1 of 2

৩৩. নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলের গৃহ

গৃহটি মনে হয় নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলের কিংবা তারও আগের, বয়সের যেন কোনো গাছ পাথর নেই। নবাব সিরাজউদ্দৌলা শহর কলকাতা আক্রমণ করে অনেক ঘর বাড়ি তোপ দেগে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন, এই বাড়িটিও বোধ হয় নবাবী সেনার তোপের মুখে পড়েছিল। দেউড়ি ভগ্ন, ছাদের এক পাশ হেলে পড়েছে, কোনো কোনো ঘরের দরজা-জানালা নেই। নিচেয় চাতালের যেখানে সেখানে শ্যাওলা-ধরা ইট-সুর্কির স্তুপ জমে আছে। কয়েকটি দেয়ালের পঞ্জর ভেদ করে মাথা চাড়া দিয়েছে বট-অশ্বত্থ গাছ। এককালে বাড়িটি বিশালাকারই ছিল অন্তত তিরিশটি প্রকোষ্ঠ, তার মধ্যে কিছু কিছু এখনো অক্ষত আছে, সেইসব প্রকোষ্ঠে ভারতের নানান প্রাস্তের, নানান জাতির, নানান ভাষার কিছু কিছু মানুষ বাসা বেঁধে আছে। জানবাজারের রানী রাসমণির প্রাসাদের পিছনে কিছু সংখ্যক খুপরি খুপরি দালান, কিছু গোলপাতার কুঁড়েঘর। আর কিছুটা দূরে নতুন নতুন সুদৃশ্য ভবন নির্মিত হয়েছে, যেসব ভবনে ইদানীং সাহেব ভাড়াটিয়ারা থাকে। এরই মধ্যবর্তী এই ভগ্ন অট্টালিকাটি।

এর দ্বিতলের অনেকগুলি ভাঙা ঘরের মধ্যে দুটি ঘর বেশ সাফ সূতরো করা। একটি ঘরে ঢালাও ফরাস ও তাকিয়া পাতা, সে ঘরটি যেন হট্টমন্দির, সেখানে কে কখন আসছে যাচ্ছে তার কোনো ঠিক নেই। অন্য ঘরটি আয়তনে অনেক বড়, তার এক পাশে সোফা কৌচ, অন্য পাশে পরস্পর যুক্ত কয়েকটি তক্তাপোশের ওপর জাজিম পাতা, মধ্যস্থলে লাল গালিচা, সেখানে কখনো কখনো নৃত্য প্ৰদৰ্শিত হয়।

নবীনকুমার একটা কৌচে হেলান দিয়ে বসে দেখছে এক পশ্চিম দেশীয়া যুবতীর নৃত্য। যুবতীটিকে ঠিক লাস্যময়ী বলা চলে না, তার নৃত্যের মধ্যেও মোহবিলাস নেই। প্রায় সর্বাঙ্গ ঢাকা অতিশয় আট পোশাক পরিধান করে আছে যুবতীটি, এক তবলিয়ার বোলের সঙ্গে সঙ্গে সে প্রায় অঙ্কের ছক মেলানোর মতন পদক্ষেপ করে যাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে সমের মুখে এসে সে এবং তবলিয়াটি একসঙ্গে বলে উঠছে, ধা!

এ জাতীয় নৃত্যবাদ্য বিশেষ দেখার বা শোনার অভ্যেস নেই বলে নবীনকুমার এর ঠিক রস গ্রহণ করতে পারছে না। সে হাতের মদিরার গেলাসে চুমুক দিচ্ছে মাঝে মাঝে, তার ভ্ৰদ্ধয় কুঞ্চিত। কোনো কিছু ঠিক মতন বুঝতে না পারলেই সে বিরক্ত হয়। এই নৃত্য পদক্ষেপ এবং তবলার বোলের অঙ্কগুলি তাকে অবশ্যই শিখতে হবে।

মাঝে মাঝে গোলোকরাম মুলুকচাঁদ এসে বলছেন, আরে লুবিনবাবু, গেলাস একদম খালি। আবার লিবেন তো! হামায় বুলবেন তো!

নবীনকুমার আপত্তি করে না, শূন্য গেলাসটি এগিয়ে দেয়। মুলুকচাঁদ আবার ভর্তি করে আনেন। মুলুকচাঁদের রসগোল্লার মতন গোল মুখখানি সদা হাস্যময়।

এই গোলোকরাম মুলুকচাঁদ হরিশ মুখুজ্যের বিশেষ প্রিয়পাত্র। হরিশ যখন প্রথম যৌবনে এক নিলামওয়ালার গুদামে চাকুরি করতেন, সেখানে ইনি ছিলেন তাঁর সহকমী। সেই জীবন থেকে হরিশ অনেক দূরে সরে এসেছেন, নিলামওয়ালার গুদামের সামান্য কেরানীর বদলে হরিশ এখন কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজের শিরোমণি। যেমন এ দেশীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ, তেমনই ইংরেজরা এক ডাকে তাঁর নাম জানে, তবু, হরিশ এই পুরাতন সহকর্মীর সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে চলেছেন। গোলোকরাম মুলুকচাঁদও আর সেই নিলামওয়ালার কর্মচারী নন, এক সময় তিনি নিজেই স্বতন্ত্রভাবে নিলামের কুঠি খুলেছিলেন, প্রায় পাঁচ ছয় বৎসর আগে হঠাৎ তাঁর ভাগ্য একেবারে ফিরে গেছে। এই জরাজীর্ণ অট্টালিকাটি তিনিই ক্ৰয় করেছেন। কিন্তু এটা মেরামত করার ব্যাপারে তাঁর কোনো উৎসাহ নেই।

গোলোকরাম মুলুকচাঁদ মানুষটি বড় বিচিত্র। অপরের সেবা করাই যেন তাঁর জীবনের একমাত্র আনন্দ। এই পড়ো বাড়ির মধ্যে কী করে যে অঢেল খাদ্য পানীয়ের সরবরাহ হয়, তা বোঝা দুষ্কর। মুলুকচাঁদ নিজে নিরামিষাশী, কিন্তু অতিথিদের জন্য তিনি নানাপ্রকারের সুপক্ক মাংসও পরিবেশন করেন। এক একদিন রাত বেশ গম্ভীর হলে, যখন শুধু অন্তরঙ্গ কয়েকজনই উপস্থিত থাকে, সেই সময় বসে নৃত্যগীতের আসর। এই পল্লীর আশেপাশে বারাঙ্গনা-নর্তকী-তয়ফাওয়ালীর কোনো অভাব নেই, একজন কারুকে ডাক পাঠালেই হলো। সকলেই জানে, মুলুকচাঁদ কোনোদিন কোনো রমণীর অঙ্গ স্পর্শ করেন না, কিন্তু তাঁর কোনো অতিথি এক একদিন এইসব রমণীদের সঙ্গে যতই বাড়াবাড়ি করে ফেলুক, মুলুকচাঁদ কোনো আপত্তি না করে মৃদু মৃদু হাসবেন। বয়েস চল্লিশ পার হয়ে গেছে। মুলুকচাঁদের গৌরবর্ণ শরীরটি বেশী দীর্ঘ নয়, উদারদেশ বেশ স্ফীত, কপালে ও দুই কানের লতিতে চন্দনের ফোঁটা। সারা বৎসর তাঁর পোশাক এক, আটহাতি ধুতি ও সাধারণ ফতুয়া, শীতকালে বড়জোর একটি মুগার চাদর জড়িয়ে নেন।

মুলুকচাঁদের আর একটি বৈশিষ্ট্য, তিনি এই শহরের জীবন্ত গেজেট। গঙ্গার অমনিঘাট ও তক্তাঘাটে প্রতিদিন কোন কোন জাহাজ ভেড়ে, তা তাঁর নখদর্পণে। হাওড়া-হুগলি রেলপথে কী কী মাল চালান যায়, তাও তিনি জানেন। চেতলার বন্দরে কিংবা পোস্তার বাজারে জিনিসপত্রের দর কেমন ওঠা-নামা করছে তার সঠিক সংবাদও মুলুকচাঁদের কাছ থেকেই জানা যাবে। শুধু তাই নয়, ইংরেজ রাজ-কর্মচারীদের ভিতরের খবর, বড় বড় সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলিতে কার কখন উত্থান-পতন হচ্ছে, সে সবও জানেন তিনি। আরও কত খুচরো খবর। রাজস্থান থেকে মুলুকচাঁদের তিন ভাই এসে ইদানীং বড়বাজার অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছে, কিন্তু তারা শুধুই ঘোরতর ব্যবসায়ী। আর মুলুকচাঁদজী সদানন্দ, হাস্যময়, অতিথিপরায়ণ, মজলিশী মানুষ।

হরিশের মুখে অনেকবার এই মুলুকচাঁদের কথা শুনেছিল নবীনকুমার। গল্প শুনলেই এরকম মানুষকে দেখতে ইচ্ছে করে। প্রায়ই সন্ধ্যার পর এখানে হরিশ আসে, নবীনকুমার একদিন হরিশের সঙ্গে এখানে আসতে চাওয়ায় তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ করেছিলেন। হরিশ। বাঁকাভাবে হেসে হরিশ বলেছিলেন, বিলো কী হে, তুমি যাবে সেখানে! সে এক ভাঙচুরো পড়ো বাড়ি, আস্তাকুড়ের ভেতর দিয়ে রাস্তা, সেখেনে কী আর তোমার মতন মানুষ যায়! আর মুলুকচাঁদেরও কী খেয়াল কে জানে, ও বাড়ি কিচুতেই মেরামত কর্বে না!

নবীনকুমার জিজ্ঞেস করেছিল, বন্ধু, তুমি যেতে পারো, আর আমি যেতে পারি না?

হরিশ কৃত্রিম বিস্ময়ে বলেছিলেন, তোমাতে আমাতে তুলনা? কীসে আর কীসে, চাঁদে আর হুলো বাঁদরের পৌঁদে! তুমি হলে গিয়ে জমিদার, আর আমি এক হা-ঘরে বামুনের বাড়ির ছেলে!

নবীনকুমার বলেছিল, জমিদারের পরিচয় কি কারুর গায়ে লেখা থাকে? জমিদার হয়িচি বলে কি যেখোনে খুশী সেখেনে যেতে পারি না?

হরিশ বলেছিলেন, তুমি জমিদারকুলের নাম ডোবাবে দেকচি! জমিদার কখনো যেখোনে সেখেনে যায়? তুমি নিজের বাড়িতে গ্যটি হয়ে বসে থাকবে, তোমার কাচে সবাই এসে হাত জোর কর্বে, এই হলো গে জমিদার! হ্যাঁ, তুমি যাবে কার কাচে, যে বংশমর্যাদায়, ধনে-মানে তোমার সমান কিংবা তোমার চেয়েও বড় তার কাচে। সেখেনেও যাবে হেক্কড়ের সঙ্গে, যত দামী শাল-দোশালা আচে সব গায়ে চাপিয়ে, হীরে-মুক্তো-চুনী-পান্নার আংটি-হার-মাদুলি সব পরে, সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে হইহই করে জুড়ি-চৌধুরী হাঁকিয়ে। তা না হলে আর জমিদার কিসের! একমাত্র ব্যতিক্রম মেয়েমানুষের বেলায়। শুনিচি অনেক জমিদার হাঁড়ি-মুচি-ডোমের ঘরেও মেয়েমানুষের টানে নুক্যে নুক্যে যায়, সে কতা আলাদা! আমার মতন এক খবরের কাগুচের কাচে তুমি যাতায়াত কর্চো, এতেই তোমার বদনাম রটবে, তার ওপর তুমি যেতে চাও জানবাজারের মুলুকচাঁদের আখড়ায়!

যেখানে বাধা, সেখানেই নবীনকুমারের জেদ। বাল্যকাল থেকেই নবীনকুমার মদ্যপানকে ঘৃণা করে এসেছে। তা কারুর উপদেশে বা নিষেধে নয়, নিজেরই রুচিতে। কিন্তু হরিশ যেদিন বললেন যে নবীনকুমার মদ্যপান করতে ভয় পায়, অচেনা কোনো জিনিসকে জানার সাহস তার নেই, সেদিনই সে ক্ষেপে উঠলো। নিজের কাছে করা প্ৰতিজ্ঞা ভেঙে সে সুরা গলাধঃকরণ করলো। প্রথম কয়েকদিন তার ঠিক সহ্য হয়নি, বমি হয়েছে বারংবার, কিন্তু হরিশের কাছে অপদস্থ হবার ভয়ে সে বমি মুছে আবার পান করেছে। কয়েক মাস কেটে যাবার পর এখনো সুরাপান তার ঠিক ধাতস্থ হয়নি, প্রথম প্রথম স্বাদ অত্যন্ত বিশ্ৰী লাগে, তবু জোর করে চালিয়ে যায়।

মুলুকচাঁদের আখড়া সম্পর্কেও নবনীকুমারের জেদ জেগে উঠলো। সে জমিদার হলেও অন্যান্য জমিদারদের রীতিনীতি সে অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে। সে সব পারে। একদিন জোর করেই হরিশের সঙ্গে চলে এসেছিলো এখানে।

প্ৰথম দর্শনেই, হরিশ পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই, মুলুকচাঁদ চিনতে পেরেছিলেন নবীনকুমারকে। সত্যিই বিস্ময়কর এই লোকটির ক্ষমতা। নবীনকুমারকে দেখেই বললেন, আসুন, আসুন। রামকমল সিংগী বাবুজীর পুতরা হামার কোঠিতে এসেছেন, কী সৌভাগ হামার! এ গরিবখানায় আপনাকে লিয়ে কুথায় বসাবো? বিন্ধু মুকারজিবাবু কেমন আছেন? আপনার মা-জননীর তবিয়ৎ স্বাস্থ্য ভালো আছে তো?

হরিশ বলেছিলেন, এ আমার বেরাদর, দোস্ত, সব কিচু। দেকো, এর যেন কোনো রকম অযত্ন না হয়। বড় মানী লোক।

মুলুকচাঁদ বলেছিলেন, আরে রাম রাম! হামাদের এই ভাঙা কোঠিতে বাবুজী লিজে এসে পা দিয়েছেন, সে কি আমাদের খাতিরের পরোয়া করবেন। উনি? সব কুছ লিজের বলে ধরে লিবেন।

প্রথম দিনই মুলুকচাঁদের আখড়ায় দুটি চমকপ্ৰদ খবর শুনল নবীনকুমার।

পানীয় খাদ্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করার পর মুলুকচাঁদ বললেন, আজ তো নানা সাহেব দশ বার মরে গিলেন!

হরিশ হাসতে হাসতে বললেন, তাই নাকি? তুমি গুনোচো, মুলুক?

মুলুকচাঁদ বললেন, হাঁ, জরুর। তুহার মনে নেই হরিশ, নওবারের বার নানাজী মরলেন গয়া টোন মে। আঠবার মরলেন মুথুরায়—।

হরিশ জিজ্ঞেস করলেন, তা এবার মরলেন কোথায় নানা?

মুলুকচাঁদ বললেন, আজ খাওবর এসেছে কি নানা সাহেব আউর একবার মরলেন নেপালে!

হরিশ বললেন, আরও কতবার মরেন উনি, দ্যাকে। আমি তো বোধ করি, উনি অন্তত একশো বার না মরে ছাড়বেন না!

মুলুকচাঁদ বললেন, তা ভি হতে পারে! ধুন্ধুপন্থ বহুৎ ধুরন্ধর আদমি আছে।

নবীনকুমারের এ সব কথাবার্তা সবই ধাঁধা বলে মনে হচ্ছিল। নানা সাহেবের বারংবার মৃত্যু সংবাদ রটনার বিষয়ে সে অবহিত ছিল না।

দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও চমকপ্ৰদ। কাফ্রিদের মতন চেহারার এক ব্যক্তি নাকি এক দরিয়ার ঘোড়া এনেচে কলকাতায় বড় মানুষের কাছে বেচতে।

হরিশ জিজ্ঞেস করলেন, দরিয়ার ঘোড়া আবার কী বস্তু?

মুলুকচাঁদ বললেন, সমুন্দর থেকে উঠে এসেছে এই ঘোড়া। বিলকুল পাক্কা সোনার মতন রঙ। এমুনি চমকদার ঘোড়া কেউ কভি দেখেনি।

হরিশ বললো, ধ্যেৎ! সমুদ্র থেকে আবার ঘোড়া উঠে আসে নাকি?

মুলুকচাঁদ বললেন, হাঁ আসে; কেনো আসবে না। সমুন্দর মনথনে ঘোড়া উঠে এসেছিল।

নবীনকুমারও অবিশ্বাসের হাসি হেসে উঠলো।

হরিশ নবীনকুমারের দিকে ফিরে বললেন, মুলুকচাঁদ কিন্তু কখনো পুরো আজগুবি কোনো সংবাদ বলে না। কিছুটা ভিত্তি থাকেই। মুলুক, তুমি ঘোড়াটা নিজের চোকে দেকোচো?

মুলুকচাঁদ বললেন, হাঁ, আপনা আঁখসে দেখেছি। পার্শীবাগানে বানধা আছে, তুমিও দেখতে পারো! দরিয়ার ঘোড়া কিনা জানি না, লেকিন এ এক আজিব জানিবার। আসলি সোনার মতন রঙ। দাম কত মাঙছে জানো?

–কত?

—এক লাখ রূপিয়া!

—তা হলে তো কালই একবার সন্ধান কত্তে হচ্চে! এক লাখ টাকা দিয়ে ঘোড়া কে কিনবে?

—সব ইমানদার বাবুরা দাম শুনে পিছু হটছে। লাখো রূপিয়া, বাপ রে বাপ! কাফ্রি লোকটা বলছে কি সে বর্ধমানের মহারাজার কাছে যাবে!

ঘরের একপাশ থেকে রাইমোহন নবীনকুমারকে উদ্দেশ করে বললো, আমাদের ছোটবাবু ইচ্ছে কল্লে কিনতে পারেন। এক লাখ টাকা তো ওঁর হাতের ময়লা!

নবীনকুমার ঘাড় ঘুরিয়ে রূঢ়ভাবে উত্তর দিল না, ঘোড়া কিনে বাজে খর্চা করার মতন ইচ্ছে আমার নেই!

হরিশ বললেন, দ্যাকো গে, ও ঘোড়ার গায়ের চামড়ায় একটু ঘষা দিলেই সোনার বদলে পোড়াকাঠের বর্ণ বেরিয়ে আসে কি না!

মুলুকচাঁদ বললেন, বহুৎ লোক দলাই মলাই করে দেখেছে। রং একদম পাকা। ঝিলকি দিচ্ছে। এইসান ঘোড়া আগে কেউ দেখেনি এ বাৎ ঠিক।

কিছুক্ষণ পরে কথাবার্তা আবার চলে গেল বিষয়ান্তরে।

এখানে রাইমোহন নিয়মিত আসে। এই বৃদ্ধের এখন আর কোনোখানে গতি নেই, যেখানেই মিনি মাগনায় সুরাপান করতে পারে সেখানেই গিয়ে পড়ে থাকে। হরিশ যে একে কী চক্ষে দেখেছেন কে জানে, এর সব দোষ তিনি ক্ষমা করেন। রাইমোহন মাতাল অবস্থায় হেড়ে গলায় শোনায়, হরিশ মুগ্ধ হয়ে তাই তারিফ করেন। রাইমোহনের নেশার টান পড়লে হরিশ অবলীলাক্রমে তার হাতে টাকা তুলে দেন। এখন রাইমোহন। এ জায়গাটির সন্ধান পেয়েছে, এখানে তার নিত্য আনাগোনা। নবীনকুমার এ লোকটিকে সহ্য করতে পারে না কেন যেন, কিন্তু হরিশের জন্য ওকে কিছু বলবারও উপায় নেই।

হরিশ অতিশয় কাজের মানুষ। সকাল থেকে সন্ধাব্যাপী তাঁর কাজের অবধি নেই, অথচ রাত্রের দিকে এখানে এসে যখন গা এলিয়ে বসেন, তখন মনে হয়। পৃথিবীর আর কোনো ব্যাপারে তাঁর শিরঃপীড়া নেই। মুলুকচাঁদের উদ্ভট গল্প, রাইমোহনের বাজে রসিকতা এবং বেসুরো গান তিনি বেশ উপভোগ করেন। সঙ্গে সঙ্গে সুরাপান। এই সব পরিবেশেই হরিশের চিত্ত-বিশ্রাম হয়।

মাঝে মাঝে হরিশ বলে ওঠেন, হাঁগো মুলুক, এখানে যে বড্ড মদ্দামানুষের গায়ের গন্ধ! আমি বেশীক্ষণ এত মন্দা গন্ধ সইতে পারি না। একটু সুরভী আনাও!

মুলুকচাঁদ অমনি শশব্যস্ত হয়ে উঠে দু-তিনজন নোকরকে পাঠিয়ে দেন। তারা কোনো নর্তকী ও তবলিয়াদের ডেকে আনে। এ পল্লীর সকলেই মুলুকচাঁদের আখড়া চেনে, অতিরিক্ত ইনামের আশায় তারা সাগ্রহে আসে।

ইংরেজী ভাষা ও ইংরেজী রচনা নিয়ে হরিশ সারাদিন নিযুক্ত থাকলেও এখানে এসে হরিশ পারতপক্ষে একটিও ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করেন না। আলাপচারির সময়। এবং তিনি দেশীয় গান ও উচ্চাঙ্গের নৃত্য-গীতের সমঝদার। তিনি ঠিক সমের মুখে মাথা ঝাঁকাতে পারেন, কখনো কখনো বাহবা দিয়ে নর্তকীদের উদ্দেশে টাকা ছুঁড়ে দেন।

নবীনকুমার এখানে আসে শুধু হরিশের টানে। সন্ধ্যা হলেই সে শ্ৰীকৃষ্ণের জন্য উৎকণ্ঠিতা রাধার মতন হরিশের টানে উচাটন হয়। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার কার্যালয়ে হরিশের দেখা না পেলে সে নিজেই সটান মুলুকচাঁদের আখড়ায় চলে আসে। ক্রমে ক্রমে মদের নেশাটিও জমে আসছে। এখানকার রঙ্গ রসিকতা এবং চতুর কথাবার্তাও তার বেশ পছন্দ। প্রথম প্রথম অবশ্য স্ত্রীলোকদের আগমনে সে আড়ষ্ট বোধ করতো। স্ত্রীলোক সম্পর্কে তার মনে কোনো বিকার জন্মায়নি। তার পত্নী সরোজিনীকে সে যথেষ্ট পছন্দ করে, সরোজিনীর কাছ থেকে সে যতটুকু পায়, তার বেশী নারীসঙ্গলিন্সা তার নেই। কিন্তু সরোজিনীর সঙ্গে খুব বেশীক্ষণ মানসিক আদান-প্ৰদান চলে না। সরোজিনীর জগৎটি বড় ক্ষুদ্র। পছন্দ মতন পুরুষ মানুষদের সাহচর্যেই নবীনকুমারের আত্মার স্মৃর্তি হয় বেশী।

যেহেতু সব ব্যাপারে নবীনকুমার এখন হরিশের অনুকরণ করতে শুরু করেছে, তাই সে এখন নৃত্য-গীতের সমঝদার হবারও চেষ্টা করতে লাগলো প্ৰাণপণে। গোড়ার দিকে এখানে এসে সে স্ত্রীলোকদের মুখের দিকে চাইতোই না, নাচের পালা এবং মাতালদের হল্লা এক সময় খুব বেড়ে উঠলে সে এখান থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিত বাড়ির দিকে। এখন সে সোজাসুজি এই সব স্ত্রীলোকদের দিকে তাকাতে পারে, তারা হাসি ছুঁড়ে দিলে সে উত্তর দেয় এবং হাততালি দিয়ে তাল দিতেও শিখেছে।

এই সব নর্তকীরা প্রায়ই বদলে যায়। ঘন ঘন নতুন মুখ দেখাই হরিশের পছন্দ। যে-কোনো নতুন রমণীর সঙ্গেই হরিশ ব্যবহার করেন অতি ঘনিষ্ঠের মতন, প্রথমেই তিনি তাদের নাম জেনে নেন এবং তারপর তাদের তুই সম্বোধন করে কথা বলেন। নবীনকুমারের মনে হয়, হরিশ বোধ হয় আসলে অন্তরে অন্তরে নারী বিদ্বেষী। জননী ও পত্নীর কাছ থেকে শান্তি পাননি বলেই সম্ভবত হরিশ পৃথিবীর আর কোনো রমণীকে শ্রদ্ধা করেন না। নারী তাঁর কাছে শুধুই যেন ভোগের সামগ্ৰী, তাদের আর যেন কোনো মূল্য নেই। প্রায়ই তিনি বলেন, মেয়েমানুষ হবে দু রকম, হয় নিজের সন্তানের গর্ভধারিণী অথবা নাচুনী। যে নর্তকীকে হরিশের খুব পছন্দ, যাকে বাহবা দেন অনেকবার, পরের দিন তাকেই আবার আনবার কথা উঠলে হরিশ মুখ ঝামটা দিয়ে বলে ওঠেন, কেন, আর কি নাচুনীর অভাব! একটা নতুন মুখ আনো না!

মুলুকচাঁদ সন্ধানও রাখে প্রচুর। হরিশ নতুন মুখ চাইলেই তিনি অমনি নতুন স্ত্রীলোক এনে দেন। হরিশের জন্য তিনি সব কিছু করতে প্ৰস্তুত! শুধু এক জায়গায় মুলুকচাঁদ হার মেনেছেন। রাইমোহন একদিন বললো, এত নাচনেওয়ালী তো দেকচি বাওয়া, কিন্তু এরা কেউই একজনের নোখের যুগ্য নয়! তাকে তো আনতে পাল্লে না!

মুলুকচাঁদ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, জানি, আপনি কার কথা হামাকে বলছেন। চেষ্টার কোনো কসুর করিনি, কিন্তু সে কেনো আসবে হামার এই গরিবখানায়। শুনেছি তো কোতো কোতো রাজা-মোহারাজাকেও সে দরওয়াজা থেকে ভাগিয়ে দেয়।

হরিশ প্রশ্ন করেন, কে? কে সে? রাইমোহন বললো, কমলি! সে মাগী বড় দেমাকী। বুড়ি হতে চল্লো, তবু দেমাক ছাড়ে না। মুলুকচাঁদ বললেন, কোমলাসুন্দরী নাম আছে সে জেনানার। হাঁ, উমর হয়েছে ঢের, তবু বড় খুবসূরৎ! আর নাচ করে খুব ভালো।

রাইমোহন রহস্যময় ভাবে চোখ মটকে বলে, এখেনকার একজন পারে তার দেমাক ভাঙতে। ইচ্ছে কল্লেই পারে।

এই কথা বলে সে নবীনকুমারের দিকে তাকায়। নবীনকুমার এ কথার অর্থ বুঝতে পারে না। সে চোখ সরিয়ে নেয়।

একদিন হরিশ এলেন বেশ দেরি করে। তাঁর কাগজের জন্য অনেক লেখা বাকি ছিল, সব সমাপ্ত করে তিনি ছাপাখানায় বুঝিয়ে দিয়ে এসেছেন। নবীনকুমার আগেই পৌঁছে গিয়েছিল এবং ইতিমধ্যেই তার দু-তিন গেলাস সুরা পান করা হয়ে গেছে। হরিশ এসে যোগ দিলেন তার সঙ্গে। প্রথমে কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়, নেশাটি ঠিক মতন না জমলে হরিশ নর্তকী আনবার কথা বলেন না।

নেশা মধ্য পযায়ে এসেছে, নর্তকীর প্রসঙ্গ উঠেছে এবং একজনকে আনবার জন্য নোকররাও বেরিয়ে গেছে। এই সময় মুলুকচাঁদ হরিশকে বললেন, ও একটা ভারি জবর খোবার বলতে বিলকুল ভুলে গিয়েছিলুম। হরিশ। এইমাত্র ইয়াদ হলো। কি, হামাদের লেফটেনাণ্ট গভরনর যো ছিল না, কালসে তার বদল হোয়ে গেলো। হ্যালিডে সাহেব আর থাকছেন না।

হরিশ চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ? হ্যালিডে আর লেফটেনাণ্ট গাভিনার থাকছেন না? কে আসছেন সে জায়গায়?

মুলুকচাঁদ বললেন, গ্রান্ট নামে সাহেব আছেন না? সে ওহি সাহেব।

হরিশ বললেন, জন পিটার গ্রান্ট। তিনি আসছেন? তুমি ঠিক জানো, মুলুকচাঁদ?

মুলুকচাঁদ বললেন, আমি ঠিক ছাড়া কি বুট বলি তোমাকে? কালই তো পহেলা তারিখ আছে না? কাল সে বদল হোচে!

হাতের গেলাসটি মাটিতে ঠিক করে নামিয়ে রেখে হরিশ বললেন, ওরে বাপ রে বাপ! এত বড় খবরটা তুমি আমায় এতক্ষণ বলোনি মুলুক? আমায় এক্ষুনি যেতে হবে।

নবীনকুমার অতি বিস্মিত হলো। লেফটেনাণ্ট গভর্নরের বদলের সংবাদে এতখানি কী গুরুত্ব আছে সে কিছুই বুঝলো না। এক সাহেবের জায়গায় আর এক সাহেব আসবে, এতে আর নতুনত্ব কোথায়?

তার প্রশ্নের উত্তরে হরিশ বললেন, তুমি বুঝতে পারলে না, নবীন? অবস্থা অনেক বদলে গেল! এই হ্যালিডে আমাদের কম ক্ষতি করেচে? আমি আশাও করিনি যে এ বিদায় নেবে! আমি নীলচাষীদের হয়ে লড়চি আর ঐ হ্যালিডে নীলচাষীদের দুশমন! সে সব সময় নীলকর সাহেবদের স্বার্থ দ্যাকে। সে সবচেয়ে বদমাস, নীলকরদের বেছে বেছে তাদের অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেটি ক্ষমতা দিয়েচে। বারাসতের ম্যাজিস্ট্রেট চাষীদের দুঃখ বোজেন, তিনি চাষীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটা আইন জারি করেচিলেন, এই হ্যালিডে ব্যাটা তার চাকরি খাওয়ার তালে ছেল। আমি চালুম, তোমরা থাকো।

নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, এত রাতে তুমি এজন্য কোথায় যাবে?

হরিশ বললেন, তুমি বুজতে পারচো না, অবস্থা কত বদলে গেল! আমার কাগজের সব লেখাগুলো পাল্টাতে হবে। এখুনি আবার নতুন করে লিকবো। জন পিটার গ্রান্ট বিচক্ষণ ভালোমানুষ, তাঁর সামনে নীলচাষীদের প্রকৃত চিত্র তুলে ধর্তে হবে। গ্ৰাণ্ট সাহেবকে যদি দলে পাই তবে এবার নীলকরদের সঙ্গে শুরু হবে আমাদের সত্যিকারের লড়াই।

কর্তব্যের ডাক পড়লে হরিশ আর দ্বিধা করেন না। হাতের মদের পাত্র ফেলে, নাচ গানের আসর ছেড়ে তিনি তখনই আবার চলে গেলেন হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার অফিসে।

সে রাতে নবীনকুমারেরও আর বাড়ি ফেরা হলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *