৩৫
আবার সেই শ্মশান। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে বাড়ি। ছোটবেলা থেকে শ্মশান দেখা অভ্যেস আছে দীপঙ্করের। প্রতিদিন রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন শ্মশানের চিৎকার কানে আসে। কিরণের সঙ্গে শা’নগর রোড দিয়ে যেতে যেতে ওই শ্মশানের পাশেই কতদিন আলুর চপ বেগুনী কিনে খেয়েছে। শ্মশান সম্বন্ধে কোনও ভয়, কোনও আতঙ্ক দীপঙ্করের মনে নেই। এ যেন তাদের বাড়ির উঠোন। এই উঠোনেই যেন ছোটবেলা থেকে দীপঙ্কর বড় হয়েছে। এই শ্মশান থেকেই দীপঙ্কর জীবনের বীজ আহরণ করেছে। সেই চেনা শ্মশানটাই যেন সেদিন আবার নতুন করে চিনতে হলো। বার বার চেনে-চিনেও যেন শ্মশানটা পুরনো হয় না দীপঙ্করের। এই সেদিন কিরণের বাবাকে এই শ্মশানে এনেছিল। এখানেই জীবন-মৃত্যুর মহাসন্ধিস্থলে যেন দীপঙ্করের আবার নতুন করে নবজন্ম হলো সেদিন।
ফোঁটা কাছে এল হঠাৎ। বললে–হ্যাঁরে দীপু, তোরা নাকি আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিস?
দীপঙ্কর বললে–কে বললে? কার কাছে শুনলে?
ফোঁটা বললে–দিদি বলছিল! আমরা না-হয় লেখাপড়া শিখিনি, তোরা তো লেখাপড়া শিখেছিস, তোদের এ কীরকম বুদ্ধি শুনি?
দীপঙ্কর বললে–এতদিন অঘোরদাদু ছিল, এতদিন একটা জোরও ছিল, এখন আর কে আছে বলো? কার জোরে থাকবো?
ফোঁটা বললে–কেন? কোন শালা তোদের তাড়াবে? আমি থাকতে কোন শালা তোদের বাড়ি থেকে বার করে দেয় দেখি?
দীপঙ্কর বললে–না, সে কথা নয়, এখন তো আমি বড় হয়েছি ভাই, এখন আলাদা বাড়ি ভাড়া করে উঠে যাওয়াই ভাল, চিরকাল তোমাদের বাড়িতে থাকবে, সেটাই কি ভাল দেখায়?
ফোঁটার তখন ঠিক সজ্ঞান অবস্থা নয়। সকাল থেকেই অনেক টেনেছে। সারা দিনই টানছে। শুধু ফোঁটা নয়, ছিটেও সঙ্গে সঙ্গে চালিয়েছে। অনেক মোহর, অনেক গয়না এসেছে হাতে। এতদিন পরে বাড়িটাও হাতে এসেছে।
ফোঁটা বললে–যতদিন ইচ্ছে তুই থাকবি, কোন শালা কিছু বলবে না।
দীপঙ্কর বললে–তুমি এখন ওদিকে যাও ফোঁটা। এখন তোমার এ-সব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না
ফোঁটা বললে–কী বললি তুই, আমি মাতাল হয়েছি?
দীপঙ্কর বললে–না, তা বলিনি, আমি বলছি, এখন আমার মনটা খারাপ, ওসব আলোচনা না করাই ভাল।
সত্যিই অঘোরদাদুর মৃত্যুটা যেন দীপঙ্করের জীবনের ভিটা পর্যন্ত টলিয়ে দিয়েছিল। এতদিনকার সম্পর্ক, এতদিনকার আকর্ষণ সব এমনি করেই বুঝি একদিন ছিঁড়ে যায় মানুষের। এই ছোটবেলা থেকে ধীরে ধীরে কত লোকের সঙ্গে কত সম্পর্ক গড়ে উঠলো, আবার একদিন কত সম্পর্ক ছিঁড়ে-খুঁড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল, তার হিসেবনিকেশ করতে গেলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এমনি করেই বুঝি একদিকে যেমন ভাঙে, আর একদিকে তেমনি গড়ে ওঠে। অঘোরদাদুকে খাটে তোলবার সময় কেউ কাঁদবার ছিল না বাড়িতে। কেউই কাঁদেনি সেদিন। একটা সস্তা তিন টাকা দামের খাঁটিয়া। আর দশ পয়সার নারকেল দড়ি। কিছু ফুল কেনবার ইচ্ছে ছিল দীপঙ্করের, কিন্তু ফোঁটা বলেছিল–দূর ফুলটুল দরকার নেই, মিছিমিছি পয়সা নষ্ট!
হয়ত সত্যিই পয়সা নষ্ট! কিন্তু তবু দীপঙ্করের মনে হয়েছিল যে-মানুষটা এত বড় সংসারের কর্তা ছিল একদিন, তার মৃত্যুতে এই পয়সা নষ্ট করাটাও যেন দরকার। সামান্য দু-আনার ফুল কিনে খাটের ওপর ছড়িয়ে দিলেই চলতো। কিন্তু তাতেও উত্তরাধিকারীদের আপত্তি। অঘোরদাদু বেঁচে থাকলে নিজেও হয়ত আপত্তি করতো না। দশ পয়সার দড়ি আর তিন টাকার একটা পকা খাঁটিয়া। আর সকারের খরচ তিন টাকা চার আনা। মোট ছটাকা সাড়ে ছ’আনা খরচ। লাখপতির শেষ খরচ। সেই সামান্য খরচটুকু করতেও যেন উত্তরাধিকারীদের আপত্তি।
একাদশী বাড়জ্জেমশাই খবর পেয়ে এসেছিলেন। বিরাট গাড়ি তার। গাড়ি থেকে নেমে খালি পায়ে এসে অঘোরদাদুর শেষ নশ্বর দেহটা দেখে গিয়েছিলেন। চাউলপটি রোডের বড়লোক যজমানরাও এসেছিলেন। যারা যারা খবর পেয়েছিলেন তারাই এসেছিলেন। পাড়ার লোকরাও এসেছিল। হালদার-বাড়ির কয়েকজন সেকেলে লোকও এসেছিল। যৌবনে এককালে যাদের সঙ্গে অঘোরদাদু মেলামেশা করতো, যাদের সঙ্গে গল্প-গুজব করতো-তারাও শেষবারের মত এসে কর্তব্যটা করে গেল।
কেউ কেউ বললেন–আহা বড় ভাল লোক ছিলেন ভট্টাচার্যি মশাই—
কেউ বললেন–পুণ্যাত্মা লোক ছিলেন তিনি, স্বর্গে চলে গেলেন—
একজন বললেন–কালীঘাট কানা হয়ে গেল এতদিনে গো–
অঘোর ভট্টাচার্যির সঙ্গে দীপঙ্কর কোনও দিন কাউকে মিশতে দেখেনি। অঘোরদাদুকে চিরকাল একলা মানুষই জেনে এসেছে দীপঙ্কর। অঘোরদাদু শুধু রিকশা চড়েছে আর দেবতার নৈবেদ্য নিয়ে এসে নিজের ঘরে জমিয়েছে। আর সারাদিন সমস্ত পৃথিবীর সব মানুষের মুখ পুড়িয়ে ছেড়েছে। সেই মানুষকেই এক মুহূর্তে পুণ্যাত্মা হতে দেখে দীপঙ্কর কেমন যেন অবাক হয়ে গিয়েছিল।
শুশান থেকে যখন ফিরলো সবাই তখন বাড়িটা নিঝুম।
ফোঁটা একবার চিৎকার করে উঠলো-বল হরি, হরি বোল–
সকলের সমবেত চিৎকার ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনটা যেন হঠাৎ থমথম্ করে উঠলো। একটা মানুষ শেষ হয়ে গেল, একটা যুগ শেষ হয়ে গেল। একটা পরিচ্ছেদ শেষ হয়ে গেল।
মা তৈরিই ছিল। নাপিত অপেক্ষা করছিল সকলের জন্যে। সকলের হাত-পায়ের নখ কেটে দিলে। প্রত্যেকের জন্যে একটু নিমপাতা আর একটা করে বাতাসা। নিমপাতাটা দাঁত দিয়ে কামড়ে বাতাসাটা খেতে হয়। ওতে কল্যাণ হয় পরলোকগত পিতৃপুরুষের। ওতে ‘না’ বলতে নেই, ওকে অস্বীকার করতে নেই। যুগ যুগ ধরে এই অনুষ্ঠান আর সংস্কারের শৃঙ্খলা দিয়ে বাঁধা তাদের জীবন। ভালো হোক মন্দ হোক–যদি অঘোরদাদুর আত্মার কল্যাণ হয় তাতে দোষ কী!
দীপঙ্কর উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিকটা চেয়ে দেখছিল। সমস্ত বাড়িটাই যেন ফাঁকা মনে হলো আজ। একদিন কাকাবাবুরা পাশের বাড়িটা ছেড়ে চলে গিয়েছিল–সেদিনও ফাঁকা মনে হয়েছিল। কিন্তু সে অন্যরকম। আজ যেন বাড়িটার আত্মাও মরে গেছে। আর কেউ স্নেহ দিয়ে ভর্ৎসনা দিয়ে গালাগালি দিয়ে দীপঙ্করকে রক্ষা করবার নেই। আজ দীপঙ্কর আর তার বিধবা মা যেন নিরাশ্রয় হয়ে গেল।
বিন্তিদি মা’র কাছ-ছাড়া হচ্ছে না সকাল থেকে। সকাল থেকে মার পাশে পাশে ঘোরাফেরা করছে। মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। ঘরের সিন্দুকটা সকালেই ছিটে ফোঁটা সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানটা ফাঁকা হয়ে আছে। দীপঙ্কর ঘরে ঢুকে দেখলে একটা মাদুর পেতে মা সেখানেই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। আর পাশে বিন্তিদি মায়ের কোল ঘেঁষে বসে আছে।
দীপঙ্কর বললে–মা, আমি একটু বেরোব–
মা বললে–এখন এত রাত্রে কোথায় বেরোবি তুই?
দীপঙ্কর বললে–এ-বাড়ি তো এবার ছাড়তে হবে আমাদের–
মা বললে–তা তো হবেই-কিন্তু তা বলে আজই? শ্রাদ্ধ-শান্তি চুকে যাক–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু এখন থেকেই তো খোঁজ-খবর করতে হবে। একটু ভদ্দরলোকের পাড়ার মধ্যে না হলে তো আর থাকা যাবে না!
মা বললে–তা তুই যা ভালো বুঝিস কর–আমি আর কী বলবো–
-–বা রে, তোমার জন্যেই তো বাড়ি ছাড়া! তুমিই তো বরাবর বলতে অন্য পাড়ায় যেতে! এতদিন অঘোরদাদুর জন্যেই তো যাওয়া হয়নি, এখন তো আর সে ভয় নেই। এখন তো তোমাকে গালাগালি দেবারও আর কেউ নেই!
মা কিছু বললে না। চুপ করে রইল শুধু। দীপঙ্করের মনে হলো অঘোরদাদুর মৃত্যুতে মা’র শোকটাই যেন সবচেয়ে গভীর। সেই অঘোরদাদুর পড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে এই সৎকারের শেষ অনুষ্ঠানটুকু পর্যন্ত একলা মুখ বুজে মা’ই সব করে এসেছে। এতটুকু কাঁদেনি। এতটুকু চোখের জল ফেলেনি। বাড়িতে চোখের সামনে এত বড় অনাচার, অবিচার, অত্যাচার হয়েছে তাতেও যেন মা এতটুকু বিচলিত হয়নি। মা’র নিঃশব্দ ব্যবহারই যেন সব শোকের পূর্ণতা প্রকাশ করে ফেলেছে। মা’র মুখে সকাল থেকে কথা বেরোয়নি একটা। যা কিছু করণীয় সব কিছু করে গেছে নিঃশব্দে। মানুষটাকে যখন সবাই শ্মশানে নিয়ে গেছে, মা বিন্তিদিকে কোলের মধ্যে পুরে সান্ত্বনা দিয়েছে। তার ও যে কেউ নেই। মা’কে কাঁদতে দেখলে তার যে কান্না রাখবার জায়গা থাকবে না। সে কার কাছে সান্ত্বনা খুঁজবে, কার কাছে আশ্রয় চাইবে! কতদিন মেয়েটার একটা বিয়ে দিতে চেয়েছে, কতদিন কত লোক এসে দেখে গিয়েছে তাকে! জলযোগ করেছে, মিষ্টি খেয়েছে, মেয়ে দেখেছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর আর কোনও খবর দেয়নি তারা। কোথাকার কার মেয়ে, বাপ-মা মরা মেয়ে বিন্তি! তাকে নিয়েই মা বাঁধা পড়ে গেল এখানে।
মুখখানা হাত দিয়ে তুলে ধরে মা বলে–হ্যাঁ রে, তোর কি ঘুমও পায় না? তুই সারাদিন আমার আঁচল ধরেই থাকবি?
কথা বললেও তবু বোঝা যেত, কিন্তু এ-মেয়ে কথাও বলে না, কাঁদেও না, রাগও করে না। শুধু বোবার মতন মা’র পিছু-পিছু ঘোরে।
–হ্যাঁ রে, তোর জন্যে কি আমি নরকেও যেতে পারবো না মা?
অঘোরদাদুর মৃত্যুর কয়েকদিন পর পর্যন্ত যেন অসাড় হয়ে গিয়েছিল এ-বাড়ির আধখানা জীবন। এই দীপঙ্কর, এই দীপঙ্করের মা, আর বিন্তিদি। আর আধখানা যেন নতুন জীবন পেয়ে গেছে! ছিটে-ফোঁটা আসর জাঁকিয়ে বসেছে এখানে। লক্কা-লোটন ও এসে উঠেছে এ-বাড়িতে। নতুন গয়না গড়িয়েছে দু’জনে। গাল ভর্তি করে পান খেয়েছে। পুরুত এসেছে, শ্রাদ্ধের ফর্দ তৈরি হয়েছে। ষোড়শ হবে, বৃষোৎসর্গ হবে। শুধু তাই নয়। একশো একজন ব্রাহ্মণভোজনের ফরমাশ দিয়েছে ফোঁটার। বলেছে–ঘটা করে শ্রাদ্ধ করতে হবে অঘোর ভট্টাচার্যির। নইলে বদ্নাম হবে। যজমানরা অসন্তুষ্ট হবে।
এ-সমস্তই লক্ষ্য করেছে দীপঙ্কর। কিন্তু কোনও কথাতেই কথা বলেনি। দীপঙ্করও বলেনি, মা-ও বলেনি, বিন্তিদিও বলেনি। এরা যেন এ-তরফের, ওরা ও-তরফের। বাড়ির সমস্ত আবহাওয়াই বদলে গিয়েছে। এ-বাড়িতে এতদিন হাসি ছিল না, শব্দ ছিল না, গোলমাল ছিল না। এখন সব এসেছে। ছিটে-ফোঁটা এখন এ-বাড়িতে বুক ফুলিয়ে বেড়ায়। লক্কা-লোটন এখন চেঁচিয়ে কথা বলে।
পুরুত মশাই আসেন। বলেন–বৃষোৎসর্গ হবে তো বাবাজী?
ছিটে বলে–আলবৎ হবে, বৃষোৎসর্গ না-হলে শ্রাদ্ধ কিসের?
–আর দান কেমন হবে?
যা যা প্রয়োজন, সবই করা হবে। অন্য লোকের শ্রাদ্ধে যা হয়, তার চতুগুণ হবে! দীপঙ্কর সবই শুনতে পায়। মা-ও সব শুনতে পায়। বিন্তিদিও শুনতে পায় সব। বড় বড় হাঁড়ি কড়া এসেছে, মণ মণ কাঠ এসেছে। ছিটে-ফোঁটার শাগরেদরা এসে বাড়ি গুলজার করে তুলেছে।
দীপঙ্করের মা একবার গিয়ে দাঁড়ায় চন্নুনীর ঘরে। চন্নুনী কথা বলতে পারে না ভাল করে। ময়লা বিছানাটার ওপর বেঁকে কুঁকড়ে শুয়ে থাকে। আর দীপঙ্করের মা’কে দেখলে চোখের জল ফেলে।
দীপুর মা বলে-কেমন আছো বাছা আজ?
চন্নুনী হাত নাড়ে। বলে-নেই–দিদি আমি আর নেই—
মা বলে–আমরা চলে যাচ্ছি, জানো চন্নুনী, আমরা বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি–
চন্নুনী বুঝতে পারে কথাটা। চোখ দিয়ে আরো বেশি করে জল পড়ে। হাত দিয়ে দীপুর মা’র হাতটা ধরে। কী যেন বলতে চায় বুড়ি। হয়ত বলতে চায় তার দশ ভরি সোনার হারটা দীপুকে দিয়েছে কি না। হয়ত আরো অনেক কিছু। বুড়িকে খানিক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করে আবার নিজের ঘরে এসে ঢোকে। আজকাল মা’র আর কোনও কাজ নেই। দুটি মানুষের রান্না আর খাওয়া।
দীপঙ্কর সকালবেলা যথারীতি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আবার সন্ধ্যেবেলা ফিরে আসে। আবার কোথায় বেরিয়ে যায় মাঝে মাঝে। কোথাও একটা মনের মত বাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না।
গাঙ্গুলীবাবু একদিন বলেছিল–আমাদের পাড়ায় ভাল বাড়ি আছে একটা, নেবেন সেনবাবু?
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু বউবাজারে যাবো, না, এই ভবানীপুরের দিকে খুঁজছি! গঙ্গার কাছে হলে ভাল হয়
গাঙ্গুলীবাবু বললে–আচ্ছা, যদি খোঁজ পাই তো বলবো আপনাকে–
দীপঙ্কর বললে–আমার কিন্তু খুব শিগগির দরকার-ও-বাড়িতে আর থাকা যাচ্ছে গাঙ্গুলীবাবু–আজ পেলে আজই উঠে যাই–
দুখানা ঘর হলেই চলবে। একখানাতে মা থাকবে আর একখানাতে দীপঙ্কর। যদি তিনখানা ঘর হয় তো আরো ভালো। সেখানা বসবার ঘর হবে! বাইরের লোকজন এলে বসবে!
শেষকালে পাওয়া গেল একটা বাড়ি। বেশ ভোলা চারদিকে। বাইরের টু-লেট টাঙানো দেখে ঢুকেছিল। সম্পূর্ণ আলাদা বাড়ি। দোতলা বাড়ি। নিচেয় দু’খানা বড় ঘর, ওপরেও দু’খানা। কলের জল আছে। বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে। স্টেশন রোড। ওপরের বারান্দা থেকে রেলওয়ে লাইন দেখতে পাওয়া যায়। দিন-রাতই ট্রেন আসা-যাওয়া করে। একটু শব্দ হবে। তা হোক। অভ্যেস হয়ে গেলে ওতে কোনও অসুবিধে হবে না। গঙ্গাটা একটু দূরে হয়ে গেল। মা’র গঙ্গাস্নান করতে অসুবিধে হবে। কিন্তু ভাড়ার দিকটাও দেখতে হবে। কুড়ি টাকা ভাড়া। এমন কিছু বেশি নয়।
পাশেই মালিকের বাড়ি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন–আপনি কী কাজ করেন?
দীপঙ্কর বললে—রেলওয়েতে—
ভদ্রলোকও নিশ্চিন্ত হলেন। বছর দু’তিন কোনও ভাড়াটেই পাচ্ছিলেন না ভদ্রলোক। খালি পড়ে ছিল বাড়িটা। আসলে কে আর শহর ছেড়ে এই বন-জঙ্গলের দিকে আসতে চায় বলুন। এখন তবু এদিকে লেক-টেক হয়েছে, একটু লোকজনের মুখ দেখতে পাচ্ছি। এই সেদিনও শেয়াল ডাকতো বাড়ির পেছনে। এই গড়িয়াহাটের মোড়ে তখনও বাজার হয়নি। ট্রামই ছিল না মশাই। লোকে আসবে কী করতে। একমাত্র এই রেল যা ভরসা। দীপঙ্কর পাঁচ টাকা আগাম দিয়ে দিলে।
ভদ্রলোক বললেন–কবে থেকে আসবেন?
দীপঙ্কর বললে–আজ থেকেই আসবো-আজ আর আপিসে যাবো না,
–সকালে না সন্ধ্যেবেলা?
দীপঙ্কর বললে–আজ দুপুরের মধ্যেই আসবো—
বাড়িতে ফিরতেই মা বললে–কী রে, এত দেরি? আপিস যাবি না?
দীপঙ্কর বললে–চলো, মা, বাড়ি ঠিক করে ফেলেছি, আজকেই চলে যাবো।
মা বললে–সে কী রে, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ ওমনি গেলেই হলো?
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আর যে আমার এখানে এক মিনিট থাকতে ইচ্ছে করছে না–
–তা এতদিন কাটালি, আর এই একটা দিন থাকতে পারবি না! কাল না-হয় যাবো–
দীপঙ্কর বললে–একটা দিনও আর আমার এখানে থাকতে ভাল লাগছে না মা, আমি এখুনি চলে যাবো-এখানে কি ভদ্দরলোক থাকতে পারে এর মধ্যে?
মা বললে–কিন্তু আজকে যে তোর জন্মদিন বাবা, জন্মদিনে এতদিনের বাসা ছাড়বি?
–কিন্তু আমি যে কথা দিয়ে এসেছি মা তাদের কাছে, আজকে দুপুরের মধ্যেই আসবো!
–তা আমাকে জিজ্ঞেস না-করে কেন কথা দিতে গেলি অমন? জানিস না আজ তোর জন্মদিন?
জন্মদিন বলে বাড়ি ছাড়া যাবে না, এমন কথা জানা ছিল না দীপঙ্করের! তাছাড়া আজকেই যে তার জন্মদিন, তাই-ই কি তার মনে ছিল!
দীপঙ্কর বললে–আমি পাঁচ টাকা বায়না দিয়ে এলুম যে!
–তা টাকা তো মারা যাচ্ছে না। জন্মদিনে কেউ বাড়ি ছাড়ে? তুই না-হয় এসব মানিস না, কিন্তু আমি মা হয়ে কেমন করে না-মেনে থাকতে পারি বল?
–তা হলে কবে যাবে?
মা বললে–কাল! কাল চল–
তা শেষ পর্যন্ত তাই ঠিক হলো। কালই যাওয়া হবে। এতদিনকার বাস উঠিয়ে কাল এখান থেকে চলে যাবে। এখানকার ভাল-মন্দ সমস্ত কিছুর সংস্রব ত্যাগ করে চলে যাবে। এখানকার কথা আর ভাববে না দীপঙ্কর। এই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল স্কুল, এই কালীঘাট, এই পাথরপটি, এই সোনার কার্তিকের ঘাট, এই মায়ের মন্দির, এই হাজি কাশিমের বাগান–এই সব কিছু ভুলে যাবে। বড় মধুর, বড় তিক্ত এই এখানকার স্মৃতি। এই সব স্মৃতি মুছে ফেলেই চলে যাবে। আর কাউকে মনে রাখবে না।
দীপঙ্কর বললে–তা হলে সঙ্গে কী-কী জিনিস যাবে বলো, আমি গুছিয়ে নিই।
মা বললে–তা এত তাড়াতাড়ি কিসের, বিকেল রয়েছে, সন্ধ্যে রয়েছে–পরে করলেই তো হবে, আপিস থেকে এসেই না-হয় করিস–
দীপঙ্কর বললে–না, সন্ধ্যেবেলা আমার বাড়ি আসতে দেরি হবে আজকে–
–কেন? সন্ধ্যেবেলা আবার কোথায় যাবি?
দীপঙ্কর বললে–রাত্রে আমি বাড়িতে খাবো না, আজকে–
-–কেন? কোথায় খাবি? কোথাও নেমন্তন্ন আছে নাকি?
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ–
–তা এতদিন থাকতে আজকেই নেমন্তন্ন? আজকে যে আমি তোর জন্যে ভাল-মন্দ রান্না করবো ভাবছিলাম!
দীপঙ্কর বললে–তা কী করা যাবে!
–তা কোথায় নেমন্তন্ন শুনি? কে নেমন্তন্ন করলে তোকে?
দীপঙ্কর বললে–সতী!
–সতী! মা-ও যেন চমকে উঠেছে–
বললে–কোন্ সতী? আমাদের সতী? সে আবার তোকে নেমন্তন্ন করতে গেল কেন? তার সঙ্গে তোর কোথায় দেখা হলো?
দীপঙ্কর বললে–এই এখানে। আমাদের বাড়িতে এসেছিল পরশু দিন–
–সে কী রে? আমি তো জানি না কিচ্ছু?
দীপঙ্কর বলল–সেই যেদিন অঘোরদাদু মারা গেল, সেই তখন। সব শুনে আর তোমার সঙ্গে দেখা করলে না। আমাকে বলেই চলে গেল। আর তখন বাড়ির মধ্যে যা কাণ্ড, কী করেই বা আসতে বলি–
মা বললে–তা তার তো বিয়ে হয়ে গেছে! কী রকম বিয়ে হলো কিছুই তো জানতে পারলুম না! তুই তার শ্বশুরবাড়ি চিনিস? তোকে ঠিকানা দিলে বুঝি?
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ–
–কিসের নেমন্তন্ন হঠাৎ?
দীপঙ্কর বললে–তা আমি কী কর জানবো বলো। তখন কি জিজ্ঞেস করবার সময়? হঠাৎ এসে বলে চলে গেল তখন আর অত-শত জিজ্ঞেস করবার সময় ছিল না।
–তা আরো সব লোকজন বোধহয় আসবে!
দীপঙ্কর বললে–না, আর কেউ নয়, শুধু আমাকে একলাই যেতে বলেছে।
মা তবু ব্যাপারটা বুঝতে পারলে না। এত দিন বাদে এত লোক থাকতে দীপঙ্করকেই বা একলা যেতে বলবে কেন? তারা তো বড়মানুষ। অনেক টাকাকড়ি তাদের। দীপঙ্করের সঙ্গে তাদের কিসের সম্পর্ক! একদিন ভাড়াটে হয়ে এসেছিল। এমন কত ভাড়াটেই তো এসেছে গেছে। কেউ তো আর কখনও ফিরেও একবার দেখা করতে আসেনি।
মা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁ রে, ছেলেপুলে কিছু হয়েছে নাকি সতীর? দেখলি কিছু? দীপঙ্কর হেসে ফেললে। বললে–সে-কথা বাপু আমি জিজ্ঞেস করতে পারিনি– ওসব কি মেয়েদের জিজ্ঞেস করতে পারা যায়?
মা বললে–জিজ্ঞেস করবি কেন, ও তো দেখেই বোঝা যায়! হলে তো সঙ্গেই থাকতো–
–না মা, ছেলে-মেয়ে কিছু সঙ্গে ছিল না। গাড়িতে আর কেউ ছিল না, একলাই এসেছিল।
দীপঙ্কর খেয়ে-দেয়ে আপিসে চলে গেল। গাঙ্গুলীবাবু টিফিনের সময় এসেছিল। দেখে অবাক হয়ে গেছে। বলল–এ কি সেনবাবু, আজ যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এসেছেন?
দীপঙ্কর বললে–আজ একটা নেমন্তন্ন আছে, সোজা আপিস থেকেই যাবো সেখানে–
–কোথায়? আত্মীয়ের বাড়িতে?
–না, আত্মীয়-স্বজন না, আমাদের পুরোন ভাড়াটে ছিল এককালে। খুব বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, হঠাৎ নেমন্তন্ন করে গেল।
–উপলক্ষ্যটা কী?
–তা জানিনে মশাই, এসে খেতে বলে গেল, আর আমিও রাজী হয়ে গেলুম।
–কিছু দিতে-টিতে হবে, না শুধু খাওয়া?
দীপঙ্কর বললে–সে সব তো কিছু বলে যায়নি, শুধু বলেছে খেতে!
–তাহলে বোধহয় ম্যারেজ অ্যানিভার্সারী, বিবাহ-বার্ষিকী! আজকাল ওই সব স্টাইল হয়েছে একরকম। অনেক জিনিসপত্র উপহার পাওয়া যায় ওতে–
দীপঙ্কর ভাবলে–তা হয়ত হতে পারে। হয়ত বিয়ের বার্ষিক উৎসব পালন করছে। কিন্তু সে-সব তো কিছুই বললে না সতী।
গাঙ্গুলীবাবু বললে–ওই, আমি যা বলেছি তাই, নিশ্চয়ই বিয়ের বার্ষিক উৎসব, আপনি বরং একটা কিছু উপহার কিনে নিয়ে যান
–কী কিনবো বলুন তো?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–যাই কিনুন, এক টাকা দু’টাকার কমে কিছুতেই হবে না।
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমি তো বেশি টাকা সঙ্গে আনিনি–আগে কথাটা মনেই আসেনি! শুধু ট্রামভাড়া আছে পকেটে, সকালবেলাই আবার পাঁচ টাকা বায়না দিয়ে এলুম বাড়িওয়ালাকে কিনা
–কোথায় বাড়ি পেলেন?
–বালিগঞ্জ স্টেশন রোডে!
গাঙ্গুলীবাবু বললে–কিন্তু সেখানে কি থাকতে পারবেন, শুনেছি বালিগঞ্জে তো ভীষণ মশা, আর কেবল বন-জঙ্গল চারদিকে–
দীপঙ্কর বললে–না গাঙ্গুলীবাবু, সে বালিগঞ্জ আর বন-জঙ্গল নেই, আপনি অনেকদিন যাননি ওদিকে গিয়ে দেখবেন, গড়িয়াহাটার মোড়ে একটা মস্ত বাজার হয়েছে, অনেক বড় বড় বাড়ি তৈরি হচ্ছে ওদিকে-একেবারে চিনতেই পারবেন না গেলে–
গাঙ্গুলীবাবু বললে–যাক্ গে, আপনি বরং দু’আনা দিয়ে একটা রজনীগন্ধার ঝাড় কিনে নিয়ে যান। সস্তাও হবে, স্টাইলও হবে
হঠাৎ মিস্টার ঘোষাল ঘরে ঢুকে পড়েছে।
ঘরে ঢুকেই বললে–হোয়ার ইজ মিস্ মাইকেল? মিস্ মাইকেল কোথায়?
গাঙ্গুলীবাবু আর দীপঙ্কর দু’জনেই দাঁড়িয়ে উঠলো।
দীপঙ্কর বললে–মিস্ মাইকেল আজকে আপিসে আসেনি স্যার-অ্যাবসেন্ট!
–আই সী!
তারপর মিস্টার ঘোষাল কী ভাবলে কে জানে! হঠাৎ চলে যেতে যেতে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে–সেন, সী মি ইন মাই রুম, আমার ঘরে একবার দেখা করবে এসো
বলেই গট গট করে মিস্টার ঘোষাল তার নিজের ঘরে চলে গেল। গাঙ্গুলীবাবু বললে–হঠাৎ আপনাকে ডাকলে যে ঘোষাল সাহেব, সেনবাবু?
–কী জানি! দেখি–
বলে দীপঙ্কর সোজা মিস্টার ঘোষালের ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই মিস্টার ঘোষাল হঠাৎ বললে–টে ইয়োর সীট সেন, বোস চেয়ারটায়
দীপঙ্কর বসলো। কিন্তু কেমন অবাক হয়ে গেল। এমন ব্যবহার তো করে না ঘোষর সাহেব। কদর্য মুখটা যেন হাসি-হাসি। বললে–ডু ইউ নো, আমি তোমায় প্রোমোট, করেছি?
দীপঙ্কর তবু বুঝতে পারলে না। এই সেদিন রাত্রে ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে মিস্ মাইকেলের ঘরে দেখা হয়েছিল। তখনই ঘৃণায় রি-রি করে উঠেছিল মনটা। আজ হাসিমুখ দেখেও দীপঙ্করের কোনও ব্যতিক্রম হলো না।
মিস্টার ঘোষাল সিগ্রেট ঠোঁটে লাগিয়েই বললে–ইয়েস, আই হ্যাভ প্রোমেট ইউ টু ডি-টি-আই-তোমার পেপার আমি দেখেছি-ইউ হ্যাভ ফেয়ার্ড ওয়েল–
কথাটা বলে যেন মিস্টার ঘোষাল একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে লাগলো।
তারপর বললে–তোমার প্রসপেক্ট আছে, তুমি উন্নতি করবে জীবনে, মন দিয়ে কাজ করবে, আরো উন্নতি করে দেব তোমার-যাও
ব্যাপারটা এত হঠাৎ ঘটলো যে দীপঙ্কর ধন্যবাদ দিতেও যেন ভুলে গেল। কী অদ্ভুত প্রকৃতির লোক! এমন সোজা সরল মিথ্যে কথাটা বলতেও বাধল না!
বাইরে আসতেই গাঙ্গুলীবাবু জিজ্ঞেস করলে–কী হলো সেনবাবু? কী বললে ঘোষাল সাহেব?
দীপঙ্করের কাছে ব্যাপারটা শুনে গাঙ্গুলীবাবু বললে–শালা একেবারে আসল শুয়োরের বাচ্চা! করলে রবিনস সাহেব আর ক্রেডিট নিলে নিজে? এ তো মানুষ খুন করতে পারে মশাই! আপনি কিছু বললেন না?
দীপঙ্কর বললে–বলতে দিন, মানুষ চিনতে পেরেছি এইটেই তো আসল লাভ, আর কী চাই–
গাঙ্গুলীবাবু চলে গেল। রবিনসন সাহেবও সকাল সকাল চলে গেল। ঘন ঘন ঘড়ির দিকে দেখছিল দীপঙ্কর। জানলা দিয়ে বাইরেও একবার চেয়ে দেখলে। সন্ধ্যের সময় যেতে বলেছে সতী। ছ’টার সময়েও সন্ধ্যে! ঠিক কখন গেলে যে মানানসই হয় তা ঠিক করতে পারলে না দীপঙ্কর।
রাস্তায় বেরিয়ে ট্রামে করে জগুবাবুর বাজারের মোড়ে নামতে হলো। অনেক বেছে বেছে রজনীগন্ধার একটা ঝাড় কিনলে। গাঙ্গুলীবাবু বলেছিল দু’আনা নেবে। কিন্তু ছ’পয়সাতেই দিয়ে দিলে। একটা পাতলা সাদা কাগজে বেশ ভাল করে মুড়ে দিলে। তারপর আবার ট্রামে উঠে হাজরা রোডের মোড়ে এসে নামলো।
প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের ভেতরে ঢুকে সতীদের বাড়িটা।
দারোয়ানটা বসেছিল। সামনে গিয়েও কেমন একটু বুকটা কাঁপতে লাগলো দীপঙ্করের।
কিন্তু সামনে যেতেই দারোয়ানটা উঠে দাঁড়াল।
বললে–আপনার নাম দীপঙ্করবাবু?
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ–
দারোয়ান বললে–আইয়ে, ভিতর আইয়ে–
দারোয়ানটা আগে আগে চলতে লাগলো। দীপঙ্কর পেছনে। ইট বাঁধানো লম্বা রাস্তা গিয়ে মিশেছে সোজা আস্তাবল বাড়ির দিকে। উত্তর দিকে লন্। লন্-এর চারপাশে বাগান। বড় রাস্তাটা থেকে আর একটা ইঁট বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে বাঁদিকে। সেদিকে একতলায় অনেকগুলো ঘর পাশাপাশি। কাঁচের জানলার ভেতরে ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে। তার সামনেই দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। সিঁড়ির ওপর কার্পেট পাতা। দীপঙ্কর চারদিকে চেয়ে হতবাক হয়ে গেল। এত ঐশ্বর্য! এই ঐশ্বর্য দেখাতেই সতী তাকে ডেকেছে নাকি?
দারোয়ানটা হঠাৎ বললে–আইয়ে বাবুজী–উপর আইয়ে–
দারোয়ানের পেছন পেছন দীপঙ্কর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো।
কত ঐশ্বর্য, কত বিলাস চারদিকে ছড়ানো! সিঁড়ির দু’পাশে ছোট ছোট টবে পাতা বাহার গাছ। বাঁকের মাথায় মোরাদাবাদী ভাসের ওপর ক্যাক্টাস্। কোথাও এতটুকু ধুলো নেই, এতটুকু অসংযম নেই। সিঁড়ির মাথায় একটা পাপোশের ওপর কালো অক্ষরে একটা মনোগ্রাম লেখা। দেয়ালগুলো সাদাও নয়, সবুজও নয়, দুটোর মাঝামাঝি কেমন একটা তেল-চক্চকে জলুস! এ কোথায় তাকে নিয়ে যাচ্ছে দারোয়ানটা! এত পরিছন্নতার মধ্যে জুতো পরে চলতেও যেন মায়া হচ্ছে।
একতলা থেকে দোতলা। দোতলার পর তিনতলা।
সত্যিই ভুবনেশ্বরবাবু অন্তত একটা মেয়ের বিয়ে দিয়ে শান্তি পেয়েছেন। দীপঙ্কর অবাক হয়ে চারদিকে দেখতে লাগলো। এ কী বাহার, এ কী বিলাস! কলকাতা শহরের মধ্যে যাদের টাকা আছে তারা কি এমনি সুখেই জীবন কাটায়! এমন ঐশ্বর্যের মধ্যে বাস করতে হলে সত্যিই অনেক সৌভাগ্য থাকা চাই। সতী ছোট থেকেই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে। তার যে এমন ঐশ্বর্য হবে, তখনই বোঝা গিয়েছিল। মা’র সঙ্গে মন্দিরে যেত, গঙ্গায় স্নান করতে যেত। বিন্তিদিকে দেখতে আসার সময় নিজের গয়নাগুলো পরিয়ে সাজিয়ে দিত। দীপঙ্করের বড় ভালো লাগলো। বড় ভালো লাগলো সতীর সৌভাগ্য দেখে। এতদিন মনে মনে যে-ক্ষোভটা ছিল তা এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। সত্যিই তো, দীপঙ্করের সঙ্গে তার সম্পর্কই বা কিসের! পাশাপাশি বাড়িতে ছোটবেলা থেকে থাকা ছাড়া আর কিসের সম্পর্ক!
–এই যে এসে গেছ, আমি ভাবলাম তুমি বুঝি ভুলে গেলে!
বারান্দায় একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েছিল সতী। দীপঙ্কর চোখ তুলে দেখলে। এই চারিদিকের অফুরন্ত ঐশ্বর্যের মধ্যে সতীকে যেন অন্যরকম দেখালো। একেবারে অন্যরকম। হাসি-হাসি মুখ। অল্প একটু ঘোমটা দিয়েছে। একটা নীল শাড়ি পরেছে। চুমকি বসানো ব্লাউজ একটা গায়ে। মাথার পেছন দিকটা খুব ভারি। মনে হলো যেন মস্ত বড় একটা খোঁপা ঝুলছে কাদের ওপর।
–দারোয়ান, তুমি নিচে চলে যাও–
দারোয়ান সসম্ভ্রমে সেলাম জানিয়ে চলে গেল। দীপঙ্কর স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছিল সতীর দিকে। বিয়ে হবার পর আজকেই বলতে গেলে সত্যিকারের প্রথম দেখা। সেদিন নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটে গাড়ির ভেতরে বসা সতী যেন এ নয়। এ যেন আলাদা।
সতীও একটু এগিয়ে এল। বললে–তোমার এত দেরি হলো যে?
দীপঙ্কর অবাক হলো। দেরি করে এসেছে নাকি সে! তার নিজের যেন মনে হচ্ছিল একটু সকাল-সকালই এসে পড়েছে। বললে–দেরি কোথায়, আমি তো ভাবছিলাম আরও পরে এলে ভালো হতো
–ও, তুমি ভেবেছিলে খেয়ে-দেয়েই পালিয়ে যাবে।
দীপঙ্কর বললে–খাবার নেমন্তন্ন করলে আগে কী করে আসি?
সতী হঠাৎ বললে–হাতে কী তোমার?
দীপঙ্কর একটু লজ্জায় পড়লো। বললে–ফুল।
–ফুল? ফুল কী হবে? ফুল কার জন্যে?
দীপঙ্কর বললে–তোমার জন্যে।
–আমার জন্যে?
সতীও অবাক হয়ে চাইলে দীপঙ্করের মুখের দিকে। একটু আগেই বোধহয় সাবান দিয়ে গা ধুয়ে এসেছে সতী। মুখে স্নো পাউডার মেখেছে। গলা পর্যন্ত সমস্ত মুখখানা ধপধপ করছে। বাগান থেকে তোলা টাটকা ফুলের মত। আর মাথায় সিঁথির আগায় লাল টক্ট করছে সিঁদুর। সিঁদুরের পাতলা রেখাটা যেন হোমের আগুনের মত জ্বলছে।
–তা আমার জন্যে আবার ফুল আনতে গেলে কেন?
দীপঙ্কর বললে–একটা কিছু উপহার তো দিতে হবে!
–কিসের উপহার?
–বারে, তোমাদের বিয়ের বার্ষিকী উৎসব করছো, আর আমি খালি হাতে আসি কী করে?
সতী হো হো করে হেসে উঠলো। হাতটা ধরে বললে–এসো এসো, ঘরে এসো- বসবে চলো
চচ্চকে মেঝে। দীপঙ্করের জুতো পরে চলতে লজ্জা হচ্ছিল। বললে–জুতোটা এখানে খুলি
সতী বললে–কেন?
দীপঙ্কর বললে–তোমাদের বাড়ি যা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, জুতোটা খুলে এলেই ভালো হতো! বলে জুতো-জোড়া খুলে রাখলে দরজার পাশে। বললে–এখানে রাখবো?
সতী বললে—থাক–
দরজায় পাতলা জালি-পর্দা ঝুলছিল। দু’পাশে কর্ড দিয়ে বাঁধা। ঘরের ভেতরে পরিষ্কার তত করছে মেঝে। মধ্যেখানে একটা মিনে-করা বিরাট থালার মত টিপয়। তার ওপর জাপানী ফুলদানী। অনেক ফুল রয়েছে তাতে। টিপয়টার চারপাশে আপহোলস্টার্ড সোফা কোচ সাজানো। কিউবিজম্ ধরনের ডিজাইন সোফদার গায়ে। দীপঙ্কর গিয়ে বসলো। একটাতে। ঘরটা যে এত বড় তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। এদিকটাতে সোফা কোচ, আর আর এক প্রান্তে একটা ডবল ডিভান। আগাগোড়া লেদার ফিটিং। আর মাঝখানে অনেকখানি খালি মেঝে। দেয়ালের দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। একজন বৃদ্ধ লোকের ছবি টাঙানো। পোট্রট। ঠিক তার উল্টোদিকের দেয়ালে একটা জোড়া-ছবি। চেয়ারে বসে আছে সতী আর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আর একজন অচেনা ভদ্রলোক।
ফুলের ঝাড়টা সতী একটা ভাসের মধ্যে রেখে দিয়ে দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললে–ওঁকে চিনতে পারছো তো? ওই আমার বাবা
ভুবনেশ্বর মিত্র এতক্ষণে চিনতে পারলে দীপঙ্কর। যেদিন প্রথম বর্মা থেকে আসেন ভদ্রলোক সেদিনই দেখেছিল। সেই প্রথম আর শেষবার। ছোট একটু দাড়ি চিবুকের ওপর। সতী যেন বাবার কাছ থেকে সেই তেজটা পেয়েছে। যৌবনের আর রূপের তেজ। স্নিগ্ধ শান্ত অথচ প্রখর তেজ একটা। যে-তেজের জন্যে দীপঙ্কর বরাবর আকর্ষণ বোধ করলেও কেমন যেন দূরে দূরে থেকেছে।
সতী হাসতে লাগলো। বললে–আমার দিকে বার বার অমন করে কী দেখছো?
দীপঙ্কর বললে–তোমার বাবার চেহারার সঙ্গে তোমাকে মিলিয়ে নিচ্ছি–
সতী বললে–আমি বাবার চেহারার কিছুই পাইনি। যাক গে, আর এদিকে এঁকে চিনতে পারছো? ইনিই হলেন আমার কর্তা
সতীর ‘কর্তা’ কথাটা বলার ধরন দেখে দীপঙ্কর বেশ মজা পেলে। বললে–ইনিই বুঝি সনাতনবাবু? বাঃ, বেশ চমৎকার চেহারা তো!
সতী নিজের স্বামীর চেহারার প্রশংসা শুনে যেন খুশী হলো মনে মনে। বললে–বাবা আমার অনেক দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছেন, খারাপ চেহারা দেখে বিয়ে দেবেন কেন?
দীপঙ্কর কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বললেন, আমি তা বলছি না, সত্যি আমি ভাবতেই পারিনি এত বড়লোকের বাড়ি তোমার বিয়ে হবে! আরো একদিন তোমার সঙ্গে দেখা করবো বলে তোমাদের বাড়ির সামনে ঘুরে গেছি, কিন্তু তোমাদের দারোয়ানের চেহারা দেখে ভয়ে ঢুকতে পারিনি!
সতী বললে–লোকটা কিন্তু ভালো, ওই গোঁফজোড়াটা দেখলেই খালি ভয় করে
দীপঙ্কর বললে–তোমার বিয়ের সময় নেমন্তন্ন খেতে পাইনি বলে একটা দুঃখ ছিল মনে, তুমি সে-দুঃখটা আজ সুদে-আসলে মিটিয়ে দিলে–
বলে হাসবার চেষ্টা করলে দীপঙ্কর। তারপর সতীর মুখের দিকে চেয়ে বললে কিন্তু, একটা কথা বুঝতে পারছি না, তোমাদের বিয়ের বার্ষিক উৎসবে আমাকে একলা শুধু নেমন্তন্ন করলে কেন?
সতী মুখ টিপে হাসতে লাগলো। বললে–আমাদের বিয়ের বার্ষিকী, এ তোমায় কে বললে?
দীপঙ্কর বললে–আমি বুঝতে পারি। প্রথমটায় আমার খেয়াল ছিল না। শেষে ভাবলাম বিনা উপলক্ষ্যে আমাকে কেন নেমন্তন্ন করতে যাবে সতী! অনেক ভেবে ভেবে যখন বার করলাম–তখন এই রজনীগন্ধার ঝাড়টা কিনে আনলুম–
সতী বললে–কেন, বিনা উপলক্ষ্যে নেমন্তন্ন করতে নেই কাউকে?
দীপঙ্কর বললে–সত্যি বলল না, আর কাউকে নেমন্তন্ন করোনি কেন?
–আরে, একে নিয়ে তোতা এক মহা মুশকিলে পড়া গেল দেখছি! তোমাকে একলা নেমন্তন্ন করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?
দীপঙ্কর চুপ করে গেল। সত্যিই তো যার যাকে কুশি নেমন্তন্ন করবে, তাতে কার কী বলবার থাকতে পারে! কথাটা ভাবতে দীপঙ্করের একটু গর্বও হলো।
বললে–আমাকে একলা নেমন্তন্ন করে তুমি আমাকে খাতির করলে, না সম্মান দিলে তা বলতে পারি না, আমার কিন্তু মনে মনে খুব গর্ব হচ্ছে সতী!
তারপর একটু থেমে বললে–কিন্তু তিনি কোথায়?
–কে?
–তোমার স্বামী! সনাতনবাবু! তোমাদের বাড়িতে এসে একলা-একলা তোমার সঙ্গে এক-ঘরে বসে গল্প করছি, এটা যেন কী-রকম দেখাচ্ছে! তিনি আসবেন না? তাঁকে ডেকে দাও?
সতী হাসলো। বললে–ওমা, তাঁকে ডাকবো কী করে? তিনি তো নেই বাড়িতে!
দীপঙ্কর বললে–কোথাও বেরিয়েছেন বুঝি?
সতী অবাক হলো। বললে–ও, তোমাকে বলিনি বুঝি? তিনি তো পুরী গেছেন! তিনিও গেছেন, আমার শাশুড়ীও গেছেন, আজ তিনদিন হলো–
দীপঙ্কর যেন আকাশ থেকে পড়লো। সেই জন্যেই কোনও শব্দ শোনা যায়নি। সমস্ত বাড়িটাতে ঐশ্বর্যের চিহ্ন থাকলেও যেন বড় ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিল। সেই জন্যে বাড়িটাতে ঢুকে মনে হচ্ছিল যেন কেমন জনমানবহীন! দারোয়ান চাকর-বাকর আছে বটে, কিন্তু যেন তবু কেউ নেই ৷
–তা তোমার ছেলে-মেয়েও বুঝি সঙ্গে গেছে?
সতী হেসে গড়িয়ে পড়লো। বললে–তোমার আক্কেল তো বলিহারি! মাকে ছেড়ে ছেলে-মেয়ে থাকতে পারে?
–আমিও তো তাই ভাবছি! তুমি রইলে এখানে, আর তোমার ছেলেমেয়েরা চলে গেল বাবার সঙ্গে! তা তারা কোথায়? তাদের তো দেখতে পাচ্ছি না?
সতী বললে–পারি না বাপু তোমার সঙ্গে কথা বলতে!
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমি কী করবো বলো, মা’কে যখন বললাম যে তুমি নেমন্তন্ন করে গেছো, তখন মা-ই আমাকে জিজ্ঞেস করলে–তোমার ছেলে-পুলে হয়েছে কি না–
সতী বললে–তা হলে তো এতক্ষণ দেখতেই পেতে, কিন্তু না হলে কী করবো?
দীপঙ্কর বললে–হয়ই নি?
দীপঙ্কর মনে মনে হিসেব করতে লাগলো–কত বছর আগে বিয়ে হয়েছে সতীর!
–দাঁড়াও, আমি দেখে আসি মাংসটা কী হলো!
দীপঙ্কর বললে–তুমিই রান্না করছো নাকি?
সতী বললে–না, ঠাকুর আছে, কিন্তু তোমাকে একদিনের জন্যে নেমন্তন্ন করেছি, তাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। শেষকালে যদি নুনে পুড়িয়ে দেয়, তখন কি আমার মুখ থাকবে? পুরোন ঠাকুরকে যে আমার শাশুড়ী পুরীতে নিয়ে গেছেন, এ তেমন সুবিধের ঠাকুর নয়–
–তাহলে তো তোমার খুব কষ্ট হলো?
সতী হাসলো। বললে–রাঁধতে কি কষ্ট হয় নাকি মেয়েদের?
দীপঙ্কর বললে–না, তা বলছি না, ওঁরা পুরী থেকে ফিরে এলেই নেমন্তন্ন করলে পারতে! তাহলে সনাতনবাবুর সঙ্গেও আলাপ হতো, আর তোমারও এই দুর্ভোগ হতো না–
সতী বললে–বাঃ জন্মদিন বুঝি কারো বদলানো যায়?
জন্মদিন? জন্মদিনের কথাটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ! তার জন্মদিন, সেকথা সতীর কি করে মনে থাকলো?
বললে–আজকে যে আমার জন্মদিন, তা তোমার কী করে মনে রইল?
সতী বললেবোস, আমি মাংসটা দেখে এক্ষুনি আসছি,–
বলে সতী ঘর থেকে চলে গেল। সতী চলে যেতেই দীপঙ্কর কেমন অবাক হয়ে গেল। তার জন্মদিনের কথা তো এক মা ছাড়া আর কারো জানবার কথা নয়। আর জানলেও মনে রাখবার কথাও তো নয়। আশ্চর্য তো! আর সতীই বা কেমন মেয়ে! স্বামী নেই, শাশুড়ী নেই বাড়িতে, হঠাৎ তাকে কি না নেমন্তন্ন করে বসলো! এদের সমাজে কি এটা চলে! আর সনাতনবাবুই বা কেমন, আর সতীর শাশুড়ীরই বা কী-রকম আক্কেল! তারা পুরী গেলেন তাদের বউকে একলা ছেড়ে! আর সতী তাকে ঠিক এই সময়েই নেমন্তন্ন করে বসলো, যখন বাড়ির লোকজন কেউ নেই! এটা কি সতীর পক্ষে ভাল কাজ হয়েছে!
খানিক পরেই সতী ঘরে ঢুকলো হাওয়ায় ভেসে। বললে–তোমাকে বসিয়ে রেখে গেছি অনেকক্ষণ,-কিছু মনে করলে না তো আবার–
দীপঙ্কর বললে–বা রে বা, তোমার কাছে আমি আজ নতুন মানুষ হলুম নাকি? সতী বললে–নতুন না হোক, আমার শ্বশুরবাড়ি তো নতুন–
দীপঙ্কর বললে–আচ্ছা সতী, সনাতনবাবুর এ-ব্যাপারটা তো বুঝতে পারছি না, মাকে নিয়ে তিনি পুরী গেলেন তোমাকে এখানে একলা ফেলে এটা কী রকম?
সতী খিল খিল করে হেসে উঠলো-বললে–বিয়ের পর এতদিন কেটে গেল, এখনও ভয় থাকবে নাকি? কী যে বলো তুমি? আমি কি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো?
–না, পালিয়ে যাবার কথা হচ্ছে না, কিন্তু….
–কিন্তু কী? বিরহ?
দীপঙ্কর বললে–তিনি তো তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছেন?
সতী বললে–না গো না, তুমি যা সন্দেহ করছে তা নয়, আমাদের দুজনের খুব। টান আছে!
তারপর একটু থেমে বললে–আসলে আমার শাশুড়ীর একটা মানত ছিল কি না, তাই গেছেন। তা বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে যাব সেটা তো ভাল দেখায় না, তাই আমি বললুম আমি থাকবো
দীপঙ্কর বললে–কবে আসবেন সবাই?
সতী বললে–গেছেন তো মাত্র তিনদিন আগে, আসতে সেই পরের সপ্তাহ হয়ে যাবে–
দীপঙ্কর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো সতীকে। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ভাড়াটে বাড়ির সতী, কলেজে যেত বাসে করে, আর এখানে এসে একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। কেমন যেন বউ-বউ চেহারা। গালে মুখে গলায় বুকে যেন একটু মন্থরতা এসেছে। একটু মোলায়েম হয়েছে। তা বিয়ের পর এই রকম হওয়াই তো স্বাভাবিক। শুধু লক্ষ্মীদির চেহারাই আরো খারাপ হয়ে গেছে। যেন আরো কঠোর, আরো প্রখর।
–তা সারাদিন কী করো তুমি? এত চাকর-ঝি, তোমাকে বোধহয় কিছুই কাজ করতে হয় না! কী করে সময় কাটাও তোমার? দু’জনে বুঝি খুব ঘুরে বেড়াও গাড়ি নিয়ে?
সতী বললে–এক এক দিন যাই–
–কোথায় যাও?
–এই একদিন হয়ত বোটানিক্সে, আর একদিন হয়ত যশোর রোড ধরে সোজা যতদূর খুশি চলে যাই। তারপর যখন ও ফিরতে বলে তখন ফিরি। এক-একদিন ঝম্। ঝম করে বৃষ্টি আসে, আমরা গাড়ির ভেতরে বসে বসে বৃষ্টি-পড়া দেখি–
দীপঙ্কর বললে–সত্যি তোমরা খুব সুখে আছো সতী!
–তোমার হিংসে হচ্ছে বুঝি?
দীপঙ্কর বললে–না, আমার নিজের কথা ভাবছি, সকালবেলা তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে আপিসে যেতে হয় তো, তারপর কতরকম লোকের সঙ্গে কতরকম কথা বলতে হয়, সে এক জঘন্য জগৎ সতী! অথচ এখন ভাবি এই চাকরির জন্যেই একদিন কত খোশামোদ, কত ধরাধরি! এখানে বেশিদিন চাকরি করলে মনুষ্যত্ব চলে যাবে আমার মনে হচ্ছে–
–কেন?
দীপঙ্কর বললে–সে তুমি বুঝবে না, আর বুঝতেও যেন কখনও না হয়। সে না বোঝাই ভাল। চাকরির জন্যে মানুষ এমন হীন কাজ নেই যা করতে পারে না! মিথ্যে কথা বলতে গেলে মুখ একটু কোঁচকায় না পর্যন্ত…তা আপিসের কথা থাক গে
–না, থাকবে কেন! আমি তোমাদের আপিসে যাবো একদিন!
–তুমি?
–হ্যাঁ, গেলে দোষ কী?
দীপঙ্কর বললে–দোষ আর কী? কিন্তু তোমরা এত সুখে আছো, আপিসে যাবেই বা কেন? আর গেলে লোকেই বা বলবে কী?
–তোমার প্রমোশন-টমোশন কিছু হলো?
দীপঙ্কর বললে সব। কেমন করে সামান্য চাকরি থেকে তাড়াতাড়ি উন্নতি হয়েছে তার। যা কখনও কারো হয়নি। অথচ ঘুষও দিতে হয়নি, খোশামোদও করতে হয়নি। কে জানে কেন যে রবিনসন সাহেবের সুনজরে পড়ে গেছে সে, তার ফলেই চাকরিটা চলছে ভালমতন। নইলে প্রাণ বেরিয়ে যেত আপিসে। আরো অনেক কথা বলে গেল দীপঙ্কর। নতুন বাড়ি ভাড়া করেছে স্টেশন রোডে, অঘোরদাদুর মৃত্যু, ছিটে-ফোঁটার ব্যবহার, লক্কা-লোটন কারোর কথাই বাদ গেল না। আর বিন্তি!
সতী বললে–এখনও বিয়ে হয়নি?
দীপঙ্কর বললে–তুমি একটু চেষ্টা করো না সতী। তুমি একটু চেষ্টা করলেই হয়। মেয়েটার জন্যেই মা ভেবে-ভেবে অস্থির। কী করে যে বাড়ি ছেড়ে যাবো আমরা তাই ভাবছি। কিন্তু যা গে
বলে অন্য প্রসঙ্গ ওঠালে দীপঙ্কর। বললে–ও-সব বাজে কথা থাক্, তোমার কথা বলল
সতী বললে–আমার কথা কী বলবো? আমাকে তো সামনেই দেখতে পাচ্ছে! খাই দাই ঘুমোই, আর কী খবর থাকতে পারে?
দীপঙ্কর বললে–বিয়ের পরে তো এই প্রথম তোমার সঙ্গে দেখা হলো। শ্বশুরবাড়ি কেমন, নতুন বর তোমার কেমন হলো, দু’জনে কেমন কাটাচ্ছ সেইসব কথা বলো।
সতী হেসে ফেললে। বললে–যেমন সবাই কাটায় তেমনি কাটাচ্ছি। বিয়ের পর একবার ওর সঙ্গে বাবার কাছে গিয়েছিলাম, এক মাস থেকে চলে এসেছিলাম
দীপঙ্কর বললে– এখানে এ-বাড়িতে ঢুকে পর্যন্ত আমার খুব ভালো লাগছে, জানো সতী! মনে হচ্ছে, অন্তত এমন একজনকেও জানি যে জীবনে সুখী হয়েছে। সংসারের চারদিকে নানান্ ব্যাপার দেখে দেখে মনটা বড় ভারী হয়ে গেছে। নিজে সুখী নাই বা হতে পারলাম, তুমি তো সুখী হয়েছ, এতেই আনন্দ হয়েছে আমার
সতী বললে–যাক্ গে, তোমাকে আর বুড়োমানুষী করতে হবে না! তোমার কী এমন কষ্টটা শুনি?
দীপঙ্কর বললে–বলছো কী? কষ্ট নয়?
–শুনিই না, কিসের কষ্ট তোমার? চাকরিতে প্রমোশন হয়েছে, আলাদা বাড়ি ভাড়া করেছ–
–তা চাকরি আর বাড়ি হলেই বুঝি সব কষ্ট ঘুচে যায় মানুষের?
সতী হেসে বললে–এখন বাকি আছে শুধু বিয়েটা! আমিই মাসীমাকে গিয়ে কথাটা বলে আসবো। না, সত্যিই এবার তোমার বিয়েটা দেওয়া দরকার! একলা একলা আর ভালো লাগছে না বুঝতে পারছি!
দীপঙ্কর বললে–তোমার মত সুখের বিয়ে হলে বিয়ে করতেও রাজী আছি আমি– সতী বললে–বিয়ে করে আবার কারো কষ্ট হয় নাকি?
দীপঙ্কর বললে–হয় না? আমাদের আপিসেই কত লোক আছে, বিয়ে করে পস্তাচ্ছে–তুমি নিজে সুখে আছো বলে তাই ওইরকম ভাবছো–তোমাদের এই সংসার, টাকার অভাব নেই, ঐশ্বর্যের অভাব নেই, এক গ্লাস জল পর্যন্ত তোমাকে গড়িয়ে খেতে হয় না, বিয়ে করা তো তোমাদেরই পোষায় সতী–
সতী বললে–তা আমরা সুখে আছি বলে তুমি যেন বাপু নজর দিও না–হ্যাঁ
–না না, দারিদ্র্য তো তুমি দেখনি সতী। আমি দেখেছি, এই আমার কথাই ধরো না, ছোটবেলায় কী কষ্টে যে মানুষ হয়েছি, বলতে গেলে ভিক্ষে করে পরের বাড়ি রান্না করে মা চালিয়েছে। সে তো তুমি দেখেছ। আমার বড় সাধ ছিল স্বদেশী করবার, দেশের শতকরা নব্বই জনই তো আমাদের মতন অবস্থা, রাস্তার কাটা ডাব কুড়িয়ে এক-একজন ভদ্রলোকের ছেলে পেট ভরায়, জানো, তাই যখন স্বদেশীদের বোমার ঘায়ে বড় বড় জজ্-ম্যাজিস্ট্রেট, লালসাহেবরা খুন হয়, তখন বড় কষ্ট হয় মনে। মনে হয়, আমি কিচ্ছু করতে পারছি না। আমি চাকরি করছি বাধ্য হয়ে, মনে হয়, আমি দেশের কোনও কাজে লাগলাম না! তোমাদের মতন টাকা যদি থাকতো তো আমাকে আর চাকরি করে সময় নষ্ট করতে হত না
সতী চুপ করে শুনতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–তোমাদের এত টাকা, এত সুখ দেখে বড় ভালো লাগলো। তাই বলছি, দেশের প্রত্যেকটা লোকের এইরকম, সুখ, এইরকম ঐশ্বর্য যেদিন হবে, সেইদিনই আমার সুখ হবে–
সতী বললে–তুমি দেখছি এখনও সেইরকম আছ–
–কী রকম?
–যে-রকম ছিলে আগে! ভেবেছিলাম এতদিন পরে একটু সেয়ানা হয়েছ বুঝি!
দীপঙ্কর বললে–তুমি জানো না সতী, আমরা সব প্রাণমথবাবুর হাতে-গড়া মানুষ। আমরা ভালোর সুগার-কোটিং দিয়ে খারাপ জিনিসের বেসাতি করি না। এককালে তুমি তো কিরণকে ঘেন্না করতে, কিন্তু জানো, সেই কিরণই….
সতী বললে–থামো বাপু, তুমি কি বক্তৃতা করতে এখানে এসেছো নাকি? তোমাকে নেমন্তন্ন করলুম কি তোমার বক্তৃতা শোনবার জন্যে?
দীপঙ্কর যেন এতক্ষণে একটু সম্বিৎ ফিরে পেলে। বললে–সত্যিই, যত বাজে কথা বলতে আরম্ভ করেছিলাম! তা সত্যি তোমার কী করে মনে রইল যে, আজকে আমার জন্মদিন? আমি নিজেই তো ভুলে গিয়েছিলাম
সতী হেসে বললে–মেয়েদের মনে থাকে সব!
–থাকে? সত্যিই থাকে?
–হ্যাঁ, সব মনে থাকে।
দীপঙ্কর বললে–আমারও তাকে। প্রথমদিন আমাকে সেই কুলী মনে করে চারটে পয়সা দিয়েছিলে, তাও আমার মনে আছে।
সতী বললে–তোমার তো বড় সাংঘাতিক মন? অত মনে থাকাও কিন্তু ভাল নয় আবার-জীবনে কখনও সুখ পাবে না তুমি!
হঠাৎ একটা চাকর ঘরে ঢুকলো। সতী বললে–কী রে শম্ভু, কিছু বলবি?
শম্ভু নামটা শুনে দীপঙ্করের মনটা চম্কে উঠলো। শম্ভু! লক্ষ্মীদির মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো মুহূর্তের জন্যে।
শম্ভু বললে–ঠাকুর বলছিল এখন লুচি বেলবে?
সতী দীপুর দিকে চেয়ে বললে–তুমি খাবে এখন দীপু? খিদে পেয়েছে? আমার সব তৈরি
দীপঙ্কর বললে–আমার জন্যে ভেবো না, তোমাদের যখন সুবিধে দেবে, আমায় জিজ্ঞেস করছো কেন?
সতী বললে–তাহলে ভাজতে বল, আর খাবার জায়গা করে দে টেবিলে শম্ভু চলে গেল। সতী বললে–সকাল-সকাল খেয়ে যেন পালিয়ে যেও না,–তুমিও আমার সঙ্গে খাবে তো?
সতী বললে–না না, তাই কখনও হয়? তুমি নতুন এলে, তোমার খাওয়ার তদারক করতে হবে তো-তুমি খেয়ে নিলে তারপর আমি খেয়ে নেব। খাবার পর চলো কোথাও বেড়িয়ে আসি, গাড়ি তো রয়েছেই।
–কোথায়?
–এই ময়দানের দিকে!
–তোমরাও বুঝি খাওয়া-দাওয়ার পর বেড়াও!
সতী বললে–মাঝে মাঝে বেড়াই বই কি! আমারও কিছু কাজ নেই, ওরও কিছু কাজ নেই–কী করি বলো!
–তাহলে তোমাদের এত বড় সংসার চলে কিসে?
সতী বললে–পৈতৃক টাকা! টাকা জমে জমে পাহাড় হয়ে উঠেছে। শেয়ার কেনা আছে গাদাগাদা। একেবারে যার মার নেই, সেই সব শেয়ার, ডিভিডেন্ডু আসে। কিছু করবার দরকারই হয় না ওর। তাছাড়া, আমি ওসব ব্যাপার নিয়ে মাথাই ঘামাই না–
–আর তোমার শাশুড়ী?
–শাশুড়ীও বউ বলতে একেবারে অজ্ঞান। আমার শাশুড়ীও খুব ভাল
দীপঙ্কর বললে–তা তো ভাল হবেই, এত টাকা-কড়ি, শাশুড়ী তো ভালবাসবেই, আর তুমি হলে বাড়ির একমাত্র বউ, বাড়িতে লোক-জনও কম-বেশ সুখে আছে সতী সত্যি-মা’কে গিয়ে সব বলবো।আর সেই কাকাবাবু কাকীমা তারা কোথায় গেলেন?
সতী বললে–সেই কালীঘাটের সেদিনকার কাণ্ডর পর তিনি বলি হয়ে চলে গেছেন বর্মায়
–আবার বর্মায়?
সতী বলল-হ্যাঁ, কাকীমার তো ছেলে-মেয়ে কিছু নেই, কী করতেই বা কলকাতায় থাকবেন, অনেক চেষ্টা করে আবার চাকরিতে বদলি করে নিলেন।
দীপঙ্কর বললে–জানো সতী, তোমার বিয়ের দিন আমি হাজত থেকে ছাড়া পেলাম, পেয়েই শুনলাম তোমার বিয়ে হচ্ছে, শুনে তখনি চলে এসেছিলাম–এই বাড়ির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, অনেক লোকজন গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছিল, প্রথমটা একটু কষ্ট হয়েছিল
–কেন, কষ্ট হয়েছিল কেন?
দীপঙ্কর হাসলো। বললে–কষ্ট হচ্ছিল নেমন্তন্ন হয়নি বলে, শেষকালে মনে হলো, তোমার বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, এ তো সুখের কথা–অথচ লক্ষ্মীদি
সতী জিজ্ঞেস করলে–লক্ষ্মীদি? লক্ষ্মীদির সঙ্গে দেখা হয় নাকি?
হঠাৎ শম্ভু ডাকলে–বৌদিমণি!
শম্ভু এসে ঘরে ঢুকলো। বললে–এবার খাবার দেওয়া হবে? টেবিল তৈরি–
সতী উঠলো। বললে–চলো চলো-তুমি আপিস থেকে আসছে, খেয়েই নেবে চলো।
এতক্ষণ যে-ঘরে বসেছিল–তার পাশেই আর একটা ঘর। পাশ দিয়ে বারান্দা গেছে। ঘরের মধ্যে শ্বেতপাথরের টেবিল। দেয়ালের গায়ে স্টীললাইফ স্টাডি অনেকগুলো ঝুলছে। আস্ত মাছ, কাটা তরমুজ। পাশের দেয়ালে নিচু মিটসেফ।
সতী বললে—বোস–
দীপঙ্কর বললে–এত!
সতী করেছে কি? অসংখ্য বাটি সাজিয়েছে থালার চারিদিকে। কত রকমের যে মাছ! কত রকমের যে তরবারী! জীবনে এমন যত্ন করে এত পর্যাপ্ত খাবার আয়োজন কেউ করেনি দীপঙ্করের জন্যে। সতী বললে–নাও, ওইখানে হাতটা ধুয়ে নাও ভাল করে, সাবান তোয়ালে সব আছে–
হাত মুখ ধুয়ে এসে দীপঙ্কর বসলো।
সতী নিজে লুচিগুলো একটা একটা করে থালায় দিচ্ছে। বললে–তুমি একটা একটা করে খাও, আমি একখানা করে দেব, তাড়াতাড়ি কোর না, আস্তে আস্তে খাও
দীপঙ্কর বললে–এত আয়োজন করেছ আমার জন্যে? সতী বললে–থা ভণিতা থাক, খাও, খেতে আরম্ভ করো দীপঙ্কর থালায় হাত দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ শম্ভু এল দৌড়তে দৌড়তে।
–বৌদিমণি?
–কী রে?
–মামণি এসেছে! মামণি! দীপঙ্কর সতীর দিকে চেয়ে দেখলে। সতীর মুখখানা যেন কেমন যন্ত্রণায় হঠাৎ নীল হয়ে উঠলো এক নিমেষে। সতী যেন খানিকক্ষণের জন্যে দীপঙ্করের উপস্থিতিও ভুলে গেল। কী বলবে ভেবে পেলে না।
শম্ভু বললে–দাদাবাবু এসেছেন–
–তুই যা, ওদের জিনিসপত্র সব নামিয়ে দিগে যা–
বলে সতী কিছুক্ষণ গুম্ হয়ে রইল। তারপর হঠাৎ যেন দীপঙ্করের কথা মনে পড়তেই হেসে ফিরে তাকাল এদিকে। দীপঙ্কর অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো নিজের মধ্যেই।
এক-সময়ে জিজ্ঞেস করলে–কে এসেছে সতী? কারা? সনাতনবাবু পুরী থেকে ফিরে এলেন নাকি?
সতী বললে–হ্যাঁ–
আর কিছু বললে না। দীপঙ্কর খেতে গিয়েও হাত গুটিয়ে বসে রইল। যেন খেতে পারলে না আর।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–আজকেই কি আসবার কথা ছিল ওঁদের?
সতী কিছু কথা হয়ত বলতো কিন্তু তার আগেই অনেক লোকের পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। প্রথমে কয়েকজন চাকর-বাকর মালপত্র নিয়ে চলে গেল পাশের বারান্দা দিয়ে। তারপর এক ভদ্রলোক। বেশ ফরসা চেহারা। হাসি হাসি মুখ। একবার এ-ঘরের দিকে তাকালেন। তারপর যেন কিছুই ঘটেনি এমনিভাবে সোজা সামনের দিকে চলে গেলেন। তাঁর পেছনেই এলেন একজন বিধবা মহিলা। সাদা থান পরা। তিনি যেন চাকরদের সঙ্গে কী-সব কথা বলতে বলতে আসছিলেন। হঠাৎ এ-ঘরের সামনে আসতেই দীপঙ্করকে দেখে যেন থমকে দাঁড়ালেন একবার। অবাক হয়ে তাকালেন দীপঙ্করের মুখের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে সামনের দিকে চলে গেলেন।
দীপঙ্কর সতীর দিকে চেয়ে দেখলে। সতীর চেহারাটা যেন বিষের মত নীল হয়ে উঠেছে। দীপঙ্করের ইচ্ছে হলো সে এ-ঘর থেকে উঠে পালিয়ে যায়। এ-বাড়ির থেকে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে যায়।
–বউমা!
হঠাৎ যেন বাইরে বজ্রপাত হলো। সতী উঠলো। বললে–তুমি খেতে আরম্ভ কর দীপু, আমি শুনে আসি কী বলছেন!
সতী বাইরে চলে যেতেই সতীর শাশুড়ীর বজ্র-গম্ভীর গলার আওয়াজ শোনা গেল– ঘরে কে ও?
সতী যেন একটু দ্বিধা করছিল।
আবার আওয়াজ–কে ও, বলো?
সতী বললে–ও দীপঙ্কর, আমাদের কালীঘাটের বাড়ির পাশে থাকতো–
–পাশে থাকতো? ও! তা ওকে ঘরে এনে খাওয়াবার আর সময় পেলে না? না কি আমরা বাড়িতে ছিলাম না বলেই ডেকেছিলে?
–না, আজকে ওর জন্মদিন!
–যার-তার জন্মদিন করবার জন্যেই কি ঘোষ-বাড়ির বউ করে এনেছি তোমাকে?
সতী বললে–আপনি জানেন না, ওর মাকে আমি মাসীমা বলে ডাকি, ও আমার ভাই-এর মতন–
–কিন্তু তোমার ভাইকে এতদিন তো একবারও ডাকোনি, যতদিন আমরা বাড়িতে ছিলাম! জন্মদিন কি এই প্রথমবার হলো তোমার ভাই-এর?
সতী বোধহয় চুপ করে ছিল। শাশুড়ীর গলা আবার শোনা গেল। বললে–যাও, যা বলবার তোমার ভাইকে বলে এসো, আমি আছি আমার ঘরে, তোমার সঙ্গে কথা আছে-যাও–
খানিক পরেই সতী ঘরে এল। দীপঙ্করের মনে হলো সতী যেন থর থর করে কাঁপছে। কিন্তু মুখটায় একটা হাসি আনবার দুর্বল চেষ্টা করতে লাগলো।
সতী ঘরে আসতেই দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে–আমি তাহলে আসি সতী–
সতী হঠাৎ করুণ হয়ে উঠলো সমস্ত চেহারাটায়। বললে–দীপু, তোমাকে খেয়ে যেতেই হবে–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু এর পরেও তুমি আমাকে খেতে বলো?
–না, তুমি যেতে পাবে না! না-খেয়ে তুমি আজ যেতে পাবে না এ-বাড়ি থেকে!
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু সতী, আমার যে কিছুই মুখে উঠবে না, এর পরেও আমি খাবো কী করে?
সতী যেন কঠিন হয়ে গেল একমুহূর্তে। বললে–আমিও এ-বাড়ির বউ, আমারও অধিকার আছে তোমাকে খাওয়াবার, সেই অধিকারটুকু তুমি আজ প্রমাণ করে দিয়ে যাও! তুমি না খেলে যে আমার অপমান হবে, এটা বুঝছো না কেন?
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু তোমার স্বামী? সনাতনবাবু?
–সে আমি বুঝবো। আমি তোমার জন্মদিনে তোমাকে নেমন্তন্ন করে ডেকে এনেছি, তোমাকে খেতেই হবে, তোমার মুখে না রুচলেও খেতে হবে, তুমি না খেয়ে চলে গেলে তোমার চোখের সামনে আমি আত্মহত্যা করবো
দেখতে দেখতে সতীর চেহারাটা দীপঙ্করের চোখের সামনে যেন বাঘিনীর মত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো।
সেদিন কী অদ্ভুত অবস্থার মধ্যেই যে পড়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর! সতীর শাশুড়ীর গলার আওয়াজ কানে এসেছিল দীপঙ্করের। কিন্তু সতীর স্বামীর গলার আওয়াজ একবারও কানে আসেনি। কেন সতী এমন কাজ করলো! কেন সকলকে না জানিয়ে তাকে নেমন্তন্ন করতে গেল! আর যদি নেমন্তন্ন করেছিল তবে কেনই বা সতীর শাশুড়ী হঠাৎ খবর না দিয়ে এসে পড়লো।
দীপঙ্করের হাতও নড়ছিল না, মুখও নড়ছিল না।
সতী হঠাৎ আবার সামনে এসে বললে–ও কি, হাত গুটিয়ে রইলে কেন, খাও? আর লুচি নেবে?
দীপঙ্করের মনে হলো সে যেন বিষ খাচ্ছে। লুচিগুলো গলা দিয়ে ঢুকে গিয়ে যেন বিষক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। সে যেন ফাঁসির কয়েদী! সামনে যেন সতী চাবুক নিয়ে পাহারা দিচ্ছে।
দীপঙ্কর বললে–আর খেতে পারবো না আমি
–না, আমি কোনও কথা শুনবো না, তোমাকে খেতেই হবে। যা যা দিয়েছি সব খেতে হবে। কিছু ফেলে রাখতে পারবে না। আমি সারাদিন ধরে নিজে তদারক করে সব করিয়েছি, এ তোমায় ফেলে রাখতে দেব না!
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু কেন তুমি আমাকে নেমন্তন্ন করতে গেলে? এতদিন এতবার তো আমার জন্মদিন এসেছে, তুমি ডেকে খাওয়াওনি বলে তো আমার কোনও দুঃখ ছিল না! আমি তো তোমার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম–
সতী জোর গলায় ডাকলে-শম্ভু—
শম্ভু এল। সতী বললে–পান সেজেছে ভূতির মা?
–না বৌদিমণি।
সতী রেগে উঠলো। বললে–কেন? পান সাজেনি কেন?
দীপঙ্কর বললে–নাই বা সাজলো সতী, থাক না, আমি তো পান খাই না–
সতী যেন রেগে গেছে খুব। বললে–তুমি চুপ করো, যা তুই পান সেজে নিয়ে আয় এখেনে, জানিস না বাড়িতে লোককে নেমন্তন্ন করলে পান দিতে হয়!
দীপঙ্কর উঠলো। উঠে হাত মুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিলে। সতী কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। পান আনতেই সতী বললে–নাও, পান খাও–
–পান? একটু বুঝি দ্বিধা করতে গেল দীপঙ্কর। কিন্তু সতীর মুখের দিকে চেয়ে আর আপত্তি করতে ভরসা হলো না।
সতী আবার শম্ভুকে ডাকলে। বললে–রতনকে বল্ গাড়ি বার করতে, দীপঙ্করবাবুকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে আসবে–
শম্ভু বললে–মামণি গাড়ি বন্ধ করতে বলে দিয়েছে যে–
দীপঙ্কর বললে–গাড়ি কী হবে, আমি তো এটুকু বেশ হেঁটেই যেতে পারবো
সতী ধমক দিয়ে উঠলো। বললে–তুমি চুপ করো তো! তুই রতনকে বলে আয় গাড়ি যে-ই বন্ধ করতে হুকুম দিক, আমি হুকুম দিচ্ছি গাড়ি বেরোবে-যা বলে আয়
শম্ভু চলে গেল। দীপঙ্করও পেছনে-পেছনে যাচ্ছিল। সতী বললে–শোন দীপু দীপু পেছন ফিরলো। সতী বললে–কালও তুমি ঠিক এই সময়ে এখানে আসবে
–কাল? কালও খেতে হবে? সতী বললে–হা, কাল তুমি এসো, তারপর যা করবার আমি করবো।
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু কাজটা কি ভাল করছো?
সতী বললে–ভাল-মন্দ সে আমি বুঝবো, আমি অনেক সহ্য করেছি,–ঠিক এসো-ভুলো না, আমি বসে থাকবো তোমার জন্যে
দীপঙ্কর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনতে পেলে সতীর শাশুড়ীর গলার আওয়াজ বৌমা, এদিকে একবার এসো তো–
পরিষ্কার তক্তকে ঝকঝকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দীপঙ্করের পা দুটো কাঁপতে লাগলো। তারপর বাইরে বাগানের সামনে আসতেই দেখলে ড্রাইভার গাড়ি বার করে দাঁড়িয়ে। দীপঙ্কর কাছে যেতেই দরজাটা খুলে দিলে। দীপঙ্কর ভেতরে উঠে বসলো।
তারপর হঁট বাঁধানো রাস্তাটা দিয়ে বাড়ির গেট পেরিয়ে গাড়িটা প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে গিয়ে পড়লো।
৩৬
উনিশ শো ঊনচল্লিশ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর একদিন পৃথিবীর একটা অংশে যুদ্ধ বেধেছিল। ছোট যুদ্ধ সেটা ছিল প্রথমে। প্রথমে কি কেউ কল্পনা করেছিল তার জের এতদিন ধরে চলবে! কিন্তু যুদ্ধটা শেষ পর্যন্ত চলেছিল ছ’বছর একুশ ঘণ্টা তেইশ মিনিট ধরে। তারিখ-সময় সবই মনে আছে দীপঙ্করের। ঠিক ভোর চারটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সময়–শুক্রবারে। আর দীপঙ্করের জীবনের এই যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল সোমবার ঠিক রাত আটটার সময়। প্রথমে সনাতনবাবুও বুঝতে পারেননি। প্রথমে সতীর শাশুড়ীও বুঝতে পারেননি–দীপঙ্করও বুঝতে পারেনি। এমন কি সতী যে সতী–সে-ও বুঝতে পারেনি। অর্থাৎ কেউই বুঝতে পারেনি। শুরু যার এত সামান্য, শেষ তার এমন ভয়াবহ হবে কে কল্পনা করতে পারবে!
অনেকদিন পরে সতীর মুখ থেকেই শুনেছিল দীপঙ্কর।
দীপঙ্করের একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল শম্ভুকে। শম্ভুকে জিজ্ঞেস করলেই সে হয়ত সব বলে দিত। বাড়ির চাকরদের কিছু জানতে বাকি থাকে না। গিন্নীরা বাবুরা কখন কি করে, কার সঙ্গে কখন কার ঝগড়া হয়, সব তারা জানে ৷
তবু দীপঙ্কর সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিল–আচ্ছা শম্ভু, তোমার মামণির কি আজকেই আসবার কথা ছিল?
–আজ্ঞে, না বাবু, কথা ছিল না তো! রেলের লাইন্-টাইন্ সব জলে ডুবে গেছে বলে রেল চলেনি, আটকে ছিল রাস্তায়। বাবুরা তিনদিন কটকের ইস্টিশানে পড়ে। তাই এখন আবার রান্না-বান্না চাপিয়েছে ঠাকুর!
তারপর দীপঙ্কর গাড়িতে উঠতেই দুই হাত জোড় করে বলেছিল–আচ্ছা পেন্নাম হই বাবু
সিঁড়িতে নামবার সময় শাশুড়ীর গম্ভীর গলার ডাক শোনা গিয়েছিল–বৌমা, এদিকে শুনে যাও তো একবার–
সতী গিয়ে কাছে দাঁড়াল। বহুদিনের বিধবা গিন্নী এ-বাড়ির। একদিন যখন এ বাড়ির আরো জলুস ছিল, আরো জাঁকজমক ছিল, সেইদিন তিনি দুধে-আলতায় পা দিয়ে এই ঘোষ-বাড়িতে ঢুকেছিলেন। সেদিন পাড়ার লোক নতুন বউ দেখতে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল সামনে। অঘোরদাদুর ওইসব যজমানদের বাড়ির লোকেদের সমপর্যায়ের লোক এরা। ব্যারিস্টার পালিতের সমগোত্রীয়। খিদিরপুরের ডকে স্টিভেডোরের, কারবার ছিল শিরীষ ঘোষের। সেকালের নামকরা স্টিভেডোর শিরীষ ঘোষ। বার্ড কোম্পানী, কিলবার্ন কোম্পানী, শ’ওয়ালেস কোম্পানীর একচেটিয়া কাজ করতো এই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের শিরীষ ঘোষের ফার্ম। সাহেবরাও শিরীষ ঘোষকে মানতো, খাতির করতো। শিরীষ ঘোষও সাহেবদের মর্যাদা রেখে কথা বলতো। শিরীষ ঘোষের ছেলে গিরিশ ঘোষ-এর বিয়েতে কলকাতার বড় বড় কোম্পানীর সাহেবরা এসে নেমন্তন্ন খেয়ে গিয়েছিল। সেদিন ঘোমটার আড়ালে এই শাশুড়ীর মুখ দেখেই তারা দামী দামী উপহার দিয়েছিল। তারপর শিরীষ ঘোষ বুড়ো বয়েসে একদিন মারা গেলেন। মারা যাবার আগে ছেলে-বউ-এর হাতে এই কারবার, এই স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। যাবার সময় বলেছিলেন–টাকা বড় নচ্ছার জিনিস, ওটা দরকার, কিন্তু ওটাই সার করিসনে তোরা, অনেক টাকা জমিয়েছি জীবনে, তোদের কিছু ভাবনা রেখে যাবো না-একটু দেখে চলবি–
আরো সব কী কী কথা বলেছিলেন শিরীষ ঘোষ। শেষ জীবনের সব আধা বৈরাগ্যের কথা। সে-সময়ে সকলেরই বৈরাগ্যের কথা আসে। আসাটাই স্বাভাবিক। ব্যাঙ্কে তখন তার লাখ বিশেক টাকা। সুন্দরবনে ছ’হাজার বিঘে আবাদ, সিন্দুকে সোনা দানা-হীরে-জহরৎ-কোম্পানীর কাগজের মোটা সুদের টাকা, আর চালু কারবার। যাবার আগে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও ত্রুটি রাখেননি। সে-যুগেই ফ্যানের হাওয়া খেয়ে গিয়েছেন, তেতলা বাড়ি করেছেন, গাড়ি চড়েছেন। আবার কী করবেন??
সতীর শাশুড়ী নতুন বউ হয়ে তখন বেশিদিন আসেননি। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর সবই তার ঘাড়ে পড়লো। স্বামী গিরিশ ঘোষ ছিলেন ভাল মানুষ গোছের লোক। দরকার হলে মিথ্যে কথাও বলতে পারতেন না, সত্যি কথাও জোর করে বলতে পারতেন না কখনও। প্রথম প্রথম নতুন বউ বলতেন–সব তাতেই যদি তুমি মাথা নাড়ো তো তোমার আসল মতটা কী?
স্বামী বলতেন–আসল মতটা না-বলাই ভালো, ওতে শুধু অশান্তি বাড়ে–
স্ত্রী বলতেন–কিন্তু এ-রকম কদ্দিন এড়িয়ে চলবে?
পুরনো কোম্পানীর সাহেবরা তখনও ঘোষ-কোম্পানীর কাছে কাজ দেয়। ঘোষ কোম্পানীকে বিশ্বাস করে। সাহেবদের তখন ওই গুণটা ছিল। একবার এক ফার্মকে ধরলে সহজে অন্য কোথাও যাবার নাম করতো না।
গিন্নী বলতেন-কী হলো, আজ আবার মুখটা শুক্নো কেন? কেউ মেরেছে নাকি? গিরিশ হেসে উঠতেন। বলতেন-কী যে বলো, মারবে আবার কে?
–না, তুমি যে-রকম মুখটা করে রয়েছ, যেন কেউ চড় মেরেছে তোমার গালে।
স্বামী বলতেন–না, হয়েছে কি, একজনকে ঠকিয়ে ফেলেছি, প্রায় হাজার দুয়েক টাকা ঠকিয়েছি–
–তাতে হয়েছে কি?
–বলো কি? ঠকানো তো পাপ। পাপের সামিল। পাপই করে ফেললাম তো! এখন কোথায় যে তাকে পাই আবার
–তাহলে আর কি! বসে বসে কাঁদো, কাঁদতে বসো!
কিন্তু বেশিদিন গিরিশ ঘোষকে এ-জ্বালা সহ্য করতে হয়নি। একদিন আপিস থেকে এসে সেই যে শুলেন, সে ঘুম আর ভাঙলো না। খবর গেল ডাক্তারের কাছে। কিন্তু কিছু ফল হলো না। শ্বশুর বলে গিয়েছিলেন–টাকা বড় নচ্ছার জিনিস–সেই নচ্ছার জিনিসই শেষপর্যন্ত পড়ে রইল আর তিনিই চলে গেলেন। তখন সোনার বয়স দু’বছর। সনাতন ঘোষ তখনকার কথা কিছুই মনে করতে পারেন না।
তা সেই সনাতন যে বড় হয়েছে, বুদ্ধিমান হয়েছে এর পেছনে শাশুড়ীর অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল। স্টিভেডোরের কারবার সেদিন তুলে দিতে হয়েছিল সেই বিধবা শাশুড়ীকে। মোটা টাকায়। কোম্পানীর স্বত্ব উপস্বত্ব সমস্ত বিক্রি করে আঁচলে চাবি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন কবে ছেলের বিয়ে দিয়ে তিনি তার হাতে সব ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবেন। চারিদিকে ঘটকী লাগিয়েছিলেন। শেষে একজন এসে খবর দিয়ে গেল এই মেয়ের কথা। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে বাপের বন্ধুর কাছে থেকে লেখাপড়া করে। আর বাপ থাকে বর্মায়। তাঁর কাঠের ব্যবসা। ছেলে নেই। একমাত্র মেয়ে। বাপের টাকার কথাটা উহ্য থাক। তিনি টাকার দিকটা দেখেননি। সত্যিই টাকাটা নচ্ছার জিনিস। দেখেছেন শুধু কুল বংশমর্যাদা রূপ গুণ। ভুবনেশ্বর মিত্র টেলিগ্রাম পেয়েই দৌড়ে এসেছিলেন কলকাতায়। রাতারাতি মেয়ে দেখা পাত্র দেখা সব কিছু হলো। সুন্দরবনের ছ’হাজার বিঘে আবাদ, মোটা টাকার কোম্পানীর কাগজ, ভাল-ভাল বাছা বাছা সব বিলিতি কোম্পানীর শেয়ার। সেটাও বড় কথা নয়। আসল হলো বংশ। আসল হলো বনেদীয়ানা। কাকাবাবুকে বললেন–কেমন দেখলে তুমি হে শচীশ?
কাকাবাবু বললেন–আমি তো সবরকম খোঁজখবর নিয়েই আপনাকে খবর দিয়েছি, রায়বাহাদুরও চেনেন ওঁদের–
–কে রায়বাহাদুর?
–রায়বাহাদুর নলিনী মজুমদার। এক পাড়ারই লোক তো সব। ওই ধরুন লখার মাঠের একাদশী বাড়জ্জে, চাউলপট্টির শশধর চাটুজ্জে–সকলের চেনা। শিরীষ ঘোষের নাম করলে এখনও সবাই কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলে তিনি ছিলেন দেবতার মত–
সেই শিরিষ ঘোষেরই নাতি।
ভুবনেশ্বরবাবু বলেছিলেন–কিন্তু বাড়িতে তো ওই মা ছাড়া দুটি প্রাণী নেই শচীশ, সতী যে-রকম মেয়ে, ও কি টিকতে পারবে?
কাকাবাবু বলেছিলেন–তা নেই, ভালোই তো! ও ননদ ভাজ দেওর ও-সব না-থাকাই ভালো। থাকলেই ঝঞ্ঝাট যত! আপনার মেয়ে যেমনভাবে মানুষ হয়েছে তাতে ও-সব না থাকাই ভালো! এখানেই দিয়ে দিন বিয়ে–
তারপর আর কিছু ভাববার সময়ও ছিল না। একটা মেয়ে সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছে নিজেরই গাফিলতিতে। এ মেয়েটার বেলায় আর সে-ভুল করলেন না ভুবনেশ্বর মিত্র! তিনদিনের মধ্যেই আয়োজন অনুষ্ঠান সব পাকা হয়ে গেল। ভুবনেশ্বর মিত্র ভবানীপুরেই একটা দোতলা বাড়ি ভাড়া করে বিয়ের আয়োজন করে ফেললেন। লোকজন নেমন্তন্ন, কেনা-কাটা সবই করলেন কাকাবাবু। একদিন উলু দিয়ে শাঁখ বাজিয়ে বেনারসী জড়িয়ে সতী এসে ঢুকলো এ-বাড়িতে!
তারপর অনেকদিন কেটে গেল। অনেক বছর কেটে গেল।
কোথায় বর্মায় কোন্ এক মগের মুল্লুকে জন্ম হয়েছিল। সেখান থেকে ভাসতে ভাসতে কোথায় কোন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের এঁদো গলিতে এসে উঠেছিল। আবার একদিন হঠাৎ এ বাড়িতে বউ হয়ে আসতে হলো সতীকে!
শাশুড়ী বললেন–দেখি, খোঁপাটা খোল তো মা, চুলটা দেখি
প্রথম প্রথম সতী কিছু বলতো না। যা বলতো শাশুড়ী মুখ বুজে শুনতো। বুঝতো নতুন বউয়ের এ-সব সহ্য করতে হয়। দুদিন বাদেই এ-সব বন্ধ হয়ে যাবে!
–চুল খুলতে বলছি, তা খুলছো না কেন, খোল?
সতী বললে–চুল তো আপনি বিয়ের সময়ই দেখেছেন, আবার কেন?
শাশুড়ী বললেন–তা হোক বাপু, কী রকম যেন পরচুলো-পরচুলো মনে হচ্ছে, আবার একবার দেখাও–
সতী খোঁপা খুলে পিঠের ওপর চুল এলিয়ে দিলে। শাশুড়ী মেপে দেখলেন।
সতী বললে–কী হলো? দেখলেন? সন্দেহ ঘুচলো?
এ-সব প্রথম দিকের কথা। বড় তেজী মানুষ শাশুড়ী। তিনি অনেক দেখেছেন, অনেক ভুগেছেন, অনেক বুঝেছেন। শ্বশুরের মৃত্যু হয়েছিল বলতে গেলে তাঁরই কোলের ওপর। স্বামীরও মৃত্যু হয়েছিল তাঁর কোলে। শ্বশুর স্বামী হারিয়ে অজস্র অর্থের মালিক হয়ে তিনি দেখেছেন সংসারে কড়া মানুষ না হলে কপালে অনেক দুঃখ। তাই এক একদিন ছাদে উঠে হঠাৎ জেরা করতেন। বলতেন–ওদিকে কী দেখছিলে বৌমা?
সতীও সোজা মেয়ে নয়। বলতো–কোন্দিকে?
–ওই যে পাশের বাড়ির জানলার দিকে? ওখানে কে আছে?
সতী বলতো–আপনি নিজে দেখুন না এসে কাকে দেখছিলুম–আসুন, দেখে যান্–
ওই পর্যন্তই। বেশি দূর গড়াতো না এসব ঘটনা। শাশুড়ীও চুপ করে যেতেন, সতীও চুপ করে যেত।
রাত্রে সনাতন ঘোষ একটু দেরি করে ঘুমোতেন। দিনের বেলাও তাঁর খুব কাজ ছিল না। তবু এখানে ওখানে যেতে হতো। সনাতনকে মা’ও একটু সমীহ করে চলতেন। ছেলে পড়ছে, আস্তে আস্তে কাছে যেতেন। তারপর জিজ্ঞেস করতেন–সোনা, আজকে দুধ খেয়েছো?
শুধু আজকেই নয়, সনাতন ঘোষ বরাবরই এমনি। একটু ভেবে নিয়ে বলতেন–হ্যাঁ মা, খেয়েছি তো!
মা বলতেন–কাল অনেক রাত পর্যন্ত তোমার ঘরে আলো জ্বলেছিল বাবা, রাত জেগে জেগে কী পড়ো? অত পড়ে কী হবে? যারা রাত জেগে জেগে বই লিখেছে, তাদের টাকার দরকার ছিল তাই লিখেছে, তোমার সে-সব অত কষ্ট করে পড়বার দরকার কী বাবা?
মাঝে মাঝে মা ধমক দিতেন চাকরদের।
বলতেন–তোদের আক্কেলটা কী শম্ভু, দেখছিস দাদাবাবু ঘরে রয়েছে, আর তুই এখানে গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছিস? বেরো এখান থেকে, দূর হয়ে যা।
–বৌমা!
শাশুড়ী ভোর বেলা উঠেই ঘরের দরজার বাইরে গিয়ে ডাকতেন।
বলতেন–এত দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা আমি পছন্দ করি না, সারা রাত কী করো শুনি? সোনা না-হয় বেশি রাত অবধি পড়াশোনা করে, সে না-হয় দেরি করে উঠবে, কিন্তু তোমার কিসের ঘুম–তুমিও কি জাগো নাকি ওর সঙ্গে?
সতীর মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোয় না। শুধু বোবার মত কিছুক্ষণ শাশুড়ীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে অবাক হয়ে। এক-একটা ঘটনা ঘটে আর অবাক হয়ে ভাবে–এ কোন্ সংসারে, কাদের সংসারে এসে পড়লো সে! এ কোথায় কাদের কাছে তাকে তুলে দিয়ে গেল তার বাবা! সমস্ত পৃথিবীটা যেন চোখের সামনে ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। এ-সব দিনকার প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ঘটনা সতী পরে দীপঙ্করকে বলেছে। ভোর হতে-না-হতেই সতীকে উঠতে হবে, উঠে কলঘরে যেতে হবে। তারপর স্বামীর শাশুড়ীর চা-জলখাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। লোকজন আছে। তাদের কাজ নেই কিছু। তাদের ঝগড়া, বিবাদ, দলাদলি–তার মধ্যে সতী সব দেখাশোনা করবে। এমনি করেই সমস্ত শিখতে হবে সংসারের কাজ। একদিন শাশুড়ীও নাকি এমনি করে হাতে ধরে কাজ শিখেছেন, বকুনি খেয়েছেন, তবে এত বড় সংসারের হাল ধরে একে চালিয়ে নিয়ে এসেছেন এখানে। যখন শাশুড়ী থাকবেন না, তখন তো তোমাকেই সব চালাতে হবে। নইলে ঝি চাকরের হাতে সব ছেড়ে দিলে কিছু কি আর আস্ত থাকবে!
বাতাসীর মা আদ্যিকালের লোক এ-বাড়ির। বলতো-বৌদিমণি, তুমি কেন আবার রান্নাবাড়িতে এলে বাছা, দেখ তো, ধোয়া-কালির মধ্যে তোমার রীল কী টিকবে? ঠাকুর একলাই তো সব পারে–
তা বাতাসীর মা বলতে পারে বটে এমন কথা। ঘোষবাড়ির আদি থেকে আছে। হয়ত অন্ত পর্যন্তই থাকবে। সে কারো পরোয়া করে কথা বলে না। একতলাটায় তারই রাজত্ব। সেখানে তার মুখের ওপর কারো কথা বলার এক্তিয়ার নেই।
বলে–আমি কার পরোয়া করতে যাবো শুনি? আমি মাঙনা খাই না পরি? গতর দিয়ে খাঁটি না? ওই দাদাবাবুকে মানুষ করিনি এই হাতে? বলুক তোদের মামণি কেমন বলতে পারে?
হঠাৎ কথার মধ্যেই সতীকে আসতে দেখে বলে–আবার বুঝি খবরদারি করতে পাঠালে তোমাকে বুড়ি?
বাতাসীর মা নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছিল–আমার নাম বাতাসীর মা বৌদিমণি-বাতাসীর মা বললেই সবাই চিনবে,-এ-বাড়ির পান থেকে চুন খসলে এই বাতাসীর মা’কেই জবাবদিহি করতে হয়, ওই তোমার কর্তাকে আমিই বুকে-পিঠে করে মানুষ করেছি, তোমার শাশুড়ী তো নড়ে বসতে মূৰ্ছো যেত তখন–এখন ভারি কাজ দেখাচ্ছে–
ভূতির মা বলতো-তুমি থাম তো বাতাসীর মা, নতুন বউ-এর সঙ্গে ওনি পুরোন কাসুন্দি ঘাটতে বসোনা
–তা ঘটবো না, বাতসীর মা কাউকে কি পরোয়া করে? গতর আছে বলে এত খাতির আমার, নইলে কে পুঁছতে লা?
তারপর বাতাসীর মা সতীর ওপর হঠাৎ সদয় হয়ে উঠতো। বলতো-দেখ তো, ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছ বৌদিমণি-বাড়িতে আসতে-না-আসতে একেবরে কাজের কাজী করে তুলবে গা, এমন বৌকাটনি শাশুড়ী তো মায়ের জন্মে দেখিনি বাছা–আহা, মুখটা একেবারে শুকিয়ে আসি হয়ে গেছে
এমনি করে রান্নাবাড়ি, ভাড়ার ঘর, পুজোর দালান, বারবাড়ি, ভেতরবাড়ি একে একে সব কিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন শাশুড়ী। কিন্তু সমস্ত দিনের শেষে যখন নিজের ঘরে শুতে যেত, তখন সনাতনবাবু লাইব্রেরী ঘর থেকে আসেননি। কিছুক্ষণ বসে থাকতো সতী চেয়ারটায়। এটা ওটা ঘটতো। এটা গুছিয়ে রাখতে, ওটা ঠিক করে দিত।
সনাতনবাবু এসে ঢুকতেন এক সময়ে।
–ক’টা বাজলো বল তো?
সতী ঘড়িটার দিকে চেয়ে বলতো-বারোটা বাজে—
উঃ, বড় রাত করে দিলাম তো তোমার? তা তুমি শুয়ে পড়লেই তো পারতে তারপর হঠাৎ ছোট টেবিলটায় বসে পড়ে বলতেন–তুমি শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো আমার একটু দেরি হবে বলে আধ-পড়া বইটা আবার পড়তে বসতেন।
খানিক পরে বোধহয় খেয়াল হতো। বলতেন–আলোটা তোমার চোখে লাগছে না তো?
সতী বলতো-না,–
তারপর অনেকক্ষণ তেমনি করেই কাটতো। সনাতনবাবু মুখ নিচু করে পড়তেন এক মনে। কী যে পড়তেন, বিছানায় শুয়ে তা দেখা যেত না। সতী প্রথমে চিত হয়ে শুয়ে থাকতো। তারপর পাশ ফিরতো। ঘড়ির কাঁটাটা আস্তে আস্তে নড়তে নড়তে উত্তর থেকে দক্ষিণে গিয়ে পৌঁছোত। তখনও সনাতনবাবুর হুঁশ নেই। সতী ওপাশ ফিরে চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করতো। তখন পৃথিবীর কোথাও কোনও কোণে কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর। শুধু ঘরের ঘড়িটার ধুক ধুক্ আওয়াজ কানে বিধছে কাঁটার মত। মুহূর্তগুলো তখন যেন সঙ্গীন ঘাড়ে করে সতীর চোখের সামনে স্থির নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই সব সময়ে সতীর মনে হতো পৃথিবীটা বুঝি এবার থেমে যাবে। একটা বিধ্বংসী প্রলয়ের মধ্যে পৃথিবীটা গড়িয়ে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে একেবারে। এমনি করে কত রাত কেটেছে ঘোষ-বাড়ির নতুন স্বামী-স্ত্রীর জীবনে।
–কী বলছো! আমায় ডাকছিলে?
হঠাৎ সনাতনবাবুর যেন হুঁশ হতো। যেন আবার অদৃশ্য জগৎ থেকে ফিরে আসতেন নিজের শোবার ঘরে। লজ্জায় পড়ে যেতেন একটু। তারপর তাড়াতাড়ি আলোটা নিভিয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়তেন।
বলতেন-ইস, বড় দেরি করে ফেললাম–
তারপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত সতীর আর ঘুম আসতো না। সনাতনবাবু কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ একতালে বয়ে চলেছে। একবার শুলে তার আর ঘুম আসতে দেরি হয় না। যে কাত্ হয়ে শোবেন সেই কাত হয়ে ঘুম থেকে উঠবেন। মাঝখানে একবার এপাশ-ওপাশও করতেন না। মাঝরাত্রে যখন একভাবে শুয়ে শুয়ে সমস্ত শরীরে ব্যথা হয়ে গেছে, তখন সতী উঠবে। উঠে পাশের বাধরুমে গিয়ে মুখে কপালে ঘাড়ে জল দিয়ে আসবে, একবার ঘড়িটা দেখবে। তারপর আবার নিজের বিছানায় এসে চিত হয়ে শুয়ে পড়বে। শুয়ে শুয়ে ঘড়ির ঘণ্টা শুনবে। একটা, দুটো। দুটোর পর তিনটে, তারপর চারটে……তারপর ভোর হয়ে যাবে। শাশুড়ীর ভোর বেলা ঘুম ভাঙে। তিনি দরজার বাইরে থেকে ডাকবেন,বৌমা, অ বৌমা
এক-একদিন বিকেলবেলা শাশুড়ী সোজা লাইব্রেরী ঘরে গিয়ে হাজির হন।
–সোনা?
সনাতনবাবু পড়তে পড়তে মুখ তোলেন।
–মা, তুমি?
একবার আমার সঙ্গে তোমায় যেতে হবে যে বাবা, নদিদির নাঙ্গী হয়েছে, দেখতে যেতে বলেছিল, সময় তো আর হচ্ছে না, আজকেই চলো!
সনাতনবাবু ঘরে এসে বলেন–চলো, তৈরি হয়ে নাও—
সতীও অবাক হয়ে তাকায়। বলে–কোথায়?
সনাতনবাবু বলেন–মা যেতে বলেছে, মা’র নদিদির নাতনী হয়েছে, অনেকদিন ধরে যেতে বলেছে, সময় পাওয়া যাচ্ছিল না মোটে, চলো–
সনাতনবাবু তখন জামা-কাপড় পরে তৈরি। সতীও আলমারি খুলে গয়না বার করলে, শাড়ি বার করলে, ব্লাউজ বার করলে। অনেক শাড়ি, অনেক ব্লাউজ, অনেক গয়না দিয়েছে বাবা। একটাও পরা হয় না। নতুন কুটুমবাড়ি যাচ্ছে, যা তা পরে যাওয়া যায় না। বিছানার ওপর সব শাড়িগুলো একে একে নামিয়ে ফেললে।
সনাতনবাবু বললেন–আমি বেরোচ্ছি, তুমি এসো–
–শোন শোন, একটু দাঁড়াও–
সতী ডাকলে পেছন থেকে। বললে–একটু দাঁড়াও, এদিকে এসো না সনাতনবাবু কাছে এলেন। বললেন–কী হলো?
সতী বললে–কোন্ শাড়িটা পড়ি বলো তো?
সনাতনবাবু বললেন–যেটা ইচ্ছে পরো না–সবগুলোই তো ভালো–
–না না, ও-রকম করে বললে চলবে না, ভালো করে ভেবে বলো—
তারপর সতী একটা বেছে নিয়ে বললে–এটা মানাবে আমাকে, না গো–এটা বেশ বট্ল্ গ্রীন রং–
–তা পরো–
যেন সতীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যেই সনাতনবাবু উত্তরটা দিলেন। বললেন–মা হয়ত রাগ করছে, তুমি এসো শিগগির, আমি গেলাম–
নতুন শায়া, নতুন ব্লাউজ, নতুন শাড়ি। বিয়ের পর এ-শাড়িটা আর পরাই হয়নি মোটে। একেবারে আনকোরা। কাপড়ের ভাঁজ খুলতে গিয়ে কেমন একরকম চমৎকার খস্ খস্ শব্দ হতে লাগলো। শাড়ির এই শব্দগুলো সতীর বড় ভালো লাগে। যেন আদর করে ফিস্ ফিস্ করে কথা বলার মতন। অন্তরঙ্গতার সুর মেশানো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গয়না পরলে। মুখে পাউডার দিলে স্নো দিলে। তারপর টিপ্ দিলে দুটো ভ্রূর মধ্যে। তারপর আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দেখলে এপাশ-ওপাশ করে। বেশ দেখাচ্ছে এবার। চুলগুলো ছোটবেলা থেকেই কোঁকড়ানো। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের সেই ছেলেটা এই চুলের দিকে চেয়ে থাকতো অনেকক্ষণ ধরে। দেখা যেন আর শেষ হয় না মুখখানা! তারপর ঘরের বাইরে বেরিয়ে একতলায় আসার মুখেই বাতাসীর মা’র সঙ্গে দেখা।
-–বাতাসীর মা, ভূতির মা কোথায় গো?
–ডাকবো বৌদিমণি?
সারা শরীরে সেন্টের গন্ধ ভুর ভুর করে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সতীর নিজের নাকেও লাগলো নিজের শরীরের গন্ধটা। বললে–আমি চললুম বাতাসীর মা, তাড়াতাড়িতে ঘরটা বন্ধ করা হলো না, ঘরময় কাপড়-চোপড় ছড়ানো রইল, ভূতির মাকে একটু বলে দিও তো–ঘরে ধুনো দিয়ে যেন দরজাটা চাবি-বন্ধ করে দেয়–
তারপর একটু থেমে আবার বললে–আর শম্ভু কোথায় গেল?
শম্ভু ওদিক থেকে দৌড়ে আসছিল। সতী বললে– শম্ভু, ঘরে সব ছড়ানো পড়ে রইল, ভূতির মা ধুনো দিয়ে দিলে, ঘরে চাবি দিয়ে দিস্, বুঝলি–
হঠাৎ যেন বাজ পড়লো মাথায়।
-–বৌমা, তুমি কোথায় যাচ্ছো আবার এখন?
সতী পেছনে চেয়ে দেখলে শাশুড়ী নামছেন সিঁড়ি দিয়ে। সাদা গরদের থান পরেছেন। সতী থমকে দাঁড়াল।
–তুমি আবার সাত তাড়াতাড়ি কোথায় চললে?
সতী অবাক হয়ে চাইলে শাশুড়ীর দিকে মুখোমুখি।
–তুমি যে সেজে-গুঁজে বেরোচ্ছ বড়? আমি তোমাকে যেতে বলেছি?
বাতাসীর মা দাঁড়িয়ে ছিল, শম্ভুও পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। দু’জনেই শুনলো। আর সতীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত তখন থর থর করে কাঁপছে–
শাশুড়ী বললেন–আমি সোনাকে নিয়ে বলে একটা কাজে যাচ্ছি–আনন্দ করতেও যাচ্ছি না, নেমন্তন্ন খেতেও যাচ্ছি না, তা তুমি কী বলে এত সাজগোজ করে ঝামেলা করতে যাচ্ছো শুনি? কে যেতে বলেছে তোমাকে?
কথাটা বলে শাশুড়ী সামনে এগিয়ে গেলেন। বাগানে গাড়ির দরজা খোলার শব্দ হলো। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ারও শব্দ হলো। তারপর গাড়িটা চলে যাবার শব্দও শুনতে পেলে সতী! তখনও কিন্তু সতী পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। তার শাড়ি, তার গয়না, তার স্নো পাউডার সেন্ট–সমস্ত কিছু যেন তার শরীরে দাউ দাউ করে জ্বলছে। আগুনে যেন তার সমস্ত শরীর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তবু এতটুকু ভেঙে পড়লো না সতী। বাতাসীর মা, শম্ভু দু’জনেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সতীর এই চূড়ান্ত অপমান চোখ দিয়ে দেখছিল। তাদের চোখের সামনে দিয়েই সতী আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে আবার ওপরে উঠতে লাগলো। উঠে নিজের ঘরে গেল। তারপর একে একে নতুন শাড়ি, গয়না, ব্লাউজ, শায়া সব খুলে ফেললে। আবার পুরোন শায়া ব্লাউজ শাড়ি গায়ে জড়ালো। আশ্চর্য, চোখ দিয়ে এতটুকু জল পড়লো না। বিছানায় ঢলে পড়লো না। মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদতেও বসলো না।
এ-সমস্তই দীপঙ্করের জানা। এ সমস্ত ঘটনাই সতী দীপঙ্করকে পরে বলেছে।
বর্মা থেকে ভুবনেশ্বর মিত্র চিঠি লিখেছেন–
“মা সতী, অনেক কাজের মধ্যে তোমাকে সবসময় সময়-মত চিঠি দিতে পারি না। তুমি কিছু মনে কোর না। তোমাকে সৎ পাত্রে অর্পণ করতে পেরেছি এই আমার এক পরম সান্ত্বনা স্বামীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করবে, স্বামী ছাড়া ত্রিভুবনে স্ত্রীলোকদের আর কোন দ্বিতীয় দেবতা নেই। সর্বদা স্বামীর ধ্যানই স্ত্রীলোকের পরম কর্তব্য জানবে। আর তোমার শাশুড়ী ঠাকুরানী, তাঁকেও মায়ের মত সেবা করবে। শৈশবে তুমি মা’কে হারিয়েছিলেন, এখন বিয়ের পর শাশুড়ী ঠাকুরানীই তোমার মায়ের স্থান গ্রহণ করেছেন। সুতরাং প্রাণ দিয়ে তাঁর তুষ্টি বিধান করবে। তোমার মা জীবিত নেই। থাকলে তিনিই তোমাকে এ-সব কথা লিখতেন। তাঁর অবর্তমানে তাই আমাকে এত কথা লিখতে হচ্ছে। আমার শরীরে আর পূর্বের ন্যায় পরিশ্রম সহ্য হয় না। ভাবি বিশ্রাম নেব। কিন্তু আবার ভাবি, বিশ্রাম নিলে বাঁচবো কী নিয়ে? তোমাদের কুশল সংবাদ দিও। তোমরা দুজনে আমার আশীর্বাদ নিও। আর শাশুড়ী ঠাকুরানীকে আমার প্রণাম জানাবে। ইতি আশীর্বাদক তোমার বাবা।”
সনাতনবাবুর নজর সাধারণত কোন ব্যাপারেই পড়ে না।
সতী বললে–বাবা চিঠি লিখেছেন–
সনাতনবাবু মুখ তুলে বললে–ও–
সতী আবার বললে–জানো বাবার শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে, বাবার শরীর খারাপের কথা শুনলে আমার রাত্রে ঘুম হয় না।
সনাতনবাবু বলেন–সত্যিই তো, বড় ভাবনার কথা–
বলেই অন্যমনস্ক হয়ে যান আবার।
সতী বলে–চিঠিটা পড়বে?
–না, তুমি তো পড়েছ, আমি আর কী করতে পড়বো।
তারপর অনেকক্ষণ ধরে বাবার কথা নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, যদি কারো সঙ্গে বসে বসে বাবার গল্প করা যেত! যদি কেউ কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে একটু! দুপুরবেলা সতী বাবাকে চিঠি লিখতে বসে। একটা চিঠি লেখে। দু’পাতা চিঠি। নিজের মনের কথার কিছু আর বাকি থাকে না লিখতে।
অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে লেখে–
“পরম পূজনীয় বাবা, তোমার শরীর খারাপের কথা শুনে বড় চিন্তিত হলাম। তুমি এবার বিশ্রাম নাও একটু। নয়ত কিছুদিনের জন্যে কোথাও বেড়াতে যাও। কাজ করলে তোমার শরীর আর টিকবে না। আর আমাকে তুমি সৎ পাত্রে অর্পণ করেছ লিখেছ। সৎপাত্রে যে অর্পণ করেছ তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এক এক সময় আমার সন্দেহ হয় বাবা, তুমি আমাকে কেন এত লেখা-পড়া শেখালে? কেন এত আত্মসম্মানের জ্ঞান দিলে? কেন আমি বোবা-কালা কানা হয়ে জন্মালাম না বাবা? তাহলে এ-সব কিছুই দেখতে শুনতে হতো না আমাকে। তাহলে আমি মুখ বুজে এ-সংসারে নির্বিবাদে কাটিয়ে দিতে পারতুম। কিন্তু আমার চারিদিকে এত সুখ তুমি কেন দিলে? আমি যে সুখের উপকরণের জ্বালায় বেঁচে মরে আছি। আমি যে এখনও বেঁচে আছি, সে কেবর তোমার মুখ চেয়ে বাবা। আর কোন কারণে নয়। ফেরত ডাকে তোমার চিঠি যেন ঠিক পাই–ইতি তোমার সতী।”
চিঠিটা ভাজ করে খামে পুরে খামের মুখটা এঁটে বাবার ঠিকানাটা লিখলে ওপরে। তারপর ডাকলে—শম্ভু–
শম্ভু ঘরে এলে সতী বললে–এই চিঠিটা নিজের হাতে পোস্টবক্সে গিয়ে ফেলে দিবি, বুঝলি? ভুল করে যেখানে-সেখানে ফেলিসনি যেন–
শম্ভু বরাবরই চিঠি ফেলে। এ আজ প্রথম নয়। তবু প্রত্যেকবারই সতী বার বার সাবধান করে দেয়। সতর্ক করে দেয়। ফিরে এলে আবার জিজ্ঞেস করে–ঠিক বাক্সের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ফেলেছিস তো? বাইরে পড়ে যায়নি?
শম্ভু বললো বৌদিমণি, আমি বরাবর চিঠি ফেলছি আর আজ আমি চিঠি ফেলতে জানবো না
আজও শম্ভু চিঠি নিয়ে চলে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেছে। হঠাৎ কী যে হলো। সতী উঠে পড়লো। উঠেই ডাকলে-শম্ভু, ও শম্ভু–
তাড়াতাড়ি সতী সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল তরতর করে। সেখানেও শম্ভু নেই। একেবারে বারবাড়ি পেরিয়ে হয়ত সদর রাস্তায় গিয়ে পৌঁছেছে। তাড়াতাড়ি বারবাড়ির উঠোনে গিয়ে বাগানের সামনে দরোয়ানকে ডাকলে–দারোয়ান, শোন তো, শম্ভু চিঠি ফেলতে গেল এখখুনি–শম্ভুকে একবার ডাক তো, শিগগির–
অনেকক্ষণ পরে দরোয়ান শম্ভুকে ডেকে নিয়ে এল।
–কী রে, চিঠি ফেলিস নি তো?
না, তখনও হাতে রয়েছে তার চিঠিটা। চিঠিটা তার হাত থেকে নিয়ে সতী সেখানা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললে। চিঠির টুকরোগুলো কুচো কুচো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে হাওয়ায় উড়তে লাগলো।
সতী তাড়াতাড়ি আবার ঘরে এল। ঘরে এসে আবার একটা নতুন চিঠি লিখলে– “বাবা, তোমার শরীরের কথা ভেবে খুব ভাবনায় পড়লাম। দিনকতক তুমি বিশ্রাম নাও। আমাদের এখানে এসে থাকতেও তো পারো। আমার শাশুড়ী বললেন–তোমার বাবাকে লিখে দাও এখানে আসতে। আমার এখানে কোনও কষ্ট নেই। শাশুড়ী আমাকে মেয়ের মতন যত্ন করেন। ছোটবেলায় আমি মাকে হারিয়েছিলাম বলে আমার যে দুঃখ ছিল, বিয়ের পরে আমার শাশুড়ী সে-দুঃখ মিটিয়েছেন। তুমি কেমন আছো, ফেরত ডাকে জানাবে।
–ইতি তোমার সতী।”
এ-সমস্ত দীপঙ্করের জানা ঘটনা। এ-সমস্ত ঘটনাই সতী দীপঙ্করকে পরে জানিয়েছে।
কিন্তু এর পরেই ঘটলো পুরী যাওয়ার ঘটনা। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের ঘোষেদের বাড়ির বাইরে থেকে যারা দেখতো, তাদের চোখে পড়তো অন্য জিনিস। খাকি ইউনিফর্ম পরা দরোয়ান কাঠের টুলের ওপর বসে থাকত গেটের পাশে। সরু ইঁট বাঁধানো লম্বা রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানকার গ্যারেজে পর পর দুখানা গাড়ি। তার পাশে বাগানের ফুল গাছের কেয়ারি। পাশের লাল রং-এর বাড়িটার রং করা দরজা-জানালা, শার্সি খড়খড়ি, আলো, জাঁক-জমক–কোনও কিছুরই কমতি নেই। যারা আরো একটু ভেতরে ঢুকতো, তারা আরো অবাক হয়ে যেত এ-বাড়ির ঐশ্বর্য দেখে। মার্বেল পাথরের ফ্লোর, মোরাদাবাদী ভাস-এ ক্যাক্টাসের চারা, বাগারের শেষপ্রান্তের এক-কোণে রাজহাঁসের দলবেঁধে চরা। কলকাতা শহরের ভবানীপুর অঞ্চলের বুকের মধ্যেও যেন এ এক অন্য জগৎ। সমস্ত বাড়িটা সব সময়েই যেন বড় নিরিবিলি। রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ গেট দিয়ে একটা গাড়ি ইট করে বেরিয়ে এল। দারোয়ান তার আগেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। দেখা যেত গাড়ির ভেতর বসে আছে একজন গরদের থান পরা বিধবা মেয়েমানুষ। পাকা চুলের ওপর বেশ যত্ন করে চিরুনি বোলানো। আর তার পাশেই একজন ভদ্রলোক। ধব্ ধব্ করছে দু’জনের গায়ের রং। প্রশান্ত গম্ভীর ধীর স্থির চেহারা। গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই গেটটা আবার বন্ধ হয়ে যেত।
যারা দেখতো তারা বলাবলি করতো–খুব বড়লোকের বাড়ি মনে হচ্ছে হে–
কিন্তু সেদিন যখন গাড়িটা বেরলো তার ভেতরে তখন অন্য একজন। সেই বিধবা মেয়েমানুষটিও নেই, সেই প্রশান্ত চেহারার ভদ্রলোকটিও নেই। আছে অন্য একজন। বেশ সুন্দর ফরসা একটি বৌ। মাথার কোঁকড়ানো চুলের খোঁপা। শরীরে আল্গা রূপের ঢেউ।
যারা দেখলে তারা বলাবলি করলে–খুব আরামে আছে মশাই এরা, এদেরই তো রাজত্ব হে–
হয়ত দীর্ঘনিশ্বাসও পড়লো কথাটার সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু যাকে লক্ষ্য করে বলা সেই সতীর কানে এ সব পৌঁছুল না।
ড্রাইভার শুধু এবার জিজ্ঞেস করলে–কোন্ দিকে যাবো বৌদিমণি?
সতী বললে–ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন—কালীঘাট–
সমস্ত দিন ধরে সতী কেবল ভেবেছিল। প্রথমে কিছুই বলেননি শাশুড়ী। বাতাসীর মা সব খবর রাখে ভেতর-বাড়ির। সে-ও জানতে পারেনি। ভূতির মা, শম্ভু দারোয়ান, বাড়ির অন্য চাকর ঝি তারাও কেউ জানতো না। সরকারবাবু নিজের ঘরে বসে হিসেবনিকেশ করে-তারও জানা ছিল না হয়ত। সনাতনবাবু লাইব্রেরী ঘরে ছিলেন। বাইরে থেকে মা ডাকলেন–সোনা–
সনাতনবাবু বললেন–আমাকে ডাকছো মা?
–হ্যাঁ, আজ রাত্রের ট্রেনে পুরী যাবো, আমার সঙ্গে যেতে হবে তোমাকে। অনেক দিনের মানত ছিল, এখন না গেলে হয়ত আর যাওয়া হবে না।
সরকারবাবু ডাক পেয়েই চশমাটা পড়ে দৌড়ে এল। শাশুড়ী বললেন–ক্যাশে টাকা আছে সরকারবাবু?
–আজ্ঞে কত?
–হাজার দুয়েক?
–আজ্ঞে মা, হাজার দুয়েক তো হবে না, আমি দেখছি কত আছে!
শাশুড়ী বললেন–দেখতে হবে না, আপনি ব্যাঙ্ক থেকেই তুলে আনুন, সোনা সই করে দিচ্ছে–
এসব ঘটনা ঘটেছে নিচেয়। কখন সরকারবাবু ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে গেছে, কখন ট্রেনের টিকিট কাটা হয়েছে, কিছুই জানতে পারেনি সতী। সকালে উঠে যথারীতি কলঘরে গেছে। সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছে, তারপর রান্নাবাড়িতে নেমেছে। তারপর দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়েছে। দুপুরবেলা নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে বই-এর পাতাও উল্টিয়েছে। বিকেলবেলা সনাতনবাবু একবার ঘরে এসেছিলেন, তিনিও কিছু বলেননি।
খবরটা দিলে শম্ভু।
শম্ভু এসে বললে–বৌদিমণি, দাদাবাবুর জামা-কাপড় বার করে দিন–
–জামা-কাপড়? জামা-কাপড় বার করে দেব কেন? ধোপ এসেছে?
–আজ্ঞে না, দাদাবাবু যে পুরী যাচ্ছেন মামণির সঙ্গে!
–পুরী! আকাশ থেকে পড়লো সতী। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই, পুরী যাচ্ছেন।
শম্ভু বললেহা বৌদিমণি, ভাঁড়ারে হুকুম হয়ে গেছে, ঘি-ময়দা বেরিয়েছে, বাতাসীর মা লুচি ভাজতে বলেছে ঠাকুরকে, বিছানা বাঁধছে কৈলাস, এবার সুটকেস গোছানো হবে–
ধড়মড় করে উঠে বসলো সতী। পুরী যাচ্ছেন দু’জনে–আর সে? সতী কি এখানে থাকবে? জামা-কাপড় বার করে দিলে আলমারি থেকে। একগাদা জামা-কাপড়। সমস্ত মাথাটা যেন গরম হয়ে গেল এক মুহূর্তে। শঙ্কু জামা-কাপড়গুলো নিয়ে যাবার পর সতী একবার দাঁড়ালো চুপ করে ঘরের মধ্যেই। মনে হলো তখুনি ছুটে যায় লাইব্রেরী-ঘরে। কিন্তু তারপরেই আবার গিয়ে দাঁড়াল জানালার সামনে। জিনিসিপত্র বাঁধাছদা হচ্ছে, খাবার তৈরি হচ্ছে–আর সতী কিছুই জানে না! সতীকে কিনা খবরটা শুনতে হলো চাকরের মুখ থেকে!
সবসময় ছটফট করে বেড়াতে লাগলো সতী। ঘড়িতে চারটে বাজলো। পাশে চাকর-বাকরদের আনা-গোনার শব্দ হচ্ছে। তোড়-জোড় চলছে যাওয়ার। নিচের রান্নাবাড়িতে লুচি ভাজা হচ্ছে। হঠাৎ শম্ভুকে দেখেই সতী ডাকলে-শম্ভু শোন–
শম্ভু আসতেই সতী জিজ্ঞেস করলে–সঙ্গে কে-কে যাচ্ছিস তোরা? তুই যাচ্ছিস?
শম্ভু বললে–না বৌদিমণি, আমি যাচ্ছি না, কৈলাস ঠাকুর আর বাতাসীর মা যাবে—
তাহলে ঠাকুর গেলে এখানে রান্না করবে কে?
–নতুন বামুন ঠাকুর!
তারপর হঠাৎ কী মনে হলো। একটু থেমে বললে–দাদাবাবু তোর কোথায় রে? লাইব্রেরী-ঘরে?
–না, মামণির ঘরে।
সতী বললে–আচ্ছা তুই যা–
কী যে করবে বুঝতে পারলে না। মনে হলো এখনি বাবাকে টেলিগ্রাম করে দেয়। আর এক মুহূর্ত এ-বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করছে না। দরকার নেই এই সংসারে। দরকার নেই। দরকার নেই। নিজের ঘরের মধ্যে ছটফট করতে লাগলো সতী। মনে হলো একটা খাঁচার মধ্যে যেন কেউ তাকে পায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। আর বেরোবার উপায় নেই তার। হঠাৎ জামা-কাপড় পরা সাজা-গোজা সনাতনবাবু ঘরে এসে হাজির হলেন।
সতী সামনে গিয়ে কী বলবে বুঝতে পারলে না। হাঁফাতে লাগলো খানিকক্ষণ। তারপর বললে–তোমরা পুরী যাবে?
সনাতনবাবু যেন অন্য কিছু ভাবছিলেন। বললেন–হ্যাঁ, কেন?
–তা আমাকে তো জানাওনি কিছু তোমরা?
–তুমি জানতে না?
সনাতনবাবু যেন এতক্ষণ জানতেন না সে-কথা। বললেন–তা নাই বা জানলে, আমিও তো জানতুম না, এখন মা আমাকে বললে–
–কিন্তু আমাকে জানানোও কি তোমাদের উচিত ছিল না?
সতী কথাগুলো বলতে বলতে হাঁফাচ্ছিল।
–আমি কি তোমাদের বাড়ির কেউ নই?
সনাতনবাবু বললেন–সত্যিই তো, তোমাকে জানানোই উচিত ছিল–
বলে তিনি নির্বিকারভাবেই ঘর থেকে চলে যাচ্ছিলেন। সতী তাঁর সামনে ঘুরে গিয়ে দাঁড়াল, বললে–তুমি কী বল তো? তোমরা সবাই চলে গেলে আমি একলা এ-বাড়িতে থাকবো কী করে? আমাকে একলা ফেলে যেতে তোমাদের কষ্ট হয় না
সনাতনবাবু কেমন যেন বিব্রত বোধ করলেন। বললেন–না না, তুমিই বা একলা থাকবে কী করে? সত্যিই তো! দাঁড়াও মাকে বলছি গিয়ে, আমি বলছি গিয়ে মাকে–
সতী সনাতনবাবুর হাতটা খপ করে ধরে ফেললে। বললে–বলতে হবে না। বলতে হবে না তোমার মাকে আমি যেতে চাই না, আমি একলাই থাকবো-একলা থাকতে কোনও কষ্ট হবে না–
সনাতনবাবু সতীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন–তা হলে বলবো না মাকে?
–না, বলতে হবে না। তোমরা যেখানে খুশি যাও, যতদিন ইচ্ছে থাকো, আমার দরকার নেই তোমাদের, আমি এখানে খুব আরামে থাকবো।
সনাতবাবু যেন নিশ্চিন্ত হলেন মনে হলো। বললেন–হ্যাঁ মা-ও সেই কথাই বলছিল, শম্ভুকে রেখে যাচ্ছি, আর নতুন বামুন ঠাকুর রইল। আর আমরা তো বেশি দিন থাকবো না। পাঁচ-ছ’দিনের মধ্যেই ফিরে আসবো–
সতী হাতটা ছেড়ে দিলে। সনাতনবাবু আবার হঠাৎ ভেবে বললেন–তা তোমার যদি যাবার ইচ্ছে থাকে তো চলো না, তোমার কথাটা ঠিক আমার মনে ছিল না–
সতী বললে–না, থাক, আমি যাবো না
–তা হলে আসি, কেমন!
বাইরে থেকে শাশুড়ীর গলা শোনা গেল-সোনা।
–যাই মা–
সনাতনবাবু বেরিয়ে গেলেন। শাশুড়ী একটু পরেই ঘরে ঢুকলেন। সেই গরদের থান। মাথার পাকা চুলের ওপর চিরুনি বোলানো। ব্যস্ত খুব। শাশুড়ীকে আসতে দেখেই সতী সামনে এসে পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলে। শাশুড়ী বললেন–সাবধানে থাকবে বৌমা, আমি সরকারবাবুকে সব বুঝিয়ে বলে গেলাম–তোমার অসুবিধে হবে না কিছু, শম্ভুকে রেখে গেলাম, নতুন টাকরটাও রইল, দরোয়ানকে বলে দিচ্ছি একটু হুঁশিয়ার হয়ে যেন থাকে–আর, আর কিছু বলতে হবে?
সতী বললে–না।
–দেখ আমার মানত ছিল বলেই যাওয়া, নইলে কে যায় এই সময় সংসার ফেলে? তোমার কিছু অসুবিধে হলে শম্বুকে বলবে, সরকারবাবুকে সব বলা আছে আমার
তারপর হঠাৎ যেন কী মনে পড়ে গেল। বললেন–যাই, ট্রেনের দেরি হয়ে যাবে আবার–
বলে শাশুড়ী চলে গেলেন। সনাতনবাবু আগেই চলে গিয়েছিলেন। সতী ঘরটার মধ্যে একলা খানিকক্ষণ সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সদর রাস্তার গেট খোলার শব্দ শোনা গেল। গাড়ি বেরলো। গাড়ির শব্দটাও এক সময়ে মিলিয়ে গেল। তারপর সব ফাঁকা। সতীর মনে হলো সমস্ত বাড়িটা যেন নিঃশব্দে একটা অট্টহাসি হাসতে লাগলো তার দিকে চেয়ে। মনে হলো এই ঐশ্বর্য, এই গাড়ি, এই সুখ, আরাম বৈভব সব যেন মিথ্যে। সব যেন ফাপা! এর চেয়ে যদি তার অসুখ করতো, যদি সে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে থাকতো সে-ও যেন অনেক ভাল ছিল তার পক্ষে। এর চেয়ে যদি একটা ছোট সংসারের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতো তার চিন্তা-ভাবনা-কর্ম, সে-ও যেন এর চেয়ে অনেক ভাল হতো। এই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বিরাট বাড়িটার চেয়ে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের পুরোন ভাঙা বাড়িটাও যেন অনেক ভাল ছিল।
শম্ভু এল ঘরে হঠাৎ বললে–বৌদিমণি—
–হ্যাঁ রে, ওঁরা চলে গেছেন?
রাত্রে খাবে না-ই ভেবেছিল সতী। কিন্তু কেন খাবে না? কেন সে নিজেকে কষ্ট দেবে? কার ওপর অভিমান করে? কে তার অভিমানের মূল্য দেবে? আবার ডাকলে শম্ভু
শম্ভু ঘরে এল আবার। সতী বললে–আমি খাবো রে—
–তখন যে বললে খাবো না! উনুন নিবিয়ে দিয়েছে নতুন ঠাকুর–
–তা হোক, আবার উনুনে আগুন দিতে বল, আমার জন্যে লুচি ভাজবে!
সেই অত রাত্রে আবার উনুনে আগুন দিতে হলো। বাতাসীর মা চলে গিয়েছে। ভূতির মা’র ঘাড়ে পড়েছে সংসার। নতুন ঠাকুর আবার লুচি ভাজলে। আবার বৌদিমণির জন্যে লুচি ভাজা হলো। আবার তরকারী রান্না হলো। সতী চেয়ে চেয়ে খেলে। কী হয়েছে তার? কিছুই হয়নি। সে কেন শরীরকে কষ্ট দিতে যাবে! আরাম করে খেয়ে রাতভোর ঘুমোবে। দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে সকালবেলা। শাশুড়ী নেই যে তাকে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে হবে।
তারপর খাওয়া-দাওয়ার পর সতী বিছানায় শুয়ে পড়লো। ভূতির
মা বললে–বৌদিমণি, একলা শুতে তোমার ভয় করবে না তো?
–কেন, ভয় করবে কেন?
–না, যদি বলো তাহলে আমি তোমার দরজার বাইরে না-হয় শুচ্ছি–
–না, না, আমার কী হয়েছে? তুমি তোমার নিজের ঘরে শোও-গে যাও ভূতির মা, আমার জন্যে তোমার কষ্ট করার দরকার নেই–
–তা হলে দরজায় খিল লাগিয়ে দিও বৌদিমণি!
ঘুম অবশ্য আসেনি সেদিন সতীর। ঘুম এলে অন্যায় হতো। সমস্ত রাত কত রাজ্যের শব্দ শুনেছে শুয়ে শুয়ে। তারপর শেষ রাত্রের দিকে একটু তন্দ্রাও এসেছিল বোধহয়। তা সেও খানিকক্ষণের জন্যে। তারপরেই ঘড়ির শব্দ কানে এসেছে আবার। আবার দূরে ট্রাম-বাস চলার আওয়াজ এসেছে কানে। সতী তখন বিছানা থেকে উঠে পড়েছে। উঠে বাইরে বারান্দায় এসে দেখেছে ভূতির মা দরজার সামনেই মেঝের ওপর শুয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
–ভূতির মা, ও ভূতির মা।
ভূতির মা ধড়ফড় করে উঠে বললে–বৌদিমণি?
–সকাল হয়ে গেছে, উঠবে না?
তারপরে শম্ভুকে ডাকলে সতী। বললে–ড্রাইভারকে বলবি আমি বেরোব আজ গাড়িতে
–কোথায় যাবে বৌদিমণি তুমি?
–তা তোর শোনবার দরকার কী? আমার যেখানে খুশি বেরোব, যা বলছি তাই কর গিয়ে
তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিয়ে সতী একটা শাড়ি বেছে নিয়ে পরলে। ভাল শাড়ি। মুখটায় স্নো পাউডার ঘষে নিলে। প্রথমে কোনও ঠিক ছিল না কোথায় যাবে। শম্ভু বলেছিল–আমি তোমার সঙ্গে যাবো বৌদিমণি?
–না, তুই থাক, দারোয়ান আমার সঙ্গে যাবে।
ড্রাইভার একবার জিজ্ঞেস করেছিল-কোন্ দিকে যাবো বৌদিমণি?
সতী বললে–ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন-কালীঘাট–
কিন্তু হঠাৎ কী যে হলো! গাড়িটা তখন হাজরা রোড দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে ঘুরছিল। হঠাৎ সতী বললে–না সোজা চলো–
তখন সকাল। এত সকালে গেলে হয়ত সবাই বিব্রত হয়ে উঠবে সেখানে। গলির ভেতর তো গাড়িটা ঢুকবে না। অনেক দিন পরে যাওয়া। হয়ত সতীকে দেখে সবাই অবাক হয়ে যাবে। হয়ত তাদের সেই বাড়িটাতে নতুন ভাড়াটে এসেছে। হয়ত দীপুরাও আর নেই সে-বাড়িতে। হয়ত দীপুরা উঠে গেছে অন্য কোনও জায়গায়। তার মাকে পরের বাড়ি রান্না করতে হয় না। হয়ত দীপু বিয়ে করেছে। হয়ত তার ছেলে-মেয়ে হয়েছে।
গাড়িটা সোজা একেবারে জজেস কোর্ট রোড দিয়ে চলছিল। আবার ঘরে এল এদিকে। এবার আবার হাজরা রোড দিয়ে ফিরে এল গাড়িটা। হরিশ মুখার্জি রোড। হরিশ মুখার্জি রোডের ওপরেই জয়ন্তীদের বাড়িটা। লক্ষ্মীদির বন্ধু জয়ন্তী পালিত। ব্যারিস্টার পালিতের মেয়ে। আর সেই ব্যারিস্টার পালিতের ছেলে নির্মল পালিত। বহুদিন আগে একবার লক্ষ্মীদির সঙ্গে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে।
সতী হঠাৎ বললে–না থাক, সোজা চলো–একেবারে সোজা–
একেবারে সোজা। এইসব রাস্তা কত চেনা! কতদিন কলেজ যাবার পথে এই রাস্তা দিয়ে কলেজের বাসে করে গেছে। সে-সব দিন যেন চোখের ওপর ভাসছে। সতী হেলান দিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলো। সমস্ত কলকাতা যেন চষে বেড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। মনের ইচ্ছেটা যেন গাড়ির চাকা হয়ে বন্ বন্ করে ঘুরছে। এ-রাস্তা যেখানে শেষ হবে, সেইখানে গিয়ে পৌঁছতে পারলে যেন ভাল হয়। রাস্তা দিয়ে আপিস-যাত্রীর দল চলেছে। একটু পরেই আপিসের দরজাগুলো খুলবে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে বইখাতা নিয়ে। একদিন সতীও এই রকম করে স্কুলে গিয়েছে। কলেজে গিয়েছে, তারপর বড় হয়েছে। তারপর একদিন বিয়েও হয়ে গেছে তার। বিয়ের পর থেকেই যেন সব গোলমাল হয়ে গিয়েছে। বিশৃঙ্খল হয়ে গিয়েছে।
সতী হঠাৎ বললে–গাড়ি ঘোরাও, গাড়ি ঘোরাও
গাড়ির চারটে চাকা কলকাতার রাস্তা তখন অনেক মসৃণ করে দিয়েছে। মনের অনেক উত্তাপ নিভে গেছে।
–কোন্ দিকে যাবো বৌদিমণি?
–ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন, কালীঘাট–
কথাটা বললে বটে সতী। কিন্তু তারা যদি সেখানে না থাকে আর! তারা যদি বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়ে থাকে! নতুন ঠিকানাটা নিশ্চয় পাওয়া যাবে ও-বাড়ি থেকে। গিয়ে বলবে সতী-এমনি এলাম! কেন, আসতে নেই নাকি? এতদিন আসেনি বলেই কি চিরকালের মত আসতে পারবে না? চিরকালের সম্পর্ক কি একেবারেই ঘুচিয়ে দিতে হবে নাকি? বলে একটু হাসবে। আর তা ছাড়া সম্পর্কটাও বড় কথা নয়। সংসারের কাজে কে কার খবর নিতে পারে! সবাই-ই তো নিজের সমস্যা নিয়ে জড়িয়ে আছে। বড়লোকের বাড়িতে সতীর বিয়ে হয়েছে বলে কি তার কোনও সমস্যাই থাকবে না?
কিন্তু নেপাল ভট্রাচার্যি স্ট্রীটের সেই রাস্তাটার ওপর গিয়ে গাড়ি থামতেই সতী কি যেন ভাবলে।
বললেদারোয়ান, উনিশের একের বি নম্বরে গিয়ে দেখে এসো তো, দীপঙ্করবাবু বলে কোনও লোক আছে কিনা, থাকলে ডেকে নিয়ে আসবে আমার কাছে
দারোয়ান বুঝতে পারেনি। সতী আরো বুঝিয়ে দিয়ে বললে–ওই যে ইট বার করা বাড়িটা–ওইখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করো গে–
আর তারপরেই দীপঙ্কর এসেছিল। কী চেহারা হয়েছে দীপুর! মাথার চুলগুলো উস্কোখুস্কো। মাথায় একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা।
আশ্চর্য তখনও জানতো না সতী, কেন সে এতদিন পরে আবার পুরোন পাড়াতে গিয়ে হাজির হয়েছিল! হঠাৎ খেয়াল হলো। দীপঙ্কর যদি জিজ্ঞেস করে সতী কেন এসেছে এতদিন পরে, তা হলে কী জবাব দেবে সে! হঠাৎ সতীর মনে পড়লো। দীপঙ্করের মা বরাবর প্রত্যেক বছর এই তারিখে ছেলের জন্যে পায়েস রান্না করতো। দীপুর মা এই দিনটাতেই ছেলের জন্যে ঝিকে দিয়ে বাজার করিয়ে আনাতো। দীপু যা যা খেতে ভালবাসে সেই সব রান্নার আয়োজন করতো। কতবার দীপুর মা সতীকে বলেছিল–দু’মাস বয়েস থেকে ওকে বুকে করে এখানে এসেছি মা, ও যে আমার বড় হবে, মানুষ হবে তা তো তখন ভাবিনি–
এমন করে কোনও মাকে তার ছেলেকে এত ভালবাসতে দেখেনি কোনওদিন সতী!
মাসীমা বলেছিল–ভরা অমাবস্যার দিন জম্মেছিল দীপু, একেবারে মৌনী অমাবস্যা, ও যখন হলো, লোকে বললে এ ছেলে তোমার চোর হবে-তা কী জানি কী হবে, ছেলে বেঁচে থাকলেই আমি খুশি মা, ছেলে-মেয়ে যে কী জিনিস তা যখন আবার তোমার ছেলে-মেয়ে হবে, তখন বুঝবে মা
দীপঙ্কর যখন জিজ্ঞেস করলে-হঠাৎ কী মনে করে তুমি?
সতী টপ করে বলে দিয়েছিল–সোমবারে তুমি আমাদের বাড়িতে যাবে, ওখানেই খাবে–
কথাটা হঠাৎই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। দীপুকে নেমন্তন্ন করবার কোনও কল্পনাই ছিল না সতীর যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। কিন্তু কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল! যখন নেপাল ভট্রাচার্যি স্ট্রীট থেকে ফিরে এসেছিল তখনও সতীর সংশয় কাটেনি। কাজটা ভাল করেছে না মন্দ! ন্যায় না অন্যায় করলে সে! কিন্তু তখন আর উপায় নেই। তখন আর বারণ করবারও পথ বন্ধ। সব ব্যবস্থা স্থির হয়ে গেছে। দীপঙ্কর সোমবার আসবে। ফাঁকা বাড়িটার মধ্যে কটা দিন কী অস্বস্তিতেই যে কাটলো! কেন সে নেমন্তন্ন। করতে গেল দীপুকে? কেন সে এমন কাজ করে বসলো? কার সঙ্গেই বা সে পরামর্শ করবে! কেমন করে তাকে বারণ করবে!
দেখতে দেখতে সোমবার এসে গেল।
ভূতির মাকে ডেকে পাঠালে সতী। বললে–ভূতির মা, আজকে একজনকে নেমন্তন্ন করেছি বাড়িতে, তুমি ব্যবস্থা করতে পারবে?
ভূতির মা বললে–কেন পারবো না বৌদিমণি, বাতাসীর মা নেই বলে কি গেরস্থবাড়ির কাজ-কম্ম বন্ধ হয়ে যাবে?
–তুমি তাহলে শম্ভুকে বলে দাও ভূতির মা, কী কী আনতে হবে। যেন গুছিয়ে-গাছিয়ে সব নিয়ে আসে, অনেক রকম মাছ, মাংস, ডিম–আর পায়েসও করতে হবে গন্ধ-চালের
ভূতির মা সত্যিই বাঁচিয়ে দিলে। বললে–তুমি কিছু ভেবোনি বৌদিমনি, হারামজাদী বাতাসীর মা নেই বলে ভেবোনি ভূতির-মা মরে গেছে। আমি থাকতে কিছু ভাবনা কোরনি।
–তুমি, আমি সব যোগাড়-যন্তর করে দিচ্ছি–
–আর রান্না? নতুন বামুন-ঠাকুর কি পারবে?
ভূতির মা’র যেন আত্মসম্মানে আঘাত লাগলো। বললে–রান্না না করতে পারে তো আমি আছি কি করতে? আমি কি মরেছি?
সমস্ত দিন সত্যিই খুব খাটুনি গেল সতীর। একটা-একটা করে রান্না। কেন যে হঠাৎ নেমন্তন্ন করতে গেল দীপুকে কে জানে! অথচ যখন নেমন্তন্ন করা হয়েছে তখন তো আর পেছানো যায় না। সমস্ত দিন রান্না-বান্নার পরিশ্রমের পর গা ধুয়ে যখন তৈরি হয়েছে, তখন দীপঙ্কর এসে গেল।
আগে থেকেই দরোয়ানকে বলে রেখেছিল সতী। বাবু এলেই যেন ওপরে নিয়ে আসে। কিন্তু তার আগেই শম্ভু এসে খবর দিয়ে গেছে। বকুটা একটু কেঁপে উঠেছিল এক মুহূর্তের জন্যে! কোনও অন্যায় কাজ করছে নাকি সে! কিন্তু তখনি মনটাকে দৃঢ় করে নিয়েছিল। অধিকার আছে বৈ কি তার। অধিকার আছে বৈ কি নিজের আত্মীয়-স্বজনদের নেমন্তন্ন করবার। সে-ও এ-বাড়ির বউ। এ-বাড়িতে অন্য সকলের মত তারও অধিকার আছে।
আর তারপর শেষ মুহূর্তে সেই দারুণ দুর্যোগ।
সেই ঘটনার পরও দীপঙ্কর খেলে। খেতে বাধ্য করলে সতী। সমস্ত বুকটা থরথর করে কেঁপে উঠছিল সতীর। তারও অধিকার আছে। সতী বলেছিল–আমারও অধিকার আছে এ-বাড়িতে তুমি–খেয়ে তার প্রমাণ দিয়ে যাও আজ–
যতক্ষণ খেয়েছে দীপঙ্কর ততক্ষণ এক অস্বাভাবিক উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপেছে শুধু সে। তারপর যখন দীপঙ্কর চলে যাবার জন্যে তৈরি, সতী শাশুড়ীকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছেকাল তুমি আসবে-আবার কাল আসবে–বুঝলে–
দীপঙ্কর চলে যাবার পর শাশুড়ী আবার ডাকলেন–বৌমা, একবার শুনে যাও এদিকে–
সতী নিজেকে শক্ত করে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল শাশুড়ীর সামনে।
শাশুড়ী তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই একই জায়গায়। তখনও ট্রেনের সাজ-পোশাক ছাড়েননি তিনি।
বললেন–আমি এখনও মরিনি বৌমা, আমার মরার আগেই আমার শ্বশুরের ভিটেতে দাঁড়িয়ে তুমি আমারই সামনে আমাকে অপমান করলে–
সতী চুপ করে রইল মাথা নিচু করে।
শাশুড়ী আবার বললেন–আর আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তুমি যা পরে বললে তা-ও আমি শুনেছি, কিন্তু মনে রেখো এখনো আমি বেঁচে আছি–
তারপর একটু থেমে বললেন—যাও–
সতী আস্তে আস্তে নিজের ঘরে চলে এল। দেয়ালের ঘড়িটার বুকের মধ্যে তখন বোধহয় তুমুল শব্দে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। সতী খাটের বাজুটা ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে, যেন ছেড়ে দিলে পড়ে যাবে সে। যেন পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
–বৌদিমণি!
শম্ভু ঘরে এসেছে। বললে–তোমার খাবার দেব বৌদিমণি?
সতী হঠাৎ পেছন ফিরলো। বললে–না, তুই যা, বাতাসীর মা’কে বলগে যা, আমি খাবো না আজ–
শম্ভু চলে গেল। খানিক পরে ভূতির মা আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকেছে। বললো বৌদিমণি, তুমি খাবে না কেন? চৌপর রাত না-খেয়ে থাকলে পিত্তি পড়বে যে, চলো খাবে চলো
সতী বললে–না, ভূতির মা, আমার খিদে নেই, সত্যি বলছি-তুমি যাও এখন এখান থেকে–
ভূতির মা তবু নড়ে না। বলে-তুমি না খেলে আমরা খাই কী করে বলে দিকি?
–না, খাওগে যাও ভূতির মা, তাতে কোনও দোষ হবে না, যাও তুমি, খেয়ে নাও গে–
সতীর সেই সব দিনের কথা দীপঙ্করের এখনও মনে আছে। প্রত্যেকটি কথা প্রত্যেকটি ঘটনার খুঁটিনাটি পর্যন্ত সতী দীপঙ্করকে বলেছিল। এ-এক অদ্ভুত আরামের জীবন সতীর। এ আরামের জ্বালা যত, মাদকতাও তত। সতীর দিনগুলো যেন আরামের আতিশয্যে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যেত। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন যন্ত্রণার কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে তে। অথচ কোথায় যেন একটা আকর্ষণও ছিল সনাতনবাবুর জন্যে!
রাত যখন অনেক, তখন সনাতনবাবু ঘরে এলেন। ভারি হাসি-হাসি মুখ।
বললেন–দেখ, ভগবানের ইচ্ছে না থাকলে কোনও আশা কি মেটে মানুষের?
সতী ভেবেছিল সনাতনবাবুও বোধহয় প্রথমে এসেই সেই প্রশ্ন করবেন। কে এসেছিল? কাকে নেমন্তন্ন করেছিল সতী? কিন্তু সে-সবের ধার দিয়েও গেলেন না তিনি। বলতে লাগলেন–আর ঘণ্টা চার-পাঁচেকের হবে, কিন্তু সেদিকেও রাস্তা বন্ধ তখন, সেদিকেও নদীর জল উঠে লাইন আটকে আছে! দু’দিন সেই গাড়িতেই বসা-শেষকালে মা’কে বললুম–
সতী কিছু কথা বললে না।
সনাতনবাবু বলতে লাগলেন-তারপর ট্রেনটা পেছু হেঁটে কটক স্টেশনে এল আবার, ভাবলাম যাওয়া যখন হলো না, তখন কলকাতাতেই ফিরে আসতে হবে, কিন্তু সেদিকেও রাস্তা বন্ধ তখন, সেদিকেও জল উঠে লাইন আটকে আছে। দুদিন সেই গাড়িতেই বসা-শেষকালে মাকে বললুম–
কী সব অনেক কথা বলে গেলেন সনাতনবাবু। কিছুই কানে গেল না। অন্যদিনকার মত সনাতনবাবু আর বই নিয়ে টেবিলে পড়তে বসলেন না। তিনদিনের পরিশ্রমের কান্তি তার শরীরে। আস্তে আস্তে জামা খুলতে লাগলেন। সতীর মনে হলো এইবার বোধ হয় বলবেন। এইবার বোধহয় জিজ্ঞেস করবেন।
কিন্তু সে-সব কথাই উত্থাপন করলেন না সনাতনবাবু। জামা খুলে সনাতনবাবু বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। তারপর হঠাৎ যেন খেয়াল হলো। বললেন–এ কি, তুমি শোবে না?
–হ্যাঁ, শুই!
সতী আস্তে আস্তে এসে পাশে শুলো। এক বিছানা। একেবারে পাশাপাশি। আলো নিভিয়ে দিয়েছে সতী। সমস্ত ঘরখানা অন্ধকার। একবার উসখুস করে উঠলেন সনাতনবাবু। ওপাশ ফিরলেন। সতী চমকে উঠলো এক মুহূর্তের জন্যে। এইবার বোধহয় জিজ্ঞেস করবেন। এইবার বোধহয় প্রশ্ন করবেন–কে ও? কে এসেছিল বাড়িতে! কাকে বসে খাওয়াচ্ছিলে!
কিন্তু সনাতনবাবু কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। ঘড়ির বুকের ধু-ধুকুনি বাড়তে লাগলো। টিক্ টিক্ শব্দটা যেন সতীর বুকের মধ্যে ঘা দিতে লাগলো। যেন আঘাত লাগতে লাগলো জোরে জোরে। যেন দম বন্ধ হবে যাবে তার।
–দেখ, একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল।
সতী উদগ্রীব হয়েই ছিল। এইবার নিশ্চয় কথাটা বলবেন। বললে–কী কথা?
সনাতনবাবু বললেন–উনিশ শো বত্রিশ সালেও এই বর্ষার সময়ে একবার রেল-লাইন এইরকম ডুবে গিয়েছিল জানো-তাই ভাবছিলাম বর্ষাকালে পুরী যাওয়াটাই আমাদের ভুল হয়েছে।
বলে সনাতনবাবু চুপ করে গেলেন। তারপর মনে হলো তিনি বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছেন।
সতী আর থাকতে পারলে না। বললে–আর কিছু বলবে না তুমি?
সনাতনবাবু ঘুমের মধ্যেই যেন উত্তর দিলেন–
–তুমি ঘুমিয়ে পড়লে?
সনাতনবাবু বললেন–না, কিছু বলছিলে তুমি?
সতী বললে–থাক তোমার ঘুম পাচ্ছে, তুমি ঘুমোও–
–না না, একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তা এখন জেগে উঠেছি, বলল না কী? কিছু বলছিলে তুমি?
সতী একটু থেমে বললে–তুমি তো কিছু বললে না আমায়?
সনাতনবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন–কিসের জন্যে?
–ওই যে যাকে তুমি দেখলে আমার ঘরে, তুমি তো জিজ্ঞেস করলে না, ও কে? সনাতনবাবুর যেন এতক্ষণে মনে পড়লো। বললেন–তাই তো বটে! ও কে?
–কিন্তু তুমি জিজ্ঞেস করলে না কেন?
সনাতনবাবু বললেন–আমার ঠিক মনে ছিল না–
–সে কি, তোমার স্ত্রীর সঙ্গে একজন অচেনা লোক বাড়ির ভেতরে ঢুকে কথা বলছিল আর তুমি একবার জিজ্ঞেসও করলে না, ও কে? এ-কথা মানুষ ভুলে যায়? ভুলতে পারে?
সনাতনবাবু যেন নিজের ভুল স্বীকার করলেন। বললেন–তা যাগে তুমিই বলো ও কে?
–না, তা আমি বলবো না, কিন্তু তুমি আগে বলো তুমি কেন জিজ্ঞেস করলে না?
সনাতনবাবু বোধহয় কী বলবেন বুঝতে পারলেন না।
সতী বললে–তোমারই তো আগে জিজ্ঞেস করা উচিত, ও কে?
সনাতনবাবু স্বীকার করলেন। বললেন, আমারই আগে জিজ্ঞেস করা উচিত–
–তা জিজ্ঞেস করলে না কেন?
হেসে ফেললেন সনাতনবাবু এবার। বললেন–এই দেখ, কী মুশকিলে ফেললে তুমি আমাকে
–না বলল, তোমাকে জবাব দিতেই হবে।
সনাতনবাবু বললেন–এবার থেকে জিজ্ঞেস করবো, এবার মনে রাখবো ঠিক!
সতী বললে–আমি কালকেও ওকে আসতে বলেছি।
–ভালোই করেছ!
–কালকে এলে আমি তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব, তুমি কথা বলবে ওর সঙ্গে, তুমি আমার সম্মান বাঁচাবে, তুমি আমার কথার মর্যাদা রাখবে।
–নিশ্চয়ই রাখবো। কালকে আমি নিশ্চয়ই কথা বলবো
সনাতনবাবু বোধহয় সত্যিই ক্লান্ত ছিলেন খুব। তিনি ওপাশ ফিরে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলেন। খানিক পরে ঘুমিয়েও পড়লেন। একটানা নিশ্বাস পড়তে লাগলো। সতীও ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলো। প্রথমে চোখ দুটো বুজে অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে এলিয়ে দেবার চেষ্টা করলে। শুধু ঘুম, কোথাও কিছু অশান্তি নেই। পৃথিবীর সব জায়গায় অখণ্ড শান্তি আছে। আমিও সুখী। আমারও কোনও কিছু অশান্তি নেই। পৃথিবীর সব জায়গায় অখণ্ড শান্তি আছে। আমিও সুখী। আমারও কোনও দুঃখ নেই। এমনি করে একমনে ঘুমের সাধনা করে অনেকবার ঘুম এসেছে তার। প্রথম আধ ঘণ্টা এক ঘণ্টা একটু চেষ্টা করতে হয়, তারপরে মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কেমন শিথিল হয়ে আসে। তারপর নিরবচ্ছিন্ন ঘুম, নিস্তরঙ্গ বিশ্রাম!
সতী আবার চিৎ হয়ে শুলো। মনে হলো কোথায় যেন শব্দ হলো একটা। খুটখুট শব্দ! কোথায় শব্দ হবে? কে শব্দ করবে? ওপরে ছাদে তো কেউ চাকর-বাকর শোয় না। সবাই একতলায় সরকারবাবুর পাশের ঘরে শুয়েছে। কেউ তো কোথাও নেই! তিন চারখানা ঘর পেরিয়ে শাশুড়ী শুয়ে আছেন তার নিজের ঘরে। সনাতনবাবু পাশেই শুয়ে আছেন। তাঁর তো একটানা নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শব্দ হয় না কোনও দিন।
সতী বিছানা ছেড়ে উঠলো। তবে হয়ত ঘড়িটার শব্দ। বিরাট ঘড়ি। মাঝে মাঝে ভেতর থেকে কেমন একটা কল-কজার খুট-খাট শব্দ হয়। সতী উঠে দাঁড়াল গিয়ে ঘড়িটার তলায়। আশ্চর্য! ঘড়ির টিক টিক শব্দটাও তো হচ্ছে না আর! অন্ধকারের মধ্যেই সতী ঘড়িটার দিকে তাকাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে। ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। কখন রাত একটা বাজার পর আর চলেনি। কাঁটা দুটো এক জায়গায় এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত দম দেওয়া হয়নি। হয়ত দম ফুরিয়ে গিয়েছে!
সতী আবার নিজের বিছানায় এসে শুলো। তখন কত রাত কে জানে!
অনেক দিন পরে এই ঘটনা শুনতে শুনতে দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল–কিন্তু শব্দটা হয়েছিল কিসের?
সতী বলেছিল–তখন বুঝিনি শব্দটা কিসের, কিন্তু পরে বুঝেছিলাম–ও বাইরের শব্দ নয়, ও ভেতরের-আমার অন্তরাত্মার শব্দ, আমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল–তার মানে?
সতী বলেছিল–তার মানে তুমি বুঝবে না, ও সবাই বোঝে না–সবাই শুনতেও পায় না। কপাল যখন কারো ভাঙতে শুরু করে, ও শব্দ শুধু সে-ই শুনতে পায়–
সতীরও সেদিন তাই মনে হয়েছিল বিছানায় শুয়ে শুয়ে। একটু ভয় পেয়েছিল প্রথমে। তারপরে আবার ঘুমোতে চেষ্টা করেছিল। কেবল মনে পড়ছিল-দীপঙ্কর এলে তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে। সনাতনবাবু তার সঙ্গে কথা বলবে, সতীর সম্মান বাঁচাবে, সতীর কথার মর্যাদা রাখবে…..
.
সব রাতই এক সময়ে ভোর হয়, সব দিনই এক সময়ে আবার সন্ধ্যেবেলায় গিয়ে ঠেকে। তবু সেদিন রাতটা যেন কাটতে চায়নি দীপঙ্করের। দীপঙ্করের মনে আছে সতীদের গাড়িটা যখন তাকে নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল তখনও দীপঙ্কর যেন সম্বিৎ ফিরে পায়নি। তখনও যেন সতীর কথাটা তার কানে বাজছে–আমারও যে এ-বাড়িতে একটা অধিকার আছে সেটা তুমি আজ খেয়ে প্রমাণ দিয়ে যাও–
তখনও যেন সতীর নীল চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে। সতীর সমস্ত শরীরটা থরথর করে কাঁপছিল যেন তখনও।
তাড়াতাড়ি যেন জ্ঞান ফিরে পেয়ে দীপঙ্কর নিজের বাড়ির মধ্যে ঢুকলো। অন্যদিন এ-সময়ে অন্ধকার থাকে। চন্নুনী সকাল-সকাল তার নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বিন্তিদিও নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে খিল দিয়ে দেয়। তখন আর কোনও কাজ থাকে না মা’র। তখন মা-ও ছিটে-ফোঁটার ভাত ঢাকা দিয়ে রেখে শুয়ে পড়তো। কিন্তু এখনকার চেহারা আলাদা। এখন অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বলে ঘরে ঘরে। লক্কা লোটনের হাসি-ঠাট্টার আওয়াজ শোনা যায়। এখন বাইরে হল্লা চলে বটে, ছিটে-ফোঁটার শাগরেদরা এসে অনেক রাত পর্যন্ত আসর জমায়–কিন্তু মা নিজের রান্নাটা সেরে বিন্তিকে খাইয়েই ঘরে খিল দিয়ে দেয়। আধখানা বাড়ি তখন অন্ধকার।
মা দেখতে পেয়েই বললে–খেয়ে এলি?
ছেলের মুখের দিকে চেয়ে কেমন ভাবনাও হলো আবার। বললে–কী রে, মুখ দেখে মনে হচ্ছে পেট ভরেনি যেন তোর?
–না মা ভরেছে।
তারপর হঠাৎ দীপঙ্কর বললে–কাল ভোরবেলা কিন্তু যাওয়া আমাদের, মনে আছে তো? যা নেবার গুছিয়ে নিয়েছ তো?
নেবার আর কীই-বা আছে দীপঙ্করদের। যা কিছু সম্পত্তি সব তো অঘোরদাদুর। যে-তক্তপোশটায় শোয় দীপঙ্কর, তা-ও অঘোরদাদুর। যে থালাটায় খায়, তা-ও অঘোরদাদুর। এই যা কিছু সবই অঘোরদাদুর দেওয়া। যখন মার কোলে চড়ে এখানে এসেছিল সেদিন যা সঙ্গে ছিল আজও তাই সঙ্গে যাবে। শুধু পাথরপটি থেকে একটা কাঠের বাক্স মা কিনেছিল। তাও অনেকদিন হয়ে গেছে। সে-বাক্সটার কজা ভেঙে গেছে, রঙ চটে গেছে। সেইটেই একমাত্র সঙ্গে যাবে। আর যাবে জামা-কাপড়, মা’র দু’একখানা সাদা থান। এই!
দীপঙ্কর আবার বললে–কাল ভোরবেলাই আমি গাড়ি নিয়ে আসবো, দেরি কোরো যেন, আমাকে আবার ঠিক সময়ে আপিসে যেতে হবে–
মা বললে–যাওয়া আমার হবে না কাল–
–কেন?
–এই যে, এই শব্দুরকে ফেলে কেন করে যাই বল? একে কোথায় রাখি?
বিন্তিদি মা’র কোল ঘেঁষে এতক্ষণ বসেছিল। বাড়িতে যে এত হৈ-চৈ উৎসবের আয়োজন হচ্ছে, এ মেয়ে যেন সে-সবের মধ্যে নেই। এ যেন একেবারে দলছাড়া।
দীপঙ্কর বললে–তা বিন্তিদিকেও নিয়ে চলো না আমাদের সঙ্গে–বিন্তিদিও যাক
–দূর, তা কী করে হয়! এদের মেয়ে, এর মায়ের পেটের ভাইরা থাকতে আমি নিয়ে যাবো, লোকে বলবে কি! আর ভাইরাই বা ছাড়বে কেন? আমরা তো পর!
তা-ও বটে। তা রাতটা কাটলো সেইরকম করেই। কিন্তু ভোরবেলাই একেবারে অন্যরকম। মা রাত থাকতেই উঠেছে। উঠে চন্নুনীর ঘরে গিয়েছে। ভেতরে ঢুকে বললে–আমরা আজ চললুম বাছা–তুমি যেন কিছু ভেবো না আবার
চন্নুনী কথা বলতে পারলে না। হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলো।
মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিলে। বললে–কেঁদে কী করবে বাছা, চিরকাল কি কেউ থাকে সংসারে? একদিন-না-একদিন তো যেতেই হবে সকলকে–
পেছন থেকে দীপঙ্কর এসে ডাকলে। বললে–মা চলো–ট্যাক্সি এসেছে–
মা বললে–ওরে, বুড়ি কাঁদতে লেগেছে, তুই একবার আয় বাবা, কাছে আয়, তোকে ছোটবেলায় কত কোলে-পিঠে করে বেড়িয়েছে, আহা তোকে দেখলেও একটু শান্তি পাবে বেচারী মরবার সময়–
দীপঙ্কর ঘরে ঢুকলো। মা নীচু হয়ে ঝুঁকে পড়ে বললে–এই আমার দীপু এসেছে বাছা। দীপুকে দেখ–
দীপঙ্কর ঝুঁকে দাঁড়াল। চন্নুনী দীপুর মাথায় হাত ছোঁয়ালো। হয়ত আশীর্বাদ করলে বুড়ি!
মা বললে–আশীবার্দ করো বাছা, দীপু যেন আমার বড়মানুষ হয়ে–
সত্যিই, সেই মানুষই কেমন করে আবার বয়েস হলে এমন অথর্ব হয়ে পড়ে এটাই আশ্চর্য! সবাই একদিন এই রকম বুড়ো হবে। এই রকম অথর্ব হবে। এই রকম কথা বন্ধ হয়ে যাবে। অঘোরদাদুও শেষের কয়েক ঘণ্টা আর কথা বলতে পারেনি। জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছিল। চন্নুনী মেয়েমানুষ, তাই হয়ত এত জোর। এখনও টিকে রয়েছে–
দীপঙ্কর বললে–চলো মা, ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে রয়েছে–
–চল চল বাবা–
তারপর বললে–বিন্তিকে একবার ডাকবো না, যা অভিমানী মেয়ে, না বলে গেলে সে মেয়ে কি আমার রক্ষে রাখবে–
তা বটে। বিন্তিদি হয়ত তখনও দরজায় খিল দিয়ে নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছ। মা সেই দিকেই যাচ্ছিল। হঠাৎ ফোঁটা টের পেয়েছে। সাধারণত ছিটে-ফোঁটা সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। ওদিকে অনেক রাত করে শোয়। তারপর বেলা আটটা-নয়াট ঘুম ভাঙে তাদের। এখন তো আর অঘোরদাদু নেই। আগে যখন অঘোরদাদু বেঁচে ছিল, তখন ভোরবেলা উঠেই বাজারের বস্তিতে চলে যেত। ছোটবেলাকার দেখা সেই ছিটে-ফোঁটাদের তখন কী ভয়ই করতো দীপঙ্কর। তারাই এখন বড় হয়েছে, এ-বাড়ির মালিক হয়েছে, অনেক টাকার মালিক হয়েছে।
ফোঁটা দেখতে পেয়েই এসেছে। বললে–কোথায় যাচ্ছ তোমরা দিদি? বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছো?
যেন ধমকাতে ধমকাতে সামনে এসে দাঁড়াল–
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ–
মা বললো বাবা, এখন তোমরা নিজেদের সংসার নিজেরা করো, আমার দীপু এখন বড় হয়েছে-সে কেন তোমাদের গলগ্রহ হয়ে থাকবে, এখন ছেলে চাকরি করছে, ছেলের বিয়ে-থা দেব আমি, আমারও তো সাধ-আহ্লাদ হয়–
ফেঁটা যেন কী ভাবলে। তারপর চিৎকার করে ডাকলে–ছিটে, ছিটে–
ছিটেও ঘর থেকে বেরিয়ে এল চোখ মুছতে মুছতে। ফোঁটা বললে–এই দ্যাখ, দীপুটার কাণ্ড দ্যাখ, এখন লায়েক হয়েছে কিনা, মাকে নিয়ে কাউকে না-বলে-কয়ে ভেগে যাচ্ছে। দ্যাখ তুই–
ছিটে সব জিনিসটা বুঝে নিয়ে বললে–তার মানে? তার মানেটা কি?
মা বললে–তোমরা রাগ করো না বাবা, দীপু তো কোনও মন্দ কাজ করছে না, এখন তো স্বাধীন হয়েছে, এখন তো আমাদের চলে যাওয়াই ভালো–আর কার জন্যেই বা থাকা? অঘোরদাদুও তো চলে গেলেন–
ছিটে বললে–অঘোর ভট্টাচার্য চলে গেল তা কী হলো? তার নাতিরা রয়েছে কী করতে?
ফোঁটা দীপঙ্করের দিকে এগিয়ে এল। বললে–কী মতলব তোর শুনি? বলি কী মতলব তোর?
দীপঙ্কর হাসতে লাগলো। বললে–আমি একটা বাড়ি ভাড়া করেছি, স্টেশন রোডে, বালিগঞ্জে, পনেরো টাকা ভাড়ায়, পাঁচ টাকা বায়না দিয়ে এসেছি–অনেক দিন তো তোমাদের জ্বালালুম, এবার–
ফোঁটা বললে ভালো চাও তো এখানে থাকো, নইলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি–
ছিটে বললে–বাড়ি ভাড়া করতে হয় তো এই বাড়ি ভাড়া নাও-এই পাশের বাড়িটা তো খালি পড়ে রয়েছে–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু পাঁচ টাকা যে বায়না দিয়ে এসেছি সেখানে–
–কুছ পরোয়া নেই, পাঁচ টাকার জন্যে ফটিক ভট্টচার্য্য গরীব লোক হয়ে যাবে না, আমি পাঁচ টাকা তোর দিয়ে দেব। তুই আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাক্, কিন্তু চলে যেতে পাবে না। তোমার ট্যাক্সিওয়ালাকে চলে যেতে বলল
তারপর কী ভেবে নিজেই বাইরে চলে গেল। বোধহয় ট্যাক্সি ফেরত পাঠিয়ে দিতে গেল।
দীপঙ্কর মার দিকে চাইলে। মা-ও চাইলে ছেলের দিকে।
ছিটে বললে–আর ভাবাভাবি নেই, এখানেই থেকে যাও–
মা বললে–কিন্তু বাবা, বিন্তির জন্যেই আমার ভাবনা, মেয়েটার বিয়েথা হলো না, তোমরা কেউ দেখলে না ওকে, ও আমাদের কাছে থাকবে
ছিটে বললে–তা থাক, কিন্তু ওর বিয়ে আমরা দেব বলে রাখছি, আমাদের বোনের বিয়ে আমরা দেব-কাউকে দিতে হবে না–
তা শেষপর্যন্ত তাই-ই হলো। এত আয়োজন, এত কল্পনা, এত প্রচেষ্টা শেষপর্যন্ত সব পণ্ডশ্রম। সতী, লক্ষ্মী, কাকাবাবু, কাকীমারা এতদিন যে বাড়িতে কাটিয়েছে, সেই বাড়িতেই দীপঙ্কররা থাকবে ঠিক হলো। ভাড়া দেবে মাসে দশ টাকা করে। ভালোই হলো, মা’র মনটা একটু খুঁতখুঁত করছিল। গঙ্গা থেকে অনেক দূর, মায়ের মন্দির থেকেও অনেক দূর। শেষপর্যন্ত ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে! আবার এতদিন পরে সেই বাড়িতে ঢুকবে, আবার সতী যে-ঘরে ঘুমোত, থাকতো, সেই ঘরেই থাকতে পারবে। তারও একটা আলাদা রোমাঞ্চ আছে বৈ কি।
মা-ও ভাবছিল বিন্তিটারই আনন্দ হবে সবচেয়ে বেশি। সে-ই কদিন ধরে ভাল করে কথা বলছিল না। কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। সে জানতো ভোরবেলায় দিদি চলে যাবে–সন্ধ্যে থেকেই দিদির কাছ-ছাড়া হয়নি।
মা বিন্তির ঘরের কাছে যেতেই কেমন অবাক হয়ে গেল। বিন্তি কোথায়? দরজা হাট করে খোলা। এমন তো হয় না! নিজের ঘর ছেড়ে সে তত বড় কোথায়ও একটা যায় না। গেল কোথায়?
–ওরে দীপু, বিন্তি কোথায় গেল? এত সকালে ঘুম থেকে ওঠে না তো সে? গেল কোথায়?
দীপঙ্কর বললে–কলঘরে দেখেছ?
–হ্যাঁ, সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম তো!
ছিটেফোঁটাও অবাক হয়ে গেল। এমন তো হয় না। কোথায় গেল! সমস্ত বাড়িটা তছনছ করে খুঁজে দেখা হল। চন্নুনীর ঘর, উঠোনের কোণ, হাজি কাশিমের বাগানের পাচিলটার ওপাশা। কোথাও নেই। হা গা মেয়েটাকে কি ভূতে নিয়ে গেল! দীপুর মা’র মাথায় যেন আকাশের বাজ ভেঙে পড়লো। সে মেয়ে নিশ্চয় কোনও সর্বনাশ বাধিয়েছে। দাওয়ার ওপরেই দীপুর মা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।
দীপঙ্কর বললে–মা, তুমি ওঠো, আমি খুঁজছি, দেখছি কোথায় আছে, যাবে কোথায়, আছে বোধহয় কোথাও এখানেই–
মা চুপ করে রইল। ছিটেও বললে–তুমি ভাবছো কেন দিদি–যাবে কোথায় সে–আমি দেখছি–
সকাল থেকে সেই যে শুরু হলো সে যেন আর থামতে চায় না। সত্যি সত্যি ছিটেও বেরোল আশেপাশে খুঁজে দেখতে। ফোঁটাও একটু ভাবতে লাগলো। এতদিন ধরে এত জিনিস নিয়ে ভেবেছে তারা, এত জিনিস নিয়ে ঝগড়া করেছে, মারামারি করেছে, মুখ খারাপ করেছে; নিজেদের অধিকারবোধ নিয়ে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে চারদিকে। তারা। এতদিন ধরে যা চেয়েছিল তা পেয়েছে। কিন্তু বোনটার কথা তো তারা ভাবেনি। একটা বোনও যে আছে তাদের, সে কথা তো তারা ভুলেই গিয়েছিল। কবে একদিন ঘোঁট ফুটফুটে একটা মেয়ে তাদের সঙ্গেই এ-বাড়িতে বড় হয়েছে, মানুষ হয়েছে। কিন্তু তাদের মতন সে ঝগড়া করতে শেখেনি, প্রতিবাদ করতে শেখেনি। সংসারের প্রতিযোগিতার ভিড়ে অস্তিত্ব বজায় রাখবার জন্যে এদের মত ঠেলাঠেলি করে নিজের জায়গাটুকু দখল করবার কায়দাটুকু শিখে নিতে জানেনি। তাই বুঝি তার কথা সবাই ভুলেই গিয়েছিল। এখন যেন তার কথা আবার নতুন করে মনে পড়লো সবার। শুধু মাই যেন ভুলতে পারেনি তাকে। সব সময় তাকে সামলে সামলে চলেছে। এ-সংসারে বিন্তিদিই বুঝি একমাত্র অচল মানুষ। সে কিছু কেড়ে নিতে জানে না, শুধু বোবার মত চুপ করে বড় বড় চোখ তুলে চেয়ে থাকতে জানে আর কাঁদতে জানে।
আগের রাত্রে তার কান্নাটাও শুকিয়ে গিয়েছিল বুঝি। যখন বাড়ি-বদলাবার কথা আলোচনা করেছে দীপু আর দীপুর মা, যখন গুছিয়ে-গাছিয়ে পরদিন ভোরবেলা চলে যাবার ব্যবস্থা করেছে, তখনও সে বেশি কিছু বলেনি। আগে বলতো। তারপর যত দিন গেছে, ততই যেন সে নিজের মনের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছে। একেবারে মনের অতলে গিয়ে ডুব দিয়েছে। এক মা ছাড়া আর কেউ যেন তার সন্ধানই পায়নি। তাই দীপুর মাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো দাওয়ার ওপর।
মা’র অনেক দিন থেকেই যন্ত্রণার চাপ চলেছে। একটার পর একটা যেন লেগেই আছে। একমাত্র ভরসা ছিল অঘোরদাদু। সেই অঘোরদাদু যেতে-না-যেতেই আবার এই।
ও-বাড়ি মানে পাশের বাড়ি। একদিন ও-বাড়িতে কত সন্তর্পণে ঢুকেছে দীপঙ্কর। কত বিগত স্মৃতির বেদনায় জড়ানো ও-বাড়ির প্রত্যেকটা ইট। সেই বাড়িতেই এবার থেকে থাকবে দীপঙ্কর। ভালোই হলো। এ-বাড়ির এই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের সঙ্গে দীপঙ্করের জীবন জড়িয়ে গেছে। এ ছেড়ে চলে না যাওয়াই ভালো। এ ছাড়তেও হয়ত পারা যাবে না আর। জীবনের সঙ্গে যা জড়িয়ে যায়, তাকে ছাড়তে পারা কি অত সহজ! এই বাড়িতেই একদিন লক্ষ্মীদি তাকে প্রাণপণে মেরেছিল, আবার এ-বাড়িতেই লক্ষ্মীদি তাকে ভালোও বেসেছিল, চকোলেট দিয়েছিল। এ-বাড়ি থেকেই কতদিন ভোরবেলা লক্ষ্মীদির চিঠি নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দাতারবাবুকে দিয়ে এসেছে। আবার এই বাড়িতেই সতী তাকে তাচ্ছিল্য দিয়েছে, অবজ্ঞা দিয়েছে হয়ত বা একটু কৃপাকণাও দিয়েছে। আর এই পাড়া। এই পাড়ার এই বাড়ির সঙ্গে যে তার সারা জীবনের যোগাযোগ। এইখানেই কিরণের সঙ্গে চাঁদা তুলে দীপঙ্কর লাইব্রেরী করেছে, এইখানকার স্কুলেই প্রাণমথবাবু তাদের হাতে গড়ে মানুষ করেছেন। এই কালীঘাটের মাটিতেই বলতে গেলে গজিয়ে উঠেছে সে। এখানকে কি এত সহজে ছাড়া যায়।
ছিটেও ফিরে এল এদিক-ওদিক ঘুরে। বললে–না, বিন্তিটা পালিয়েছে নিশ্চয়–
দীপঙ্কর বললে–পালিয়েছে? পালাতে যাবে কেন?
ছিটে বললে–না পালালে যাবে কোথায়? কোনও জায়গা তো আর খুঁজতে বাকি রাখিনি–পাথুরেপটি, হালদার-পাড়া, পাণ্ডা-বাড়ি, ধর্মশালাগুলো সব চষে এলাম। কোথাও নেই। কালীঘাটে থাকলে আমার চোখে ধুলো দিয়ে কোনও শালা লুকিয়ে থাকতে পারবে না–সে নেই, হাওয়া হয়েছে–
ফোঁটাও ফিরে এল। বললে–দিদি, পাওয়া গেল না-ভেগেছে সে নির্ঘাত–
দীপঙ্কর বললে–পুলিসে খবর দিয়েছ? থানায় খবর দিলে না কেন?
ফোঁটা বললে–থানার কথা ফটিক ভটচায্যিকে বলতে হবে না-থানা-পুলিস এ শৰ্মাদের ঘর-বাড়ি–
সত্যিই শেষপর্যন্ত কোথাও পাওয়া গেল না বিন্তিদেকে। সকাল সাতটা আটটা ন’টা বাজলো। তখন আর দেরি করা যায় না। আপিসে আছে।
মা বললে–জানিস দীপু, সেই জন্যেই মেয়েটা কাল অন্যদিনের মত মোটে কান্নাকাটি করলে না–
দীপঙ্কর বললে–তুমি অত ভাবছো কেন মা, পুলিসে তো খবর দেওয়া হয়েছে, তারা নিশ্চয়ই খুঁজে বার করবে–
মা বললে–এতদিন বুকের কাছে রেখে রেখে সে যে আমার পেটের মেয়ের মত হয়ে গিয়েছিল রে, আমি না ভাবলে আর কে ভাববে–তার আছে কে?
সত্যিই তো, তার আছে কে! কার জন্যে সে এ বাড়িতে থাকবে! অঘোরদাদুর মৃত্যুর পর থেকেই মা কেমন হয়ে গিয়েছিল। তারপর বিন্তিদির ব্যাপারে যেন আর ঠিক থাকতে পারলে না। কোথাকার কাদের মেয়ে, খুঁজলে তার সঙ্গে সম্পর্ক বার করা যাবে না, তবু কেন যে তার জন্যে দীপঙ্করেরও মনটা কেমন করতে লাগলো, কে জানে! মনে হলো, এ তার কী হলো। পৃথিবীতে এত জিনিস আছে ভাববার, এত সমস্যা! বিরাট পৃথিবীর কত অসংখ্য মানুষ কত অসংখ্য সমস্যার ভারে একেবারে জর্জরিত হয়ে আছে, দীপঙ্কর একলা ভেবে তার কতটুকু প্রতিকার করতে পারবে!
আপিসে বেরোবার সময় দীপঙ্কর ফোঁটাকে দেখতে পেয়ে বললে–আমি আপিসে চললুম, তোমরা একটু খোঁজ নিও, জানো–
ফোঁটা বললে–তোর কিছু ভাবনা নেই দীপু, আমরা দু’ভাই খুঁজে বার করবোই তুই নিশ্চিন্তে আপিসে যা–
দীপঙ্কর বললে–মাকে তো বলে বলেও মুখে একটু জল দেওয়াতে পারলুম না, মা সকাল থেকে কিছু খেলে না পর্যন্ত–এখন বিন্তিদেকে যদি না পাওয়া যায় তো কী যে হবে বুঝতে পারছি না–
ফোঁটা বললে–সে কি, দিদি কিছু খায়নি? কেন? না খেলে কি সে ফিরবে? তা তুই কিছু ভাবিস নে, তুই আপিসে যা, আমি দিদিকে গিয়ে সব বুঝিয়ে বলছি–
দীপঙ্কর তারপর আপিসে চলে এসেছিল। আপিসেও অনেক দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছিল। প্রমোশন হলেই হয় না। হাতে-কলমে কাজ করতে হোক আর না হোক, দায়িত্বটা বেড়েছে। যারা একদিন দীপঙ্করের সঙ্গে পাশাপাশি বসে কাজ করেছে, তারাও আজ সসম্ভ্রমে সমীহ করে কথা বলে। যে জাপান-ট্রাফিক এতদিন এত জরুরী ব্যাপার ছিল তা নিয়ে আর কেউ-ই মাথা ঘামায় না। রবিনসন সাহেব এখন অন্য জিনিসে মাথা ঘামাচ্ছে। কখনও খেয়াল হলো তো একবার ফাইলটা এনে দেখে। দিল্লী থেকে জরুরী চিঠি না এলে আর তা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করে না।
দীপঙ্করের নতুন চাপরাশী লোকটা ভালো। দীপঙ্কর আপিসে যাবার আগেই ঘরের চেয়ার টেবিল পরিষ্কার করে রাখে। মেদিনীপুর দেশ মধুর।
দীপঙ্কর ডাকে—মধু–
মধু তড়াক করে ভেতরে ঢুকে বলে–আমাকে ডাকছিলেন হুজুর–
–রবিনসন সাহেব আমাকে ডাকেনি?
–না হুজুর!
সবে ধন ওই এক কর্তা! কবে কখন এসে পড়ে সাহেব তার বাঁধা-ধরা নিয়ম-কানুন নেই। খেয়াল হলো তো ভোরবেলাই কুকুর নিয়ে এসে হাজির। আবার এক-একদিন দশটা বেজে গেলেও সাহেবের দেখা নেই। দোতলা থেকে এজেন্টের খাস চাপরাশী বার-বার এসে রবিনসন সাহেবের খোঁজ করে গেছে। দ্বিজপদ সকাল থেকেই দরজা আগলে বসে আছে। কিন্তু সাহেবের দেখা নেই। দ্বিজপদ জানে কেন সাহেবের দেরি হচ্ছে। কুকুরের অসুখ। কুকুরের একটা কিছু অসুখ হলেই সাহেবের সব কিছু গোলমাল হয়ে যায়। ডাক্তারের কাছে ফোন্ করে। মাঝে মাঝে বাজারে কুকুরের বিস্কুট না-পাওয়া গেলেই সাহেব ক্ষেপে যায়।
বলে-ডু ইউ নো সেন, বাজারে বিস্কিট পাওয়া যাচ্ছে না—
দীপঙ্কর তো অবাক হয়ে যায়। বলে-পাওয়া যাচ্ছে স্যার–প্লেন্টি পাওয়া যাচ্ছে–
সাহেব বলে–অল রাইট, তুমি এখনি বলো কোন দোকানে পাওয়া যাচ্ছে, আমি চাপরাশি পাঠাচ্ছি–
শেষকালে দ্বিজপদ বলে–না হুজুর, আমি চারদিন ধরে কলকাতার সব দোকানে খুঁজছি, সে-বিস্কুট নয়–কুকুরের খাওয়ার বিস্কুট–
শেষে যখন কোথাও পাওয়া যায় না তখন ডাক পড়ে মিস মাইকেলের। শর্ট-হ্যান্ড, নোট নিতে হবে। লেখো চিঠি লন্ডনে। বিস্কিট-ম্যানুফ্যাকচারাস-লন্ডন। ফেমাস কোম্পানি সমস্ত। সেইখানে চিঠি লিখতে হয় রেলওয়ের কাগজে, রেলওয়ের কালিতে আর রেলওয়ের খরচে। সাতদিন ধরে সারা পৃথিবীর বিস্কুট-কোম্পানিদের চিঠি লিখতে লিখতে মিস মাইকেলের হাত ব্যাথা হয়ে যায়। হাত টনটন করে। তখন রেলওয়ের কাজের কথা আর মাথায় ঢোকে না সাহেবের। কেউ মোটা ফাইল নিয়ে ঘরে ঢুকলে সাহেব বিরক্ত হয়। বলে-নো নো নট টো- ডে, মাই ডগ ইজ সি নাউ–
তা সি হলে কী হবে, সেই কুকুরই আবার আপিসে আসে। এসে টেবিলের ওপরে উঠে বসে থাকে। আর সাহেব তার সঙ্গে কানে কানে কী সব বিড় বিড় করে কথা বলে। সে-কথা আর কেউ বুঝতে পারে না। দ্বিজপদ দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে আর অবাক হয়ে যায়। হেসে ফেলে।
জার্নাল সেকশানের কে-জি-দাশবাবু দেখা হলে ঘাড় নিচু করে সসম্ভ্রমে হাত তুলে নমস্কার করে কিন্তু সেকশানে গিয়ে বলে–কাজ করবো কী গাঙ্গুলীবাবু, কাজ করতে আর মন চায় না–
গাঙ্গুলীবাবু বলে–কেন বড়বাবু?
কে-জি-দাশবাবু বলে-আরে, সেদিনের ছোকরা, যাকে হাতে ধরে কাজ শেখালুম, তাকেই আবার গুড় মর্নিং করতে হয়, মান-অপমান কিছু আর রইল না–
কথাটা গাঙ্গুলীবাবুই আবার দীপঙ্করের কানে তোলে। বলে-দেখুন সেনবাবু, আপনার প্রমোশন হয়েছে বলে বড়বাবুর হিংসেটা দেখুন–
দীপঙ্কর বলে–তা হোক গাঙ্গুলীবাবু, ওটা আমি হলে আমারও হতো, আমারও হিংসে হতো
তারপর একটু থেমে দীপঙ্কর বলে–আমি জানি কে কী বলে আমার সম্বন্ধে।
গাঙ্গুলীবাবু বলে–সব কি আর আপনার কানে যায় সেনবাবু? সব কানে যায় না। আপনি যে এই সাদাসিধে কোটপ্যান্ট পরে আসেন তাতেও আপনার নিন্দে হয়
–কেন, নিন্দে হয় কেন?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–বলে ও-ও আপনার একটা চাল! অহঙ্কারটা ঢাকবার ও-ও একটা ছল আর কি। লোকে বলে আপনি রবিন্সন সাহেবের কুকুরকে বিস্কুট কিনে দেন টি-টিন-তাইতেই আপনার প্রমোশন হয়েছে–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আপনি তো জানেন গাঙ্গুলীবাবু, আমি কত গরীব। আপনাকে আমি সব তো বলেছি। আমার মা পরের বাড়িতে রান্না করে আমাকে মানুষ করেছে। আমার অজান্তে আমার মা নৃপেনবাবুকে তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে আমার চাকরি করিয়ে দিয়েছিল-তা-ও তো আপনাকে বলেছি। তা আমি কিসের অহঙ্কার করতে যাবো বলুন? আর অভাবের কথা যদি বলেন তো অভাব আমি যা দেখেছি তা আপনারাও দেখেননি। আমি কিনতে যাবো সাহেবের বিস্কুট! আর রবিনসন সাহেব তাই নেবে?
সত্যিই, দীপঙ্করের মনে হতো এই চাকরি, এই প্রমোশন, এই ফরসা জামা কাপড়ও যেন তাকে আজ লজ্জা দেয়। এই চাপরাশীর সেলাম-এ-ও যেন তার পাওনার অতিরিক্ত। গেটে ঢোকবার মুখে দরোয়ান আজকাল তাকে সেলাম করে। কে-জি দাশবাবু, রামলিঙ্গমবাবু, সবাই কেমন অন্যরকম চোখে চেয়ে দেখে। কোথায় যেন একটা সম্পর্কের বাধা-নিষেধ এসে দীপঙ্করকে সকলের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। মাইনে বেড়েছে তার নিঃসন্দেহে। এখন আর মাইনে নেবার জন্যে পে-ক্লার্কের সামনে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াতে হয় না। এখন পে-ক্লার্ক নিজেই এসে তার হাতে মাইনে দিয়ে সই করিয়ে নেয়। এ-ও যেন ভালো লাগে না। পদ-মর্যাদা হয়েছে বলে সে কি দূর হয়ে যাবে? সে কি পর হয়ে যাবে? এক-একদিন নিজেই সেকশানে যায়। যেতেই সবাই যেন চকিত হয়ে ওঠে। কেউ-কেউ মুড়ি খেতে খেতে মুড়ির ঠোঙাটা লুকিয়ে ফেলে। যারা আপিসের মধ্যে খবরের কাগজ পড়ে, তারা হঠাৎ ধরা পড়ে গিয়ে কাগজটা লুকিয়ে মুখটা নিচু করে বসে থাকে। তবু কিছু বলে না দীপঙ্কর। কেন বলবে? মানুষ তো মেশিন নয়। সকাল দশটা থেকে মুখ বুজে কাজ করলেই কি ভাল কাজ হয়? কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু গল্প করা ভালো বৈ কি। একদিন দীপঙ্কর এদের মধ্যেই এইখানে বসেই কাজ করেছে। সুতরাং সেকশানে কাজ হয় কি না-হয় কিছুই জানতে বাকি নেই। তবু দীপঙ্করের বলতে যেন কেমন বাধে। কে-জি-দাশবাবু এসে কমপ্লেন করেন। বলেন কেউ কাজ করে না সেকশানে, এরকম করলে আমি কী করে কাজ চালাবো বলুন আপনি কিছু বলেন না ওদের-ওরা তাই সাহস পেয়ে গেছে–
দীপঙ্কর বলে–ওদের নিয়েই কাজ করতে হবে কে-জি-দাশবাবু, গল্প করার মধ্যেই কাজ তুলে নিতে হবে–
কে-জি-দাশবাবুর সঙ্গে এইসব কথা নিয়ে আলোচনা করতেও যেন দীপঙ্করের কেমন লজ্জা হয়। এই চেয়ার, এই চেয়ারটারই এত মূল্য! এই চেয়ারটাকেই তো তারা সম্মান দেয়। তারপর আপিস থেকে বেরোলে অগণিত মানুষের ভিড়ের মধ্যে দীপঙ্কর আবার তখন যেন নিজেকে খুঁজে পায়। আবার যেন বেঁচে ওঠে সে। আবার যেন অস্বস্তি কেটে যায়। কিন্তু এমন একদিন তো আসবে, যখন এই চেয়ার থেকে তাকে সরে যেতে হবে-একদিন বাইরের পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে এক সারিতে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, তখন কোথায় থাকবে এই ভয়, এই মর্যাদা, এই সেলাম, আর এই চেয়ার। আপিসে ঢোকবার পরমুহূর্ত থেকেই যেন সারাক্ষণ তাই আড়ষ্ট হয়ে কাটে। যেন সহজ-স্বাভাবিক হওয়া যায় না। যেন এখানে সে দীপু নয়, যেন এখানে সে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে নয়। এখানে যেন সে রাজা। নকল রাজা। যাত্রা-থিয়েটারের মত জরি আর ভেলভেটের জামা-পরা নকল রাজা। এই নকল সাজ ছেড়ে সকাল বেলাই আবার তাকে ছেঁড়া শার্ট ময়লা ধুতি পরে আত্মপ্রকাশের বাস্তব ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। যখন দিল্লীর বোর্ড থেকে চিঠি আসে, যখন সেকশানের বড়বাবুরা সেন সাহেবের মতামতের জন্যে উদগ্রীব প্রতীক্ষা করে থাকে, তখন হাসি পায় দীপঙ্করের। মনে হয়, এত সহজেই এরা এত গুরুত্ব দেয়ৈ একে! এদের কাছে ধর্ম গেলেও যেন ক্ষতি নেই, মনুষ্যত্ব গেলেও যেন লোকসান নেই, চাকরিটা যেন বাঁচে, সেলাম যেন বাঁচে, চেয়ার যেন টিকে থাকে।
মিস মাইকেল এক-একদিন ঢুকে পড়ে। ঢুকে দীপঙ্করকে দেখে অবাক হয়ে যায়।
বলে–এ কি সেন, কী ভাবছো? বাড়ি যাবে না?
মিস মাইকেলের সেই এক রকম চেহারা। সেই কাঁধ-কাটা গাউন, সেই ব করা চুল, সেই রং মাখা ঠোঁট। এক-একদিন এক-একরকম ভ্যানিটি ব্যাগ। আজকাল আর বেশি দেখা হয় না আগেকার মতন। যেদিন প্রথম ঘরটা ছেড়ে চলে এসেছিল দীপঙ্কর, সেদিন ভারি দুঃখ করেছিল মেমসাহেব। কিন্তু হাসিমুখেই বলেছিল–কিন্তু আমি রিয়্যালি গ্ল্যাড্ সেন, আই উইশ ইউ মোর সাকসেস–
তারপর বলেছিল–আর তুমি দেখে নিও সেন, আমিও আর বেশিদিন ইন্ডিয়ায় থাকবো না–
–কেন? কোথায় যাবে?
মিস মাইকেল বলেছিল–আমি ভিভিয়ানকে চিঠি লিখেছি–
–ভিভিয়ানকে? কেন?
–আমি ম্যারিকায় চলে যাবো। আই শ্যাল টেক এ চান্স—
মিস মাইকেলের ধারণা, যত কষ্ট বুঝি শুধু তারই কপালে। মিস মাইকেল ছাড়া আর সবাই যেন সুখে আছে। বলে-কী আছে আমার জীবনে? প্রত্যেক মাসে আমাকে লোন করতে হয়–এভাবে আর কতদিন চালাবো বলো
–কিন্তু আমি এত কম টাকায় কী করে চালাচ্ছি?
মিস মাইকেল বলে–তুমি যে ড্রিঙ্ক কর না। ড্রিঙ্ক না করলে বেঁচে থেকে লাভ কী! তুমি সিগ্রেট খাও না, ড্রিঙ্ক কর না, তোমার ভাবনা কী?
–কিন্তু তুমিও তো না করে থাকতে পারো। তাতে অনেক পয়সা বাঁচে। লোন করতে হয় না। হেলথ ভালো থাকে কত সুবিধে!
মিস মাইকেল হাসে। বলে-লাইফের তুমি আর কতটুকু জানো সেন, লাইফের তুমি কিছুই তো দেখলে না! মানি ইজ এভরিথিং, টাকাই জীবনের সব। যদি আমার ভিভিয়ানের মত টাকা থাকতো!
আশ্চর্য! অঘোরদাদুও ঠিক এই কথাই বলতো। টাকা দিয়ে সব কেনা যায়। সব কেনা যায় টাকা দিয়ে। কিন্তু সবই যদি টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব, তাহলে লক্ষ্মীদি কেন দাতারবাবুর মত লোককে গরীব জেনেও বিয়ে করলে! আর টাকাই যদি সব, তবে সতীই বা অত ঐশ্বর্যের মধ্যে কেন বিষের মত নীল হয়ে শুকিয়ে যায়। একদিন দীপঙ্কর চাকরির জন্যে কত ঘোরাঘুরি করেছে। সেদিন তেত্রিশ টাকার চাকরিটা পেয়ে মনে হয়েছিল হাতে বুঝি স্বর্গ পেলে সে। কিন্তু সেই তেত্রিশ টাকাই ধাপে ধাপে বেড়ে আজ এত উঁচুতে উঠেছে। কিন্তু সেদিনকার চেয়ে সুখ কি বেশি বেড়েছে তার? শান্তি কি বেশি পেয়েছে সে? বিচার করলে বোধহয় প্রমাণ হয়ে যাবে, সেদিনই দীপঙ্কর বেশি সুখী ছিল। সেই এক পয়সার তেলেভাজা খেতে খেতে কিরণের সঙ্গে কাটানো দিনগুলোই যেন বেশি আনন্দে কেটেছে তার। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন দিয়েই দীপঙ্কর এখন ফরসা ধোপ-দুরস্ত কাপড়-জামা পরে আপিসে আসে, দশজনে সসম্ভ্রমে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। হয়ত সমীহ করে, হয়ত বা শ্রদ্ধাও করে। হয়ত ভয়ও করে। তার কাছ থেকে কৃপা পাবার জন্যে হয়ত উন্মুখ হয়ে থাকে। তবু ভয়ে সসম্ভ্রমে হয়ত কাছে আসতে পারে না। ছোট ছোট ছেলেরা সেই আগেকার মত চাঁদা তুলতে আসে। সরস্বতী পুজোর চাঁদা। দুর্গা পুজোর চাঁদা। দীপঙ্করের সামনে এসে ভয়ে ভয়ে চাঁদার খাতাটা এগিয়ে দেয়। ঠিক যেমন দীপঙ্কর একদিন দিত। তাদের দিকে চেয়ে দীপঙ্কর কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তারও মনে পড়ে যায়, নিজের ছেলেবেলাকার কথা। কিন্তু ওরা তো জানে না, বাইরেই শুধু বয়েস বেড়েছে দীপঙ্করের-মনে মনে তো সেই ছোটই আসে সে! এখনও কিরণের সঙ্গে দেখা হলে যেন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তেলেভাজা কিনে খেতে পারে!
দীপঙ্কর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে-তোমরা সব কোন্ পাড়ায় থাকো খোকা?
তারা বলে-হালদার পাড়ায়–
–তা এতদূরে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে চাঁদা চাইতে এসেছো যে?
তারা বলে–আপনার নাম শুনে এসেছি–
–আমার নাম শুনে? দীপঙ্কর অবাক হয়ে যায়! দীপঙ্কর কি এ-পাড়ায় নামজাদা লোক হয়ে গেছে নাকি?
তারা বলে–হ্যাঁ, আপনি যে রেলের মস্ত বড় অফিসার! আমরা জানি যে! আপনি অনেক টাকা মাইনে পান।
হয়ত তারা কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কথাটা বলেনি। হয়ত দীপঙ্করকে তারা সম্মান দিতেই চেয়েছিল কথাটা বলে। কিন্তু দীপঙ্করের মনে হলো তাকে যেন ছেলেরা চড় মারলে! দীপঙ্কর বেশি টাকা মাইনে পায়, এইটেই যেন তার পরিচয়! আর কিছু নয়। আর কিছু পরিচয় নেই তার। আর কোনও গুণ নেই। তাড়াতাড়ি টাকাটা দিয়েই দীপঙ্কর সোজা আপিসে চলে গেল। হঠাৎ যেন সমস্ত পৃথিবী থেকে আত্মগোপন করতে ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু কোথায় যাবে! কোথায় গিযে বাঁচবে! কোথায় গিয়ে আত্মবিলোপ করবে! আপিসে যাবার আগেই, বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ই মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায় রোজ। আবার সেই ঘরটাতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসতে হবে। সেই ফাইল, সেই মধু দরজাটা খুলে দিয়ে সবিনয়ে সেলাম করবে। আবার সেই দিল্লীর বোর্ডের চিঠি, সেই রবিনস সাহেবের কুকুরের প্রসঙ্গ, সেই মিস্টার ঘোষাল! সমস্ত দিনটা পুরোন ফাইলের চিঠির তলায় তলিয়ে যেতে হবে। তারপর যখন মুখ তুলে চাইবে, যখন জ্ঞান ফিরবে, তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দিনের পর দিন। সম্মান যেন মাইনে দিয়ে বিচার হবে সেখানে, মানুষের মূল্য যাচাই হবে টাকা আনা পাই দিয়ে।
তবু কাজ করতে হয়। যেতেও হয় রোজ। এক-একদিন রবিনসন সাহেব ডেকে পাঠায়। দ্বিজপদ এসে ডেকে নিয়ে যায়। ঘরে গিয়ে দেখে সাহেবের ঘরে হুলস্থুল কাণ্ড বেধে গেছে। মিস্টার ঘোষাল আছে। আরো কত লোক দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক নেই। সাহেবের কুকুর জিমিও আছে।
–লুক হিয়ার সেন,–
দীপঙ্কর ঘরে ঢুকতেই রবিনসন সাহেব বললে–লুক হিয়ার, এই দেখ, এই চিঠিখানা বোর্ড থেকে এসেছে সাত তারিখে, অন সেভেনথ অব দি মন্থ-রেকর্ড সেকশানে এসে তিনদিন পড়ে ছিল—সী–
দীপঙ্কর দেখলে। সত্যিই তারিখ স্ট্যাম্প সব লাগনো হয়েছে তিনদিন পরে। সেখানে থেকে ট্রানজিট সেকশানে এসেছে পনেরো দিন পরে। সেখানে দুদিন আটকে ছিল। সেখান থেকে রবিনসন সাহেবের কাছে আসতে লেগেছে আরো তিনদিন!
রবিনসন সাহেব বললে–কীভাবে তোমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চলছে–দেখ, দেখবার জন্যেই তোমাদের ডেকেছি-ঘোষাল, হ্যাভ ইউ সীন? তুমি দেখেছো?
মিস্টার ঘোষাল বললে—দেখেছি–
তারপর দীপঙ্করের দিকে চেয়ে সাহেব বললে–তুমি দেখেছ সেন?
দীপঙ্কর মাথা নাড়লে।
রবিনসন সাহেব বললে–এখন বলো হোয়াট টু ডু? আমি কি করবো?
মিস্টার ঘোষাল বললে–স্যার, আপনি আমার হাতে ছেড়ে দিন কেস্টা, আমি ডীল করবো–
–কী করে?
মিস্টার ঘোষাল বললে–আই শ্যাল পানিশ দি কালপ্রিটস–
–নো–
রবিনসন সাহেব বললে–তুমি সাউথ ইন্ডিয়ান, তুমি গুডনেচার্ড লোক, তোমার দ্বারা হবে না–আমি সকলকে শাস্তি দিতে চাই, এমন শাস্তি দিতে চাই যাতে কেউ ভুলে না যায় লাইফে–
সকলের সামনে ঘোষালকে সাউথ-ইণ্ডিয়ান বলতে সকলে অবাক হয়ে চাইলে এ ওর মুখের দিকে। কিন্তু মিস্টার ঘোষাল গম্ভীর হয়ে রইল।
রবিনসন সাহেব বললে–সেন, আমি তোমাকে দিচ্ছি, ইউ মাস্ট পানিশ দেম– আই লিভ ইট টু ইউ–
এমনি করেই আপিসের কাজ চলে। একটা চিঠি এ-ঘর থেকে ও-ঘর যেতে চোদ্দ দিন লাগে। একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে সারা আপিসে হৈ-চৈ পড়ে যায়। কে দোষী, কে গিল্টি তাই খুঁজতেই সব কাজ ফেলে রাখতে হয়। আসল কাজের কাজ কিছু হয় না। বোর্ড থেকে একটা চিঠি এলে তাই নিয়ে সবাই হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দেয়। কিন্তু সমাধান কেউ করে না। এমনি করেই চিরদিন আপিসের কাজ চলে আসছে, এমনি করেই হয়ত চিরদিন চলবে। দীপঙ্কর অনেক চেষ্টা করেও কাজের কোনও উন্নতি করতে পারেনি। দীপঙ্কর বুঝেছিল দোষ আসলে ক্লার্কদের নয়, দোষ যদি কোথাও থাকে তো সে ওপর তলায়। ওপর-তলার কর্তাদের সাত খুন মাপ। ওপর-তলার কর্তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। তারা দরকার হলে ময়দানে খেলা দেখতে যায়, আপিসের চাপরাশী নিয়ে বাড়িতে বাটনা বাটায়, রান্না করায়। সেখানে কারোর কিছু বলার এক্তিয়ার নেই। বাড়িতে জানে সবাই। দেখে সবাই। দেখে-জেনেও কিছু বলবার উপায় নেই, বলবার অধিকারও নেই। পুওর ক্লার্ক যে ওরা!
সবাইকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে এল দীপঙ্কর। রেকর্ড সেকশান, ডেসপ্যাঁচ সেকশান, ট্র্যাফিক আপিসের সবাইকে ডেকে নিজের ঘরে আনলে দীপঙ্কর। সবাই দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে আসামীর মত তার দিকে মুখ করে।
দীপঙ্কর বলতে লাগলো-এমন কাজ কেন করেন আপনারা যাতে অন্য লোকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়? নিজের কাজটুকুর মধ্যে কেন ফাঁকি দেন আপনারা? কেন ধরা পড়বেন? ভুল সকলেরই হয়, ভুল করাই মানুষের নিয়ম, কিন্তু ফাঁকি কেন দেবেন সেটা আমি বুঝতে পারি না।
কথাগুলো বলে দীপঙ্কর সকলের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলে।
তারপর আবার বলতে লাগলো আপনারা সরকারী আপিসে কাজ করছেন, তাই চাকরির মূল্যটুকু বুঝতে পারছেন না–আজ মার্চেন্ট আপিসের ভেতরে গিয়ে দেখে আসুন তো, দেখেবেন সেখানে নিখুঁতভাবে কাজ হয়ে চলেছে। ভুল সব জায়গাতেই আছে, সেখানেও আছে, কিন্তু সেখানেও মানুষ কাজ করে, মেশিন নয় তারা–কিন্তু এখানকার মত এত ফাঁকি সেখানে চলে না–কারণ সেখানে শাস্তির ভয় আছে, সেখানে ফাইন হয়–
কথাগুলো বলতে বলতে দীপঙ্করের যেন কেমন অকারণ ভয় হতে লাগলো। হয়ত এখনি প্রতিবাদ করবে। হয়ত প্রতিবাদে কেউ বলবে–ফাঁকি শুধু আমরাই দিই না স্যার, ফাঁকি অফিসাররাও দেন, কই তাদের তো এমন করে জবাবদিহি করতে হয় না?
হয়ত কেউ বলবে–স্যার, আমরা পাঁচ মিনিট দেরি করে এলে আমাদের নামে ক্রস পড়ে যায়, আর সেদিন যে ক্রফোর্ড সাহেব দেরি করে আপিসে এলেন? তার বেলায়? অফিসাররাও তো দেরি করে আসেন। তাদের নিজের গাড়ি থাকতেও কেন তাদের দেরি হয়? তারা যে খেলায় মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখেন নিশ্চিন্তে, আর এসে বলেন গার্ডেনরীচে ডিসকাশন করতে গিয়েছিলেন ফাইল নিয়ে, তার বেলায়? তারা যে স্টেশন ওয়াগনে করে ডিউটির নাম করে চৌরঙ্গীতে গিয়ে চুল হেঁটে আসেন–তার বেলায়? ড্রাইভার যখন জিজ্ঞেস করে লগ-বুকে কী লিখবো, তখন যে তারা লিখিয়ে দেন,অন টেস্ট! তার বেলায়?
সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তবু দীপঙ্কর কথাগুলো বলতে বলতেই নিজের মধ্যে যেন ভয়ে সিঁটিয়ে উঠলো। কেন এরা এত নিরীহ, কেন এরা এত সহ্য করে, কেন এরা এত বোবা! দীপঙ্কর প্রত্যেকের মুখের দিকে চেয়ে দেখতে লাগলো। এখন যদি কেউ সাহস করে বলে দেয়-স্যার আপনি যে এত কথা বলছেন আমাদের, আপনি নিজে নৃপেনবাবুকে তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে রেলে ঢোকেননি? রবিনসন সাহেবের কুকুরের যখন কোথাও বিস্কুট পাওয়া যাচ্ছিল না তখন আপনি খুঁজে খুঁজে নিজের পয়সায় বিস্কুট এনে দেননি? আপনিই কি আমাদের চেয়ে বেশি অনেস্ট?
হঠাৎ ভয়ে একটা আর্তনাদ করে উঠতে গিয়ে দীপঙ্কর নিজের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলে। কেউ জানতে পারলে না দীপঙ্করের মনের ভেতরকার কথাগুলো। কেমন নিরীহ অপরাধীর মত সব দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে মুখ করে। এদের প্রত্যেকের সংসারে অভাব আছে দুঃখ আছে। এদের বোনের বিয়ের পাত্র খুঁজতে খুঁজতে এরা হয়রান হয়ে যায়। এরা বৌ-এর অসুখের সময় পাড়ায় শেতলাতলার চরণামৃত খাইয়ে ডাক্তার ওষুধের খরচ বাঁচায়। একটা কাপড় আর একটা শার্ট পরে সপ্তাহ চালিয়ে এরা সমাজে ভদ্রতা বজায় রাখবার চেষ্টা করে। দীপঙ্কর সেন তো এদেরই সমগোত্রীয়। এদেরই দলে তো দীপঙ্কর। আজ এরা আসামী আর দীপঙ্কর এদেরই বিচারক হয়ে গদি-আঁটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বসে মাতব্বরি করছে। আজ ঘটনাচক্রে এদের বিচারের ভার তো দীপঙ্করের হাতে পড়েছে, কিন্তু দীপঙ্করের বিচার কে করবে? কবে করবে?
–আপনারা আপিসে এসে কতক্ষণ খবরের কাগজ পড়েন, আর কতক্ষণ আপিসের কাজ করেন তা আমি জানি, তারপর কতক্ষণ টিফিন-রুমে গিয়ে কাটান তা-ও জানি। অথচ পাঁচটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি যাবার বেলায় আপনারা এক সেকেন্ডও দেরি করেন না! কিন্তু এ ফাঁকি আপনারা কাকে দিচ্ছেন, ভেবে দেখেছেন কি? এখন যদি প্রত্যেককে আমি পাঁচ টাকা করে ফাইন করি?
দীপঙ্করের মনে হলো তার নিজের পিঠেই যেন সপাং করে কেউ চাবুক মারলো! এ কী বলছে সে? এ কাকে বলছে সমস্ত কথা? দীপঙ্কর কি নিজেকেও ভুলে গেছে এই গদি আঁটা চেয়ারটায় বসে? দীপঙ্করও তো ওদেরই মতন, একজন রাস্তার লোক। ফরসা জামা-কাপড় পরে এই চেয়ারে বসেছে বলেই কি তার সাত খুন মাপ হয়ে গেছে? কিন্তু আশ্চর্য, আশ্চর্য হয়ে গেল দীপঙ্কর লোকগুলোর মুখের দিকে চেয়ে। কারো দুদিন দাড়ি কামানো হয়নি, কারো চশমার একটা ডাণ্ডি ভাঙা, কারো জামার নীচে ছেঁড়া গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে। এদের কাছে চাকরি যে তাগা-তাবিজ। চাকরি যে এদের স্লেভ বানিয়ে ছেড়েছে। এরা কি স্পষ্ট কথা বলতে পারে, এরা কি সত্য কথা বলতে পারে? এরা কি আর মানুষ আছে আজ? এরা যে ক্লার্ক! দীপঙ্করের একটু সাহস হলো তখন। এরা জানেও না যে, এরা ইচ্ছে করলেই দীপঙ্করকে এখান থেকে এক নিমেষে সরিয়ে দিতে পারে! শুধু দীপঙ্করকে নয়, এই রবিনসন সাহেব, এই এজেন্ট, এই দিল্লীর রেলওয়ে বোর্ডকেও এরা উৎখাত করতে পারে! অথচ এরা খবর রাখে না। খবর রাখবার সময়ই পায় না। সকাল থেকে এরা বাজার-হাট-সংসার-সন্তান চাকরি-স্বাস্থ্য-উকীল-ডাক্তার নিয়েই ব্যস্ত। কখন খবর রাখবে! জানে না তাদের মতই ছেঁড়া শার্ট পরা একজন লোক উনিশশো আঠারো সালে একদিন হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোকের মুক্তি দিয়েছে–। সেও যুদ্ধের শেষের দিকে। সে বলেছিল–
“Comrades, labouring people, you are now the state’s supreme power. The revolution has put meaning into life for as just as it will for millions around the world, who now see no meaning in their eight hour labour in someone else’s factory, at monotonous toil at someone else’s machines. We would free man from his enslavement by man.”
দীপঙ্কর যেন বুক ফুলিয়ে চাইলে তাদের দিকে। এরা সে-খবর জানে না তাই রক্ষে। নইলে এতক্ষণে দীপঙ্করকে এরা পাল্ট প্রশ্ন করতো। প্রশ্ন করতো-কেন রবিনসন সাহেবের এত মাইনে আর কেনই বা তাদের মাইনে এত কম! প্রশ্ন করতো-কেন তাদের ছেলে-মেয়েরা পেট ভরে খেতে পায় না, অথচ রবিনসন সাহেবের কুকুরের কেন বিস্কুট খেয়ে খেয়ে জিভে অরুচি ধরে গেছে! প্রশ্ন করতো–কেন সেন সাহেবের চেয়ারে গদি আঁটা আর তাদের চেয়ারে কেনই বা ছারপোকার বাসা! প্রশ্ন করতো-কেন তাদের গাফিলতির জন্যে কৈফিয়ৎ তলব করা হয়, আর ক্রফোর্ড সাহেবের দেরি করে আসার ঘটনা কেনই বা চোখ বুজে সহ্য করা হয়!
দীপঙ্কর বাচলো যেন। ভালোই হয়েছে। ভালোই এরা সে প্রশ্ন করে না। এরা তো কিরণের মত সর্বস্ব জলাঞ্জলি দেবার দীক্ষা পায়নি। দীপঙ্কর নিজেকে আবার কঠোর করে তুললে। এরা জানে না, দীপঙ্করও একদিন ছেঁড়া জামা গায়ে দিয়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় লাইব্রেরীর জন্যে চাঁদা চেয়ে চেয়ে বেড়িয়েছে। জানে না তাই বেঁচে গেল আজ। আর জানলেই বা কী হতো। দীপঙ্কর তো একলা নয়। দীপঙ্করের পেছনে মিস্টার ঘোষাল আছে, এজেন্ট আছে, বোর্ড আছে, লেজিসলেটিভ কাউন্সিল আছে। দীপঙ্করের পেছনে সমস্ত ব্রিটিশ গভর্নমেন্টই তো আছে।
–এখন যদি আপনাদের সকলকে পাঁচ টাকা করে ফাইন করি, কী করবেন আপনারা?
আশ্চর্য, লোকগুলো গরু-ভেড়ার মত চোখ পিট পিট করে চাইতে লাগলো দীপঙ্করের দিকে। যেন হাত-জোড় করে তারা তার কাছে মা চাইছে। আশ্চর্য, বিদ্রোহ করে তারা ক্ষমা চাইছে! এরা আবার মানুষ!
দীপঙ্কর আর সহ্য করতে পারলে না। তার নিজের কড়া কথাগুলো নিজের কানেই যেন ভণ্ডামির মত শোনাল। এত নীচ, এত হীন, এত জঘন্য কাজ করবার ভার দিয়েছে। তাকে রবিনসন সাহেব! এ সে কাদের শাস্তি দিচ্ছে, কাদের পানিশমেন্ট দিচ্ছে! দীপঙ্করকে শাস্তি দেবার কি কেউ নেই! এত বড়-বড় অন্যায়ের পরও তো সে ফরসা জামা-কাপড় পরে আপিসে এসে বসছে। তাকে সবাই সম্মান করছে, খাতির করছে। তাকে তো কেই জেলে দিচ্ছে না। এত বড় ভণ্ড হয়েও তো সে সমাজে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে। দীপঙ্করকে তো কেই সন্দেহ করছে না। সে তো সকলের চোখে সাধু, সৎ, সভ্য মানুষ!
–যান, এমন করে আর ফাঁকি দেবেন না। যান–
সবাই চলে গেলে আস্তে আস্তে। কৃতজ্ঞতায় তাদের চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো যাবার সময়। তারা বাইরে এসে নিশ্চিন্তে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলে।
একজন বললে–সত্যি সেন সাহেব কী চমৎকার লোক–দেবতার মতন—
খানিকটা যেন আন্দাজ করতে পারলে দীপঙ্কর। অস্বস্তিতে উসখুস করতে লাগলো মনটা। এত বড় মিথ্যে যেন সংসারে নেই আর। এত বড় ঠক্ যেন পৃথিবীতে আর নেই। ঘৃণায় লজ্জায় মাথাটা নিচু করে ফাইলের কাগজের মধ্যে ডুবিয়ে দিলে নিজেকে। ওরা তো জানে না, দীপঙ্কর সারা জীবন ভণ্ডামি করেছে! কিরণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, লক্ষ্মীদির কাছে ভালোমানুষির অভিনয় করেছে, সতীর সঙ্গেও ছলনা করেছে! আসলে দীপঙ্কর বুঝি ভদ্রলোক হতেই চেয়েছে কেবল, অথচ তারা কেউই তার ভেতরটা তো দেখতে পায়নি! দেখতে না পেয়ে ভালোই হয়েছে। তার চাকরিতে প্রমোশন হয়েছে। সবাই তার প্রশংসা করেছে। সকলের চোখে সে নিজেকে মহৎ প্রমাণ করেছে। অথচ তারা তো জানে না আসলে সে-ও তাদেরই মতন। লক্ষ্মীদির সঙ্গ তার ভাল লাগে, সতীর সান্নিধ্য কামনা করে। কিরণের মাকে যে সে পাঁচ টাকা করে মাসে মাসে দেয়, সে তো তার মহানুভবতা নয়, সে তো তার অহঙ্কার। আর সত্যি কথা বলা? সেও তো আর এক ছল। মিথ্যে কথা বলবার ক্ষমতা তার আছে নাকি? মিথ্যে কথা বলতে পারা, ছিটে-ফোঁটার মত সংসার-সমাজকে অস্বীকার করা-ও-সব কি অত সহজ?
মিস্টার ঘোষাল হঠাৎ ঘরে এল। মুখে চুরোট। জুতোর আওয়াজেই বুঝেছিল দীপঙ্কর যে ঘোষাল সাহেব আসছে। ঘরের ভেতরে এসেই একটা পা চেয়ারে তুলে দিয়ে কায়দা করে বেঁকে দাঁড়াল। বললে–কী করলে সেন? হাউ ডিড় ইউ ডীল উইথ দেম?
হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর পড়লো। পাঁচটা বেজে গেছে। ইস, সারাদিনটা এইসব বাজে কাজে কাটলো! আপিসের আসল কাজ কিছুই হয়নি। একগাদা ফাইল জমে গেছে। একটু পরেই সন্ধ্যে হবে। তারপর? তারপর সতীর ওখানে যাবার কথা আছে। সতী কেন যে আবার তাকে যেতে বললে কে জানে! কী অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যেই যে ফেলেছিল কাল সতী! পান দিলে, গাড়ি দিলে। এত খাতির কেন তাকে কে জানে!
মিস্টার ঘোষাল বললে–ফাইন করে দিয়েছ তো সবাইকে?
দীপঙ্কর বললে—না–
–হোয়াই? তুমি ফাইন করোনি?
ঘোষাল সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লো। তোমাকে দিয়ে দেখছি অ্যাড়মিনিস্ট্রেশনের কাজ কিছুই চলবে না। মিঃ ঘোষাল চুরোটটা মুখ থেকে বার করে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লো।
বললে–হোয়াট ডু ইউ মীন?
দীপঙ্কর বললে–বড় গরীব লোক ওরা মিস্টার ঘোষাল, আমি ওদের জানি, আমি ওদেরই মতন একজন ছিলাম, আমিও ওদের মতন একদিন গরীব ছিলাম। আমার মা পরের বাড়িতে এই সেদিন পর্যন্তও রান্না করে আমাকে মানুষ করেছে–আই নো দে পারফেক্টলি ওয়েল, দে আর হেলপলেস ক্রিচার্স
–কিন্তু এখন তো তুমি আর পুয়োর নও, এখন তো তুমি ওদের বস্
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু ওদের দেখে আমার নিজের অবস্থার কথা মনে পড়ে গেল।
–তার মানে?
–তার মানে, আমিও তো অন্যায় করি, আমিও তো ফাইল ক্লিয়ার করতে ডিলে করি, আমিও তো মাঝে মাঝে দেরি করে আপিসে আসি, আমিও তো তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছি–
ঘোষাল সাহেব যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল দীপঙ্করের কথা শুনে। খানিকক্ষণ যেন চুরোট টানতেই ভুলে গেল।
বললে–কিন্তু ইউ আর অ্যান্ অফিসার, তুমি এখন ওদের বস, তুমি এখন ওদের লর্ড–
–কিন্তু আমি নিজেও তো কালপ্রিট মিস্টার ঘোষাল!
–সে কি?
দীপঙ্কর বললে–ওদের মতন আমিও কত ভুল করেছি, কত মিসবিহেভ করেছি, আমার ভুলের জন্যেও তো রেলওয়ের কত হাজার-হাজার টাকার লোকসান হয়েছে–
–বাট কিং ক্যান ডু নো রং!
দীপঙ্কর হাসলে। বললে–এখনকার দিনে এ-কথার কোনও মূল্য নেই মিস্টার ঘোষাল। দু’দিন পরে পৃথিবীতে কিং বলেই হয়তো কোনও জিনিস থাকবে না
–কিন্তু কিং না থাকুক, তার বদলে ডিকটেটর আসবে, যেমন জার্মানিতে, রাশিয়ায়, ইটালীতে…..
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু সে তো ট্রেড় ডিপ্রেশনের জন্যে! ওয়ারের পর বলেই এই হচ্ছে, এ ওয়ারের এফেক্ট, কিন্তু একদিন সাধারণ মানুষ তো মাথা তুলে দাঁড়াবে, আমাদের কাছে আমাদের অত্যাচারের তো কৈফিয়ৎ চাইবে একদিন–সেদিন যে….
হঠাৎ ঝোলানো দরজাটা খুলে গেল।
–হুজ্ দ্যাট?
অনুমতি না নিয়ে ঘরে ঢোকা অপরাধ। দরজাটা খুলতেই দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেছে। সতী! সতী এখানে? সতী আপিসে এসে হাজির হয়েছে? ঘোষাল সাহেবও পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে অবাক হয়ে গেছে। এ বেঙ্গলী লেডি!
দীপঙ্কর অবাক হয়ে বললে–তুমি?
সতী হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলো। আজকে একটা অন্য শাড়ি পরেছে। নীল নয়, বটল গ্রীনও নয়। কেমন যেন কমলালেবুর মত রং। মেরুন না মভূ কে জানে! সতীকে দেখে মিস্টার ঘোষালও যেন একটু আড়ষ্ট হয়ে গেছে। মিস্টার ঘোষাল সহজে আড়ষ্ট হবার লোক নয়। কিন্তু সতীর চেহারার মধ্যে কোথায় যেন একটা স্বাতন্ত্রী আছে। মানুষকে যেন আকর্ষণ করে। আবার দূরেও ঠেলে। সতী সোজা এসে বললে–তোমার কাজের ক্ষতি করলাম বোধ হয় দীপু
সতী ততক্ষণে নিজেই একটা চেয়ারে বসে পড়েছে। যেন বড় উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। সতীকে দেখে দীপঙ্কর আরো বিব্রত হয়ে পড়লো। তা বলে একেবারে আপিসে এসে হাজির হলো শেষকালে! বিশেষ করে মিস্টার ঘোষালের সঙ্গে দেখা হওয়াটা ঠিক যেন ভাল মনে হলো না। তাছাড়া অনেক কাজও পড়ে আছে হাতে। সারাদিন কোনও কাজই হয়নি।
–হঠাৎ আমার আপিসে এলে যে?
–কেন আসতে নেই!
–না, তা নয়। কিন্তু চিনতে কষ্ট হয়নি তো?
সতী বললে–না, কষ্ট হবে কেন–ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিয়েছিলুম, সেই নিয়ে এল সোজা। ভাবলুম আমাদের বাড়ি যাবার কথাটা হয়ত তোমার মনে থাকবে না, তাই একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এলুম।
–আবার আজকে? কালই তো গিয়েছিলাম, আজকে আর না-ই বা গেলাম!
হঠাৎ দীপঙ্করের মনে পড়লো মিস্টার ঘোষালের কথা। এতক্ষণে তার উপস্থিতি যেন ভুলেই গিয়েছিল দীপঙ্কর সতীকে দেখে। মিস্টার ঘোষালের দিকে ফিরে বললে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই মিস্টার ঘোষাল, ইনি হচ্ছেন শ্রীমতী সতী ঘোষ, আমার বাল্যবন্ধু-আর ইনি হচ্ছেন মিস্টার ঘোষাল, আমার ওপরওয়ালা
সাধারণত মিস্টার ঘোষাল এত সব ফর্মালিটির বালাই মানতে চায় না। বিশেষ করে মহিলাদের সঙ্গে আলাপের সঙ্গে আলাপের ব্যাপারে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে হাতটা সতীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে–অত্যন্ত খুশি হলাম মিসেস ঘোষ, আমি সামান্য একজন রেলওয়ের সেবক মাত্র,-মিস্টার সেনের ওপরওয়ালা হওয়াটা আমার একমাত্র গৌরব বলতে পারেন–
সতীও নিময়-মাফিক নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল মিস্টার ঘোষালের দিকে। দীপঙ্কর লক্ষ্য করলে মিস্টার ঘোষাল যেন সতীর হাতটা একটু বেশি জোরেই ঝাঁকুনি দিলে। তারপর বললেন–বসুন, বসুন, আপনি–
সতী বসেছিল বটে কিন্তু কথাগুলো বলেছিল দীপঙ্করের দিকে চেয়ে। বলেছিল
তুমিই তো আমাকে আপিসে আসতে বারণ করেছিলে, বলেছিলে এখানে চাকরি করলে ভদ্রতা রক্ষে হয় না, মানুষ এখঅনে অমানুষ হয়ে যায়–
মিস্টার ঘোষাল বললে–সেন যদি এ-কথা বলে থাকে তো কোনও অন্যায় বলেনি মিসেস ঘোষ, এতক্ষণ আমাদের এই কথাই হচ্ছিল। আপনি তো আর আমাদের ক্লার্কদের দেখেননি, আসলে তারা মানুষ নয়–
–মানুষ নয়? মানুষ নয় তো কী?
–তারা সব বীস্ট, এক-কথায় বীস্টই বলতে পারেন তাদের। তাদের চেহারা দেখলেই বুঝতে পারবেন আপনি! তাদের জামা-কাপড়, তাদের দাড়ি, তাদের চাল-চলন কিছুই মানুষের মত নয়। এত নোংরা ডার্টি থাকে সে আপনি না-দেখলে বুঝতে পারবেন না!
কথাগুলো শুনতে শুনতে দীপঙ্করের কেমন অস্বস্তি লাগছিল। কাদের গালাগালি দিচ্ছে মিস্টার ঘোষাল! মনে আছে সতী ঘরে আসার পর থেকেই সেদিন গড় গড় করে কথা বলে যাচ্ছিল ঘোষাল সাহেব। যেন অনেক দিনের পরিচয় দু’জনের। অনেক দিনের আলাপ। বিলাতের গল্প, নিজের ঐশ্বর্যের গল্প। ঘোষাল সাহেব যে এত কথা বলতে পারে, সতী না থাকলে তা জানতেই পারতো না দীপঙ্কর।
হঠাৎ দ্বিজপদ ঘরে ঢুকলো। বললে–হুজুর, সাব সেলাম দিয়া–
–কাকে? আমাকে?
মিস্টার ঘোষাল উঠলো। বললে–যাবেন না মিসেস ঘোষ আমি আসছি–
মিস্টার ঘোষাল উঠলো। চলে যেতেই সতী বললে–তুমি কীরকম লোকের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলে দীপু, এ যে গায়ে পড়ে আলাপ করতে চায়, একেবারে ছাড়তে চায় না। এমন জোর হ্যান্ডসেক করেছে যে, হাতটা এখনও টনটন করছে–
দীপঙ্কর সে-কথার কোনও জবাব না দিয়ে বললে–হঠাৎ তুমি কী করতে এলে আবার আজই?
সতী বললে–ওই যে বললাম, তোমায় সঙ্গে করে নিয়ে যেতে–
–কিন্তু তোমাদের ব্যাপারের মধ্যে আমি নাই-ই বা গেলাম–মিছিমিছি তোমার শাশুড়ী কী ভাবলেন আমার সম্বন্ধে, কে জানে!
সতী বললে–কী আবার ভাবলে? বাড়ি তো তার একার নয়
–আর তোমার স্বামী সনাতনবাবুই বা কী ভাবলেন বলে তো! আমি চলে আসার পর তিনি কী বললেন?
সতী বললে–তিনিই তো আজকে নিয়ে যেতে বললেন তোমাকে। বললেন, আজকে পরিচয় হলো না, কালকে ওঁকে আবার নিয়ে এসো–চলো চলো
–কিন্তু এত সকাল-সকাল?
–তাতে কী হয়েছে! এখন গিয়ে গল্প করবে, চা খাবে, তারপর রাত্রে একেবারে খেয়ে-দেয়ে চলে আসবে
–কিন্তু…….
দীপঙ্কর কেমন যেন দ্বিধা করতে লাগলো। বললে–জানো সতী, আজকে বাড়িতেও একটা কাণ্ড হয়েছে
–কী কাণ্ড?
–সেই বিন্তিদিকে ভোরলেবা থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মার এত ভাবনা হয়েছে যে কী, বলবো! এদিকে নতুন বাড়ি ভাড়া করে পাঁচ টাকা বায়না দিযেছিলুম, সেখানেও যাওয়া হলো না। সেই তোমরা যে-বাড়িটাতে ভাড়া ছিলে, সেই বাড়িতেই মা’কে নিয়ে উঠেছি। আজ সকালে বাড়িটাতে ঢুকে সমস্তক্ষণ কেবল তোমাদের সেই পুরোন কথাগুলো মনে পড়ছিল–
–কিন্তু বিন্তি গেল কোথায়? পেয়েছ তাকে শেষপর্যন্ত?
দীপঙ্কর বললে–না, আপিসে আসার সময় পর্যন্ত কানও খবর জানি না-পুলিসে খবর দেওয়া হয়েছে–
–কোথায় যেতে পারে?
দীপঙ্কর বললে–নিজের ঘর ছাড়া সে কোথাও যেত না, সেইজন্যেই মা সকাল থেকে খায়নি আজ
সতী বললে–তাহলে আর দেরি কোর না, চলো চলো শিগগির চলল, আমি তোমাকে সকাল-সকাল ছেড়ে দেব, শেষকালে তোমাদের ঘোষাল যা লোক, হয়ত এখুনি এসে পড়বে আবার
দীপঙ্করের ভয় হলো। সত্যিই যদি এখুনি এসে পড়ে তো আর ছাড়তে চাইবে না হয়ত। শেষকালে তাকে এড়াবার জন্যে মুশকিলে পড়তে হবে তাদের। অথচ অসংখ্য কাজ পড়ে রয়েছে টেবিলে। অনেক ফাইল দেখা হয়নি সকাল থেকে। বাড়িতেও বিন্তি দি ফিরে এসেছে কিনা কে জানে! সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল! আবার এখন সতীদের বাড়ি যেতে হবে। নিজের সংসার, নিজের স্বামী নিয়ে সতী সুখে থাকুক, তাতে দীপঙ্করও সুখী হবে। কিন্তু তার জীবনের সঙ্গে দীপঙ্করকে কেন মিছিমিছি জড়ানো!
সতী বললে–কী ভাবছো এত? চলো
–কিন্তু এখনও যে বিকেল!
–তা না হয় একটু বেড়িয়ে-টেরিয়ে তারপর বাড়ি যাবো, এখন আপিস থেকে বেরোও তো!
দীপঙ্কর উঠলো। তারপর বললে–আমি কিন্তু কালকের মত দেরি করতে পারবো না, আমাকে একটু সকাল-সকাল ছেড়ে দিও, কেমন?
সতী বললে–তাই ছাড়বো, এখন চলো—
.
সেদিনও জানতো না দীপঙ্কর সতী তাকে এ কোথায় নিয়ে চলেছে! মানুষের জীবনে যখন অভিশাপ আসে তখন সে প্রথমে এমনি আশীর্বাদের ছদ্মবেশেই আসে। তখন তার বাইরের চেহারা দেখে তার আসল রূপটা দেখা যায় না। তাকেই সত্য বলে মনে করি, আনন্দ বলে ভুল করি, বন্ধু বলে অভ্যর্থনা করি। অথচ বেশ তো ছিল দীপঙ্কর। সকলকে ছেড়ে নিজেকে নিয়েই তো সে বেশ ছিল। নিজে আর তার মা। ছোটবেলা থেকে যা সে হতে চেয়েছিল তা সে হতে পারেনি, কিন্তু যা সে হয়েছিল তাই-বা কি কম! সেই কমটুকু নিয়েই জীবনে সান্ত্বনা পেতে চেয়েছিল দীপঙ্কর। নিজের জীবনের অসাফল্যকে অনাবশ্যক অভাববোধ দিয়ে পীড়িত করতেও চায়নি দীপঙ্কর। লক্ষ্মীদি ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখান থেকেও প্রত্যাখ্যানের পর দীপঙ্কর নিজেকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছিল–এমন সময় কেন সতী এল!
পরে একদিন শম্ভু বলেছিল–আপনি তো জানেন না নতুনবাবু, বৌদিমণির জন্যে আমার বড় কষ্ট হয়–
দীপঙ্কর একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল–কেন শম্ভু, তোমাদের বাবুদের এত টাকা, তবে কষ্ট কেন?
–ওই যে মামণি; মামণি কি সোজা মানুষ ভেবেছেন?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু তোমার দাদাবাবু? দাদাবাবু তো লোক ভাল—
শম্ভু বলেছিল–আজ্ঞে দাদাবাবু তো দেবতুল্য লোক, তার তুলনা হয় না—
–তাহলে তোমার বৌদিমণির কষ্ট কিসের?
শম্ভু এ-কথার উত্তর দিয়েছিল, কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারেনি দীপঙ্কর। সেদিন আপিস থেকে গাড়িতে যেতে যেতেও দীপঙ্কর সেই কথাই আরম্ভ করেছিল। সতীর গাড়ি। এই গাড়িটা চড়েই সেদিন সতী তাকে নেমন্তন্ন করতে গিয়েছিল।
সতী বললে–তোমার আপিসের কাজের ক্ষতি করলাম নাকি?
দীপঙ্কর বললে–না, ক্ষতি আর কি, আমিই আজকে সকলকে কাজ করে না বলে ধমকেছি, আর আমিই আজকে কাজ ফাঁকি দিয়ে তোমার সঙ্গে চলেছি
–তা একটু না হয় আমার জন্যে কাজে ফাঁকিই দিলে।
দীপঙ্কর বললে–সে জন্যে নয়, কিন্তু কালই তো গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে! কাল না-হয় আমার জন্মদিন ছিল, কিন্তু আজকে আবার কিসের উপলক্ষ্য?
সতী বলল–তুমি আবার জিজ্ঞেস করছে, কেন? আমার অপমানটা তো তুমি নিজের কানেই শুনলে?
দীপঙ্কর সতীর মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। বললে–আমি তোমাদের বাড়িতে নতুন মানুষ, সবটা বুঝতে পারিনি, আর তাছাড়া, আমার কৌতূহলও নেই ও-ব্যাপারে
–কৌতূহল না থাক, উপকার তো করতে পারো আমার।
–উপকার?
দীপঙ্কর চমকে উঠলো। বললে–আমাকে তুমি উপকার করতে বলো না সতী। ছোটবেলায় একজনের উপকার করেছিলাম, রোজ ভোরবেলা মন্দিরে-মন্দিরে ফুল দিয়ে আসতাম, সেই সময়ে একজনের খুব উপকার করতাম, অন্তত মনে করতাম তার উপকার করছি বুঝি; কিন্তু সেই উপকারের ফলটা দেখে পর্যন্ত উপকারের ওপর অরুচি ধরে গেছে–
–কার? কার উপকার করেছিলে?
–সে তুমি না-ই বা শুনলে। আর তাছাড়া, তোমার কাছ থেকে উপকারের অনুরোধ শুনলেও হাসি পায় যে–!
সতীও হাসলো। বললে–এখন আর সে-কথা বলতে পারবে না। এখন তুমি অনেক বড়। এখন তুমি অন্য মানুষ, এখন তুমি আর সে-তুমি নেই–
দীপঙ্কর গম্ভীর হয়ে গেল কথাটা শুনে। বললে–কেন?
–এখন তুমি কত বড় চাকরি করো! এখন তুমি কত মাইনে পাও!
দীপঙ্কর আর থাকতে পারলে না। বললে–শেষকালে তুমিও আমাকে অপমান করবে সতী! মাইনে দিয়েই তুমি আমাকে বিচার করবে! তোমার কাছে অন্তত এটা আশা করিনি! তাহলে আমার চেয়ে মিস্টার ঘোষাল বেশি মাইনে পায় বলে তুমি দেখছি কোনদিন তাকেও আমার চেয়ে বেশি খাতির করবে!
সতী বললে–সত্যিই, তোমাদের মিস্টার ঘোষাল কি জঘন্য লোক–
দীপঙ্কর বললে–সব মানুষ তো সমান হয় না–আমার দুর্ভাগ্য যে ওইসব লোকের সঙ্গেই আমাকে কাজ করতে হয়! অথচ দেখ সতী, একদিন এই চাকরির জন্যে কত মাথা খুঁড়েছে আমার মা, কত ঠাকুর দেবতার কাছে মানত করেছে–এখন দেখছি এরা চাকরি দিয়ে টাকা দিয়ে আমার মনুষ্যতুটুকুও কিনে নিয়েছে
সতী ঠিক বুঝতে পারলে না কথাগুলো। বললে–কেন, ও-কথা বলছো কেন?
দীপঙ্কর বললে–সে ঠিক তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না। আজকেই অনেকগুলো লোককে খুব বকেছি, খুব ধমক দিয়েছি, কিন্তু বকতে বকতে কেমন মনে হচ্ছিল, আমি যেন নিজেকেই শাস্তি দিচ্ছি, আমার বকুনিগুলো যেন আমার মুখেই ফিরে আসছে! আমি যেন তখন নিজেই অপরাধী হয়ে আছি তাদের শাস্তি দিয়ে!
–কেন, এ-রকম কেন মনে হয় তোমার?
দীপঙ্কর বললে–জানো সতী, ছোটবেলায় আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে ছিল, তার নাম লক্ষ্মণ সরকার, আমাকে দেখেলেই সে চাটি মারতো। আমি যে তার কী শত্রুতা করেছিলাম জানি না কিন্তু আমাকে দেখলে সে না-মেরে থাকতে পারতো না। কতদিন তার মার খেয়ে আমি কেঁদেছি, ভেবেছি কেন ও মারে! ছোটবেলায় কারণটা বুঝতে পারিনি আজ বড় হয়ে বড় চাকরি করে বুঝতে পেরেছি
–কী বুঝেছ?
দীপঙ্কর বললে–বড় হয়ে আজ আমি নিজেও একজন লক্ষ্মণ সরকার হয়ে গেছি। আর শুধু আমিই নয়, আমরা যারা বেশি মাইনের চাকরি করি, যারা একটু অবস্থা ফিরিয়েছি, তারা সবাই লক্ষ্মণ সরকার হয়ে গেছি। আমরা তাই সুবিধে পেলেই দীপঙ্করদের চাটি মেরে মজা পাই
তারপর একটু হেসে বললে–একলা তোমার শাশুড়ীকে দোষ দিয়ে লাভ কী!
সতী বললে–তুমি সব জানো না তাই হাসতে পারছো
দীপঙ্কর বললে–দেখবে, একদিন যখন তুমি নিজেও শাশুড়ী হবে, তখন তুমিও লক্ষ্মণ সরকার হয়ে উঠবে–
সতী বললে–শাশুড়ী আমি আর হবো না–
–কেন, যখন তোমার ছেলে-মেয়ে হবে, তাদের বিয়ে হবে, তখন শাশুড়ী হবে বৈ কি!
সতী বললে–তুমি সব জানো না, তাই এইরকম কথা বলছো–
দীপঙ্কর বললে–যেটুকু দেখলাম কাল তাতেই সব বুঝে নিয়েছি–
–তা যদি বুঝতেই পারলে তো বললে না কেন কিছু?
দীপঙ্কর বললে–আমি আর কী বলববা বলো, আমি আর কী করতে পারি? আমি খেলুম শুধু, পেটে ঢুকছিল না, তবু খেলুম-তোমার মান রাখবার জন্যেই খেলুম।
তারপর একটু থেমে বললে–তারপর তুমি তো গাড়ি করে পাঠিয়ে দিলে, কিন্তু বাড়িতে গিয়ে বিছানায় শুয়েই কি ঘুম আসে? কিছুতেই ঘুমোতে পারি না। শেষে ভাব লাম, দূর ছাই, সতীর কথা ভেবে ভেবে আমার ঘুম আসবে না এটা কী রকম! সতী আমার কে? কেউ না
সতী বললে–আমারও ঘুম আসেনি দীপু, পরশু রাতের পর এখন পর্যন্ত একটুও ঘুমোই নি
দীপঙ্কর বললে–আর একটু সহ্য করো, তোমার শাশুড়ী তো বুড়ো মানুষ, ক’দিনই বা বাঁচবে বুড়ি–তারপর তুমি আর সনাতনবাবু–
সতী বললে–আজ সেই জন্যেই তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি–
–কিন্তু আমি গিয়ে তোমার কতটুকু সাহায্য করতে পারবো বুঝতে পারছি না! আমি আজ না-ই বা গেলাম, তাছাড়া, বাড়িতে অনেক কাজ, বিন্তিদিকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
সতী বললে–না না তুমি চলো, ওঁকে বলে রেখেছি যে তুমি আসবে, ওঁর সঙ্গে যে তোমার আলাপ করিয়ে দেব! আজকে তোমার যাওয়া চাই-ই। আর কিছু নয়, কালকের ব্যাপারের একটা নিষ্পত্তি করা চাই-ই-তারপরে তোমাকে আর জীবনে কখনও যেতে বলবো না। জীবনে আর কখনও না গেলেও আমি কিছু মনে করবো না
এখন মনে হয়, আশ্চর্য, সতী যদি জানতো মানুষের জীবনে কোনও সমস্যার নিষ্পত্তিই এত সহজে হয় না! যদি জানতো যে-সমস্যা নিয়ে সে এমন করে বিপর্যস্ত হয়েছিল তার সমাধান এত সহজে হবার নয়! যদি জানতো এমনি করে মানুষের জীবনে সমস্যাটা প্রথমে ছোট হয়েই উদয় হয় বটে, কিন্তু তারপর তাকে বাড়তে দিলে তা আর ছোট থাকে না! সেই ছোটই আবার একদিন বৃহৎ হয়ে বৃহত্তরকেও উপহাস করতে পারে! যদি জানতো তাহলে আর সেদিন অত আগ্রহ করে গাড়ি নিয়ে একেবারে দীপঙ্করের আপিসে এসে হাজির হতো না।
গাড়িতে পাশে বসে রয়েছে সতী। আর দীপঙ্কর অন্যমনস্ক হয়ে নানা কথা ভাবতে লাগলো। এমন করে নিজেকে সতীর হাতে ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে কি ভাল! সতী বড়লোকের বাড়ির বউ, তার অনেক আছে, অল্প নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। অনেক আছে বলেই অল্পকে হারাতে তার ভয় নেই, কিন্তু দীপঙ্কর কেন যাচ্ছে! কিসের স্বার্থ তার! শুধু একটু সান্নিধ্য! শুধু একটু কথা বলার সুখ!
সতী হঠাৎ বললে–বাঁ দিকের রাস্তা ধরলো।
দীপঙ্কর বললে–আমার যেন কি-রকম ভয় করছে সতী–
–কেন, কী হয়েছে? কিসের ভয়?
দীপঙ্কর বললে–না, ভয় নয়, তোমাদের সংসারের মধ্যে আমি গিয়ে কেন আবার গণ্ডগোল বাধাই বলো তো
সতী বললো-না, কোনও গণ্ডগোল হবে না, আজকে ওঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব যে তোমাকে-কালকে আমারই ভুল হয়েছিল, কালকে ওঁকে ডেকে তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেই ভালো হতো–
দীপঙ্কর বললে–তুমি বলছো, যাচ্ছি! কিন্তু তোমাদের শাশুড়ী স্বামী, তোমাদের পরিবারের মধ্যে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে কী সুরাহা হবে বুঝতে পারছি না–
গাড়িটা আবার সোজা রাস্তায় পড়লো। আর বেশি দূর নয়। বেশ সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। রাস্তায়-রাস্তায় আলো জ্বেলে দিয়েছে। বাড়িতে এতক্ষণ কী হচ্ছে কে জানে! বিন্তিদিকে পাওয়া গেছে কিনা তার ঠিক নেই। বাড়িতে মাকে বলে আসা হয়নি। মা-ও হয়তো ভাববে। এখন মা’র আর কোনও কাজ নেই আগের মত। আগে বাড়িসুদু লোকের ভাত রাঁধতে হতো। আজ সকাল থেকে বলে-বলেও মা’কে খাওয়ানো যায়নি। মা কেবল কেঁদেছে। আশেপাশের সব জায়গায় দেখা হয়েছে। কোথাও নেই। সেই পুরোন বাড়ি! যে-বাড়ির ভেতরে একদিন ঢুকতে কত রোমাঞ্চ হতো, এখন সেই বাড়িরই বাসিন্দা হয়ে গেছে দীপঙ্কর। সতী লক্ষ্মীদি যে-ঘরে শুততা সেই ঘরটাতেই আজ শোবে দীপঙ্কর। সেই ঘরেরই চারটে দেয়ালের মধ্যে দীপঙ্করের রাতটা কাটবে।
–নেমে এসো দীপু!
হঠাৎ যেন জ্ঞান ফিরে এল দীপঙ্করের। কালকে এই বাড়িতেই এসেছিল দীপঙ্কর। এই বাড়ির গেট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভেতরে ঢুকেছিল। আজ আবার সেই বাড়ির গেট দিয়ে সতীর গাড়িতে করেই ভেতরে ঢুকছে।
–এসো,–
আপিস থেকেই সোজা আসা। সেই সকালবেলা বাড়ি থেকে আপিসে গিয়েছে। আপিসে গিয়ে পর্যন্ত এক মিনিটের বিশ্রাম পাওয়া যায়নি। রবিনসন সাহেবের ঘরেই কেটে গেছে দু’ঘণ্টা। সকলের সময় নষ্ট হয়েছে। তারপর স্টাফের সঙ্গে বকাবকি। কিছুই কাজ হয়নি সারাদিনে। টেবিলে ফাইলের পাহাড় জমে গেছে। কালকে সকালে গিয়েই সব পরিষ্কার করতে হবে। তারপর যেটুকু সময় কাজ করার ইচ্ছে ছিল তাও নষ্ট হয়ে গেল সতী আসার পর!
সতী আগে আগে চলছিল। এতক্ষণ খেয়াল হয়নি। এক গাড়িতে পাশাপাশি বসে আসার সময়ও খেয়াল হয়নি। হঠাৎ মনে হলো, সতী কী যেন একটা সেন্টু মেখেছে। দীপঙ্করের মনের সমস্ত গ্লানিটা যেন এক মুহূর্তে কেটে গেল। কী সেন্ট। এত চমৎকার গন্ধ! না কি, বাগানের ফুলের গন্ধ! ভারি চমৎকার, ভারি চমৎকার সতীদের বাগানটা! নানারকম ফুল ফুটে রয়েছে! আজও সেই মার্বেল-ফ্লোর, আজও সেই ক্যাক্টাস, আজও সেই মনোগ্রাম আঁকা পাপোশ! আজও সেই ঝকঝকে তক্-তকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ।
আজ কিন্তু আর দোতলায় ওঠবার সিঁড়িটার দিকে নয়। আজ এক তলাতেই। সতী সামনে সামনে যাচ্ছিল। সিঁড়িটার কাছে যেতেই পেছন ফিরে বললে–এদিক দিয়ে এসো দীপু–
বলে সতী আবার চলতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায় এদিকে?
কত বড় বাড়ি সতীদের! বাইরের রাস্তা থেকে এতখানি বোঝাই যায় না। বোঝা যায় না-ভেতরে এত ঘর আর এত কম লোক! বোঝা যায় না–এত বিরাট বাড়ির মধ্যে এত বারান্দা আর এত করিডোর আর এত কিছু অতিক্রম করে তবে সনাতনবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হয়!
–আর কতদূর, সতী?
সতী বললে–তোমার ভয় নেই, এসো না–
৩৭
সে কবেকার কথা। কত কাল আগে স্টিভেডোর শিরীষ ঘোষ সবে কলকাতায় সাহেব কোম্পানীর আমলে বেশ পসার জমাতে শুরু করেছেন। সস্তা-গণ্ডার সময় তখন। দুতিন টাকা চালের মণ। চার আনা করে দুধের সের। কিন্তু সেই সস্তা-গণ্ডার আমলেও মেদিনীপুরে দুর্ভিক্ষ হতো, ফরিদপুর বন্যায় ভেসে যেতো। সনাতনবাবুর কাছেই সে-সব কাহিনি শুনেছিল দীপঙ্কর। নিজেদের বাড়ির নিজেদের বংশের সব পুরোন কাহিনি। দেয়ালে দেয়ালে পূর্বপুরুষদের ছবি টাঙানো। পূর্বপুরুষ বলতে নাম-করা কেউই নেই। কবে বর্ধমান না হুগলী কোন জেলা থেকে এসেছিলেন শিরীষ ঘোষ। খিদিরপুর ডক তখন তৈরি হয়েছে। মাল ওঠানো নামানো আর কুলি-মজুর খাটানো এক সমস্যার ব্যাপার। জাহাজ এসে পৌঁছেলে সবাই ভিড় করে দাঁড়াতে গিয়ে। রাতারাতি সাহেবদের ঠকিয়ে, সাহেবদের ভুল বুঝিয়ে অনেক মাল পাচার হয়ে যেত বাইরে। সাহেব কোম্পানী টেরও পেত না সে-সব। কাপড় আসতো ম্যাঞ্চেস্টর থেকে, যন্ত্রপাতি আসতো লিভারপুল থেকে। কাগজ, কালি, পুতুল, খেলনা, চটের থলি সবই আসতো জাহাজে। তখন ভালো করে গুদামও তৈরি হয়নি। বৃষ্টিতে মাল ভিজতো রোদে পুড়তো। সাহেবরা আমদানি-রপ্তানির কাজে হাজার-হাজার টাকা লগ্নী করেছে, ছোটখাটো ব্যাপারে নজর না-দেওয়ায় লোকসান হতো মাঝে-মাঝে। শিরীষ ঘোষ তখন ছোট ছেলেটি। ভাগ্য অন্বেষণে হাজির হয়েছিল খিদিরপুরে ডকের ধারে। ঘুরে বেড়াত কাজের সন্ধানে। ভাবতো যদি জাহাজে চড়ে বিলেত যাওয়া যায় একবার তো ভাগ্য ফিরিয়ে নেবে চিরকালের মত। কিন্তু সে-আশা সফল হয়নি তাঁর। ভাগ্য ফিরলো অন্যরকমভাবে।
একদিন জাহাজ থেকে নামাবার সময় একটা ক্রেন জেটির ওপর পড়ে গেল। বিরাট একটা ক্রেন। মাল জাহাজে ওঠানো-নামানোর জন্যে তখন সবে কলকাতায় ক্রেন আমদানি করছে সাহেব কোম্পানী। সেই বার্মিংহামে তৈরি ক্রেন জেটিতে নামাতে গিয়ে পড়ে গেছে। জখম হয়েছে অনেকে। কেউ আর কাজ করতে চায় না। শিরীষ ঘোষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। সাহেব কোম্পানীর বড়কর্তা পামারস্টোন্ সাহেব এসে হাঁক-ডাক করছিলেন খুব। কিন্তু নেটিভ-নিগাররা কেউ কাজ করতে চায় না। তখন শিরীষ ঘোষ এগিয়ে গেলেন। ভাঙা ইংরিজীতে বললে–আমি ক্রেনটা তুলে দিতে পারি হুজুর–আমার কুলি-মজুর আছে–
–কে তুমি? হু আর ইউ?
শিরীষ ঘোষ বললেন–আমি পুওর ম্যান স্যার–পুওর ম্যানস সন–
–তা আনো। আনো লোক, আনো কুলি-মজুর। তখুনি শিরীষ ঘোষ চলে গেলেন মুন্সীগঞ্জে। সেই ঝাঁ ঝাঁ করছে রদুর। মুন্সীগঞ্জের একটা খোলার চালের খুপরিতে তখন থাকতেন তিনি। মা’র একজোড়া সোনার অনন্ত ছিল তাঁর তখন শেষ সম্বল। সেইটি নিয়েই তখনি বেরিয়ে পড়লেন বাজারে। স্যাকরার দোকানে গিয়ে বেচে দিলেন সে দুটো। খাঁটি গিনি সোনার অনন্ত। যখন আর কিছু জুটবে না তখনকার জন্যে রেখে দিয়েছিলেন লুকিয়ে। তখন আর বেশি ভাববারও সময় নেই। পাঁচ ভরির অনন্ত। বারো টাকা করে ভরি তখন সোনার। ষাট টাকায় দিলেন সে-দুটো বেচে। টাকাগুলো পকেটে নিয়ে মুন্সীগঞ্জের কুলিপাড়ায় গিয়ে হাজির হলেন। সেখানে তখন বহু কুলির আড্ডা। সকলকে আগাম চার আনা করে বিলোতে লাগলেন। তাদের সবাইকে নিজে হাজির হলেন জেটিতে। দেড়শো কুলি। এখন এই চার আনা করেই নাও সবাই, বাকিটা পরে পাবে। জেটিতে যেতেই সাহেব কুলি-মজুর দেখে খুব খুশী। মাথার ওপর কাঠ-ফাটা রোদ, লাঞ্চ খাওয়া হয়নি।
পামারস্টোন্ সাহেব দেখেই বললেন–কী পুওর ম্যান, কুলি এনেছ?
–আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার, দরকার হলে আরো আনতে পারবো।
তা সেই ক্রেন উঠলো শেষপর্যন্ত। নির্বিঘ্নেই উঠলো। হৈ হৈ শব্দ করে ক্রেন উঠলো। পামারস্টোন সাহেব খুব খুশী। আর সেই থেকেই শিরীষ ঘোষের ভাগ্য ফিরলো। ক্রেন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শিরীষ ঘোষেরও ভাগ্য উঠলো।
আর তারপর থেকেই শুরু হয়েছে আর এক নতুন মহাজনের ইতিহাস। কলকাতার এই দক্ষিণে তখন সব সুরকির রাস্তা। কিছু কিছু মেঠোপথ। কিছু বাঁশঝাড় আর কিছু ধানজমি। হাজরা রোডের দক্ষিণ দিকে তখন সবটাই জঙ্গল। সেই সময়েই এই মাঠের কোণে এসে বসতবাড়ি করলেন, নতুন মহাজন শিরীষ ঘোষ। যখন টাকা ছিল না, তখন মুন্সীগঞ্জের খোলার বস্তিতে তার দিব্যি চলে যেত। কিন্তু টাকা হাতে আসার পর আর তা চললো না। টাকার কী অদ্ভুত ম্যাজিক! মানুষ যন্ত্র আবিষ্কার করে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে, আকাশে পাখা লগিয়ে দূরত্বকে জয় করেছে। রেলগাড়ি স্টীম ইঞ্জিন, মোটরগাড়ি চড়ে রূপকথার দৈত্য-দানব রাজকুমাররা এক পদক্ষেপে সাত-সাত ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়েছে। সবই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু নতুন যন্ত্র-যুগের সব আবিষ্কারকে ম্লান করে দিয়েছে টাকা। নতুন সমাজের বনেদ হলো বংশ-গৌরব নয়–টাকা। যা কিছু হচ্ছে পৃথিবীতে, যা কিছু ঘটছে, যত প্রেরণা যত গবেষণা, যত উদ্যম আকাঙ্খ উত্থান সবই এই মুদ্রার মোহে। শিরীষ ঘোষ যখন কোম্পানী খুললেন খিদিরপুরে, যখন বাড়ি করলেন ভবানী পুরে, তখন সবেমাত্র টাকার পাখা গড়াচ্ছে। আগেকার দিনে শ্যামবাজারের বনেদী পাড়ার টাকা থাকতো আরাম করে লোহার সিন্দুকের মধ্যে ঘুমিয়ে। বাইজী নাচের আসরে আর শুড়িখানায় তার খাতির ছিল অনেক। কিন্তু এবার আর বাইজী নয়, টাকা নিজেই ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো। কারবারের টাকা ব্যাঙ্কের সিন্দুকে এসে আর ঘুমিয়ে রইল না, বাইরের জগতে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াতে লাগলো। সে হলো সচল সজীব গতিশীল টাকা! এ যুগে টাকা শুধু গতিশীল নয়, এ-যুগে টাকা হলো ক্রিয়েটিভ। টাকা বংশবৃদ্ধি করতে লাগলো। টাকা যত বেশি চলতে লাগলো তত বাড়তে লাগলো। এ যুগের মহাজনদের আর বাইজীদের নাচের আসরে টাকা খরচ করতে হলো না। টাকা নিজেই নেচে মর্যাদা বাড়াতে লাগলো। সবই এ-যুগে বেচা-কেনার পণ্য হয়ে উঠলো। টাকা নিজে রূপান্তরিত হয়ে সকলকেই রূপান্তরিত করে দিলে। মেহ দয়া মায়া ভালবাসা সবই হলো টাকার শিকার। মানুষ নিজেই একদিন টাকার পণ্য হয়ে উঠলো। তাই টাকা যাকেই ছুঁলো যা কিছু স্পর্শ করলো সব সোনা হয়ে উঠলো। আগেকার যুগে মুনি ঋষিদের হাতেও এমন ভেলকি খেলতো না। আগে ছিল ‘ডেথ দি লেভেলার, এখন হয়েছে ‘টাকা দি লেভেলার। মৃত্যুর চেয়েও কঠিন, মৃত্যুর চেয়েও শক্তিশালী টাকা। টাকা সমস্ত শ্রেণিভেদ ভেঙে দিয়ে নিজের নতুন কৌলীন্য জাহির করলো। টাকা স্বর্গ তো বটেই-টাকাই হলো শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তাছাড়া, টাকাই বংশ, টাকাই গোত্র, টাকাই শ্ৰেণী! নতুন করে যে-শ্রেণিতে শিরীষ ঘোষ ঠাই পেলেন, সে-সমাজও টাকায় তৈরি। সবার চেয়ে বড় কুলীন টাকা, সবার চেয়ে বড় ব্রাহ্মণ টাকা। আসলে রক্তই হলো টাকা, রক্তের মতন টাকাই সমাজের শিরা-উপশিরার মধ্যে প্রবাহিত হতে লাগলো তখন থেকে।
এই এত যে টাকার ক্ষমতা, এ শিরীষ ঘোষ বুঝেছিলেন বৈকি। বুঝেই টাকার পেছনে এত ছুটেছিলেন। কিন্তু আর একটা দিকও নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন বোধহয়। কারণ তখন দক্ষিণেশ্বরে এক পরমহংস প্রচার করছেন-মাটি টাকা, টাকা মাটি। কিন্তু তখন খুব দেরি হয়ে গিয়েছে। ততদিনে টাকার পাহাড় জমিয়ে ফেলেছেন তিনি। বাড়ি গাড়ি করে, বাগান, জমিদারী, আবাদ কিনে টাকার ক্ষমতাটাও বুঝেছেন, টাকার জ্বালাটাও বুঝে নিয়েছেন। তিনি দেখেছিলেন, যারা একদিন প্রথম জীবনে তাকে আশ্রয় দেয়নি, টাকা হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আশ্রয়ে এসে তাকে তোষামোদ করেছে। টাকার সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সব জুটেছে। যত ভক্ত-সংখ্যা বেড়েছে, যত গলগ্রহদের সংখ্যা বেড়েছে, তত টাকার জ্বালা বুঝেছেন। শেষ জীবনে নিজের সহধর্মিণীর মৃত্যুতে সেটা আরো বেশি করে বুঝেছিলেন। তারপর একদিন গিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে। তখন সেখানে অনেক ভক্তের ভিড়। কিছু কথা বলবার সাহসও হয়নি, সুযোগও হয়নি। নিজের অগাধ টাকার অপরাধে তখন নিজেই তিনি অপরাধী, তাই আর মুখ খুলতে পারেননি। তারপর শেষকালে একদিন তো মারাই গেলেন।
শিরীষ ঘোষ আর বেশিদিন বাঁচলে কী হতো বলা যায় না, হয়ত সব সম্পত্তিটম্পত্তি বিলিয়ে যেতেন দু’হাতে। কিন্তু তখন ছেলের হাতে এসে পড়লো সেই অগাধ টাকা। ছেলে শুধু নয়, পুত্রবধূর হাতে। আজ তিন পুরুষ ধরে সেই টাকা বেড়ে বেড়ে এখন এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছিয়েছে যে, খরচ করে উড়িয়েও তা আর ফুরোনো যাবে না।
গাড়িতে আসতে আসতেই সতী বলেছিল–এ-বাড়ির যদি এত টাকা না থাকতো তো বোধহয় ভালো হতো দীপু–
–কেন, টাকার জন্যেই তো আমরা সব এত চাকরি-বাকরি করছি, টাকার জন্যেই তো এই দাসত্বের জ্বালায় জ্বালছি–টাকা থাকলে কি আর এত সইতে হতো!
–না, তুমি জানো না দীপু, সকলের সব জিনিস তো সয় না, এদেরও তেমনি টাকা সয় না।
–সে কি! টাকা কি এরা ওড়ায়?
সতী বলেছিল–সে তো তবু বরং ভালো ছিল, তাতেও বুঝতাম এরা বেঁচে আছে, কিন্তু সে-ক্ষমতা যে এদের নেই, টাকা ওড়ানোতেও ক্ষমতার দরকার হয়, সাহসের দরকার হয়, মেজাজের দরকার হয়–
সেই যে কবে একদিন তিন পুরুষ আগে শিরীষ ঘোষ বলে গিয়েছিলেন–টাকা বড় নচ্ছার জিনিস-এরা বুঝি তার কদৰ্থ করেছে। এরা তাতেই বুঝি বড় ভয় পেয়ে গেছে। ব্যাঙ্কের ডিপোজিটে, আইরনের শেয়ারে সেই যে টাকাগুলো আটকে রেখেছে, তার থেকে আর নড়চড় হবার যেন উপায় নেই। শুধু টাকাই আটকে রাখেনি, টাকার সঙ্গে শিরীষ ঘোষের অধস্তন পুরুষ তাদের আত্মাও আটকে রেখেছে, তাদের সম্ভ্রম, বনেদিয়ানা, পৌরুষ সব কিছু গচ্ছিত রেখে দিয়ে এসেছে ব্যাঙ্কে। দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আছে। সম্ভ্রমের এক তিল নষ্ট হলেই তাদের যেন লোকসান হয়ে যাবে, বনেদিয়ানার এক চুল নষ্ট হলেই যেন তাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। অর্থের সঙ্গে সঙ্গে বুঝি পরমার্থকেও তারা বন্দী করে রেখেছে ব্যাঙ্কে। ব্যাঙ্কের সেফ ডিপপাজিট ভল্টে। পৃথিবী যদি একদিন রসাতলেও যায়, যদি প্রলয়-পয়োধি জলে সবকিছু একাকার হয়ে যায় একদিন, তবু তাতেও তাদের বনেদিয়ানা ধ্বংস হবে না। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের গেট-এ দারোয়ান বসিয়ে, ব্যাঙ্কের পাশ-বই সিন্দুকে আটকে রেখে তাই তাঁরা তাঁদের আভিজাত্যকে বন্দী করতে চেয়েছিলেন। যেন কিছুতেই না খোয়া যায়, যেন কিছুতেই না গায়ে আঁচড় লাগে সেখানে! কিন্তু কে জানতো বর্মায় মানুষ হওয়া একটা আশ্চর্য মেয়ে সে-বাড়ির বউ হয়ে ঢুকে তিন-পুরুষের সমস্ত ধ্যান-ধারণা এমন করে তছনছ করে দেবে!
দীপঙ্করও বুঝতে পারেনি তার সেই জন্মদিনের নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার জের এমন করে এতদিন ধরে চলবে! এমন মর্মান্তিক তার পরিণতি হবে!
সতী সামনে সামনেই চলছিল। বললে–এসো, ভেতরে এসো, এইখানেই উনি আছেন–
দীপঙ্কর বললে–এ কোথায় নিয়ে এলে?
সতী বললে–এইটেই ওঁর লাইব্রেরী-ঘর, এখানেই ওঁর বেশিরভাগ সময় কাটে–
পর্দা সরিয়ে ঢুকতেই দীপঙ্কর দেখলে-বিরাট একটা ঘর। চারদিকে খালি বই। বই-এর মধ্যে টেবিলে বসে আছেন কালকের সেই ভদ্রলোক, সেই সনাতনবাবু। তখন পেছন ফিরে বসেছিলেন।
সতী ভেতরে গিয়ে ডাকলে। বললে–শুনছো, এই দীপুকে এনেছি–
ভদ্রলোকের গায়ে একটা হাত-কাটা পাঞ্জাবি। উস্কোখুস্কো চুল। সতীর কথাটা কানে যেতেই পেছন ফিরলেন। দীপঙ্করের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু চিনতে পারলেন না। সতীর দিকে ফিরে বললেন–কাকে এনেছো বললে?
সতী বললেসেই যে যার কথা বলেছিলুম?
–ও, তাই বলো–
বলে উঠে সসম্ভমে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন–কী আশ্চর্য, আগে বলতে হয়! আপনি বসুন বসুন–
দীপঙ্কর একটা চেয়ারে বসলো। বললে–আপনি ব্যস্ত হবেন না—
সনাতনবাবু যেন সত্যিই বিব্রত হয়ে পড়লেন তবু। বললেন–দেখুন, কালকে আমি পুরী থেকে ফিরে এলাম তখন মানে পুরী থেকে ঠিক নয়, আসলে কটক থেকে ফিরে এলুম। বর্ষাকালে রথের সময় পুরী যাওয়াটাই ভুল–আমি ভেবে দেখছিলাম পুরী যেতে হলে হয় সেপ্টেম্বর নয় মার্চ মাসে যাওয়াই ভালো–
তারপর ঝুঁকে পড়ে বললেন–আমি আজ তিনখানা বই কিনেছি এই সম্বন্ধে, কাল রাত্রে আপনি বললে বিশ্বাস করবেন না, আমার ভালো ঘুমই হয়নি–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কেন?
–ঘুম কী করে হবে বলুন, আমি ভাবতে লাগলাম, উড়িষ্যাতেই বা এত বন্যা হয় কেন? আমাদের পূর্ববঙ্গেও বন্যা হয় অবশ্য, গত একশ বছরে নব্বই বার বন্যা হয়েছে। কিন্তু উড়িষ্যা সম্বন্ধে আমার সঠিক স্ট্যাটিসটিক্স জানা নেই, তাই পড়ছিলুম-ভাবলাম উড়িষ্যার বন্যা সম্বন্ধে একটু জেনে রাখা ভালো-এই দেখুন এই তিনখানা বই আজ কিনে এনেছি–
দীপঙ্কর দেখলে তিনখানা মোটা-মোটা নতুন বই টেবিলে রয়েছে। উড়িষ্যার বন্যা,
উড়িষ্যার ভূতত্ত্ব, নদীতত্ত্ব, আর যেন সব কী বিষয় নিয়ে লেখা।
দীপঙ্কর বললে–আপনি পড়ছিলেন, আপনার পড়ার ক্ষতি করলাম মাঝখান থেকে–
–না না, ক্ষতি করবেন কেন? এ কি একদিনে শেষ হবে ভেবেছেন? এ তিনখানা বইতে তো হবে না, আরো অনেকগুলো বই কিনতে হবে, আজ বুকসেলার্সদের চিঠি লিখে দিয়েছি, উড়িষ্যা সম্বন্ধে যত বই আছে, সব পাঠাতে–আমি তো ঠিক করেছি অন্তত ছ’মাস লাগবে, এ ব্যাপারটা জানতে–
দীপঙ্কর সনাতনবাবুর কথা, সনাতনবাবুর ব্যবহার লক্ষ্য করতে করতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। বললে–কোন ব্যাপারটা?
সনাতনবাবু বললেন–এই বন্যার ব্যাপারটা ব্যাপারটা তো ঠিক সহজ নয়, প্রায়ই হয় যে এটা, উনিশশো বত্রিশ সালে যে ভীষণ বন্যা হয়েছিল আমার মনে আছে–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু বন্যা যদি হয়ই, তার আপনি কী করবেন জেনে? আপনি তো প্রতিকার করতে পারবেন না?
সনাতনবাবু চাইলেন সতীর দিকে, চেয়ে হাসলেন। বললেন–দেখছ তো, তুমি যা বলো, ইনিও তাই বললেন–প্রতিকার যদি না-ই করতে পারলুম, জানতেও তো ইচ্ছে করে, জানলেও তো আনন্দ
আশ্চর্য এই মানুষটা! সতীও বলেছিল দীপঙ্করকে। শুধু বন্যাই নয়, সব জিনিস সম্বন্ধেই সনাতনবাবুর কৌতূহল। বহুদিন আগে একদিন ইলিশ মাছ ভাজা খেয়ে খুব ভালো লেগেছিল সনাতনবাবুর। ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলেন–এটা কী মাছ ঠাকুর?
ঠাকুর বললে–আজ্ঞে ইলিশ মাছ–
ইলিশ মাছ! ইলিশ মাছ ভাজা তো আগেও খেয়েছেন। কিন্তু এত ভালো তো লাগেনি কখনও!
জিজ্ঞেস করলেন-কোন্ বাজার থেকে মাছ আনা হয়েছে জানো তুমি ঠাকুর?
–আজ্ঞে, জানি, কৈলাস তো যায় বাজারে, রোজ যে-বাজার থেকে আসে, সেই বাজার থেকেই এনেছে।
সনাতনবাবু বললেন–কৈলাসকে ডাকো তো ঠাকুর!
কৈলাস আসতেই সনাতনবাবু বললেন–ঠাকুর কৈলাসকে জিজ্ঞেস কর তো কোন্ বাজার থেকে মাছ এনেছে–
কৈলাসের কথায়, তেমন সন্তুষ্ট হলেন না সনাতনবাবু। শেষে ডাক পড়লো সরকারবাবুর। সরকারবাবু এলেন ভেতরে। সনাতনবাবু জিজ্ঞেস করলেন-আজকে ইলিশ মাছটা কোথা থেকে কিনে আনা হয়েছে সরকারবাবু?
সরকারবাবু একটু ভয় পেয়ে গেল। বললে–আজ্ঞে হুজুর, আমি তো টাটকা মাছ দেখেই নিয়েছিলাম-রোজ তার কাছ থেকেই মাছ কিনি–
সনাতনবাবু তখন খাওয়া থামিয়ে দিয়েছেন। বললেন–সেই জন্যেই তো আমি জিজ্ঞেস করছি, কোন বাজারের মাছ?
–আজ্ঞে, জগুবাবুর বাজার!
সনাতনবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন–কোন নদীর মাছ বলতে পারেন?
–আজ্ঞে তা তো বলতে পারি না! আমি মেছুনীকে জিজ্ঞেস করবো কাল–
সনাতনবাবু হাসলেন। বললেন–তবেই হয়েছে, সে কি আর নদী চেনে, সে কেবল মাছই চেনেতাকে জিজ্ঞেস করলে কিছু ফল হবে না, সে তো আর লেখাপড়া জানে না সরকারবাবু–
সরকারবাবু বললেন–তা হলে কী করবো বলুন আজ্ঞে?
সনাতনবাবু আবার খেতে লাগলেন। বললেন–না, আপনাকে কিছু করতে হবে না, যা করবার আমিই করবো’খন–
খেয়ে উঠেই সনাতনবাবু লাইব্রেরী-ঘরে গিয়ে ডায়েরী খুললেন। খুলে লিখে রাখলেন–’বেলা বারোটার সময়ে ইলিশ মাছ ভাজা খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু লাগলো। সকালবেলা জগুবাবুর বাজারের মেছুনীর কাছ থেকে কেনা। কোন্ নদীর মাছ জানা যায় নাই। ডায়েরীতে লেখা শেষ করে বইগুলো খুঁজতে লাগলেন। মাছ সম্বন্ধে কোনও বই নেই তাঁর কাছে। একবার টেলিফোন করলেন কলেজ স্ট্রীটে। জিজ্ঞেস করলেন-ইলিশ মাছ সম্বন্ধে আপনাদের কাছে কোনও বই আছে?
কয়েকটা দোকানেই টেলিফোন করলেন। কোথাও নেই। তারা বললে–আমাদের এখানে পাবেন না, আপনি ক্যালকাটা ইউনিভাসিটির জুলজি ডিপার্টমেন্টে একবার টেলিফোন করতে পারেন–
শেষকালে তাই হলো। টেলিফোন করলেন সেখানে। নো রিপ্লাই। একজন অনেকক্ষণ পরে উত্তর দিলে-হঠাৎ ইউনিভার্সিটি ছুটি হয়ে গেছে লাইব্রেরীয়ানের মৃত্যুতে। কালকে টেলিফোন করবেন আপনি, বেলা বারোটার পর।
কিন্তু ব্যাপারটা অত সোজা নয়। জরুরী ব্যাপার। ফেলে রাখলে চলে না। হঠাৎ খেয়াল হলো। চিড়িয়াখানায় টেলিফোন করলেন। সে ক’দিন যে কী উত্তেজনায় কাটলো সনাতনবাবুর! একবার এখানে টেলিফোন করেন, একবার সেখানে। সনাতনবাবুর মা বললেন–কী হলো বাবা, কিছু বলতে পারলো ওরা!
সনাতনবাবু বললেন–না মা, কী করা যায় বলো তো এখন?
মা বললেন–কী আর করবে বাবা, ও ছেড়ে দাও-তুমি খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো–
কিন্তু সে-কদিন কিছুতেই আর ঘুম আসে না। সকালবেলা জগুবাবুর বাজারের মেছুনীর কাছ থেকে ইলিশ মাছ এনে বেলা বারোটার সময় ভাজা খেতে কেন এত সুস্বাদু লাগলো, তা জানা উচিত।
রাত্রিবেলা সতী বললে–তোমার হয়ত ক্ষিধে পেয়েছিল খুব, তাই ভাল লেগেছে ও নিয়ে অত ভাবছ কেন?
সনাতনবাবু বললেন–কিন্তু জানতে তো ইচ্ছে করে, জানলে তো আনন্দ হয়–
সতী বললে–তা পৃথিবীর তো জানার অনেক জিনিস আছে, সব কি তুমি জানতে পারবে, না জানা সম্ভব?
সনাতনবাবু বললেন–তা বলেছ তুমি ঠিক, সত্যিই তো, ইলিশ মাছ ছাড়াও তো অনেক জিনিস আছে, সব কি আমি জানতে পারবো? সব কি জানা যায়?
–তার চেয়ে এখন এসো, শুয়ে পড়ো—
জোর করে সতী সনাতনবাবুকে শুইয়ে দিলে। গায়ে চাদরটা ঢাকা দিয়ে দিলো। বললে–শুয়ে পড়ো এবার,-তোমার ঘুম পায় না?
সনাতবাবু বললেন–কী রকম আশ্চর্য ব্যাপার দেখো, তোমরা সবাই তো মাছ খেলে, আমিও খেলুম, কিন্তু আমারই ভালো লাগলো, আর আমারই যত মাথাব্যাথা–
কথা বলতে বলতেই খানিক পর ঘুমিয়ে পড়লেন সনাতনবাবু। সতী টের পেলে সনাতনবাবুর তালে তালে নিশ্বাস পড়তে লাগলো। তারপরেও অনেকক্ষণ জেগে রইল সতী। অনেকক্ষণ। আবার সেই ঘড়ির ধুকধুকুনি সতীর বুকে বাজলো। আবার তন্দ্রা এল সতীর। আবার ভোরবেলা ঘরের বাইরে শাশুড়ী ডাকলেন-বৌমা
কিন্তু পরের দিনই তিনশো টাকার বই কিনে আনলেন সনাতনবাবু চৌরঙ্গীর বিলিতি দোকান থেকে। একেবারে মাছের যাবতীয় ইতিহাস, মাছের চাষ, কত রকমের মাছ আছে পৃথিবীতে–সমস্ত লেখা আছে। সমুদ্রের মাছ, নদীর মাছ, পুকুরের মাছ। বিদেশের মাছ, স্বদেশের মাছ। সেই বই পড়তে লাগলেন আবার দাগ দিয়ে দিয়ে। সকাল থেকে অনেক গভীর রাত পর্যন্ত। আর কোনও চিন্তা নেই তার। ছ’মাছ পরে মাছ সম্বন্ধে সব কিছু যখন জানা হয়ে গেল, তখন বাঁচলেন। সনাতনবাবুও বাঁচলেন, সনাতনবাবুর মা’ও বাঁচলেন।
কিন্তু জানবার বিষয় তো আর একটা নেই সংসারে। সব জিনিসেই সনাতনবাবুর অদম্য কৌতূহল। একদিন সকালবেলা খবরের কাগজ খুলেই দেখলেন স্টেটসম্যানের এডিটারের ওপর কে যেন পিস্তলের গুলি ছুঁড়েছে, বড় বড় অক্ষরে খবরটা ছাপা হয়েছে। সে উনিশশো বত্রিশ সালের কথা। কলকাতার বহু লোক সে-খবরে চমকে উঠেছিল। কিন্তু সনাতনবাবু চমকালেন না।
বিকেল ছ’টার সময় এডিটার ওয়াটসন সাহেব অক্টারলোনী মনুমেন্ট, ইডেন গার্ডেন স্ট্র্যান্ড রোড হয়ে নেপিয়ার রোডের দিকে মোটরে চড়ে আসছেন। গাড়িটা একটু ধীরে ধীরে চলেছে, এমন সময় একটা লোক গাড়ির জানালা দিয়ে সাহেবের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছে। ওয়াটসনের স্টেনোগ্রাফার মিস্ গ্রস্ পাশে বসে ছিল। তিনটে গুলির মধ্যে একটা তার গায়েও এসে লাগলো। তারপর অনেক কাণ্ড। ওয়াটসন্ সাহেবকে পি-জি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। আর সন্ধ্যে সাতটার সময় মাঝেরহাটে বুড়োশিবতলায় দু’জনকে পাওয়া গেল। দুজনেই তখন মরে গেছে। একজনের নাম ননী লাহিড়ী। আর একজন হালদার পাড়া রোডের গোপাল চৌধুরী।
তখন এ-সব নিয়ে কদিন হৈ চৈ হলো শহরে। পুলিস, খানাতল্লাসী চললো। দীপঙ্করের সে-সব দিনকার কথা মনে আছে। কিরণের সঙ্গে মেশাই তখন বন্ধ। পেছনে পেছনে সি-আই-ডি ঘুরছে। আই-বি আপিসে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল দীপঙ্করকে। সতীরও তখন নতুন বিয়ে হয়েছে।
সনাতনবাবু মাকে ডাকলেন। বললেন–কী ভীষণ কাণ্ড হয়েছে জানেনা মা?
মা বললেন–কী!
সনাতনবাবু বললেন–একেবারে সাহেবদের মেরে খুন করে ফেলছে সবাই
মা বললেন–ও-সব স্বদেশীদের কাণ্ড, ও তো রোজই হচ্ছে সোনাও আর নতুন কী?
সনাতনবাবু বললেন–তা তো আমিও জানি, কিন্তু এত পিস্তল কোত্থেকে আসছে জানতে হবে তো!
মা বললেন–ও জেনে তোমার কী হবে?
সনাতনবাবু বললেন–না, জানা তো দরকার। এত পুলিস, পাহারা, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট রয়েছে, তবু এত পিস্তল কোত্থেকে আসছে!
–যেখান থেকে খুশী আসুক, আমাদের কী?
–বারে! জানতে হবে না? পিস্তল অম্নি এলেই হলো? তাহলে পুলিস মিলিটারি রাখবার দরকার কী। আমাদেরই তো দেশের সব মানুষ, আমরা তো এই দেশেই বাস করছি। শুধু খাওয়া-দাওয়া আর ঘুমোনো তো পশুরাও করে। আমাদের সঙ্গে তাহলে আর তাদের তফাত্তা কী?
রাত্রে একমনে বই পড়া দেখে সতী জিজ্ঞেস করলে–সত্যি এ-সব জেনে কী হবে? সনাতনবাবু বললেন–তোমার জানতে ইচ্ছে করে না? সতী বললে–না।
সনাতনবাবু বললেন–আশ্চর্য তো! সত্যিই তোমার জানতে ইচ্ছে করে না, কে প্রথম পিস্তল আবিষ্কার করলো, প্রথম কাকে পিস্তল মারা হলো। প্রথম পিস্তল দেখতে কী রকম ছিল, তারপর সেই পিস্তর থেকে আজকের মর্ডান পিস্তলের কী তফাৎ-সে-সব জানতে ইচ্ছে করে না!
সতী বললে–সে আমার জেনে কী লাভ?
সনাতনবাবু হাসলেন। বললেন–তাহলে খেয়ে ঘুমিয়ে বেঁচে থেকেই বা কী লাভ?
সেই গুলি মারার ঘটনার পর থেকেই গাদা গাদা বই আনাতে লাগলেন সনাতনবাবু। সেই বই সব আবার দিন-রাত পড়তে লাগলেন। ছ’মাস পরে সব জানা হয়ে গেল। তখন বাচলেন। সনাতনবাবুও বাঁচলেন, সনাতনবাবুর মা’ও বাঁচলেন।
কথাগুলো শুনতে শুনতে দীপঙ্করের খুব ভালো লাগছিল। এও একরকম মানুষ। কত জানবার জিনিস পৃথিবীতে! একটা জীবনে সব জিনিস জেনে শেষ করা যায় না। পৃথিবীতে এত বই, এক জীবনে সব পড়ে শেষ করা যায় না। তবু চারদিকে থাক-থাক সাজানো বইগুলো দেখে কেমন শ্রদ্ধা হতে লাগলো সনাতনবাবুর ওপর। দরকার কি অত জানার! অন্য দশজন বড়লোকরা যা করে, তাই করলেই তো পারেন সনাতনবাবু! কেন মিছিমিছি এত পরিশ্রম! এত পয়সা খরচ! বিচিত্র মানুষ বটে সনাতনবাবু। এই সব নিয়েই মেতে আছেন তো বেশ! এই সব নিয়েই তো উন্মত্ত হয়ে আছেন!
দীপঙ্কর বললে–এগুলো সব কী বই?
সনাতনবাবু বললেন–এইগুলোই তো এতদিন পড়ছিলুম, ওয়ার নিয়ে কিছু ঘাটাঘাটি করেছিলুম অনেকদিন ধরে, হঠাৎ এই মাছের ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতেই আবার মাছ সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছে হলো
–ওয়ার? যুদ্ধ সম্বন্ধে হঠাৎ পড়লেন কেন?
–ওয়ার বাধবে শুনছি।
–যুদ্ধ বাধবে?
বহুদিন আগে একটা যুদ্ধ গিয়েছে, সে-যুদ্ধ দেখেনি দীপঙ্কর। সে-যুদ্ধের গল্পই শুধু শুনেছে। মধুসূদনের বোয়াকে দুনিকাকারা বসে সব গল্প করতো যুদ্ধের। মেসোপোটেমিয়া আর প্যারিসের লড়াই-এর গল্প হতো রোয়াকের ওপর বসে বসে। আবার সেই যুদ্ধ বাধবে? বলছেন কী সনাতনবাবু!
সনাতনবাবু বললেন–সে কি, আপনি শোনেননি? আপনাদের আপিসের সাহেবরা কিছু বলছে না?
দীপঙ্কর বললে–না, কই, কিছু তো শুনিনি!
শুনুন আর না-শুনুন, আমার নিজেরই যেন কেমন সন্দেহ হচ্ছে যুদ্ধ বাধবে আবার মশাই। জার্মানীতে নাজি-পার্টি ওঠার পর থেকেই কেমন সন্দেহ হচ্ছে। ওই যে হিটলার লোকটা দেখছেন, ও লোকটা তত খারাপ নয়, লোকটা দেশকে ভালবাসে, দেশের ভালোই চায়, কিন্তু ওর পেছনে অনেক মাড়োয়ারী রয়েছে তারাই আসলে ওকে নাচাচ্ছে–
–সে কি?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, তারা অনেক বন্দুক-রাইফেল গোলা-গুলি তৈরি করে ফেলেছে, সেগুলো বিক্রি হচ্ছে না, একেবারে কারখানায় জমে পাহাড় হয়ে উপচে পড়ছে, সেগুলো চালানো চাই তো–
সনাতনবাবু অনেক সব কথা বলতে লাগলেন। যুদ্ধের একেবারে গোড়াকার কথা সব। তখন কেউই জানতো না যুদ্ধ হবে। দীপঙ্করও জানতো না। খবরের কাগজেও সে সব কথা বেরোতো না। কিন্তু সনাতনবাবুই, মনে আছে, সেদিন প্রথম দীপঙ্করকে যুদ্ধের কথাটা বলেছিলেন। কে জানে, হয়ত সনাতনবাবু নিজেই জানতেন না তার কথা শেষকালে এমন করে অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাবে। আর সে-যুদ্ধে সমস্ত পৃথিবী জড়িয়ে পড়বে। জড়িয়ে পড়বে ইংরেজ, জড়িয়ে পড়বে ফরাসী, রাশিয়া সবাই। জড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর প্রত্যেকটা লোক প্রত্যেকটা অধিবাসী। আর সে যুদ্ধে শেষপর্যন্ত সতীও জড়িয়ে পড়বে!
–আপনি তো জানেন, কী করে হিটলার ক্ষমতা পেলে? ভোটের আগে কমিউনিস্ট পার্টিকে বদনাম দেবার জন্যে নিজেরাই নিজেদের পার্লামেন্ট হাউসটা আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিলে মশাই! কী শয়তান দেখুন! বদনাম হলো অন্য সব পার্টির। আর তারপরেই ভোট। ভোটে একেবারে গো-হারা হারিয়ে দিলে সকলকে। আমি তখন থেকেই ওয়াচ করছি কি না, বই পড়ছি আর দেখছি–কী হয়!
কথা বলতে আরম্ভ করলে আর শেষ হয় না। কথা বলতে আরম্ভ করলে সনাতনবাবুর আর জ্ঞান থাকে না কোনও দিকে। সাধারণত কথা বলবার হয়ত লোকই পান না মনের মত। আজকে দীপঙ্করকে পেয়ে সনাতনবাবু যেন মন খুলে কথা বলতে পেরে বেঁচেছেন। একাই কথা বলে যাচ্ছিলেন সনাতনবাবু, আর দীপঙ্কর আর সতী দুজনেই শুনছিল।
বললেন–আমি কি এসব জানতুম! স্টেটসম্যানের এডিটরকে যেদিন স্বদেশীরা গুলি করলে, সেই দিনই প্রথম খেয়াল হলো যে পিস্তল কোথা থেকে প্রথম এল। মানে বন্দুক কবে প্রথম আবিষ্কার হলো। সেই সব বই আনালুম, এনে পড়তে পড়তে দেখি, আরে জার্মানী তো কাণ্ড বাধিয়ে বসেছে-এ তো যুদ্ধ লাগলো বলে! তখন আরো বই আনাই, দেখি যা ভেবেছি তাই–আসলে দেখলাম হিটলারের পেছনে রয়েছে থাইসেন
–থাইসেন?
–থাইসেনের নাম শোনেননি? আসলে লোকটা ব্যবসাদার। লোহা-লক্কড়, কয়লা, নানারকমের ব্যবসা তার, সে দেখলে হিটলার লোকটা তো বক্তৃতা করতে পারে ভালো! তা দাও একে চ্যান্সেলার করে। তাহলে একটা মজার গল্প বলি শুনুন–
বেশ মশগুল হয়ে গল্প ফাঁদছিলেন সনাতনবাবু। সতী বললে–আর গল্প থাক্, দীপু এসেছে আপিস থেকে তা জানো তো! আমি আপিস থেকে ওকে টেনে এনেছি। এখনও ওর খাওয়া-দাওয়া হয়নি–
সনাতনবাবু বললেন–ছি ছি ছি, এ কথা তো আগে বলোনি আমায়! আপনার খাওয়া হয়নি তা তো আমায় বলতে হয়! না, না, আপনাকে আর আটকাবো না, আপনি বাড়ি চলে যান, আপনাকে আর কষ্ট দেব না–
–ওমা, সে কি? বাড়ি চলে যাবে কেন? তুমি চলে যেতে বলছো কেন ওকে?
সতীও হাসতে লাগলো। দীপঙ্করও একটু লজ্জায় পড়লো।
সতী বললে–দেখলে তো ওঁর কাণ্ড, জানো, ওকে আমি নেমন্তন্ন করেছি আজ, তোমাকে কাল অত করে বললাম।
–তাই নাকি?
আকাশ থেকে পড়লেন সনাতনবাবু। বললেন–না না, আমার মনে পড়েছে-তাহলে তো ভালোই হলো, আরো অনেকক্ষণ গল্প করা যাবে
বলে উঠলেন। বললেন–দাঁড়ান, তাহলে আর একটা বই এনে দেখাচ্ছি আপনাকে, এই পাশের ঘর থেকে নিয়ে আসছি
বলে পাশের ঘরের দিকে চলে গেলেন। দীপঙ্কর সতীর দিকে চাইলে, বললে সনাতনবাবু তো বেশ মানুষ সতী!
সতী সে-কথার উত্তর দিলে না। বললে–তুমি কিন্তু আজ খেয়ে যাবে দীপু চলে যেও না যেন–
দীপঙ্কর বললে–আজ সনাতনবাবুর সঙ্গে আলাপ করে সত্যিই খুব খুশী হলাম, এত খবর রাখেন–
ততক্ষণে এসে পড়েছেন সনাতনবাবু। হাতে একখানা বই। বললেন–এখানা নতুন আনিয়েছি, এই দেখুন, একটা জায়গায় আপনাকে পড়িয়ে শোনাই
সতী বললে–তাহলে আমি রান্নার কতদূর কী হলো দেখি গে–তুমি বোস দীপু—
বলে সতী চলে গেল।
অদ্ভুত মানুষ এই সনাতনবাবু! কোথায় কত দূরে সব দেশ, সে-সব দেশের সমস্যা, সে-সব দেশের মানুষের নাড়ি-নক্ষত্র সব জেনে মুখস্থ করে বসে আছেন একেবারে। উনিশশো একত্রিশ সালে ব্রেজিলে কত লক্ষ ব্যাগ কফি সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তাও মুখস্থ। একদিকে সাধারণ মানুষ তার ধর্ম, তার জীবিকা, আর একদিকে বড়দের রাজনীতি। জার্মানীতে ইহুদীদের ওপর যেমন অত্যাচার, তেমনি রাশিয়াতে মহাজনদের ওপর অত্যাচার। দুটোই এক। কোথাও বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই, সহযোগিতা নেই। যুদ্ধ বাধলে কেউ জিতবে না, দেখবেন। আজ দুদিক থেকেই দু’দল দু’রকম মত চালাবার চেষ্টা করছে। একদল বলছে সহযোগিতা শান্তি আর যুক্তির পথেই সভ্যতা এগিয়ে চলবে–আর একদল চাইছে ধ্বংস। মৃত্যুর মধ্যে, অপঘাতের মধ্যে, আত্মহত্যার মধ্যেই আত্মবিনাশ! কাকে আপনি চান বলুন? দুজনেরই সমান ভোট, দু’দলই দলে ভারি–দু’দলের হাতেই সবরকম হাতিয়ার আছে-বোমা, বারুদ, রাইফেল, বন্দুক, গ্যাস সব কিছু! কারা জিতবে এখন বলুন?
–সোনা!
হঠাৎ সনাতনবাবুর কথার মধ্যে বাধা পড়লো। সনাতনবাবু কথা থামিয়ে দরজার দিকে চেয়ে বললেন–এই যে মা–
দীপঙ্কর চেয়ে দেখলে। সনাতনবাবুর মা ঘরের ভেতরে ঢুকছেন। সতীর শাশুড়ী। কালকে এই চেহারাটাই দেখেছিল দীপঙ্কর। এঁকে দেখেই সতী ভয়ে নীল হয়ে গিয়েছিল।
–এ কে সোনা?
সনাতনবাবু উত্তর দেবার আগেই দীপঙ্কর সোজা তাঁর কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে।
দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠে বললে–সতী আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে–সনাতনবাবুর সঙ্গে আলাপ করে দিতে
–বৌমা ডেকে এনেছে? তুমিই কালকে এসেছিলে, না?
দীপঙ্কর বললো—হ্যাঁ–
–তা বৌমা না-হয় পাগল, তুমি কী বলে পাগলের কথায় এলে এখানে?
পাগল! সতী পাগল! দীপঙ্কর কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়লো। সনাতনবাবুর মা এ কী বলছেন! সতী পাগল! একবার সনাতনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। সনাতনবাবু তখন সেই বইটা নিয়ে আবার চোখ বোলাতে শুরু করেছেন
–তুমি কি রকম ভাই, বৌমার?
দীপঙ্কর বললে–ওরা কালীঘাটে আমাদেরই বাড়ির পাশে থাকতো-ছোটবেলা থেকেই পরিচয়। একসঙ্গে অনেকদিন কাটিয়েছি কিনা, আমার মাকে সতী মাসীমা বলে ডাকতো–আর কিছু নয়
–তা এতদিন দেখছো, ও পাগল কিনা জানো না?
–আজ্ঞে, আপনি কী বলছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না–
–তা যদি না বুঝতে পেরে থাকো তো আর বুঝেও কাজ নেই। আমি এই বউকে নিয়ে এতদিন ঘর করছি, আমি বুঝতে পেরেছি, ও পাগল ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা না-হয় ভালো করে খোঁজ-খবর না-নিয়ে বিয়ে দিয়েছি, কিন্তু তোমরা কেন ওর কথায় ভোল? তোমরা কেন ওর কথায় এ বাড়িতে আসো?
অপমানটা দীপঙ্করের বুকে গিয়ে শেলের মতন বিধলো। কিন্তু কী বলবে বুঝতে পারলে না।
সতীর শাশুড়ী আবার বলতে লাগলেন-কালকে তোমাকে আমি দেখেছি, কিন্তু মুখের ওপর কিছু বলিনি, কিন্তু আজও কী বলে তুমি এলে?
দীপঙ্করের মনে হলো আর যেন একমুহূর্ত এখানে দাঁড়ানো তার উচিত নয়। বললে–আচ্ছা, আমি চলে যাচ্ছি এখুনি
–হ্যাঁ, যাও; ও ডাকলেও কখনও এসো না, ও একটা পাগল, একটা বদ্ধ পাগলকে আমার বউ করে এনেছি
ততক্ষণে ঘরের বাইরে পা বাড়িয়েছিল দীপঙ্কর। সনাতনবাবুর যেন এতক্ষণে খেয়াল হলো, বললেন–কোথায় যাচ্ছেন দীপঙ্করবাবু? এই চ্যাপটারটা শুনুন, এই চ্যাপটারটা পড়িয়ে শোনাই আপনাকে–
সনাতনবাবুর মা বললেন–তুমি আর ওকে ডেকো না সোনা, ওকে যেতে দাও–
বলে পেছন-পেছন বেরিয়ে এলেন। ঘরের বাইরে এসে দীপঙ্কর কোন দিকে যাবে বুঝতে পারলে না। লম্বা বারান্দা। তার একপাশে ঘর, আর একপাশে চৌকো-চৌকো থাম। দুটো থামের ফাঁকে ফাঁকে বাগানের কিছু-কিছু নজরে পড়ে অন্ধকারের মধ্যে।
সতীর শাশুড়ী বোধহয় দীপঙ্করের অসুবিধেটা বুঝতে পারলেন। বললেন–তুমি যেন কিছু মনে কোরো না আবার–
দীপঙ্কর পেছন ফিরে যেন কথাটার মানে বুঝতে চাইলে।
সতীর শাশুড়ী বললেন–তোমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বললাম বলে কিছু যেন আবার ভুল বুঝো না বাবা-আমাদের এই ঘোষ-বাড়ির বংশে এ নিয়ম নেই–
দীপঙ্কর একটু দ্বিধা করতে লাগল। তারপর বললে–কিন্তু আপনি ওকে পাগল কেন বলছেন বুঝতে পারছি না।
সতীর শাশুড়ী এবার গলা ছাড়লেন। বললেন–তা পাগল নয়? পাগল না হলে নিজের পেটের ছেলেকে মা হয়ে কেউ খুন করতে পারে?
দীপঙ্কর চমকে উঠলো। কথাটা শুনে এক-পা পেছিয়ে এসেছে। বললে–কী বলছেন?
সতীর শাশুড়ী বললেন–যা বলছি ঠিকই বলছি বাবা, নিজের পেটের ছেলেটাকে জলজ্যান্ত মেরে ফেললে!
তারপর দীপঙ্করের বিস্ময়ের ঘোর কাটবার আগেই আবার বললেন–অনেক দুঃখেই আমার মুখ দিয়ে এসব কথা বেরোচ্ছে আজ, নইলে তোমরা পাড়ার লোক, পাড়ার লোকের কাছে ঘরের কথা সাতকাহন করে বলার মানুষ আমি নই, আমার সে স্বভাবও নয়–তোমাকে বৌমা নিজে ডেকে এনেছে বলেই এত কথা বলতে হলো, আমার নিজের জ্বালায় জ্বলছি ওকে নিয়ে, এর মধ্যে তোমরা এসে আর আমার জ্বালা বাড়িও না বাবা, তুমি যাও এখন
দীপঙ্করের আরো অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু ভদ্রমহিলার মুখ চোখের দিকে চেয়ে আর কথা বলতে সাহস হলো না। এ কোন্ সংসার, এ কোন রহস্যের মধ্যে এসে পড়লো দীপঙ্কর! সতীকে দেখে বাইরে থেকে পাগলের কোনও লক্ষণই বোঝা যায়নি। সতীকে তো সহজ স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল। কেন সে খুন করলে নিজের ছেলেকে। আর তার যে কোনদিন ছেলে হয়েছিল, তা-ও তো বলেনি সতী!
দীপঙ্করের মনে হলো, সত্যিই তো সতীর শাশুড়ীর কোনও অন্যায় নেই। যাকে সংসার করতে হয়, সে-ই সংসারের জ্বালা বোঝে। সতীর কী! সতী তো এ-সংসারের সামান্য বউ মাত্র। কিন্তু এই শাশুড়ীকেই তো বিধবা হবার প্রথম দিন থেকে এই সংসারের হাল চালাতে হচ্ছে। থাকুক না অজস্র টাকা, কিন্তু টাকাটাই তো সব নয়। একদিন সামান্য জাহাজটাকে একলাই চালিয়ে নিয়ে এসেছেন এতদিন। এখন এই সংসার কার হাতে তুলে দিয়ে তিনি যাবেন! কার ওপর তিনি ভরসা করবেন! ছেলে তো লেখাপড়া, বই-বিদ্যে নিয়ে মেতে আছে। হয়ত ভেবেছিলেন, ছেলের বিয়ের পর ছেলের বউকেই সব ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হবেন। কিন্তু হয়ত সতীকে তার পছন্দ হয়নি। হয়ত সতী তাঁর মনোমত নয়। এ কী অদ্ভুত জগৎ, এ কী অদ্ভুত সংসার। এদের এ-সংসারে স্বামী হয়ত স্ত্রীর মনোমত নয়, স্ত্রীও হয়ত স্বামীর মনোমত নয়। আবার ছেলেও হয়ত মায়ের মনোমত নয়, মা-ও হয়ত ছেলের মনোমত নয়। আর পুত্রবধূ! সতী যেমন শাশুড়ীর মনোমত নয়, শাশুড়ীও তাই হয়ত সতীর মনোমত নয়। অথচ দিনের পর দিন এক সংসারে এক ছাদের তলায় একই সঙ্গে এদের বসবাস করতে হবে। ভালো না লাগলেও বাস করতে হবে। এ কী যন্ত্রণা! গেটটা পেরিয়ে যাবার সময় দীপঙ্করের মনে হলো, একদিন সাহেবপাড়ায় মিস্ মাইকেলর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময়েও ঠিক এই কথাই তার মনে হয়েছিল। লক্ষ্মীদির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবার সময়েও এই একই কথা মনে হয়েছিল তার। বাইরে থেকে তো লক্ষ্মীদিকে দেখে কেউ বুঝতে পারে না, মিস্ মাইকেলকে দেখেও কারো বুঝতে পারার কথা নয়। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের সতীদের বাড়িটা দেখেও তো বোঝবার কোনও উপায় নেই। তবে কি সবাই এক! গরীব বড়লোক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত দ্র-অভদ্র সবাই! প্রিয়নাথ মল্লিক রোড, ফ্রি স্কুল স্ট্রীট, গড়িয়াহাটা, ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন-এর মধ্যে কোনও তফাৎ নেই? কোনও তফাৎ নেই কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, ইংলন্ড, আমেরিকা, জাপান, জার্মানী, রাশিয়ার মধ্যে। মানুষের পৃথিবীতে এমনি করেই কি সর্বত্র অন্তরে হাহাকার আর বাইরে ছদ্মবেশের প্রলেপ!
দীপঙ্করের নিজের মতই যেন সবাই। ভেতরে ফুটো আর বাইরে জামা-কাপড়ের ফরসা চাকচিক্য! একদিকে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ভাঙা বাড়িটার মধ্যে জীবনযাত্রার নির্লজ্জ পরিহাস আর অন্যদিকে আপিসে গদি-আঁটা চেয়ার-টেবিলের বিলাস-বৈভব! এইটেই কি সত্যি, এইটেই কি নিয়ম। আশ্চর্য! তেত্রিশ টাকার ঘুষের কনক্রীটের ওপরেই কী পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জীবনের বুনিয়াদ!
–দীপুদীপু-উ-উ-উ-উ–
হঠাৎ কানটা খাড়া করে একবার দাঁড়াল দীপঙ্কর। মনে হলো সতীর গলা ভেসে আসছে। যেন বাড়ির ভেতরের বারান্দা থেকে সতীর গলাটা ক্রমে আরো কাছে আসছে। সতী যেন দূর থেকে তাকে ডাকছে। সে ডাক ক্রমে কাছে আসছে। আরো কাছে। আরো, আরো কাছে। অন্দর মহল থেকে বার-বাড়ি, বার-বাড়ি থেকে বার-বাড়ির বারান্দা, বারান্দা থেকে বাগান, বাগান থেকে সদর গেট-এইবার হয়ত একেবারে দৌড়তে দৌড়তে রাস্তায় এসে তাকে ধরবে।
–দীপু-উ-উ-উ-উ–
দীপঙ্কর হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে পা বাড়িয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি চলতে লাগলো। আরো তাড়াতাড়ি। হাজরা রোডের মোড়ের ট্রাম রাস্তার লোকজনের ভিড়ের মধ্যে একবার মিশে যেতে পারলে আর তাকে খুঁজে পাবে না সতী। আর খুঁজে পাবে না দীপঙ্করকে। সতীর জীবন থেকে এবার চিরকালের মত হারিয়ে যাবে দীপঙ্কর। দীপঙ্করের মনে হলো, এ সংসারের যেন কোন অর্থ নেই, যেন কোনও উদ্দেশ্য নেই। সত্যি, সকাল বেলার জীবনটা যেন আপিসে যাবার জন্যেই তৈরি হয়েছে। আপিসটা তৈরি হয়েছে যেন পা দুটোকে খানিক বিশ্রাম দেবার জন্যে! আর সন্ধ্যেবেলাটা! সন্ধ্যেবেলাটার সৃষ্টি যেন আপিস থেকে বাড়ি ফেরবার পর একটু অবসর যাপনের জন্যে। আর কিছু নয়। আর তারপর ঘুম। ঘুম না হলে পরের দিন আপিস যাবে কী করে। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত সেই একই চক্র। পৃথিবীর বুড়ো সূর্যটার মতই যেন অকারণে কেবল চক্রাকারে ঘোরা।
সতীর গলাটা তখন আর কানে আসছে না। রাস্তার ভিড় তখন একটু পাতলা হয়ে এসেছে। হাজরা পার্কের দক্ষিণের এই ফুটপাথের ওপর বহুকাল আগে একবার প্রফেসর অমল রায়চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেদিন দীপঙ্কর যে-প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল তাঁকে, সে-প্রশ্নটাই আবার কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো। সক্রেটিসের সেই কথাটা। কেন সংসারে ভালো লোকেরা কষ্ট পায়! কেন ভালো লোকেরা সাফার করে! কে তার কথার উত্তর দেবে। এই অগণিত জনতা, এই ট্রাম-বাস, দোকানপাট, এই রাস্তা-ঘাট-পার্ক, ওই আকাশ-নক্ষত্র-চাঁদ, কার কাছে সে উত্তর পাবে! সক্রেটিস যদি বেঁচে থাকতেন আজ!
–স্যার আপনি এখানে?
হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পেলে দীপঙ্কর। সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে সসম্ভ্রমে। শাট-পরা, মালকোচা মারা ধুতি, হাতে একটা গোল অ্যালুমিনিয়ামের খাবারের কৌটো। বোঝা গেল আপিসের ক্লার্ক কেউ হবে।
দীপঙ্কর বললে–তুমি এদিকে কোথায়?
ছেলেটি বললে–বায়োস্কোপ দেখতে এসেছিলাম স্যার এম্প্রেস থিয়েটারে–
কথাটা বলে চলে যাওয়াই উচিত ছিল ছেলেটার। কিন্তু তবু দাঁড়িয়ে রইল। বললে–স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, আমি দু’মাস ধরে লিভ-ভেকেন্সিতে কাজ করছি, এখনও পার্মানেন্ট ভেকেন্সিতে আমাকে দেওয়া হলো না–
আরো বোধহয় অনেক কথা গড়গড় করে বলে গেল। নিজের দুঃখের কথা, নিজের বি-এ পাস করার কথা, নিজের সংসারের কথা। নিজের চাকরির কথা। নিজের সামান্য আয়ের কথা।
দীপঙ্কর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে-তুমি ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছ? তেত্রিশ টাকা ঘুষ?
কিন্তু বলতে গিয়েও দীপঙ্করের মুখে কথাটা বেধে গেল। মুখের চেহারাটা ভালো করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখলে। কোন সেকশন, কোথায় বাড়ি, কিছুই জিজ্ঞেস করলে না দীপিঙ্কর। কিছুই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না। দীপঙ্করের মনে হলো, এরা দীপঙ্করের চেয়েও যেন সুখী, দীপঙ্করের চেয়েও ভাগ্যবান। নইলে এত অভাবের মধ্যেও তো সিনেমা দেখতে এসেছে। এরা তো কই তার মত সংসারের কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামায়। এরা কি সক্রেটিসের নাম শুনেছে, বাবাফ-এর নাম শুনেছে, থাইসেন-এর নাম শুনেছে। এরা কি তার মত এই ট্রাম-বাস-পার্ক, এই দোকানপাট-মানুষ, এই আকাশ চাঁদ-নক্ষত্র নিয়ে মাথা ঘামায়। এরা কি প্রশ্ন করে কেন ভালো মানুষেরা কষ্ট পায় সংসারে! এরা কি জীবনের অর্থ খুঁজতে একলা-একলা ঘুরে বেড়ায় তার মত গাড়িয়াহাটা, ফ্রি স্কুল স্ট্রীট, প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে! খুঁজে বেড়ায় ইতিহাসের কেতাবে!
দীপঙ্কর ছেলেটিকে সরিয়ে দিলে। বললে–এ-সব কথা রাস্তায় হয় না–আপিসে দেখা করো–
আশ্চর্য, এখানেও আপিস! এখানেও আপিসের হাত থেকে মুক্তি নেই। তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে চলতে লাগলো দীপঙ্কর। হয়ত ওদের মতন হতে পারলেই ভালো হত। সংসারের বুকের ওপর বসে দেনা-পাওনার কড়ি নিয়ে মাথা ঘামাতো না। সব জিনিস কড়ি দিয়ে কিনতো আর দাম পেলেই বেচতো। কিন্তু যে-মানুষ সামাজিক, যে-মানুষ স্বাদেশিক, যে-মানুষ মানবিক-যে-মানুষ একাধারে সব, তার শান্তি কেমন করে হবে! তাকে শান্তি দেবে কে?
বাড়ির কাছে আসতেই দীপঙ্কর যেন চমকে উঠলো। বাড়ির সামনে যেন অনেক লোকের ভিড়। অন্ধকারে কাউকে বিশেষ করে চেনা যায় না। কিন্তু যেন কিছু একটা ঘটেছে। একটা কিছু বিপর্যয়।
.
কাছে আসতেই পুলিসের ভিড় দেখে আরো অবাক হয়ে গেল।
তবে কি ছিটে ফোঁটার কাণ্ড! ছিটে- ফোঁটার ব্যাপারে পুলিস আসাটা কিছু বিচিত্র নয়। অনেক কাণ্ডর মধ্যে তারা জড়িয়ে থাকে। পুলিস-দারোগার সঙ্গে জীবনে তাদের অনেকবার মোলাকাত করতে হয়েছে। পুলিস-দারোগাকে ভয় করে চলবার মানুষ নয় ছিটে-ফোঁটারা।
তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবারই ইচ্ছে ছিল দীপঙ্করের। কিন্তু হঠাৎ ফোঁটা ডাকলে দূর থেকে।
বললে–এই যে দীপু এসে গেছে রে–এই দীপু—
দীপঙ্কর ভিড় ঠেলে কাছে গেল।
–কী হয়েছে এখানে।
ফোঁটা বিড়ি টানছিল। বললে–বিন্তিটার কাণ্ড শুনেছিস?
বিন্তিদি! বিন্তিদি আবার কী কাণ্ড হলো? বিন্তিদিকে পাওয়া গেছে তাহলে?
ফোঁটা বললে–আয়, ভেতরে দেখবি আয়—
বলে ফোঁটা দীপঙ্করের হাত ধরে বাড়ির উঠোনে নিয়ে গেল।
ভেতরে উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা বুকফাটা কান্না যেন হঠাৎ সেই অন্ধকার রাত্রির হৃৎপিণ্ড ভেদ করে দীপঙ্করকে গ্রাস করতে এল। পাশেই মা বসে ছিল বিন্তিদির মাথাটা ধরে। মাথার চুলগুলো একদিনেই জট ধরে গেছে। ধুলোয় লুটোচ্ছে। গলা পর্যন্ত সমস্ত শরীরটার ওপর একটা চাদর বিছানো। স্থির নিশ্চল নিথর শরীর। বিন্তিদি যেন চিত হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
দীপঙ্করকে দেখেই মা নতুন করে আবার ডুকরে কেঁদে উঠলো।
ফোঁটা বললে–বোকার বেহদ্দ—
এতক্ষণে যেন জ্ঞান ফিরে এল দীপঙ্করের। পাশ ফিরে বললে–কে?
–আরে, বলা নেই কওয়া নেই, চুপি চুপি একলা গিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছে! কেউ টের পাইনি আমরা–
বড় অস্বাভাবিক লেগেছিল ছিটের কাছে, ফোঁটার কাছে। তাদের কাছে বড় বিচিত্র লেগেছিল বিন্তিদির এই আত্মবিলোপ! যেন তারা আশা করেনি এমন হবে। কিন্তু আশ্চর্য, সেই অন্ধকার উঠোনের মধ্যে বিন্তিদির নশ্বর দেহটার সামনে দাঁড়িয়ে বিন্তিদির অপমৃত্যুটাকে দীপঙ্করের বড় সহজ বড় স্বাভাবিক মনে হয়েছিল সেদিন। ছোটবেলা থেকে দেখা বিন্তিদিকেই যেন আবার নতুন করে দেখছিল সে। যেন আবার নতুন করে বুঝতে চেষ্টা করছিল তাকে। সারা জীবন ধরে যে কথা বলেনি, সেই মেয়ে যেন হঠাৎ বাঅয় হয়ে উঠেছে। যে-মেয়ে সব সময়ে সকলকে ভয় করে এসেছে, আজ যেন সে হঠাৎ নিলজ্জ হয়ে উঠেছে। হঠাৎ নির্ভীক হয়ে উঠেছে। এইটেই যেন বিন্তিদির পক্ষে স্বাভাবিক। একলা চুপি চুপি বাড়ি থেকে রাতের অন্ধকারে তাই বেরিয়ে পড়েছিল সেদিন। অন্ধকার পাথর-পটির গলির মধ্যে গিয়ে তাই হয়ত তার পথ চিনতে কষ্ট হয়নি। তাই হয়ত বর্ষার গঙ্গার দিকে চেয়ে একবার দ্বিধাও করেনি। অমাবস্যার অন্ধকার যেমন অনন্ত জ্যোতিষ্কলোককে প্রকাশ করে দেয়, তেমনি নিবিড়তম দুঃখের মধ্যেই হয়ত তার আত্মা আনন্দলোকের ধ্রুবদীপ্তি দেখতে পেয়েছিল। হয়ত তাই দেখেই বিন্তিদির মন বলে উঠেছিল–বুঝেছি, সব দুঃখের রসহ্য আমি বুঝে ফেলেছি, আর কোনও সংশয় নেই, আর কোনও দ্বিধা নেই। সব সুখ-দুঃখের শেষপ্রান্ত যেখানে গিয়ে মিলেছে, সেখানে গিয়েই আমার হৃদয় অনন্ত দেবতার সন্ধান পাবে। অমৃত যার ছায়া, মৃত্যুও যার ছায়া, তাকে ছাড়া আর কার কথা ভাববো, তাকে ছাড়া আর কার কাছে আশ্রয় চাইবো
তারপরই হয়ত একটা শব্দ হয়েছিল গঙ্গার বুকে।
আর ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে বিন্তিদি হয়ত তার অনন্ত দেবতার কাছেই পৌঁছিয়ে গিয়েছিল শেষপর্যন্ত।
কয়েকজন পুলিস-কনস্টেবল এসে ঢুকলো থানা থেকে। তারা এবার বিন্তিদিকে নিয়ে যাবে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে তাকে নিয়ে।
মা কেঁদে উঠলো–ওগো, তোমরা ওকে কাটা-ছেঁড়া কোর না–
ছিটে বলল-না দিদি, কাটা-ছেঁড়া করবে না, শুধু এগজামিন করে নিয়েই আবার আমাদের মড়া আমাদেরই দিয়ে দেবে–
সত্যিই তো, মাকে কে বোঝাবে যে পুলিসেরও একটা দায়িত্ব আছে, একটা কর্তব্য আছে। কেউ বিষ খাইয়ে মেরে গঙ্গায় ফেলে দিতেও তো পারে! দীপঙ্কর আস্তে গিয়ে মাকে ধরে তুললো। বললে–ঘরে চলো মা, ও আর ভেবে কী হবে! যা হবার হয়ে গেছে–
মা হয়ত বুঝলো। মা তো দীপঙ্করের চেয়েও আরো বেশি দেখেছে। কত মৃত্যু অতিক্রম করে কত দুঃখের সমুদ্র পার হতে হয়–তবেই তো জীবন পূর্ণ হয়ে ওঠে। বহুকাল আগে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে সেই যে এক মহোৎসব শুরু হয়েছে, সেইখানেই তো আমরা এসে নিমন্ত্রিতের মতন দাঁড়িয়েছি। সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা সমস্তই যে সেই মহোৎসবকে কেন্দ্র করে। জীবনের মহোৎসবের নিমন্ত্রণে এসে আমরা কত বিচিত্র স্বাদে কত বিচিত্র রূপে কত অভাবনীয়, কত অনির্বচনীয় চেতনার বিস্ময়ে কতবার আত্মহারা হয়ে উঠবো, তার কি শেষ আছে!
সেদিন সমস্ত রাত মা ঘুমোত পারেনি। সকাল থেকে খায়নি কিছু। তারপর বিকেল থেকেই এই বিপর্যয়। সমস্ত বাড়িটাও এক-সময়ে নিঃঝুম হয়ে উঠলো।
মা-র ঘর থেকে নিজের ঘর এসে দীপঙ্কর নিজেও ঘুমোতে পারলো না। মনে হলো শুধু বিন্তিদির অপমৃত্যুই নয়, শুধু লক্ষ্মীদির অধঃপতনই নয়, সতীর অপমানও নয়, কিছু নয়, এরা যেন সবাই উপলক্ষ! দীপঙ্করের জীবনযাত্রার পথের দু’ধারের সব জঞ্জাল। পথের ধারেই যেন এদের রেখে যেতে হয়–পথের ধারেই এদের সমাধি, পথের ধুলোতেই এদের পরিসমাপ্তি!
কিন্তু পরদিন আর কোনও কথা শুনলো না দীপঙ্কর।
একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে এল নিজেই। মাকেও নিয়ে এসে তুললো গাড়িতে। বললে–এখানে থাকলে আর তুমি বাঁচবে না মা, এখানে থাকলে তোমাকে আর আমি বাঁচাতে পারবো না–
মা-ও যেন আপত্তি করতে পারলে না আর।
ছিটে এল, ফোঁটা এল। তারাও যেন বিন্তিদির ঘটনার পর কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে।
বললে–যাবি? সত্যি সত্যিই যাবি?
দীপঙ্কর বললে–এবার আর বাধা দিও না তোমরা, এরপর এখানে থাকলে মা বাঁচবে না আর
এই বাড়ি থেকে যাওয়া কি এতই সোজা! কথাগুলো বলতে বলতে দীপঙ্করের গলাটাও কেমন বুজে এল। আজ আর তাকে বাধা দেবার কেউ নেই। যারা বাধা দিয়েছিল, সেই ছিটে ফোঁটাও যেন আজ অন্যরকম হয়ে গেছে। তাদেরও আর জোর খাটছে না যেন। কিন্তু দীপঙ্করের মনে হলো ছিটে-ফোঁটা বাধা দিলেই যেন ভালো হতো। যেন একটু বাধা দিলেই দীপঙ্কর থেকে যায় এখানে। এই ছোটবেলা থেকে এত বড় হওয়ার স্মৃতি-জড়ানো বাড়িটাতে।
দীপঙ্কর বলতে লাগলো-এখানে থাকবো বলেই তো ঠিক করেছিলাম, কিন্তু এরপর থাকি কী করে তোমরাই বলো?
কই, কিছু তো বলছে না ছিটে-ফোঁটা। কই, আগের বারের মতন তো টেনে নামিয়ে নিচ্ছে না গাড়ি থেকে! কেন ওরা প্রতিবাদ করছে না। কেন বলছে না–কী হবে গিয়ে? থাক্ না এখানে। থাকতে থাকতে সব সয়ে যাবে। আবার নতুন পাড়ায় গিয়ে, নতুন জায়গায় ভালো লাগানো শক্ত! গঙ্গা দূর হয়ে যাবে। লাভ কী গিয়ে!
দীপঙ্কর বললে–পুলিস থেকে যা বলে, আমি খবর নেব’খন, আর অঘোরদাদুর শ্রাদ্ধতেও আমি আসবো, তোমরা কিছু ভেবো না
মা এতক্ষণে কথা বললে। বললে–চন্নুনীর সঙ্গে আর দেখা করলুম না বাছা, তোমরা বলে দিও আমি চলে গেছি–
তখনও কেউ কিছু বলছে না। ছিটে-ফোঁটা যে অত দুর্দান্ত লোক, তারাও যেন মনে মনে চাইছে দীপঙ্কর চলেই যাক। দীপঙ্কর এখান থেকে দূর হয়ে যাক। আশ্চর্য! এই রকমই বোধহয় হয় সংসারে। এইটেই বোধহয় স্বাভাবিক! দীপিঙ্করের মনে হলো তারা যেন তাকে তাড়িয়েই দিচ্ছে বাড়ি থেকে। ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দিচ্ছে। একবার বলুক না ওরা, শুধু আর একটি বার থাকতে বলুক না। তাহলে তো আর দীপঙ্কর যায় না। এতদিনের পাতা সংসার ছেড়ে আবার নতুন করে তাহলে সংসার পাততে হয় না। বলুক না সেই কথাটা। বলুক না যে চলে গেলে তারা কষ্ট পাবে!
–কী বললে?
মনে হলো যেন কী বললে তারা।
ছিটে বললে–না কিছু বলিনি–
দীপঙ্কর বললে–তাহলে আসি?
তারপর পাঞ্জাবী ট্যাক্সি-ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলে। পাড়ার দু-একজন ভদ্রলোক অত ভোরে উঠে এসে দেখছিল। তারাও কিছু বলতে পারলে না। তাদের সকলের চোখের সামনে স্নেহ-প্রীতির সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে দীপঙ্কর চলতে লাগলো।
মনে আছে পরে গাঙ্গুলীবাবু শুনে বলেছিলেন–কেন? আপনার কষ্ট হলো কেন?
দীপঙ্কর বলেছিল–কী জানি, আমার মনে হলো ওরা যেন আমায় তাড়িয়ে দিলে মশাই! আমাকে আর একবার বললেই আমি গাড়ি থেকে নেমে ওই বাড়িতেই থাকতুম, আর যেতুম না কখনও
আশ্চর্য! এইরকম মানুষই দীপঙ্কর। যেখানে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেখানে সম্পর্কটা চিরস্থায়ী করতে না পারলে যেন বুকের মধ্যে কষ্ট হয়, বেদনা হয়। অথচ মুখে বললে সে-কষ্টটার কথা কেউ বুঝতে পারে না। সবাই ভাবে এও এক ছলনা বুঝি দীপঙ্করের। এও একরকম মিথ্যাচার।
দীপঙ্কর বললে–অথচ দেখুন, এতদিন কেটে গেল, আর একদিনের জন্যেও যাইনি ও-বাড়িতে। সেই বিন্তিদির শেষপর্যন্ত কী হলো, অঘোরদাদুর শ্রাদ্ধই বা কী রকম হলো, তা-ও দেখতে যাইনি!
ছিটে নিজে নতুন ঠিকানায় নেমন্তন্ন করতে এসেছিল। বলেছিল–যাস্ কিন্তু ঠিক, খুব ঘটা করছি–সাত শো লোক খাবে–দিদিকে নিয়ে যাস–
ছিটে-ফেঁটা দুজনেই একটা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি বাড়ি নেমন্তন্ন করে বেড়াচ্ছে।
বললে–মোল্লার চকের দই অর্ডার দিয়েছি। আর দত্তপুকুর থেকে ছানা আসছে আর সোমবার দিন জ্ঞাতৃভোজন, বারাসত থেকে তিন-মণ পোনা মাছ আসছে, পোনা মাছের কালিয়া আর খাসীর মাংস করবো-কেমন হবে বল তো?
দীপঙ্কর ফিরিস্তি শুনে যাচ্ছিল। বললে–ভালোই তো–
ছিটে বললে–শ্রাদ্ধের দিন ছানার ডালনা আর ধোকার তরকারি করছি, আর দই সন্দেশ, রাবড়ি আর শেষকালে একটা করে ল্যাংড়া আম–কেমন হবে?
দীপঙ্কর এ-কথারও কোনও উত্তর দিলে না।
ছিটে বললে–কী রে, কথা বলছিস না কেন, বল কেমন আইটেম্ করছি–
দীপঙ্কর বললে–আমি আর কী বলবো, ভালোই তো!
ছিটে বললে–সবাই বলছে এত খরচ করবার দরকার কী?
দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ, আমিও তো তাই বলছি তোমাদের–
ছিটে বললে–না রে, তুই জানিস না, শালারা বলবার সময় ওই কথা বলবে, কিন্তু খারাপ খেতে দিলে আড়ালে ঠুকবে। বলবে-নাতি দুটো ঠাকুর্দার শ্রাদ্ধে একটা পয়সা খরচ করলে না। এ শালার ভদ্দরলোকদের আমি খুব চিনে নিয়েছি, জানিস, এর চেয়ে ছোটলোক শালারা ভালো, তারা নুন খাবে গুণও গাইবে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–আর বিন্তিদির শেষপর্যন্ত কী হলো?
–কী আর হবে, তুই তো গেলিনে, আমকেই সব করতে হলো! টাকা ছাড়লুম, সব ঠিক হয়ে গেল!
–কীসের টাকা? টাকা কেন?
ছিটে বললে–টাকা লাগবে না? তুই বলছিস কী? টাকা না দিলে লাস দেবে কেন আমাদের?
দীপঙ্কর কেমন অবাক হয়ে গেল। এতেও টাকা? চেঁচে থাকলেও টাকা মৃত্যুতেও টাকা! লাস তো পাওয়া গিয়েছিল লক-গেটে-এর ভেতর। বিন্তিদি ভাসতে ভাসতে একেবারে চেতলার মাটি-কাটা খালের লক-গেটে গিয়ে আটকে ছিল। সেইখান থেকে পুলিস প্রথম আবিষ্কার করে বিন্তিদিকে। শাড়িটা ভেসে উঠেছিল জলের ওপরে। যারা ভোরবেলা বেড়াতে বেরোয়, তাদের নজরেই প্রথমে জিনিসটা পড়ে। কী যেন একটা ভাসছে। মেয়েমানুষের শাড়ি এখানে ভাসছে কেন? তারপর ভিড় জমে যায় ব্যাপারটা দেখতে। তারাই খবরটা দেয় আলিপুর থানায়। তারা ডোম নিয়ে এসে লাস তোলে। তারপর খোঁজখবর করতে করতে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ঠিকানাটা বেরিয়ে পড়ে। সেখান থেকেও একটা মেয়ের নিরুদ্দেশ হবার খবর ভবানীপুর থানায় ডায়েরী করে গিয়েছিল। সোজা কে ঘোরপ্যাঁচ নেই এর মধ্যে! তবু টাকা লাগছে কেন?
ছিটে বললে–তা বললে শুনবে কে? শেষকালে দিলুম নাকের ওপর পাঁচটা টাকা ফেলে-তারপর একেবারে জল! সেই লাস নিয়ে ক্যাওড়াতলায় গিয়ে পুড়িয়ে এলুম
কী সহজ সরলভাবে কথাগুলো বলে গেল ছিটে! বললেও নিয়ে আর ভাবি না বুঝলি, কপালে গচ্চা লেখা ছিল, গাঁট-গচ্চাকে খণ্ডাবে বল?
তারপর একটু থেমে বললে–আর গচ্চা কি আজ প্রথম দিলুম রে, সারা জীবনটা তো গচ্চা দিতে দিতে গেল কেবল–সেইজন্যেই তো কংগ্রেসের মেম্বার হয়ে গেছি
–সে কি? কংগ্রেসের মেম্বার হয়েছ তুমি?
ছিটে হাসলো দাঁত বার করে। বললে–শুধু আমি নই, ফোঁটাও হয়েছে-তোদের মাস্টার প্রাণমথবাবুর কাছে গিয়ে চার আনা চাঁদা দিয়ে জয়-মা-কালী বলে মেম্বার হয়ে গেছি।
দীপঙ্কর বললে–তাহলে তো জেল খাটতে হবে?
–তা খাটবো, জেলই খাটবো, জেল খাটতে পেছুপাও নয় ছিটে-ফোঁটা, জেল তো এমনিতেই খাটছি, না-হয় ওমনিতেই খাটবো!
–কিন্তু, কংগ্রেসের মেম্বার হয়ে সুবিধেটা কী হবে তোমার?
ছিটে বললে–আরে দ্যাখ না, নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে ঘরে বসে মাল খাবো, তাতেও ঘুষ দিতে হবে–এ কী রাজত্বে বাস করছি বল্ দিকিনি আমরা! এ শালার স্বরাজ হলে ঘুষ থেকে তা অন্তত বাচবো! আমরা তো সুভাষ বোসের সঙ্গে এক-হাজতে কাটিয়েছি। ও জে এম সেনগুপ্তের দলের লোকেরা যা-ই বলুক লোকটা মাইরি সচ্চা লোক, স্বরাজ হলে আর যাই হোক ঘুষ তো আর দিতে হবে না–
কথা বলতে বলতে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ যেন খেয়াল হলো। বললে যাই, অনেক জায়গায় আবার ঘূরতে হবে-তা তুই যাস কিন্তু, দিদিকে নিয়ে যাস–
বলে উঠলো ছিটে। বাড়িটার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে দেখলে এদিক-ওদিক। বললে– কত ভাড়া দিস্ বাড়ির? কুড়ি টাকা?
দীপঙ্কর বললো—হ্যাঁ–
ছিটে বললে–কুড়ি টাকা? ভাড়াটা একটু বেশি, তা যাই হোক, স্বরাজ হলে এই বাড়ির ভাড়া দশ টাকা করে দেব আমরা,-শালা ইংরেজরা না গেলে আর ভদ্দরলোকদের বেঁচে থেকে সুখ নেই–যাই–
বলে গাড়িতে উঠে চলে গেল ছিটে-ফোঁটা!
শেষ পর্যন্ত হয়ত শ্রাদ্ধাবাড়িতে যেত দীপঙ্কর। একবার ইচ্ছেও হয়েছিল। অনেক দিনের সম্পর্ক। অনেক কিছু দিয়েছিল অঘোরদাদু! বলতে গেলে অঘোরদাদু না থাকলে হয়ত বড় হওয়াই হতো না শেষ পর্যন্ত। হয়ত সেই দু’মাস বয়সেই জীবন-লীলা ফুরিয়ে যেত দীপঙ্করের। মানুষটার মনের কোণে যতটুকু স্নেহ-প্রীতিই থাক, সবটুকু পেয়েছিল শুধু দীপঙ্কর একলা। আর কেউ নয়। সেই তার আত্মার সদ্গতির জন্যে অন্তত দীপঙ্করের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সকাল বেলাই একটা কাণ্ড হলো।
প্রতিদিন সকালে উঠে বাজার করে নিয়ে এসে দীপঙ্কর আপিসে চলে যেত ভাত খেয়ে। ছোটখাটো সংসার। বলতে গেরে দুজনের সংসার। মা যে সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন থেকে চলে এসেছে, তারপর থেকে যেন অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিল। যেন কথা কমে গিয়েছিল মুখে। এত সাধ ছিল মা’র, এত কল্পনা। কতদিন থেকে আকাঙ্খ ছিল ছেলে নিজে একটি বাড়ি ভাড়া করবে–আর মা হবে সেই সংসারের গৃহিণী। পরের বাড়ির রান্নার হাত থেকে মা বাঁচবে। মা ভেবেছিল তাতেই বুঝি স্বর্গ-সুখ। তাতেই বুঝি সমস্ত কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পাবে মা। কিন্তু দীপঙ্করও লক্ষ্য করে অবাক হয়ে গেল–মা যেন চুপ করে কী ভাবে একলা-একলা। মা যেন নিজের জীবনের ভারে দিন দিন নুইয়ে পড়ছিল।
সেই ছোটবেলাকার মতন দীপঙ্কর মার কাছে আপিস থেকে এসে বলতো-মা, কী হয়েছে তোমার?
মা বলতোকই কিছু হয়নি তো!
–তবে? এ-পাড়াটা কি খারাপ লাগছে তোমার?
–না খারাপ লাগবে কেন?
পুবদিকের রেললাইনের ওপারে কচুরিপানা ভর্তি সার-সার পুকুর। আর আশে পাশে কয়েকটা চালাঘর। পাশেই রেলওয়ে ডস্ শেড়। ওয়াগন থেকে মাল নামে ইয়ার্ডে। সেখান থেকে শেড়-এর ভেতরে ওঠে! পুবদিকের বারান্দায় দাঁড়ালে স্পষ্ট রেলের কাজকর্ম দেখা যায়। এতদিন রেলের চাকরি করছে দীপঙ্কর, অথচ নিজের চোখে রেলগাড়ি দেখবার সুযোগ কবারই বা হয়েছে? মা’র কত সাধ ছিল ছেলে রেলের চাকরি করলে ছেলের পাসে তীর্থ দর্শন করবে। কাশী গয়া বৃন্দাবন যাবে। কিন্তু এতদিন অঘোরদাদুর জন্যে কোথাও যাওয়া হয়নি। কার ওপর অঘোরদাদুর ভার দিয়ে যাবে! বিন্তিদিই বা কার কাছে থাকবে। কিন্তু এখন? এখন তো আর কোনও বন্ধন নেই, এখন তো আর বাধা দেবার কেউ নেই।
–একবার কোথাও যাবে মা? তুমি যে কত বলতে তীর্থ করবার কথা।
মা বলতোনা বাবা, কোনও তীর্থের দরকার নেই আমার, তুই-ই আমার তীর্থ, তুই-ই আমার কাশী গয়া
আশ্চর্য! অঘোরদাদুর বাড়িতে রান্না করতে করতে কতদিন অনুযোগ করেছে অভিযোগ করেছে মা। চিরকাল রান্না করতে পারবে না বলে কত বক বক করেছে মা চন্নুনীর কাছে। অথচ আজও নিজের হাতে রান্না করতে মা’র এতটুকু কান্তি নেই।
দীপঙ্কর বলেছিল–একজন লোক বরং রাখি, সেই রাঁধবে, তুমি বরং জপ তপ আহ্নিক নিয়ে থাকো–
মা বলেছেনা বাবা, রাঁধতে আমার কষ্ট নেই–
–কিন্তু এমন করে সারাজীবনই কি তুমি ভাত বেঁধে যাবে কেবল?
মা বলেছি–আমি মরলে তুই বরং ঠাকুর রাখিস্ একটা–
অঘোরদাদু আর বিন্তিদির মৃত্যুর পর থেকেই কেমন যেন হয়ে গেছে মা। অর্থাৎ এ-বাড়িতে আসবার পর থেকেই যেন মা অন্যরকম হয়ে গেছে। সকালবেলাই কলে জল আসে। সেই অত ভোরেই মা চান করে নেয়। তারপর উনুনে আগুন দিয়ে ঠিক আগেকার মত ভাত চড়িয়ে দেয়। দীপঙ্কর তখন চাকরটাকে নিয়ে বাজারে চলে গেছে। নতুন চাকর। ছোট ছেলে। মেদিনীপুর না কাঁথি–কোথায় যেন বাড়ি।
দীপঙ্কর ডাকে—কাশী—
কাশী এসে দাঁড়ায় বাজারের ঝাড়ন নিয়ে।
দীপঙ্কর বলে–তোর আসল নামটা কী রে? কাশীনাথ না কাশীশ্বর না কাশীপতি?
কাশী হাসে। বলে–শুধু কাশী–
–শুধু কাশী কি রে। শুধু কাশী কারো নাম হয়!
–আজ্ঞে হ্যাঁ, শুধু কাশী!
ছেলেটার বাপও নেই, মাও নেই। দীপঙ্করের চেয়েও দুঃস্থ। দীপঙ্করের চেয়েও অনাথ। কাশীকে দেখে দীপঙ্করের নিজের কথাই মনে পড়ে। কাশীর মতই দীপঙ্কর একদিন নিঃস্ব ছিল, সহায়সম্বলহীন ছিল, অনাথ ছিল। তফাৎ শুধু দীপঙ্করের মা ছিল, কাশীর মা নেই।
সংসারের কাজে ঝঞ্ঝাট ঝামেলা থাকেই। ঝাট ছাড়া সংসার হয় না, মাঝে মাঝে মা-ও কাশীকে বকে। মা-ও মেজাজ খারাপ করে। বলে-বসে তো আছিস, বলি ততক্ষণে ঘরগুলো ঝাট দিতে পারিস না–
তারপর আবার হয়ত মা রান্নঘর থেকে ডাকে–কাশী, ও কাশী–
কাশীর কোথাও সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না। হঠাৎ কখন কোথায় যে থাকে, তারও ঠিক থাকে না। ছোট ছেলে, হয়ত বাইরে দোকান থেকে কিছু আনতে গেছে। তারপর রাস্তায় কিছু মজা দেখে সেখানেই জমে গেছে। যখন বাড়িতে এল, তখন মা’র উনুন কামাই যাচ্ছে। কাশী আসতেই মা ঝাঁজিয়ে উঠলো-কোথায় গেছলি রে তুই, গেছলি কোথায় বল?
কাশী বলে–আমি তো দোকান থেকে সরষের তেল আনতে গিয়েছিলাম–
সরষের তেল আনবার কথা মা ভুলে গিয়েছিল। তবু দমলো না মা। বললে সরষের তেল আনতে গিয়েছিলি-তা এতক্ষণ? এই এক ঘণ্টা? মাইনে দেওয়া হচ্ছে না তোমাকে? ছটাকা যে মাইনে দেওয়া হচ্ছে তোমায়, সে কি মুখ দেখে?
এক-এক সময় মা’র বকুনি দেখে দীপঙ্করও অবাক হয়ে যেত। এমন তো ছিল না মা। এমন মেজাজ তো মার ছিল না আগে! একদিন মা-ই ছিল অঘোরদাদুর বাড়িতে আশ্রিতা, আজ মা-ই হয়েছে মালিক। একদিন মা’র দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন অঘোরদাদু, আজ মা-ই হয়েছে আবার কাশীর দণ্ডমুণ্ডের মালিক। মালিক হলেই কি এমনি হতে হয়। ঘরের ভেতরে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দীপঙ্কর অন্যমনস্ক হয়ে যায়। লুকিয়ে লুকিয়ে কাশীর মুখখানার দিকে চেয়ে দেখে মুখটা কেমন ম্লান হয়ে গেছে। শুকিয়ে গেছে চেহারাটা বকুনি খেয়ে। আহা! কেউ ওকে লেখাপড়া শেখায়নি। ওকে লেখাপড়া শেখাবার কেউ নেই। অঘোরদাদু দীপঙ্করকে লেখাপড়ার খরচ দিয়েছিল তাই দীপঙ্করের লেখাপড়া হয়েছে। চাকরি হয়েছে। কাশীকে দেখে দীপঙ্করের নিজের কথাই বার বার মনে পড়ে যায়। অঘোরদাদু না থাকলে তাকেও তো এইরকম কাশীর মতন পরের বাড়িতে চাকরের কাজ করে পেট চালাতে হতো। তাতে আর কাশীতে তফাৎ কী! দীপঙ্কর–হয় মোটা মাইনে পায়, কিন্তু তাতে কী!
মা ধমক দিয়ে বলে-কোন কম্মে আছো তুমি শুনি? বাবুর জুতোটায় একটু রং দিতে পারো না? কেবল খাবার কুমীর?
তাড়াতাড়ি রং আর বরুশটা নিয়ে কাশী পায়ের সামনে বসে জুতো রং করতে লেগে যায়।
মাঝে মাঝে দীপঙ্করের মনে হয় মাকে একটু বুঝিয়ে বলে। বুঝিয়ে বলে যে-মা, ও ও তো মানুষ, ওরও তো একটু বিশ্রাম দরকার, ওরও তো একটু খেলা করতে ভালো লাগে, ও-ও তো আমার মত অনাথ–
কিন্তু বলতে গিয়েও থেমে যায়। দরকার নেই। এতদিন পরে মা একটু কর্তৃত্ব করতে পেরেছে, এতদিন পরে অন্তত একজনের ওপরেও নিজের মালিকানা আরোপ করতে পেরেছে। বললে হয়ত মা সব কথা বুঝবে না। সারা জীবন মা পরের কর্তৃত্ব মেনেই চলেছে, পরের খেয়াল-খুশির তাঁবেদারি করে চলেছে, এই এতদিন পরে মুক্তি হয়েছে মা’র, মা যদি কাশীকে একটু বকেই, তাতেই বা কী! দীপঙ্কর চোখ-কান বুজে থাকলেই পারে। কিন্তু পৃথিবীর সবদিকে চোখ-কান খোলা রাখা যার স্বভাব, সে কেমন করে সব দেখেও চুপ করে থাকতে পারবে!
আড়ালে কাশীকে ডেকে বলে–হ্যাঁরে, কাশী, তোর কষ্ট হচ্ছে?
–না বাবু, কিসের কষ্ট!
কাশী বুঝতে পারে না। দীপঙ্করের মত নরম মন নয় বলেই হয়ত কষ্ট বোধটা তার এত তীব্র নয়। কিন্তু কষ্ট যা, তা কষ্টই। বোধ থাকুক, আর না-থাকুক। শীতে কাশী হি হি করে কাঁপলে দীপঙ্করেরই যেন শীত করে, বর্ষায় বেশি ভিজলে দীপঙ্করেরই যেন গা শপু-শপ করে। কাশীর কষ্ট দেখলে দীপঙ্করের নিজেরই কষ্ট হয় যেন। দীপঙ্করের কেমন মায়া হয় কাশীটার জন্যে। লুকিয়ে লুকিয়ে গেঞ্জি কিনে এনে দেয় কাশীকে। বলে–নে। পর এটা–
তারপর চুপি চুপি বলে-মাকে যেন বলিস নি আমি দিয়েছি এটা—
তারপর ঘরে নিয়ে বলে–দ্যাখ, একটা কথা শোন–
কাশী বুঝতে পারে না দাদাবাবু কী বলবে। কাছে এসে দাঁড়ায় একটু ভয়ও হয় বুঝি তার।
দীপঙ্কর বলে-দ্যাখ, মা যদি তোকে বকে, তুই যেন কিছু মনে করিস নি, মা’র তো বয়েস হয়েছে, বুড়ো মানুষ তো, একটু বকলে তোর ক্ষতি কী, বুঝলি?
কাশী মাথা নাড়ে।
–আর দ্যাখ, মা যদি তোকে পেট ভরে খেতে না দেয় তো আমাকে বলবি, বুঝলি! আমি তোকে পয়সা দেব, দোকান থেকে খেয়ে আসিস-বুঝলি? বুঝলি তো?
কাশী আশ্বাস পেয়ে চলে যায়। কিন্তু দীপঙ্করের মনে হয় এ-ও যেন স্বার্থপরতা! এ ও আর এক রকমের স্বার্থপরতা! কাশীর ভাল করাটা যেন উপলক্ষ। আসলে দীপঙ্কর নিজের স্বার্থেই কাশীকে সন্তুষ্ট করতে চায় কাশী চলে গেলে তো তারই ক্ষতি! তার মায়েরই ক্ষতি! কাশী চলে গেলে তো দীপঙ্করকে নিজেকেই দোকানে ছুটতে হবে, বাজারে ছুটতে হবে। কিন্তু আসলে সে কাশীর ভালো চায়, না নিজের ভাল চায়? নিজের আরাম চায় বলেই তো কাশীকে এত ভালবাসে দীপঙ্কর। ভালবাসার ভান করে। আসলে দীপঙ্কর তো ভাল নয়–স্বার্থপর, ভণ্ড, শয়তান। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে কাশীর কাছেও ভালোমানুষ সাজে সে। ভাবতে ভাবতে আবার কেমন ঝিমিয়ে পড়ে দীপঙ্কর। আবার আপিস গিয়ে খানিকক্ষণ নিস্তেজ হয়ে বসে থাকে। সে ক’দিন কিছুই ভালো লাগে না। সমস্তক্ষণ কেবল মনে হয়, সে ফরসা জামা-কাপড় পরে ভদ্রলোক সেজে বেড়াচ্ছে– আসলে সে নীচু, সে হীন, সে পশু!
৩৮
সেদিন সকালবেলাই কাণ্ডটা ঘটলো। একটা থার্ড ক্লাস ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে–
কাশী সদর দরজা খুলে দিলে। বললে–হ্যাঁ, এই বাড়িতেই থাকেন–
আর কথাবার্তা নেই। দীপঙ্কর তখন জামা-কাপড় পরে আপিস যাবার জন্যে তৈরি। নতুন এজেন্ট এসেছে আপিসে। আজকাল ঘন-ঘন ডাক আসে ক্রফোর্ড সাহেবের কাছে। মিস্টার ঘোষালের মত লোকও ব্যস্ত হয়ে ছুটাছুটি করে। দিল্লী থেকে এক-একটা জরুরী চিঠি আসে, আর আপিসসুদ্ধ তোলপাড় পড়ে যায়। নতুন সাইডিং হবে কোথায়, কোথায় নাইটি পাউন্ড রেললাইন তুলে একশো কুড়ি পাউন্ড করা হবে, তারই জোর তলব। একটু দেরি হলে চলবে না। মিস মাইকেলেরও কাজ বেড়ে গেছে। ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার, চীফ ইঞ্জিনিয়ার, ট্রাফিক সুপারিন্টেন্ডেন্ট, সবাই মিলে মিটিং হয়। তারপর দু-তিন দিন একসঙ্গে কনফারেন্স করে চিঠি ড্রাফট করতে হয়। কিন্তু একটা ঝঞ্ঝাট মিটতে-না মিটতে আর-একটা ঝঞ্ঝাট এসে হাজির হয়। তখন আবার মিটিং আবার কনফারেন্স!
মিটিং-এ কিছু কথা উঠলেই রবিনসন সাহেব বলে-অল রাইট, সেন ক্যান ডু ইট সেন সব পারে!
তারপর সেনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় কাজ। কত ওয়াগন ডক্-এ হ্যান্ডওভার করা হয় রোজ, তার স্টেটমেন্ট তৈরি করতে হবে। সেন তৈরি করবে। লাস্ট ইয়ারে কত ওয়াগন ডেলিভারি হয়েছে, আর এ-বছরে এই ছ’মাসে কত হয়েছে, তার নিখুঁত হিসেব চাই। এক দিনের মধ্যে।
চীফ ইঞ্জিনীয়ার বলে–ট্রিট দিস্ য়্যাজ মোস্ট আর্জেন্ট–
দীপঙ্কর রামলিঙ্গমবাবুকে ডেকে পাঠায়। রামলিঙ্গমবাবু বলে-এ-কাজ আজকের মধ্যে কী করে হবে স্যার? এখন তো তিনটে বেজেছে–
দীপঙ্কর বলে–কী করবো বলুন, বোর্ডের রিপ্লাই কাল পাঠাতেই হবে–
রামলিঙ্গমবাবুকে কিছু না-বলে নিজের সেকশানে গিয়ে বলে–আজ কেউ পাঁচটার সময় বাড়ি যেতে পারবে না-বীরেশবাবু, পঞ্চাননবাবু, কালীপদবাবু, সব এখানে আসুন–
–কেন?
–সেন-সাহেবের অর্ডার। এই স্টেটমেন্ট তৈরি করে তবে যাবে সবাই।
সবাই ফোঁস করে উঠলো। তার মানে? পাঁচটা তেইশের পাঁশকুড়া লোক্যাল ছাড়লে কোন ট্রেনে বাড়ি যাবো শুনি? ছ’টা ছাপ্পান্ন? ছটা ছাপ্পান্নয় গেলে বাড়ি পৌঁছাতে তো সেই যার নাম রাত নটা। তারপর খরচপাতি নেই–বাড়ির লোক ভাববে না? তাছাড়া আপিসে চাকরি করতে এসেছি বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি সাহেবরা? এই বেলা তিনটের সময় দেড় বছরের পুরোন স্টেটমেন্ট তৈরি করতে হবে! সাহেবদের কী! তাদের তো সংসার দেখতে হয় না, তাদের তো বাজার করতে হয় না। তারা বুঝবে কী করে আমাদের জ্বালাটা!
–তাহলে আপনারা সেন-সাহেবকে বলুন গিয়ে, আমি কী করবো!
–হ্যাঁ, যাবো তো, এখখুনি গিয়ে বলবো।
কিন্তু আশ্চর্য, কেউ সেন-সাহেবের কাছে যায় না। কারোরই সাহেবের সামনে গিয়ে বলবার সাহস নেই। মাথা গুঁজে স্টেটমেন্ট তৈরি করে। বকেয়া কাজ ফেলে রেখে সেকশানসুদ্ধ লোক স্টেটমেন্ট নিয়ে বসে। পুরোন এক বছর দেড় বছর আগেকার সব ফাইল। ধুলো ময়লা জমেছে। ধুলো ঘাঁটতে ঘাটতে বাবুদের জামা-কাপড়, ধুতি-শার্ট ধুলোয়-ধুলো হয়ে যায়।
ওদিক থেকে ক্রফোর্ড সাহেব তাগাদা দেয়-ইজ ইট রেডি সেন? এত দেরি হচ্ছে কেন?
সাহেবদের ঘরে টি আসে, কফি আসে স্ন্যাক্স আসে আর মিটিং বসে। তারপর এক সময়ে আর ধৈর্য থাকে না কারো। সাহেবরা চলে যায়। পরের দিন আর্লি আওয়ার্সে এসে যেন সব রেডি থাকে। তখন পেলেই চলবে। কিন্তু সেকশানে পুরোদমে তখন কাজ চলছে। সন্ধ্যে ছ’টা বাজলো, সাতটা বাজলো। রাত আটটা বাজলো।
হঠাৎ রামলিঙ্গমবাবু ঘরে ঢুকলেন আবার। হাতে একটা দশ টাকার নোট।
বললেন–সেন-সাহেব মিষ্টি খেতে দিয়েছে আপনাদের, এই নিন–
এত যে রাগ, এত যে গজগজানি, সব জল হয়ে গেল দশ টাকার ঘুষ পেয়ে। বাবুদের মুখে হাসি ফুটলো। চাপরাশী দশ টাকার সিঙাড়া, কচুরি, নিমকি, রসগোল্লা, চা নিয়ে এল সেই রাত আটটার সময়। বাবুরা গপ গপ করে গিলতে লাগলো সেই ঘুষ। দশ টাকার ঘুষ দিয়ে দীপঙ্কর সেকশানের বাবুদের কিনে নিলে। রাতারাতি ভালো হয়ে গেল মানুষটা। রাতারাতি দেবতা হয়ে গেল দীপঙ্কর সেন। রাত ন’টার সময় সেই স্টেটমেন্ট তৈরি করে বাবুরা লাফাতে লাফাতে বাড়ি চলে গেল। কিন্তু যে-স্টেটমেন্টের জন্যে এত চা, কফি, সিঙারা, কচুরি খরচ হলো, সেই স্টেটমেন্টই আর দরকার হলো না। পরদিনই বোর্ড থেকে টেলিগ্রাম এল প্রোজেক্ট ক্যানসেলড়! লেটার ফলোজ!
এমনি করেই রোজ একটা-না-একটা হুলস্থুল কাণ্ড বাধে। তখন মনে হয় দিন বুঝি আর কাটবে না–চাকরি বুঝি আর টিকবে না। তারপর আবার সব ঠিক হয়ে যায়। আবার ঢিমেতালে চলে আপিস। আবার হৃদয় চাপরাশী পাঠার চপ আর ঘুগনি নিয়ে ঘরে-ঘরে ফিরি করে বেড়ায়। আবার রবিনসন সাহেবের কুকুরের অসুখ করে। আবার রেকর্ড সেকশান থেকে একটা চিঠি ট্রানজিট সেকশানে আসতে চৌদ্দ দিন লাগে। আবার সকলের তলব পড়ে সাহেবের ঘরে। আবার বোর্ড থেকে জরুরী চিঠি আসে। আবার মিটিং আবার কনফারেন্স। আবার চা, সিঙ্গাড়া, কচুরি, রসগোল্লা ঘুষ দিতে হয়। আবার বাবুরা খুশী হয়।
এমনি করেই চলছিল। এমনি করেই হয়ত বরাবর চলবে আপিসের কাজ! তবু নতুন এজেন্ট আসার পর আবার আপিসে সাজ-সাজ রব পড়ে গেছে। হাঁক-ডাক শুরু হয়েছে।
সেদিন তাড়াতাড়িই আপিস যাচ্ছিল দীপঙ্কর। হঠাৎ কাশী বললে–ঘোড়ার গাড়িতে একজন বাবু এসেছে–
–বাবু! কে বাবু?
কাশী বললে–সঙ্গে একজন মেয়েমানুষও আছে–
ততক্ষণে ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া চুকিয়ে দিয়েছে ভদ্রলোক। তিন টাকা ভাড়া হয়েছিল হাওয়া স্টেশন থেকে কালীঘাট। কালীঘাট ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন পর্যন্ত। কিন্তু সেখান থেকে ঠিকানা নিয়ে আবার এই জায়গা পর্যন্ত আসতে হয়েছে।
ভদ্রলোকের সঙ্গে ঝগড়া বেধে গেল গাড়োয়ানের। বললে–সাড়ে তিন টাকা দিচ্ছি, তবু হবে না? আমাকে কি পাড়াগেঁয়ে লোক পেয়েছ? নেবার হয় নাও, নয়তো চলে যাও, আমি আর একটি পয়সা দেব না–
গাড়োয়ান বললে–পুরোপুরি চার টাকা না দিলে আমি যাবো না বাবু, চার টাকাই দিতে হবে, অনেক ঘুরেছি–
–এ তো দেখছি মহা জ্বালা হলো!
তারপর পাশের দিকে চেয়ে বললে–ওরে ক্ষিরি, তুই যা। তুই বাড়ির ভেতরে যা দিকি–তোর জ্যাঠাইমাকে গিয়ে বল তো গাড়োয়ান ঝামেলা করছে বড়–
দীপঙ্করের মা এসে অবাক! এ কে? এরা কারা?
ভদ্রলোক কিন্তু এক নিমেষেই চিনতে পেরেছে। বললে–আমায় চিনতে পারছে না বৌদি, আমি সন্তোষ
সন্তোষ! তবু চিনতে পারলে না মা। ঘোমটাটা আরো একটু টেনে দিলে মুখের ওপর। ভদ্রলোকের গায়ে ছিটের শার্ট। পায়ে ডার্বি জুতো। উঁচু কাপড়। হাঁটু পর্যন্ত ধুলো। আর পাশে একটি ফুটফুটে মেয়ে। মাথায় বেড়াবিনুনী খোঁপা। একটা কাঁচপোকার টিপ্ কপালে। একটা ডুরে শাড়ি পরেছে। পায়ে আলতা।
সন্তোষ বললে–-ওরে ক্ষিরি, তোর জ্যাঠাইমাকে পেন্নাম কর-পেন্নাম করতেও শিখিয়ে দিতে হবে?
–থাক্, থাক্, বাছা—
চিবুকে হাত দিয়ে মা একবার ঠোঁটে ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করলে।
সন্তোষ বললে–যাই বলল বৌদি, তোমাদের কলকাতার গাড়োয়ানরা কিন্তু বড় বদমাইশ, তিন টাকায় রফা হলো, আমি আট গণ্ডা পয়সা বকশিশ দিচ্ছি, তাতেও খুশী নয়–
বলে চামড়ার ব্যাগ বার করে পুরোপুরি চারটে টাকাই দিলে। তারপর বললে তোমার চাকরটাকে বলো না বৌদি, মালগুলো নামিয়ে নিক–
মাল মানে টিনের তোরঙ্গ একটা আর একটা পাকা কুমড়ো আর কয়েকটা ঝুনো নারকোল। কাশী কাছেই দাঁড়িয়েছিল। সে নামিয়ে নিলে ট্রাঙ্কটা আর পুঁটলিটা।
সন্তোষ বাড়ির মধ্যে ঢুকে বললে–আমাকে তুমি চিনতে পারোনি বৌদি ঠিক
সত্যিই মা তখনও চিনতে পারেনি।
সন্তোষ বললে–কে বল তো?
মা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। সন্তোষ বললে–সে কি আজকের কথা বৌদি, সম্পর্ক তো রাখলে না আর দেশের সঙ্গে! ভাবলাম বৌদি যদি সম্পর্ক নাই রাখে তো আমরা রাখবো না কেন? তাই ক্ষিরিকে নিয়ে চলে এলাম রেলে চড়ে
মা বললে–রসুলপুরের সন্তোষ তুমি?
–দেখ দিকিনি! এতক্ষণ লাগলো চিনতে! তবু যা হোক চিনতে পারলে এই-ই যথেষ্ট
মা বললে–তা এই তোমার মেয়ে নাকি?
সন্তোষ বললে–মেয়ে নয় বৌদি, গলার কাঁটা
–তা আমার জা কোথায়? জা-কে নিয়ে এলে না যে?
সন্তোষ বললে–জা কি আর আছে বৌদি! এই গলার কাঁটাকে রেখে পালিয়েছে। আমাকে জ্বালাতে–
–সে কি! এই এতটুকু দেখেছি তোমাকে সন্তোষ, কবেই বা বিয়ে করলে, আর কবেই বা মেয়ে হলো, কিছুই জানি না।
সন্তোষ বললে–দিন যে হু-হুঁ করে যাচ্ছে বৌদি, দিন কি কারো জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে! তা বেশ বাড়ি তোমার বৌদি, ভাবলাম কলকাতায় গিয়ে তবু একটা ওঠবার জায়গা হলো, কী দিনকাল যে পড়েছে! তা পা ধোবার জল কোথায় বলে দিকিনি-কাল রাত্তির বেলা কাদা মাড়িয়ে রেলে উঠিছি, আর পা ধোবার জল পাইনি–
কাশী জল দিলে। পা ধুতে লাগলো সন্তোষ। জুতো জোড়াও ধুতে লাগলো। বললেও ক্ষিরি, পা ধুবি তো ধুয়ে নে মা–
দীপঙ্কর আপিসের জামা-কাপড় পরছিল। মা কাছে আসতেই দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-ওরা কারা মা?
মা বললে–তুই চিনবি না, রসুরপুরের লোক–সম্পর্কে ঠাকুরপো—
নিচে থেকে সন্তোষ তখন ডাকছিল–ও বৌদি, কোথায় গেলে?
মা বললে–এই দীপু আপিস যাচ্ছে ঠাকুরপো, তুমি একটু বোস, আমি যাচ্ছি
দীপঙ্কর বললেমা তুমি যাও, আমার কিছু দরকার নেই, ওদের আবার খাবার যোগাড় করতে হবে বোধহয়–
মা নিচেয় আসতেই সন্তোষ বললে–এই কুমড়োটা আমার ভিটের কুমড়ো, ভাব লাম দেশের কুমড়ো খেতে বৌদির হয়ত ভালো লাগবে-খেয়ে দেখো মিষ্টি একেবারে গুড়-ও ক্ষিরি, কুমড়োটা বার কর তো মা পোঁটলা খুলে–
তারপর খানিক পরে সন্তোষ আবার বললে–দুটো কুমড়ো আনবার ইচ্ছে ছিল, বুঝলে বৌদি, কিন্তু আনা কি অত সহজ কথা-রেল ইস্টিশান কি এখানে-দু’মাইল হেঁটে তবে ইস্টিশানে আসতে হয়–আর যা কাদা–
মা বললে–তা মেয়ের বিয়ের ঠিক করেছ কিছু?
সন্তোষ বললে–সেই জন্যেই তো তোমার কাছে এলুম বৌদি-তুমি যদি একটা হিল্লে করে দিতে পারো–
–তা গায়ে পাত্র পেলে না সন্তোষ? গাঁয়ে দত্তরা তো মস্ত বড় বংশ। ওদের বলে কয়ে কারো সঙ্গে দু’হাত এক করে দিলে না কেন?
সন্তোষ বললে–গাঁয়ের কথা আর বলো না বৌদি, গাঁয়ের নাম কোর না, সে গা আর নেই; নেহাত উপায় নেই বলে গায়ে পড়ে আছি, নইলে ঝাটা মারি অমন গায়ের মুখে, কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না, কেউ কারো নাম সইতে পারে না, মেয়েটার বিয়ে দিতে পারলে আমিও বেরিয়ে পড়বো গাঁ থেকে–দেখে নিও–
মা বললে–বেরিয়ে পড়ে কোথায় যাবে?
–এই যেদিকে দুচোখ যায় বেরিয়ে পড়বো। আমি তো সেই কথাই বলি সকলকে। বলি, তোমরা সতীলক্ষ্মীকে গাঁ থেকে তাড়িয়ে দিলে, এ গাঁয়ের কি আর ভালো হবে ভেবেছ, সব উচ্ছন্নে যাবে, তা উচ্ছন্নে যাচ্ছেও সবাই–
মা বললে–আমার কথা ছেড়ে দাও সন্তোষ, আমি জীবনে কারো মন্দ করিনি, জীবনে কখনও কাউকে মন্দ কথা বলিনি, মাথার ওপর ভগবান আছে, তার দিকে চেয়েই চলেছি–
তারপর একটু থেমে বললে–তা তুমি আজকে থাকতো তো?
সন্তোষ বললে–কী যে তুমি বলল বৌদি, থাকবো না তো যাবো কোথায়? থাকতেই তো এইচি–
মা বললে–তা হলে চান-টান করে নাও-আমি তোমাদের চাল নিই–
সন্তোষ বললে–নাও চাল নাও-আমার একটু বেশি করে চাল নাও বৌদি, আমি একটু বেশি ভাত খাই, তা জানো তো–আর মুড়ি আছে?
–মুড়ি?
–হ্যাঁ, সেই কাল রাতিরে বেরিয়েছি, তারপর থেকে আর পেটে তো কিছু পড়েনি, আমাকেও দাও, আর ক্ষিরিকেও দুটি দাও–
ক্ষিরি এতক্ষণ দরজার চৌকাট ধরে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল, বাবার কথা শুনছিল। এতক্ষণে কথা বললে–আমাকে দিতে হবে না জ্যাঠাইমা, বাবাকেই দাও–
সন্তোষ বললে–কেন? খা না, খেতে দোষ কী? রসুলপুরের মুড়ি খেয়েছিস, এখন কলকাতার মুড়ি খেয়ে দেখ না, দেখবি কলকাতার মুড়ি কত মিষ্টি–
দীপঙ্কর দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বারান্দা পার হয়ে সদর দরজার দিকে যেতে হবে। সন্তোষ চেয়ে দেখলে দীপঙ্করের দিকে। বললে–এই তোমার ছেলে বুঝি বৌদি?
দীপুর মা বললে–হ্যাঁ–দীপু, ইনি তোমার সম্পকে কাকাবাবু হন, প্রণাম করো এঁকে—
.
সন্তোষ বসে ছিল পা মুড়ে। কথাটা শুনেই পা দুটো দীপুর দিকে বাড়িয়ে দিলে। দীপু সেই কাকাবাবুর কাদা ধুলো মাখা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই, সন্তোষ বললে–বাঃ, বেশ দিব্যি ছেলে তোমার বৌদি, সেই দু’মাস বয়েসে দেখেছিলুম, আর আজ দেখলুম–
মা বললে–হ্যাঁ, আশীর্বাদ করো ঠাকুরপো, যেন ওকে সুস্থ রেখে যেতে পারি আমি–
–বেশ ছেলে তোমার। কী নাম তোমার বাবা?
মা বললে–মনে আছে সেই জমিদারবাড়ির নাতি হলো, তার নাম রেখেছিল দীপঙ্কর, তাই আমার ছেলেরও নাম রেখিছি দীপঙ্কর-রেলে চাকরি করছে এখন
–বা—বা–, তা কত মাইনে পাচ্ছে এখন?
সন্তোষ এতক্ষণে পা দুটো গুটিয়ে নিলে। এতক্ষণে দীপঙ্করের আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিলে আর একবার। সেই গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া বৌদির এমন সোনারচাঁদ ছেলে হবে, তা যেন কল্পনাও করতে পারেনি সন্তোষ-কাকা। শুনেছিল ছেলের চাকরি হয়েছে, কোন এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে দাসীবৃত্তি করে ছেলেকে মানুষ করছে বৌদি। সেই ছেলের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতেই এসেছিল। কিন্তু সে ছেলে যে এমন কেষ্ট বিষ্ণু হয়েছে তা রসুলপুরের সন্তোষবিহারী মজুমদারের জানার কথা নয়।
–তা ভালোই হলো বৌদি দ্যাখো দিকিনি কাণ্ড, আমি ক্ষিরির পাত্তোরের জন্যে হিল্লী-দিল্লী খুঁজে বেড়াচ্ছি আর এদিকে তোমার ছেলেই যে রয়েছে, তা মাথায় ঢোকেনি। –যাও বাবা, আপিসে যাও, দেরি কোর না, চাকরি হলো লক্ষ্মী, লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলতে নেই, গায়ের লোক ক্ষিরির কপাল দেখে একেবারে চমকে উঠবে–এমন জামাই গাঁয়ে কারো হয়নি বৌদি–
দীপঙ্কর ততক্ষণে সদর দরজা দিয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়েছে।
সন্তোষ বললে–বুঝলে বৌদি, কোথায় গেলে তুমি? ও বৌদি–দ্যাখ তো ক্ষিরি, তোর জ্যাঠাইমা কোথায় গেল?
মা তখন রান্নাঘরে গিয়ে উনুনে হাঁড়িতে নতুন করে ভাত চাড়াচ্ছে–
ক্ষিরির ওপর নির্ভর না করে সন্তোষ নিজেই রান্নাঘরের কাছে গিয়ে বললে–বৌদি কোথায় গো, রান্নাঘরে নাকি?
–এই যে ঠাকুরপো–
সন্তোষ বললে–আমি ঠিকই করে ফেললাম বৌদি–ও তোমার ছেলেকেই জামাই করবো আমি! এমন পাত্তোর থাকতে আমি কিনা ক্ষিরির বিয়ের জন্যে কাঁহ-কাহা ঘুরে বেড়াচ্ছি–
মা রান্নাঘর থেকে বললে–তুমি চান করে নাও ঠাকুরপো, চৌবাচ্চায় জল আছে–
–সে হবে’খন, আগে মুড়ি খাই, মুড়ি খেতে খেতে তেল মাখবো’খনও ক্ষিরি, ক্ষিরি কোথায় গেলি রে, ইদিকে আয় না, মুড়ি খাবি তো আয় না ইদিকে, নে আঁচলটা ফাঁক কর–
শুধু মুড়ি নয়, মুড়ির সঙ্গে নারকোলকোরা, কাঁচা লঙ্কা সবই এল। তারপর স্নান, তারপর আর এক প্রস্থ খাওয়া, আর এক প্রস্থ গল্প।
সন্তোষ বললে–উঃ, এতদিনে ভাবনাটা চুকলো, জানলে বৌদি, আজ একটু পেট ভরে ঘুমোতে পারবো–
তারপর একটু থেমে বললে–তোমারও ভাবনা চুকলো বৌদি, তোমাকেও আর হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে না, দীপুর আপিসের ভাত দিতে হবে না! কীরে ক্ষিরি, পারবি না? আপিসের ভাত দিতে পারবি না?
ক্ষিরি আর পারলে না। বললে–বাবা, তুমি থাম তো!
সন্তোষ অবাক হয়ে গেল। বললে–কেন রে, কী বলছিস তুই? থামবো কেন? এমন বর পাবি নাকি তুই রসুলপুরে? দেখবি কলকাতার জল গায়ে পড়লেই তোর কেমন ফরসা রং বেরোয় গায়ে! বৌদির মতন এমন শাশুড়ী অনেক তপস্যা করলে তবে পায় মানুষে!
মা বললে–সে-সব কথা পরে হবে’খন সন্তোষ, আজ তোতা তুমি আছো–
সন্তোষ বললে–আমি আর যাবো কোথায় বৌদি, আমার কোন্ চুলোয়ই বা যাবার জায়গা আছে? মেয়ের বিয়ে দিয়ে আমি জামাই-এর এখানেই পড়ে থাকবো-আমাকে দুটো খেতে দেবে না তোমার ছেলে?
.
দুপুরবেলা এই নতুন পাড়ায় একটু শব্দ হয় বেশি। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের চেয়েও একটু বেশি শব্দ। হুস হুস করতে করতে ট্রেন আসে, মালগাড়ি আসে, ধোঁয়ায় ধোয়া হয়ে যায় আকাশ। উঠোনের তারে কাপড় শুকোতে দিলে কয়লার গুড়োয় ভর্তি হয়ে যায়। তখন ঠিকে-ঝি বাসন মাজতে আসে। কাশী তখন আবার ঘর-দোর ঝাট দিতে বসে। ছেলে আসবে কখন তার ঠিক থাকে না। চাকরিতে মাইনে বাড়ার পর থেকেই ছেলের বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। কোনও দিন না কোনও দিন রাত দশটা। মা ততক্ষণ ভাত আগলে বসে থাকে। আস্তে আস্তে পাড়া নিরিবিলি হয়ে আসে, তখন মশা ভন্ ভন করে চারিদিকে। হঠাৎ হয়ত একটা রেলগাড়ি শিস দিতে দিতে ছুটে আসে ইস্টিশানের দিকে, আর সমস্ত বাড়িটা তখন থরথর করে কাঁপতে থাকে।
দুপুরবেলা সন্তোষ খালি মেঝের ওপরেই নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগলো। অদ্ভুত নাক-ডাকা! কাশী যে কাশী, ছোট এতটুকুন ছেলে, সেও নাক-ডাকার বহর দেখে হেসে ফেললে।
মা খুব বকুনি দিলে একচোট। বললে—হাসছিস কেন রে? হাসছিস কেন? তোর নাক ডাকে না? না তুই একেবারে মহাপুরুষ হয়ে জন্মেছিস–
ক্ষিরি কুণ্ঠিত গলায় বললে–বাবাকে ডেকে দেব জ্যাঠাইমা?
–কেন? ডাকবে কেন মা? কাল সারারাত ঘুম হয়নি, একটু ঘুমোন না!
ক্ষিরি বললে–না, বড় নাক ডাকছে কিনা তাই…
–তা নাক ডাকলেই বা, বুড়ো মানুষ হলে অমন নাম একটু ডাকেই। তাতে কী হয়েছে! তুমিও একটু গড়িয়ে নাও না। তুমিও তো বাছা রাত জেগে এসেছে, ঘুমোও না। একটু
–আপনি শোবেন না জ্যাঠাইমা?
–তা আমি শুলে যদি তুমি শোও তো আমি শুচ্ছি আর শুলে কি আমার চলে বাছা, এখনি কলে জল আসবে, একটু যদি না দেখি তো রান্নার জল ধরা হবে না, ঠিকে-ঝি এসে ফিরে যাবে, সংসার করা কি কম জ্বালা–
বলতে বলতে মা মেঝের ওপরই গড়িয়ে পড়লো।
বললে–তুমি ওই মাদুরটা টেনে নিয়ে শোও মা, কাপড় ময়লা হয়ে যাবে—
কিন্তু তার আগেই ক্ষিরি মার পাশে শুয়ে পড়েছে। মা’র মনে হলো এ যেন সন্তোষের মেয়ে নয়, যেন বিন্তিই। বিন্তির মতই ন্যাওটা। ঠিক তার মতই পাশ-ঘেঁষে শুয়ে পড়লো।
মা বললে–তোমার ভাল নাম কী মা?
ক্ষিরি বললে—ক্ষীরোদা–
–বেশ নাম, মা বুঝি নাম রেখেছিল?
ক্ষিরি বললে–মা’কে তো আমি দেখিনি জ্যাঠাইমা, জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত বাবাকেই দেখে আসছি।
হঠাৎ মা’র যেন বিন্তির কথাগুলোই মনে পড়তে লাগলো শুয়ে শুয়ে। আহা গো! সে-মেয়েটাও এমনি করে গায়ের পাশটিতে পড়ে থাকতো দিন রাত। কোল থেকে নড়তো না। এমন মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিল! শেষপর্যন্ত অমন করে আত্মঘাতী না হলে কি আর বাড়ি ছাড়তে পারতো! আশ্চর্য মেয়ের সাহস বটে। সেই মেয়ে, যার কথা বেরোত না মুখ দিয়ে, সেই মেয়েই কী করে যে অমন সাহসের কাজ করতে পারলো কে জানে? ভাবতে ভাবতে কখন যেন তন্দ্রা এসে গিয়েছিল মা’র। সকাল থেকে রান্না করতে হয়েছে দুবার করে। খুব বুঝি পরিশ্রম হয়েছিল–
–জ্যাঠাইমা, ও জ্যাঠাইমা?
ও-পাশের বারান্দায় সন্তোষ কাকার তখনও নাক ডাকছে জোরে জোরে। বাড়িটা বেশ সরগরম হয়ে রয়েছে।
–জ্যাঠাইমা, ও জ্যাঠাইমা!
মা ধড়মড় করে উঠে বসলো। বললে–কী মা, কী হলো মা?
ক্ষিরি বললে–কে যেন সদর দরজায় কড়া নাড়ছে, দরজা খুলে দেব?
হয়ত ঝি এসেছে। মা বললে–দাঁড়াও, আমি দেখছি–
কেমন হঠাৎ যেন ঘুমটা দু’চোখ জুড়ে এসেছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, টের পায়নি। এত রেলগাড়ির আনাগোনা বালিগঞ্জ ইস্টিশানে, অন্যদিন ঘুমই আসে না। আর আজ একেবারে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। বেলা পাঁচটা পর্যন্ত একেবারে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল।
কিন্তু দরজা খুলতেই মা পিছিয়ে এল। কাদের বাড়ির চাকর!
–দীপঙ্করবাবু আছেন?
–তুমি কোত্থেকে আসছে?
লোকটা বললে–আমি পিরোনাথ মল্লিক রোড-এর ঘোষেদের বাড়িতে কাজ করি, দীপঙ্করবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এ্যাসেছিলাম
–তা বাবু তো নেই। বাবু আপিসে। কী দরকার আছে বলো, এলে বলবো। লোকটা আবার জিজ্ঞেস করলে-বাবু আপিস থেকে কখন আসেন?
আরে, তার কি ঠিক আছে? কাজ পড়লে রাত নটা রাত দশটাও হয় ফিরতে। যেমন কাজ পড়বে, তেমনি দেরি হবে। কতদিন রাত দশটার পরও এসেছে আপিস থেকে দীপঙ্কর। মা জানালাটা ধরে রাস্তার দিকে চেয়ে বসে থাকতো। এ-রাস্তাটা জনহীন। সন্ধ্যের পর এ-রাস্তা দিয়ে লোকই হাঁটে না কেউ। এ কালীঘাট নয়। রাত বারোটার সময়ও সন্ধ্যে মনে হবে। ওই ইঞ্জিনের সোঁ সোঁ শব্দ আর মালগাড়ির শান্টিং এর আওয়াজ এ-পাড়াকে চব্বিশ ঘণ্টা সরগরম করে রাখে।
কাশী এল। ছোট ছেলে। কোথায় ঘুরতে বেরিয়েছিল পাড়ায়।
মা বললে–কোথায় গিয়েছিলি রে? সমস্ত দুপুর হুট-হুঁট করে ঘুরে বেড়াবি? এদিকে কেউ দরজা ঠেললে আমি খুলে দেব নাকি? তাহলে তোকে মাইনে দিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে কেন শুনি?
তখনও লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। বললে–আমি যাচ্ছি মা, বাবু এলে বলে দেবেন আমি পিরোনাথ মল্লিক রোডের ঘোষদের বাড়ি থেকে এসেছিলাম
বলে চলে গেল লোকটা। তারপর কাশীকে নিয়ে পড়লো মা। এমন চাকর হয়েছে মা, যে কোনও কম্মে নেই, কেবল খাওয়া আর ঘুরে বেড়ানো
কিন্তু খানিক পরেই আবার ফরমাশ। বাজার করতে যেতে হবে কাশীকে। আলু বেগুন পটল দু-একটা টুকি-টাকি কিনে আনতে। বাড়িতে লোক এসেছে, তাদের খাওয়ার জন্যে দরকার। ঝাড়নটা নিয়ে বাইরে বেরোতেই লোকটার সঙ্গে দেখা। ইস্টিশানের গেটটা পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে। কসবায়। লোকটা ট্রামের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। কাশীই আগ বাড়িয়ে গেল। বললে–কালকে সকাল-সকাল এসো, বুঝলে, এই আপিস যাবার আগে
–বাবু কখন আপিসে যায়?
কাশী বললে–সকাল ন’টার আগে। নটার আগে এলে দেখা হবে,
–আর বিকেল বেলা?
কাশী বললে–বিকেল বেলার কোনও ঠিক নেই, সেই রাত ন’টার সময়ও হতে পারে, রাত দশটাও হতে পারে–
বলে চলে যাচ্ছিল কাশী। বালিগঞ্জ ইস্টিশানের লাইনে তখন গাড়ি নেই। লোহার গেটটা খোলা। ওপারে বাজার। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে কে যেন ডেকে উঠলো-কাশী
কাশী নিজের নামটা শুনে এদিক ওদিক চাইলে। তারপর হঠাৎ দাদাবাবুকে দেখে অবা হয়ে গেছে। দীপঙ্করেরও মনে আছে সেদিন অমন করে বালিগঞ্জ স্টেশনে না এলে কাশীর সঙ্গেও দেখা হতো না। আর কাশীর সঙ্গে দেখা না হলে শম্ভুর সঙ্গেও দেখা হবার সুযোগ হতো না।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কোথায় যাচ্ছিস তুই? ওরা আছে এখনও? সেই রসুলপুর থেকে যারা এসেছিল?
কাশী বললে–দাদাবাবু, আপনাকে একজন খুঁজতে এসেছিল
–কে রে?
কাশী বললে–পিরোনাথ মল্লিক রোডের ঘোষেদের বাড়ি থেকে!
প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের ঘোষদের বাড়ি থেকে? কে? কী বলতে এসেছিল? কখন এসেছিল? কে সে? কী নাম তার? কী রকম চেহারা?
একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্নের ভিড় ঠেলে আসতে দীপঙ্কর যেন উন্মাদ হয়ে উঠলো একেবারে।
কাশী বললে–দাঁড়ান, আমি ডেকে দিচ্ছি–
লোকটা বোধহয় তখনও ট্রামের জন্যে অপেক্ষা করছিল। পই পই ক ভুল কাশী। দীপঙ্করের মনের মধ্যে যেন প্রশ্নের ঝড় বয়ে গেল। সতী পাঠিয়েছে! সতী তার বাড়ির ঠিকানা জানলে কী করে? হয়ত ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ছিটে-ফোঁটার কাছ থেকে জেনে নিয়েছে। কিন্তু সতী নিজে এলো না কেন? আর এমন কী দরকার পড়লো হঠাৎ যে লোক পাঠিয়েছে তার কাছে! সেদিনের সেই ঘটনার পর আর কেমন করেই বা দেখা করে সে? সেইদিনই তো চরম শিক্ষা হয়ে গেছে। সমস্ত আশা, সমস্ত কামনার সমাধি হয়ে গেছে। সতীর শাশুড়ীই তো দীপঙ্করকে যেতে বারণ করে দিয়েছে। তারপর আর কেমন করে যায় সে? কোন সাহসে তার সঙ্গে দেখা করে? সতী তো পাগল। সতীর শাশুড়ীই তো বলেছে পাগল সে। তারপর কতদিন আপিসে গিয়ে ভেবেছে, সতী হয়ত সেদিনের মত হঠাৎ আবার একদিন আপিসে এসে হাজির হবে। কতবার মনে হয়েছে একবার সতীকে টেলিফোন করে। টেলিফোন করে জানিয়ে দেয় সেদিনকার সমস্ত ঘটনাগুলোর কথা। সতীর শাশুড়ী কেমন করে তাকে বাড়ি থেকে মিষ্টি কথা বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল–তা সবিস্তারে সতীর কানে তোলে। কিন্তু অনেক ভেবেও সাহস হয়নি। এতদিন পরে সতী তাহলে আবার খবর পাঠিয়েছে কেন? বালিগঞ্জ স্টেশনের সেই ঢালু প্ল্যাটফরমটার ওপর দাঁড়িয়ে দূরে রাস্তার দিকে চেয়ে দেখতে লাগলো দীপঙ্কর। সাইডিং এর ওপর রবিনসন সাহেবের সেলুনটা রয়েছে। ভেতরে সাহেব আছে, মিসেস রবিনসন আছে। আর আছে জিমি। ওয়াগনগুলো অকারণে আটকে থাকে এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নিজের চোখে দেখতে এসেছে মিস্টার রবিনসন। তারপর এখান থেকে মটর ট্রলির ব্যবস্থা হয়েছে। মটর-ট্রলিতে করে সাহেব লাইন দেখতে দেখতে যাবে গড়িয়াহাটা লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত। লেভেল-ক্রসিং এ অ্যাসিডেন্ট হয়ে গেছে একটা। মোষের গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে থার্টি সেভেন আপ-এর সঙ্গে। সাহেব নিজে গিয়ে স্পট দেখে আসবে।
–এই যে দাদাবাবু, এসেছে!
দীপঙ্কর চেয়ে দেখলেশম্ভু! শম্ভু তার বাড়িতে খোঁজ নিতে এসেছে!
শম্ভুও অবাক হয়ে গেছে দীপঙ্করকে দেখে।
শম্ভু বললে–আপনাকে খুঁজতেই গিয়েছিলাম আপনার বাড়িতে–
–কেন রে? কী হয়েছে?
তারপর কাশীর দিকে চেয়ে বললে–তুই যা কাশী এখন, মা’কে গিয়ে বলবি সাহেবের সঙ্গে আমি আপিসের কাজে এসেছি এদিকে, আমার দেরি হবে বাড়ি ফিরতে
কাশী চলে গেল। শম্ভু যেন উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল। বললে–মহা মুশকিল হয়েছে দাদাবাবু, বৌদিমণি আপনার কাছে পাঠালে আমাকে
দীপঙ্কর ভয় পেয়ে গেল। বললে–কী হলো?
শম্ভু বললে–সেই যে আপনি চলে এলেন সেদিন তার পরই কাণ্ডটা ঘটলো–
–কী কাণ্ড?
বৌদিমণিকে মা-মণি আর বেরোতে দেয় না বাড়ি থেকে। বৌদিমণিকে চোখে চোখে রেখে দিয়েছে সারাক্ষণ, বাতাসীর মা, ভূতির মা, দারোয়ান, কৈলাস সবাইকে বলে দিয়েছে মা-মণি
সেই বিকেল বেলার পড়ন্ত সূর্যের আলোর তলায় বালিগঞ্জ স্টেশনের ঢালু প্ল্যাটফরমটার ওপর দাঁড়িয়ে দীপঙ্করের মনে হলো সতী যেন তখনও তাদের প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িটার ভেতর থেকে বারান্দার সামনে দৌড়ে আসতে আসতে চিৎকার করে ডাকছে–দীপু-উ-উ-উ-উ–
হঠাৎ পাশেই একটা ইঞ্জিনের হুইশল্-এর শব্দে দীপঙ্করের ভাবনার খেইগুলো যেন ছিঁড়ে-খুঁড়ে গেল। বললে–তাহলে তোমার বৌদিমণি তোমাকে কী বলতে বলেছে আমাকে?
শম্ভু বললে–কী আর বলবে দাদাবাবু, শুধু বলেছে আপনাকে খবরটা দিতে—
দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না। বললে–কিন্তু আমি কী করবো খবরটা শুনে বলো?
শম্ভু বললে–তাও তো বটে, আপনিই বা কী করবেন! মা-মণি লোকটা তত ভাল নয়, ওই মাগীটাই যত নষ্টের গোড়া দাদাবাবু, অমন ভালোমানুষ বউ পেয়েছে কিনা তাই অমন কষ্ট দিতে পারছে–!
বলে খানিক থেমে আবার বললে–জানেন দাদাবাবু এক-একদিন আমাদের চাকর ঝিদের সামনেই বৌদিমণিকে কাঁট-কাট করে কথা শোনায়! আপনি চলে আসার পরেই বৌদিমণিকে বললে–আমাদের ঘোষবাড়ির নাম ডোবালে তুমি বৌমা, বাইরের লোকদের বাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে তুমি সোহাগ করো, তোমার গলায় দড়ি জোটে না?
আশে-পাশে অনেক ভিড়। দীপঙ্কর বললে–এখানে দাঁড়িয়ে গল্প হবে না, তুমি এসো শঙ্কু আমার সঙ্গে
দীপঙ্কর শ্যুকে নিয়ে লাইন পেরিয়ে নিজের সেলুনে গিয়ে বসালো। বললেবোস শম্ভু ওখানে–
শম্ভু গাড়ির মধ্যে ঢুকে অবাক হয়ে দেখলে চারদিকে। গদি আঁটা চেয়ার দুটো। গদি আঁটা বিছানা। ভেতরে ঠিক যেন শোবার ঘরের মতন সাজানো। পাশেই রান্নার জায়গা।
দীপঙ্কর বিছানার ওপর বসলো। বললে–তোমাদের সামনেই এইসব কথা শোনায়?
–হ্যাঁ দাদাবাবু, আমাদের সামনেই শোনায়। আর বৌদিমণির সেইসব কথা শুনে চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসে। শুনে আমাদেরই লজ্জা হয়ে দাদাবাবু। আমরা সেখান থেকে সরে আসি–।
–আর সেদিন কী হলো? সেই আমাকে যেদিন তোমার মা-মণি তাড়িয়ে দিলে?
শম্ভু বললে–মা-মণির কি চোখের পর্দা আছে দাদাবাবু, চোখের পর্দা নেই মাগীর! চোখের পর্দা থাকলে কেউ অমন কথা বলতে পারে? আর আমিও তাই বৌদিমণিকে বলি। বলি–তোমার ভাবনা কিসের বৌদিমণি? তুমি তোমার বাপের কাছে চলে যাও না, তোমার বাপের অত টাকা, আরাম করে থাকবে সেখানে, শ্বশুরের ঘর তোমার কপালে নেই তো কী করবে তুমি?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তা শুনে কী বলে তোমার বৌদিমণি?
–বলে, আমি চলেই যাবো রে শম্ভু, আমি শেষপর্যন্ত বাবার কাছেই চলে যাবো। বৌদিমণি কথাগুলো বলে আর মুখটা কেমন শুকিয়ে যায় তার। মা তো নেই বৌদিমণির, তাই বাপের কাছে যেতেও কষ্ট হয় আর কি। বাপও যে মেয়ে-অন্ত প্রাণ–
–তুমি কেমন করে এত সব জানলে শম্ভু?
শম্ভু বললে–আমি জানবো না তো কে জানবে দাদাবাবু, আমি ও-বাড়িতে এই এতটুকু বেলা থেকে আছি। আমার মা ছিল ওই বাড়ির ঝি, সেই ছোটবেলা থেকেই ওখানে আমি মার সঙ্গে আছি যে! মা কবে মারা গেছে, কিন্তু আমি কি আর এখন ও-বাড়ি ছাড়তে পারি? ওই বৌদিমণির বিয়ের তত্ত্ব তো আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম, তখন দেখেছি বৌদিমণির বাবাকে
–আচ্ছা শম্ভু–বলে যেন একবার দ্বিধা করতে লাগলো একটু। বলবে কি বলবে না বুঝতে পারলে না দীপঙ্কর। আর সব কথা একজন চাকরের কাছে জিজ্ঞেস করা যায় কিনা তাও ঠিক করতে পারলে না।
–কী বলবেন বলুন না দাদাবাবু!
দীপঙ্কর বললে–তোমার বৌদিমণির কি ছেলে হয়েছিল?
শম্ভু বললে–তা আপনি জানেন না বুঝি, ওই শাশুড়ী-মাগীর জন্যেই তো মরে গেল ছেলেটা! আহা কি ফুটফুটে ফরসা দেখতে হয়েছিল কী বলবো! ঠিক বৌদিমণির মতন। তা শাশুড়ীর তো আর সহ্য হলো না। দিনরাত কেবল পিটপিটুনি আরম্ভ হলো–কেবল বলে-বৌমা এটা ছুঁয়ো না, বৌমা ওটা ছুঁয়ো না-আঁতুড়ের কাঁথা একদিন কাকে নিয়ে ফেলেছিল রান্নাবাড়ির রোয়াকে সেই নিয়ে বাতাসীর মা’কে যত বকুনি, বৌদিমণিকেও তত বুকনি! তা বাতাসীর মা তো মেদিনীপুরের লোক, সে ছাড়বে কেন? সেও হাজার গণ্ডা কথা শুনিয়ে দিলে। তখন রোখ পড়লে বৌদিমণির ওপর।
–বৌদিমণি কী বললে?
–বৌদিমণি আর কি বলবে! চোখ দুটো রাগে ঠিকরে বেরিয়ে এল, তবু মুখ দিয়ে কিছু বললে না। আর জানেন তো বৌদিমণি বড়ঘরের মেয়ে, তার মুখ দিয়ে কি গালাগালি বেরোয়?
–তা তোমার মা-মণি গালাগালি দেয় নাকি বৌদিমণিকে?
শম্ভু বললে–দিনরাত তো গালাগালিই দেয় দাদাবাবু! আমাদের সকলকে গালাগালি দেয়, তার তবু একটু মানে আছে। আমরা চাকর-ঝি, আমাদের না-হয় উপায় নেই। কী করবো, পরের বাড়িতে গতর খাটাই, মাইনে পাই, খেতে পাই, তাতেই পুষিয়ে যায়–কিন্তু বৌদিমণি কেন সইবে? বৌদিমণি তো মাগীর পেট-ভাতার ঝি-চাকর নয়–
–তা তারপর কী হলো?
–তারপর শেষকালে ছেলেকেও ছুঁতে দেয় না মা-মণি! কেবল বলে-বাসি-কাপড়ে ছেলেকে ছুঁয়োনি, ছেলেকে ছুঁয়ে ঘরের আলনায় হাত দিয়োনি। এটা করোনি, সেটা করোনি! ছেলের একটা দিন-রাত্তিরের ঝি ছিল, তাকে পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টা উঠতে বসতে খ্যা-খ্যাচানি! অমন করলে কে কাজ করবে দাদাবাবু!
–তা তোমার মা-মণির কি ঘুচিবাই আছে নাকি?
শম্ভু বললে–আজ্ঞে না, ঘুচিবাই থাকতে যাবে কেন? বেশ খাচ্ছে দাচ্ছে, মোটা হচ্ছে মাগী। আর বলিহারী চোখ বটে মা-মণির আজ্ঞে, সেই তিনতলার ঠাকুর-ঘরে বসে বাড়ির কোথায় কী হচ্ছে সবদিকে নজর রেখেছে। কে কখন শুনো গামছা পরে কল থেকে ভেতর-বাড়িতে এল, ঠাকুর ক’পলা ঘি দিলে চাকরদের ডালে, বাতাসীর মা ভাড়ার থেকে কটা বাসন বার করে দিলে, সব জানতে পারে বুড়ি! এমন স্যায়নার ধাড়ি, জানেন?
–কিন্তু ছেলেটা মরে গেল কেন?
শম্ভু বললে–তা মরবে না? অত ছোঁয়াছুঁয়ি, অত পিটপিটুনি করলে ছোট ছেলে বাঁচে? তিন মাস যেতে না যেতেই শরীরে নোনা লেগে গেল! দাদাবুবা ডাক্তার ডেকে আনলে, বড় বড় ডাক্তার। কিন্তু তখন আর ডাক্তার ডাকলেই বা কী হবে বলুন!
–তারপর?
–তারপর শাশুড়ী মাগীর পিট-পিটুনী আরো বেড়ে গেল। বলে, বৌমা, তুমি নিজের পেটের ছেলেকে খুন করলে গা, তুমি ডান না পিশাচ! কথায় কথায় বৌদিমণির হেনস্থা হতে লাগলো। তারপরে পুরীতে শ্রীক্ষেত্রে বাবা জগন্নাথের কাছে মান ছিল, সেইখানে গেল মাগী! নিজের নাতিকে খুন করে আবার ঠাকুর-দেবতার কাছে মানত রক্ষে হচ্ছে। অমন মানতের মুখে ঝাঁটা মারি। যাবার সময় বৌদিমণি কত করে বললে–আমায় নিয়ে যাও শ্রীক্ষেত্রে, আমিও বাবা জগন্নাথের শ্রীচরণে মান রক্ষে করবো, তা শুনলে কি মাগী? নিয়ে গেল?
দীপঙ্কর এতক্ষণ মন দিয়ে উদ্গ্রীব আগ্রহ সব শুনছিল। বললে–তা তোমার দাদাবাবু কিছু বলেন না? তারই তো মা? মা’কে তিনি বলতে পারেন না কিছু?
শম্ভু বললে–তা হলেই হয়েছে, মায়ের মুখের ওপর কথা বলবে? সাতজন্মে অমন মা যেন কারো না হয় দাদাবাবু। মা নয় তো ডাইনী, অনেক পাপ করলে তবে অমন মায়ের গভ্যে মানুষের জন্ম হয়-ছি ছি ছি
শম্ভু বেশ ভারিক্কি চালে, বুড়ো মানুষের মত কথাগুলো বলে গম্ভীর হয়ে রইল।
তারপর বললে–আপনি সেদিন চলে আসার পরই আমি বৌদিমণিকে গিয়ে খবরটা দিলুম-বৌদিমণি শুনেই ছুটতে ছুটতে এল। ততক্ষণ আপনি চলে গেছেন। বৌদিমণি আপনার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে দৌড়চ্ছিল সদর-গেটের দিকে, হঠাৎ মা-মনি ধরে ফেললে। বললে–কোথায় যাচ্ছো বৌমা?
বৌদিমণি বললে–আপনি দীপুকে তাড়িয়ে দিলেন?
মা-মনি বললে–বেশ করেছি তাড়িয়ে দিয়েছি, আমার বাড়ি থেকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি–
বৌদিমণি কথাটা শুনে খানিক থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কী বলবে যেন বুঝতে পারলে। কথা যেন মুখে আটকে গেল আজ্ঞে।
মা-মণি বললে–তুমি যা করছিলে করোগে, ভেতরে যাও–
বৌদিমণি আস্তে আস্তে ভেতরের দিকে যাচ্ছিল। তারপর কী ভেবে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে না উঠে, লাইব্রেরী-ঘরের দিকে চলতে লাগলো।
মা-মণি ডাকলে–ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?
বৌদিমণি পেছন ফিরে দেখলে একবার। তারপর আবার যেমন চলছিল তেমনি চলতে লাগলো।
মা-মণিও বৌদিমণির পেছন পেছন চলতে লাগলো তাড়াতাড়ি। বললে–বৌমা, ওদিকে কোথায় যাচ্ছো আবার?
কিন্তু বৌদিমণি ততক্ষণে সোজা একেবারে দাদাবাবুর লাইব্রেরী-ঘরের মধ্যে ঢুকে গেছে। দাদাবাবু তখন বই পড়ছে। দাদাবাবুর বই পড়বার সময় একেবারে কোনও দিকে জ্ঞান থাকে না। বৌদিমণি সোজা একেবারে টেবিলের সামনে গিয়ে দাদাবাবুর মুখোমুখি দাঁড়াল। ঝড়ের মতো একেবারে বইখানা উল্টে দিয়ে বললে–তুমি কী বলল তো?
দাদাবাবু চমকে উঠেছে। বললে–কেন, কী হলো?
–তোমার চোখের সামনে দীপুকে তাড়িয়ে দিলেন মা, আর তুমি কিছু বললে না? তুমি মুখ বুজে রইলে? তুমি কি? তুমি আটকাতে পারলে না তাকে, আমি রান্নাঘরে খাবার যোগাড় করতে গেছি, আর এরই মধ্যে সর্বনাশ হয়ে গেল? তুমি কিছু বলতে পারলে না? তোমার মুখ নেই?
–বৌমা!
হঠাৎ ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়াল সতীর শাশুড়ী। মা-মণির গলা পেয়ে সনাতনবাবু পেছন ফিরলেন। মার মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। একবার মার মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন, আর একবার সতীর মুখের দিকে।
শাশুড়ী বললে–তোমার কি আজকাল কানে কথা যায় না বৌমা? আমি তোমাকে বললাম না রান্নাবাড়িতে যেতে, তুমি যে আবার এখানে এলে? যাও, ভেতরে যাও–
সতী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুলছিল। বললে–আমি যাবো না!
–তার মানে?
–আপনি আগে জবাব দিন, কেন দীপুকে আপনি তাড়িয়ে দিলেন? কী করেছে সে? কী ক্ষতি করেছে সে আপনার?
সনাতনবাবু এতক্ষণে যেন জিনিসটা বুঝতে পারলেন সমস্ত। বললেন–না, ক্ষতি তো কিছু করেননি তিনি মা, খুব ভালো লোক তো দীপঙ্করবাবু। তা তিনি তো নিজেই চলে গেলেন,–
–তুমি থামো সোনা! আমি কথা বলছি বৌমার সঙ্গে, তুমি কেন কথা বলো মাঝখান থেকে? তোমাকে কে কথা বলতে বলেছে? বৌমা, তুমি এ-ঘর থেকে বেরিয়ে এসো–খোকার পড়ার ব্যাঘাত হচ্ছে–
সতী সনাতনবাবুর মুখের দিকে তাকালে একবার। সনাতনবাবু বললেন–না মা আমার পড়া হয়ে গেছে, ও কালকে পড়লেও চলবে, যা বলবার তুমি বলো না আমার সামনে! আমিও শুনি–
মা-মনি বললেন–না, তোমার শোনার দরকার নেই, সব কথায় তোমার থাকা উচিত নয় সোনা
সতী বললে–হ্যাঁ, উনি শুনবেন, ওঁরও শোনা উচিত, আমি কত সুখে এ-বাড়িতে বাস করছি, তা ওঁরও জানা উচিত। উনি দেখুন কত সুখে আমাকে রেখেছেন আপনি! উনি নিজের চোখেই আজ দেখুন–
সনাতনবাবু বললেন–ছি, অমন করে কথা বিল না ওঁর সঙ্গে সতী, উনি মা, ওঁর সঙ্গে কি অমন করে কথা বলতে আছে?
মা-মণি বললেন–তুমি আর এর মধ্যে থেকো না সোনা, যা বলবার আমিই বলছি–
তারপর সতীর দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বললেন–বৌমা, এদিকে এসো–
সনাতনবাবু বললেন–যাও না, মা ডাকছেন, কথা শুনছো না কেন? যাও-মা’র কথা শুনতে হয়–
সতী শাশুড়ীর দিকে চেয়ে বললেন–কী বলবেন, বলুন?
–তুমি এ-ঘর থেকে বেরিয়ে এসো আগে–
সতী বললে–এ-ঘর আমার নয়? এ-ঘরে কি আমার ঢোকবার অধিকার নেই? এ বাড়িতেও কি আমি শান্তিতে থাকতে পাবো না? আমি কি এ-বাড়ির কেউ নই বলতে চান?
বলতে বলতে সতী যেন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলো বড়। থর থর করে কাঁপতে লাগলো তার সমস্ত শরীরটা। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের সেই প্রাসাদের মধ্যে সেদিন যেন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বস্তির অন্ধকার নেমে এল। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের মতই কদর্য কুশ্রী আবহাওয়া। সতী তখনও বলে চলেছে-আপনারা ভেবেছেন এমনি করে আমাকে জব্দ করে আমার গলা টিপে মেরে ফেলবেন? আমার কেউ নেই বলে কি আপনারা এমনি করে আমাকে কষ্ট দেবেন? আমার কি মন বলে কোনও জিনিস থাকতে নেই? আমিও তো মানুষ! আপনাদের মতই আমারও তো কষ্ট থাকতে পারে, ব্যাথা থাকতে পারে, ঘুম পেতে পারে! আমি আপনার কী করেছি যে আমাকে এত কষ্ট দেন আপনি?
যতক্ষণ সতী কথা বলছিল, শাশুড়ী কিছু বলেন নি। সতী থামতেই শাশুড়ী বললেন– তোমার কথা শেষ হয়েছে?
সতী বললে–কথা আমার শেষ হবে না, আপনারা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন আমার কথা শেষ হবে না, আপনারা মরলে আমার কথা শেষ হবে, তখন আমি চুপ করবো
–কী বললে?
শাশুড়ী যেন এবার রুখে দাঁড়ালেন। বললেন–কী বললে তুমি বৌমা?
–যা বললাম শুনলেন তো!
সনাতনবাবু আবার কথা বললেন। বললেন–ছি! এই কথা বলতে আছে? এটা তুমি কী বললে বল তো, রাগলে তোমার জ্ঞান থাকে না দেখছি
–তুমি থামো সোনা, যা বলবার আমি বলবো ওকে। তোমায় কিছু বলতে হবে না।
তারপর সতীর দিকে চেয়ে বললেন–বৌমা, আমি অনেক সহ্য করেছি, মুখ বুজে আমি অনেক সহ্য করেছি এতদিন, তবু কিছুছু বলিনি তোমায় কখনও। আমার এক ছেলে, ভেবেছিলাম সেই ছেলের বিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হবো, কিন্তু সে আমার কপালে নেই। আমি ভালো করে বুঝে নিয়েছি আমার কপালে সুখ নেই। কিন্তু আমি আর সহ্য করবো না। তোমার বাবা সামনে থাকলে তাকেও বলতাম। বলতাম–এমন করে আমার সর্বনাশ করলেন কেন? তোমার বোন যে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, তা-ও আমাকে তখন বলেননি তিনি! হয়ত ভেবেছিলেন আমি মেয়েমানুষ, মাথার ওপর কেউ নেই, কিছুই টের পাবো না কিন্তু যাক, যা হবার হয়ে গেছে, এখন তুমি যে ঘোষবাড়ির নাম ডোবাবে, আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না–তুমি এখন এসো–
তারপর সনাতনবাবু দিকে ফিরে বললেন–সোনা, বৌমাকে এত কথা শোনাচ্ছি বলে তুমি যেন আবার কিছু মনে কোর না বাবা, বৌমার ভালোর জন্যেই বলা, তোমারও ভালোর জন্যেই বলা–
সনাতনবাবু বললেন–না মা, আমি কিছু মনে করছি না তার জন্যে—
সতী হঠাৎ বললে–তা হলে আমাকে চলে যেতে দিন এখান থেকে–
শাশুড়ী কিছু বুঝতে পারলেন না। বললেন–কোথায় যেতে দেব? তোমার বাপের কাছে?
সতী বললে–আমার যেখানে খুশি আমি যাবো, তা আপনার জানবার দরকার নেই!
–তার মানে? তুমি যেখানে-সেখানে যাবে, আর আমার জানবার দরকার থাকবে?
সনাতনবাবু কথা বললেন এতক্ষণে। তিনিও সতীর কথায় অবাক হয়ে গেছেন যেন। বললেন–কোথায় যাবে তুমি এত রাত্তিরে?
–আমি যেখানেই যাই তোমার কী? তোমরা কি আমার জন্যে ভাবো? আমার সুখ দুঃখের কথায় কান দাও?
শাশুড়ী বললেন–কোথায় যাবে, যাও দেখি-যাও—
সতী বললে–আমি যেতে পারি না ভাবছেন?
–যাও না দেখি-যাও
সতী খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলে। যেন চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল তার। কিন্তু তখুনি শক্ত করে নিলে নিজেকে। বললে–এই আমি চললাম–
বলে সত্যিই চলতে লাগলো সতী। সত্যিই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শাশুড়ী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। আর তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। সতীর পেছন পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সনাতনবাবুও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মা’র সঙ্গে বাইরে এলেন। শাশুড়ী দেখলেন সতী সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলো না। বারান্দা দিয়ে রান্নাঘরের দিকেও গেল না। সোজা দক্ষিণ দিকে চলতে লাগলো। একেবারে সোজা।
শাশুড়ী পেছনে দূর থেকে ডাকলেন–বৌমা—
সতী কোনও উত্তর দিলে না। যেমন চলছিল তেমনিই চলতে লাগলো সোজা।
শাশুড়ী আবার ডাকলেন-বৌমা, দাঁড়াও—
সতী তখন বারান্দা থেকে বাঁদিকের সিঁড়ি দিয়ে বাগানের রাস্তায় নামছে—
সনাতনবাবু মা’র পাশে পাশে চলছিলেন। বললেন–আরে, চলে যাচ্ছে দেখছি যে—
সেই অন্ধকারের মধ্যেই সতী সিঁড়ি দিয়ে বাগানে নামলো। বাগানের গায়ে সরু ইট বাঁধানো রাস্তা। বহু বছর আগে এই বাড়ির এক পূর্বপুরুষ যে-রাস্তা দিয়ে একদিন তার গৃহলক্ষ্মীকে নিয়ে গৃহপ্রবেশ করেছিলেন, সেদিন সেই সন্ধ্যেবেলায় সেই বাড়িরই এক গৃহলক্ষ্মী সেই রাস্তা দিয়েই আবার চলে যেতে লাগলো বাইরের দিকে। একদিন খিদিরপুর ডকে পামারস্টোন্ সাহেব লক্ষ্মীবরণের পন্থাটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন ঘোষ পরিবারকে, কিন্তু কেমন করে আবার সেই লক্ষ্মীকে ঘরে অচলা করে রাখতে হয়, তা শিখিয়ে দেননি তার উত্তরপুরুষকে। বলে দেননি যে লক্ষ্মী বরণ করা সোজা, কিন্তু তাকে বেঁধে রাখা সোজা নয়। শিখিয়ে দেননি যে ব্যাঙ্কের সে ডিপোজিট ভল্টে চাবি বন্ধ করলে কাগজে ছাপা নোটকে হয়ত আটকানো যায়, মিন্টের ছাপা সোনার কয়েনকেও হয়ত নিরাপদে রাখা চলে, কিন্তু লক্ষ্মী তো নোট নয়, কয়েনও নয়! তার আত্মা আছে, তার প্রাণ আছে, তার হৃদয় আছে। স্টীলের চাবিতে তাকে বন্দী করা যায় না, লোহার শেকলে তাকে শৃঙ্খলিত করা যায় না। তাকে মুক্তি দিয়েই তবে তাকে পেতে হয়, তাকে বন্ধনহীন করেই তবে তাকে বাঁধতে হয়।
শাশুড়ী শেষবারের মত আর একবার ডাকলেন-বৌমা-শোন—
সনাতনবাবু ডাকলেন–সতী-ফিরে এসো–
কিন্তু পৃথিবী তখন এক কক্ষপথ থেকে আর এক কক্ষপথে ছুটে চলেছে। সতেরোশো ঊননব্বই সালে কবে একদিন ফ্রান্সে এক বিপ্লব হয়েছিল। তার স্মৃতি লোকে ভুলে গেছে। টাটকা মনে আছে উনিশশো চোদ্দ সালের বিশ্ব-যুদ্ধটার কথা। কিন্তু তখনও ফ্রান্সের লুই-দ্য-ফোর্টিনথ, আর ম্যাডাম-দ্য-ব্যারিরা পৃথিবী থেকে মুছে যায়নি। তাদের কেউ বসেছে ইংলন্ডের সিংহাসনে, কেউ জার্মানীতে, কেউ আমেরিকায়, কেউ বা ফ্রান্স এ। কবে একদিন আমেরিকার এক ঋষি বলেছিল–”That Government is best which governs not at all.” কবে একদিন একজন কোন জার্মান ঋষি বলেছিল Workers of the World unite. You have nothing to lose but your chains, and have a world to win. সে-সব কোনও কথাই এতদিন ফলেনি। মানুষের কুরুক্ষেত্রে বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়, একদিন শেষও হয়ে গেছে। হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি মানুষের অপমৃত্যু দিয়েও মানুষ তাদের চাওয়া গভর্নমেন্ট পায়নি। শ্রমিকেরাও তাদের বন্ধন ভাঙতে পারেনি তখনও। মানুষের সংসারের লক্ষ্মী বুঝি এমনি করে সতীর মতই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে ঘর থেকে। ইন্ডিয়ার টাকা, ইংলন্ডের পাউন্ড, আমেরিকার ডলার, ফ্রান্সের ফ্রাঙ্ক, জার্মানীর মার্ক, রাশিয়ার রুবল, ইটালীর লীরা সকলকে ট্যারি বোর্ডের চাবি দিয়ে সে ডিপোজিট ভল্টে আটকে রাখবার চেষ্টা হয়েছে কতবার। কিন্তু তবু কোথাও স্ট্রাইক বন্ধ হয়নি, কোথাও হরতাল থামেনি, কোথাও অসন্তোষ কমেনি একতিল। দিন দিন সায়েন্স আর ইন্ডাস্ট্রি কেবল এগিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে আর সমাজ স্থাণুর মত এক জায়গায় হতভম্ব হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। সনাতনবাবু আর তার মা তাই সতীর কাণ্ড দেখে অবাকই হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
শাশুড়ী আবার ডাকলেন–বৌমা–শোন এদিকে–
সতী তখন ছুটতে আরম্ভ করেছে গেটের দিকে। একবার গেট-এর দিকে যেতে পারলে ঘোষ-বাড়ির সুনামকে আর ধরে রাখা যাবে না। শিরীষ ঘোষের গৃহলক্ষ্মী প্রিয়নাথ মল্লিক রোড ধরে হাজরা রেপাড়ে গিয়ে পড়লে শহরের মধ্যবিত্ত নোংরায় সে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
শাশুড়ী আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন–দারোয়ান গেট বন্ধ করো–দারোয়ান–
সনাতনবাবু বললেন–দারোয়ান গেট বন্ধ করো–
চিৎকার শুনে ঘোষবাড়ির যে-যেখানে ছিল সবাই দৌড়ে এল। বাতাসীর মা, ভূতির মা, ঠাকুর, কৈলাস, ড্রাইভার সবাই। ঘোষবাড়ির গেটে দারোয়ান সজাগই থাকে সবসময়। সতী গেট পর্যন্ত পৌঁছবার আগেই ঝন ঝন করে একটা যান্ত্রিক শব্দ হলো। আর সতী গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লো বন্ধ গেটটার ওপর।
.
বালিগঞ্জ স্টেশনের সাইডিং-এর ওপর দরজা-বন্ধ সেলুনের ভেতরে বসে গল্প শুনতে শুনতে দীপঙ্করের যেন দম আটকে এল। দীপঙ্কর ভুলে গেল পাশের সেলুনেই রবিনসন সাহেব, আর মিসেস রবিনসন রয়েছে। রয়েছে তাদের কুকুর জিমি। ভুলে গেল সে এসেছে ডিউটিতে।
শম্ভু থামতেই দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-তারপর?
শম্ভু বললে–তারপর আর কী দাদাবাবু, তারপর থেকেই হুকুম হয়ে গেল বৌদিমণিকে আর বাইরে বেরোতে দেওয়া হবে না।
শম্ভু আরো অনেক কথা বলে গেল। কেমন করে সতীর শাশুড়ী সতীকে দিন-রাত নজরবন্দী করে রেখেছে। কোথাও বেরোতে দেয় না। এখন প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের সদর গেট-এ তালাচাবি বন্ধ থাকে দিনরাত। যখন কেউ বেরোয়, দারোয়ানকে বলে চাবি খুলে তবে বেরোয়। পেছনের খিড়কির একটা দরজা ছিল, সেটাতেও চাবি পড়ে গেছে। খিড়কির দরজার চাবি থাকে মা-মণির কাছে। সে চাবি চাইবার দরকার হয় না কখনও। বাইরের মেথর সে-দরজা দিয়েই ভেতরে আসতো নর্দমার ময়লা পরিষ্কার করতে। আজকাল সদর দিয়ে ঢোকে। সরকারবাবু কৈলাসকে নিয়ে বাজার করতে যাবার সময় দরজা খুলে দেয় দারোয়ান, তারপর আবার চাবি বন্ধ করে দেয়। বাতাসীর মা ভাড়ার ঘরের ভেতরে বসে বসে আপন মনেই গজ গজ করে–কী সব্বনেশে শাশুড়ী মা, এ কি তোমার গাঁটের কড়ি, যে চাবি দিয়ে সিন্দুকে বন্ধ করে রাখবে গা–
যখন কেউ থাকে না কাছে তখন বাতাসীর মা এক-একবার সতীর কাছে যায়। বলে–তোমার কিসের দায় বৌদিমণি? কিসের দায় তোমার শুনি? তোমার বাপকে চিঠি লিখে দাও না বাছা, বাপ এসে তোমাকে নিয়ে যাক, দেখি কী করে মাগী আটকায়! বউ করে ঘরে এনেছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি মাগী?
সতী বলে-তুমি এখন যাও বাতাসীর মা, এ-সব শুনতে আমার ভালো লাগে না–
ভূতির মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাছে আসে। চারদিকে দেখে নিয়ে বৌদিমণির ঘরে আসে। বলে-একবার এলাম বৌদিমণি–
সতী বলে-কেন এলে ভূতির মা, তোমাদের চাকরিটা যাবে শেষকালে–
ভূতির মা বলে–মা-মণি নেই এখন বৌদিমণি, বাইরে গেছে, তাই তো ভরসা করে এলুম
সতী বলে-শাশুড়ী থাকুক আর না-থাকুক, তোমরা আমার কাছে এসো না ভূতির মা–জানতে পারলে তোমাদের ওপরেই আবার চাপ দেবে, ভাববে আমিই বুঝি ডাকি তোমাদের–
ভূতির মা বলে–সে যা হবার হবে বৌদিমণি, তোমার যদি কিছু কাজ থাকে তো বলো আমি করে দিই-চিঠিপত্তর কিছু যদি পাঠাতে চাও কারো কাছে তো আমাকে বলল
শাশুড়ী যদি বাইরে কোথাও যান তো বেশিক্ষণ থাকেন না বাড়ি ছেড়ে। কলকাতার মধ্যেই আশেপাশে আত্মীয়স্বজন আছে। দেখা করে আসেন। যাবার সময় দারোয়ানকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে যান। বলেন–দারোয়ান, গেটে চাবি লাগিয়ে দেবে আমি যাবার পর, সবদিকে যেন নজর থাকে, খুব হুঁশিয়ার, বুঝলে–
দারোয়ান বলে-বুঝেছি মাইজী–
যাবার সময় সনাতনবাবুকেও বলে যান। সনাতনবাবুর কাছে গিয়ে বলেন-সোনা, আমি একবার বেরোচ্ছি, নদিদির বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি বাড়িতে আছো তো?
সমস্ত দিনটা যে কেমন করে কাটে, কেমন করে চলে যায়, তা শুধু সতীই জানে। শাশুড়ী পাশের ঘরে থাকে। শোবার ঘরের পাশে পুজোর ঘর। পুজোর ঘরে বসে জপতপ করেন। কিন্তু নজর সবদিকে। পুজো করতে করতেই হঠাৎ কি খেয়াল হয়। ডাকেন বৌমা, অ বৌমা–
সতী গিয়ে কাছে দাঁড়ায়।
শাশুড়ী বলে–কোথায় ছিলে? আমি তোমায় কখন থেকে ডাকছি—
সতী সে-কথার জবাব দেয় না, বলে–কী বলবেন, বলুন–
শাশুড়ী রেগে যান। বলেন-তুমি অমন করে কথা বলছো কেন, তোমার কী হয়েছে? কী হয়েছে বলো তো তোমার?
সতী বলে–আপনি কী জন্যে ডেকেছিলেন, তাই বলুন–
শাশুড়ী তখন আরো রেগে যান। বলেন–তোমার লঘু-গুরু জ্ঞান নেই বৌমা? কার সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় তুমি জানো না?
কী কথা থেকে কী কথা এসে যায়। সামান্য ব্যাপার থেকে একেবারে তুমুল কাণ্ড বেধে ওঠে। শাশুড়ী বলেন–বৌমা, তোমার বাবার কাছে যা করতে করতে, এখেনে ঘোষবাড়িতে ওসব চলবে না, এই আমি তোমায় বলে রাখলুম–
সতী কিছু বুঝতে পারলে না। বললে–কী চলবে না?
শাশুড়ী বলেন-দেখ বৌমা, তুমি লেখাপড়া জানা মেয়ে বলে ভেবো না আমি মুখ মানুষ
সতী বলে–এসব কথা কেন বলছেন আপনি আমাকে? আমি কী করেছি? কেনই বা আমাকে ডাকেন আপনি? আমি কি চোর না ডাকাত?
শাশুড়ী বলেন–দ্যাখো বৌমা, আমি এখন পুজোয় বসেছি। আমাকে বিরক্ত কোর, যাও–
–কিন্তু আপনিই তো আমায় ডাকলেন।
–আবার কথা বলছো?
এরপর আর সতী দাঁড়ায় না। শাশুড়ী আবার ডাকেন। বলেন-যেও না বৌমা, শোন–সতী ফিরে দাঁড়ায়।
শাশুড়ী বললেন–ভেবো না বুড়ো মানুষ বলে আমি চোখ-কানের মাথা খেয়ে বসে আছি, আমি সব দেখতে পাই, সব শুনতে পাই।
তারপর একটু থেমে বললেন–ঝি-চাকর-বাকরের সঙ্গে অত শলা-পরার্মশ ভাল নয়। ওরা হলো ছোটলোক, ওদের সঙ্গে অত কথা বললে ওরাই তোমার মাথায় চড়ে বসবে একদিন–সেটা কি তোমার পক্ষে ভালো হবে?
সতী খানিকক্ষণ শাশুড়ীর মুখের দিকে সোজা চেয়ে রইল। তারপর বললে–আর কিছু বলবেন?
শাশুড়ী বললেন–বলবার আমার অনেক কথা আছে বৌমা, কিন্তু এখন পুজোয় বসেছি, তাই বেশি বলা হলো না, তুমি যাও, তোমার জন্যে আমার ধম্মকম্ম সব মাথায় উঠবে দেখছি।
বলে তিনি আবার পুজোয় মন দেবার চেষ্টা করেন। সতী তখন একেবারে নিচে নেমে গেছে। সনাতনবাবু নিজের লাইব্রেরী ঘরে পড়ছিলেন। একেবারে ঝড়ের মতন গিয়ে ঢুকলো সতী সেই ঘরে।
সনাতনবাবু চমকে উঠলেন। বললেন–এসেছো? এই তোমার কথাই ভাবছিলাম–
–আমার কথা? আমার কথা তুমি ভাবো?
সনাতনবাবু বললেন–সেদিন তুমি বলছিলে না কোথাও বেরোতে পাও না, কোথাও যেতে পাও না, তাই ভাবছিলাম তুমিও আমার মত বই পড়ো না, এই দ্যাখ, কী চমৎকার একটা বই..
সতী বললে–আচ্ছা, তোমরা কি চাও আমি আত্মঘাতী হই?
সনাতনবাবুর মুখটা শুকিয়ে গেল, বললেন–আমরা?
–হ্যাঁ, তোমরা! আমি কি বাঘ না ভালুক, চোর না ডাকাত! আমাকে এভাবে আটকে রেখেছ কেন?
–তোমাকে আটকে রেখেছি? আমরা?
–আটকে রাখোনি? জানো না তুমি? চাকর-ঝিদের সঙ্গে কথা বলা পর্যন্ত বারণ! আমার জন্যে সদর গেটে পর্যন্ত তালা-চাবি দেওয়া থাকে! কোথাও চিঠি লিখতে পারবো না! টেলিফোন লাইনটা পর্যন্ত সরিয়ে দরজাবন্ধ ঘরের বেতর রাখা হয়েছে! কেন? আমি পালিয়ে যাবো বলে? আর আমি যদি পালাই-ই তো তোমরা আমাকে ধরে রাখতে পারবে? সে-ক্ষমতা তোমাদের আছে?
–এসব তুমি বলছো কি? তুমি পালাবে মানে?
সতী বললে–আমি যদি মরেই যাই তো তাতেই বা তোমাদের কী এসে যায়? আমার জন্যে তো তোমাদের গায়ে একটুকু আঁচড় লাগবে না! তোমরা তো বাঁচবে তা হলে! তোমাদের টাকা, তোমাদের নাম তোমাদের বংশ…..
–ছি, কী যে বলো! তুমি রেগে গেছ খুব দেখছি, বোস, বোস, এখানে বোস, মাথা ঠাণ্ডা করো
সতী বললে–না, তোমার ঘরে আমি বসতে আসিনি–
সনাতনবাবু বললেন–বসতে না-ই বা এলে তবু যখন এসেছ তখন বোস না একটু–তোমার তো কোনও কাজ নেই এখন–
–কাজ? কাজ কি তোমরা দিয়েছ আমাকে? এ-বাড়ির কোনও কাজে কি আমার হাত দেবার অধিকার আছে?
–আচ্ছা, কাজ না-হয় না-ই করলে, আমিও তো কোন কাজ করি না, একটু না হয় বসেই রইলে আমার কাছে!
সতী যেন কেমন অবাক হয়ে চেয়ে রইল সনাতনবাবুর মুখের দিকে। বললে–তুমি আজ এই কথা বললে?
–কেন, আমি তো কতবার তোমাকে বলেছি!
–কী বলেছ?
সনাতনবাবু বললেন–বলেছি তো যে আমার সঙ্গে তুমিও লেখাপড়া, করো, কত জিনিস জানতে পারবে, কত আনন্দ পাবে। এসো না একসঙ্গে পড়ি এই বইখানা ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট-কী সব ভালো-ভালো কথা লিখেছে, জানো–একবার পড়তে আরম্ভ করলে আর ছাড়তে পারবে না–এ-বইখানা প্রথম ছাপা হলো উনিশশো আঠারো সালে–
সতী বললে–তোমার কাছে এলে কি কেবল এইসব কথাই শুনতে হবে? আর কিছু কথা নেই তোমার?
–কেন, এ-সব কথা তোমার ভালো লাগে না?
সতী বললে–তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে কি এইসব কথা বলবার জন্যে?
সনাতনবাবু হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন সতীর দিকে। যেন কিছু বুঝতে পারলেন না তিনি।
সতী বলতে লাগলো–তুমি জেগে-জেগেও বই পড়বে, ঘুমিয়ে-ঘুমিয়েও বই-এর স্বপ্ন দেখবে, তাহলে কেন তুমি বিয়ে করেছিলে! আর যার মা এমন তার বিয়ে করাই বা কেন!
–মা’র কথা বলছো? তা মা তো অন্যায় কিছু করে না। মা তো তোমার ভালোর জন্যেই বলে, মা তো তোমার ভালোই চায়
হঠাৎ পেছনে নিঃশব্দে কখন মা এসে দাঁড়িয়েছিলেন, টের পায়নি দুজনেই।
মা বললেন–বৌমা, তুমি কি নালিশ করবার জন্যেই এসেছো সোনার কাছে?
সনাতনবাবু বললেন–না মা, নালিশ করছে না তো, ঠিক নালিশ নয়–
–থামো তুমি-আমি বৌমাকে বলছি, বৌমা আমার কথার জবাব দেবে–।
সতী চুপ করে পাথরের মত দাঁড়িয়েছিল। এবার সোজা মুখ তুলে চাইল শাশুড়ীর দিকে। হয়ত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই শাশুড়ী বললেন–আমার দিকে চেয়ে অমন করে চোখ রাঙাচ্ছ যে বড়! কাকে তুমি চোখ রাঙাচ্ছ শুনি? তোমার চোখরাঙানিতে আমি ভয় পাবো না বৌমা, আমাকে তুমি তেমন মেয়েমানুষ পাওনি। এসো, চলে এসো এ-ঘর থেকে। আমি তোমাকে বলেছি না, যখন-তখন সোনার কাছে আসবে না, যখন-তখন বরের সঙ্গে দেখা করা আমি পছন্দ করি না–
সতী মাথা নিচু করলো। তারপর আস্তে আস্তে কোনও কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মা বললেন–দেখলে তো সোনা, বৌমার তেজটা দেখলে তো একবার! কী-রকম মাটি মাড়িয়ে মাড়িয়ে গেল–তুমি তো নিজের চোখেই দেখলে!
সনাতনবাবু কথাটা বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন–মাটি মাড়িয়ে মাড়িয়ে গেল মানে?
মা বললেন–ওকেই তো মাটি মাড়িয়ে মাড়িয়ে যাওয়া বলে-তুমি তো সংসারের কিছুই জানলে না, কিছুই দেখলে না, তা এখন সব দেখ–
–সব দেখবার এখনও অনেক বাকি আছে মা!
হঠাৎ যেন বজ্রপাত হলো। শাশুড়ীও দেখলেন, সনাতনবাবুও দেখলেন-সতী দরজার বাইরে গিয়েও যেন তাদের কথা শুনছিল এতক্ষণ। তাঁরা টের পাননি। সতী দরজার সামনে এসেই বললে–সব দেখার এখনও অনেক বাকি আছে
–কী বললে?
–বলছি, এখন দেখার হয়েছে কী, দেখার এখনও অনেক বাকি আছে!
–তার মানে?
সতী বললে–বলছি, যে সব দেখবে, সে একদিন জগৎ দেখবে!
–তোমার আস্পর্ধা তো কম নয় বৌমা? তুমি আমার মুখের ওপর কথা বলো? কিন্তু যাকে বলা সে ততক্ষণে দুম দুম করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেছে। শাশুড়ীও। পেছনে-পেছনে গেলেন। সিঁড়ির পর বারান্দা। সেই বারান্দার শেষে বাঁদিকে সতীর ঘর। সতী নিজের ঘরে গিয়েই দরজায় দড়াম করে খিল বন্ধ করে দিয়েছে। শাশুড়ীও বউ-এর পেছনে-পেছনে সিঁড়ি দিয়ে উঠে বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে খানিক দাঁড়ালেন। তারপর হতাশায় রাগে যেন নিজেকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবেন মনে হলো। অসহায়ের মত সেইখানে দাঁড়িয়েই ফুলতে লাগলেন। তাঁর মুখ যেন বোবা হয়ে গিয়েছে। চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন–শম্ভু, শম্ভু, ও শম্ভু—
.
–তারপর?
শম্ভু বললে–আজ্ঞে, আমরা তখন সব দেখছিলাম লুকিয়ে লুকিয়ে। বাতাসীর মা, ভূতির মা, কৈলাস, আমি, সরকারবাবু সকলের কানেই কথাগুলো গিয়েছিল। মা-মণির গলা তো খাটো নয়। বাজখাই গলা মাগীর।
বাতাসীর মা বললেছি ছি, আমি হলে অমন শাশুড়ীর মুখে নুড়ো ঘষে দিতুম না–
ভূতির মা বললে–বৌদিমণি ঠিক করেছে, মা-মণির মুখের মত জবাব দিয়েছে– ঠ্যাকার ভাঙবে এবার–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তাহলে তোমার বৌদিমণির ওপর খুব অত্যাচার হচ্ছে তো!
–আজ্ঞে, অত্যাচারের আর কতটুকু বললাম আপনাকে! দূর থেকে আপনি কতটুকুই বা জানতে পারবেন! আমরা বাড়ির ভেতরে থাকি, তাই কিছু দেখতে পাই শুনতে পাই। আহা, বাড়ির মধ্যে বৌদিমণির হয়ে কথা বলবার একটা মানুষ পর্যন্ত নেই!
গল্প শুনতে শুনতে দীপঙ্কর যেন একেবারে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িটার মধ্যে গিয়ে পড়েছে। যেন স্বচক্ষে সব দেখছে। সতীর কপালে এত দুঃখ ছিল, এত কষ্ট ছিল, কে তা কল্পনা করতে পেরেছিল?
শম্ভু বলতে লাগলো–তারপর মা-মণি আমাকে ডাকতেই আমি কাছে গেলাম। বললাম–কী বলছেন, মা-মণি?
মা-মণি বললেন–বাতাসীর মা কোথায়? তাকে ডাক–আর ভূতির মা, কৈলাস, তাদেরও ডেকে নিয়ে আয় আমার সামনে–সকলকে ডেকে আন আমার ঘরে-এক্ষুনি–
শম্ভু সকলকে ডেকে নিয়ে এল মা-মণির ঘরে। মা-মণির নিজের ঘরে। মা-মণি তখনও যেন অপমানে অবজ্ঞায় থর থর করে কাঁপছেন। কিন্তু বাইরে থেকে তা বোঝবার উপায় নেই। বেশ ধীর স্থির গম্ভীর চেহারা। নিজের ঘরের ভেতর কার্পেটের আসনের ওপর বসে ছিলেন। সকলকে দেখেই বললেন–সবাই এসেছিস?
বাতাসীর মা, ভূতির মা, কৈলাস, শম্ভু সবাই বললে–এসেছি মা-মণি।
মা-মণি বললেন–দারোয়ান কোথায়, দারোয়ানকে ডাক–
শম্ভু গিয়ে আবার দারোয়ানকে ডেকে নিয়ে এল। মা-মণি বললেন–দারোয়ান, গেটে ঠিক রোজ চাবি দেওয়া হচ্ছে তো?
দারোয়ান বললে–জী হাঁ–
মা-মণি বললেন–চাবি খোলা পেয়ে যদি বাড়ির বউ বেরিয়ে যায় তো তোমার চাকরি আমি খতম করে দেব দারোয়ান, এটা যেন মনে থাকে–
দারোয়ান বললে–কভি নেই মা-মণি–
–আর শম্ভু, তুই আর বৌদিমণির ফরমাজ খাটতে পারবিনি, যদি দেখি ফরমাজ খাটছিস তো তোরও চাকরি খতম হয়ে যাবে এই বাড়ি থেকে–এই বলে রাখলুম-আর বাতাসীর মা–
বাতাসীর মা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল একপাশে।
মা-মণি তাহার দিকে লক্ষ্য করে বললেন–আর বাতাসীর মা, তুমি বুড়ো মানুষ, তোমাকেও সাবধান করে দিচ্ছি বাছা, যদি তোমার ভালো চাও তো বৌমার কানে আর বিষমন্তর দিও না, এই বলে রাখছি।
বাতাসীর মা হাউ-মাউ করে উঠলো। বললে–ওমা, কোথায় যাবো গো, আমি আবার কখন বৌদিমণির কানে বিষমন্তর দিলাম, আমি বলে আমার বাতের ব্যথায় মরছি, আমি দেব বিষমন্তর!
মা-মণি বললেন–কে কী মন্তর দেয় বৌমার কানে সব আমার জানা আছে। সব আমার কানে যায়, আমার সবদিকে নজর আছে, আমার দশটা চোখ-তা নইলে এই ঘোষবাড়িকে এতদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারতুম না! কবে দেউলে হয়ে যেত, তা জানো?
বাতাসীর মা বলতে লাগলো-ওমা, কী সব্বনেশে কথা মা, আমি বলে বুড়োমানুষ, তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, আমি বিষমন্তর দেব তোমার বৌমার কানে–আমার কি পরকালের ভয় নেই গা?
মা-মণি বললেন–মড়া-কান্না নিচেয় গিয়ে কাঁদো গে বাতাসীর মা, এখানে আর জ্বালিও না আমাকে, যাও–
বাতাসীর মা চলে গেল গজ গজ করতে করতে।
–আর, শম্ভু শোন,ফের যদি কোনও দিন শুনি যে, তুই বৌমার চিঠি ফেলতে গেছিস তো তোরই একদিন কি আমারই একদিন! অত যদি দরদ তোর বৌমার জন্যে তো এ-বাড়িতে থাকা চলবে না–
অনেকক্ষণ ধরে অনেক বকুনির পর মা-মণি সকলকে ছেড়ে দিলেন। তারপর রান্না বাড়ির দাওয়ায় জটলা বসলো। প্রথমে ফিস ফিস। তারপরে গুজ গুজ। বাতাসীর
মা বললে–আমি কারো পরোয়া করিনে, কিসের পরোয়া শুনি! কাকে ভয়? আমি মেদিনীপুরের মেয়ে, আমাকে শাসানো? আমি দেখিয়ে দেব না।
ভূতির মা বললে–তা তখন তো মা-মণির মুখের ওপর কথা বেরোল না, এখন যে ফোঁসফোসানি বড়
–থাম তুই, ছোট মুখে বড় কথা! বলি তোর কীর্তি জানিনে আমি? কার সগ্যে বাতি দিয়ে বাঁজা মাগী সেজেছিলি, বলবো? হাটে হাঁড়ি ভাঙবো?
দীপঙ্কর বাধা দিয়ে বললে–ও-সব কথা থাক শম্ভু, তারপর কী হলো বলো? তোমার বৌদিমণি ঘরে খিল দিয়েই পড়ে রইল সারাদিন?
শম্ভু বললে–সেই কথাই তো বলছি দাদাবাবু, সেই কথা বলতেই আসা। রাত্তির বেলা ঠাকুর জিজ্ঞেস করলে-বৌদিমণি খাবে না? দাদাবাবু খেলেন, মা-মণিও পরোটা খেলেন। কিন্তু বৌদিমণির খাবার কথা কেউ বলে না। আমি মা-মণিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলুম-বৌদিমণিকে খেতে ডাকবো মা-মণি?
মা-মণি বললে–আর আদিখ্যেতা করে খেতে ডাকতে হবে না, যার খিদে পাবে সে নিজে এসে খেয়ে যাবে-তোর অত টান কেন শুনি?
–তা আমারও সাহস হলো না আজ্ঞে যে বৌদিমণিকে গিয়ে ডাকি! শেষে বাতাসীর মা গেল। বৌদিমণির ঘরের সামনে গিয়ে ডাকলে-বৌদিমণি, খাবে না আজ?
ভেতর থেকে কেউ উত্তর দেয় না। কোনও সাড়াশব্দ নেই। আমার বড় ভয় করতে লাগলো আজ্ঞে। কতরকম কাণ্ড তো হতে পারে! মেয়েমানুষের মন তো, কিছু বলা যায় না। ছেলে মারা যাবার পর বৌদিমণি এইরকম তিনদিন খায়নি। তিন রাত্তির ঘরের দরজা খোলেনি। সে-সব তো জানি। সে-সব কি দিন গেছে বাড়িতে! ছেলেটাকে যখন শ্মশানে নিয়ে গেল, তখন কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল বৌদিমণি–কিছুতেই আর জ্ঞান আসে না। ডাক্তার এসে ওষুধ দিলে তবে চৈতন্য ফিরে আসে। তখন ওই শাশুড়ী মাগীই কী হেনস্থা করেছিল–সে তো সকলের মনে আছে! আমার তাই কেমন ভয় করতে লাগলো। আমিও দরজার সামনে গিয়ে ডাকলুম-বৌদিমণি, খেয়ে নাও, খাবে না? দরজা খোল–
ক্রমে আরও রাত হলো।
মা-মনি ডাকলেন আমাকে। বললেন–যা, দাদাবাবুকে ডেকে নিয়ে আয় লাইব্রেরী ঘর থেকে–
দাদাবাবুকে ডেকে নিয়ে এলুম। দাদাবাবু আসতেই মা-মণি বললেন–সোনা, আজকে আর বেশি পড়াশুনা করতে হবে না, আজকে শুয়ে পড়ো–
দাদাবাবু চলে যাচ্ছিল নিজের ঘরের দিকে। মা-মণি বললে–ওদিকে যাচ্ছো কোথায়, আজকে ওঘরে নয়, এই আমার ঘরে শোও–
সনাতনবাবু যেন অবাক হয়ে গেলেন। বললেন–কোন ঘরে?
মা-মণি বললেন–এই আমার ঘরে, আজ থেকে তুমি আমার ঘরেই শোবে বাবা–
–কেন মা?
মা-মনি বললেন–তর্ক করা না তুমি, যা বলছি শোন, আমার ঘরেই তোমার বিছানা করিয়েছি।
–তা হলে তুমি কোথায় শোবে?
মা-মণি বললেন–দুজনেরই জায়গা হবে আমার ঘরে। আমার কোনও অসুবিধে হবে না–
–তাহলে তোমার বৌমা কোথায় শোবে মা?
–বৌমার কথা আর বোল না তুমি। আমার খুব শিক্ষা হয়ে গেছে। আমাকে বলে কিনা জগৎ দেখাবে! কত বড় আস্পর্ধা মেয়েমানুষের! যার এত তেজ, তার এ বাড়িতে থাকা কী করতে?
সনাতনবাবু মার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ কী ভাবলেন। দু’পাশে দুটো খাট। এতদিন একটা খাটই ছিল ঘরে। দেয়ালের গায়ে ঠাকুর-দেবতার ছবি টাঙানো, মা পুজো জপ তপ নিয়েই থাকেন সারাদিন। হঠাৎ যেন নিজের শোবার ব্যবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেছেন। বললেন–তা বৌমাকে বলেছ তো?
–কী আবার বলবো!
সনাতনবাবু বললেন–যে এবার থেকে আমি এখানে তোমার কাছে শোব?
তা সে-কথাও কি বৌমার কাছে অনুমতি নিয়ে করতে হবে? আমি কেউ না? আমার কথাটা কি এতই ফ্যালনা? বৌমা আজ নতুন এসেছে এ-বাড়িতে? তার অনুমতি নিয়ে তবে আমাকে কাজ করতে হবে নাকি?
সনাতনবাবু বিব্রত হয়ে পড়লেন। বললেন–না না, তা ঠিক বলছি না আমি–
–তবে? আমি হুকুম দিলাম আজ থেকে তুমি আমার কাছে শোবে। তাতে কার মনে কী হবে তা-ও কি আমি ভাবতে যাবো? এতটুকু বেলায় যখন তোমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি, তখন বৌমা কোথায় ছিল শুনি? সেই বৌমাই আজ আপন হয়ে গেল, আর মা-বেটি হয়ে গেলাম পর!
সনাতনবাবু তাড়াতাড়ি বিছানায় বসে পড়লেন। বললেন–আমি কি তাই বলেছি?
–বলবে কেন! মুখ দেখেও তো মনের ভাব বোঝা যায়! তোমার মুখের সামনেই তো আমাকে বললে জগৎ দেখাবে! তা কে কাকে জগৎ দেখায় দেখা যাক। আমিও মরছি না এত শিগগির। আমিও দেখাবো জগৎ দেখাতে জানি কি না! আমিও ঘোষবাড়ির বউ! ন’দিদি ঠিকই বলেছে–তোর বউকে অত আদর দিয়ে দিয়েই ওর মাথাটা খেয়েছিস তুই নয়ন–
তা সেই ঘরেই সনাতনবাবুর রাত ভোর হলো সেদিন। সেই এক ঘরে। তিনি। পড়লেন আর ঘুমোলেন। কোথা দিয়ে রাত কেটে গেল বুঝতে পারলেন না। প্রত্যেক দিন ভোরবেলা শাশুড়ী গিয়ে বৌমার ঘরের সামনে গিয়ে ডাকাডাকি করেন। কিন্তু সেদিন আর ডাকলেন না। সতীর ঘরের দরজাও খুললো না।
শম্ভু গিয়ে আস্তে আস্তে টোকা মারলো দরজায়।
–বৌদিমণি, বৌদিমণি, আমি শম্ভু!
তবু কেউ দরজা খোলে না। কেউ সাড়া দেয় না।
শম্ভু বললে আমার বুকটা কেমন দুর-দুর করে কাঁপতে লাগলো হুজুর। কেমন যেন মনে হলো যদি কিছু বিপদ ঘটে থাকে! যদি….আর ভাবতে পারলুম না। বড় ভয় করতে লাগলো। শরীরের মধ্যে হাত-পাগুলো সেঁধিয়ে যেতে লাগলো ভয়ে।
বললাম–বৌদিমনি দরজা খুলুন, মা-মণি কলঘরে নাইতে গেছে–
কিছুতেই দরজা খুললো না আজ্ঞে। কাল সন্ধ্যেবেলা দরজায় খিল দিয়েছে, আর আজ এত বেলা হলো, খেলে না দেলে না, কিছু করলে না। আমার বড় ভয় করছে হুজুর, তাই খুঁজে খুঁজে দুপুরবেলা আপনার খোঁজে বেরিয়ে পড়লুম–
দীপঙ্কর বললে–তা তুমি যে বললে বৌদিমণি আমার কাছে পাঠিয়েছে তোমায়?
শম্ভু বললে–আজ্ঞে, আমি মিথ্যা কথা বলেছিলুম তখন, আমার মাথার ঠিক ছিল না, আমার বড় ভয় করছে কাল থেকে! আমি কার কাছে যাব, কাকে খবর দেব, কিছুই বুঝতে পারছি নে! একটা মানুষ ঘরের মধ্যে বন্ধ হয়ে রইল, আমি কেমন করে চুপ করে থাকতে পারি বলুন–তাই আপনার কাছে দৌড়ে এসেছি। কালীঘাট থেকে এই ঠিকানা নিয়ে এসেছিলাম
–তা বাড়ির লোক কেউ কিছু বলছে না? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে না?
–কে কী বলবে আজ্ঞে? বৌদিমণির জন্যে কার এত মাথাব্যথা হবে বলুন?
দীপঙ্কর অনেকক্ষণ ভাবতে লাগলো আপন মনে। বললে–তা এ-ব্যাপারে আমি কী। করতে পারি বলো তো শ? ওদের বাড়ির অন্দর মহলের ব্যাপারে আমার কথা ওরা শুনবে কেন?
শম্ভুবললে–কিন্তু আপনি না বললে আর কে বলবে? আর কে আছে বৌদিমণির? আপনি বললে তবু বৌদিমণি দরজা খুলতে পারে! যদি বেঁচে থাকে তো আর কারো কথা শুনবে না, শুধু আপনার কথাই শুনবে
দীপঙ্কর বললে–তোমাকে কে বললে যে আমার কথা শুনবে!
শম্ভু বললে–হ্যাঁ দাদাবাবু, আমি সব জানি, বৌদিমণি যদি কারো কথা শোনে তো সে দাদাবাবু নয়, মা-মণি নয়, একমাত্তর আপনি। বাতাসীর মা, ভূতির মা, সবাই আমাকে তাই বললেশম্ভু, তুই সেই সেদিনকার দাদাবাবুকে ডেকে নিয়ে আয়, সেই বাবু এলে তবে হয়ত বৌদিমণির রাগ পড়বে
–কিন্তু তোমার বৌদিমণির রাগ ভাঙাতে গিয়ে শেষে কি তোমার মা-মণির গালাগালি খাবো আবার?
শম্ভু বললে–আজ্ঞে, বৌদিমণির জীবনের চেয়ে মা-মণির গালাগালিটার কথাই আপনি বেশি ভাবলেন? আর বৌদিমণি যদি একটা সব্বনাশ বাধিয়ে বসে তো তখন?
দীপঙ্কর নিজের মনেই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলো। হয়ত দীপঙ্কর গেলে সতীর ওপর অত্যাচার আরো বাড়বে। তাছাড়া সতীর স্বামী আছে। তাদের চেয়ে কি দীপঙ্করই সতীর ভালো-মন্দ বেশি বুঝবে? দীপঙ্কর কে? সতীর কে? কেউ নয়। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কেউই নয়। কোনও অধিকারই বলতে গেলে নেই দীপঙ্করের। কোন অধিকারে তাহলে সে যাবে সেখানে? গিয়ে কী বলবে সতীর শাশুড়ীকে? সতীর স্বামী সনাতনবাবুকে? আর দীপঙ্করের কথাই যে সতী শুনবে, তারই বা নিশ্চয়তা কী? সতীর যদি অভিমানই থাকে তো সে দীপঙ্করের ওপর নয়। তবে দীপঙ্করের কথায় কেন তার রাগ ভাঙবে?
শম্ভু বললে–এখন একবার যাবেন দাদাবাবু? এখন না গেলে দেরি হয়ে যাবে বড়। পরে আর হয়ত দেখা হবে না
দীপঙ্কর কিছু উত্তর দিতে পারলে না হঠাৎ। শম্ভু তার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে একদৃষ্টে। আর দীপঙ্কর বাইরের প্ল্যাটফর্মের অগণিত জনস্রোতের দিকে চেয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আছে।
–কাল সারারাত ঘুম হয়নি আমার আজ্ঞে, কী করবো কিছু ঠিক করতে পারিনি আমরা। তাই সকালবেলাই বাতাসীর মাকে বললুম। বাতাসীর মা সেকালের লোক তো। মা-মণির ওপর হাড়ে হাড়ে চটা। তা ভূতির মা-ও ছিল কাছে। সবাই বললে সেদিনকার দাদাবাবুর কাছে গিয়ে খবর দিয়ে আয়, অন্তত বাপকে যেন খবরটা দিয়ে দেয়। তা আপনার ঠিকানা তো জানতাম না, ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে সে বলে দিল। সেখান থেকে সোজা এখানে আসছি।
দীপঙ্কর বললে–দেখ শম্ভু, এখন তো আমি যেতে পারবো না, আমি এখন আমাদের অফিসের সাহেবের সঙ্গে কাজে বেরিয়েছি–
–তা কাজ শেষ করেই না-হয় যাবেন!
দীপঙ্কর বললে–কাজ শেষ হতেও দেরি হবে আজ, এখনি সাহেবের সঙ্গে গড়িয়াহাটের লাইন দেখতে যেতে হবে, সেখান থেকে কখন ফিরতে পারবো, তা-ও ঠিক নেই
–হুজুর সাহেব ডেকেছে।
হঠাৎ দ্বিজপদ সেলুনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। দীপঙ্কর উঠলো। বললে–বলো যাচ্ছি–
শম্ভু যেন অনিচ্ছের সঙ্গেই উঠলো। বললে–তবে আমি আসি দাদাবাবু–
দীপঙ্কর কি বলবে বুঝতে পারলে না। খানিক পরে বললে–আমাকে তুমি কেন যে খবরটা দিলে বুঝতে পারছি না শম্ভু। আমি কোনও উপকারই করতে পারবো না তোমার বৌদিমণির, শুধু শুধু কষ্ট করে আমাকে বলতে এলে এতদূর–
শম্ভু নিচে নামতে নামতে বললে–আপনি যা ভালো হয় করবেন, আমি আর কিছু বলবো না–
শম্ভু সত্যিই চলে যাচ্ছিল। দীপঙ্কর সেলুনের দরজায় দাঁড়িয়ে আর একবার ডাকলে। বললে কী হয় শেষপর্যন্ত আমাকে একবার জানাবে?
শম্ভু যেন খুশী হয়নি। বললে–দেখি কী করি–
শম্ভু আস্তে আস্তে লাইন পেরিয়ে চলে গেল। দীপঙ্কর সেখানেই, সেই সেলুনের দরজার হ্যাঁন্ডেলটা ধরেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ভিড়। এখুনি লক্ষ্মীকান্তপুর লোক্যাল আসবে। অনেক লোক জমায়েত হয়েছে। ওদিকে চায়ের স্টল। অথচ সব যেন কেমন ফাঁকা মনে হলো। মনে হলো হঠাৎ বড় নির্জন হয়ে গেল জায়গাটা। যেন আবার ঝড় উঠবে। আবার কাল-বৈশাখীর ঝড়ে সমস্ত কিছু উড়ে যাবে। ঠিক যেমন করে ছোটবেলায় ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে ঝড় উঠতো সেইরকম। ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে হাজি কাশিমের বাগানের নারকোল গাছগুলো এপাশ থেকে ওপাশে দুলতো। কী ভয় যে করতো তখন দীপঙ্করের। সত্যিই অনেকদিন ঝড় হয়নি কলকাতায়। সারা পৃথিবীতেই যেন অনেকদিন কেউ ঝড় উঠতে দেখেনি। যেন এতদিন এত বছর ধরে কেবল ঝড়ের প্রস্তুতি চলেছে। যেন পশ্চিমের আকাশটায় একটু একটু করে মেঘ জমেছে কেবল। মেঘ জমেছে ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে, মেঘ জমেছে গড়িয়াহাটার লক্ষ্মীদির বাড়িতে আর জমেছে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে। অনন্তরাও ভাবে যেন সেই ঝড়ের অগ্রদূত, ভিভিয়ান লে-ও যেন সেই ঝড়ের বার্তাবহ আর সনাতনবাবুও যেন সেই ঝড়ের পুরোধা! দীপঙ্করই কি সেদিন কল্পনা করতে পেরেছিল সেই ঝড়ে সবাই একদিন জড়িয়ে পড়বে। বুঝতে পেরেছিল যে, সে-ঝড় থেকে দীপঙ্করও রক্ষা পাবে না?
দীপঙ্করের সমস্ত জীবনটা যেন তিনটে জায়গার সঙ্গে একেবারে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। কোথায় জন্ম, তারপর কোথায় বড় হওয়া, আর তারপর দিনে দিনে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার রৌদ্র-ছায়ায় সে বেড়ে উঠলো। অথচ কাউকেই ত্যাগ করতে পারলো না। সেই ছোটবেলার ছোট পরিধির সঙ্গে যেন আজকের এই বড় মানুষটার কোনও তফাৎ রইল না আর। শুধু বয়সেই বাড়লো, অভিজ্ঞতাই বাড়লো, কিন্তু জীবন বড় হলো না। দৃষ্টি পরিষ্কার হলো না। নইলে কেন সে সব জেনেও নিজের ছোট মনের ছোট পরিধিতে আশ্রয় দিয়েছিল সতীকে। যে সতী পরের স্ত্রী! যে সতী প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের ঘোষবাড়ির কুলবধূ! কেন তা জেনেও তার ভাল-মন্দর ভার তুলে নিয়েছিল নিজের হাতে?
কিন্তু সে-কথা এখন থাক।
রবিনসন সাহেব তৈরিই ছিল নিজের সেলুনে। মিসেস রবিন্সও তৈরি ছিল। তৈরি ছিল জিমি।
রবিনসন সাহেব বললে–আর ইউ রেডি সেন?
–ইয়েস স্যার!
–আমারাও রেডি!
রবিনসন সাহেব উঠলো। মিসেস রবিন্সও উঠলো সাহেবের পেছনে। রবিনসন সাহেব বললে–জিমি ইজ ভেরি জলি টু-ডে-জিমি আজ খুব খুশী, জানো সেন–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–হোয়াই?
সাহেব বললে–বিকজ মিসেস আমাদের সঙ্গে আছে
মেমসাহেব সিগারেট ধরিয়েছিল। বললে–তুমি জানো সেন, হি লাইকস মী মোস্ট
তারপর কোলে করে জিমিকে মটর ট্রলিতে তুলে নিলে। সত্যি, কী আদরের কুকুরই যে ছিল জিমি! মটর ট্রলি চালাতে লাগলো সাহেব। একটা বিচিত্র শব্দ করতে করতে মটর ট্রলি ছেড়ে দিলে। লাইন ক্লিয়ার দেবার ব্যবস্থা করেছিল মজুমদারবাবু। সাউথ কেবিনে করালীবাবু উঁকি মেরে দেখলেন জানালা দিয়ে। বড় সাহেব ইন্সপেকশনে যাচ্ছে। লেবেল ক্রসিং-এ প্রায়ই অ্যাকসিডেন্ট হয়। মদ খেয়ে কতকগুলো লোক রাস্তা পার হচ্ছিল, গুডস ট্রেন এসে সব কটাকে চাপা দিয়েছে। অনেকদিন থেকে সাহেবের ইচ্ছে ছিল সেফটি মেজারস্ আরো ভালো করতে। ওখানে লেক হয়েছে। পচা এঁদো জায়গাগুলো ভরাট করে আরো বড় লেবেল-ক্রসিং করতে হবে। গেটম্যান বাড়িয়ে দিতে হবে। মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা উচিত নয়। অনেক দিন ধরে করেসপন্ডেন্স চালিয়েছে বোর্ডের সঙ্গে। তাই নিজের চোখে স্পটটা দেখা দরকার।
দুদিকে পানা কুকুর, খাল, মেঠো পথ। বিকেলের সূর্যটা পশ্চিমদিকে ঢলে পড়ছে।
সাহেব মটরের লিভারটা টিপে বসে আছে আর ফট ফট শব্দ হচ্ছে।
রবিনসন সাহেব দু’পাশে নজর দিয়ে বললে–সী হাউ ডার্টি, ওতেই তো মশা হয়, সি-এম-ও-কে একটা নোট দিতে হবে সেন, টেক ইট ডাউন–
দীপঙ্কর হাতের ফাইলটা খুলে নোট করে নিলে। সি-এম-ও-কে চিঠি দিলেই স্টেপ নেবে মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট। ম্যালেরিওলজিস্টকে খবর দিলেই তেল ছড়িয়ে দিয়ে যাবে এখানে। এই পানা পুকুরে। এই মশাই স্টাফকে কামড়াবে। কেবিনের লোকরা মশার জন্যে ভালো করে কাজ করতে পারে না। গেটম্যানরাও মানুষ–তারাও বাঁচবে! রবি সাহেব ম্যাপ খুলতে বললে। ম্যাপ দেখতে দেখতে সাহেব ট্রলি চালাতে লাগলো। দিস এরিয়া। আগে কত বনজঙ্গল ছিল। সেসব দিনের কথা সাহেবের মনে আছে। দীপঙ্করের তখন চাকরি হয়নি। কী রকম বদলে গেছে সব। সমস্ত জায়গাটা একদিন আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট এদিকটাও শহর বানিয়ে তুলবে।
সেই গড়িয়াহাট লেবেল-ক্রসিং।
ভূষণ মালি ডিউটিতে ছিল। সাহেব আর মেমসাহেব ট্রলি থেকে নামতেই ভূষণ মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সেলাম করলে। তারপর মেমসাহেবকেও সেলাম করলে। মেমসাহেব তখন কুকুরটার গলা থেকে চেন খুলে দিয়েছে। খুলে দিয়ে সিগ্রেট ধরালে একটা।
রবিনসন সাহেব দীপঙ্করকে কাছে ডাকলে-কাম হিয়ার সেন, ডায়াগ্রামটা খোল তো–
ম্যাপটা খুলতেই সাহেব মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে লাগলো। ব্লু-প্রিন্ট। ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেন্টে তৈরি হয়েছে ট্রাফিক আপিসের চাহিদা মত। এই দেখ, এদিক থেকে লেকটা শুরু হয়েছে, এ রেল লাইনের প্যারালেল চলে যাবে ওই পশ্চিমের রসা রোড পর্যন্ত। ওদিকে ওভারব্রীজ পর্যন্ত একেবারে। তারপর একদিন দু’পাশেই শহর বেড়ে উঠবে। আরো ট্র্যাফিক, আরো ব্যস্ত হয়ে উঠবে এই লেবেল-ক্রসিং। ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের সঙ্গে চিঠিপত্রের ফাইলটাও সঙ্গে এনেছিল দীপঙ্কর। এই গুমটি ঘরও বড় করতে হবে। অনেক বড়। গুমটি ঘরে বসে লিভার টানলেই গেট বন্ধ হয়ে যাবে। ওদিকে ইস্ট কেবিন আর ওয়েস্ট কেবিন-এর মধে এক ফারলং জমি দিয়ে আরো বড় করে তৈরি করতে হবে রাস্তা। একসঙ্গে দুখানা কার্ট যাতে যেতে পারে-আপ অ্যান্ড ডাউন! কত সাধ ছিল রবিনসন সাহেবের। কত সাধের রেলওয়ে তার। দিন-রাত এই রেলওয়ের ভালোর জন্যে কী চিন্তাই করতো। রেলওয়ে আর রেলওয়ে স্টাফ–তাদের দুঃখ কষ্ট সাহেব সইতে পারতো না। আর মেমসাহেব! ভূষণ তো মা বলতে অজ্ঞান। মেমসাহেব যেন তার মা। ওই সিগারেট খাওয়াটুকুই শুধু যা পছন্দ হতো না তার। সাহেবের ইচ্ছে ছিল এই রেলওয়েকে একদিন মনের মত করে গড়ে তুলবে। ভালো ভালো স্টাফ কোয়ার্টার হবে। ভালো ভালো ইউনিফর্ম পাবে। বিনা পয়সায় স্টাফের ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়তে পাবে। হয়ত সাহেব শেষপর্যন্ত থাকলে তাই-ই হতো, কিংবা হতো না। কিন্তু সাহেব তো জানতো না একদিন বিনা নোটিশেই তার যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসবে। বিনা নোটিশেই একদিন তাকে রেলওয়ে ছেড়ে চলে যেতে হবে। আর সে কি ছোটখাটো যুদ্ধ! সাহেবও জানতো না যে, সেই যুদ্ধই আবার ছ’বছর একুশ ঘণ্টা তেইশ মিনিট ধরে চলবে। আর বিনা নোটিশেই…..
দীপঙ্করের হঠাৎ মনে পড়ে গেল। কাছেই লক্ষ্মীদি। এত কাছাকাছি। একবার যাওয়া যায় না লক্ষ্মীদির কাছে! এই তো এই রাস্তাটা ধরে একটু এগিয়ে গিয়েই ডান দিকে পড়বে বাড়িটা! দাতারবাবু কি এখনও ভালো হয়নি! অনন্তবাবু কি এখনও লক্ষ্মীদির সঙ্গে পাশের ঘরে বসে হাসাহাসি করে! অনন্তবাবু কি এখনও সেইরকম মদ খেয়ে আসে আর লক্ষ্মীদি অসঙ্কোচে তার সঙ্গে কথা বলে! একদিন লক্ষ্মীদিই তার বাবার ঠিকানা জানায়নি। ভুবনেশ্বর মিত্রের ঠিকানাটা জানতে সেদিন দীপঙ্করই গিয়েছিল প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের সতীদের বাড়িতে। তারপর দেখা না করেই ঠিকানা না নিয়েই ফিরে এসেছিল। আর আজ আবার লক্ষ্মীদির কাছেই যেতে হবে ভুবনেশ্বরবাবুর ঠিকানা জানবার জন্যে! লক্ষ্মীদি যদি ঠিকানা না দেয়? যদি জিজ্ঞেস করে ঠিকানা নিয়ে কী হবে? কার জন্যে দরকার ঠিকানা? সতীর কথা সব বললেও কি ঠিকানা দেবে না? বড় লোভ হতে লাগল দীপঙ্করের। অনেক দিন এদিকে আসেনি। এত কাছে স্টেশন রোডে বাড়ি ভাড়া করেছে, তবু আসা হয়নি। আসতে ইচ্ছে করলেও আসেনি। ইচ্ছে করেই আসেনি। কী দরকার। কিন্তু এত কাছে এসে দীপঙ্করের মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলো।
হাতের খোলা ম্যাপটা দেখতে দেখতে তখন কত কথা বলে চলেছে সাহেব। ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট, ওয়েস্ট কেবিন, গ্যাঙ ম্যান, ডবল লাইন, ব্লু-প্রিন্ট-কত সব টেকনিক্যাল কথা। কিছুই যেন কানে যাচ্ছিল না দীপঙ্করের। কিছুই যেন শুনতে ইচ্ছে করছিল না। এত কাছে এসে পড়েছে আর একবার দেখা করবে না!
হঠাৎ মেমসাহেবের যেন সম্বিৎ ফিরে এল।
–জিম্মি, মাই জিম্মি—
রবিনসন সাহেব চমকে উঠলো। দীপঙ্করও ফিরে চাইলে।
গেটটা পেরিয়ে ও-পাশের জলাজমির ধারে বুঝি ছাড়া পেয়ে জিমি একটু ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ একটা আর্তনাদে চমকে উঠেছে মেমসাহেব। মেমসাহেবের অন্তরাত্মা একেবারে শুকিয়ে গেছে। মেমসাহেব দৌড়ে গেছে জিমির কাছে। সাহেবও দৌড়ে গেছে। কয়েকটা নল-খাগড়ার গাছ, একটু ঢালু জলা-জমি, পানাভর্তি জল।
মেমসাহেব কাছে গিয়ে কুকুরটাকে ধরতেই দীপঙ্কর প্রথমে দেখতে পেয়েছে। অল্প অল্প অন্ধকারে জায়গাটা একটু ঝাপসা হয়ে এসেছে। তবু স্পষ্ট দেখলে দীপঙ্কর।
–স্নেক স্যার, স্নেক–
সাহেব মেমসাহেব দু’জনেই তিন হাত পেছিয়ে এসেছে। একটা কালকেউটে। ততক্ষণে সাপটা কিলবিল করতে করতে নিঃশব্দে আবার জলাজমির নলখাগড়ায় ঢাকা জায়গাটায় লুকিয়ে পড়লো। তারপর সেই ধুলোকাদার ওপরেই মেমসাহেব সিল্কের গাউন নিয়ে বসে পড়লো। আর কুকুরটাকে কোলে নিয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলো।
–জিম্মি, মাই, জিম্মি–
রবিনসন সাহেব, দীপঙ্কর, ভূষণ সবাই সেই দৃশ্য দেখে যেন হতবাক হয়ে গেছে। তাদের কারো মুখে আর কোনও কথা নেই। যেন কিছুক্ষণের জন্যে তিনজনেই কথা বলতে ভুলে গেছে। মেমসাহেব তখনও কুকুরের মুখখানা ধরৈ হাউ হাউ করে কেঁদে চলেছে। পেটের ছেলের শোকেও বুঝি কেউ অমন করে কাঁদে না।
৩৯
সব মানুষেরই একটা-না-একটা অবলম্বন থাকে। অবলম্বনও বটে, আবার বোঝাও বটে। সেই বোঝার ভার বয়ে বয়ে যতক্ষণ সে বেড়ায় ততক্ষণ তার অপার শান্তি। কত আনন্দের বোঝা, কত বেদনার বোঝ। কম হোক বেশি হোক, সেই বোঝাটাই বুঝি তার জীবনের সম্পদ। সেই সম্পদটুকু আঁকড়ে ধরে নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে আর আরো বাঁচতে চায়। রাত্রের অন্ধকারের অবসরে সেই স্মৃতির সম্পদগুলো নিয়ে সে নাড়াচাড়া করে। গুছিয়ে রাখে, ধুলো ঝাড়ে, যত্ন করে স্মৃতির আলমারিতে সাজায়। কবে একদিন দুদণ্ডের জন্যে কাকে ভাল লেগেছিল, কবে হাসিমুখে কথা বলেছিল, কবে দুঃখ দিয়েছিল কে, তারই সব খুঁটিনাটি। যত বয়েস বাড়ে খুঁটিনাটিগুলো জমে জমে স্থূপাকার হয়ে ওঠে। যত স্তূপীকৃত হয় তত কৃপণের মত সেগুলো সঞ্চয় করে মানুষ। নিজের মনের এক কোণে লুকিয়ে রাখে। কেউ যেন জানতে না পারে, কেউ যেন দেখতে না পায়। সে সম্পদ তার একার, তার একান্ত নিজের। সেখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই।
সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ছোটবেলা থেকে ছোট ছোট স্মৃতি জমে জমে স্তূপাকার হয়ে গিয়েছিল একদিন। যখন দীপঙ্কর আরো বড় হয়েছিল, আরো বয়েস বেড়েছিল তার, তখন সেই স্মৃতির বোঝা নিয়ে এক-একদিন ভাবতো। সাজাতে বসততা, গুছোতে বসততা। মনে হতো-কেন এমন হলো! কেন এমন ঘটলো! কার দোষে এমন হতে পারলো! কে দায়ী? কারা দায়ী? ভেবে ভেবেও কোনও কূল-কিনারা পেত না।
মনে আছে পরেরদিন আপিসে গিয়ে প্রথমে মনে পড়েছিল রবিনসন সাহেবের কথা। সাহেব আপিসে আসেনি। সাহেব মেমসাহেব সারারাত কেউ-ই ঘুমোয়নি। সে কি কান্না মেমসাহেবের। মেমসাহেবরাও কাঁদে কেমন করে, তা দীপঙ্কর জানত না আগে। মিস মাইকেলকেই প্রথম কাঁদতে দেখেছিল। তারপর এই মিসেস রবিন্স।
–মাই জিম্মি, মাই জিম্মি–
সেই মরা কুকুরকেই জড়িয়ে ধরে মেমসাহেব চিৎকার করে কেঁদেছিল। ভূষণের চোখ দুটোও ছলছল করে উঠছিল তাই দেখে। রবিনসন সাহেব কাঁদেনি বটে, কিন্তু তার সেই চেহারা কান্নার চেয়েও বেশি করুণ।
ক্রফোর্ড সাহেব বাড়িতে টেলিফোন করে সাহেবকে কনডোলেন্স জানিয়েছিল। সমস্ত আপিসটাই যেন হাহাকার করে উঠেছিল সাহেবের কুকুরের শোকে। তারপর সাহেব একদিন চাকরিও ছেড়ে দিলে। সেই কুকুর মারা যাওয়ার পর থেকে আর আপিসে আসেনি সাহেব। আপিসে নিজের ঘরে ঢোকেনি।
অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। আবার সেই মটর ট্রলিতে করে বালিগঞ্জ স্টেশনে ফিরে যাওয়া। তারপর সেই সেলুনে চড়ে আবার শেয়ালদার হাসপাতালে যাওয়া। সেই কুকুরের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। তখনি সি-এম-ও-কে পাঠানো। ডি-এম ও, অ্যাসিস্টেন্ট সার্জেন, কম্পাইডার, নার্সকেউ আর বাদ রইল না। সবাই এসে জড়ো হলো। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। তখন সব আশার সমাধি। রবিনসন সাহেব উদ্গ্রীব হয়ে চেয়ে ছিল সি-এম-ওর মুখের দিকে। দীপঙ্করও চেয়ে দেখলে।
ডাক্তার বললে–হি ইজ ডেড-অ্যান্ড গান–
তারপর সান্ত্বনা দেওয়ার পালা। দীপঙ্কর মানুষের মৃত্যু অনেক দেখেছে। কিরণের বাবার মৃত্যু, অঘোরদাদুর মৃত্যু, বিন্তিদির অপঘাত মৃত্যুও দেখেছে। তার কাছে রবিনসন সাহেবের জিমির মৃত্যু তেমন কিছু নতুন নয়, অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু হোক কুকুর, কিন্তু তার মৃত্যুতেও যে রবিনসন সাহেবের এত শোক হতে পারে, সেইটেই নতুন লেগেছিল দীপঙ্করের। সেইদিনই বুঝেছিল দীপঙ্কর, জিমি বোধহয় অঘোরদাদুর চেয়েও ভাগ্যবান। অঘোরদাদুর মৃত্যুর দিনের স্মৃতিটাও তার মনে পড়লো। সেদিন কেউ ছিল না কাঁদবার, একটা গাঁদা ফুলের মালা কিনতেও ছিটে-ফোঁটা আপত্তি করেছিল সেদিন। কিন্তু জিমির জন্যে সাহেব আর মেমসাহেবের শোক দেখে কে বলবে যে, জিমি মানুষ ছিল না, ছিল সামান্য একটা কুকুর মাত্র! সেই কুকুরেরই কফি এল, সেই কুকুরের জন্যেই ফুল এল। সেই কুকুরের জন্যেই আবার মিছিল হয়েছিল সেদিন। সাহেব, মেমসাহেব, ঘোষাল সাহেব, দীপঙ্কর, রেলের প্রায় সমস্ত অফিসার কালো স্যুট পরে কবরখানা পর্যন্ত গিয়েছিল কফিনের সঙ্গে সঙ্গে।
গাঙ্গুলীবাবুই প্ৰথম খবরটা এনেছিল। বলেছিল–জানেন সেনবাবু, রবিনসন সাহেব নাকি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন, চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিলেত চলে যাচ্ছেন?
–কে বললে আপনাকে?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–কে-জি-দাশবাবুর কাছে শুনলাম, শুনলাম নাকি ঘোষাল সাহেব রোজ যাচ্ছে রবিনসন সাহেবর কাছে–যাতে ওই পোস্টটা পায়–
দীপঙ্কর বললে–তা হতে পারে, আমি কিছু জানি না, আমি খবরও রাখি না–
–আপনি যান না?
দীপঙ্কর বলেছিল–আমি প্রথম ক’দিন গিয়েছিলুম, পরে যাওয়া বন্ধ করলুম, সবাই ভাবছিল, আমি বুঝি প্রমোশনের কথা বলতেই যাচ্ছি। একে তো আমার বদনাম আমি সাহেবের কুকুরের বিস্কুট কিনে দিয়ে প্রমোশন পেয়েছি–
সত্যিই, দীপঙ্করের মনে হয়েছিল কী-ই বা হবে প্রমোশন হয়ে, কী-ই বা হবে আরো টাকা হয়ে! আরো প্রমোশন হলে কি আরো সুখী হবে, আরো টাকা হলে কি আরো শান্তি পাবে! কই মা’র তো সুখ বাড়েনি, মা’র তো শান্তি বেশি হয়নি। মনে হয়, মা যেন নতুন বাসায় এসে আরো খিটখিটে হয়ে গেছে। কথায় কথায় কাশীকে আরো বকাবকি করে, আরো মেজাজ খারাপ করে। এখন মা’র নিজের সংসার, এখন তো মা-ই গিন্নী, এখন তো মা-ই সব। মার কথার ওপরে কথা বলবার কারো এক্তিয়ার নেই। সংসারের ব্যাপারে মা-ই একচ্ছত্র। কোনও কথা মা’কে জিজ্ঞেস না করে দীপঙ্কর করে না। মা’র অনুমতি ছাড়া দীপঙ্কর কিছু করা ভাবতেই পারে না। পাছে মার মনে আঘাত লাগে, পাছে মা’র মনে কষ্ট হয়। কিন্তু তবু মা’র যেন অভিযোগের শেষ নেই। যেন হাজার হাজার অভিযোগ অশান্তি সারাক্ষণ মাকে ঘিরে রয়েছে।
সন্তোষকাকা রয়েছে সংসারে, তার মেয়েও রয়েছে। রসুলপুর থেকে এসে একদিন উঠেছিল হয়ত বিনা উদ্দেশ্যেই। কিংবা হয়ত কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু আর যায়নি। সন্তোষকাকা রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে গল্প করে। ক্ষীরোদা বাটুনা বাটে, মাকে সাহায্য করে। মা’র একটা সাহায্য করবার লোক হয়েছে আজকাল। রান্না করতে করতে মা বলে-ভড়ার থেকে একটু সরষের তেল নিয়ে এসো তো মা–
সন্তোষকাকা দাওয়ার ওপর বসে বলে–অনেকদিন মাংস খাওয়া হয়নি বৌদি, একদিন মাংস করতে পার না, দেখতাম কলকাতার মাংস কেমন খেতে-বেশ ঝাল দিয়ে গরম মশলা দিয়ে–
তারপর ক্ষিরির দিকে চেয়ে বলে-হারে ক্ষিরি, একবার রসুলপুরে সেই পাঁঠা কেটেছিলুম মনে আছে তোর? তুই তখন ছোট, ওঃ, কী ঝাল দিয়েছিল তোর মা! একেবারে নালে-ঝোলে একাকার হয়ে গিয়েছিলি তুই-তোমার জা খুব ভাল রাঁধতে পারতো জানলে বৌদি, এমন রাধতো না যে নোলায় পড়ে আমিই সব ভাত খেয়ে ফেলতুম, শেষে আর ভাত থাকতো না কারোর জন্যে, আবার রাঁধতে হতো–
বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হাসতো।
সন্তোষকাকার সঙ্গে কেউ কথা বলুক আর না-বলুক, তাতে কিছু এসে যায় না সন্তোষকাকার।
দীপঙ্করকে দেখতে পেলেই বলতো-এই যে বাবা, এখন আপিস থেকে এরে?……….তা খুব মন দিয়ে চাকরি করবে বাবা, চাকরি হলো লক্ষ্মী, লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলবে না বাবা-এই তোমায় বলে রাখলুম–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করতো–আপনার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো এখানে?
–আরে, অসুবিধে হলে আমি চুপ করে থাকবো ভেবেছ, আমি সে লোকই নয় বাবা, এই দেখ না, বৌদিকে সেদিন বললাম-কলকাতার লোক চা খায় শুনলাম, তা কই তোমাদের বাড়িতে চায়ের পাট তো নেই। তারপরেই চা খেতে শুরু করলাম, এখন রোজ চা খাচ্ছি, ঘুম থেকে উঠেই বৌদি চা করে দেয়, আবার কালকে মাংস খেয়েছি,-কোনও অসুবিধে নেই–
তারপর একটু থেমে বললে–তা তোমার তো দেখাই পাওয়া যায় না বাবা, তুমি যে কখন আপিস থেকে আসো, কখন আপিসে যাও, কিছুই টের পাই না–
দীপঙ্কর বললে–আপিসের খুব কাজ পড়েছে, তাই একটু দেরি হয় আমার আজকাল–
–তা বাবা, তুমি তো রেলে কাজ করো, বলি পাশ-টাশ দিতে পারো না আমাদের, বুড়ো বয়সে একটু তীর্থ-ধর্ম করতাম, বৌদিও তো কোথাও যায়-টায় নি শুনলুম–
এ-কথার উত্তরে দীপঙ্কর কি বলবে বুঝতে পারলে না।
সন্তোষকাকা আবার বললে–তুমি বাবা রেলে চাকরি করবে আর আমি তোমার কাকা হয়ে কিনা পয়সা খরচ করে টিকিট কেটে রেলে চড়বো, সে যে বড় লজ্জার কথা, লোকে বলবে কী–আর তাছাড়া, আমার অত পয়সাই বা কোথায়–
দীপঙ্করের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোয় না। এদের বোঝানোও মুশকিল যে, গ্রাম-সুবাদে কাকা হলে তার পাশ পাওয়া শক্ত। শুধু গ্রাম সুবাদে কেন, কাকা জ্যাঠা বাবা কারোর পাশই দেয় না। সন্তোষকাকার সঙ্গে এত কথা বলা অর্থহীন। আপিস থেকে এসে রোজই বাড়িতে দেখে খুব খাওয়ার পাট চলেছে। হয় মুড়ি, নয় পরোটা, নয় একটা কিছু মুখে পুরছে সন্তোষকাকা। মা-ও কাছে কাছে আসে। বলে–চাকরি আছে তো তোর?
দীপঙ্কর হাসে। বলে–চাকরি আমার যাবে না মা, তোমার ভয় নেই–
মা বলে—তবু ভয় করে বাবা, সেই নৃপেনবাবু চাকরিটা করে দিয়েছিলেন, তাই তবু চলছে, নইলে কে চাকরি দেয় অমন করে বল তো?
কবেকার সব কথা! সব কথা মা’র মনে আছে। মা মনে মনে অতীতের কথাও ভাবে, বর্তমানের কথাও ভাবে, ভবিষ্যতের কথাও ভাবে হয়ত। দীপঙ্করের এক-একবার মনে হয়, মা না থাকলে তার কথা এমন করে কে ভাবতো। মা ছাড়া তো তার আর কেউ নেই।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করে–তুমি কোথাও যাবে মা? কাশী কি বৃন্দাবন কি গয়া? সন্তোষকাকা বলছিল–
মা বললে–যেতে তো পারি, কিন্তু তোকে এখানে কে দেখবে?
–কেন, কাশী! কাশী আমার ভাত ফুটিয়ে দেবে।
মা বলে-তবেই হয়েছে, কাশী তোকে আপিসের ভাত দেবে,
দীপঙ্কর বলে-দুটো দিন যে-কোনও রকমে চালিয়ে নেবে ও, তা বলে তুমি কেন আমার জন্যে এখানে চিরকাল ভাত রাঁধতে যাবে।
মা বলে-তা হলে তুইও চল্ না, আমাদের সঙ্গে যাবি–
দীপঙ্করের কি এখন যাওয়া চলে! আপিস ছেড়ে কি একদিনও যাওয়া চলে কোথাও! কত কাজ জমে গেছে তার। দিনে দিনে কত কাজ বেড়েছে। দীপঙ্কর বলে–এখন আপিস থেকে যাওয়া চলবে না আমার মা,-অনেক কাজ–সাহেব অফিসে আসছে না–
সত্যিই কাজ অনেক। রবিনসন সাহেব আর আপিসে আসছে না। মিস্টার ঘোষাল রোজ রবিনসন সাহেবর বাড়ি গিয়ে কী সব বলে আসছে। কী সব শোনাচ্ছে সাহেবকে কে জানে। নানারকম কথা উঠেছে আপিসে। ক্রফোর্ড সাহেবও কিছু বলছে না। সব যেন প্রথমে ভাব চারিদিকে। সেদিন আপিসে গিয়েই ডেকে পাঠালে পাশ-সেকশ্যানের বড়বাবুকে। হরিশবাবু বৃদ্ধ লোক। পাকা ঘুঘু। এই পাশের ব্যবসা করেই বেশ দু’পয়সা কামিয়ে থাকেন। কার্ড পাশ ভাড়া খাটান। পাশ বেচেনও আবার। সেন সাহেবের ডাক পেয়েই দৌড়ে এলেন। বললেন–আমায় ডাকছিলেন স্যার?
এককালে এই হরিশবাবুই ছিল পাশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ক্লার্কদের কাছে এরই আবার অন্যরকম মূর্তি। তাদের কাছে অন্যরকম মেজাজ। বললেন–আপনার পাশ চাই নাকি স্যার?
দীপঙ্কর বললে–আমার নয়, মা’র জন্য-কাশী যাবে–
হরিশবাবু বললে–তা ফর্মটা আমি এনে দিচ্ছি, আপনাকে জিজ্ঞেস করে আমি নিজেই ফিলআপ করে দিচ্ছি–
তারপরেই দৌড়ে একটা ফর্ম নিয়ে এসে নিজেই ভর্তি করতে লাগলেন। বললেন–শুধু আপনার মা, আর কেউ নয়? ভাই, বোন, কি কাকা, জ্যাঠা, কেউ নয়?
দীপঙ্কর হাসলো একটু। দীপঙ্কর হাসতেই হরিশবাবু যেন কৃতার্থ হয়ে গেল।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-কাকা জ্যাঠার পাশও পাওয়া যাচ্ছে নাকি আজকাল হরিশবাবু?
হরিশবাবু বললে–আপনি যদি চান তো কায়দা করে আমি তাও করে দিতে পারি–সবই তো আমার হাতে, এই তো সেদিন ঘোষাল সাহেব ওয়াইফের পাশ নিলেন–
–ঘোষাল সাহেবের ওয়াইফ! মিস্টার ঘোষাল তো বিয়েই করেননি!
হরিশবাবু বললেন–উনি তো প্রায়ই নেন, একলা তো কখনই বাইরে যান না, ওয়াইফও থাকে, সঙ্গে আবার দু’তিনজন সিস্টার-ইন-ল থাকে অনেক সময়। আমি তো স্যার আপনাদের সেবা করবার জন্যেই আছি, তবু আপিসে সবাই আমার বদনাম দেয়, সবাই বলে আমি নাকি এই পাশ নিয়ে ভাড়া খাটাই–
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে–সিস্টার-ইন-ল-রাও আজকাল পাশ পায়?
হরিশবাবু বললে–পায় না স্যার, রুল নেই, কিন্তু আমি যখন আছি তখন আর কে দেখছে? আমি আনম্যারেড সিস্টার বলে লিখে দিই–কে ধরবে, বলুন? আপনাদের সেবার জন্যে আমি সব করতে পারি। আপনিও নিন না, মাদার-এর সঙ্গে আনম্যারেড সিস্টার, আঙ্কেল-টাঙ্কেল সব নিয়ে নিন, আমি এমন কায়দা করে দেব, দেখবেন কেউ ধরতে পারবে না–
–থামুন!
দীপঙ্করের গলার গম্ভীর স্বরে হরিশবাবুর কলমটা হাত থেকে হঠাৎ খসে পড়ে গেল। সোজাসুজি চেয়ে দেখলে সেন সাহেবের দিকে। সেন সাহেবের যেন এ অন্য মূর্তি। তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিলে হরিশবাবু। দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল হরিশবাবুর স্পর্ধা দেখে। ভেবেছে কি এরা! সবাই ঘোষাল সাহেব নাকি! যখন ক্লার্ক ছিল দীপঙ্কর, তখন এই হরিশবাবুই তার সঙ্গে অন্যরকম ব্যবহার করতো। মানুষই মনে করতো না তাকে। আজ গদি-আঁটা চেয়ারে বসেছে বলে একেবারে আমূল বদলে যেতে হয়! একেবারে খোশামোদে বিগলিত হয়ে যেতে হয়! শুধু পদোন্নতি হয়েছে বলেই তার খাতির, মাইনে বেড়েছে বলেই তার বেশি সম্মান?
–আপনি কি সকলকেই নিজের মত মনে করেন হরিশবাবু?
–স্যার, আমাকে ক্ষমা করুন, আমি অন্যায় করেছি স্যার।
তারপর দীপঙ্কর সই করে দিতেই ফর্মটা নিয়ে হরিশবাবু কেন্নোর মত নিঃশব্দে সরে গেল। আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই একেবারে পাশ এনে হাজির করলে। পাশটা নিয়ে দেখে দীপঙ্কর বললে–ঠিক আছে, যান আপনি–
স্কাউড্রেল! কথাটা ভাবতেই দীপঙ্কর শিউরে উঠলো। কে স্কাউড্রেল নয়? সবাই তো স্কাউলে! ভাবতে নিজেরই লজ্জা হলো। দীপঙ্কর নিজেই তো স্কাউড্রেল! কেন মিছিমিছি এত রেগে গিয়েছিল সে! কই, নৃপেনবাবুর সেই অন্যায় তো দীপঙ্কর নিঃশব্দেই হজম করেছিল! তাড়াতাড়ি মধুঁকে আবার ডাকলে। বললে–মধু, পাশবাবুকে একবার ডেকে আন্ তো
পাশবাবু আবার তেমনি ঘাড় নিচু করে ঘরে ঢুকলো। বললে–আমাকে ডেকেছিলেন স্যার?
দীপঙ্কর বললে–আপনাকে অকারণে বকেছি হরিশবাবু, কিছু মনে করবেন না
হরিশবাবু হাসলো৷ কিছুই যেন হয়নি তার। বললে–না, না, আপনি আর আমাকে লজ্জা দেবেন না স্যার, আপিন তো আমাকে ন্যায্য কথাই বলেছেন-এই দেখুন না, কত লোক এসে ধরে আমাকে, পরের জন্যে কত বে-আইনী কাজ করতে হয় আমাকে! এই ঘোষাল সাহেব, ক্রফোর্ড সাহেব। এরা তো হামেশাই বে-আইনী পাশ নিচ্ছেন, আসলে তো সবাই-ই নেয় স্যার। রেলের চাকরিতে কে না নিচ্ছে? পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে রেলে চড়তে যাবে কেন বলুন তো? আপনিই শুধু দেখছি..
–থাক—
দীপঙ্কর নিজের ফাইলের দিকে চোখ নামাতেই হরিশবাবু সেলাম করে চলে গেল।
.
বাড়িতে যেতেই মা এল। দীপঙ্কর বললে–মা, তোমার পাশ এনেছি–তুমি যে বিশ্বনাথ দর্শন করবে বলেছিলে–
–সে কি রে?
মা-ও অবাক হয়ে গেল। বললে–আমি আবার কবে বলেছিলুম তোকে বিশ্বনাথ দর্শন করবার কথা!
দীপঙ্কর বললে–তুমি বলেছিলে, তোমার মনে নেই। নৃপেনবাবুকে যেদিন চাকরির দরখাস্ত দিয়েছিলুম, সেইদিনই তুমি বলেছিলে
–তা আমি কার সঙ্গে যাবো! চিনি না, শুনি না–কোথায় যাবো কোথায় থাকবো, তোকে এখানে কে-ই বা দেখবে?
–কেন সন্তোষ কাকা যাবে, সন্তোষ কাকার মেয়ে যাবে-তোমরা তিনজনে যাবে, আমি সব বন্দোবস্ত করে দেব, ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে আসবো। আমার জন্যে ভেবো না
–ওদেরও পাশ নিয়েছিস নাকি?
দীপঙ্কর বললে–ওদের তো পাশ হবে না মা, ওদের টিকিট কেটে দেব আমি
–সে কি? টাকা খরচ করে টিকিট কাটতে হবে ওদের? রেলের চাকরি করে তাহলে আর কী সুবিধে হলো?
মা-ও সেদিন আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্করের কাণ্ড দেখে! রেলের চাকরি করে কেউ রেলের টিকিট কাটে! গাঙ্গুলীবাবু হরিশবাবু সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। গাঙ্গুলী বাবু বলেছিল–সবাই তো নিচ্ছে মশাই, আপনার নিতে দোষ কী? কে দেখছে?
দীপঙ্কর বলেছিল–তা নিক, ওতে আমার মন সায় দেবে না, তাছাড়া রাত্তিরে ঘুমই হবে না আমার–
–সে কি? সেদিন ঘোষাল সাহেব রেলের বড় ঘড়িটা বাড়িতে নিয়ে গেছে, জানেন?
–বড় ঘড়িটা? যেটা ওঁর ঘরে টাঙানো ছিল?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–ওঁরই বা দোষ কী, আমরা তো সবাই-ই নিই সেনবাবু। আপিসসুদ্ধ নোক কেউ কাগজ কালি কলম কেনে ভেবেছেন? কেউ কেনে না। সকলের ছেলে-মেয়েরা এই কাগজেই ইস্কুলের লেখা চালাচ্ছে, চিরকাল তো এই-ই হয়ে আসছে! তাতে দোষই-বা কী বলুন, সাহেবদের জিনিস, যত নেওয়া যাই ততই ভালো, ওরা তো আমাদের দেশ থেকে সব নিয়ে যাচ্ছে লুটে-পুটে
বলে কী গাঙ্গুলীবাবু! গাঙ্গালীবাবুর কথা শুনে দীপঙ্করের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সির সির করে উঠলো। চিরকাল ধরে কাগজ কলম কালি সব নিচ্ছে!
–শুধু কাগজ-কলম-কালি নয়! পেন্সিল, ব্লটিং পেপার, আলপিন সমস্ত–আপনি জানতেন না এতদিন? আশ্চর্য!
তা হোক, তবু টিকিট কিনে নিলে দীপঙ্কর। সন্তোষকাকা আর তার মেয়ের টিকিট। অনেক টাকা লাগলো। চিঠি লিখে দিয়েছিল কাশীতে। কোনও অসুবিধে হবে না মা’র। গাঙ্গুলীবাবুদের পাণ্ডা স্টেশনে এসে নিয়ে যাবে। মা’র হাতেও টাকা দিয়ে দিলে। বললে–সঙ্গে টাকা থাকা ভাল মা, কখন কী দরকার হয়, তুমি নিজের কাছে রেখে দিও টাকাগুলো।
জীবনে কখনও এমন গাড়িতে মা ওঠেনি। ওমা, এ যে সাহেবদের গাড়ি দীপু! সন্তোষকাকা আর তার মেয়েও গাড়িতে ঢুকে চারদিকে চাইতে লাগলো। এই পাশেই কলঘর। সবসময় দরজা বন্ধ রেখে দেবেন। বাজে লোককে ঢুকতে দেবেন না। এ কামরাটাই রিজার্ভ করা। এখানে কেউ ঢুকতে পাবে না। আপনারা তিনজনেই এ গাড়িতে যাবেন।
মা বললে–খুব সাবধানে থাকবে বাবা, কাশী যেন সদর দরজা বন্ধ করে রাখে, একটু বলবে তুমি–
দীপঙ্কর বললে গিয়েই চিঠি দেবেন কাকা, নইলে আমি ভাববো–
সন্তোষকাকা বললে–তুমি ভেবো না বাবা, ক্ষিরি আছে আমার, ও চিঠি লিখতে জানে–ওকে আমি ওই জন্যেই তো লেখাপড়া শিখিয়েছি–কী রে, ও ক্ষিরি, তুই চিঠি লিখতে পারবি না?
মনে আছে ট্রেনটা ছেড়ে দেবার পরও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল দীপঙ্কর সেখানেই। মা চলে গেল, এ কথাটা যেন ভাবতেই পারা যায় না। ছোটবেলা থেকে এতদিন একসঙ্গে কেটেছে, এতদিন একবাড়িতে কাটিয়েছে। মা ছাড়া দীপঙ্কর নিজেকে যেন কল্পনাই করতে পারে না। বাড়িতে গিয়ে আজই প্রথম দেখবে মা নেই। আজই প্রথম মা’র বিছানাটা রাত্রে খালি পড়ে থাকবে। আজই প্রথম দীপঙ্করের সমস্ত জীবনটা এমন করে ফাঁকা হয়ে গেল। প্রত্যেক দিন বাড়ি ফিরে গিয়ে প্রথমে মা’কে দেখে তবে অন্য কাজ করেছে দীপঙ্কর। যেখানেই গেছে, বাড়ি ফেরবার কথা মনে হলেই প্রথমে মনে পড়েছে মা’কে। আজ রাত্রে হয়ত ঘুমই আসবে না। হয়ত মা’ও ঘুমোতে পারবে না সেখানে গিয়ে। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতে যেমন, এই স্টেশন রোডের বাড়িতেও তেমনি। খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠিয়ে দিত। ছোটবেলায় কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে ফুল দিতে আসতো দীপঙ্কর, এখানেও দীপঙ্করকে উঠিয়ে দিয়ে তবে সংসারের কাজে হাত দেয় মা। প্ল্যাটফরম থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে আসবার সময় মনে হলো ট্রেনটা ঠিক পৌঁছাবে তো! যদি কোনও লোক গাড়ির দরজা ঠেলে, আর মা যদি ভুলে দরজা খুলে দেয়! যদি টাকাগুলো কেড়ে নেয়! ভালো করে বলে দেওয়া হলো না তো। তা ছাড়া আরো বেশি টাকা মা’র হাতে দিলে হতো। মা হয়ত ইচ্ছেমত খরচ করতে পারবে না। তা মা’র আর কী-ই বা দরকার, কী-ই বা কিনবে! হয়ত কিনবে হাতা বেড়ি, চাকী বেলুন, এমনি সংসারের খুঁটিনাটি কিছু। নিজের জন্যে তোর মা’র কেনবার কিছু নেই। কিনবেও না। হয়ত এক পয়সার একটা তেলের পলা, কি পেটা লোহার কড়া একটা। বড় জোর একটা কাসি। এইরকম টুকিটাকি কিছু।
প্ল্যাটফরমের বাইরে অনেক ভিড়। দীপঙ্কর দাঁড়িয়েছিল চুপ করে।
–গাড়ি হবে হুজুর, ফিটন গাড়ি?
–রিক্সা চাই হুজুর?
–ট্যাক্সি হবে স্যার?
দু’তিনজন দালাল ঘেঁকে ধরল তাকে। দীপঙ্কর চেয়ে দেখলে তাদের দিকে। ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ। তখনও যেন দীপঙ্করের কানে বেনারস এক্সপ্রেসের হুইসলের শব্দটা আসছে। ট্রেনটা চলেছে, আর চাকার একটানা শব্দ হচ্ছে–ঘটাঘট। মা হয়ত শুয়ে পড়েছে বার্থের ওপর। আজই প্রথম বিশ্রাম মা’র জীবনে। আজই দীপু নেই, রান্না নেই। কিছু কাজ নেই মা’র। সন্তোষকাকা আর তার মেয়ের জন্যে লুচি পরোটা আলুচচ্চড়ি করে পোঁটলা বেঁধে সঙ্গে নিয়েছে।
–আর তোমার খাবার? তুমি রাত্তিরে কি খাবে মা?
–আমি আর কী খাবো, রেলে চড়ে আমি কিছু খাবো না বাবা, আমার খেতে প্রবিত্তি হয় না–
–তা হোক, ডাব খেতে তো আর আপত্তি নেই! গাড়ি তো গিয়ে পৌঁছবে সেই কাল ভোরবেলা। রাত্তিরে কিছু মুখে না দিলে কি চলে! দীপঙ্কর চারটে ডাব, চারটে কমলালেবু কিনে দিয়েছিল সঙ্গে। ডাবের মুখটা কাটিয়ে এনেছিল। সন্তোষকাকা গাঁয়ের লোক, ডাবের মুখটা খুলে দেবে’খন। গাড়িতে আবার বাসি কাপড় ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার যেন কোর না। কত করে বুঝিয়ে বলে দিয়েছিল দীপঙ্কর। গাঙ্গুলীবাবু বলেছিল–আমাদের চেনা-শোনা পাণ্ডা, আমারই শ্বশুরমশাই বরাবর ওদের কাছে গিয়ে ওঠেন, আমি চিঠি লিখে দিয়েছি, আপনার কোনও ভাবনা নেই–
–আর আসবার সময় রিজার্ভেশনের কথাও লিখে দিয়েছেন তো?
–তা আর দিইনি, বলেন কী আপনি! বলে দিয়েছি আমাদের সেন সাহেবের মা যাচ্ছেন, কোনও অসুবিধে যেন না হয়–
তারপর একটু থেমে গাঙ্গুলীবাবু বললে–আমিও একবার বেড়াতে যাবো সেনবাবু, অনেকদিন ধরে আমার স্ত্রী বড় পীড়াপীড়ি করছে!
–কোথায় যাবেন?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–এই কাশী হোক, পুরী হোক, মধুপুর গিরিডি হোক–যেতেই হবে, আর ছাড়ছে না! পাগল মানুষ তো, আবার কবে মাথা বিগড়ে যায় বলা তো যায় না–
তা গাঙ্গুলীবাবুই সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তারই পাণ্ডা, তাকেই আগে থাকতে চিঠি লিখে সব ব্যবস্থা হয়েছিল। মা’র এতদিনে সাধ! মুখে বলতো বটে যে–দীপুই তার। কাশী-গয়া, দীপুই তার তীর্থ-ধর্ম। কিন্তু মনে মনে তো তীর্থ করতে ইচ্ছে হতো মা’র। তাই ইদানীং মেজাজ যেন আরো খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। কাশীকে দিনরাত বকতো মা। ভালোই হয়েছে। একটু ঘুরে এলে মা হয়ত আবার সুস্থ হয়ে উঠবে। কত দিন আর দীপঙ্করের জন্যে সংসারে আটকে থাকবে স্বার্থপরের মত! কাল ভোরবেলা, রাত থাকতে থাকতে মোগলসরাইতে গাড়ি পৌঁছোবে। এতক্ষণ বোধহয় বর্ধমান পেরিয়ে গেছে। মা হয়ত ঘুমোচ্ছে এখন। গরমে হয়ত একটু তন্দ্রা এসেছে। ইলেকট্রিক পাখাটা মার দিকে টেনে দিয়ে এসেছিল দীপঙ্কর। মা’র দিকের জানালাটার কাঁচটা বন্ধ করে দিয়েছিল। ধুলো আসবে ভেতরে। যদি রোদ আসে তো খড়খড়িটাও যেন বন্ধ করে দেয়। সন্তোষ কাকাকে সমস্ত বলে দিয়ে এসেছিল। কেমন করে জানালা খুলতে হয় বন্ধ করতে হয় সব দেখিয়ে দিয়ে এসেছিল।
সন্তোষ কাকা বলেছিল–ও ক্ষিরি, ভালো করে দেখে নে মা, কেমন করে জানালা খুলতে হয় বন্ধ করতে হয় শিখে নে
দীপঙ্কর বলেছিল–আর ভেতরে দিকের এই ছিটকিনিটা বন্ধ করে রাখবেন, তাহলে কেউ আর ঢুকতে পারবে না—
–ওই ক্ষিরিকে দেখিয়ে দাও বাবা, ক্ষিরি সব বুঝতে পারে, ক্ষিরির খুব বুদ্ধি, একবার বললেই সব বুঝতে পারে, কী রে ক্ষিরি, বুঝতে পারবি তো?
ক্ষিরি কিছু কথা বলেনি। লজ্জায় জড়সড় হয়ে সব লক্ষ্য করছিল।
সন্তোষকাকা তাকে আরো লজ্জায় ফেললে। বললে–তুমি যা ভাবছো বাবা, ও তা নয়, খুব চালাক-চতুর মেয়ে আমার। এই দেখ না, তোমার কাকীমা মারা যাবার পর থেকে ওই মেয়েই তো আমার সংসার চালিয়ে আসছে–
তারপর মা’র দিকে ফিরে বললে–কী বৌদি-তুমি তো দেখলে এ কদিন ক্ষিরিকে–ঠিক বলিনি?
মা কিছু বললে না।
সন্তোষকাকা তবু ছাড়বার পাত্র নয়। বললে–তুমি তো সেদিন মাংস খেলে, কীরকম রান্না হয়েছিল বলো তো? ভাল না? কার রান্না ধরতে পেরেছিলে?
হাসতে লাগলো সন্তোষকাকা হো হো করে। ক্ষিরিকে বললে–দেখলি তো ক্ষিরি, দীপু আমার ধরতেই পারেনি
ওদিকে তখন হুইসল দিয়েছে।
মা বললে–গাড়ি ছাড়বে বাবা, তুমি নেমে যাও
দীপঙ্কর তারপর নেমে এসেছিল। গাড়িটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলে। প্রথমে আস্তে, তারপর বেগ বাড়লো। দীপঙ্কর এগিয়ে চলতে লাগলো সঙ্গে সঙ্গে। মা নেই, মা চলে গেল। মা’কে যেন কেউ ছিনিয়ে নিয়ে গেল দীপঙ্করের কাছ থেকে। দীপঙ্করের মনে হতে লাগলো-কেউ যেন জোর করে তার মা’কে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল তার কাছ থেকে।
দীপঙ্কর হাত তুলে নাড়াতে লাগলো। তারপর ট্রেনটা প্ল্যাটফরম ছাড়িয়ে ডিসট্যান্ট সিগন্যাল ছাড়িয়ে এঁকে বেঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল এক নিমেষে!