৩৩. দ্য ডেথ ইটারস
ভোল্ডেমর্ট হ্যারির দিকে না তাকিয়ে নিজের শরীর দেখতে লাগলেন। ওর হাত দুটো অনেকটা লম্বা মলিন মাকড়সার মতো, সরু সরু সাদা লম্বা আঙ্গুলগুলো বুকের ওপরে বিন্যস্ত, যেন নিজেকে নিজে আদর করছে। ওর দুহাত, ওর মুখ, লাল বর্ণ দুচোখ, চোখের মণি দুটো লম্বালম্বিভাবে কাটা বেড়ালের চোখের মতো অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। হাত তুলে আঙ্গুলগুলো বাঁকালেন ভোল্ডেমর্ট, চোখে মুখের ভাবমোহিত আর উল্লসিত বিজয়ী। ভোল্ডেমর্ট ওয়ার্মটেলের দিকেও তাকালেন না। ও তখন কবরস্থানের মাটিতে শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে আর কাটা স্থান থেকে গলগল করে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সাপদের দিকেও তাকালেন না ডভান্ডেমর্ট। সাপগুলো তখন ফিরে এসে হ্যারিকে ঘিরে ভয়ঙ্করভাবে হিস হিস শব্দ করে চলেছে। ভোল্ডেমর্ট তার অস্বাভাবিক একটা লম্বা হাত বড় একটা পকেটে পুরে দণ্ডটা টেনে বের করলেন। জাদুদণ্ডের গায়ে সস্নেহে হাত বোলালেন, তারপর দণ্ডটাকে তুলে সোজা ওয়ার্মটেলের দিকে প্রসারিত করলেন। তারপর ঐন্দ্রজালিক শক্তিতে ওকে মাটি থেকে তুলে সোজা হ্যারির পাশে ছুঁড়ে দিলেন। ও কবরের পাদদেশে পরে শরীরটাকে কুঁকড়ে মুড়ে আগের মতই একঘেঁয়ে কাঁদতে লাগল। তারপর ভোল্ডেমর্ট টকটকে লাল চোখে হ্যারির দিকে তাকালেন–মুখে তার হিমশীতল, অস্বাভাবিক এক আনন্দের হাসি।
ওয়ার্মটেলের আলখেল্লা রক্তে ভিজে লাল। আলো পড়ে রক্তমাখা জায়গাটা চকচক করছে, ও হাতের তালু কাটা জায়গায় চেপে রেখেছে। রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, প্রভু, আমার প্রভু… আপনি প্রতিজ্ঞা, আপনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন…।
তোমার হাত সরাও, ভোল্ডেমর্ট তাচ্ছিল্য করে বললেন।
হা হা প্রভু… ধন্যবাদ প্রভু…।
ওয়ার্মটেল রক্তমাখা একটা হাত তুলল; কিন্তু ভোল্ডেমর্ট আবার সেই রকম কুর হাসি হাসলেন।–অন্য হাতটা ওয়ার্মটেল।
প্রভু… অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করবেন।
ভোল্ডেমর্ট নিচু হয়ে ওয়ার্মটেলের বাঁ–হাতটা ধরে সরালেন। জোর করে হাতটা কনুই পর্যন্ত টেলে তুললেন, হ্যারি দেখল ওর হাতে খুলির উল্কি। উল্কির রং লাল। খুলির মুখ থেকে একটা সাপ ফণা তুলে রয়েছে। হ্যারি কিডিচ ফাইনাল খেলার সময় ওই রকম একটি ডার্কমার্কের সাপ দেখেছিল। ওয়ার্মটেলের কান্না তোয়াক্কা না করে ভোল্ডেমর্ট সেই উল্কিটা পরীক্ষা করতে লাগলেন।
ভোল্ডেমর্ট খুব আস্তে বললেন, তাহলে তারা সকলেই জেনেছে আবার ফিরে এসেছে, এখন আমরা দেখব, আমাদের জানতে হবে।
কথাটা বলে ভোল্টেমর্ট তার হাতের লম্বা একটা আঙ্গুল দিয়ে ওয়ার্মটেলের হাতের উল্কিতে চাপ দিলেন।
তখনই হ্যারির কপালের কাটা দাগে তীব্র ব্যাথা করে উঠল। ওয়ার্মটেলও ককিয়ে উঠল! ভোল্ডেমর্ট ওয়ার্মটেলের হাতের উল্কির দাগ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। হ্যারি দেখল উল্কির রংটা কুচকুচে কাল হয়ে গেছে।
মুখে নিধুর সাফল্যের হাসি এনে ভোল্ডেমর্ট সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মুখটা ঘুরিয়ে অন্ধকারে কবরগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
এদের মধ্যে কজন সাহসী ইচ্ছে করলে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে? ভোল্ডেমর্ট আপনমনে ফিস ফিস করে বললেন। মৃদুদীপ্ত চোখে আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন…, কতজন মৃর্থ আছে যারা পিছিয়ে যাবে?
ভোল্ডেমর্ট উত্তেজিতভাবে হ্যারি আর ওয়ার্মটেলের সামনে পায়চারি করতে লাগলেন। চোখের দৃষ্টি কবরস্থানের ওপরে। মিনিট দুই পরে হ্যারির দিকে তাকালেন। সাপের মতো মুখে নিধুর হাসি ফুটে উঠল।
হ্যারি পটার তুমি আমার মৃত বাবার ভগ্ন কবরের ওপর দাঁড়িয়ে আছ, ভোল্ডেমর্ট খুব আস্তে হিস হিস করে বললেন। তোমার প্রিয় মায়ের মতো তিনি মাগল ও মূৰ্থ ছিলেন। কিন্তু দুজনেই তাদের কিছু কর্তব্য করেছিলেন। তোমার মা শিশু অবস্থায় তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন… আর আমি আমার বাবাকে হত্যা করেছিলাম। এখন দেখ কতটা সে নিজেকে প্রয়োজনীয় প্রমাণ করেছেন তারা মৃত্যুর মধ্যদিয়ে।
ভোল্ডেমর্ট আবার পিশাচের মতো হাসলেন। এখন তিনি পায়চারি করছেন আর তার দৃষ্টি হ্যারির ওপর। সাপটা ঘাসের ওপর গোলাকার বৃত্ত করে ঘুরছে। পটার তুমি কী ওই পাহাড়ের কোলে জীর্ণ বাড়িটা দেখতে পাচ্ছ? আমার বাবা ওখানে থাকতেন। আমার মা একজন ডাইনি (জাদুকরি) ছিলেন। একই গ্রামে থাকতেন। বাবার প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু আমার মা বলেছিলেন তিনি জাদুকরি। আমার বাবা জাদু ভালবাসতেন না। পটার, আমার বাবা, আমার জন্মের আগে আমার মাকে ফেলে তার মাগল বাবা-মার কাছে ফিরে গেলেন। আমাকে জন্ম দিলেন মা… মারা গেলেন… অনাথ বালক আমি… তাই মাগলদের পরিচালিত অনাথ আশ্রমে লালিত–পালিত হতে থাকলাম। কিন্তু মাকে ছেড়ে চলে যাওয়াতে বাবা খোতর অপরাধ করেছিলেন… আমি মার প্রতি অবিচারের প্রতিহিংসা নিয়েছিলাম… সেই মূর্খটা, যে তার নামে আমার নামকরণ করেছিল টম রিডল। ভোল্ডেমর্ট এখনও ক্ষিপ্ত নেকড়ে বাঘের মতো কবরের চার পাশে হাঁটতে লাগলেন। চোখ তার অন্ধকারে ভগ্নপ্রায় বাবার কবরের ওপর।
আমার কথা শোন, তোমাকে আমার পরিবারের কথা বললাম, ভোল্ডেমর্ট শান্ত ভাবে হ্যারিকে বললেন, আমি জন্ম থেকেই স্পর্শকাতর… দেখ, হ্যারি! আমার সত্যিকারের পরিবারের সবাই এখন ফিরবে।
হঠাৎ কবরস্থানের বাতাস শোঁ শোঁ শব্দে যেন প্রবল ঝটকা বাতাসের সাথে কতগুলো আলখেল্লা দৃশ্যমান। প্রতিটি কালো পাতা গাছের ছায়ার তলায় জাদুকররা জাদুটোনা করতে প্রস্তুত। সকলেরই শরীর বোরখায় ঢাকা, মুখে মুখোশ। একের পর এক ওরা গাছতলা ছেড়ে যাচ্ছে… ধীরে, অতি ধীরে…। এত ধীরে যে তারা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারবে না। ভোর্টে নীরবে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ওদের মধ্যে একজন ডেথইটার (ওরা জ্যান্ত মানুষের বুকে চেপে প্রাণ ও রক্ত শুষে নেয়) ভোল্টেমর্টের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল… তার কালো আলখেল্লার তলদেশ (হেম) চুম্বন করলেন।
মাস্টার… মাস্টার… রক্তচোষা (ডেথইটার)! বাকি সব ডেথইটাররা হেঁট হয়ে ভোল্টেমর্টের পায়ে চুম্বন করে টম রিডিলের কবরকে কেন্দ্র করে গোলাকার বৃত্ত করে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইল। তাদেরও দেহ আচ্ছাদনে আবৃত, মুখে মুখোশ। দাঁড়াবার সময় কিছু অংশ ফাঁকা রাখল হয়ত আরও কোনও ডেথইটারদের প্রতীক্ষায়। ভোল্টেমর্টের মুখ দেখে মনে হল তিনি আর কোনও ডেথইটারদের আশা করছেন না। ভোল্ডেমর্ট ওদের মুখোশাবৃত মুখের দিকে তাকাতেই ওদের মুখগুলো মনে হল বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে, অথচ একটুও বাতাস বইছে না। তাহলে তো ওরা কাঁপছে, হ্যারির মনে হল।
ভোল্ডেমর্ট বললেন, স্বাগতম ডেথইটারস, তের বছর, তের বছর পর তোমাদের সঙ্গে আবার আমি মিলিত হলাম। তোমরা যেন গতকাল আমার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলে এমনভাবে আমার ডাকে সাড়া দিয়েছ।… আমরা আজও ডার্কমার্কের ছত্রছায়ায় একত্রে মিলিত। সত্য না অসত্য?
ভোল্ডেমর্ট মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হাঁচলেন। হাঁটার সময় তার ক্ষুদ্র নাকের গর্ত দুটো সামান্য বিস্ফোরিত হল।
আমি যেন অপরাধের গন্ধ পাচ্ছি, ভোল্ডেমর্ট বললেন, বাতাসে অপরাধের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে। দ্বিতীয়বার সমবেত ডেথ ইটাররা শিউরে উঠল। যদিও এ ভীতি সকল সময়ই ছিল, কিন্তু কেউ–ই তার কাছ থেকে কেটে পড়েনি বা কেটে পড়ার সাহস করেনি।
তোমাদের সকলে সময়মত আমার সামনে উপস্থিত দেখে মনে হয় সকলেই ভাল ও সুস্থ আছ। কিন্তু আমি নিজেকে প্রশ্ন করছি, কেন তারা তাদের প্রভুর সাহায্যের জন্য কখনো এগিয়ে আসেনি, এটাই কি আমার প্রতি তাদের একান্ত আনুগত্য?
সকলেই নীরব। এক চুলও কেউ নড়েনি, শুধু ওয়ার্মটেল মাটিতে শুয়ে একইভাবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। তখনও ওর হাতের রক্তপাত বন্ধ হয়নি।
বেশ, আমি আমার প্রশ্নের জবাব আমি দিচ্ছি। আমার অবর্তমানে আমার কিছু বিশ্বস্ত অনুগামী আমার শক্রদের সঙ্গে শুধু যোগই দেয়নি। আমার বিরুদ্ধে কাজও করেছে, আর এখন সাধু সাজছে। এমন এক ভাব দেখাচ্ছে যে তারা কিছুই জানে না!
আবার নিজেকে প্রশ্ন করছি, তারা কেমন করে ভাবলো যে, আমি আবার শক্তিশালী হব না? তারা কি জানতো না, মৃত্যু থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য কি কি পথ অবলম্বন করে রেখেছিলাম? তারা কী আমার সেই সময়ের অসামান্য শক্তি সম্বন্ধে কিছুই জানতো না? যেকোনও জীবিত জাদুকরের মধ্যে আমি কত শক্তিশালী ছিলাম তোমরা অবশ্যই জানতে।
–আমি এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি, তারা ভেবেছিল আরও একটি শক্তিশালী জাদুকর থাকতে পারে, লর্ড ভোল্টেমর্টের বিনাশ করতে পারে, হয় তারা অন্য একজনের কাছে অনুগত, হয়তো সেই মূর্খ ডাম্বলডোরের কাছে, যে নগণ্যদের কাছে এবং মাডব্লাডস আর মাগলদের কাছে শ্রেষ্ঠ। হ্যাঁ সেই অ্যালবাস ডাম্বলডোর হোগার্ট স্কুলের নগণ্য এক হেডমাস্টার!
ডাম্বলডোরের নাম উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ডেথইটাররা সামান্য নড়াচড়া করল, মাথা নাড়ল।
ভোল্ডেমর্ট তাদের বুঝতে পারেনি, আমার কাছে ওটা হতাশা তো বটেই, আমি স্বীকার করি আমি অতি মাত্রায় হতাশ হয়েছি, ভুল করেছি বিশ্বাসঘাতকদের বুঝতে না পেরে।
ডেথইটারদের মধ্য থেকে একজন বেরিয়ে এসে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাঁপতে কাঁপতে লর্ড ভোল্টেমর্টের পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মাস্টার। মাস্টার আমাকে ক্ষমা করন, আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন।
ভোল্ডেমর্ট হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে হাতের জাদুদণ্ড তুলে বললেন, ক্রুসিও!
ভুলুণ্ঠিত ডেথইটার ভীষণ চিৎকার করে ভোল্ডেমর্টের পায়ের তলায় ছটফট করতে লাগল। হ্যারি ওর চিৎকার শুনে মনে হলো, আশপাশের বাড়িতে যারা থাকে, তারা নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছে ডেথইটারের মর্মভেদী কান্নার শব্দ! তারা পুলিশ নিয়ে অবিলম্বে আসুক, যা হোক, যেমন করে হোক একটা কিছু করুক।
ভোল্ডেমর্ট আবার তার জাদুদণ্ড তুললেন, ডেথইটার বড় বড় শ্বাস–প্রশ্বাস ফেলতে লাগল, মুখ দিয়ে তার ফেনা বেরোতে লাগল।
ভোল্ডেমর্ট মোলায়েম সুরে বললেন, অ্যাভেরি উঠে দাঁড়াও, হ্যাঁ, তুমি কী বলছিলে, ক্ষমা? শোন আমি ক্ষমা করি না, কোনও কিছু ভুলিও না। তের বছর, দীর্ঘ তেরটা বছর, তের বছরের পরিশোধ চাই তোমাদের ক্ষমা করার আগে। ওই ওয়ার্মটেল ইতোমধ্যে কিছুটা পরিশোধ করেছে, কি হে করোনি ওয়ার্মটেল?
ভোল্ডেমর্ট ওয়ার্মটেলের দিকে তাকালেন। ওয়ার্মটেল তখনও কাঁদছে, হাতের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে।
–হ্যাঁ প্রভু, ওয়ার্মটেল গুঙিয়ে গুঙিয়ে বলল, দয়া করন প্রভু, দয়া করন আমাকে…।
–হ্যাঁ, অবশ্যই তুমি আমার দেহ ফিরে পেতে সাহায্য করেছ, ওয়ার্মটেলের দিকে তাচ্ছিল্য দৃষ্টি দিয়ে বললেন। তুমি অপদার্থ ও বিশ্বাসঘাতক হলেও… আমাকে সাহায্য করেছ যারা সাহায্য করেছে অবশ্যই তাদের লর্ড ভোল্ডেমর্ট পুরস্কার দেয়।
ভোল্ডেমর্ট আবার তার হাতের জাদুদণ্ড তুলে বাতাসে আন্দোলিত করলেন। গলিত রূপোর মতো কিছু পদার্থ দণ্ডের শেষ ভাগ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। আকারবিহীন সেই রূপোর মতো জিনিসটা, মুহূর্তের মধ্যে পাক খেতে খেতে একটা মানুষের হাতে পরিণত হয়, চাঁদের আলো পড়ে সেই হাতটা চকচক করতে লাগল। তারপর ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে ওয়ার্মটেলের কাটা কব্জিতে জুড়ে গেল।
ওয়ার্মটেলের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না থেমে গেল, শ্বাস–প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে গেল। ও বিস্ময়ভরা দুচোখে চকচকে হাতটা দেখতে লাগল, এমনভাবে যেন বিশ্বাসই হয় না তার। ও চকচকে আঙ্গুলগুলো দুমড়োতে লাগল, তারপর কাঁপতে কাঁপতে সেই হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা এক টুকরো গাছের ডাল তুলে নিয়ে সেটাকে চাপ দিয়ে চূর্ণ করলো।
ও আনন্দে অধীর হয়ে বলল, হে প্রভু, কি সুন্দর… ধন্যবাদ–ধন্যবাদ, আপনাকে।
তারপর ভোল্টেমর্টের কাছে হাঁটু গেড়ে এসে তার আলখেল্লার শেষ প্রান্তের একাংশ ঠোঁট বেকিয়ে চুম্বন করতে লাগল।
ওয়ার্মটেল ভবিষ্যতে আমার প্রতি আনুগত্য যেন অটুট থাকে, ভোল্ডেমর্ট কঠিন স্বরে বললেন।
–কখনই… প্রভু… কখনই বিচ্যুত হবে না, আমার প্রভু।
তারপর ওয়ার্মটেল ডেথইটারদের দলে যোগ দিয়ে, পুলকিত হয়ে বারবার নতুন চকচকে হাতটা দেখতে লাগল। তখনও ওর চোখের জল চন্দ্রালোকে ঝিকমিক করছে। ভোল্ডেমর্ট এগিয়ে এসে ওয়ার্মটেলের পাশে দাঁড়ানো লোকটির সামনে দাঁড়ালেন।
ভোল্ডেমর্ট ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, লুসিয়াস, আমার অনির্ভর বন্ধু, আমি শুনলাম এখনও তুমি তোমার পুরনো অভ্যাস ত্যাগ করতে পারনি; যদিও সকলের কাছে তুমি খুবই সম্মানিত মানুষ। তুমি, আশা করি এখনও মাগল সংহারের নেতৃত্ব নিতে পার। আমার তো তাই বিশ্বাস? তা সত্ত্বেও তুমি এই দীর্ঘ তের বছরে আমাকে খোজার কোন চেষ্টা করোনি, লুসিয়স, আমি নিশ্চিত বলতে পারি কিডিচ ওয়ার্লড কাপে যা করেছিলে সেটা হাসির খোঁড়াক ছাড়া কিছুই নয়। দুঃখের বিষয় তোমার সাহস–শক্তি তোমার প্রভুকে খোঁজার ও সাহায্যে ব্যবহার হয়নি…।
মুখোশ পড়া অবস্থায় লুসিয়স ম্যালফয় বলল, আপনার কোন চিহ্ন, কোনও আভাস, বা আপনার ঠিকানা জানতে পারলে এই ভূত্যকে সেই মুহূর্তে আপনার পাশে দাঁড়াতে ও সাহায্য করতে কোনো কিছু রুখতে পারতো না।
গত গ্রীষ্মে যখন আমার একটি ডেথইটার আমার মার্ক নিক্ষেপ করেছিল, তখন তুমি পালিয়েছিলে? ভোল্ডেমর্ট তাচ্ছিল্য করে বললেন। ম্যালফয় সহসা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। হা লুসিয়াস, আমি সব জানি, তুমিও আমাকে হতাশ করেছ, ভবিষ্যতে তোমার কাছ থেকে কি বিশ্বস্ত কাজ আশা করতে পারি?
অবশ্যই লর্ড, অবশ্যই, আপনি অতি মহানুভব দয়ালু, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
ভোল্ডেমর্ট হাঁটতে হাঁটতে ম্যালফয় আর তার পাশের মুখোশ পরা লোকটির মাঝে জায়গাতে অন্তত দুজনের অভাব দেখে সেদিকে তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকালেন। লেস্টাররেঞ্জেরসদের এখানেই তো দাঁড়ানোর কথা, ভোল্ডেমর্ট অতি উদাসিনভাবে বললেন, অথচ ওদের এখন আজকাবানে কবর দেয়া হয়েছে।
সত্যিই তারা আমার খুবই বিশ্বস্ত মানুষ ছিল। ওরা আমাকে ত্যাগ করেনি বলেই আজকাবান কারাগারে ছিল, আমি যখন আজকাবান জেলখানা ভেঙে চূর্ণ করে দেব তখনই তাদের যথাযযাগ্যভাবে সম্মানিত করব। এমন সম্মান যা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। ডেমেন্টরসরা আমার সাথ দেবে, ওরা আমাদের বন্ধু। আমরা আমাদের মধ্যে নির্বাসিত দানবদের নিয়ে আসব, আমি চাই আমার সব বিশ্বস্ত অনুগামীরা আমার কাছে ফিরে আসুক, এমন এক জীবন্ত প্রাণীদের সৈন্যদল, যাদের নাম শুনলে লোকেরা শিউরে উঠবে আতঙ্কে।
কিছু ডেথইটারদের সামনে দিয়ে চলতে চলতে থামলেন, তাদের সঙ্গে দুএকটা কথাও বললেন।
ম্যাকনায়ার, ওয়ার্মটেল বলছে তুমি নাকি ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হয়ে ভয়ংকর সব জম্ভজানোয়ারের নিধনের কাজকর্ম করছ? তুমি এখন তাদের চাইতে শীঘ্রই আরও ভাল জীবন্ত প্রাণী পাবে ম্যাকনায়ার, লর্ড ভোল্ডেমর্ট তোমাকে তা দেবে।
ধন্যবাদ, মাস্টার… অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, ম্যাকনায়ার বলল।
তারপর আবরণে ঢাকা সবচাইতে বিরাট শরীরের দুজনের কাছে দাঁড়ালেন, ও হা ক্রাব আর গোয়েল, তোমরা দুজনেই আশা করি আগের চাইতে ভাল কাজ করতে পারবে। তাই না গোয়েল?
ওরা দুজনেই মাথা নত করল।
ইয়েস মাস্টার….।
নিশ্চয়ই করব, মাস্টার।
আর নট, তোমাকেও বলি একই কথা, ভোল্ডেমর্ট বললেন। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে গোয়েলের ছায়ার সামনে দাঁড়ালেন।
প্রভু, আমি আপনার সামনে প্রতিজ্ঞা করছি, অবনত হয়ে বলছি, আমি আপনার একজন অতি বিশ্বস্ত অনুচর, নট বলল।
তারপর ভোল্ডেমর্ট ওদের মাঝখানে ফাঁকা স্থানে এসে দাঁড়ালেন। চোখ তার রক্তবর্ণ… যেন সেই ফাঁকা জায়গার চারদিকে লোকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের যেন দেখতে পান।
এখানে ছয় জন ডেথইটারদের দাঁড়াবার কথা। ছজনের মধ্যে তিনজন আমার কাজে মারা গেছে, একজন কাওয়ার্ডকে ফিরিয়ে আনতে হবে, তার জন্য তাকে তার পাওনা দিতে হবে একজন চিরকালের জন্য আমাকে ছেড়ে গেছে, ফিরলে তাকে অবশ্যই হত্যা করা হবে। বাকি একজন আমার বিশ্বস্ত ভৃত্য। সে ইতোমধ্যে আমার কাজে যোগ দিয়েছে।
কথাগুলো শুনে ডেথইটাররা শিউরে উঠল, হ্যারি দেখল মুখোশ পরা অবস্থায় তারা পাশের লোকদের দিকে তীর্যকভাবে তাকাচ্ছে।
সে এখন হোগার্টে কাজ করছে, বিশ্বস্ত ভৃত্য! তারই সহায়তায় আমি আজ রাতে আমার এই ছোট বস্তুটিকে পেয়েছি।
হ্যাঁ, ভোল্ডেমর্ট বললেন। বলার সময় তার ঠোঁটবিহীন মুখটা সামান্য নড়ল।
চোখের দৃষ্টি হ্যারির ওপর।–হ্যারি পটার আমাদের দলের নবজনের আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে এসেছে। খুব বেশি সময়ের জন্য নয়, তাহলেও বলতে পার ও আমাদের একজন গেস্ট অব অনার (সম্মানীয় অতিথি)।
নিস্তব্ধ কবরস্থান। ওয়ার্মটেলের ডানদিকে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ডেথইটার এগিয়ে এল, লুসিয়স ম্যালফয়ের কণ্ঠস্বর মুখোশের আড়াল থেকে শুনতে পেল হ্যারি।
মাস্টার, আমাদের জানার জন্য মন বড় চঞ্চল, আপনার কাছে আমরা জোড় হাতে জানতে চাইছি–বলুন, কেমন করে এই অলৌকিক কাজ সম্ভব হল, কেমন করে আবার আপনি আমাদের মধ্যে ফিরে এলেন।
লুসিয়াস, বড় সুন্দর ঘটনা, ভোল্ডেমর্ট বললেন। আমার কথাটি শুরু ও… কথাটি শেষ হল… আমার এই ছোট বন্ধুটি দিয়ে।
কথাটা বলে ভোল্ডেমর্ট কবরের বেদিতে যেখানে হ্যারি দাঁড়িয়েছিল, সেখানে ধীর পদক্ষেপে গেলেন। এমন স্থানে যেয়ে দাঁড়ালেন যাতে গোল হয়ে দাঁড়ানো ডেথইটার ও মুখোশধারীরা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা যেন ভোল্ডেমর্ট আর হ্যারিকে ভাল করে দেখতে পায়। সাপটা তখনও হ্যারির চারপাশে ঘুরছে।
–অবশ্যই তোমরা সকলেই জান, এই ছেলেটাই আমার পতনের কারণ! ভোল্ডেমর্ট তার রক্তচক্ষু হ্যারির দিকে তাক করে ধীরে ধীরে বললেন। হ্যারির দিকে ভোল্ডেমর্ট তাকাতেই হ্যারির কপালের কাটা দাগে আবার যন্ত্রণা শুরু হল। অসম্ভব জ্বালা করতে লাগল। এত তীব্র যে ও ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। তোমরা এটাও জান যে রাতে আমি আমার সব ক্ষমতা হারিয়েছিলাম, শরীর হারিয়েছিলাম, সেদিন আমি ওকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলাম। ওর মা ওকে বাঁচাতে গিয়ে মারা পড়ল এবং ওকে সুরক্ষা দিয়ে গেল। আমি এতটা বুঝতেও পারিনি অবশ্য… আমি ছেলেটাকে ছুঁতে পর্যন্ত পারিনি।
ভোল্ডেমর্ট ওর হাতের একটা লম্বা সাদা আঙ্গুল তুলে হ্যারির চিবুকে ঠেকালেন… ওর মা তার ত্যাগের চিহ্নস্বরূপ এই ছেলেটা রেখে গেল… তার ত্যাগ পুরানো জাদুবিদ্যা। আমার সে কথা জানা উচিত ছিল… আমি অতি মূর্খ তাই ততটা ধ্যান দিইনি… তাতে কিছু যায় আসে না, এখন ওকে আমি স্পর্শ করতে পারি।
হ্যারির চিবুকে ভোল্ডেমর্টের সাদা আঙ্গুলের শীতল স্পর্শতে ওর মনে হল, মাথাটা ব্যথায় চৌচির হয়ে যাবে!
ভোল্ডেমর্ট ওর কানের কাছে মুখ এনে খুব নরমভাবে আগের মতো হাসলেন, তারপর আঙ্গুলটা সরিয়ে নিয়ে ডেথইটারদের বলতে লাগলেন, বন্ধুরা সত্যই আমি ভুল হিসেব করেছিলাম, স্বীকার করছি। আমার কার্স, ওই মূর্খ মহিলার কারণে ওর ছেলের দিকে না গিয়ে উল্টো ঘুরে এসে আমার ওপর পড়ল যাকে বলে বুমেরাং। আ. ব্যথার ওপর ব্যথা, আমার বন্ধুরা, আমি এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমি আমার শরীর থেকে ছিন্ন হয়ে গেলাম, না আমি একটা প্রেতাত্মা, না একটা নিকৃষ্টতম ভূত। কিন্তু তাহলেও আমি জীবিত, কি যে হয়েছিলাম তা জানি না… আমি অন্য কোনও মানুষের মতো নই, যে পথ ধরে চললে অমর হাওয়া যায়, আমি সেই পথে চলেছি। তোমরা জান আমার একমাত্র উদ্দেশ্য মৃত্যুকে জয় করা। এখন আমি পরীক্ষা করে দেখেছি… আমার মনে হয় অন্তত একটা বা তারও বেশি আমার গবেষণা সফল হয়েছে। তা না হলে সেই কার্সের ফল অনুযায়ী আমার মৃত্যু হওয়ার কথা; কিন্তু আমার মৃত্যু হয়নি। যাক সে কথা। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল জীবের মতো শক্তিহীন ছিলাম… নিজেকে রক্ষা করার কোনও ব্যবস্থা ছিলো না… আমার দেহ ছিলো না… আর দেহ না থাকার জন্য অবশ্য কোনও জাদুমন্ত্র আমাকে কিছু করতে পারেনি।
আমার মনে আছে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য আমার কত বিদ্রি রজনী গেছে–পাহাড়, পর্বতে, খানাখন্দরে, জঙ্গলে, লোকালয় থেকে বহু দূরে। আমি ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করেছি। আমার এক অনুচর ডেথইটারের কথা মনে করেছিলাম, ভেবেছিলাম ও আমার কাছে আসবে এবং আমার জন্য জাদু প্রয়োগ করবে, যা আমি পারিনি, আমার দেহ পুনরুদ্ধার করবে; কিন্তু বৃথা আমি তার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। শুধু একটিমাত্র ব্যক্তি আমার কাছে ছিল। আমি অন্যদের দেহ অধিকার করতে পারি; কিন্তু আমি অসংখ্য জীবিত মানুষের কাছে যেতে সাহস করিনি। কারণ আমি জানতাম অরররা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি নিজেকে গোপন রাখার জন্য বিভিন্ন জম্ভ জানোয়ারের রূপধারণ করেছি, তার মধ্যে সাপ আমার প্রিয়। নিখুঁত আত্মা হওয়ার চাইতে জন্তুদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আমার ভাল মনে হয়েছিল, জাদু করার জন্য তাদের অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হয়, তাই জদের ভেতরে বেঁচে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয়নি… কারণ ওদের জীবন স্বল্পকালের হয়।
তারপর বছর চারেক আগে… আমার আবার ফিরে আসার আশার আলো দেখা দিল… একদিন এক যুবক জাদুকর আমি যে জঙ্গলে থাকতাম সেই জঙ্গলের পথ ধরে যাচ্ছিল… সেখানে আমার বাসগৃহ ছিল… তখন দারুণ সুযোগ হাতের মুঠোয় এসে যায়… এমনি তো আমি শয়নে জাগরণে স্বপ্ন দেখছিলাম… ও আবার ডাম্বলডোরের স্কুলের শিক্ষক ছিল।… ওকে আমার ইচ্ছেতে কাবু করা কঠিন ব্যাপার ছিল না। ও আমাকে এই দেশে নিয়ে এল, তারপর আমি ওর দেহ কবজা করে ফেললাম। ওকে তদারক করতে লাগলাম যাতে আমার ইচ্ছে যথাযথ পালন করে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা সার্থক হল না। আমি ফিলচসফারস স্টোন চুরি করতে সক্ষম হইনি… অমর হবার সুযোগ হল না। তখন থেকেই আমার এই অবস্থা… আবারও এই হ্যারি পটার আমার স্বপ্ন চূর্ণ করল।
চারদিকে নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল। এত নিস্তব্ধ যে কৃষ্ণবর্ণের পাতার গাছের একটিও পাতা নড়ছে না। ডেথইটারসরা নির্বাক…! ওদের জ্বল জ্বলে চোখ ভোল্ডেমর্টের দিকে শুধু নয়, হ্যারির দিকেও।
সেই ভৃত্যের মৃত্যু হল আমি যখন তার দেহ ছেড়ে চলে গেলাম। পুনরায় আমি যেমন ছিলাম তেমন দুর্বল হয়ে পড়লাম।
ভোল্ডেমর্ট বলে যেতে লাগলেন…, আমি বহু দূরে আমার আত্মগোপনের জায়গা ঠিক করলাম। আমি তোমাদের মিথ্যে বলবো না… তখন আমার মাঝেমধ্যেই মনে হয়েছিল আর হয়তো কখনও শক্তিলাভ করবো না।…হ্যাঁ সেটাই ছিল আমার জীবনের চরম অন্ধকারের দিন। আবার কোন জাদুকরকে পাবার আশা ছেড়েছিলাম… আমার মনে হয় তোমরা আমার সেই সময়কার অবস্থা বুঝতে পারছ।
দুএকজন মুখোশধারী জাদুকর অস্বস্তিতে নড়াচড়া করল; কিন্তু ভোল্ডেমর্ট লক্ষ্য করলেন না।
একবছর আগে যখন আমি সব আশা–ভরসা ছেড়ে দিলাম তখন হঠাৎ একদিন আশার আলো জ্বলে উঠল। আমার এক ভৃত্য, ওয়ার্মটেল… আজকাবানে যাবার শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য চাউড় করেছিল সে মরে গেছে। ওর এক সময়ের বন্ধুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার মতই পাহাড়–পর্বত–জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। ও ঠিক করল আমার কাছে ফিরে আসবে। আমি যেখানে আত্মগোপন করে আছি সেটা অনেক খুঁজে খুঁজে বের করল। অবশ্য ইঁদুররা ওকে সাহায্য করেছিল। ওয়ার্মটেলের ইঁদুরের প্রতি অদ্ভুত ভালবাসা। তাই না ওয়ার্মটেল? ওর সেইসব ছোট ঘোট নোংরা বন্ধুরা বলল, আলবেনিয়ার জঙ্গলের মধ্যে একটা জায়গা আছে, সেখানে ওরা যেতে ভয় পায়… সেখানে নাকি এক বিরাট কালো ছায়া আছে, এ ছায়া ইঁদুরদের মেরে ফেলে।
আমি যে জঙ্গলে থাকতাম সেটা খুঁজে বের করা ওয়ার্মটেলের পক্ষে সহজ ছিল। আমি যে জঙ্গলে ছিলাম সেটা খুঁজতে খুঁজতে খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ল। জঙ্গলের মুখে একটা সরাইখানা ছিল সেখানে কিছু খাবার জন্য ঢুকল। ওখানে বার্থা জোরকিনস নামে এক জাদুকরির সঙ্গে ওর আলাপ হল। সে মিনিস্ট্রি অব ম্যাজিকে কাজ করত।
এখন দেখ ভাগ্য কেমন করে লর্ড ভোল্ডেমর্টকে সাহায্য করে। পুনরুত্থানের এই সর্বশেষ সম্ভাবনা, আবার ওয়ার্মটেলের জীবনের শেষ। ওয়ার্মটেল সেই সরাইখানায় দারুণ এক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল, যা কখনও বা এখনও আমি তার কাছ থেকে আশা করি না। ও বার্থাকে একদিন রাতে ওর সঙ্গে বেড়াবার জন্য অনুরোধ করল। তারপর ওকে কাবু করে আমার কাছে নিয়ে এল। ওর কাছ থেকে আমি অনেক তথ্য সংগ্রহ করলাম। ও আমাকে জানাল ট্রাইউইজার্ড টুর্নামেন্ট এ বছর হোগার্টে হবে। আরও বলল, একজন বিশ্বস্ত ডেথইটারের সাথে তার জানাশুনা আছে সে আমাকে সাহায্য করতে পারে। যদি আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। বার্থা জোরকিনস আমাকে অনেক মূল্যবান খবরাখবর দিল। আমি কাজ বাগাবার জন্য ওর ওপর মেমরিচার্ম প্রয়োগ করলাম। খুবই শক্তিশালী জাদুমন্ত্র। আমার সব প্রয়োজনীয় তথ্য আদায় করে নেবার পর ওর তখন মানসিক ও শারীরিক অবস্থা কাহিল। এত বেশি যে পূর্বের অবস্থাতে ফিরে আসা অসম্ভব। আমার তাকে দিয়ে কাজ শেষ হলে, রেখে লাভ নেই, আমি ওকে ফেলেছিলাম…।
ভোল্ডেমর্ট কথাগুলোর পর ওর হাড়কাঁপানো হাসি হাসলেন, লাল চোখের দৃষ্টিশূন্য ও দয়ামায়াহীন।
ভেবে দেখলাম ওয়ার্মটেলকে ছাড়া ঠিক হবে না। কারণ সকলেই জানে ও মৃত। ওকে নরবরে অবস্থায় দেখতে পেলে বিরোধীপক্ষ সুযোগ পাবে। যাকগে ওর মতো শক্তসমর্থ এক ভূতের আমার প্রয়োজন ছিল। বেচারা জাদুকর ওয়ার্মটেল সবল হলেও শুধুমাত্র আমার নির্দেশ পালন করা ছাড়া নিজ থেকে কিছু করার কোনও মানসিক শক্তি ছিল না। আমার নবজন্মের জন্য দরকার ছিল এক শক্তসমর্থ দেহ। ভেবে দেখলাম ওকে দিয়ে আমার কাজ হবে না। এরই মধ্যে আমি অপেক্ষা করছি আমার নিজস্ব আবিষ্কারের দুটি জাদুমন্ত্রের জন্য। ভোল্ডেমট কথা বলে যাচ্ছেন কিন্তু চোখ তার সাপের ওপর।–হা কি বলছিলাম আমার আবিস্কৃত দুটি স্পেল (জাদুমন্ত্র) আর নাগিনের বিষ। নাগিনের কাছ থেকে সাপের ভয়ঙ্কর বিষ সহ হয়ে গেছে, এখন সেই তিনটির সাহায্যে, দুটি স্পেল, সাপের বিষের সঙ্গে ইউনিকর্ণের রক্ত। আমি প্রায় মানুষের দেহ ধারণ করে, শক্তি সঞ্চয় করে যাতায়াত করতে সক্ষম হব।
–ফিলচসফারস স্টোন চুরি করার আর কোনও আশা করিনি, কারণ আমি জানতাম ডাম্বলডোর সেটা ধ্বংস করে দিয়েছে। যাই হোক আমি ফিরে যেতে চাইছিলাম আমার পুরনো দেহে, আর প্রভূত শক্তি সঞ্চয় করে অমরত্ব পেতে।
আমি জানি পুরনো দিনের কালজাদু ছাড়া সম্ভব নয় সেটা। আজ রাতে সম্পূর্ণভাবে পূর্বের স্থানে ফিরতে যে পোসানটা খাব–তার জন্য আমার আরও তিনটি উপরকণ দরকার। ভালকথা-একটি তো আমার হাতের মুঠোতে, ওয়ার্মটেল তাই না? একটি ভূত্যের মাংস।
–আমার পিতার হাড়, তার জন্য আমাদের তার কবরের কাছে আসতে হয়েছে, কিন্তু বাকি? শত্রুর রক্ত! ওয়ার্মটেল অবশ্য আমাকে বলেছে, যে কোনও জাদুকরকে আমি ব্যবহার করতে পারি, তাই না ওয়ার্মটেল? যে জাদুকর আমাকে ঘৃণা করে, যেমন বলতে বাধা নেই, তোমাদের মধ্যে অনেকেই ভয় পেলেও ঘৃণা কর। আমাকে আবার পূর্ণ ক্ষমতায় ফিরে আসতে গেলে ওই তিনটি আমার চাই–ই চাই। তাহলে আমি আগের চেয়ে অনেক বেশিগুণ শক্তিশালী হব। আমি চাই হ্যারি পটারের রক্ত। আমাকে যার জন্য তের বছর আগে শক্তিচ্যুত হতে হয়েছে। রক্ষাকারী যে রক্ত ওর মা ওর শরীরের সব শিরা–উপশিরাতে দিয়েছে, সেই রক্ত আমি পান করব। আমার শিরা–উপশিরায় বইবে। তখন কেউ আমাকে কিছু করতে পারবে না।
–কিন্তু কোথায় কেমন করে পাব হ্যারি পটারকে? ডাম্বলডোরও নানা উদ্ভাবন শক্তিতে ওকে সুরক্ষিত করে রেখেছে, যখন থেকে পটারের বাবা-মার মৃত্যু হয়। খুব সম্ভব ওই সুরক্ষার কথা পটারও জানে। ডাম্বলডোর এমন এক পুরাতন জাদুমন্ত্র করেছেন তাতে যতদিন ওই ছেলেটি তার আত্মীয়স্বজনের কাছে থাকবে… সুরক্ষিত থাকবে। এটাই সমস্যা, আমি ভাবতে লাগলাম। সেখানেও আমি ওকে ছুঁতে পারলাম না, কিডিচ ওয়ার্ল্ড কাপের সময়েও না। আমি ভেবেছিলাম, হয়ত সেই সময় ওর সুরক্ষা একটু দুর্বল হবে। আত্মীয়স্বজনের কাছে বা ডাম্বলডোরের আওতায় নেই। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এক দঙ্গল জাদুকরদের মধ্য থেকে ওকে কিডন্যাপ করাও সম্ভব নয়। তারপর হোগার্টেও সম্ভব নয়। ওখানেও তো সেই ধূর্ত মাগলপ্রেমী মূর্খ ডাম্বলডোর! দিনরাত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পটার সুরক্ষিত।
বার্থা জোরকিনসের তথ্য নিয়ে এবং হোগার্টে অবস্থিত আমার বিশ্বস্ত অনুচর ডেথইটারের সাহায্যে ছেলেটির নাম গবলেট অব ফায়ারে দেই। তাকে বলা হল পটার যেন ট্রাইউইজার্ড টুর্নামেন্ট জয়লাভ করে–ও যেন কাপে সর্ব প্রথমে হাত ছোঁয়ায়… আমার ডেথইটার ওই কাপটাকে পোর্ট–কীতে (একটা সিস্টেম) পরিণত করবে, তারপর সেখান থেকে ওকে এখানে নিয়ে আসবে। মূৰ্থ ডাম্বলডোরের সাহায্য, সুরক্ষা… সব বানচাল করবে। তারপর সে সম্পূর্ণভাবে আমার কজায় থাকবে। ও হ্যাঁ, আজ আমার পরিকল্পনা সফল হয়েছে… এই দেখ সেই হতভাগা… যে আমার পতনের নায়ক।
ভোল্ডেমর্ট ধীরে এগিয়ে হ্যারির দিকে চাইলেন। নিজের জাদুদণ্ডটা তুলে বললেন, ক্রুসিও!
বলার সাথে সাথে হ্যারির সমস্ত শরীরটা নিদারুণ এক ব্যথায় জর্জরিত হল, মনে হল সব হাড়গোড় জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেয়া হয়েছে, খুলির মধ্য থেকে সবকিছু ছিটকে বেরোচ্ছে.. কাটা জায়গাটা যেন খান খান হয়ে যাবে। চোখ দুটো বন বন করে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই, তার জীবন শেষ… মৃত্যুদূত সামনে এসে দাঁড়িয়েছে… মৃত্যু… মরতেই হবে।
তারপরই হ্যারি দেখল চতুর্দিকে ঘন কুয়াশা। সেই কুয়াশার মধ্যে ওর শরীরটা আসুরিকভাবে মোটা দড়িতে বেঁধে ভোমেন্টের বাবার কবরের হেড স্টোনের ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।… অদূরে কুয়াশা ভেদ করে দুটো রক্তবর্ণ চোখ ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শব্দ বলতে শুধু ডেথইটারদের খনখনে গলায় অট্টহাসি!
এটা কত মূর্খতা এটা ভাবা যে এই বালকটি এক সময় আমার থেকেও শক্তিশালী হয়ে উঠবে!
কারও মনে আমি এককণা সন্দেহ রাখতে চাই না, হ্যারি পটারের ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাই আমার কবল থেকে এতদিন ছাড়া পেয়েছে। আমি যে কত শক্তিশালী ওকে নির্মমভাবে হত্যা করে প্রমাণিত করব। এখানে, এখন কেউ ওকে বাঁচাতে আসবে না। কারও পক্ষে সম্ভব নয় ওকে বাঁচানো… ডাম্বলডোর নয়, এবং কোন মা মৃত্যুবরণ করেও ওকে বাঁচাতে পারবে না। যাই হোক, আমি ওকে হত্যা করবো না এই মুহূর্তে। কে বেশি শক্তিশালী তা ওকে প্রমাণ করতে হবে আমার সঙ্গে লড়াই করে, একটু ধৈর্য ধর। নাগিন, ভোল্ডেমর্ট ফিস ফিস করে বললেন। বলার সঙ্গে সঙ্গে নাগিন ঘাসের ওপর দিয়ে স্থান ছেড়ে ডেথইটারদের দিকে চলে গেল। ডেথইটাররা তাকিয়ে রইল… ভোল্ডেমর্ট, নাগিন আর হ্যারি পটারের দিকে। ওয়ার্মটেল, এখন পটারকে বন্ধনমুক্ত কর। ওর জাদুদণ্ড ওর হাতে দিয়ে দাও।