৩৩. ঝাঁ ঝাঁ রোদ উঠেছে

সকাল নটার মতো বাজে।

ঝাঁ ঝাঁ রোদ উঠেছে। মামুন দোতলার বারান্দায় বসে দাড়িতে সাবান লাগাচ্ছে। আজ তাকে অনেকগুলি কাজ করতে হবে। রাজমিস্ত্রীকে খবর দিতে হবে। সেতাবগঞ্জে যেতে হবে সিমেন্টের জন্যে। চাইনিজ সিমেন্টের বস্তা পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি ব্যাগে বিশ-ত্রিশ টাকা কম পড়বে। আকিল মিয়ার রড দিয়ে যাবার কথা। সে আসেনি। তার খোঁজেও যেতে হবে। আজ দিনের মধ্যে কি কি করতে হবে একটা কাগজে লিখে ফেললে হয়। মামুন ঠিক করল দাড়ি শোভ করার পরই পয়েন্ট বাই পয়েন্ট সব লিখে ফেলবে। সামনে প্রচুর কাজ। ভালই লাগছে। কাজ ছাড়া মানুষ থাকতে পারে?

আয়নাটা ভাল না। মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে চোয়াল ভাঙা অচেনা একটি লোক বসে আছে। স্বাস্থ্য বোধ হয় খারাপ হয়েছে। মামুন গালে ব্লেড ছোঁয়াতেই অনেকখানি কেটে গেল। টপটপ করে রক্ত পড়তে লাগল। আরো কি কাণ্ড? নতন ব্লেড। গাল কাটার কথা না। সে কি দাড়ি শেভ করাও ভুলে গেছে? মামুন তোয়ালে দিয়ে গাল চেপে উঠে দাঁড়ানো মাত্র অদ্ভুত একটি দৃশ্য দেখল। মুনা আসছে। কাধে পাটের একটি ব্যাগ। এই ঝাঁ ঝাঁ রোদেও গায়ে একটা চাদর। বিস্মিত চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে এগুচ্ছে। দ্বিধার ভঙ্গিটি স্পষ্ট। মামুন উঁচু গলায় চোঁচাল। এ্যাই এ্যাই। মুনা তাকাল চোখ তুলে। হাসল। মামুন ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। মুনা নয়, জাহানারা। এত বড় ভুলও হয় মানুষের। মুনা কেন এখানে আসবে? তার এত কী দায় পড়েছে?

কী ব্যাপার এ্যাই এ্যাই করে চেঁচাচ্ছিলেন কেন?

মামুন হাসল। জাহানারা বলল, এত বড় অসুখ দেখে এলেন তারপর তো এক’দিনও এলেন না। নানান রকম ঝামেলায়…।

কোন ঝামেলা ছিল না। আপনি ইচ্ছে করেই যাননি। মামুন কী বলবে বুঝতে পারল না। আপনার গাল দিয়ে তো টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। তুলা দিয়ে গাল চেপে রাখুন। ঘরে তুলা নেই?

না এটা কি ডাক্তারখানা। তুলা, জগ ওষুধপত্র এইসব থাকবে। আসুন ভেতরে আসুন।

না। আমি বসব না। হয়রত আলীকে ফেরত দিতে এসেছি।

পড়েছেন নাকি?

আপনি এত কষ্ট করে নিয়ে গিয়েছেন আর আমি পড়ব না। মেয়েদের আপনারা কি ভাবেন, পাষাণ?

মামুন বলল, আপনি একটু বসুন। দেখি আমি চায়ের ব্যবস্থা করি। এই পাঁচ মিনিট।

জাহানারা বসে রইল। মামুন প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল। চা তাকেই বানাতে হবে। কাজের যে মেয়েটি আছে সে ভাত-তরকারি ছাড়া অন্য কিছু রাঁধতে পারে না।

জাহানারা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আমার খুব একটা ভাল খবর আছে।

কী খবর?

দেখি আন্দাজ করুন তো?

মেয়েটি হাসছে মিটমিটি। তার চরিত্রের সঙ্গে এই হাসিটি ঠিক মিশ খাচ্ছে না। মামুন ধাঁধায় পড়ে গেল।

বলতে পারলেন না? আমার ট্রান্সফার অর্ডার হয়েছে।

বলেন কি?

আমি শনিবারে ঢাকায় চলে যাচ্ছি।

আমিও ঢাকায় যাচ্ছি। আমি আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। কোনো চিন্তা করবেন না। গল্প করতে করতে যাব। ফাইন হবে।

জাহানারা হাসল। মামুন অবাক হয়ে বলল, হাসছেন কেন?

আপনার মধ্যে একটা ছেলেমানুষি আছে তাই দেখে হাসছি।

জাহানারা আবার হাসতে লাগল। কিশোরীদের হাসি; যা শুধু শুনতে ইচ্ছে করে।

আপনি খুব খুশি হয়েছেন?

খুশি হব না। মানে! কী বলছেন। আপনি?

এই জায়গাটা কী এতই খারাপ?

হ্যাঁ খারাপ। আর কিছুদিন থাকলে আমি মরে যেতাম।

মানুষ খুব কঠিন জিনিস। মানুষ এত সহজে মরে না।

আমি মরি। আপনার গাল দিয়ে কিন্তু এখনো রক্ত পড়ছে। ঘরে ওষুধপত্র কিছুই নেই?

না।

গাঁদা ফুলের পাতা কচলে গালে দিন না।

গাঁদা ফুলের পাতা আমি পাব কোথায়?

জাহানারা আবার হাসতে শুরু করল। তার আজ এত আনন্দ হচ্ছে। সে বেশিক্ষণ থাকবে না। বলে এসেছিল। কিন্তু সে বিকাল পর্যন্ত রইল। অনবরত কথা বলল। যাবার সময় কেমন যেন বিষন্ন হয়ে গেল। হালকা স্বরে বলল, আপনি যতবার ঢাকা যাবেন ততবার আমাদের বাসায় আসবেন। আসবেন তো?

হ্যাঁ আসব।

আমি আপনাকে সঙ্গে নিয়ে এক’দিন উনাকে দেখতে যাব।

কাকে দেখতে যাবেন?

ঐ যে মেয়েটি যে আমার মত দেখতে।

ও মুনাকে?

হ্যাঁ। উনি আমাকে দেখে আবার রেগে যাবেন না তো?

না রাগবে না; ও অন্য ধরনের মেয়ে।

জাহানারা নিঃশ্বাস ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *