অমাবস্যার রাত, কিন্তু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটলেও তমিজের বাপের তো কিছু ঠাহর করতে কখনো ভুল হয় না। কিন্তু পাকুড়গাছটা আজ সে কোথাও খুঁজে পায় না কেন? পাকুড়গাছ না পেলে তার চলবে না। পাকুড়গাছের তলায় দাঁড়িয়ে মুনসির সঙ্গে তার চোখাচুখি হতে হবে। তমিজ আটকা পড়ে আছে, সে প্রায় এক বছর হতে চললো। বেটাটা তার ছাড়া পায় না কেন? কোথাও কোনো দোষ হলো কিনা কে জানে? গতবার মেলার দিন ভোরে, না ভোররাতে এমন ক্যাচালে পড়ে গেলো যে, পোড়াদহের মেলায় একটিবারের জন্যে উঁকিও দিতে পারলো না। সন্ন্যাসীর থানে জোড়া পায়রা দেওয়ার কথা, তমিজ দিলো কি-না তাও তো জিগ্যেস করতে পারলো না। আবার ভবানী সন্ন্যাসীর ভোগের বাঘাড়টা ধরলো। তা সেটা তো বাপু কালাহারের পানিতেই ছেড়ে দিলো। সন্ন্যাসী কি মেলার অছিলা করে মুনসিকে একটা মাছ দিতে পারে না? কী জানি বাপু, কোথায় কী দোষ হলো, পাকুড়গাছ থেকে অন্তত ইশারা করে একবার জানিয়ে দিতে পারে। আবার দেখো, দশরথ, কতো পুরানা আমলের মানুষ, তার ঠাকুরদার ঠাকুরদা, না-কি তারও বাপ না ঠাকুরদা এখানে এসেছিলো গিরিদের সঙ্গে, একই সময়ে বিলের এপার ওপারে বন কেটে বসত করলো তমিজের বাপের দাদা, না তারও দাদার দাদা, না-কি তারও বাপ না দাদা,—এসব হিসাব তমিজের বাপ করতে পারে না–তো সেই দশরথ কর্মকারের বাড়িতেও কি-না মাঝিরা আগুন ধরিয়ে দেয়। মুনসি কি এতেই গোস্বা করলো কি-না কে জানে? পাকুড়তলায় তমিজের বাপ একবার পৌঁছুতে পারলেই গাছের মগডালের দিকে তাকাবে, তা হলে মুনসি ইশারা করে ঠিকই বলে দেবে, কোনটা তার দোষ, কী তার গুনা।
মণ্ডলদের ইটখোলা উত্তরে বেড়েছে, দক্ষিণেও অনেকটা এগিয়ে আসছে। বিল প্রতি বছর পুরট হয়, ইটখোলা বাড়ে। কিন্তু পাকুড়গাছ কোথায়? এদিকে গাছ কাটা পড়েছে অনেক, বড়ো বড়ো গাছ সব চলে যায় ইটের ভাটার পেটে। কিন্তু তাই বলে পাকুড়গাছ কি আর কাটা পড়তে পারে? ঐ গাছে কুড়ালের কোপ পড়ার আগেই কুড়াল গলে যাবে না? সারাটা রাত বিলের ধারে ধারে ঘুরে ঘুরে শীতে ও কাদায়, ঘুমে ও খোয়াবে তমিজের বাপের পায়ের পাতা থেকে শুরু করে সারাটা গতর জমে জমে আসে। একবার মুনসির একটা শোলোক আগুনের জীব যতো মুনসির নফর। সম্মুখে দর্শনমাত্র–জান ধড়ফড়া তমিজের বাপের মাথায় গুনগুন করলে সে আশায় আশায় ছুটে যায় আরো উত্তরে। না। পাকুড়গাছ তো নজরে পড়ে না।
তার ঘুরতে ঘুরতে, হয়তো তার পায়ের চাপে চাপে কিংবা চোখের নজরে নজরে শীতকালের ভোর হয় এবং আরো একটু বেলা হলে বঁটখোলার লোকজন এসে দেখে তমিজের বাপের ঘোরাঘুরিতে ভেঙে পড়েছে কাঁচা হঁটের বেশ কয়েকটা সারি। কে একজন মিস্ত্রি তেড়ে আসে, তুমি কেটা গো? বেআক্কেলে বুড়া, চোখোত দ্যাখো না? কিছুক্ষণ পর আসে গফুর কলু। তমিজের বাপকে কাঁচা ইট নষ্ট করতে দেখে তাকে সে বকাঝকার সুযোগ পায়, বুড়া হয়া গেলা, তোমার বুদ্ধি আর হবি কুনদিন? হামাগোরে বড়ো সাহেব ছোটো সাহেব আসুক, তারপর তোমার বিচার কী হয় তাই দেখো।
আজকাল আজিজ হলো বড় সাহেব এবং কাদের হলো ছোটো সাহেব। কিন্তু এই খবর তমিজের বাপের জানা নাই। সেই সম্মানিত ব্যক্তিদের খোঁজে সে এদিক ওদিক দেখে। গফুর কলু কি মুনসি আর ভবানী সন্ন্যাসীর কথা বলছে? তমিজের বাপ কাঁচা ইটের ভাঙাচোরা পাঁজায় চারদিকে তাকায়, সকালবেলার আলোয় পাতি পাতি করে খোজে। . কিন্তু পাকুড়গাছ দূরের কথা বড়ো মাপের কোনো গাছের চিহ্নও দেখতে পায় না।
ফকির বাহিরিলো তার না থাকে উদ্দিশ।
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ঘোড়া করিলো কুর্নিশ।
দুলদুল উড়াল দিলো নাহিক উদ্দিশ।।
কিন্তু এই গান আসে কোত্থেকে? গফুর কলু তাকে সাবধান করে দেয়, এই বুড়ার বেটা, তামান রাত ঘুরিছো, ঐতো দলদলা, যদি পড়া গেলাহিনি? ফুটখানেক উঁচু ইট, দিয়ে ঘেরা চোরাবালির জায়গাটা দেখে তমিজের বাপের কিছুই এসে যায় না। গফুর কলুকে সে জিগ্যেস করে, ক্যা রে, গফুর, পাকুড়গাছটা কুটি রে?
মুনসির পাকুড়গাছ? ওটা তো বিলের উত্তর সিথানে। তুমি এটি কী উটকাও?
উত্তর সিথান তো এটাই,লয়? এই যে বাঙালির স্রোত এটি ঢুকলো। এর উত্তরে আর বিল কুটি?
গফুর কলু বিচলিত হয়, তাই তো, উত্তর সিথান তো এটাই হবি। পাকুড়গাছ তো দেখি না।
এর মধ্যে হামাগারে বাবু কয়া দিলো কাল বাদে পরশু কিছু হঁট দেওয়াই লাগবি। বলতে বলতে জর্দার গন্ধে বিলের সোঁদা হাওয়াকে সচল করে এসে হাজির হয় বৈকুণ্ঠ গিরি। তমিজের বাপকে দেখে সে পানভরা গাল ভরে হাসে, ক্যা গো, তুমি বুঝি তামান রাত এটি ঘুরিচ্ছো? গলা নামিয়ে সে জানতে চায়, কী কথাবার্তা কিছু হলো?
তমিজের বাপ জিগ্যেস করে, বৈকুণ্ঠ, তুই তো বাবুর কামে ইটখোলা লিতি আসিস। পাকুড়গাছ কুটি রে? তামান আত উটকানু। গাছ তো পাই না।
আরে পাকুড়গাছ তো কালাহার বিলের উত্তর সিথানে। তুমি উটকাও কুটি?
তখন গফুর কলু এমন কি মিস্ত্রিদের কেউ কেউ পর্যন্ত বলে, আরে উত্তর সিথান তো এটাই।
মুনসির পাকুড়গাছ পাওয়া যাচ্ছে না শুনে বৈকুণ্ঠের গালের পান শুকিয়ে যায়, তার মুখ থেকে বেরোয় কথার ছিবড়ে, তাই তো। ও গফুর, ভঁটার জন্যে এতো গাছ তোমরা কাটলা, পাকুড়গাছেত কুড়ালের কোপ মারো নাই তো? তা কুড়ালের কোপে কি আর মুনসির আসন লড়ে? মুনসি হামাগোরে সন্ন্যাসী ঠাকুরের সেনাপতি আছিলো না? তার কিছু হলে ঠাকুরে কি সহ্য করবি?
তোর খাসলত গেলো না বৈকুণ্ঠ। মুনসি সন্ন্যাসীর চাকরি করিছে কোনদিন? সন্ন্যাসীর সাথে মজনু শাহের। মুনসিকে সন্ন্যাসীর অধীনস্থ করার জন্যে বৈকুণ্ঠের প্রচেষ্টার প্রতিবাদ করতে গিয়েও তমিজের বাপ থেমে যায়। না, না, সন্ন্যাসীর সঙ্গে বেয়াদবি করাও ঠিক নয়, ওরা দুই জনেই তো এই এলাকার মুরুব্বি।
এ বৈকুণ্ঠও তমিজের বাপের কথায় কান না দিয়ে এদিক ওদিক খোজে। মুকুন্দ সাহার ইটের তাগাদা দেওয়া মাথায় ওঠে তার। শুধু খোজে আর খোজে। পাকুড়গাছ কোথায়?
তা খোঁজাখুজি করার আর আছেই বা কী? চারদিকে তো সব সাফ, কয়েক মাস আগের গাছপালা যা ছিলো সবই তো ঢুকে পড়েছে ইটের ভাটার পেটের ভেতরে। তবে গফুর কলু ও মিস্ত্রিরা বলে, শিরীষ গাছ, গোট চারেক শিল কড়ুই, অনেক কটী পিতরাজ, গোটা চারেক অর্জুন, উত্তর পশ্চিমে উঁচু ডাঙা জমির বেশ কয়েকটা কাঁঠাল, খান তিনেক আমগাছ—তাদের কেটে-ফেলা বড়ো বড়ো গাছের মধ্যে ছিলো তো এইই। বিলের একেবারে উত্তরে দাঁড়ালে পুব দিকে কোনো গাছই আর চোখে পড়ে না, একবারে দেখা যায় পোড়াদহ মাঠের সন্ন্যাসীর থানের বটগাছের ঝাপড়া মাথা। তা হলে পাকুড়গাছ কোথায়?
আবদুল আজিজও এসে বড়ো উদ্বিগ্ন হয়। মুনসির আসন যদি তারা কেটে থাকে তো সেটা ভালো কথা নয়। তার বেটা মরলো আর বছর, এ বছর তার সম্বন্ধী হলো খুন। খঞ্জনদিঘির পীরসাহেবের হিসাব মতো আহসান যদি কলকাতায় কোনো ঘরে বন্দি হয়ে থাকে তো এই মুনসির বদদোয়াতেই এখন মারা পড়বে হামিদার স্বপ্নে দেখা সেই সিঁদুর মাখা খাড়ার ঘায়ে। হামিদা আজকাল যা শুরু করেছে, এই পাকুড়গাছ সরে যাওয়ার কারণেই সে আবার বদ্ধ উন্মাদ হয়ে না পড়ে। উতলা মনে আবদুল আজিজ বাড়ি ফেরে এবং বাপজান! কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছটা-পর্যন্ত বলতেই। জোহরের নামাজে দাঁড়ানো শরাফত স্থির চোখে তার দিকে তাকায়। তাড়াহুড়ায় সে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ে বাপের পাশে। শরাফত বলে, অজু করা আর একটা জায়নামাজ বিছায়া নামাজ পড়ো।
তাদের নামাজ শেষ হওয়ার আগেই মণ্ডলবাড়িতে চাউর হয়ে যায়, কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আবদুল আজিজ কৈফিয়ৎ দেওয়ার মতো করে বলে, কিন্তু পাকুড়গাছ তো একটাও কাটা পড়ে নাই। ইটখোলার প্রত্যেকটা গাছ কাটার সময় আমি নিজে খাড়া হয়া থাকিছি।
আবদুল কাদের টাউন থেকে এসে গোসল করে ভাত চেয়েছে কয়েকবার। আজকাল নামাজ তার প্রায়ই কামাই হয়। তবে নামাজ নিয়ে শরাফত তার সরকারি চাকুরে বড়ো ছেলেকে যেভাবে বলতে পারে, ছোটো ছেলেকে সেভাবে তাগাদা দেওয়াটা দিন দিন তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে। কাদের হঠাৎ চিৎকার করে, আরে ভাত দেও না! তারপর ভুরু কুঁচকে বলে, আরে পাকুড়গাছ থাকলেই কি আর না থাকলেই কী? মুনসির কি আবার জায়গার অভাব আছে নাকি? ইটের ভাটা আছে না? এতো বড় ভাঁটা, মুনসি বসবার পারবি, শোবার পারবি।
মুনসিকে নিয়ে এভাবে ঠাট্টা করায় আবদুল আজিজ চমকে ওঠে। তবে রাগের চেয়ে তার ভয়টা বেশি হওয়ায় এভং কাদেরের সামাজিক ও পারিবারিক দাপট দিন দিন বাড়ছে বলে কাদেরের কথাকে স্রেফ রসিকতা বলে গণ্য করার প্রাণপণ চেষ্টায় একটুখনি হাসি তৈরী করার জন্যে সে ঠোঁটের ব্যায়াম করে।
তবে এই হাসির ব্যায়াম তার ক্ষান্ত হয় শরাফত মণ্ডলের কথায়, বিলের উত্তর দিকে পাকুড়গাছ কেউ কোনোদিন দেখিছে? পাকুড়গাছ ওটি আছিলো কবে?
এমন কি আবদুল কাদের পর্যন্ত বাপের কথায় থ হয়ে যায়। এরকম কথা বুড়া বলে কীভাবে?
শরাফত মণ্ডলের বড়োবৌ তখন পুবদুয়ারি পুরনো টিনের ঘরে বসে তার ক্লান্ত বেটারা এখন পর্যন্ত অভুক্ত থাকায় আক্ষেপ প্রকাশে ব্যস্ত। মণ্ডলের ছোটোবিবি রান্নাঘরে মাদুরের ওপর ভাত তরকারি বাড়ে আর স্বামীর কথা শুনে তার প্রতিবাদ করার জন্যে জিভে শক্ত শক্ত শক্ত কথা শানায়। তার পাশে চুপচাপ বসেছিলো হামিদা। স্বামী, দেওর কী শ্বশুরের সব কথা না বুঝলেও কোনো অমঙ্গলের আঁচ পেয়ে সে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে চায়। খাওয়া হলেই সে একটু ঘুমিয়ে নেবে। হুমায়ুন আর আহসানের কী হলো তা জানতে ঘুমের ওমে না ঢুকে তার আর উপায় কী?
সবার এরকম বিপন্ন উদ্বেগ দেখে শরাফত মণ্ডল কাষ্ঠহাসি ছাড়ে, তার গলার স্বর এখন বড়ো খরখরে, বিলের পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ-কোনো জায়গার এক ইঞ্চি জায়গাও হামি বাদ দেই নাই। লায়েববাবুর সাথে ঘুরা ঘুরা দেখিছি। লিজে একলা একলাও দেখিছি। ওটি পাকুড়গাছ আছিলো কোনোদিন দেখি নাই তো। হবার পারে, আগিলা জামানার মানুষ দেখিছে! হামার লজরেত পড়ে নাই।