মুকুন্দ সাহার দোকানে কয়েক দিনের বাসি আনন্দবাজার পত্রিকায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে লোকজন। কলকাতায় মুসলমানরা হিন্দুদের মেরে সাফ করে ফেললো। সুরাবর্দি নিজে পিস্তল নিয়ে বেরিয়েছে হিন্দু মারতে। সতীশ মুক্তারের গলাটা ঘ্যারঘারে হলেও আনন্দবাজার পত্রিকা জোরে জোরে পড়ে মন্তব্য করার দায়িত্বটা পালন করতে হয় তাকেই। তবে তার সাটাসাটি শুনে বৈকুণ্ঠের তেমন উত্তেজনা হয় না, এইসব মানুষের রাগ করার ক্ষমতাও তার জানা আছে। এই সময় দরকার ভবানী পাঠকের মতো তেজি সন্ন্যাসীর, পাঠান সেনাপতিকে নিয়ে সুরাবর্দি একশোটাকেও সে ঠিক সাফ করে ফেলতে। পারে। আজ সন্ধ্যার পর পোড়াদহে তার থানে বৈকুণ্ঠ গিয়ে একবার বসবে।
বেশ এক পশলা বৃষ্টিতে ভাদ্রের গুমোটটা ধুয়ে গিয়ে বিকালবেলা ঝকঝক করে উঠলে গাল ভরা জর্দা দেওয়া পান নিয়ে বৈকুণ্ঠ কাদেরের ঘরে গেলো কেরামতের গান শুনতে।
কিন্তু কাদেরের দোকানে আজ সুরের লেশমাত্র নাই। কাদেরের চেয়ারে বসে রয়েছে। আবদুল আজিজ। চোখজোড়া তার লাল, দাড়ি-না-কামানো গালে দাড়ির ছোটো ছোটো কাঁটার গোড়ায় গোড়ায় কাঁপুনিতে তাকে অচেনা ঠেকে। বৈকুণ্ঠকে দেখে কেউ কেউ তার দিকে তাকায় চোখ পাকিয়ে এবং কয়েকটা ছেলে হঠাৎ করে চেঁচিয়ে ওঠে, লড়কে লেঙে পাকিস্তান।
আবদুল কাদের বলে, বৈকুণ্ঠ, তুই যা, এখন যা। পরে আসিস।
বৈকুণ্ঠ একটু সরলেও দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে এবং শোনে, কলকাতায় হিন্দুদের হাতে খুন হয়েছে আবদুল আজিজের সম্বন্ধী আহসান আলি। আহসানের সঙ্গে ছিলো আজিজ নিজে। সে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। কলকাতার ময়দানে সেদিন মুসলিম লীগের মস্ত মিটিং; মিটিং থেকে ফেরার সময় হিন্দুরা তাদের হামলা করলে সম্বন্ধীর হাত ধরে আজিজ দৌড় দেয়। মিটিঙেই ওরা শুনেছিলো, শহরে অনেক জায়গায় দাঙা লেগে গেছে। সভা শেষ হওয়ার আগেই তারা বেরিয়ে পড়েছিলো। ধর্মতলা পর্যন্ত আসতেই দেখা গেলো, দোকানপাট সব লুট হচ্ছে। একটা হিন্দু দোকানের সামনে দাঁড়াতে চাইছিলো আজিজ, কিন্তু আহসানই তাকে টেনে নিয়ে যায় সামনে। তালতলার কাছাকাছি এলে এক মুসলমান দোকানে তারা উঠতে যাচ্ছে, এমন সময় কয়েকটা হিন্দু আহসানের পেটে বসিয়ে দিলো ছুরির ফলা। আহসান সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে গেলো। আজিজকে নিজের দোকানে টেনে নেয় এক হিন্দু দোকানদার। সেখান থেকেই সে দেখলো, আহসানের বুকে ছুরির আরো কয়েকটা ঘা বসিয়ে দিয়ে গুণ্ডারা পাকড়াও করলো ১৪/১৫ বছরের এক পানবিড়ির দোকানদারকে। আজিজ সেখানে কী করতে পারে? তাকে নিজের দোকানে আলমারির পেছনে পুরো দুটো দিন দাঁড় করিয়ে রেখে ঐ হিন্দু দোকানদার রাস্তায় ছেড়ে দেয়। আজিজ এইসব বলে আর হাঁপায়। কলকাতায়। দাঙা হবে কে জানতো? আজিজ গিয়েছিলো আহসানের দোকানের জন্যে মাল কিনতে। ১৬ তারিখে কলকাতায় সব বন্ধ, কেনাকাটা তো কিছুই হলো না। ভেবেছিলো পরদিন বাজার থেকে মাল কিনে রাত্রে দার্জিলিং মেলে ফিরবে। আহসান শান্তাহারে নেমে ধরবে মিটার গেজের ট্রেন আর আজিজ চলে যাবে জয়পুর। তা আল্লা তার কপালে যে এই রেখেছে তা জানতো কে? শেষে কলুটোলায় এক দর্জির দোকানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আজিজ আজ টাউনে পৌঁছেছে দুপুরবেলা। শ্বশুরবাড়িতে কোনোমতে খবরটা দিয়ে। টমটম নিয়ে বাড়ি এসেছে। তার বৌ এখন বাড়িতে, বৌকে খবরটা দিতে সাহস হচ্ছে না বলেই আজিজ হাটে এসে বসে রয়েছে। সে তেমন কথাও বলতে পাচ্ছে না, তার সম্বন্ধীর খুন হওয়ার বিবরণ গফুর কলু এমনভাবে ছাড়ে যে, মনে হয় সে নিজে ঐ হাঙ্গামায় রীতিমতো অংশ নিয়েছে। তার বর্ণনা শুনতে শুনতে আবদুল আজিজ হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে, এই কান্না কতোটা সম্বন্ধীর শোকে আর কতোটা সম্বন্ধীর বোনের ভয়ে তা জরিপ করা মুশকিল হলেও তা সাড়া তোলে কাদেরের তরুণ কর্মীদের শরীরে। একজন বলে, কাঁদেন কেন? শোধ নেওয়া হবে। আবদুল কাদের বৈকুণ্ঠকে ধমক দেয়, বৈকুণ্ঠ, তুই গেলু না? ঘরত যা।
বৈকুণ্ঠ নড়বে কি, তার সামনে ত বন ঝুলছে সন্ন্যাসীর হাতের খাঁড়া। আবদুল আজিজের সম্বন্ধীকে সে কয়েকবার দেখেছে, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ আর টিকালো। নাক দেখে কে বলবে, এ বামুনের ঘরের ছেলে নয়? আর ব্যবহার কতো ভালো, তাকে বলতো বৈকুণ্ঠবাবু; সাহার দোকানের কর্মচারী বলে কখনো হেলা করে নি। খুব পান খেতো, জর্দাও খেতো একই মার্কার। একবার খুশি হয়ে নিজের জর্দার কৌটা জোর করেই দিয়ে দিলো বৈকুণ্ঠের হাতে, বললো, আরে টাউনে এই জর্দা তো যখন তখন পাই। আপনে রাখেন।—তো সেই মানুষকে খুন করলো কারা গো? ঐ খুনীদের ঘাড়ের ওপর ভবানী সন্ন্যাসীর খাড়া যদি নেমে না আসে তো সেটা সন্ন্যাসীর হাতে রেখে কী লাভ? সে কি কেবল মাগীমানুষের গয়না হয়ে হাতে ঝুলবে? মুকুন্দ সাহার দোকানে কয়েকদিন থেকেই সে শুনে আসছে, কলকাতায় খুব দাঙা চলছে। মোসলমানরা হিন্দু। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের ঘরে, আর হিন্দু পুরুষমানুষগুলোকে কচুকাটা করছে। তা মোসলমান জাত শালারা বড়ো মাথাগরম, শালাদের খাওয়াদাওয়ায় বাছবিচার নাই, এর এটো সে খায়, পুরুষগুলো আছে খালি বিয়ের তালে। কিন্তু আবদুল আজিজের সম্বন্ধী, আহা কী সুন্দর ছেলেটা, এভাবে খুন হবে কেন? বৈকুণ্ঠের মাথাটা এলোমেলো হয়ে যায়। তার খুনীদের ওপর সন্ন্যাসীর খাড়াটিকে ঝুলতে দেখার জন্যে সে ওখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সন্ন্যাসী এই এলো বলে। পাছে সে চোখের আড়াল হয় এই ভয়ে বৈকুণ্ঠ এক পা নড়ে না।
তার পিঠে হাত রেখে আবদুল কাদের তাকে একরকম ঠেলে বাইরে নিয়ে যায়। মুকুন্দ সাহার দোকানে তাকে ঢুকিয়ে বারান্দা থেকে চিৎকার করে, মুকুন্দবাবু, আজ রাতটা আপনারা ঘরের ভেতর থাকবেন। চিন্তার কারণ নাই। তবু বাইরে না বারানোই ভালো। কলকাতায় মোসলমান মারার খবর পায়া চ্যাংড়াপ্যাংড়া একটু চেত্যা আছে। তা আমাদের ওয়ার্কাররা হাটের মধ্যেই থাকবি, ভয় নাই।
মুসলিম লীগের কর্মীরা হাটে থাকবে শুনে মুকুন্দ সাহার ভয় বাড়ে। কলকাতার খবর সে কম রাখে না। কাদের তো পড়ে দৈনিক আজাদ, সতীশ মুক্তার সবসময় বলে অজাত। মুক্তার লেখাপড়া জানা বামুন, ঠিকই বলে, শালা মোসলমানরা ভাষা পর্যন্ত লিখতে জানে না ঠিকমতো, আবার কাগজ হাঁকায়। মুখের হাতে ভুলভাল ভাষায় মিছে। কথা ছাড়া আর কী বেরুবে?–আবদুল কাদের চলে গেলে মুকুন্দ সাহা ফিসফিস করে, বৈকুণ্ঠ, দরজার খিল লাগাবু, ছিটকিনি দিবু, বাঁশের ঊশাটাও লাগায়া দিস। তারপর ধানের বস্তা দরজার সামনে এনে বলে, এই দুইটা দরজার সাথে ঠেস দিয়া রাখিস। যে শালাই আসুক, দরজা খুলবু না। শাবল থাকলো, ভয় করিস না। আজ হামার বাড়িত যাওয়াই লাগবি। বাড়ি খালি। হরিপদ থাকলে কয়েকদিন আগে মৃত ভাইপোর কথা মনে পড়ায় তার গলা ভারী হয়ে আসে। তবে ঘর থেকে নামতেই তার পা হয়ে আসে খুব হালকা, তাড়াতাড়ি চলে যায় বাড়ির দিকে।
লণ্ঠনের আলোয় বৈকুণ্ঠ বিছানা পাতে ঘরের কোণে তক্তপোষের ওপর। ঘুমের ঘোরে খাড়া হাতে সন্ন্যাসীকে তৎপর দেখার লোভেই হোক আর হঠাৎ-নামা টিপটিপ বৃষ্টির সঙ্গে চেরাগ আলির গান শোনার সখেই হোক, কিংবা চোখ জুড়ে ঘুম নেমেছিলো বলেই হয়তো বিছানায় শোবার সঙ্গেসঙ্গে বৈকুণ্ঠ ঘুমিয়ে পড়ে। তার ঘুমোবার সুযোেগ নিয়ে দরজায় ঠেস দিয়ে রাখা বস্তা দুটোয় ঢুকে পড়ে ইঁদুর! তাদের ব্যস্ত চলাচলের শব্দে জেগে উঠে বৈকুণ্ঠ সারা ঘরে ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখে। না, কোথায় ইঁদুর! বৃষ্টি বোধহয় থেমে গেছে, টিনের চালে এখন আর টুপটাপ আওয়াজ নাই। বিছানায় ঘুমোলে বৈকুণ্ঠ ফের শোনে, এই শুরু হলো ইদুরের উৎপাত। এদিকে কারা যেন আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, এতেও শালা ইদুরের আসাযাওয়া এতোটুকু কমে না। ধানের বস্তা সব সাফ করে ফেললো। তারপর আলো বাড়তে থাকলে ইঁদুর আর থাকে না। কিন্তু এতো হ্যাজাক জ্বলে কেন? এসব কিসের আলো? এতো মানুষ মশাল নিয়ে এসেছে কেন? এতো আলো, এতো লোকজন দেখেও, তার মাথায় টোপর দেখেও চেরাগ আলি গম্ভীর হয়ে থাকে। কী হলো? ও ফকির, কথা কও না কিসক? তার ব্যাকুলতায় ফকির একটু হাসে, বলে, তোর বিয়া, তুই বুঝিস না? তা তার বিয়েতে ফকিরের এমন মন খারাপ করার কী হলো? বিয়া হলে কি আর হামাগোরে সাথে তুই থাকবু, না তোক থাকবার দিবি? বলতে না বলতে তার হাতের দোতরার টুংটাং আওয়াজে বেজে ওঠে :
নওশা সাজে আপনারে দেখি মুসা হাসে।
শুনিয়া মজনুর মুখে বেদনা পরকাশে।।
শাদিতে মিলন শাদি পরম মিলন।
পরম মিলনে ছিন্ন হয় নিজ জন।।
ফকিরের খটখটে কথায় বৈকুণ্ঠের ঘুম ভেঙে যায়, তার গা ছমছম করে। বিয়ের স্বপন দেখা ভালো কথা নয়। ফকির তো সেই কথাই জানিয়ে গেলো। এখন প্রথম জানালো, না-কি আগেও এই শোলোক সে কখনো বলেছে? একবার তমিজের বাপের কাছে গেলে হতো, অনেক করে ধরলে সে নিজে কিংবা কুলসুম এই স্বপ্নের একটা বৃত্তান্ত ঠিক বলে দেবে।
ক্যা রে, বৈকুণ্ঠ, আয় ঘরত আয়। বৈকুণ্ঠের গলা শুনে তাকে আদর করে ঘরে ডেকে তমিজের বাপ বিছানা ছেড়ে ওঠে। ঢুকতে ঢুকতে বৈকুণ্ঠ বলে, স্বপনের মধ্যে ফকির আসিছিলো, শোলোক কয়া গেলো। মনে হলো, তোমার কাছে বিত্তান্তটা শূন্যা লেই।
তমিজের বাপ ধীরেসুস্থে উঠে ডোবার দিকে যায়, তার কোনো তাড়া নাই। তাড়া দেয় বরং কুলসুম, তুমি এটি আসো কোন আক্কেলে? কামারপাড়ার সোম্বাদ শোনো নাই?
না তো।–রাত্রিবেলা কামারপাড়ায় কারা যেন আগুন লাগিয়ে এসেছে। তারা সব চিৎকার করতে করতে যায় এবং আগুন লাগিয়ে ঐভাবে নারায়ে তকবির, আল্লাহ আকবর বলতে বলতে ফেরে। তবে কামাররা একজোট হয়ে আবার বন্দে মাতরম চিৎকার করতে করতে তাদের তাড়া করে। কামারের ঘরে তো আর অস্ত্রের অভাব নাই, তাই হামলাটা তাদের ওপর বেশিক্ষণ চালানো যায় নি। এই পর্যন্ত বলতে কুলসুম বেশি সময় নেয় না। বৈকুণ্ঠ কেবল জিগ্যেস করে, আগুন ধরাছিলো কী দিয়া?
কুলসুম তা জানবে কোত্থেকে? গলা একেবারে খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে সে কেবল জানায়, মানুষ গেছিলো এই পাড়া থ্যাকা। কালাম মাঝির ঘরত কাল মেলা মানুষ জড়ো হছিলো। তামান রাত কথাবার্তা শোনা গেছে। তমিজের বাপোক ডাকে নাই। তাই ঘুম পাড়িচ্ছিলো, একবার বুধা বুঝি ডাক দিলো, হামি শুনলাম কালাম মাঝি কচ্ছে, দূর ঐ বোগদাটাক লিয়া কী হবি? তোমরা যাও।
ডোবা থেকে ফিরে উপুড় হয়ে লুঙির কোঁচড়ে মুখ মুছতে মুছতে তমিজের বাপ বলে, উগলান থো। তুই ক বৈকুণ্ঠ, কী দেখলু ক।
কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে দেখা স্বপ্ন বলতে বৈকুণ্ঠের এলোমেলো হয়ে যায়। একবার বলে, টিনের চাল থেকে ইঁদুর পড়ছিলো টপটপ করে, ধানের বস্তায় ঢুকে তারা ধান সব খেয়ে ফেলেছে। তারপর অনেক মশাল জ্বলতে দেখে সে চেরাগ আলিকে জিগ্যেস করে, এতো আলো কিসের? চেরাগ আলি বললো, এসব হলো বৈকুণ্ঠের বিয়ের আতসবাজি। তারপর কী একটা শোলোক বললো, এখন সেটা আর মনে পড়ছে না। নিজের বিয়ের স্বপ্নের কথা কুলসুমের সামনে বলতে তার কেন যেন বাধো বাধো ঠেকে। মানুষের স্বপ্নের বৃত্তান্ত শোনার খাই এই ছুঁড়িটার কখনো গেলো না। দাদার আমলে ছিলো যেমন, এখনো তেমনি আছে। দাদার ধাতই পেয়েছে, স্বপ্নের কথা শুনতে হলে পয়সা চাই তার। এখন কেমন বেহায়ার মতো বলে ফেললো, শোনো, ইগলান কাম পয়সা ছাড়া হয় না। দাদা কম করা হলেও একটা কানা পয়সা না লিয়া খাবের তাবির কয় নাই। তমিজের বাপ তাকে হাত তুলে চুপ করতে বললে ভেতরের উঠানে যেতে যেতে সে গজর গজর করে, মানুষটাক গাঁও পার করা দিয়া আসো গো, অক তো মারবিই, তোমার ঘরতও আগুন দিবি।
কুলসুমের এসব কথায় বৈকুণ্ঠের স্বপ্নের বিবরণ ফের উল্টাপাল্টা হতে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ইন্দুরে ধানের বস্তাত ঢুকা খালি খুটখাট করিচ্ছিলো। তারপরে–।
কুলসুমের বিড়বিড় বকা হঠাৎ ছন্দ পায়,
ইন্দুরে খাইলো ধান বড়ো কুফা বাত।
জানিয়া রাখিও বান্দার কমিলো হায়াৎ।।
কুলসুমের একটিমাত্র শোলোকে বৈকুণ্ঠের সারা রাতের স্বপ্নই মনে পড়ে। প্রথম থেকে সে সব বলে আর চেরাগ আলির বই সামনে রেখে তমিজের বাপ একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে চৌকা চৌকা দাগ কাটে। এর মধ্যে কালাম মাঝির বাড়ি থেকে শোর শোনা যায়, আজ শালা হাতিয়ার লিয়া যামু। মালাউন এটি একটাও রাখা হবি না। অন্য একটি ভারী গলায় কে বলে, আজ শালা লায়েবেক ধরা হবি। শালা হামাগোরে মানুষ জ্ঞান করে না। শুনতে শুনতে তমিজের বাপের কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কি-না বোঝা মুশকিল। মাটিতে আঁকিবুকি কাটা তার অব্যাহত থাকে।
ক্যা গো তমিজের বাপ, ও চাচা ও তমিজের বাপ চাচা। শমশেরের গলা শুনে। একটু চমকে উঠলেও তমিজের বাপ তাকে ভেতরে ডাকে।
শমশের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, মণ্ডলের, বড়ো বেটা তোমাক খবর দিছে, এখনি যাওয়া লাগবি।
কিসক? কুলসুম প্রায় তেড়ে আসে, ঐ বাড়িত যাওয়া লাগবি কিসক? যার বেটাক জেলের ভাত খিলাবার পাঠাছে, তাক আবার ডাকে কিসক?
মণ্ডলের বেটার সম্বন্ধি না শালা না শ্বশুরেক কলকাতাত হিন্দুরা জববা করিছে। খবর পাও নাই? তো আজিজ মিয়ার বৌ বিশ্বাস পায় না। স্বামীক কয়, তুমি হামার ভায়েক ছ্যাড়া পলায়া আসিছো। হামার ভাই মরে নাই। এটা ঠিক ঠিক কবার পারবি তমিজের বাপ। টাউনের মেয়ামানুষ, কাল থ্যাকা খবর শুন্যা খালি বেহুঁশ হয়া যাচ্ছে। তুমি না হয় একবার চলো। তমিজের বাপকে রাজি করাতে সে টোপ দেয়, এই সুযোগে তমিজের কথাটাও না হয় তুলবা। বৈকুণ্ঠের দিকে নজর পড়লে শমশের একটু কাঁচুমাচু হয়, ক্যা গো, তুমি? কলকাতাত বলে হিন্দুরা মোসলমান ধরা ধরা মারিচ্ছে। তুমি বাপু এটি থাকো না, হাটোত যাও, না হয় সাহার বাড়িত যায়া কয়টা দিন থ্যাকা আসো।
তমিজের বাপ বৈকুণ্ঠকে ছাড়ে না, তুই আমার সাথে চল। তোর খাবের তাবির করা সোজা লয়। এখন চল। ঘুরা আসি।
মণ্ডলবাড়ি ঢোকার আগেই হামিদার হাউমাউ কান্না তমিজের বাপের বুকে জোরে ধাক্কা মারে। এই মেয়েটার বুক থেকে তার বেটাটা ছিড়ে গেলো এই তো কয়েক মাস আগে। এখন আবার হিন্দুরা কেড়ে নিলো তার ভাইকে। কালাহারের মুনসি এসব দেখে না? কলকাতা অনেক দূরের জায়গা, অতোটা দূরে তার নজর বোধহয় আর যায় না।
তমিজের বাপকে দেখে শরাফত মণ্ডলের মেজাজ চড়ে যায়, বুড়াটা আবার এই বাড়িত ঢোকে কোন সাহসে? বিল ডাকাতি করিছে, এখন বাড়িত হামলা করবার চাস? শালা নিমকহারাম বুড়া।
আবদুল আজিজ বিব্রত হয়, ভয় পায় আরো বেশি। তবে বাপের চেয়েও বেশি ভয় তার তমিজের বাপের অভিশাপকে। সে কিছু বলার আগেই আবদুল কাদের বলে, তমিজের বাপকে খবর দিয়া আনা হছে। ভাবি খালি বেহুঁশ হয়া যাচ্ছে। আহসান ভাইয়ের আসল অবস্থাটা যদি তমিজের বাপ কবার পাবে, ভাইজান তাই তাক খবর দিছে।
বেটার বৌয়ের এসব আদিখ্যেতা শরাফতের অসহ্য ঠেকে। হায়াৎ মওতের মালিক আল্লা। আল্লা মওত দিয়েছে, ছেলেটা মারা গেছে। মুর্দাকে জিন্দা ভাবা, কিংবা মুদাকে জিন্দা করার চেষ্টা করা গুনা। রসুলুল্লী স্বয়ং কারো হায়াৎ মওত নিয়ে আল্লার কাছে তদবির করেন নি। আর কোথাকার কোন শালা তমিজের বাপ, এই বাড়ির নিমক খেয়ে বড়ো হয়ে আবার তারই বিল ডাকাতি করতে যায়, সেই ডাকাতটা আসে মরা মানুষের। তত্ত্বতালাশ করতে। আবার এসব শেরেকি কাম হয় কি-না তারই বাড়িতে। বড়োবেটার বৌ এসে তার জামাতের ইজ্জত নষ্ট করে দিলো। টাউনের মেয়ে, গায়ের রঙ ফর্সা, আবার বৌ হয়ে আসার পর বাড়ির আয় উন্নতিও বেড়েছে, ছেলেমেয়েদের মানুষও করছে ভালো করে। বৌটাকে কিছু কওয়াও যায় না, আবার সওয়াও মুশকিল।
সুতরাং শাসাতে হয় তমিজের বাপকেই, শরাফত মণ্ডল তার আরেক দোষ ধরে, কাল তোমরা মাঝিপাড়ার মানুষরা আগুন ধরায়া আসিছে কামারপাড়াত। আর বেনবেলা সাথে লিয়া ঘোরো বৈকুণ্ঠক, তোমার মতলবটা কী কও তো? এই চ্যাংড়াটাক
মারবার ফন্দি করিছো? এ বাপের কথায় কাদের একটু অসন্তুষ্ট, কামারপাড়াত আগুন ধরলো কীভাবে কেউ কবার পারে? কামারের ঘরে তো দিনরাত হাঁপরের আগুন জ্বলেই। হাঁপর থ্যাকাও তো দশরথের চালে আগুন ধরবার পারে। না-কি?
কাদেরের তেজে একটুখানি জ্বলে ওঠে গফুর কল, কলকাতা মোসলমান মরিচ্ছে কুত্তাবিলায়ের লাকান। আর এটি দশরথ কর্মকারের মরিছে দুইটা গোরু। তা গোরু তো হিন্দুর দেবতা, গোয়ালেত যায়া দেবতাক ছাড়া দিবার পারলো না কিসক, লিজের জানের ভয়ই বেশি হয়া গেলো?
গোরু ছাড়া থাকলে তুই ধর্যা লিয়া আসবার পারিলিহিনি, না? আরে, তুই হলু কলুর বেটা, গোরু তো তোর জান রে! গোরু ছাড়া গাছ থ্যাকা ত্যাল করবার পারবু? মাঝিগোরে সাথে তুইও গেছিলু? মাঝিপাড়ার ঘাটা না তোর জন্যে বন্ধ করা হছে?
বাপজান। সংযম রাখা কাদেরের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে, আজ হিন্দুর হাতে মার খাচ্ছে সব জাতের মোসলমান। মোসলমানের আবার জাত কী? কিন্তু হিন্দুরা কলকাতায় কি কোনো মোসলমানকে বাদ দিচ্ছে, কন? আহসান আলির হত্যাকাণ্ডটি সে বর্ণনা করে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায়। মরার আগে সে এক ফোঁটা পানি খেতে চাইলে হিন্দু গুণ্ডা তার মুখে পেচ্ছাব করে দিয়েছিলো। হিন্দু মেয়েরা পর্যন্ত বাড়ির ছাদ থেকে লাঠিসোটা এগিয়ে দিচ্ছিলো। তার উত্তেজনায় শরাফত মণ্ডল নরম হয়, কিন্তু বাপু আজিজের জানটাও তো বাঁচলো হিন্দু দোকানদারের হাতেই। এটাও তো দেখবা।
সে রকম তো আমরাও করি। করি না? এই যে বৈকুণ্ঠ গিরি, কাল সন্ধ্যা থ্যাকা কচ্চি, বাপু, একটু হুঁশিয়ার হয়া থাকো। চেনাজানা মানুষ, একে আমরা চিনি, এর জন্যে কি আমাদের মায়ামমতা নাই?
আর ঐ হিন্দু দোকানদার? শরাফত মরিয়া হয়ে তর্ক করে, আজিজের সাথে ঐ মানুষটার কি চেনাজানা আছিলো?
আপনে একটা একটা মানুষ ধরা যদি কথা কন তো আর কিছু কওয়া যায় না। কিন্তু এখন উঠিছে জাতের সওয়াল। হিন্দু মোসলমান কাটাকাটি করে দুই জাত হয়।
একটা একটা মানুষ নিয়েই তো জাত, এই কথাটা বলা শরাফতের বুদ্ধিতে কুলায়। আবার এই সময় আজিজ তমিজের বাপকে ডেকে নেয় বাড়ির ভেতরে, এতেও সে বিরক্ত। বরং এতেই বেশি অসন্তুষ্ট হয়ে সে বড়ো বেটাকে বলে, দেখো, বাপু, বাড়ির ভেতরে পর্দার দিকে খেয়াল রাখো।।
কিন্তু ততোক্ষণে তমিজের বাপ ভেতরের উঠানে গিয়ে বসে পড়েছে তার দাদাশ্বশুরের ভেঁড়াখোড়া বই আর একটা কঞ্চি নিয়ে। এই বাড়ি পাকা হবার পর সে ভেতরে ঢুকলো এই প্রথম। উঁচু পাকা বারান্দায় জলচৌকিতে বসে রয়েছে হামিদা, পাশে শরাফতের দুই নম্বর বিবি। হামিদার মাথার ঘোমটা তার কপালের ওপরেই ওঠানো। কাঁদতে কাঁদতে সে যা বলে তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয় তার সৎশাশুড়ি। হামিদার মতো তারও বিশ্বাস, আহসান আলি মরে নি। হিন্দুরা তাকে হয়তো কোথাও লুকিয়ে রেখেছে, কিংবা সে পালাতে গিয়ে আটকা পড়েছে কোথাও।
তমিজের বাপ উঠানে বসে নানারকম দাগ কাটে, বিড়বিড় করে কী বলে, বইটা দেখে, তারপর রায় দেয়, কুটি আছে এখন কওয়া যাচ্ছে না। মরলে তো–।
কই নাই? হামি কই নাই? হামিদা এমনভাবে চেঁচিয়ে ওঠে যে, তমিজের বাপ তার ভাইয়ের জীবিত থাকার কথা ঘোষণা করলো। ফেঁপাতে ফোঁপাতে সে বলে, গত–কয়েকদিন ধরে বাড়ির পশ্চিমদিকে খালি কাক ডাকে, খালি কাক ডাকে। তখনই তার মনে হয়েছে, কোথাও কী সর্বনাশ হচ্ছে। কিন্তু মিয়াভায়ের কথাটা তার একবারো মনে হয় নি। তবে তার মিয়াভাই নামাজরোজা করা মানুষ, সে অপঘাতে কখনোই মরতে পারে না। হাজার হলেও সে হলো টাউনের লোক, কলকাতায় চলাফেরায় সে কি আবদুল আজিজের চেয়ে অনেক বেশি পারঙ্গম নয়? তমিজের বাপ তো দুনিয়ার আর আখেরাতের অনেক কথা জানে। সে কি একটু গোনাগাথা করে মিয়াভাইয়ের এখনকার অবস্থাটা বলে দিতে পারে না?
তমিজের বাপ উঠতে উঠতে বলে, অমাবস্যার আগে আর কিছু কওয়া যাবি না।
অমাবস্যার রাতে কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়তলায় মুনসির দেখা পাওয়ার সম্ভাবনাটা বাড়ে। এ তো সবাই জানে। আজিজের কেমন ভুলোলা লাগে, সম্বন্ধীকে সে কি সত্যি একেবারে মরে যেতে দেখেছে? তাকে মেরে কি নালার ভেতর ফেলে দিতে দেখলো? তা অমাবস্যার সময় না হয় তমিজের বাপকে আরেকবার ধরা যাবে। তার তো এখনো দিন বিশেক বাকি।
সন্ধার আগেই আজিজ তার বৌকে টমটমে উঠিয়ে নিয়ে গেলো টাউনে। সেখানে তার শ্বশুরবাড়িতে বৌকে রেখে সে চলে যাবে জয়পুর। বাবরটা একা পড়ে আছে সেখানে। ছেলেকে নিয়ে সপ্তাহখানেক পর সে ফের শ্বশুরবাড়ি আসবে। ঐ সময় বাড়িতেও এক পাক ঘুরে যাবে। এইসব ঝামেলায় ইটখোলায় লোকসান হচ্ছে। মুকুন্দ সাহাকে কয়েক হাজার ইট দেওয়ার কথা। তাকেও কিছু বলার সময় পাওয়া গেলো না।
বেটা বেটার বৌ চলে গেলে খড়ম পাল্টে পাম্পসু পায়ে শরাফত মণ্ডল রওয়ানা হয় কামারপাড়ার দিকে। যুধিষ্ঠির এবার তার জমিতে বর্গা করে আউশ ফলালো, কামারের হাতে খন্দ মন্দ হয় নি। কিন্তু কাল তো আগুনে তার দুটো গোরুই পুড়ে মরেছে। এবার তাকে বর্গা করতে দেয় কী করে সেই ভাবনায় মণ্ডল বেশ কাতর।