সিংহবাড়িতে গণ্ডা গণ্ডা দাস-দাসীর মধ্যে থাকোমণি এখন বেশ ভালোভাবেই মিশে গেছে এবং নিজের কাজে বেশ পাকাপোক্তও হয়ে উঠেছে। এখন সে-ও অন্যদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কলহ করে এবং নিজের ভাগটি কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত হিসেবে বুঝে নিতে জানে। ইদানীং সে বেশ একটু স্থূলকায়া হওয়ায় তার মুখে দেখা দিয়েছে। তৈলাক্ত সুখী সুখী ভাব।
খাঁচার পাখিকে নিয়ে কবিরা কত কবিতা রচে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খাঁচার পাখির মনে মুক্ত আকাশের জন্য দুঃখ কতকাল পোষা থাকে তা কে বা জানে। অভ্যাস বশে প্রথম প্রথম কিছুদিন বন্য বিহঙ্গম খাঁচার মধ্যে থেকে ছটফট করে বটে, তারপর এক সময় সে হয়তো সেই খাঁচাকেই ভালোবেসে ফেলে। অনেক সময় দেখা যায়, পিঞ্জরের দ্বার খোলা থাকলেও আকাশের পাখি আর ফিরে যেতে চায় না মুক্ত আকাশে।
গরীব কৃষকের বধু ছিল থাকোমণি, এখন ধনী গৃহের দাসী, তার নিজস্ব ও সন্তানের জন্য পেয়েছে নিশ্চিন্ত আশ্রয় ও খাদ্য। পুরোনো দিনের কথা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছে তার স্মৃতিতে। সেই ভয়মাখানো গ্ৰাম্য সরলতা তার ভাবে প্রকারে আর খুঁজে পাওয়া যায় না একটুও। প্ৰথম বছরখানেক সে তার হারানো স্বামীর জন্য বিরলে। অশ্রুপাত করতো, এখন ত্ৰিলোচন দাসের কথা তার কদাচিৎ মনে পড়ে এবং মনে পড়লেই ক্ৰোধ জাগে। থাকে।মণির এখন নিশ্চিত ধারণা, সে হতচ্ছাড়া মিনসে তাদের ফেলে রেখে সজ্ঞানেই পলায়ন করেছে। নইলে, এ শহরে এত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, আর সেই মানুষটা কপূরের মতন উপে গেল? থাকোমণি নিজেও এখন প্রায়ই বাড়ির বাইরে বেরোয়, এই তো সেদিন এ-বাড়ির অন্য দাস-দাসীদের সঙ্গে দল বেঁধে বাগবাজারের কুটুম বাড়িতে তত্ত্ব দিয়ে এলো। দুটি নগদ টাকা আর একখানা নতুন শাড়ি পেয়েছিল। সেজন্য। তাছাড়াও গিন্নীমার সঙ্গিনী হয়ে প্রায়ই যায়। গঙ্গার ঘাটে। শহুরে হালচোলও সে বুঝে গেছে অনেকটা।
স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারেই ইতিমধ্যে সতীত্ব বিসর্জন দিতে হয়েছে তাকে। দাসী-বাদীর কাজ করেও সতীত্বের গুমর দেখাবে, এ তো অসম্ভব কথা। বয়েসে যুবতী, স্বাস্থ্য ভালো, তার ওপর বেওয়া, এমন রমণী তো পুরুষের খাদ্য হবেই। প্রথম বছর দেড়েক থাকোমণি অতি কষ্টে নিজেকে সামলে ছিল, বংশানুক্রমিক সংস্কারবশতঃ তার ধারণা ছিল, যে স্ত্রীলোক পরী-পুরুষের কাছে ধরা দেয়, তার স্থান হয় অনন্ত নরকে। কিন্তু শহরের এই জমিদার বাড়িতে থেকে, যে বাড়িকে অনেকে কথায় কথায় বলে রাজবাড়ি, থাকোমণি আস্তে আস্তে বুঝতে পারলো, এ রকম বাড়ির ওপরতলা আর নীচের তলাতেই আছে স্বৰ্গ আর নরক। আর এখানকার নরকও তেমন ভয়াবহ নয়, বরং একটু মানিয়ে নিতে পারলে বেশ আরামদায়কই হয়ে ওঠে।
এইসব গৃহের ভূত্যাতন্ত্রের মধ্যে মাঝে মাঝেই নানারকম ওঠাপড়া থাকে। কতা-গিনীদের কাছে যে যত পেয়ারের, নীচের তলায় তার তত প্ৰতাপ। অবশ্য এমনও দেখা যায়, কতা আজ যে ভূত্যের সব কথা বিশ্বাস করছেন, দুদিন বাদে তাকেই হয়তো জুতো পেটা করে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। এই তো চিন্তামণি দাসী ছিল গিন্নীমা বিম্ববতীর একেবারে অতি নিজের লোক, গত মাসেই কোন অপরাধে কে জানে চিন্তামণিকে একেবারে বাড়ি ছাড়া করে দেওয়া হলো। সে নাকি আর কলকাতা শহরেই থাকতে পারবে ୩।
দিবাকরের স্ত্রী সোহাগবালার কর্তৃত্ব অবশ্য এখনো অক্ষুন্ন আছে। তার প্রবল ব্যক্তিত্ব দমন করার সাধ্য কারুর নেই। এখনো সকালবেলা পানের বাটা হাতে নিয়ে বারান্দার জলচৌকিতে বসে সোহাগবালা হুকুমের পর হুকুম চালায়। রান্নাবান্নার ব্যবস্থা থেকে আর সব কিছুই হয় তার নির্দেশে। এই ক-বছরে আরও অসম্ভব বেশী মোটা হয়ে গেছে সোহাগবালা, এখন আর সে নিজে নিজে হাঁটতে পারে না। দুজন দাসী দুদিক থেকে তাকে ধরে ধরে এনে বসিয়ে দেয় বারান্দায়। ঐটুকু পদচারণার পরিশ্রমেই তার শরীর থেকে স্বেদ নির্গত হয় গল গল করে। গরম সে সহ্য করতে পারে না একেবারেই, গ্ৰীষ্মকালে গায়ে কাপড় রাখতেও যেন তার কষ্ট হয়। শুধু একটা পাতলা ফিনফিনে সাদা ফরাসডাঙার শাড়ি পরে থাকে। শরীরে যত বেশী মেদ বধিত হচ্ছে, তত ফসও হচ্ছে তার গাত্ৰবৰ্ণ। সেই পাতলা শাড়ি ভেদ করে দেখা যায়। তার পাশ বালিশের মতন বিশাল দুটি স্তন এবং সিঁড়ির মতন পেটের ভাঁজ। আচলের মধ্য দিয়ে হাত গলিয়ে দিয়ে সেখানকার ঘামচি চুলকোতে চুলকোতে সোহাগবালা হাঁক দেয়, কই রে দুজ্জোধন! মাচের মুড়ো দুটো দেকালি নি? হ্যালা গোপালী, পশু তোকে ঘিয়ের টিন ভরে দিলুম। আর এর মধে ফেীত হয়ে গেল? চ্যায়ারখানা অমন খোলতাই হয়েচে, আজকাল বুজি গাঁতরেও ঘি মাকচিস? গতরসোগা, নিমকহারাম, লক্ষ্মীছাড়া…।
স্বগ্রামে দিবাকর দুখানি পাকা বাড়ি বানিয়েছে, পুকুর কাটিয়েছে, মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রায়ই সে স্ত্রীকে বলে দেশে গিয়ে সেখানকার সংসারের ভার নিয়ে থাকতে। সন্তান-সন্ততি কিছু হলো না, এখন এই বয়েসে তো ধর্মকর্ম করবারই কথা। তাছাড়া সেখানে দিবাকরের দুই ভাইয়ের পরিবার সব লুটে পুটে খাচ্ছে। কিন্তু সোহাগবালা কিছুতেই যাবে না। সেখানে কি সে এতগুলো দাসদাসীর ওপর কর্তৃত্ব করতে পারবে? তাছাড়া চুরির নেশা বড় নেশা, নিজের সংসারে গেলে সোহাগবালাকে শুধু খরচই করতে হবে, আর এখানে চাল-ডালের পাহাড়ে সে গড়াগড়ি দিতে পারে, সাঁতার দিতে পারে ঘি-তেলের সমুদ্রে। যদিও গড়াগড়ি দেওয়া কিংবা সাঁতারকাটার মতন শারীরিক শক্তি আর তার নেই, প্রায়ই বাত ব্যাধিতে তাকে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়তে হয়।
প্রথম প্রথম অন্যান্য দাসদাসীদের দেখে থাকোমণি বুঝেছিল যে সোহাগবালার সকল রকম অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যাওয়াই এ বাড়ির নিয়ম। কারণ, সোহাগবালার নামে কারুর কাছে কখনো নালিশ চলে না। ওপর মহলের কারুর সঙ্গে কথা বলারই অধিকার নেই নীচতলার ভৃত্যদের। গুরুতর কোনো ব্যাপার ঘটলে সে খবর জানাতে হয় দিবাকরকে। রান্নাঘরের দুজন ঠাকুর নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে একজন একটি জ্বলন্ত কাঠি তুলে মেরেছিল অন্য জনের মাথায়। সে ঘটনা ওপরতলার বাবুদের কর্ণগোচরও হয়নি। যা কিছু প্ৰতিবিধান তা দিবাকরই করেছিল। যে পাঁচকটি মার খেয়েছিল, তাকেই বরখাস্ত করে দেয় দিবাকর। সুতরাং সোহাগবালার হুকুমে খুন্তি পুড়িয়ে পিঠে ছাঁকা দেগে দেবার শাস্তি দেওয়া হয় যখন কোনো অবাধ্য দাস-দাসীকে, তখন সে ঘটনা দিবাকরকে জানানোও অর্থহীন।
বিশ বাইশটি দাস-দাসীর মধ্যে দু-চারজনকে অবশ্য হঠাৎ হঠাৎ দয়া-দক্ষিণ্য দেখায় সোহাগবালা। এর কারণ সহজে বোঝা যায় না। কোনোদিন যদি সন্ধের পর সোহাগবালা কোনো দাসীকে তার পা টিপে দেবার জন্য নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে যায়, তা হলেই বুঝতে হবে যে সেই দাসীর কপাল ফিরেছে। থাকোমণি অবশ্য গোড়ার থেকেই যে সোহাগবালার বিষ নজরে পড়েছিল, তা কাটিয়ে উঠতে ঢের সময় লেগে গেছে।
দুলালকে আর দিনের বেশীর ভাগ সময়ই কাছে পায় না থাকোমণি। দুলাল থাকে ওপরতলাতেই, সে ছোটবাবুর খাস ভৃত্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে, এজন্য দুটি টাকা মাইনেও বরাদ হয়েছে তার এবং ভালোমন্দ খেতেও পায়। সে নবীনকুমারের খেলার সঙ্গী, এই খেলার একটি অঙ্গ প্রহার সহ্য করা, দুলালচন্দ্র এই বয়েসেই শিখে নিয়েছে, যে মনিবের হাতে প্ৰহার খেলে প্রতিবাদ করতে নেই। রূপালী রঙ করা কাঠের তলোয়ার নিয়ে লড়াই করতে করতে দুলালচন্দ্ৰ নিজেই এক সময় ইচ্ছে করে ধরাশায়ী হয়, নবীনকুমার তার বুকের ওপর চেপে বসে গলায় তলোয়ারের পোঁচ দেয়। ব্যথা পেয়ে দুলালচন্দ্র যত হাসে ততই নবীনকুমার মাত্রা বাড়ায় অত্যাচারের এবং শেষ পর্যন্ত দুলালচন্দ্রের চোখ দিয়ে জল বার হতে দেখে তৃপ্ত হয় সে। অবশ্য নবীনকুমার ভালোও বাসে দুলালচন্দ্ৰকে, সে শুধু ওকে তার সুস্বাদু খাদ্যেরই ভাগ দেয় না, তাকে সে বিদ্যাশিক্ষায়ও সাখী করে নিয়েছে। দুলালচন্দ্র এর মধ্যেই বাংলা যুক্তাক্ষর সমন্বিত দাতাকৰ্ণ বইটি পড়তে পারে।
মানুষ বেশীদিন একেলা থাকতে পারে না। পুত্র সংসৰ্গ বঞ্চিতা হয়েই থাকোমণি আস্তে আস্তে অন্য দাসদাসীদের সঙ্গে মিশতে শুরু করে। দাসদাসী মহলের প্রধান বিলাসিতই হলো নানা রকম কুৎসা রটনা। কলকাতার সমস্ত বড় বড় ঘরের গুপ্ত কাহিনীই যেন তাদের নখদর্পণে। এমন কি কোন বড় মানুষ ওপরে ওপরে বড়মানুষী ঠাঁট বজায় রাখলেও ভেতরে ভেতরে সে ফোঁপরা হয়ে গেছে, সে সব গূঢ় কথাও তাদের অজানা নয়।
অধঃপতিত ধনী তাদের কাছে অতিশয় কৃপার বস্তু। যতদিন ঐশ্বর্যের রবরবা, ততদিন এইসব মানুষরা দেবতা স্থানীয়, স্বৰ্গ থেকে পতন হলেই দেখতে পাওয়া যায় তাদের খড়ের শরীর। দাসদাসীরা তাদের নিয়ে হাসাহাসি করে। দ্বারকানাথ ঠাকুরকে এরা বলে দ্বারিকা মহারাজ, দাস-দাসীদের চোখে তিনিছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রের তুল্য, সেইজন্যই তাঁর মহারাজ উপাধি এরাই দিয়েছে, কিন্তু তাঁর পুত্রকে এরা বলে দেবাঠাকুর। সেই দেবাঠাকুর নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছেন বলে তাঁর প্রতি এদের অসীম ঘৃণা। গ্রাম থেকে আসা এই সব সর্বহারা পরিবারের লোকেরা বড় মানুষদের দারিদ্র্য কিছুতেই যেন সহ্য করতে পারে না। বস্তুত মল্লিক বাড়ির ছোট বধূর এক মুসলমানের সঙ্গে পলায়নের কাহিনীর চেয়েও যেন এই দেবাঠাকুরের অধঃপতনের গল্প দাস-দাসীদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় বোধ হয়।
একদিন নকুড় সন্ধেবেলা ঢুকে পড়েছিল থাকোমণির ঘরে। চরসের নেশায় নকুড়ের চোখ দুটি টকটকে লাল, তার গায়ে অসুরের শক্তি। নকুড় সম্প্রতি বাজার সরকারের পদে উন্নীত হয়েছে, ফলে সে আর এখন ঠিক ভৃত্য শ্রেণীর মধ্যে নেই, অন্যরা তাকে নেকড়োদাদা বলে ডাকতে শুরু করেছে। ইদানীং মাছের দর বেশি চড়া, রুই-কাৎলার দর উঠেছে আট টাকা মণ, নকুড় তাও দশ টাকা মণ হিসেবে চালায়। এ বাড়িতে রোজ কিছু না হোক আট-দশ সের মাছ আসে, অর্থাৎ নকুড়ের রোজ এক অধুলি উপরি রোজগার, তার থেকে এক সিকি যদিও দিতে হয় সোহাগবালাকে, তবু নকুড়কে দেখলেই বোঝা যায়। তার বেশ টাকার গরমই হয়েছে।
ছেলে থাকে ওপরে বাবু মহলে, তাই থাকোমণি ঘরে ছিল একা, হঠাৎ নকুড়কে দেখে সে আঁতকে উঠেছিল। নকুড় অতি মিঠে গলায় বলেছিল, আর কতদিন শুকিয়ে থাকবি পেয়ারী? আজ তোর নরম হাতের ছিলিম টানবো।
ভৃত্যমহলে গাঁজা, গুলি, চরসের নেশা প্ৰায় সবাই করে, স্ত্রীলোকেরাও বাদ যায় না। কর্তারা নীচতলার কোনো খবরই রাখেন না। ভৃত্যরা শুধু এক ব্যাপারে সাবধান থাকে, যাতে কোনো রকম গোলমাল ওপরে না পৌঁছোয়। সেইজন্যই সুরাপান এখানে নিষিদ্ধ। সুরাপান করলেই হল্লা করার একটা প্রবৃত্তি জাগে বলে কারুর যদি কোনোদিন ঐ তৃষ্ণা খুব পায়, তাহলে সে সেদিন বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়ে আসে।
থাকোমণি বলেছিল, ওমা, ওকি, ওকি!
নকুড় তার পাশে বসে পড়ে আদরকাড়া কণ্ঠে বলেছিল, ছিলিম সাজতে জনিস না, পেয়ারী? আয় আমি তোকে শিক্যে দিচ্চি!
এর পর সে ছিলিম টানার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্ক বিরহিত কারণে থাকোমণির আঁচল টানার চেষ্টা করেছিল।
থাকোমণি সেবার অবশ্য পালিয়ে বেঁচেছিল। কোনোরকম চিন্তা না করেই সে সহজাত বুদ্ধিতে বুঝেছিল যে বাঁচবার একমাত্র উপায় সোহাগবালার কাছে আশ্রয় নেওয়া। নকুড়ের মতন শক্তিশালী ব্যক্তিও সোহাগবালার সামনে এসে জুলুম করার সাহস দেখাবে না।
সোহাগবালা জিজ্ঞেস করেছিল, ও মা, অমন হা-ঘরে মাগীদের মতন দম ফাটাচ্চিস কেন! কী হয়েছে লা?
থাকোমণি এটুকুও বুঝেছিল যে নকুড়ের নামে কোনো নালিশ করা ঠিক হবে না। নীচতলার জগতে কোনো পুরুষের নামে কোন স্ত্রীলোকের নালিশ জানাবার নিয়ম নেই। যাবতীয় শাস্তি স্ত্রীলোকদেরই প্ৰাপ্য।
থাকোমণি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে ছিল।
—ভূত দেকিচিস নাকি? মুখ অমন আমসি পারা হয়ে গ্যাচে কেন?
এই ব্যাপারটা মেনে নেওয়াই সুবিধাজনক বলে থাকোমণি ঘাড় হেলিয়ে বলেছিল, হাঁ গো মা। ছায়ার মতন কী যেন স্যাৎ করে সরে গেল!
—পাইখানার দিক ঠেঙে তো? বাসী কাপড়ে গিয়িচিলি। কদিন বলিচি সন্ধের পর ওদিকে বাসী কাপড়ে যাবিনি, দেবে একদিন ঘাড় মুচড়ে—
নকুড় অবশ্য সেদিন আর কোনো ঝঞ্ঝাট করেনি। থাকোমণির ঘরেই বসে সে ঘণ্টাখানেক ধরে চরস পুড়িয়ে পুড়িয়ে টানতে লাগলো। আর হাসতে লাগলো ফিক ফিক করে।
সব কিছুই চক্ৰবৎ পরিবর্তিত হয়। যার আরম্ভ এক রকম, তার শেষও সেই অনুযায়ী হবে। থাকোমণির মতন যারা গা ছাঁটা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়, তারা কেমন ভাবে ফিরে আসবে, তা নকুড় জানে।
এর পর থাকোমণি যেন সত্যিই একদিন বাড়ির মধ্যে ভূত দেখলো। কিছুদিন ধরে তার ওপর ভার দেওয়া হয়েছে সন্ধেবেলা বাতি জ্বালানোর। ওপরতলায় বাতি জ্বালাবার আলাদা লোক আছে, থাকোমণি শুধু রান্না ঘর, ভাঁড়ার ঘর, জলের ঘর, আনাজের ঘর আর ভিতর মহলের এক তলার বিভিন্ন কুলুঙ্গিতে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বালায়। গন্ধকমাখানো একটি পাটকাঠি এক হাতে, অন্য হাতে তেলের ডিবে নিয়ে ঘোরে থাকোমণি।
মোঝ মহলের অব্যবহৃত বৈঠকখানার সামনের বারান্দার কুলুঙ্গিতে রাখা। সেজ বাতি জ্বালতে গিয়ে থাকোমণি দারুণ ভাবে চমকে উঠলো। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দিবাকর। বৈঠকখানার দরজাটা ঠেলা দিয়ে খুলে দিবাকর বললো, আয়!
বড়বাবু তখনো বেঁচে, কিন্তু পর পর কয়েকদিন বাড়ি ফিরছেন না। বাবুর বড় ছেলে গঙ্গানারায়ণ গেছে মহাল পরিদর্শনে। বিধুশেখর সকালে একবার তদারক করে চলে যান, তারপর সারাদিন দিবাকরই যেন বাড়ির কর্তা। এই সব দিনে দিবাকরও যথেষ্ট নেশাভাঙা করে। অবশ্য সোহাগবালার এমনই দাপট যে দিবাকর কোনোদিন বাড়ির বাইরে রাত কাটাবার সাহস পায়নি।
দিবাকরকে দেখে থাকোমণি ভয়ে একেবারে বাক্যরহিত হয়ে গিয়েছিল। চিৎকার পর্যন্ত করতে পারেনি। দিবাকর যে এমন ব্যবহার করবে, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। পিছন দিকের দালানে এইমাত্র সোহাগবালাকে বসে থাকতে দেখেছে সে, আর এত কাছে দিবাকর তার কাছে এমন প্ৰস্তাব করছে। দিবাকরের বয়েস প্ৰায় ষাটের কাছাকাছি, তাকে থাকোমণি প্ৰায় পিতার মতন মনে করে। তাছাড়া দিবাকরই তো তাদের দণ্ডমুণ্ডের মালিক।
দিবাকর আবার বললো, ভিতরে আয়, হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইচিস কি? অ্যাঁ? চেহারাখানা তো বেশ খোলতাই হয়েচে।
দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে থাকোমণি সেদিনও দৌড়োলো। আবার আশ্রয় নিল সোহাগবালার কাছে। মুখে কিছু বললো না, শুধু থরথর করে কাঁপতে লাগলো ভয়ে।
সোহাগবালা ধমকে বললো, আ মার, এ আবাগীর বেটির দেকচি বেশী বেশী ভয়! মুচ্ছে যাবে একেবারে। বাড়ির মধ্যে ভূত আসবে? অ্যাঁ? এ বাড়িতে নারায়ণ প্ৰিতিষ্ঠে করা আছে, ভূতের বাপের সাধ্যি কি এর ত্ৰিসীমানায় পা বাড়ায়!
সেদিন সারারাত ঘুম আসেনি থাকোমণির। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছে। সে বুঝেছে, তার যৌবনের প্রতি চিল শকুনের দৃষ্টি পড়েছে। কয়েক বছর দু-বেলা পেটপুরে খেয়ে জেল্লা ফিরেছে তার শরীরের। আরশিতে নিজেকে দেখে সে নিজেই যেন চিনতে পারে না। পুরুষ মানুষের দৃষ্টি যখন তার গায়ে বেঁধে, তখন এক ধরনের সুখানুভূতিতেও শিরশির করে তার সবঙ্গে। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে পড়ে মাতু বলে সেই মেয়েটির কথা। সে হতভাগিনী পোয়াতী হয়ে পড়েছিল, তারপর সেই ভুলের মাসুল হিসেবে তাকে প্ৰাণ দিতে হয়। তারপরেও ভবা নামের একটি দাসী ঐ একই ভুল করে। সে অবশ্য প্ৰাণে মরেনি। কিন্তু গৰ্ভ নিষ্কাষণের পর তার শরীর শালিকের বাচ্চার মতন এমনই শুকিয়ে হাড়-বের-করা হয়ে যায় যে এখন আর কেউ তার দিকে তাকিয়েও দেখে না।
সেই রাত্রেই থাকে।মণির ইচ্ছে হয়েছিল ও বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে। বিশ্বসংসারে তার ছেলে দুলালচন্দ্র ছাড়া আর কেউ নেই। ছেলের হাত ধরে পথে বেরিয়ে পড়লে সে ভিখ, মেঙেও দিন চালাতে পারবে। এ শহরে কাঙালীরও অন্ন জুটে যায়। তবু তো থাকোমণির মান বাঁচবে!
থাকোমণি অনায়াসেই চলে যেতে পারতো। কেউ তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেনি। এক বাড়ির দাসদাসীরা অন্য বাড়িতে কাজ পেয়ে চলে যায়। কেউ তাদের বাধা দেয় না। কিন্তু আমরা পূর্বেই খাঁচার দরজা খোলা পাখির উল্লেখ করেছি।
সম্মান রক্ষার জন্য পুত্রের হাত ধরে থাকে।মণির পথে বেরিয়ে পড়ার শুভ সঙ্কল্প ক্রমশই পিছিয়ে যায়। বাবুদের উচ্ছিষ্টান্নও দুলালের কাছে রাজভোগের মতন, থাকোমণি নিজেও কোনোদিন বুড় মুল্ল কটা চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খায়ন—এসব ছেড়ে অনিশ্চিভের উদ্দেশ্যে যেতে তার আর পা ওঠে না।
তারপর একদিন তার ডাক পড়ে সোহাগবালার ঘরে। শীতের প্রাদুভাবের সঙ্গে সঙ্গে সোহাগবালার বাতের ব্যামো বৃদ্ধি পায়। কয়েকদিন ধরে সে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী। থাকোমণি ইদানীং সোহাগবালার খুব ন্যাওটা হয়ে গেছে, প্রায় সর্বক্ষণ তার কাছাকাছি থেকেছে। সেই সুবাদেই বোধ হয় সোহাগবালার সেবার জন্য থাকোমণিকে পছন্দ করা হয়। সন্ধ্যাকাল, দুলাল তখনও ওপর মহলে নবীনকুমারের সঙ্গে রয়েছে, নবীনকুমার ঘুমিয়ে না পড়লে সে নীচে নামবে না, এই সময় থাকোমণি নিজের ঘরে এসে কাপড় বদলে সোহাগবালার ঘরের দিকে যায়। সোহাগবালার ছুৎমাৰ্গ আছে, বাসী কাপড় পরে কেউ তার অঙ্গ সম্পর্শ করতে পারে না।
থাকোমণির যাবার সময় অন্য দাসীরা তার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে। এতদিনে থাকোমণির কপাল ফিরলো, আর কোনোদিন সোহাগবালা গালমন্দ করে তার বিষ ঝাড়বে না থাকোমণির ওপর। কয়েকজন দাসী কী সব মন্তব্য করে, থাকোমণি ঠিক বুঝতে পারে না।
নীচতলায় সোহাগবালার অধিকারে আছে তিনখানা কুঠরি। নীচ মহলে বেশ কয়েকটি ঘরই সারা বছর অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকে, ইচ্ছে করলে সোহাগবালা তবে সব কটাই ব্যবহার করতে পারে।
যত মোটা হচ্ছে ততই সোহাগবালার বিছানার গদি হচ্ছে পুরু। কর্তাদের বাতিল করা বিশাল একটা পালঙ্ক তার শয়নকক্ষে রয়েছে। সোহাগবালা ব্যথায় উঃ আঃ করছিল, এক গলা ঘোমটা দিয়ে এসে থাকোমণি তার পদসেবা করতে লাগলো। ভীমের গদার মতন মোটা মোটা পা সোহাগবালার, কিন্তু মাংস যেন নরম তুলতুলে, হাত দিলে আঙুল বসে যায়।
আধা ঘণ্টাটাক সেবা নেবার পর সোহাগবালা খানিকটা আরাম বোধ করার পর ডাকলো, এই মেয়ে, ইদিকে আয়, আমার সামনে ডাঁড়া।
থাকোমণি এসে তার শিয়রের কাছে দাঁড়ালো।
সোহাগবালা বললো, মুখের কাপড় তোল।
থাকোমণির মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো সোহাগবালা। তার আজকের দৃষ্টি কণ্ঠস্বর, সবই যেন অন্য প্রকার। থাকোমণির মুখে সে কী দেখছে তা সেই জানে।
একটু পরে সে বললো, পাশের ঘরে যা। তোদের গোমস্তাবাবুর জ্বর হয়েচে। যদি মাতা টিপে দিতে বলে দিবি। যদি পা টিপে দিতে বলে পা টিপে দিবি। যা–
থাকোমণি স্থাণু হয়ে গেল। সোহাগবালা নিজে তাকে দিবাকরের কাছে যেতে বলছে! এই দিবাকর, একদিন তাকে ফাঁকা অন্ধকার বৈঠকখানা ঘরের দরজা খুলে বলেছিল, আয়। সোহাগবালা নিশ্চয়ই সে কথা জানে না। এখন কি সে কথা থাকোমণির বলে দেওয়া কর্তব্য? কিন্তু কোনো পত্নীর কাছে কি কেউ পতির নিন্দা করে? কিংবা তেমন করেও কি কিছু লাভ হবে!
থাকোমণির মনে হলো, সেই মুহূর্তে সে মরে গেলেই যেন ভালো হয়।
সোহাগবালা আবার কুকুমের সুরে বললো, যা। ভয় নেই!
থাকোমণি এবার আর পালিয়ে গেল না। অচৈতন্যের মতন সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল পার্শ্ববর্তী কক্ষের দিকে।
শয্যা শূন্য, সেখানে দিবাকর নেই। সে দাঁড়িয়েছিল দ্বারের পাশে, উৎসুক প্রতীক্ষ্ণয়। থাকোমণি ঘরে ঢোকা মাত্ৰই দিবাকর তাকে দু হাতে চেপে ধরলো। জুরো রুগীর মতন। তপ্ত তার হাত, কিন্তু এ জ্বর অন্য রকম।
দিবাকর তাকে টেনে নিয়ে গল শয্যার দিকে। থাকোমণি কোনোক্রমে একবার বললো, ওগো, আমায় দয়া করুন গো বাবু!
তার উত্তরে দিবাকর বললো, চুপ, টু শব্দটি করবিনি। গলা টিপে দেবো একেবারে। অর্ধ প্রহর পরে সে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো থাকোমণি, তখনও সে কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। সোহাগবালা ঠিক সেই দ্বারের দিকেই চক্ষু নিবদ্ধ করে পাশ ফিরে ছিল। থাকোমণি বেরুতেই সে অঙ্গুলির ইঙ্গিত করে বললোম, ডাঁড়া!
তারপর কোনোক্রমে উঠে বসবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে বললো, উষ্ণু, নিজে পাচ্ছিনি; শোন, ডান দিকের ঐ কুলুঙ্গিতে দ্যাখ একটা বেতের ঝাঁপি রয়েচে, সেটা নিয়ায় আমার কাচে। পেচোয় পাওয়ার মতন হাঁ করে ডাঁড়িয়ে রাইলি কেন, যা বলচি শোন! বেতের ঝাঁপিটা আমায় দে।
থাকোমণি কান্না থামিয়ে সোহাগবালার হুকুম তামিল করতে হলো। বেতের ঝাঁপি থেকে কয়েকটি শিকড় বাকড় বার করে সেগুলো থাকোমণির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, এগুলো এখুনি বেটে খেয়ে নিগে যা। ভয় নেই। আমার কতা শুনে চলবি, ঠিক থাকিবি। তেত্ৰিশ বছর হলো বে হয়েছে, একদিনও তোদের গোমস্তাবাবুকে বাড়ির বাইরে রাত কাটাতে দিইনি। পুরুষ মানুষকে ধরে রাকা কি যে–সে কতা! তার ওপর ভগমন আমার কপালে ছেলে।পুলে দিলেন না!
বালিশের তলা থেকে একটি নতুন শান্তিপুরী তাঁতের শাড়ি বার করে সেখানিও থাকোমণির হাতে তুলে দিয়ে বললো, এ কাপড়টা যানো আগেই পরে ফেলিসনিকো। এর পর যেদিন ডাকবো, চান-টান করে এই নতুন বস্তর পরে আসবি—! এখন যা—!
এর পরেও থাকোমণি স্বেচ্ছায় মরলো না কিংবা ছেলের হাত ধরে পথে বেরিয়ে পড়লো না। দু-তিনদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদলো। শুধু। দুলাল তার মাকে অনেকদিন কাঁদতে দেখেনি। রাত্রে শুয়ে শুয়ে একদিন মায়ের ফোঁপানি শুনে জিজ্ঞেস করেছিল, তোর কী হয়েছে মা?
থাকোমণি উত্তর দিতে পারে না।
তারপর, পরের সপ্তাহে যখন সোহাগবালা থাকে।মণির বদলে অন্য একজন দাসীকে ডেকে পাঠালো, সেদিন, বিস্ময়ের কিছু নেই, থাকোমণির খানিকটা ঈর্ষা হলো পর্যন্ত। সেদিনও তার চোখ ঠেলে জল বেরিয়ে আসতে চাইছিল। অবশ্য পরবর্তী সপ্তাহে তার আবার ডাক পড়লো। তারপর প্রায় প্রতি মাসেই নিয়মিত দু-একবার।
এবং একদিন নকুড়ও এলো তার ঘরে। ঘোলাটে চক্ষু ও অসম্বত কণ্ঠে নকুড় বললো, সেই তো মল খসালি, আগে শুধু এঁটো হলি! তারপর থাকে।মণিকে সবলে আঁকড়ে ধপাস করে পড়ে গেল মেঝের ওপরে। সেদিন নকুড়কে বাধা দেবার মতন শুধু শারীরিক জোর নয়, মনের জোরও অবশিষ্ট ছিল না। থাকোমণির। এমন কি, এরকম ঘটনা কয়েকবার ঘটবার পর নকুড়কেই বেশী পছন্দ করে ফেললো থাকোমণি। দিবাকর বৃদ্ধ, নকুড় যুবক। দিবাকরের অনেকগুলি দাঁত নেই, আর নকুড় বন্য পশুর মতন হিংস্র।
কিছু দিনের মধ্যেই এই দুই পুরুষ মানুষের সঙ্গে পালা করে মিলন-ভোগ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেল থাকোমণি। এবং এর ফলেই হয়তো তার চলনে, বিলনে, কথাবার্তায় ব্যক্তিত্বের ছাপ এলো, এতদিন পর সে নারী হিসেবে নিজের মূল্য বুঝতে পেরেছে।
কয়েক দিন ধরে দুলালচন্দ্রের জ্বর। তার জন্য নবীনকুমার এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে স্বয়ং এসে দুলালকে দেখে গেছে। কোনো দাসীর ঘরে বাবুদের ছেলের আসা প্ৰায় এক অসম্ভব ঘটনা। কিন্তু নবীনকুমার বায়না ধরলে তা রোধ করার ক্ষমতা কারুর নেই। কয়েক দিন দুলালচন্দ্ৰ একেবারে নেতিয়ে পড়েছিল, ভয়ে উৎকণ্ঠায় থাকোমণিও প্রায় মুমূর্ষর মতন হয়ে গিয়েছিল। ঐ ছেলে ছাড়া পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই, ছেলের কিছু হলে সে আর বাঁচবে কী নিয়ে! কাল থেকে অবশ্য দুলালচন্দ্র আবার ভালোর দিকে, বোঝাই যায়, তার বিপদ কেটে গেছে। এই সময়ে সোহাগবালা অনেক সাহায্য করেছে তাকে, লোক পাঠিয়ে কোবরেজ মশাইদের কাছ থেকে দাওয়াই আনিয়ে দিয়েছে। সোহাগবালার কাছে থাকোমণির কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে পাশে শুয়ে ছিল থাকোমণি, এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। এ আওয়াজ থাকোমণির চেনা। এ নকুড়, নয়, ডাক এসেছে দিবাকরের কাছ থেকে। না গিয়ে উপায় নেই। থাকোমণি স্নান করতে গেল।
ফিরে এসে যখন সে শাড়ি বদল করছে, এমন সময় জেগে উঠলো দুলালচন্দ্ৰ। জিজ্ঞেস করলো, মা, কোথায় যাচ্চিস এখন?
একটু অপ্ৰস্তুত হয়ে থাকোমণি বললো, কোথাও না! দেখি, একবার বুঝি গিন্নীমা কেন ডেকেচেন।
এর পর স্বাভাবিক ভাবেই ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগলো দুলালচন্দ্র। সে এখন মাকে ছেড়ে থাকতে চায় না। থাকোমণি যতই বোঝায় যে একটু শুয়ে থাক আমি আসচি, সে বুঝবে না। অসুস্থ হলে মায়ের ওপর অযৌক্তিকভাবে বেশী জোর খাটাবার একটা অধিকার সব সন্তানদেরই বর্তে যায়। সেই অনুযায়ী দুলালচন্দ্ৰ আনুনাসিক কান্না জুড়ে দেয় এবং মায়ের আঁচল টেনে ধরে।
বেশী দেরি করলে সোহাগবালা আর দিবাকর রাগ করবে। অনেক চেষ্টা করেও যখন দুলালকে বোঝানো গেল না, তখন বিরক্ত হয়ে থাকোমণি খুব জোরে তাকে একটা থাবড়া কষিয়ে দিল। গরগরিয়ে বললো, তুই মর, মর, মরতে পারিস না! তুই মরলে আমার হাড় জুড়োয়!