চাচা আবু তালিবের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সিরিয়া সফর এরং পাদ্রী বাহীরার সঙ্গে সাক্ষাত প্ৰসঙ্গ
ইব্ন ইসহাক বলেন, অতঃপর আবু তালিব বাণিজোপলক্ষে একটি কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া রওয়ানা হন। প্রস্তুতি সম্পন্ন করে যেই মাত্র তিনি রওয়ানা হন, ঠিক তখনি রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে জড়িয়ে ধরেন। এতে তাঁর প্রতি আবু তালিব বিগলিত হয়ে পড়েন এবং বলে ওঠেন, আল্লাহর শপথ! একে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আমিও তাকে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন করব না, সেও কখনো আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।
যা হোক, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সঙ্গে করে আবু তালিব রওয়ানা হন। কাফেলা সিরিয়ার বুসরা নামক এক স্থানে যাত্রা বিরতি করে। সেখানকার একটি গীর্জায় এক পাদ্রী অবস্থান করেন। তার নাম ছিল বাহীরা।
খৃষ্টীয় ধর্মের তিনি বড় পণ্ডিত ছিলেন। পাদ্ৰীত্ব গ্রহণ অবধি তিনি ঐ গীর্জায়ই সব সময় থাকতেন। খৃষ্টানদের ধারণা মতে, খ্ৰীষ্টীয় ধর্মগ্রন্থে তিনিই ছিলেন শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত। উত্তরাধিকার সূত্রে এই জ্ঞান তারা পেয়ে থাকেন।
মক্কার এই বণিক কাফেলা এর আগেও বহুবার এ পথ চলাচল করেছে। কিন্তু পাদী বাহীরা এতকাল পর্যন্ত কখনো তাদের সঙ্গে কথাও বলেন নি এবং তাদের প্রতি ফিরেও তাকান নি। কিন্তু এই যাত্রায় কাফেলা পাদ্রীর গীর্জার নিকটে অবতরণ করলে পাদ্রী তাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেন। কাফেলার লোকজনের ধারণা মতে, পাদ্রী তাঁর গীর্জায় বসে কিছু একটা লক্ষ্য করেই এমনটি করেছিলেন। তাদের ধারণা, পাদ্ৰী কাফেলার মাঝে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দেখে ফেলেছিলেন। ফলে তখন একখণ্ড মেঘ দলের মধ্য থেকে শুধু রাসূলুল্লাহ (সা)-কেই ছায়া। দিচ্ছিল। কাফেলার লোকেরা আরও সামনে অগ্রসর হয়ে পাদ্রীর কাছাকাছি একটি গাছের ছায়ায় অবস্থান নেয়। পাদ্রী রাসূলুল্লাহ (সা)-কে মেঘের ছায়া প্ৰদান এবং তার প্রতি গাছের ডাল-পালা বঁকে থাকছে লক্ষ্য করেন। এসব দেখে পাদ্রী তাঁর গীর্জ হতে বেরিয়ে আসেন। এদিকে তাঁর আদেশে খাবার প্রস্তুত করা হয়। এবার তিনি কাফেলার নিকট লোক প্রেরণ করেন। কাফেলার প্রতিনিধি দল পাদ্রীর নিকট উপস্থিত হলে পাদ্রী বলেন, ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেছি। আমার একান্ত কামনা তোমরা প্ৰত্যেকে আমার এই আয়োজনে উপস্থিত হবে, বড় ছােট,গোলাম-আযাদ সকলে। জবাবে একজন বলল, আজ আপনি ব্যতিক্রম কিছু করছেন দেখছি। ইতিপূর্বে কখনো তো আপনি আমাদের জন্য এরূপ আয়োজন করেন নি। অথচ এর আগেও বহুবার আমরা এই পথে যাতায়াত করেছি। আজ এমন কি হলো বলুন তো? বাহীরা বললেন, ঠিকই বলেছ! তোমার কথা যথার্থ। ব্যাপার তেমন কিছু নয়। তোমরা মেহমান। একবেলা খাবার খাইয়ে তোমাদের মেহমানাদারী করতে আশা করেছিলাম। আর কি!
কুরাইশ বণিক কাফেলার সকলেই পাদ্রীর নিকট সমবেত হন। বয়সে ছোট হওয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ (সা) গাছের নিচে তাদের মালপত্রের নিকট থেকে যান। পাদ্রী যখন দেখলেন যে, কাফেলার সব লোকই এসেছে। কিন্তু তিনি যে গুণ ও লক্ষণের কথা জানতেন, তা কারো মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তখন তিনি বললেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমার খাবার থেকে তোমাদের একজনও যেন বাদ না যায়। লোকেরা বলল, হে বাহীরা! আপনার নিকট যাদের আসা উচিত ছিল, তাদের একজনও অনুপস্থিত নেই। কেবল বয়সে আমাদের সকলের ছোট একটি বালক তাঁবুতে রয়ে গেছে। পাদ্রী বলল, না, তা করো না। ওকেও ডেকে পাঠাও, যেন সেও তোমাদের সঙ্গে এই খাবারে শরীক হতে পারে। বর্ণনাকারী বলেন, এর জবাবে কাফেলার এক কুরাইশ সদস্য বলে উঠল, লাত-ওজার শপথ! মুহাম্মদ ইব্ন আবদুল্লাহ ইব্ন আবদুল মুত্তালিব এই খাবারে আমাদের মধ্য থেকে অনুপস্থিত থাকা আমাদের জন্য দুৰ্ভাগ্যই বটে। অতঃপর সে উঠে গিয়ে মুহাম্মদ (সা)-কে কোলে করে এনে সকলের সঙ্গে আহারে বসিয়ে দেয়। বাহীরা তাকে দেখে গভীর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং তার দেহে সেসব লক্ষণ দেখার চেষ্টা করেন, যা তিনি তাঁর কিতাবে ইতিপূর্বে পেয়েছিলেন।
আহার পর্ব শেষে সকলে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। এই সুযোগে বাহীরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে গিয়ে বললেন, হে বালক! আমি তোমাকে লাত-ওজার শপথ দিয়ে জানতে চাচ্ছি, আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করবো, তার যথার্থ জবাব দিবে কি? বাহীরা লাত-ওজার নামে এই জন্যই কসম খেয়েছিলেন যে, তিনি মুহাম্মদ (সা)-এর সম্প্রদায়কে এ দুই নামের শপথ করতে অভ্যস্ত বলে শুনেছিলেন। যা হোক, জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আপনি আমাকে লাত-ওজার নামে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আল্লাহর শপথ! আমি এই দুটোর মত অন্য কিছুকেই এত ঘৃণা করি না। বাহীরা বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাকে যা যা জিজ্ঞেস করবো, তার যথাযথ জবাব তুমি দিবে কি? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আপনার যা ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করুন। বাহীরা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাঁর ঘুম, আকার-আকৃতি ইত্যাদি সব বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এক এক করে সব প্রশ্নের জবাব দিলেন। তাঁর প্রদত্ত সব বিবরণ বাহীরার পূর্ব থেকে জানা নবীর গুণাবলীর সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। তারপর বাহীরা তাঁর পিঠে দৃষ্টিপাত করে পূর্ব থেকে জানা বিবরণ অনুযায়ী তার দুস্কন্ধের মধ্যবর্তী স্থানে নবুওতের মহর দেখতে পান।
পাদী বাহীরা এবার নবীজির চাচা আবু তালিব-এর দিকে ফিরে বললেন, এই বালক আপনার কী হয়? আবু তালিব বললেন, আমার পুত্র। বাহীরা বললেন, না সে আপনার পুত্র নয়। এই বালকের পিতা জীবিত থাকতে পারে না। আবু তালিব বললেন, ও আমার ভাতিজা। পট্ৰী বললেন, ওর পিতার কি হয়েছে? আবু তালিব বললেন, ও যখন তার মায়ের গর্ভে তখন ওর পিতা মারা যান। পাদ্রী বললেন, ঠিক বলেছেন। ভাতিজাকে নিয়ে আপনি দেশে ফিরে যান।
আর ওর ব্যাপারে ইহুদীদের থেকে সতর্ক থাকবেন। আল্লাহর শপথ! ইহুদীরা যদি ওকে দেখতে পায় আর আমি ওর ব্যাপারে যা কিছু বুঝতে পেরেছি, যদি তারা তা বুঝতে পারে, তাহলে ওরা ওর অনিষ্ট করবে। আপনার এই ভাজিতাটি ভবিষ্যতে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হবেন। আপনি ওকে নিয়ে শীঘ্ৰ দেশে ফিরে যান। আবু তালিব সিরিয়ার বাণিজ্য শেষ করে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নিয়ে তাড়াতাড়ি মক্কায় ফিরে আসেন।
ইব্ন ইসহাক বলেন, যারীরা, ছামামা ও দারিসমা আহলে কিতাবের এই তিন ব্যক্তিও বাহীরার মত উক্ত সফরে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দেখেছিল এবং তাকে সনাক্ত করতে পেরেছিল। তারা রাসূল (সা)-এর ক্ষতিসাধন করার চেষ্টাও করে। বাহীরা তাদেরকে নিবৃত্ত করেন। তিনি তাদেরকে আল্লাহর কথা এবং তাওরাতে মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে যে বিবরণ আছে, সে সবের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তারা তাঁর বক্তব্য বুঝে ফেলে এবং তাকে সত্য বলে মেনে নেয়। ফলে তারা মুহাম্মদ (সা)-কে ছেড়ে দিয়ে ফিরে যায়।
ইউনুস ইব্ন বুকায়ার ইব্ন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, আবু তালিব উক্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনটি কাসীদা আবৃত্তি করেছিলেন। এতো গেল ইব্ন ইসহাক এর বর্ণনা! অন্য এক মুসনাদেও মারফু সূত্রে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।
হাফিজ আবু বকর আল-খারায়েতী বৰ্ণনা করেন যে, আবু বকর ইব্ন আবু মূসা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আবু তালিব সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা)-সহ আরও কয়েকজন কুরাইশী ব্যক্তি। পাদ্রী বাহীরার এলাকায় গিয়ে তারা যাত্রা বিরতি করে। তাদেরকে দেখে পাদ্রী বেরিয়ে আসেন। এর আগেও তারা এই পথে চলাচল করত; কিন্তু পাদ্ৰী কখনো বেরিয়ে আসেন নি, তাদের প্রতি ফিরেও তাকান নি। যা হোক কুরাইশ কাফেলা অবতরণ করে আর পাদ্ৰী বেরিয়ে তাদের নিকটে চলে আসেন ৷ এসেই তিনি নবীজি (সা)-এর হাত ধরে ফেলে বলেন, ইনি বিশ্বজগতের সরদার। বায়হাকীর বর্ণনায় অতিরিক্ত রয়েছে, ইনি বিশ্বজগতের প্রভুর রাসূল! আল্লাহ তাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমত বানিয়ে প্রেরণ করেছেন। একথা শুনে কুরায়শের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি বলে উঠল, আপনি তার সম্পর্কে কী জানেন? পাদ্রী বললেন, তোমরা পেছনের ঐ পাহাড়ের পাদদেশ অতিক্রম করার সময় প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাথর তাঁর প্রতি সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিল। আর এগুলো নবী ছাড়া অন্য কাউকেই সিজদা করে না। আর আমি তাকে তার কাধের সামান্য নিচে অবস্থিত মহরে নবুওত দেখে সনাক্ত করতে পেরেছি।
অতঃপর পাদ্ৰী ফিরে গিয়ে তাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করেন এবং খাবার নিয়ে এসে দেখতে পেলেন যে, একটি মেঘখণ্ড নবীজি (সা)-কে ছায়া প্ৰদান করছে। তিনি তখন উটের দেখাশোনা করছিলেন। কাফেলার কাছে এসে তিনি বললেন, ঐ দেখা মেঘ ওঁকে ছায়া দিচ্ছে। লোকেরা নবীজিকে গাছের ছায়া তলে নিয়ে আসে। নবীজি (সা) গাছের ছায়ায় বসা মাত্র ছায়া তাঁর প্রতি ঝুকে পড়ে। পাদ্রী বললেন, লক্ষ্য কর, গাছের ছায়া ওর প্রতি ঝুকে পড়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, পাদ্ৰী তখন কাফেলার লোকদেরকে শপথ দিয়ে বললেন, যেন তারা নবীজি (সা)-কে নিয়ে রোমে না যায়। কারণ রোমবাসী তাকে দেখলে লক্ষণ দেখে চিনে ফেলবে এবং হত্যা করে ফেলবে। এ কথা বলেই পাদ্ৰী মুখ ফিরিয়েই দেখতে পেলেন যে, সাতজন রোমক এগিয়ে আসছে। বর্ণনাকারী বলেন, দেখে পাদ্রী তাদের প্রতি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের আগমনের উদ্দেশ্য কী? জবাবে তারা বলল, আসলাম, কারণ আমরা জানতে পেরেছি যে, এই নগরীতে এ মাসেই এই নবীর আগমন ঘটতে যাচ্ছে। তাই প্রতিটি রাস্তায় লোক প্রেরণ করা হয়েছে। আর আমরা আপনার এ পথ দিয়ে তার আগমনের সংবাদ পেয়েছি। পাদ্রী বলনে, আচ্ছা, তোমাদের পেছনে কি কেউ আছে তোমাদের চাইতে উত্তম? তারা বলল, না। আমরা কেবল নবীর এই পথে আগমনের সংবাদ পেয়েই এসেছি। পাদ্রী বললেন, আচ্ছা, বলতো, আল্লাহ যে কাজ সম্পাদন করার ইচ্ছা করেন, তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কি কোন মানুষের আছে? তারা বলল, না। বৰ্ণনাকারী বলেন, একথার পর তারা পাদ্রীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এবং তার সাহচর্য অবলম্বন করে।
বর্ণনাকারী বলেন, এরপর পাদ্রী কুরাইশ কাফেলাকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, বল তো, এই বালকের অভিভাবক কে? জবাবে তারা বলল, আবু তালিব। পাদ্রী নবীজির ব্যাপারে পুনঃপুনঃ অনুরোধ করায় আবু বকর ও বিলালকে সাথে দিয়ে নবীজিকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দেন। পাদ্রী পাথেয় হিসাবে কিছু পিঠা ও যায়তুন তেল তাঁর সঙ্গে দিয়ে দেন।
তিরমিয়ী, হাকিম, বায়হাকী ও ইব্ন আসাকির এবং আরও বহু হাদীসবেত্তা ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসটির সনদ গরীব পর্যায়ের। ইমাম তিরমিয়ী বলেছেন, বর্ণনাটি হাসান ও গরীব। বায়হাকী ও ইব্ন আসাকিরও এটি উদ্ধৃত করেছেন।
আমার মতে, এ বর্ণনাটিতে কয়েকটি গারাবাত বিদ্যমান। প্রথমত, এটি সাহাবীগণের মুরসাল বর্ণনার অন্তর্ভুক্ত। কারণ আবু মূসা আশআরী আরবে আগমন করেছেন খায়বারের বছর অর্থাৎ হিজরতের সপ্তম বছর। ইব্ন ইসহাক যে তাকে মক্কা থেকে হাবশায় হিজরতকারী অভিহিত করেছেন, সে তথ্য গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব বর্ণনাটি মুরসাল। কারণ, ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন রাসূল (সা)-এর বয়স ছিল বার বছর। সম্ভবত আবু মূসা এ প্রসিদ্ধ ঘটনাটি অন্য কারো মুখে শুনেই বর্ণনা করেছেন।
দ্বিতীয়ত, এর চেয়ে বিশুদ্ধতার হাদীসেও মেঘের কথা উল্লেখ নেই। তৃতীয়ত, এই যে বলা হল, আবু বকর তার সঙ্গে বিলালকে প্রেরণ করলেন, কথাটাও গ্রহণযোগ্য নয়; কারণ, সে সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স ছিল বার বছর, তাহলে আবু বকর এর বয়স ছিল নয় কি দশ বছর। আর বিলালের বয়স তার চেয়েও কম। এমতাবস্থায় প্রশ্ন জাগে, ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন আবু বকরই বা কোথায় ছিলেন, বিলালই বা ছিলেন কোথায়? দুজনই তো তখন ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত। তবে, একথা বলা যায় যে, ঘটনাটি এরূপ ঘটেছিল ঠিকই। তবে এটি অন্য কোন ঘটনা কিংবা তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স বার বছর হওয়ার বর্ণনাটি সঠিক নয়। কারণ, ওয়াকিদী ছাড়া আর কেউ বার বছরের কথা উল্লেখ করেন নি। সুহায়লী বৰ্ণনা করেছেন। যে, সে সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স ছিল নয় বছর। আল্লাহই ভালো জানেন।
মুহাম্মদ ইব্ন সালিহ সূত্রে ওয়াকিদী বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স যখন বার বছর, তখন তিনি চাচা আবু তালিব এর সাথে একটি বণিক কাফেলার সাথে সিরিয়া সফর করেন। পথে তারা পাদ্রী বাহীরার মেহমান হন। তখন বাহীরা আবু তালিবের কানে কানে কী যেন বললেন। নবীজি (সা)-এর প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার জন্য বলেন। ফলে আবু তালিব তাকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দেন।
মহান আল্লাহর হেফাজতে আবু তালিবের নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (সা) যৌবনপ্রাপ্ত হন।
এ সময়ে আল্লাহ তাকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় যাবতীয় জাহিলী কর্মকাণ্ড ও দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত রাখেন। ফলে তিনি সমাজে ব্যক্তিত্বে সকলের শ্রেষ্ঠ, চরিত্রে সর্বোত্তম, আলাপে-ব্যবহারে, উঠায়-বসায় সবচাইতে ভদ্র, সহনশীলতা-বিশ্বস্ততায় সবচাইতে মহান, কথা-বার্তায় সত্যবাদী, সমস্ত অশ্লীলতা ও নোংরামী থেকে মুক্ত। কখনো তাকে নিন্দাবাদ করতে বা কারো সাথে কলহ-বিবাদ করতে দেখা যায়নি। সব দেখে তার স্বজাতি, তার নাম দেয় আল-আমীন। আল্লাহ প্রদত্ত এসব গুণাবলি দেখে আবু তালিব নিজের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ ও সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রাখেন।
মুহাম্মদ ইব্ন সাদ আবু মুজালিয থেকে বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর আবু তালিব মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হন। নবীজি (সা)-কে সঙ্গে না নিয়ে তিনি সফর করতেন না। একবার (নবীজিকে সঙ্গে নিয়ে) তিনি সিরিয়ার অভিমুখে রওয়ানা হন। পথে এক স্থানে যাত্রা বিরতি দেন। এক পাদ্রী সেখানে এসে বলেন, তোমাদের মধ্যে একজন পুণ্যবান ব্যক্তি আছেন। অতঃপর বললেন, এই বালকের পিতা কোথায়? জবাবে আবু তালিব বললেন, এই তো আমিই তার অভিভাবক। পাদ্রী বললেন, এই বালকের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখবেন। একে নিয়ে সিরিয়া যাবেন না। ইহুদীরা বড় হিংসাপরায়ণ। সুযোগ পেলে তারা এর ক্ষতি করবে বলে আমি আশংকা করছি। আবু তালিব বললেন, একথা শুধু আপনিই বলছেন না, এটা আল্লাহরও কথা। অতঃপর আবু তালিব তাকে মক্কা ফেরতে পাঠান এবং বলেন, হে আল্লাহ! মুহাম্মদকে আমি তোমার হাতে সোপর্দ করলাম। আবু তালিব মৃত্যু পর্যন্ত মুহাম্মদ (সা)-এর দেখাশুনা করেন।
বাহীরার কাহিনী
সুহায়লী যুহরীর সীরাত গ্ৰন্থ থেকে বর্ণনা করেন যে, বাহীরা একজন ইহুদী পণ্ডিত ছিলেন। আমার মতে, উপরের কাহিনী থেকে যা বুঝা যায়, তা হলো, বাহীরা ছিলেন। খৃষ্টান পাদ্ৰী। আল্লাহই সম্যক অবহিত। মাসউদী থেকে বর্ণিত বাহীরা আবদুল কায়স গোত্রের লোক ছিলেন। তার আসল নাম ছিল জারজীস।
ইব্ন কুতীয়বার মাআরিফ কিতাবে আছে, ইসলামের সামান্য পূর্বে জাহেলী যুগে এক ব্যক্তি শুনতে পেয়েছিলেন যে, কে যেন বলছে, পৃথিবীর সেরা মানুষ তিনজন। বাহীরা, রিআব ইব্ন বারা আশ-শামী এবং তৃতীয়জনের আগমন এখনও ঘটেনি। সেই তৃতীয়জন ছিলেন। প্রতীক্ষিত রাসূলুল্লাহ (সা)। ইব্ন কুতায়বা বলেন, এই ঘোষণা শ্ৰবণের পর রিঅ্যাব ইব্ন শামী এবং তার পিতার কবরে অবিরাম হালকা বৃষ্টিপাত হতে দেখা গিয়েছিল।