৩৩. ফাইট অ্যান্ড ফ্লাইট
হ্যারি কিছুই বুঝতে পারছে না হারমিওন কি করতে চলেছে বা মনের ভেতর ওর কি প্ল্যান আছে। হ্যারি আমব্রিজের সঙ্গে যাবার সময় হারমিওনের সঙ্গে একটু দূরত্ব রেখে চললো। আমব্রিজ যদি সন্দেহ করেন, হারমিওনের সঙ্গে কোথায় চলেছে তার বিন্দুবিসর্গ হ্যারি জানে না। হ্যারি চুপচাপ, হারমিওনের সঙ্গে একটি কথাও নয়। আমব্রিজ ওদের খুব কাছে কাছেই চলেছেন। চলার সময় ওর ভারি নিঃশ্বাস কানে আসতে লাগলো।
ওরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এনট্রেন্স হলে ঢুকলো। গ্রেট হল থেকে শুনতে পেল ছেলে–মেয়েদের কথাবার্তা, খাবার বাসনের শব্দ। মাত্র কুড়ি ফিট দূরে ওরা পরীক্ষা শেষের আনন্দে মশগুল। ওরা যেন পৃথিবীর কোনো কিছু পরোয়া করছে না। সেই আনন্দ, উৎসব, হৈ চৈ থেকে ওরা শুধু বাদ পড়েছে।
হারমিওন ওক গাছের দরজা দিয়ে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে সুগন্ধে ভরা সন্ধ্যা শেষের মাঠের সবুজ ঘাসে পা দিলো। তখনও সূর্য অস্ত যায়নি। সূর্যের কিরণ গাছ ভেদ করে নিষিদ্ধ অরণ্যের তলায় পড়ছে। হারমিওন ইচ্ছে করেই সবুজ কচি ঘাসের ওপোর দিয়ে চললো। দিন শেষের সূর্যের আলোতে ওদের ছায়াগুলো লম্বা লম্বা দেখাচ্ছে।
আমব্রিজ হ্যারির কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ওটা কী হ্যাগ্রিডের হাতে লুকানো আছে?
হারমিওন ভয়পীড়িত গলায় বললো, না না, কখনোই না। হ্যাগ্রিড হয়তো ভুল করে অন্য কোথাও সরিয়ে রেখেছেন।
আমব্রিজের উত্তেজনা তখন চরমে পৌঁছেছে। কোনওরকমে বললেন, হ্যাঁ, তাও করতে পারে। একটা আধা দানবতো।
আমব্রিজ হাসলেন। হ্যারির ইচ্ছে হলো আমব্রিজের গলা টিপে ধরে, কিন্তু অনেক কষ্টে গলাটিপে দেওয়ার ইচ্ছে দমন করলো। ঠাণ্ডা বাতাস লেগে ওর কপালটা দপদপ করতে লাগলো। ও জানে ভোল্ডেমর্ট ওকে হত্যার পরিকল্পনা করলে কপালের কাটাদাগ সাদা হয়ে গিয়ে তীব্র জ্বলন শুরু হয়।
হারমিওনকে কোনো কথা না বলে অরণ্যে ঢুকতে দেখে আমব্রিজের মনে সামান্য সন্দেহ হলো। বললেন, সেটা তাহলে কোথায় আছে?
–আমরা ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীরা ভুলক্রমে সেটা যদি দেখতে পায়, তাই গভীর অরণ্যের ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে রেখেছেন। ওই দিকে হতে পারে। হারমিওন অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলটা দেখালো।
–হা হা ঠিক কথা বলছে। কথার মধ্যে খুবই উৎকণ্ঠা, বেশ তাহলে তোমরা দুজন আগেআগে হেঁটে আমাকে পথ দেখাও।
হ্যারি বললো–আমরা যদি আগে আগে হটি তাহলে আপনার দণ্ডটা পেতে পারি?
দুঃখিত পটার, ওটাতে দেওয়া যাবে না। মন্ত্রণালয়েল কাছে তোমাদের জীবনের মূল্যের চাইতে আমার জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
হ্যারি প্রথম বড় গাছটার তলায় দাঁড়ালো। অন্ধকারাচ্ছন্ন অরন্যের মধ্যে দণ্ড ছাড়া চলা খুবই বিপদের ব্যাপার হতে পারে। এর আগে কখনও ওরা দণ্ড ছাড়া ভেতরে যায়নি। ও আমব্রিজের দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘনবদ্ধ বড় বড় গাছের তলায় সরু পথচলা রাস্তা ধরে এগোতে লাগলো। আমব্রিজের পা দুটো। ছোটো ছোটো, ওদের তালে তাল রেখে চলতে পারছেন, না। তবুও সেই অমূল্য শক্তিশালী অস্ত্র করায়ত্ত্ব করার লোভে থপ থপ করে এগিয়ে চললেন।
একটা কাঁটাগাছে আমব্রিজের লম্বা ঝুল ওয়ালা আলখেল্লাটা আটকে গেলে আমব্রিজ সেটা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, আর কতোটা হাঁটতে হবে হে?
–হাঁটতে হবে। ওটা খুব ভাল করে একটা অন্ধকার জায়গায় লুকোনো আছে।
যে পথে হ্যাগ্রিডের সঙ্গে এয়পকে দেখতে গিয়েছিলো সেই পথটা দিয়ে না চলে অন্য পথে হারমিওনকে যেতে দেখে হ্যারিরও মনে শঙ্কা হলো। তিন বছর আগে এরাগগ দানবের সন্ধানে ওই রাস্তাটায় হেঁটেছিল। হারমিওন তখন ওর সঙ্গে ছিলো না। মনে হলো, শেষ পর্যন্ত কি বিপদের সম্মুখীন হতে হবে, সে সম্বন্ধে হারমিওনের যেনো কোনো চিন্তা-ভাবনা-ধারণা নেই।
–তুমি ঠিক জানো আমরা ঠিক পথে চলেছি? হারমিওন সংক্ষেপে বললো, ভালো করেই জানি।
আমব্রিজের বয়স হয়েছে তাই দুটি কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে চলা কষ্টকর। হাঁপিয়ে উঠছেন গভীর জঙ্গলে ঝোঁপ ঝাড়ু ঠেলে হাঁটতে। আমব্রিজ একটা ভাঙা ডালে পা লেগে প্রায় হোঁচট খেয়ে প্রপাত ধরনী তলে হচ্ছিলেন। কোনো রকমে সামলে নিয়ে বললেন, আর কতোটা হাঁটতে হবে। কি করে বলবে?
হারমিওন এগিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে বললো–আর একটু।
হ্যারি খানিকটা এগিয়ে যাওয়া হারমিওনকে সাবধান করে দিলো–হারমিওন জোরে জোরে কথা বলো না, এখানে সব কথা শুনতে পাওয়া যায়।
আমব্রিজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওদের পিছু পিছু চললেন, অস্ত্রের সন্ধানে। –একটু আগে গেলেই দেখতে পারে।
ওরা নিজেরাই জানে না কতোটা পথ ওরা হেঁটে গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন অরণ্যের মধ্যে ঢুকেছে। হ্যারি মুখ তুলে দেখলো বড় বড় গাছের শাখা-প্রশাখা, পল্লব একাকার হয়ে আকাশ ঢেকে ফেলেছে। অনেকটা চাঁদোয়ার মতো। হ্যারির মনে হলো একবার নয় অনেকবার জঙ্গলটার ভেতরে এসেছে। আরও মনে হলো যেনো দুটো অদেখা অজানা চোখ ওর গতিবিধি লক্ষ্য রেখে চলেছে।
আমব্রিজ খুব রেগে গেছেন। আরও কতোটা হাঁটতে হবে?
হারমিওন বেশ জোরে জোরে বললো–আর বেশি দূরে নয়। ওরা এখন অন্য একটা অন্ধকার জঙ্গলে ঢোকার প্রবেশপথের (ক্লিয়ারিং) সামনে পৌঁছেছে।
হঠাৎ কোথা থেকে একটা তীর এসে ওদের সামনে বিরাট গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে গাছের তলায় পড়লো। আকাশ বাতাস নানারকমের জg জানোয়ার, মানুষের পদ শব্দে ভরে উঠলো। হ্যারি বেশ বুঝতে পারলো পায়ের তলার মাটি কাঁপছে। আমব্রিজ ভয় পেয়ে গিয়ে হারমিওনের আড়ালে দাঁড়ালেন।
হ্যারি তখন একলা দাঁড়িয়ে। ও দেখলো, প্রায় পঞ্চাশটা সেনট্যার ওদের তিনজনকে ঘিরে ধরেছে। তীর-ধনুক নিয়ে। ওদের দিকে তাক করে রয়েছে।
ওরা সামান্য পিছু হটে এলো, জঙ্গলে ঢোকার মুখের কাছ থেকে।
ম্যাগোরিয়ন, বাদামি রঙের সেনট্যার ওদের দিকে এগিয়ে এলো তীর-ধনুক তুলে। বাকিরা এমনভাবে দাঁড়ালো যেন ম্যাগোরিয়নের আদেশের প্রতিক্ষা করছে। সেনট্যারদের দেখে ভয়ে আমব্রিজের মুখ শুকিয়ে গেলো। যে সেনট্যারটা ওর দিকে আসছিলো তারা জাদুদণ্ড তুলে ধরলো আমব্রিজকে লক্ষ্য করে।
আমব্রিজ ভয়জড়িত কণ্ঠে বিড় বিড় করে কিছু বললেন হ্যারি কিছু বুঝতে পারলো না। আড়চোখে হারমিওনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখে তার বিজেতার হাসি।
একজন কর্কশ সুরে বললো, তোমরা কে?
নীরব হয়ে তিনজনই দাঁড়িয়ে রইলো।
ম্যাগোরিয়ন উদ্ধত স্বরে আবার বললো, আমি জানতে চাই তোমরা কে? আমব্রিজ যাতে সকলে শুনতে পায় তেমনিভাবে বললেন, আমি ডরোলেস আমব্রিজ, সিনিয়র আন্ডার সেক্রেটারি, মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিক। আর হোগার্টসের উচ্চ পদস্থ তদন্তকারী অফিসার, হেডমিস্ট্রেস।
ম্যাগোরিয়ন বললো, ও তুমি মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিকের লোক?
–যেসব সেনট্যাররা ঘিরে দাঁড়িয়েছিলো তারা আমব্রিজের কথা শুনে উসখুস করে উঠলো।
–হ্যাঁ ঠিকই শুনেছো, আমব্রিজ সামান্য গলা চড়িয়ে বললেন।
–একটু সাবধানে কথা বলবে। তোমরা কি জানো না তোমাদের মতো আধা মানুষের ওপোর আক্রমণ, ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের রেগুলেসন ও কন্ট্রোল অফ ম্যাজিক্যাল ক্রিচারর্স আইন অনুসারে বেআইনী, অপরাধ?
এক উগ্র চেহারার কালো রঙের সেনট্যার চিৎকার করে বললো, আমাদের তুমি কি বললে?
হ্যারি ওকে চিনতে পারলো, বেন। বেন অসম্ভব রেগে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো। ধনুক তীর সোজা করলো। যারা এসে দাঁড়িয়েছিলো তাদের মুখ আক্রোশ যেনো ফেটে পড়তে লাগলো।
হারমিয়ন বললো, ওদের আধা মানুষ বলবেন না প্রফেসর! কিন্তু আমব্রিজ যেনো শুনতে পাননি মনে হলো। ম্যাগারিয়নের দিকে জাদুদণ্ড তেমনিভাবে তুলে রেখে বলে গেলেন, আইন পনের ফ-এ পরিষ্কারভাবে বর্ণিত আছে, কোনো ম্যাজিক্যাল ক্রিচার যাদের মানুষের যোগ্য বুদ্ধি নেই, তাদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা দায়ি হবে তাদের কাজকর্মের জন্য।
–মানুষের কাছাকাছি বুদ্ধি? বেন আর বাকি সেনট্যাররা পায়ের ক্ষুড় দিয়ে মাটিতে আঁচড় কাটতে লাগলো। ওরা সবাই অপমানজনক কথাতে অসম্ভব রেগে গেছে।
–আমাদের অরণ্যে কি করতে এসেছে। হ্যারি আর হারমিওনকে খুব সম্ভব চেনে তাই ওদেরও বললো, তোমরা এখানে কেন?
আমব্রিজ ব্যঙ্গ করে বললেন, কী বললে তোমাদের অরণ্য? মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিক তোমাদের ওপোর দয়া করে এই অরণ্যের কিছু অংশে তোমাদের থাকতে দিয়েছেন।
সাঁ করে একটা ছুঁচলো ফলা ওয়ালা তীর আমব্রিজের কান ঘেঁষে চলে গেলো। ভাগ্য ভালো মাথায় লাগেনি। তীর সোঁ শব্দে যাবার সময় আমব্রিজের কানের কাছে কিছু চুল সঙ্গে করে নিয়ে গেলো।
বেন বললো, তাহলে অরণ্যটা মানুষদের?
আমব্রিজের হাত তখনও মাথার ওপোর। বললেন–নোংরা আধা জg আধা মানুষ! বন্য জন্তু তোমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা শক্ত!
হারমিওন ভেবেচিন্তে বললো, চুপচাপ থাকুন। কিন্তু সাবধান করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমব্রিজের হাতের জাদুদণ্ড ম্যাগোরিয়নের দিকে তাক করে বললেন, ইনারসেবাস!
শুধু ম্যাগোরিয়নের নয় অন্যান্য সব সেনট্যারদের আকাশ থেকে মোটা সাপের মতো দড়ি ভেসে এসে শক্ত করে বেঁধে ফেললো। দারুণ রাগে ম্যাগেরিয়ন আর অন্যান্য সেনট্যারসরা হাত ছুঁড়তে লাগলো ছাড়া পাবার জন্য।
হ্যারি হারমিওনকে টেনে অরণ্যের মাটিতে মুখ চেপে ধরলো। সেনট্যারদের পা প্রায় মাড়িয়ে ফেলেছিলো ওদের; কিন্তু ওদের ওরা ডিঙিয়ে আমব্রিজের দিকে গেলো।
আমব্রিজ ভয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলেন–না-আ-আ-আ-না-আ আ আমি একজন সিনিয়র আন্ডার সেক্রেটারি, তোমরা আমাকে পা দিয়ে দলিত করতে পারো না… না… না! জন্তু জানোয়ারের দল।
হ্যারি দেখলো এক ঝলক লাল আলো। আমব্রিজ ওদের একজনকে স্টান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভীষণভাবে আর্তনাদ করে উঠলেন। দেখলো বেন, আমব্রিজকে তুলে ধরেছে আর আমব্রিজ ছাড়া পাবার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছেন। তার হাতের জাদুদণ্ড অরণ্যের মাটির ওপোর পড়ে গেছে, হ্যারির বুকের ভেতরটা আশঙ্কায় দুরু দুরু করতে লাগলো। হ্যারি জাদুদণ্ডটা মাটি থেকে তোলবার আগেই একজন সেনট্যার ওটা নিয়ে টুকরো টুকরো করে দিলো।
পাকা চুলওয়ালা চোয়ালের সেনটার শক্ত করে হারমিওনের হাত চেপে ধরতেই পেছন থেকে অন্য একজন সেন্ট্রার বললো, ওরা ছেলে মানুষ, আমরা তো বাচ্চাদের কোনও ক্ষতি করি না।
–রোনান, ওটাই তো ওকে এখানে পথ দেখিয়ে এনেছে। ও শক্ত করে হ্যারির হাত ধরেছিল। না না ও বাচ্চা নয়, প্রায় বড়দের পর্যায়ে এসেছে।
ও হ্যারির গলা ধরে ঝাঁকুনি দিল।
হারমিওন অনুনয় করে বললো, দয়া করে আমাদের কোনও ক্ষতি করবেন না, মারধোর করবেন না। আমরা মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিকের কর্মী নই।
–আমরা ওকে এখানে এনেছিলাম যাতে আপনারা ওকে আমাদের হয়ে উচিত শিক্ষা দিতে পারেন।
যে পাকাচুলের সেনট্যার হারমিয়নের হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়েছিলো হ্যারি তার মুখ দেখে বুঝতে পারলো হারমিওন দারুণ ভুল করে ফেলেছে। ও হাতটা টেনে নিয়ে পেছনের পা দুটো অসম্ভব জোরে মাটি আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো, তুমি মনে করছো তোমার আদেশে আমরা কাজ করবো? তোমার শত্রুকে পোষা হাউন্ড কুকুরের তো তাড়িয়ে দেবো?
–না, আমি সে কথা বলিনি, হারমিওন বললো, আমরা ভেবেছিলাম তোমরা আমাদের সাহায্য করতে পারবে।
কিন্তু ওরা এতো রেগে রয়েছে যে কারও কথায় কান দিতে চায় না। পা ঠক ঠক করেই চলেছে, হাতের তীর ধনুক তাগ করে রেখেছে।
ঠিক সেই সময়ে অরন্যে ঢোকার মুখ থেকে ভীষণ শব্দ করে গাছপালা ভাঙা কট কট শব্দ শুনতে পেলো। ওদের হাত থেকে তীর ধনুক পড়ে গেলো। ওরা হ্যারি–হারমিওনের হাত ছেড়ে দিলো। ওরা দেখলো গ্ৰয়প ওদের দিকে ভীষণ এক মূর্তি করে এগিয়ে আসছে। আসার সময় গ্ৰয়প গাছপালা ভেঙে কাছে পিঠের জঙ্গল সাফ করে দিলো। হঁটের মতো হলুদ দাঁত বার করে হাসতে লাগল।
ও মুখ ব্যান করাতে মুখটা আরও বড়ো দেখালো। –হ্যাগার!
হ্যারি জানে না হ্যাগার বলতে গ্রপি কি বললো। অথবা সেটা কি ভাষা থেকে রূপান্তরিত হয়েছে।
–হ্যাগার, গ্রপি আবার চিৎকার করে উঠলো।
ও আরেকটু এগিয়ে যেতেই সেনট্যাররা ভীত হয়ে গেলো, হাতের তীর ধনুক মাটিতে পড়ে গেলো।
ম্যাগোরিয়ন বললো, দানব তুমি এখান থেকে চলে যাও, তোমাকে আমরা চাই না।
কথাটা গ্ৰয়পের মনে কোনও দাগ কাটলো না, আবার ভীষণভাবে গর্জন করে উঠলো–হ্যাগার!
হারমিওন বললো, হ্যারি, মনে হয় ও বলছে হ্যাগ্রিড! হারমিওন বললো–ও তাহলে আমাদের চিনতে পেরেছে।
–হার্মি! গ্রপ গর্জন করলো, হ্যাগার কোথায়?
হারমিওন বললো, আমি জানি না। আমি অতি দুঃখিত গ্ৰয়প, হ্যাগ্রিড এখন কোথায় আমরা জানি না।
কথাটা শুনে এয়প ওর একটা পায়ের চেয়ে আরও মোটা আরও বড়ো হাত ওদের দিকে এগিয়ে দিতেই হারমিওন ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতেই হুড়মুড় করে সেনট্যারদের গায়ের ওপোর পড়ে গেলো।
সেনট্যাররা খুব সম্ভব গ্ৰয়পের আক্রমণের অপেক্ষা করছিলো। এয়পের হাতের ওপোর ওরা বর্শার ফলার মতো তীর ঘন ঘন ছুঁড়তে লাগলো। যন্ত্রণা কাতর রক্তাক্ত গ্রয়প তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে দিলো। ও মুখটা প্রকাণ্ড হাতের চেটোতে মুছে নিয়ে সেনট্যারদের তীর-ধনুক সব কেড়ে নিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে দিলো।
হারমিওন-হ্যারি একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দেখলো গ্ৰয়পের সমস্ত শরীর থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে, তাতে ওর কোনও খেয়াল নেই। ওর ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে মনে হলো ও সেন্ট্যারদের জীবন শেষ করে দেবে। সেন্ট্যাররা আমব্রিজকে ধরে নিয়ে পালিয়ে গেলো। ওরা পালিয়ে গেলে আহত বাঘের মতো এয়প পাহাড়ের মতো দেহটা নিয়ে দাপাদাপি করতে লাগলো। নিমেষে সব ছোট বড়ো গাছ ভেঙে দিলো। তারপর ওদের তাড়া করলো।
হারমিওন বললো, হ্যারি আমার মনে হয় গয়প ওদের সবকটাকে মেরে ফেলবে।
হ্যারি বললো, আমার তো তাই মনে হয়। বেন তো আমব্রিজকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। একটু একটু করে গোলমাল বন্ধ হয়ে গেলো।
হ্যারির কপালটা ব্যথায়, উত্তেজনা করতে লাগলো শুধু নয়, কাটা দাগে জ্বালা যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেলো।
ওরা অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছে। সিরিয়স ও ভোল্ডেমর্টকে স্বপ্নে দেখার পর অনেকটা সময় কেটে গেছে। হ্যারির হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড নেই, অরণ্য থেকে ফেরার কোনও ট্রান্সপোর্টও নেই।
–দারুণ প্ল্যান করে এসেছিলাম এখানে, এখন বলো ফিরি কেমন করে। মিনিস্ট্রিতে যাই কেমন করে।
হারমিওন বললো, আমাদের প্রথমে ক্যাসেলে ফিরতে হবে।
–তার ভেতরে হয়তো সিরিয়সের মৃত্যু হবে, হ্যারি একটা গাছের ডালে ক্ষিপ্তের মতো লাফ মারতে মারতে বললো। ওর কানে এলো চটরপটর শব্দ, ঠিক মাথার ওপোর। হ্যারি দেখার জন্য মুখ তুললো। দেখতে পেলো একটা বাউট্রাকল। দেখে মনে হয় খুবই রেগে আছে। ও ওর লম্বা লম্বা আঙ্গুলগুলো ওদের দিকে প্রসারিত করে রেখেছে।
হারমিওন বললো, জাদুদণ্ড ছাড়া আমরা তো কিছুই করতে পারবো না। হ্যারি এখন ভাবো কেমন করে আমরা লন্ডন যেতে পারব। সে সময় ওদের পেছন থেকে খুবই পরিচিত গলায় কেউ বলে উঠলো।
–হ্যাঁ, আমরা ও ভাবছি।
হ্যারি, হারমিওন তৎক্ষণাৎ পেছনে গাছের দিকে তাকালো। ওরা দেখলোরন। রনের পেছনে জিনি, নেভিল আর লুনা। ওদের চেহারায় লাল ছড়ে যাওয়ার মত দাগ। জিনির চিবুক কাটা, নেভিলের ডানচোখের তলাটা ফোলা ফোলা, রনের ঠোঁট কেটে গেছে, কাটা জায়গা দিয়ে দরদর করে রক্ত বেরোচ্ছে। কিন্তু তাহলেও ওরা খুব খুশি, মনে হলো হ্যারির।
রন একটা গাছের ডাল সরিয়ে হাতে হ্যারির ম্যাজিক ওয়ান্ড নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বললো–কোনও কিছু ঠিক করলে?
হ্যারি আশ্চর্য হয়ে রনের হাত থেকে দণ্ডটা নিয়ে বললো, তোমরা ছাড়া পেলে কেমন করে?
–দু একটা স্টানস, একটা ডিসআর্মিং চার্ম, নেভিলের ছোট ইমপেডিমেন্ট জাদু, রন হারমিওনের হাতে ওর দণ্ডটা দিলো। কিন্তু জিনির জবাব নেই, ও ব্যাট বগি হেক্স দিয়ে ম্যালফয়কে কাবু করেছে। ওর সমস্ত মুখটা পৎপতে ডানা দিয়ে ঢেকে গিয়েছিলো। সে যাক আমরা জানালা দিয়ে তোমাদের নিষিদ্ধ অরণ্যের দিকে যেতে দেখেছিলাম। আমব্রিজ কোথায় গেলেন?
–একপাল সেনট্যার ওকে তুলে নিয়ে গেছে। জিনি একটু আশ্চর্য হয়ে গেলো। বললো, তোমাদের ছেড়ে দিলো? –গ্ৰয়পের তাড়ায় ওরা ওকে নিয়ে পালিয়েছে, হ্যারি বললো। লুনা বড়ো বড়ো চোখ করে বললো–গ্ৰয়প কে?
–হ্যাগ্রিডের ছোটো ভাই, যাকগে সেসব কথা, হ্যারি তুমি আগুনে কি দেখেছিলে? সিরিয়সকে সত্যি ধরেছে ইউ-নো-হু… অথবা…?
–হ্যাঁ, কথাটা হ্যারি বলতেই আবার ওর কপালের কাটাদাগে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেলো। আমি নিশ্চিত সিরিয়স এখনও বেঁচে রয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই মাথায় আসছে না, কেমন করে ওখানে গিয়ে ভোল্টেমর্টের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করবো।
কথাটা শুনে সকলেই চুপ, মুখে ভীতির ছাপ, দারুণ সমস্যা মনের মধ্যে দানা বেঁধেছে।
লুনা এমন একটা বাস্তব কথা বললো যে হ্যারি অন্তত ওর মুখ থেকে আগে শোনেনি, আমরা কী ওখানে উড়ে যেতে পারি না?
হ্যারি বললো, ঠিক আছে। প্রথম কথা হচ্ছে আমরা… আমরা বলতে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে নয়। দ্বিতীয় কথা হলো, রনের কাছে শুধু একটি ঝাড়ু আছে, সেটা আমব্রিজের সিকিউরিটি গার্ড দেয়নি। জিনি বললো, কেন আমার তো একটা আছে।
রন বললো, দুঃখের বিষয় তোমায় তো সঙ্গে নেওয়া যাবে না।
জিনি বললো, আমায় তোমরা ক্ষমা করবে, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি। সিরিয়সকে আমি তোমাদের কারও চাইতে কম ভালোবাসি না। ওর মুখে ফ্রেড আর জর্জের মতো দৃঢ়তার ছাপ দেখা গেলো। ইউ–নো-হুঁর সঙ্গে যখন তুমি পরশপাথর (ফিলোজফার স্টোন) নিয়ে লড়াই করেছিলে সেই সময় তোমার যা বয়স ছিলো এখন আমার তার চেয়ে তিন বছর বেশি বয়স, বুঝেছো? আর আমিই আমব্রিজের অফিসে ম্যালফয়কে কাবু করেছি জায়েন্ট ফ্লাইং বোগিস দিয়ে আক্রমণ করে।
–তা ঠিক, কিন্তু…।
নেভিল শান্ত স্বরে বললো, আমরা সকলেই ডার্কআর্ট (ডিএ) প্রতিরোধের সদস্য আমাদের একসঙ্গে ইউ নো-হুঁর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। তা না হলে বলতে হবে আমরা খেলা করেছি বা ওই রকম কিছু একটা।
হ্যারি অধৈর্য হয়ে বললো, না না অবশ্যই ওটা আমাদের খেলা নয়। লুনা খুব খুশিতে উপচে পড়ে বললো, ঠিক বলেছো।
হ্যারি রনের দিকে তাকালো, ও জানে রন ওরই মতো একই চিন্তা করছে। ও যদি তিনজন ছাড়া ডিএর সদস্য সিরিয়সকে ইউ-নোহর কবল থেকে বাঁচাবার জন্য অন্য কাউকে নেয়, তাহলে অন্তত জিনি, নেভিল অথবা লুনাকে নেবে না।
হ্যারি বললো, ঠিক আছে ও নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে লাভ নেই কারণ ওখানে কেমন করে যাবো তা এখনও ঠিক হয়নি।
লুনা বললো, কেন? আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা ঠিক হয়ে গেছে। আমরা তো উড়ে যাবো।
রন বললো, তুমি হয়তো ঝাড়ু ছাড়াই উড়ে যেতে পারবে, আমাদের তো সেই আর্ট জানা নেই।
লুনা গম্ভীর হয়ে বললো, ঝাড়ু ছাড়াও ওড়া যায়।
রন বললো, তাহলে তো আমার মনে হয় সুরক্যাক বা ওই রকম কিছু একটার পিঠে চেপে যেতে হবে।
লুনা গম্ভীরভাবে বললো, কোনো শিংওয়ালা সুরক্যাকরা উড়তে পারে না। হ্যাগ্রিড আমাকে বলেছেন, ওদের পিঠে যারা চাপে তারা উড়তে না পারলেও ওরা ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়।
হ্যারি দুটো বড়ো বড়ো গাছের মাঝে ঘুরে দাঁড়ালো। দুটো থেস্ট্রাল (রূপ কথার ডানা ওয়ালা ঘোড়া) ওদের কথোপোকথন শুনছিলো। উজ্জ্বল শুভ্র চোখে সেখানে এসে দাঁড়ালো যেনো ওদের কথাবার্তা বুঝতে পারছে।
–হা পারে! হ্যারি ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ওরা মাথা নাড়লো, কালো লম্বা ল্যাজ দোলালো। হ্যারি ওর হাতের কাছের একটা থেস্ট্রালের ঘাড়ের বাঁ দিকটা চুলকে দিয়ে বললো, কেন সকলে বলে ওদের দেখতে কুৎসিত?
রন যে থেস্ট্রালকে আদর করলো তার দিকে তাকিয়ে বললো, নাকে হাত না দিলে ওদের দেখতে পাবে না।
হ্যারি বললো, ঠিক বলেছো। –কটা নেবে? –আপাতত দুটো। হারমিওন বললো, তিনটে। ও তখনও ঠিক ধাতস্ত হতে পারেনি। –তিনটে নয়, চার, জিনি বললো।
লুনা বললো, আমরা গুনতিতে তো ছজন।
হ্যারি বললো, বোকার মতো কথা বলবে না। দুজনে যাওয়া সম্ভব নয়। কথাটা বলে নেভিলে জিনি আর লুনার দিকে তাকালো। এই ব্যাপারে তোমরা মোটেই ওয়াকিবহাল নয়, তোমরা যাবে না। ওরা তিনজনই প্রতিবাদ করলো। হ্যারির কাটা দাগ আবার টনটন করে উঠলো। এখন প্রতিটি মুহূর্ত ওদের কাছে। অতি মূল্যবান। তর্ক করার সময় নেই হ্যারির।
ও শেষকালে কাটা কাটাভাবে বললো–তোমাদের যা ইচ্ছে তাই করো। আমরা যদি আরও থেস্ট্রাল না পাই তাহলে মনে হয় তোমরা যেতে পারবে না।
–আমি বলছি আরও দুচারটে এসে যাবে, জিনি বললো। –তুমি কেমন করে বুঝলে?
–কারণ তোমরা লক্ষ্য করোনি, হারমিওন আর তোমার গায়ে রক্ত মাখামাখি। জিনি স্বাভাবিকভাবে বললো, আমি জানি হ্যাগ্রিড কাঁচা মাংস দেখিয়ে থ্রেস্টালদের ডাকেন। এই কারণেই দুটো থেস্ট্রাল এসেছে।
হ্যারির রোবে টান পড়তেই দেখলো একটা থেস্ট্রাল রোবটা টানাটানি করছে। ওর রোবের হাতাটা গ্ৰয়পের রক্তে ভেজা ছিলো।
–বাঃ চমৎকার ধরেছোতো! হ্যারি বললো, রন আর আমি এই দুটো থেস্ট্রালের ওপোর চেপে এগোই, হারমিওন এখানে থেকে আরও কয়েকটা থেস্ট্রাল জোগাড় করুক মাংস–রক্তের লোভ দেখিয়ে।
হারমিওন রেগে গিয়ে বললো–মোটেই না, আমি থেকে যাবো না।
লুনা বোকাবোকা হাসতে হাসতে বললো–তার কোনও দরকার নেই, ওই দেখো রক্তের গন্ধে আরও থেস্ট্রাল আসছে।
হ্যারি দেখলো কম করে ছটা থেস্ট্রাল এসে গেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে ওদের বড় বড় তেল চকচকে ডানা পিঠের দুপাশে গোটানো রয়েছে। অন্ধকারে ওদের চোখ জ্বলছে। এখন আর ওদের বেশি থেস্ট্রাল দরকার নেই।
–ঠিক আছে, যার যেটা ইচ্ছে বেছে নিয়ে পিঠে চেপে বসো, হ্যারি রেগে গিয়ে বললো।