বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি ছোট্ট বাড়িতে প্রায় সারা দিনরাত ধরেই চলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ; নাটক ও গানের রিহার্সাল, প্রোগ্রামের রেকর্ডিং। এই পাড়াটি এমনিতে নির্জন ও নিরিবিলি, অধিকাংশই উচ্চবিত্ত মানুষদের বাড়ি, অনেকখানি জুড়ে আর্মির এলাকা, এরই মধ্যে একটি বাড়ি সবসময় সরগরম। কিছুদিন আগে এই বাড়িটিই ছিল মুজিবর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের দফতর, এখন তিনি বেতারকর্মীদের ব্যবহার ও বাসস্থানের জন্য বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র উঠে গেছেন।
এই একই বাড়িতে বেতারকেন্দ্রের সবরকম কাজ ও প্রায় সত্তর জন শিল্পী, সংগঠক ও কলাকুশলীদের মাথা গোঁজার জায়গা। যে যেখানে পারে পাঁচ-ছ’ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেয়। দুটো মাত্র বাথরুম, এক একসময় সে দুটোর দরজার সামনে লাইন পড়ে যায়। খেতে হয় দু বেলাই খিচুড়ি কিংবা ভাত-ডাল আর একটা লম্বা ঝোল। তবু সবাই মিলে এক জায়গায় থাকার একটা আনন্দ আছে, কেউ কেউ আগে বেশ আরাম ও বিলাসিতার জীবনে অভ্যস্ত থাকলেও এখানে দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের গরিমা উপভোগ করার মেজাজে মেনে নিচ্ছে সব অসুবিধে। অবশ্য হঠাৎ হঠাৎ ছোট ছোট দল-উপদলে ধারণা, চাচামেচি ও ঝগড়াঝাঁটি চলে, শিল্পীদের পক্ষে সর্বক্ষণ একজোট হয়ে থাকা সম্ভব নয় বোধহয়, কিন্তু বৃহত্তর কারণটি মনে পড়ে যেতেই আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যায়!
মাঝে মাঝেই সীমান্তের ওপার থেকে নতুন মানুষ এসে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ছ’টি বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তানী প্রচার যন্ত্রের চাকরি ছেড়ে দলে দলে যোগ দিচ্ছেন মুজিবনগর সরকারের পক্ষে। কেউ কেউ আগেই চাকরি ছেড়ে, গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন। এরা অনেকে পাচার করে আনছেন কিছু কিছু পুরোনো অনুষ্ঠানের, গানবাজনার টেপ, এদের মুখে শোনা যায় পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচারের নতুন নতুন কাহিনী।
সবচেয়ে সাড়া পড়ে গিয়েছিল চট্টগ্রামের বেতারকর্মীদের আগমনের দিনটিতে। বেলাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে সেই এগারোজন পেয়েছিলেন বীরের অভ্যর্থনা। পাকিস্তানী শাসকদের অগ্রাহ্য করে এরাই প্রথম স্থাপন করেছিলেন বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। ২৫ শে মার্চ শুরু হয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনীর নারকীয় অত্যাচার, পরের দিনই কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ভবন থেকে এই বিদ্রোহী কর্মীরা স্বাধীনতার বাণী ঘোষণা করে দেন। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের এক মেজর জিয়াউর রহমান এই গোপন কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের নাম করে যখন আবার স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপনের বাণী ঘোষণা করেন, তখন তা নিপীড়িত, শঙ্কাতুর কিন্তু প্রতিবাদে উন্মুখ বাঙালীদের মনে ভরসা যুগিয়েছিল।
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটি বেতার কেন্দ্র হলেও এখান থেকে ট্রান্সমিশনের ব্যবস্থা নেই। এখান থেকে রেকর্ড করা অনুষ্ঠানের টেপ নিয়ে যাওয়া হয় সীমান্তের কাছাকাছি কোনো একটি জায়গায় একটি পঞ্চাশ কিলোওয়াটের ট্রান্সমিটারে সম্প্রচারের জন্য। সে জায়গাটির নাম স্যত্নে গোপন রাখা হয়েছে, কেননা, পাকিস্তানী সামরিক শক্তি যে-কোনো উপায়ে সেই ট্রান্সমিশন যন্ত্র ধ্বংস করে দিতে চাইবেই, এবং সীমান্তের এপারেও পাকিস্তানী গুপ্তচরদের অভাব নেই।
তাজউদ্দীন সাহেবের নিজস্ব ঘরখানাকেই বানানো হয়েছে স্টুডিও। সাউণ্ড প্রুফ করার জন্য বিছানার চাঁদর ঝুলিয়ে আর তুলো গুঁজে কোনোক্রমে বন্ধ করা হয়েছে জানলা-দরজার ফুটোফাটা। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ধার দিয়েছেন দুটো পুরোনো টেপ রেকর্ডার, অনুষ্ঠান প্রযোজনা ও রেকর্ডিং-এর জন্য তাঁরা কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সহযোগিতারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের প্রচার দফতরের দায়িত্বে রয়েছেন যিনি, সেই টাঙ্গাইলের জনাব আবদুল মান্নান বলেছিলেন, নাঃ, আমাগো প্রোগ্রাম আমাগো পোলাপানরাই করবো। আপনারা ট্রান্সমিশনের ব্যবস্থা করতেছেন, সেইটাই যথেষ্ট!
যন্ত্রপাতি ও উপকরণের অপ্রতুলতা পূরণ করে দিয়েছে এখানকার কর্মী শিল্পীদের অদম্য প্রাণশক্তি ও অফুরান উৎসাহ। সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধারা জলকাদার মধ্যে প্রতিদিন লড়াই করে যাচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শহরে-গ্রামে অসংখ্য মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গড়ে তুলছে প্রতিরোধ, সীমান্তের এপারে যারা আশ্রয় নিয়েছে, সেই শিল্পী বুদ্ধিজীবীরাও কোনো না কোনো ভাবে এই যুদ্ধে অংশ নিতে চান। স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠানগুলিও এক হিসেবে যুদ্ধ, তাই এ বাড়িতে সর্বক্ষণই যেন যুদ্ধকালীন ব্যস্ততা।
শওকতের সঙ্গে মঞ্জু আর হেনা একদিন এলো এই বেতার কেন্দ্রটি দেখতে। মামুন আজ বাড়িতে থাকবেন, তিনি সুখুর দেখাশুনো করবেন, তিনিই জোর করে পাঠিয়েছেন মেয়েদুটিকে। বাবুল চৌধুরীর এখনও কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
আব্দুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, অজিত রায়, কাঁদেরী কিবরিয়া এইসব শিল্পীদের দেখতে পেয়ে মঞ্জু আর হেনা দু’জনেই বেশ উত্তেজিত। এইসব বিখ্যাত লোকদের ছবিই আগে দেখেছে ওরা, এখন তাঁরাই জলজ্যান্ত অবস্থায় চোখের সামনে! এবং এদের চালচলন একেবারে সাধারণ মানুষের মতন! লুঙ্গি পরে খালি গায়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের তালিম নিচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা মাত্র কয়েকমাস আগেও ঢাকায় ছিলেন সুদূর তারকালোকের মানুষ। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানটা শুনলেই রোমাঞ্চ হয়! একটা ঘরে বসে কামাল লোহানী খবর লিখে যাচ্ছেন। পাশের ঘরে রিহার্সাল চলছে জল্লাদের দরবার’ নাটকের। চরমপত্রের জন্য বিখ্যাত এম আর আখতার মুকুল মঞ্জু আর হেনাকে দেখে চিনতে পেরে বললেন, কী! তোমরাও গান করবা নাকি? আমাগো কোরাসের জন্য কয়েকটা ফিমেল ভয়েস দরকার।
সঙ্গীত পরিচালক সমর দাসও চিনতে পারলেন মঞ্জুকে। একসময় তিনি ওদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন, মঞ্জুর গান শুনেছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম বিলকিস বানু না? তুমি তো অনেক নজরুলের গান শিখেছিলে, আমাদের এখানে গান করো!
মঞ্জু লজ্জায় শরীর মোচড়াতে থাকে। অনেক দিন অভ্যেস নেই, বিয়ের পর সে গান গাওয়া ছেড়েই দিয়েছে।
শওকত চোখ টিপে বললো, আপনি ছাড়বেন না, সমরদা। ওরে আপনারা গানের দলের সাথে জুইড়া লন! সেইজন্যই ওরে নিয়া আসছি।
সমর দাস হাতঘড়ি দেখে বললেন, আমাকে একটা রি-রেকর্ডিং করতে হবে। এখন একটু ব্যস্ত আছি। আপনেরা একটু ঘোরেন ফেরেন। ঠিক ফরটি ফাইভ মিনিট পর আমি এই মেয়েটিরে নিয়ে বসবো।
সেই ঘর থেকে বেরিয়েই একজন লোককে দেখে শওকত বললো, সেলাম আলেকুম, জহির ভাই! আপনি এখানে?
সেই ভদ্রলোক বললেন, এই যে শওকত, তুমিও আইস্যা পড়ছো? আমার একটা টক আছে, রেকর্ড করাবো।
শওকত মঞ্জু আর হেনার দিকে চেয়ে বললো, ইনি কে চিনেছো? জনাব জহির রায়হান, ফেমাস ফিল্ম ডাইরেকটার অ্যান্ড রাইটার।
মঞ্জু আর হেনা দু’জনেই ওঁর নাম আগে শুনেছে, তারা অভিবাদন জানালো। শওকত আবার বললো, জহিরভাই, আপনার জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটার নাকি একটা প্রিন্ট এসেছে? কলকাতায় দেখানো হবে?
জহির রায়হান বললেন, চেষ্টা চলছে। কিছু এডিটিং দরকার। পরে কথা হবে, বাংলাদেশ মিশানে এসে দেখা করো!
শওকত বললো, আপনি টক দেবেন, আমরা একটু শোনতে পারি না?
–ভিতরে বোধহয় ঢুকতে দেবে না। বাইরে দাঁড়াতে পারো। অন্য কেউ একজন ওদের কথাবার্তা শুনে বললো, ঠিক আছে, ভিতরেই আসো, কিন্তু কোনো শব্দ করবা না, হাঁচি কাশির রোগ নাই তো?
হেনা-মঞ্জুরা রেকর্ডিং রুমে ঢুকে প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলো। বেশ তীব্র উত্তেজনা বোধ করছে তারা। স্পষ্টভাবে উচ্চারিত না হলেও তারা বুঝতে পারছে যে তারা এখানে ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে যাচ্ছে।
জহির রায়হানের কথিকাটির নাম ‘পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’। পরিষ্কার উচ্চারণে তিনি বলতে লাগলেন, পাকিস্তানের এই অপমৃত্যুর জন্য বাংলাদেশের মানুষ দায়ী নয়। দায়ী পাকিস্তানের শাসক চক্র, যারা পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী অঞ্চলের স্বাধিকারের প্রশ্নকে লক্ষ লক্ষ মৃতের লাশের নিচে দাবিয়ে রাখতে পেরেছে…। বাংলাদেশ এখন প্রতিটি বাঙালীর প্রাণ। বাংলাদেশে তারা পাকিস্তানের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না। সেখানে তারা গড়ে তুলবে এক শোষণহীন সমাজব্যবস্থা, সেখানে মানুষ প্রাণভরে হাসতে পারবে, সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে…
পড়া শেষ হতেই কলাকুশলীরা সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো। চমৎকার বলা হয়েছে, ভবিষ্যতের সুন্দর ছবিটা যেন সকলের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ঐ ছবিটাই তো বর্তমানের সব দুঃখকষ্ট ভুলিয়ে দেয়।
রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে জহির রায়হান বললেন, কলকাতায় যেন ঢাকার থেকেও বেশী গরম পড়ে মনে হয়, তাই না?
শওকত বললো, কইলকাতায় কত মানুষ! বাপরে বাপ! রাস্তা দিয়ে হাঁটনের সময়েও মাইনষের গায় মাইনষের ধাক্কা লাগে!
জহির রায়হান বললেন, তবে সন্ধ্যাবেলা কলকাতায় একটা সুন্দর বাতাস ওঠে প্রায়ই, বঙ্গোপসাগরের হাওয়া।
মঞ্জু শওকতকে মৃদু খোঁচা মেরে বললো, শওকতভাই, এবার বাসায় চলো।
শওকত বললো, সমরদার কথা শুনে পলাইতে চাও তাই না? ঐসব হবে না, আজ তোমারে গান গাইতেই হবে।
সমর দাস অন্য কাজ শেষ করার পর হারমোনিয়াম নিয়ে বসে সা-পা টিপে বললেন, দেখি গলা খোলো তো! একটা লাইন গাও!
মঞ্জু তবুও দ্বিধা-শরম কাটাতে পারছে না, তার ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে উঠেছে। হেনা আর শওকত দু’জনে মিলে তাকে অনেক করে বোঝাতে লাগলো। শওকত বললো, শোনো মঞ্জু, স্বাধীনতা এমনি এমনি পাওয়া যায় না, তার জন্য প্রত্যেককেই কিছু না কিছু দিতে হয়। এখানে ঘরে বসে শুধু দিনগুলো নষ্ট করবে কেন? স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনে মুক্তিযোদ্ধারা কতটা প্রেরণা পায় তা তুমি জানো? আমি নিজে দেখে আসছি,
হেনা বললো, আপা, বাংলাদেশের মইধ্যে সকলে এই প্রোগ্রাম শোনে। দুলাভাই তোমার গলা শোনলেই চেনতে পারবেন! তাইলে তিনি বোঝবেন যে আমরা ভালো আছি। চিঠিপত্র তে পাওয়া যায় না!
এই কথা শুনে মঞ্জু চোখ বড় বড় করে তাকালো।
শওকত বললো, হেনা ঠিক বলেছে। এইভাবেই তো দেশের মইধ্যে অনেকে আমাগো খবর পায়। তুমি যদি বাবুল চৌধুরীর একটা ফেভারিট গান করো, সেইটাই হবে তোমার চিঠি!
সমর দাস খানিকটা অস্থিরভাবে বললেন, কোন গান বলো, আমিও ধরছি!
মঞ্জু এবার খুব আস্তে আস্তে শুরু করলো, “দুঃখ যদি না পাবে তো, দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে…
সমর দাস একটুক্ষণ গলা মিলিয়ে থেকে হঠাৎ থেমে গেলেন। অনেকদিনের অনভ্যাসের জন্য মঞ্জুর গলা কাঁপা কাঁপা লাগছে, লয়ও ঠিক থাকছে না। সমর দাস মন দিয়ে শোনার পর বললেন, হু, গলায় সুর আছে কিন্তু কয়েকটা দিন প্র্যাকটিস করা দরকার। এখনই প্রোগ্রাম করা ঠিক হবে না।
এরপর শুরু হলো মঞ্জুর গলা সাধা। শওকত, পলাশ আর তার এক বন্ধু বরুণ নিয়মিত এসে উৎসাহ দিতে লাগলো। এরা তিনজনেই গান-পাগল, এরা মঞ্জুকে গায়িকা করে তুলবেই। বরুণ একটা হারমোনিয়াম এনে দিল মঞ্জুকে। মঞ্জুর সঙ্গে সঙ্গে ওরাও গান করে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে।
মামুন নিজে গান বাজনা ভালোবাসলেও ঘরের মধ্যে এই হৈ হট্টগোলে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়লেন। ছেলেগুলো ভালো, এদের উৎসাহ উদ্দীপনায় মঞ্জু যেন একটা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে, তার মুখ অন্যরকম দেখায়। হেনার গানের গলা নেই কিন্তু সেও স্বাধীন বাংলা বেতারে অনুষ্ঠান করবে বলে নজরুলের কবিতা বেছে আবৃত্তির অনুশীলন শুরু করে দিয়েছে, এতে মামুনের খুশি হবারই কথা, তিনি অখুশিও নন, তবু তার নিজের কাজের অসুবিধেটাও অনুভব করছেন।
একদিন মঞ্জু বললো, মামুনমামাও ভালো গান করে।
পলাশ বললো, ঠিক তো, আমি মামুনমামার গান শুনেছি তোমাদের বাড়িতে। আপনিও একটা গান করুন না!
বরুণ এসে মামুনের হাত ধরে টানাটানি করে বললো, আসেন মামুনভাই, আসেন, আমাদের একটা গান শোনান!
মামুন লজ্জায় মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন, আরে দুর দুর আমি গুন গুন করতাম, সেও অনেকদিন আগে, সেসব তোমাদের শোনাবার মতন নয়।
ওরা নাছোড়বান্দা, মামুনকে টানতে টানতে নিয়ে বসালো হারমোনিয়ামের সামনে। পলাশ সেটা বাজায়, বরুণ একটা মোটা বইতে টোকা মেরে তবলার তাল দেয়। অনেকদিন পর মামুনের যেন বয়েস কমে গেল। তিনি শুধু গান করতে বাধ্য হলেন না, গলা খুলে হাসলেনও। বরুণ তার গান শুনে মন্তব্য করলো, মামুনভাই, আপনার গলা তো ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতন! মামুন বললেন, আর তোমার গান তো অন্যদিকে ফিরে শুনলে মনে হয় হেমন্তবাবু গাইছেন!
দশদিন পর মঞ্জুর দু’খানা গানের রেকর্ডিং হলো বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের স্টুডিওতে। বেশ সুনাম হলো তার গানের।
শুধু স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠানেই নয়, বাংলাদেশের শিল্পীরা কলকাতা ও কাছাকাছি মফস্বলের নানান জলসাতেও অংশ গ্রহণ করেন। ক্রমে সেইসব আসরেও ডাক পড়তে লাগলো। মঞ্জুর। ব্যারাকপুর, চন্দননগর কিংবা বর্ধমানে দলবল মিলে হৈ হৈ করতে করতে যাওয়া, সেখানে বিপুল সংবর্ধনা ও গানবাজনা, খাওয়া-দাওয়া, তা ছাড়া রিলিফ ফাণ্ডের জন্য কিছু টাকাও পাওয়া যায়। অনেক গায়ক, শিল্পী, সাংবাদিক এসে পড়েছেন, তাঁদের সকলের স্থান সঙ্কুলান হয় না বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে, কলকাতায় শুভার্থীরা তাঁদের জন্য আলাদা আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ল্যান্সডাউন রোডের একটা ফ্ল্যাটে এরকম রয়েছেন পনেরো-ষোলোজন, পলাশ ও বরুণরা বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে এদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেছে, সেখানেও প্রায় সবসময়েই চলে গান বাজনা ও নাটকের মহড়া।
মঞ্জু ও হেনাকে সেখানে নিয়ে যায় শওকত। মামুন আপত্তি করেন না, সন্ধেবেলাটা ঘর ফাঁকা থাকলে তাঁর লেখালেখির সুবিধে হয়। আবার মনের মধ্যে একটা খটকাও থাকে। এভাবে মঞ্জু হেনাকে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? এখনকার ছেলেমেয়েরা সমানভাবে মেশে, কলকাতায় এটা প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার, তবে কি মামুন এখনও ভেতরে ভেতরে প্রাচীনপন্থী রয়ে গেছেন?
হেনা আর মঞ্জুকে অনেকেই ভাবে পিঠোপিঠি দুই সহোদরা, মঞ্জু একটু সাজগোজ করলে মনেই হয় না যে তার একটি সন্তান আছে। এই দু’জনের প্রতি যুবকদের উৎসাহ দেখলে ভয় হবারই কথা। এখানে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তৌফিক ইমামের সঙ্গে মামুনের বেশ পরিচয় হয়ে গেছে, কাছেই তার বাড়ি। জাস্টিস ইমামের পরিবারের লোকজন হেনা-মঞ্জুদের। বেশ পছন্দ করে, ওরা সে বাড়িতে প্রায়ই যায়। সুখুর সমবয়েসী দুটি বাচ্চা আছে বলে মঞ্জু মাঝে মাঝে সেখানে সুখুকে রেখে আসে। একদিন মঞ্জু বলেছিল, মামুনমামা, জজসাহেবের মেজো ছেলে ফারুককে তো আপনি দেখেছেন। কী সুন্দর ব্যবহার। ওর সাথে হেনার বিয়ের সম্বন্ধ করলে কেমন হয়? হেনার সাথে খুব ভালো মানাবে!
মামুন প্রবল বেগে মাথা নেড়েছেন। দেশ স্বাধীন হবার আগে তিনি মেয়ের বিয়ের কথা চিন্তাই করতে চান না। কিন্তু তার আগেই মেয়ে যদি কারুকে পছন্দ করে বসে?
বাংলাদেশ মিশনের ঠিকানায় লণ্ডন থেকে ফিরোজার এক ভাইয়ের একটা চিঠি এসেছে মামুনের নামে। তাতে তিনি জেনেছেন যে, ফিরোজা এবং তার ছোট মেয়ে গ্রামের বাড়িতে ভালো আছে, মামুনও লণ্ডন ঘুরিয়ে একটা চিঠি লিখেছেন স্ত্রীকে
মাদারীপুরে সেরকম কিছু হামলা হয়নি, সে খবরও তিনি পেয়েছেন আগে। বাবুল চৌধুরীর এখনও কোনো সন্ধান নেই। ঢাকা থেকে যারা আসছে, তারাও বাবুল সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না।
শ্রীরামপুরে বাংলাদেশের শিল্পীদের একটা বিরাট সংবর্ধনা সভা হবে, সেখানে মঞ্জুকে নিয়ে যেতে চায় শওকত। আরও দু’জন মহিলা শিল্পীও যাচ্ছে। তিনখানা কোরাস গানে মঞ্জুর রিহার্সাল দেওয়া আছে, সেইজন্য মঞ্জুকে বিশেষ দরকার।
মামুন বললেন, শ্রীরামপুর? সে তো অনেকদূর।
শওকত বললো দূর কোথায়, মামুনভাই! গাড়িতে যাওয়া-আসা, আমরা রাত্তির সাড়ে নটা-দশটার মধ্যে ফিরে আসবো। অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল সাড়ে পাঁচটায়।
মামুন খুঁত খুঁত করতে লাগলেন। মঞ্জুকে অতদূর পাঠাতে তাঁর মোটেই ইচ্ছে করছে না, অথচ সরাসরি আপত্তি জানাতেও পারছেন না। শওকত হেনাকে নিয়ে যাবার বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেনি, মামুন শেষ পর্যন্ত বললেন, হেনাও তাহলে সঙ্গে যাক। তোমার ওপরে দায়িত্ব দিলাম, শওকত।
হেনাকে তিনি সঙ্গে পাঠাতে চান মঞ্জুকে পাহারা দেবার জন্য। কিন্তু মঞ্জু যদি গানাটান নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন হেনাকে কে পাহারা দেবে? মঞ্জুর চেয়ে হেনার বয়েস অনেক কম, তার যদি মাথা ঘুরে যায়? কোন্ দিকটা যে মামুন সামলাবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না। শওকতকে তিনি বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস করেন না। মামুন রাগ করতে পারেন এমন কোনো কাজ শওকত কিছুতেই করবে না। কিন্তু অচেনা যায়গায় কত রকম মানুষ থাকে!
একজন বিবাহিতা রমণী অনাত্মীয়দের সঙ্গে দূরের কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতে যাবে, এটা কিছুদিন আগেও অবিশ্বাস্য ছিল, কিন্তু হঠাৎ কেমন যেন সবকিছু পাল্টে গেছে। এই কয়েক মাসের মধ্যেই পরিবর্তিত হয়েছে অনেক মূল্যবোধ।
ওরা চলে যাবার পর মামুন একটা লেখা শেষ করবেন ভেবে বসলেন। কিন্তু একলাইনও লেখা এগোচ্ছে না। গোলমালের মধ্যেই তার লেখা অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন নির্জনতার মধ্যে আর চিন্তাশক্তি কাজ করতে চায় না। সুখুকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে জাস্টিস ইমামের বাড়িতে, মামুন আজ প্রকৃতই একা।
লেখা ছেড়ে মামুন রেডিওটা নিয়ে খুটখাট করতে লাগলেন। এখন ভালো কোনো প্রোগ্রাম নেই। খাটে শুয়ে কিছুক্ষণ একটা বই পড়ার চেষ্টা করলেন, তাতেও মন বসলো না। ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। একবার ভাবলেন, প্রতাপের বাড়িতে যাবেন আড্ডা দিতে, কিন্তু সে বাড়ি অনেক দূর, সন্ধের পর গেলে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যায়। বালু হক্কাক লেনে ‘জয় বাংলা’ অফিসে গিয়ে দেখলেন সেখানেও আজ কেউ নেই।
পার্ক সার্কাস ময়দানে ঢুকে মামুন চিনেবাদাম খেতে লাগলেন। সারাদিন অসহ্য গরম গেছে, সন্ধের পর অনেকেই পার্কে হাওয়া খেতে আসে। আকাশে মেঘের চিহ্ন নেই, বেশ জ্যোৎস্না উঠেছে, পার্কের মধ্যে এদিকে সেদিকে জোড়ায় জোড়ায় নারী-পুরুষদের বসে থাকতে দেখা যায়। দুদিন আগেই এই তল্লাটে নকশালরা প্রচুর বোমাবাজি করেছে তবু লোকে সন্ধের পর এখানে আসতে ভয় পায় না।
মামুনের মনে পড়ে গেল ঢাকার কথা। শোনা যায়, প্রায়ই সন্ধের পর ঢাকা শহরে কারফিউ থাকে। আজও কি কারফিউ? কলকাতার আকাশে জ্যোৎস্না ফুটলে ঢাকাতেও আজ জ্যোৎস্না থাকতে পারে। কতই বা দূর! জ্যোৎস্নার মধ্যে ঢাকার রাস্তাঘাট সব সুনসান ফাঁকা? মাঝে মাঝে দারুণ দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বোমা ফাটাতে শুরু করেছে, চোরাগোপ্তা খুনও হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকেরা। এই সময় কি সেনাবাহিনী ট্যাংক নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে পেট্রোল দিতে? প্রেস ক্লাব বিল্ডিং-এ পঁচিশে মার্চ রাতে গোলাবর্ষণ করা হয়েছিল,তারপরেও কি সেখানে আর কেউ যায়? ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে যারা দিনের পর দিন কুৎসিত সব মিথ্যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তারাও তো বাঙালী, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায় না? কিংবা শুধু আর্মির ভয়েই তারা জেনেশুনে এইসব মিথ্যে প্রচার করছে? বাবুল চৌধুরী কোনোদিন আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদ সমর্থন করেনি, এই যুদ্ধ সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহ নেই, আর্মির অফিসারদের সঙ্গে তার চেনাশুনো আছে, সুতরাং তার কোনো বিপদ হবার কথা নয়। হয়তো সে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ নিয়ে কোনো কাজ করছে এখন, আর তার বউ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা দেবার জন্য গান গাইছে বেতারে!
শ্রীরামপুরের অনুষ্ঠানে তাঁকেও তো ডাকলে পারতো। তিনি হেনা-মঞ্জুদের সঙ্গে গেলে আর কোনো চিন্তা থাকতো না। তাঁর মতন একজন বয়স্ক মানুষকে ওরা সবসময় সঙ্গে নিতে চায় না। তাতে অনেক মজা মাটি হয়। পৃথিবীটাই যৌবনভোগ্যা। মামুনের মতন প্রবীণদের এখন স্থান ছেড়ে দিতে হবে।
নটা বাজবার আগেই মামুন বাড়িতে ফিরে এলেন। মঞ্জুরা যাওয়ার আগে তাড়াহুড়ো করে রান্না করে রেখে গেছে। খরচা বাঁচাবার জন্য এমনিতেই প্রায় দিনই একবেলা রান্না হয়। ভাতে পানি ঢালা আছে, এই গরমে পান্তা ভাত বেশ ভালোই লাগে।
সুখু আজ রাতটা জজ সাহেবের বাড়িতেই থাকবে। হেনা-মঞ্জুরা খুব সম্ভবত খেয়েই আসবে। ভাত না খাওয়ালেও এইসব অনুষ্ঠানের পর এতসব নোন্তা আর মিষ্টি খাবার দেয় যে তারপর আর বাড়িতে এসে কিছু খেতে ইচ্ছে করে না।
রেডিওটা চালিয়ে ঘড়ির দিকে চোখ রেখে মামুন একাই খেতে বসলেন সাড়ে নটার সময়। কিছু কাজ করার না থাকলেই বেশি খিদে পায়। এইবার মঞ্জুদের এসে পড়া উচিত।
দশটা বেজে গেল, তবু ওদের ফেরার নাম নেই। শওকত কথা দিয়ে গিয়েছিল, এরা কথা রাখতে জানে না। দশটা কি কম রাত? গাড়ি করে আসবে, পথে কত রকম বিপদ হতে পারে, ওদের কি তাড়াতাড়ি রওনা দেওয়া উচিত ছিল না? ছেলে ছোকরাদের কোনো আক্কেল নেই।
শওকত বিয়ে করেছিল তাঁরই পরিচিত ওয়ালীউল ইসলামের ছোট মেয়ে নাসিমকে। বড় চাপা আর নিরীহ মেয়ে ছিল সে। সে বেচারি প্রথম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। তারপর কি আর শওকত বিয়ে করেছে? কিছু বলেনি তো! মঞ্জুকে সে কি শুধু স্নেহ করে না অন্যকিছু? হঠাৎ মামুনের মনে পড়ে গেল, বাবুল চৌধুরীর সঙ্গে শওকতের কোনোদিন ঠিকমতন ভাব জমেনি। একদিন শওকতের সঙ্গে বাবুলের কী নিয়ে যেন খুব কথাকাটাকাটি হয়েছিল না? শওকত এখানে প্রথম দিন এসে আলতাফের চিঠি দিয়েছিল, তারপর সে আর বাবুল সম্পর্কে কোনোরকম উচ্চবাচ্য করেনি। বাবুলের কোনো বিপদ হলেও যেন কিছু যায় আসে না। সে মঞ্জুকে নিয়ে মেতে উঠেছে।
এগারোটা বেজে যাবার পর মামুন রীতিমতন ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। জনবহুল কলকাতা রাস্তাও এখন প্রায় নিঃশব্দ হয়ে এসেছে। নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে ওদের। মঞ্জুর যদি খারাপ কিছু ঘটে যায়, তা হলে মামুন তাঁর দিদির কাছে, মঞ্জুর স্বামীর কাছে কী কৈফিয়ত দেবেন? সকলেই বলবে, মামুন কেন মঞ্জুকে অতদূর যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন! মঞ্জুর সঙ্গে হেনাও গেছে, সেটা তাঁর আরও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কাজ হয়েছে।
এখন মামুন কী করবেন, কাকে খবর দেবেন? থানায় যাওয়া উচিত? বাংলাদেশ মিশনে? সেখানে এত রাতে কেউ থাকবে?
অসহায়ভাবে ছটফট করতে লাগলেন মামুন, কিছুক্ষণ বাড়ির সামনে রাস্তায় পায়চারি করলেন, তারপর ওপরে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন জানলায়।
পৌনে একটার সময় বাড়ির সামনে একটা প্রাইভেট গাড়ি থামলো। সদর দরজা খোলাই রেখেছেন মামুন, তিনি দেখলেন প্রথমে হেনা নেমেই দৌড়ে ঢুকে এলো বাড়ির মধ্যে। তারপর মঞ্জু নেমে কয়েক পা এগোতেই গাড়ির মধ্যে থেকে কেউ তাকে ডাকলো।
গাড়ি থেকে নামলো পলাশ, শওকত কোথায়? গাড়িতে আর কেউ আছে বলে তো মনে হয় না। নিয়ে গেল শওকত আর ফিরে এলো পলাশের সঙ্গে? পলাশের হাতে কিসের যেন একটা বড় প্যাকেট। মঞ্জুর কাছে এসে সে প্যাকেটটি তুলে দেবার আগে মঞ্জুর মুখের দিকে তাকালো, মঞ্জুও চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। যেন সেই দৃষ্টির মধ্যে একটা সেতুবন্ধন আছে। দপ করে মামুনের মাথার মধ্যে জ্বলে উঠলো একটা তীব্র শিখা। সেটা রাগ না ঈর্ষা! বাবুল চৌধুরীকে কী কৈফিয়ত দেবেন সে কথা মামুনের মনে পড়লো না, তার মনে হলো পলাশ নামের ঐ ছোকরা মঞ্জুকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে! ঐ ছেলেটার চোখদুটো উপড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হলো মামুনের।