প্রিয় রানু ভাবী,
এর আগে তোমাকে দু’টি চিঠি দিযেছি। শুধু তোমাকে না যাদের যাদেব চিনতাম সবাইকেই দিযেছি। একটা কলকাতা থেকে, একটা এখান থেকে। কেউ জবাব দেযনি। কী করে দেবে, আমি তো কোনো ঠিকানা দেইনি।
এখন বাজছে সাড়ে পাঁচটা। চারদিক অন্ধকাব। আমি ঘরে এখনো বাতি জ্বালাইনি। অন্ধকাবে লিখছি। অন্ধকারে চিঠি লিখতে বেশ লাগে তাই না ভাবী?
আজ সকালে ডাক্তার দেবশর্মার কাছে গিয়েছিলাম। বিশাল পর্বতেব মত এক ভদ্রলোক। রাগী রাগী চেহারা। ভদ্রলোককে দেখে প্রথমে যা ভয় পেয়েছিলাম। পরে দেখি ভযেব কিছু নেই। বেশ হাসিখুশি মানুষ। চা খাওয়ালেন। মজার ব্যাপার কী জানি ভাবী? চায্যের সঙ্গে বিস্কিট ছিল, ভদ্রলোক চায়ে বিস্কিট ডুবিয়ে ডুবিযে খাচ্ছিলেন। এত বড় একজন ডাক্তার এরকমভাবে বিস্কিট খায়? আমার যা হাসি লাগছিল। একটা বিস্কিট ভেঙে চায়ের কাঁপে পড়ে গেল। তিনি আবার একটা চামুচ দিয়ে সেই বিস্কিট তুলতে গিয়ে নিজের শার্টে ফেলে দিলেন। একটু হলেই আমি হেসে ফেলতাম। ভাগ্যিস হাসি চেপে রাখতে পেরেছি। না পারলে কী একটা লজ্জার কাণ্ড হত বল দেখি।
ভাবী, আমি এখন আমার রুমে একা। ও বেড়াতে গেছে। আমাকে সঙ্গে নেয়নি। পাগল মানুষকে নিয়ে কোনো ঝামেলা হয় সেই ভযে। আমারো যেতে ইচ্ছে করছিল না। শহরটা যা ংরা। তবে হোটেলটা খুব সুন্দর। সিনেমার যে রকম হোটেল থাকে। সে রকম। রিসিপশনে একটা মেয়ে থাকে, ওর নামটা এখন মনে পড়ছে না। এই মেয়েটা ভাল। আমার মত বক বক করে, তবে মেযেটার একটা খুব বাজে স্বভাব আছে। সেটা চিঠিতে লেখা যাবে না। যখন তোমার সঙ্গে দেখা হবে তখন বলব। আমার বলতে মনে না থাকলে তুমি মনেশ্বকরিয়ে দিও।
পরশু রাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি। সাদা উইলি শিফনটা পরে তুমি যেন কোথায় যাচ্ছ। বিয়ের পরপর তুমি যেমন সুন্দর ছিলে তোমাকে ঠিক সে রকম সুন্দর লাগছিল। অবশ্যি স্বপ্নে সব মেয়েকেই সুন্দর লাগে। আর পুরুষদের লাগে বিচ্ছিরি। আমি স্বপ্নে যে কটা পুরুষকে দেখেছি তাদের সবাই খুব বিচ্ছিরি। অনেক আজেবাজে কথা লিখে ফেলেছি। তাই না ভাবী? অবশ্যি ভাইয়ার ধারণা আমি খুব সুন্দর চিঠি লিখি। যা মনে আসে তাই লিখে ফেলি বলেই নাকি আমর চিঠিগুলি সুন্দর হয়। ভাইয়া কত যে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে। ওমা, তোমার কাছে ভাইয়ার কথা কেন বলছি? আমার চেয়ে তুমি তো তাকে অনেক ভাল জান।
আচ্ছা ভাবী, তোমার কী মনে আছে বিয়ের পর তুমি যখন প্রথম আমাদের বাড়িতে এলে তখন আমি কেমন রেগে গেলাম তোমার ওপর, কথায় কথায় ঝগড়া করতাম। তবু অবাক হয়ে শুনলাম তুমি একদিন ভাইয়াকে বলছি, মিলি বেচারীর অনেক সমস্যা। বাবা তাকে দেখলেই কেন জানি রেগে যান, এমন সব কথাবার্তা বলেন যে সহ্য করা মুশকিল। আমার এত ভাল লাগল তোমার কথা শুনে। তার পর তোমার সঙ্গে ভাব হল। মনে আছে প্রায়ই তোমাকে বলতাম, ভাবী আজ রাতে তোমার সঙ্গে ঘুমুব। তুমি বালিশ নিয়ে আমার ঘরে ঘুমুতে আসতে।
বেশ কিছু দিন থেকে আমার আবার তোমার সঙ্গে ঘুমুতে ইচ্ছা হচ্ছে। ভাইয়ার সঙ্গে তোমার যখন মিটমাট হয়ে যাবে তখন আমি তোমাদের সঙ্গে কিছুদিন থাকব। তোমাকে ঠিক ছোটবেলার মত বলব, ভাবী ভয় লাগছে আজ রাতে তোমার সঙ্গে ঘুমুব। তখন তুমি যদি বল, উঁহু আমি পাগল সঙ্গে নিয়ে ঘুমুব না তাহলে কিন্তু ভাবী আমি খুব রাগ করব। পাগলরা রাগ করলে কী অবস্থা হয় তুমি তো জান না। খুব খারাপ অবস্থা হয়।
চিঠি এই পর্যন্তই। রানু চিঠি শেষ করে শীতল চোখে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইল মতিয়ুরের দিকে। মতিয়ুর শুকনো মুখে একটা সোফায় বসে আছে। অসম্ভব রোগা লাগছে তাকে। যেন খুব বড় একটা অসুখ করেছে। রানু বলল, মিলির ভাইকে খবর দিয়েছেন?
ঢাকায় পৌঁছে খবর দিয়েছি। টেলিগ্রাম করেছি।
মিলি তাকিয়ে রইল মতিয়ুরের দিকে। মতিয়ুর বলল, ভাবী আমি যাই? রানু কিছু বলল না। মাথা নিচু করে বসে থাকা এই লোকটিকে সে এই মুহূর্তে আর সহ্যই করতে পারছে না।
ভাবী, আমি তার চিকিৎসার কোন ত্রুটি করিনি।
ত্রুটি করেছ এমন কথা কেউ বলছে না।
কারোর বলার দরকার নেই ভাবী। আমার নিজেরই মনে হচ্ছে কোথাও মস্ত বড় একটা গণ্ডগোল করেছি।
রানুকে অবাক করে দিয়ে মতিয়ুর রহমান হাউ মাউ করে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল। শোকের এমন তীব্র প্রকাশ বহুদিন দেখা হয়নি। এই লোকটিকে সাত্মনাসূচক কিছু কথাবার্তা বলা উচিত কিন্তু বলতে ইচ্ছা করছে না। কাজের মেয়েটি ছুটে এসেছে। অবাক হয়ে দৃশ্যটি দেখছে।
রানু বলল, বাসায় যাও মতিয়ুর। মতিউর ভাঙা গলায় বলল, বাসায় গিয়ে আমি কী করব? বাসায় আমার কে আছে?
কী অদ্ভুত কথা বাসায় কে আছে? রানু বিরসমুখে তাকিয়ে আছে। কান্নাকাটি, চিৎকার কিছুই তার মনে দাগ কাটছে না। সবটাই মনে হচ্ছে বানানো, মেকি। লোকটির টাকা-পয়সা হয়েছে, কিছু দিনের মধ্যেই সে পুতুল পুতুল ধরনের একটি মেয়ে বিয়ে করবে। গয়নায় তার শরীর ঢেকে দেবে। সেই মেয়েটি পর পর কয়েকটি বাচ্চা দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য রকম হয়ে যাবে, গালের হাড় বড় হয়ে যাবে, দাঁতগুলি হয়ে যাবে উঁচু। পৃথিবীর প্রতি অপরিসীম বিরক্তি নিয়ে এই মেয়েটি দুপুর বেলা নিউ মার্কেটে শাড়ির প্যাকেট নিয়ে হাঁটবে।
কে মনে রাখবে মিলির কথা? কেউ না? তার মেয়েটিও না। সবাই চেষ্টা করবে মিলিকে দ্রুত ভুলে যেতে। ভুলে যাওয়াই ভাল। পাগল মাকে মনে রাখার কোনো দরকার নেই। কেউ কাউকে মনে রাখে না।