৩৪. ভদ্রলোক সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন

মুনা বলল, আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?

ভদ্রলোক সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। যেন প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারছেন না। মুনা বলল, আমি অন্য একটা কেইসের ব্যাপারে। আপনার কাছে এসেছিলাম। আমার মামা একটা ঝামেলায় পড়েছিলেন…

ভদ্রলোক মুনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মনে আছে। ক্রিমিনাল মিস এপ্রোপ্রিয়েশনের মামলা। চারশ তিন ধারা। আপনার মামার নাম শওকত হোসেন কিংবা শওকত আলি।

মুনা যথেষ্ট অবাক হল। এই উকিল ভদ্রলোক অসম্ভব ব্যস্ত। চেম্বারে লোকজন গিজগিজ করছে। তার পক্ষে এতদিন আগের একটা মামলার কথা মনে থাকার কথা নয়। এর রকম স্মৃতিশক্তি মানুষের থাকে?

আপনার নামও মনে আছে। মিস মুনা। এখনো কি মিস আছেন না মিসেস হয়েছেন?

হইনি এখানে।

কেন অসুবিধা কি?

ভদ্রলোক গভীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন। যেন সত্যি সত্যি জানতে চান। কত বিচিত্র স্বভাবের মানুষই না থাকে পৃথিবীতে।

অসুবিধাটা কি বলুন।

ব্যক্তিগত অসুবিধা। সেটা এই জায়গায় বলতে চাই না।

আরে এই জায়গা কি দোষ করল? উকিলের চেম্বারে সব কথা বলা যায়। এ টু জেড।

আমি যে সমস্যা নিয়ে এসেছি তার সঙ্গে আমার মিস বা মিসেসের কোনো সম্পর্ক নেই।

ও আচ্ছা।

আমি কি সমস্যাটার কথা বলব?

আজ শুনতে পারব না। আজ ব্যস্ত। আগামী সপ্তাহে আসুন। সোমবার। এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যান। কাগজপত্র কী আছে?

কিছু কিছু আছে।

সেই সব রেখে যান। আমার এসিসটেন্ট আছে। জুনিয়র দুই উকিল। বুদ্ধিশুদ্ধি মিলিটারিদের মত। মাথার খুলির ভেতরে সাবানের ফেনা ছাড়া আর কিছু নেই। নো ব্রেইন। কিন্তু উপায় কি বলুন? এই শমসের চা দে। ইনারে চা দে।

মুনা বলল, আমি চা খাব না।

কেন খাবেন না?

কারণ কিছুই না। খেতে ইচ্ছে করছে না।

আপনি বললেন। কারণ নেই আবার খেতে ইচ্ছে করছে না। দুরকম কথা বলেন কেন? খেতে ইচ্ছে করছে না। এটাই হচ্ছে কারণ। কথাবার্তা চিন্তা-ভাবনা করে বলা উচিত।

উকিল ভদ্রলোক থু করে একদলা থুথু ফেললেন এ্যাসট্রেতে। চারদিকে এ্যাসট্রের ছাই ছড়িয়ে পড়ল। ভদ্রলোক বিরক্ত হবার বদলে মনে হয় আরো খুশি হলেন। ছাই কি করে উড়ে সেটা পরীক্ষা করবার জন্যে আরেক দফা থুথু ফেললেন।

মিস মুনা।

জি।

ছাই ফেলবার জন্যে সব টেবিলে এ্যাসট্রে থাকে। কিন্তু থুথু ফেলবার জন্যে কিছু থাকে না। কিছু থাকা উচিত। পিকদানি টাইপ কি বলেন?

মুনা কিছু বলল না। উকিল সাহেব হাই তুলে বললেন চলে যান, বসে আছেন কেন? সোমবারে আসবেন। দেখে দেব। আমার ফিস কিন্তু আরো বেড়েছে। জেনে যাবেন। শেষে আমড়াগাছি করবেন। সেটা হবে না। উকিলের চেম্বার কোনো মাছের বাজার না। মুহুরির কাছে সব জেনে-টেনে যান।

জি আচ্ছা।

সোমবারে ফিসের টাকার গোটাটাই নিয়ে আসবেন। খালি হাতে আসবেন না। মুনা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনার কাছে যারা আসেন তাদের সবারই নামধাম কি আপনার মনে থাকে?

হুঁ থাকে। নাম মনে থাকে আর কোনো ধারার কেইস ঐটা মনে থাকে। করে খাচ্ছি। তো এই কারণেই। হা হা হা।

মুনা বের হয়ে গেল। অফিসের সময় হয়ে আসছে। এখান থেকে একটা রিকশা নিলে ঠিক সময় পৌঁছান যাবে। মুনা খানিকক্ষণ ভেবে ঠিক করল। আজ অফিসে যাবে লাঞ্চ টাইমের পর। এই সময়টায় সে চেষ্টা করবে বাকেরের বড় ভাইকে ধরতে। হাসান সাহেব বোধ হয় নাম। আগের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে সাকুলার রোডে বাড়ি নিয়েছেন। সেই ঠিকনা বের করতে মুনার কম ঝামেলা হয়নি।

 

একটি কাজের লোক মুনাকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেল। তারপর আর কারোরই কোন খোঁজ নেই। বাড়ি নিঃশব্দ। ইংরেজিতে এই ধরনের পরিবেশকেই বোধ হয়। পিন ড্রপ সাইলেন্স বলা হয়। মনে হচ্ছে শুধু এই বাড়ি নয় আশপাশের কয়েকটি বাড়িতেও লোকজন নেই।

সুন্দর করে সাজানো বসার ঘর। পর্দা টেনে রাখার জন্যে আধো আলো আধো আঁধার। তবু এর মধ্যেই বোঝা যাচ্ছে এ ঘরে একবিন্দু ধুলো নেই। রোজ দুবেল কিংবা কে জানে হয়ত তিন বেলা এই ঘর ঝাড়পোচ করা হয়। অডিকেলনের গন্ধের মতো মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে নাকে। গন্ধটাও ঘরের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। যেন এটা না থাকলেই মানাত না। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর কাজের লোকটি আবার ঢুকল। তার হাতে চমৎকার একটি ট্রে। ট্রেতে এক কাপ চা অন্য একটি প্লেটে কিছু বিসকিট। রুটিন কাজ। যারা এখানে আসে তাদের সবার জন্যেই বোধ হয় এই ব্যবস্থা। মুনা বলল। উনার কি দেরি হবে? আমার অফিস আছে।

কাজের লোকটি বলল, আসতেছেন। তারপরও আধঘণ্টার মত বসে থাকতে হল।

মানুষকে বসিয়ে রাখার মধ্যে এরা কি কোনো আনন্দ পায়?

হাসান সাহেব ঘরে ঢুকলেন অফিসের পোশাক পরে। ঢুকেই ঘড়ি দেখলেন, এর মানে সময় বেশি দেওয়া যাবে না।

আপনি কি আমার কাছে এসেছেন?

জি।

আপনার সঙ্গে কি আমার পরিচয় আছে?

জি না। তবে আমরা এক পাড়ায় থাকতাম।

ও আচ্ছা। কি ব্যাপার বলুন?

আমি এসেছি আপনার ভাইয়ের ব্যাপারে।

বাকের? নতুন কোনো ঝামেলা বঁধিয়েছে নাকি?

জি না।

হাসান সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। তিনি দ্বিতীয়বার ঘড়ি দেখলেন। কিন্তু বসলেন। ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে তিনি সমস্ত ব্যাপার মন দিয়ে শুনবেন।

বলুন কি বলবেন?

বাকের ভাই অনেক’দিন ধরে হাজতে পড়ে আছে। কেউ বোধ হয় কিছু করছে না। দেখতে-টেখতেও যাচ্ছে না।

বাকেরের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

সম্পর্ক কিছু নেই। এক পাড়ায় থাকতাম। অনেক সময় আমাদের অনেক উপকার করেছেন।

ও তো গুণ্ডামি করে জানতাম। উপকার ও করে নাকি?

মানুষের চরিত্রের অনেকগুলি দিক থাকে।

তা থাকে। এ ম্যান হ্যাঁজ মেনি ফেসেস। ভালই বলেছেন। বাকেরের ব্যাপারটায় আমি ইচ্ছা! করেই নীরব আছি। এর কারণ আছে। আমার মনে হয় আপনাকে বুঝিয়ে বললে বুঝবেন। আমি মনে প্ৰাণে চাচ্ছি। যাতে ওর একটা শিক্ষা হয়। হাজতে ঢোকা মাত্র বের করে আনলে ঐ শিক্ষাটা হবে না।

আপনি চাচ্ছেন বিচার-টিচার হবার পর বাকের ভাই বেশ কিছু দিনের জন্যে জেলে চলে যাক।

হাসান সাহেব ঘড়ি দেখলেন। কিন্তু তার মধ্যে কোন চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেল না। তিনি সিগারেট বের করলেন এবং কাজের লোকটিকে চা দিতে বললেন। মুনা সহজ স্বরে বলল, আপনি বোধ হয় জানেন না এটা সাজানো মামলা। বাকের ভাইয়ের কাছে অস্ত্রশস্ত্র কিছুই ছিল না।

আপনি কি করে জানেন?

বাকের ভাইয়ের অনেক দোষ আছে কিন্তু সে মিথ্যা কথা বলে না।

হাসান সাহাবে হেসে ফেললেন। মুনা লক্ষ্য করল হাসিটি খুব সুন্দর। সহজ স্বাভাবিক।

আপনার নাম কি?

মুনা।

আমি কি আপনাকে তুমি করে বলতে পারি? বয়সে আমি অনেক বড়।

নিশ্চয় তুমি করে বলবেন।

আমি এখন অফিসে যাব। গাড়ি এসে গেছে বোধ হয়। হর্ন দিচ্ছে। তুমি কোথায় যাবে বল

তোমাকে নামিয়ে দেব।

আমাকে নামিয়ে দিতে হবে না। আমি রিকশা নিয়ে চলে যাব।

রিকশা নিয়ে চলে যাবার কোন দরকার নেই, এস, তুমি। আর শোন, আমি একজন এডভোকেটের সঙ্গে কথা বলছি। ও বাকেরের ব্যাপারটা দেখছে। তুমি হয়ত ভাবিছ আমি ভাই হিসেবে কোন দায়িত্ব পালন করছি না। এটা ঠিক না। দেখছি। আড়াল থেকে দেখছি। তাছাড়া…

তাছাড়া কি?

আফিসে আমার নিজের একটা সমস্যা যাচ্ছে। আমার পায়ের নিচে মাটি নেই। অনেক গল্প। তুমি আরেক’দিন এস, তোমাকে বলব।

হাসান সাহেব মুনাকে শুধু যে অফিসে নামিয়ে দিলেন তাই নয় নিজে গাড়ি থেকে নামলেন। মুনা কোথায় বসে তা দেখলেন। মুনা যখন বলল, এক কাপ চা খাবেন? তিনি বললেন–মন্দ কি।

চা খাওয়া যেতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *