মানুষের দৈহিক পরিগঠন
আধুনিক শারীরবিজ্ঞান অনুসারে যাকে রূপান্তর-প্রক্রিয়া বলা হয়, মানবজাতির দৈহিক পরিগঠনে সেই রূপান্তর-প্রক্রিয়া গোড়া থেকেই কার্যকর ছিল। শুধু তাই নয়, মানবজাতির দৈহিক গঠন-কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সেই রূপান্তর-প্রক্রিয়া কার্যকর হয়েছে এক সুপরিকল্পিত কর্মসূচির অধীনে, সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সুষমধারায়, একের-পর-এক পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিকতায়। বলা অনাবশ্যক যে, এই পরিকল্পনা কার্যকর হওয়ার পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে সেই মহান স্রষ্টার মহতী ইচ্ছা–যিনি সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক। আর এই পরিকল্পনা তথা কর্মসূচী বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে সেই মহান সৃষ্টিকর্তার সর্বময় ক্ষমতা ও সার্বিক মহত্ত্বই যে প্রতিফলিত হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
কোরানে প্রথম মানবসৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বক্তব্য সেখানেই থেমে থাকে নাই; বরং দ্বিতীয় বা পরবর্তী পর্যায়ে মহান স্রষ্টা তাঁর সেই সৃষ্টিতে যে গঠনাকৃতি প্রদান করেছেন সে কথাও গুরুত্বসহকারে সেখানে উল্লিখিত হয়েছে। যথা :
“আমরা তোমাদের নির্মাণ করিয়াছি; উহার পর আমরা তোমাদিগকে দিয়াছি গঠনাকৃতি; উহার পর আমরা ফিরিশতাদিগকে বলিয়াছি, সিজদা কর আদমকে।”–সূরা ৭ (আ’রাফ), আয়াত ১১ (সূত্র নং ১৩) :
এখানে সৃষ্টিকর্মের তিনটি পর্যায়কে স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে। তবে, প্রথম দুটি পর্যায় হচ্ছে এই গবেষণার ক্ষেত্রে সর্বাধিক জরুরি : আল্লাহ্ মানবসৃষ্টির সূচনা করেছেন; এবং উহার পর মানবজাতিকে প্রদান করেছেন ‘গঠনাকৃতি’ (আরব, সাওওয়ারা)।
সময়ের ধারাবাহিকতায় সুষ্ঠু একটা পরিকল্পনার অধীনে মানুষের সেই চেহারাসুরত বা গঠনাকৃতি যে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে, লাভ করেছে পরিপূর্ণ এক সুসমতা, সে কথাটাও কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে এভাবে:
“যখন তোমার প্রভু প্রতিপালক ফিরিশতাদিগকে বলিলেন, আমি একটি মানুষ তৈয়ার করিতে যাইতেছি কাদা হইতে, নকশাকাটা নরম মাটি হইতে। অতঃপর যখন আমি সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তাহার গঠন পুরাপুরি সমাপ্ত করিব এবং তাহার মধ্যে আমার রূহ ফুৎকার করিব, তখন তোমরা উহার সামনে সিজদা নত হইও।”সূরা ১৫ (হিজর), আয়াত ২৮-২৯ (সূত্র নং ১৪) :
মানুষকে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গঠন করিবার’ (আরবী–সাওওয়ায়) এই কথাটি পুনরায় উল্লিখিত হয়েছে কোরআনের ৩৮ নং সূরার (সাদ বা সোয়াদ) ৭২ নং আয়াতে।
গঠন-কাঠামোগত মিশ্র ও জটিল প্রক্রিয়ায় মানুষের এই চেহারাসুরত বা আকৃতি কিভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমতা ও সুসম্পূর্ণতা লাভ করেছে (আরবী ক্রিয়াপদ ‘রাককাবা’, অর্থ, বিভিন্ন উপাদানের সহায়তায় কোন কিছু তৈরি করা, সুসম্পন্ন করা) সে কথাও কোরআনের অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে স্পষ্ট ভাষায়ঃ
“(আল্লাহ) সেই একক সত্তা যিনি তোমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন; তোমাকে গঠন করিয়াছেন সঠিক ও সুসমমাত্রায়; তোমাকে ভারসাম্যপূর্ণ করিছেন সেই সুরত বা আকৃতিতে যাহা তিনি ইচ্ছা করিয়াছেন; এবং তিনি তোমাকে সুসম্পন্ন করিয়াছেন বিভিন্ন উপাদানে।”–সূরা ৮২ (ইনফিতার), আয়াত ৭-৮ (সূত্র নং ১৫) :
মানুষ পরিগঠিত হয়েছে–আল্লাহর ইচ্ছানুসারে এক নির্দিষ্ট আকৃতিতে। আমাদের আলোচ্য গবেষণার জন্যে কোরআনের এই বক্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
“আমরা (এখানে আল্লাহ মানুষকে গঠন করিয়াছি সর্বোত্তম সাংগঠনিক পরিকল্পনা অনুসারে।”-সূরা ৯৫ (তীন), আয়াত ৪ (সূত্র নং ১৬) :
আরবী ‘তাকবীম’-এর অর্থ ‘কোন কিছুকে সুপরিকল্পিতভাবে সুসংগঠিত করা।’ এরদ্বারা বুঝা যায় যে, মানুষের সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার জন্য আগেথেকেই সুনির্ধারিত এক পরিকল্পনা ছিল এবং সেই পরিকল্পনা অনুসারে মানুষের উন্নতি ও অগ্রগতির ধারাও ছিল সুনির্দিষ্ট ও স্থিরীকৃত।
কোরআনের এই আয়াত অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় মানবসৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ‘সাংগঠনিক পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, ডারইউনের কথিত ‘বিবর্তন’ নয়, বরং আধুনিক সৃষ্টিশীল বিবর্তনের ক্ষেত্রে যারা বিশেষজ্ঞ তারা তাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষারক্ষেত্রে এ বিষয়ে অভিন্ন অভিমত পোষণ করেন। এমনকি সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে মানবজাতির রূপান্তর সাধনের ব্যাপারে তারা অনেকেই ‘অর্গানাইজেশনাল প্ল্যান’ বা ‘সাংগঠনিক পরিকল্পনা’–এই টার্মটি পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। বলা অনাবশ্যক যে, মানবসৃষ্টির প্রক্রিয়ায় সাংগঠনিক পরিকল্পনার এই বিষয়টি এখন বিজ্ঞানের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপ্রমাণিত তত্ত্ব। যদিও প্রায় দেড় হাজার বছর আগে অবতীর্ণ কোরআনে আরবী ‘তাকবীম’ শব্দের দ্বারা ঠিক এই টার্মাটিই একই অর্থে ও একই তাৎপর্যে উল্লিখিত হয়েছে!