জন-অরণ্যের নেপথ্য কাহিনী
কোনো গল্প-উপন্যাস পাঠক-পাঠিকাদের ভালো লাগলে লেখকের যেমন আনন্দ তেমনি নানা অসুবিধে। পথে-ঘাটে, ট্রামে-বাসে, আপিসে-রেস্তরাঁয় পরিচিতজনরা এগিয়ে এসে বলেন, তোমার অমক বইটা পড়লাম–দারণ হয়েছে। ডাকপিওন অপরিচিতজনদের চিঠির ডালি উপহার দিয়ে যায়; সম্পাদক ও প্রকাশকের দপ্তর থেকে রি-ডাইরেকটেড হয়েও অনেক অভিনন্দন-পত্র আসে। এসব অবশ্যই ভালো লাগে। কিন্তু অসুবিধে শুরু হয় যখন উপন্যাসের মূল কাহিনী সম্পর্কে পাঠকের মনে কৌতূহল জমতে থাকে।
তখন প্রশ্ন ওঠে, অমুক কাহিনীটি কী সত্য? কেউ-কেউ ধরে নেন, নির্জলা সত্যকেই গল্পের নামাবলী পরিয়ে লেখকেরা আধুনিক সাহিত্যের আসরে উপস্থাপন করে থাকেন। আর একদল বিরক্তভাবে বলে ওঠেন, “সব ঝুটা হ্যায়—জীবনে এসব কখনই ঘটে না, সস্তা হাততালি এবং জনপ্রিয়তার লোভে বানানো গল্পকে সত্য-সত্য ঢঙে পরিবেশন করে লেখকেরা দেশের সর্বনাশ করেছেন।
জন-অরণ্য উপন্যাস নিয়ে আমাকে এই ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপে পাঠক ও দর্শকের কৌতূহলে ইন্ধন জুগিয়েছে। দেশের বিভিন্ন মহলে কাহিনীর পক্ষে এবং বিপক্ষে বিতর্কের ঝড় উঠেছে।
প্রত্যেক গল্পের পিছনেই একটা গল্প লেখার গল্প থাকে এবং জন-অরণ্য লেখার সেই নেপথ্য কাহিনীটা স্বীকারোক্তি হিসেবে আদায় করবার জন্য অনেকেই আমার উপর চাপ দিয়েছেন। কৌতূহলী পাঠকদের এতোদিন আমি নানা তর্কজালে আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি। বলেছি, “থিয়েটারের সাজঘর দেখলে নাটক দেখবার আকর্ষণ নষ্ট হতে পারে।” কিন্তু সে যুক্তি শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। বিদেশের লেখকরা নাকি গল্প লেখার সাজঘরের গল্পটাও অনেক সময় উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। বিখ্যাত এক সায়েবলেখকের নাম করে জনৈকা পাঠিকা জানালেন, “আপনি তো আর মিস্টার অমুকের থেকে কৃতী লেখক নন? তিনি যখন তাঁর অমুক উপন্যাস রচনার ইতিহাসটা বই-আকারে লিখে ফেলেছেন তখন আপনার আপত্তি কোথায়?”
মহিলার কথায় মনে পড়লো, উপন্যাস রচনার জন্য সংগহীত কাগজপত্র, নোটবই, প্রথম খসড়া ইত্যাদি সম্পর্কে এখন বিদেশে বেশ ঔৎসুক্য সষ্টি হয়েছে। ওয়াশিংটনে পৃথিবীর বহত্তম গ্রন্থাগার লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের পাণ্ডুলিপি বিভাগে এই ধরনের ওয়ার্কিং পেপার সযত্নে সংগ্রহ করা হচ্ছে। ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে ওই গ্রন্থাগারে আমাকে জেমস মিচনারের ‘হাওয়াই’ উপন্যাস সংক্রান্ত ওয়াকিং পেপারস-এর একটা বাক্স সগর্বে দেখানো হয়েছিল।
আমার পাঠিকাকে বলেছিলাম, “আমরা এখনও সায়েব হইনি। পড়াশোনা, অনুসন্ধান, গবেষণা, লেখালেখি, কাটাকাটির পরে শেষপর্যন্ত যে বইটা বেরুলো তাই নিয়েই পাঠকদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তার আগে কী হলো, তা নিয়ে লেখক ছাড়া আর কারুর মাথা-ব্যথ্যর যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।”
পাঠিকা মোটেই একমত হলেন না—সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করে বললেন, “লজ্জা পাবার মতো কিছু, যদি না করে থাকেন, তাহলে কোনো কিছুই গোপন করবেন না।”
এরপর চুপচাপ থাকা বেশ শক্ত। কাতরভাবে নিবেদন করলাম, “এদেশে মূল উপন্যাসটাই লোকে পড়তে চায় না। উপন্যাসটা কীভাবে লেখা হলো সে-বিষয়ে কার মাথা-ব্যথা বলুন?”
মহিলা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, “ওসব ছেলে-ভুলোনো কথায় মেয়ে ভুলতে পারবেন। আপনার জন-অরণ্য লেখার গল্পটা আমরা পড়তে চাই।”
অতএব আমার গত্যন্তর নেই। জন-অরণ্য উপন্যাসের গোড়ার কথা থেকেই শর করতে হয়।
এই উপন্যাস লেখার প্রথম পরিকল্পনা এসেছিল আমার বেকার জীবনে। সে অনেকদিন আগেকার কথা। বাবা হঠাৎ মারা গিয়ে বিরাট সংসারের বোঝা আমার মাথার ওপর চাপিয়েছেন। একটা চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অথচ আফিস অথবা কারখানার কাউকে চিনি না—চাকরি কী করে যোগাড় করতে হয় তাও জানি না। এই অবস্থায় নতুন আপিসে গিয়ে লিফটে চড়তে সাহস পেতাম না—আমার ভয় ছিল লিফটে চড়তে হলে পয়সা দিতে হয়। চাকরির সন্ধানে সারাদিন ঘরে ঘরে কলকাতার আপিসপাড়া সম্বন্ধে আমার মনে বিচিত্র এক ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল। একদিন এক পদস্থ ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে আমাকে বকুনি লাগালেন, “বাঙালীরা কি চাকরি ছাড়া আর কিছু, জানবে না? বিজনেস করুন না?”
“কিসের বিজনেস?” ভদ্রলোক বললেন, “এনিথিং—ফ্রম আলপিন টু এলিফ্যান্ট।”
সেই শুরু। বিজনেসে নেমে পড়বার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই সময় পার্কেচক্রে এক মাদ্রাজি ছোকরার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেলো—মিস্টার ঘোষ নামে এক বাঙালী ফাইনানসিয়ারের সহযোগিতায় তিনি ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেট তৈরির ব্যবসা খুলেছেন। আমি ওই কোম্পানির এজেন্ট।
বাস্কেট তৈরির সেই কারখানা এক আজব জায়গায়। তার ঝুড়িগুলো রং হতো মধ্য কলকাতার এক পুরানো বাড়িতে। এই রং করতেন কয়েকজন সিন্ধি এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা-সন্ধ্যেবেলায় যাঁদের অন্য পেশা ছিল। দেহবিয় করেও দেহধারণ কঠিন হয়ে পড়েছিল বলে এঁরা এই পার্টটাইম কুটিরশিল্পে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তখন আমার কম বয়স, কলকাতার অন্ধকার জীবনযাত্রা সম্পর্কে কিছুই জানি না। এইসব স্নেহশীলা মহিলাদের সাক্ষাৎ-সংস্পর্শে এসে অভিজ্ঞতার এক নতুন দিগন্ত আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হলো।
অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসায়ে নেমে আপিসপাড়ার যে-জীবনকে দেখলাম তার কিছুটা ‘চৌরঙ্গী’র মুখবন্ধে নিবেদন করেছি। অনেক কোম্পানির কোট-প্যান্ট-চশমাপরা ক্রেতা গোপনে বাড়তি কমিশন চাইতেন, হাতে কিছু গুঁজে না দিলে পাঁচ-ছ’টাকার অর্ডারও তাঁরা হাতছাড়া করতেন না। মানুষের এই অরণ্যে পথ হারিয়ে মানুষ সম্বন্ধে যখন আশা ছাড়তে বসেছিলাম তখন ডালহৌসি-পাড়ার সাহেবী আপিসে এক দারোয়ানজীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। দারোয়ানজী সস্নেহে আমার কাছ থেকে কয়েকটা ঝুড়ি কিনলেন, সঙ্গে সঙ্গে পেমেন্টের ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি ভাবলাম দারোয়ানজীর এই স্পেশাল আগ্রহের স্পেশাল কারণ আছে। বিক্রির টাকাটা হাতে পেয়ে দারোয়ানজীকে কমিশন দিতে গেলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, “ছি ছি! ভেবেছো কি? তোমার কাছ থেকে পয়সা নেবার জন্যে এই কাজ করেছি আমি! ঘামে ভেজা তোমার অন্ধকার মুখখানা দেখে আমার কষ্ট হয়েছিল, তাই তোমাকে সাহায্য করেছি।”
দারোয়ানজী সেদিন আমাকে মাটির ভাঁড়ে চা খাইয়েছিলেন। নানা মূল্যবান উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।”
জীবনের এক সঙ্কটমুহূর্তে ডালহৌসি-পাড়ার অশিক্ষিত দারোয়ান আমাকে বাঁচিয়েছিল—আমি হেরে যেতে যেতে হারলাম না।
আমার মনের সেই অনুভূতি আজও নিঃশেষ হয়নি—মানুষকে আমি কিছুতেই পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারি না। কিন্তু ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেট হাতে দোকানে দোকানে, আপিসে আপিসে ঘরে মানুষের নির্লজ্জ নগ্নরূপ দেখেছি। দু-একটা জায়গায় ঝুড়ি জমা দিয়ে একটা পয়সাও আদায় করতে পারিনি। এক সপ্তাহ পায়ে হেঁটে আপিসপাড়ায় এসে এবং টিফিন না করে আমাকে সেই ক্ষতির খেসারৎ দিতে হয়েছে। ক্যানিং স্ট্রীটের একটা দোকানে ছ’টা ঝুড়ি দিয়েছিলাম—অন্তত তিরিশবার গিয়েও পয়সা অথবা ঝুড়ি কোনোটাই উদ্ধার করতে পারিনি। তবু যে পুরোপুরি হতাশ হইনি, তার কারণ মধ্যদিনে মধ্য-কলকাতার বান্ধবীরা। তাঁরা আমাকে উৎসাহ দিতেন। বলতেন, দেহের ব্যবসাতেও অনেক সময় টাকা মারা যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সুযোগ আসে যখন সমস্ত লোকসান সুদসমেত উসুল হয়ে যায়।
আমারও সামনে একদিন তেমন সম্ভাবনার ইঙ্গিত ঝলমল করে উঠলো। এক ভদ্রলোক বললেন, তিনি ডিসপোজাল থেকে খুব সস্তাদরে কিছু স্টীল বেলিং হুফ কিনেছেন। দাম বললেন এবং জানালেন, এর ওপর চড়িয়ে আমি যত দামে মাল বিক্রি করতে পারবো সবটাই আমার প্রফিট।
এইসব বেলিং হুফ কাপড়ের কল এবং জুট মিলে লাগে। কয়েকদিন খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, ঠিক মতো পার্টি যোগাড় করতে পারলে বেশ কয়েক হাজার টাকা লাভের সম্ভাবনা আছে। বিজনেসে বড়লোক হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনেক আপিসে ঘুরলাম। কিন্তু কোনো ফল হলো না। শেষে এক বন্ধ ভদ্রলোক আমার ওপর দয়াপরবশ হয়ে বললেন, “এইভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য হয় না ভাই—বড় বড় কারখানায় আপনার জানশোনা কোনো অফিসার নেই? ওই রকম কারুর মাধ্যমে পারচেজ অফিসারদের নরম করবার চেষ্টা করুন।”
অফিসারকে নরম করবার ব্যাপারটা তখনও বুঝে উঠতে পারিনি। একজন পরিচিত ভদ্রলোকের সাহায্যে এক জুট মিলে কিছুটা এগোলাম। জিনিসের নমুনা দিলাম। দামও যে সস্তা জানিয়ে দিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না। পরিচিত ভদ্রলোক আমার দুঃখে কষ্ট পেয়ে বললেন, “পারচেজ অফিসার মালিকের আত্মীয়-ওরা নিজেদের খেয়ালখুশী মতো চলে, ওদের সাতখুন মাপ।”
ভদ্রলোকের কাছে যাতায়াত করে জুতোর হাফসোল খুইয়ে ফেলেছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু করা গেলো না। উনি কেন যে আমাকে অর্ডার দিলেন না তাও অজানা রয়ে গেলো।
শেষ পর্যন্ত ছোটখাট একটা চাকরি যোগাড় হয়ে যাওয়ায় ব্যবসার লাইন ছেড়ে বিজনেসে বড়লোক হবার স্বপ্নটা চিরদিনের মতো বিসর্জন দিয়েছি। এমন সময় একদিন মধ্য-কলকাতার সেই বাড়িতে গিয়েছি, কিছু হিসেব-পত্তর বাকি ছিল। তখন দুপুর তিনটে। রোজী নামে এক খ্রীষ্টান দেহপসারিণীর সঙ্গে আমার খুব আলাপ ছিল। তার ঘরে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেলাম—আমার পরিচিত পারচেজ অফিসার সেখানে বসেই দুদণ্ডের আনন্দ উপভোগ করছেন। মিনিট দশেকের মধ্যেই ভদ্রলোক বিদায় নিলেন।
পরে শুনেছি, আমাদের কোম্পানির মাদ্রাজি যুবকের বিশিষ্ট অতিথি হিসাবেই ভদ্রলোক রোজীর বিজন কক্ষে এসেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সেই বেলিং হুফ যা আমি বেচতে পারিনি তা তিনি রোজীর দেহসান্নিধ্যে সন্তুষ্ট হয়ে চড়া দরে কিনেছেন। রোজী আমার বোকামিতে বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “ইউ আর এ ব্লাডি ফুল। আমাকে আগে বলোনি কেন?”
অস্বস্তিকর এই ঘটনা আমার মনের গভীরে গেঁথে গিয়েছিল। কিন্তু তখন অন্য এক জগতে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার নাটকে দুলতে আরম্ভ করেছি। আমার সামনে নতুন এক পৃথিবীর সিংহদ্বার সহসা উন্মীলিত হয়েছে, যার অন্তঃপুরে বসবাস করছেন বিচিত্র এক বিদেশী–নাম নোয়েল বারওয়েল।
সাহিত্যের নিত্য-নূতন পথে ঘুরতে ঘুরতে ব্যর্থ বিজনেসম্যান শংকর-এর ছবিটা আমার অজান্তেই অস্পষ্ট হতে আরম্ভ করেছিল। এ-সম্বন্ধে লেখবার ইচ্ছেও তেমনি ছিল না। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। কিছু দিন আগে খেয়ালের বশে একলা পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে লালবাজারের পূর্ব দিকে হাজির হয়েছি। কোনো সময় রবীন্দ্র সরণি ধরে হ্যারিসন রোডের দিকে ছুটতে আরম্ভ করেছিলাম। নতুন সি আই টি রোডের মোড়ে এসে দেখলাম লোকে লোকারণ্য চিৎপুর রোডে ট্রাম বাস ট্যাক্সি এবং টেম্পোর জটিল জট পাকিয়েছে। জ্যাম জমাট এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে একটা সেকেলে ধরনের ট্রামগাড়ির বৃদ্ধ ড্রাইভার করুণভাবে ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে। বিরাট এই যন্ত্রদানবকে হঠাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায় গিরগিটির মতো মনে হলো। বেশ কিছুক্ষণ আমি ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম পথের ধারে একটা বিবর্ণ মলিন ল্যাম্পপোস্টের তলায় তেইশ-চব্বিশ বছরের এক ছোকরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার হাতে একটা অর্ডার সাপ্লয়ারের ব্যাগ। ভদ্রলোক যে অর্ডার সাপ্লয়ার তা বুঝতে আমার একটুও দেরি হলো না।
তরুণ এই ব্যবসায়ীর বিষণ্ণ সরল মুখখানি হঠাৎ কেন জানি না আমাকে অভিভূত করলো। যুবকটি ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। কার অপেক্ষায় সে এমনভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে? চিৎপুর রোডের স্থবির ট্রাফিক ইতিমধ্যে আবার চলমান হয়েছে এবং একটা ট্যাক্সি হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালো। এক অদ্ভুত স্টাইলের মধ্যবয়সী ভদ্রলোক ভারিক্কী চালে পাইপ টানতে টানতে ট্যাক্সির মধ্যে থেকে ছোকরার উদ্দেশ্যে বললেন, “মিস্টার ব্যানার্জি।” তরুণ ব্যবসায়ী দ্রুতবেগে ওই ট্যাক্সির মধ্যে উঠে পড়লো।
অতি সাধারণ এক দৃশ্য। কিন্তু হঠাৎ আমার মনে পড়লো আজ ১লা আষাঢ়।
কিন্তু চিৎপুর রোডের মানুষরা কেউ আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের খোঁজ রাখে না। অপেক্ষমান যুবকের দ্বিধাগ্রস্ত মুখখানা এরপর কিছুদিন ধরে আমার চোখের সামনে সময়ে-অসময়ে ভেসে উঠতো। পরিচয়হীন মিস্টার ব্যানার্জির নিষ্পাপ সরল মুখে আমি যেন বর্ণনাতীত বেদনার মেঘ দেখতে পেলাম। আমার পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে গেলো। ভাবলাম, লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের হতভাগ্য এই দেশে বেকার এবং অধবেকারদের সুখ-দুঃখের খবরাখবর সাহিত্যের বিষয় হয় না কেন? আমি এ বিষয়ে খোঁজ-খবর আরম্ভ করলাম।
চাকরির ইন্টারভিউ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটা ম্যাগাজিন লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়। এই সব ম্যাগাজিনের প্রশ্নোত্তর বিভাগ মন দিয়ে পড়ে আমার চোখ খুলে গেলো। ইন্টারভিউতে এমন সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয় যার উত্তর সেইসব প্রতিষ্ঠানের বড়কর্তারাও যে জানেন না তা হলফ করে বলা যায়। এ বিষয়ে আরও কিছু অনুসন্ধান করতে গিয়ে একদিন হতভাগ্য সুকুমারের খবর পেলাম। শুনলাম, চাকরির পরীক্ষায় পাস করবার প্রচেষ্টায় বারবার ব্যর্থ হয়ে ছেলেটি উন্মাদ হয়ে গিয়েছে—পৃথিবীর যতরকম জেনারেল নলেজের প্রশ্ন ও উত্তর তার মুখস্থ। বাস স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে অপরিচিতজনদের সে এইসব উদ্ভট প্রশ্ন করে এবং উত্তর না পেলে বিরক্ত হয়।
ছোট ব্যবসায়ে বাড়তি কমিশন, ঘুষ এবং ডালির ব্যাপারটা আমার অজানা নয়। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে নতুন একটি বিষয়ের অবতারণা হয়েছে। ব্যাপারটা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য তা যাচাই করবার জন্যে কয়েকজন সাকসেসফুল ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাঁরা সুকৌশলে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন বললেন, ব্যবসার সব ব্যাপার সাহিত্যের উপাদান হতে পারে না। ঠিক সেই সময় আমার এক পরিচিত তরণ বন্ধুর সঙ্গে অনেক দিন পরে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো।
একদিন স্ট্র্যান্ড রোডে গঙ্গার ধারে বসে শুনলাম এই যুবকের নানা অভিজ্ঞতার কাহিনী। সে বললো, “যে-কোনোদিন সময় করে আসুন সব দেখিয়ে দেবো।”
নদীর ধারে ডাব বিক্রি হচ্ছিল। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, “ডাব খাবে?” বন্ধু হেসে উত্তর দিলো, “আপনার সঙ্গে এমন একজন মহিলার পরিচয় করিয়ে দেবো যিনি অভিসারে বেরোবার আগে এক গেলাস ডাবের জল খাবেনই।”
এই মহিলাটির ঠিকানা আমার বিশেষ পরিচিত এক ভদ্র গলিতে। স্বামী বৃহৎ এক সংস্থার সামান্য কেরানি। নিজের নেশার খরচ চালাবার জন্যে বউকে দেহব্যবসায়ে নামিয়েছেন। অথচ বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ এবং সুভাষচন্দ্রের ছবি ঝুলছে। এই মহিলা সত্যিই একদিন জানাশোনা পার্টির সঙ্গে বেরুতে যাচ্ছেন এমন সময় স্বামী মত্ত অবস্থায় ফিরলেন। সেজেগুজে বউকে বেরতে দেখে ভদ্রলোক তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, “পর পর কদিন তোমার ওপর খুব ধকল গিয়েছে। আগামীকালও তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে। আজ তোমায় বেরতে হবে না; অত পয়সার আমার দরকার নেই?” একে নিয়েই শেষ পর্যন্ত মলিনা গাঙ্গুলীর চরিত্র তৈরি হলো।
সবচেয়ে মজা হয়েছিল জন-অরণ্য উপন্যাস দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পরে। মিসেস গাঙ্গুলী যত্ন করে গল্পটা পড়েছিলেন। পড়া শেষ করেই পরিচিত খদ্দেরের সঙ্গে তিনি হোটেলে গিয়েছিলেন বিখ্যাত এক বেওসাদারের মনোরঞ্জনের জন্যে। সেখানে আরাধ্য ভি-আই-পির শুভাগমনের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ভদ্রমহিলা বললেন, “শংকর-এর জন-অরণ্য উপন্যাসটা পড়েছেন? মিসেস গাঙ্গুলীর চরিত্রটা ঠিক যেন আমাকে নিয়েই লেখা!”
আমার তরুণ বন্ধুর সাহায্যে নগর কলকাতার এক নতুন দিক আমার চোখের সামনে উদ্ঘাটিত হয়েছিল। এই জগতে পয়সার বিনিময়ে মা তুলে দেয় মেয়েকে, ভাই নিয়ে আসে বোনকে, স্বামী এগিয়ে দেয় স্ত্রীকে। মিসেস বিশ্বাস এবং তাঁর দুই মেয়ের বিজনেসের যে ছবি আঁকা হয়েছে তা মোটেই কল্পনাপ্রসূত নয়। লোভের এই কলুষিত জগতে খদ্দেরের অঙ্কশায়িনী কন্যার আর কতক্ষণ দেরি হবে তা জানবার জন্যে মা নির্দ্বিধায় দরজার ফুটো দিয়ে ওদের দেখে আসেন এবং শান্তভাবে ঘোষণা করেন, “আর দেরি হবে না, টোকা দিয়ে এসেছি, আপনারা বসুন। আমার এই মেয়েটার ঐ দোষ! কাস্টমারকে ঝটপট খুশী করে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারে না। বড় সময় নষ্ট করে।”
অভিজাত সায়েব পাড়ায় মিসেস চক্রবর্তী, মিসেস বিশ্বাসের দুই কন্যা রুমুঝুমু, মিসেস গাঙ্গুলী এবং চরণদাসের ‘টেলিফোন অপ্রেটিং স্কুলের ছাত্রী’ ছাড়াও আরও অনেকের দুর্বিসহ অপমান ও লজ্জার কাহিনী এই সময় জানবার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মিসেস সিনহা। বাইরে পরিচয় ইনসিওরেন্স এজেন্ট। কিন্তু আসলে মিসেস গাঙ্গুলীর সমব্যবসায়িনী। এই মহিলার জীবন বড়ই দুঃখের, এর কথা কোনো এক সময় লেখার ইচ্ছে আছে।
উপন্যাসের সমস্ত উপাদান বিভিন্ন মহল থেকে তিলে তিলে সংগ্রহ করে অবশেষে জন-অরণ্য লিখতে বসেছিলাম। সমকালের এই অপ্রিয় কাহিনী সকলের ভালো লাগবে কিনা সে-বিষয়ে মনে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য একটাই ছিল। আমাদের এই যুগে বাংলার কর্মহীন অসহায় যুবক-যুবতীদের ওপর যে চরম অপমান ও লাঞ্ছনা চলছে উপন্যাসের মাধ্যমে তার একটা নির্ভরযোগ্য চিত্র ভবিষ্যতের বাঙালীদের জন্যে রেখে যাওয়া; আর সেই সঙ্গে এদেশের ছেলেদের এবং তাদের বাবা-মায়েদের মনে করিয়ে দেওয়া যে বেকার সমস্যা সমাধানের জরুরী চেষ্টা না হলে আমাদের সমাজ ও ব্যক্তি-জীবনের বুনিয়াদ ধ্বসে পড়বে।
উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছে এ-কথা অবশ্যই বলা যায় না। কিন্তু অনেকে এই বই পড়ে বিচলিত হয়েছেন। এই ডিসটাবশড্ মানসিক অবস্থায় কেউ-কেউ অভিযোগ করেছেন, এই উপন্যাসের মধ্যে শুধুই নিরাশা, কোনো আশার আলো দেখানোর চেষ্টা হয়নি। তাঁদের প্রশ্ন ‘জন-অরণ্য পড়ে কার কী উপকার হবে?’ আমার বিনীত উত্তর, দীর্ঘ দিনের ঘুম ভাঙানোর জন্যেই তো এই উপন্যাসের সৃষ্টি এবং নিরাশার নিচ্ছিদ্র অন্ধকার থেকেই তো অবশেষে আশার আলো বেরিয়ে আসবে। এই উপন্যাস পড়ে কারও কোনো উপকার হবে কিনা বলা শক্ত, কিন্তু সত্যকে তার স্বরূপে প্রকাশিত হতে দিলে কারোও কোনো ক্ষতি হয় না। এই মুহূর্তে এর থেকে বেশি তো কিছু জানা নেই আমার।
পাণ্ডুলিপিতে এই উপন্যাস পড়ে আমার একান্ত আপনজন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “বড্ড অপ্রিয় বিষয়ে কাজ করলে। লেখাটা শেষ পর্যন্ত কী হবে কে জানে।”
আমার মনেও যে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল না এমন নয়। তবু একটা সান্ত্বনা ছিল। বাংলার ঘরে ঘরে অসহায় সুকুমার ও সোমনাথরা তিলে তিলে ধংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, এদের সঙ্গে সঙ্গে অভাগিনী কণারাও সর্বনাশের অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে, সমকালের লেখক হিসেবে এদের সম্বন্ধে স্বদেশবাসীকে অবহিত করবার দায়িত্ব আমি অস্বীকার করিনি। অপ্রিয় ভাষণের ভয়ে সত্য থেকে মুখ সরিয়ে নিইনি।
বিদেশ থেকে বহু চেষ্টায় বিপ্লবী লেখক ফ্যাননের একখানা বই পেয়েছিলাম। সেই বইয়ের মুখবন্ধে ফরাসী মানব সাতর জ্বালাময়ী ভাষায় লিখেছিলেন, “হে আমার দেশবাসিগণ, আমি স্বীকার করতে রাজী আছি, তোমরা অনেক কিছুরই খবরাখবর রাখে না। কিন্তু এই বই পড়ার পর তোমরা বলতে পারবে না, নির্লজ্জ শোষণ এবং অন্যায়-অবিচারের সংবাদ তোমাদের জানানো হয়নি। হে আমার দেশবাসিগণ, তোমরা অবহিত হও।” উপন্যাসের প্রথম পাতায় সাতরের মহামূল্যবান সাবধানবাণীটি আবার পড়তে অনুরোধ জানাই।
দেশ পত্রিকায় জন-অরণ্য প্রথম প্রকাশিত হবার দিন আমি একটু দেরিতে বাড়ি ফিরেছিলাম। স্ত্রী বললেন, “তোমার উপন্যাসের প্রথম পাঠক সত্যজিৎ রায় ফোন করেছিলেন। যত রাতেই হোক, তুমি ফিরলেই যোগাযোগ করতে বলেছেন।”
পরের দিন ভোরে শুনলাম দুটি ছেলে বরানগর থেকে দেখা করতে এসেছে। ছেলে দুটি বললো, “আমরা গতকালই আসতাম। গতকাল বহু চেষ্টা করেও রাত আটটার আগে আপনার ঠিকানা যোগাড় করতে পারিনি। আমরা দুই বেকার বন্ধু—অনেকটা আপনার সোমনাথ ও সুকুমারের মতো। আমরা আপনার কাছ থেকে সুধন্যবাবুর জামাই—যিনি কানাডায় থাকেন তাঁর ঠিকানা নিতে এসেছি। এদেশে তো কিছু হবে না, বিদেশে পালিয়ে গিয়ে দেখি।” জন-অরণ্যর সুধন্যবাবু এবং তাঁর কানাড়াবাসী জামাই নিতান্তই কাল্পনিক চরিত্র কিন্তু ছেলে দুটো আমাকে বিশ্বাস করলো না। ক্ষমা চাইলাম তাদের কাছ থেকে। বিষণ্ণ বদনে বিদায় নেবার আগে তারা সজল চোখে বললো, “জন-অরণ্য উপন্যাসের একটা লাইনও যে বানানো নয় তা বোঝবার মতো বিদ্যে আমাদেরও আছে শংকরবাবু। আপনি সুধন্যবাবুর জামাইয়ের ঠিকানা দেবেন না তাই বলুন।”
সত্যজিৎ রায় জন-অরণ্য চলচ্চিত্রায়িত করবার কথা ভাবছেন জেনে বিগত রাত্রে যতটা আনন্দিত হয়েছিলাম, আজ সকালে ঠিক ততটাই দুঃখ হলো। দেশের লক্ষ লক্ষ বিপন্ন ছেলেমেয়েদের হৃদয়ে আশার আলোক জ্বালিয়ে দেবার ক্ষমতা আমার নেই ভেবে লজ্জায় মাথা নিচু করে অসহায়ভাবে বসে রইলাম।
—মার্চ, ১৯৭৬
শংকরের লেখা “কত অজানারে” বা “নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি” যদি upload করেন….