৩৪. জীবনলাল মাথা নেড়ে বলেছিল

চৌত্রিশ

জীবনলাল মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘শোন আঙ্কল। তুমি যদি আমাদের কথাটা মনে রাখো তাহলে আমি তোমার একটা উপকার করতে পারি। আজকের রাতটা বিনা পয়সায় থাকার ব্যবস্থা হলে কেমন হয়?’

‘খুব ভাল।’

‘আমি যেখানে নিয়ে যাব সেখানে ভাল অথবা মন্দ যে-কোনও ব্যবহার পেতে পার। যাই পাও রাতটা কোনমতে কাটিয়ে সকালবেলায় তুমি তোমার ধান্দায় চলে যেয়ো, আমি গ্রামে ফিরে যাব।’

‘খুবই ভাল কথা।’

সেইরাত্রে পাশাপাশি শুয়ে চাপা গলায় জীবনলাল বলল, ‘তাজ্জব ব্যাপার!’

‘কেন? আকাশলালের ঘুম পাচ্ছিল।’

‘আমার মাসির মতো মুখরা মেয়েমানুষ আমি জীবনে দেখিনি। ওর মুখের জ্বালায় না থাকতে পেরে মেসোমশাই পুলিশে নাম লিখিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের গুলি খেয়ে মরেছে, সেই বাড়িতে ঢোকামাত্র কিরকম অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম মনে আছে? যেন মেশিনগান চলছে। তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘তারপর যেই তুমি কলতলায় স্নান করতে গেলে তারপর একদম চুপ মেরে গেল?’

‘আমার স্নান করার সঙ্গে তার চুপ করার কি সম্পর্ক?’

‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না। মাসির পাক ঘরের জানলা দিয়ে কলতলা দেখা যায়। মেসো মরে গেছে, বাচ্চাকাচ্চা হয়নি, দেখতে শুনতে মন্দ নয় তবু কোনও পুরুষ বিয়ে করতে এগিয়ে আসেনি শুধু ওই মুখের জন্যে। আর বিয়ের কথা বললেই মাসি খেপে আগুন হয়ে যায়। সেই মাসি কলতলায় তোমার মধ্যে যে কি দেখল কে জানে তাড়াতাড়ি এসে আমাকে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘ওর নাম কি রে?’

আমি বললাম, ‘গগনলাল।’

মাসি চোখ ঘোরাল, ‘যাঃ। গগন মানে তো আকাশ। আকাশলাল মরে গেছে।’

আমি হেসে বলেছিলাম, ‘দূর! এ আকাশলাল হতে যাবে কেন? এ গগনলাল। ওই আকাশলালের মুখের সঙ্গে কি কোন মিল আছে?’

মাসি খুব গম্ভীর মুখে বলেছিল, ‘দুটো মিল আছে। পিঠে দুটো জড়ুল আছে। পাশাপাশি। দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। কি জানি, মরা মানুষ চেহারা পাল্টে এল নাকি!’

‘তারপর থেকে বারেবারে তোমাকে দেখছে। কিন্তু মুখে আর শব্দ নেই। আমি জানি কাল সকালের মধ্যে পাড়ার সবাই জেনে যাবে যে তোমার পিঠে আকাশলালের মত জোড়া জড়ুল আছে।’

সকালে ঘুম ভেঙেছিল বেশ দেরিতেই। অসুস্থ শরীরে দীর্ঘ পথযাত্রার ক্লান্তি যেন কাটতে চাইছিল না। আর একটু ঘুমালে কেমন হয় এমন যখন সে ভাবছে তখন গলা কানে এল, ‘কটা বাজল জানা আছে। এর পরে চায়ের পাট বন্ধ।’

আকাশলাল উঠল। সে বুঝতে পারল জীবনলাল সাত সকালেই তাকে না বলে বেরিয়ে গেছে। মুখ হাত পা ধুয়ে সে যখন বাইরে বেরুবার জন্যে পা বাড়াচ্ছে তখন মাসি সামনে এল, ‘চা কে খাবে? আমি কত কাপ গিলব?’

অতএব চা খেতে বসতে হল। খানিকটা দূরে বসে মাসি বলল, ‘বোনপো তো দেশে ফিরে গেছে। বলে গেল তার আঙ্কলের নাকি যাওয়ার জায়গা নেই। তা কোথায় যাওয়া হবে।’

‘দেখি। রাতের বেলায় মাথার ওপরে একটা ছাদ তো দরকার?’

‘ঠিক বুঝেছি। তা পেটের আগুন নেভাবে কে? কাজকর্ম কিছু করা হয়?’

‘কাজকর্ম? না। তবে করতে হবে কিছু।’

‘পিঠে দুটো জড়ুল কবে থেকে হয়েছে?’

‘ও দুটো জন্ম থেকে। মা বলত তোর পিঠেও এক জোড়া চোখ।’

‘তিনি কোথায় আছেন?’

‘মা? মা নেই।’

‘আত্মীয়স্বজন?’

‘নাঃ।’

‘বিয়ে থা?’

হেসে ফেলল আকাশলাল, ‘আমাকে বিয়ে কে করবে?’

‘ন্যাকা!’ মাসি উঠে দাঁড়াল, ‘আজ আর বেরুতে হবে না। বুক জুড়ে অনেক কাটা দাগ দেখেছি। মুখ দেখলেই বোঝা যায় রক্ত নেই শরীরে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর পাশের বাড়ির হাবিলদার ভাই থানায় নিয়ে গিয়ে নাম লিখিয়ে আসবে। ওরা যে কাগজ দেবে তা পকেটে রাখতে হবে।’ মাসি চলে গেল সামনে থেকে।

আকাশলাল ঠোঁট কামড়াল, এ তো নতুন ফ্যাসাদে পড়া গেল। থানায় গেলে যে জেরা করবে তার জবাব ঠিকঠাক দিতে না পারলে—! মুখ দেখে তাকে কেউ আকাশলাল বলে ভাবতে পারছে না ঠিক। এরা জানে আকাশলাল মরে গেছে। কিন্তু তার জড়ুল দুটো? মুখ পাল্টে দেবার সময় ওই জড়ল দুটোর কথা ভুলে গেল কি করে? আবার এমন লোক থাকতে পারে যে আকাশলালের শরীর চেনে। ব্যাস, হয়ে গেল। সে নিজের হাত পা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। কোথাও তেমন কোনও বিশেষ চিহ্ন চোখে পড়ছে না। না। সাবধানের মার নেই। থানায় যাবে না সে। সুযোগ খুঁজে নিয়ে সে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে।

রাস্তায় পা দিয়ে সে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দেখল নাগরিকদের। হাঁটতে হাঁটতে তার স্মৃতিতে একটু একটু করে অনেক দৃশ্য ভেসে আসছিল। যেন এই সব পথ দিয়ে সে অনেকবার যাওয়া আসা করেছে, বাঁক নিতেই একটা ফটোর দোকান দেখতে পাবে এবং পেলও। আকাশলাল চমকে উঠল। তার তো কিছু কিছু কথা এখন ঠিকঠাক মনে পড়ছে। একসময় এখানে কারফিউ হত। মানুষ ভয়ে পথে বের হত না। একটা দেওয়ালে প্রায় উঠে আসা পোস্টার ঝুলতে দেখল সে। ওয়ান্টেড আকাশলাল। এই তাহলে তার ছবি। বেশ ভাল মানুষ ভাল মানুষ চেহারা। ওরা প্রচুর টাকা দিত কেউ ধরিয়ে দিলে। অথচ দেশের মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করেনি।

কিছুটা হাঁটার পর একটা চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে সে ঢুকে পড়ল। দোকান প্রায় খালি। বেঞ্চিতে বসতে একটা ছোকরা এগিয়ে এল, ‘গরম চা?’

হ্যাঁ বলতে গিয়েও সামলে নিল আকাশলাল। সে মাথা নাড়ল।

‘তাহলে কি দেব?’

‘কিছু না।’ মাথা নিচু করে বলল সে। একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে যাবে সে। এমন খদ্দের জীবনে দ্যাখেনি ছেলেটা। কাউন্টারে বসা মালিকের দিকে তাকিয়ে সে ভেতরে চলে যেতেই মালিক গলা খুলল, ‘ভাই সাহেবের কি শরীর খারাপ?’

‘হ্যাঁ। একটু—।’

‘গরম চা খান না। ঠিক হয়ে যাবে।’

সে মুখ তুলে লোকটার দিকে তাকাতেই দেওয়ালে পোস্টার ঝুলতে দেখল। তার নিজের মুখের পোস্টার। এই ছবিটা একটু অন্য ধরনের। জীবিত বা মৃত ধরে দিতে পারলে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি।

দোকানদার বলল, ‘আকাশলাল। এখন আর কোনও দাম নেই। এমনি টাঙিয়ে রেখেছি।’

‘দাম নেই কেন?’

‘লোকটা বেঁচে আছে বলে কেউ ফিস ফিস করে। কবরে মুর্দা ঢুকে গিয়ে কেউ কি বেঁচে ফিরতে পারে? তারপর ওর তিনটে হাত ছিল। তিনটে হাতই খতম।’

‘তার মানে?’

‘ডেভিডটা মরেছিল প্রথমে। তারপর গেল ত্রিভুবন। আর আজ রেডিওতে বলেছে যে কোনও এক পাহাড়ি গ্রামে লুকিয়ে থাকা হায়দারকে পুলিশ মেরে ফেলেছে।’

‘হায়দার নেই?’ আচমকা বেরিয়ে এল মুখ থেকে।

‘রেডিওতে তাই বলল। আরে মশাই গেছে বেশ হয়েছে। আমিও এককালে আকাশলালের সমর্থক ছিলাম। দেশে বিপ্লব হোক চাইতাম। কিন্তু দিনের পর দিন শুধু খুন জখম, ব্যবসা বন্ধ, বিপ্লবের নামগন্ধ নেই শুধু ছেলেগুলো খতম হয়ে যাচ্ছে এ আর কাঁহাতক ভাল লাগে? এই দেখুন, এখন শান্তি এসেছে। শুনছি মিনিস্টারও বদল হবে। এই ভাল।’ দোকানদার হাঁক দিলেন, ‘চা দিয়ে যা।’

আকাশলাল কিছু বলার আগেই একজন মোটাসোটা ভারী চেহারার মানুষকে শ্লথ পায়ে দোকানে ঢুকতে দেখা গেল। দোকানদার হাতজোড় করল, ‘আসুন স্যার, আসুন স্যার।’

‘আর স্যার বলার দরকার নেই। আমি এখন কমন ম্যান।’ ভারী শরীরটা নিয়ে আকাশলালের পাশে বেঞ্চিতে বসতেই সেটা কেঁপে উঠল।

দোকানদার বলল, ‘স্যার সবাইকে তো একসময় অবসর নিতেই হয়।’

‘নো। অবসর নয়। ওরা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ওই বোর্ড আর তার ম্যাডাম। এবং সেটা এই শহরের সবাই জানে। আমাকে জেলে পাঠাতে পারত, পাঠায়নি। কিন্তু দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। আমার এখন একটা ভাল থাকার জায়গা পর্যন্ত নেই।’ ভার্গিস চোখ বন্ধ করলেন, ‘অন্য মানুষ হলে আত্মহত্যা করত। কিন্তু আমি করব না। কেন জানো?’

দোকানদার প্রশ্ন করল না মুখে কিন্তু তার ভঙ্গি বুঝিয়ে দিল সেটা।

‘আমার ক্রমশ সন্দেহ হচ্ছে লোকটা বেঁচে আছে।’ সদ্য গজানো দাড়িতে হাত বোলাল ভার্গিস।

‘কোন লোকটা স্যার।’

‘আমার সর্বনাশের কারণ যে। তোমার ওই পোস্টারটা যার।’

‘কিন্তু আকাশলাল তো—।’

‘আমিও তাই বিশ্বাস করতাম। কিন্তু ওই বুড়ো ডাক্তার কার অপারেশন করেছিল। আমি যদি আর ঘন্টা চারেক আগে লেডি প্রধানের বাড়িতে হানা দিতে পারতাম। ওখানে যেসব যন্ত্রপাতি দেখেছি তা মডার্ন অপারেশন থিয়েটারে থাকে। এইসব প্রশ্ন তুলতেই বোর্ড আমাকে সরিয়ে দিল। আকাশলাল মরে গেছে, ডেভিড মরে গেছে, ত্রিভুবন নেই, এতে বোর্ডের মঙ্গল।’

দোকানদার বলল, ‘স্যার আজ রেডিওতে বলেছে হায়দারও মরেছে।’

‘তাই নাকি? বাঃ। খেল খতম। কিন্তু সেই লোকটা গেল কোথায়? অন্তত ওর মৃতদেহ কেউ দেখতে পেয়েছে বলে দাবি করেনি। উত্তরটার জন্যে আমাকে বেঁচে থাকতে হবেই।’

এইসময় চা এল। ভার্গিসের জন্যে ভাল কাপ প্লেট, আকাশলালের জন্যে গ্লাশ। চুপচাপ লোক দুটোর কথা শুনতে শুনতে আকাশলাল একসময় কেঁপে উঠেছিল। এই তাহলে ভার্গিস। এরই কথা বলেছিল হায়দার। তাকে খুঁজে বের করতে না পারার অপরাধে ওর চাকরি গিয়েছে। ও যদি জানতে পারত সে কত কাছে বসে আছে!

চায়ে চুমুক দিয়ে ভার্গিস বলল, ‘কোন জায়গায় মরেছে হায়দার?’

‘পাহাড়ি গাঁয়ে।’ এগিয়ে গিয়ে ছোট ট্রানজিস্টারটা নিয়ে এসে চালু করল দোকানদার। গান হচ্ছে। ভার্গিস বলল, ‘বন্ধ কর ওটা।’

‘গানের পরেই খবর হবে।’

ভার্গিস চা খেতে খেতে আকাশলালের দিকে তাকাল, ‘আপনি কি অসুস্থ?’

‘হ্যাঁ, একটু-।’

‘খুব খারাপ অসুখ নাকি? মুখটা কেমন কেমন দগদগে লাল!’

‘না, না, খারাপ কিছু না।’

‘থাকেন কোথায়?’

‘শহরের বাইরে। গাঁয়ে।’ ভেতরটা কুঁকড়ে উঠল আকাশলালের।

এইসময় খবর আরম্ভ হল। প্রথমেই হায়দারের খবর। ‘একটি পাহাড়ি গ্রামের বৃদ্ধের আশ্রয়ে সে লুকিয়ে ছিল। পুলিশ অতর্কিতে হানা দিলে বাধা দিতে চেষ্টা করে। গুলি চালায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। দেরিতে পাওয়া এই খবরের সঙ্গে জানা যায় যে ওই গ্রামের লুকোনো ডেরায় হায়দার একা ছিল না। তার সঙ্গী ছিল অসুস্থ। ঘর থেকে বের হত না। কিন্তু পুলিশ হানার আগেই সেই লোকটি গা ঢাকা দিতে সমর্থ হয়। সমস্ত এলাকায় জোর তল্লাসি হচ্ছে।’ তার পর দেশের অন্যান্য খবরের পরে পাঠক পড়লেন, ‘নগর পুলিশ দফতর থেকে জানানো হয়েছে শহরে একজন মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। মানুষটির পিঠে জোড়া জড়ুল ছিল। তার মুখের চামড়া লালচে। যদি কেউ এমন মানুষের সন্ধান পান তাহলে অবিলম্বে নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করুন।’

খবর শেষ হওয়া মাত্র ভাগিস বিড়বিড় করলেন, ‘আকাশলালের পিঠে জোড়া জড়ুল ছিল।’

‘তাই নাকি?’ দোকানদার কৌতূহলী।

‘হুম্‌।’

‘কিন্তু সে মরে গেছে।’

‘অসুস্থ লোকটা কে? গ্রামের নাম বলল না হতভাগারা। আমি যদি হেডকোয়ার্টার্সে জানতে চাই তাহলে ওর জানাবে না। আমি তো এখন ছেঁড়া কাগজ।’ পকেট থেকে টাকা বের করলেন ভার্গিস, ‘চায়ের দাম।’

দোকানদার বলল, ‘ছি ছি ছি। আপনার কাছে দাম নেব কি করে ভাবছেন?’

‘কদিন এমন ব্যবহার করবে হে!’ উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর পাশের মানুষটির দিকে তাকালেন, ‘চিকিৎসা করান ভাল করে। কি নাম আপনার?’

‘গগনলাল।’

‘এখানে কোথায় উঠেছেন?’

‘দেখি।’

ভার্গিস তাঁর ভারী শরীর টেনে টেনে বেরিয়ে গেলে আকাশলাল দোকানদারকে বলল, ‘ভাই, আমার কাছে পয়সা নেই। চায়ের দাম দিতে পারব না।’

‘সেটা তো চেহারা দেখেই বুঝেছি। যে ভদ্রলোক ওখানে বসেছিল তার পরিচয় জানা আছে?’

‘না।’

‘কোথাকার মানুষ আপনি? ভার্গিসকে চেনেন না! পকেটে পয়সা নেই, থাকার জায়গা নেই, এই শহরে টিকবেন কি করে মশাই! যান কেটে পড়ন।’ হাত নেড়ে বিদায় করল দোকানদার।

চা খেয়ে শরীর ভাল লাগছিল। আকাশলাল ধীরে ধীরে দোকানের বাইরে বেরিয়ে এল। কোথায় যাওয়া যায় এখন? ঠিক তখনই সে ভার্গিসকে দেখতে পেল। ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আকাশলাল হাসার চেষ্টা করল। লোকটা কি তাকে চিনতে পারছে? অসম্ভব। ওই পোষ্টারের ছবির সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। ব্যান্ডেজ খোলার পর তার এই পরিবর্তিত মুখ এখন পর্যন্ত আগের পরিচিত কারও দেখার কথা নয়। সে এগিয়ে গেল, ‘এখনও দাঁড়িয়ে আছেন?’

‘কোথায় থাকা হবে?’

‘দেখি।’

‘আমার ওখানে চল। দেড়খানা ঘর নিয়ে কোনও মতে টিকে আছি। রান্নাবান্না করতে পার?’

‘তা পারি।’

‘তাহলে তো কথাই নেই। ফলো মি।’ ভার্গিস হাঁটতে লাগল। খানিকটা দূরত্ব রেখে লোকটাকে সে অনুসরণ করতে লাগল। মাঝেমাঝে, খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর, মুখ ফিরিয়ে ভার্গিস দেখে নিচ্ছেন, সে ঠিকঠাক আসছে কিনা। পালাবার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে কিন্তু পালাতে ইচ্ছে করছিল না। সে এর মধ্যে লক্ষ করেছে, পথচারীরা ভার্গিসকে চিনতে পেরে তরল মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে। এককালের পুলিশ কমিশনার সেই সব মন্তব্য কানে যাওয়া সত্ত্বেও যখন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না তখন বোঝাই যাচ্ছে ক্ষমতার এক বিন্দু অবশিষ্ট লোকটার হাতে নেই। এমন লোককে ভয় পাওয়ার কারণ নেই।

একটা সরু গলির মধ্যে পুরনো দোতলা বাড়ির স্যাঁতসেঁতে ঘরে ঢুকে ভার্গিস বলল, ‘আপাতত এটাই আমার আস্তানা। ওইটে কিচেন। কফি বানাও।’

আকাশলাল অনেক চেষ্টার পরে দুকাপ কফি বানাল।

কফির কাপ হাতে নিয়ে ভার্গিস বলল, ‘বোসো। তোমাকে একটা কথা বলছি। কি জানি কেন, তোমাকে দেখার পর থেকেই আমার কিরকম অসুবিধে হচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব চিনি অথচ সেটা সম্ভব নয়। নাম বললে-গগনলাল, আকাশলাল বলে কারও নাম কখনও শুনেছ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। পোস্টারে দেখেছি।’

‘অ। তোমার গলার স্বর আমার খুব চেনা চেনা লাগছে। ব্যাপারটা কি বলো তো?’

‘আমি কি করে বলব!’

‘তোমার পিঠে কোনও জড়ুল আছে?’

‘আছে।’

‘একজোড়া?’

‘তাই তো শুনেছি। নিজের পিঠ তো দেখা যায় না।’

‘আমি দেখতে চাই। দেখাও। জামা খোল।’

‘মাফ করতে হবে। কেউ কিছু চাইলেই সেটা করার ধাত আমার নেই।’

‘তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ জানো?’

‘দোকানদার বলল আপনি পুলিশ কমিশনার ছিলেন। সরকার আপনাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।’

‘তুমি আমাকে আগে চিনতে না?’

‘না।’

‘কিন্তু এখানকার অনেকেই এখন আমায় খাতির করে।’

‘আপনাকে একটা কথা বলি। যখন আর সরকারি পদে আপনি নেই তখন আর পুলিশের মত আচরণ করছেন কেন? ব্যাপারটা খুব হাস্যকর!’

শোনামাত্র ভার্গিসের মুখ করুণ হয়ে উঠল, ‘তাহলে আমি এখন কি করব?’

‘সাধারণ মানুষ যা করে তাই করুন।’

‘আমি তো সেসব পারি না। কখনও করিনি।’ করুণ গলায় বলল ভার্গিস। দেখে মায়া হল আকাশলালের। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘থানায় গেলে আপনাকে পাত্তা দেয়?’

‘একদম না। হাসি-মশকরা করে। চেয়ার সরে যেতে ওরা আমাকে কোনও মর্যাদা দেয় না।’ মাথা নেড়ে ভার্গিস বলল, ‘এগুলো হয়েছে ওই আকাশলালের জন্যে। আমাকে যদি ম্যাডাম আর কিছুটা সময় আগে ছেড়ে দিত তাহলে ওর বডি ধরে ফেলতাম আমি।’

‘ম্যাডাম?’

‘ম্যাডামের নাম শোনোনি? কিরকম মাকাল তুমি।’

‘ভার্গিস সাহেব, যদি আকাশলালকে জীবিত অবস্থায় হাতে পান তাহলে কি করবেন?’

‘কি করব?’ হঠাৎ খুব উত্তেজিত দেখাল ভার্গিসকে। কিন্তু সেটা অল্প সময়ের জন্যে। তারপরই ক্রমশ মিইয়ে যেতে লাগল লোকটা, ‘কিছুই করতে পারব না।’

‘তাহলে উত্তেজনা ছাড়ুন। আমার মনে পড়ছে, পাবলিক আপনাকে ঘেন্না করে।’

‘করত। এখন মজা পায়।’

‘আপনি বিপ্লবের গলা টিপে মারতে চেয়েছিলেন।’

‘চেয়েছিলাম কিন্তু তার কোনও প্রয়োজন ছিল না। ওরা নিজেরাই মরত।’

‘তার মানে?’

‘এখানে বিপ্লবও কিনে নেওয়া হয়। পুলিশ কমিশনার হয়েও সেটা বুঝতে পারিনি।’ ভার্গিস হাসল, ‘এই যে এতদিন লোকে আকাশলাল আকাশলাল করে নাচত এখন কেউ ভুলেও তার নাম উচ্চারণ করে না। আবার অশান্তি হোক কেউ সেটা চায় না। আকাশলাল যদি ফিরে আসত তাহলে সে পায়ের তলায় জমি পেত না।’

‘তাহলে লোকটার সঙ্গে শত্রুতা করে আপনার কি লাভ?’

‘কোনও লাভ নেই। শুধু মনের জ্বালা মিটছে না।’

‘এই যে আমি, আপনার সামনে বসে আছি, আমিও তো-আকাশলাল হতে পারি।’

‘তুমি? আকাশলাল? একেবারে সন্দেহ যে হয়নি তা নয়। পরে বুঝেছি অসম্ভব।’

‘কেন?’

‘লোকটা মরে গেছে। ধরা যাক বেঁচে উঠল। তার মুখ পাল্টাবে কি করে? ধরা যাক সেটাও পাল্টাল। তার ব্যবহার বদলে যাবে কি ভাবে? তোমার মতো হাতজোড় করে কথা সে বলত না।’

‘কিন্তু আমার হাতের রেখা দেখুন। ওটা পাল্টায়নি। পিঠের জড়ল একই আছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে যাবে। গলার স্বরও। আমিই আকাশলাল। না, উঠবেন না। আমার পয়সা কড়ি নেই কিন্তু একটা রিভলভার আছে। রিভলভারে গুলি ভরা, বুঝতেই পারছেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *