সূর্যকে শুতে দেওয়া হয়েছিল একটি ছোট্ট মাটির ঘরে। মাটিতে পরিপাটি করে বিছানা পাতা, তার পায়ের কাছেই কয়েকটা ভূষির বস্তা এবং ঘরটাতে একটু ছাগল ছাগল গন্ধ। কয়েক দিন আগেই এদিকে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেছে, সেই সময় বোধহয় এই ঘরে ছাগলগুলোকে এনে রাখা হয়েছিল।
সারারাত সূর্যর ঘুম এল না, ঠায় জেগে রইল চোখ মেলে। মাথার কাছে একটা লণ্ঠন জ্বালা ছিল, সেটা সে ইচ্ছে করেই নিভিয়ে দিয়েছে। নিস্তব্ধ পল্লিতে শুধু একটানা ঝিঁঝির শব্দ ও মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক। পাশের গোয়ালঘরে গোরুদের বড় বড় নিশ্বাস ও স্বপ্ন-দেখা গোঙানির শব্দ শোনা যায়।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সূর্য বিছানা থেকে উঠে বাইরে চলে এল। দেখা গেল, বাড়ির কিছু কিছু লোকজন তারও আগে জেগেছে। রান্নাঘরে আঁচ পড়ে গেছে, একজন বুড়ি গোবরছড়া লেপছে দেওয়ালে।
দিনের আলোয় সূর্য বাড়িটাকে ভালো ভাবে দেখল। একটা উঠোনকে ঘিরে কয়েকটা ঘর। উঠোনের ঠিক মাঝখানেই একটা বেশ বড় নিমগাছ। নিমগাছের নীচে ধান ঝাড়াইয়ের ব্যবস্থা। রান্নাঘরটি উঠোনের এক কোণে। মাটির ঘর হলেও দেওয়ালগুলি বেশ ঝকঝকে তকতকে। মোটামুটি একজন সম্পন্ন চাষির বাড়িই বলা যায়।
মুখ ধোওয়ার জায়গা টায়গা কোথায় সূর্য জানে না, কাকে কী জিজ্ঞেস করবে, তাও বুঝতে পারছে না। সে একটু জড়োসড়ো হয়েই উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, এই সময় চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল উপেন সামন্ত মশাই। বেঁটেখাটো মানুষটি, খালি গায়ে বেশ নাদুসনাদুস চেহারা।
এই যে উঠে পড়েছ দাদা? চলো, পুকুরে যাই একসঙ্গে।
উপেন সামন্তের বয়স সূর্যর প্রায় তিন গুণ, তবু সে সূর্যকে আগাগোড়া দাদা বলেই সম্বোধন করতে লাগল এরপর থেকে। এ রকম অতিথিপরায়ণ মানুষ কদাচিৎ দেখা যায়। সূর্যকে সারাক্ষণ সে এমন খাতির করতে লাগল, যেন স্বয়ং ভগবান এসেছে তার বাড়িতে। তাকে ছাপোষা গৃহস্থই মনে হয়–চাষবাস জমিজমা নিয়েই ব্যস্ত–এর সঙ্গে ব্রজগোপালের দলের কী করে যোগাযোগ হল সূর্য ঠিক বুঝতে পারে না। এ-সম্পর্কে কোনও প্রশ্নও সে করতে পারে না, কারণ সে রকম নিয়ম নেই!
রান্নাঘরের পেছনে একটু দূরেই পুকুর। ঘাটে সিঁড়ি নেই। তালগাছ কেটে ধাপ বানানো হয়েছে। ছোট ছোট পানা ভাসছে পুকুরের জলে। উপেন সামন্ত নিমগাছের ডাল ভেঙে একটি দাঁতন সূর্যর হাতে দিয়ে কথা বলতে বলতেই দাঁত মেজে নিয়েছে। পুকুরের পাড়ে নেমে পানা সরিয়ে সরিয়ে খানিকটা জল পরিষ্কার করে নিল, তারপর বেশ আরাম করে মুখ ধুতে ধুতে কুলকুচো করা জল আবার ছিটিয়ে ফেলতে লাগল পুকুরে। সূর্যকে বলল, নাও দাদা, নাও।
সূর্যর ইংরেজি স্কুলে শিক্ষাপ্রাপ্ত মন একটু দ্বিধাগ্রস্ত। স্বাস্থ্য বইয়ের নানা উপদেশ মাথার কাছে ঘুরঘুর করে। কিন্তু এখন উপায়ান্তর নেই। উপেনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে সে ভাবল, স্বাস্থ্যের সমস্ত নিয়মকানুন অগ্রাহ্য করা সত্ত্বেও এর স্বাস্থ্যটি তো বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে। তবুমুখের জল কুলকুচো করে পুকুরে ফেলার ব্যাপারটাতেই সূর্যর অস্বস্তি কাটে না। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে সে হাত দিয়ে অনেকখানি জল সরিয়ে সরিয়ে তারপর এক আঁচল জল মুখে পুরে দেয়। জলে একটু গন্ধ আছে, কিন্তু খুব বিস্বাদ নয়।
চায়ের পাট নেই এ বাড়িতে, সূর্যকে খেতে দেওয়া হল একথালা পাতলা সুজির হালুয়া। এটা যে সূর্যর খাতিরেই বানানো হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গুড় দেওয়া হালুয়া সূর্য আগে কখনও খায়নি, গরম গরম বেশ খেয়ে ফেলা যায়।
একটু পরেই উপেন সামন্ত চাষের কাজে বেরিয়ে গেল। ব্রজগোপাল বলে যাওয়া সত্ত্বেও এবং সূর্যর অনেক পীড়াপীড়িতেও সে সূর্যকে কিছুতেই সঙ্গে নিল না। একগাল। হেসে বলল, তাও কি হয়? ভদ্রলোকের ছেলেকে দিয়ে কি হাল চাষ করানো যায়? তরোয়াল দিয়ে কি কেউ দাড়ি কামায়?
সূর্য বলল, আমি তো ভদ্রলোক নই।
তা তুমি যাই বলো দাদা–তোমার এ চেহারা–আমাকে যে শেষে পুলিশে ধরবে। তুমি দাদা কোথাও বেরিয়োনি!
সূর্য কিছুতেই তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাতে পারল না। সারা দিন সে বাড়ির মধ্যে বন্দি। এ বাড়িতে বিভিন্ন বয়সি পাঁচ জন নারী আছে। উপেন সামন্তর মা এখনও বেঁচে–তার ভাই মারা গেছে, বিধবাটি এ বাড়িতেই থাকে। উপেন সামন্তর এক ছেলে বাবার সঙ্গেই চাষবাস দেখে, আর এক ছেলে খড়গপুরে কলেজে পড়তে গেছে।
বাড়ির মেয়েরা সূর্যর দিকে অবাক ভাবে চেয়ে থাকে–কেউ সামনাসামনি কোনও কথা বলে না। বয়স্ক মেয়েরা ফিসফাস করে বলে, কী সুন্দর, কী সুন্দর। কুমারী মেয়েরা ফিকফিকিয়ে হেসে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সূর্য দারুণ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। নিজের চেহারা বিষয়ে সে একেবারেই সচেতন নয়। অন্য কেউ এ-বিষয়ে কথা বললে সে মনে মনে বিরক্তই হয় একটু দুর্ভাগ্যের বিষয় প্রায় জায়গাতেই তাকে এ-বিষয়ে আলোচনা শুনতে হয়। প্রথম বার দেখে কেউই তাকে বাঙালি বলে মনে করে না।
ব্রজগোপাল বলে গিয়েছিলেন, সূর্য গ্রামের লোককে দেশের কথা বোঝাবে। কিন্তু গ্রামের লোককে সে কোথায় পাবে? কী করে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তাই-ই সে জানে না। ওরা তো প্রায় সারা দিনই মাঠে থাকে–সন্ধ্যাবেলা ফিরেই খাবার খেয়ে। নেয়–এবং অল্পক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত্রে কেরোসিনের আলো জ্বেলে রাখা রীতিমতন ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। সূর্য কথা বলার কোনও লোক খুঁজে পায় না।
বাড়ির মেয়েরা সারা দিন রান্নাবান্না করে, গোরুর জন্য খড় কুচোয়, ধান ঝাড়ে–আর। বাড়ির লপ্ত বাগানে কাজ করে। বেগুন ও লঙ্কার গাছ আছে অনেকগুলো, এক ধারে আলুর গাছও লাগানো হয়েছে। প্রথম দু-এক দিন সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাগানের কাজ লক্ষ করল, তারপর নিজেই একদিন লেগে গেল সেই কাজে।
গাছগুলোর গোড়া খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জল দেয়, আগাছা পরিষ্কার করে। বেশ মেতে উঠল সে এই কাজে। নিছক বসে বসে পরের অন্ন ধ্বংস করছে না–এই চিন্তাও তাকে আনন্দ দেয়। পুকুর থেকে সে নিজেই খেতের জন্য ঘড়া ঘড়া জল তুলে আনে।
প্রথম দিন একটি পনেরো-যোলো বছরের মেয়ে তার কাছে এসে লজ্জা ভেঙে বলেছিল, আপনি পারবেননি। আমাকে দিন।
সূর্য গম্ভীর ভাবে বলেছিল, ঠিক পারব।
খানিকক্ষণ মাটি খোঁচাবার পরে সে দেখল তার সামনে মাটিতে একটা ছায়া পড়ে আছে, মেয়েটি তখনও পেছনে দাঁড়িয়ে।
সে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, তোমার নাম কী?
মেয়েটি লজ্জাতেই বাঁচে না। তক্ষুনি দৌড়ে পালিয়ে গেল। বছর দশ-এগারো বছরের আর একটি মেয়ে আছে, সেও আবার দেখতে এল সূর্যকে। সূর্য তার নাম জিজ্ঞেস করলে সেও লাগাল এক দৌড়।
আস্তে আস্তে লজ্জা ভাঙে। মেয়ে দুটির নাম লক্ষ্মী আর অন্নপূর্ণা। নক্ষী আর অন্নো– এই শুনে সূর্যকে আন্দাজ করে নিতে হয়েছে। ক্রমশ ওরা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজে লেগে যায়। বেশ একটা উৎসাহের সাড়া পড়ে যায় ওদের মধ্যে। এ রকম সাহেবের মতন চেহারার কোনও মানুষকে তো ওরা কখনও মাঠে বসে কাজ করতে দেখেনি।
সূর্যকে উপেন একটা কোরা ধুতি কিনে দিয়েছে। সেটা পরে সে এখন খালি গায়েই বাগানের কাজ করে, জল তোলে। অন্য বাড়ির লোকরা দেখতে আসে তাকে।
সূর্যর একটু অসুবিধে হয়েছিল স্নান করা নিয়ে। এখনও সে সাঁতার জানে না তাই পুকুরে নামতে ভয় পায়। দু-চার দিন পর উপেন এটা জানতে পেরে জোর করে তাকে পুকুরে নামাল এবং দিন তিনেক হাত-পা ছুড়িয়ে শিখিয়ে দিল সাঁতার। এটা সূর্যর পক্ষে একটা মস্ত লাভ। এরপর সে মহা উৎসাহে যখন তখন পুকুর দাপিয়ে বেড়ায়।
লক্ষ্মী আর অন্নপূর্ণা কোনও রকম লেখাপড়া জানে না। অক্ষর জ্ঞান পর্যন্ত নেই। এসব বাড়ির মেয়েদের লেখাপড়ার কথা কেউ চিন্তাই করে না কখনও। সূর্য একবার ভাবল, ওদের একটু লেখাপড়া শেখাবার চেষ্টা করলে কেমন হয়? এবাড়িতে বই বা কাগজপত্রের কোনও পাটই নেই, কী কারণে যেন একটা সাত-আট বছর আগেকার পঞ্জিকা পড়ে আছে শুধু। সেটা দিয়েও কোনও সুবিধে হবে না। বাগানে কাজ করতে করতে সূর্য ঝুরো ঝরো মাটির ওপর কাঠি দিয়ে অ আ লিখে ওদের শেখাবার চেষ্টা করে। ওদের সব কথাতেই হাসি। হেসে গড়াগড়ি যায় মাটিতে। সূর্য রীতিমতন গুরুমশাইয়ের মতন ওদের ধমকায়। উপেনের বউ দূর থেকে দেখে–সেও হাসে, যেন একটা মজার খেলা শুরু হয়েছে এখানে।
এখানে থাকতে থাকতে মনে হয়, পৃথিবীটা বড়ই ছোট। মানুষজনের সুখ-দুঃখ সবই ছোট-ঘোট, কারওর কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই বলে অতৃপ্তিও নেই। দু-চারখানা গ্রাম। ছাড়া আর কোনও জায়গার খবর এরা রাখে না। জন্ম-মৃত্যুও নিজস্ব নিয়মে চলে। রাত্তিরবেলা নক্ষত্র-ভরা আকাশের নীচে সূর্য একলা দাঁড়িয়ে থেকে ভাবে, এ-দেশ সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। নিজেকে তার খুবই ছোট মনে হয়।
আস্তে আস্তে সূর্য বাড়ির বাইরে বেরোতে শুরু করে। দু-চার জন লোকের সঙ্গে আলাপ হয়। মুদিখানার সামনে গিয়ে বসে–অন্যরা সহজে তার সঙ্গে কথা বলতে চায় না, সেও নিজে থেকে কিছু বলে না, চুপচাপ শোনে। গ্রামের মানুষ ইতিমধ্যেই এই অদ্ভুত যুবকের কথা জেনে গেছে। সূর্যকে দেখলেই তারা পরস্পরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। একটি দুটি লোক দ্বিধা কাটিয়ে প্রশ্ন করে, সাহেব কি কলকাতা থেকে আসছেন?
সূর্য একদিন ওই রকম মুদিখানার সামনেই বসেছিল, একটি বাচ্চা ছেলে তার সামনে এসে বলল, আপনাকে ডাক্তারবাবু ডাকছে।
সূর্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাকে?
সূর্য উপস্থিত অন্যান্য লোকদের দিকে তাকাল। একজন লোক বলল, পাগল ডাক্তার বোধহয় টের পেইয়েছেন।
সূর্য জিজ্ঞেস করল, আমি যাব?
সবাই একসঙ্গে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ যান না। তোক ভালো। ডাক্তার তোক ভালো। গরিব মানুষদের খুব দেখে।
সূর্য একবার ভাবল, এ-বিষয়ে উপেনের সঙ্গে তার একবার পরামর্শ করা দরকার কিনা। পরক্ষণেই মনে হল, ডাকতে যখন পাঠিয়েছে–তখন সূর্য না গেলে এই লোকগুলো ভাববে সে ভয় পেয়েছে। সেটা তার কাজের পক্ষে সুবিধাজনক নয়।
ছেলেটির সঙ্গে সে হাঁটতে হাঁটতে গেল এই গ্রাম ছাড়িয়ে অন্য গ্রামে। সেখানে একটি মাটির বাড়ির সামনে ডাক্তারের নামে বাংলা সাইনবোর্ড ঝোলানো। ডাক্তারের নাম তমোনাশ বিশ্বাস।
ভেতরে ঢুকে দেখল একটি করে নড়বড়ে আলমারি, টেবিল ও চেয়ার এবং দুটি কাঠের বেঞ্চ পাতা। ডাক্তার একজন করা রুগির মুখের মধ্যে টর্চ ফেলে দেখছেন। আরও কয়েক জন লোক নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
কোরা ধুতি-পরা খালি গায়ে সূর্য সেই ঘরের মধ্যে ঢুকে দাঁড়াতেই ডাক্তার কড়া চোখে তার দিকে তাকালেন। আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বললেন, তুমিই উপেন সামন্তর বাড়িতে এসে রয়েছ? বোসো ওখানে।
সূর্য বেঞ্চির এক কোণে বসল।