1 of 2

৩৩. বিনোদিনীকে নিয়ে সুষ্ঠুভাবে রিহার্সাল পরিচালনা

বিনোদিনীকে নিয়ে সুষ্ঠুভাবে রিহার্সাল পরিচালনা করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে ঠিক সময় আসে না, তার বাড়িতে লোক পাঠালেও সে বিরক্ত হয়। গিরিশচন্দ্ৰ অন্য নটী-নটীদের নিয়ে রোজ কিছুক্ষণ মহড়া চালাবার পর গালে হাত দিয়ে বসে থাকেন। বিনোদিনীর প্রধান ভূমিকা, তার সঙ্গে অন্য অনেকগুলি চরিত্রের সংলাপ থাকে, বিনোদিনী না এলে কাঁহাতক আর প্রক্সি দিয়ে চালানো যায়?  রাগে গিরিশের গালের চামড়া চকচক করে, ব্র্যান্ডির বোতল খুলে তিনি জল না। মিশিয়েই ঢাকাঢাকা করে খানিকটা ঢেলে দিলেন গলায়।

বিনোদিনী যখন আসে, তখনও তার বায়নাক্কার শেষ থাকে না। পার্ট বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলে, চক্ষে আলোর ছররা লাগছে। ওই বাতিটা সরিয়ে দাও না গা! কিংবা, কাশি হয়েছে, কেউ একটু আদা কুচিয়ে এনে দেবে? কিংবা, হ্যাঁ যাদুকালী, তোর কাপড়ে কিসের গন্ধ? আমার যে বমির ভাত উঠে আসছে। যা, যা, শাড়িটা বদল করে আয়!

এইভাবে মহড়ার বিঘ্ন হয়। এমন কী বিনোদিনী যা কোনওদিন সাহস করেনি, এখন সে গিরিশচন্দ্রকে দু-একটা সংলাপ বদল করে দিতে বলে। আদেশের সুরে নয় অবশ্য, মিনতির সুরে, হাত জোড় করে অনুরোধ জানায়, এই জায়গাটা বড্ড খটোমটো লাগছে, একটু সহজ করে দিলে হয় না?

কিন্তু সেই অনুরোধই হুকুমের মতন শুনায়!

অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বেগড়াই করলে তাদের ধাতস্থ করতে পারে থিয়েটারের মালিক অথবা পরিচালক। এক্ষেত্রে মালিক গুর্মুখ রায়ের প্রশ্ৰয়েই সময় আগাগোড়া গুর্মুখ বসে থাকে এক পাশে, আবার গুর্মুখের সঙ্গেই চলে যায়। গুর্মুখের সামনে স্বয়ং গিরিশচন্দ্রও বিনোদিনীকে শাসন করার সাহস পান না, কারণ গুর্মুখের মুখের কোনও রাশ নেই, সকলের সামনেই সে গিরিশচন্দ্ৰকে অপমান করে বসবে।

এতগুলো বছর কাটল, গিরিশচন্দ্রের হাতে অনেক অভিনেত্রীই তৈরি হয়েছে। নানান অস্থান-কুস্থান থেকে মেয়েগুলিকে তুলে আনা হয়, চেহারাটা একটু চলনসই হলেই হল, ভালো করে কথা বলতে পারে না, অনেক বাংলা শব্দের মানে বুঝতে পারে না, হাঁসের মতন চলন, প্যাঁচার মতন চাউনি। সেই থেকে গড়ে-পিটে নিতে হয়, এক একজন একেবারেই উতরোয় না, এক একজন দাঁড়িয়ে যায়। কাদার তাল থেকে তৈরি হয় এক জীবন্ত মূর্তি। গিরিশচন্দ্ৰ শুধু অভিনয় শেখান না, তাদের রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী শোনান, বিলেতে রঙ্গমঞ্চের নটী-নটীদের নানান গল্প বলেন। তাদের লেখাপড়া শেখাবার জন্য মাস্টার নিয়োগ করেন। চিন্তার প্রসারতা না এলে, নিজের গণ্ডির বাইরের জগৎটাকে না চিনলে নানা রকম চরিত্রের বৈশিষ্ট্যও বোঝা যায় না।

একদিন গুটিপোকা প্রজাপতি হয়, মঞ্চে হাততালি পেতে শুরু করে। যে যত বেশি ক্ল্যাপ পায়, তার তত কদর। পর পর কয়েকটি নাটক জনপ্রিয় হলেই অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর মাথা ঘুরে যায়। তখন শুরু হয় নানা রকম বায়নাক্কা। কার কটা সিনে অ্যাপিয়ারেন্স, ডায়লগ কার কম কার বেশি, ড্রেস চেঞ্জ কতবার, এইসব নিয়ে ওজর আপত্তি। মাইনে বাড়াবার দাবি, দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেবার হুমকিও যোগ হয়। গুরুর কথা আর মনে থাকে না।

গিরিশচন্দ্র এমন অনেক দেখেছেন। কিন্তু বিনোদিনী কখনও এমন ছিল না। মাত্র কুড়ি বছর বয়েসেই সে প্রচুর খ্যাতির অধিকারিণী, কিন্তু গিরিশচন্দ্রকে সব সময় মান্য করে এসেছে। এখন তার এই দুর্বিনয়ের কারণটাও বুঝতে পারেন গিরিশচন্দ্র। থিয়েটারের স্বার্থে সবাই মিলে জোর করে ঠেলেঠুলে বিনোদিনীকে গুর্মুখের মতন এক বর্বরের অঙ্কশায়িনী হতে বাধ্য করা হয়েছে। তাই বিনোদিনী যেন প্রতিশোধ নিতে চাইছে এখন, তার ভাব-ভঙ্গির মধ্যে সর্বক্ষণ ফুটে ওঠে : স্টার থিয়েটার তৈরি হয়েছে আমার ইজ্জতের মূল্যে, আমার ইচ্ছেমতন এখানে সব কিছু চলবে।

এখন নাটক চলছে, নল-দময়ন্তী’, রিহার্সাল দেওয়া হচ্ছে পরবর্তী নাটক “কমলে-কামিনী’র। গিরিশচন্দ্ৰ নিজে আর অভিনয় করছেন না, নাটক রচনা ও পরিচালনাতেই তাকে সৰ্ব্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। নল দময়ন্তী” জমজমাট ভাবে চলছে, দময়ন্তীর ভূমিকায় বিনোদিনীর তুলনা নেই। তা ছাড়া এই নাটকে মঞ্চে অনেক চমকপ্ৰদ ব্যাপার ঘটে। একটা পদ্মফুল থেকে সহসা অপ্সরাদের আত্মপ্রকাশ, নলের পরিধেয় বস্ত্র নিয়ে একটি পাখি আকাশে উড়ে যায়, এমনটি আগে কেউ দেখেনি।

স্টার থিয়েটার লাভ হচ্ছে যথেষ্ট, কিন্তু গুর্মুখ তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না, আয়ের চেয়ে সে বেশি ব্যয় করে। তার আনন্দ প্রতাপচাঁদ জহুরীর ন্যাশনাল থিয়েটারকে জব্দ করা গেছে। ওদের মঞ্চ এখন টিমটিম করে। নল-দময়ন্তী’র এখনও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা, তবু গুর্মুখ চায় ওটা থামিয়ে নতুন নাটক নামাতে। গিরিশচন্দ্র দ্রুত রচনা করেছেন ‘কমলে-কাহিনী’। কিন্তু তাতে বিনোদিনীর কোনও চরিত্র পছন্দ নয়। দময়ন্তীর মতন আর একটি জোরালো চরিত্র নেই। সব নাটক কী একরকম হতে পারে। কমলে-কামিনীতে বিনোদিনীকে দুটো ভূমিকা দেওয়া হল, দেবী চণ্ডী ও খুল্লনা, তবু বিনোদিনী ঠোঁট ওলটায়।

রাগ কমাবার জন্য গিরিশচন্দ্রের দুটি উপায় আছে। গুর্মুখের সামনে বিনোদিনীকে ধমক দিতে পারেন না বলে তার অহং আহত হয়। বুকের মধ্যে বজ্ৰপাত হতে থাকে। তখন তিনি নিঃশব্দে উঠে চলে যান। মঞ্চের পিছনে একটি অন্ধকার স্থানে গিয়ে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে শ্যামা-মায়ের নামে একটি স্তোত্র আবৃত্তি করেন। ক্রমশ তাঁর স্বর উচ্চ থেকে উচ্চতর গ্রামেও ওঠে, চক্ষু দিয়ে জল গড়ায়, এই সময় কেউ তার কাছে যেতে সাহস পায় না। এরকম সময়ে অবশ্য মদ্যপানে কোনও বাধা নেই।

একদিন তার ওই রকম সাধনার অবস্থায় দেখা করতে এলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার।

অতিশয় ব্যস্ত ডাক্তার, বিজ্ঞান সমিতির জন্যও তাকে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। তবু তিনি নিয়মিত থিয়েটার দেখতে আসেন। থিয়েটারে তার নেশা ধরে গেছে। ঘোর নাস্তিক তিনি, অথচ ‘ধ্রুব চরিত্র’ নাটকের ভক্তিরসের গানগুলি শুনে তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেন না। “নল-দময়ন্তী” দেখতে দেখতেও সেই একই অবস্থা। দর্শকরা অনেকেই ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারকে চেনে। তারা অবাক হয়ে লক্ষ করে, এই বদমেজাজি জাঁদরেল মানুষটিও নাটকের অভিনয় দেখতে দেখতে কেঁদে ফেলেন!

কিন্তু ভক্তিগীতি শুনে মুগ্ধ হওয়া আর ভক্ত হওয়া এক কথা নয়। মহেন্দ্রলাল এখনও ভক্তিবাদ থেকে অনেক দূরে। এক রাত্রে তিনি নাটক দেখার পর নাট্যকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন। গিরিশকে তিনি চেনেন অনেকদিন ধরে। দিন পড়ে যাবার পর মহেন্দ্রলাল মঞ্চের পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হেঁকে বললেন, গিরিশ কোথায় হে, গিরিশ?

আজও গিরিশের মেজাজ বেশ খারাপ। বিনোদিনী একটা গোলমাল করেছে। পোশাক পরিবর্তনের অছিলায় বিনোদিনী একটি সিনে প্রবেশে করেছে সাত মিনিট দেরি করে। দর্শক বুঝতে পারেনি, সহ-অভিনেতারা তাৎক্ষণিক সংলাপ যোগ করে চালিয়ে দিয়েছে, বিনোদিনীও প্রবেশের পর অভিনয়ে কোনও খুঁত রাখেনি, কিন্তু নাট্য পরিচালক তা মানবেন কী করে? গিরিশচন্দ্রের অন্তরাত্মা পর্যন্ত জ্বলে উঠেছিল। এর আগে এমন বেয়াদপি দেখলে তিনি বিনোদিনীকে ঠাস ঠাস করে চড় লাগাতেন, কিন্তু বিনোদিনীর অভিনয়ের সময় উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে গুর্মুখ। তার রক্ষিতার গায়ে কেউ হাত তুললে সে তাকে গুলি করে মেরে ফেলবে।

গিরিশচন্দ্ৰ তাই মঞ্চের পেছনে অন্ধকারে বসে শ্যামা-মায়ের স্তোত্র উচ্চারণ করছেন। অন্য কোনও লোককে এ সময় গিরিশচন্দ্রের কাছে যেতে দেওয়া হত না, কিন্তু মহেন্দ্রলালকে আটকায় কার সাধ্য!

মহেন্দ্রলাল গিরিশচন্দ্রের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। দারুণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন একটুক্ষণ। গিরিশচন্দ্র চক্ষু বুজে দুলে দুলে স্তোত্র আওড়াচ্ছেন।

মহেন্দ্রলাল বললেন, হা কপাল! একেও দেখছি কালীতে খেয়েছে!

চোখ মেলে গিরিশচন্দ্র বললেন, ডাক্তার মশাই! আসুন, বসুন।

মহেন্দ্রলাল বললেন, ঢঙ করছিলে? নাটক করছিলে? না সত্যি সত্যি ভক্ত হয়েছ?

গিরিশচন্দ্র বললেন, চেষ্টা তো করছি, কিন্তু সত্যিকারের ভক্ত এখনও হতে পারলাম কই?

মহেন্দ্রলাল বললেন, ঘোষের পো, তোমাকে তো আমি অন্যরকম জানতাম। ঠাকুর-দেবতায় ভক্তি কখনও দেখিনি। কোঁৎ-এর মত মানতে। বিজ্ঞানে ঝোঁক ছিল। তোমার এসব হল কবে থেকে?

এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে গিরিশচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, প্লে-টা কেমন লাগল, বলুন।

মহেন্দ্রলাল বললেন, প্লে তো বেশ জমিয়েছ। আমার ধারণা ছিল কী জান, যেমন পতিতা মেয়েমানুষদের শিখিয়ে পড়িয়ে তুমি সতী-সাধ্বী, স্বর্গের দেবীর পার্ট করাচ্ছ, তেমনি তুমি নাস্তিক হয়েও ভক্তিরসের কাহিনী লিখে ফাটাচ্ছে! নাট্যকারও একজন অভিনেতা!

গিরিশচন্দ্র বললেন, ডাক্তারমশাই, আপনি ঠিকই বলেছেন, আগে আমি কিছুই মানতাম না। কিন্তু আমার জীবনে একটা অলৌকিক অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই থেকে আমি…

মহেন্দ্রলাল ব্যগ্রভাবে বললেন, অলৌকিক অভিজ্ঞতা? কী, শুনি, শুনি!

এই সময় বিনোদিনীকে বগলদাবা করে গুর্মুখ সেখানে এসে উপস্থিত হল।

গিরিশচন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এখানে হবে না। সেসব কথা আপনাকে আমি আর একদিন বলব!

মহেন্দ্রলাল বুঝলেন, এখানে এখন ওদের কাজের কথা হবে। তিনি আর দাঁড়ালেন না। গিরিশের এই রূপান্তরের কাহিনীটি জানার জন্য তাঁর মনে কৌতূহল রয়ে গেল।

কাজের কথা কিছু নয়, গুর্মুখ গিরিশের সঙ্গে বসে দু’ পাত্তর সুরা পান করতে চায়। সে সৰ্বক্ষণই সঙ্গে বোতল রাখে, দিনের বেলা থেকেই তার চক্ষু রঙিন।

গিরিশচন্দ্রের হঠাৎ যেন আজ জেদ চেপে গেল। এ ছোকরা কতটা পান করতে পারে দেখা যাক। দু’দিনের কাপ্তান! গিরিশের বয়েস এখন চল্লিশ, গুর্মুখ এখনও কুড়িতেও পৌঁছয়নি। গেলাসের পর গেলাস উড়ে যেতে লাগল, বোতলের পর বোতল। গুর্মুখের জেদ চেপে গেছে, সে এই বুড়োর কাছে হার স্বীকার করবে না। রাত যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন হঠাৎ এক সময় গুর্মুখ ধপাস করে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল, গিরিশচন্দ্র তখনও নীলকণ্ঠের মতন সোজা হয়ে বসে আছেন। বিনোদিনী ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। হাতের গেলাসে যে-টুকু বাকি ছিল, তা শেষ করে একটা রাম ঢেঁকুর তুললেন গিরিশচন্দ্র। তারপর হেঁকে বললেন, ওরে, কে আছিস, এই পেঁচি মাতালটাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়!

গুর্মুখ সে-ই যে শয্যা নিল, দশ দিন আর উঠতে পারল না শয্যা ছেড়ে। তখন বোঝা গেল, তার শরীরে নানান রোগ। গুর্মুখের জননীর তার ছেলের উচ্ছৃঙ্খলতা কিছুতেই সামলাতে পারছিলেন না, এবার ছেলের অসুস্থতায় ভয় পেয়ে লাহোরে থেকে তার এক ভাইকে আনালেন জরুরি তলব দিয়ে। গুর্মুখের সেই মামা এক বিশালদেহী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। তিনি এসেই সংসারের হাল ধরলেন, এবং হুকুম জারি করলেন যে, বিনোদিনীর সঙ্গে গুর্মুখের কোনও সম্পর্ক রাখা চলবে না এবং থিয়েটারের ব্যবসা অবিলম্বে বন্ধ করে দিতে হবে।

কোনওক্রমে একটু সুস্থ হয়ে, দুর্বল শরীর নিয়ে গুর্মুখ একদিন উপস্থিত হল স্টারে। সকলকে সমবেত করে সে প্রস্তাব দিল, বিনোদিনীকে সে এই থিয়েটারের অর্ধেক মালিকানা লিখে দেবে। বাকি অর্ধেক যে-কেউ কিনে নিতে পারে।

কেউ কিছু বলার আগেই গিরিশচন্দ্ৰ প্ৰতিবাদ জানালেন। প্রথমে তিনি বিনোদিনীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, তোর কাছে এই প্রস্তাব যতই লোভনীয় হোক, তবু তোর ভালোর জন্যই বলছি, বিনোদ, তুই রাজি হোস না! তুই শিল্পী, তোকে সব সময় অভিনয়ের উন্নতির কথা ভাবতে হবে, নাটক যাতে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়, সেই চিন্তা করতে হবে, মঞ্চের ব্যবসা চালানো কি তোর কাজ • সর্বক্ষণ টাকা-পয়সার চিন্তা মাথায় রাখতে পারবি? রাখতে যদি পারিস, তাহলে তুই আর শিল্পী থাকতে পারবি না! কোনটা চাস তুই? ওসব আমাদের কাজ না, বিনোদ। আমায় যদি কেউ বিনা পয়সাতেও দেয়, তাহলেও আমি কোনও থিয়েটারের মালিক হব না।

তারপর গুর্মুখের দিকে তাকিয়ে গরমভাবে বললেন, তুমি যদি বিনোদকে মালিকানা দাও, তাহলে কালই দল ভাঙবে। স্টার নষ্ট হয়ে যাবে। বিনোদ একজন নটী, তার অধীনে অন্য নটী-নটীরা কাজ করতে চাইবে না। গুর্মুখের আর সে তেজ নেই। গলার স্বর চি-চি করছে। পারিবারিক তাড়নায় সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থিয়েটারের দায় থেকে মুক্ত হলে বাঁচে। এখনই সে সব কিছু বিক্রি করে দিতে চায়। বহু ব্যয়ে নির্মিত এই রঙ্গমঞ্চ, শেষ পর্যন্ত দরাদরি করে রফা হল মাত্র এগারো হাজার টাকায়। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন টাকা জোগাড় করে নিয়ে এল। গিরিশচন্দ্রেরই মনোনীত চার জনকে স্বত্বাধিকারী নির্দিষ্ট করে রেজিস্ট্রি হবার পর স্টার হল শিল্পীদের নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ।

গিরিশচন্দ্র ঠিকই বুঝেছিলেন যে বিনোদিনীকে মালিকানা দিলে তার দেমাকের চোটে টেকা যেত না, অন্য নটী-নটীরা অচিরেই বিদ্রোহ ঘোষণা করত। কিন্তু বিনোদিনী যে এত সহজে মেনে নিল গিরিশচন্দ্রের কথা, তাতেও তার জন্ম হল একপ্রকার। যারা বিনোদিনীর প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল, এখন তারাই সহানুভূতি দেখাতে লাগল। সকলেরই মনের ভাবখানা এইরকম, আহা, মেয়েটা এত টাকার সম্পত্তি ছেড়ে তো দিল! এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে কেউ ছাড়ে?

বিনোদিনী এখন আর কথায় কথায় দৰ্প প্ৰকাশ করে না বটে। তবে অভিমান দেখাতে ছাড়ে না। কারুর সঙ্গে সামান্য মতান্তর হলেই বলে ওঠে, আমারই জন্য তো এই থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা, এখন তোমরা যদি আমাকে বাদ দিতে চাও তো দাও!

অনেকদিন পর বিনোদিনী কোনও বাঁধা বাবু থেকে মুক্ত হয়েছে, এখন রাত্তিরের দিকে মাঝে মাঝে গিরিশচন্দ্র দু’- একজন সঙ্গীসাথী নিয়ে তার বাড়িতে গল্পগাছা করতে যান। এরা নাটুকে মানুষ, নাটকের কথাই ঘুরে ফিরে আসে। বিয়ার ও ব্রান্ডি পান করতে করতে গিরিশচন্দ্র নতুন নাটকের গান ও দু’একটা দৃশ্যও রচনা করে ফেলেন। বিনোদিনীর এখনও ধারণা, পরবর্তী নাটকে সে উপযুক্ত ভূমিকা পায়নি । সব সময় তার ভয় অন্য কোনও নটী না তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । বনবিহারিনী ন্যাশনাল ছেড়ে স্টারে যোগ দিয়েছে, তাকে বিনোদিনী সহ্য করতে পারে না। গিরিশচদ্রের কাছে অনুযোগ জানাতে গেলে এখন যে ধমক খায় । তবু এক রাতে গিরিশচন্দ্রের হাতে সুরার পাত্র তুলে দিতে দিতে সে কাতরভাবে বলল, মহড়া দেখে সবাই বলাবলি করছে, ‘কমলে কামিনী’ প্লে তে তুমি আমার চেয়ে বেশি ক্ল্যাপ পাবে!

গিরিশচন্দ্র বললেন, পাগল নাকি! তুই চণ্ডীর সাজে যখন প্রথম দেখা দিবি, সারা অডিটোরিয়াম হাততালিতে  ফেটে পড়বে । এ আমি রাজি রেখে বলতে পারি ।

বিনোদিনী বলল, সে তো আমার সাজ দেখে হাততালি দেবে। আর ভুনি হাততালি পাবে গান শুনিয়ে । কত সুন্দর সুন্দর গান । ওই পার্টটা আমায় দিলে না কেন?

গিরিশচন্দ্র বললেন, ওটা তো পুরুষের পার্ট । শ্ৰীমত সওদাগর। ভুনির বয়েস হয়েছে, তাই তাকে পুরুষের পার্ট দিয়েছি। ও পার্ট তোকে মানাবে কেন?

বিনোদিনী এবার তেজের সঙ্গে বলল, কেন, আমি পুরুষের পার্ট করতে পারি না?

গিরিশচন্দ্র বললেন, তা পারবি না কেন? তোর ক্ষমতা আছে, যে কোনও পার্টই তুই ফোটাতে পারিস । কিন্তু লোকে তো মদ্দার সাজে বিনোদিনীকে দেখতে আসে না। তারা বিনোদিনীর ছলাকলা, চোখ-মুখ ঘোরানো, নাচ-গান দেখতে আসে। দর্শক হল লক্ষ্ণী!

বিনোদিনী বলল, তবু একবারটি আমার শ্রীমন্তর পার্ট করেতে দাও। গান আমি শিখে নেব।

গিরিশচন্দ্র এবার ধমক দিয়ে বললেন, ঘ্যান ঘ্যান করিসনি বিনোদ। আজ বাদে কাল প্লে নামছে বোর্ডে, এখন আমি বদলাব? ভুনিই বা রাজি হবে কেন?

বিনোদিনী ফাঁস করে বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বেশ, আমার তবে একেবারেই বাদ দাও ।

গিরিশচন্দ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তুই সত্যিই পুরুষের পার্ট করতে চাস? আর একটা সাবজেক্ট আমার মাথায় দানা বাধছিল.……তুই যদি রাজি থাকিস, তা হলে লিখে ফেলি। তোকে  পুরুষ সাজতে হবে, আগাগোড়া পুরুষ, ফচকেমি-ফাজলামি নেই, পারবি?

বিনোদিনী বলল, কেন পারব না?

গিরিশচন্দ্র বললেন, ঠিক আছে । তা হলে লিখতে শুরু করি। শুধু পুরুষের পার্ট না। শক্ত পাৰ্ট। আগাগোড়া তোকেই টানতে হবে । মনে রাখিস, এটাই হবে তোর জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *