকে ফাদাক অঞ্চলে ইহুদীদের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। ফাদাকবাসীগণ মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণে প্রথমত ইসলাম গ্রহণের প্রতি তেমন আগ্রহ প্রকাশ করে নি। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যখন খায়বারের ইহুদীদের উপর মুসলিমগণকে বিজয় দান করলেন তখন তারা মনে প্রাণে ভীত হয়ে পড়ল এবং রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর নিকট লোক পাঠিয়ে খায়বারবাসীগণের চুক্তির অনুরূপ ফাদাকের উৎপাদনের অর্ধেক দেয়ার প্রতিশ্রুতিসহ সন্ধিচুক্তির প্রস্তাব করল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সানন্দে এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন যার ফলে অত্যন্ত সহজভাবে ফেদাকের উপর মুসলিমগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিমগণকে ঘোড়া, উট কিংবা তরবারীর ব্যবহার করতে হয় নি।[1]

[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৩৭ ও ৩৫৩ পৃঃ।

 ওয়াদিল কুরা (وَادِيْ القُرٰى):

খায়বার বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মনের দিক দিয়ে যখন কিছুটা মুক্ত হলেন তখন ওয়াদিল কুরা বা কুরা উপত্যকায় গমন করলেন। সেখানে ইহুদীদের একটি দলের বসবাস ছিল। এক পর্যায়ে আরবদের একটি দল গিয়ে তাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল।

মুসলিমগণ যখন কোরা উপত্যকায় অবতরণ করলেন তখন ইহুদীগণ তাঁদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে আক্রমণ করল। তারা পূর্ব হতেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল। তাদের এ আক্রমণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একজন দাস মৃত্যুমুখে পতিত হল। লোকজনেরা বললেন, ‘তার জন্য জান্নাত বরকতময় হোক। নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,

(‏كَلَّا، وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ، إِنَّ الشَّمْلَةَ الَّتِيْ أَخَذَهَا يَوْمَ خَيْبَرَ مِنْ الْمَغَانِمِ، لَمْ تُصِبْهَا الْمَقَاسِمَ، لَتَشْتَعِلُ عَلَيْهِ نَارًا‏)

‘কখনই না। সে সত্তার শপথ! যাঁর হাতে রয়েছে আমার জীবন, খায়বার যুদ্ধে এ ব্যক্তি যুদ্ধ লব্ধ মাল হতে বন্টনের পূর্বেই যে চাদর খানা চুরি করেছিল তা আগুনে পরিবর্তিত হয়ে ওর জন্য দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এ কথা শুনে একটি ফিতা, দুটি ফিতা কিংবা যিনি যে জিনিস গোপনে নিয়ে গিয়েছিলেন সে সব রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর খিদমতে এনে হাজির করলেন। নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‏(‏شِرَاكٌ مِّنْ نَّارٍ أَوْ شِرَاكَانِ مِنْ نَّارٍ‏)‏‏ ‘এ একটি কিংবা দুটি ফিতা ছিল আগুনের।’’[1]

অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) মুসলিম বাহিনীকে যুদ্ধের উপযোগী সুশৃঙ্খলভাবে সারিবদ্ধ করলেন। সমগ্র বাহিনীর পতাকা সা‘দ বিন উবাদাহর হাতে সমর্পণ করলেন। একটি পতাকা দিলেন হুবাব বিন মুনযিরকে এবং তৃতীয় পতাকা দিলেন উবাদাহ বিন বিশরকে। এরপর ইহুদীদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। এ দাওয়াত গ্রহণ না করে তাদের এক ব্যক্তি যুদ্ধের জন্য ময়দানে অবতরণ করল। আল্লাহর নাবী (ﷺ)-এর পক্ষে যুবাইর বিন ‘আউওয়াম (রাঃ) যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করলেন। অতৎপর ইহুদীদের পক্ষ থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। যুবাইর (রাঃ) তাকেও হত্যা করলেন। এরপর তাদের পক্ষ থেকে তৃতীয় ব্যক্তি ময়দানে অবতরণ করলেন। এর সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য আলী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাকে হত্যা করলেন। এভাবে একে একে তাদের ১১ ব্যক্তি নিহত হয়। যখন একজন নিহত হতো তখন নাবী কারীম (ﷺ) অবশিষ্ট ইহুদীগণকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন।

ঐ দিন যখন সালাতের সময় হতো তখন সাহাবাদের নিয়ে নাবী কারীম (ﷺ) সালাত পড়তেন। সালাতের পর পুনরায় ইহুদীদের সামনে ফিরে যেতেন এবং তাঁদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন।

এভাবে যুদ্ধ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিন সকালে পুনরায় গমন করলেন। তখনো সূর্য বর্শা বরাবর উপরে ওঠেনি এমন সময় তাদের হাতে যা কিছু ছিল তা সম্পূর্ণ নাবী কারীম (ﷺ)-এর হাতে সমর্পণ করে দিল। অর্থাৎ নাবী (ﷺ) শক্তি দিয়ে বিজয় অর্জন করেন এবং আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পদসমূহের সবটুকুই নাবী কারীম (ﷺ)-এর হাতে গণীমত হিসেবে প্রদান করেন। বহু সাজ-সরঞ্জামাদি সাহাবীগণ (রাযি.)-এর হস্তগত হয়।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওয়াদিল কুরা নামক স্থানে চার দিন অবস্থান করেন এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সাহাবীগণ (ﷺ)-এর মধ্যে বন্টন করে দেন। তবে জমিজমা খেজুরের বাগানগুলো ইহুদীদের হাতেই ছেড়ে দেন এবং খায়বারবাসীগণের অনুরূপ ওয়াদিল কোরাবাসীগণের সঙ্গেও একটি চুক্তি সম্পাদন করেন।[2]

[1] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬০৮ পৃঃ।

[2] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৪৬ পৃঃ।

 তাইমা (تَيْمَـــاء):

তাইমার ইহুদীগণ যখন খায়বার, ফাদাক এবং ওয়াদিল কুরার অধিবাসীদের পরাভূত হওয়ার খবর পেল তখন তারা মুসলিমগণের বিরুদ্ধে শক্তির মহড়া প্রদর্শন ছাড়াই সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দূত প্রেরণ করল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের সন্ধি প্রস্তাব গ্রহণ করে সম্পদাদি সহ বসবাসের অনুমতি দেন।[1] অতঃপর তাদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেন যার ভাষা ছিল নিম্নরূপ:

‘এ দলিল লিখিত হল আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে বনু আদিয়ার জন্য। তাদের উপর কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হল এবং মুসলিমগণ তাদের জিম্মাদা হলেন। তাদের উপর কোন প্রকার অন্যায় করা হবে না এবং দেশ থেকে তাদের বিতাড়িত করা হবে না। রাত্রি হবে তাদের সাহায্যকারী এবং দিন হবে পূর্ণতা প্রদান কারী (অর্থাৎ এ চুক্তি হবে স্থায়ী ব্যবস্থা) এ চুক্তি লিপিবদ্ধ করেন খালিদ বিন সাঈদ।[2]

[1] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৪৭ পৃঃ।

[2] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৪০ পৃঃ। এ ঘটনা বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ এবং সাধারণ হাদীস পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে। যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৪৭ পৃঃ।

 মদীনা প্রত্যবর্তন (الْعَوْدَةُ إِلَى الْمَدِيْنَةِ):

তাইমায়াবাসীগণের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের পর নাবী কারীম (ﷺ) মদীনা প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। প্রত্যাবর্তনকালে লোকজনেরা একটি উপত্যকার নিকট পৌঁছে সকলে উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকেন ‏(‏اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ‏)‏ ‘আল্লাহ আকবর, আল্লাহ আকবর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। তা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‏(‏إِرْبَعُوْا عَلٰى أَنْفُسِكُمْ، إِنَّكُمْ لاَ تَدْعُوْنَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا، إِنَّكُمْ تَدْعُوْنَ سَمِيْعًا قَرِيْبًا‏)‏‏ ‘স্বীয় আত্মার প্রতি কোমলতা প্রদর্শন কর। তোমরা কোন বধির কিংবা অনুপস্থিতকে আহবান করছ না, বরং সে সত্তাকে আহবান করছ যিনি শ্রবণ করছেন এবং নিকটে রয়েছেন।[1]

পথ চলার সময় একবার রাত্রি বেলা দীর্ঘ সময় যাবত চলার পর রাত্রির শেষভাগে পথের মধ্যে কোন এক জায়গায় শিবির স্থাপন করলেন এবং শয্যা গ্রহণের সময় বিলাল (রাঃ)-কে এ বলে তাগাদা দিয়ে রাখলেন যে, ‘রাত্রিতে আমাদের প্রতি খেয়াল রেখ (অর্থাৎ প্রত্যুষে আমাদের জাগিয়ে দিও)।’ কিন্তু বিলাল (রাঃ) ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তিনি পূর্ব দিকে মুখ করে নিজ সওয়ারীর উপর হেলান দিয়ে বসেছিলেন এবং সে ভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। রাত্রি শেষে সকলের গায়ে রোদের অাঁচ লাগলেও কেউই ঘুম থেকে জাগতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ সর্ব প্রথম ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং সকলকে ঘুম থেকে জাগ্রত করেন। নাবী (ﷺ) সে উপত্যকা হতে বাহির হয়ে সামনের দিকে কিছুদূর অগ্রসর হন। অতঃপর লোকজনদের ফজরের সালাতের ইমামত। বলা হয়ে থাকে যে, এ ঘটনাটি অন্য কোন সফরে ঘটেছিল।[2]

খায়বার সংঘর্ষের বিস্তারিত বিবরণাদি লক্ষ্য করলে জানা যায় যে, নাবী কারীম (ﷺ)-এর মদীনা প্রত্যাবর্তন হয় ৭ম হিজরী সফর মাসের শেষ ভাগে কিংবা রবিউল আওয়াল মাসে।

[1] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬০৫ পৃঃ।

[2] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৪০ পৃঃ। এ ঘটনা বিশেষ ভাবে প্রসি্দ্ধ এবং সাধারণ হাদীস পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে। যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৪৭ পৃঃ।

 সারিয়্যায়ে আবান বিন সা’ঈদ (سَرِيَّةُ أبَانِ بْنِ سَعِيْدٍ):

সেনাধ্যক্ষগণের তুলনায় নাবী কারীম (ﷺ) অধিক গুরুত্বের সঙ্গে এ কথা বলতেন, যে হারাম মাসগুলো শেষ হওয়ার পর মদীনাকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রাখা কোন ক্রমেই দূরদর্শিতা কিংবা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মদীনার আশেপাশে এমন সব বেদুঈনদের অবস্থান ছিল যারা লুটতরাজ এবং ডাকাতি করার জন্য সব সময় মুসলিমগণের অমনোযোগিতাজনিত সুযোগের অপেক্ষায় থাকত। এ কারণে তাঁর খায়বার অভিযানের প্রাক্কালে বেদুঈনদের ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আবান বিন সাঈদের (রাঃ) নেতৃত্বে নাজদের দিকে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। আবান বিন সাঈদ তার উপর আরোপিত দায়িত্ব পালন শেষে প্রত্যাবর্তন করলে খায়বারে নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয়। ঐ সময় খায়বার বিজয় পর্ব শেষ হয়েছিল। অধিকতর বিশুদ্ধ তথ্য হচ্ছে, অভিযান ৭ম হিজরীর সফর মাসে প্রেরণ করা হয়েছিল। সহীহুল বুখারীতে এর উল্লেখ রয়েছে।[1] হাফেজ ইবনু হাজার লিখেছেন, ‘এ অভিযানের অবস্থা আমি জানতে পারিনি।’’[2]

[1] সহীহুল বূখারী যুদ্ধের অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য, ২য় খন্ড ৬০৮-৬০৯ পৃঃ।

[2] ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৪৯১ পৃঃ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *