৩৪. বকুলের ছোড়দা বলে উঠলো

বকুল এ ঘরে আসতেই বকুলের ছোড়দা বলে উঠলো, ও বাড়ির বড়দা কেন এসেছিলেন রে?

বকুল অবাক হয়ে বলে, ওমা তুমি বাড়িতে ছিলে? তবে যে দেখা করলে না?

দূর, ছেড়ে দে! ওসব দেখাটেখা করার মধ্যে আমি নেই! বলেই ছোড়দা হঠাৎ মুখটা ফেরায়, ধরা গলায় বলে, লোকের কাছে দেখাবার মত মুখ কি আর আমার আছে বকুল?

বকুল হেসে উঠে বলে, অন্ততঃ ওঁর কাছে ছিল। ওঁর মতে, এ যুগে নিন্দের বলে কিছু নেই।

তারপর বড়দার আসার উদ্দেশ্য সংক্ষেপে বর্ণনা করে।

ছোড়দা একটুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বলে, অথচ মনে হতো ওই বাড়িটা অচলায়তন। মুক্তকেশী দেবীর অস্থি পোঁতা আছে ও ভিটেয়।

থাকলে সেই পোঁতা অস্থিতে অবশই শিহরণ লাগছে।

আর আমরা কত নিন্দিত হয়েছি। আমাদের মা ওদের মত নয় বলে কত লাঞ্ছনা গেছে। তার উপর দিয়ে!

বকুল আস্তে বলে, আজও যাচ্ছে ছোড়দা। যারা একটু অন্যরকম হয়, তাদের ওপর দিয়ে লাঞ্ছনার ঝড় বয়েই থাকে। পরবর্তীকালে তোমার বংশধরেরাই হয়তো তোমাকে মুক্তকেশী দেবীর যোগ্য উত্তরসাধক বলে চিহ্নিত করবে।

ছোড়দা একটু চুপ করে থেকে বলে, আমি নিজের ভুল সংশোধন করতে চেয়েছিলাম বকুল, সুযোগ পেলাম কই?

সত্যি চেয়েছিলে?

ছোড়দার চোখ দুটো লাল হয়ে ওঠে। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে, তোদের ছোটবৌদির কষ্ট আর চোখে দেখতে পারা যাচ্ছে না।

শুধু ছোটবোদির?

আমার কথা থাক্ বকুল।

কিন্তু এ সমস্যার সমাধান তো তোমাদের নিজেদের হাতে ছোড়দা।

সে কথা তো অহরহই ভাবছি, কিন্তু ভয় হয় যদি আমাদের ডাককে অগ্রাহ্য করে! যদি ফিরিয়ে দেয়!

বকুল মৃদু হেসে বলে, ওখানেই ভুল করছো ছোড়দা। তুমি যদি বলো, তুই আমায় কিছুতেই ফিরিয়ে দিতে পারবি না। আমিই তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো, যাবোই। দেখ কি হয়! কিন্তু মনে জেনো–ওর ভালবাসাকে অমর্যাদা করে নয়। ও যাকে জীবনে নির্বাচন করে নিয়েছে, তোমাদের কাছে হয়তো তার অযোগ্যতার শেষ নেই, কিন্তু যোগ্যতা অযোগ্যতা কি বাইরে থেকে বিচার করা যায় ছোড়দা?

ওঁর ঠিকানাটা তো তোরই হাতে।

তোমার হাতেও চলে যেতে পারে ছোড়দা, যদি তুমি সত্যিকার ক্ষমার হাতটা বাড়িয়ে দিতে পারো ওর দিকে।

ছোটবৌদি এসে দাঁড়াল।

বলল, ও-বাড়ির নির্মলের বৌ তোমায় ডেকেছে বকুল।

বকুল চকিত হয়।

আশ্চর্য, এখনো বকুল ‘নির্মল’ নামটা শুনলেই চকিত হয়! জগতে অনেক রহস্যের মধ্যে এ এক অদ্ভুত রহস্য, অনেক আশ্চর্যের মধ্যে এ এক পরম আশ্চর্য।

অবশ্য বকুলের এই গভীরে তলিয়ে থাকা চেতনায় চকিত হওয়া বাইরের জগতে ধরা। পড়ে না। বকুল সহজ ভাবে বলে, কেন ডেকেছে জানো?

ঠিক জানি না। তবে ওর সেই নাতিটাকে তো তার বাবা নিজের কাছে নিয়ে গেছে, মাকেও বোধ হয় নিয়ে যেতে ব্যস্ত। মজাটি জানো, ছেলেটার হাত কাটা গেছে বলে পার্টিতে আর ঠাই হয়নি। তারা নাকি বলেছে, অমন একটা চিহ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ালে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। ছেলেটা বলেছে, আর একটু শক্ত হয়ে উঠি, দেখে নেব ওদের। বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওদের বিশ্বাসভঙ্গের শাস্তি দিয়ে ছাড়বে।

বকুল অন্যমনস্কের মত বলে, তাই বুঝি?

তাই তো। অলকা বৌমা যে গিয়েছিল একদিন। আর যারা সব আছে বাড়িতে তাদের সঙ্গে যে খুব ভাব বৌমার। ওখান থেকেই শুনে এসেছে।

নির্মলদার বৌ ভাল আছে?

জোর করেই মাধুরীবৌ না বলে নির্মলদার বৌ বললো বকুল। যেন সকলকে দেখাতে চাইলে (হয়তো নিজেকেও), ওই নামটা উচ্চারণ করা বকুলের কাছে কিছুই নয়। খুব সাধারণ।

ছোটবৌদি বললো, মোটেই নাকি ভাল নেই। চেহারা দেখলে নাকি চেনা যায় না। এই যা যাচ্ছে, আর ফিরবে বলে মনে হয় না।

কাছে গিয়ে খাটের ধারে বসে পড়ে বলে বকুল, তা চেহারাটা তো বেশ ভালই করে তুলেছ, ছেলের কাছে গিয়ে আর তাকে ভোগাবার দরকার কি? আর দু-দশদিন এখানে থাকলেই তো সরাসরি ছেলের বাবার কাছে চলে যেতে পারতে।

তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক বকুল–, মাধুরী-বৌ একটু হেসে বলে, অহরহই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি, যেন এই ঘর থেকে এই খাটবিছানা থেকেই তার কাছে চলে যেতে পারি। তা ছেলের আর তর সইছে না। হয়তো ভাবছে লোকনিন্দে হচ্ছে, কর্তব্যের ত্রুটি হচ্ছে–

বকুল একটু তাকিয়ে থেকে বলে, শুধু এই ভাবছে? আর কিছু ভাবতে পারে না?

মাধুরী-বৌ শীর্ণ হাতখানা বকুলের কোলে রেখে বলে, আর কি ভাববে?

কেন, মার কষ্ট হচ্ছে, মার অসুবিধে হচ্ছে, মার জন্যে মন কেমন করছে—

মাধুরী-বৌয়ের ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা দেখা দেয়। ব্যঙ্গতিক্ত অবজ্ঞার হাসি।

বকুল অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে।

এরকম হাসি হাসতে জানে মাধুরী-বৌ?

কিন্তু কথাটা খুব ভদ্রই বলে মাধুরী। বলে, তেমন হলে তো ভালই।

ডেকেছিলে?

হ্যাঁ, তোমার কত কাজ, তার মধ্যে অকারণ ডেকে বিরক্ত করলাম

বাজে সৌজন্যটুকু ছাড়ো তো! বলো কী বলবে?

বলব না কিছু

মাধুরী আস্তে বলে, একটা জিনিস দেব।

বকুলের এখনো বুক কেঁপে ওঠে, এ কী লজ্জা, এ কী লজ্জা!

মাধুরী-বৌ যদি তার স্বামীর একটা ফটোই বকুলকে দিতে যায়, ক্ষতি কি? বকুলের হঠাৎ কেন কে জানে ওই কথাই মনে এল।

কিন্তু ফটো নয়। খাতা।

অথবা ফটোও।

খাতার শেষ পৃষ্ঠায় ফটোও সাঁটা আছে।

ওঁর এই ডায়েরির খাতাটা–, মাধুরী বালিশের তলা থেকে খাতাটা বার করে বলে, ভেবে আর পাই না নিয়ে কী করি! হাতে করে ওই হাতের লেখাগুলো নষ্ট করতেও পারিনি প্রাণ ধরে, অথচ ভয় হচ্ছে সত্যিই যদি হঠাৎ মরে-টরে যাই, কে দেখবে কে পাতা ওলটাবে– তাই শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, যার জিনিস তাকেই বরং দিয়ে দিই।

বকুল খাতাটায় হাত ঠেকায় না, অসহায় ভাবে বলে, যার জিনিস মানে?

অথচ বকুল প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমানায় এসে পৌঁছেছে, বকুল অনামিকা দেবীর খোলস এঁটে রাজ্য জয় করে বেড়াচ্ছে।

মাধুরী বিছানায় রাখা খাতাটা বকুলের কোলে রেখে দিয়ে বলে, যা বললাম, ঠিকই বলছি। পাতায় পাতায় যার নামাবলী, তারই জিনিস, তার কাছে থাকাই ঠিক।

হঠাৎ, মাধুরীর কোটরগত চোখের রেখায় রেখায় জল ভরে আসে। বকুল অপরাধীর মত কাঠ হয়ে বসে থাকে।

মাধুরীই আবার লজ্জার হাসি হেসে বলে, শরীরটা খারাপ হয়ে নার্ভগুলো একেবারেই গেছে। কথা বললেই চোখে জলটল এসে পড়ে। সত্যিই খাতাটা তোমার জন্যে তুলে রেখেছিলাম।

বকুল ওর রোগা হাতটা হাতে নিয়ে আস্তে বলে, ভেবে বড় সুখ ছিল, অন্ততঃ তোমার মধ্যে কোনো শূন্যতা নেই, ফাঁকি নেই!

মাধুরী রোগা মুখেও তার সেই অভ্যস্ত হাসিটি হেসে বলে, নেইই তো। সবটাই পূর্ণ, শুধু সেই পূর্ণতার একটা অংশ তুমি। তোমার ওপর আমি বড় কৃতজ্ঞ বকুল, তুমি আর সকলের মত ঘর-সংসার স্বামী-পুত্তর নিয়ে মত্ত হওনি। তেমন হলে হয়তো এ খাতা কবেই ছিঁড়ে ফেলে দিতে হত।

বকুল হাসবার চেষ্টা করে বলে, বর জোটেনি তাই ঘর-সংসারেরও বালাই নেই। তার মধ্যে ত্যাগের মহত্ব না খোঁজাই ভাল মাধুরী-বৌ। বরং তোমার কাছেই আমার–যাক, থাক সে কথা। সব কথা উচ্চারণে মানায় না। তবে যাবার দিন এসে না গেলে তো যাওয়া হয় না, অতএব সে দিনটা ত্বরান্বিত করার সাধনা না করাই উচিত!

না, তা করিনি। এমনিই কি মানুষের অসুখ-টসুখ করে না?…আচ্ছা ভাই, ওর খাতা পড়ে মতে হত-অবিশ্যি আগে কোনোদিনই পড়তাম না, তখন ভাবতাম সকলেরই একটুখানি নিভৃত জায়গা থাকা উচিত। কিন্তু যাবার আগে খাতাটা দিল। বলল, পড়ে দেখো। যাবার আগে তোমার কাছে নির্মল হয়ে যাই। নিজের নামটা নিয়ে অনেক সময় ঠাট্টা করতো তো। …তা পড়তে পড়তে মনে হতো, তোমাদের কথা নিয়ে কিছু লেখার কথা ছিল তোমার, লিখেছো কোথাও? তোমার কত বই, সব তো আর পড়িনি, জানতে ইচ্ছে করছে, কী লিখেছো তাতে?

বকুল আস্তে মাথা নেড়ে বলে, না, সে আর কোনোদিনই লেখা হয়নি মাধুরী-বৌ। লিখবো ভাবলে মনে হতো, লেখবার মত আছে কী? এ তো জগতের নিত্য ঘটনার একটা টুকরো। কোথায় বা বিশেষত্ব, কোথায় বা মৌলিকত্ব, তারপর হঠাৎ

বকুল একটু চুপ করে থেকে বলে, তখন মনে হল, আর লিখেই বা কী হবে?…আসল কথা, নিজের কথা লেখা বড় শক্ত। তাদের কাছেই ওটা সহজ, যারা নিজের কথার ওপর অনেক রংপালিশ চাপিয়ে জৌলুস বাড়াতে পারে, যাতে জিনিসটা মূল্যবান বলে মনে হয়। সেটা তো সবাই পারে না।

মাধুরী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ওইটা নিয়ে ওর একটু অভিমান ছিল।

বকুল মাধুরীর হাতটায় একটু চাপ দিয়ে বলে, হয়তো সেটাই ভাল হয়েছিল মাধুরী-বৌ। হয়তো লিখলে ওর মন উঠতো না। প্রত্যাশার পাত্রটা খালিই থেকে যেতো, অভিমানের সুখটা থেকেও বঞ্চিত হতো, যা হয়। হয়নি সেটাই ভাল।

তবু সময় পেলে একটু দেখো, তারপর ছিঁড়ে ফেলো, পুড়িয়ে ফেলে, যা তোমার খুশি। জগতের আর কারুর চোখে পড়লে মাধুরী নামের মেয়েটাকে হয়তো করুণা করতে বসবে। ভাববে, আহা বেচারী, বোধ হয় কিছুই পায়নি। তাদের তো বোঝানো যাবে না, এমন হৃদয়ও থাকে, যারা ফুরিয়ে যায় না, ফতুর হয়ে যায় না।

মাধুরী-বৌ ক্লান্তিতে চোখ বোজে।

বকুল ওই বোজা চোখের দিকে তাকিয়ে আর একটা মুখ মনে করতে চেষ্টা করে।

নামটা যেমন স্পর্শ করে যায়, মুখটা তেমন সহজে ধরা দেয় না।..অনেকটা ভাবলে তবে

কিন্তু সেই সরল-সরল ভীরু-ভীরু নির্বোধ মুখটার মধ্যে এমন কিছু আশ্বাস পায় না বকুল, যা মাধুরী পেয়েছে।.সত্যিই কি পেয়েছে? না ও শুধু ওর আপন মনের মাধুরী মিশায়ে রচনা করা মূর্তি?…

একটু পরে চোখ খুলে মাধুরী বলে, আজ তোমায় ডেলেছি সব কথা বলতে। অনেক প্রশ্ন করতে। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে, তোমার এই এত বড় জীবনে আর কখনো কোনো ভালবাসা আসেনি?

বকুল হেসে ওঠে, ওরে বাবা! এ যে দারুণ প্রশ্ন! চট করে তো মনে পড়ছে না।

ভেবে ভেবে মনে করো। এত প্রেমের কাহিনী লিখলে, আর…

হয়তো সেই জন্যেই লিখতে লিখতে আর সময়ই পেলাম না। তাছাড়া-বকুল একটু সহজ পরিহাসের মধ্য দিয়ে এ প্রসঙ্গে ইতি টানে, তোমার মতন সুন্দরী তো নই যে, মুগ্ধ ভক্তের দল পতঙ্গের মত ছুটে আসবে?

প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে।

তা সেটাই ভাবো। তাতেও আমার প্রেস্টিজ বজায় থাকলো।

বলে উঠে দাঁড়ায় বকুল।

খাতাটা নিয়ে যাও!

সত্যই নিতে হবে?

বাঃ, তবে কি শুধু শুধু তোমায় ডেকে কষ্ট দিলাম? তোমার কাছে দিয়েই নিশ্চিন্ত হলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *