দু শো-আড়াই শো জন যুবক মিলে একটা পুকুর কাটতে শুরু করেছে। পাশের গ্রামের চাষীদের কাছ থেকে যে যা পারে খন্তা-কোদাল-শাবল ধার করে এনেছে, ঝুড়ি-ঝোড়াও যোগাড় হয়েছে কিছু। খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে সকাল থেকে, দুপুরবেলাতেই আকাশে ঘনাচ্ছে কালো। মেঘ, আজ সন্ধেবেলা আবার নির্ঘাৎ ঝড় বৃষ্টি নামবে, কাজ শেষ করে ফেলতে হবে তার আগে আগে।
একেবারে শুকনো জায়গায় পুকুর কাটা হচ্ছে না, এখানে একটা কাদাজলের ডোবা ছিল আগেই। কাছাকাছি কোনো জনবসতি নেই, চার পাশটা অনেকটা পতিত জমির মতন। এখানে কয়েকসার নতুন ক্যাম্প বসাবারও জায়গা পাওয়া যাবে।
এখন যুদ্ধের চেয়ে পুকুর খোঁড়াটাই বেশী জরুরি। বেলুনিয়া পতনের পর বোঝা গেছে, বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু আক্রমণ ও প্রতিরোধ করে মুক্তিযুদ্ধ চালানো যাবে না। যুদ্ধের প্রস্তুতি ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে।
কিন্তু প্রতিদিন শত শত যুবক আসছে মুক্তি যুদ্ধের সৈনিক হবার জন্য নাম লেখাতে। ভারতীয় সীমান্তের ক্যাম্পগুলিতে আর তিল ধারণের জায়গা নেই। এদের ট্রেনিং দেবার উপায় তো দূরে থাক, শুধু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেই হিমসিম খাবার মতন অবস্থা সেক্টর কমাণ্ডারদের। অথচ ছেলেগুলি আসছে প্রচণ্ড উদ্দীপনা এবং দেশ স্বাধীন করার মৃত্যুপণ নিয়ে, এদের ফিরিয়ে দেওয়াও যায় না! তাঁবুগুলির অতি জীর্ণদশা, ইতিমধ্যে নেমে গেছে প্রবল বর্ষা, এখন কোনোক্রমে মাথা গোঁজাই একটা বড় সমস্যা। দু’বেলা আহার্যের মধ্যে শুধু চাল আর ডাল, তাও দু’একদিন অন্তরই চাল ফুরিয়ে যাওয়ায় আবার বস্তা বস্তা চাল যোগাড় করার জন্য মাথা ঘামাতে হচ্ছে। প্রতিবছরই জুন-জুলাই মাসে চালের দর বাড়ে, এবার আরও বেড়েছে।
খাদ্যের চেয়েও পানীয় জল এবং গোসল করার পানির সমস্যা কম জরুরি নয়। সীমান্ত। ক্যাম্পগুলির কাছাকাছি পুকুরের জল দূষিত হয়ে গেছে। হুড়োহুড়ি করে যে দু’চারটি টিউবওয়েল খোঁড়া হয়েছিল, তাও অকেজো হয়ে যাচ্ছে অতি ব্যবহারে। খাদ্যের চেয়েও পানীয় জলের প্রয়োজনীয়তা যে কত বেশী, তা বোঝা যায় এইসব সঙ্কটের সময়ে। দু’একটি ক্যাম্পে কলেরা শুরু হতেই ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক, তার ওপর শুরু হয়েছে অদ্ভুত এক চোখের অসুখ। হঠাৎ চোখ লাল হতে শুরু করে, তারপর চোখের কোণে পুঁজ জমতে থাকে। সেই সঙ্গে দুর্বিষহ জ্বালা। ডাক্তাররা এই রোগের নাম বলেন কনজাংকটিভাইটিস। কিন্তু লোকের মুখে মুখে এ রোগের নতুন নাম হয়েছে জয় বাংলা! কেউ বলে, এই রোগ আসছে ঢাকা থেকে, কেন না পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যেও এই চোখ লাল করা রোগ ছড়িয়েছে, আবার কেউ বলে ভারত থেকেই আসছে এই ভাইরাস! মোটকথা, ঢাকা-আগরতলা-কলকাতা, কোথাও এই বিরক্তিকর রোগের উপদ্রব কম নয়। ঢাকাতে কলেরাও শুরু হয়ে গেছে এবং পাকিস্তান রেডিও অশ্রান্ত ভাবে প্রচার করে যাচ্ছে যে এই কলেরার বীজাণু ছড়াচ্ছে ভারত।
চোখের রোগটার কোনো ওষুধ নেই, শুধু জলের ঝাঁপটা দিলে খানিকটা জ্বালার উপশম হয়। কিন্তু প্রাণে ধরে কি কেউ নিজের চোখে দুর্গন্ধ নোংরা জলের ঝাঁপটা দিতে পারে! তাই গত দু’দিন ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলিতে অন্য সব কাজ বন্ধ রেখে শুধু নতুন পুকুর কাটার উদম চলছে।
যারা মাটি কাটছে ও মাটি বইছে, তাদের দেখলেই বোঝা যায় যে, তারা জীবনে কখনো এই কাজ করেনি। অধিকাংশই কলেজের ছাত্র, সচ্ছল বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে এসে তাদের পক্ষে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ দেওয়া তবু সহজ, কিন্তু পুকুর কাটা, কলেরা রোগীর সেবা করা, কিংবা ছেঁড়া তাবু, বাঁশ, চাটাই, বেড়া, হাঁড়িকুড়ি মাথায় করে বয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া এদের পক্ষে অনেক শক্ত কাজ। টি ভারতীয় সীমান্তের ঠিক ধার ঘেঁষে ঠাকুর গাঁও শিবিরের কাছাকাছি দুটি পুকুরই একেবারে নোংরা হয়ে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই নতুন পুকুর খোঁড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এত কষ্টের মধ্যেও হাস্য পরিহাস বন্ধ হয়নি।
টাঙ্গাইলের এক ছেলে গৃহত্যাগ করার সময় তাদের পারিবারিক সম্পত্তির মধ্যে থেকে একটি পুরোনো তলোয়ার সঙ্গে এনেছিল, শাবল-কোদাল কিছু যোগাড় করতে না পেরে সে সেই তলোয়ার দিয়েই মাটি খুঁড়ছে, তার কাছাকাছি লোকেরা প্রবল হা হা শব্দে হাসছে। তলোয়ার দিয়ে পুকুর খোঁড়া, এটা হাসির ব্যাপার নয়! কাদার মধ্যে বারবার আছাড় খেয়ে কারুর চেহারা হয়েছে ভূতের মতন।
বিকেলের দিকে সনে হাওয়া ও টিপিটিপি বৃষ্টি শুরু হলো। দুপুরে কেউ কিছু খায়নি, তবু এই বৃষ্টির মধ্যেও কেউ কাজ ছেড়ে চলে গেল না। আজ সন্ধের মধ্যে শেষ করতে পারলে বৃষ্টির জলে পুকুর ভরে যাবে। কুমিল্লা ভিকটোরিয়া কলেজের অধ্যাপক হাসমত সাহেব সবকিছু দেখাশুনোর দায়িত্ব নিয়েছেন, রোগা-পাতলা মানুষটি পুকুরের চার ধার ঘুরে ঘুরে লাফিয়ে লাফিয়ে বলছেন, হাত চালাও! হাত চালাও! ভাই ও বন্ধু হাত চালাও, হাত চালাও! সন্ধ্যার সময় গরম গরম খিচুড়ির সাথে আইজ ডিম সেদ্ধ পাবা, হাত চালাও, হাত চালাও!
হঠাৎ হাসমত সাহেবের নজর গেল একজনের প্রতি। টাউজার্স ও গেঞ্জিপরা এই ব্যক্তিটি অসম্ভব রূপবান, গায়ের রং রক্তচন্দনের মতন, বেশ দীর্ঘকায় ও ছিপছিপে, তীক্ষ্ণ নাক, ওষ্ঠাধর এমনই পাতলা যে নারীদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যদিও সারা মুখে অল্প অল্প দাড়ি, তবু এই মানুষটিকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হয় হাসমত সাহেবের। এই লোকটি কারুর সঙ্গে কোনো কথা বলছে না, নিজেই কোদালে মাটি কেটে একটা ঝুড়িতে ভরছে, তারপর নিজেই সেটা মাথায় নিয়ে ওপরে উঠে এনে ফেলে যাচ্ছে নির্দিষ্ট জায়গায়। লোকটার চোখেমুখে যে চাপা আভিজাত্যের ছাপ, তাতেই বোঝা যায় যে, তাকে অন্য কোনো সম্মানীয় কাজ দেওয়া উচিত ছিল। বয়েসেও সে অন্যদের চেয়ে বড় মনে হয়।
হাসমত তবু বিশেষ মাথা ঘামালেন না। চেনা লোক হলেও তার সঙ্গে এখন আলাপ করার সময় নয়। তা ছাড়া চেনা কারুর সঙ্গে কথা বলতেও ভয় হয়, প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ট্র্যাজিক কাহিনী বহন করে এনেছে। কত আর শোনা যায়! সারা বাংলাদেশে পাক বাহিনীর অত্যাচার সমস্ত বিশ্বাসযোগ্যতার সীমানা ছাড়িয়ে গেছে।
খানিকবাদে এক জায়গায় হৈ চৈ ও ক্ষুব্ধ চিৎকার শুনে হাসমত সেদিকে ছুটলেন। এখানে মারামারি লেগে গেছে। এরকম মারামারি লাগছে প্রায়ই। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়বার জন্য ছুটে এলেও এইসব যুবকেরা এখনো পুরোনো রাজনৈতিক দলাদলি কিংবা ব্যক্তিগত শত্রুতা পুরোপুরি ভুলতে পারেনি। শরীরের বিষ ফোঁড়ার মতনই ক্রোধ ও বিদ্বেষ মাঝে মাঝে খুঁসে ফুঁসে ওঠে। মুক্তি যোদ্ধাদের ক্যাম্প চালাতে গিয়ে হাসমত গোড়া থেকেই অনুভব করছেন যে শুধু দেশপ্রেমের আবেগই যথেষ্ট নয়, একটা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে গেলে প্রত্যেককে আগে কঠোর ভাবে নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষার ট্রেনিং দেওয়ারও খুবই দরকার ছিল। কিন্তু তার সময় কোথায়? দলে দলে ছেলেরা আসছে, তাদের চার-পাঁচ দিন কোনরকমে প্রাথমিক গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরা একটা রোমান্টিক যুদ্ধের স্বপ্ন চোখে নিয়ে এসেছে, প্রত্যেকেই কোনো না কোনো অ্যাকশানে যেতে চায়, কিন্তু প্রত্যেকের হাতে তুলে দেবার মতন অস্ত্রও নেই, তা ছাড়া এলোমেলো অ্যাকশনেরও কোনো মানে হয় না।
হাসমত ছুটে এসে দেখলেন, সেই ফর্সা, সুদর্শন পুরুষটিকেই মাটিতে শুইয়ে ফেলে তার বুকের ওপর চেপে বসেছে একজন, আর দশ-বারোজন এক সঙ্গে চ্যাঁচাচ্ছে, মার, মার, খতম কইরা ফ্যালা!
হাসমত রুক্ষভাবে অন্যদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে এগিয়ে গিয়ে বললেন, থাম, থাম! কী হইছে, কী হইছে আগে ক!
সবাই চেঁচিয়ে উঠলো, স্পাই! স্পাই! রাজাকার! আলবদর!
কয়েকজন শাবল, খন্তা উচিয়েছে, এখুনি লোকটির মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে, হাসমত দু’হাত তুলে গলা ফাটিয়ে বললেন, খবর্দার, কেউ মারবা না! সেকটর কমাণ্ডারের অর্ডার, স্পাই ধরা পড়লে হ্যাঁর কাছে নিয়া যাইতে হবে! ইন্টারোগেশান কইরা খবর বাইর করতে হবে! অরে আমার হাতে দ্যাও!
স্পাই শব্দটাই এমন যে একবার উচ্চারিত হলেই বিদ্যুৎ তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, স্পাইকে খুন করার আগ্রহে ছড়িয়ে পড়ে দারুণ উল্লাস। ফর্সা লোকটির বুকে যে চেপে বসে আছে তার নাম সিরাজুল। দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এর মধ্যেই তার খুব নাম ছড়িয়েছে। একটি প্লাটুনের নেতৃত্বের ভার তার ওপর। সেই সিরাজুল রক্ত চক্ষু তুলে বললো, সার এডারে আমি ভালো। কইরা চিনি, আমি নিজের হাতে এড়ারে শ্যাষ কইরা দিতে চাই!
হাসমত কঠোরভাবে বললেন, ছাড় অরে তুই! উইঠ্যা আয়!
কোথা থেকে দড়ি যোগাড় হয়ে গেল, লম্বা লোকটির হাত দুটো বাঁধা হলো পিছমোড়া করে। তার নাক দিয়ে দরদর করে গড়াচ্ছে রক্ত, একটা চোখ বুজে গেছে, হাসমত আর এক মিনিট দেরি করলে একে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। অন্যরা চ্যাঁচামেচি করে যা অভিযোগ জানাচ্ছে তার মর্মার্থ এই যে, এই লোকটা গত তিন চার দিন হলো এখানকার ক্যাম্পে যোগ দিয়েছে। কিন্তু সে কারুর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি, এর নাম কেউ জানে না, কোথা থেকে এসেছে তারও কোনো উদ্দেশ নেই। এর সম্পর্কে অনেকের মনেই সন্দেহ জেগেছিল, আজ সিরাজুল একে একজন কোলাবোরেটার হিসেবে চিনে ফেলেছে!
হাসমত বললেন, আমি এরে মেজর সাহেবের কাছে নিয়ে যাইতাছি, তোমরা কাজ করো, কাজ করো! কাজ শেষ না করলে ছুটি নাই!
যেন অন্যদের খুশি করার জন্যই হাসমত সেই বন্দীর গালে এক থাপ্পড় কষিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই, তুই কথা কস্ না ক্যান? তোর নাম কী?
থাপ্পড় খেয়ে লোকটির মুখখানা একদিকে বেঁকে গেল, তবু কোনো শব্দ বেরলো না।
সিরাজুল বললো, সার, আমিও আপনার সাথে যামু। এডারে আমি কিছুতেই ছাড়ুম না।
তারপর সে লোকটিকে এক ঠ্যালা মেরে বললো, চল, হারামজাদা!
অন্য লোকজনদের ছাড়িয়ে, ফাঁকা মাঠের মধ্যে এসে সিরাজুল হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো, গভীর বিস্ময়ে মুখ ফিরিয়ে হাসমত জিজ্ঞেস করলেন, তোর আবার কী হইলো? এই সিরাজুল, কী হইলো?
কান্নার আবেগে সিরাজুল কোনো কথা বলতে পারছে না। যেন তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে, মাটিতে বসে পড়ে সে প্রায় দম বন্ধ গলায় চিৎকার করতে লাগলো, মনিরা, মনিরা!
সিরাজুলের মতন একটা বেপরোয়া জেদী ছেলে যে এরকম ভাবে কাঁদতে পারে তা যেন। বিশ্বাস করতে পারছেন না হাসমত। তিনি বারবার হাত বাঁধা লোকটির মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। এখন আরও বেশী চেনা চেনা লাগছে। মুখোনি গভীর বিষাদে মাখা। কিন্তু যার উপলব্ধি গভীর নয়, তার মুখে এরকম বিষাদ ফুটতে পারে না। এরকম চেহারার মানুষ কি গুপ্তচর হতে পারে? গ্রামের অশিক্ষিত গুণ্ডা ধরনের ছেলেদের নিয়েই রাজাকার, আলবদর বাহিনী গড়েছে পাকিস্তানী সরকার। এই মানুষ কিছুতেই সে রকম হতে পারে না।
হাত বাঁধা লোকটি এবার আস্তে আস্তে বললো, আমি মানিরাকে অনেক খুঁজেছি, সিরাজুল, বিশ্বাস করো—
সেই কণ্ঠস্বর শুনেই চিনতে পারলেন হাসমত। এ যে তাঁর সহপাঠী। বাবুল চৌধুরী, তাঁদের সময়কার ফাস্ট বয়!
তিনি বলে উঠলেন, বাবুল? আমারে চিনতে পারস নাই? আমি হাসমত। বাবুল, তুই এইখানে।
সিরাজুল কান্না থামিয়ে লাফিয়ে উঠে বাবুল চৌধুরীর টুটি চেপে ধরে বললো, আজরাইল! এই আজরাইলডা আমার সর্বনাশ করছে! অরে আমি নিজের হাতে।
অতি কষ্টে সিরাজুলের হাত থেকে বাবুলকে ছাড়িয়ে হাসমত তাকে নিয়ে গেলেন সেকটর ওয়ান-এর কমাণ্ডার মেজর রফিকুল ইসলামের কাছে। মেজর রফিকুল ইসলাম তখন আরও কয়েকজন সামরিক অফিসারের সঙ্গে জরুরি বিষয়ে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন, তিনি হাসমতের ওপরেই ভার দিলেন এই বিবাদের নিষ্পত্তি করতে।
একটা ফাঁকা তাঁবুতে বাবুল চৌধুরীকে নিয়ে বসলেন হাসমত, কিন্তু সিরাজুল এমনই চ্যাঁচামেচি করতে লাগলো যে আসল ঘটনা জানারই কোনো উপায় রইলো না। তার চিৎকার শুনে আশেপাশে অন্য লোকও জড়ো হয়ে যায়। একটু পরে অবশ্য খানিকটা সুবিধে হলো, মেজর রফিকুল ইসলামের অডার্লি এসে ডেকে নিয়ে গেল সিরাজুলকে।
হাসমত দু’কাপ চা যোগাড় করে আনলেন। তারপর নিজের সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ইস, এমনভাবে মারছে আগে আমার সাথে যোগাযোগ করিস নাই ক্যান? তোর এই অবস্থা হইলো ক্যামনে? তুই মাটি কাটতে গেছোস…সব কথা আমারে খুইলা বল তো এবার!
চা-টা খেয়ে নিল বাবুল, কিন্তু সিগারেট প্রত্যাখ্যান করলো। কথা বলতেও তার ইচ্ছে করছে না। সে দীর্ঘশ্বাস নিতে লাগলো বারবার। তার ইচ্ছে করছে শুয়ে পড়তে।
হাসমত বাবুলকে একটা ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সিরাজুলের সাথে তোর আগে কোথায় দেখা হইছিল? মনিরা কে? ব্যাপারটা কী ঘটছে?
বাবুল হাসমতের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, কিন্তু তার দৃষ্টি যেন অনেক দূরে। অস্ফুট স্বরে সে বললো, আমি দেখলাম একজন মা নিজের হাতে তার ছেলেটারে মেরে ফেললো!
হাসমত আঁতকে উঠে বললেন, কোন মা? সেই কি মনিরা?
বাবুল দু’দিকে মাথা নাড়লো।
গত কয়েক মাসে বাবুল বহু সাঙ্ঘাতিক অভিজ্ঞতা পার হয়ে এসেছে কিন্তু তার এখন শুধু মনে পড়ছে মাত্র দিন সাতেক আগের একটা ঘটনা। সেটা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না বলে কথাও বলতে পারছে না।
প্রতিদিন দলে দলে মানুষ যাচ্ছে সীমান্তের দিকে। গ্রাম থেকে যুবকেরা অনেক আগেই সরে পড়েছে। এখন যাচ্ছে বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষের স্রোত। অসহায়, দুঃখী মানুষেরা চলেছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। ভারতের রেফিউজি ক্যাম্পগুলিতে কলেরার তাণ্ডবের খবর এদিকেও এসে পৌঁছেছে, তবু এরা নিবৃত্ত হচ্ছে না। রোগ ভোগের মৃত্যুটা প্রকৃতির সংহার। হানাদারের অস্ত্রে মরার চেয়েও সেটাও বোধহয় শ্রেয়।
বাবুল শেষপর্যন্ত জুটে পড়েছিল এই রকম একটি দলে। দিনেরবেলা ঝোপেজঙ্গলে লুকিয়ে থেকে রাত্তিরবেলা পথ চলা। রাত্তিরে যখন তখন আর্মি পেট্রল কিংবা হেলিকপটার-টহলে ধরা পড়ে যাবার ভয় থাকে। এই দলটারই কিছু লোক আর্মির গুলিতে মরেছে, দুটি যুবতাঁকে সকলের সামনে লাঞ্ছনা করেছে, তারা শেষপর্যন্ত আর আসতেই পারেনি।
তৃতীয় দিন ভোরবেলা ওরা হঠাৎ প্রায় ধরা পড়ে যেতে বসেছিল। একটা ছোট নদী পার হতেই দেখলো দূরে দুটি মিলিটারির গাড়ি। তখন আর পেছোবার উপায় নেই। পাশেই একটা পাট ক্ষেত দেখে সবাই ঢুকে পড়লো সেখানে। প্রায় সাত-আট ফুট লম্বা পাট গাছের বিস্তীর্ণ ক্ষেত। তারমধ্যে একদল মানুষ ঢুকে বসে থাকলে বোঝবার উপায় নেই। শুধু কোনো শব্দ করা যাবে না, বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও এটা বুঝে গেছে, তবু দু’আড়াই বছরের একটি শিশু মায়ের কোলের মধ্যে হঠাৎ কেঁদে উঠলো। হয়তো তাকে কোনো পোকা কামড়ে ধরেছিল, কিন্তু তখন আর তা দেখার সময় নেই, মা তার সন্তানের মুখটা চেপে ধরলো। তখন মিলিটারির গাড়ি পাট ক্ষেতের ধার দিয়ে যাচ্ছে, কী শ্লথ তাদের গতি, যেন কিছু সন্দেহ করেছে, খান সেনাদের কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। শিশুটি কিছু বুঝছে না, সে মায়ের হাত ছাড়াবার জন্য ছটফট করছে, আর তার মা প্রাণপণে চেপে ধরে আছে তার মুখ…
খানসেনারা নদী পার হবার আগেই শিশুটি মারা গেছে তার মায়েরই হাতের চাপে। কেউ তার জন্য জিভের চুকচুক শব্দও করল না, এতগুলি মানুষের জীবনের তুলনায় একটা শিশুর জীবন অতি তুচ্ছ। তার সামান্য কান্নার আওয়াজ শোনা গেলেই দলকে দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। সবাই বললো, ছেলেটাকে ঐ পাটক্ষেতেই ফেলে চলে যেতে, এমন কি শিশুটির বাবা পর্যন্ত, কিন্তু জননীটির তখন এক অদ্ভুত বিহ্বল অবস্থা, সে যেন তখনও ঠিক ভুলতে পারছে না যে সে কি একজন হত্যাকারিণী, না এতগুলি মানুষের জীবনদাত্রী। এই শিশুটির জীবনের বিনিময়েই যদি এতগুলি মানুষ প্রাণে বাঁচে থাকে তা হলে তার জন্য এই শিশুটি কোনো সম্মান পাবে না! মৃত শিশুটিকে বুকে চেপে ধরে তার মা একটা দৌড় লাগালো।
শিশুটির মুখ একবারই মাত্র দেখেছিল বাবুল। অবিকল যেন তার ছেলে সুখুর মতন।
এই ঘটনা কি কারুর কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করা যায়? সে ভাষা নেই বাবুলের।
নিজের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার পর বাবুল তার পুরোনো বন্ধুদের খোঁজ করেছিল। জহিরের বাসা ফাঁকা, সেখানে কেউ নেই, কোথায় গেছে তাও কেউ বলতে পারে না। অন্য বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন ইণ্ডিয়ায় পালিয়ে গেছে, কয়েকজন আশ্রয় নিয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামে, আর দু’একজন যোগ দিয়েছে শান্তি কমিটিতে। পল্টন যোগ দিয়েছে মুক্তিবাহিনীতে, সে আছে মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে।
মনিরার খোঁজ করার জন্য বাবুল আর্মি ক্যান্টনমেন্টে পর্যন্ত গিয়েছিল। তার বন্ধু পাকিস্তানী কর্নেলটি তাকে জোর করে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। একটু দেরি হলে তারা বাবুলকেও ছাড়তো না। সাধারণ সোলজাররা কোনো যুবতাঁকে জোর করে ধরে নিয়ে গেলে তারপর আর তার খোঁজ করা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিছুদিন পরেই তার লাশ শিয়াল-শকুনের খাদ্য হবে। কিন্তু মনিরার লাশ না দেখা পর্যন্ত বাবুল নিবৃত্ত হতে চায়নি। সে শুধু এইটুকু খবর পেয়েছিল যে, যে হাবিলদারটি মনিরার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, সে বদলি হয়ে গেছে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। চট্টগ্রাম পর্যন্ত আর পৌঁছোতে পারেনি বাবুল।
সন্ধে হতে না হতেই বৃষ্টি নামলো। হৈ হৈ করে গান গাইতে গাইতে ফিরে এলো পুকুর কাটা যুবকের দল। হাসমত বাবুলের মুখ থেকে কোনো কথা বার করতে না পেরে শেষপর্যন্ত ধৈর্য। হারিয়ে ফেলে বললেন, তাইলে তুই শুইয়া থাক, বিশ্রাম নে। তবে কোথাও চইল্যা যাইস না, মেজর সাহেবের কাছে আমারে তোর ব্যাপারে রিপোর্ট করতে হবে।
বাবুল এবারে হাসমতের হাত চেপে ধরে বললো, সিরাজুলের সাথে আমার কথা বলতেই হবে। ও যদি আমারে খুন করতে চায় তো করুক। কিন্তু নিজের জান দিয়াও আমি মনিরারে বাঁচাবার চেষ্টা করেছি, সে কথাটা ওরে বিশ্বাস করাতেই হবে!
হাসমত বললো, আইচ্ছা, তুই বয়, আমি দেখি সিরাজুল কোথায়!
খোঁজ নিয়ে জানা গেল সিরাজুল তখনও রয়েছে মেজর সাহেবের ক্যাম্পে। সেখানে দু’জন পরিচিত ব্যক্তিও রয়েছে, খুব সম্ভবত ইণ্ডিয়ান বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের দু’জন অফিসার। সেখানে চলেছে দীর্ঘ ইন্টারভিউ।
আরও আধ ঘণ্টা পরে সিরাজুল সেই ক্যাম্প থেকে বেরুতেই হাসমত তাকে ধরলেন। সিরাজুলের চোখ মুখের চেহারা এখন সম্পূর্ণ অন্য রকম, যেন বেশ একটা গর্ব আর আনন্দের ভাব। বিকেলবেলা মাঠের মধ্যে বসে যে কেঁদেছিল, সে যেন অন্য সিরাজুল।
বি এস এফ-এর অফিসাররা দু’জন খুব ভালো সাঁতার জানা, শক্ত সমর্থ, সাহসী যুবককে নিতে এসেছে, কোনো একটা বিশেষ ব্যাপারে ট্রেনিং দেবার জন্য। মেজর সাহেব বেছে বেছে। পনেরো জনকে হাজির করিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে থেকে একমাত্র সিরাজুল মনোনীত হয়েছে। রফিকুল ইসলাম নিজে সিরাজুলের কাঁধ চাপড়ে তাকে কনগ্রাচুলেট করেছেন। শিগগিরই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে কোনো অজ্ঞাত জায়গায়।
নিজেকে এখন খুব দামী আর প্রয়োজনীয় মনে করছে সিরাজুল। সেইজন্যই যেন বাবুল চৌধুরীর ওপর রাগ কমে গেছে অনেকখানি।
হাসমত তাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, শোন, আমি তো বাবুল চৌধুরীকে অনেকদিন থিকা চিনি। সে মিথ্যা কথা কওয়ার মানুষ না। সে কইছে, সে নিজের জান দিয়াও তোর বউরে বাঁচাবার চেষ্টা করছিল। হয়তো তোর বউ আছে কোথাও পলাইয়া।
সিরাজুল হাসমতের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ও কথা বাদ দ্যান, সার। কিন্তু আসল। কথা হইলো, বাবুল চৌধুরী আমাগো ক্যাম্পে আইছে ক্যান সেইটা জানছেন? সে মুক্তিযুদ্ধ সাপোর্ট করে না, স্বাধীন বাংলা দেশ মানে না, সে তো চীনাপন্থী।
হাসমত বললেন, অনেক চীনাপন্থী এখনে মত চেইঞ্জ করছে, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। আসতেছে।
সিরাজুল বললো, আমি বিশ্বাস করি না, সার। অনেক আর্মি অফিসারের সঙ্গে তার দোস্তি আছে, সে একজন কোলাবরেটর। সে এখানে কোনো মতলোবে আইছে!
–এ কথা ঠিক না, সিরাজুল। বাবুল চৌধুরীগো মতন মানুষ স্পাই হয় না। তার। ইডিয়লজির সাথে তোমার মিল না হইতে পারে কিন্তু সে খাঁটি মানুষ।
–তার সাথে আর্মি অফিসারগো দোস্তি আছে, আমি নিজে জানি! অনেকেই জানে।
–আর একটা বিরাট পরিবর্তন হইছে, কেমন যেন ঘোর লাগা মানুষের মতন ভাব। সিরাজুল, তুমি বাবুলরে কয়দিন জানো? সে নিজে নিজে পুকুরের মাটি কাটতে গেছিলো।
–সার, আপনেরে আমি সাফ কথা বলি। সে কি কোনো অ্যাকশানে যাবে? সে দেশের জন্য প্রাণ দিতে রাজি? আজ রাত্তিরেই দুইটা অ্যাকশন টিম অ্যামবুশ করতে যাবে। তারে একটা দলে পাঠান।
–এত তাড়াতাড়ি না। সে অসুস্থ, শুধু শরীরে না, মনেও। তা ছাড়া তার ট্রেনিং নাই।
–সে যে পাপ করেছে, সেই পাপস্খলন হবে যদি সে দেশের জন্য প্রাণ দিতে যায়। নইলে আমি আপনেরে কইয়া দিলাম, সার, ঢাকায় তারে যারা জানতো, সেইরকম কোনো মুক্তিযোদ্ধা তারে দ্যাখলেই মাইরা ফেলবে। আমি না মারি, অন্য কেউ মারবে, সিওর!
সিরাজুলকে নিয়ে হাসমত একটু পরে গেলেন বাবুল চৌধুরীর কাছে। বাবুল ঠিক একই জায়গায় ঠায় একেবারে বসে আছে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে তার।
সিরাজুলকে দেখে সে শান্তভাবে বললো, আমারে মারিস না, আমারে মারলে একজন ফ্রিডম ফাইটার কমে যাবে।
সিরাজুল হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললো, ওঠো বাবুল চৌধুরী, আজই তোমারে রাইফেল নিয়া যুদ্ধে যাইতে হবে। তুমি কী রকম ফ্রিডম ফাইটার তার প্রমাণ দাও।