তৃতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২রা অক্টোবর
শ্রীরামকৃষ্ণের বালকের অবস্থা।
ঠাকুরের পা একটু ফুলো ফুলো বোধ হওয়াতে তিনি বালকের ন্যায় চিন্তিত আছেন।
সিঁথির মহেন্দ্র কবিরাজ আসিয়া প্রণাম করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রিয় মুখুজ্জে প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) — কাল নারাণকে বললাম, তোর পা টিপে দেখ দেখি, ডোব হয় কি না। সে টিপে দেখলে — ডোব হল; — তখন বাঁচলুম। (মুখুজ্জের প্রতি) — তুমি একবার তোমার পা টিপে দেখো তো; ডোব হয়েছে?
মুখুজ্জে — আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আঃ! বাঁচলুম।
মণি মল্লিক — কেন? আপনি স্রোতের জলে নাইবেন। সোরা ফোরা কেন খাওয়া।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না গো, তোমাদের রক্তের জোর আছে, — তোমাদের আলাদা কথা!
“আমায় বালকের অবস্থায় রেখেছে।
“ঘাস বনে একদিন কি কামড়ালে। আমি শুনেছিলাম, সাপে যদি আবার কামড়ায়, তাহলে বিষ তুলে লয়। তাই গর্তে হাত দিয়ে রইলাম। একজন এসে বললে — ও কি কচ্ছেন? — সাপ যদি সেইখানটা আবার কামড়ায়, তাহলে হয়। অন্য জায়গায় কামড়ালে হয় না।
“শরতের হিম ভাল, শুনেছিলাম — কলকাতা থেকে গাড়ি করে আসবার সময় মাথা বার করে হিম লাগাতে লাগলাম। (সকলের হাস্য)
(সিঁথির মহেন্দ্রের প্রতি) — “তোমাদের সিঁথির সেই পণ্ডিতটি বেশ। বেদান্তবাগীশ। আমায় মানে। যখন বললাম, তুমি অনেক পড়েছ, কিন্তু ‘আমি অমুক পণ্ডিত’ এ-অভিমান ত্যাগ করো, তখন তার খুব আহ্লাদ।
“তার সঙ্গে বেদান্তের কথা হল।”
[মাস্টারকে শিক্ষা — শুদ্ধআত্মা, অবিদ্যা; ব্রহ্মমায়া — বেদান্তের বিচার ]
(মাস্টারের প্রতি) — যিনি শুদ্ধ আত্মা, তিনি নির্লিপ্ত। তাঁতে মায়া বা অবিদ্যা আছে। এই মায়ার ভিতরে তিন গুণ আছে — সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ। যিনি শুদ্ধ আত্মা তাঁতে এই তিনগুণ রয়েছে, অথচ তিনি নির্লিপ্ত। আগুনে যদি নীল বড়ি ফেলে দাও, নীল শিখা দেখা যায়; রাঙা বড়ি ফেলে দাও, লাল শিখা দেখা যায়। কিন্তু আগুনের আপনার কোন রঙ নাই।
“জলে নীল রঙ ফেলে দাও, নীল জল হবে। আবার ফটকিরি ফেলে দিলে সেই জলেরই রঙ।
“মাংসের ভার লয়ে যাচ্চে চণ্ডালে — সে শঙ্করকে ছুঁয়েছিল। শঙ্কর যেই বলেছেন, আমায় ছুঁলি! — চণ্ডাল বললে, ঠাকুর, আমিও তোমায় ছুঁই নাই, — তুমিও আমায় ছোঁও নাই! তুমি শুদ্ধ আত্মা — নির্লিপ্ত।
“জড়ভরতও ওই সকল কথা রাজা রহুগণকে বলেছিল।
“শুদ্ধ আত্মা নির্লিপ্ত। আর শুদ্ধ আত্মাকে দেখা যায় না। জলে লবণ মিশ্রিত থাকলে লবণকে চক্ষের দ্বারা দেখা যায় না।
“যিনি শুদ্ধ আত্মা তিনিই মহাকারণ — কারণের কারণ। স্থূল, সূক্ষ্ম কারণ মহাকারণ। পঞ্চভূত স্থূল। মন বুদ্ধি অহংকার, সূক্ষ্ম। প্রকৃতি বা আদ্যাশক্তি সকলের কারণ। ব্রহ্ম বা শুদ্ধ আত্মা কারণের কারণ।
“এই শুদ্ধ আত্মাই আমাদের স্বরূপ।
“জ্ঞান কাকে বলে? এই স্ব-স্বরূপকে জানা আর তাঁতে মন রাখা! এই শুদ্ধ আত্মাকে জানা।”
[কর্ম কতদিন? ]
“কর্ম কতদিন? — যতদিন দেহ অভিমান থাকে; অর্থাৎ দেহই আমি এই বুদ্ধি থাকে। গীতায় ওই কথা আছে।১
“দেহে আত্মবুদ্ধি করার নামই অজ্ঞান।
(শিবপুরের ব্রাহ্মভক্তের প্রতি) — “আপনি কি ব্রাহ্ম?”
ব্রাহ্মভক্ত — আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — আমি নিরাকার সাধকের চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারি। আপনি একটু ডুব দেবেন। উপরে ভাসলে রত্ন পাওয়া যায় না। আমি সাকার-নিরাকার সব মানি।
[মারোয়াড়ী ভক্ত ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — জীবাত্মা — চিত্ত ]
বড়বাজারের মারিয়াড়ী ভক্তেরা আসিয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুর তাঁহাদের সুখ্যাতি করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — আহা! এরা যে ভক্ত। সকলে ঠাকুরের কাছে যাওয়া — স্তব করা — প্রসাদ পাওয়া! এবার যাঁকে পুরোহিত রেখেছেন, সেটি ভাগবতের পণ্ডিত।
মারোয়াড়ী ভক্ত — “আমি তোমার দাস” যে বলে সে আমিটা কে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — লিঙ্গশরীর বা জীবাত্মা। মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার — এ চারিটি জড়িয়ে লিঙ্গশরীর।
মারোয়াড়ী ভক্ত — জীবাত্মাটি কে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — অষ্টপাশ জড়িত আত্মা। আর চিত্ত কাকে বলে? যে ওহো! করে উঠে।
[মাড়োয়াড়ী — মৃত্যুর পর কি হয়? মায়া কি? “গীতার মত” ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — গীতার মতে, মরবার সময় যা ভাবে, তাই হবে। ভরত রাজা হরিণ ভেবে হরিণ হয়েছিল। তাই ঈশ্বরকে লাভ করবার জন্য সাধন চাই। রাতদিন তাঁর চিন্তা করলে মরবার সময়ও সেই চিন্তা আসবে।
মারোয়াড়ী ভক্ত — আচ্ছা মহারাজ, বিষয় বৈরাগ্য হয় না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — এরই নাম মায়া। মায়াতে সৎকে অসৎ, অসৎকে সৎ বোধ হয়।
“সৎ অর্থাৎ যিনি নিত্য, — পরব্রহ্ম। অসৎ — সংসার অনিত্য।”
মারোয়াড়ী ভক্ত — শাস্ত্র পড়ি, কিন্তু ধারণা হয় না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — পড়লে কি হবে? সাধনা — তপস্যা চাই। তাঁকে ডাকো। “সিদ্ধি সিদ্ধি” বললে কি হবে, কিছু খেতে হয়।
“এই সংসার কাঁটাগাছের মতো। হাত দিলে রক্ত বেরোয়। যদি কাঁটাগাছ এনে, বসে বসে বল, ওই গাছ পুড়ে গেল, তা কি অমনি পুড়ে যাবে? জ্ঞানাগ্নি আহরণ কর। সেই আগুন লাগিয়ে দাও, তবে তো পুড়বে!
“সাধনের অবস্থায় একটুখাটতে হয় তারপর সোজা পথ। ব্যাঁক কাটিয়ে অনুকূল বায়ুতে নৌকা ছেড়ে দাও।”
[আগে মায়ার সংসার ত্যাগ, তারপর জ্ঞানলাভ — ঈশ্বরলাভ ]
“যতক্ষণ মায়ার ঘরের ভিতরে আছ, যতক্ষণ মায়া-মেঘ রয়েছে, ততক্ষণ জ্ঞান-সূর্য কাজ করে না। মায়াঘর ছেড়ে বাহিরে এসে দাঁড়ালে (কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের পর) তবে জ্ঞানসূর্য অবিদ্যা নাশ করে। ঘরের ভিতর আনলে আতস কাচে কাগজ পুড়ে না। ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালে, রোদটি কাচে পড়ে, — তখন কাগজ পুড়ে যায়।
“আবার মেঘ থাকলে আতস কাচে কাগজ পুড়ে না। মেঘটি সরে গেলে তবে হয়।
“কামিনী-কাঞ্চন ঘর থেকে একটু সরে দাঁড়ালে — সরে দাঁড়িয়ে একটু সাধনা-তপস্যা করলে — তবেই মনের অন্ধকার নাশ হয় — অবিদ্যা অহংকার মেঘ পুড়ে যায় — জ্ঞানলাভ হয়!
“আবার কামিনী-কাঞ্চনই মেঘ।”
১ ন হি দেহভৃতা শক্যং ত্যক্তুং কর্মাণ্যশেষতঃ।
য়স্তু কর্মফলত্যাগী স ত্যাগীত্যভিধীয়তে ৷৷ [গীতা, ১৮।১১]