নারায়ে তকবির—আল্লাহু আকবর স্লোগানে গোলাবাড়ি থেকে ওদিকে লাঠিডাঙা এবং এ দিকে গিরিরডাঙা পর্যন্ত কেঁপে উঠলে শীতরাত্রির হিম কেটে লাফিয়ে ওঠে চারপাশের গ্রামগুলো। শরাফত মণ্ডল নিজেই প্রায় দৌড় দিয়ে হাজির হয় গোলাবাড়ির হাটে, কাদেরকে ধরে এই মানুষগুলিকে যে করে হোক ঠেকাতে হবে। কিন্তু কাদের দোকানেও নাই। চেয়ার ও বেঞ্চ জোড়া দিয়ে নবিতনের বোনা কাঁথার ওপর রেড ক্রসের কম্বল গায়ে মাথায় জড়িয়ে অঘোরে ঘুমায় কেরামত আলি। তার গায়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে ওঠাতে হয়। কাদের ভাই তো সন্ধ্যার অনেক আগেই টাউনে গেলো, কাল দুপুরবেলা আসবি। তো দরজা আটকানো নাই কেন? ভালো করে চোখ মুছে কেরামত দেখে, পাশে গফুর নাই। দরজা খুলে বাইরে থেকে ভালো করে ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেছে কেরামত টেরই পায় নি। শরাফত হায় হায় করে। দরজা ভেতর থেকে ভালো করে না আটকে এরকম কুম্ভকর্ণ মার্কা একটা লোককে রেখে যায় সে কোন আক্কেলে? কলুর বেটাকে একশোবার বেচলেও দোকানের মালপত্রের দাম উঠবে না। তবে শরাফতের হায় হায় করার দ্বিতীয় কারণটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। গফুরও তা হলে কাছারি হামলা করতে গেছে, এর মানে এতে কাদেরেরও সায় আছে। কাছারির একটা প্রাণীর গায়ে আঁচড় লাগলে নায়েববাবু আশেপাশের গ্রামে একটা মানুষকে রেহাই দেবে না। টাউনের নেতাদের সঙ্গে কাদের দিনরাত ঘোরে, অথচ বোঝে না, জমিদারবাবুর বড়ো ছেলে হলো খান বাহাদুর আলি আহমদের গেলাসের ইয়ার। বন্ধুকে খুশি করতে খান বাহাদুর মন্ত্রীর সমস্ত ক্ষমতা খাটাবে।।
শরাফত বলে, কেরামত, চলো, মাঝিগোরে আটকান লাগবি। কাছারির কিছু হলে সর্বনাশ হয়া যাবি গো। কিন্তু ততোক্ষণে আশেপাশের গ্রামের মানুষ সব ভিড়ে গেছে। মাঝিদের সঙ্গে, কাদেরের দোকানের ভেতর থেকেও বোঝা যায়, সবাই চিৎকার করতে। করতে ছুটছে লাঠিডাঙা কাছারির দিকে। শরাফত একবার বাইরে বেরিয়ে ও কাছারির দিক থেকে বন্দুক ছোঁড়ার আওয়াজে ঘরে ঢুকে কাঁপতে থাকে।
ওদিকে কাছারি থেকে কয়েকবার বন্দুকের আওয়াজ হতে থাকলে কালাম মাঝির ভাইপো আফসার দলবল নিয়ে পিছু হটে। কিন্তু অনুসারীদের সামলানো তখন তার সাধ্যের বাইরে, সমলাবার ইচ্ছাও তার ছিলো কিনা সন্দেহ। লোকজন উল্টোদিকে দৌড় দেয় বটে, তবে রাস্তা থেকে কয়েক গজ ভেতরে মুচিপাড়ার সবেধন নীলমণি। আটটা ঝুপড়ি তছনছ করে দেয় এবং গোটা বারো শুওরকে মেরে ফেলে মাছ মারার বড়ো বড়ো কোঁচ দিয়ে। কেউ কেউ গোলাবাড়ির হাট পর্যন্ত আসে এবং কাদেরের অফিস-কাম-দোকানের ভেতর থেকে শরাফত ও কেরামত শুনতে পায় শালা মুকুন্দ। সাহার দোকানটা ধরা হোক। কিন্তু কালাম মাঝির উচ্চকণ্ঠ ধমকে তারা থামে, আরে এটাক ধরা কী হবি? বাদ দাও। খাড়াও, কালই শালা একটা বন্দুক জোগাড় করি, শালার লায়েবেক জখম করবার না পারলে হামার জিউ ঠাণ্ডা হবি না।
পরদিন গোলাবাড়িতে হাটবার। কিন্তু দোকানপাট সব বন্ধ, লোকজন যা আছে। সবাই চাপা উত্তেজনায় চুপচাপ হাঁটে। আগের রাতে নায়েবের নাকি কাছারিতেই থাকার কথা, বোধহয় খবর পেয়েই বিকালবেলা কেটে পড়েছে। গুজব শোনা যাচ্ছে, নায়েববাবুর কাছ থেকে খবর পেয়ে জমিদারবাবুর বড়ো ছেলে আলি আহমদ সাহেবের কাছে রিপোর্ট করেছে। হাটে হয়তো পুলিস এসে পড়বে, পুলিস এলে কী হতে পারে, কার কার ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি,—এই নিয়ে জল্পনা চলে। আবদুল কাদের কাছারি হামলার ব্যাপারটা জানতো না, গফুর কলুকে সে একটু বকেও দিয়েছে। তবে এই নিয়ে নায়েবের থানা পুলিস করার কথায় সে বেশ রেগে যায়। তার দোকান-কাম-অফিসে বসে প্রথম রাগটা সে ঝাড়ে অনুপস্থিত বাপের ওপর, বাপজানের এটা বাড়াবাড়ি। কাছারিত হামলার খবর শুনলে তার এতো মাথা গরম হয় কিসক? বাপজানের সম্পত্তিত হাত দেওয়ার ক্ষমতা কি নায়েবের আছে? নায়েব আছে কয়দিন? এ্যাসেম্বলিতে জমিদার উচ্ছেদের বিল তো ওঠানোই হছে, কয়দিন পরে জমিদারই পাছার কাপড় তুল্যা দৌড় মারবি, আর নায়েব তো তার চাকর।
আলিম মাস্টার এই বিলের ব্যাপারে তার আপত্তি জানায়, কিন্তু জমিদারগোরে। আবার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে কিসক? তা হলে তো জমিদারগোরে কাছ থ্যাকা জমিদারি একরকম কিন্যাই লেওয়া হচ্ছে। এটা কি জমিদারি উচ্ছেদ হচ্ছে, কও?
সেদিন টাউনে লীগ অফিসে এই নিয়ে কথা উঠেছিলো, মিল্লাত পত্রিকায় এই নিয়ে সরকারকে নাকি খুব একচোট নেওয়া হয়েছে শুনে শামসুদ্দিন খোন্দকার বলছিলো, আরে মানুষকে সর্বস্বান্ত করার রাইট তো সরুকারকে দেওয়া হয় নাই। ইসমাইল হোসেনের কথা শুনে শুনে কাদেরও জমিদারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই বলে আসছে। কিন্তু এই আলিম মাস্টার মুসলিম লীগের কোনো কাজেই ভালো কিছু দেখতে পায় না বলে কাদের এখন সাদেক উকিলের কথার প্রতিধ্বনি করে, ইসলামে কারো সম্পত্তি জোর দখল করার আইন নাই, বুঝলেন? সরকার একজনের সম্পত্তি লিবি দাম না দিয়া, তা কি ইনসাফের কাম হয়, কন?
দেড়শো বছর ধরা জমিদাররা সম্পত্তি ভোগ করিচ্ছে, প্রজার ধনপ্রাণ সব তারাই ভোগ করলো, এতো করার পরেও জমিদারির দাম উশুল হয় নাই? কয়েকটা মানুষ কাছারির সামনে হৈ চৈ করলো, এখন শুনি পুলিস অ্যাসা সবগুলাক বান্দিবার ব্যবস্থা করিচ্ছে।
আলিম মাস্টারের প্রথম কথাটির জবাব দেওয়া কঠিন বলে কাদের প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যায়। তা ছাড়া কয়েকদিন আগে ইসমাইল হোসেনও অবিকল এই কথাগুলোই বললো।
তবে মাস্টারের দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি নিয়ে সে বেশ উৎসাহিত, আরে রাখেন আপনার পুলিস। গোলাবাড়িত পুলিস ঢোকানো অতো সোজা নয়।
কেরামতের সমর্থনের আশায় সে জিগ্যেস করে তাকেই, কী হে কবি, আধিয়াররা পুলিসকে আচ্ছা কোবান দেয় নাই? জয়পুরে পুলিস তো ভালোই মার খাইছিলো, নয়?
কাদেরের কথায় কেরামত চাঙা হয়ে ওঠে এবং একদিন পরেই গান বেঁধে ফেলে। তা ভালো সুযোগও পাওয়া গেলো একটা। গোলাবাড়িতে সেদিন সাদেক উকিল আর শামসুদ্দিন ডাক্তার উপস্থিত। কাছারির হামলার ব্যাপারটা বোধহয় তারা সরেজমিন দেখতে এসেছিলো আলি আহমদের হুকুমেই। কাদেরের অনুমোদনে কেরামত আলি শুরু করলো,
বিসমিল্লা বলিয়া আজি বাঁধিনু শোলোক।
খোশখবর দিব আজি শুন ব্রলোক। আজি দীন গরিবের
আজি দীন গরিবের আঁধার দিনের হইল অবসান।
এই ভারতে কায়েম হবে আজাদ পাকিস্তান। সেথায় সবাই সমান
সেথায় সবাই সমান দীনী ফরমান হইবে সেথায় জারি।
প্রজার মঙ্গল তরে উচ্ছেদ হইবে জমিদারি জমিদারে প্রজায়
জমিদারে প্রায় জোতদার চাষায় একই আসন পান
চাষীমজুর দীনদরিদ্রের মুশকিল আসান।।
গানের তখনো মেলা বাকি, সাদেক উকিল হাত তুলে থামায়, রাখো। তোমরা একটা পয়েন্ট বোঝা না, মোসলমান গরিব ধনীর ভেদাভেদ করলে এখন লাভ হচ্ছে কার? সলভ্যান্ট মুসলমান থাকলে বেনিফিটেড হবে এন্টায়ার মুসলিম নেশন। সলভ্যান্ট লোক না থাকলে ডেভেলপমেন্ট হবে কী করে? এখন গভর্নমেন্ট বিলংস টু আস। দেয়ার শুড বি নো এজিটেশন এগেনস্ট আওয়ার ওন গভর্নমেন্ট। নাজিমুদ্দিন সাহেব সেদিন কারেকটলি পয়েন্ট আউট করলেন, এখন আমাদের ফাইট হলো এগেনস্ট দি হিন্দুস।
কাদের পর্যন্ত সমর্থন করে সাদেক আলিকে, শুনলা তো। তোমার গানে ইসলাম কৈ? ইসলামের মহিমা লিয়া গান লেখো, তেজি গান লেখো মিয়া।
এই গান জুতের না হওয়ায় কেরামতের তেজ নিভু নিভু। আজকাল কোনো গানই সে আর বাঁধতে পারে না। আলিম মাস্টার ঠিকই বুঝেছে, তোমার ভালো গান ঐ তেভাগার কথা লিয়া যিগলা লেখিছিলা উগলানই। তা জয়পুর পাঁচবিবিতে সে ঘটনা। দেখতো, মানুষের তেজ দেখতো আর কলমের আগায় গান ঝরে পড়তে ঝরঝর করে, এমনই তোড় আসতো যে, দোয়াতে কলম চোবাবার তরটাও সইতো না।
আজ তার এই হাল হলো কেন? অথচ কেরামত তো নিজে দেখেছে, চেরাগ আলি মানুষের যে কোনো খোয়াবের তাবির করতে চট করে একটা করে গান ধরতো আর খোয়াবের সঙ্গে তার শোলোক কেমন ফিট করে গেছে চমৎকার। চেরাগ আলি ভঁওতা মারতো, এসব হলো তার পাওনা-গান। তার সেই বইতেও কিন্তু ঐসব শোলোকের কিছুই পাওয়া যায় না। তবে?-তা হলে হয়তো বইতে আঁকা চৌকো চৌকো ঘরের ভেতরে আরবি অক্ষর কিংবা সংখ্যা যেগুলো আছে সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে ফকিরের শোলাকের ইশারা। তমিজের বাপের মতো একটা হদ্দ মাঝি, মুখর মুখ, হাবাগোবা মানুষ,-সেও মানুষের কাছে এতো খাতির পায় ঐ বইয়ের বরকতেই। তার ঐ যে ঝিম ধরে বসে থাকা, রাত হলে বিলের উত্তর সিথান না কী বলে শালারা, সেখানে পাকুড়তলা না কী যেন আছে, সেখানে ঘুমের ধ্যে ঘুরে বেড়াবার মধ্যে কী এমন মাজেজা থাকতে পারে? এসব তো আসলে শালার ব্যারাম! ব্যারাম ছাড়া আর কী? খালি ব্যারামের জোরে কেউ কি আর মানুষের কাছে ইজ্জত পেতে পারে? —আসলে তার বল হলো ঐ ফকিরের বই। বইয়ের জোরে সে ঝিম মেরে বসে থাকে, বইয়ের জোরে সে মানুষকে এভাবে টানতে পারে আর ধরে রাখতে পারে! ঐ বই যদি কেরামতের হাতে পড়ে তো প্রত্যেক দিনই সে মেলা শোলোক বেঁধে ফেলে। সব তার নিজের বাঁধা শোলোক, সেসব গান চেরাগ আলির পাওনা-গানের সুনাম ছাড়িয়ে উঠে যাবে কোথায়! মানুষে খালি শুনবে। আর বৈকুণ্ঠ পর্যন্ত মাথা নাড়বে, বলবে, ই বাপু, গান বান্দিছো একখান। হামাগোরে ফকিরও এংকা শোলোক কোনোদিন পায় নাই। আহা! কেরামতের গা শিরশির করে ওঠে, বইটা যদি নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়!—অবশ্য শীতেও তার গা শিরশির করতে পারে। নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।
সে রাতে শীতও পড়েছিলো! গোলাবাড়ি হাটে সব কয়টা দোকানঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিলো ভেতরের মানুষেরা। বটতলার বাঁধানো চাতালে বসে কেরামত দুই হাত তফাতের কিছু দেখতে পায় না। ঘোলাটে সাদা কাদার মতো থকথকে কুয়াশায় গাঁথা হতে থাকে তমিজের বাপের ঘরের চৌকাঠ। চৌকাঠের ওপারে মাটির মেঝেতে হাঁটু ভেঙে লম্বাটে পায়ের পাতায় চাপ দিয়ে বসে থাকে কুলসুম। বসে-থাকা অবস্থাতেও মেয়েটাকে কী লম্বা দেখাচ্ছে গো! আর কী সোন্দর তার গলার রেখা! গলায় ঘাগের আভাসমাত্র না থাকায় বুক তার ফুটে উঠেছে মস্ত দুটো ফুলের মতো। না, না ফুল নয়, জমজ গম্বুজের মতো। জোড়া গম্বুজের মাঝখানে এবং প্রত্যেকটি গম্বুজের চূড়ায় সেজদা দেওয়ার জন্যে কেরামতের মাথা নুয়ে নুয়ে পড়ে। জোড়া গম্বুজে, না, জমজ গম্বুজে সেজদা দেওয়ার জন্যে কেবল মাথা নয় তার গোটা শরীর এতোটাই কাঁপে যে, ভয় হয়, বটতলার ঘোলা কুয়াশার ঝাঁপিয়ে পড়ে খোদাই-করা পাথরের গম্বুজ দুটোকে সে তছনছ করে ফেলবে। হুঁশিয়ার হয়ে সে একটু সরে বসে। তখন তার জিভে সুড়সুড়ি লাগে, জিভে ফুসকুড়ির মতো শোলোক ফুটে উঠছে। কেরামতের খুশি খুশি। লাগে। এইবার যদি এসে পড়ে পাকিস্তানের তেজি গান! গান তেমন তেজি হলে কাদেরই টাউন থেকে খরচপাতি করে ছাপাবার ব্যবস্থা করবে। গান একবার চালু হলে কতো মানুষ কিনবে, পাইকারদের দিয়ে সে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। পাকিস্তানের তেজি গান ভেবে বিড়বিড় করলে ওঁয়া ওঁয়া করে বেরিয়ে আসে নতুন শোলোকের একটি চরণ,
সিনাতে খোদাই করা জমজ গম্বুজ।
কিন্তু এর পরের চরণ আর আসে না। এটা কী ধরনের শোলোক তার মাথায় পয়দা হয়? এটা তার নিজের বাঁধা শোলোকের লাইন তো? কী জানি, সেদিন কুলসুমের ঘরের দরজার চৌকাঠে যে দুটো চরণ তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো বমির মতো, সেটাও কি তার বাঁধা? কৈ, তার কোনো শোলোকের সঙ্গে তো এর কোনো মিল নাই। তা হলে, এটা কি বেরিয়ে এসেছে ফকিরের ঐ বইয়ে পাওয়া কোনো ইশারা থেকে? কুলসুম কি বই তাকে কিছুতেই দেবে না?
মণ্ডলবাড়িতে একদিন গিয়ে ফকিরের বই হাতে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখে কেরামত। কাদের ছিলো না, তবে দেখা হলো আবদুল আজিজের সঙ্গে। আজিজের মন খারাপ, বেশ মুসিবতে আছে। ফসল কাটার সময় নিয়ম মাফিক বৌকে নিয়ে এসেছে, কিন্তু ধানের মাপজোকের দিকে হামিদার এবার মন নাই। তার ভাই আহসান আলি যে কলকাতায় দাঙায় মরে যায় নি, এই ধারণা এখন তার বিশ্বাসে দাঁড়িয়েছে। জয়পুরের কাছেই খঞ্জনদিঘির পীরসাহেবের কাছে তাকে নিয়ে গিয়েছিলো আজিজ। হুজুর জানিয়েছে যে, আহসান আলি মরে নি। দক্ষিণের কোনো বড়ো শহরে ছোটো গলির একটি ঘরে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। শহরটি যে কলকাতা এ তো বোঝাই যায়, কিন্তু গলির ঠিকানা পীরসাহেবে দেয় নি।
এরপর হামিদা প্রথমদিকে সপ্তাহে দুই দিন, পরে চার দিন এবং দিন পনেরো হলো রোজ রোজ স্বপ্ন দেখছে : মোটাসোটা কয়েকটা টিকিওয়ালা লোক খালি গায়ে খাটো ধুতি পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আহসানকে ঘিরে, তাদের সর্দারের কপালে লাল চন্দন লাগানো, হাতে সিঁদুর লাগানো খাড়া খাড়াটা ঝুলছে আহসানের মাথার ওপরে, তার কোপ নিচে পড়তে শুরু করতেই, আহসানের গলায় কি মাথায় ঘা পড়ার আগেই হামিদার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙে তার নিজেরই বিকট চিল্কারে, জেগে উঠে সে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আর এবারে শ্বশুরবাড়ি এসে প্রথম রাত্রেই স্বপ্নে সিঁদুরমাখা খাড়ার নিচে আহসানের মুখে একটি কচি চেহারার লক্ষণ দেখে মানোযোগ দিয়ে লক্ষ করে!-আরে, এ তো তার হুমায়ুনের মুখ। নরণাং মাতুলক্রমঃ প্রবাদটি অনুসারে হামিদার এই স্বপ্নসিরিজের অনেক আগে থেকেই ছেলেবেলার আহসানের সঙ্গে হুমায়ুনের স্বভাব, আচরণ ও চেহারায় অনেক মিল ছিলো; আর স্বপ্নে দুজনকে অভিন্ন শরীরে দেখে হামিদা ভয় পায়, আবার একটু খুশিও হয় বৈ কি?-মামা ভাগ্নে এক সঙ্গে, এমন কি একই শরীরে থাকলে সিঁদুরমাখা খাড়াটা হয়তো ঠেকাতে পারবে।
এসব হলো তার ঘুমের ভেতরকার ভয় এবং ঘুমের ভেতরকার ভরসা। কিন্তু জাগরণে সে বড়ো ধন্দে পড়ে : আহসান তো আসলে বেঁচেই রয়েছে, বেঁচে থাকতে সে হুমায়ুনের সঙ্গে মিলিত হয় কীভাবে? এখন মরার পর হুমায়ুন যদি তাকে কোনো ইঙ্গিত দেয় এই আশায় হামিদা সুযোগ পেলেই বাড়ির পালানে গোরস্থানের দিকে রওয়ানা হয়। মেয়েমানুষের গোরস্থানে যাওয়া জায়েজ নয় বলে বাড়ির লোকজন তার দিকে কড়া নজর রাখে। হামিদার ধন্দের তাই আর সুরাহা হয় না। হয়তো এ জন্যেই যতোক্ষণ জেগে থাকে মাথাটা তার দপদপ করে। এই শীতের বিকালে এমন কি সন্ধ্যাবেলাতেও তাকে প্রায়ই গোসল করতে হয়। এতে তার ঠাণ্ডা লাগে না, সর্দি হয় না, এমন কি গা গরম পর্যন্ত করে না। শাশুড়ি তাই অসন্তুষ্ট, এতো পাথরের মতো শরীরের বৌ থাকলে ঘরে নক্ষী থাকে না। মণ্ডলের ছোটোবিবি অবশ্য তাকে সাব্যস্ত করে মাথাখারাপ বৌ বলে, ইগলান পাগলি হবার চিহ্ন গো। পাগলের শরীলে শীত কম, তার তাপ বেশি। সব কিছুর মতো এই ব্যাপারেও বড়োবিবি তার সঙ্গে একমত নয়, কিসের পাগলি? উগলান সব ঢং। পাগলের চোখেত বলে নিন্দ থাকে? পাগলা মানুষ এতো নিন্দ পাড়ে? তা কথাটা ঠিক। সন্ধ্যা হতে না হতে হামিদার চোখ ঢুলুঢুলু হতে থাকে, তার হাই ওঠে এবং প্রায়ই না খেয়ে সে শুয়ে পড়ে। ভাই ও বেটার হালহকিকত জানতে ঘুম ছাড়া তার আর কোনো আশ্রয় আছে?
আবদুল আজিজের হয়েছে বিপদ। ভাই আর বেটাকে স্বপ্নে দেখার ভয়ে ও আশায় হামিদার উৎকণ্ঠা ও প্রস্তুতি দেখতে দেখতে সে অতিষ্ঠ, অথচ ঐ স্বপ্নের বখরা তার জোটে না। সে একজন গভর্নমেন্ট এমপ্লয়ি, এর উপর মাসখানেক হলো টাউনে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে অন প্রোমোশন। টাউনের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে হেড এ্যসিস্টট্যান্ট হয়েও বাড়িতে এতো জ্বালা সে আর কাহাতক সহ্য করে? বাড়ির বৌয়ের আচরণে নানাজনের কৌতূহল, কৌতুক, বিরক্তি ও হতাশার সবই তো বেঁধে আজিজেরই গায়ে।
আবার ঘন ঘন বাড়ি না এলেও কথা শোনায় কাদেরও। তার প্রমোশন দিয়ে টাউনে ট্রান্সফারটা অবশ্য কাদেরের তদবিরের ফলেই হয়েছে। টাউনে ছোটোখাটো একটা বাড়ি ভাড়া করে কাদের এখন কন্ট্রাকটরি শুরু করেছে, তাই বাড়ির সব সামলাতে হয় আজিজকে। টাউনে সে উঠেছে শ্বশুরবাড়িতে, কিন্তু একদিন পর পর বাড়ি না এলে কাদের রাগ করে। ইটখোলার দেখাশোনা সব তার ওপর। মুশকিল হলো এই যে, এটা শুরুও তো হয় তার হাতেই। হুমায়ূনের কবর বাধাবার পর অনেকটা ইটসিমেন্ট বাঁচলে প্রথমে পাকা করলো কলপাড়। পাকা কলপাড়ের পানি গড়াতে শুরু করলো পায়খানা যাবার পথে। গোরস্থানে যাবার পথও তো ঐটাই। গোরস্থান থেকে দুটো দুটো করে ইট বসিয়ে একেবারে উঠান পর্যন্ত নিয়ে আসা হলো। তখন দুই ভাইয়ের মাথায় চাপলো বাড়ি পাকা করার হাউস। নায়েবের ভয়ে শরাফত একটু দোনোমননা করছিলো, তাতে কাদেরের জেদ চড়ে গেলো দশগুণ, মোসলমানের বাড়ি পাকা হলে নায়েবের গাও কামড়ায়? কাদের অবশ্য টাউন থেকেই ইট আনতে চেয়েছিলো। তাতে ঝামেলা মেলা, খরচাও পড়ে বেশি। বিলের উত্তরে জমি পত্তন নিয়ে আজিজ ইটখোলা করলো। বাড়ি পাকা হলো, কিন্তু ইটের ভাটা আর বন্ধ হলো না। ইটের ভাটা সম্পূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার; হাজার চেষ্টা করেও, হাজার হুঁশিয়ার থেকেও কতো ভাঁটা থেকে থার্ড ক্লাস ইট বেরোয়, ঝামা বেরোয়। কিন্তু আজিজের ইট এ পর্যন্ত খারাপ হলো না। প্রথম প্রথম মানুষ কতো কথা বলেছে, জায়গাটা খারাপ, এটা হবে সেটা হবে। মুকুন্দ সাহার দোকানের ঐ বেয়াদব ছোঁড়াটা একদিন আজিজের সামনেই বললো, মুনসি সহ্য করবি না। মুনসির ইশারা পালে সন্ন্যাসী ঠাকুর কী করে না করে কওয়া যায় না। তা এখন মুকুন্দ সাহা তো নিজেই হঁটের ব্যবসা শুরু করলো এই বঁটখোলা থেকেই। কাদেরের কন্ট্রাকটরি করতে ইট যা লাগে সব তো টানে এখান থেকেই। চাকরিতে বলো, ব্যবসায় বলো, আল্লার রহমতে আজিজের দিন এখন ভালোই।
কিন্তু বৌ এরকম করলে তার আর কিসের সুখ? কেরামতকে দেখে প্রথমে সে তেমন আমল দেয় না, কাদের বাড়ি নাই।
কেরামত হাসে, আজ তো আসার কথা তারপর সে জানতে চায়, ভাবিসাহেবার অসুখ শুনিচ্ছিলাম! গাঁওশুদ্ধ মানুষের কৌতূহল আজিজের আর সহ্য হয় না। জবাব না দিয়ে বাড়ির ভেতরে সে যাবার জন্যে পা তোলে, কেরামত বলে, তমিজের বাপ কিন্তু বই দেখ্যা যা কছিলো, জয়পুরের পীরসাহেব শুনলাম একই কথা কছে?
আবদুল আজিজ ঘুরে দাঁড়ায়, তমিজের বাপ কী বলছিলো? ঐ যে উঠানে দাগ কেটে কেটে কী যেন বললো, না?
এলাকার সব মানুষের মতো কেরামতও জানে, তমিজের বাপ বই দেখ্যা কলো, ভাবিসাহেবার ভাই মরছে কি-না কওয়া যাচ্ছে না। অমবস্যার রাতে ফির কবার চাইছিলো, আপনেরা তো আর আসলেন না।
আজিজ এবার ভাবনায় পড়ে। তমিজের বাপকে একবার খবর দেওয়া যায় না? কিন্তু বেটার বৌয়ের এই রোগ রাষ্ট্র করতে শরাফতের ঘোর আপত্তি। কাদের আবার ফকিরালি পানিপড়া সহ্য করতে পারে না। কেরামতের সঙ্গে আজিজ একটু হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে নিচু গলায় বলে, মুশকিল, তমিজের বাপেক বাপজান একদম দেখবার পারে না। তমিজটা খালি খালি জেলের ভাত খাচ্ছে। সে যা বলতে পারে না তা হলো এই যে, এসব জুলুম করলে বাড়িতে রোগবালাই লেগেই থাকবে। তবে এটা বলতে পারে তমিজের বাপ হয়তো অসুখটার কারণ–।
কেরামত আলি সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে একমত পোষণ করে এবং আবার ভিন্নমতও জানায়, জে। তমিজের বাপ এই বাড়িত আসলে আবার বড়োমিয়া কোদ্দ করবি। আর তমিজের বাপ তো জাহেল মানুষ। তার জারিজুরি সব পাওয়া যায় ঐ ফকিরের বইয়ের মদ্যে। বইটা যদি নেওয়া যায় তো–।
ঐ ছেঁড়াখোঁড়া বইটা? তমিজের বাপ তো লেখাপড়াই জানে না। ঐটা দেখে মাটিতে কীসব দাগ কাটে।
বইয়ের মধ্যে ইশারা দেওয়া আছে। ঐ বই আমার হাতে পড়ে তো আমিও বুঝমু। আপনেও বুঝবেন।
তা ঐ বইটা চায়া আনলেই তো হয়। ও কি বই দিবি?
আপনে হুকুম করলে বাপ বাপ করা দিয়া যাবি।
না না, জুলুম করার দরকার নাই। তমিজের বাপের শক্তিতে আজিজের একটু ভয় আছে, এমনি যদি দেয়। নিয়া আসো না। তাড়াতাড়ি করো। বাবরের মাকে বোধহয় এখানে রাখা যাবে না বেশিদিন।
না। দেরি হবি না। বই আমি নিয়া আসমু।
ক্যা গো, মণ্ডলবাড়িত শুনলাম, তমিজ বলে বারায়া আসিচ্ছে। তদবির চলিচ্ছে, না?
কেটা কলো? তমিজের বাপের হিম গলায় কোনো আশা বা সন্দেহ বোঝ মুশকিল। কালাম মাঝি তো দৌড়াদৌড়ি খুব করছে, একদিন পর পর টাউনে যায়, ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে দেখা করে, ভোটের আগে দেওয়া তার ওয়াদার কথা নাকি মনেও করিয়ে দেয়। উকিলের পেছনেও কালাম মাঝি খরচ করেছে মেলা। তার ছেলের জন্যে কালাম এতো ঢালছে, তমিজের বাপ সে টাকা শোধ করবে কী করে? কালাম মাঝি কাগজে তার একটা টিপসই নিয়ে তমিজের বাপের ভিটাসুদ্ধ ঘরগুলো নিজের নামে করে নিয়েছে। কুলসুম একটু গাঁইগুঁই করছিলো, তার ভাবনা, বুড়া মরলে তার ঠাঁই হবে কোথায়? কালাম মাঝি তো হেসেই অস্থির, আরে এই বাড়ি হামি লিয়া করমু কী? বাড়িঘরভিটা তোমারই থাকলো, তোমরাই ভোগ করবা। ট্যাকা দিলে একটা কাগজ রাখা লাগে না? না হলে ঐ শালা মণ্ডলই একদিন কবি, তোর ভিটার পালান তো হামাক বেচিছুই, ঐ সাথে বাড়িঘরও বেচা হয়া গেছে। আরে জাল দলিল একটা বানাতে ঐ বুড়ার আর কতোক্ষণ?
তা ভিটাবাড়ি লিখে দেওয়ার পর তমিজের বাপের আশা হয়েছে, তমিজ এবার ছাড়া পেতে পারে। চেরাগ আলি বলতে, মানুষের একদিকে লোকসান মানেই অন্য দিকে কোথাও লাভের ইশারা। বলতো,
বানেতে ভাসিল ধান না ভাঙিও মন।
পেঁয়াজরসুনে হইবে দ্বিগুণ ফলন।।
তমিজের বাপ ও কুলসুমের দিক থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে কেরামত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আজিজ ভাই তমিজের জন্যে আফসোস করে খুব। তার বৌটা ক্যাংকা। হয়া গেছে, হামাক কয়, তমিজের বাপ ছাড়া তার ব্যারাম আর কেটা ধরবার পারবি না।
তার আর দেখার কী আছে? ভাইয়েক লিত্যি খোয়াবের মধ্যে দেখে। ভাই তো, তার মর্যাই গেছে। কুলসুমের এরকম ঠাণ্ডা কথায় কেরামত চুপসে যায়। হামিদার ভাইয়ের মৃত্যু সম্বন্ধে কুলসুমের এরকম নিশ্চিত ধারণা তার পছন্দ হয় না, একটা ভুল গণনা যদি বোনের কলজেটাকে জুড়াতে পারে তো কার কী লোকসান?
ঐ খোয়াবের কথাই তো হামি কলাম, আজিজ ভায়েক কলাম। আরে, ফকিরের বই তো যি সি বই লয়। খোয়াবের যিগলান তাবির ল্যাখা আছে, তোমরা তো বুঝবার পারো না। তমিজের বাপ গেলে ভালো হয়। না হলে হামাক বইটা দাও, তমিজের বাপের কাছ থ্যাকা হামি না হয় শিখ্যা পড়া লিয়া মণ্ডলবাড়িত যাই। কেরামতের এতো কথাতেও কুলসুম কিছু না বললে কেরামত জানায়, আজিজ হাজার হলেও একটা অফিসার মানুষ। তমিজের মুক্তির জন্যে সেও তো চেষ্টা করতে পারে। এরকম সুযোগ সহজে আসে না। তমিজ জেলের ভাত খাবে আর কতোদিন?
বছর ঘুরতে আর এক মাস বাইশ দিন। কুলসুমের সংক্ষিপ্ত দীর্ঘশ্বাসে কেরামত ভরসা পায়। ব্যাকুল হয়ে সে জানায়, বইটা একবার মণ্ডলবাড়িতে নিয়ে গেলে আজিজ হয়তো তার বাপের হাতে পায়ে ধরে মামলাটা উঠিয়েও নিতে পারে। কুলসুম কিছুই বলে না। তমিজের বাপ একটু উসখুস করলেও কুলসুমের চেহারায় পাথরের মূর্তি অবিচল থাকে। কেরামত বিরক্ত হয় না, বরং তার বুকের গম্বুজে পাথরের শক্তি তাকে বইটা হাত করার জন্যে তাকে আরো তাগাদা দিতে থাকে। কেরামতের সরব ও নীরব অনুনয়ে কাজ হয় না। কুলসুম চুপচাপ উঠানে গিয়ে বিপরীত দিকে মুখ করে, বুক বিপরীত দিকে রেখে বসে থাকে।
তমিজের বাপ জানে, আর বেশি চাপাচাপি করলে কুলসুম রান্নাবান্না না করে উঠানেই শুয়ে থাকবে। তখন তার খাওয়া দাওয়াও বন্ধ। তমিজের বাপ আস্তে করে বলে, আজ থাক। দেখি।