কবির মাস্টারের ঘুম ভাঙে সূর্য ওঠার আগে। কিন্তু গত ক দিন ধরে এই নিয়মের ব্যতিক্রম হচ্ছে। আটটা-নটার আগে বিছানা থেকে নামতে পারছেন না। সকালবেলা গাঢ় ঘুমে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে থাকে। শরীরে কোনো রকম জোর পান না। ঘুম ভাঙার পরও অনেকক্ষণ তাঁকে বিছানার উপর বসে থাকতে হয়, নড়াচড়া করতে পারেন না। তাঁর মনে ভয় ঢুকে গেছে, হয়তো-বা এক সময় পুরোপুরি বিছানা নিতে হবে। জীবন কাটবে অন্যের করুণায়। এরচে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে? চট করে মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষ্ণ করা ভয়াবহ ব্যাপার। এটা তিনি চান না।
আজ অবশ্যি তাঁর ঘুম সূর্য ওঠার আগেই ভেঙেছে। শওকত তাঁকে ডেকে তুলেছে। শওকতের মুখ গভীর। বড়ো রকমের কোনো ঝামেলা হয়েছে বোধহয়। কিন্তু শওকত তাঁকে কিছু বলছে না। ঘুম ভাঙিয়ে চা বানাতে গিয়েছে। একেক সময় শওকতের উপর রাগে তাঁর গা জ্বলে যায়।
হয়েছে কী রে শওকত? ব্যাপারটা বল।
রান্নাঘর থেকে শওকত বলল, চা খান, তারপরে কইতাছি। খবর খারাপ।
চা খাবার পরও শওকত কিছু বলল না। কবির মাস্টার বড়ো বিরক্ত হলেন।
ব্যাপারটা কী?
আসেন আমার সাথে। নিজের চউক্ষে দেখেন। মুখের কথায় কাম কী?
এর সঙ্গে বাক্যালাপ করা অর্থহীন। করিব মাস্টার গায়ে চাদর জড়ালেন। ছাতা হাতে নিলেন। কত দূর যেতে হবে কে জানে।
বেশি দুর যেতে হল না। স্কুলের পুকুরের কাছে এসে শওকত বলল, দেখেন, নিজের চউক্ষে দেখেন।
কবির মাস্টার কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারলেন না। পুকুরের সব মাছ মরে ভেসে উঠেছে। দুধের সরের মতো মাছের সর পড়ে গেছে। অনেক লোকজন জড়ো হয়েছে। এর মধ্যেই। তারা কবির মাস্টারের দিকে এগিয়ে এল, কিন্তু কেউ কিছু বলল না।
কবির মাস্টার বসে পড়লেন। তাঁর মাথা ঘুরছে। বহু যত্বে তিনি এই পুকুর তৈরি করেছেন। মাটি ভরাট হয়ে গিয়েছিল। মাটি কাটিয়েছেন। পোনা মাছের চারা ছেড়েছেন। ফিশারি ডিপাটমেন্টের লোক এনে পানিতে সার দিয়েছেন! শ্যাওলা পরিষ্কার করিয়েছেন, কিন্তু তাঁর নিজের জন্যে তো এটা তিনি করেন নি। করেছেন সুখী নীলগঞ্জের জন্যে। মাছের আয় পুরোটা যেত। স্কুলে; স্কুল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যেত। কিন্তু এটা কী করল?
শওকত বলল, স্যার উঠেন, বাড়িত যাই। বইস্যা থাইক্যা কী করবেন? কার জন্যে বসবেন?
তিনি উঠলেন, বাড়ি গেলেন না, পুকুরের ঘাটে গিয়ে বসলেন। এই বছরই ঘাট পাকা করেছেন। কী সুন্দর এখন দেখতে হয়েছে।
খবর রটে গিয়েছে। ছেলে-বুড়ো এখন পুকুরপাড়ে ভেঙে পড়েছে। কেউ-কেউ বড়ো-বড়ো মাছ তুলে নিচ্ছে। ভয়ে-ভয়ে রান্না করবে। খাবে। মাছের শরীরে বিষ কতটুকু গিয়েছে কে জানে। বিষাক্ত মাছ খেয়ে হয়তো অসুস্থ হবে অনেকে। তাঁর ইচ্ছা হল এক বার বলেন, এই মাছ খেয়ো না। কিন্তু বললেন না। বলতে ইচ্ছা হল না। কেনই-বা বলবেন?
বেশ কিছু সাপ মরে ভেসে উঠেছে। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা সেইসব সাপ কিঞ্চির আগায় নিয়ে মহানন্দে ছোটাছুটি করছে। মাঝে-মাঝে এ ওর গায়ে ফেলে দিচ্ছে। কবির মাস্টার ঘাটে বসে শিশুদের খেলা দেখতে লাগলেন। শওকত বেশ কয়েক বার চেষ্টা করল স্যারকে বাসায় নিয়ে যেতে। পারল না। তিনি মূর্তির মতো বসে রইলেন। রোদ বাড়তে লাগল।
দুপুর এগারটায় থানার ওসি সাহেব তদন্তে এলেন। দু জন কনস্টেবল নিয়ে পুকুরের চারদিকে কয়েকবার ঘুরলেন। স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলে কবির মাস্টারের পাশে এসে বসলেন। আশপাশের সবাইকে অবাক করে দিয়ে কবির মাস্টারের পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। খাকি পোশাক-পরা কেউ সাধারণত পা ছুঁয়ে সালাম করে না। কবির মাস্টার বললেন, তালো আছে বাবা?
জ্বি স্যার। আপনার দোয়া।
তাহলে তো ভালো থাকার কথা না, কারণ দোয়া আমি তোমার জন্যে করি নি।
এখন করবেন। রোদের মধ্যে বসে আছেন কেন? বাড়ি চলে যান।
বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। রোদে বসে থাকতে ভালোই লাগছে।
এনড্রিন দিয়ে মেরেছে। আপনার সঙ্গে কি স্যার কারো শত্ৰুতা আছে?
না।
চট করে কিছু বলবেন না স্যার। ভালো করে ভেবে বলুন।
ভেবেই বললাম। শত্ৰুতা থাকবে কেন?
স্যার আপনি ঘরে গিয়ে কিছু মুখে দিন। শীতকালের রোদই গায়ে লাগে বেশি।
হ্যাঁ, যাব। খানিকক্ষণ পরেই যাব। শুধু—শুধু বসে থেকে লাভ কী? কেনই-বা বসব?
তিনি কিন্তু উঠলেন না। সন্ধ্যা পর্যন্ত একই জায়গায় একইভাবে বসে রইলেন। মনে হচ্ছে তিনি একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। নীলগঞ্জ স্কুলের হেডমাস্টার অন্য স্যারদের সঙ্গে নিয়ে অনেকক্ষণ বোঝালেন, কী জন্যে বসে আছেন? নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভটা কী হচ্ছে? সারা দিন কিছু মুখে দেননি। হিম পড়তে শুরু করেছে। বড়ো রকমের একটা অসুখ না বাধিয়ে আপনি ছাড়বেন না মনে হচ্ছে। তাতে লাভটা হচ্ছে কার?
কবির মাস্টার ক্লান্ত গলায় বললেন, লাভ-লোকসান নিয়ে ভাবি না।
আপনি না ভাবলেন, আমরা তো ভাবি। কেন আপনি শুধু—শুধু বসে আছেন?
একটা প্রতিবাদ করছি, বুঝলে? একটা প্রতিবাদ। যে এই কাজ করেছে, সে এক সময় আমার কাছে এসে ক্ষমা চাইবে, তখন আমি উঠব। তার আগে আমি উঠব না। সারা রাত বসে থাকব।
সন্ধ্যার পর শওকত বলল কাজটা সে-ই করেছে। ক্ষমা চায়। আর কোনো দিন করবে না।
শুধু শওকত নয়, একের পর এক অনেকেই আসতে লাগল। সবাই বলছে কাজটা তারই করা। পাশের দু-একটি গ্রাম থেকেও লোকজন এসে বলল, কাজটা তারা করেছে।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারলেন না। অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলেন। তাঁকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে। সেখানে তিন দিন রেখে ঢাকায় পিজিতে। ঢাকায় পঞ্চম দিনের বিকেলে তিনি চোখ মেললেন। শুনলেন কে যেন বলছে–বুড়ো মনে হচ্ছে এই যাত্রায় টিকে গেল।
কথা বলছে রফিক। তিনি ভাবতে চেষ্টা করলেন, রফিক এখানে এল কী করে। মাথা ঘোরাতে চেষ্টা করলেন, পারলেন না। শরীর সীসার টুকরার মতো টুকরার মতো ভারি হয়ে আছে।
মামা, কথাবার্তা কিছু শুনতে পারছি? তাকাও দেখি আমার দিকে। বল তো কে?
রফিক।
মনে হচ্ছে আরও কিছুদিন আমাদের যন্ত্রণা দেবো?
তুই এখানে কোত্থেকে? আমি যেখানকার, সেখানেই আছি। তুমি বর্তমানে আছ ঢাকায়। পিজিতে। বেঁচে উঠবে এ রকম কোনো আশা ডাক্তারদের ছিল না। তুমি তাদের বোকা বানিয়ে বেঁচে উঠেছ। বুঝতে পারছ?
পারছি।
রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা আমরা পালা করে তোমাকে পাহারা দিচ্ছি। বিকাল চারটা থেকে রাত আটটা পৰ্যন্ত আমার ডিউটি।
তোর সঙ্গে উনি কে?
ইনি হচ্ছেন। বাবলুর বাবা। সোভাহান সাহেব। বিখ্যাত জ্যোতিষী। তুমি আরেকটু সুস্থ হলেই তোমার হাত দেখে ভূত-ভবিষ্যৎ-বৰ্তমান সব বলে দেবে। এমনকি তোমার পুকুরের মাছ কে মোরল, সেই খবরও বলে দেবে।
সোভাহান বলল, রফিক সাহেব, ওনাকে এখন ঘুমুতে দিন, বিরক্ত করবেন না। আসুন আমরা বারান্দায় গিয়ে বসি।
কবির মাস্টার কিছু বলতে চেষ্টা করলেন। গভীর ঘুমে তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। চেষ্টা করেও তিনি জেগে থাকতে পারছেন না।
রফিক বলল, বুড়ো তো মনে হয় গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়েছে। এখন আর পাহারা দেবার কোনো মানে নেই। চলুন, বাড়ি চলে যাই।
বাড়ি গিয়ে কী করবেন?
তাহলে চলুন আপনার আস্তানায় যাই। আপনি কী-ভাবে জীবনযাপন করেন দেখে আসি।
দেখার মতো কিছু না। বস্তির মতো একটা জায়গায় বাস করি। ওখানে গেলে আপনার দম বন্ধ হয়ে যাবে।
বন্ধ হলে হবে, চলুন যাই।
সত্যি যাবেন?
আরে, কী মুশকিল। আমি কি ভদ্রতা করে যাবার কথা বলছি?
কী করবেন। আমার ওখানে গিয়ে?
গল্প করব। যদি চা খাওয়ান, চা খাব।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আপনার অন্য উদ্দেশ্য আছে।
তা আছে। আপনি খুব ভালো করে আরেকবার আমার হাত দেখবেন। ঐদিন তেমন মনোযোগ দেন নি। ভাসা-ভাসা কথা বলেছেন।
ব্যাপারটাই তো ভাই ভাসা-ভাসা।
ভাসা-ভাসা হলেও যত দূর সম্ভব। আপনি একটু তলিয়ে দেখবেন। আপনার কাছে হাত দেখার ম্যাগনিফায়িং গ্রাসফ্লাস আছে না?
সোভাহান হেসে ফেলল। রফিক বিরক্ত হয়ে বলল, হাসবেন না। ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস। আপনার হাত দেখার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। বাসায় চলুন, সেখানে আমি সব বলব।
বেশ তো চলুন! কিন্তু তার আগে আপনি কি একটা খবর দেবেন না?
কী খবর?
আপনার মামার যে জ্ঞান ফিরেছে, সেই খবর।
খবর দেবার দরকার নেই। আটটার সময় নীলু ভাবী এসে নিজের থেকেই জানবে। মরবার খবর চটপট দিতে হয়। বাঁচার খবর না দিলেও চলে।
সোভাহান যেখানে থাকে, তাকে ঠিক বস্তি বলা যাবে না। কাঁচা ঘর নয়। হাফ বিল্ডিং। দুটি কামরা! আসবাবপত্র যা আছে, তা বেশ গোছানো। হাত দেখা, কোষ্ঠি গণনার প্রচুর বইপত্র।
রফিক বলল, এইসব বই পড়েছেন নাকি?
হ্যাঁ, পড়েছি।
তার পরেও বলেন, আপনি এসব বিশ্বাস করেন না?
জ্বি-না, করি না।
অদ্ভুত লোক ভাই আপনি। দেখি, চায়ের ব্যবস্থা করুন।
সোভাহান কেরোসিনের চুলা ধরাল। চায়ের কাপ সাজোল। সহজ গলায় বলল, রফিক সাহেব, চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবেন?
খিদে-খিদে অবশ্যি লাগছে। কী আছে ঘরে?
মুড়ি খাবেন? তেল-মরিচ দিয়ে মেখে দিই?
দিন। লোকজন আসে কেমন আপনার কাছে?
বেশি আসে না। তবে আসে কিছু কিছু। টাকা যা পাই, তার থেকে বাড়িভাড়া দিই। খাবার খরচ ওঠে।
জমে না কিছু?
না। সঞ্চায়ের ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই। কার জন্যে সঞ্চয় করব বলুন। আমরা নগ্ন হয়ে পৃথিবীতে এসেছিলাম, নগ্ন হয়ে ফিরে যেতে হবে।
কিন্তু দিন বাঁচবেন, নগ্ন হয়ে বাঁচতে পারবেন না। কিছু একটা গায়ে হবে।
দিতেই হবে, এমন কোনো কথা কিন্তু নেই। কেউ কেউ জীবনও নগ্নগাত্রে কাটিয়ে দেন।
কাইণ্ডলি আপনার হাই ফিলসফি রেখে আমার হাতটা দেখুন। আপনি বলেছিলেন, আমি প্রচুর পয়সা করব।
তা বলেছিলাম।
সে-রকম লক্ষণ অবশ্যি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু স্ত্রীভাগ্যে ধন, তা তো মনে হচ্ছে না। যা হচ্ছে, বন্ধুভাগ্যে হচ্ছে।
তাই নাকি?
জ্বি, তাই। আজ একটু সময় নিয়ে হাতটা দেখুন। ম্যাগনিফাইয়িং গ্রাসফ্লাস যা আছে বের করুন। বিনা পয়সায় হাত দেখাব না, রীতিমতো ফী দেব। কত নেন। আপনি? রেট কত?
বাঁধা কোনো রেট নেই। যার যেমন খুশি দেয়।
আমার কাছে কুড়িটা টাকা আছে, এর অর্ধেক আপনাকে দিয়ে দেব। দেরি করে লাভ নেই। এখনই নিয়ে নিন।
সোভাহান হাসল। চায়ের পানি ফুটছে। কোৎলিতে চায়ের পাতা ছাড়ল। রফিক ছেলেটিকে তার বেশ পছন্দ হয়েছে। চমৎকার ছেলে।
রফিকের ভাগ্য পরিবর্তনের একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা গুপ্তধন পাওয়ার মতো। ঢাকা কলেজে তার সঙ্গে ইদরিস বলে একটা ছেলে পড়ত। মহা হারামি। সবার সঙ্গে ফাজলামি করত। ফিজিক্স-এর নবী স্যারের মতো কড়া লোকের ক্লাসেও এক দিন বাঘের একটা মুখোশ পরে হাজির। নবী স্যার বেশ অনেকক্ষণ। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সবার নিঃশ্বাস বন্ধ। না জানি কী হয়। নবী স্যার খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, কী ব্যাপার?
ইদরিস বলল, কোনো ব্যাপার না স্যার। ছোট ভাইয়ের জন্যে কিনেছিলাম। একটু পরে দেখলাম। এখন খুলে ফেলব।
খুব ভালো কথা। নাম কী তোমার?
আমার নাম ইদরিস।
ক্লাসের শেষে আমার সঙ্গে দেখা করবে।
জ্বি-আচ্ছা, স্যার।
নবী স্যার ইদরিসকে পঁচিশ টাকা ফাইন করে দিলেন।
সেই ইন্দরিস এক দিন বাসায় এসে উপস্থিত। গলায় মাইক লাগিয়ে চিৎকার-তুই দেখি ব্যাটা দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেছিস!
চেষ্টা করছি।
শুনলাম, বেকার।
আগে তো শুনেছিস, এবার স্বচক্ষে দেখ।
হা হা হা। ব্যাটা তোর রস কমে নি দেখি। চল আমার সঙ্গে।
কোথায়?
একটা ব্যবস্থা করে দিই।
কী ব্যবস্থা করবি?
বিজনেসে লাগিয়ে দিই। একটা ইনডেনটিং ফার্ম খুলে ফেলা।
সেটা আবার কী?
কাগজে-কলমে ব্যবসা। দালালি যাকে বলে।
করতে হয় কী?
কিছুই করতে হয় না। বড়ো-বড়ো কানেকশন থাকতে হয়। তোর তা আছে। তোর শ্বশুর তো বিরাট মালদার পাটি। চল তোকে নিয়ে বের হই।
রফিক বের হল। সারা দিন ঘুরল। ব্যবসার কথাটথা বলল।
বুঝলি রফিক, তোর ব্রেইন আছে, তুই এই লাইনে উন্নতি করবি। ব্যবসা বুঝে নিতে মাস ছয়েক লাগবে, তারপর দেখবি আঙুল ফুলে বটগাছ। মানুষের বেলায় সাধারণত কলাগাছ হয়, আমার ধারণা তোর বেলা হবে বটগাছ। যাকে বলে বটবৃক্ষ।
ক্যাপিটেল লাগবে না? তা তো লাগবেই। লাখ তিনেক টাকা শুরুতে লাগবে।
সর্বনাশ! নয় মন তেলও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না। তিন লাখ টাকা কে দেবে আমাকে।
ব্যাঙ্ক দেবে।
ব্যাঙ্ক কেন দেবে।
কেনার প্রশ্ন তুলিস না। ব্যাঙ্কের লক্ষ লক্ষ টাকা দশ ভূতে লুটে খাচ্ছে। ব্যাঙ্কগুলি হচ্ছে কিছু সুবিধাবাদী লোকের টাকা মারার যন্ত্র। তোকে আমি লোন পাইয়ে দেব।
তোর স্বাৰ্থ কী?
আছে, স্বাৰ্থ আছে। বিনা স্বার্থে আমি কিছু করব নাকি? ইদরিস সেই ইদরিস নয়। এখনই সেটা বলব না। তুই আগে মনস্থির কর, বিজনেস করবি, না আদর্শ বাঙালি ছেলের মতো দশটা-পাঁচটা অফিস করবি। তোকে সাত দিন সময় দিলাম। সাত দিন বসে বসে ভাব। এই সাত দিন আমার অফিসের কাজকর্ম দেখ। লোকজনের সঙ্গে কথাটথা বল। তারপর এসে বল-ইয়েস অর নো।
আজ রফিকের সেই সাত দিনের শেষ দিন। সন্ধ্যাবেলায় ইদরিসকে কিছু একটা বলতে হবে। রফিক ঠিক করেছে, সোভাহানের এখান থেকে বের হয়েই সোজাসুজি ইদরিসের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হবে। হ্যাঁ বলবে। না বলার কোনো অর্থ হয় না।
সোভাহান দীর্ঘ সময় হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় বলল, আপনার ব্যবসা হবে। লেগে যান।
সত্যি বলছেন?
যা দেখছি, তাই বললাম। আপনার হবে।
মেনি থাংকস। তাহলে উঠি?
আমার একটা অত্যন্ত জরুরি কাজ আছে। একজনের কাছে যাব।
ইদরিসের বাসা কলাবাগানের লোক সার্কাসে। বিশাল তিনতলা দালান। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান। ফোয়ারা, কালো পাথরের কী-একটা মূর্তি অনেকটা ময়ুরের মতো দেখতে, যদিও এটা ময়ুর না। ইদরিস বাসায় ছিল না। সে এল রাত এগারটায়। অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে রফিক। যায় নি। এখনও বসে আছে। খিদের যন্ত্রণায় প্ৰাণ যাবার মতো অবস্থা। এক ফাঁকে রাস্তার এক রেস্টুরেন্ট থেকে দুটা পরোটা এবং এক টাকার ভাজি কিনে খেয়েছে। এইসব জিনিস সহজে হজম হতে চায় না। তাও হজম হয়ে দ্বিতীয় বার যখন খিদে পেল, তখন ইদরিসের গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকল। গাড়ি থেকে নিজে নামার সামৰ্থ নেই। দুতিন জন ধরে–ধরে নামাল। রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, তোর কী হয়েছে?
ইদরিস হাসিমুখে বলল, কিছুই হয় নি দোস্ত। মদিরা পান করেছি। হাপ্তায় এক দিন মোটে খাই। আজ হচ্ছে সেই দিন। তোর কী ব্যাপার?
আজ থাক, অন্য এক দিন বলব।
অন্য দিন বলার দরকার কী, আজই বল। আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না, কিন্তু মাথা পরিষ্কার আছে। হ্যাঁ নাকি না?
হাঁ।
গুড। কাল অফিসে আসবি। এগারটার আগে আসিবি।
ঠিক আছে, আসব।
মুনির মিয়া, আমার দোস্তকে বাড়ি পৌঁছে দাও।
বলতে-বলতেই ইদরিস হাড়হড় করে বমি করল। যে দু জন তাকে ধরে রেখেছিল, তাদের এক জন নোংরায় মাখামাখি হয়ে গেল। কিন্তু মুখ বিকৃত করল না। এই দৃশ্য সম্ভবত এদের কাছে নতুন নয়।
রফিক আছিস এখনও?
আছি।
জিনিসটা সহ্য হয় না, তবু খাই। তোর কাছে মিথ্যা বলেছিলাম, সপ্তাহে এক দিন না, রোজই খাই। রোজই এই অবস্থা।
তাহলে তো চিন্তার কথা।
চিন্তার কথা তো ঠিকই। মদ খেয়ে কোম্পানি লাটে তুলে দিয়েছি। তোর কাছে মিথ্যা বলব না রে ভাই, লাখ টাকা আমার দেন। ড়ুবে যাচ্ছি, বুঝলি? তোর লেজ ধরে এখন ভেসে উঠতে চাই।
ইদরিস আবার বমি করতে লাগল। গেটের দারোয়ান এগিয়ে এসে রফিককে বলল, স্যার, আপনি চলে যান। একটা রিকশা নিয়ে চলে যান।
রফিক যেতে পারছে না। মাতালরা বমি করতে-করতে সত্যি কথা বলতে থাকে, এই দৃশ্য সে কোনো ছবিতেও দেখে নি। বড়ো অবাক লাগছে।
রফিক আছিস?
আছি।
আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেল রে দোস্ত। এক বেশ্য মেয়ের জন্য নষ্ট হয়ে গেল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, মাগীর নাম কাঞ্চন। বুঝলি, আমি এক নরাধম। আচ্ছা দোস্ত, নরাধম কি সন্ধি না সমাস? সব ভুল মেরে বসে আছি।
দারোয়ান আরেক বার রফিকের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, বাড়ি যান স্যার। আপনি থাকলেই সমস্যা।
রফিক নড়ল না। দৃশ্যের শেষটা তার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।