তমোনাশ ডাক্তার একে একে চার-পাঁচ জন রোগীকে পরীক্ষা করলেন এবং মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাতে লাগলেন সূর্যর দিকে। সূর্য লক্ষ করল, ডাক্তারবাবুটি কোনও রোগীর কাছ থেকে ফি নেন না। টেবিলের ওপর একটা টিনের কৌটো রাখা আছে, তাতে যার যা খুশি বা সাধ্য ফেলে যাচ্ছে। অবশ্য ওষুধও সকলেরই প্রায় এক রকম–পাতলা। লাল রঙের মিকশ্চার।
ঘরের মধ্যে দুটি বেড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে, চেহারা মোটেই সুবিধের নয়-সূর্যর পায়ের কাছে এসে মিউ মিউ করতেই সে পা তুলে নেয় বেঞ্চের ওপর। পাশে যে ক’জন লোক বসে আছে তারা একেবারে নির্বাক নিস্পন্দ। মনে হয়, ডাক্তারকে সবাই খুব ভয় পায়। সারা ঘর জুড়ে একটা অস্বস্তিকর গন্ধ। ডাক্তারের ঠিক পেছনেই দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের পাশে বসে-থাকা গান্ধীজির একটা ফটোগ্রাফ বাঁধানো। ভেতর দিকের একটা দরজায় ময়লা পরদা হাওয়ায় ওড়ে। সেখানে দেখা যায় একটা টানা বারান্দা, উঠোনে তুলসী মঞ্চ, চার পাঁচটা বাচ্চা ছেলে হুটোপুটি করছে।
হঠাৎ একটা শব্দ শুনে সবাই চমকে ওঠে। ডাক্তার তার সামনে বসা রুগিটিকে এক চড় মেরেছেন। লোকটি মাঝবয়সি, কিংবা বয়স হবার আগেই বুড়িয়ে গেছে, চেয়ারের ওপর ঝুঁকে বসেছিল–মার খেয়ে মুখ দিয়ে একটা গোঙানির মতন শব্দ করল। লোকটির ডান হাতের ওপরের দিকে একটা মস্ত বড় ক্ষত, পুরনো ব্যান্ডেজ খুলে ডাক্তার নতুন ব্যান্ডেজ লাগাচ্ছিলেন–লোকটির কাছাকাছি এসে তিনি ওর মুখে মদের গন্ধ পেয়েছেন।
ডাক্তার গর্জন করে বললেন, হারামজাদা, তুই ফের মদ গিলিছিস! তোর এত বড় সাহস, তুই আমার কাছে আসবার আগেও–হারামজাদা–
ডাক্তার আবার তার দু’গালে দু’ঘা কষালেন, রাগে তিনি রীতিমতন কাঁপছেন। ডাক্তারের রোগাটে লম্বা শরীর, ষাটের কাছাকাছি বয়স, কিন্তু গলায় তেজ আছে।
মার খেয়ে লোকটি মুখ ঢেকে ফেলেছে আর সরু গলায় বলছে, আর করবুনি, আর করবুনি।
যা বেরিয়ে যা, দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে—
লোকটি ডাক্তারের পা ধরতে যায়। নেশার ঝেকে সামলাতে পারে না, হুমড়ি খেয়ে পড়ে পায়ের ওপরে। ডাক্তার পা সরিয়ে নিয়ে অন্যদের উদ্দেশ্য করে বললেন, এসব কে। বিক্রি করে এ-তল্লাটে? সে-দিন অত করে বললাম–
কেউ প্রথমে উত্তর করে না। এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। একজন বলে, কাছেপিঠে তো আজ্ঞে কেউ এমন সাহস করবেনি–আপনি বলেছেন–
ডাক্তারের রাগ একটুও কমে না। তিনি আর রুগি দেখবেন না সে-দিন। চেঁচিয়ে বললেন, বেরিয়ে যা। সব দূর হয়ে যা। তোরা মরতে চাস মর। আমি কী করব।
সব লোকই তখন সরব হয়ে ওঠে। নানা রকম কাকুতিমিনতি। ঘরের মধ্যে একটা হট্টমেলা শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারকে আবার রুগি দেখতে বসতেই হয়। কিন্তু তার মুখে বেদনার ছায়া। সূর্য চুপ করে বসে নাটকের মতন এই দৃশ্য দেখে।
সব চুকেবুকে গেলে ডাক্তার সূর্যকে ডাকলেন, এবার তুমি এ-দিকে এসো।
সূর্যকে উঠে গিয়ে ডাক্তারের মুখোমুখি রুগিদের টুলেই বসতে হয়। রুগি দেখার মতন চোখেই ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস করেন, নাম কী?
সূর্যকুমার ভাদুড়ী।
তুমি কোন দলের?
সূর্য চুপ করে থাকে। ডাক্তারের চোখ থেকে চোখ সরায় না।
তোমাকে কে পাঠিয়েছে? উপেনের বাড়িতে এসে ঘাপটি মেরে রয়েছ কেন?
কিছু একটা উত্তর দিতে হবেই, তাই সূর্য বলল, আমি এখানে বেড়াতে এসেছি।
হা হা করে হেসে উঠে ডাক্তার বললেন, বেড়াবার আর জায়গা পেলে না বাপু? এই এঁদো পচা গায়ে তোমার মতন ছেলেরা বেড়াতে আসে? খোলসা করে কও দিকিনি সব কথা!
আমার এক দাদার সঙ্গে উপেন সামন্তর চেনা আছে। তাই তিনি আমাকে এখানে। রেখে গেছেন।
তা তোমার দাদাটি কে? তিনি কোন দলের? দলের তো অন্ত নেই। বারো রাজপুতের তেরো হাঁড়ির হাল হয়েছে এ-দেশে। তুমি জেলা কংগ্রেস কমিটির কারোকে চেনো?
না।
শোনো, তোমাকে একটা সাফ কথা বলে দিই। কংগ্রেসের কর্মী ছাড়া এই এলাকায় আমরা আর কারোকে ঢুকতে দেব না।
আপনি কী বলছেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি তো কোনও দলে নেই।
সং সাজার চেষ্টা কোরো না। সেদিনের ছেলে, গাল টিপলে এখনও দুধ বেরোবে– আর তুমি আমার সঙ্গে চালাকি করতে এসেছ? তোমার নামে পুলিশের হুলিয়া আছে?
আমি সত্যিই এখানে বেড়াতে এসেছি।
এখান থেকে দু’ক্রোশ দূরেই থানা। তুমি দু-এক দিনের মধ্যেই ধরা পড়বে। তুমি এখান থেকে সরে পড়ো।
সূর্য এবার একটু তেজ দেখিয়ে বলল, বাঃ, মানুষ কি কোথাও বেড়াতেও আসতে পারবে না?
আমাকে ভোলাবার চেষ্টা কোরো না। ওই দাদাটাদা শুনেই বুঝেছি, তুমি বোমা-পিস্তলের দলের ছেলে। দু-চারটে আলপিন ফুটিয়ে তোমরা ব্রিটিশ সিংহকে তাড়াতে চাও। আমাদের এখানে ওসব চলবে না। তুমি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এ-জায়গা ছেড়ে চলে যাবে।
সূর্য তেড়িয়া ভাবে বলল, আপনার হুকুমে?
হ্যাঁ।
যদি না যাই?
যে-রকম ভাবে বেড়াল পার করে দেখেছ? আমাদের ছেলেরা তোমাকে সেই রকম ভাবে পার করে দিয়ে আসবে।
সূর্যর ঠোঁটে সামান্য ব্যঙ্গের হাসি। সে কটমট করে চেয়ে রইল তমোনাশ ডাক্তারের দিকে। ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটির টুটি চেপে ধরতে পারে।
ডাক্তারের মুখোনিতে একটা মলিন ছায়া পড়ল। আপন মনেই বললেন, আমরা, এখানে অনেক সহ্য করেছি। আর না। তোমাদের মতন হঠকারীদের জন্য সাধারণ মানুষকে মরতে হয়। পেডি, ডগলাস, বার্জকে যখন পর পর তিন বছরে মারল তারপর মেদিনীপুরের ওপর কী অত্যাচার গেছে, সে-খবর রাখো? প্রদ্যোৎ ভটচাযের নাম শুনেছ? সে ছিল আমার নিজের ছেলের মতন। তোমারই বয়সি হবেফঁসির দড়িতে প্রাণ দিয়েছে। হিরের টুকরো ছেলে সব–ভুল পথ দেখিয়ে–তোমার মাথার ওপরেও ফাঁসির দড়ি ঝুলছে দেখতে পাচ্ছি আমি, কিংবা লোকজনই তোমাদের পিটিয়ে মারবে। সে তোমার যা খুশি করতে চাও করো–কিন্তু এখানে না–আমার এলাকায় সাধারণ মানুষের ওপর আমি অত্যাচার হতে দেব না।
সূর্য বলল, যত বেশি অত্যাচার হবে, ততই দেশের লোক জাগবে।
ডাক্তার চেঁচিয়ে বললেন, ভুল! ভুল! ন্যায়ের পথ ছাড়া সারা দেশের মানুষকে সংঘবদ্ধ করা যায় না। শিগগিরই মহাত্মাজির ডাক আসবে, সমস্ত দেশবাসীকে সত্যাগ্রহে নামতে হবে। তোমরা যদি আমাদের সঙ্গে আসতে চাও
সূর্য প্রকাশ্য ব্যঙ্গে বলল, কী করবেন তখন? অনশন?
দরকার হলে তাও করতে হবে। অনশনের শক্তি জানো? তাতে যে শুধু শত্রু হার মানে তাই-ই নয়, নিজের আত্মা শুদ্ধ হয়। হিংসা দিয়ে হিংসাকে জয় করা যায় না। ‘ গণদেবতা যে-দিন জেগে উঠবেন–
ভেতরের দরজার পরদা সরিয়ে একজন মহিলা ডাকলেন ডাক্তারকে। ডাক্তার হাত তুলে বললেন, দাঁড়াও, একটু পরে ডাক্তারকে তখন বক্তৃতায় পেয়ে বসেছে। অনর্গল উপদেশ দিতে লাগলেন সূর্যকে।
সূর্য অবাধ্য ছেলের মতন অমনোযোগী। ইচ্ছে করে পা দোলাচ্ছে। সে তর্ক করতে ভালোবাসে না, কিন্তু এইসব কথা শুনলে তার হাসি পায়।
একবার শুধু সে বলল, আপনি এত অহিংসার কথা বলছেন, কিন্তু আপনাকে দেখলে তো অহিংস মনে হয় না। তখন ওই লোকটিকে অমন ভাবে মারলেন—
ডাক্তার হুংকার দিয়ে বলছেন, বেশ করেছি। বাপ ছেলেকে মারে না? শোনো বাপু, তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি কেন এ-পথে এসেছ? তোমাকে দেখলেই মনে হয় তুমি ধনীর ঘরের আদরের দুলাল। দেশ উদ্ধার করা মানে ছেলেখেলা নয়। বন্দুক পিস্তল ছোঁড়ার নেশায় একবারও কি ভেবে দেখো না, মানুষের প্রাণ কী অমূল্য? অন্যের প্রাণের কথা না হয় নাই-ই ভাবলে, নিজের প্রাণ? দেশের কাজ বড় পবিত্র কাজ, এ জন্য দরকার চরিত্রবল। নিয়মিত ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়। মাথাগরম লোকজনের দ্বারা একাজ হয় না। যুগমানব গান্ধীজি–
সূর্য আকস্মিক ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি চলি। সন্ধে হয়ে আসছে।
তমোনাশ গভীর কৌতূহলের সঙ্গে দেখতে লাগলেন ছেলেটিকে। তারপর বললেন, ঠিক আছে। কালকেই চলে যেয়ো এখান থেকে।
সূর্য এবার শান্ত ভাবে বলল, যদি না যাই, জোর করে পাঠিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না।
আমরা জোর করে না পাঠালেও পুলিশই তোমাকে ধরবে।
সেটা আমি বুঝব।
এই সময়ে লালপাড় শাড়ি-পরা এক কল্যাণময়ী নারীমূর্তি হাতে একটি খাবারের প্লেট নিয়ে ঢুকলেন। চিনি মেশানো চিড়েভাজা এবং একটি কলা। মহিলা প্লেটটি রাখলেন সূর্যর সামনে।
সূর্য চলে আসবার জন্য উদ্যত হয়েছিল, মহিলাকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে গেল। খাবারের প্লেট অবহেলা করে কি তার চলে যাওয়া উচিত? মানুষজনের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করতে তার একটুও আটকায় না কিন্তু মহিলাদের সামনে সে নিজের ব্যবহার সম্পর্কে দিশেহারা হয়ে যায়।
মহিলা কোমল গলায় বললেন, নাও বাবা, খেয়ে নাও। তোমার নাম কী? তুমি কাদের ছেলে?
ভেতরের দরজার সামনে চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ের কৌতূহলী মুখ।
দেওয়ালের পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে ছটা বাজল। তমোনাশ ডাক্তার চমকে উঠে বললেন, আরে বাপরে, ছটা বাজল। ডাকো, ডাকো সবাইকে ডাকো।
সূর্য খাবারের প্লেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। ঘরে ঢুকলেন আট-ন’জন মহিলা ও শিশু। সবাই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে। বাচ্চাদের ভঙ্গিও বেশ বাধ্য। হাতজোড় করে চেয়ে রইল ডাক্তারের দিকে। সূর্য বুঝল, এবার এখানে একটা প্রার্থনা সভা হবে। প্রতি দিনই হয় বোধহয়।
ডাক্তার তার ভাঙা গলায় শুরু করতেই সবাই একযোগে আরম্ভ করে দিল গান:
রঘুপতি রাঘব রাজারাম
পতিত পাবন সীতারাম
ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম…।
সবাই দুলে দুলে গান গায়। তমোনাশ ডাক্তার চোখ বুজে তাল দিতে থাকেন। ঘরের মধ্যে সূর্যই একমাত্র চোয়াড়ে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, তার ঠোঁটে সেই হাসিটা লেগেই আছে।
প্রথম গানের পর তমোনাশ ডাক্তার হরিজন পত্রিকা থেকে গান্ধীজির রচনার খানিকটা অংশ অনুবাদ করে শোনালেন। নারী ও শিশুরা তার কতটা বুঝল কে জানে। মনে হয় বিশেষ করে সূর্যকে শোনাবার জন্যই আজকের এই বিশেষ অনুষ্ঠান।
পাঠ শেষ হবার পর সবাই নিস্তব্ধ। ডাক্তার বইখানা টেবিলে রাখলেন। সূর্যর দিকে ফিরে আস্তে আস্তে বললেন, আমাদের যৌবনকালে একটা গান আমরা খুব গাইতাম।
আজও সে গান মনে পড়লে
ডাক্তার শুরু করে দিলেন:
যায় যবে জীবন চলে
জগৎ মাঝে তোমার কাজে
বন্দে মাতরম বলে।
বেত মেরে কি মা ভোলাবি,
আমি কি
মার সেই ছেলে…
সূর্য দেখল বৃদ্ধ ডাক্তারের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে।