৩৩-৩৪. বিষ্ণুপ্ৰসাদ কলকাতায়

বিষ্ণুপ্ৰসাদ কখনও কলকাতায় যায়নি। দার্জিলিং মেলের থ্রিটিয়ারে বসে সে একটু উদাস হয়েই প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়েছিল। নামই নিউ জলপাইগুড়ি কিন্তু শিলিগুড়ি শহরটা এই স্টেশনকে চারপাশ থেকে চেপে রেয়েছে। আর শিলিগুড়ি মানে জেলা দার্জিলিং। শিলিগুড়িতে এসে পাহাড়ের মানুষের কোনও অসুবিধা হয় না। দুপা হাঁটলেই একজন স্বজাতিকে দেখা যায়।

ট্রেনে চাপলেই অদ্ভুত উত্তেজনা হয় সায়নের। বিশেষ করে রাতের ট্রেনে। হু হু করে ট্রেন ছুটছে অন্ধকার চিরে, মাঝে মাঝে হুইসল বাজছে, জানলার বাইরে চোখ রেখে যখন কিছুই দেখা যাচ্ছে না তখন ইচ্ছেমতো কল্পনা করে নাও। যা খুশি। সেই কল্পনাটাই উত্তেজনা বাড়ায়।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, কী হল, মন কেমন করছে!

বিষ্ণুপ্ৰসাদ হাসল, না। আমি ডাকতার সাহেবের কথা ভাবছিলাম। সত্যি সত্যি যদি উনি নিরাময় বন্ধ করে চলে যান তাহলে তো তুমি আর ওখানে ফিরে যাবে না। আচ্ছা, কলকাতা তো শুনেছি খুব বড় শহর, ওখানে তোমার চিকিৎসা হয় না কেন?

হবে না কেন? কত লোকের হচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ের আবহাওয়ায় ডাক্তার আঙ্কলের কাছে থেকে আমার বেশি উপকার হয়েছে। কিন্তু যা ভয় পাচ্ছ তা ঠিক না। ডাক্তার আঙ্কল নিরাময় বন্ধ করে চলে যাবেন না। সায়ন খুব আস্থা নিয়ে কথাগুলো বলল।

ওদের উল্টোদিকে একটি পরিবার বসেছিল। তারা যে মন দিয়ে কথা শুনছে তা বুঝতে পারেনি সায়ন। পরিবারের যিনি কর্তা তিনি প্রশ্ন করলেন, তোমার কি টি বি হয়েছিল ভাই?

টি বি? হকচকিয়ে গেল সায়ন।

পাহাড়ে আর সমুদ্রের ধারে লোকে টি বি সারাতে যায়। কী বন্ধ হয়ে গেলে আর ফিরে যাবে না বলল, তোমার অসুখ কি সারেনি? শেয়ালের মতো মুখের গঠন, ভদ্রলোকের চোখে সন্দেহ।

সায়ন বলল, আপনি ভুল করছেন, আমার টি বি হয়নি।

অ তা বোষে-টোম্বে গিয়েছিলে নাকি এই বয়সে? কী এমন রোগ যা কলকাতায় না সারিয়ে পাহাড়ে গিয়েছ চিকিৎসার জন্যে?

 বোম্বে গেলে কী রোগ হয়?

ওই যে কাগজে পড়েছি, সোনার দোকানে কাজ করতে গিয়ে বাঙালি ছেলেরা মৃত্যুরোগ নিয়ে ফিরে আসছে।

অদ্ভুত! সায়ন জানলার দিকে তাকাতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। বিষ্ণুপ্ৰসাদ বাংলা বোঝে তবে শক্ত শব্দ না। মৃত্যুরোগ বুঝতে না পেরে সে নেপালিতে সায়নকে মানে জিজ্ঞাসা করল। এই কয় মাসে নেপালি ভাষার অনেকটাই আয়ত্তে এসে গিয়েছিল সায়নের। সে অর্থ এবং ইঙ্গিত বুঝিয়ে বলতেই বিষ্ণুপ্ৰসাদ হাসতে লাগল। তাই দেখে কর্তা তাঁর পরিবারের সদস্যদের চাপা গলায় নির্দেশ দিলেন।

ট্রেনটা ভালই চলছিল। টয়লেটে যাওয়ার সময় সায়নের চোখে পড়েছিল অনেক বার্থ ফাঁকা। অথচ টিকিটঘরে গিয়ে টিকিট চাইলেই বলা হয় রিজার্ভেশন ফুল, ওয়েটিং-এ নাম লেখাতে হবে। যদি ট্রেনে জায়গা থাকে তাহলে কি ইচ্ছে করে ওসব বলে? কী লাভ?

ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পর একটা ছোট স্টেশনে গাড়ি দাঁড়াতেই হই হই করে কয়েকটা ছেলে উঠে এল। উঠেই টয়লেটগুলোয় দখল নিয়ে নিল ওরা। একজন চেঁচিয়ে বলল, দাদারা দিদিরা দয়া করে আধঘণ্টা আপনাদের সবকিছু চেপে রাখুন। আধঘণ্টা পরে টয়লেটে গিয়ে খালাস করবেন। একেবারে যুদ্ধকালীন তৎপরতার সঙ্গে পেটি উঠতে লাগল। দশ মিনিটের মধ্যে সেগুলো চোখের আড়ালে চলে গেল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। এবার ছেলেগুলো মাঝখানের প্যাসেজে এসে দাঁড়াল। প্রত্যেকের হাতে এক একটা প্যাকেট। একজন সায়নদের কাছে এসে তাকাল। তারপর উল্টোদিকের ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন দাদু?

বর্ধমান।

বাঃ। আপনার সিটের নীচে এটা রাখছি। বর্ধমান পর্যন্ত এটা আপনার সম্পত্তি। কেউ জিজ্ঞাসা করলে সে কথাই বলবেন। প্যাকেটটা ভদ্রলোকের দুপায়ের ফাঁক দিয়ে নীচে ঢুকিয়ে দিল ছেলেটা।

কী আছে এতে? ভদ্রলোক রেগে গেলেন।

যাই থাক, আমরা দুটো পয়সা পাব যদি আপনি সঙ্গে নিয়ে যান। গরিব বেকার ছেলে, বুঝতেই পারছেন।

কিন্তু যেটা আমার নয় সেটা আমি–।

যা বললাম তাই করবেন। ঝামেলা করতে চাইলে বিপদে পড়বেন। দিদিমা, একটু বুঝিয়ে দিন দাদুকে। ছেলেটি সরে গেল।

সায়ন দেখল কম্পার্টমেন্টের কেউ কিছু বলছে না। হঠাৎ আশ্চর্যরকমের শান্ত হয়ে গেছে ভেতরের পরিবেশ। ট্রেনের ছুটন্ত চাকার আওয়াজ ছাড়া কোনও শব্দ নেই। নীরবতাই যেন বর্ম হয়ে গেছে যাত্রীদের।

এইসময় ওদের নেতা চিৎকার করল, আরে! সবাই বোবা হয়ে হয়ে গেলেন নাকি? কথা বলুন, বি নর্মাল। এতক্ষণ যেরকম গল্প করছিলেন তাই করুন। বলতে বলতে সে এগিয়ে এল সায়নদের কাছে। বিষ্ণুপ্ৰসাদকে দেখে নেপালিতে জিজ্ঞাসা করল কোথায় যাচ্ছে সে। বিষ্ণুপ্ৰসাদ জবাব দিতেই জানতে চাইল কলকাতায় চাকরি করে কি না! ভানুপ্রসাদ মাথা নেড়ে না বলে জানাল তার চাকরি নেই, বেকার।

ছেলেটা সিগারেট ধরাল। তারপর প্যাকেটটা বিষ্ণুপ্রসাদের সামনে ধরল। বিষ্ণুপ্ৰসাদ মাথা নাড়ল, সে সিগারেট খাবে না।

ছেলেটা বলল, আগে চারমিনার খেতাম, এখন উইলস খাই। যখন বেকার ছিলাম তখন কেউ চাকরি দেয়নি। শেষ পর্যন্ত বাঁচার জন্যে আমরা এই লাইনে এলাম। এসে দেখলাম সব শালা চোর। ছেলেটা হাসল।

সায়ন চুপচাপ শুনল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কী করছেন?

কিছু না। আমরা ক্যারিয়ার। স্মাগলারদের মাল ক্যারি করে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছি। তার জন্যে ভাল টাকা পাই। ছেলেটা তাকাল, তুমি বোধহয় ট্রেনে যাওয়া-আসা করো না। যারা করে তারা জানে, জিজ্ঞাসা করে না।

কিন্তু এটা তো অন্যায়, বেআইনি ব্যাপার।

হ্যাঁ শালা, কে ন্যায় করছে বে? হঠাৎ ক্ষেপে গেল ছেলেটা, কোন হারামি আইনের পথে চলছে? এই যে মালগুলো ট্রেনে তুললাম স্টেশনের পুলিশকে পাঁচশো খাওয়াতে হল। একটু পরে ট্রেন থামলে দেখবে পুলিশের সার্চ পার্টি এসে মাল চাইবে। মালদাতে আবার আর একদল আসবে। রেলের স্টাফদের মাল দিতে হচ্ছে। এরা সবাই সরকারি স্টাফ, জনগণের দেওয়া ট্যাক্স থেকে মাইনে পায়। মাইনে পেয়ে ছোঁক ছোঁক করে ঘুষ খাওয়ার জন্যে। এদের কাছে গিয়ে অন্যায় বেআইনি শব্দগুলো বলছ না কেন?

তাই যদি হয়, চোখের সামনে না রেখে লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছ কেন?

দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ জন্মায়, তাই না। কয়েকজন জেনুইন অফিসার আছে এ লাইনে। গোটা চারেক। তারা উঠলে লাইফ হেল করে ছাড়ে। তাই তাদের ভয়ে লুকোতে হয়। অবশ্য লুকোবার জায়গা ওরা জানে। কিন্তু দামি জিনিসগুলো আমরা প্যাসেঞ্জারদের হাতে ধরিয়ে দিই। তোমায় দেখে মনে হচ্ছে বাপ-দাদুর জমানো টাকা আছে। বেকার হয়ে আমাদের মতো না খেয়ে মরো, তাহলে জ্বালা বুঝবে চাঁদু।

বুড়ো কর্তা ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞাসা করল, আমার সিটের তলায় যেটা রেখে গেলে সেটায় কী আছে?

ছেলেটা চোখ বড় করল, কিছু নেই। দেখুন দাদু, আমরা আপনাদের সঙ্গে একবারও খারাপ ব্যবহার করিনি। করেছি? তাহলে খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য করবেন না। শালা দেশের প্রধানমন্ত্রী চুরি করছে, মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে মাল বানাচ্ছে, পার্টির দাদারা ভিখিরি থেকে রাজা হয়ে গেল তার বেলায় দোষ নেই। আরে ভাই, ইন্ডিয়া একটা ভিখিরি দেশের নাম। কিস্যু দেওয়ার ক্ষমতা নেই এই দেশের। ভবিষ্যৎ যেখানে অন্ধকার তখন যে যেমন পারে লুটে নিলে কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারবে।

ট্রেনের গতি কমে আসতেই ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর চিৎকার করে বলল, পার্টনার নাম্বার টু, একশো টাকার নোট দিবি। বেশি ঝামেলা করলে আর একটা। তার বেশি নয়।

ট্রেন থামল। জায়গাটা বিহার। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। এর মধ্যে দরজায় শব্দ হল। বেশ জোরে জোরে। ছেলেটা চেঁচাল, কেউ দরজা খুলবেন না। যা করার আমরাই করব। পার্টনার টু-!

সায়ন শুনল বাইরে থেকে ধমক দেওয়া হচ্ছে দরজা খুলে দেওয়ার জন্যে। সে উঠে এগিয়ে গেল দেখতে। কম্পার্টমেন্টের অন্য যাত্রীদের চেহারা এখন পুতুলের মতো। বাতিল পুতুল।

সায়ন দেখল আর একটি ছেলে দরজার জানলা খুলে কথা বলার চেষ্টা করছে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করল, পার্টনার সর্বনাশ। পাণ্ডে হারামিটা দাঁড়িয়ে আছে।

সঙ্গে সঙ্গে দৌড়োনো শুরু হয়ে গেল। উল্টোদিকের দরজা খুলে দুদ্দাড় করে নেমে গেল সবাই। যাওয়ার আগে শাসিয়ে গেল কেউ যেন পুলিশের কাছে মুখ না খোলে।

দরজা প্রায় ভেঙে ফেলার জোগাড়। একজন ভদ্রমহিলা উঠে দরজাটা খুলে দিতেই তাতার দস্যুদের মতো পুলিশ বাহিনী ঢুকে পড়ল কম্পার্টমেন্টে। ওদের সামনে যে অফিসারটা রিভলবার উচিয়ে প্রথমে উঠল সে হিন্দিতে চিৎকার করল, এতক্ষণ দরজা খোলেননি কেন? জবাব দিন?

কেউ জবাব দিল না। লোকটা গালাগাল দিল, সবকটা হিজড়ে। কারও সাহস নেই প্রতিবাদ করার। খুঁজে দ্যাখ। 

সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনী সক্রিয় হল। পুরো কম্পার্টমেন্ট খুঁজে এসে তারা জানাল আসামিরা পালিয়েছে।

পালিয়ে কোথায় যাবে। এই ট্রেনেই উঠেছে। মাল সার্চ করো।

পুলিশরা আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। যাত্রীদের স্যুটকেস, ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করতে লাগল। এই সময় সেই ভদ্রমহিলা, যিনি দরজা খুলে দিয়েছিলেন, পুলিশ অফিসারের সামনে গিয়ে বললেন, আপনারা কি অন্ধ না অন্ধ সেজে থাকতে পছন্দ করেন এটা আমি বুঝতে পারছি না।

কী বলতে চাইছেন?

 যেসব জিনিসের উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন সেগুলো কোথায় আছে তা আপনারা জানেন না? নিরীহ মানুষদের মালপত্র নিয়ে টানাটানি করছেন?

কোথায় আছে?

আশ্চর্য। আপনি জেনেশুনেও ন্যাকামো করলে আমার কিছু বলার নেই।

 আপনি আমার সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলতে পারেন না।

আপনারা যা করছেন তাতে অন্য কোনও ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছি না।

ঠিক আছে, আপনি আমাকে হেল্প করুন। কোথায় লুকিয়েছে মালগুলো?

ঠিক সে-সময় একজন সেপাই বলল, টয়লেটগুলো খুলতে হবে স্যার। সাধারণত ওখানেই ওরা লুকিয়ে রাখে।

অফিসারের নির্দেশে টয়লেটগুলোর সম্ভাব্য লুকোনো জায়গা দেখা হল। পুলিশ কিছুই পেল না।

নেমে যাওয়ার আগে অফিসার মহিলার সামনে এলেন, আমরা খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না। আপনি হেল্প করলে পাওয়া যেত।

ওরা মালপত্র নিয়ে টয়লেটে ঢুকছিল।

আচ্ছা। ট্রেনের নীচে সার্চ করো। চিৎকার করে উঠলেন অফিসার। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন চলতে শুরু করল। যেভাবে ওরা উঠেছিল সেভাবেই নেমে গেল পুলিশগুলো। সম্ভবত ওদের ডিউটি এই স্টেশনেই সীমাবদ্ধ।

ট্রেন চলছে। দেখা গেল ওপাশের দরজায় শব্দ হচ্ছে। সায়ন দেখল চলন্ত ট্রেনের দরজার বাইরে থেকে সেই ছেলেটির গলা ভেসে আসছে। ছুটন্ত ট্রেনে যখন ওরা ঝুলে আছে তখন নিশ্চয়ই অন্য কম্পার্টমেন্টে ওঠেনি। এই সময় একটি বাদামওয়ালা দরজা খুলে দিল। পরপর ঢুকল ছেলেগুলো। ওদের চেহারা দেখে আঁতকে উঠল সায়ন। ঝড়ে বিধ্বস্ত গাছেরাও এদের থেকে বিন্যস্ত থাকে। কম্পার্টমেন্টে ঢুকেই ওরা দৌড়ে গেল টয়লেটে। নিজেদের মধ্যে চিৎকার করে বলাবলি করতে লাগল মালগুলো ঠিক আছে। পুলিশ খুঁজে পায়নি। ওদের মুখেচোখে একটু স্বস্তি ফিরে এল।

যে ছেলেটি নেতা সে পুরো করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আপনাদের কাছে যেসব জিনিস আমরা জমা রেখেছিলাম সেগুলো ঠিক না থাকলে বলুন। পুলিশ কি কারও কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছে?

কেউ জবাব দিল না। ছেলেটি বলল, তাহলে ধরে নিচ্ছি মালগুলো ঠিক আছে। আমরা যে স্টেশনে এই ট্রেনে উঠেছি সেই স্টেশনে এই কম্পার্টমেন্টের টি টি নেমে অন্য জায়গায় উঠেছে। সামনের স্টেশনে সে আবার ফিরে আসবে। মনে রাখবেন ওই লোকটা ডিউটিতে থাকার সময় কানে শুনতে পায় না। অতএব ওকে কিছু বললে, আপনাদের কোনও লাভ হবে না। আমি এবার দিদিমণির সঙ্গে কথা বলব।

ছেলেটি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সেই মহিলার সামনে যিনি খুব উত্তেজিত হয়েছিলেন পুলিশের সামনে। সায়ন ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতেই অন্য ছেলেগুলোর একটা ধমকে উঠল, অ্যাই? কোথায় যাচ্ছ?

দেখব। সায়ন স্পষ্ট জবাব দিল।

আর দেখতে হবে না। বেশি দেখতে চাইলে বাবার বিয়ে দেখিয়ে দেব। শালা যেন সিনেমা দেখতে যাচ্ছে। ছেলেটা হাত তুলল।

তুমি এর চেয়ে ভালভাবে কথা বলতে পার না? সায়ন জিজ্ঞাসা করল। ওর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে ছেলেটা হাত নামাল। মুখ ফিরিয়ে নিল। সায়ন দেখল বিষ্ণুপ্ৰসাদ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। নেতা তখন ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করছে, আমি উঠেই বলেছি আমরা বেকার ছেলে। বেঁচে থাকার জন্যে রোজগারে নেমেছি। আমরা না করলে অনাহারে মরতাম, কিন্তু অন্য কেউ করত। সেটা আপনার ভাল লাগেনি। আপনি পুলিশের কাছে চুকলি কেটেছেন।

কে বলল চুকলি কেটেছি? ভদ্রমহিলা খুব ঘাবড়ে গেলেন।

আপনার জন্য পাণ্ডে পরের স্টেশনে খবর পাঠাবে ট্রেনের তলা সার্চ করতে। এর জন্যে আপনাকে শাস্তি পেতে হবে।

তার মানে?

এই কম্পার্টমেন্টের কেউ পুলিশের সঙ্গে কথা বলেনি। একমাত্র আপনিই বারেবারে বলেছেন। আপনার কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ টয়লেট সার্চ করতে গিয়েছিল। ফিরে এসে আপানার সঙ্গে কথা বলে ওরা উত্তেজিত হয়েছিল কিন্তু মাল বের করার সময় পায়নি। এই মাল ধরা পড়লে মালিক আমাদের কাছে ক্ষতিপূরণ আদায় করে। সেক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা কী হয় ভাবতে পারেন? আপনাকে আমি জানলা দিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। কী শাস্তি চান?

ভদ্রমহিলা দু হাতে মুখ ঢাকলেন। তাঁর শরীর কাঁপছিল।

আপনি উঠুন। আমরা কেউ আপনার শরীরে হাত দেব না। আপনি নিজের শাড়ি জামা খুলুন। ছেলেটি গম্ভীর মুখে বলল।

না! ভদ্রমহিলা চিৎকার করে উঠলেন।

 হ্যাঁ। আমরা আপনার গায়ে হাত দিতে চাই না। খুলুন।

আমি খুলব না। ডুকরে কেঁদে উঠলেন ভদ্রমহিলা।

তাহলে কথা রাখতে পারছি না। আমরা হাত বাড়ালে আপনি আরও বেইজ্জত হবেন। এই কম্পার্টমেন্টের কোনও ভেড়ুয়া আপনাকে বাঁচাতে আসবে না। বড্ড তেল হয়েছে আপনার। খপ করে হাত ধরল ছেলেটি। ধরে এক ঝটকায় দাঁড় করিয়ে দিল।

সায়ন খুব ধীরে সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ছেড়ে দাও।

অ্যাই! মাস্তানি মারাবি না। ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেব।

 তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু ওঁকে ছেড়ে দাও।

ছেলেটি কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। হাত সরিয়ে নিয়ে অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে কেন?

সায়ন হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নাকের নীচটা মুছতেই সেখানে রক্ত লেগে গেল। বিষ্ণুপ্ৰসাদ ছুটে এল। সায়নকে দু হাতে ধরে বলল, তুমি শোবে চলো। আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছ তুমি।

ওরা কেউ কিছু বলল না। বিষ্ণুপ্ৰসাদ সায়নকে ওদের বার্থে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল। রক্ত বের হচ্ছে বিন্দু বিন্দু। সায়ন তার ওষুধের ব্যাগটা বের করতে বলল নিচু গলায়। সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করছে তার। ওষুধগুলো থেকে বিশেষ ক্যাপসুলটা দেখিয়ে দিতেই বিষ্ণুপ্রসাদ সেটা খাইয়ে দিল।

ছেলেগুলো ওদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল টয়লেটের নীচ থেকে তাদের মালগুলো তুলে যাত্রীদের সিটের নীচে রাখতে। নেতা এসে দাঁড়াল সামনে, ওর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে কেন?

বিষ্ণুপ্ৰসাদ তাকাল, ওর অসুখ আছে। লিউকোমিয়া।

মাই গড। ছেলেটা চমকে উঠল। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে বলল, ডাক্তার দরকার? দাঁড়াও। সে চিৎকার করল, এই কম্পার্টমেন্টে কেউ ডাক্তার আছেন? প্লিজ উঠে আসুন।

কেউ এলেন না। সায়ন হাত নাড়ল, দরকার নেই।

 ট্রেনটা পরের স্টেশনে থামতেই কয়েকজন পুলিশ উঠে এলেন কামরায়। সঙ্গে টি টি। পুলিশ অফিসার বললেন, কী যে করো তোমরা। আমার ওপর অর্ডার এসেছে টয়লেটের নীচটা দেখতে। ওখানে চোরাই মাল আছে থাকলে নিয়ে যেতে আমি বাধ্য।

নেতা বলল, খুঁজে দেখুন।

ওরা খুঁজল। কিছু পেল না। নেতা বলল, পাননি এটা জানিয়ে দেবেন। সে দুটো একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিল।

আরও তিনটে দাও। অফিসার বললেন।

ছেলেটি আর একটা যোগ করল। কোনও কথা বলল না।

অফিসার তিনটে নোট নিয়ে নিঃশব্দে নেমে গেলেন। ওঁরা নেমে গেলে টি টি লিস্ট বের করলেন। নেতা তাঁর পকেটে আর একটা একশো টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, একজন ডাক্তার দরকার।

কেউ উন্ডেড হয়েছে?

না। নেমে গিয়ে জানিয়ে দিন মালদায় ফোন করে দিতে।

টিকিট চেক করতে হবে যে।

যা বলছি তাই করুন।

টি টি নেমে গেলেন। ছেলেটি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, পার্টনাররা, তোমরা কোনও প্যাসেঞ্জারকে বিরক্ত কোরো না। সবাই দুদিকের দরজার সামনে চলে যাও। ট্রেন ছাড়ল।

সায়ন ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিষ্ণুপ্ৰসাদ তার মাথার পাশে বসেছিল। উল্টো দিকের বেঞ্চিতে বসা পরিবার অদ্ভুত চোখে সায়নকে দেখছে। ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী অসুখের নাম বলল?

লিউকোমিয়া। বৃদ্ধ জবাব দিলেন।

খুব খারাপ রোগ? ছোঁয়াচে?

বুঝতে পারছি না। শুনেছি এক ধরনের ক্যান্সার।

 তাহলে বাঁচবে না। তোমার ছোটকাকা তো ক্যান্সারে মরেছেন।

 চুপ করো! কার মুখ দেখে এবার বেরিয়েছিলাম।

ট্রেন চলছে। রাত এখন প্রায় দশটা। যাত্রীরা যে যার খাবার প্রায় নিঃশব্দে খেয়ে নিয়েছে। বিষ্ণুপ্ৰসাদ কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে লক্ষ রাখছিল, রক্ত বের হচ্ছে না অনেকক্ষণ আগে থেকে। হঠাৎ সে দেখতে পেল সেই ভদ্রমহিলা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিষ্ণুপ্ৰসাদ কী করবে বুঝতে না পেরে হাসল।

কেমন আছেন উনি? ভদ্রমহিলা নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন।

বিষ্ণুপ্ৰসাদ ভাঙা বাংলায় বলল, ঘুম দিচ্ছে।

আমি একটু বসতে পারি?

ভানুপ্ৰসাদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা সায়নের মাথার পাশে বসলেন। বুকে ওর নাক দেখলেন। বিষ্ণুপ্ৰসাদ দাঁড়িয়েছিল। সে বলল, ঘুম দিলে ঠিক হো যায়েগা।

কী হয়েছে ওঁর? ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন।

ওপাশের কর্তা জবাব দিলেন, লিউকোমিয়া, ডেঞ্জারাস ডিজিজ। বেশিদিন বাঁচে না। ইনফেকসাস কিনা জানি না।

ভদ্রমহিলা চাপা গলায় ফোঁস করে উঠলেন, আপনি কি শিক্ষিত?

 ভদ্রলোকের মুখ দুমড়ে গেল। অন্য দিকে তাকালেন।

ভদ্রমহিলা বিষ্ণুপ্ৰসাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, এরকম কি প্রায়ই হয়? এইভাবে রক্ত বেরিয়ে আসে?

বিষ্ণুপ্ৰসাদ একটু চিন্তা করল। সায়নের দৈনন্দিন সমস্যার কথা সে জানে না। কিন্তু কিছুদিন ধরেই তো ওকে সুস্থ দেখছে সে। তাই বলল, নেহি। ডেইলি হয় না।

ভদ্রমহিলা বললেন, আপনি আপনার বার্থে শুয়ে পড়ুন। আমি ওঁর পাশে আছি।

যে মহিলাকে বাঁচাতে গিয়ে সায়ন অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাঁর এই ব্যবহারে খুশি হল বিষ্ণুপ্ৰসাদ। কিন্তু তার খিদে পেয়ে গিয়েছিল। নিরাময় থেকে নিয়ে আসা খাবারের প্যাকেট ব্যাগে রয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা বের করে খেতে অস্বস্তি লাগল তার। সে দ্বিতীয় বাঙ্ক টেনে চেন লাগিয়ে উঠে পড়ল। ভদ্রমহিলা একটু কুঁজো হয়ে নীচে বসে রইলেন।

মালদা স্টেশনে ট্রেন থামার পর নেতা একজন ডাক্তারকে নিয়ে ওদের সামনে এলেন। ডাক্তার ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

ভদ্রমহিলা বললেন, আমি ঠিক জানি না। তবে শুনলাম ইনি লিউকোমিয়া পেশেন্ট। ব্লিড করছিল। অনেকক্ষণ ঘুমোচ্ছেন।

এখন রক্ত পড়ছে?

না।

তাহলে ঘুমোক। এসব পেশেন্ট আমার আওতার বাইরে। আন্দাজে ওষুধ দেওয়া ঠিক হবে না। ঘুমই বেস্ট মেডিসিন। ডাক্তার চলে গেলেন।

নেতা ছেলেটি গেল না। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল। ভদ্রমহিলা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কিছু বলবেন?

মাথা নাড়ল ছেলেটা। তারপর চলে গেল।

সারারাত ধরে যে স্টেশনেই ট্রেন থেমেছে সেই স্টেশনে হয় রেলের লোক নয় পুলিশ এসে হাত পেতেছে আর ছেলেগুলো টাকা দিয়ে গিয়েছে। যাত্রীদের মধ্যে যারা অত্যন্ত ঘুমকাতুরে তারা ছাড়া সবাই হয়ে সেসব দৃশ্য দেখেছে।

বোলপুর স্টেশনে যখন ট্রেন ঢুকল তখন ভোর হচ্ছে। ভদ্রমহিলা কুঁজো হয়ে বসে হেলান দিয়েছিলেন। তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ অস্বস্তি হতেই তাকালেন। দেখলেন, সায়ন উঠে বসার চেষ্টা করছে। কিন্তু মাথার ওপর মধ্যের বাঙ্কটা থাকায় সে সোজা হতে পারছে না।

ভদ্রমহিলা দ্রুত বললেন, উঠবেন না ভাই, শুয়ে থাকুন।

কেন? সায়নের ব্যাপারটা দুর্বোধ্য লাগল।

আপনি অসুস্থ। সায়ন এবার মাঝখানের জায়গাটায় সোজা হয়ে দাঁড়াল, না, আমি এখন ঠিক আছি। আপনি এখানে?

আমার জন্যে আপনি অসুস্থ হয়েছিলেন।

আপনার জন্যে হইনি। আমি অসুস্থতা সঙ্গে নিয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু ওরা কোথায়? ওরা আপনার কোনও ক্ষতি করেনি তো?

না। আপনার মুখে রক্ত দেখে ওরা অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেল। নইলে তখন আমার যে কী হত ভাবলেই শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে।

অদ্ভুত তো। কথাটা বলে সায়ন বিষ্ণুপ্রসাদের দিকে তাকাল। সে তখন আরামে ঘুমোচ্ছ। গতরাতে খাওয়া হয়নি, এখন খিদে পাচ্ছে। সে বিষ্ণুপ্ৰসাদকে ডাকতেই সাড়া পেল।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল নেপালিতে, কাল রাত্রে খেয়েছিলে?

বিষ্ণুপ্ৰসাদ হাসল, আমরা কেউই খাইনি৷ উনিও না। জবাবটা নেপালিতেই দিল সে।

এই সময় প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো হকার দুটো চায়ের ভাঁড় জানলায় রেখে আর একটা আনতে আনতে বলল, দিদিমণি, চা নিন। গরম গরম চা। খেলে প্রাণ জুড়িয়ে যাবে।

ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, তিনটে চায়ের দাম কত?

হকার জিভ বের করল, দাম বললে দাদা আমার জিভ উপড়ে দেবে। আপনারা খেয়ে নিন দিদি।

তোমার দাদাটি কে?

ছেলেটি তিনটে চায়ের ভাঁড় জানলার ওপরে রেখে সরে গেল উত্তর না দিয়ে। সায়ন বলল, আমি চা খাই না।

আমি খাই কিন্তু এই চা খেতে পারব না।

কেন?

আমার মনে হচ্ছে কাল রাত্রে যে ছেলেটি আমাকে অপমান করেছিল সে-ই এই হকারের দাদা। ভদ্রমহিলা বললেন।

সায়ন হাত বাড়িয়ে একটা ভাঁড় বিষ্ণুপ্ৰসাদকে দিতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। চলন্ত ট্রেনের ঝাঁকুনিতে জানলায় রাখা ভাঁড় থেকে চা চলকে পড়ল। ভদ্রমহিলা সেই ভাঁড় দুটো জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।

ভদ্রমহিলা গজগজ করলেন, একে বলে জুতো মেরে গোরু দান। যাক গে, আপনার শরীর এখন কেমন আছে?

ভাল। কোনও প্রব্লেম নেই।

উত্তেজিত হলেই কি আপনার রক্তপাত হয়?

কখনওসখনও।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। এই শরীর নিয়ে অমন সাহসী হলেন কী করে?

সায়ন হাসল, মনে হয়েছিল প্রতিবাদ করা প্রয়োজন, তাই।

আপনার নাম জানা হয়নি।

সায়ন রায়।

 আমি নন্দিতা। স্কুলে পড়াই। যাই, কাল সারারাত সিট ছেড়ে থেকেছি। জিনিসপত্রগুলো ঠিক আছে কিনা দেখি। নন্দিতা চলে গেলেন।

সায়ন টয়লেটে গিয়ে দেখল দেওয়াল, প্যান ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। কোনওমতে পরিষ্কার হয়ে ফিরে এল সে। বিষ্ণুপ্রসাদের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, অসুখ বাড়েনি তো?

মাথা নাড়ল সায়ন, না। এর আগে যতবার রক্ত বেরিয়েছে ততবারই শরীরে রক্ত দিতে হয়েছে। মনে হচ্ছে এবার তার প্রয়োজন হবে না।

হঠাৎ ট্রেনটা গতি কমাল। এবার রাতের সেই ছেলেগুলো তৎপর হল। সিটের নীচ থেকে মালগুলো বের করে দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করল জায়গার জন্যে। ট্রেন তখন চলতে হয় বলে চলছে। ঝপ ঝপ করে বান্ডিলগুলো ফেলতে লাগল ওরা। সেগুলো ফেলে দেওয়ার পর ওরা যাত্রীদের কাছে এল কাল রাতে গচ্ছিত রাখা দামি জিনিসগুলো ফেরত নিতে। ট্রেন তখন হুইসল দিচ্ছে।

নেতা ছেলেটি সায়নের সামনে এল, এখন কেমন আছেন?

ঠিক আছি।

এসব করতে আমাদের ভাল লাগে না কিন্তু না করেও উপায় নেই। আমাদের যদি ক্রিমিন্যাল বলা হয় তাহলে সেটা হতে কে বাধ্য করছে তা নিয়ে কেউ ভাবে না।

আপনি এত কৈফিয়ত দিচ্ছেন কেন?

ছেলেটি হাসল, ঠিক। বোকার মতো ব্যাপার। চলি, দিদিমণির কাছে ক্ষমা চেয়ে এসেছি। উনি অবশ্য ক্ষমা করতে পারেন না। ছেলেটি নেমে যাওয়া মাত্র যাত্রীরা সরব হল। ট্রেন তখন পূর্ণ গতিতে চলতে শুরু করেছে। রেল পুলিশ এবং কর্মচারীদের সঙ্গে চোরাকারবারিদের বন্দোবস্ত আছে, এ কথা সবাই সোচ্চারে বলাবলি করছিল। নইলে ট্রেনের ড্রাইভার ঠিক ওদের নেমে যাওয়ার জায়গায় গাড়ির গতি কমিয়ে দেবে কেন?

সায়ন শুনল নন্দিতা চিৎকার করে বললেন, আপনারা দয়া করে চুপ করবেন? ওরা যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ তো ভিজে বেড়ালের মতো বসেছিলেন। এখন গলা ফাটিয়ে বীরত্ব দেখিয়ে কী লাভ?

শেয়ালদা স্টেশনে নেমে নন্দিতা একটা কাগজের টুকরো এগিয়ে দিলেন, সায়ন, এখানে আমার ঠিকানা ফোন নাম্বার লেখা আছে। তুমি আমার চেয়ে বয়সে ছোট বলে তুমি বলছি। যদি ফোন করো তাহলে ভাল লাগবে। তুমি যা করেছ তা আমি সারা জীবন মনে রাখব।

সায়ন হাসল। বিষ্ণুপ্ৰসাদ কুলি নিতে দিল না। অজস্র মানুষের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সায়নের অস্বস্তি শুরু হল। এত মানুষ, কেউ কারও জন্যে না ভেবে ছুটে চলেছে ট্যাক্সি বা বাস ধরতে। সায়ন বলল, দাঁড়াও, সবাই বেরিয়ে যাক, তারপর যাব।

প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হয়ে গেলে বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, বাপস। কী বড় স্টেশন। স্টেশনটাই যদি এত বড় হয় তাহলে শহরটা না জানি কত বড় হবে।

সায়ন কথা বলল না।

ট্যাক্সি নিয়ে ওরা যখন রায়বাড়ির সামনে পৌঁছোল তখন দুপুর। এতদিন পাহাড়ের নির্জনতায় থেকে কলকাতার ভিড়, জ্যাম, গরম কাহিল করে দিয়েছিল সায়নকে। এই ট্যাক্সিটা পেতেও বাড়তি টাকা দিতে হয়েছে। বিষ্ণুপ্রসাদের কৌতূহল এত প্রবল ছিল যে কষ্টবোধ ছিল না।

বাড়ির সামনে পৌঁছে অবাক হয়ে গেল সায়ন। পরীগুলো নেই। সেই জায়গায় মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করছে কিছু লোক। সে বিষ্ণুপ্ৰসাদকে বলল, এই আমাদের বাড়ি।

এই সময় পাঁড়েজি কাঁপতে কাঁপতে ছুটে এল। ট্যাক্সি থেকে নেমে আসা সায়নকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল বৃদ্ধ, ও সানুবাবা, সব খতম হো গিয়া, বিলকুল খতম। ও মেরা গোপাল, তুম কাঁহা থা!

সেই চিৎকার শুনে ওপরের জানলায় এসে উঁকি দিতেই নন্দিনীর শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। তাঁর মনে হল পাঁড়েজি এক জ্যোতির্ময় পুরুষকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।

.

৩৪.

ওপরে উঠে এসে সায়ন যখন তাঁকে প্রণাম করেছিল তখনও নন্দিনীর বুক কাঁপছিল। সায়নকে দেখে তাঁর ওরকম লাগছিল কেন? সায়নকে বুকে জড়িয়ে ধরেও তাঁর স্বস্তি হচ্ছিল না। সায়ন বলল, মা আমার সঙ্গে বিষ্ণুপ্ৰসাদ এসেছে।

বিষ্ণুপ্ৰসাদ কে?

আমাদের ওখানে থাকে।

তোদের ওখানে? কথাটা মোটেই পছন্দ হল না নন্দিনীর।

ওহো, নিরাময় নয়। ও পাহাড়ের ছেলে। খুব ভাল। ডাক্তার আঙ্কল আমাকে একা আসতে দিলেন না বলে ওকে অনুরোধ করেছিলাম।

কী করে সে?

এখন এলিজাবেথকে সাহায্য করছে, পরে সব বলব।

সায়নের বাবার তখন সবে ঘুম ভেঙেছে। চায়ের কাপ নিয়ে বসেছিলেন। সেই কাপ হাতে বাইরের ঘরে এলেন তিনি, কেমন আছিস?

সায়ন বাবার দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে মনে অভিমানের মেঘ ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে এতদিন পাহাড়ে রয়েছে অথচ বাবা সময় পায়নি দেখা করার। শেষমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিতে পারল সে। বলল, ভাল।

পথে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

না।

নন্দিনী বললেন, ওর সঙ্গে একটি ছেলে এসেছে। পাহাড়ি ছেলে। ডাক্তারবাবু সঙ্গে পাঠিয়েছেন।

সায়ন প্রতিবাদ করল, না, না। ডাক্তার আঙ্কল পাঠাননি। আমি অনুরোধ করেছিলাম বলে এসেছে।

সায়নের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ও কি আজই ফিরে যাবে?

দূর। আজ ফিরবে কেন? ও তো এর আগে কলকাতায় কখনও আসেনি। সদুদাকে বলতে হবে ওকে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিতে।

নন্দিনী আর কথা বাড়াতে রাজি হলেন না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে জলখাবার খেয়ে সায়নকে বিশ্রাম নিতে বললেন তিনি।

সায়ন বলল, বিষ্ণুপ্ৰসাদকে ডাকো।

সায়নের বাবা বললেন, ওর কথা চিন্তা করতে হবে না। পাঁড়েজিকে বলে দিচ্ছি, নীচেই ওর ব্যবস্থা করে দেবে।

সায়ন বলল, তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না বাবা! বিষ্ণুপ্ৰসাদ পাঁড়েজিদের মতো নয়। ও আমাকে পছন্দ করে বলে অনেক কাজ ফেলে কলকাতায় এসেছে। মা, তুমি ওকে ওপরে আসতে বলো। আমার ঘরে অনেক জায়গা, ওখানেই বিষ্ণুপ্ৰসাদ থাকবে।

সায়ন নিজের ঘরে চলে গেলে নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, কী করব?

সায়নের বাবার মুখ গম্ভীর, বললেন, দিস ইজ টু মাচ। রায়বাড়ির ইতিহাসে অবাঙালি দূরের কথা অনাত্মীয়কেই বাড়ির ভেতরে কখনও রাত কাটাতে দেওয়া হয়নি। ছেলেটা নিশ্চয়ই নেপালি। ওর ব্যাকগ্রাউন্ড আমরা জানি না। হুট করে সায়নের বেডরুমে ওকে থাকতে বললে অন্য সবাই কী বলবে?

নন্দিনী বললেন, আগে ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে দ্যাখো, কী রকম তা তো জানোনা।

কথা বলে কী হবে?

তবু নন্দিনী কাজের মেয়েকে দিয়ে নীচে খবর পাঠালেন। একটু বাদে তার পেছন পেছন বিষ্ণুপ্ৰসাদ উঠে এল। হাতে ব্যাগ। ঘরে ঢুকে নমস্কার করল খুব বিনীত ভঙ্গিতে।

নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম বিষ্ণুপ্ৰসাদ?

জি।

বাংলা জানো?

 কম কম।

নন্দিনী হেসে ফেললেন। সায়নের বাবা গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, কলকাতায় কতদিন থাকার ইচ্ছে?

মাথা নাড়ল বিষ্ণুপ্ৰসাদ! তারপর হিন্দি বাংলা মিশিয়ে বলল, আমি জানি না। সায়ন যেমন বলবে তেমন হবে।

কলকাতায় কোনও আত্মীয়স্বজন নেই?

 মাথা নাড়ল বিষ্ণুপ্ৰসাদ, নেই। তারপরই মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলল, সায়নের শরীর ভাল নেই। ওকে এখনই ডাক্তার দেখান।

নন্দিনীর কপালে ভাঁজ পড়ল, কেন? কী হয়েছে?

 কাল রাত্রে ট্রেনে ওর নাক থেকে রক্ত পড়েছিল।

সে কী? ও তো কিছু বলল না!

হ্যাঁ। ওষুধ খেয়ে সারারাত ঘুমোবার পর ঠিক হয়েছে।

সায়নের বাবা বললেন, তা হলে নিরাময়ে থেকে তো ওর কোনও উপকারই হয়নি। আমি তোমাকে বলেছিলাম! তুমি যখন ওখানে গিয়েছিলে তখনও তো ব্লিডিং হয়েছিল।

কথাটায় কান না দিয়ে নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা বাবা, ওখানে কি ওর প্রায়ই রক্ত পড়ত?

না, না। ও তো আমাদের মতো হয়ে গিয়েছে। মিস্টার ব্রাউনের ডেডবডির সঙ্গে হেঁটেছে। আমাকে খবর দিতে ম্যাডামের বাড়িতে গিয়েছিল।

তুমি কি অনেক দূরে থাকো?

 হ্যাঁ। নিরাময় থেকে অনেক ওপরে। বিষ্ণুপ্ৰসাদ জবাব দিল।

 সায়নের বাবা বললেন, হোয়াট ইজ দিস। ডাক্তার ওকে অ্যালাউ করল কী করে পাহাড়ে উঠতে?

নন্দিনী বললেন, ঠিক আছে, এখন এ নিয়ে মাথা গরম কোরো না। ছেলেটা তো স্বাভাবিকভাবেই বাড়িতে এসেছে। তুমি আমার সঙ্গে এসো। সায়নের বাবার অসন্তুষ্ট মুখের দিকে না তাকিয়ে নন্দিনী বিষ্ণুপ্ৰসাদকে নিয়ে ভেতরে গেলেন। সায়নের ঘরে ঢুকে দেখলেন বাথরুমের দরজা বন্ধ। জলের আওয়াজ হচ্ছে। বললেন, এই ঘরে সায়নের সঙ্গে তুমি থাকবে। আচ্ছা, ট্রেনে কি হঠাৎই ওর নাক থেকে রক্ত বেরিয়েছিল?

মাথা নাড়ল বিষ্ণুপ্ৰসাদ, না। একটা গোলমাল হয়েছিল। কতকগুলো গুণ্ডা একজন মেয়েকে ভয় দেখাচ্ছিল। ও প্রতিবাদ করতে গেল হঠাৎই। সেই সময় রক্ত বেরিয়ে এসেছিল।

নন্দিনী চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর বুক জুড়িয়ে গেল খবরটা শুনে।

এই সময় দরজা খুলে বের হল সায়ন। স্নান সেরে নিয়েছে ইতিমধ্যে। বলল, এসেছ। যাও, চান করে নাও। ভাল লাগবে। মা খিদে পেয়েছে।

তুই এইসময় ওখানে কী খেতিস?

ওখানকার কথা ভুলে যাও, বাড়িতে যা আছে তাই দাও।

বাঃ, ভুললে চলবে কেন? ডাক্তার নিশ্চয়ই কখন কী খাবি তার চার্ট করে দিয়েছেন। লুচি তরকারি খেতে বলেছেন?

সায়ন হাসল, অনেকদিন খাইনি। তরকারি নয়, বেগুনভাজা করো লুচির সঙ্গে।

বিষ্ণুপ্ৰসাদ টয়লেটে ঢুকে গেলে নন্দিনী সায়নের কাছে এলেন, এই, মুখ তোল, দেখি তো।

 সায়ন অবাক, মুখ দেখার কী হল?

কাল রাত্রে ট্রেনে রক্ত বেরিয়েছিল?

ওঃ, এর মধ্যেই রিপোর্ট পেয়ে গেছ? ও কিছু নয়।

তোর কী দরকার ছিল অন্যের ঝামেলায় জড়াবার?

বাঃ। ধরো আমি তোমাকে চিনি না, তুমি আমার মা নও। তোমাকে কতকগুলো গুণ্ডা অসম্মান করছে দেখে আমি চুপ করে থাকব?

নন্দিনী ঢোঁক গিললেন, কিন্তু তুই নিজে দুর্বল, গুণ্ডাদের সঙ্গে পারবি?

অন্যায়ের প্রতিবাদ যে করে সে আর দুর্বল থাকে না। তখন যে অন্যায় করে সে-ই দুর্বল হয়ে যায়। সায়ন চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, তা ছাড়া ওই ছেলেগুলো তো সত্যিকারের গুণ্ডা নয়।

তার মানে? ওরা শুনলাম একটি মেয়েকে–!

 ঠিকই শুনেছ। কিন্তু সেটা করছিল ভয় পেয়ে। ভদ্রমহিলার জন্যে একটু হলে ওরা ধরা পড়ে যেত। আর ধরা পড়লে ওদের সামনে কোনও পথ খোলা থাকত না। ওরা স্মাগল্ড জিনিস কলকাতায় পৌঁছে দিচ্ছিল। জিনিসগুলো ওদের নয়। যদি না দিতে পারে তা হলে স্মাগলার ওদের শেষ করে দেবে। যদি দিতে পারে তা হলে সামান্য টাকা পাবে।

এটা অন্যায় নয়?

নিশ্চয় অন্যায়। কিন্তু ছেলেগুলো কেন এই অন্যায় করছে। ওদের অনেকেই পড়াশুনা করেছে। কিন্তু চেষ্টা করেও কাজকর্ম পায়নি। এই দেশের সরকার ওদের পাশে দাঁড়ায়নি। একটা লোককে দিনের পর দিন অনাহারে রাখবে অথচ তাকে সৎ হতে বলবে এটা কতদিন সে মেনে নিতে পারে?

কিন্তু তুই যদি আরও অসুস্থ হয়ে যেতিস? শোন, খেয়েদেয়ে একবার বাবার সঙ্গে ডক্টর দাশগুপ্তের কাছে যাবি।

কেন?

কেন আবার? কাল রাত্রে রক্ত পড়েছিল, ওরকম হলে তো আগে ব্লাড দিতে হত।

তখন আমি শয্যাশায়ী হয়ে যেতাম। এবার তেমন কিছু হয়েছে? সকালে ঘুম ভাঙার পর কোনও অসুবিধে অনুভব করিনি। তুমি চিন্তা কোরো না।

রান্নাঘরে কাজের মেয়েকে কী কী করতে হবে নির্দেশ দিয়ে নন্দিনী স্বামীর কাছে গেলেন, কী হল তোমার?

তোমাদের জন্যে আমি পাগল হয়ে যাব।

হঠাৎ?

 হঠাৎ নয়। চিরকালই। এই ছেলের অসুখের পেছনে কী পরিমাণ খরচ হচ্ছে তুমি জানো। তবু আমি কখনও কার্পণ্য করিনি, কিন্তু ও যদি আমার ওপর মানসিক টর্চার করে তা হলে আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আর তুমি তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছ। ওই উটকো নেপালি ছেলেটার স্ট্যাটাস কী আমরা জানি না। হয়তো ওর বাবা মালপত্র বয়, কুলির কাজ করে। তুমি তাকে আমার কথা অস্বীকার করে ভেতরে নিয়ে গেলে। চমৎকার!

নন্দিনীর স্বামীর কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। বললেন, আমি কোনও অন্যায় করিনি। এ বাড়িতে কোনও অল্পবয়সী মেয়ে নেই যে বাইরের ছেলেকে ভেতরে ঢোকালে সমস্যা হবে। তা ছাড়া যে নেপালি ছেলেটা আমার অসুস্থ ছেলেকে কলকাতায় পৌঁছে দিচ্ছে কোনও স্বার্থ ছাড়াই তার প্রতি অকৃতজ্ঞ হব কেন? সায়ন ওকে বন্ধু বলে মনে করে। ওকে ওপরে না নিয়ে এলে তোমার ছেলে ক্ষেপে যেত। আর স্ট্যাটাস নিয়ে কেন মাথা ঘামাচ্ছ? রায়বাড়ি রায়বাড়ি করে তো অনেকদিন কাটালে, কদিন বাদে সেই রায়বাড়ি ধুলোয় মিশে যাবে। তার বন্দোবস্ত তো নিজেরাই করেছ। আর কেন?

ছেলেটা কবে যাবে?

তুমি জিজ্ঞাসা করো।

বুঝতে পারছ না কেন, অন্য শরিকরা আমাকে ওর ব্যাপারে প্রশ্ন করলে কী জবাব দেব?

ছেলেকে দেখিয়ে দিও।

.

এরকম বাড়িতে বিষ্ণুপ্ৰসাদ কখনও থাকেনি। এত বড় ঘর, ছাদ কত উঁচুতে, বাথরুমটা শোওয়ার ঘরের চেয়ে বড়। চৌবাচ্চা ভর্তি জল সেখানে। সায়নের পাশে বসে লুচি বেগুনভাজা মিষ্টি খাওয়ার সময় তাকে বেশ তৃপ্ত দেখাচ্ছিল।

নন্দিনী ওদের খাওয়া দেখছিলেন। সায়নকে অনেকদিন পরে তিনি স্বাভাবিক মানুষের মতো খেতে দেখছেন। ওর চোখমুখে অসুস্থতার চিহ্নমাত্র নেই। পাহাড়ে যখন গিয়েছিলেন, ছেলেকে টুরিস্ট লজে নিজের কাছে এনে রেখেছিলেন তখনও এমন প্রাণবন্ত ছিল না।

খাওয়া শেষ হলে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার পেট ভরেছে বিষ্ণু?

জি।

এখন দুজনে গল্প করে। দুপুর একটায় খেতে দেব। নন্দিনী চলে গেলেন।

সায়ন বলল, এখন রেস্ট নাও। আমি সদুদাকে বলছি তোমাকে যাতে কলকাতা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেয়।

সদুদা কে?

 আমার এক দাদা। তুমি টিভি দেখবে?

এ বাড়িতে টিভি রয়েছে বাইরের ঘরে। সেখানে তখনও সায়নের বাবা বসেছিলেন। সেই ঘরে ঢুকে সায়ন বলল, বাবা, টিভিটা একটু খুলব, বিষ্ণুপ্ৰসাদ দেখবে।

সায়নের বাবা কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলেন। টিভি খুলে একটা সিনেমার চ্যানেল ধরে বিষ্ণুপ্ৰসাদকে বসিয়ে সায়ন বাইরে বেরিয়ে এল। নীচে নেমে পাঁড়েজির কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল সদানন্দ বাদলকে নিয়ে সকালবেলায় বেরিয়ে গেছে।

ওপাশে মাঠের ভেতর কুলিরা কাজ করছে। ভিত শেষ। অনেক যন্ত্রপাতি আসছে। ওখানে বাড়ি উঠবে।

সায়ন ভেতরে পা বাড়াল। মা ব্যাঘ্রবাহিনী ঠিক আগের মতনই আছেন। এই সকাল পেরিয়ে যাওয়া সময়টা তাঁর পুজোয় বসেছেন ঠাকুরমশাই।

ও কে? সানু না?

ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে আতরবালাকে দেখতে পেল সায়ন। হাতে পুজোর থালা নিয়ে এগিয়ে আসছে। সায়ন জিজ্ঞাসা করল, বড়মা কেমন আছেন?

এখনও আছেন। মা ব্যাঘ্রবাহিনী যতদিন রাখবেন ততদিন তো থাকতেই হবে। তুমি কবে এলে? আতরবালা সামনে এসে দাঁড়াল।

আজই।

ওরা ছেড়ে দিল?

কারা?

 ওই যে, কোন পাহাড়ের হাসপাতালে গিয়েছিলে।

না ছাড়লে এলাম কী করে?

 আতরবালার যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। ছেলেটার চলাবলার মধ্যে অসুস্থতা দেখতে পাচ্ছিল না সে। অথচ এতদিন শুনেছে ওর মরণরোগ হয়েছে।

সায়ন সরে এল। এই মহিলাকে দেখলেই তার শাকচুন্নির ছবি মনে পড়ে। ঊর্মিলা কাকিমার কাছে রাজশেখর বসুর একটা বই আছে। কী যেন তাঁর ছদ্মনাম? হ্যাঁ, পরশুরাম। সেই বইয়ে আতরবালার একটা ছবি আছে। সিঁড়ি ভেঙে সে একটা বন্ধ দরজায় পৌঁছে গেল।

দরজা খুলল কালোর মা, ওমা, এ যে সানুদাদা।

টুপুর কোথায়?

কালোর মায়ের চিৎকার শুনে প্রথমে ছুটে এল টুপুর, আরে! তুমি? কখন এলে? আমার চিঠি পেয়েছ। মা, দ্যাখো, কে এসেছে!

কৃষ্ণা দরজায় এলেন, ওমা, সানু, এসো, এসো।

সায়নকে নিয়ে হইচই পড়ে গেল। টুপুর একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে। সমরেন্দ্রনাথ এবং সৌদামিনী এলেন। ওঁদের সমস্ত কৌতূহল মেটাতে হল সায়নকে। শেষ পর্যন্ত সমরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ওখানকার ডাক্তার কী বলছেন? আর যেতে হবে না তো?

এই প্রশ্ন এখনও বাবা বা মা করেননি। সায়ন বলল, আমি এখানে কিছুদিনের জন্যে এসেছি।

তার মানে? তোমার অসুখ সারেনি?

এই অসুখ কখনও সারে না। ঠিকঠাক নিয়ম মেনে চললে বেশ কিছু দিন বেঁচে থাকা যায়। সায়ন হাসল।

সে কী? তাহলে ওখানে গিয়ে কী লাভ হল? সৌদামিনী জিজ্ঞাসা করলেন।

ওখানে না গেলে হয়তো এতদিনও বাঁচতাম না।

মুহূর্তেই পরিবেশ গম্ভীর হয়ে গেল। সেটাকে সহজ করতে সায়ন বলল, কোনও মানুষ কি চিরকাল বেঁচে থাকে? কেউ ষাট কেউ সত্তর কেউ আশি। আমার বেলায় হয়তো তার চেয়ে কম।

কৃষ্ণা বললেন, ওষুধ-টষুধ ঠিকঠাক খাচ্ছ তো?

নিশ্চয়ই।

আমার কিন্তু তোমার চেহারা আগের থেকে অনেক ভাল লাগছে। কৃষ্ণা বললেন, বোসো, একটু মিষ্টি আনি।

না না। আমি এইমাত্র পেটপুরে লুচি আর বেগুনভাজা খেয়েছি। পরে এসে খাব। সায়ন হাত নাড়ল।

সৌদামিনী বা কৃষ্ণা কাজ ফেলে এসেছিলেন। তাঁরা ভেতরে চলে গেলে সায়ন সমরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করল, এই বাড়ি কবে ভেঙে ফেলা হবে?

ভগবান জানেন। ওরা যে গতিতে কাজ করছে তাতে নতুন বাড়ি শেষ হতে বছর দুয়েক লেগে যাবে। এদিকে দিন দিন এ বাড়িটা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। এখন খরচা করে সারাবারও মানে হয় না।

সমরেন্দ্রনাথ কথা ঘোরালেন, তোমার আর পড়াশুনা হল না।

না। অবশ্য পড়াশুনা করেও বা কী লাভ হত।

কেন? এ আবার কীরকম কথা।

বেশিদিন তো বাঁচব না। ডিগ্রি নিয়ে কারও উপকারে লাগব না। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ বেঁচে থাকে বেঁচে থাকার জন্যে। কেন বেঁচে আছে তারা নিজেরাই জানে না। মরে যাওয়ার পর তাদের কথা কেউ বলে না। অনেকটা গোরু-ছাগলের মতো। তাই যে যার মতো কিছু কাজ যা মানুষের উপকারে আসবে করে গেলে বেঁচে থাকার পক্ষে যুক্তি পাওয়া যায়।

সমরেন্দ্রনাথ তাকালেন। তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, বোসো, কথা বলো। আমাকে আবার একটু বেরুতে হবে।

তিনি চলে গেলে টপুর এই প্রথম ফিক করে হেসে ফেলল। সায়ন জিজ্ঞাসা করল, হাসছ যে?

বাবার বের হওয়ার কথা বিকেলবেলায়। তোমার কথাগুলো ভাল লাগল না বলে চলে গেল।

 সায়ন ভেবে পেল না খারাপ লাগার মতো কী কথা সে বলেছে।

টুপুরের দিকে তাকাল সায়ন। টুপুরটা যেন পাল্টে গেছে। কীকরম বড় বড় ভাব। আগে টুপুর তাকে দেখতে পেলেই গা ঘেঁষে বসত। আজ এ বাড়িতে ঢোকার সময় ওর মধ্যে সেই আগের অভিব্যক্তি দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তারপরেই গুটিয়ে গিয়েছে। সায়ন জিজ্ঞাসা করল, তোমার খবর কী?

ভাল।

এরকম গম্ভীর কেন? মেয়েরা বড় হলে বেশি কথা বলতে নেই। লোকে ছ্যাবলা বলবে।

তুমি বড় হচ্ছ?

বাঃ। হচ্ছি না?

কোন ক্লাস তোমার?

ক্লাসে ওঠা ছাড়াও মেয়েরা বড় হয়।

আমি জানি না।

কী করে জানবে! তুমি তো আর মেয়ে নও।

সায়ন উঠল, আমি চলি।

ওমা, এই তো এলে, চলে যাচ্ছ কেন?

যাই, সবার সঙ্গে দেখা করতে হবে। টুপুর। তুমি মন দিয়ে পড়াশুনা করবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

বাঃ। এইমাত্র বললে ডিগ্রি নিয়ে কোনও লাভ হবে না।

সেটা আমার ক্ষেত্রে। তোমাকে অনেকদিন বেঁচে থাকতে হবে। তাই না?

টুপুর হাসল, ঠাকুমা বলে বিদ্যের জাহাজ হয়ে কোনও লাভ নেই। সেই তো শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাঁড়ি ঠেলতে হবে। যে মেয়ে বিয়ে করবে না তার পড়াশুনা করা উচিত।

অবাক হয়ে তাকাল সায়ন। টুপুরটা কীকরম বদলে গিয়েছে। রায়বাড়ির গিন্নিরা যে গলায় কথা বলে সেই গলায় বলছে। সে বলল, আসছি।

আবার এসো কিন্তু।

দরজা বন্ধ হয়ে গেলে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল সায়ন। তার হঠাৎ শীত শীত করতে লাগল। অথচ এখন কলকাতায় বেশ গরম। সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিল।

ঊর্মিলা অবাক। দরজা খুলে সায়নকে দেখে জড়িয়ে ধরল সে। বই হাতে নিয়ে কমলেন্দু উঠে এল। হঠাৎ কার সঙ্গে কলকাতায় এল সব খুলে বলতে হল সায়নকে। সেটা শেষ হলে সায়ন জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা তোমার কাছে রাজশেখর বসুর একটা বই ছিল না? ভেতরে ছবি আঁকা?

দুখানা আছে। কজ্জলি আর হনুমানের স্বপ্ন। ঊর্মিলা হাসল, পড়বি?

শাকচুন্নির ছবি আছে একটাতে?

হ্যাঁ। কেন বল তো?

বড়মায়ের কাজের লোক আতরবালাকে দেখে সেই ছবিটার কথা মনে পড়ল একটু আগে। কী রোগা হয়ে গেছে, না?

ঊর্মিলা চোখ বড় করল, তুই তো ভীষণ পেকে গিয়েছিস! এরপর হয়তো আমাকে কারও সঙ্গে তুলনা করবি। কদিন থাকবি বল?

দেখি।

কমলেন্দু বলল, তোর শরীর যদি একটু ঠিক থাকে তাহলে আর ওখানে যাওয়ার কী দরকার বল!

এখানে থেকে আমি কী করব?

 বাড়িতে থাকবি, বই পড়বি। তোর মা খুশি হবে।

সায়ন উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে এমন ভঙ্গিতে হাসতে লাগল যে কমলেন্দু আর এই প্রসঙ্গে কথা বলল না।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের ছাদে যাওয়া যাবে?

কেন যাবে না, চল। ঊর্মিলা উঠে দাঁড়াল।

কমলেন্দু মনে করিয়ে দিল, এখন কিন্তু চড়া রোদ।

 সায়ন বলল, কষ্ট হলেই চলে আসব।

ঊর্মিলার সঙ্গে ছাদে এল সায়ন। বিশাল ছাদ। এককালে এখানে কত খেলা করেছে সে। সেইসব স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছিল।

এখন ছাদে কিছু জামাকাপড় শুকোচ্ছে। কোনও মানুষ নেই। এত বড় ছাদ খাঁ খাঁ করছে। ঝুঁকে রাস্তা দেখল সায়ন। ঊর্মিলা পাশে ছিল, বলল, নতুন বাড়িতে এত সহজে ছাদে যাওয়া যাবে না।

সায়ন বলল, নতুন বাড়ির নামও কি রায়বাড়ি হবে?

কী জানি নামে কী আসে যায়।

তোমাকে একটা কথা বলব?

কী কথা?

একটু আগে টুপুরদের ওখানে গিয়েছিলাম। ও কেমন বদলে গেছে। এখন কথা বলছে এমন ভাবে যেন দিদিমা। ওর এখন থেকেই মাথায় ঢুকে গেছে বিয়ে হবে এবং সংসার করবে। অতএব পড়াশুনোর তেমন দরকার নেই।

নিশ্চয়ই ওর মা ঠাকুমার মুখে ওই রকম শুনেছে’, ঊর্মিলা জিজ্ঞাসা করল, এতে মন খারাপ হল কেন?

আমি ভেবেছিলাম ও অন্যরকম হবে। চলো, নীচে যাই।

ঊর্মিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নীচে নামতেই সদানন্দর সঙ্গে দেখা। হইচই করে সদানন্দ তাকে তার অফিসঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। তারপর সিগারেট ধরিয়ে বলল, ফেয়ার ওয়েল টু পাহাড় হয়ে গেছে?

না।

সে কী? আবার যাবি নাকি?

দেখি। শোনো, তুমি একটা উপকার করবে? আমার সঙ্গে একটি নেপালি ছেলে এসেছে। ওর নাম বিষ্ণুপ্ৰসাদ। এর আগে কখনও কলকাতায় আসেনি। ওকে তোমার বাইকে বসিয়ে কলকাতা দেখিয়ে দেবে?

কলকাতা দেখাব মানে?

ওই যে, চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, প্ল্যানেটোরিয়াম, কালীঘাটের মন্দির।

দূর। চিড়িয়াখানা ছাড়া আমি নিজে কিছুই দেখিনি।

তাহলে?

 সদানন্দ হাসল, হবে। এই সুযোগে দেখা হয়ে যাবে।

 হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সায়ন, আজ বিকেলে যাবে?

আজ? আজ কেন? সদানন্দ মাথা নাড়ল।

ও তো বেশিদিন থাকবে না।

কোথায় আছে?

আমাদের বাড়িতে।

চমকে উঠল সদানন্দ, সে কী রে! তুই দেখছি বিপ্লব করেছিস। তোর মা-বাবা রাজি হল? এ বাড়িতে তো এরকম ঘটনা এর আগে ঘটেনি। সাবাস। তাহলে তো নিয়ে যেতেই হয়। ঠিক আছে, তিনটের সময় রেডি থাকতে বলিস। তুই যাবি না?

না। তা ছাড়া তোমার বাইকে তিনজনের অসুবিধে হবে। ও হ্যাঁ, তোমার বিয়ে কবে? সায়ন হাসল।

সঙ্গে সঙ্গে মুখটা কালো হয়ে গেল সদানন্দের, ঠোঁট কামড়াল।

 সায়ন জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে সদুদা!

আমি খুব প্রব্লেমে পড়ে গেছি সানু। তুই তো বড় হয়েছিস, লোক বলা যায়। কিন্তু আর কাউকে বলিস না। সিগারেট নেবাল সদানন্দ, যার সঙ্গে বিয়ের ঠিক হয়েছে, ওর মা আমার মা এগিয়ে গেছে, দিন ঠিক হওয়ার মুখে, তোকে তাই বলে এসেছিলাম, মনে আছে?

আছে।

সেই মেয়েটি আর একটা ছেলেকে ভালবাসে।

সেকী?

অবাক হওয়ার কী আছে? ভাল তো বাসতেই পারে। তা মেয়েটি আমাকে আলাদা জানিয়েছে। বলেছে জানার পরেও যদি আমি তাকে বিয়ে করি তাহলে সে বাধ্য হয়ে বিয়ে করবে কারণ গুরুজনদের অস্বীকার করার উপায় নেই। অথচ সেই ছেলেটা, বুঝলি, বেকার। চাকরি করে না।

তারপর?

তারপর বাদল পরামর্শ দিল বিয়েটা যে কোনও ছুতোয় কিছুদিন পিছিয়ে দিতে। ওই ছেলেটার সঙ্গে দেখা করে আমাদের গাড়ির লাইনের ব্যবসায় ঢুকিয়ে দিয়েছি। শিক্ষিত ছেলে তো, চটপট কাজ বুঝে নিয়েছে। এই তো গতকাল একটা মারুতির ডিল করিয়ে দিল, হাজার দশেক পাবে। বলেছি, মাস ছয়েকের মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যেন বিয়ে করে ফেলে।

মাস ছয়েক?

হাঁ। মাকে বলেছি তার আগে আমি কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না। যাক গে, তুই ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিবি। তিনটের সময়।

সায়ন বলল, সদুদা, তুমি এত ভাল!

 দূর। আমার মাথায় এসব ঢুকত নাকি? বাদলের পরামর্শে–, ঠিক আছে।

চাতালের পাশ দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল সায়ন। সে যখন এখানে থাকত তখন এই সিঁড়িটা প্রায় নিষিদ্ধ এলাকা ছিল। একমাত্র বিজয়া দশমীর সন্ধেবেলায় যেতে হত প্রণাম করতে।

সিঁড়ির মাঝখানে মিষ্টি তামাকের গন্ধ নাকে এল। গন্ধরাজ। সামনেই তাঁর দরজা। মায়ের নিষেধ ছিল ওই দরজা পার হওয়ার। শুধু সে কেন, এ বাড়ির কোনও ছেলেমেয়ে গন্ধরাজের ঘরে গিয়েছে কিনা সন্দেহ।

দরজা খুলল আতরবালা। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী চাই?

বড়মায়ের সঙ্গে দেখা করব।

ওঁর শরীর ভাল নেই, শুয়ে আছেন।

ও। ঠিক আছে।

এইসময় ভেতর থেকে কাঁপা গলা ভেসে এল, কে? কে রে আতর?

আতরবালা মাথা নাড়ল, হয়ে গেল! আর কী হবে; এসো ভেতরে এসো। নইলে আমার মাথার পোকা বের করে ফেলবে।

আতরবালার পেছন পেছন ঘরে ঢুকল সায়ন। সেইসব প্রাচীন আসবাব, ঘর সাজানোর জিনিসগুলোকে এখনও দেখতে পেল সে। বড়মা শুয়ে আছেন ইজিচেয়ারে। পেছনে এবং দুপাশে বালিশ, পা দুটো খাটো টেবিলের ওপর ছড়ানো। শুয়ে থাকা মানুষকে প্রণাম করতে নেই।

আমি সায়ন, চিকিৎসার জন্যে পাহাড়ে গিয়েছিলাম, আজ ফিরে এসেছি। আপনাকে নমস্কার করতে এলাম।

কে পাঠাল? চিঁচি করে জানতে চাইলেন বড়মা।

কেউ না।

অসুখ শুনেছিলাম সারবার নয়, সারল কী করে?

 এখনও সারেনি।

ছোঁয়াচে নাকি? মুখ দিয়ে রক্ত পড়া তো ছোঁয়াচে রোগ।

আমার নাক এবং কান দিয়েও পড়ে। সায়ন হাসল, আপনি কি এখন একা আছেন এ বাড়িতে?

হঠাৎ বড়মা দু হাতে মুখ ঢাকলেন, ও আতর, ও মুখপুড়ি, ওকে এখান থেকে যেতে বল। এই বয়সে আমার রাজরোগ হলে মরে যাব। হুঁ হুঁ হুঁ। অদ্ভুত নাকি কান্না জুড়ে দিলেন বৃদ্ধা। সায়ন দেখল ওঁর হাত কাঁপছে। চামড়া ঝুলে গিয়েছে এখন, তাতে অজস্র কুঞ্চন, শরীর থলথলে। এখন বোধহয় হাঁটতেও পারেন না।

আতরবালা এগিয়ে এল, আর দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে? চলো।

 ঠিক সেইসময় ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল গন্ধরাজ। ঢুকেই নাক টেনে নস্যি নিল, ওরে বাবা। তুমি আবার কোত্থেকে হাজির হলে? রোগ সারাতে পাহাড়ে গিয়েছিলে না?

সায়ন দেখল বৃদ্ধের ভাঙচুর হয়ে যাওয়া মুখের সঙ্গে কালো কলপ লাগানো চুল একদম বেমানান। ঠিক তখনই চিৎকার করে উঠল বড়মা, আবার এসেছে, শকুনটাকে আবার ঢুকতে দিলি কেন আতর?

গন্ধরাজ ধমকাল, শকুন? আমি শকুন? এই আমি না থাকলে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে মুখাগ্নি করবে কে? নাতি তো তার বউকে নিয়ে ভাগলবা। কৃতজ্ঞতা বলে কোনও বোধ নেই? তারপর গলার স্বর অদ্ভুতরকমের মোলায়েম করে বলল, ও আতর, আতরবালা, একটু আমার ঘরে আসবে, দরকারি কথা আছে।

আতরবালা চোখ ঘোরাল, মরণ!

তাই দেখে খুব খুশি হলেন গন্ধরাজ। টস করার মতো আঙুল বাজিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সায়ন এগিয়ে গেল বড়মায়ের সামনে। যাই।

বড়মা চোখ মেললেন। খুব ক্লান্ত দৃষ্টি। হঠাৎ সেই দৃষ্টি পাল্টে গেল। চোখ বিস্ফারিত হল। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ঠাকুর ঠাকুর। গুরুদেব দয়া কর দীনজনে।

আতরবালা জোর করে সায়নকে বাইরে পাঠিয়ে দিল। দ্রুত নীচে নেমে সদানন্দ আর বাদলকে দেখতে পেল সায়ন, সদুদা, বড়মার শরীর বোধহয় খারাপ হয়েছে। চোখ মুখ কেমন করছে।

সদানন্দ কান পাতল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, আতর নেই ওখানে?

আছে।

তাহলে কিছু হয়নি। গোলমাল হলে আতর কানের পর্দা ফাটাত।

তবু চলো না। সায়ন প্রায় জোর করেই সদানন্দকে নিয়ে ওপরে উঠল আবার। দরজা ভেজানো। আতরবালা কোথাও নেই। বড়মায়ের মাথাটা কাত হয়ে রয়েছে একদিকে। শরীরে প্রাণ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *