1 of 2

৩৪. যতটা সাহস এবং উৎসাহ

যতটা সাহস এবং উৎসাহ নিয়ে জয়িতা মেয়েটিকে দেখতে এসেছিল, ব্যান্ডেজ খোলার পর সেটা দূর হয়ে শরীর গোলানো অনুভূতি তৈরি হল। তার মনে হচ্ছিল বমি হয়ে যাবে। অত্যন্ত ভেপসে গিয়েছে ঘা, ওষুধ দেওয়া সত্ত্বেও আজ দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। গতকাল কিন্তু গন্ধটা এমন ছিল না অথবা থাকলেও পাওয়া যায়নি। এখন আরও কুৎসিত দেখাচ্ছে মেয়েটির মুখ, গলা। দাঁতে দাঁত চেপে ঘা পরিষ্কার করতে লাগল জয়িতা। মেয়েটির মা উদ্বিগ্ন মুখে পাশে দাঁড়িয়ে। আঙুলে তুলে নিয়ে ঘা স্পর্শ করার সময় প্রথমে যে অস্বস্তিটা প্রবল হয়েছিল ধীরে ধীরে সেটা মিলিয়ে গেল। নতুন করে মলম বুলিয়ে আবার ব্যান্ডেজ করল জয়িতা। পুরোনোটাকে কোনরকমে মুড়ে নিয়ে সে মেয়েটির মাকে ওষুধ খাওয়াতে ইঙ্গিত করে বেরিয়ে এল বাইরে।

ঘরের বাইরে তখনও ভিড়। সবাই জয়িতার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে। সে বেরিয়ে আসামাত্র কয়েকজন ঢুকে গেল ভেতরে। জয়িতা আর দাঁড়াল না। হন হন করে সে হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে যখন একদম একা, পাহাড়ের একটা রাস্তার শেষে দাঁড়িয়ে, তখন ব্যান্ডেজটার কথা খেয়াল হল। সেটাকে যাদের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলতেই পেট গুলিয়ে উঠল। হাঁটু মুড়ে বসে জয়িতা বমি করতে লাগল। এই ঠাণ্ডাতেও কপালে ঘাম জমছিল। শরীরে সেই তৈলাক্ত অনুভূতি।

মিনিট পাঁচেক পরে যখন বমিটা বন্ধ হল তখন শরীরে প্রচণ্ড ক্লান্তি। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে জয়িতা একটা বড় পাথরের ওপরে শরীর এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পড়ে রইল সে। এবং তখনই তার মনে হল এই পৃথিবীতে সে এখন একা। একটিও মানুষের কাছে কিছু আশা করার নেই। যখন সে কলেজে পড়ত, কলকাতায় ব্যস্ত থাকত তখন এই চিন্তাটা এমন ভাবে তাকে পীড়িত করেনি। সীতা রায় অনেক দূরের মানুষ, রামানন্দ রায়ের জন্যে হঠাৎ তার কান্না পেয়ে গেল। এই কান্না ঠিক রামানন্দ রায় না নিজের জন্যে তা সে জানে না। সচেতন মানুষ হিসেবে রামানন্দ রায়কে অপছন্দ করার যথেষ্ট কারণ আছে, ঘেন্না করারও। কিন্তু কন্যা হিসেবে হঠাৎ সে রামানন্দ রায়ের অভাব বোধ করতে লাগল। হয়তো রুটিন তবু ওই যে দিনে একবার এসে তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, এভরিথিং অল রাইট, সেইটে করার আর কেউ রইল না। জয়িতার মনে হচ্ছিল, একটি মানুষ জীবনে সব কিছু পেতে পারে তার ক্ষমতা দিয়ে, চেষ্টা দিয়ে কিন্তু একটু স্নেহ না পেলে তার বড় জিনিস হারিয়ে যায়। রামানন্দ রায় কি তাকে খুব স্নেহ করতেন? সেই সময় সে কোন গুরুত্ব দেয়নি, বরং ধান্দা বলেই মনে হয়েছে। আজকে কেউ তাকে এসে ওই গলাতেও কথা বলবে না। চোখ খুলে ঘোলাটে আকাশটাকে দেখতে দেখতে ক্রমশ এইসব চিন্তার বাইরে বেরিয়ে এল জয়িতা। গম্ভীর মেজাজের মেঘগুলো যেন নাকের ডগায় ঝুলছে। এখানে ওই আকাশটা কত কাছে। যেন হাত বাড়ালেই নাগাল পাওয়া যায়। চুপচাপ শুয়ে রইল জয়িতা।

ট্রাঞ্জিস্টারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল কল্যাণ। উনুন তৈরি করা হয়েছে পাথর সাজিয়ে, তাতে কাঠ জ্বলছে। যতটা না আগুন তার চেয়ে বেশি ধোঁয়া। সুদীপ মত পালটে খিচুড়ি বসিয়ে দিয়ে বলল, একটা রান্নার বই কিনে আনলে হত। আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল যোল বছর বয়সে। জয়িতা তা থেকে অনেক বড় হয়েও রান্নার র জানে না। আজকালকার মেয়েদের কাছে তুই কোন কিছু আশা করতে পারিস না।

আনন্দ কথাগুলো শুনে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। কয়েকটা নেহাতই বাচ্চা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে জুলজুল চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে। আনন্দ লক্ষ্য করল ওদের দৃষ্টি উনুনটার দিকে। চোখেমুখে ক্ষুধা প্রকট হয়ে উঠেছে। এই গ্রামের মানুষগুলোর বেশির ভাগই সারা বছর আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকে। হয়তো কোন কোন দিন খেতেই পায় না। কিন্তু এই অবস্থার সঙ্গে ওরা এমন অভ্যস্ত যে খুব একটা মাথা ঘামায় বলেও মনে হচ্ছে না। কোন সরকারি সাহায্য এখানে পৌঁছয় না। মাঝে মাঝে কেউ কেউ কিছু জিনিস নিয়ে পাহাড়ি পথ ভেঙে যে টাকা রোজগার করতে যায় না এমন হতে পারে না। কারণ প্রত্যেকটা মানুষের শরীরে যে পোশাক আছে তা তাহলে এল কোত্থেকে? পালদেমকে প্রশ্নটা করেছিল সে। পালদেম বলেছে প্রত্যেক বছর দুটো লোক খচ্চরের পিঠে জিনিসপত্র চাপিয়ে এই গ্রামে আসে। তারা টাকা নেয় না কিন্তু সেগুলোর বিনিময়ে জিনিসপত্রই নিয়ে থাকে। গ্রামের লোকেরা পোশাক, নুন, চিনি এবং চাল কিনে থাকে এইভাবে। ব্যাপারটা হয়তো ঘটে থাকে কিন্তু নিজের প্রয়োজনে মানুষ গ্রাম থেকে বেরিয়ে যোগাযোগ করবে না এ অসম্ভব। যে লোকটা ওদের দেবতার মূর্তি চুরি করে পালাচ্ছিল সে নিশ্চয়ই এই গ্রামের লোক। তার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল, পালদেম কিন্তু কিছুই বলতে চায়নি। পৃথিবীর কিছু মানুষ একটি দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে প্রায় জন্তুর মত জীবনযাপন করছে এবং তা নিয়ে কারও মাথা ঘামাবার কোন দায় নেই। চুপচাপ ভাবতে ভাবতে আনন্দর মাথায় দ্বিতীয় চিন্তা চলকে উঠল। সে বন্ধুদের দিকে উত্তেজিত হয়ে তাকাল। কল্যাণ এখনও কানে ট্রাঞ্জিস্টার চেপে স্টেশন ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সুদীপ উনুনে বসানো পাত্রটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আনন্দ উঠে বাচ্চাগুলোর দিকে এগিয়ে যেতেই ওরা সরে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল। আনন্দ বন্ধুর মত হাসতে চেষ্টা করল। বাচ্চাগুলো সেই হাসি ফিরিয়ে দিল না। আরও তিন পা এগিয়ে গিয়ে হাত মুখ তুলে খাবার ভঙ্গি করেই দূরের জ্বলন্ত উনুনটাকে ইঙ্গিতে দেখাল। বাচ্চাগুলো খানিকটা থতমত হয়ে ওর দিকে তাকাল। এবার কারও কারও মুখে হাসি ফুটে উঠল। দুজন একসঙ্গে মাথা নেড়ে জানাল তারা খেতে সম্মত। আনন্দ হাত তুলে তাদের আশ্বস্ত করল। তারপর ফিরে এল বন্ধুদের কাছে। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কেসটা কি?

আনন্দ বলল, আরও সাত আট জনের জন্যে খিচুড়ি করতে হবে। দেখে মনে হল ওরা ক্ষুধার্ত।

কল্যাণ ট্রানজিস্টারটা বন্ধ করে বলল, মাথা খারাপ নাকি! যা স্টক আছে তা আমাদেরই বেশি দিন কুলোবে না, তার ওপর দানছত্র করলে এখনই না খেয়ে মরতে হবে।

আনন্দ হেসে বলল, যখন এগুলো শেষ হয়ে যাবে তখন কি খেয়ে থাকবি?

কল্যাণ উত্তর দিল না প্রথমে। তারপর চুপচাপ উঠে ঢুকে গেল ঘরে।

সুদীপ বলল, অত খিচুড়ি একসঙ্গে রান্না করার জায়গা নেই। একটু খিচুড়ি একবার খাইয়ে ওদের ভালবাসা পাওয়া যাবে বলে তোর মনে হচ্ছে? ইমপসিল। মেয়েটার কিছু হলে আমাদের টুকরো টুকরো করে ফেলবে ওরা।

জানি না। তবে একদল ক্ষুধার্ত ছেলের সামনে বসে খেতে পারব না আমি।

একদল? তুই ভেবেছিস ওই কটি ছেলেই ক্ষুধার্ত? খবর পেলে সমস্ত গ্রাম চলে আসবে খেতে।

খাবে। আমাদের সঙ্গে যা আছে তাই ওদের খেতে দেব। আনন্দ নির্লিপ্ত মুখে উত্তর দিল।

সুদীপ উঠে দাঁড়াল, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?

মাথা আমার ভালই আছে সুদীপ। আমি এই লোকগুলোর সঙ্গে একটু ভাব করতে চাই।

হোয়াট ফর? এরা আমাদের কোন উপকারে আসবে না। দেখলি না, পালদেম কি কাণ্ডটা করল!

আনন্দ আকাশের দিকে তাকাল। তার মাথায় যে চিন্তাটা এসেছে সেটাকে গুছিয়ে বলার মত সে কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বলতে গেলেই নিজের কাছে কেমন খেলো মনে হচ্ছে। ওরা এর মধ্যে একটা মতলবের গন্ধ খুঁজে পেতে পারে আর সেই মতলবটাকে সমর্থন করবে এমন ভাববার কোন কারণ নেই।

খিচুড়ি হয়ে গিয়েছিল। সুদীপ তাড়াতাড়ি পাত্রটাকে নামিয়ে ঘরে নিয়ে গেল। আনন্দ দেখল বাচ্চাগুলো আরও কয়েক পা এগিয়ে এসেছে। ওদের প্রত্যেকের মুখে আকাঙক্ষা স্পষ্ট। ঠিক তখনই ড্রাম বাজার শব্দ কানে এল। সে অবাক হয়ে দেখল বাচ্চাগুলো পলকে পিছন ফিরে ছুটতে লাগল উলটো দিকে। আনন্দ দুরেও কিছু লোককে ছুটে যেতে দেখল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল সমস্ত গ্রামে ড্রামের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। শব্দ শুনেই সুদীপ বাইরে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কিসের আওয়াজ রে?

আনন্দ মাথা নাড়ল, বুঝতে পারছি না। সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে ওই পাশে যাচ্ছে।

সুদীপ ফ্যাকাশে মুখে বলল, মেয়েটা মরে গেল না তোর জয়িতা কোথায়? মেয়েটা মরে গেলে আর দেখতে হচ্ছে না। এদিকে তো কেউ নেই, পালাবি?

আনন্দ বলল, জয়িতাকে ফেলে পালাতে পারব না। আর পালিয়ে যাবই বা কোথায়? তার চেয়ে চল দেখে আসি ব্যাপারটা। কল্যাণকে ডাক।

কল্যাণ পিছনেই ছিল। সে গলা তুলে বলল, আমি আগ বাড়িয়ে ধরা দিতে পারব না। জ্বলন্ত উনুনে এসে পড়লাম কড়াই এড়াতে গিয়ে। পুলিশকে বলতে পারতাম, আইনের আশ্রয় নিতে পারতাম কিন্তু এখানে সেসব— পালাতে হলে পালা, আমি রাজী আছি। শেষ কথাগুলো সুদীপের দিকে তাকিয়ে বলল সে।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, পুলিশকে কি বলতিস? আমার হাত ভাঙা ছিল, আমি একটাও খুন করিনি, গুলিও ছুঁড়িনি। অতএব আমি অপরাধী নই, এই তো? চল, আনন্দ, যা হবার হবে, ব্যাপারটা দেখেই আসা যাক। সুদীপ নেমে হাঁটতে লাগল।

কল্যাণ খানিকটা ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে চিৎকার করল, তোরা ঘুরে আয়, আমি এইসব পাহারা দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি আসতে চেষ্টা করিস।

সুদীপ যেতে যেতে বলল, আমি কল্যাণকে বিশ্বাস করি না, ও আমাদের ফাঁসিয়ে দিতে পারে।

আনন্দ হাসল, কার কাছে? এখানে নিজেরাই যদি নিজেদের গলায় ফাঁস পরাই তাহলে অন্য কথা।

ড্রামের আওয়াজ বাড়ছিল। যত এগোচ্ছে তত জায়গাটা জনমানবশূন্য ঠেকছে। ছেলেবুড়ো সবাই দৌড়চ্ছে বোঝা যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ওরা মন্দিরটার কাছে পৌঁছে গেল। সমস্ত গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছে এক জায়গায়। কাহুন উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কিছু বলল। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা চিৎকার করে যেন সমর্থন জানাল। এবার ওরা লোকটাকে দেখল। দুটো হাত পিছু মোড়া করে বাঁধা। এর পর আগে কাহুন হেঁটে যাচ্ছে, পিছনে দুটো লোক হাতবাঁধা লোকটিকে নিয়ে। পালদেমও ওই দলে রয়েছে।

সুদীপ ফিসফিস করে বলল, আমাদের জন্যে নয়, মূর্তি চুরি করা লোকটাকে বোধ হয় শাস্তি দেবে আজ। কি শাস্তি দিতে পারে?

আনন্দ কোন কথা বলল না। একটা গোল ড্রাম ধরে রেখেছে দুটো লোক, আর তার মাঝখানে তালে তালে পিটিয়ে যাচ্ছে মিছিলের একটি লোক। ওরা সোজা পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে উঠছিল। আনন্দ সুদীপকে ইশারা করল বাঁ দিকে সরে আসতে। আড়ালে আড়ালে খানিকটা দূরে যাওয়ামাত্র জয়িতাকে দেখতে পেল সুদীপ। একটা বড় পাথরের ওপরে জয়িতা বসে চারপাশে তাকাচ্ছে। ওদের দেখে নেমে এসে জিজ্ঞাসা করল, কিসের আওয়াজ হচ্ছে রে?

সুদীপ বলল, শাস্তির। তুই এখানে কি করছিলি?

জয়িতা কাঁধ নাচাল। যেন সেটাই উত্তর হয়ে গেল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কার শাস্তি?

আনন্দ বলল, মূর্তিচোর লোকটার। ওরা ওকে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের চুড়োতে। এদিক দিয়ে গেলে মনে হয় আড়াল থেকে দেখা যাবে।

একেবারে চূড়োয় ওঠার পর ড্রামের আওয়াজ থামল। গ্রামের সমস্ত মানুষ এখন চুপচাপ। কাহুন চারপাশে তাকিয়ে পালদেমের উদ্দেশ্যে কিছু বলতেই সে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করল।

সুদীপ বলল, যে করেই হোক এদের ভাষাটা তাড়াতাড়ি শিখতে হবে। পালদেমটা মনে হচ্ছে, নেতা।

জয়িতা বলল, এখানে সবাই রাজা। মনে হচ্ছে লোকটাকে মেরে ফেলবে।

সুদীপ মাথা নাড়ল, দূর! একটা মূর্তি চুরির জন্যে ওরা মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে নাকি!

পালদেম বক্তৃতা চালাচ্ছিল।

জয়িতা বলল, অন্ধ ধর্মবিশ্বাস মানুষকে নরকেও নিয়ে যেতে পারে। ওরা লোকটাকে যদি মেরে ফেলতে চায় তাহলে কি আমরা বাধা দেব?

সুদীপ নিঃশ্বাস ফেলল, ইমপসিবল। খালি হাতে কিছু করতে যাওয়া বোকামি হবে।

বক্তৃতা শেষ করে পালদেম চিৎকার করে কাউকে ডাকতেই একটি যুবতীকে দেখা গেল এগিয়ে যেতে। যুবতী সুগঠনা, দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে সে রূপসী এবং সেই বিষয়ে সে বিশেষ সচেতন। পালদেমের সামনে গিয়ে যুবতী মাথা নিচু করে দাঁড়াতে কাহুন তাকে প্রশ্ন করল একটার পর একটা। যুবতী যেই উত্তর দিচ্ছে অমনি মূর্তিচোর চিৎকার করে যেন প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। কিন্তু তার চিৎকার ড়ুবে যাচ্ছে জনতার চিৎকারে। বেশ কিছুক্ষণ এই চলার পর পালদেম কাহনকে ইশারা করল। আনন্দ চোখের পলক ফেলার আগেই দেখল ওরা লোকটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিল। সামান্য শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করার সুযোগ পেল না লোকটা, শরীরটা যেন পাক খেতে খেতে নেমে যেতে লাগল নিচে। কয়েক হাজার ফুট তলায় পাথরের ওপরে যখন আছড়ে পড়বে তখন এই গ্রামের সঙ্গে তার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না। ওরা তিনজন স্তব্ধ হয়ে দেখল গ্রামবাসীরা নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন কেউ কোন কথা বলছে না। অনেকটা শোক মিছিলের মতো দেখাচ্ছে, শুধু অদ্ভুত আওয়াজ বের হচ্ছে ড্রাম থেকে। অনেকটা বিজয়া দশমীর ঢাকের বোলের মত।

জয়িতা বলতে পারল শেষ পর্যন্ত, কি নৃশংস!

সুদীপ বলল, কোন বিচার হল না, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেল না লোকটা, পাহাড় থেকে ছুড়ে ফেলে মেরে ফেলা হল। জানতে হবে সিদ্ধান্তটা কে নিল!

জয়িতা বলল, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি লাভ! ফিরে চল। তারপর নামতে নামতে বলল, আমরা যখন নানুভাই আর মন্ত্রীকে খুন করি তখনও নিশ্চয়ই কেউ কেউ বলেছে কি নৃশংস! আমরাও অবশ্য বিচার ব্যবস্থার সুযোগ দিইনি ওদের!

সুদীপ ক্ষেপে গেল, কার সঙ্গে কার তুলনা করছিস! ডাইরেক্ট ইনফ্লুয়েন্স অফ কল্যাণ! যারা বিচার ব্যবস্থাকে কবজা করে রেখেছে ক্ষমতার জোরে, যারা ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করবে সেই পুলিশ পারচেজড যেখানে ওদের সুযোগ নিতে দেওয়া মানে সসম্মানে বেরিয়ে আসতে বলা। আজ অবধি কটা কমিশনে বা ক্রিমিনাল কেসে অপরাধীকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলতে পারিস? খোদ পুলিশের এক কর্তা মারা গেল কনস্টেবল সমেত অথচ অপরাধী ধরা পড়ল না। যাকে সাজানো হল সে মারা গেল লকআপে। সঞ্জীব তীর্থঙ্করের কেসটা ভাব? এখানে তো তেমন সমাজব্যবস্থার রাষ্ট্রীয় যন্ত্র নেই।

রাষ্ট্রীয় যন্ত্র নেই, সমাজব্যবস্থার কথা জানলি কি করে?

মনে হয়। নইলে লোকটার বউ ওর বিরুদ্ধে অন্তত কথা বলত না। বউটাকে দেখে তোর দুঃখী মনে হয়েছে? শালা, মেয়েছেলে–।

সুদীপকে শেষ করতে দিল না জয়িতা, নো মোর, তোর ওপর কল্যাণের প্রভাব কম নয়।

ওরা নিচে নেমে হাঁটতে লাগল আস্তানার দিকে। আনন্দ জিজ্ঞেস করল, মেয়েটার ঘা কেমন দেখলি? কোন উন্নতি হয়নি?

জয়িতা বিশদ বলল। আনন্দ বলল, ঠিক আছে, গুড সাইন।

আস্তানায় এসে ওরা দেখল কল্যাণ নেই। কিন্তু সেই বাচ্চা কটা দাঁড়িয়ে আছে। সুদীপ বলল, আনন্দ, তুই কি ফ্যাচাং বাধালি বল তো! ওরা তোকে দেখে আপনজনের মত হাসছে।

আনন্দ জয়িতাকে বলল, আমি ওদের খাওয়াব বলেছিলাম। ওরা ক্ষুধার্ত।

জয়িতা বলল, আমিও। আমাকে কে খাওয়াবে?

আনন্দ হেসে ফেলল, সবাই মিলে খাওয়ানো যাক সবাইকে।

সুদীপ বলল, ঠিক আছে, আমি আবার উনুন ধরাচ্ছি কিন্তু তুই বাচ্চাগুলোকে ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে খাওয়া। নইলে মেম্বার বেড়ে যাবে পিলপিল করে।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, আমাদের জন্যে যেটা রাঁধলি সেটা দিয়ে দিতে বলছিস?

কাঁধ ঝাঁকাল সুদীপ, কি আর করা যাবে। তারপর জয়িতাকে বলল, আগের খিচুড়িটা খুব ধূর হয়েছিল। এক্সপেরিয়েন্স মেকস এ ম্যান এফিসিয়েন্ট। এবার দারুণ রাঁধব। তুমি পটের বিবি হয়ে বসে থাকবে তা চলবে না, এসো হাত লাগাও।

জয়িতা হেসে ফেলল, একটা মানুষের মৃত্যু দেখেও তুই ঠাট্টা করছিস। পটের বিবিরা শুনেছি খুব সুন্দরী হয়। যেমন পটেশ্বরী বউঠান। আমি খুব গর্বিত বোধ করছি।

 

আনন্দ বাচ্চাগুলোকে দেখছিল। সুদীপ যাকে ধূর রান্না বলেছে তাই ওরা খাচ্ছে পরম তৃপ্তি নিয়ে। ঘরের মধ্যে সসপ্যানটাকে মাঝখানে রেখে ওরা কয়েক সেকেন্ডে শেষ করে ফেলল খিচুড়ি। কিন্তু ওই পরিমাণে ওদের কিছুই হয়নি বোঝা গেল। তবু প্রতিটি মুখেই এখন খুশীর ছাপ। আনন্দ এবার ইঙ্গিত করল পাত্রটাকে ধুয়ে আনতে। সঙ্গে সঙ্গে দুজন ওটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাকিরা আর কিছু করার নেই বুঝতে পেরে একে একে উঠে দাঁড়াল। আনন্দ চেষ্টা চালাচ্ছিল ওদের সঙ্গে কথা বলার। বাচ্চাগুলো লজ্জা পাচ্ছিল, নিজেদের মধ্যে হাসছিল এবং শেষ পর্যন্ত ওদের দুই সঙ্গী পাত্র নিয়ে ফিরে এলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। আনন্দ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল।

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং তথাকথিত সামাজিক চেহারার যে পরিবর্তন অধিকাংশ মানুষ মনে মনে কামনা করেন অথচ অংশ নেন না সক্রিয়ভাবে ওরা সেখানে আঁচড় কাটতে চেয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে সেটা আঁচড়ও ছিল না। একটা মধুচক্রের মারফত মুনাফাখোরকে ধ্বংস, জাল ওষুধের কারবার বন্ধ করা অথবা অসৎ মন্ত্রীকে খুন করলে অত বড় দেশের কোন উপকার করা হয় না। তার ধারণা ঘটনার মধ্যে দাঁড়িয়ে যত তীব্র ছিল বেরিয়ে এসে সেটাই এখন পানসে ঠেকছে। যে দেশের প্রতিটি মানুষকে বাঁচতে হয় কোন না কোন ভাবে অসৎ হয়ে অথবা অসৎ ছায়ার সঙ্গে তাল রেখে সেখানে ওই ঘটনা কোন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া যদি সৃষ্টি করে তা অত্যন্ত সাময়িক। হয়তো এতদিনে আরও দশটা জাল ওষুধের কারখানা তৈরি হয়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষমাত্রই চাইবে অন্যের ওপর দিয়ে ঝড়টা যাক, আমি যেন নিরাপদে থাকি। তা ছাড়া দেশের সিস্টেমটাই এমনভাবে তৈরি যে কয়েকটা রাজনৈতিক দল, কিছু ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবী যা করবে মিলেমিশে তাই মেনে নেবে সাধারণ মানুষ। এই মেলামেশাটাও যদিও আপাতচোখে দেখা যায় না, ফলে কৃত্রিম রেষারেষি ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সহজেই। ব্যক্তিহত্যা অথবা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে ধ্বংসের মধ্যে ব্যক্তিগত আনন্দ থাকতে পারে কিন্তু তা করে গণজাগরণ সম্ভব নয়। বস্তুত ভারতবর্ষে সেই ঘটনাটি আদৌ যাতে না ঘটে তার জন্যে ডান এবং বামপন্থীরা সুচতুর চেষ্টা চালিয়ে বেশ স্থিতাবস্থায় এসে গেছে। এই ভাবনা যদি সত্যি হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া হবে কল্যাণের। সে নিশ্চয়ই জানতে চাইবে এখন করণীয় কি? সে কেন আগে থেকে খতিয়ে দ্যাখেনি? আনন্দ ছটফট করছিল। তিন-তিনটে ঘটনা ঘটার পর ওরা হিমালয়ে বসে আছে। দেশে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তার খানিকটা আন্দাজ নিয়েই এসেছিল কিন্তু সেটা এখন কোন্ অবস্থায় আছে তা জানা যাচ্ছে না। তবে পুলিশ ওদের খুঁজে বেড়াচ্ছে, ধরা পড়লে খুনের দায়ে খুন হতে হবে এবং অধিকাংশ মানুষ সেটাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নেবে। যদি অন্ততপক্ষে একশজন লোক।

এই সময় সুদীপ ডাকল, আনন্দ একবার বাইরে আয়।

আনন্দ দরজায় এসে দৃশ্যটা দেখল। কল্যাণ দৌড়ে দৌড়ে পাহাড় থেকে নামছে আর তার পিছনে ও পাশে কয়েকজন যুবক। যেভাবে জন্তুকে তাড়িয়ে নিয়ে আসা হয় ওরা কল্যাণকে সেইভাবেই নিয়ে আসছে। আস্তানার কাছে পৌঁছে কল্যাণ ধপ করে বসে পড়ল। আনন্দ ছুটে গেল ছে, কি হয়েছে? কল্যাণ কোন কথা বলতে পারল না। সে হাঁপাচ্ছে, এই শীতেও তার শরীর ঘামে ভেজা।

এই সময় পালদেমকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। পিছু ধাওয়া করে আসা যুবকদের কাছে ঘটনাটা শুনে পালদেম এগিয়ে এসে কল্যাণকে দেখল, তারপর আনন্দকে প্রশ্ন করল, ওকে তোমরা কোথায় পাঠিয়েছিলে? আমি বলেছিলাম এই গ্রাম ছেড়ে তোমাদের না যেতে, তোমরা শুনলে না!

আনন্দ কল্যাণের দিকে তাকাল। সে চোখ বন্ধ করে তখনও নিঃশ্বাস ফেলছে জোরে জোরে। আনন্দ বলল, ওকে আমরা কোথাও পাঠাইনি। মনে হয় ও পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল।

না। পালদম প্রায় চিৎকার করে উঠল, ও আমাদের শত্রুপক্ষের গ্রামের দিকে যাচ্ছিল। আমাদের লোক ওকে দেখামাত্রই দৌড়তে আরম্ভ করে। অপরাধী ছাড়া কেউ পালাবার চেষ্টা করে না। তোমাদের বলে দিচ্ছি এই ঘটনাটা যেন দ্বিতীয়বার না ঘটে।

আনন্দ এবারে অবাক। কল্যাণ পালাচ্ছিল? কাউকে কিছু না বলে? কিন্তু ওর সঙ্গে পরে কথা বলা যাবে। সে পালদেমকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে তোমাদের শত্রুপক্ষ আছে?

আছে। মাঝে মাঝেই ওরা আমাদের ওপর হামলা করে।

কেন?

পালদেম প্রশ্নটা শুনে এবার হাসল, ওদের যখন খাবার দরকার হয় অথবা মেয়ের প্রয়োজন হয় তখন চলে আসে। শত্রুতা কয়েক পুরুষ ধরেই চলছে। মেয়েটা কি ভাল হয়ে যাবে?

শেষ প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন জয়িতার উদ্দেশে।

ওরা নির্বাক হয়ে বসে ছিল। উত্তরে জয়িতা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

পালদেম বলল, তাহলে তোমাদের মঙ্গল। শোন, আর কদিনের মধ্যে জোর বৃষ্টি হবে। তারপর বরফ পড়বে এখানে। একবার বরফ পড়া শুরু হলে আর পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করা অসম্ভব। তোমরা তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে সারিয়ে তোল।

আনন্দ মাথা নাড়ল, আমরা চেষ্টা করছি। আমি কথা দিচ্ছি এখান থেকে কেউ পালাবার চেষ্টা করবে না। যদি কেউ করে তাহলে সে নিজের দায়িত্বে করবে। আর একটা কথা, তোমাদের বেশির ভাগ মানুষের গলাতে যে রোগ হয়েছে তার ওষুধ আমাদের কাছে আছে। যদি চাও আমরা দিতে পারি।

পালদেমের মুখে অবিশ্বাস ফুটে উঠল, এসব বলে তুমি সুবিধে চাইছ? আমার ছেলে দুদিন ধরে শুয়ে আছে। তাকে তুমি সারিয়ে দিতে পারবে কালকের মধ্যে?

আনন্দের বুকে কাঁপুনি এল, কিন্তু সে ঝুঁকি নিতে রাজী হল, কি হয়েছে তোমার ছেলের?

কথা বলছে না, সমস্ত শরীর আগুনের মত গরম আর মাঝে মাঝে শরীর কাঁপছে।

বর্ণনা শুনে আনন্দর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। গ্রামে তাদের পাশের বাড়ির শিশুটির একই উপসর্গ হয়েছিল। প্রায় কান্নাকাটি পড়ে গিয়েছিল তখন। ডাক্তার এসে বলেছিলেন ওটাকে তড়কা বলে। তিনি শরীর থেকে সমস্ত গরম কাপড় খুলে ফেলে মিনিট দশেক ধরে জল ঢালতে বলেন। তাতে শিশুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে জ্বর এবং খিচুনি না হবার ওষুধ দিলে সে ভাল হয়ে ওঠে। পালদেমের ছেলের একই অসুখ হয়েছে কিনা সে বুঝতে পারল না। তা ছাড়া শিশুর জন্যে যে ওষুধের প্রয়োজন তা তাদের সঙ্গে নেই। খিচুনি বন্ধের ওষুধ আনার কথা, ভাবারও কোন কারণ ছিল না। সঙ্গে জুরের ট্যাবলেট এবং ক্যাপসুল আছে। সে জিজ্ঞেস করল, তোমার ছেলের বয়স কত?

পাঁচ।

আনন্দ ভেতরে ঢুকে ওষুধের বাক্স খুলল। এই সময় জয়িতার গলা পেল সে, তুই যাবি?

আনন্দ বলল, হ্যাঁ। একটা চান্স নেওয়া যাক। ওয়ান-থার্ড ট্যাবলেট দিলে কাজ হবে বোধ হয়।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কল্যাণ কি পালাতে চেয়েছিল?

আনন্দ বলল, ওটা ওকেই জিজ্ঞাসা কর। কেন যে এমন বোকামি করে। সে ওষুধ নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

জয়িতা বলল, আমি তোর সঙ্গে যাব?

আনন্দ মাথা নাড়ল, না। সুদীপ আর কল্যাণ অন্তত এই মুহূর্তে একা থাকুক আমি চাই না।

পালদেমের পাশে হাঁটছিল আনন্দ। সেই সময় টিপটিপ বৃষ্টি নামল। আনন্দ বলল, তোমরা শেষ পর্যন্ত লোকটাকে মেরে ফেললে? অন্য শাস্তি দেওয়া যেত না?

সবাই চাইল। ওর বউ পর্যন্ত বলল এমন স্বামীর সঙ্গে ঘর করতে চায় না।

আনন্দ রমণীটিকে মনে করল। সে জিজ্ঞাসা করল, ওদের ছেলেমেয়ে নেই?

না। আমাদের গ্রামে ছেলেমেয়ের সংখ্যা এমনিতেই কম। লোকটার কোন ভাইও নেই যাতে বউটা বিয়ে করতে পারে। এখন ওকে নিয়ে আবার সমস্যা দেখা দেবে। পালদেম বলল।

আবার কেন?

এর আগে মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল আমাদের শত্রুরা। অনেকে বলে ওরও নাকি যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। এসো।

পালদেমের ঘরে নিচু হয়ে ঢুকল আনন্দ। দুজন রমণী ছেলেটির পাশে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। পালদেম ঢুকেই তাদের ধমক দিল। সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল ওরা। পালদেম বলল, এই আমার ছেলে। ওকে দেখে যদি মনে কর সারাতে পারবে তাহলেই হাত দাও। নইলে ফিরে যেতে পার।

আনন্দ দেখল বাচ্চাটাকে অনেক কিছু চাপা দেওয়া সত্ত্বেও বারংবার কাঁপছে। মুখ টকটকে লাল। সে জিজ্ঞাসা করল, অসুখ হলে তোমরা কি কর?

পালদেম বলল, কাহন এসে মন্ত্ৰপড়া শেকড় দিয়ে যায়। এবার তাতে কমেনি। তা ছাড়া ওর শরীরে পাহাড়ের দানোটা এসে ঢোকার পর থেকে আমি আর কানকে ডাকিনি।

পাহাড়ের দানো? হতভম্ব হয়ে গেল আনন্দ।

নইলে ওর শরীর অমন করবে কেন? গ্রামের লোকজন যদি জানতে পারে তাহলে দানোটাকে মারবার জন্যে ছেলেটাকেই পুতে দেবে মাটিতে।

চাপা সরিয়ে ছেলেটার নগ্ন শরীরে হাত দিতে অবাক হয়ে গেল আনন্দ। প্রচণ্ড উত্তাপ, ঠিক কতটা জ্বর বোঝা যাচ্ছে না। তবে চারের কম তো নয়ই। ঘাড় শক্ত। চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কে তার কোন স্বচ্ছ ধারণা নেই। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে তার মনে হল সঙ্গে অন্তত কিছু ওষুধ আছে, এদের তো তাও নেই। ডায়মন্ডহারবারের গ্রামের শিশুটিরও ঘাড় এমন শক্ত ছিল। কিন্তু এই ঠাণ্ডায় যদি জল ঢাললে নিমোনিয়া হয়ে যায়? হলে হবে, কিন্তু এ ছাড়া তো সে কোন রাস্তা জানে না। পাসদেমকে দিয়ে জল আনিয়ে সে নিজের হাতে ন্যাকড়া ভিজিয়ে তাই দিয়ে ছেলেটির শরীরে জল বোলাতে শুরু করল। মিনিট দশেক পরে ওর মনে হল ছেলেটার ঘাড় নরম হচ্ছে, একটু একটু করে খিচুনি কমছে, শেষ পর্যন্ত ছেলেটা চোখ মেলল একবার, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। আনন্দ বুঝল ওর আরাম হচ্ছে। শরীরটা পরিষ্কার করে মুছিয়ে দিয়ে ও ট্যাবলেট তিন টুকরো করল। টুকরোটা গুড়ো করে নিয়ে জলের সঙ্গে মিশিয়ে ছেলেটার মুখে জোর করে ঢেলে দিল সে। ঘরের তিনটে মানুষ চুপচাপ তার কাজ দেখছিল।

পালদেম বলল, দানোটা বোধ হয় ওর শরীর থেকে বেরিয়েছে, না?

আনন্দ মাথা নাড়ল, তুমি আমার বন্ধুদের বল খেয়ে নিতে। আমাকে এখানে বসে থাকতে হবে, নইলে তোমার দানো আবার ফিরে আসতে পারে।

পালদেম বলল, আমি তোমার খাবার এখানে এনে দিচ্ছি। তুমি উঠো না।

আনন্দ বাচ্চাটার কপালে হাত রাখল। জ্বর সামান্য কমেছে বলে মনে হল। সে একমনে প্রার্থনা করছিল ওষুধটা যেন জাল না হয়, যেন কাজ দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *