1 of 2

৩৪. চক্ষু মেলে নবীনকুমার

চক্ষু মেলে নবীনকুমার প্রথমে বুঝতেই পারলো না যে সে কোথায়? ঘরের ছাদ অন্য রকম, এত সরু সরু কড়িকাঠের ছাদ সে আগে কখনো দেখেনি। জানলায় চৌকো সবুজ-রঙা কাঠের গরাদ, সেই জানলার বাইরে দিয়ে আকাশের ভাসমান মেঘ দেখা যাচ্ছে। নবনীকুমারের শয়নকক্ষ থেকে তো এমনভাবে আকাশ দৃশ্যমান নয়।

হঠাৎ তোপ দাগার শব্দ হতে সে বিষম চমকে উঠলো। এত জোরে তোপের শব্দ তো সে কোনোদিন সকালে শোনেনি, মনে হয় যেন খুব কাছে। পর পর সাত বার তোপ দাগ হলো কেল্লা থেকে, অর্থাৎ সকাল এখন সাত ঘটিকা। সে ধড়মড় করে উঠে বসলো। এ তার নিজ গৃহ নয়, এ তো মুলুকচাঁদের সেই ঘর। দিনের আলোয় কোনোদিন এখানে নবীনকুমার আসেনি বলে সব কিছুই তার অচেনা বলে বোধ হলো।

জাজিম পাতা তক্তপোষের ওপর শুয়ে ছিল সে, মেঝেতে লম্বা ঠ্যাং দুটি গুটিয়ে শরীরটাকে দ-এর আকৃতি দিয়ে এখনো ঘুমোচ্ছে রাইমোহন, ফাটা বাঁশীর শব্দের মতন নাসিকা ধ্বনি হচ্ছে তার। মেঝেতে আর এক পাশে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে আর এক ব্যক্তি, তার ওষ্ঠের পাশ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। উচ্ছিষ্ট মাখা একটি খাবারের পিরীচের ওপর ভন ভন করছে এক রাশ নীল ড়ুমো মাছি, তার পাশেই পড়ে আছে শাস্তা জরি বসানো একটি ব্যালঝেলে লাল ওড়না।

নবীনকুমার দু হাতে চক্ষু ঘর্ষণ করলো। এখানে সে রাত্রি যাপন করেছে, এই নোংরা পরিবেশে? কেন? কী হয়েছিল গত রাত্ৰে! তার কিছুই মনে পড়লো না। শরীরে একটা বিবমিষার ভাব। অন্যের ব্যবহৃত এমন অপরিচ্ছন্ন শয্যায় অন্য নীচু শ্রেণীর লোকদের সঙ্গে একই কক্ষে সে কখনো শয়ন করেনি।

নবীনকুমার তক্তাপোষ থেকে মেঝেতে নেমে দাঁড়ালো। সে বসেছিল কৌচে, সেখান থেকে রাত্রে তক্তাপোষের ওপর গেল কী করে? কী যেন একটা খবর পেয়ে হরিশ হঠাৎ চলে গেলেন। তারপর একটি নর্তকী এলো। এ নর্তকীটি অন্য ধরনের, অঙ্কের ছকে পা মেলোনর বদলে ঘাগড়া ওড়াচ্ছিল বেশী, একটি সূরা ভর্তি গেলাস রেখেছিল মাথার ওপরে। হরিশ এ রকম নাচ পছন্দ করেন না, সেইজন্যই কি হরিশের অনুপস্থিতিতে চটুল নৃত্য শুরু হয়েছিল। হরিশ নেই বলে নবীনকুমারকেই সকলে প্ৰধান অতিথি হিসেবে খাতির করছিল। নর্তকীটি বার বার তার সামনে এসে অঙ্গভঙ্গি করছিল নানারকম। তারপর আর কিছু স্মরণে আসে না। সে কি চেতনা হারিয়ে ফেলেছিল একেবারে?

মুলুকচাঁদ এই সময় সেই কক্ষে ঢুকে উৎফুল্লভাবে বললেন, এই তো, আপনি উঠিয়ে পড়েছেন? তবিয়ৎ ভালো আছে তো? লিন, মুখ ধুয়ে লিন, তারপর একটু গরম গরম দুধ আর জিলাপি খান।

মুলুকচাঁদ এরই মধ্যে স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্র পরেছেন। কপালে তিলক, দু কানের লতিতে টাটকা চন্দনের ফোঁটা, মুখে বেশ একটা পরিতৃপ্তির ভাব। যেন তিনি সারাদিনের কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ার

নবীনকুমার আচ্ছন্নের মতন জিজ্ঞেস করলো, আমার কী হয়েছিল কাল? আমি বাড়ি যাইনি কেন? মুলুকচাঁদ বললেন, কুছু তো হয়নি। আচানক আপনার নিন্দ এসে গেলো, হাত থেকে গিলাসটা খসে পড়লো, তখন হামিলোক সব ধোরাধোরি করে আপনাকে শুইয়ে দিলাম। কোষ্ট হয়েছে খুব? আহা-হা, বহুৎ মচ্ছর কেটেছে! শালা, ইত্‌না মচ্ছর

নবীনকুমার বললো, আমার ঘুম এসে গেসলো, তো আমায় ডেকে তুলে বাড়িতে পাটিয়ে দিলেন না কেন? আমি কখুনো বাড়ির বাইরে থাকি না—

মুলুকচাঁদ বললেন, অনেক তো ডাকাডাকি করলুম। লেকিন সরাবের নিন্দ কি সহজে ভাঙে! আপনি তো স্রিফ পাত্থর বনে গেলেন। হামি তখুন। নাচ-গানা সোব বন্ধ করে দিলুম। বললুম কী, বাবুজীর নিন্দ এসে গেছে, আভি সব চুপ যাও! হরিশেরও এমুন হয়, সে তখুন শুয়ে যায়।

নবীনকুমার আর কথা না বাড়িয়ে বললো, আমি বাড়ি যাবো, আমার জন্য গাড়ি ডাকতে হবে।

মুলুকচাঁদ বললেন, আপনার গাড়ি তৈয়ার আছে।

মুলুকচাঁদ শ্বেত পাথরের গেলাসে গরম দুধ এবং শাল পাতায় মোড়া এক চাঙ্গাড়ি জিলিপি এনে হাজির করলো, কিন্তু নবীনকুমারের কোনো খাদ্য গ্ৰহণেই প্রবৃত্তি নেই এখন। সে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।

লম্বা টানা অলিন্দের একেবারে শেষ প্রান্তে দেয়ালে ঠেস দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে বসে ঘুমুচ্ছে দুলালচন্দ্র। সারারাত্রি সে এইভাবেই কাটিয়েছে। নবীনকুমার তার কাছে গিয়ে দুবার নাম ধরে ডাকতেই সে ত্রস্তে উঠে দাঁড়ালো। নবীনকুমার বললো, চল! হাঁটতে গিয়ে নবীনকুমার টের পেল, তার এখনো পা কাঁপছে, মস্তিষ্কের মধ্যে টলোমলো ভাব। ভাঙচুড়ো প্রাসাদটির বহিদ্বারে নবীনকুমারের জুড়ি গাড়িটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সহিস এবং পিছনের ভৃত্যটি ছাদের ওপর ঘুমন্ত। দুলাল তাদের ডেকে তুললো। মুলুকচাঁদ প্রত্যুৎগমন করার জন্য দ্বার পর্যন্ত এসেছেন, কিন্তু নবীনকুমার আর কোনো কথা না বলে উঠে বসলো কোচের মধ্যে।

জোড়াসাঁকোর সিংহ সদনের সামনে সেই একই সুদৃশ্য, জমকালো জুড়ি গাড়িটি থামলো, যে গাড়ি ঠিক এমনই ভাবে অনেক বৎসর আগে এ রকম সকালে ফিরে আসতো। রামকমল সিংহকে নিয়ে। আজ রামকমল সিংহের বদলে গাড়ি থেকে নামলো তাঁর অষ্টাদশ বৎসর বয়স্ক পুত্র। পোশাক মলিন, চক্ষু দুটি আরক্ত, চুল অবিন্যস্ত। মুখ নিচু করে গাড়ি থেকে নেমে নবীনকুমার চলে এলো ভিতরে। সে কারুকে ভয় পায় না, তবু নিজেকে তার মনে হচ্ছে অপরাধী। তার সর্বাঙ্গে যেন অশুচি হয়ে গেছে। গলার মধ্যে যেন জমে আছে বাম্প, কান্না দমনের সময় এ রকম হয়।

নিজের ঘরে প্রবেশ করে পালঙ্কে বসা মাত্র সরোজিনীও এলো সেই ঘরে। নবীনকুমারের পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে সে জুতো খুলে দিতে লাগলো। তারপর মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো, আপনার স্নানের জল দিতে বলবো কি?

নবীনকুমার শুধু বললো, হুঁ।

সরোজিনী আবার জিজ্ঞেস করলে, আজ তেল মাকাবেন? যদুকে ডাকবো?

নবীনকুমার পুনরায় বললো, হুঁ।

সরোজিনী উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি স্নান সেরে নিন, আমি ঠাকুরকে খাবার দিতে বলচি।

সরোজিনী বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নবীনকুমার বিমূঢ়ের মতন বসে রইলো। সরোজিনী তো একবারও প্রশ্ন করলো না, কাল ফেরেনি কেন, কিংবা কোথায় ছিল। তার কথায় কোনো অভিমানের ছায়া পর্যন্ত নেই!

অনেকক্ষণ একই অবস্থায় বসে রইলো নবীনকুমার। সামনের আয়নায় সে তার মুখখানি দেখতে পাচ্ছে। এক রাত্রেই যেন অনেকখানি বদল হয়েছে তার। মুখভর্তি মশার কামড়ের দাগ, ওষ্ঠের ওপর যে সব গুম্ফের রেখা দেখা দিয়েছিল, এখন যেন তা হঠাৎ গাঢ় বৰ্ণ ধারণ করেছে।

একটু পরে সরোজিনী এসে তাড়া দিল, ও কি, আপনি চান কত্তে গেলেন না? নুচি ভাজা হচ্চে, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে যে?

নবীনকুমার বললো, হ্যাঁ, যাই।

ভালো করে শরীরে সরষের তেল দলাইমলাই করিয়ে স্নান সেরে নিল সে। আহারে রুচি নেই, তবু কিছু খেতে হলো। মে মাসের আকাশ গুমোট হয়ে আছে, শরীরে জ্বালা ধরানো গ্ৰীষ্মের উত্তাপ, সরোজিনী পাখার বাতাস করতে লাগলো তাকে।

এক সময় নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, আমি যে কাল রাত্রে বাড়ি ফিরিনি, মা সে কতা জানেন?

সরোজিনী বললো, হ্যাঁ, জানেন।

—মায়ের দাসীকে খপর দাও, মায়ের পুজোআচ্চা সারা হলে আমি একবার তাঁর সঙ্গে দেকা কর্বো।

খাওয়া শেষ হলে সরোজিনী একটি রূপের রেকবিতে করে কয়েকটি সাজা পানের খিলি তার সামনে ধরলো। নবীনকুমার বাড়িতে কোনোদিন পান খায় না, ধূমপানের অভ্যেসও তার নেই। কিন্তু মুলুকচাঁদের ওখানে কয়েকদিন সকলে বারংবার পীড়াপীড়ি করায় সে দু-একটি পান মুখে দিয়েছে। আজ সকালে তার ওষ্ঠাধর তাম্বুল রসে রক্তিম ছিল, তা দেখেই সরোজিনী পান এনে দিয়েছে।

নবীনকুমার হাত দিয়ে রেকাবিটা সরিয়ে দিয়ে বললো, থাক্‌!

সরোজিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, এবার সে প্রায় সারাদিনের মতন অদৃশ্য হয়ে যাবে। বাড়ির পুরুষদের সঙ্গে বাড়ির নারীদের দিবাভাগে দেখা সাক্ষাতের প্রথা নেই। কিন্তু নবীনকুমারই এ প্রথা ভেঙেছিল, সে কোনো দাস-দাসীর কাছ থেকে তার নিজস্ব পরিচর্যা পছন্দ করে না। তার স্নানাহারের সময় সরোজিনীর উপস্থিতি চাই।

মস্তিষ্ক এখনো ঠিক পরিষ্কার হয়নি, তার ইচ্ছে করছে শুয়ে থাকতে। কিন্তু সে দুর্বলতা দমন করে সে দেখা করতে গেল তার মায়ের সঙ্গে।

বিম্ববতী পুত্রের জন্য প্ৰস্তুত হয়েই বসেছিলেন। নিজের হাতে দই, লেবুর রস ও মধু দিয়ে সরবৎ বানিয়েছেন, রাত্রি জাগরণের পর এই সরবৎ খেলে শরীর ঠাণ্ডা হয়। তাঁর স্বামীও এই সরবৎ পান করতে ভালোবাসতেন। নবীনকুমারের হাতে গেলাসটি তুলে দিয়ে তিনি বললেন, নে, এক চুমুকে খেয়ে নে।

কোঁচার ফুলটি বাঁ হাতে ধরে মায়ের ঘরে একটি কেদারায় বসলো নবীনকুমার। গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কেমন আচো, মা? অনেক দিন তোমার শরীর গতিকের খপর নেওয়া হয়নি কো।

বিম্ববতী মুগ্ধ, বিগলিত হয়ে প্রায় ছলোছালো নেত্ৰে বললেন, আমি ভালোই আচি রে, খুব ভালো আচি। তোদের ভালোতেই আমার ভালো। আমার বউমাটি অতি সতীলক্ষ্মী, ভালো বংশের মেয়ে তো, খুব উঁচু নজর, আমায় খুব দ্যাকে, পান থেকে চুনটি খসলেই একেবারে হা-হা করে আসে।

নবীনকুমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে চেয়ে রইলো। যেন এই রমণীটি তার অচেনা, সে এঁর অন্তর যাচাই করার চেষ্টা করছে।

অপ্রত্যাশিত ভাবে সে বললো, মা, ইব্রাহিমপুরে আমাদের কুঠিবাড়িটা আমি বেচে দেবো ঠিক করিচি!

বিম্ববতী বললেন, সে কি, তুই আবার সম্পত্তি বেচাবি? কেন, তোর টাকার খামতি পড়লো কিসে?

—ইব্রাহিমপুরে আমাদের সব জমি নীলকর সাহেবদের ইজেরা দেওয়া হয়েছে, সুদু সুদু কুঠিবাড়িটা টিকিয়ে রেখে লাভ কী? চারটে লোকের মাসমাইনে ফালটুস খর্চা।

—ইজেরায় জমি তো আবার ফেরত পাওয়া যায় শুনিচি।

–বাঘের মুখ থেকে কেউ কখুনো ছাগল ছানা ফেরত এনেচে, শুনেচে? ও জমি ইজেরা দেওয়াই ভুল হয়েছেল।

—এ সব বিষয় সম্পত্তির কতা আমার সঙ্গে ক্যানো বাপু? তোরা যা ভালো বুজিস করবি। তোর জ্যাটাবাবু রয়েচেন, তাঁর পরামর্শ নিয়ে চললে…

–হ্যাঁ ও বিষয়েও একটা কতা আচে, মা। জ্যাঠাবাবুকে যদি আমি এ বাড়িতে কখুনো ডেকে পাটাই, তাতে তাঁর কি অপমানিত বোধ হবে? উকিলের পরামর্শ আমার তো দরকার বটেই, কিন্তু আমি শপথ করিচি, ও বাড়িমুখো আমি কোনোদিন হবো না।

-ওমা, এমন শপত…তুই কী বলচিস ছোট্‌কু? কেন, যাবি না কেন ও বাড়িতে?

—তোমার মনে নেই, সেই যে জ্যাঠাবাবুর নাতির উপনয়নের দিনকে আমায় অপমান করেছিলেন? ওঁরা বামুন, আমরা কায়েত, আমরা কখুনো এক হতে পারি না।

—তোর জ্যাটাবাবুর সঙ্গে আমাদের আবার বামুন-কায়েতের সম্পর্ক কী? তুই কী সব অলুক্ষণে কতা কইচিস!

—আমি ঠিকই বলচি মা। আমি শিবুকে দেখতে যাচ্চিলুম, আমায় বারণ করা হয়েছেল, কারণ আমি বামুনের ছেলে নই। ও বাড়িতে আর আমি কোনোদিন পা দেবো না।

বিম্ববতী একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর মুখখানিতে বিষাদের ম্লান ছায়া একবার পড়েই আবার মিলিয়ে গেল। তিনি মিনতি মাখা আর্দ্র স্বরে বললেন, বাবা ছোটকু, তোকে একটা কতা বলবো? তুই রাকবি বল? আমার মাতার দিব্যি, তুই আমার এই একটা অনুরোধ যদি রাকিস…

নবীনকুমার তৎক্ষণাৎ কোমল কণ্ঠে বললো, কেন রাকবো না, মা? তোমার কতা কি আমি ফেলতে পারি? তুমি যা বলবে নিশ্চয়ই মানবো!

—তুই তোর জ্যাটাবাবুর সঙ্গে অসৈরণ করিসনি। লক্ষ্মী মানিক আমার, উনি গুরুজন, আমাদের সোংসারের মাতার ওপর ছাতা ধরে আচেন অ্যাতদিন, তাঁকে তুই অচ্ছেদ্দা করিসনি! উনি তোর ভালো বই মন্দ কখুনো চাইবেন না…

নবীনকুমার একটুক্ষণ হাসিমুখে চেয়ে রইলো জননীর দিকে। তারপর বললো, তুমি ভয় কেন পাচ্চো, মা! আমি কতা দিলুম, জ্যাঠাবাবুর সামনে কখুনো অশুদ্ধার ভাব দেকাবো না।

আর কিছুক্ষণ কথা হলো এই বিষয়ে। নবীনকুমার বার বার আশ্বস্ত করলো বিম্ববতীকে, এমন কি একবার সে উঠে কাছে এসে জননীর বাহু ছুঁয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, তুমি কেন উতলা হচ্চো, মা? আমি কি তোমার অবাধ্য ছেলে?

 

মাতা পুত্রের এই আলাপচারির পর দুজনের মনে প্রতিক্রিয়া হলো দুরকমের। অনেকদিন পর বিম্ববতী আনন্দ সাগরে ভাসতে লাগলেন। নবীনকুমারের এমন মধুর ব্যবহার তিনি প্রত্যাশাই করেননি। ছেলে ঠিক তার বাপের ধাত পেয়েছে। রামকমল সিংহও দু-চারদিন বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়ে এলে তারপর বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে খুব নরম ব্যবহার করতেন, এমন কি ঝি চাকরদের সঙ্গেও কথা বলতেন মধু ঢালা কণ্ঠে। স্ত্রীর প্রতি তাঁর সোহাগ উথলে উঠতো। বিধুশেখরের সঙ্গে সন্ধি করতে নবীনকুমার এক কথায় রাজি হয়ে গেল। এবার বিম্ববতী নিশ্চিন্ত, এখন তাঁর প্রয়োজন শুধু বিধুশেখরের কাছ থেকে তাঁর নিজের মুক্তি। এবার তিনি এই সংসার থেকে বিদায় নেবেন, এবং বিধুশেখরের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যাবেন।

নবীনকুমার তার ঘরে ফিরে এলো ক্ষুব্ধ হয়ে। মনের মধ্যে চাপা ক্রোধ ও অপমান। তার মায়ের সঙ্গে বিষয় সম্পত্তির আলোচনা করার বাসনা তার বিন্দুমাত্র ছিল না, বিশেষত আজ। কিন্তু একটা কিছু প্রসঙ্গ তুলে তো কথা শুরু করতে হয়, তাই সে ইব্রাহিমপুরের কুঠির কথা বলেছিল। সে অপেক্ষা করছিল, মা তাকে অন্য কথা বলবেন। সে নিজে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে, মা কি এর মর্ম বোঝেননি? কাল রাত্রে সে বাড়ি ফেরেনি, সেজন্য একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না? মা তাকে কখনো ভর্ৎসনা করেন না, কিন্তু  স্নেহের সুরে তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা তো করতে পারতেন। তুললেন কিনা বিধুশেখরের প্রসঙ্গ। মায়ের কণ্ঠে তার জন্য একটু উদ্বেগও প্রকাশ পেল না, এতই স্বাভাবিক গৃহের বাইরে রাত্রি যাপন? সবাই ধরে নিয়েছে, সে তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করবে?

 

সেই রাত্রেই নবীনকুমার আবার গেল মুলুকচাঁদের বাড়িতে। তারপর প্রতি রাতে। সুরাপানের নেশা শুরু হলো বল্গাহীন ভাবে। নৃত্য গীতের আসরে সে জাঁকিয়ে বসে। হরিশ নেই, তিনি গেছেন বারাসতে, সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাসিলি ইডেন রায়ত প্রজাদের জন্য যে রুবকারি জারি করেছিলেন, সেটা কার্যকর করবার জন্য তিনি নীলকরের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে লড়ছেন। হরিশের অনুপস্থিতিতে নবীনকুমারই মুলুকচাঁদের রাত্রি বাসরের প্রধান ভোক্তা। সে নিজেও অর্থব্যয় করতে লাগলো অফুরন্ত। প্রতি রাত্রেই বারাঙ্গনা-নর্তকী আনা হতে লাগলো একাধিক। প্রায়ই নবীনকুমার রাত্রে স্বগৃহে ফেরে না। একবার যখন শুরু করেছে, তখন সে এর চূড়ান্ত না দেখে ছাড়বে না।

বাঘের সঙ্গে ফেউ-এর মতন রাইমোহন ঠিক তার সঙ্গে লেগে আছে। আরও বেশ কয়েকজন ইয়ার বক্সীও জুটেছে। সদ্য বখামি ধরা ধনী যুবকদের কীভাবে উস্কানি দিতে হয়, সে ব্যাপারে তাদের পেশাদারী দক্ষতা আছে। তারা নানাপ্রকারে নবীনকুমারকে নাচাতে লাগলো এবং প্রমোদ আসরটি এর পর আব শুধু মুলুকচাঁদের আখড়াতেই সীমাবদ্ধ রইলো না। রাইমোহন কিছুদিন রামকমল সিংহের মোসাহেবী করেছিল, এখন তাঁর পুত্রের মোসাহেব হতে যেন তার আরও বেশী উৎসাহ।

রাইমোহন একটা কথা বলে প্রায়ই নবীনকুমারকে খোঁচা দেয়। সে যতই বড়-মানুষী করুক, যতই নৃত্যগীতের সমঝদার হোক, এ শহরের সবচেয়ে নামকরা নর্তকীর নাচ তো সে এখনো দেখেনি! কমলাসুন্দরীর নাম দেশসুদ্ধ সব মানুষ জানে, বয়েস একটু হয়েছে বটে, কিন্তু এখনো কী রূপ, এখনো কী কোমরের ছন্দ!

একদিন রাইমোহনের চেষ্টার ফল ফললো। সেদিন বেশ গোলাপী গোছের নেশা হবার পর নবীনকুমার রাইমোহনকে বললো, যাও নিয়ে এসো সেই বেটীকে; কত টাকা নেয় সে? গাধার মুখের সামনে যেমুন গাঁজরের টোপ ধরে, তেমনি তার সামনে টাকার তোড়া তুলে ধরে গে!

রাইমোহন জিভ কেটে বললো, ওরে বাপরে বাপ! তার কাচে টাকার গরমটি দেকাবার উপায় নেই কো! সে এদানি কারুর বাড়িতে যায় না। তার কুঠীতে যেতে হয় নাচ দেকবার জন্যে। তাও সকলকে দেয় না। শুনিচি, স্বয়ং লকনৌয়ের নবাব নাকি ডেকে পাট্যেছেলেন, ও মাগী যায়নি!

নবীনকুমার বললো, সে আসে না, কিসের তার এত দেমাক? নাচুক কুঁদুক যাই করুক, বাজারে-অবিদ্যা ছাড়া তো আর কিচু নয়!

রাইমোহন বললো, তাকে আর পাঁচটা মেয়েমানুষের মতুন ভাববেন না। তা হলে কি আর এত করে নাম কচ্চি! কালো কষ্ঠিপাথরে গড়া যেন একখানি প্ৰতিমা, বয়েসের ছোঁয়া তার গায়ে লাগে না। কত রাজা-রাজড়া তাকে বাঁধা রাঁড় কত্তে হা-পিত্যেশী হয়েছেন, কিন্তু ভাবী ভোলবার নয়! দেকতে আমন সুন্দর হলে কী হবে, তার কতগুলো বড় চ্যাটাঙে। আপনার নাম শুনলে বোধ করি আপনাকে ঢুকতেই দেবে না!

—কেন, আমার নাম শুনলে ঢুকতে দেবে না কেন? আমি কি ব্ৰহ্মদৈত্যি না মামদে ভূত?

—সে একটা গুঢ় কতা আচে। সে আপনাকে বলা যাবে না! নবীনকুমার টলতে টলতে উঠে এসে রাইমোহনের কণ্ঠ চেপে ধরলো দু হাতে। গর্জন করে বললো, তুমি আমার কাচে কী নুকোচো? সব সময় তুমি আমার কাচে ঐ মেয়েমানুষটার নাম বলো কেন? আবার কেনই বা বলচো আমার নাম শুনলে সে ঢুকতে দেবে না?

রাইমোহন বললো, আগে সে মাগীর সঙ্গে আমার যথেষ্ট এয়ার্কি ছেল, আমি অনেকবার ওখেনে গতায়াত করিচি। এদানি আমি আপনার সঙ্গে মেলামেশা কচ্চি শুনে সে ক্ষাপচুন্নি হয়ে আচে, আমায় আর ঢুকতে দেয় নাকো!

নবীনকুমার আরও কুপিত হয়ে বললো, আমায় সে চেনে? আমি এর মধ্যে এত নামজাদা হয়ে পড়িচি!

অন্য একজন ফোঁড়ন দিল, এত কতার দরকার কী, সব্বাই মিলে একবার তার কাচে গেলে তো হয়, তা হলে চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়ে যাবে খন!

নবীনকুমার রাইমোহনকে ছেড়ে দিয়ে বললো, চলো! এখুনি চলো!

 

সদলবলে হই হই করে বেরিয়ে পড়লো সকলে। কমলাসুন্দরীর গৃহ অদূরেই। হেমপীরের গলির মধ্যে সেই উদ্যান সমন্বিত বারান্দাওয়ালা বাড়ি। নবীনকুমার এলো জুড়ি গাড়িতে, অন্যরা পায়ে হেঁটে। রাত প্ৰায় এগারোটা। কমলাসুন্দরীর বাড়িতে আজ কোনো আসর বসেনি, অধিকাংশ কক্ষই অন্ধকার, দেউড়ির লোহার গেট বন্ধ, সেখানে পাহারা দিচ্ছে দুজন দ্বারবান।

দ্বারবানরা জুড়ি দেখেই চিনতে পারলো। বিস্মিত মুখে গাড়ির দরজা খুলে দিল তারা। রাইমোহন তার ওপরে তড়পে বললো, ব্যাটার হাঁ করে দেকচিস কী, চিনতে পারিসনি? বড়বাবু রামকমল সিংহের একমাত্র ছেলে নবীনকুমার। দেউড়ি খোল!

দ্বিরুক্তি না করে গেট খুলে দিল দ্বারবানেরা। নবীনকুমারের বেশ বেসামাল অবস্থা, কোঁচার ওপরে পা পড়ে যাওয়ায় সে হুমড়ি খাচ্ছিল, রাইমোহন তাকে ধরলো। নবীনকুমারের চেতনাও প্রায় লোপ পাবার পথে, সে এর মধ্যেই ভুলে গেছে যে কোথায় এসেছে। সে জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, এটা কার বাড়ি?

রাইমোহন রঙ্গ করে বললো, এই তো কমলাসুন্দরীর বাড়ি। এটা আপনার নিজের বাড়িও বলতে পারেন।

অন্য একজন ইয়ার বললো, তবে যে বাওয়া বলেছেলে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না! আগেই তো জাঁক করে বাবুর নাম শোনালে! চিচিং ফাঁকের মতন দোরও খুলে গেল!

রাইমোহন তার দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে বললো, চোপ! তারপর নবীনকুমারকে বললো, আসুন ছোটবাবু, আসুন।

নবীনকুমার বললো, নাচ দেকবো না? নাচ?

—নিশ্চয় দেকবেন? এসে পড়িচি যখন…আসুন, ওপরে আসুন।

দ্বিতলে সিঁড়ির মুখে দু-তিনটি যুবতী আলুথালু বেশে দাঁড়িয়েছে এসে, রাইমোহন জিজ্ঞেস করলো, কই, বিবিসাহেবা কোতায়?

একটি মেয়ে বললো, এত রাতে তোমরা কে গা? দ্বারোয়ান ব্যাটারা তোমাদের দোর খুলে দিলে?

রাইমোহন ধমকে বললো, চুপ কর বেটী। জানিস কে এসেচে? কার বাড়িতে তোরা আচিস, জানিস? স্বয়ং বাড়ির মালিক এয়েচেন। কমলী কোতায়?

—সে তো দোর আটকে শুয়ে পড়েচে!

নবীনকুমার জড়িত স্বরে বললো, নাচ কোতায়, নাচ? কে নাচবে? গলা যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল!

রাইমোহনের সঙ্গেই বোতল ছিল, নবীনকুমারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ভিজ্যে নিন গলা, শুকো গলায় কী আর নাচ জমে?

কমলাসুন্দরীর নিজস্ব কক্ষ কোনটি তা রাইমোহনের অজানা নয়। সে দরজায় ধাক্কা দিয়ে রাইমোহন চেঁচিয়ে বললো, কমলী, অ্যাই কমলী, ওট্‌, দ্যাক কাকে এনিচি।

 

হল্লা শুনে কমলাসুন্দরী আগেই জেগে উঠেছিল, দ্বার খুললো সঙ্গে সঙ্গেই। তার অঙ্গে ইহুদী-আনা কিংখাপের লম্বা ঝোলা পোশাক, গলায় এক ছড়া সবুজ পান্নার মালা, চুল খোলা। রাইমোহন মিথ্যে বলেনি, কমলাসুন্দরীর রূপ এখনো আগেকার মতন নিটোল আছে, শুধু বয়েসের জন্য খানিকটা মেদ লেগেছে।

রাইমোহন সাড়ম্বরে বললো, ওরে কমলী, শাঁক বাজা, আজ তোর কত ভাগ্যি! বড়বাবুর ছেলে এয়োচেন, দ্যাক, পাদ্যার্ঘ্য দে!

কমলাসুন্দরী তখনও ঠিক বুঝতে পারেনি। ভুরু দুটো তুলে জিজ্ঞেস করলো, কাকে এনোচো? কার ছেলে বললে? বড়বাবু কে?

—বড়বাবু আবার কজন রে, অ্যাঁ? বড়বাবু একজনই হয়। তোর বড়বাবু, যিনি কোলে শুয়ে মল্লে তুই বেধবা হইচিলি! তেনার ছেলে তোর পীরিতের জন্যে এসেচেন!

নবীনকুমার বললো, নাচ কোতায়, নাচ? আমার যে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে!

কমলাসুন্দরী সত্যিই প্রস্তরমূর্তির মতন নিষ্পন্দ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই চক্ষে জল এসে গেল তার। রাইমোহনের দিকে চেয়ে বললো, হ্যাঁ গা, তোমার শরীলে কি মানুষের রক্ত নেই? অনেক পাপ করিচি জীবনে, তা বলে আমায় এমন শাস্তি দেবে?

রাইমোহন বললো, ডাঁড়া ডাঁড়া, এখুনি কী হয়েচে! তোর পাপের সরা পূর্ণ হতে এখুনো ঢের বাকি আচে। চুল বাঁদ, পায়ে ঘুঙুর দে, বাবু তোর নাচ দেকবেন!

নবীনকুমার বললো, ধ্যাৎ আমার ঘুম পেয়ে যাচ্ছে! বিছানার ওপর কেউ নাচ দেকায় তো শুয়ে শুয়ে দেকি!

রাইমোহন হো হো করে হেসে উঠে বললো, বাঃ খাসা বলেচেন। বিছনার ওপর নাচ! তাই দোকা কমলী, ছোটবাবুকে তুই বিছনার ওপর নাচ দেকা, আমরা পাঁচাপেঁচি লোক, আমরা বাইরে থাকবো।

কমলাসুন্দরী বললো, তোমার মুকে এবার আমি মুড়ো ঝাঁটা ভাঙবো! পাহারাওয়ালাকে দিয়ে তোমায় চাবকবো!

নবীনকুমার সম্পূৰ্ণ আচ্ছন্নের মতন মাথা দোলাতে দোলাতে বললো, আমি যে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পাচ্ছি না, আমায় কেউ একটা বিছানা দাও।

কমলাসুন্দরী নিজেই এগিয়ে এসে নবীনকুমারের এক হাত ধরে বললো, আহা রে, সাত রাজার ধন এক মানিক, তার কি দশা করেচে এই পাষুণ্ডেরা! বাবু, তুমি বাড়ি যাও। তোমাকে এখানে থাকতে নেই।

নবীনকুমার বললো, আমায় বিছানা দাও! আমায় এরা বেশী খাইয়ে দিয়েচে।

কমলাসুন্দরী বললো, আহা রে! তোমায় আমি দুধের ফেনার মতন নরম বিছনা দিতে পারি, সারারাত তোমার মাতায় পাখার হাওয়া কত্তে পারি। কিন্তু তেমন ভাগ্যি করে যে আসিনি। এ পাপের জায়গায় থাকলে তোমার বদনাম হবে!

রাইমোহন বললো, যা যা বেটী, বেশী বকিসনি। ওকে তোর বিছনায় শুয়ে নাচ দেকা! কী ছোটবাবু, বিছনায় শুয়ে এখুনো নাচ-বেশ ভালো লাগবে না?

নবীনকুমার তার কথার প্রতিধ্বনি করে বললো, হ্যাঁ…বিছনায় শুয়ে…নাচ…আমার দাও বিছনা…

কমলাসুন্দরী বললো, ছি, বাবু, তোমায় অমন কতা বলতে নেই। আমি তোমার কে হই, তুমি জানো না? আমি যে তোমার মায়ের মতন!

নবীনকুমার অতিকষ্টে চোখ খুলে বললো, কই? যাঃ! কে বললে তুমি আমার মায়ের মতন! আমার মা ভগবতী ঠাকুরকে যেমন দেকতে সেইরকম।

কমলাসুন্দরী বললো, তা হোক, তবু আমিও তোমার মায়ের মতন। তোমার বাপ যে আমার কাচে আসতেন, আমায় তিনি দয়া কত্তেন!

রাইমোহন বললো, তাতে কী হয়েচে, বাপ বেটায় কী এক জায়গা থেকে সওদা করে না? তুই দোকান খুলে বসিচিস, কখন বাপ এলো, কখন ছেলে এলো, অত হিসেবে তোর দরকার কী?

কমলাসুন্দরী বললো, তোর মুকে পোকা পড়বে! শেয়াল-কুকুরে তোমায় ছিঁড়ে খাবে!

রাইমোহন সে অভিশাপে ভ্রূক্ষেপ না করে চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো, মা! তোর বড় মা হবার শক, না রে। কমলী! কুলটা স্বৈরিণী, বাজারের মাগী! তোর মতন বেশ্যারা কখুনো কারুর মা হয় না, ভগ্নী হয় না, কন্যা হয় না! যে বেশ্য সে বেশ্যই, আর কিচু না। বেশ্যার সন্তান কথুনো ভদ্রলোক হয় না। এখন ছোটবাবুকে ঘরে নিয়ে যা! বিছনায় তোলা! চলুন ছোটবাবু।

নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, কোতায়? আমি কোতায় যাবো!

রাইমোহন বললো, বিছনায়। শুয়ে শুয়ে নাচ দেকবেন।

রাইমোহন পিছন থেকে সামান্য একটু ধাক্কা দিতেই নবীনকুমার টলতে টলতে এগিয়ে গেল। কমলাসুন্দরী দরজার কাছে দু হাত ছড়িয়ে বললো, না, কিছুতেই না, ওগো তুমি এমন ভালো মানুষের ছেলের এমন সব্বেনাশ করো না

রাইমোহন যেন প্রতিশোধস্পৃহায় একেবারে মেতে উঠেছে। রুক্ষভাবে কমলাসুন্দরীকে এক ধাক্কা দিয়ে বললো, সর! দেকচিস না বাবুর কষ্ট হচ্চে! বাবু তোর বিছনায় শোবেন।

নবীনকুমার বললো, আমি শোবো…ওগো আমায় শুতে দাও—

নবীনকুমারকে কমলাসুন্দরীর বুকের ওপর ঠেলে দিয়ে রাইমোহন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা টেনে বাইরে থেকে শিকলি তুলে দিল।

তারপর সে নাচতে লাগলো ধেই ধেই করে। সে কি প্ৰবল নাচ! যেন কোনো রোগা, চিমসে ধরা বৃদ্ধ মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্য। সেই সঙ্গে হাসি এবং হাততালি!

অন্য ইয়াররা যারা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল, তারা বললো, এ কি, মাতা খারাপ হয়ে গেল নাকি বুড়োটার? আঁ?

রাইমোহন নাচ থামিয়ে ফেললো অবিলম্বেই। এখনো তার কাজ ফুরোয়নি। লম্বা লম্বা পা ফেলে সে দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দৌড়ে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। এখন তাকে বিধুশেখরের বাড়ি যেতে হবে। এত বড় একটা সংবাদ তাকে না জানালেই নয়। আর বিধুশেখর যদি এই রাত্রেই এসে স্বচক্ষে দেখে যেতে চান, তা হলে তো সোনায় সোহাগা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *