বারাসতের বালিকা বিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে শহরে খুব শোরগোল চলছে।
এত বড় শহরে বালিকাদের শিক্ষার জন্য আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা করা গেল না। এক একবার উদ্যোগ হয় ও ভেস্তে যায়। খ্ৰীষ্টীয় ধর্মপ্রচারিকাগণ দু-একটি স্কুল খুলেছেন। অবশ্য কিন্তু সেখানে সম্ভ্রান্ত দেশীয় ব্যক্তিগণ কেউই তাঁদের কন্যাদের পাঠাতে চান না। মুসলমান সমাজে কঠোর পদ প্রথা, তাদের বালিকারা বাইরে পড়তে যাবে না। হিন্দু পরিবারের অবরোধ একটু একটু করে ভাঙছে, যদিও জাত নষ্ট হবার ভয় এখনো যায়নি। এ ভয় সম্পূর্ণ অমূলকও নয়, মিশনারিরা যেন রক্তলোলুপ ব্যাঘের মতন জোর করে ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে খ্ৰীষ্টান করার জন্য ব্যগ্ৰ। এই অবস্থার মধ্যে বারাসত নামে ক্ষুদ্র পল্লীর স্থানীয় অধিবাসীদের চেষ্টায় একটি দেশীয় বালিকা বিদ্যালয় দিব্যি চলছে। এজন্য বারাসতবাসীরা সারা দেশের প্রশংসাভাজন হয়েছিল। বিশেষত প্যারীচরণ সরকারের পরিশ্রম ও উদ্যোগেই স্কুলটি চলছিল বলে সবাই তাঁকে ধন্য ধন্য করে। হঠাৎ একটি উল্টো ব্যাপার ঘটলো।
বারাসতের ঐ বিদ্যালয়ে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী উৎসবে একজন ইংরেজ সস্ত্রীক গিয়েছিলেন সভাপতি হিসেবে। একটি অল্প বয়েসী বালিকার কবিতাপাঠ শুনে মোহিত হয়ে ইংরেজ পুরুষটি আদর করে তার গাল টিপে দেন। অমনি অভিভাবকদের মধ্যে চিৎকার চাঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। একদল বললে, হিন্দু কন্যাকে ম্লেচ্ছ ছুঁয়েছে বলে মেয়েটির জাত গেছে। কেউ কেউ এমন কথাও বললে যে ইংরেজের সম্পর্শে মেয়েটির শ্ৰীলতা হানি হয়েছে। সাহেবটি অপ্ৰস্তুতের একশেষ। শেষ পর্যন্ত ব্যাপার এমন দাঁড়ালো যে স্কুলটি উঠে যাবারই উপক্রম। স্কুলের শিক্ষকদের ধোপা নাপিত বন্ধ হলো, এমনকি স্থানীয় জমিদার ডাকাত লেলিয়ে তাঁদের প্রাণে মারবারও চেষ্টা করলেন।
শহরের পত্র-পত্রিকায় এই বিষয় নিয়ে বাদানুবাদ চললো বেশ কয়েকদিন। পথে-ঘাটেও লোকের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা। হিন্দু সমাজের এবম্বিধ ছুৎমার্গের নিন্দে করলে অনেকে, আবার সাহেবদের সংস্পর্শ থেকে বালক-বালিকাদের সম্পূর্ণ দূরে রাখারও পক্ষে কম লোক নেই।
এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশী মনে আঘাত পেলেন জন বীট্ন। এ দেশের মানুষের মন যদি এতখানি সংস্কারাচ্ছন্ন হয়, তাহলে এ দেশে বিদ্যার প্রসার হবে কিরূপে। সরকারী মহলেও বিরূপ প্ৰতিক্রিয়া দেখা দিল। এ দেশের লোকদের ইংরেজি শেখাবার জন্য সরকার ক্রমশই বেশী উদ্যোগ নিচ্ছিল বটে, কিন্তু উচ্চ শ্রেণীর রাজকর্মচারীদের মত হলো এই যে স্ত্রী-শিক্ষার ব্যাপারে তাঁদের মাথা গলাবার দরকার নেই। এ দেশীয়দের সঙ্গে ব্যবহারে সরকার সব সময় সতর্ক থাকতে চান। মিশনারিদেরও খানিকটা নিরস্ত করা দরকার। ভারতীয়রা অর্থনৈতিক ক্ষতির ব্যাপারটা বোঝে না। শুধু ধর্মে হস্তক্ষেপ করলেই তারা ক্ষেপে ওঠে।
ডেভিড হেয়ারের স্মৃতিসভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন জন বীট্ন। ডেভিড হেয়ার মারা গেছেন ছ বছর আগে, তবু প্রত্যেক বছর তাঁর মৃত্যুদিনে শিক্ষিত হিন্দুরা সভার আয়োজন করে তাঁকে স্মরণ করে। বক্তৃত হয় ইংরেজি ও বাংলায়। বীট্ন বিস্মিত হয়ে দেখলেন, কোনো কোনো বক্তা হেয়ার সাহেবের কীর্তির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে অশুপাত করে। এ জাতি সত্যিই বড় বিচিত্র। এক সাহেবের সম্পর্শে এদের জাতি নষ্ট হয়। আবার আর এক সাহেবের কথা মনে করে কাঁদে।
সেই সভাতেই কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালীর সঙ্গে পরিচয় হল বীট্নের। তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে তিনি খুশী হলেন, তাঁরা যথেষ্ট শিক্ষিত এবং উদার মনের মানুষ। আরও কয়েকটি সভাসমিতিতে দেখা হলো ঐদের সঙ্গে। ভারতীয়দের মধ্যে এঁরা অগ্রণী শ্রেণীর। পরে বীট্ন খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন যে ঐরাই এককালের ইয়ং বেঙ্গল নামে খ্যাত যুব সম্প্রদায়, ডিরোজিও নামে এক অকালমৃত ফিরিঙ্গি যুবক ছিলেন এঁদের শিক্ষাগুরু। এ দেশীয়দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষায় এরাই সবচেয়ে বেশী কৃতবিদ্য। তিনি আরও শুনলেন যে এঁদের মধ্যে যাঁর নাম রামগোপাল ঘোষ, তাঁর বাড়িতে প্রায়ই এঁরা একত্রিত হয়ে নানারকম উচ্চাঙ্গের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
বীট্ন রামগোপাল ঘোষকে আমন্ত্রণ জানালেন যেন তিনি এক সন্ধ্যাবেলা বন্ধুবান্ধবসহ তাঁর বাড়িতে চা পান করতে আসেন। রামগোপাল ঘোষ এলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সুহৃদ দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় এবং আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে। এদের মধ্যে একজন ব্যতীত আর সকলেই সাহেবী পরিচ্ছদে ভূষিত। যিনি ব্যতিক্রম, তিনি পরিধান করে আছেন ধুতি ও ফতুয়া, মাথায় মস্তবড় টিকি। ইনি বিদ্যাসাগরের বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার।
মদনমোহনের সঙ্গে রামগোপালের পরিচয় হয়েছে কয়েক বছর আগে। এই পরিচয় বন্ধুত্বে পরিণত হওয়ায় একটি বিরাট সুফল ফলেছে। ইয়ং বেঙ্গলের দল ইংরেজি শিক্ষার ফলে গোড়ার দিকে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে শুধু ইওরোপীয় সংস্কৃতি অনুকরণ করতেন। তাঁরা মনে করতেন, এ দেশের সব কিছুই কু-সংস্কারে ভরা। মদনমোহনের মাধ্যমে তাঁদের সেই ভুল আস্তে আস্তে ভাঙলো, তাঁরা সন্ধান পেলেন সংস্কৃত সাহিত্যের বিরাট ঐশ্বর্যের, তাঁরা বুঝলেন মাতৃভাষা বাংলার প্রয়োজনীয়তা। মদনমোহনের বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আলাপ হবার পর তাঁরা টের পেলেন, সংস্কৃত পণ্ডিতদের মধ্যে এমন মুক্ত মনের মানুষ থাকতে পারে। এর ফলে পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানের সঙ্গে মিলন হলো ভারতীয় সংস্কৃতির, মানবপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত হলো দেশপ্ৰেম।
বীট্ন খাতির করে বসালেন রামগোপাল ও তাঁর বন্ধুদের। দু-একবার শুধু তিনি ঈষৎ সংশয়পূর্ণ নয়নে তাকালেন মদনমোহনের দিকে। তিনি শুনেছিলেন ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতরা অপরের ছোঁয়া কিছু খায় না। তাহলে এই ব্ৰাহ্মণকে কি কিছু জলখাবার খাওয়ার অনুরোধ জানানো সঙ্গত হবে? ইনি অপমান বোধ করবেন না তো?
চতুর মদনমোহন বীট্নের সংশয় বুঝতে পেরে নিজেই সহাস্যে বলে উঠলেন, মহাশয়, আমি গো-মাংস ভক্ষণ করি না, কিন্তু চায়ের স্বাদে খুব তৃপ্তি পাই। এবং ইহাও জানি, গো-মাংস ভক্ষণকারীরাই অতি উত্তম চা প্ৰস্তুত করেন।
বীট্ন বাংলা জানেন না, সুতরাং কথাবার্তা চলতে লাগল। ইংরেজিতেই। মদনমোহনও বেশ ইংরেজি জানেন, মাঝে মাঝে দু-একটি শব্দে আটকে যান, তখন বাংলায়, ইংরেজি প্রতিশব্দটি জেনে নেন রামগোপালের কাছ থেকে।
মদনমোহন সুরসিক, হাস্যরঙ্গ ছাড়া কথা বলতে জানেন না, সেজন্য অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই আড়ষ্টতা কেটে গেল। বীট্ন অতি উচ্চ রাজকর্মচারী হলেও তাঁর ব্যবহারে সেরকম কোনো ভাব নেই।
প্রথমে কথা চলছিল আবহাওয়া নিয়ে। বার্তাসে এখন অতি উৎকট তাপ, দুজন পাঙ্খাপুলার ঘরে ঝোলানো বিশাল পাখাঁটি টানছে, তবু গরম কমে না। রামগোপাল বললেন, ইংলণ্ডে এখন বসন্তকাল। বার্তাস অতি স্নিগ্ধ। আমাদের এদেশে গ্ৰীষ্ম ও শীতের মধ্যে আর, কোনো ঋতু নাই। মহাশয়ের এ দেশের আবহাওয়ায় কষ্ট হইতেছে না?
বীট্ন বললেন, তেমন কষ্ট কই? আপনাদের দেশে ঘন ঘন বৃষ্টি নামে। আমি বৃষ্টি বড় ভালোবাসি। বৃষ্টিপাত শুরু হইলেই গবাক্ষে দাঁড়াইয়া বাহিরে দেখি। এত তীব্র ধারাবর্ষণ ইংলণ্ডে নাই। মদনমোহন বললেন, শুধু বৃষ্টি দেখার সুফল নাই। বৃষ্টির সময় নগ্ন গাত্রে বাহিরে দাঁড়াইবেন। তাহাতে ঘামচি মরিবে!
বীট্ন হেসে উঠে বললেন, হাঁ, ঘামচিতে কিছু কষ্ট পাইতেছি বটে, ঘামাচির এই প্রকার ঔষধের কথা তো আমার জানা ছিল না। মহাশয়কে ধন্যবাদ!
দক্ষিণারঞ্জন জিজ্ঞেস করলেন, যতদূর জানি, মহাশয় আগে সরকারী কর্ম করিতেন না। এখন এই পরিণত বয়েসে হঠাৎ সরকারী কর্ম লইলেন কেন?
বীট্ন বললেন, কারণ ভারতবর্ষে আসিবার আগ্রহ ছিল আমার।
দক্ষিণারঞ্জন বললেন, সেইরকমই অনুমান করিয়াছিলাম। এই আগ্রহের বিশেষ কানো কারণ আছে কি?
তখন বীট্ন জানালেন যে, সতীদাহের এক মামলার ব্যাপারে তাঁর প্রথম ভারত সম্পর্কে আগ্ৰহ জাগাবার কথা। তারপর থেকেই তিনি এ দেশ সম্পর্কে অনেক পড়াশুনো করেছেন। কথায় কথায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সতীদাহ প্ৰথা এ দেশ থেকে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গেছে কি না।
রামগোপাল জানালেন যে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গেছে, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। দূর গ্রামাঞ্চলে এখনো এরকম কিছু কিছু ঘটতে পারে। এমন কি এই শহরেও—। তারপর তিনি কিছুদিন আগে তাঁর বাড়ির সামনের সেই ঘটনাটি সবিস্তারে জানালেন। খুব সম্ভবত মেয়েটি সেইদিন তার স্বামীর চিতায় পুড়ে মরতেই যাচ্ছিল। মেয়েটি এখনো রামগোপাল ঘোষের বাড়িতেই আছে। এখনও সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি, মাঝে মাঝেই আত্মঘাতিনী হবার চেষ্টা করে।
দক্ষিণারঞ্জন বললেন, ইহাই আশ্চর্যের কথা, অনেক বালিকা স্বেচ্ছায় মরিতে চায়। কেহ তাহাদের উপর জোর করে না।
মদনমোহন বললেন, জোর নিশ্চয়ই করে। জোর করে এই সমাজ। অসহায় বিধবা বালিকা কোন ভরসায়, কাহার ভরসায় বাঁচিবে?
রামগোপাল বললেন, অশিক্ষাই ইহার জন্য দায়ী। বালিকারা যদি কিছু শিক্ষা পাইত, তাহা হইলে নিজের জীবনের মর্ম বুঝিত। মহাশয়কে একটি প্রশ্ন করিতে পারি কি? আপনি সরকারের শিক্ষা বিভাগের অধিকতা, এ দেশে বালিকাদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা হইতে পারে না?
বীট্ন হেসে উঠে বললেন, বালিকাদের জন্য শিক্ষা? এ দেশের মানুষ তাহা চায় না। আপনি বারাসতের ঘটনা শ্রবণ করেন নাই?
রামগোপাল বললেন, ওরকম দু-একটি ঘটনাতেই পশ্চাদপদ হইলে চলিবে কেন? আপনার গৃহে আসিবার পূর্বেই আমি এ বিষয়ে চিন্তা করিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম। আপনার নিকট এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করিব। স্ত্রী শিক্ষার জন্য আমরা কিছু করিতে পারি না?
বীট্ন বললেন, এ দেশে আসিবার আগে হইতেই আমি স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ে চিন্তা করিতেছি। বালিকা স্কুল খোলা আমারও উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এখন দেখিয়া শুনিয়া বুঝিতেছি, এ দেশে তাহা সম্ভব নহে।
মদনমোহন বললেন, মহাশয়, এত অল্প সময়েই নিরাশ হইলেন কী প্রকারে?
বীট্ন বললেন, বুঝাইয়া বলিতেছি। আমি সরকারের শিক্ষা বিভাগের প্রধান। কিন্তু আমি ইচ্ছা! করিলেই যাহা খুশি করিতে পারি না। অৰ্থ বরাদের জন্য আমাকেও অন্যদের অনুমতি লইতে হয়। আমি দেখিলাম যে স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ে ব্যবস্থা করিবার কোনো আগ্রহ সরকারের নাই। বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট হবাহাউস আমার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন। তখনও আমি জেদ ধরিয়াছিলাম; প্রয়োজন হইলে নিজ জেব হইতে অর্থব্যয় করিয়া স্কুল খুলিব। আমি দীর পরিগ্রহ করি নাই, আমার নিজের সংসার নাই, যদি নারীজাতির সেবার জন্য কিছু করিয়া যাইতে পারি, তাহা হইলে আমার জীবন ধন্য হইবে। কিন্তু বারাসতের ঘটনায় বুঝিলাম, এ দেশের মানুষই স্ত্রী-শিক্ষা চায় না। দক্ষিণারঞ্জন লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, আপনি যদি রাজী থাকেন, আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আমরা আপনাকে সর্বাঙ্গীন সাহায্য করিব।
রামগোপাল দক্ষিণারঞ্জনের মতন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়েন না। তিনি ধীর স্বরে বললেন, আমরা এ ব্যাপারে। আপনার মতন সমান আগ্ৰহী। অবশ্য আপনি ভাবিতে পারেন, আমরা নিজেরাই উদ্যোগী হইয়া স্কুল খুলিতেছি না কেন? আমরা জানি, বহু লোক আমাদের প্রতিবন্ধকতা করিবে। বলপ্রয়োগেরও চেষ্টা করিতে পারে। বালিকাদের কোনো প্রকার বিপদে জড়াইবার ঝুঁকি নিতে আমরা পারি না। তবে এ দেশের মানুষ রাজশক্তিকে খুব ভয় পায়। সরকার সাহায্য করুক বা না করুক, আপনি ব্যক্তিগতভাবে যদি অগ্রণী হইয়া কোনো স্কুল খুলেন, তাহা হইলেও লোকে আপনাকে সরকারের প্রতিনিধি মনে করিয়া ডরাইবে। আপনার পশ্চাতে থাকিয়া আমরা আপনাকে সর্বপ্রকার সাহায্য করিব।
মদনমোহন বললেন, স্কুল খুলিলে তাঁহাতে ছাত্রী সংগ্রহের ভর আমার উপর ছাড়িয়া দিতে পারেন। ভুবনমালা ও কুন্দমালা নামে আমার দুইটি কন্যাসন্তান আছে, তাহারাই প্রথম দুই ছাত্রী হইবে। আপনি কোনো সচ্চরিত্র বিবিকে শিক্ষয়িত্রী নিয়োগ করিবেন।
বীট্ন সবিস্ময়ে বললেন, আপনি ব্ৰাহ্মণ–আপনার কন্যারা বাড়ির বাহিরে আসিয়া পাঠশালায় যাইবে? সমাজে আপনি পতিত হইবেন না?
মদনমোহন বললেন, কেন পতিত হইব? ব্রাহ্মণ কন্যাদের বিদ্যার্জন তো নতুন কিছু না। চিরকালই করিতেছে। দুই চারিটি উল্লুক না হয় নিষ্ঠীবন নিক্ষেপ করিবে, তা করুক।
বীট্ন জিজ্ঞেস করলেন, ঐ শিক্ষার চল আপনাদের মধ্যে আগেও ছিল বলিতেছেন? আমি কখনো শুনি নাই।
মদনমোহন বললেন, আপনাকে কয়েকটি উদাহরণ দিতেছি। পুরাকালে নারীরা পুরুষের সমান শিক্ষিতা ছিল, কয়েকজন বেদের সূক্তও রচনা করিয়াছে। মহর্ষি বাল্মীকির শিষ্যা আত্ৰেয়ী অগস্ত্য ঋষির আশ্রমে পাঠ গ্ৰহণ করিতে যাইতেন। ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য গাগী ও মৈত্ৰেয়ীকে ব্ৰহ্মবিদ্যা শিক্ষা দিয়াছিলেন। বিদর্ভ রাজার কন্যা রুক্সিনী নিজে পত্র লিখিয়া কৃষ্ণের নিকট পাঠাইয়াছিলেন, এ কথা মহাভারতে আছে। উদয়নাচার্যের কন্যা লীলাবতী কতখানি জ্ঞানবতী ছিলেন দেখুন যে তিনি শঙ্করাচার্য ও মণ্ডন মিশ্রের তর্ক-বিচারে মধ্যস্থতা করিয়াছিলেন। কর্ণাটের রাজমহিষী এবং কবি কালিদাসের পত্নী ছিলেন পণ্ডিতা। বিশ্বদেবী নামে এক নারী গঙ্গাবাক্যাবলী নামে একটি গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন। খনা নামী এক নারী জ্যোতিষশাস্ত্র এমন উত্তম জানিতেন যে, এখনও লোকে খনার বচন মান্য করে। আর কত উদাহরণ দিব? এত প্ৰাচীনকালেই বা যাইবার প্রয়োজন কী? হটী বিদ্যালঙ্কার নামে এক প্ৰসিদ্ধা রমণী বারাণসীতে টোল খুলিয়া বসিয়া এক্ষণে রীতিমতন ছাত্রদের শিক্ষা দিতেছেন। তাঁহার কথা কে না না জানে?
বীট্ন বললেন, এ সব কথা আপনার জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করিতেছেন না কেন?
মদনমোহন বললেন, করিব, নিশ্চয়ই করিব। বালিকাদের শিক্ষার উপযুক্ত বহি আমি নিজে রচনা করিব।
দক্ষিণারঞ্জন বললেন, যদি শীঘ্ৰ কাৰ্য শুরু করিতে চান, তাহা হইলে বিদ্যালয়ের ভবন আমি নিজে দিতে প্ৰস্তুত আছি। মীর্জাপুরে আমার একটি বৈঠকখানা বাটী খালি রহিয়াছে, সেখানেই স্কুল বসিতে পারে।
বীট্ন বললেন, আজই চলুন না। শুভস্য শীঘ্রম।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বীট্ন এবং দক্ষিণারঞ্জনের জুড়িগাড়ি ছুটে চললো মীর্জাপুর—বাহির সিমুলিয়ার দিকে।
দক্ষিণারঞ্জনের বৈঠকখানা বাটটি সত্যিই দেখবার মতন। বড় বড় খিলান ও দালান সমন্বিত প্ৰাচীন ঠাটের একটি সুরম্য গৃহ, তার বাইরে চতুর্দিকে বাগান। বাগানে নানাবিধ ফলবান মূল্যবান বৃক্ষ। সেই উদ্যানটি আবার উচ্চ প্ৰাচীরে বেষ্টিত। একটি মাত্র প্রবেশদ্বার। বাগানটি আরও প্রশস্ত করবার মানসে দক্ষিণারঞ্জন সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী সাড়ে পাঁচ বিঘা। ভূমি নয় সহস্র টাকা মূল্যে ক্রয় করেছেন।
বাড়িটি দেখে সকলেরই পছন্দ হলো। সে রকম একটি বাড়ি ভাড়া দিলে কিছু না হোক মাসে একশত টাকা পাওয়া যায়, তবু দক্ষিণারঞ্জন শুধু ফেলে রেখেছিলেন। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এখানে অবসর যাপনের জন্য আসতেন, এখন এক কথায় বাড়ি ও সংলগ্ন জমি দান করে দিতে চাইলেন। মদনমোহন সন্তোষ প্রকাশ করে দক্ষিণারঞ্জনকে বললেন, দ্বারের কাছে মিষ্টিধারী দুটি দ্বারবান বসিয়ে দিলেই আর কুমতলবীরা কেউ ভিতরে ঢুকতে পারবে না। আর ইস্কুল পরিচালনার জন্য আমার বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্ৰকে দলে টানতে চাই, ও-রকম একজন কড়া-ধাতুর মানুষ দরকার।
সিদ্ধান্ত হলো, এই প্রশস্ত সুন্দর ভবনটিতেই স্কুল বসবে। অনেক কথা ঠিক হয়ে গেল সেখানেই। প্রশ্ন উঠলো, স্কুলের নাম কী হবে? রামগোপাল বললেন, ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল বা কলিকাতা বালিকা বিদ্যালয়ই তো খুব সহজ ও সঙ্গত নাম।
বীট্ন বললেন, যদি ইংলণ্ডের রানীর নামে স্কুলের নাম রাখা যায়, তাহা হইলে হয়তো ভবিষ্যতে সরকারী সাহায্য মিলিতে পারে।
মদনমোহন বললেন, বিকটরিয়া বালিকা বিদ্যালয়, ইহা তো অতি উত্তম নাম। স্ত্রী বিদ্যালয়ের সহিত এ জগতের সবাপেক্ষা শক্তিশালিনী রমণীর নাম যুক্ত রহিল।
বীট্ন বললেন, আমার ভগিনীর সহিত কুইন ভিকটোরিয়ার পরিচয় আছে। তাহাকে আমি লিখিতে পারি, বোধ করি সে রানীর সম্মতি আদায় করিতে সক্ষম হইবে।
নামের প্রশ্নটি তখনকার মত অমীমাংসিত থাকলেও স্কুল খোলা বিষয়ে কোনো দ্বিমত রইলো না।
অল্পকালের মধ্যেই এক সোমবারে স্কুল শুরু হয়ে গেল। মদনমোহন তাঁর দুই কন্যাকে স্কুল ভবনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দ্বারের পাশে। হাওয়ায় ফরফর করে উড়তে লাগলো তাঁর দীর্ঘ শিখাগুচ্ছ, মুখে অনাবিল হাসি। স্কুল ভবনের সামনের উদ্যানে দাঁড়িয়ে শ্ৰীমতী রিডসডেল নামে এক উচ্চশিক্ষিতা মেম সাদরে ডেকে নিতে লাগলেন বালিকাদের।
প্রথম দিন স্কুলে এলো একুশটি বালিকা। কিন্তু ক্রমশই ছাত্রী সংখ্যা কমতে লাগলো। বালিকাদের কোনো বেতন লাগে না, পুস্তক ও কাগজপত্রও দেওয়া হয় স্কুল থেকে। এমনকি যে সব বালিকার বাড়ি থেকে যাতায়াতের অসুবিধা আছে, স্কুল থেকে তাদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। তবু কয়েক মাসের মধ্যেই ছাত্রীসংখ্যা কমতে কমতে দাঁড়ালো সাতে।
ইতিমধ্যে শহরের কিছু মানুষ ও কয়েকটি পত্র-পত্রিকা এই উদ্যমকে স্বাগত জানালেও বহু লোক আর বহু পত্রিকা নিন্দা-মন্দ ও কুৎসা রটনায় উঠে পড়ে লাগলো। এই বিদ্যালয়ে যায় নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য বালিকারা, তবু তাদের নিয়েই আদিরসের রসিকতা চললো অঢেল। এক পত্রিকার বৃদ্ধ সম্পাদক লিখলেন, বাঘ ও ছাগলের মধ্যে যেমন শুধু খাদ্য ও খাদকের সম্বন্ধ, পুরুষ ও নারীর মধ্যেও তাই।
বীট্ন, দক্ষিণারঞ্জন প্রমুখ কিন্তু এতেও দমলেন না। স্কুল তাঁরা চালাবেনই। সাতজন ছাত্রী, তার জন্য মাসে প্রায় আটশো টাকা খরচ। বীট্ন মনে মনে কল্পনা করে রেখেছেন একদিন এই স্কুল বিশাল হবে, শত শত বালিকা এখানে পড়তে আসবে, তখন আরও বড় ভবনের প্রয়োজন হবে, সেই উদ্দেশ্যে তিনি ইতিমধ্যে কাছাকাছি আরও অনেক জমি কিনে ফেলেছেন। কিন্তু ছাত্রীসংখ্যা প্ৰতিনিয়ত কমতে থাকায় তাঁর কল্পনা বুঝি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শুভার্থীরা বললেন, অপপ্রচারের ফলাফল যাই হোক, ছাত্রীসংখ্যা হ্রাসের আর একটি কারণ আছে, মীর্জাপুর হলো শহরের এক প্রান্তে, অত দূরে অভিভাবকরা তাঁদের কন্যাদের পাঠাতে ভয় পান। স্কুলটি হওয়া উচিত শহরের মধ্যস্থলে।
বীট্ন এ পরামর্শের যুক্তি স্বীকার করে বললেন যে, তবে তাই হোক, শহরের কেন্দ্ৰেই গড়ে উঠবে। নতুন বিদ্যালয় গৃহ। হেদুয়ার পশ্চিম পার্থে অনেকখানি জমি খালি পড়ে আছে, বর্তমানে তা আগাছায় পূর্ণ। কিন্তু সে জমির মালিক সরকার। বীট্ন সরকারের কাছে প্রস্তাব দিলেন যে মীর্জাপুরের সমুদয় জমি ও অট্টালিকাটির বিনিময়ে সরকার তাঁদের ঐ হেদুয়ার জমি হস্তান্তর করুন। সরকার এতে আপত্তি করলেন না। বীট্ন নিজে যেন সরকারের লোক নন, তিনি এক্ষেত্রে দেশীয় সমাজের প্রতিনিধি।
বৎসর দেড়েকের মধ্যেই একদিন তিনি মহা সমারোহে নতুন বিদ্যালয় ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করালেন। ফ্রি মেশনরা এলো সমারোহ করে। ডেপুটি গভর্নরের পত্নী লেডি লিটলারের হস্ত দিয়ে রোপণ করানো হলো একটি অশোক বৃক্ষের চারা। বীট্ন তাঁর ভাষণে বললেন যে, এই বৃক্ষ হোক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য সংস্কৃতির মিলনের প্রতীক। আমি শুনেছি, বাংলায় অশোক কথাটির অর্থ আনন্দ-বনস্পতি। এই বৃক্ষটি শুধু দেখতে সুন্দর নয়, এর সঙ্গে অনেক শুভ ইচ্ছা মিশ্রিত হয়ে আছে। আমি এ কথাও শুনেছি যে প্রাচীন কালে ভারতীয় রমণীরা এই বৃক্ষের কোমল কোরক চিবিয়ে খেতেন তাঁদের সন্তানদের কল্যাণ কামনায়। আরও সুখের কথা এই যে, ইওরোপীয় প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা এই অশোক বৃক্ষের নাম রেখেছেন জেনেসিয়া অশোকা, এই নামের মধ্য দিয়ে তাঁরা স্যার উইলিয়াম জোনসের স্মৃতিকে অমর করেছেন। সেই মহাত্মা উইলিয়াম জোনস এ দেশে তাঁর জীবন ব্যয় করেছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য জগতের জ্ঞানের সম্মিলনের জন্য। এই বৃক্ষকে কেন্দ্র করে দূর-দূরান্তে সেই জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ুক।
নতুন ভবন নির্মাণ করতে ব্যয় হবে প্রায় চুরাশি হাজার টাকা, এর মধ্যে পূর্বের বাড়ি ও জমি ছাড়াও দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় দান করলেন আরও কয়েক হাজার টাকা। উত্তরপাড়ার বিদ্যোৎসাহী রাজা জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এগিয়ে এলেন সাহায্যের জন্য, বর্ধমানের মহারাজা এক সহস্র মুদ্রা দিয়ে নিয়মরক্ষা করলেন। একা বীট্নই নিজের সঞ্চয় থেকে ব্যয় করলেন চল্লিশ সহস্ৰ মুদ্রার বেশী। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য, ভবনটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাপ্ত করা। তিনি স্বয়ং এসে প্রায়ই দেখে যান, কাজ কতখানি অগ্রসর হলো। আবার অল্পসংখ্যক ছাত্রী নিয়ে মীর্জাপুরে যে স্কুলটি টিমটিম করে চলছে, সেখানেও তিনি নিয়মিত যান। তাদের উৎসাহ দিতে।
একদিন তিনি মীর্জাপুরের বিদ্যালয়ে এলেন ঈষৎ বিষণ্ণ বদনে। তিনি নেটিভদের ব্যাপারে এতখানি উৎসাহী হয়ে পড়েছেন, সর্বক্ষণ নেটিভদের সঙ্গে মেলামেশা করেন বলে তাঁর সহযোগী কোনো কোনো রাজপুরুষ তাঁকে বিদ্রুপ করতে শুরু করেছেন। শুধু এই একটি স্কুল স্থাপন করেই ক্ষান্ত হননি বীট্ন। তিনি আরও স্কুল খুলতে উদ্যোগী হয়েছেন। বাংলাভাষার উন্নতির জন্যও তিনি চিন্তা করছেন অনেকখানি। মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া সুচারুভাবে শিক্ষা হতে পারে না। অথচ বাংলাভাষায় উত্তম গ্ৰন্থ নেই, সেজন্য তিনি স্থাপন করেছেন বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ইংরেজি থেকে বই অনুবাদ করবেন বাংলাভাষায়। যার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়, তাকেই তিনি বলেন, বাংলায় বই লিখুন, বাংলাভাষাকে উন্নত করুন। নারীগণের শিক্ষার জন্য আপনারাও কিছু করুন। বাংলা সাহিত্যের পরীক্ষায় সবোৎকৃষ্ট ছাত্রের জন্য তিনি একটি সোনার মেডেলও ঘোষণা করেছেন।
স্কুলের জন্য মহারানী ভিকটোরিয়ার নামটি পাওয়া যায়নি। শুধু বিদ্রুপ নয়, সেদিন তাঁর প্রতিযোগী এক রাজপুরুষ–তাঁকে ভর্ৎসনাও করেছেন খানিকটা। এ দেশের সরকারকে কিছু না জানিয়ে তিনি সরাসরি ভিকটোরিয়ার এক পার্শ্বচরীর মারফত মহারানীকে এই স্কুলের কথা যে জানাবার চেষ্টা করেছিলেন, তা সঙ্গত হয়নি। সুতরাং স্কুলের নাম ক্যালকাটা ফিমেল স্কুলই থাকবে। ক্ষুব্ধ হয়ে বীট্ন এই স্কুল ও অন্যান্য মফঃস্বল স্কুলের সব বৃত্তান্ত জানিয়ে বড়লাট লর্ড ডালহৌসির কাছে এক দীর্ঘ পত্র পাঠিয়েছেন। তবু তাঁর মনের বিষণ্ণত কাটেনি।
স্কুলের উদ্যানে তিনি দেখলেন একটি বালিকা বাড়ি যাবার নাম করে কাঁদছে। বীট্ন কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কাঁদিতেছ। কেন, মা?
বালিকাটি তাঁর কথা বুঝতে পারলো না, কিন্তু চুপ করে গেল। বীট্নের সৌম্য মুখমণ্ডল দেখে তাঁকে ছাত্রীরা কেউ ভয় পায় না। তিনি মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে মিঠাই বিতরণ করেন। বালিকারা কাড়াকাড়ি করে খায়।
বীট্ন কাছে এসে বালিকাটির চিবুক স্পর্শ করে বললেন, মা, তুমি রানী হইবে?
মেয়েটি তখনো বুঝলো না। প্যান্ট-কেটধারী বীট্ন অমনি ধুলোর মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ে বললেন, এই দ্যাখো আমি ঘোড়া হইয়াছি। তুমি আমার পৃষ্ঠে চড়িয়া রানীর মতন আমাকে হাঁকাও।
মেহের একটা বিশ্বজনীন ভাষা আছে, যা সব শিশুরাই বোঝে। মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলে বীট্নের পিঠে চড়ে বসে বললো, বেথুন ঘোড়া, হ্যাট হ্যাট।
দুই কন্যাকে নিয়ে যাবার জন্য এসেছিলেন মদনমোহন। দ্বারের কাছ থেকে এই দৃশ্য দেখে তাঁর চোখে জল এসে গেল। একটু পরে বীট্ন খেলা সমাপ্ত করার পর তিনি বললেন, মহাশয়, আপনার তুলনায় আমরা অতি নগণ্য মানুষ!
বীট্ন লজ্জা পেয়ে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি ছাত্রী সংগ্ৰহ করিবেন বলিয়াছিলেন, সে কাজ যথেষ্ট করিতেছেন কই? আমার আরও ছাত্রী চাই।
হেদুয়ায় স্কুল ভবনটি প্রায় সমাপ্ত হয়ে এসেছে, আর এক মাসের মধ্যেই এর দ্বারোদঘাটন করা যাবে। বীট্ন ভেতরে ভেতরে যেন উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠছেন। সেই শুভ দিনটিতে তিনি কী প্রকার বিশাল উৎসবের আয়োজন করবেন, মনে মনে সেই পরিকল্পনার অন্ত নেই।
ইতিমধ্যে তিনি একদিন গেলেন জনাইতে একটি স্কুল পরিদর্শন করতে। ফেরার পথে সাংঘাতিক বৃষ্টি শুরু হলো। সে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চলাই দুষ্কর। কিন্তু বীট্নের মন পড়ে আছে কলকাতায়, তিনি বৃষ্টিতে ভিজে, সেই জলকাদা ভেঙেই ফিরলেন।
এবং ফিরেই জ্বরে পড়লেন। তিনদিনের মধ্যেই বোঝা গেল তাঁর এই রোগ কালব্যাধি।
পুরো একদিন অচেতন থাকার পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তিনি দেখলেন, তাঁর শিয়রের কাছে দেশী ও ইওরোপীয় শুভানুধ্যায়ীরা সার বেঁধে দণ্ডায়মান রয়েছেন। বীট্ন প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, স্কুল ভবনে রঙের কাজ সম্পূর্ণ হইয়াছে তো?
কয়েকজনের চক্ষে জল এসে গেল। একজন অতিকষ্টে বললেন, রঙ অতি মনোহর হইয়াছে। মহাশয়, আপনি সারিয়া উঠিয়া সব স্বচক্ষে দেখিবেন।
বীট্ন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর শান্ত স্বরে তাঁর ভারতীয় বন্ধুদের উদ্দেশে বললেন, আমরা ইংরেজরা মৃত্যুকে ভয় পাই না। আপনাদের মতন আমাদের পরলোকেও বিশ্বাস নাই। জানি, শেষ নিশ্বাসের সাথে সাথেই সব কিছুর শেষ। শুধু দুই একটি বাসনা অপূর্ণ রহিয়া গেল এই যা দুঃখ। আপনাদের নিকট অনুরোধ, দেখিবেন, আমার অবর্তমানে যেন স্কুলটি না মরে।
তারপর তিনি একজন আইনজীবীকে মুখে মুখে তাঁর উইল বলে গেলেন। তাঁর যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সবই তিনি রেখে গেলেন স্কুলটির জন্য। যে জুড়িগাড়িটিতে তিনি নিজে চড়িতেন, সেটি প্ৰত্যহ দাঁড়িয়ে থাকবে বিদ্যালয়ের সামনে। বালিকারা এটিতে করে যাতায়াত করবে।
বীট্নের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই হেদুয়ার পার্শ্বে নবনির্মিত বালিকা বিদ্যালয়টির নামকরণের সমস্যা। আর রইলো না। বেথুন সাহেবের স্কুল সকলের মুখে মুখে রটে গেল এই নাম।