৩৩. জমিদারের মান রেখেছে রামচন্দ্র

জমিদারের মান রেখেছে রামচন্দ্র। ফসল খুব ভালো হবার কথা নয় তার জন্য নির্দিষ্ট জমিতে। উপর থেকে পলির গভীরতা ঠিক বোঝা যায়নি।

কিন্তু সীমানা নিয়ে কোনো গোলমালও হয়নি দখলের সময়ে। সিংহীদের জমির সীমায় সীমায় লাঙল ধরেছিলো রামচন্দ্র, এরশাদ, ছিদাম আর ইয়াজ-আমলাদের ভাষায় গুলবাঘারা।

নায়েব একদিন রামচন্দ্রকে ডেকে পাঠালো।

রামচন্দ্র, ফসল প্রজারা তিন ভাগের এক ভাগ দিক, কিন্তু সেই এক ভাগের একটা কমপক্ষে পরিমাণ ঠিক থাকা উচিত, কী বলো?

রামচন্দ্র একটু ভেবে নিয়ে বললো, এরশাদভাই, কী ক?

তা ধরেন যে থাকা উচিত।নাইলে লোভে পড়ে জমি নিলাম, চষলামনা, এমন হবি।হইছেও কিছু কিছু। এরশাদ বললো।

নায়েব বললো, খাজনার পরিমাণ টাকার ফসলটা অন্তত নিয়মিত পাওয়া দরকার।

রামচন্দ্র বললো, আমি কিছুই কবো না এখন, ভাবে দেখি। আপনের জ্ঞানবুদ্ধির লেখাজোখা নাই। আপনেও ভাবেন। সব বার সমান ফসল দেয় না জমি। তাছাড়াও মানষের জেবন

বিচক্ষণ নায়েব কথাটিকে তখনকার মতো সরিয়ে নিয়ে বললো, তামাক খাও, রামচন্দ্র। তামাক খাওয়ার পর নায়েব বললো, রামচন্দ্র, তোমার কী একটা বলার ছিলো যেন?

আজ না, আর একদিন কবো। বলে রামচন্দ্র বিদায় নিলো।

নায়েবমশাই এর আগে একদিন বিস্মিত হয়েছিল। যখন খাসজমিতে কায়েম হওয়ার আনন্দে সবাই উজ্জ্বল তখন রামচন্দ্র উইলের কথা তুলেছিলো। আজকের রামচন্দ্রও যেন ততোধিক ক্লান্ত একজন।

পথে রামচন্দ্র ভাবলো, নায়েব কথাটাকে টেনে নিচ্ছিলো। কিন্তু প্রকাশ না করেই ভালো। করেছে সে। রায়ত থেকে জোতদার হওয়ায় সত্যিকারের কোনো লাভ নেই।

অবশ্য কথাটা উঠে পড়লে সে নিজের প্রস্তাবের যুক্তি হিসাবে বলতে পারতো রায়ত থেকেই তো জোতদার হয়, জমিদার হয়। জমির সংস্পর্শে থাকতে থাকতে তার সঙ্গে নানা প্রকারের সম্বন্ধই হতে পারে।

কিন্তু এটা উত্তর নয়। কিংবা কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলা যায়, আমরা যা কামনা করি সেটা কি সব সময়ে আমাদের চেতনাগ্রাহ্য? সেটা আমাদের নিজস্ব কামনানা হয়ে অন্যের আকাঙ্ক্ষার অনুকরণও হতে পারে। নিজের একটা বিশিষ্ট অভাববোধ আছে, তার স্বরূপ নির্ণীত হয়নি, অথচ প্রতিকারের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, এমন সময়ে অন্যের কামনালব্ধ বিষয় দিয়ে নিজের অভাববোধটিকে প্রলেপিত করার ইচ্ছা হয়। জোতদারি রামচন্দ্রর উচ্চাভিলাষ নয়, বরং তার বিপরীত। রুপোর টাকার পাহারাদারি করতে, তাকে বাজারে চালু রাখতে উৎসাহ নেই; অথচ তার মায়া ছাড়তে না পেরে কোম্পানির কাগজ করা।

এমন হতে পারে না কি মৃত্যু এবং অবসানের সূচক উইলের ব্যাপারটাই তার মনে একটা সাময়িক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে? এবং সেব্যাপারটাও তার অজ্ঞাত?

যাই হোক, রামচন্দ্র বাড়িতে ফিরে দেখলো উঠোনে ধান মেলে দেওয়া হয়েছে। উঠোনের একপাশে বসে ধূলিধূসর ভান্‌মতি কুলোয় করে ধান ঝেড়ে পরিষ্কার করছে। রামচন্দ্র বললো, দিনরাতই কাম করিস কে?

না, বাবা, দিনরাত না।

দ্যাখ তো চেহারা কী করছিস ধানের ধুলায়?

ভান্‌মতি উঠে গিয়ে রামচন্দ্রর তামাক সেজে আনলো।

রামচন্দ্রর স্ত্রী এক এক হাঁড়ি সিদ্ধ করা ধান রোদে মেলে দিতে এলো। ধানগুলো উঠোনে ঢেলে একটা বাখারি দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে সে বললো, ধানের ধূলা গায়ে লাগে না যার সে কেমন মিয়েছিলে? তোমার ভান্মতি কি সংসার করবি নে?

কিন্তুক এ-সংসার তো সনকার। রামচন্দ্র হাসিমুখে বললো।

তা হলিও বেটার বউ শাশুড়ির পাছে পাছে ঘুরে কামকাজ শিখে নিবি।

সনকাও ভান্‌মতিকে ভালোবাসে। কিন্তু সে তাকে বেটাবউ বলে উল্লেখ করে। রামচন্দ্র তাকে মেয়ে হিসেবে দেখতে চায়।

অন্য আর একদিন সনকা অত্যন্ত মৃদুস্বরে বললো, শোনন, তোমাক এক কথা কই। তুমি যে আসনে বসো সেখানে ভান্‌মতির বসা লাগে না।

বিস্মিত হয়ে রামচন্দ্র প্রশ্ন করলো, কেন?

সনকা কণ্ঠস্বরকে আরও নিচু করে বললো, জাননে কে, অমঙ্গল হয় লোকে কয়। শ্বশুরের সামনে মাথার কাপড় ফ্যালে তা ফেলুক, তাই বলে এক আসনে বসা লাগে না।

কেন, আমার মিয়ে থাকলি কি আমার কাছে বসতো না?

সে তোমার রক্তমাংসে তৈরি হইছিলো।

তা বটে। লোকে মন্দ কবি, না?

লোকের কথার ভারি ধারি! কউক, মুঙ্‌লার বাপ মণ্ডল অন্যাই করছে, মুঙ্‌লাক শিখায়ে দিবো মাথা কাটে আনবি তার। তেজোবতী সনকা কথাটা উঁচু গলাতেই বলে ফেলো।

মেয়ের মৃত্যুর তারিখটা রামচন্দ্রর মনে আছে, কিন্তু সেটা কবে এসে পড়ে পার হয়ে যায় তা তার ঠিক খেয়াল থাকে না। কিছুদিন বাদে এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সে দেখলো, তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে সনকা সেখানে বসে দুহাত দিয়ে তুলসীমঞ্চ স্পর্শ করে অস্ফুট স্বরে হরিনাম করছে। দেখামাত্র রামচন্দ্র বুঝতে পারলো এবং ম্লান হয়ে গেলো। আজ তার মেয়ের মৃত্যুবার্ষিকী। তার স্ত্রী যেন কোনো এক অদৃশ্য পুরুষের দু পায়ে হাত রেখে মিনতি জানাচ্ছে।

রাত্রিতে রামচন্দ্র সনকাকে বললো, একটা কথা কবো?

কও।

আচ্ছা, এমন যে কদাকাটা করো, ভানুমতির লাগে না?

কেন্ লাগবি?

ধরো যে তার তো সতীন।

সনকা একেবারে কাঠ হয়ে গেলো।

কথা কও না যে!

সনকা বললো, ভান্‌মতির দুপাশে তুমি আছো আর মহিমকাকা আছে। তার মুঙ্‌লা আছে।

এই দুনিয়ার সব তার দখলে। আমার সেই ছোটোমিয়েটার জন্যি কি কেউ থাকবি নে? আমিও না?

সনকার চোখ দিয়ে জল পড়ছিলো। কথাগুলি শুধু সনকার নয়, রামচন্দ্রর অন্তঃকরণই যেন সনকার মুখ দিয়ে কথাগুলি উচ্চারণ করছিলো। রামচন্দ্রর চোখ দুটিও ঝাঁপসা হয়ে এলো। সে বললো, তুমি আমার পাশে শুয়ে শুয়ে ভগোমানের কাছে তার কথা কও। আমি যে কবের পারি নে। শেষ কথাটি বলতে গিয়ে রামচন্দ্রর ঠোঁট দুটি অবাধ্যের মতো কাঁপতে লাগলো।

.

কিছুদিনের মধ্যেই রামচন্দ্র কেষ্টদাসের অনুপস্থিতি অনুভব করতে শুরু করলো। একদিন বিকেল হলে সে নতুন মহাভারতখানা হাতে নিয়ে কোঁচার খুঁটে ধুলো মুছে আবার কুলুঙ্গিতে রেখে দিলো। সে পড়তে জানে না।

পথে পথে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একদিন রামচন্দ্রর মনে হলো আবার একটা মচ্ছোবকরলে হয়। দু-একজনকে বললোও সে কথাটা, কিন্তু অত বড়ো ব্যাপারটায় হাত দিতে যতটা দরকার তেমন উৎসাহ কেউ দেখালো না।

এই পর্যায়ে আলাপ করতে করতে একদিন রেবতী চক্রবর্তী বললো, বাপু হে, ধর্মে কি আর কারো মতি আছে?

একেবারেই নাই তা না। ধান-পান করতি দিন যায়, কীর্তন গান করে কখন কন্‌?

কথা ভালোই। ধর্মে যদি মতি হয়ে থাকে শিবমন্দির উদ্ধার করো না কেন্‌?

আলাপটা যেখানে হচ্ছিলো উদ্দিষ্ট শিবমন্দিরের ধ্বংসাবশেষটি তার থেকে খুব দূরে নয়। গ্রামের মাঝখানে এই শিবমন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ বহুদিন থেকে জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে আছে।

রামচন্দ্র বললো, রেবতদাদা, তোমার তো পুরোত বংশ। এখনো তার জন্যি দু-পাঁচ বিঘা নিষ্কর জমি ভোগ করো। একদিনও কি পূজা দেও?

রেবতী চক্রবর্তী বললো, বিশ্বম্ভর সারা বিশ্ব ভর করে আছেন, আমার বাড়িতে রোজ পূজা হয়। সে যদি কোথাও যায় তবে এখানেও আসে।

সূত্রপাত এমনি সামান্য কথাবার্তা থেকে। একদিন দেখা গেলো গ্রামের পাঁচ-সাতজন বৃদ্ধকে নিয়ে রামচন্দ্র দা হাতে করে শিবমন্দিরের জঙ্গল কাটতে লেগে গেছে। যে শক্তি ও উৎসাহের জন্য রামচন্দ্র চাষীদের মধ্যে বিশিষ্ট তার সবটুকু সে প্রয়োগ করলো জঙ্গলটার উচ্ছেদে। পথের ধার থেকে জঙ্গল শুরু হয়ে মন্দিরের চত্বর পর্যন্ত প্রায় একশ হাত চৌরশ জমি। মাঝারি ও বড়ো বেল এবং আম কাঁঠালের গাছগুলিকে রেখে অন্যসব গাছ ও আগাছা কাটতে কাটতে রামচন্দ্রর দল ধীরে ধীরে মন্দিরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

ব্যাপারটা অভিনবত্বে পথিক দাঁড়িয়ে পড়ে। রামচন্দ্র হাঁক দিয়ে বলে, ও ভাই, এদিকে আসো। তামুক খাও। পিটুলি গাছটায় একটা কোপ দিয়ে যাও। বাবা বিশ্বম্ভর কৃপা করবি। অনেকে হাসিহাসি অপ্রতিভ মুখে পালিয়ে যায়। দু-একজন তামাকের লোভে কিংবা দলেমিশবার লোভে দা হাতে করে কিছুক্ষণ কাজ করেও যায়।

একদিন মুঙ্‌লা আপত্তি জানালো সনকার মুখ দিয়ে।

সনকা রামচন্দ্রকে বললো, মুঙ্‌লা একলা পারবি কেন্‌?

কেন্ পারে না? যখন আমি থাকবো না তখন কী করবি? আমি যখন একলা করছি তখন আমার কোন শ্বশুর আসে লাঙল ধরছে? আমার যে বয়েস তাতে ওপারের খবর নেওয়া লাগে।

মুঙ্‌লার সঙ্গে লাঙল অবশ্য ধরেছিলো রামচন্দ্র কিন্তু সে যেন মুখ রক্ষা করার ব্যাপার। দুপুরের পর জমিতে ফিরে না গিয়ে রামচন্দ্র শিবমন্দিরের জঙ্গল কাটতে যায়। স্কুল-পালানো ছেলের মতো সে বলে, জমিতে রোদ্দুর, জঙ্গলে ছায়ায় বসা যায়।

.

এমনি সময়ে রামচন্দ্রর কাছে একখানা চিঠি এলো। তাকে কেউ চিঠি লিখবে এটা বিশ্বাস করাই কঠিন। অবশেষে ডাকপিওন যখন বললো খামে নবদ্বীপের ছাপ আছে তখন মনে হলো তার, এ নিশ্চয় কেষ্টদাসের চিঠি। কে পড়বে? মুঙ্‌লা কিছু পারে পড়তে, ছিদামও কিছু জানে। কিন্তু কিছু জানার উপরে নির্ভর করে এমন একটা মূল্যবান জিনিস নষ্ট করা যায় না। ব্যাপারটা শুনে ভান্‌মতি বললো, আমি একবার দেখি না। রামচন্দ্রকে বিস্মিত করে ভান্‌মতি একটু থেমে থেমে চিঠিটা পড়ে দিলো।

কেষ্টদাস নবদ্বীপে আছে। সে গ্রামে ফিরবে এমন সম্ভাবনা নেই। ছিদাম মানুষ হয়ে গেছে। তাহলেও রামচন্দ্র যেন আপকালে তাকে দেখে।

রামচন্দ্র সেদিন আদৌ জমিতে গেলো না। সন্ধ্যা হতে হতেই সে কেষ্টদাসের বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেলো। কেষ্টদাস চিঠি লিখেছে সে ভালো আছে, এই সংবাদ দেওয়ার ছিলো; সে নিজে এতদিন পদ্ম-ছিদামের দিকে লক্ষ্য রাখেনি এই দুঃখ ছিলো।

ছিদাম বাড়িতে ছিলো না। পদ্ম তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে ঘরে উঠতে গিয়ে রামচন্দ্রকে দেখতে পেলো।

ছিদাম বাড়িতে নাই?

সানিকদিয়ারে গেছে, বসেন।

কী কর্তব্য তাই ভাবছিলো রামচন্দ্র, ততক্ষণে পদ্ম মাদুর পেতে দিয়ে ‘বসেন, আলো জ্বালে আনি’ বলে চলে গেছে।

আলো জ্বেলে এনে পদ্ম খানিকটা সময় কপাট ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।

রামচন্দ্র বললো, শুনছো না, কন্যে, গোঁসাই চিঠি দিছে, সে ভালোই আছে নবদ্বীপে।

আমরা কোনো চিঠি পাই নাই। ছিদাম চিঠি দিছলো কাকে দিয়ে লেখায়ে। তা মনে কয় ঠিকানায় ফের পায় নাই।

ইতিমধ্যে একসময়ে পানের বাটা নিয়ে এসেছিলো পদ্ম। সে মুখ নিচু করে পান সাজতে লাগলো। সন্ধ্যার স্নিগ্ধ হাওয়ায় মাটিতে ছড়ানো একগোছ পাতা উড়ে উড়ে বেড়ালো বারান্দার নিচের আঙিনাটুকুতে। শাদা মাটিতে লেপা বারান্দা, দেয়াল, আঙিনায় স্নান আলো এবং ছায়ায় জালিকাটা।

এর আগেও মহাভারতের আসরে পান এসেছে, কখনো রেকাবিতে,কখনো ছিদামের হাতে। আজ রামচন্দ্রর প্রসারিত হাতে পান দিতে গিয়ে পদ্মর হাতখানা যেন একটি দীর্ঘতর মুহূর্ত রামচন্দ্রর হাতের উপরে রইলো।

পদ্ম বললো, আপনি শিবমন্দির পতিষ্ঠে করতিছেন?

শুনছো? পতিষ্ঠে কোথায়–আছেই তো।

পদ্ম হেসে বললো, মুঙ্‌লা কয়, বাবা যদি শি নিয়ে থাকে, জমি দ্যাখে কে?

অমন কয়। কও, পদ্ম, আমি যখন না-থাকা হধ্যে তখন? আজ যে কেষ্টদাস নাই, ছিদামের সকল একা একা করবের হয় না?

পদ্ম নিজে থেকে মাদুরের একপ্রান্তে বসলো। একটা যেন আকুল নিষেধ ফুটে উঠলো তার স্বরে। সে বললো, এমন না-থাকার কথা কন্ কেন্‌?

তার মনে হতে লাগলো, বলিষ্ঠতা, অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার প্রতীক বলে যাকে মনে হয় তার মুখে এ কী কথা! সে আবার বললো, এ কথা কি আপনের বাড়ির সকলে মানে নিছে?

সে যখন এ কথা কয়টি বললো তখন অনুভব করলো : তোমার চারিপাশে তারুণ্য ও মধুর চপলতার অজস্র উপকরণ ছড়িয়ে রাখলে এমন মনোভাব হতো না তোমার। বলা বাহুল্য, এ ভাষা তার জানা নেই, সুতরাং এই চিন্তাটুকুর অংশ হিসেবে মধুর হাসি ও চোখের বিদ্যুৎইতস্তত ছড়ানো রইলো। এবং সে বুঝতে পারলোনা, তার নিজের চোখ দুটি যে-কোনো পুরুষের সম্ভাব্য কামনার স্নিগ্ধ আশ্রয়ের মতো ডাগর হয়ে ফুটে উঠেছে।

ছিদাম এলো না। আর একটু অপেক্ষা করে রামচন্দ্র চলে গেলো।

কিছুক্ষণ বাদে পদ্মর আত্মপ্রসারী ব্যাকুলতাটা সংকুচিত হয়ে তার দৈনন্দিন আবরণে আত্মগোপন করলো।কবিপ্রসিদ্ধিতে কোনো কোনো ফুল এমনি দিনেরাত্রে সংকুচিত হয়।নতুবা এই সংকোচে অনুশোচনা ছিলো না।

রামচন্দ্র পথে বেরিয়ে অনেকটা দূর নির্দিষ্ট কিছু চিন্তা করলো না। তার নিজের মনের একটা খুশি খুশি ভাব সে উপভোগ করছিলো। অন্ধকারে সান্যালবাড়ির হাতার পাশে চলতে চলতে হাসনাহেনার গন্ধটাও এখন উপভোগ্য বোধহয়। এরপরে এই খুশির কারণ অনুসন্ধান না করলেও তার মনে পড়লো, পদ্মর মুখের গড়নটা যে এমন তা সে জানতো না। আর পদ্ম একটা রুপোর চিক্‌হার পরেছিলো। সেটা নিশ্চয়ই নতুন, নতুবা অত সুন্দর দেখাতো না।

.

রামচন্দ্র মন্দিরের চত্বর পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। সেকালের জমাট সুরকি আতর দেওয়া চত্বর। অধিকাংশ জায়গায় ভেঙে চটা উঠে গেছে। সে-জীর্ণতার এখানে-সেখানে দু-একটি পাকুড় জাতীয় গাছ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। তবুচত্বরে পৌঁছতে পেরে রামচন্দ্র অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলো। সে চত্বরের একাংশে বসে সঙ্গীদের নিয়ে গল্প করছিলো। সান্যালমশাই বলেছেন–গ্রামের লোকদের যদি সত্যি এত আগ্রহ হয়ে থাকে তবে তার বাড়ির কাজ শেষ হলে মিস্ত্রীদের তিনি পাঠিয়ে দেবেন। মেরামত করে মন্দিরটাকে উদ্ধার করা যায় কিনা চেষ্টা করে দেখা যাবে।

রামচন্দ্র এই কথাটা আনন্দের সঙ্গে রটনা করছিলো।

এইরকম আলাপের এক ফাঁকে একজন বৃদ্ধ একদিন বললো, এমন সময়ে যদি কেষ্টদাস থাকতো তবে তোমার সুবিধা হতে মণ্ডল।

কোথা থেকে কী কথা উঠে পড়লো। আলাপটা গড়াতে গড়াতে কেষ্টদাসের পারিবারিক ব্যাপারকে অবলম্বন করলো।

সে থাকেইবা কী করে? ক্ষেত খামার সংসার সে কোন কালে দেখছে?

তাইলেও অমন ভালো না।

কি ভালো না?

বৃদ্ধটি বোধহয় কেষ্টদাসের সঙ্গে নিজের অবস্থার তুলনা করেছে। বয়েস হয়েছে, বিদায়ের কথা তারও মনে হয়। তার অভাবেও বাড়ির আর-সকলের জীবন স্বাভাবিক কথাবার্তা হাসিখুশিকে অবলম্বন করে অগ্রসর হবে–এটা ভাবতে যেন তার মন দমে যায়। সে বললো, তাই বলে এত হাসিখুশি এত কথাবার্তা ভালো না।

মানুষে কি চেরকালই মুখ গাো করে থাকবের পারে?

তা না পারে, কিন্তু তুমি দেখো রামচন্দ্র, ছিদাম আর পদ্ম যেন খুব কাছাকাছি গিছে।

তা একই বয়েস, ভাই-বন্ধুর মতো ওরা খাটেখোট। বললো রামচন্দ্র। 

অন্য এক অবসরে রামচন্দ্র ভাবলো, বুড়োটা কী শুনতে কী শুনেছে। কিন্তু প্রতিবেশীরা যদি এরকম মনে করে যে কেষ্টদাস চলে যাওয়াতে তারা দুঃখিত না হয়ে বরং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, সেটাও তো ভালো নয়। মানুষের এমন নির্দয় হওয়া উচিত নয়। এই সময়ে একবার তার পর গলার চিহারটার কথা মনে পড়লোহার পরার বয়েস তার পার হয়নি, তবে এদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, হারটা আর দু-চারদিন পরে পরলেই ভালো ছিলো।

ছিদামকে এ-বিষয়ে উপদেশ দেওয়া উচিত কিনা মনে মনে এই আলোচনা করতে করতে কিছু সময় চলে গেলো।

সানিকদিয়ারের জারু কামারের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর একটি বিবাহযোগ্য মেয়ে ছিলো। কেষ্টদাস তাদের পাল্টাঘর। চাষী হিসাবে ছিদাম উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠবে এমন সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। জারু কামার একদিন খোঁজখবর নিতে এসেছিলো।

সে যখন স্বগ্রামে ফিরে যাচ্ছে তখন রামচন্দ্রর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিলো।

জারু বললো, কেন, পদ্ম কি কেষ্টদাসের ইস্ত্রি না?

গাঁয়ের লোক তো তাই জানে। এ কথা কন্ যে?

ছিদামও তো কেষ্টদাসের ছাওয়াল?

আপনের কথা ধরবের পারি না।

জারু কথা ভাঙলো না। মামুলি দু-একটা কথা বলে সে চলে গেলো।

রামচন্দ্ৰইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিলো। বিষণ্ণতায় সেদীর্ঘকাল মুহ্যমান হয়ে রইলো। কেষ্টদাস আপদে-বিপদেছিদামদের রক্ষাকরার জন্য চিঠিতে অনুরোধকরেছে। কিন্তু একীবিপদে পড়লো ছিদাম। মানুষের মন, বিলের ঠাণ্ডা জলেও ঝড় উঠলে ভরা ডুবি। আহা, এ থেকে কি তাকে রক্ষা করা যাবে?

কিন্তু ধর্মকে রক্ষা করতে হবে। তাই যদি না করা গেলে তবে বৃথাই শিবমন্দির করা। অবশেষে একদিন রামচন্দ্র ছিদামকে ডেকে নিলো। শিবমন্দিরের চত্বরটুকু ভরদুপুরে নির্জন থাকে। কথা বলার পক্ষে এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন।

ছিদাম বিস্মিত হয়ে বললো, কে, জ্যাঠা, এখানে ডাকে পাঠাইছো যে?

আয়, আয়, একটুকু কথা কই।

কিছুক্ষণ চাষবাস নিয়ে আলাপহলো। তারপর রামচন্দ্র বললো, তোক এক কথা কই, শোন। গোঁসাই যে মহাভারত পড়ে, শুনছিস? তার মধ্যে ভীষ্মর এক কথা আছে। তার মতো বীর আর কৈল কেউ না। ইচ্ছা করলি ধেনুকে বাণ জুড়ে সাতদিনে না কয়দিনে পৃথিমি রসাতলে দিবের পারে। ধরো যে সে গঙ্গার ছাওয়াল, পদ্মা আর গঙ্গা ধরো যে একই। এক মচ্ছকুমারী দেখে ভীষ্মর বাবার ইচ্ছা হলো তাক ঘরে আনে। খবর শুনে ভীষ্ম বলে কন্যেক নিয়ে আসি। ভীষ্মর বাপ বুড়া আর সে জুয়ান। কন্যের মা বাপ কন্যের বিয়ে দিতে চায় ভীষ্মর সঙ্গে। ভীষ্ম কয়, তা হয় না, বাপ যখন তাক চায়েছে ওকন্যে তারই। অথচ মনে করো, ইচ্ছা করলি সে-ই রাজকন্যে পাতে পারতো।

ছিদাম গল্পটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। গল্পটাকে মনে মনে আলোচনা করে সে বললো অবশেষে, একথা কন যে?

ভাবে দ্যাখো ভীষ্ম কত বড়ো। আমরা কি এত পারি? তাইলেও কিছু তো করবের হবি?

এরপরে অন্য অনেক কথা হলো। জমিজমার কথা রামচন্দ্রর মতো কে বলতে পারে। আর আজ সে যেন বহুদিন পরে মন খুলে জমিজমার কথাই আলোচনা করলো।

কিন্তু ছিদাম ভীষ্মর উপাখ্যান ভুলতে পারলোনা। এই গল্পটা বলার জন্যই যে রামচন্দ্র তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো চিন্তা করতে গিয়ে সে-বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ হলো।

পদ্মর কথা তার মনে পড়লো। যেদিন ক্লান্ত অসুস্থ পদ্ম প্রথম এসেছিলো সেদিন থেকে আজ  পর্যন্ত কতভাবেই না সে পদ্মকে দেখেছে। অক্লান্তকর্মা পদ্ম, যে-পদ্ম গান বেঁধে দেয়, এক-হাঁটু, জলকাদায় যে ধানের জমিতে কাজ করে পাশে দাঁড়িয়ে। পদ্মই তাকে উৎসাহিত করে চাষী করেছে।

একদিন ছিদাম বলেছিলো, কেন, এত খাটবো কেন?

মুঙ্‌লাও তো খাটে।

তার বাপ-মা আছে, ভান্‌মতি আছে। আমার বাপ কনে গেছে কে জানে, মাকে জন্মের কালে খাইছি।

পদ্ম কাছে এসে দাঁড়িয়ে রসিকতা করে বলেছিলো, ভান্‌মতি একটা আনে দিবো।

আমি কি তাই কইছি?

কোনো অভাব বোধ ছিদামের নেই। মুঙ্‌লা ভান্‌মতিকে পাওয়ায় সে কিছুটা দুঃখিত হয়েছিলো। কারণ, মুঙ্‌লাকে সে আর তেমন করে পায় না। কিন্তু তার বদলে পদ্মকে সে যেন আরও কাছে পেয়েছে। এক রাত্রিতে চারিদিকে যখন জ্যোৎস্নার অগাধ নির্জনতা তখন ছিদাম পদ্মর পাশে বসে মাথালটা মেরামত করছিল। সে বললো, তোমাক পদ্মই কবো।

কও।

দ্যাখো, পদ্ম, মানুষ যে বিয়ে করে কেন তা বুঝি না। কিন্তুক আমার যদি কোনোকালে বউ আনো দেখেশুনে আনবা। সে যদি তোমার মতো কথা কবের না জানে, যদি আমাক দিয়ে এমন করে খাটায়ে না নেয় তবে কৈল আমি জমিজমা নিয়ে খাটবের পারি নে।

কিন্তু যে কথাটা বারবার মনে আসতে চাচ্ছে আর ছিদাম ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে সেটা বাইরের কথা নয়। সমবয়সী কৃষকদের দলে আলাপের সময়ে বউয়ের কথা উঠে পড়া স্বাভাবিক। যৌবনের ধর্ম অনুসারে ছিদামের মনেও একটি গৃহকোণের স্বপ্নচিত্র ফুটে ওঠে,সে গৃহের হাসিমুখটুকুর সঙ্গে পদ্মর সাদৃশ্য থাকে।

ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার কথা শুনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ছিদামের সহসা অনুভব হলে এখন বাড়ি ফিরলে সে হয়তো পদ্মকে এসব কথা বলে ফেলবে। বাড়ির কাছাকাছি এসে ফিরে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুতপদে সে এরশাদের বাড়ির দিকে রওনা হলো, যেন সেখানে কিছু কাজ পড়ে আছে।

সন্ধ্যার অন্ধকারে সে বাড়ি ফিরলো।

ছিদাম আস্‌লে? বলে পদ্ম এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে।

যেন মস্ত একটা ধানের বোঝা তার পিঠে চাপানো আছে, কথা বলার মতো দম আর অবশিষ্ট নেই, এমন ভঙ্গিতে ছিদাম পদ্মর পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলো। অন্ন-জল, লাঙল-মাটির মতো যে বিষয়টিকে প্রাত্যহিক অভ্যস্ততায় সে গ্রহণ করতে পেরেছিলো, ভীষ্মর গল্প শোনার পর সেটার গূঢ় অর্থ তার চোখের সম্মুখে খুলে গেছে। আর কোনোদিনই যেন সে সহজ হয়ে পদ্মর সঙ্গে কথা বলতে পারবে না।

কুপি জ্বেলে নিয়ে পদ্ম ঘরে এলো। কী হইছে, ছিদাম, কোনো অন্যাই কাজ করছো?

ছিদাম নিরুত্তর।

রাত্রিতে আহারের জায়গা করে পদ্ম বললো, খাতে আসো, ছিদাম।

সাড়া না পেয়ে ঘরে ঢুকে সে দেখলো ছিদাম বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে করে আরও কাছে গিয়ে পদ্ম দেখলো, চাপা কান্নার মতো একটা অত্যন্ত মৃদু আলোড়নে ছিদাম কেঁপে কেঁপে উঠেছে।

পদ্ম বিছানায় বসে ছিদামের পিঠে হাত রেখে বললো, কেন, কাঁদো কে ছিদাম?

ছিদামের কান্না এবার প্রকাশিত হলো। সে উঠে বসলো, তার দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।কী বলে সান্ত্বনা দেওয়া যাবে,কী সম্বোধন করলে ছিদামের দুঃখ দূর হয়, চিন্তা করলো পদ্ম। কী হইছে, সখা? কী হইছে, ভাই?

ছিদাম ভেবেছিলো সে প্রাণ থাকতে ভীষ্মর উপাখ্যান শোনার কথা পদ্মকে বলবে না, অন্তত উপাখ্যান শুনে রামচন্দ্রর বক্তব্য সম্বন্ধে তার কী মনে হয়েছে তা কখনো তাকে বলা যায় না। কিন্তু সহসা সে বলে ফেলো।

পদ্ম মুখ নিচু করে শুনলো। গল্প শেষ হলে উঠে দাঁড়িয়ে সে বললে, রাত হইছে, খাতে চলো।

কে, পদ্ম, আমি কী করবো?

কিছু করবা না। পদ্ম দৃঢ়স্বরে বললো

একটা পার্থক্যের দেয়াল দুজনের মাঝখানে রচনা করার চেষ্টা করলো ছিদাম। অন্যান্য ব্যাপারে যেমন, এ বিষয়েও তেমনি তাকে পদ্ম সাহায্য করতে অগ্রসর হলো। রান্নাঘরে ছিদামের আহার্য ঠিক করে রেখে পদ্ম ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। প্রয়োজনেও কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। ছিদাম জমিজিরাত তদারক করতে যায় না। তার আহারে রুচি নেই। পদ্ম অনুনয় করতে বাধ্য হয়। ছিদাম ঘরে চলে এলে নিজের আহার্য অনেকসময়ে গোরুর মুখের সম্মুখে ধরে দিয়ে অভুক্ত পদ্ম ঘরে এসে পান সাজতে বসে। এক রাত্রিতে ছিদামকে পান দিয়ে সে চলে যাচ্ছিলো, হঠাৎ ফিরে দাঁড়ালো। তার চোখ দুটি ঝকঝক করে উঠলো। সে বললো, তুমি আমাক খাওয়াও পরাও, যত্ন করো। মাথায় করে রাখছে। যেভাবে সেভাবেই তোমার আমি।

সে রাত্রি শেষ হতে তখনো বাকি ছিলো। ছিদাম উঠে গিয়ে দেখলো পদ্ম তার বিছানায় নেই। সে কুপি ধরিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে দেখলো, একটা খুঁটির পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে পদ্ম।

পদ্ম?

আসো। কুপিটা নিয়ে দেও, চোখে লাগে।

এ যেন কোনোদিনই পরিচিত নয় এমন এক পদ্মর কণ্ঠস্বর।

আর একদিন রাত্রিতে ছিদাম পদ্মর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

আমি বলি কি, আমি চলে যাই। পদ্ম বললো।

কোথায় যাবা?

শূন্য থেকে আসছিলাম আবার কোনো শূন্য খুঁজে নিবো।

তাই যাও।

কিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ছিদাম বললো, তা যেন যাবা, একদিন যখন আবার দেখবের ইচ্ছা করবি?

পদ্ম হু হু করে কেঁদে ফেলো।

পরদিন অত্যন্ত সকালে ঘুম থেকে উঠে দরজা খোলা দেখে পদ্মর মনে হলো ছিদাম বোধহয় আজ অন্যদিনের চাইতে প্রত্যুষে উঠেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন ছিদাম এলো না তখন সে ভাবলো, কয়েকদিন জমিতে যায়নি, আজ বোধহয় অনুতাপে পুড়ে রাত থাকতে উঠে সেখানেই গেছে। একটা আলোড়নের পরে সংসার আবার নতুনভাবে স্থিতিলাভ করবে এই আশায় পদ্মর মুখখানা হাসি হাসি হয়ে উঠলো।

দুপুর গড়িয়ে গেলে রান্না শেষ করে পদ্ম অপেক্ষা করতে লাগল। বেলা গড়িয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে যে ভয়টা সৃষ্টি হচ্ছিলো সেটা সন্ধ্যায় বিভীষিকা হয়ে উঠলো। একা একা অন্ধকার পথে সে খানিকটা ঘুরে এলো। রাত্রিতে জেগে বসে থাকতে থাকতে পদ্ম পর্যায়ক্রমে একবার চোখ ঢেকে কাঁদলো, আর একবার পথের দিকে তাকালো। দ্বিতীয় দিন সে দুখানা গ্রামের পথে পথে একা একা ঘুরে বেড়ালো। তৃতীয় দিনে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে আরম্ভ করলো। সেদিন সন্ধ্যার পর সে রামচন্দ্রর স্ত্রীর কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লো।

সনকা বললো, কিনে গেলো?

জান্ নে।

কেন্ গেলো?

জান্ নে।

রামচন্দ্র শুনে বললো, রাগ করছিলো?

না।

তুমি কিছু কইছিলা?

কইছিলাম, চলে যাবো।

প্রায় সাতদিন পরে ছিদামের সংবাদ পেলো পদ্ম নিজেই। যে অসম্ভব জায়গায় তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো তার থেকেই প্রমাণ হয়, পদ্ম এ কয়েকটি দিনে সম্ভব-অসম্ভব কোনো জায়গাই খুঁজতে ছাড়েনি।

শিবমন্দিরে কাজ করতে এসে তার কান্নার শব্দ অনুসরণ করে পদ্মকে দেখতে পেলো রামচন্দ্র। ছিদাম আত্মহত্যা করেছে। শিবমন্দিরের পিছন দিকে এখনো অনেক জঙ্গল। সেখানে একটা গাছের নিচু ডাল থেকে ছিদামের মৃতদেহ ঝুলছে।

রামচন্দ্র কাছে গিয়ে দাঁড়ালে পদ্ম প্রথমে হাহাকার করে উঠলো, তারপরে পাথর হয়ে। গেলো। রামচন্দ্রর লোকজন শবটিকে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে লাগলো।

পদ্ম আর কাঁদলো না। পূতিগন্ধ গলিত মৃতদেহটার পাশে লুটিয়ে পড়ে সে ফিসফিস করে বললো, শোনো, ওঠো, কয়দিন ছান করো নাই, খাও নাই। চলো, আমরা চলেই যাবো। এখন ওঠো, খাও নাই যে। দ্যাখো না, চুলেও তেলজল পড়ে নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *