হিজরী প্ৰথম সনের ঘটনাবলী
হিজরী ষোড়শ, কারো কারো মতে সপ্তদশ বা অষ্টাদশ সনে খলীফা হযরত উমর (রা)-এর শাসনামলে হিজরী সন গণনার সূচনা সম্পর্কে সাহাবায়ে কিরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম একমত হন। আর তা এভাবে হয় যে, আমীরুল মু’মিনীন উমর (রা)-এর দরবারে কোন এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছু দলীল-দস্তাবেজ উপস্থাপন করা হয় এবং তাতে একথা উল্লেখ ছিল যে, শাবান মাসে তা পরিশোধ করতে হবে। তখন হযরত উমর (রা) জিজ্ঞেস করলেনঃ কোন শা’বান মাস? এর এ বছরের শা’বান মাস, যাতে আমরা এখন আছি, নাকি গত বছরের শা’বান মাস, না আগামী বছরের শা’বান মাস? এরপর তিনি সাহাবায়ে কিরামকে ডেকে একটা তারিখ নির্ধারণের ব্যাপারে তাদের নিকট পরামর্শ আহবান করেন, যাতে ঋণ পরিশোধ ইত্যাদির ক্ষেত্রে উক্ত তারিখ দ্বারা পরিচয় পাওয়া যায়। কেউ কেউ পারস্যের অনুরূপ তারিখ নির্ধারণের প্রস্তাব করলে খলীফা তা না-পসন্দ করেন। আর পারসিকরা একের পর এক তাদের রাজা-বাদশাহ দ্বারা তারিখ গণনা করতো। কেউ কেউ রোম সাম্রাজ্যের তারিখ অনুযায়ী তারিখ নির্ধারণের জন্য প্ৰস্তাব করে। রোমানরা তারিখ নির্ধারণ করে মেসিডোনিয়ার ফিলিপস তনয় সম্রাট আলেকজান্ডারের রাজত্বকাল থেকে ৷ খলীফা উমর (রা) এ প্রস্তাবও পসন্দ করেননি। কিছু কিছু সাহাবী রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্ম থেকে তারিখ নির্ধারণের প্রস্তাব করেন। আবার কোন কোন সাহাবী প্রস্তাব করেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নবুওয়াত লাভ থেকে তারিখ গণনা শুরু করতে। আবার কিছু লোক বলেন, বরং রাসূল (সা)-এর হিজরত থেকেই তারিখ গণনা শুরু করা হোক। কেউ কেউ বলেন, বরং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ওফাত থেকেই শুরু করা হোক। হিজরত থেকে তারিখ গণনা শুরু করার দিকে খলীফা উমর (রা) ঝাঁকেন। কারণ, হিজরতের ঘটনা প্ৰসিদ্ধ ও খ্যাত। এ ব্যাপারে সকলে তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
ইমাম বুখারী (র) সহীহ বুখারী গ্রন্থে তারিখ এবং তারিখের সূচনা পরিচ্ছেদে আবদুল্লাহ ইবন মুসলিম সূত্রে সাহল ইবন সাআদ থেকে বর্ণনা করে বলেনঃ
সাহাবায়ে কিরাম রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নবুওয়াত লাভ বা ওফাত থেকে (তারিখ) গণনা শুরু করেননি, বরং তারা শুরু করেছেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মদীনায় আগমন থেকে।
ঐতিহাসিক ওয়াকিদী ইবন আবিয যিনাদ সূত্রে ইবন সীরীন থেকে বর্ণনা করে বলেন : হযরত উমর (রা) সমীপে কেউ একজন আবেদন জানায় : তারিখ নির্ধারণ করে দিন হে আমীরুল মু’মিনীন। খলীফা উমর জানতে চাইলেন, কী তারিখ? লোকটি বললো : আজমী তথা অনারবরা একটা কাজ করে তারা লিখে রাখে— অমুক শহরে অমুক মাসে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তখন হযরত উমর (রা) বললেন : চমৎকার, তাহলে তোমরাও লিখে রাখা। তখন লোকজন বললো : কোন সন থেকে আমরা সূচনা করবাে? কিছু লোক বললো, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওয়াত লাভ থেকে। অপর কিছু লোক বললোঃ না, বরং তার ওফাত থেকেই শুরু করি। এরপর হিজরত থেকে সূচনা করার ব্যাপারে সকলেই একমত হন। পরে কিছু লোক বললেন, : কোন মাস থেকে আমরা সূচনা করবাে? কিছু লোক বললেন, : রমাযান মাস থেকে। আবার অপর কিছু লোক বললেন, : না, বরং মুহাররম মাস থেকে (শুরু করা
হোক)। কারণ, মুহাররম মাস হজ্জ থেকে লোকদের ফিরে যাওয়ার মাস। আর তা হচ্ছে হারাম তথা সম্মানিত মাস। তাই মুহাররম মাস থেকে হিজরী সন গণনা শুরু করার ব্যাপারে সকলেই
একমত হন।
ইবন জারীর (তাবার) আল্লাহ্ তা’আলার বাণী – ১. JLJ/, ” : 1, সম্পর্কে কুতীয়বা সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করে বলেন :
هو المحرم فجر السذسة–তা হলে মুহাররম মাস, সনের সূচনা। উবায়দ ইবন উমায়ার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন :
ان المحرم شهر الله و هو رآس السنة یکسی البیت و یورخ به الناس ،
و يضرب فيه الورق–.
“মুহাররম হল আল্লাহর মাস, তা-ই বছরের শুরু, তাতে (বায়তুল্লাহর) গিলাফ পরানো হয়, লোকেরা এ দ্বারা তারিখ নির্ণয় করে এবং মুদ্রা চালু করা হয়।”
ইমাম আহমদ (র) রাওহ ইবন উবাদা সূত্রে আমর ইবন দীনার থেকে বর্ণনা করে বলেন :
ইয়া’লা ইবন উমাইয়া সর্বপ্রথম ইয়ামানে ইতিহাস লিখার সূচনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) রবিউল আউয়াল মাসে মদীনায় আগমন করেন এবং লোকেরা এ বছরের প্রথম মাস থেকেই বছরের তারিখ গণনার সূচনা করেন।
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক যুহরী সূত্রে এবং মুহাম্মদ সালিহ শা’বী সূত্রে এবং তারা উভয়ে
বলেন, :
বনূ ইসমাঈল হযরত ইবরাহীম (আ:)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা থেকে তারিখ গণনার সূচনা করে। এরপর হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল আলায়হিমােস সালাম কর্তৃক বায়তুল্লাহর ভিত্তি স্থাপন থেকে তারিখ গণনার সূচনা করে। এরপর তারিখ গণনার সূচনা করা হয় কাআব ইবন লুয়াই-এর মৃত্যু থেকে। এরপর তার সূচনা করা হয় হস্তী বাহিনীর হামলার দিন থেকে। এরপর তারিখ গণনার সূচনা করেন। হযরত উমর ইবন খাত্তাব হিজরতের বছর থেকে। আর এটা হিজরী সপ্তদশ বা অষ্টাদশ সনে। দলীল-প্রমাণ এবং সনদ-সূত্র সমেত বিষয়টা আমরা সবিস্তারে আলোচনা করছি হযরত উমর (রা)-এর জীবন চরিত গ্রন্থে। মহান আল্লাহই সমস্ত প্রশংসার মালিক। উদ্দেশ্য এই যে, তারা ইতিহাস গণনার সূচনা করেন হিজরী সন থেকে। আর বছরের শুরু নির্ধারণ করেন মুহাররম মাসকে। ঐতিহাসিকদের মধ্যে এটাই প্ৰসিদ্ধ ও খ্যাত। আর এটাই জামহুর ইমামগণের মত।
সুহায়লী প্রমুখ ইমাম মালিক (র) থেকে বর্ণনা করে বলেন, :
ইসলামী সনের সূচনা রবিউল আউয়াল মাস থেকে। কারণ, এটা এমন মাস, যে মাসে রাসূলুল্লাহ্ (সা) হিজরত করেন। সুহায়লী এ ব্যাপারে অন্যত্র আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা প্ৰমাণ উপস্থাপন করেন :
لمسجد أسس على التقوی من آول یوم
“প্ৰথম দিন থেকে যে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে তাকওয়ার উপর”। অর্থাৎ নবী করীম (সা)-এর মদীনায় প্রবেশের প্রথম দিন থেকে, আঃ, এটাই হলো ইসলামের ইতিহাস গণনার প্রথম দিন। যেমন হিজরতের সনই ইতিহাসের প্রথম সন-এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম একমত হয়েছেন। ইমাম মালিক (র) যা বলেছেন তা যে যথার্থ, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তবে বাস্তব কার্যক্রম এর বিপরীত। আর তা এ জন্যে যে, আরবী মাসের সূচনা মুহাররম মাস থেকে। তাই তারা প্ৰথম বছরকে হিজরতের সন নির্ধারণ করেছেন আর বছরের শুরু নির্ধারণ করেছেন মুহাররমকে। কারণ এটাই প্রসিদ্ধ ও পরিচিত, যাতে শৃংখলা বিপন্ন না হয়। আল্লাহই ভাল জানেন।
তাই আমরা বলি, আর আল্লাহর নিকটই সাহায্য চাই; রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কায় অবস্থানকালেই হিজরী সনের সূচনা হয়। আর আনসারগণ আকাবার দ্বিতীয় বায় আতে অংশ নিয়েছেন, যেমন আইয়ামে তাশরীকের মধ্যভাগে আমরা আলোচনা করে এসেছি আর তা ছিল হিজরী সনের পূর্বে যিলহাজ্জ মাসের ১২ তারিখ। এরপর আনসারগণ ফিরে যান এবং রাসূলুল্লাহ (সা) মুসলমানদেরকে মদীনায় হিজরতের অনুমতি দান করেন। শেষ পর্যন্ত যার পক্ষে হিজরত করা সম্ভব, রাসূলুল্লাহ ছাড়া এমন কেউই মক্কায় অবশিষ্ট থাকেননি। আর আবু বকর (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কারণে নিজেকে আটকে রাখেন, যাতে রাস্তায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে সঙ্গ দান করতে পারেন, যেমন ইতোপূর্বে আমরা আলোচনা করে এসেছি। এরপর তাঁরা দু’জন এমনভাবে বের হন, যে সম্পর্কে ইতোপূর্বে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। নবী করীম (সা)-এর পর আলী ইবন আবু তালিব পেছনে থেকে যান তারই নির্দেশে, যাতে করে রাসূল (সা)-এর নিকট যেসব আমানত ছিল, তা ফেরত দিতে পারেন। এরপর হযরত আলী (রা) কুবায় এসে তাদের সঙ্গে মিলিত হন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সোমবার দুপুরের কাছাকাছি সময়, যখন প্রখর রৌদ্রতাপ ছিল, এমন সময় মদীনায় আগমন করেন।
আর ওয়াকিদী প্রমুখ বলেন, : এটা রবিউল আউয়ালের ২ তারিখের ঘটনা। আর ইবন ইসহাকও একথাই বৰ্ণনা করেন। তবে পার্থক্য এই যে, তিনি এ তারিখের উপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করেননি। আর তিনিও এ বর্ণনাকেও প্রাধান্য দান করেছেন যে, ঘটনাটা রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখের। আর এটাই প্ৰসিদ্ধ ঘটনা, যা জামহুর ঐতিহাসিকগণ গ্ৰহণ করেছেন। বিশুদ্ধতম উক্তি অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মক্কায় অবস্থানের মুদত ছিল নবুওয়াত লাভের পর তেরো বছর। আর এটাই আবু হামযা যাব্বী সূত্রে ইবন আব্বাস থেকে হাম্মাদ ইবন সালামার বর্ণনা। এ বর্ণনায় ইবন আব্বাস (রা) বলেন :
“রাসূলুল্লাহ্ (সা) চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন আর মক্কায় অবস্থান করেন (নবুওয়াত লাভের পর) তেরো বছর। ইবন জারীর মুহাম্মদ ইবন মামার সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করে বলেন :
রাসূলুল্লাহ্ (সা)মক্কায় তের বছর অবস্থান করেন। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবন আব্বাস (রা) সুরমা ইবন আবু আনাস-এর কবিতা লিখেছেন ঃ ثوی فی قریش بیضع عشرة حجة – یذکر لو ییلقی صدیقا موانیا তিনি কুরায়শের মধ্যে তেরো বছর অবস্থান করেন। এ সময় তিনি উপদেশ দান করেন, যদি কোন সহানুভূতিশীল সঙ্গী পাওয়া যায়! আর ওয়াকিদী ইবরাহীম ইবন ইসমাঈল সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, সুরমার উপরোক্ত কবিতা তিনি প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করেন। অনুরূপভাবে ইবন জারীর হারিছ সূত্রে ওয়াকিদী থেকে পনের বছরের কথা উল্লেখ করেছেন। এ উক্তি নিতান্তই গরীব। আর এর চেয়েও বেশী গরীব হল ইবন জারীরের উক্তি । রাওহ ইবন উবাদা সূত্রে কাতাদা থেকে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ঃ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপর মক্কায় কুরআন নাযিল হয় আট বছর এবং মদীনায় দশ বছর। এ শেষোক্ত উক্তির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন হাসান বসরী । উক্তিটি এই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কায় দশ বছর অবস্থান করেছেন। আনাস ইবন মালিক, হযরত আইশা, সাঈদ ইবন মুসাইয়িব, আমর ইবন দীনার এমত সমর্থন করেন। এ ব্যাপারে ইবন জারীর তাদের নিকট থেকে রিওয়ায়াত উল্লেখ করেন । এটা ইবন আব্বাস থেকেও একটা বৰ্ণনা ! ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল। ইয়াহইয়া ইবন সাঈদ সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন ঃ
তেতাল্লিশ বছর বয়সে নবী করীম (সা)-এর উপর ওহী নাযিল হয়, এরপর তিনি মক্কায় দশ বছর অবস্থান করেন।
ইতিপূর্বে আমরা ইমাম শা’বী সূত্রে বর্ণনা করেছি ঃ
হযরত ইসরাফীল (আ) নবী করীম (সা)-এর সঙ্গে তিন বছর ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বাণী নিয়ে আসতেন এবং আরো কিছু। অন্য বর্ণনায় আছে ঃ
তিনি ফেরেশতা ইসরাফীলের উপস্থিতি অনুভব করতেন, কিন্তু তাকে দেখতেন না। এরপর জিবরাঈল (আঃ) আগমন করেন। ওয়াকিিদী তীর কোন কোন শায়খ থেকে বর্ণনা করেন যে, উক্ত শায়খ শা’বীর এ উক্তি অস্বীকার করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)মক্কায় দশ বছর অবস্থান করেন বলে যারা বলেছেন, আর তের বছর অবস্থান করেন বলে যারা বলেছেন, ইবন জারীর এ দু’ উক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেন। তিনি এ চেষ্টা করেন ইমাম শা’বীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যা তিনি উল্লেখ করেছেন। আসল ব্যাপার আল্লাহই ভাল জানেন।