চৌত্রিশ
‘পাপ, পাপ, মহাপাপ!’ কণ্ঠস্বর মোটেই ভরাট নয়, উচ্চগ্রামেও নয় কিন্তু একটা কনকনে শীতের হাওয়ায় জড়ানো শব্দগুলো। মাধবীলতা চমকে উঠল। শরীরের কোথাও কোন কম্পন নেই, ভূপতিত গাছের মত পড়ে আছেন মহীতোষ। অথচ শব্দগুলো বেরিয়ে আসছে স্বচ্ছন্দে। মাধবীলতা বুঝতে পারল না কার পাপ, কিসের পাপ, কোন পাপের কথা বলছেন মহীতোষ। কিন্তু তিন চার মিনিট অন্তর অন্তর তাকে ওই তিনটে শব্দ শুনতে হচ্ছে। এখন অনিমেষ বা হেমলতা ধারে কাছে নেই, ছোটমাও অনেকক্ষণ এদিকে আসছেন না।
মাধবীলতা সাহস সঞ্চয় করল, ‘আপনি কথা বলবেন না!’
‘চোপ! চোপ! মহাপাপ।’ তিনটে শব্দ পৃথক স্বরে উচ্চারিত হল।
মাধবীলতা একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মহীতোষকে লক্ষ্য করল। না, শব্দগুলোর কোন প্রতিফলন মুখে হচ্ছে না। ওর মনে হল মহীতোষ পূর্ণ চেতনায় কথা বলছেন না, কি বলছেন তাও বুঝছেন না। সে মহীতোষের মাথায় হাত রাখল, ‘বাবা, আপনি বিশ্রাম নিন।’
‘কে বাবা? কার বাবা? হাত সরাও।’ পাথরের মত মুখ থেকে শব্দগুলো ছিটকে এল।
‘বাবা, আপনি ঘুমোন। এখন কথা বলবেন না।’
‘কথা বলব না! জ্ঞান দিচ্ছে! কে তুমি?’
মাধবীলতা ঠোঁট কামড়ালো। সেই সঙ্গে তার মনে এক ধরনের জেদ জন্ম নিল। সে নিচু গলায় বলল, ‘আমি আপনার বউমা।’
‘বউমা? অ।’ মহীতোষ যেন আচমকাই চুপ করে গেলেন। মাধবীলতা কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ লক্ষ্য করল কিন্তু মানুষটার কোন সাড়াশব্দ পেল না। শরীর তো স্থির এবং কথাও যখন বন্ধ হয়ে থাকে তখন অস্বস্তি হয়। সে ডাকল, ‘বাবা!’
মহীতোষ জিভ নাড়লেন। এই একটি অঙ্গের সঞ্চালনে তিনি সক্ষম। কোন অলৌকিক প্রক্রিয়ায় এমন কাণ্ড ঘটল মাধবীলতা জানে না। মহীতোষ কিছু বলার আগেই ব্যাপারটা চোখে পড়ল। ডাক্তার বলেছিলেন একটা বড় অয়েলক্লথ কিনতে। নিত্য তাতে পাউডার ছিটিয়ে মহীতোষকে শুইয়ে দিতে হবে। পেচ্ছাপ পায়খানা করলে যাতে বিছানা না ভেজে এবং একনাগাড়ে শোওয়ার ফলে শরীরে ঘা না জন্মায় তারই জন্যে এই ব্যবস্থা। আজ সকালে অর্ককে দিয়ে সেরকম একটা কিনে আনা হয়েছে কিন্তু এখনও তা বিছানায় পাতা হয়নি। এখন মহীতোষ বিছানা ভাসিয়ে দিয়েছেন। চাদর তোষক সব চপচপে হয়ে উঠেছে। ওই মানুষটাকে একা নড়ানোর সাধ্য মাধবীলতার নেই। সে বিব্রত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল।
হেমলতা ঠাকুরঘরে। মাধবীলতা রান্নার ঘরের দরজায় এসে দেখল ছোটমা জ্বলন্ত উনুনের সামনে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। সে ডাকল, ‘মা।’
ছোটমা মুখ ফেরালেন। আর তখনই মাধবীলতার বুক ছ্যাঁত করে উঠল। এরকম বিষন্ন এবং নিঃস্ব চাহনি সে কখনো দ্যাখেনি। অত্যন্ত দুঃখী এবং একা মানুষের মুখ এরকম হয়। সে নিচু গলায় বলল, ‘মা—।’
‘কি হয়েছে?’ ছোটমা মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
‘বাবা বিছানায়—।’
‘ওঃ, আমি আর পারছি না। আমার মরণও হয় না, ভগবান।’ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন ছোটমা। তাঁর ডান হাত সজোরে কপালে আঘাত করল। মাধবীলতার ভয় হল উত্তেজনার ঝোঁকে ছোটমা না আগুনের মধ্যে পড়ে যান। সে দ্রুত পায়ে রান্নার ঘরে ঢুকে বলল, ‘মা, এমনভাবে ভেঙে পড়বেন না।’
‘ভাঙব না?’ ছোটমা ফুঁসে উঠলেন, ‘একটা মানুষ কতদিন সহ্য করতে পারে বল? দোজবরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। এই বাড়িতে যখন এলাম তখন মস্ত বড় ছেলের মন পেতে হবে, স্বামীর সেবা করতে হবে। আর সর্বত্র আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হল মরে যাওয়া সতীন। তার মত বউ নাকি হয় না। বিয়ের পর চা-বাগানে নিয়ে যাওয়া হল আমাকে। ভাবলাম একা একা হয়তো স্বামীর মন পাব। তা তিনি আমাকে দেখে মরা বউ-এর কথা ভাবেন আর হা-হুতাশ করেন। মদ খান আর মা মা করেন। দিনরাত মারধর খেতাম তখন। কিন্তু ভাবতাম সব ঠিক হয়ে যাবে, আমিও মা হব। হল না, কিছুই হল না, শুধুই ঝিগিরি করে যাওয়া—।’ হাউ হাউ কান্নাটা ছিটকে বেরিয়ে এল। আর তখনই মাধবীলতা নাড়া খেল। তার সহকর্মীরা বলে, কখনও কখনও অনিমেষও, তার মত মহিলা নাকি হয় না। এমন আত্মত্যাগ নাকি দেখা যায় না। সেদিন সুচিত্রা বলেছিল টিচার্সরুমে, ‘আজকের দিনে এরকম স্যাক্রিফাইস কেউ বিশ্বাস করবে না।’ ছাই, লোকে বাড়িয়ে বলে। অনিমেষের জন্যে সে যা করেছে তাতে এক ধরনের স্বার্থ কাজ করত। সেটা অন্ধের মত ভালবাসা। হ্যাঁ, ভালবাসা যখন অন্ধ হয়ে যায় তখন স্বার্থপরতা আসে। তারই নেশায় সে যা করার তা করেছে। কিন্তু ছোটমা তো ভালবেসে বিয়ে করেননি। তাঁকে জোর করে এই পরিবারের সঙ্গে জুতে দেওয়া হয়েছিল। কিসের স্বার্থে তিনি এইভাবে নিজেকে নিঃস্ব করে দিলেন?
আঁচলে চোখ মুছলেন ছোটমা। তারপর অন্যরকম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওরা কেউ নেই? অনিমেষ, অর্ক?’
‘নিশ্চয়ই আছে। ডাকব?’
‘হ্যাঁ। চল। আমি একা তো আর ওঁকে নাড়াতে পারব না।’ ছোটমা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতেই মাধবীলতা পেছন ফিরল। এবং তখনই ছোটমা তাকে ডাকল, ‘শোন! তুমি আমাকে পছন্দ করতে পারনি আমি জানি। আসলে মেয়েরা চট করে কোন মেয়েকে মেনে নিতে পারে না। আমিও পারিনি। তোমাকে দেখে আমার খুব হিংসে হয়েছিল তাই বিয়ের কথা তুলেছিলাম। কিছু মনে করো না।’
মাধবীলতা আর দাঁড়াল না। দাঁড়াতে পারল না।
পরমহংসকে চিঠি লিখল অনিমেষ। এখানে আসার পর যা যা ঘটেছে সব জানাল। এখন এই সংসার সম্পূর্ণ অচল। মহীতোষের সেবা শুশ্রূষা করার জন্যে একটা লোক রাখা দরকার। ছোটমায়ের পক্ষে আর বোঝা টানা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যা অবস্থা তাতে যে কোন দিন মহীতোষ কিংবা হেমলতা চলে যেতে পারেন। তাছাড়া ঘাড়ের ওপর একটা মামলা ঝুলছে, সেটার হালচাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা নেই। এই অবস্থায় দুটো উপায় সামনে খোলা আছে। এক, টাকা পয়সা দিয়ে লোক রাখা যাতে এদের কোন অসুবিধে না হয়। দুই, তাদের চিরকালের জন্যে এখানে এসে থাকা। দুটোই সম্ভব নয়। কারণ তাদের কোন উদ্বৃত্ত অর্থ নেই যা এখানে পাঠানো যায়। আর এখানে থাকলে মাধবীলতার চাকরি বিনা না খেয়ে মরতে হবে। এই অবস্থায় কি করা যায় তার মাথায় ঢুকছে না। এখানে এসে তার শরীর ভালই আছে। অনেক চাঙ্গা লাগছে এখানে। কলকাতার ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচছে। দিনরাত আর সেইসব অশ্লীল কথার ঘিনঘিনানি গায়ে মাখতে হচ্ছে না। অর্ককেও যে ওই পরিবেশের বাইরে আনতে পেরে নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে তাও লিখল অনিমেষ। কিন্তু ফিরতে হবেই যখন তখন আর এসব ভেবে লাভ কি! কলকাতাকে দূর থেকে রাক্ষুসীর মত মনে হচ্ছে। চিঠির শেষে জুড়ে দিল, যদি পরমহংস এখানে আসে তাহলে ওদের ভাল লাগবে। নতুন বাড়িটা যদি হাতছাড়া না হয় তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
এতসব লেখার পর অর্কর হাতে চিঠিটা ডাকে পাঠিয়ে অনিমেষের নিজের কাজের জন্যেই খটকা লাগল। কতকাল পরমহংসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তিন-চারদিন সে সহানুভূতি দেখাতেই এত কথা তাকে লেখা গেল। এভাবে নিজের সমস্যা অন্য কাউকে বলতে পারার মধ্যে সুখ আছে কিন্তু কয়েক সপ্তাহ আগেও সে ব্যাপারটা চিন্তা করতে পারত না। মানুষ পরিবেশের এবং পরিস্থিতির চাপে নিজেকে পাল্টে নেয়, যে কোন জন্তুর মত, হয়তো গাছের মতও। অনিমেষ দুপুর রোদে বারান্দার চেয়ারে বসে গাছগাছালি দেখছিল। হঠাৎ তার মনে হল সরিৎশেখর ছোটবাড়ি থেকে লাঠি হাতে বেরিয়ে আসছেন। সে চমকে স্পষ্ট চোখে তাকাতেই দেখল একটা কলাগাছের মরা সাদা পাতা হাওয়ায় দুলছে। অনিমেষের বুক নিংড়ে বাতাস বেরিয়ে এল। দাদুকে অনেকদিন বাদে এমন করে মনে পড়ল। এই বাড়িটা দাদু বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে তৈরি করেছিলেন। কি হল? মানুষের সাধ কখনও পূর্ণ হয় না তবু মানুষ সাধ করে যায়। আজ বাবাকে যখন বিছানা থেকে তোলা হল তখন থেকেই এক ধরনের ক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে। মানুষের মত অসহায় জীব আর কেউ নেই।
এইসময় গেটে শব্দ হল। অনিমেষ দেখল একজন প্রৌঢ় মানুষ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটাকে তার খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে অথচ মাথার সাদা চুল চেহারাটাকে যেন গুলিয়ে দিচ্ছে। খাকি প্যান্টের ওপর সাদা সুতির হাওয়াই শার্ট পরা মানুষটি ভেতরে পা ফেলতেই এবার স্মৃতি স্পষ্ট হল। অনিমেষ হাত বাড়িয়ে ক্লাচদুটো টেনে নিতে না নিতেই মানুষটি বারান্দার সিঁড়িতে পা ফেলে থমকে দাঁড়াল। তার চোখ এখন অনিমেষের ওপর স্থির। তারপর খুব আন্তরিক হাসি ফুটে উঠল মুখে, ‘আমাকে চেনা যাচ্ছে?’
অনিমেষ উদ্বেলিত হচ্ছিল। কিন্তু যতটা সম্ভব সতর্কতার সঙ্গে সে ঘাড় নাড়ল, ‘জুলিয়েন না?’
‘যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আমার ভয় হচ্ছিল যদি পরিচয় দিতে হয়—!’
‘আসুন।’ অনিমেষ উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল।
জুলিয়েন বাধা দিল, ‘আরে থাক থাক, আপনাকে উঠতে হবে না।’
অনিমেষ তবু উঠল। ওপাশে পড়ে থাকা চেয়ারটাকে টেনে আনল সামনে, ‘বসুন।’
আরাম করে বসে জুলিয়েন বলল, ‘আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছেন, তাই না?’
‘খানিকটা। ঠিক আশা করা যায়নি।’
‘আমিও অবাক হয়েছিলাম। গতকাল যখন শুনলাম আপনি এসেছেন এবং শরীরের এই অবস্থা তখন অবাক-ভাবটা কাটলো।’
‘সে কি! তার আগে অবাক হচ্ছিলেন কেন?’
‘আমরা প্রথমে জানতাম আপনাকে ওরা শেষ করে ফেলেছে। এরকম খবরই আমাদের কাছে এসেছিল। বছর খানেক আগে আপনার সঙ্গে জেলে আটকে থাকা একটি ছেলে বেরিয়ে এসে খবর দিল আপনি নাকি সেই বন্দীমুক্তির আগেই রিলিজড্ হয়েছেন। রিলিজড্ হয়ে আপনি কোথায় গিয়েছেন তা কেউ বলতে পারেনি। আপনার বাবাও নাকি কলকাতায় গিয়ে সন্ধান পাননি। তারপর থেকেই আমরা খোঁজ নিতাম এই বাড়ির সঙ্গে কোন যোগাযোগ আপনার আছে কি না। সেটাও নেই জেনে অবাক হয়েছিলাম। সেই সময় যারা একসঙ্গে কাজ করেছি আজ তাদের অনেকের চরিত্র পাল্টে গেছে। আপনার ক্ষেত্রে সেটা ভাবতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। তা কালকেই জানতে পারলাম আপনি এসেছেন এবং ওরা এই হাল করে ছেড়েছে।’ জুলিয়েন ঠোঁট মুচড়ে অনিমেষের পায়ের দিকে তাকাল। ওর চোখ ছোট হয়ে এসেছিল।
অনিমেষ এতক্ষণ চুপচাপ জুলিয়েনের কথাগুলো শুনছিল। শেষ হতেই জিজ্ঞাসা করল, ‘কার কাছে আমার আসার খবর পেলেন?’
জুলিয়েন যেন বেশ অবাক হল, ‘সে কি! আপনি বুঝতে পারেননি?’
একটু চুপ করে থেকে অনিমেষ এবার ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ। ডাক্তারবাবুর কথাবার্তা এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে গেল। জুলিয়েন এবার জিজ্ঞাসা করল, ‘শরীর ছাড়া আপনি কেমন আছেন?’
‘আছি এই মাত্র। আমার পক্ষে শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব নয়!’
‘সে কি! কাল তো আপনিই ডাক্তারকে ডাকতে গিয়েছিলেন!’
‘হ্যাঁ, ওইটুকুই ক্ষমতা।’
‘মনে হচ্ছে আপনি মনে মনে খুব আপসেট হয়ে রয়েছেন।’
‘দেখুন, এতগুলো বছর জেলখানা আর বস্তির একটা বদ্ধ ঘরে শুয়ে থেকে আমার পক্ষে আর কি করা সম্ভব! ছেড়ে দিন এসব কথা। আপনাদের খবর বলুন।’
‘আমি ভেঙে পড়িনি। অবশ্য আমি একা নই, আমাদের দলটা বাড়ছে।’
‘আপনি কি আগাগোড়াই বাইরে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ। নেপালে। সেখান থেকে বাংলাদেশে কিছুদিন আবার নেপালে। এদেশের জেলের ভাত এখনও আমার পেটে পড়েনি।’ জুলিয়েন হাসল।
অনিমেষ সতর্কচোখে মানুষটিকে পরিমাপ করল, ‘আপনি কি এখনও স্বপ্ন দেখেন?’
‘অবশ্যই।’ জুলিয়েনের কণ্ঠস্বর হঠাৎ জোরালো হল, ‘স্বপ্ন দেখা ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। তখন আমাদের অনেক গোলমাল ছিল। ক্ষমতা সম্পর্কে মোটেই সচেতন ছিলাম না। একটা মোষের পক্ষে হাতির সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়। কিন্তু তেমন তেমন বাইসন হলে কিছুক্ষণ লড়ে যেতে পারে। আর যদি ধূর্ত বাঘ হয় তাহলে চান্স ফিফটি ফিফটি। এটাই আমরা বুঝিনি। তাছাড়া আর একটা ব্যাপার আছে, অন্য দেশের ধার করা শ্লোগান দিয়ে আর এক দেশে বিপ্লব হয় না। এই তো এত বছর হয়ে গেল সি পি এম সি পি আই এই দেশে আন্দোলন করছে, এখন তো আমাদের মাথায় জনদরদী বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু আপনি জিজ্ঞাসা করে দেখুন কটা সাধারণ মানুষ ইনকিলাব শব্দটার মানে জানে? জানে না কিন্তু পাখির শেখা বুলির মত কপচায়। এতে কোন লাভ হবে না চীনের চেয়ারম্যান কখনও আমাদের চেয়ারম্যান হতে পারে না।’
অনিমেষ বলল, ‘আমি আপনাকে ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘কেন?’
‘আপনারা ঠিক কি করতে চাইছেন? আমার কাছে কেন এসেছেন?’
জুলিয়েনের একটা হাত হঠাৎ এগিয়ে এসে অনিমেষের হাতের ওপর পড়ল, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন। আমরা আবার নতুন করে শুরু করতে চাই, আপনি মদত দিন। তাছাড়া আর একটা ব্যাপারে আমি আপনার কাছে দায়বদ্ধ আছি।’
‘দায়! আমার কাছে?’ অনিমেষ অবাক।
‘হ্যাঁ। স্বৰ্গছেঁড়ায় যে ঘটনাটার পর আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি সেই ঘটনাটা মনে আছে? একজনকে ব্রিজের নিচে বালিতে আমরা কবর দিয়েছিলাম!
চকিতে অনিমেষের সব মনে পড়ল। সেইরাত্রে ওরা একটি সুপরিকল্পিত ডাকাতি করেছিল। ওদের একজনের মৃত্যু হয়। প্রচুর টাকা এবং সেই মৃতদেহ নিয়ে ওরা পালিয়েছিল। তখন অস্ত্র সংগ্রহের জন্যে টাকার দরকার। তাছাড়া চিহ্নিত লোকটি প্রকৃত অর্থেই অত্যাচারী এবং শোষক ছিল। অ্যাকশনের নেতৃত্ব তার হাতেই ছিল। লোকটি মারা যায় কিন্তু ওদের একজন মদেশিয়া কমরেডকে হারাতে হয়। বাক্স ভরতি সেই টাকাগুলো জুলিয়েনের জিম্মায় ছিল। তারপর অনবরত পুলিসের সঙ্গে লুকোচুরি, জায়গা পাল্টানোর ফলে জুলিয়েনের সঙ্গে আর যোগাযোগ ছিল না। জুলিয়েন কি সেই কথাই বলতে চাইছে?
অনিমেষ বলল, ‘সবই মনে আছে। কিন্তু তাতে আমার কাছে আপনার কি দায় রয়েছে তা আমি বুঝতে পারছি না।’
‘টাকাগুলো এখনও যেমন ছিল তেমন রয়েছে।’
‘তার মানে?’ অনিমেষ সোজা হয়ে বসল।
‘আমাকে পালাতে হয়েছিল। ডুয়ার্সে আপনার চেয়ে আমি বেশি পরিচিত। আমাকে ধরা পুলিসের পক্ষে খুব সহজ। তাই পালাবার আগে ব্যাগ লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলাম।’ জুলিয়েন হাসল।
‘কোথায়?’
‘একজনের কাছে। একজন গরীব মদেশিয়া মহিলার কাছে। অবশ্য মদেশিয়াদের মহিলা বলার রেওয়াজ এখনও হয়নি। জুলিয়েন মাথা নাড়ল।
‘সেই মহিলা এত বছর টাকাগুলো রেখে দিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ। ব্যাগটা বোধহয় খুলে দ্যাখেননি।’
‘আশ্চর্য!’ অনিমেষ বিশ্বাস করতে পারছিল না।
‘অবশ্যই। তবে এখনও তো অনেক আশ্চর্য ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে থাকে।’
সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ জুলিয়েনকে আর একবার দেখল। একজন আদিবাসী মহিলা সততার সঙ্গে হাজার হাজার টাকা পনের বছর পাহারা দিয়েছেন, হাত দেননি। এটা অবশ্যই আশ্চর্যজনক ঘটনা। সেই মহিলার সঙ্গে জুলিয়েনের কি সম্পর্ক তা সে জানে না। কিন্তু এতদিন বাদে তার মত একজন পঙ্গু অথর্ব মানুষের কাছে এসে সেই টাকা অটুট আছে তা জুলিয়েন জানাতে এসেছে। কি প্রয়োজন ওর? স্বচ্ছন্দে সেই টাকা হজম করে দিতে পারত ও। আর একজন জীবিত মানুষকে যেচে জানাতে আসাটা কি আরও বেশি আশ্চর্যজনক নয়?
অনিমেষ বলল, ‘এসব কথা আমাকে বলছেন কেন?’
জুলিয়েন বলল, ‘সেদিন যারা আমাদের সঙ্গী ছিল তারা ওই ঘটনাকে ভুলে যেতে চায়। তাদের জীবনযাত্রাও পাল্টে গিয়েছে। তাছাড়া দুজন বোধহয় মরেও গিয়েছে এর মধ্যে। আপনি আছেন জানার পর আমি খোঁজ করে যাচ্ছি। ওই টাকাগুলোর একটা ব্যবস্থা করতে আপনার সম্মতি দরকার।’
অনিমেষ হাসল, ‘দেখুন, আমার কাছে টাকাগুলোর থাকা আর না থাকা সমান ব্যাপার। আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন। আর করলেও তো সেটা আমি জানতে পারতাম না। তাই না?’
জুলিয়েনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, ‘আপনি কি ইঙ্গিত করছেন জানি না, তবে ওইদিনের নেতৃত্ব আপনার হাতে ছিল। টাকাগুলো আমি ব্যক্তিগতভাবে খরচ করতে পারি না। সেটা এখন আপনার বোঝা উচিত।’
‘আপনি কিভাবে খরচ করতে চাইছেন?’
জুলিয়েন তার খাকি প্যান্টের ওপর হাত ঘষল। তারপর বলল, ‘বিপ্লবের উদ্দেশ্যে ওই টাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। অথচ সবই ভেস্তে গিয়েছিল। এখন আমরা নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা করছি। কিছু কিছু কাজও শুরু হয়েছে তবে খুবই প্রাথমিক স্টেজে। টাকাটা আমার ইচ্ছে এই কাজে ব্যয় করা হোক।’
অনিমেষ বলল, ‘আপনারা কি কাজে নেমেছেন, তার পথ এবং উদ্দেশ্য কি আমার জানা নেই তবে আপনার ইচ্ছে যখন তখন টাকাটা আপনি ব্যবহার করতে পারেন, আমার কোন আপত্তি নেই।’
‘আমার ইচ্ছেটাকেই মেনে নিচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ। কারণ টাকাটার অস্তিত্বই আমি জানতাম না আপনি না জানালে।’
জুলিয়েন অবাক হচ্ছিল, ‘আপনি নির্দ্বিধায় টাকাটা ছেড়ে দিলেন?’
অনিমেষ বলল, ‘কি করব? ডাকাতির ভাগ চাইবো?’
‘এভাবে বলছেন কেন?’
‘ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন উঠলে তো তাই বলতে হয়। ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্দেশ্যে কি আমরা টাকাটা সংগ্রহ করেছিলাম? করিনি। একটি মানুষের প্রাণ ওর সঙ্গে জড়িত আছে। তার সম্মানের জন্যেও আমরা কেউ ওই টাকা নিজের স্বার্থে খরচ করতে পারি না। অতএব ‘ছেড়ে দেওয়া’ কথাটা উঠতেই পারে না। আপনারা যখন কিছু ভাবছেন এবং সেটা যদি সাধারণ মানুষের ভালর জন্যে হয় তাতেই ওটা খরচ করুন। তা যদি না হয় তাহলে অনুরোধ, হয় মাদার তেরেসা নয় ওইরকম কোন প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দেবেন। ওঁরা মানুষের যা উপকার করেন একটা বড় রাজনৈতিক দল হাজার বক্তৃতার পরেও তার ক্ষুদ্রাংশ করতে পারে না।’ অনিমেষ ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘চা খাবেন?’
জুলিয়েন সজোরে মাথা নাড়ল, ‘না। ওসব পাট শেষ করে দিয়েছি।’
‘ওসব পাট মানে?’
‘চা সিগারেট মদ। আপনি বসুন। ও হ্যাঁ, আপনার বাবা কেমন আছেন?’
‘বাবার কথা আপনি—ও, বুঝতে পারছি। একইরকম আছেন। সমস্ত শরীর অসাড় শুধু বাকশক্তি ফিরে এসেছে। আপনি কি এখন জলপাইগুড়িতেই আছেন?’
‘না। চালসায় আছি। কাল রাত্রে খবর পেয়েছি। অনিমেষ, আমি কিন্তু এখনও স্বপ্ন দেখি। আমার বয়স আপনার চেয়ে অন্তত বছর পনের বেশী হবে। তবু স্বপ্ন দেখতে আমার বাধছে না। আপনি কিন্তু আমায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।’
অনিমেষ সেই যুবক জুলিয়েনের কথা মনে করার চেষ্টা করল। সে যখন স্কুলের ছাত্র তখনই জুলিয়েন স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেই মদেশিয়া যুবক এখন প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায়। কিন্তু শরীরের গঠন এখনও মজবুত। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার পরিবারের খবর কি?’
‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’ স্ত্রী মারা গেছেন আমি বিদেশে থাকতেই। ছেলেমেয়েরা যে যার নিজের মত করে খাচ্ছে। বড় হয়ে গেছে ওরা, আমার সঙ্গেও ব্যবধান বেড়েছে। আপনার তো এক ছেলে।’ জুলিয়েন হাসল।
‘হ্যাঁ।’ কথাটা বলার সময়ে মাধবীলতার মুখ মনে পড়ল অনিমেষের। জুলিয়েনের কথা মাধবীলতা জানে। তাকে ডেকে আলাপ করিয়ে দেওয়া খুবই সঙ্গত কাজ। কিন্তু অনিমেষের মনে যেন দ্বিধা জন্মাল। দেখা যাক, আর একটু দেখা যাক। আজ, অনেক অনেকদিন পরে জুলিয়েনের সঙ্গে দেখা হওয়ায় নিজেকে যেন আলাদা মনে হচ্ছে। এত কথা এমনভাবে অনেকদিন বলেনি সে।
জুলিয়েন প্যান্টে হাত ঘষল আবার, ‘আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন?’
অনিমেষ আবার চেয়ারে হেলান দিল, ‘জুলিয়েন, আমি শেষ হয়ে গেছি।’
‘কে বলল? কখনও না। একটা মানুষের শরীরে যতক্ষণ রক্ত চলাচল করে ততক্ষণ সে শেষ হয় না। আপনি এসব চিন্তা ছাড়ুন।’
‘কিন্তু আমি হাঁটতে পারি না—এ দুটো ছাড়া। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে আসতে পারি না। পৃথিবীর সর্বত্র কেউ আমার জন্যে সমান জায়গা বিছিয়ে রাখবে না। আমার পক্ষে স্বপ্ন দেখাও বাতুলতা।’
জুলিয়েন মাথা নাড়ছিল ঘন ঘন, ‘এসব কথা আপনার মুখে একদম মানাচ্ছে না। আপনার শরীর নিশ্চয়ই অশক্ত কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশী অসুস্থ হয়ে পড়ছেন মানসিকভাবে। এইটে আপনাকে কাটিয়ে উঠতেই হবে। মনে জোর আনুন তাহলে দেখবেন অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। অনিমেষ, আপনাকে আমাদের দরকার।’
অনিমেষ কিছুক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইল। ওর দুই হাতের মুঠোয় চেয়ারের হাতল, চোয়াল শক্ত। একটা পা মাটিতে অন্যটা শুকনো কাঠির মত বাঁকানো। ওর এই ভঙ্গী দেখে জুলিয়েন কিছু ভাবল তারপর বলল, “ঠিক আছে, আপনাকে এখনই এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে না। আমি পরে আসব।’
‘না, আপনি বসুন।’ অনিমেষ মুখ তুলল, ‘আপনারা কি করতে চাইছেন?’
‘আমাদের আগের ভুলগুলো আমরা শুধরে নিতে চাই।’
‘আপনি কি এখনও বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখছেন?’
‘নিশ্চয়ই। এই সমাজব্যবস্থা এবং এই সংবিধানে এদেশের মানুষের মুক্তি কখনই আসবে না। এদেশের গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের জন্যে নয়।’
‘এসব কথা তো সাতষট্টি সালের আগেও বলতাম, বলতেন।’
‘তখন কথাটা যে বিশ্বাসে বলতাম আজ সেটা না বলার মত কোন ঘটনা দেশে ঘটেনি। যেহেতু একটা আন্দোলন পূর্ণ সাফল্য পেল না সঙ্গে সঙ্গে সব চিন্তাভাবনা ভুল—এটা হবে কেন? একটা লোক গুণ্ডা লম্পট, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে হেরে গিয়েছি তার মানে এই নয় যে লোকটাকে ভদ্রলোক বলতে হবে। গুণ্ডা তো গুণ্ডাই রইল, তাই না!’ জুলিয়েন এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, ‘এসব কথা আপনাকে কেন বলতে হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না।’
‘কিন্তু জুলিয়েন, এদেশে কি বিপ্লব সম্ভব?’
‘অবশ্যই সম্ভব। যতদিন শ্রেণীবিভাগ থাকবে, অর্থনৈতিক বৈষম্যের চূড়ান্ত ব্যবস্থা থাকবে, যতদিন গণতন্ত্রের নামে ধাপ্পাবাজী চলবে ততদিন পৃথিবীর যে-কোন দেশে বিপ্লব সম্ভব।’
‘এসব কথা যে-সব নেতারা সাতষট্টির আগে বলতেন তাঁরাই তো এখন নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন। তখন বিধানসভা লোকসভাকে শুয়োরের খাঁচা বলতে পছন্দ করতেন যাঁরা তাঁরাই এখন সেখানে ঢোকার জন্যে তৎপর হচ্ছেন। সাধারণ মানুষ এদের চেহারা জেনে ফেলেছে। আমি জেলখানায় এও শুনেছি সাতষট্টি সালের ঘটনাটার মাধ্যমে কিছু মানুষ চেয়েছিলেন দেশের নেতৃত্ব, যারা নির্বাচনে দাঁড়ালে কখনই জিততে পারতেন না। মনে হচ্ছে কথাটা মিথ্যে নয়। সেই সময় সামান্য হইচই করে এখন তো তাঁরা রীতিমত বিখ্যাত। লোকে চোখ বড় করে বলে, উনি খুব বড় নকশাল ছিলেন। সামাজিক স্ট্যাটাসই পাল্টে গিয়েছে তাঁদের। এখনও অবশ্য সাধারণ মানুষ তাঁদের ভোট দিতে তেমন ইচ্ছুক নন কিন্তু পরের নির্বাচনে জেতার আশা সবাই করে যাচ্ছেন। তা এইসব মানুষ যখন চোখের সামনে তখন সাধারণ লোক আপনাদের বিশ্বাস করবে?’
‘করবে। কারণ বিশ্বাস চাপানো যায় না, অর্জন করতে হয়। সাতষট্টি সালে আমরা জনগণকে বাদ দিয়ে বিপ্লবের কথা ভেবেছিলাম। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যেহেতু মানুষ খুবই কষ্ট এবং দারিদ্র্যের মধ্যে আছে তাই বিপ্লবের ডাক দিলেই সবাই আমাদের সঙ্গে এসে হাজির হবে। কিন্তু এখন সেসব ভুল ধারণা করার মত মানসিকতা আমাদের নেই। আমরা জনসাধারণকে বোঝাবো, তাদের আস্থা অর্জন করব। জানি সবচেয়ে বড় বাধা আসবে বামপন্থী দলগুলির কাছ থেকে। সাতষট্টি সালে ওরা ক্ষমতায় ছিল না। এখন তো কংগ্রেস আর ওরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দিন পাল্টাবেই বলে আমার বিশ্বাস। আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন।’ জুলিয়েন অনিমেষের হাত জড়িয়ে ধরল।