1 of 2

৩৫. ইব্রাহিমপুর পরগণা

ইব্রাহিমপুর পরগণার বিরাহিমপুর গঞ্জের নদীতীরে বাঁধানো ঘাটের হাতনায় বসে আছে। একজন মানুষ। মানুষটি বেশ দীর্ঘ এবং বলিষ্ঠকায়, মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে, মুখে গুম্ফ-দাড়ির জঙ্গল, শরীরের বর্ণ তামাটে। লোকটির পরণে একটি ধুতি লুঙ্গির মতন ফেরত দিয়ে বাঁধা, কোমর থেকে উধবাঙ্গ নিরাবরণ। শীতের প্রাতঃকাল, বাতাসে বেশ শিরশিরে ভাব, কিন্তু লোকটির সেদিকে কোনো হঁসই নেই, সে একদৃষ্টি চেয়ে বসে আছে জলের দিকে।

লোকটিকে দেখলে কোনো সন্ন্যাসী বা দরবেশ বলে বোধ হয়, কিন্তু অপরের দৃষ্টি আকৃষ্ট করার জন্য তার কোনো প্ৰয়াস নেই। সে স্থাণুবৎ ঐ একই জায়গায় বসে আছে দীর্ঘ সময় ধরে, চক্ষু জলের দিকে নিবদ্ধ, যেন সে পাঠ করতে চায় নদীর তরঙ্গের ভাষা।

বিরাহিমপুরের গঞ্জ এক সময় ছিল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে আশপাশের বিশ পঞ্চাশখানা গ্রাম থেকে মানুষজন আসতো এখানে সওদা করতে। কিন্তু বছর পাঁচেক ধরে সেই গঞ্জ ভেঙে গেছে, হাটখোলায় কতকগুলি চালা এখনো টিকে আছে, কিন্তু মানুষজন আর আসে না। নদীর পাড় ভাঙলে অনেক সময় গঞ্জ-বাজার স্থান বদল করে, কিন্তু এখানে নদী বেশ শান্ত, তবু অন্য গ্রামের লোক পারতপক্ষে বিরাহিমপুরে এখন পা দিতে চায় না। ভয় পায়।

ঘাটে কিছু কিছু নারী-পুরুষ স্নান করতে আসে। নদীর পাড়ের মানুষের তো নদীকে বাদ দিয়ে জীবন চলে না। তবু মানের চেয়ে বিশ্রাম্ভালাপে আর বেশী সময় কাটায় না কেউ আগের মতন, রমণীরা কলসী নিয়ে জল ভারতে এসে বারবার জল ফেলে জল ভরে না, ত্রস্তে চলে যায়। এরকম সকল থেকেই আসছে তারা, চকিত বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখছে এই আগন্তুককে। কিন্তু লোকটির কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।

বিরাহিমপুর পরগণাটি মুসলমান প্রধান, দু-চার ঘর হিন্দু পরিবারও রয়েছে। সকলেরই এখন ছন্নছাড়া দশা। বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লোকের কৌতূহলও বাড়তে লাগলো। একই স্থানে ঠায় বসে থাকা এই মানুষটি কে? গলায় রুদ্রাক্ষের মালা নেই, বাহুতে তাবিজ মাদুলি নেই, ললাটে চন্দন নেই, চুল চুড়া করে বাঁধা নয় বলে মুসলমানরা তাকে স্বজাতীয় কোনো ধৰ্মিষ্ঠ মানুষ বলে ধরে নেয়। কয়েকজন নিম্নস্বরে লোকটির বিষয়ে আলোচনা করে। শেষ পর্যন্ত দু-একজন এগিয়ে এসে বললো, ছালাম আলেকুম, ফকির ছায়েব! এহানে বেশীক্ষণ বসবেন না, আমাগো গোরামে আহেন।

লোকটি কয়েকবার ডাকাডাকির পর মুখ তুলে তাকালো। ভাষাহীন নিথর দৃষ্টি, শান্ত কিন্তু জোরালো। কোনো উত্তর দিল না। লোকগুলি বারংবার ঐ একই কথা বললো, তবু এই মানুষটির কোনো সাড়া নেই। আবার তার চক্ষু জলের দিকে নিবদ্ধ।।

প্ৰায় দ্বিপ্রহরের সময় মানুষটি একটি বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। মন্ত্রচালিতের মতন এগিয়ে গেল জলের দিকে। বুক জলে যাবার পর সে ড়ুব দিল। ঘাটে স্নানরত কয়েকজন নারী-পুরুষ সবিস্ময়ে দেখছে লোকটিকে। কিন্তু সে ড়ুব দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠলো না, বেশ সময় কেটে গেল, তবে কি সে আত্মঘাতী হলো? প্ৰায় নদীর মধ্যস্থলে ভূস করে জেগে উঠলো তার মাথা, ধীর, সাবলীলভাবে সন্তরণ করে আবার সে ফিরে এলো তীরে। তারপরও সে আর একটি বিস্ময়কর কাজ করলো, ঘাটের পাশ থেকে একটুখানি মাটি তুলে জিভে ঠেকালো। এতক্ষণে যেন শীত বোধ হলো তার শরীরে, প্রবল ঝাঁকুনি লাগলো তার সর্বাঙ্গে।

এবার সে নিজে থেকেই স্নানার্থীদের কাছে এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, শেখ জামালুদ্দীনকে চেনো? তার বাড়িটা আমায় দেখিয়ে দিতে পারো?

লোকগুলি বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাতাকি করলো। একজন জিজ্ঞেস করলো, কোন শ্যাখ জামালুদ্দীনের কথা কইত্যাছেন, ছায়েব? হে কেডা?

আগন্তুক আবার প্রশ্ন করলো, শেখ জামালুদ্দীন এ গোরামে থাকে না? তোমরা তাকে চেনো না?

চিনবে না কেন, সবাই চেনে। কিন্তু শেখ জামালুদ্দীন এমনই একজন অকিঞ্চিৎকর মানুষ যে তার সম্পর্কে বিদেশ থেকে আসা কোনো ব্যক্তি শুদ্ধ ভাষায় খোঁজ করবে, এ কথা বিশ্বাসই হয় না। শেখ জামালুদ্দীনের মতন লোকেদের নিজের পরিবারের বাইরে কোনো মূল্যই নেই। তবে কি এতদিন পর জামালুদ্দীনের নসীব বদলালো? আল্লাতালার কাছ থেকে কোনো ফেরেস্তা এসেছেন তার সৌভাগ্যের দ্বার খুলে দেবার জন্য?

 

তখন সকলে সেই আগন্তুককে নিয়ে চললো গ্রমের দিকে। খবর ছুটে গেল আরও দ্রুত। নদী-তীরের এক রহস্যময় পুরুষ এসেছে জামালুদ্দীনের সন্ধানে, গ্রামের ঘর বাড়ি থেকে অনেকে বাইরে বেরিয়ে পড়লো ওই লোকটিকে দেখবার জন্য। বলবান, নগ্নগাত্র পুরুষটি সিক্ত বসনে হেঁটে চলেছেন, চারদিকে দেখছেন মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। গ্রামের অনেকগুলি বাড়ি ভাঙা, অনেক গৃহ পরিত্যক্ত, কেমন যেন একটা শ্ৰীহীন ছন্দহীন ভাব। গোরুগুলি এত কৃশকায় যে ওদের দেখলেই ওদের মনিবন্দের অবস্থা টের পাওয়া যায়।

জামালুদ্দীন শেখ নিজের বাড়ির উঠোনে বসে নারকেল ছোবড়া দিয়ে দড়ি পাকাচ্ছিল, বাইরে মনুষ্যকণ্ঠের গোলযোগ শুনেই সে সব কিছু ফেলে দৌড়ে গোয়াল ঘরের পিছনে লুকোলো। লোকেরা তাকে ডাকতে লাগলো, জামাল? এ জামাইল্লা, বাড়ায়ে আয়, দাখ আইস্যা-। কয়েকজন হুড়মুড় করে ঢুকে গেল ভেতরে, এদিক ওদিক খুঁজে গোয়ালঘর থেকে টেনে নিয়ে এলো জামালকে। সে তখন ভয়ে শালিক পাখির মতন থরথর করে কাঁপছে।

জামালুদ্দীনের বয়েস পঁচিশ-ছাব্লিশের বেশী নয়, অতিশয় শীর্ণ চেহারা, বক্ষের পাঁজরা কখানা পরিষ্কার গোনা যায়, পরণে একটি নেংটি। সবচেয়ে বেশী দৈন্যের ছায়া তার তৈলাক্ত মুখখানিতে মাখানো। সে বোধ হয় জীবনে কখনো কারুর সামনে, এমনকি নিজের সন্তানের সামনেও একটিও অহংকারের বাক্য উচ্চারণ করতে পারেনি।

আগন্তুকটি জামালুদ্দীনকে দেখে যেন অত্যন্ত নিরাশ হলো। সবিস্ময়ে বললো, তুমি-তোমার নাম জামালুদ্দীন শেখ?

জামালুদ্দীন হাত জোড় করে বললো, আইজ্ঞা হুজুর, মুই, জামালুদ্দীন শাখ-ছায়েবগো হুকুইম কহনো অমাইন্য করি নাই।

আগন্তুক আবার বললো, তুমি সত্যি জামালুদ্দীন? তোমার টানে আমি এসিচি।

জামালুদ্দীন বললো, আমার কিছু গোস্তাকি হইলে মাফ করবেন, হুজুর!

—তোমার বিবিকে ফিরে পেয়েচো?

সবাই আবার তাজ্জব। বাইরের জগৎ থেকে একজন মানুষ এসে জামালুদ্দীনের পত্নীর কথা বলছে। ইনি জামালুদ্দীনের পত্নীকে ফিরিয়ে দেবেন, ইনি কি জাদুকর?

—তোমার বউ হানিফাবিবিকে ওরা ধরে নিয়ে গেসলো।

—আইজ্ঞা না, হুজুর, আমার বিবির নাম ফাতিমা…গত সনে ইন্তেকাল হইয়ে গ্যাচে তার-তিনডো পোলাপানরে থুইয়া।

—ফতিমা? তবে কি আমি নাম ভুলে গেচি? আমার যতদূর মনে পড়ে…জামালুদ্দীন শেখ-তার অন্য রকম চেহারা-তার বিবির নাম হানিফা।

এবার একজন মাতব্বর গোছের বৃদ্ধ এগিয়ে এসে লুঙ্গির গিট ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করলো, আপনে কার কথা জিগাইতাছেন? জামালুদ্দীনের বিবির কথায় আপনের কাম কী?

আগন্তুক কিছুক্ষণ মাটির দিকে নীরবে চেয়ে রইলো, তার ললাট কুঞ্চিত। একটুক্ষণ পর মুখ তুলে সে বললো, এই গ্রামে একজন জামালুদ্দীন শেখ ছিল না? যার বউ হানিফা বিবিকে নীলকর সাহেবদের কুঠিতে জোর করে ধরে নিয়ে গেসলো?

এবার সকলে হই হই করে উঠলো। এ যে অনেক পুরোনো কথা। হ্যাঁ, মাক গরগর সাহেবের গোমস্তা গোলোক দাস হানিফা বিবিকে লুঠ করে নিয়ে গিয়েছিল বটে। তখন তাগড়া জোয়ান জামালুদ্দীন শেখ কারুর নিষেধ না শুনে গোঁয়ারের মতন সাহেবদের কুঠিতে গিয়েছিল বিবির খোঁজ নিতে। তারপর থেকে কেউ আর তাদের খোঁজ জানে না। কেই বা তাদের কথা মনে রাখবে, তারপর আরও কত ঘটনা ঘটেছে। এ গ্রামে। এই যে কাঁদের মিঞা, এক চক্ষু কানা, এর চক্ষুটা গেল। গত শীতে, ডানকান সাহেব ঠিক এর ঐ চক্ষুটার ওপর সপাটে চাবুক কষিয়েছিলেন। এই যে মইনুদ্দিন সর্বক্ষণ পাগলের মতন বিড়বিড় করে, তারও তো এমন দশা হয়েছে মারের চোটে, আর তোরাব মিঞা, সে এখানে নেই অবশ্য, তার বিবিকেও ধরে নিয়ে গেছে সাহেবদের অনুচরেরা-তোরাব মিঞারও দেওয়ানা হবার মতন অবস্থা–।

অনেক লোকের চিৎকার হাট্টগোলের মধ্যে আগন্তুক এই সব কথা শুনলো। সে ভুল জামালুদ্দীন শেখের কাছে এসেছে। এবার তাকে নিয়ে যাওয়া হলো নিরদিষ্ট জামালুদ্দীন শেখের বাড়িতে। সেখানে জামালুদ্দীনের বৃদ্ধ পিতা এখনো জীবিত, চোখে একেবারেই দেখতে পায় না। আগন্তুক সেই বৃদ্ধের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে শান্তভাবে বললো, আমি তোমার ছেলের সন্ধান করবো বলে কথা দিয়েচিলুম, তারপর আমার কী যেন মতিভ্রম হলো, সে কথা রাখিনি, কিন্তু সেই টানে আমি আবার ফিরে এসিচি।

বৃদ্ধ এই আগন্তুকের কথা প্রায় কিছুই বুঝতে পারলো না। তার হাত জড়িয়ে ধরে খুঁ খুঁ শব্দে কাঁদতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আগন্তুক এদিক ওদিক চাইতে লাগলো অস্থিরভাবে। যেন তার পরবর্তী কর্মটি কী হবে তা সে ঠিক করতে পারছে না।

এই সময় কিছু দূরে শোনা গেল হট্টগোল। গ্ৰাম্য পথ দিয়ে আসছে দুজন অশ্বারোহী, তাদের সামনে দিয়ে সভয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটছে কিছু ছেলেমেয়ে। এখানকার এরাও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। অশ্বারোহীদের দেখে। তারা আগন্তুকটিকে অনুরোধ করতে লাগলো কোনো বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে লুকোতে, কারণ সবল চেহারার মানুষ দেখলে নীলকররা অকারণে অত্যাচার করতে প্ৰলুব্ধ হয় কিংবা জোর করে মজুরি খাটাবার জন্য কুঠিতে ধরে নিয়ে যায়। আগন্তুক সে সব অনুরোধে কৰ্ণপাত করলো না, স্থিরভাবে দণ্ডায়মান রইলো সেই একই জায়গায়।

অশ্বারোহী দুজনেই সাহেব, তাদের পেছনে পেছনে পদব্রজে আসছে নীলকুঠির গোমস্তা গোলক দাস এবং কয়েকজন লাঠিয়াল। তারা যে এই গ্রাম পরিদর্শনেই বেরিয়েছে তা নয়, কিছু দূরেই নদীতে চড়া পড়েছে এবং স্বভাবতই সে চর গেছে সাহেবদের দখলে, সেই চরে যেতে হলে এই গ্রামের মধ্য দিয়ে গেলে পথ কম হয়। তা ছাড়া, মাঝে মাঝে সাহেবদের চেহারা দেখিয়ে গ্রামবাসীদের ভয় পাওয়ানো দরকার।

ভিড়ের অনেকেই ছুটে গিয়ে লুকোলো, দু-চারজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে রইলো আগন্তুকের পাশে। সাহেব দুজন পরস্পর কথাবার্তায় মগ্ন, গ্রামের লোকের দিকে ভ্রূক্ষেপও করছে না। কিন্তু গোলক দাসের তীক্ষ্ণ চোখ ঠিক পড়লো এদিকে। থমকে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, এ বেটা আবার কেড রে? এডারে তো আগে দেহি নাই!

একজন বৃদ্ধ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বললো, হুজুর, এ আমার ফুফাতো ভাই। ভেন্ন গেরামে থাকে।

গোলক দাস লোকটির আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বললো, হুঁ, চ্যাহারাখান তো দেহি ষণ্ডার মতন, ডাকাইতি করে নাকি? এই তোর নাম কী?

আগন্তুক কোনো উত্তর দিল না।

সেই বৃদ্ধটি আবার বললো, হুজুর, অর মাথার ঠিক নাই, বায়ু রোগ হইছে, পাকিমুড়া গোরামে মোর ফুফার বাড়িতে…

গোলক দাস একটুক্ষণ দ্বিধা করলো। তারপর মনস্থির করে পেছনের লাঠিয়ালদের উদ্দেশে বললো, ল, ল, দৌড়াইয়া আগা—।

ভয়-দেখানো দলটি চলে যাবার পর উপযাচক উপকারী বৃদ্ধটি বললো, বড় বাঁচা বাঁইচা গ্যালেন, ছায়েব! এবার কন তো আপনি কেডা, কোন দ্যাশ থানে আইছেন?

—আমি গঙ্গানারায়ণ সিংহ। এই নাম গ্রামবাসীদের মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো না। সাধারণ প্রজারা জমিদারের নাম মনে রাখে না, বা সে ব্যাপারে মাথাও ঘামায় না। তারা জমিদারকে চেনে জমিদারের কর্মচারীদের দিয়ে। কর্মচারীরা যাকে খাতির করে নিয়ে আসে সে-ই জমিদার। জমিদার বদলায় কিন্তু কৰ্মচারীরা তো বদলায় না। তা ছাড়া জমিদারের সঙ্গে এ গ্রামের সম্পর্কও নেই অনেকদিন। তাদের জমিদার তাদের বিপদের সময় নীলকর সাহেবদের দিকে ঠেলে দিয়ে দূরে সরে গেছে।

তবে হিন্দু নাম শুনে অনেকের মধ্যে নতুনভাবে বিস্ময়ের সঞ্চার হলো। দুএকজন বৃদ্ধ সিংহ পদবীটিতে জমিদারী গন্ধ পেল কিছুটা, কিন্তু এই নগ্নদেহ, উন্মাদের মতন চেহারার মানুষটিকে জমিদার পরিবারের একজন মনে করার মতন স্মৃতি অতদূর প্রসারিত হলো না।

গঙ্গানারায়ণ আপনমনে বললো, আমি থাকবো এখেনে…আমি কোতায় থাকবো? তোমরা আমায় থাকতে দেবে? আমি তৃষ্ণার্ত, তোমরা কেউ একটু জল খাওয়াবে আমায়?

একজন বললো, আপনে হেঁদু, আপনে আমাগো মইধ্যে থাকবেন ক্যামনে? হেঁদু পাড়ায় যান গিয়া।

আর একজন বললো, আপনে পলান এহান থিকা, আপনে বিপদে পড়বেন!

গঙ্গানারায়ণ তখনও চিন্তিত। অন্যদের কথা ভালোভাবে শুনছে না। ললাট কুঞ্চিত করে বললো, এখেনে আমাদের কে যেন থাকতো? কী যেন নাম! ও, ভুজঙ্গ, সে আচে এখনো?

অনেকেই ভুজঙ্গকে চেনে। বছর পাঁচেক আগে জমিদারী আমলে সেই-তো আসতো খাজনা আদায় করতে। তারা হই-হই করে উঠলো। হ্যাঁ, আছে। ভুজঙ্গ নায়েব এখনো আছে কুটিবাড়িতে।

এবার গ্রামবাসীরা গঙ্গানারায়ণকে নিয়ে চললো কুঠিবাড়ির দিকে।

 

কুঠিবাড়িটি গ্রামের এক প্রান্তে। এক সময়ে এখানে বেশ কয়েকজন কর্মচারী ছিল, জমিদাররা মহাল পরিদর্শনে এলে এখানে দু-একদিন অবস্থান করতেন। এখন জমিদারী কাজকর্ম এ অঞ্চলে কিছুই নেই, কুঠিবাড়িটি টিকে আছে কোনোক্রমে, বেতনভুক কৰ্মচারীর সংখ্যা চারজনে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন কুঠি ছেড়ে নিজ গ্রামেই বসবাস করছে। ভুজঙ্গ নায়েব অবশ্য কুঠিবাড়িতেই মৌরসীপাট্টা গেড়ে আছে, তার ধারণা জমিদাররা এ অঞ্চলে আর কোনোদিন আসবে না, কুঠি সংলগ্ন বিষয়-সম্পত্তি তারই ভোগে লাগবে। নীলকররাও এদিকের সমস্ত জমিই কুক্ষিগত করলেও জমিদারী কুঠিতে হস্তক্ষেপ করেনি।

অনেকদিন বাদে প্রজাদের দল বেঁধে এদিকে আসতে দেখে ভুজঙ্গ নায়েব বিস্মিত হয়ে বেরিয়ে এলো। দৈর্ঘ্য কিছু কম হলেও তার শরীরটি সুগঠিত, ডান বাহুতে একটি বড় রূপের তাগা বাঁধা, ওষ্ঠের ওপর পাকানো গুম্ফ। লাল পেড়ে ধুতির খুঁট গায়ে জড়ানো, গলায় মালার মতন ভাঁজ করা মোটা সাদা ধপধাপে উপবীত। ভুজঙ্গ তন্ত্রসাধনা করে, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তাকে তান্ত্রিক হিসেবেও সমীহ করে খানিকটা।

ভিড় ছেড়ে এগিয়ে এসে গঙ্গানারায়ণ বললো, কেমন আচো, ভূজঙ্গ? আমি আবার ফিরে এসিচি।

ভুজঙ্গ চক্ষু সরু করে একটুক্ষণ চেয়ে রইলো এই লোকটির দিকে। তারপর ওষ্ঠের কোণে অবজ্ঞার হাসি ফুটিয়ে বললো, তুই কেডা? ফিরা আইছস মানে? ব্ৰেহ্মদৈত্য নাকি? তা দিনের বেলা কী মনে কইর‍্যা?

গঙ্গানারায়ণ বললো, তুমি আমায় চিনতে পারচো না? আমি তোমার মনিব।

ভুজঙ্গ বললো, আমার মনিব? হেঃ, হে-হে-হে-হে! দিনের বেলা এক বেহ্মদত্যি আইস্যা কয় কি না আমার মনিব।

প্রজাদের দিকে ফিরে সে ধমক দিয়ে বললো, ব্যাটারা কোন পাগলা-ছাগলারে ধইরা আনছস। অ্যাঁ? খেলা পাইছস?

গঙ্গানারায়ণ এক পা এগিয়ে এসে বললো, ভুজঙ্গ, তোমার মনে নেই? আমি গঙ্গানারায়ণ সিংহ। এক রাত্রে বোট থেকে হটাৎ চলে গিসলুম, আমার মতিভ্ৰম হয়েছিল—

ভুজঙ্গ এবার হাত জোড় করে বললো, হুজুর, আমার মাথাডা গরম করাইবেন না। এই চাষাভুষারা জানে, আমি একবার ক্ষ্যাপলে বড় সাংঘাতিক। এ পইর্যন্ত পাঁচ ছয়জন আইসা কইছে, মুই গঙ্গানারায়াইন, তোমাগো মনিব! হেঃ! হে-হো-হে! আরে, হারামজাদা কোৎকা খাইতে না চাস তো আহনো পলা!

গঙ্গানারায়ণ হাসলো। মুখের জঙ্গল ভেদ করে দেখা গেল তার ধবল দন্তপঙক্তি। মৃদু স্বরে সে বললো, অনেক দিন হয়ে গ্যাচে, চিনতে না পারারই কথা। আমি নিজেই তো তোমায় দেকে ঠিক চিনতে পারিনি, ভূজঙ্গ। তোমার চুলে পাক ধরেচে। কুঠিবাড়ির পাশে এমন জঙ্গলও আগে দেকিনি! একটা কামরা সাফসুতরো করো, আমি এখন এখেনে থাকবো।

—থাকবে? এটা কি তোমার বাপের জমিদারি?

—আমার বাপের জমিদারিই বটে! আমার না হোক, আমার বাপের তো নিশ্চয়ই। আমি রামকমল সিংহের পুত্র গঙ্গানারায়ণ!

—তুমি যদি রামকমল সিংহের ছেলে হও, তা হলে আমি নবাব সিরাজদৌল্লার নাতি! যত সব! গঙ্গানারায়ণ সিংহী মইরা ভূত হইয়া গ্যাছে কবে! তেনার ছেরাদ্দ-শান্তি পইর্যন্ত হইয়া গ্যাছে।

—আমি মরে যাইনি, ভূজঙ্গ। সন্ন্যাসী হয়ে গিসলাম। কেন মিচিমিচি সময়ের অপচয় কর্চো!

–এ যে দেহি জাল পরতাপ চান্দের মামলা। তুমি যদি গঙ্গানারায়ণ হও, তা হলে এহানে ক্যান, কইলকাতায় যাও, সিংহ পরিবারের সঙ্গে মামলামোকদ্দমা লড়ো? সোহানে গিয়া নিজের জমিদারির হিস্যা বুইঝ্যা লও, আমি কী করুম!

–মামলা-মোকদ্দমা লড়বার দরকার হবে না। আমার মা বেঁচে আছেন আশা করি, তাঁকে খবর পাঠাতে হবে একটা।

ভুজঙ্গ আরও কিছুক্ষণ ধরে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলো। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে গঙ্গানারায়ণ বললো একজন পরামানিক ডেকে আনতে। প্রজারা এতক্ষণ গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে এই নাট্যকৌতুক উপভোগ করছিল। তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে এমন আমোদ সহসা আসে না। তারাই কয়েকজন ছুটে গিয়ে হিন্দুপাড়া থেকে ধরে আনলো একজন পরামানিক।

 

কুঠির সামনে একটি বকুল গাছের নিচে মাটিতেই জোড়াসন করে বসলো গঙ্গানারায়ণ। পরামানিকের কাঁচিতে তার পাঁচ বৎসরের বর্ধিত কেশ, গুম্ফ ও শ্মশ্র খসে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলো প্ৰজারা। এই চেহারা আর কোনোক্রমেই চিনতে ভুল হবার কথা নয়। এই গঙ্গানারায়ণকে তারা শুধু যে আগে দেখেছে তা নয়, ভূতপূর্ব জমিদার রামকমল সিংহের সঙ্গেও এর মুখের যথেষ্ট আদল আছে।

ভুজঙ্গ নায়েবেরও আর বাক্যস্ফুর্তি হলো না। গঙ্গানারায়ণ উঠে দাঁড়াতেই সে হাত জোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো তার সামনেই। নিতান্ত ব্ৰাহ্মণ বলেই সে জমিদারের পদধূলি গ্রহণ করলো না।

এই গঙ্গানারায়ণকে দেখে সকলে নির্ভুলভাবে চিনতে পারলেও আগেকার গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে অমিলও অনেক। সেই লাজুক, অন্তর্মুখী, নমনীয় শরীরের যুবকটি আর নেই। এখন সে মানুষের চোখের দিকে স্পষ্টভাবে তাকাতে পারে, তার কণ্ঠস্বর গভীর ও ভরাট, তার নীরবতার মধ্যেও অস্থিরতার চিহ্নমাত্র নেই।

ধীর পায়ে হেঁটে সে এগিয়ে গেল কুঠিবাড়ির দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *