৩৫. এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক

এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক। দুটো মানুষ পরস্পরকে ভালবেসে, অপেক্ষা এবং নিজেদের মন যাচাই করে যখন একত্রিত হয় তখন সেই সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব দুজনের ওপর এসে যায়। পৃথিবীসুন্ধু মানুষ আশা করে তারা শান্তিতে বসবাস করবে। একটি মানুষের ব্যবহার, দৃষ্টিভঙ্গী যে জীবনের ঘাতপ্রতিঘাতে পাল্টে যেতে পারে সেটা সচরাচর কেউ মানতে চায় না। পুরনো ছবির সঙ্গে নতুন ছবির গরমিল হলেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। এক রবিবারে পরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দীপাবলীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

সেই রাত্রের পর এবাড়ির ছবিটা মোটামুটি এই রকম। কাজের মেয়েটিকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। সে নির্বিকার মুখে নিচের ফ্ল্যাটে দত্তবাবুর কাছে কাজ করছে। দেখা হলে ওর মুখ দেখে বোঝাই যায় না কোনকালে সে এদের কাছে কাজ করেছে। ওকে বিদায় করেছে অলোকই। পরদিন সকালে দীপাবলী কিছু বলার আগেই জানিয়ে দিয়েছে ওকে তার দরকার নেই। তার বদলে একটি বছর পনেরর ইউ পির ছেলেকে অলোক ধরে নিয়ে এসেছে। চা বানান, রুটি সেঁকা এবং দু-একটা ভাজাভুজি ছাড়া তার কোন কৃতিত্ব নেই।

সকালে উঠে সে-ই চা বানায়, ব্রেকফাস্টের যোগাড় করে। দীপাবলী শেষ পর্বে তার সাহায্য নিয়ে টেবিলে সেগুলো পরিবেশন করে। অলোক এবং সে খাওয়া শেষ করে প্রায় নির্বাক থেকেই। খুব বাধ্য না হলে কেউ বেশী শব্দ ব্যবহার করে না। অফিস যাওয়ার পথে অলোক তাকে নামিয়ে দিয়ে যায়। কোন কোন দিন দীপাবলীকে নামাবার সময় জানায় যে কাজের চাপ থাকায় সে বিকেলে আসতে পারবে না। সেদিন একা একাই ফেরে দীপাবলী। দিল্লীর বাস সার্ভিসে সে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যেদিন অলোক সঙ্গে থাকে সেদিন বাড়ি ফিরে বা খাওয়ার পর সে বই নিয়ে বসে। কিছুটা সময় বাড়িতে কাটিয়ে অলোক বেরিয়ে যায়। ফেরে রাত দশটার পরে। যেদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরা হয় না। সেদিন অলোক একটু বেহিসাবী। অন্তত বারোটা বেজে গেলে সে বেল বাজায়। পায়ে জোর থাকে না, টেবিলে চাপা দেওয়া খাবারে একটুও আগ্রহ থাকে না। দিন তিনেক ওর জন্যে না খেয়ে অপেক্ষা করার পর দীপাবলী এখন দশটা বেজে গেলে আর অপেক্ষা করে না।

এই বাড়িতে কাজ করতে এসে চাকরটি খুব খুশি। সে যে দুহাতে পয়সা মারছে তা বুঝেও চুপ করে থাকে দীপাবলী। এক জায়গায় নির্লিপ্ত ক্রমশ বিস্তার করেছে সবক্ষেত্রেই। অলোকের বাইরের জীবন, সন্ধের পর পার্টি পার্টিতে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যেসটা থেকে নিজেকে একেবারে সরিয়ে নিয়েছে সে। এই নিয়ে কথাও হয়েছিল একদিন। দীপাবলী খুব ভদ্ৰভাবেই বলেছিল, যেখানে তাকে না নিয়ে গেলে অলোকের সম্মানহানি হবার আশংকা। থাকবে সেখানে সে নিশ্চয়ই যাবে। অলোক হেসে জবাব দিয়েছিল, অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমায় বাঁচালে। অবশ্য তার পরে এতদিনেও সেইরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য নয় কিন্তু অলোক কি ভাবে ম্যানেজ করছে তা সে-ই জানে।

এই রকম সম্পৰ্ক যার কোন ব্যাখ্যা নেই, যা আছে বললে ভুল বলা হবে আবার নেই মানে অত্যন্ত মিথ্যে ভাষণ তাই বুলেছিল ওদের ফ্ল্যাটে। পরেশবাবু এলেন এই পটভূমিতে। বৃদ্ধকে দেখে আপ্লুত হল দীপাবলী। অত্যন্ত আন্তরিক হয়ে উঠল সে। সোফায় বসে পরেশবাবু বললেন, অলোক এখন আমার ওখানে। এই দ্যাখখা, আমার বলছি কেন, ওটা তো তোমাদেরও বাড়ি। বুঝলাম তুমি একা আছ তাই কথা বলতে এলাম। আজকাল তো একা বেশী চলাফেরা করতে পারি না, বয়স খুব কামড় দিচ্ছে, কিন্তু কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছিল তোমার কাছে আসা দরকার।

দীপাবলী পাশে বসে বলল, এত কষ্ট করলেন কেন? আমায় ডেকে পাঠালেই তো হত।

ডেকে পাঠালেই যে যেতে তা আমি জানি। কিন্তু তাতে তো কথা হত না মা।

দীপাবলী আড়ষ্ট হল। বৃদ্ধকে দেখেই সে আন্দাজ করেছিল কিছু একটা ঘটেছে। এই মানুষটিকে তার খুব ভাল লাগে। কালীবাড়িতে যেচে আলাপ করে তিনি স্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন কনে হিসেবে পছন্দ করার জন্যে বলে নয়, মানুষটির বুকে একটা নরম মন আছে যার স্পর্শ পেলে খুব ভাল লাগে। সে কথা ঘোরাবার জন্যে জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে একটু চা করে দিই?

না হে। দুবারের বেশী চা খেলে রাত্রে জেগে থাকতে হয়!

বৃদ্ধ চুপ করে রইলেন। দীপাবলীও নির্বাক। সে বুঝতে পারছিল শ্বশুরমশাই কথা খুঁজছেন। ঠিক কিভাবে বক্তব্য রাখবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি আমাদের ব্যাপারে কিছু জানতে চান?

বৃদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়লেন, ঠিক বলেছ। জানতে চাই। যা জেনেছি তার ওপর নির্ভর করে কিছু বলতে মন থেকে সায় পাচ্ছিলাম না। তোমার মুখে কিছু শুনি, তারপর বলব।

বেশ, কি জানতে চান বলুন!

তোমাদের কি হয়েছে?

আমাদের? দীপাবলী তাকাল। তারপর নিচু গলায় বলল, মতবিরোধ।

হঠাৎ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন বৃদ্ধ, ও হো, তাই বল। তোমার শাশুড়ি যা বলল তাতে মনে হচ্ছিল কত কি না ঘটে গেছে। তা মতবিরোধটা মিটিয়ে নেওয়া যায় না?

দীপাবলী জবাব দিল না। এই বৃদ্ধের সঙ্গে ওই তেতো বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। সে চুপ করে আছে দেখে বৃদ্ধ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল?

দীপাবলী বলল, আপনি কি শুনেছেন তা জানলে বলতে সুবিধে হত।

হাত নাড়লেন পরেশ মুখার্জি, একদিন শুনলাম তোমার রান্না নাকি অলোক খেতে পারছে না। তা তোমার শাশুড়ি যখন আমাদের সংসারে এল তখন সে লুচি বেললে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ হয়ে যেত। শিখতে শিখতে শেখা হয়ে যায়। তোমার শাশুড়ি রান্নার লোক পাঠালেন। আমার ভাল লাগেনি ব্যাপারটা। বলেছিলাম ওদেরটা ওদের বুঝতে দাও। এই করে তিনি বড় ছেলে আর বড়বউ-এর মধ্যে অশান্তি বাঁধিয়েছেন। না, না, আমায় বলতে দাও। তারপর কানে এল অলোক নাকি রোজ খুব মদ খাচ্ছে আর সেই সঙ্গে তুমিও তাল দিচ্ছ। দ্যাখো, দেশটা তো বিলেত আমেরিকা হয়ে যায়নি যে চায়ের বদলে মদ খেতে দেখলে কিছু মনে হবে না। ছেলে রোজ মদ খাচ্ছে শুনলে রাগ হয় কিন্তু ছেলের বউ মদ খাচ্ছে শুনলে বুকের ভেতর কষ্ট হয়। ওটা কি খাওয়ার জিনিস? অলোকের বন্ধুদের বউরা খায়?

হ্যাঁ। তাঁরা কোল্ড ড্রিঙ্কসের রঙের আড়াল রেখে খান।

তুমি খাও? সত্যি?

হ্যাঁ, কখনও সখনও।

কেন মদ খাও? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, অলোক তোমায় খেতে বলেছে?

ওঁকে দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই। হ্যাঁ, উনি বলেছেন। কিন্তু খেয়েছি তো আমি। তবে মদ খেতে আমার যেমন ভাল লাগেনি তেমনি খেয়ে যে খুব বড় অন্যায় করেছি তাও মনে হয়নি।

মনে হয়নি? বৃদ্ধ বিরক্ত, অযথা পয়সা এবং শরীর নষ্ট। সংসার ছারখার হয়ে যাবে।

আমি মদের সপক্ষে বলছি না। রাবড়ি তো খুব দামী জিনিস। কিন্তু কেউ যদি বোজ দু-কিলো করে রাবড়ি খায় তাহলে একই ঘটনা ঘটা সম্ভব।

হুম্। কিন্তু এই পরিণতিবোধটা তো সবাই শেষ পর্যন্ত রাখতে পারে না। অলোক পেরেছে?

আমি ওঁর সম্পর্কে কোন মন্তব্য করব না।

তোমাদের মতবিরোধ কি নিয়ে?

অনেক বিষয়ে। দোষ কার আমি জানি না। হয়তো আমারই।

তাহলে তোমরা শান্তিতে নেই?

আমি অন্তত নেই।

উঃ। এই উত্তরটা শুনব বলে আমি কখনও ভাবিনি। তোমরা তো দেখে শুনে বিয়ে করেছ। শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব তোমাদের।

এক হাতে কি তালি বাজে?

না বাজে না। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে জোর কর না কেন তুমি?

জোর করে যারা আদায় করে তারা কি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে?

হুম্! কিন্তু গোলমালটা কোথায়?

খুব সরল ব্যাপার। বিয়ের আগে আমরা যখন মিশেছিলাম তখন যা বলেছি যা করেছি তা যেমন সত্যি, যা বলিনি তাও ছিল সত্যি। এই দ্বিতীয় ব্যাপারটা বিয়ের পর এক সঙ্গে থাকতে গিয়ে আবিষ্কৃত হল আমাদের দুজনের ভাবনাচিন্তা দুরকম। যেহেতু বিয়ের আগে প্রয়োজন হয়নি খাওয়াদাওয়া জীবনযাপন সম্পর্কে নিজেদের মত যাচাই করা তাই তখন বোঝা যায়নি। এখন ধাক্কা লাগছে প্রতি পায়ে। শেষপর্যন্ত ঠিক করা হয়েছে, আমরা ঝগড়া করব না। যে যার মত থাকব। কেউ কাউকে বিরক্ত করব না। দীপাবলী অকপটে জানাল।

এত তাড়াতাড়ি, আমি ভাবতে পারছি না। বৃদ্ধ বিড়বিড় করলেন।

আপনি এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।

কি বলছ তুমি? তোমরা অশান্তিতে থাকবে আর আমি চিন্তাশূন্য থাকব?

চিন্তা করে যে কিছু লাভ নেই!

কিছু মনে করে না, তুমি এমন গলায় কথা বলছ যে তোমাদের সম্পর্কটা মরে গিয়েছে, এখন আর কিছু করার নেই। আমি এটা একদম বিশ্বাস করি না। আমি তার বাবা। এখনও সে আমার মুখের ওপর কোন কথা বলে না। আমি যা বলব তাই শুনবে।

নিশ্চয়ই। ও আপনাকে খুব ভালবাসে।

তাহলে?

কিন্তু জীবনের সত্যিটা তো অন্যরকম। আপনি যেচে কেন আঘাত নিতে যাবেন?

মানে?

এই যে আমি, নিজের জীবন দিয়ে যেটা বুঝতে পেরেছি তা আপনার আদেশে কতদিন ভুল বলে মনে করে মানিয়ে চলব? একটা সময় আসবেই যেদিন আমি আপনাকে অস্বীকার করব। সেদিন আপনি দুঃখ পাবেন না? বলুন!

বৃদ্ধের মাথাটা বুকের ওপর নেমে এল, এখন কি তোমাদের সেই অবস্থা, মা?

আমি জানি না। তবে আমরা কেউ কাউকে বিরক্ত করি না।

কিন্তু তুমি একটা কথা দেবে?

বলুন। অবস্থা যাই হোক, তোমরা আলাদা হয়ে যেও না।

দীপাবলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তাহলে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে।

নিশ্চয়ই। বল, কি কথা?

আপনার ছেলের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোন কথা বলবেন না।

বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন দীপাবলীর মুখের দিকে। তারপর বললেন, বেশ, তাই হবে।

দীপাবলী হাসল, আমিও কথা দিচ্ছি আপনাকে, সহ্যের শেষ সীমা পেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি সম্পৰ্কটাকে আইনত ছিন্ন করব না। আমার দিক থেকে তো নয়ই। তবে কেউ যদি সেটা ছিন্ন করে মুক্তি পেতে চায় তাহলে আপনি কিছু মনে করবেন না।

বেশ। যা ভাল বোঝ তাই কর।

আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।

আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, ভুলটাই বা বুঝব কি করে? ঠিক কি হয়েছে বল তো?

টুকরো টুকরো ঘটনা মিলে মিশে যা হয়, তাই–।

কিন্তু এভাবে তোমরা কতদিন থাকবে?

থেকে যাব যদি আরও বড় কিছু না হয়।

সন্তান সন্ততি এলে?

দীপাবলী মাথা নামাল। সে কি জবাব দেবে? ওই পার্টির রাতের পর আলোকের সঙ্গে তার কোন শারীরিক সম্পর্ক নেই একথা শ্বশুরমশাইকে বলা যায় না। এই মানসিকতা নিয়ে সে যে কোন সন্তানের মা হতে চাইবে না তাও অলোক জানে। কিন্তু বৃদ্ধ সেটা ভাবতে পারছেন না। তাঁদের কালে বাক্যালাপ বন্ধ হলেও মাঝরাত্রে স্বামীস্ত্রী এক বিছানায় শুলে শরীরের আলাপ স্বচ্ছন্দে করে যেতে পারতেন। কারণ মান অপমান প্রেম বা প্রেমহীনতা ছাপিয়ে সম্পর্কটা জন্মজন্মান্তরের বলে মনে করায় আর কোনও অসুবিধে হত না। কিছুক্ষণ একইভাবে বসে থাকার পর পরেশবাবু বললেন, এবার আমি চলি। দীপাবলী বলল, একটু দাঁড়ান, আপনাকে আমি এগিয়ে দিয়ে আসি। বৃদ্ধ আপত্তি করলেন না। তৈরি হয়ে এল দীপাবলী। নিচে নেমে সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কিসে এসেছেন?

অটোতে।

কাউকে বলে আসেননি?

না। এমনি চলে এলাম।

সে কি! সবাই নিশ্চয়ই চিন্তা করছে।

করুক। একদিন করলে কোন অসুবিধে হবে না।

ওরা বেশ কিছুটা হাঁটার পর একটা অটো পেয়ে গেল। সেটায় ওঠার আগে পরেশবাবু বললেন, আমি এসেছিলাম তোমাকে বুঝিয়ে বলব যাতে সম্পৰ্কটা সহজ হয়। কিন্তু সেটা যে পারলাম না বুঝতেই পারছ। আমাদের বংশে এখনও কোন স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয়নি। দ্যাখো, যে কথা দিয়েছ তা রাখতে পার কি না!

আমি চেষ্টা করব। অন্তত দূরে চলে গেলেও সম্পর্কটাকে নিজে থেকে ভাঙব না।

পরেশবাবু চলে গেলেন। একা, দিল্লীর এই নিৰ্জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দীপাবলীর হঠাৎ খুব মন কেমন করে উঠল। নিজেকে অত্যন্ত নিঃস্ব, ছিবড়ে বলে মনে হচ্ছিল। পৃথিবীতে কেউ নেই যার কাছে গিয়ে দুদণ্ড বসা যায়। অনেকদিন আগে গীতবিতান পড়তে পড়তে মন এত আনন্দিত হয়েছিল যে তার মনে হচ্ছিল জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সে এক ছুটে তাঁর পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়ত। আজ মনে হল কেন সে আরও পঞ্চাশ বছর আগে জন্মাল না! তাহলে এই মন-কেমনকরা মনটা নিয়ে সে ওঁর কাছে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত।

বাড়িতে ফিরে সে গীতবিতান নিয়ে বসল। মানুষের ভেতরের মনের সব কথা ঈশ্বরের মত তিনি বলে গিয়েছেন। গুরুদেব নন, পরমবন্ধুর মত হাত জড়িয়ে ধরেন তিনি। ডুবে গেল সে। হুঁস এল অলোকের গলায়, একটু বিরক্ত করছি।

সে ধড়মড় করে উঠে বসল। কাপড় ঠিক করল। কখন যে অলোক ফিরেছে সে জানে না। অলোক জিজ্ঞাসা করল, বাবা কি এখানে এসেছিলেন?

হ্যাঁ। গীতবিতান বন্ধ করল দীপাবলী।

হঠাৎ?

খোঁজখবর নিতে।

কি ব্যাপারে?

আমরা কেমন আছি, জানতে চাইলেন।

ও। ওখানে তো রীতিমত হইচই পড়ে গিয়েছে। না বলে চলে এসেছেন। বাড়িতে এসে শুনলাম এক বৃদ্ধ এসেছিলেন। তাই বুঝতে পারলাম। অলোক আর দাঁড়াল না।

দীপাবলী নিজের মনে হাসল। অলোক কেন প্রশ্ন করল না সেই জানে। ওরা কেমন আছে তা সে কিভাবে জানিয়েছে জানতে চাওয়াটাই তো স্বাভাবিক ছিল। অবশ্য কোন কিছুই তো এখন আর নিয়ম মেনে ঘটছে না। সেই পার্টির রাতে অলোকের মাথার পাশে বসে যখন সে ভেজা তোয়ালে দিয়ে ওকে আরাম দিচ্ছিল, একটু আশ্রয়ের জন্যে যখন অলোক নিজেকে বাচ্চা ছেলের মত তার কাছে তুলে দিয়েছিল তখন কি একটুও ভাবতে পেরেছিল পরের দিন সকালে জীবন অন্যরকম হবে।

যা ছিল এককালে অস্বাভাবিক তাই আজকাল ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে!

দিন যায় দিনের মত। ক্রমশ সমস্যা এবং সংঘাতের ধারগুলো আর তেমন ধারালো থাকে না। এরকম একটা সময়ে মনোরর চিঠি এল। বেশ বড় চিঠি। গত বিকেলে এসেছিল। লেটার বক্স খোলা হয়নি। আজ সকালে বেরুনোর সময় বের করে নিয়ে অফিসে বসে চোখ রাখল দীপাবলী চিঠিতে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ না পাওয়া সত্ত্বেও একটি বৃদ্ধার হাতের লেখা এমন সুন্দর হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল হত। দীপাবলী তারিখ দেখল। ঠিক বারো দিন আগে লেখা হয়েছে।

সতীসাবিত্রী সমানেষু দীপাবলী, শেষ পর্যন্ত তোমার পত্ৰ পাইয়া সমস্ত বিষয় অবগত হইলাম। তুমি আমাদের এর আগে চিঠি দিয়াছিলে কিন্তু তাহা আমরা পাই নাই। এই পত্ৰ। না পাইলে তাহা জানিতেও পারিতাম না। তাই নিতান্ত বাধ্য হইয়া তোমার শাশুড়িকে পত্ৰ দিয়াছিলাম। সাধারণত এখানকার ডাকঘর হইতে পত্র হারায় না। আমার নামে পত্ৰ সাধারণত আসে না। তোমার পত্ৰ পাইয়া আমি এই অঞ্চলের পিওনকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারি এ বাড়ির ছোট পুত্রের হাতে সে আমার নামে আসা একটি পত্র অনেকদিন আগে দিয়া গিয়াছিল। ইহা তাহার স্পষ্ট মনে আছে। সংবাদটি শোনামাত্র আমি তাহাকে প্রশ্ন করি। প্রথমে সে অস্বীকার করে। মাতাল অবস্থায় সমস্ত বাড়িতে অশান্তি করে। তারপর নিজেই জানায় যে তোমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখিতে চায় না বলিয়াই ওই চিঠি আমাকে দেয় নাই।

মনে মনে কষ্ট পাওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করিবার ক্ষমতা নাই। এই বাড়িতে বাস করা এখন নরকযন্ত্রণা ভোগ করা ছাড়া আর কিছু নয়। ইতিমধ্যে কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়াছে। জানি এই সব কথা তোমাকে জানাইয়া বিরক্ত করা উচিত নহে। আমি জানাইতেও চাহি নাই। কিন্তু অঞ্জলি তোমার চিঠি পাওয়ার পর হইতে ক্রমাগত আমাকে তাগাদা দিতেছে।

তোমার বড় ভাই বাগানে কোয়াটার্স পাইয়াছে। তাহার নতুন বাসায় মাত্র দুইটি ঘর। কোয়াটার্স পাওয়া মাত্র সে বাগানের মালবাবুর মেয়ে যমুনাকে বিবাহ করে। যমুনা দেখিতে সুন্দরী নহে, অত্যন্ত মুখরা। কিন্তু বয়সকালে প্রেম হইলে মানুষের দৃষ্টি অন্ধ হইয়া যায়। অঞ্জলির এই বিবাহে অত্যন্ত আপত্তি ছিল কিন্তু তাহার কথা কে শোনে। বিবাহের পর জায়গা কম এবং বাসা পাওয়ার অছিলা দেখাইয়া সে বউকে লইয়া বাগানে উঠিয়া গিয়াছে। অঞ্জলির অনেক অনুনয়ে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করে নাই। সে চাকরি পাইয়াছিল যাহার কারণে তাহাকে ভুলিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নাই। মাসে মাত্ৰ একশত টাকা পাঠাইয়া দিয়া সে তাহার দায়িত্ব শেষ করে। তোমার ছোট ভাই মাতাল। আর কি দোষ তাহার আছে জানা নাই। বেশিরভাগ সময় তাহার পকেটে টাকা থাকে না। যখন টাকা থাকে তখন মায়ের হাতে দেয়। বুঝিতেই পারিতে এই সংসার কি অবস্থায় চলিতেছে।

গত শনিবারের আগের শনিবারে অঞ্জলি হঠাৎ কুয়োর ধারে মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যায়। সে যে গত দুদিন কিছুই খায় নাই তাহা আমিও জানিতাম না। যাহা রান্না করিয়াছিল তাহাই ছোট পুত্রকে ধরিয়া দিয়াছে। পড়িয়া যাওয়ার সময় সে মাথায় আঘাত পায় এবং জ্ঞান হারায়। আমি যখন দেখিতে পাই তখন বাড়িতে কেহ নাই। ডাক্তার ডাকিয়া আনা হয়। অনেক চেষ্টার পরে অঞ্জলির জ্ঞান ফেরে। ডাক্তার তাহাকে জলপাইগুড়ির হাসপাতালে লইয়া যাইতে বলে। কিন্তু কে লইয়া যাইবে? তাহার চিকিৎসা বাড়িতেই হয়। দেখা যায় তাহার বাম দিকে পক্ষাঘাত হইয়াছে। কথা জড়াইয়াছে। অল্প দিনের মধ্যে শুইয়া থাকিবার জন্যে সর্বাঙ্গে ঘা দেখা দেয়। তখন তোমার বড় ভাই বাগানের ডাক্তারকে আনাইয়া তাহার মাকে দেখায়। বাগানের ডাক্তারের ওষুধে একটু উপকার হয়। এখন ঘা শুকাইয়াছে। একা আমার পক্ষে এই বয়সে এতসব সামলানো যে কত কষ্টকর তাহা কে বোঝে।

গত তিনদিন হইতে অঞ্জলির বুকে তীব্র যন্ত্রণা হইতেছে। ডাক্তার ওষুধ দিতেছেন। কিন্তু তাহাতে তেমন কাজ দিতেছে না। সে কেবলই মৃত্যুর কথা বলিতেছে। আর সেই সঙ্গে তোমাকে চিঠি লিখিবার জন্যে তাগাদা দিয়া চলিয়াছে। তাহার বিশ্বাস তুমি যদি তাহাকে নিজের কাছে লইয়া যাও তাহলে এ যাত্রায় বাঁচিয়া যাইবে। নিজের সন্তানের প্রতি আর ভরসা নাই, একদা যাহাকে সন্তান ভাবিয়া বড় করিয়াছিল তাহাকেই আঁকড়াইয়া ধরিতে চাহিতেছে।

তুমি এখন বিবাহিতা। তোমার নতুন সংসার হইয়াছে। তুমি এখন আর একা থাকো না। অতএব আর একজনের ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য তোমাকে দিতে হইবে। সেখানে অঞ্জলির স্থান যে হইতে পারে না তাহা এই মানুষটিকে কে বোঝাইবে? এত কষ্টের মধ্যেও আমি দ্যাখো বেশ বাঁচিয়া আছি। তোমার পিতা চলিয়া যাইবার আগে যদি এই হতভাগীর একটা ব্যবস্থা করিয়া যাইত! সে কি কখনও অনুমান করিয়াছে যে তাহার স্ত্রী অর্থকষ্টে অভুক্ত থাকিবে, তাহার মায়ের পরনে দুইটির বেশী কাপড় নাই, তাহার পুত্র প্রতি রাত্রে মদ্যপান করিবে? সে স্বর্গে থাকিলেও কি শান্তি পাইতেছে?

এই হল এখানকার অবস্থা। তোমাকে জানাইলাম। এইবার যখন আসিয়াছিলে তখন যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলে তাহা আর পালন করিবার দরকার নাই। মানুষের পরিস্থিতি সবসময় সমান যায় না। কিন্তু আমি কি করিব ভাবিয়া কূল পাইতেছি না।

ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। তুমি এবং নাতজামাই আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করিও। ইতি, আশীবাদিকা, তোমার ঠাকুমা, মনোরমা দেবী।

স্তব্ধ হয়ে বসে রইল দীপাবলী। চোখের সামনে অঞ্জলির মুখ ভেসে উঠল। সেই যৌবনকালের অঞ্জলি, চা বাগানের কোয়াটার্সে যার গা ঘেঁষে বসলে কি আরাম হত। রবিবারে ফুলকো লুচি ভেজে দিত যে মহিলা, যাকে সে একসময় মা ছাড়া অন্য কোন ভূমিকায় ভাবতে পারত না। অতীতের সমস্ত তিক্ততা তো এবার ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। অঞ্জলি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছিল। সেই অঞ্জলি এখন পড়ে আছে। বিছানায়, যার অঙ্গ পড়ে গিয়েছে, চিকিৎসা হচ্ছে না অথভাবে আর সে রয়েছে রীতিমত বৈভবের মধ্যে। এখানে মদ কিনতে হু হু করে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে আর সেখানে চাল কেনার পয়সা নেই। দীপাবলীর চোখে জল এসে গেল। যদি সম্ভব হত অঞ্জলি আর মনোরমাকে তার কাছে নিয়ে আসা তাহলে সে তাই করত! আরামে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসার ভাল সুযোগ পাওয়া ছাড়া ওদের তো অন্য কোন আকাঙ্খ নেই। এগুলো সে এখন স্বচ্ছন্দে দিতে পারে। আর সে যদি বোঝাতে পারে ওদের পাশে আছে তাহলে বাকি জীবনটা আনন্দিত না হবার কোন কারণ নেই।

কিন্তু কিভাবে সম্ভব? অলোকের সঙ্গে এখন যেভাবে বাস করতে হচ্ছে সেখানে আর দুটো-মানুষকে এনে তোলার কথা বলাই যায় না। পরেশ মুখার্জীকে দেওয়া কথা অনুযায়ী দিল্লীতে থাকতে হলে তাকে একটা মুখোস পরতেই হবে। ওদের এখানে নিয়ে এলে অলোক হয়তো আপত্তি করবে না কিন্তু ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাবে। এক শহরে আলাদা থাকলে আর সত্যিটাকে চেপে রাখা যাবে না। তাহলে কি করা যায়? দীপাবলী কুল, পাচ্ছিল না। তারপর ঠিক করল আপাতত মনোরমার নামে শপাঁচেক টাকা মানি অর্ডার করে পাঠানো যাক। অঞ্জলির চিকিৎসার জন্যে টাকাটা নিশ্চয়ই খুব প্রয়োজন দেবে। যে দুজন মানুষ তাকে জন্মাবার পর তিল তিল করে বড় করেছে তাদের চরম কষ্টের দিনে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতে একমাত্র পশুরাই পারে। এতসব ভাবার পরেও বুকের ভেতর থেকে চাপটা সরছিল না। জ্ঞান হবার সময় থেকে যাদের সঙ্গে সম্পর্ক, রক্তের যোগাযোগ থাক বা না থাক, তার গভীরতা পরবর্তীকালে যে সম্পর্ক যোগাযোগ তৈরি হয় তার থেকে অনেক বেশী, আজ নতুন করে প্রমাণিত হল ওর কাছে।

দুপুরে আই এ সি ডেকে পাঠালেন। ভদ্রলোক আজ বেশ হাসিখুশি। ঘরে ঢুকতেই বসতে বললেন। দীপাবলী অনুমান করতে পারছিল না। আই এ সি বললেন, মিসেস মুখার্জী, আপনি তো ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে এসেছেন। তাই না?

হ্যাঁ। আমি দিল্লীতে থাকতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু আপনাকে হয়তো ওয়েস্ট বেঙ্গলে ফিরে যেতে হবে। কাল হেড অফিসে গিয়ে শুনলাম। একটা অল ইন্ডিয়া ট্রান্সফার অর্ডার বের হচ্ছে।

কিন্তু আমি তো ফিরে যেতে চাইনি।

কিছু করার নেই। সরকারি পলিসি। আমি খবরটা পেয়েছি বলে আপনাকে জানালাম।

কেন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল?

ভদ্রলোক হাসলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক আমার অনেক ওপরওয়ালা। তাঁদের মনের কথা আমি কি করে বুঝব? তবে আপনার বিরুদ্ধে ক্রমাগত অভিযোগ জমা হচ্ছিল। যাদের ইন্টারেস্টে আঘাত দিয়েছেন তারা শুধু এই অফিস থেকে নয় দিল্লী থেকেই আপনাকে সরিয়ে দিতে চায়। দে আর ভেরি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল। যা হোক, অডারটা এসে গেলে আর সময় পাওয়া যাবে না। আপনি এখন থেকে হাতের কাজ গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করুন।

মানে?

মানে যা হাফ ডান হয়ে আছে তা শেষ করুন। নতুন কেসে হাত দেবেন না।

দীপাবলী বেরিয়ে এল। নিজের সিটে বসামাত্র মনে হল একেই বলে যোগাযোগ। কাকতালীয় বলে কি না তা সে জানে না। একটু আগে যে সমস্যার সমাধান খুঁজে পথ পাচ্ছিল না তা আচমকা এসে গেল সামনে। সে যদি কলকাতায় বদলি হয়ে যায় তাহলে বেচারা অলোককে কারও কাছে একা থাকার জন্যে কৈফিয়ত দিতে হবে না। পরেশবাবুকে দেওয়া কথার খেলাপও হবে না। এবং যদি সে কলকাতায় একটা বাড়ি ভাড়া নেয় তাহলে অঞ্জলি এবং মনোরমাকে স্বচ্ছন্দে নিজের কাছে এনে রাখতে পারবে। একধরনের স্বস্তি এল।

কিন্তু কে তার এই উপকারটা করল। একজন, না একাধিক? কোন অফিসার নিজের থেকে বদলি না চাইলে তাকে এত অল্প সময়ের মধ্যে ভিন্ন প্রদেশে পাঠানো হয় না। খুবই শক্তিশালী একটা হাত এর পেছনে কাজ করছে। অন্তত সে কিছু মানুষকে যে উদ্বিগ্ন করেছে তা বোঝা যাচ্ছে। যদি অলোকের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ থাকত তাহলে সে কি করত? এত। সহজে পশ্চিমবাংলায় ফিরে যেত? অসম্ভব। এই নিয়ে তুলালাম করত। তাতে কতটা ফল হত সে ব্যাপারে এখন অবশ্য বেশ সন্দেহ হচ্ছে কিন্তু এইভাবে চুপচাপ মেনে নিতে হত। না। আর একটা লড়াই করতে হচ্ছে না বলে যেমন স্বস্তি আসছে তেমনি মনে হচ্ছে, করার মত অবস্থা হলে সে সবচেয়ে ভাল থাকত। দীপাবলী পিওনকে ডাকার জন্যে বেল টিপল। হাতের কাজ শেষ করা যাক।

বিকালে অলোকের গাড়ি এসে দাঁড়াল নিঃশব্দে। দীপাবলী উঠে বসল। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ অলোক বলল, আজ রাত্রে বাড়িতে না খেয়ে বাইরে খাবে?

কোথাও নেমতন্ন আছে?

না, না। জাস্ট! মনে হল খাওয়া যেতে পারে। বেশ।

আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর একটু উশখুশ করে অলোক আবার কথা বলল, দুপুরে রণজিৎ টেলিফোন করেছিল। সেই ড্রিমল্যান্ড প্রমোটার্স?

ও!

ও বলল, তুমি নাকি পশ্চিমবাংলায় ট্রান্সফারড হয়ে যাচ্ছ?

চমকে উঠল দীপাবলী। খবরটা এখনও কাগজে টাইপড হয়ে বিতরিত হয়নি। তার নিজের অফিসে সে আই এ সির মুখে সদ্য শুনেছে। এরই মধ্যে বাইরের লোক জেনে অলোককে ফোন করে বলেছে? সে বলল, চমৎকার!

মানে?

এদের নেট ওয়ার্ক দেখছি খুব স্ট্রং। শুনলাম খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল কিছু লোক আমাকে এখান থেকে বদলি করতে চাইছে। এরই মধ্যে যে এটা চাউর হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি।

হ্যাঁ। আমিও জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ও সোর্স বলতে চাইল না।

আমার যারা বদলি চাইতে পারে তাদের মধ্যে এই ভদ্রলোকও থাকতে পারেন। কারণ ওঁর ইন্টারেস্টে আঘাত পড়েছিল।

তাহলে ঘটনাটি কি সত্যি?

আমি এখনও হাতে কোন অর্ডার পাইনি।

পেলে তুমি কি অ্যাকসেপ্ট করবে?

না করলে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়।

তুমি অ্যাপিল করতে পারো।

দীপাবলী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে উচ্চারণ করল, কেন করব?

অলোক কোন জবাব দিল না। চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে ফিরে এল বাড়িতে। আজকের বিকেল অন্য দিনের থেকে আলাদা নয়। চাকরের হাতে চা, বিশ্রাম, স্নান, সবই নিয়মমাফিক চলল। শুধু রাত্রের রান্না করতে নিষেধ করা হল ছেলেটাকে।

আটটা নাগাদ সেজেগুজে ওরা বের হল। পুরনো দিল্লীর একটা মোগলাই রেস্টুরেন্টে ওকে নিয়ে গেল অলোক। রেস্টুরেন্টটা পরিষ্কার। খাবার অর্ডার দিয়ে অলোক বলল, আমি বুঝতে পারছি তোমার পক্ষে আমার সঙ্গে এভাবে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।

সম্ভব হচ্ছে না বলব না। আছি তো।

তুমি কি ইচ্ছে করে ট্রান্সফার নিচ্ছ?

না। সেটা মাথায় আসেনি।

অলোক বলল, ঠিক আছে। মনে হয় এটাই ভাল হল।

দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি এভাবে থাকতে ভাল লাগছে?

একদম না। তোমার কি মনে হচ্ছে না আমরা একটা সময়ে ভুল করেছিলাম?

না, সেটা মনে হচ্ছে না।

থ্যাঙ্কস।

আমার মনে হয় আমাদের শুরুটা ঠিক ছিল। মাঝখানটা যে মিলবে না তা জানা ছিল না। মাঝে মাঝে তোমাকে আমি স্ট্যান্ড করতে পারি না। ঠিক তেমনি আমাকেও তুমি সহ্য করতে পারে না অনেক সময়। ঠিক বলছি?

ঠিক।

আমাদের মধ্যে এখন খুব সামান্যই ভাল লাগা অবশিষ্ট আছে। অথবা এটাকেই একসময় বিশাল বলে ভুল করেছিলাম।

ঠিকই। কিন্তু যেটুকু আছে সেটুকুকে নষ্ট করতে চাই না আমি।

আমিও না।

আমার বিরুদ্ধে তোমার নিশ্চয়ই অনেক অভিযোগ আছে। তুমি বলেছও।

ফরগেট দ্যাট। একই ব্যাপার তোমার ক্ষেত্রেও।

তাহলে, আমি চলে গেলে আমাদের মধ্যে কি সম্পর্ক হবে?

সময়ের ওপর ছেড়ে দাও সিদ্ধান্ত নেবার ভার। আর যদি তোমার মনে হয় এখনই অন্য প্রয়োজনে তোমার আইনত বিচ্ছেদ প্রয়োজন, জানিও, পাবে।

আমার প্রয়োজন নেই। হবে বলে মনে হয় না। হলে জানাব। কিন্তু এই কথাটা তোমাকেও জানাচ্ছি। বিচ্ছেদ চাইলে জানাতে দ্বিধা করো না।

কলকাতায় কোথায় গিয়ে উঠবে?

জানি না।

আমি সাহায্য করলে নেবে?

আপত্তি কি? তুমি তো আমার শত্ৰু নও। দীপাবলী হাসল।

গম্ভীর হল অলোক, তাহলে আমাদের শত্ৰু কে?

দীপাবলী স্পষ্ট উচ্চারণ করল, আমরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *