ট্রেনের কথা একদম খেয়াল থাকে না দীপনাথের। অথচ কৌটো কোম্পানির মালিক নীলাম্বর ভদ্র তাকে শিখিয়েছিল, কলকাতায় এখানে সেখানে যাতায়াতের সময় যদি কাছাকাছি রেল স্টেশন থাকে তবে তাতেই যাতায়াত করবেন। কলকাতার বাসে-ট্রামে ওঠা মানে কিছুক্ষণ নরকবাস। তার চেয়ে ট্রেন ঢের ভাল।
কিন্তু দীপনাথের একমাএ দূরে যাওয়ার কথা ভাবলেই ট্রেনের কথা মনে পড়ে। অথচ কলকাতায় লোকাল ট্রেন যে কত উপকাবী তা খেয়াল থাকে না।
আজ অবশ্য খেয়াল হল। মণিদীপার দেওয়া আধুলি পকেটে নিয়ে বেরিয়ে সে আজ প্রথম কালীঘাট স্টেশনের কথা ভাবল। মিনিট দশেক হাঁটলেই ট্রেনের নাগাল।
বাড়ির বাইরে এসে সে একবার দোতলার অন্ধকার বারান্দাটার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ততটা অন্ধকার নয় যাতে মণিদীপাকে দেখা যাবে না। চুপচাপ রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার আলো অতদুরে মৃদু হয়ে পৌঁছেছে, সঙ্গে একটা বড় গাছের চিকড়ি-মিকড়ি ছায়াও।
দীপনাথ স্টেশন পর্যন্ত দৃশ্যটাকে বয়ে আনল।
ফাঁকা স্টেশন প্ল্যাটফর্মে কুড়িয়ে বাড়িয়ে জনা পাচেক যাত্রী হবে। স্টেশনঘরে জিজ্ঞেস করে জানল ট্রেনের এখনও দেরি আছে।
সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার পর আজকাল কোনও কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে গেলে সময়টা বড় দেরিতে কাটে, অপেক্ষা দীর্ঘ মনে হয়। তবু সিগারেট ছেড়েছিল বলে দীপনাথ আজকাল নিজের পকেটে হাত দিয়ে পয়সার অস্তিত্ব টের পায়। দিনে কম করেও আড়াই থেকে তিন টাকা ছিল তার সিগারেট আর দেশলাইয়ের খরচ। একদিন খুব শান্তভাবে সে এই খামোখা খরচটার কথা ভাবল। পরদিনই সিগারেটের বদলে মেনথল দেওয়া লজেন্স কিনল এক ডজন। লজেন্স মুখে ফেলে মুখের সরস ভাবটা বজায় রাখল, সিগারেট আর ছুঁল না। কোনও কিছু ছাড়তে হলে এক কঁকিতেই ছাড়তে হয়, ধীরে ধীরে ছাড়া যায় না।
ঠিক সেই সিগারেটের মতোই সহজে যে সব ছাড়া যাবে তা তো নয়। স্টেশনের একটা বেঞ্চের কোনায় বসে দীপনাথ কেবলই যখন অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়ানো মণিদীপার কথা ভাবছিল তখন তার মনে হল, এটা ছাড়া যায় না। এটা ছাড়লে বাচার কোনও অর্থ থাকে না। জীবনের প্রতিটি মিনিটই তবে অসহনীয় এক-একটি ঘণ্টায় দাঁড়াবে।
আবার ভাবল, একটু আগেই না সে বিশ্বাসের কথা বলছিল!
মুশকিল হল দীপনাথের প্রিয় কোনও চিন্তা নেই, একমাত্র আজকাল মণিদীপাকে ভাবা ছাড়া। সে কী করে একা তার অবসরকে ভরে তুলবে।
বৃষ্টির জল এখানে সেখানে জমে আছে। প্ল্যাটফর্মের মোরম ভেজা। ভ্যাপসা একটা গরম থম–ধরা ভাব। স্টেশনের আলোর সংখ্যা এতই কম যে চারদিক ভাল করে দেখা যায় না। এই স্টেশন থেকে কোনওদিন গাড়ি ধরেনি দীপনাথ, কোনওদিন ট্রেন থেকে নামেওনি এই স্টেশনে। আজই প্রথম। আধুলি ভাঙিয়ে শিয়ালদার টিকিট কাটবার পর খুব অল্প কিছু খুচরোই অবশিষ্ট আছে পকেটে। পকেট থেকে পয়সাগুলো বের করে হাতের মুঠোয় ধরে থাকে দীপনাথ। আধুলিটায় মণিদীপার স্পর্শ ছিল। এই পয়সাগুলোয় বুকিং ক্লার্কের হাতের ছোঁয়া আছে মাত্র তবু এও তো মণিদীপারই স্পর্শের ভাঙানো খুচরো।
আজই, এই মুহূর্তে মণিদীপাকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য দীপনাথ আচমকা পয়সাগুলো ছুড়ে দিল লাইনের দিকে। ঠুং ঠাং শব্দ হল অদূরে। দু’-একজন অন্ধকারে মুখ তুলল শব্দের দিকে। লাইনের ওপর গাড়ির আলো এসে পড়ল তখন।
গাড়িতে কোনও ভিড় নেই, বরং অস্বস্তিকর রকমের ফাঁকা। দীপনাথ উঠল এবং ফাঁকা বেঞ্চে খুব হাত পা ছড়িয়ে বসল।
দীপনাথ!
উঁ!
এবার একটা বিয়ে করো।
আমি অপদার্থ, অপদার্থের বিয়ে করতে নেই।
বিয়ে করো দীপনাথ, তা হলে অন্তত সন্ধেবেলা ফিরে যেতে ভাল লাগবে। মেসবাড়িতে ফেরা তো ঠিক ফেরা নয়।
কথাটা ঠিক। প্রতিদিনই মনে হয়, কোথাও ঠিক ফিরে যাচ্ছি না। কিন্তু শুধু ওটুকুর জন্য অতটা রিস্ক নেওয়া কি ভাল?
তবে কী ভাল দীপনাথ? পরকীয়া?
পরকীয়া? ছিঃ ছিঃ, তা কেন?
তবে বিয়ে করো দীপনাথ। জীবনে একজনের কাছে অন্তত পুরোপুরি উন্মােচন করতে পারবে নিজেকে। এখন এটা তোমার দরকার।
ভাবছি। বরং আর-একটু ভাবি।
তুমি ভাবতে বড় ভালবাসো। অত ভেবে ভেবে ঘুঘু পাখি হয়ে যেয়ো না। সঙ্গে কিছু করো।
বিয়ে করলে খাওয়াব কী?
বোস তো চাকরি দিচ্ছে।
যদি দেয়। বোসকে তো ঠিক বোঝা যায় না।
বলো কী! বোস যে তোমার বন্ধু!
তবু বোস সাহেবের মতো লোককে বিশ্বাস নেই হে, হয়তো এ জীবনে বিয়েটা ঘটেই উঠবে না।
কীরকম মেয়ে হলে হবে তোমার দীপনাথ?
খুব সুন্দর কিছু নয়। মিষ্টি চেহারাটা হবে। খুব ভালবাসতে জানবে আর… আর কী!
আর কিছু নয়?
আর খুব বিশ্বস্ত হবে। খুব বিশ্বস্ত।
বাঃ।
তবে একটু ভয় করে। ভয় করে।
কেন বলো তো!
আমার মেজদা শ্রীনাথ আর মেজোবউদির মধ্যে তো দেখছি। বিলু আর প্রীতমের মধ্যেও দেখছি। বোস সাহেব আর মণিদীপার ব্যাপারও জানি। তাই ভয় করে।
যদি মণিদীপাকে বোস সাহেব ডিভোর্স করে তা হলে কখনও তাকে বিয়ে করতে পারবে দীপনাথ?
পারব। নিশ্চয়ই পারব।
ভেবে বলল। ভাল করে ভেবে দেখো।
পারব। বলছি তো। তবে সেটা ঘটবে না।
যদি ঘটে?
ঘটবে না। মণিদীপা কি আমাকে ভালবাসে?
ভালবাসার কথা থাক, দীপনাথ। আমি বলি বিশ্বস্ততার কথা। একটু আগেই বলছিলে না যে, মানুষের ঘর-সংসার খাঁ খাঁ হয়ে যাবে!
বলছিলাম।
বিশ্বস্ততার কথা বলছিলে?
হুঁ। তা-ও।
মণিদীপাকে বিশ্বাস করতে পারবে?
পারব না কেন?
কী করে পারবে? সে যে বিশ্বাসের ঘরে আগুন দিয়েই আসবে, যদি আসে।
আসবে না। এরকম কিছু ঘটবে না।
যদি ঘটে?
বলেছি তো, যদি আসে তবে বিনা প্রশ্নে তাকে নেব।
তবে একটু আগে তাকে যে বড় বিসর্জন দিলে!
আমার মনে হয় ওরা বিয়ে ভাঙবে না। যদি না ভাঙে তবে মণিদীপার ভালর জন্যই ওকে মন থেকে বিসর্জন দেওয়া আমার উচিত।
তা হলে প্রতিমা ভাসান হয়ে গেল বলছ! আর ওকে নিয়ে ভাববে না?
না। যেভাবে সিগারেটের নেশা ছেড়েছিলাম ঠিক সেইভাবে ছাড়ব।
জানি সিগারেট ছেড়ে মেনথল দেওয়া লজেন্স খেতে। এখন কে তোমার লজে‡স হবে দীপনাথ? বীথি?
না, না! ওকথা বোলো না। ওই আমার একটা মাত্র পাপ, মাত্র একবারের পদস্খলন!
তাই তো বলি দীপনাথ, বিয়ে করো। তা হলে আর দুনিয়াটা এত গোলমেলে লাগবে না।
শিয়ালদা সাউথ স্টেশনে ঘরমুখো যাত্রীদের হাউড় ভিড়, গাড়ি থামতেনা-থামতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল কামরায়। ঠেলা গুঁতো খেয়ে, ঘষটে, চেপটে অতি কষ্টে নামে দীপনাথ। প্ল্যাটফর্মের থিকথিকে ভিড় কেটে ফটকের দিকে এগোয়।
সুখেন ঘরেই ছিল। পাজামা পাঞ্জাবি পরে যেন বেরোবার মুখে বসে আছে। দীপনাথকে দেখেই বলল, আমি আপনার জন্যই ওয়েট করছিলাম। বাইরের জামা-কাপড় আর ছাড়বেন না। চলুন বেরোই।
কলেজের পড়ুয়া রুমমেটটি আজ ঘরেই আছে। খুব কম কথা বলে, একটু অভদ্র রকমের চুপচাপ থাকে। সে আজ খুব নিবিষ্ট মনে বইখাতা খুলে পড়াশুনো করছে।
দীপনাথ আড়চোখে তাকে দেখে নিয়ে বলল, কোথায়?
বাইরে চলুন বলছি।
দীপনাথ বিরক্ত হয়। সুখেনের বন্ধুত্ব আজকাল তার শাসরোধ করে দিচ্ছে। কিন্তু পাছে পড়ুয়া ছেলেটির সামনেই কাণ্ডজ্ঞানহীন সুখেন বোস কোনও কথা বলে ফেলে সেই জন্য সে ঘরের বাইরে এল।
রাস্তায় এসে সুখেন বলে, আজ বীথি আপনাকে নেমন্তন্ন করেছে।
একটু চমকে উঠে দীপনাথ বলে, কেন?
সেদিন আপনাকে ঠিকমতো কিছু খাওয়াতে-টাওয়াতে পারেনি বলে দুঃখ করছিল। আজ আমার অফিসে ফোন করে বলল, তোমার বন্ধুকে নিয়ে অবশ্যই আসবে। যত রাত হোক আমি অপেক্ষা করব।
দীপনাথ খুবই রেগে যাওয়ার চেষ্টা করে। তার মনে হয়, এই প্রস্তাবে তার বোমার মতো ফেটে পড়া উচিত। কঠিন প্রতিরোধ তৈরি করা উচিত। সুখেনকে প্রচণ্ড অপমান করা উচিত।
কিন্তু কোনওটাই পারে না দীপনাথ। ভিতরে একটা বোমার পলতেয় আগুন সে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু মিয়ানো বোমাটা ফাটল না। তবু যতদূর সম্ভব গলায় ঝঝ এনে সে বলল, না, আমি যেতে পারব না। আমি অসম্ভব টায়ার্ড।
আজ যে বড় জমাটি বাদলার ওয়েদার ছিল দীপবাবু!
বাদলার ওয়েদার তো কী হয়েছে?
ভারী অপ্রতিভ মুখে বোকাটে হাসি হেসে সুখেন বলে, আপনি ভারী তেজি মানুষ। মর্যালিস্ট। কিন্তু বীথি আজ কোনও দুষ্টুমি করবে না, কথা দিয়েছে। আপনি যে রেগে আছেন তা ওকে আমি বলেছি। আপনি জানেন না, বীথি ভারী ভাল মেয়ে। জীবনে অনেক ঘা খেয়ে
উদাসভাবে দীপনাথ বলে, খারাপ মেয়েদের সব গল্পই এরকম। বীথি ভাল মেয়ে হলেই বা আমার কী?
ব্যথিত মুখে সুখেন বলে, আপনি ভুল বুঝেছেন।
ওসব কথা থাক। আমি ইন্টারেস্টেড নই।
ও যে অপেক্ষা করবে।
অপেক্ষা করতে তো কেউ বলেনি। তবু যদি করে তো করবে।
বাদলা ওয়েদারটা ছিল। জমত।
আমার মেজাজ ভাল নেই সুখেন।
সেইজন্যই তো আরও দরকার। বীথি মেজাজ ভাল করার ওষুধ জানে।
ভিতরে ভিতরে দীপনাথের প্রতিরোধ ভেঙে যাচ্ছিল। দুর্গের ফটক ভেঙে ঢুকে আসছে অশ্বারোহী। বাদলা দিন, অবসাদ, একঘেয়ে মেসের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়া— এসবের মধ্যে তো কিছু রহস্য নেই। তা ছাড়া একবার যখন পদস্খলন ঘটেছে তখন দু’বারে আর বেশি কী হতে পারে? খুব শিগগিরই সে বিয়ে করে ফেলবে, তখন ভাল করে দুর্গের চারদিকে পরিখা কাটবে, মজবুত ফটক লাগাবে। শুধু আজকের দিনটা… একটা দিন…
দীপনাথ বলল, এটা আপনাদের খুব অন্যায়।
দীপনাথের কণ্ঠস্বরে দুর্বলতা ধরে ফেলে সুখেন উজ্জ্বল মুখ করে বলল, আপনার বন্ধুত্ব ছাড়া আমি সত্যিই অন্য কিছুকে তেমন মূল্য দিই না। লোকে শুনলে ভাববে আমি আপনার খারাপ বন্ধু, কু-পথে নিয়ে যাচ্ছি। মাইরি, তা নয়। আমি শুধু চাই, আপনার জীবনে আরএকটু আনন্দ আসুক।
দীপনাথ একটু ধমক দিয়ে বলে, কিন্তু এই-ই শেষ বার। বীথিকে কথাটা বলে দেবেন।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! শুধু আজকের দিনটা।
আবার টানা রিকশা ভাড়া করে সুখেন। বলে, টানা রিকশার মতো এমন বাবুয়ানির জিনিস হয় না। ভারী আয়েসের গাড়ি। নিজেকে রাজা-রাজা লাগে।
দীপনাথ টানা রিকশা দু’চোখে দেখতে পারে না, তবু আনমনে বলল, হুঁ।
কী ভাবছেন?
কিছু না।
আজকাল আপনাকে আরও বেশি অন্যমনস্ক লাগে। অফিসে ঝামেলা চলছে নাকি?
না। এমনি নানা কথা ভাবি।
আমি একটু অন্যরকম। আমার মাথায় তেমন ভাবনা-চিন্তা আসে না। মন-টন খারাপ হলে আমি ফুর্তি করতে বেরিয়ে পড়ি।
ফুর্তি করাটাই তো জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয় মানুষের।
করুণ মুখ করে সুখেন বলে, আমি খুব ভোঁতা ধরনের, বুঝলেন! পলিটিকস ভাল লাগে না, খেলাধুলো বুঝি না, দেশ কাল নিয়ে খামোখা মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করে না। দুনিয়াটাকে নিয়ে আমার কোনও চিন্তা নেই। এমনকী নিজের পরিবার নিয়েও ভাবি না। ইন্দো-চায়না ওয়ারের সময় এক ভদ্রলোক আমাকে যুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করায় আমি ভারী ফাঁপরে পড়েছিলাম। আবছা আবছা কানে এসেছিল বটে চিনের সঙ্গে ইন্ডিয়ার কী একটা গণ্ডগোল হচ্ছে, কিন্তু তার ডিটেলস কিছু জানতাম না। লোকটা আমাকে দেশদ্রোহী-ট্রোহী বলে খুব গালাগাল করেছিল। মাইরি, দেশদ্রোহী কি না আমি তাও ঠিক বলতে পারব না। আমার গণ্ডিটা বড়ই ছোট।
দীপনাথ হাসছিল।
সুখেন হাসি দেখে উদ্বেগের গলায় বলল, আমি লোকটা কি খুব খারাপ? আমাকে আপনার কেমন লাগে বন্ধু?
আপনি দারুণ লোক।
ঠাট্টা করছেন!
করলেই বা, অন্যের কথায় আপনার কী আসে যায়?
অন্যের কথায় আসে যায় না ঠিকই, কিন্তু আপনার কথায় আসে যায়। আমার জীবনে বলতে গেলে আপনিই সঠিক বন্ধু হলেন। আর কারও সঙ্গ আমার কখনও এত ভাল লাগেনি। আপনার জন্য আমার অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে।
আর কিছু করতে হবে না, মাঝে মাঝে রবীন্দ্রসংগীত, অতুলপ্রসাদী বা রজনীকান্তের গান শোনাবেন তা হলেই হবে।
ঠিক আছে। যখনই ইচ্ছে হবে একবার মুখ ফুটে বলবেন, শুনিয়ে দেব।
রিকশা গড়পারে ঢুকতেই বুকটায় খামচা-খামচি শুরু হল দীপনাথের। বীথির মুখোমুখি হওয়াটাই ভারী লজ্জার হবে। জীবনে যে মহিলার সঙ্গে তার অতখানি ঘনিষ্ঠতা হল সেদিন তাকে সে ভাল করে চেনেও না।
দোতলার ঘরের দরজায় আজ দারুণ একটা ছাপ-ছক্করওয়ালা পরদা টাঙানো। পাল্লা দুটো খোলা। ভিতর থেকে ধূপকাঠির চন্দনগন্ধ আসছে। ঘরের ভিতরে রজনীগন্ধা ছিল আজ। নীলরঙা জিনস-এর ফুলপ্যান্ট আর খালি গায়ে তোয়ালে জড়ানোে স্বস্তি সোফায় বসে কী একটা চিঠি পড়ছিল। তারা ঘরে ঢুকতেই মুখ তুলে হাসল। কী সুন্দর হাসি! কোমল দাড়িতে মুখটা ভারী নরম যিশুখ্রিস্টের মতো দেখায়। মাথা ভরতি লম্বা চুল। অকপট চাউনি। চেহারাটা রোগাটে হলেও মাংসপেশিগুলো কঠিন। শরীরে লকলক করে জোরালো একটা ভাব।
কী খবর দীপনাথবাবু? অনেকদিন বাদে এলেন।
দীপনাথ খুব অস্বস্তির সঙ্গে হাসল। স্বস্তি কি জানে না যে, দীপনাথ বীথিব প্রেমিক? নিজের মায়ের কথা না জানাটা তার পক্ষে অস্বাভাবিক। স্বস্তির মুখে চোখে খরশান বুদ্ধির দীপ্তি। এ ছেলে সব জানে। তবে কী করে সহ্য করে?
দীপনাথবাবুকে বসিয়ে রেখে সুখেন ভিতরে গেল। স্বস্তি উঠে গেল না। বসে চিঠিটা পড়ে আবার ভাজ করে খামে ঢুকিয়ে পকেটে পুরল। তারপর বলল, একটু বসুন। মা বাথরুমে। এসে যাবে এক্ষুনি।
স্বস্তিকে আপনি বলবে না তুমি তা ঠিক করতে পারছিল না দীপনাথ। স্বস্তির বয়স খুবই কম, কিন্তু ওর নরম হাসির পিছনে একটা ঝাঁঝালো ব্যক্তিত্ব আছে বলে সন্দেহ হয়।
কেন জানে না, এর আগের দিন অস্পষ্টভাবে স্বস্তিকে দেখে যেন আর কারও কথা মনে হয়েছিল। আজও হল। কে? একটু ভাবল দীপনাথ। তারপরেই অবাক হয়ে দেখল, স্বস্তিকে দেখে তার কেন যেন অপরিচিত অদেখা, স্নিগ্ধদেবের কথা মনে পড়ে। স্নিগ্ধদেব কি এরকম? হয়তো কালো, মোগা, লম্বা এবং আরও পরিণত এবং ধীর স্থির। তবু স্বস্তির ভিতর যেন ওইরকম এক বিপ্লবীর গন্ধ আছে।
দীপনাথ বলল, আপনি কি পলিটিকস করেন?
স্বস্তি আবার সুন্দর হাসিটি হাসল। কিন্তু প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল না। নরম গলায় বলল, স্টুডেন্টস মুভমেন্ট করি কিছু কিছু। আপনি ইন্টারেস্টেড?
একসময়ে নর্থ বেঙ্গলে আমিও করতাম। তারপর যা হয়।
ও।–স্বস্তি আর কিছু বলল না।
দীপনাথ অস্বস্তি বোধ করতেই থাকে। স্বস্তি বোধহয় রাজনীতির ব্যাপারে খুব সচেতন। এলেবেলে লোকের সঙ্গে ও নিয়ে কথা বলতে চায় না। দীপনাথ তাই নিরুত্তাপ প্রশ্ন করল, বাইরে থেকে এলেন?
ওয়াই এম সি এ-তে টেবিল টেনিস খেলতে গিয়েছিলাম। খেয়েই আবার বেরিয়ে যাব।
কোথায়?
আমি একটা নাইট স্কুল করেছি। বেলেঘাটায়।
খুব ভাল।
দীপনাথ আলগা গলায় বলে। কিছুতেই এই ছেলেটিকে তার বীথির মতো নষ্ট মহিলার গর্ভজাত বলে মনে হয় না। সে জিজ্ঞেস করে, আর কী করেন?
স্বস্তি মাথা নেড়ে বলে, সংগঠন ছাড়া খুব বেশি কিছু করা একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই একটা অর্গানাইজেশন করে তুলছি।
কী করতে চান?
অনেক কিছু। টু মেক পিপল কনশাস৷ সোশ্যালি অ্যান্ড পলিটিক্যালি।
জনসাধারণকে নিয়ে ভাবা বা দেশের জন্য কিছু করার কথা দীপনাথ বহুকাল হল ভুলে গেছে। এই গ্রীষ্মের রাতে এখন সে এক কামার্ত শুকনো পুরুষ, প্রায় বিগত-যৌবনা এক সুন্দরীর বৈঠকখানায় বসে অপেক্ষা করছে। তার দেশ নেই, দেশবাসী নেই, দায়দায়িত্ব নেই। নিজের জন্য কি একটু লজ্জা হচ্ছিল দীপনাথের?
লজ্জা থেকে মুক্তি দিতেই বুঝি স্বস্তি উঠে পড়ে বলল, আমি একটু আগেই খেয়ে নিচ্ছি। স্কুলে ওরা অপেক্ষা করবে। কিছু মনে করবেন না।
না, না। আপনি কাজে যান।
স্বস্তি চলে গেল। পাশের খাবার পরে চেয়ার টানার শব্দ হল।
চুপচাপ বসে দীপনাথ নিজের ভিতরকার অস্বস্তি ভোগ করতে থাকে। এই যে এরা, এই স্বস্তি এবং তার না, এরা কারা, সমাজের কোন শ্রেণির মানুষ, ভাল না মন্দ তা কিছুই বুঝতে পারে না সে। ভারী রহস্যময় এরা। হয়তো অকপট, হয়তো সংস্কারমুক্ত, তবু মন থেকে এদের স্বীকার করে নিতে পারছে না দীপনাথ।
নিজের মায়ের ঘৃণ্য জীবনে কি অভ্যস্ত হয়ে গেছে স্বস্তি? তার প্রতিবাদ নেই? বিপ্লব নেই?
খুব অল্প সময়ে খাওয়া শেষ করে খালি গায়ের ওপর একটা ভঁজহীন হাওয়াই শার্ট চড়াতে চড়াতে বেরিয়ে যাওয়ার সময় স্বস্তি যখন তার দিকে চেয়ে হেসে গেল তখনও দীপনাথ তার মুখ দেখে কিছুই বুঝতে পারল না। কিন্তু হঠাৎ স্বপ্লোঞ্ছিতের মতো উঠে সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় স্বস্তিকে ধরল, শুনুন, আমি আপনার নাইট স্কুলটা একটু দেখব।
স্বস্তি অবাক হলেও কোনও আবেগ প্রকাশ করল না। শান্ত গলায় বলল, মা আজ আপনাদের নেমন্তন্ন করেছে শুনেছি। ততক্ষণ ওয়েট করা তো সম্ভব নয়।
আমার নেমন্তন্নের চেয়ে নাইট স্কুলটা দেখাই বেশি দরকার।
পরে দেখবেন। কিছু তেমন দেখার মতো ব্যাপার নয়। মা অপেক্ষা করছে। আপনি যান, আমিও চলি।
দীপনাথ নিজেকে সামলাতে না পেরে হঠাৎ বলল, আপনার মা নন, আপনাকেই আমার বেশি দরকার। আমি আপনার কাছে কিছু শিখতে চাই।
স্বস্তি হয়তো সন্দেহ করল, দীপনাথ মদ-টদ খেয়েছে। তাই সামান্য হেসে বলল, শেখার কথা বলছেন কেন? ওসব ইমোশনের কথা।
হতে পারে। কিন্তু এখন আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই।
স্বস্তি একটু স্থির চোখে তার দিকে চেয়ে খুবই আবেগহীন ভদ্র গলায় বলল, মায়ের বন্ধুদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালই, কিন্তু আমি তাদের কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হই না, অন প্রিনসিপ্ল। মাফ করবেন।
স্বস্তি চলে যাওয়ার পরও তার গম্ভীর, গভীর, বেতারঘোষকের মতো সুন্দর কণ্ঠস্বরটি অনেকক্ষণ কানে লেগে রইল দীপনাথের।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে একবার ভাবল, এখান থেকেই মেসে ফিরে যাবে।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে দুর্গের ফটক ভেঙে যে ঘোড়সওয়ার ঢুকেছে সে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে নীতিবোধ, আব্রু এবং প্রতিরোধ।
আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছিল দীপনাথ। মাঝপথ পর্যন্ত উঠেই থামল। বাইরের ঘরে নয়, কিন্তু ভিতরের ঘরে কোথাও তীব্র স্বরে বীথি কিছু বলছে। বলছে বোধহয় সুখেনকেই। সুখেনের গলাও শোনা গেল। দু’জনের বোধহয় ঝগড়া হচ্ছে।
ঝগড়ার শব্দটা দীপনাথকে সাহায্য করল অনেক। তার নিজের ভিতরের উত্তেজনা হঠাৎ স্তিমিত হয়ে এল। অনিচ্ছে জাগল।
কাউকে কিছু না বলে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এল দীপনাথ। ধীরে সুস্থে হেঁটে গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়ল।