চতুত্রিংশ পরিচ্ছেদ
সমালোচনা করবেন না
জন জীবনে ডিসরেলির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গ্লাডস্টোন। সাম্রাজ্যের যে-কোনো তর্কের বিষয় নিয়েই দুজনে লড়াই করতেন। অথচ তাদের দুজনেরই জীবনে একটা মিল ছিল, তা হল তাদের সুখী ব্যক্তিগত জীবন।
উইলিয়াম আর ক্যাথরিন গ্লাডস্টোন ঊনষাট বছর, প্রায় তিন কুড়ি বছর উজ্জ্বল বিবাহিত জীবন কাটান। সাধারণ জীবনে প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন গ্লাডস্টোন কোনদিনই স্ত্রীর সমালোচনা করেন নি।
ক্যাথরিন দি গ্রেটও তাই করতেন। তিনি কখনই স্বামীর সমালোচনা করেন নি।
ছোটদের কখনও সমালোচনা করার কথা নিশ্চয়ই আপনারা ভাবেন … হয়তো ভাবছেন, আমি বলবো সমালোচনা করবেন না। না, আমি তা বলবো না। আমি শুধু বলবো তাদের সমালোচনা করার আগে কেবল আমেরিকার সাংবাদিকের একটা বিখ্যাত লেখা ‘ফাদার ফরগেটস’ পড়তে। এটা বহুবার উদ্ধৃত হয়েছে এবং রিডার্স ডাইজেস্ট থেকে তুলে দিচ্ছি :
‘শোন ছোট্ট সোনা, আমি তোমাকে যখন বলছি তুমি ঘুমোচ্ছ। আমি তোমায় বকাবকি করেছি, আমি তোমার ঘরে চুপি চুপি এসেছি একা। তোমার একখানা হাত তোমার গলার তলায়, তোমার সোনালী চুল ঘামে ভিজে কপালের মধ্যে আটকে রয়েছে। এখন আমি দোষীর মতই তোমার কাছে এসেছি।
আমি এই কথাগুলোই ভাবছিলাম। আমি তোমার প্রতি কত বিরক্ত বোধ করেছি। স্কুলে যাওয়ার আগে তোমায় খুব বকেছিলাম কারণ তুমি সব খাবার ছড়িয়ে ফেলেছিল। তারপর তোয়ালে দিয়ে মুখ না মুছে কেবল তোয়ালেটা মুখে ছুঁয়েছিলে। তুমি তোমার জুতো সাফ করোনি বলেও বকাবকি করেছি।
সকাল বেলায় প্রাতরাশের সময়েও তোমায় বলেছিলাম। তুমি তোমার সব খাবার ছড়িয়ে ফেলেছিলে তারপর না চিবিয়ে সব খেয়ে ফেলেছিলে। তোমার চিবুক টেবিলে রেখে-রুটিতে খুব পুরু করে মাখন মাখিয়েছিলে। যখন তুমি আবার খেলতে যাও তখন আমি ট্রেন ধরতে ছুটেছিলাম, তখন তুমি চেঁচিয়ে বলেছিলে যাচ্ছি বাবা।
একই রকম ব্যাপার ঘটেছিল বিকেলেও। রাস্তা দিয়ে যখন আসছিলাম তখন দেখেছিলাম তুমি রাস্তার মধ্যে মাটিতে হাঁটু রেখে খেলে চলেছ, তোমার মোজায় অনেক ফুটো। তোমাকে তোমার বন্ধুদের সামনে বেশ বকাবকি করে হটিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসি। মোজার অনেক দাম, তুমি যদি নিজে কিনতে তাহলে বুঝতে পারতে বোধ হয়। বাবার কাছ থেকে তোমায় কথাটা শুনতে হল। কথাটা মনে রেখ।
পরের কথাটা তোমার মনে আছে? এরপর আমি যখন লাইব্রেরীতে বসে পড়েছিলাম, তুমি কেমন ভয় জড়ানো বিষাদমাখা চোখে এসে দাঁড়িয়েছিলে। আমি যখন কাগজ নামিয়ে তোমায় দেখলাম তুমি আসার জন্য আমি যে বাধা পেলাম তাই অধৈর্য হয়ে খিঁচিয়ে বলেছিলাম, কি হল, কি চাই?
তুমি কিছুই বলোনি। শুধু কচি কচি হাত দুটো দিয়ে আমার গলাটা আদরের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আমায় চুমু খেয়েই ছুটে চলে গিয়েছিলে। তোমার হৃদয়ে ইশ্বর যে ভালবাসা দিয়েছেন তা শুকিয়ে যায়নি।
ছোট্ট সোনা, একটু পরেই আমার হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল। একটা অদ্ভুত রকম ভয় আমাকে কেমন যেন চেপে ধরতে চাইল। এ আমার কি রকম অভ্যাস! ক্রমাগত তোমার দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছি, বকুনির অভ্যাসই আমায় যেন পেয়ে বসেছে তোমাকে শুধু বকুনিই দিয়ে চলেছি। এটা ঠিক নয় যে তোমাকে ভালবাসিনা-আসলে তোমার কাছ থেকে অনেক বেশিই আমি চাইছিলাম। তোমার কাছ থেকে আমি যা চাইছিলাম তা আমার বয়সের মাপকাঠিতে। তোমাকে ঠিক সেই ভাবেই বিচার করেছি।
অথচ তোমার চরিত্রে রয়েছে কত ভালত্ব-কত সূক্ষতা। তোমার ছোট্ট হৃদয় বিশাল পর্বত শিখরে ছড়িয়ে পড়া ভোরের আলোর মতই বিরাট। তার প্রমাণ তুমি ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলে। আজ তাই তোমার কাছে অন্ধকারে হাঁটু মুড়ে বসেছি। আমার নিজেকে এই মুহূর্তে অপরাধী মনে হচ্ছে …।
এ আমার সামান্য অনুশোচনা মাত্র। তুমি জেগে থাকলে একথা তোমায় বললে বুঝতে পারতে না। আমার জানা উচিত ছিল তুমি ছোট্ট একটা ছেলে মাত্র …।
কিন্তু কাল থেকে আমি হব একজন সাহিত্যিকের বাবা এবং তোমার সঙ্গে ঠিক বন্ধুর মত ব্যবহার করবো। তোমার দুঃখের সময় আমি দুঃখ পাব এবং তোমার আনন্দের সময় আমিও আনন্দে সমান অংশীদার হব। কখনও রেগে কথা বললে তখনই নিজেকে সামলে নিয়ে ভুল সংশোধন করবো। ঠিক মন্ত্রের মত আমি আওড়াব তুমি যে একটি ছোট্ট শিশু মাত্র, এর বেশী কিছু নও।
আমি তোমাকে পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষ ভেবে ভুল করেছি …। এখন আমি বুঝতে পারছি তুমি শুধু একটি শিশু মাত্র–ক্লান্ত হয়েইতুমি বিছানায় শুয়ে আছে। …আমি তোমার কাছে ঢের বেশি কিছু চেয়েছি সেটা চাওয়া আমার উচিত হয়নি।