৩৪. এমন সময় যা ঘটল

এমন সময় যা ঘটল তার জন্য কেউ তৈরী ছিলেন না; প্রবীণ অর্বাচীন কারো কোনো আলোচনায় আমি এ ব্যাপারের কোনো আভাস ইঙ্গিত পাইনি।

বেলা তখন চারটে হবে। দোস্ত মুহম্মদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি রাস্তায় তুমুল কাণ্ড। দোকানীরা দুদ্দাড় করে দরজাজানলা বন্ধ করছে, লোকজন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটোছুটি করছে, চতুর্দিকে চিৎকার, ও ভাই কোথায় গেলি, ও মামা শিগগির এসো। লোকজনের ভিড়ের উপর দিয়ে টাঙ্গাওয়ালারা খালি গাড়ি, বোঝাই গাড়ি এমনি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে চালিয়েছে যে, আমার চোখের সামনে একখানা গাড়ি হুড়মুড়িয়ে কাবুল নদীর বরফের উপর গিয়ে পড়ল, কেউ ফিরে পর্যন্ত তাকাল না।

সব কিছু ছাপিয়ে মাঝে মাঝে কানে চিৎকার পৌঁছয়, বাচ্চায়ে সকাও আসছে, বাচ্চায়ে সকাও এসে পড়ল। এমন সময় গুড়ম করে রাইফেলের শব্দ হল। লক্ষ্য করলুম শব্দটা শহরের উত্তর দিক থেকে এল। সঙ্গে সঙ্গে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য জনতা যেন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেল। যাদের হাতে কাঁধে বোঁচকা-বুচকি ছিল তারা সেগুলো ফেলে দিয়ে ছুটলো, একদল রাস্তার পাশের নয়ানজুলিতে নেমে গেছে, অন্য দল কাবুল নদীতে জমে-যাওয়া জলের উপর ছুটতে গিয়ে বারে বারে পিছলে পড়ছে। রাস্তার পাশে যে অন্ধ ভিখারী বসতে সে দেখি উঠে দাঁড়িয়েছে, ভিড়ের ঠেলায় এদিক ওদিক টাল খাচ্ছে আর দুহাত শূন্যে তুলে সেখানে যেন পথ খুঁজছে।

আমি কোনো গতিকে রাস্তা থেকে নেমে, নয়ানজুলি পেরিয়ে এক দোকানের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালুম। স্থির করলুম, বিদ্রোহ বিপ্লবের সময় পাগলা ঘোড়ার চাট খেয়ে অথবা ভিড়ের চাপে দম বন্ধ হয়ে মরব না; মরতে হয় মরব আমার হিস্যার গুলী খেয়ে।

এক মিনিট যেতে না যেতে আরেক ব্যক্তি এসে জুটলেন। ইনি ইটালিয়ান কলোনেল্লো অর্থাৎ কর্নেল। বয়স ষাটের কাছাকাছি, লম্বা করোগেটেড দাড়ি।

এই প্রথম লোক পেলুম যাকে ধীরেসুস্থে কিছু জিজ্ঞাসা করা যায়। বললুম, আমি তো শুনেছিলুম ডাকাত-সর্দার বাচ্চায়ে সকাও আসবে আমান উল্লার হয়ে শিনওয়ারীদের সঙ্গে লড়বার জন্য। কিন্তু এ কী কাণ্ড?

কলোনেল্লো বললেন, মনে হচ্ছে ভুল খবর। এ তো আসছে শহর দখল করবার জন্য।

তাই যদি হয় তবে আমান উল্লার সৈন্যেরা এখনো শহরের উত্তরের দিকে যাচ্ছে না কেন, এ রকম অতর্কিতে বাচ্চায়ে সকাও এসে পৌঁছলই বা কি করে, তার দলে কি পরিমাণ লোজন, শুধু বলুক না কামান-টামান তাদের সঙ্গে আছে–এ সব অন্য কোনো প্রশ্নের উত্তর কলোনেল্লো দিতে পারলেন না। মাঝে মাঝে শুধু বলেন, কী অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।

আমি বললুম, সাধারণ কাবুলী যে ভয় পেয়েছে সে তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু ইয়োরোপীয়ানরা এদের সঙ্গে জুটল কেন? এরা যাচ্ছে কোথায়?

কলোনেল্লো বললেন, আপন আপন রাজদূতাবাসে আশ্রয়ের সন্ধানে।

ততক্ষণে বন্দুকের আওয়াজ বেশ গরম হয়ে উঠেছে–ভিড়ও দেখলুম ঢেউয়ে ঢেউয়ে যাচ্ছে, একটানা স্রোতের মত নয়। দুই ঢেউয়ের মাঝখানে আমি কলোনেল্লোকে বললুম, চলুন বাড়ি যাই। তিনি বললেন যে, শেষ পর্যন্ত না দেখে তিনি বাড়ি যাবেন না। মিলিটারি খেয়াল, তর্ক করা বৃথা।

বাড়ির দোরের গোড়ায় দেখি আবদুর রহমান। আমাকে দেখে তার দুশ্চিন্তা কেটে গেল। বাড়ি ঢুকতেই সে সদর দরজা বন্ধ করে তার গায়ে এক গাদা ভারী ভারী পাথর চাপাল। বিচক্ষণ লোক, ইতিমধ্যে দুর্গ রক্ষা করার যে বন্দোবস্তের প্রয়োজন সেটুকু সে করে নিয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, বেনওয়া সাহেব কোথায়? বললো, তিনি মাত্র একটি সুটকেশ নিয়ে টাঙ্গায় করে ফ্রেঞ্চ লিগেশনে চলে গিয়েছেন।

ততক্ষণে বন্দুকের শব্দের সঙ্গে মেশিনগানের একটানা ক্যাটক্যাট যোগ দিয়েছে। আবদুর রহমান চা নিয়ে এসেছিল। কান পেতে শুনে বলল, বাদশার সৈন্যেরা গুলী আরম্ভ করেছে। বাচ্চা মেশিনগান পাবে কোথায়?

আমি জিজ্ঞেস করলুম, বাদশার সৈন্যরা কি এতক্ষণে বাচ্চার মুখোমুখি হল? তবে কি সে বিনা বাধায় কাবুলে পৌঁছল?

আবদুর রহমান বলল, দোরের গোড়ায় দাঁড়িয়ে অনেককেই তো জিজ্ঞেস করলুম, কেউ কিছু বলতে পারল না। বোধ হচ্ছে বাচ্চা বিনা বাধায়ই এসেছে। ওর দেশ হল কাবুলের উত্তর দিকে, আমার দেশ পানশির— তারও উত্তরে। ওদিকে কোনো বাদশাহী সৈন্যের আনাগোনা হলে আমি দেশের লোকের কাছে থেকে বাজারে খবর পেতুম। বাদশাহী সৈন্যের সবাই তো এখন পুব দিকে শিনওয়ারীদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছে— আলী আহমদ খানের বেতে।

গোলাগুলী চলল। সন্ধ্যা হল। আবদুর রহমান আমাকে তাড়াতাড়ি খাইয়েদাইয়ে আগুনের তদারকিতে বসল। তার চোখমুখ থেকে আন্দাজ করলুম, সে কাবুলীদের মত ভয় পায়নি। কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারলুম, বাচ্চা যদি জেতে তবে লুটতরাজ নিশ্চয় হবে এবং তাই নিয়ে আমার মঙ্গলামঙ্গল সম্বন্ধে সে ঈষৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। কিন্তু এ সব ছাপিয়ে উঠছে তার কৌতূহল আর উত্তেজনা শহরে সার্কাস ঢুকলে ছেলেপিলেদের যে রকম হয়।

কিন্তু এই বাচ্চায়ে সকাওটি কে? আবদুর রহমানকে জিজ্ঞেস করতে হল না, সে নিজের থেকেই অনেক কিছু বলল এবং তার থেকে বুঝলুম যে, আবদুর রহমান বরফের জহুরী, ফ্রস্টবাইটের ওঝা, রন্ধনে ভীমসেন, ইন্ধনে নলরাজ, সব কিছুই হতে পারেন, কিন্তু বসওয়েল হতে এখনো তার ঢের দেরী। বাচ্চায়ে সকাও সম্বন্ধে সে যা বলল তার উপরে উত্তম রবিন হুড খাড়া করা যায়, কিন্তু সে বস্তু জলজ্যান্ত মানুষের জীবনী বলে চালানো অসম্ভব।

চোদ্দ আনা বাদ দেওয়ার পরও যেটুকু রইল তার থেকে বাচ্চার জীবনের এইটুকু পরিচয় পাওয়া গেল যে, সে প্রায় শতিনেক ডাকাতের সর্দার, বাসস্থান কাবুলের উত্তরদিকে কুহিন্তানে, ধনীকে লুটে গরীবকে পয়সা বিলোয়, আমান উল্লা যখন ইউরোপে ছিলেন তার পরাক্রম তখন এমনি বেড়ে গিয়েছিল যে, কাবুলকুহিন্তানের পণ্য-বাহিনীর কাছ থেকে সে রীতিমত ট্যাক্স আদায় করত। আমান উল্লা ফিরে এসে কুহিন্তানের হাটে-বাজারে নোটিশ লাগান, ডাকাত বাচ্চায়ে সকাওয়ের মাথা চাই, পুরস্কার পাঁচ শ টাকা; বাচ্চা সেগুলো সরিয়ে পাল্টা নোটিশ লাগায়, কাফির আমান উল্লার মাথা চাই, পুরস্কার এক হাজার টাকা।

আবদুর রহমান জিজ্ঞেস করল, কর্নেলের ছেলে আমাকে শুধালো যে, আমি যদি আমান উল্লার মুণ্ডুটা কাটি, আর আমার ভাই যদি বাচ্চায়ে সকাওয়ের মুণ্ডুটা কাটে তবে আমরা দুজনে মিলে কত টাকা পাব। আমি বললুম, দেড় হাজার টাকা। সে হেসে লুটোপুটি; বলল, এক পয়সাও নাকি পাব না। বুঝিয়ে বলুন তো, হুজুর, কেন পাব না?

আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, কেউ জ্যান্ত নেই বলে তোমাদের টাকাটা মারা যাবে বটে, কিন্তু কর্নেলের ছেলেকে বলল যে, তখন আফগানিস্থানের তখৎ তোমাদের পরিবারে যাবে।

আরো শুনলুম, বাচ্চায়ে সকাও নাকি দিন দশেক আগে হঠাৎ জবলুস-সিরাজের সরকারী বড় কর্তার কাছে উপস্থিত হয়ে কোরান ছুঁয়ে কসম খেয়েছিল যে, সে আমান উল্লার হয়ে শিনওয়ারীদের সঙ্গে লড়বে এবং সেই কসমের জোরে শখানেক রাইফেল তাঁর কাছ থেকে বাগিয়ে নিয়ে ফের উধাও হয়ে গিয়েছিল।

তবে কি সেই বন্দুকগুলো নিয়েই বাচ্চার দল আমান উল্লাকে আক্রমণ করেছে? আশ্চর্য হবার কি আছে? আমান উল্লা যখন উপজাতিদের কাছ থেকে ভোলা ট্যাক্সের পয়সায় ফৌজ পুষে তাদের কাবুতে রাখেন তখন বাচ্চাই বা আমান উল্লার কাছ থেকে বন্দুক বাগিয়ে তাঁকে আক্রমণ করবে না কেন?

রাত তখন বারোটা। আবদুর রহমান বলল, আজ আমি আপনার বসবার ঘরে শোব।

আমি বললুম, তুমি তো ঠাণ্ডা ঘর না হলে ঘুমোত পারে না। আমার প্রাণ রক্ষার জন্য তোমাকে এত দুর্ভাবনা করতে হবে না।

আবদুর রহমান বলল, কিন্তু আমি অন্য ঘরে শুলে আমার বিপদ-আপদের খবর আপনি পাবেন কি করে? আমার জান বাবা আপনার হাতে সঁপে দিয়ে যাননি?

কথাটা সত্যি। আবদুর রহমান আমার চাকরীতে ঢুকেছে খবর পেয়ে তার বুড়া বাপ গাঁ থেকে এসে আমাকে তার জানের মালিক, স্বভাবচরিত্রের তদারকদার এবং চটে গেলে খুন করবার হক দিয়ে গিয়েছিল। আমি বুড়াকে খুশী করবার জন্য সিংহ ও মুষিকের গল্প বলেছিলুম।

কিন্তু আবদুর রহমানের ফন্দিটা দেখে অবাক হলুম। সাক্ষাৎ নিউটন। এদিকে বাক্সে দুটো ফুটো করে দুটো বেরালের জন্য, অন্য দিকে মাধ্যাকর্ষণতত্ত্বও আবিষ্কার করতে পারে— একদিকে কর্নেলের ছেলের ধাঁধায় বোকা বনে যায়, অন্য দিকে তর্কে বাঙালীকেও কাবু করে আনে।

আবদুর রহমান শুয়ে শুয়ে কতলে-আম্ অর্থাৎ পাইকারী খুনখারাবি লুটতরাজের যে বর্ণনা দিল তার থেকে বুঝলুম বাচ্চায়ে সকাও যদি শহর দখল করতে পারে তবে তার কোনোটাই বাদ যাবে না। চেঙ্গিস, নাদির রাজা-বাদশা হয়ে যখন এ সব করতে পেরেছেন তখন বাচ্চা ডাকাত হয়ে এ সব করবে না সে আশা দিদিমার রূপকথাতেও করা যায় না।

ইরান আফগানিস্থান চীন প্রভৃতি সভ্য দেশে সাজা দেওয়ার নানারকম বিদগ্ধ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। কামানের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া, কোমর অবধি মাটিতে পুঁতে চতুর্দিক থেকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করে মারা, পেট কেটে চোখের সামনে নাড়িভুড়ি বের করে করে মারা, জ্যান্ত অবস্থায় চামড়া তুলে মারা ইত্যাদি বহুতর কায়দায় অনেক চাক্ষুষ বর্ণনা আমি শুনেছি। তার মধ্যে একটা হচ্ছে দেওয়ালের গায়ে দাড় করিয়ে লম্বা পেরেক দিয়ে দুকান দেওয়ালের সঙ্গে গেঁথে দেওয়া। আবদুর রহমানের কাছ থেকে শোনা, সে অবস্থায়ও নাকি মানুষের ঘুম পায় আর মাথা বার বার স্কুলে পড়ে। তার তুলনায় রাইফেল-মেশিনগানের শব্দ, আর চেঙ্গিস নাদিরের কাহিনীস্মরণ ধুলি পরিমাণ। কাজেই সেই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়াটা বীর অথবা কাপুরুষ কোনো কিছুরই লক্ষণ নয়।

সকাল বেলা দেউড়ি খুলে দেখি শহরে মেলার ভিড়। কাবুল শহরের আশপাশের গাঁ থেকে নানা রকম লোক এসে জড়ো হয়েছে, সুযোগসুবিধে পেলে লুটে যোগ দেবে বলে। অনেকের কাধেই বন্দুক, শীতের ভারী ভারী জামার ভিতর যে ছোরা পিস্তলও আছে সেটাও অনায়াসে বোঝা গেল। আবদুর রহমানের বাধা সত্ত্বেও বেরিয়ে পড়লুম ব্যাপারটার তদারকতদন্ত করবার জন্য।

আর্ক কাবুল শহরের ভিতরকার বড় দুর্গ— হুমায়ুনের জন্ম এই আর্কের ভিতরেই হয়েছিল। আর্ক থেকে বড় রাস্তা বেরিয়ে এসে কাবুল নদীর পারে ঠেকেছে তাকেই কাবুলের চৌরঙ্গী বলা যেতে পারে। সেখানে দেখি একটা বড় রকমের ভিড় জমেছে। কাছে গিয়ে বুঝলুম কোনো এক বড় রাজকর্মচারী অফিসারও হতে পারেন–কাবুল শহরের লোকজনকে বাচ্চার বিরুদ্ধে লড়বার জন্য সলা-মন্ত্রণা দিচ্ছেন।

ওজার্ম সিতেআইয়াঁ–ধরো হাতিয়ার, ফ্রান্সের লোক, বাঁধো দল, বাঁধো দল ধরনের ওজস্বিনী ফরাসিনী বক্তৃতা নয়— ভদ্রলোকের মুখ শুকনো, ফ্যাকাশে ঠোঁট কাঁপছে আর বিড় বিড় করে যা বলছেন দশ হাত দূর থেকে তা শোনা যাচ্ছে না।

টিমের কাপ্তান যে রকম প্র্যাক্টিসের পূর্বে আঁটা আঁটা হকিষ্টিক বিলোয় তেমনি গাদা গাদা দামী দামী ঝকঝকে রাইফেল বিলোনো হচ্ছে। বলা নেই কওয়া নেই, যার যা ইচ্ছে এক একখানা রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে। শুধু লক্ষ্য করলুম উত্তর দিকে কেউই গেল না– অথচ লড়াই হচ্ছে সেই দিকেই।

রাইফেল বিলোনো শেষ হতেই ভদ্রলোক তড়িৎ গতিতে চলে গেলেন। বিপজ্জনক অবশ্য কর্তব্য কর্ম অর্ধসমাধান করে মানুষ যে রকম তড়িঘড়ি অকুস্থান থেকে সরে পড়ে। তখন চোখে পড়ল তার পরনে পাজামা-কুর্তাজুব্বা-পাগড়ি দেরেশি নয়। তারপর চারদিকে তাকিয়ে দেখি কারো পরনেই দেরেশি নয়, আর সকলের মাথায়ই পাগড়ি। আমার পরনে সুট, মাথায় হ্যাট অস্বস্তি বোধ হতে লাগল।

এমন সময় দেখি ভিড় ঠেলে হন্ হন্ করে এগিয়ে আসছেন মীর আসলম। কোনো কথা না কয়ে আমার কাঁধে হাত দিয়ে আমাকে বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে চললেন— আমার কোনো প্রশ্নের উত্তরে মুখ না খুলে, কোনো কথায় কান না দিয়ে। বাড়ি পৌঁছতেই আমাদের দুজনকে দেখে আবদুর রহমান কি একটা বলে তিন লম্ফে বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরোল।

মীর আসলম আমাকে বলতে আরম্ভ করলেন। এ কি তামাশা দেখার সময়, না, ইয়ার্কি করে ঘুরে বেড়াবার মোকা। তাও আবার দেরেশি পরে।

আমি শুধু বললুম, কি করে জানব বলুন যে, দেরেশি পরার আইন মকুব হয়ে গিয়েছে।

মীর আসলম বললেন, মকুব বাতিলের প্রশ্ন এখন কে শুধায় বাপু। যে কোনো মুহূর্তে বাচ্চায়ে সকাও শহরে ঢুকতে পারে। কাবুলীরা তাই দেরেশি ফেলে ফের মুসলমান হয়েছে। দেখলে নাইস্তক সর্দার খান জোব্বা পরে রাইফেল বিলোলেন?

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, সে কি কথা, রাজপরিবার পর্যন্ত ভয় পেয়ে দেরেশি ছেড়েছেন?

মীর আসলম বললেন, উপায় কি বলো? বাদশাহী ফৌজ থেকে সৈন্যেরা সব পালিয়েছে। এখন আমান উল্লার একমাত্র ভরসা যদি কাবুল শহরের লোক রাইফেল বন্দুক নিয়ে বাচ্চাকে ঠেকাতে পারে। তাদের খুশী করার জন্য দেরেশি বর্জন করা হয়েছে।

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কিন্তু আপনিই তো বলেছিলেন রাজধানীর সৈন্যের কখনো বিদ্রোহ করে না।

বিদ্রোহ তারা করেনি। তারা সব পালিয়েছে। যাদের বাড়ি বহু দূরে, বরফ ভেঙে এখন যে সব জায়গায় পৌঁছনো যায় না, তারা এখনো শহরে গা-ঢাকা দিয়ে আছে। যারা নিতান্ত গাঢাকাও দিতে পারেনি, তারাই লড়তে গেছে, অন্ততঃ আমান উল্লার বিশ্বাস তাই। আসলে তারা দেহ,-আফগানানের পাহাড়ের গায়ে বসে চন্দ্রসূর্য তাগ করে গুলী ছুঁড়ছে। বাচ্চাকে এখনো ঠেকিয়ে রেখেছে আমান উল্লার দেহরক্ষী খাস সৈন্যদল।

আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, কিন্তু মৌলানার বাসা তো দেহ,আফগানানের পাহাড়ের গায়ে। চলুন, তার খবর নিয়ে আসি।

মীর আসলম বললেন, শান্ত হও। আমি সকালে সে দিকেই গিয়েছিলুম, কিন্তু মৌলানার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারিনি। সেখানে লড়াই হচ্ছে। আমি মোল্লা মানুষ কাবুল শহর আমাকে চেনে। আমি যখন সেখানে পৌঁছতে পারিনি, তুমি যাবে কি করে?

এ সংবাদ শুনে আমার মন থেকে অন্য সব প্রশ্ন মুছে গেল। চুপ করে বসে বসে ভাবতে লাগলুম, কিছু করার উপায় আছে কি না। মীর আসলম আমাকে বাড়ি থেকে বেরতে পই পই করে বারণ করে চলে গেলেন। ইতিমধ্যে আবদুর রহমান একখানা নূতন রাইফেল নিয়ে উপস্থিত। চোখে মুখে খুশী উপছে পড়ছে। বলল, হুজুর, চট করে একখানা কাগজে লিখে দিন আপনার রাইফেল নেই। আমি আরেকটা নিয়ে আসি। আমি তখন মৌলানার কথা ভাবছি আমার কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে আবদুর রহমান চলে গেল।

লুটপাট আরম্ভ হয়নি সত্য, কিন্তু হতে কতক্ষণ? সকাল বেলা যখন বেরিয়েছিলুম তখন কোথাও কোনো পুলিশ দেখতে পাইনি। রাজার দেহরক্ষীরা পর্যন্ত বাচ্চাকে ঠেকাতে গিয়েছে, এখন শহর রক্ষা করবে কে? আর এ-পরিস্থিতি আফগান ইতিহাসে কিছু অভিনব বস্তু নয়। বাবুর বাদশাহ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, কাবুল শহরে কোনো প্রকার অশান্তির উদ্ভব হলেই আশপাশের চোর-ডাকাত শহরের আনাচেকানাচে শিকারের সন্ধানে ঘোরাঘুরি করত। মীর আসলম আবার আরেকটা সুখবর দিলেন যে, বাবুরের আমলে কাবুল আজকের চেয়ে অনেক বেশী সভ্য ছিল। অসম্ভব নয়, কারণ বাবুর লিখেছেন অশান্তির পূর্বাভাস দেখতে পেলেই তিনি রাস্তায় রাস্তায় সেপাই মোতায়েন করতেন; আমান উল্লা যে পারেননি সে তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

অবশ্য একটা সান্ত্বনার কথা হচ্ছে এই যে, কাবুলের বসতবাড়ি লুট করা সহজ ব্যাপার নয়। প্রত্যেক বাড়ি দুর্গের মত করে বানানো চারিদিকে উঁচু পাঁচিল, সেও আবার খানিকটা উঠে ভিতরের দিকে বেঁকে গিয়েছে তাতে সুবিধে এই যে, মই লাগিয়ে ভিতরে লাফিয়ে পড়ার উপায় নেই। দেয়ালের গায়ে আবার এক সারি ঘেঁদা; বাড়ির ছাতে দাঁড়িয়ে দেয়ালের আড়াল থেকে সে হেঁদা দিয়ে রাইফেল গলিয়ে নির্বিঘ্নে বাইরে গুলী চালানো যায়। বাড়িতে ঢোকার জন্য মাত্র একখানা বড় দরজা–সে দরজা আবার শক্ত বুনন কাঠে তৈরী, তার গায়ে আবার ফালি ফালি লোহার পাত পেরেক দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে।

মোক্ষম বন্দোবস্ত। দুখানা রাইফেল দিয়ে পঞ্চাশজন ডাকাতকে অনায়াসে ঠেকিয়ে রাখা যায়। কারণ যারা রাস্তা থেকে হামলা করবে তাদের কোনো আচ্ছাদনআবরণ নেই যার তলা থেকে রাইফেলের গুলী বাঁচিয়ে দেওয়াল ভাঙবার বা দরজা পোড়াবার চেষ্টা করতে পারে।

কিন্তু প্রশ্ন, এই ডিসেম্বরের শীতে সমস্ত রাত ছাদের উপর টহল দিয়ে নজর রাখবে কে? বড় পরিবার হলে কথা নেই; পালা দিয়ে পাহারা দেওয়া যায়, কিন্তু এ স্থলে সেই প্রাচীন সমস্যা কাকা আর আমি একা, চোর আর লাঠি দুজন। বরঞ্চ তার চেয়েও খারাপ। চোর না হয়ে এরা হবে ডাকাত, হাতে লাঠি নয় বন্দুক আর সংখ্যায় এদের নারায়ণী সেনা হতেও আপত্তি নেই।

এ অবস্থায় মৌলানা আর তার তরুণী ভার্যাকে ডেকে আনি কোন বুদ্ধিতে? কিন্তু ওদিকে তারা হয়তো রয়েছেন আণ্ডার দি ফায়ার দুই ফৌজের মাঝখানে। স্থির করলুম, বেশী ভেবে কোনো লাভ নেই। মৌলানার পাড়ায় ঢুকবার সুযোগ পেলেই তাঁকে সব কথা বুঝিয়ে বলে নির্বাচনের ভারটা তাঁরই হাতে ছেড়ে দেব।

আবদুর রহমান খবর দিল, বাচ্চার ডাকুরা অ্যারোড্রোম দখল করে ফেলেছে বলে আমান উল্লার হাওয়াই জাহাজ উঠতে পারছে না।

আমি শুধালুম, কিন্তু আমান উল্লা বিদেশ থেকে যে সব ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া গাড়ি এনেছিলেন সে সব কি হল?

নিরুত্তর।

কাবুল বাসিন্দাদের যে রাইফেল দেওয়া হল তারা লড়তে যায়নি।

আবদুর রহমান যা বললো তার হুবহু তর্জমা বাঙলা প্রবাসে আছে। শুধু এ স্থলে উলুখড়ের দুখানা পা আছে বলে দু রাজার মাঝখানে সে যেতে রাজী হচ্ছে না। আমি বললুম, তাজ্জবের কথা বলছ আবদুর রহমান, বাচ্চায়ে সকাও ডাকাত, সে আবার রাজা হল কি করে? আবদুর রহমান যা বললো তার অর্থ, বাচ্চা শুক্রবার দিন মোল্লাদের হাত থেকে তাজ পেয়েছে, খুতবায় (আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে) তার নাম বাদশা হিসেবে পড়া হয়েছে, আমান উল্লা কাফির সে ফতোয়া প্রচারিত হয়েছে ও বাচ্চায়ে সকাও বাদশাহ হবীব উল্লা খান নাম ধারণ করে কাবুল শহর থেকে কাফির আমান উল্লাকে বিতাড়িত করবার জন্য জিহাদ ঘোষণা করেছেন।

অদৃষ্টের পরিহাস! আমান উল্লার পিতার নাম হবীব উল্লা। আততায়ীর হস্তে নিহত হবীব উল্লার অতৃপ্ত প্রেতাত্মা কি স্বীয় নামেই প্রতিহিংসার রক্ত অনুসন্ধান করছে।

সন্ধ্যার দিকে আবদুর রহমান তার শেষ বুলেটিন দিয়ে গেল। আমান উল্লার হাওয়াই জাহাজ কোনো গতিকে উঠতে পারায় বোমা ফেলেছে। বাচ্চার দল পালিয়ে গিয়ে মাইলখানেক দূরে থানা গেড়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *