বান্ধবপুর লঞ্চঘাটে এমএল আড়িয়াল খাঁ লঞ্চ ভিড়েছে। ছয়জন যাত্রী ডেকে চাদর বিছিয়ে তাস খেলতে খেলতে আসছিল। তাদের তাসখেলা শেষ হয় নি। লঞ্চ ভিড়ার অনেকক্ষণ পরেও তারা খেলা নিয়ে মত্ত রইল। যাত্রীদের বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে, এদের তাড়া নেই। এদের সঙ্গে মালামালও নেই। লঞ্চের কেবিন বয় বলল, আপনার নামবেন না? তাদের একজন উদাস গলায় বলল, নামতেও পারি, আবার নাও নামতে পারি।
তেমন কোনো হাসির কথা না। কিন্তু সবাই হাসছে।
কেবিন বয় বলল, যাবেন কই?
যাব দোজখে।
আবার হাসির শব্দ। এবারের হাসি আরো উচ্চকিত। তবে তার মধ্যে আনন্দ 6नश्।
ছয়জনের এই দলটি ভাড়া করে এনেছেন ধনু শেখ। এরা দাঙ্গাহাঙ্গামায় অত্যন্ত দক্ষ। তাদের সঙ্গে ধনু শেখের একটাই কথা— মালাউন কমায়ে চলে যাবে। লুটের মাল সবই তোমাদের। স্থানীয় সাহায্য যা করার তিনি করবেন। শোনা যাচ্ছে কোন জায়গা পাকিস্তানে পড়বে তা ঠিক হবে মুসলমানের সংখ্যা দিয়ে। ভোটাভুটি হবার সম্ভাবনা। বান্ধবপুরকে অবশ্যই পাকিস্তানে ঢুকাতে হবে। যে-কোনো ভালো কাজের সঙ্গে সামান্য মন্দ কাজ করতে হয়। স্বাধীন পাকিস্তান বিরাট ভালো কাজ। তার জন্যে কিছু রক্তপাত হতেই পারে। স্বাভাবিকভাবে একটা শিশুর জন্ম দিতে গিয়েও মায়েদের প্রচুর রক্ত দেখতে হয়। সেখানে নতুন দেশের জন্ম হচ্ছে। সহজ কথা তো না।
ধনু শেখ খবর দিয়ে শ্ৰীনাথকে এনেছেন। মূল্য উদ্দেশ্য গল্পগুজব করা। মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক সমস্যা। গল্প করার সঙ্গী লাগে। ধনু শেখের প্রায়ই মনে হয়, গরু হয়ে জন্মালে ভালো ছিল। ঘাস খেয়ে জীবনটা পার করে দিতে পারতেন। চিন্তা নাই, ভাবনা নাই। জগতের একমাত্র বিষয় সবুজ ঘাস। সকালক থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাস খাওয়া। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেই ঘাস জাবর কাটা। জাবর কাটার সময় মশা বিরক্ত করলে লেজের বাড়ি দিয়ে মশা মারা।
শ্ৰীনাথ, আছ কেমন?
আজ্ঞে ভালো আছি।
চারদিকে দাঙ্গা লেগে গেছে, শুনেছি বোধহয়?
শুনেছি। বান্ধবপুরে দাঙ্গা নাই, কিছু নাই, ব্যাপারটা কী বলো দেখি?
শ্ৰীনাথ বলল, আপনার মতো বিশিষ্টজনরা থাকতে দাঙ্গা কেন হবে?
ধনু শেখ বললেন, আমি বিশিষ্টজন তোমারে কে বলল? আমি অবশিষ্টজন। দুই ঠ্যাং-এর মধ্যে একটা চলে গেছে, একটা আছে অবশিষ্ট। এখন বলো আমি অবশিষ্টজন না?
শ্ৰীনাথ চুপ করে রইল। ধনু শেখ তাকে কী জন্যে ডাকিয়েছেন সে বুঝতে পারছে না। এই লোক বিনা উদ্দেশ্যে কিছু করবে না।
ধনু শেখ বললেন, শুনলাম তোমরা দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি করেছ। নমশুদ্ৰ, চামার, ঢুলি সব দলে টেনেছ। রামদা সড়কির ব্যবস্থা করেছ। মুসলমান মারা শুরু করব কবে? পঞ্জিকা দেখে একটা শুভদিন বের কর। অশুভ দিনে মারামারি শুরু করলা, দেখা গেল ফল হয়েছে। খারাপ। নিজেরাই শেষ।
শ্ৰীনাথ বলল, অনুমতি দেন যাই। আমার শরীরটা ভালো না।
শরীর তো আমারও ভালো না। পচন ধরেছে। শশাংক পালের শরীর যেমন পাচে গিয়েছিল আমারও যাচ্ছে। আবার শুনলাম লাবুসের শরীরেও পচন ধরেছে। ভালো কথা মনে পড়েছে। শশাংক পালের ভূতের গল্পটা পুরা শুনা হয় নাই।
‘আমি উঠলাম’ বলে শ্ৰীনাথ উঠতে যাওয়ার আগেই ধনু শেখের লোকজন চলে এলো। ধনু শেখ বললেন, তোমরা চলে এসেছ ভালো করেছ। এর নাম শ্ৰীনাথ। আমার নিজের লোক। কাজকর্ম যা করবা এরে সাথে নিয়া করব। সে প্রত্যেক হিন্দুর বাড়ি চিনে। কোন কোন বাড়িতে ডবকা যুবতী আছে তাও জানে। কলিকাতার দাঙ্গায় বহুত মুসলমান মেয়ের সর্বনাশ হয়েছে- শোধ নেয়ার প্রয়োজন আছে।
শ্ৰীনাথ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু এইটুকু বুঝছে তার মহাবিপদ।
মুখে বসন্তের দাগওয়ালা একজন গলা নামিয়ে বলল, কাজ কি আজ রাতেই শুরু হবে?
ধনু শেখ বললেন, আরে না। বিশ্রাম কর। খাওয়াদাওয়া কর। অবস্থা বিবেচনা কর। তবে শ্ৰীনাথ যেন পালায়া না যায়। তাকে প্রয়োজন আছে।
এরা শ্ৰীনাথকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে লঞ্চঘাটের দিকে। তারা হাঁটছে দ্রুত। শ্ৰীনাথ তাদের সঙ্গে তাল মিলাতে পারছে না। শ্ৰীনাথ বলল, আমাকে কোথায় নিয়ে যান?
বসন্তের দাগওয়ালা লোকটি বলল, শ্বশুরবাড়ি নিয়া যাই। তোমার শ্বশুর সাব কী করব জানো? তোমার বিচি ফালায়া তোমারে খাসি করব।
দলের সবাই হো হো করে হেসে উঠল। তাদের মনে চাপা আনন্দ।
মনিশংকর লাবুসকে দেখতে এসেছেন। তিনি রোজই আসেন। অনেকক্ষণ বসে থাকেন। তাঁকে পুরাপুরি বিভ্রান্ত মনে হয়।
পুকুরঘাটে শীতলপাটি বিছানো। শীতলপাটির ওপর কলাপাতা। লাবুস কলাপাতার ওপর শুয়ে থাকে। তাকে সারাক্ষণ পাখা দিয়ে বাতাস করে হাদিস উদ্দিন। মাওলানা ইদরিস তার মেয়েকে নিয়ে পাশেই থাকেন। তিনি নফল রোজা রাখছেন। এবং মনে মনে কোরান খতম দিচ্ছেন।
লাবুস বেশির ভাগ সময় থাকে ঘোরের মধ্যে। তখন অদ্ভুত অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখে। অপরিচিত নানানজনের সঙ্গে কথা বলে। যেসব ঘটনা তার জীবনে ঘটে গেছে হুবহু সেই ঘটনাও ঘটতে দেখে। একদিন দেখল পুকুরঘাটে বসে বিভূতি বাবু মুগ্ধ গলায় নিজের বই পড়ে শুনাচ্ছেন। লাবুস এবং হাদিস উদ্দিন পাঠ শুনছে। কী পড়া হচ্ছে তাও লাবুসের মনে আসে। একটি শব্দও এদিক ওদিক হয় না।
কুড়ুলে বিনোদপুরের বিখ্যাত বস্ত্রব্যবসায়ী রায় সাহেব ভরসারাম কুণ্ডুর একমাত্র কন্যার আজ বিবাহ। বরপক্ষের নিবাস কলকাতা, আজই বেলা তিনটার সময় মোটরে ও রিজার্ভ বাসে কলকাতা থেকে বর ও বরযাত্রীরা এসেছে। অমন ফুল দিয়ে সাজানো মোটরগাড়ি এদেশের লোক কখনো দেখে নি।
একদিন সে তার মা জুলেখাকে দেখল। দোতলা পাকাদালানের একটা বড় ঘরে জুলেখা সতরঞ্চির ওপর বসে। তার সামনে হারমোনিয়াম। একপাশে রূপার পানদানিতে পান। ঘরের এক কোনায় জুলেখার কাছ থেকে বেশ দূরে তবলা এবং তানপুরা নিয়ে একজন বসেছে। একজন বংশীবাদক আছে, সে বসেছে জুলেখার পাশে। জুলেখা গান করছে এবং বৃদ্ধ এক শেরওয়ানি পরা মানুষ গান শুনছেন। গানের কথা–
কেবা কার পর, কে কার আপন,
কালশয্যা পরে মোহতন্দ্ৰা ঘোরে।
দেখি পরস্পরে অসার আশার স্বপন।
হঠাৎ গান থেমে যায়। হৈচৈ-এর শব্দ শোনা যায়। একদল মানুষ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে। ভাঙচুরের শব্দ। আর্তনাদ। কালো ধোয়া। লাবুসের সামনে সব অস্পষ্ট হয়ে যায়।
মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। গোল মুখ। চোখ বড় বড়। মেয়েটা সব সময় খেলছে। কখনো তার হাতে সুতা, কখনো কাপড়ের টুকরা। লাবুস তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। মেয়েটা খেলায় এতই মগ্ন থাকে যে বেশির ভাগ সময়ই লাবুসের প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
নাম কী গো তোমার?
ভুলে গেছি।
মানুষ অনেক কিছু ভুলে যায়। তার নাম ভুলে না।
আমি ভুলে গেছি।
তুমি এই বাড়িতে থাক?
হুঁ। মাটির নিচে গুপ্তঘরে থাকি।
কতদিন ধরে থাক?
অনেক দিন। অনেক অনেক দিন। কতদিন ভুলে গেছি। আমি সব ভুলে গেছি।
তোমার বাবা মা, এদের কথা মনে আছে?
ভুলে গেছি। আমি আর কথা বলব না।
মেয়েটা উঠে চলে যায়। আবারো আসে। লাবুসের আশেপাশেই বসে খেলায় মগ্ন হয়ে যায়।
মনিশংকর বললেন, আজ শরীরটা কেমন বোধ হচ্ছে?
লাবুস বলল, ভালো।
মনিশংকর হতাশ গলায় বললেন, এই কি ভালোর নমুনা? তুমি তো মরুতে বসেছী। চলো তোমাকে কলকাতা নিয়ে যাই। বড় বড় ডাক্তাররা তোমাকে দেখুক। দেখে বলুক কী হয়েছে।
লাবুস বলল, আমার কী হয়েছে। আমি জানি। কেউ তা বিশ্বাস করবে না। জগৎ বড়ই বিচিত্র।
জগৎ বিচিত্ৰ হোক, যাই হোক, তোমার দরকার চিকিৎসা।
আমার সময় হয়ে গেছে। চিকিৎসায় কিছু হবে না।
তোমার সময় হয়ে গেছে, তুমি বুঝে ফেললা? তুমি কি ভগবান? আমি তোমাকে এইভাবে মরতে দেব না।
লাবুস বলল, আমি কাউকে যে কথা কোনোদিন বলি নাই আপনাকে বলতে চাই। মাওলানা সাহেবকে আর হাদিস উদ্দিনকে দূরে যেতে বলেন।
আমাকে বলতে চাও কেন?
আপনি বিশ্বাসী মানুষ। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন।
মাওলানা এবং হাদিস উদ্দিন উঠে গেল। হাদিস উদিনের খুব শখ ছিল ছোটকর্তার কথাগুলি শোনে। সে ছোটকৰ্তার বিষয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানে, কাউকে তা বলতে পারছে না। এখন সময় হয়েছে বলার।
লাবুস বলল, আমি চোখের সামনে অনেক কিছু দেখি। ছোটবেলা থেকে দেখতাম। তখন ভাবতাম। সবাই আমার মতো দেখে। অনেক পরে জানলাম, সবাই আমার মতো দেখে না।
কী দেখ?
ভবিষ্যতের ঘটনা দেখি। আমার মা যে আমাদের ছেড়ে খারাপ জায়গায় চলে যাবে- এটা অনেক ছোটবেলায় দেখেছি। আমি মৃত মানুষজনদের দেখি। তাদের কেউ কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে।
কী কথা বলে?
অনেক কথা। বেশির ভাগ কথার অর্থ আমি বুঝি না। তখন আমার খুব কষ্ট হয়।
লাবুস হাঁপাতে লাগল। মনিশংকর বললেন, এখন আর কথা বলার প্রয়োজন নাই। বিশ্ৰাম কর।
আপনাকে অতি জরুরি একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আমি স্পষ্ট দেখেছি, বান্ধবপুর জায়গাটা হিন্দুস্থানের মধ্যে পড়েছে। এখানের বহু মুসলমান মারা যাবে। তাদের রক্ষার ব্যবস্থা করেন।
মনিশংকর বললেন, জ্বরে তোমার গা পুড়ে যাচ্ছে। জ্বরের সময় বিকার উপস্থিত হয়। বিকারের ঘোরে মানুষ অনেক কিছু দেখে। তোমার জ্বর কমুক। শরীর স্বাভাবিক হোক। তখন তোমার কথা শুনব।
লারুস বলল, আমার শরীর এখন জ্বলে যাচ্ছে। হাদিস উদ্দিনকে বলেন যেন শরীরে পানি ঢালে।
মনিশংকর নিজেই আজলা ভরে পানি লাবুসের শরীরে ঢালতে লাগলেন। লাবুস বিড়বিড় করে বলল, বান্ধবপুরের মহাবিপদ। অনেক মানুষ মারা যাবে। অনেক মানুষ মারা যাবে।
মনিশংকর বললেন, বাবা শান্ত হও।
মসজিদের নতুন ইমাম নিয়ামত হোসেন প্রবহমান পানিতে অজু করেন। বদ্ধপানিতে অজু করার চেয়ে প্রবহমান পানিতে অজুর সোয়াব বেশি। তিনি ঘাটে বসে অজু শেষ করে উঠতে যাবেন, হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি আটকে গেল। ভাসতে ভাসতে কী যেন এগিয়ে আসছে। ফজরের ওয়াক্ত। আকাশ এখনো অন্ধকার। পরিষ্কার কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু নদীর পানি চকচক করছে। নিয়ামত হোসেন ভাসমান বস্তুটির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। একসময় তিনি বিড়বিড় করে বললেন, গাফুরুর রহিম, এটা কী?
নদীর পানিতে চিৎ হয়ে ভাসছে শ্ৰীনাথ। নিয়ামত হোসেন কাউকে কিছু না বলে মসজিদে গেলেন। টিউবকলের পানিতে আবার অজু করলেন। ফজরের নামাজ আদায় করলেন। মসজিদে তিনি ছাড়া দ্বিতীয় নামাজি কেউ নেই। ফজরের নামাজে কখনোই লোক হয় না। নামাজ শেষ করে তিনি ধনু শেখের বাড়িতে গেলেন। ঘুমন্ত ধনু শেখের ঘুম ভাঙালেন। নদীতে কী দেখে এসেছেন বললেন। বর্ণনার সময় নিয়ামত হোসেনের গলা কাপতে লাগল।
ধনু শেখ বললেন, এটা বলার জন্যে তুমি আমার ঘুম ভাঙায়েছ? শ্ৰীনাথের মৃত্যুর খবর ঘুম ভাঙায়ে আমাকে দিবার কী আছে? শ্ৰীনাথ কি আমার ভায়রা ভাই? মরছে গেছে ফুরাইছে। সবাই মারা যাবে। আমিও যাব তুমিও যাবে।
নিয়ামত হোসেন বললেন, কালরাতে শ্ৰীনাথ বাবুকে আমি দেখেছি।
কোথায় দেখেছ? এশার নামাজ পড়ে ফিরতেছি, হঠাৎ দেখি হাত ধরে তাকে টেনে লঞ্চে নিয়ে তুলতেছে। আপনার লোকজন তুলতেছে।
আমার লোকজনটা কে?
লঞ্চে করে এরা এসেছে। আপনার সঙ্গে দেখা করেছে।
ধনু শেখ বললেন, তুমি কি বলতে চাও আমি শ্ৰীনাথকে খুন করায়েছি?
নিয়ামত হোসেন বললেন, জি-না।
ধনু শেখ বললেন, তাহলে আমাকে এই ঘটনা বলার মানে কী?
গোস্তাকি হয়েছে।
নিয়ামত শোন, বেশি বেশি বুঝার চেষ্টা নিবা না এবং বেশি বেশি দেখবা না। কম দেখা ভালো। কম বুঝাও ভালো।
জি আচ্ছা।
হিন্দুরা সব মুসলমান মেরে শেষ করে ফেলতেছে, এইটা জানো?
জানি না।
দাঙ্গার খবর পড়া নাই? কলিকাতায় কী হয়েছে? বিহারে কী হয়েছে? মুসলমান সব শেষ। আর এদিকে পা পিছলায়ে পানিতে পড়ে মালাউন একটা মারা গেছে, আর তুমি হয়ে গেছ বেচাইন। বুরবাক কোথাকার। যাও সামনে থেকে। একটা কথা মনে রাখবা, তুমি কিছুই দেখা নাই। বুঝেছ?
জি।
আগামীকাল জুম্মাবার না?
জি।
জুম্মার নামাজের পরে তুমি সুন্দর কইরা ওয়াজ করবা। তুমি বলবা সব মুসলমানের দায়িত্ব নিজেদের রক্ষা করা। পরিবার রক্ষা করা এবং পাকিস্তান হাসেলের জন্য কাজ করা। বলতে পারবো?
পারব।
তার জন্যে প্রয়োজনে রক্তপাত করতে হবে। শহীদ হতে হবে। বলতে পারবা না?
পারব।
মিনমিন কর বলতেছ। কেন? জোর গলায় বলো। গলায় জোর নাই? তুমি কি মেন্দামারা মুসলমান? শরীর তো বানায়েছ মহিষের মতো। অনেক কথা বলে ফেলেছি, এখন সামনে থেকে যাও। তুমি আমার সকালের ঘুম নষ্ট করেছ। বুরবাক কোথাকার।
নিয়ামত হোসেন ঘর থেকে বের হলেন। এখন তার লঞ্চের টিকেট ঘরে যাবার কথা, তা না করে তিনি মসজিদে গেলেন। দুরাকাত নফল নামাজ পড়লেন। কিছুক্ষণ কোরান পাঠের চেষ্টা করলেন। মন বসল না। তিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে টিকেট ঘরে গেলেন।
টিকেট ঘর থেকে দেখা যায় অনেক লোকজন নদীর পাড়ে ভিড় করেছে। শ্ৰীনাথকে ডাঙ্গায় তোলা হচ্ছে। বলা হরি, হরি বল ধ্বনি উঠছে। নিয়ামত হোসেন আবার টিকেট ঘর থেকে বের হলেন। তিনি গেলেন মনিশংকরের কাছে। মাথা নিচু করে ফিসফিস করে কথা বললেন। তাঁর বেশির ভাগ কথাই অস্পষ্ট।
মনিশংকর বললেন, কাল জুম্মার নামাজের পরে দাঙ্গা শুরু হবে। কী বলেন আপনি?
নিয়ামত হোসেন বললেন, এই জন্যে বাইরে থেকে লোক আসছে।
লোক কে এনেছে? ধনু শেখ?
নিয়ামত হোসেন জবাব দিলেন না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর বড়ই ভয় লাগছে।
আজ জুম্মাবার।
ধনু শেখ আগে জুম্মার নামাজে আসতেন। ঠ্যাং কাটা যাবার পর আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। বসে বসে নামাজ পড়ার মানে হয় না। সবাই যেন করে তাকায়। তবে আজ তিনি জুম্মার নামাজে এসেছেন। তাঁর লোকজন কেউ আসে নি। তারা লঞ্চে অপেক্ষা করছে। তাদেরকে বলা হয়েছে জুম্মার নামাজ শেষ হবার পর তিনি যখন বাড়ি ফিরবেন তখন আসল কাজ শুরু হবে।
আজ জুম্মার নামাজে ভালো জমায়েত হয়েছে। অনেক অপরিচিত মানুষও দেখা যাচ্ছে। মাওলানা ইদরিস এসেছেন। তিনি ইমাম নিয়ামত হোসেনের পাশেই বসেছেন।
নামাজ শেষে খুতবা পাঠের পর ইমাম নিয়ামত হোসেন বললেন, হাফেজ মাওলানা ইদরিস আপনাদের কিছু বলবেন।
মাওলানা ইদরিস উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, চারদিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাহাঙ্গামার খবর আসতেছে। এই বিষয়ে সামান্য কিছু বলব। আমার বেয়াদবি ক্ষমা করবেন। আল্লাহপাক সুরা হুজুরাত-এর তের নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি। বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বড় সাবধানী। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ এর বেশি আমার আর কিছুই বলার নাই। মূল আয়াতটা আমি আপনাদের আরবিতে পাঠ করে শুনাব। তার আগে ছোট্ট একটা ঘোষণা আছে- আপনারা জানেন লাবুস খুবই অসুস্থ। তার জন্যে আমি দরুদে শেফা পাঠ শুরু করেছি। যেন আল্লাহপাক তার রোগযন্ত্রণার অবসান করেন। আপনারা তার জন্যে দোয়ায় সামিল হবেন। লাবুস তার সমস্ত বিষয়সম্পত্তি দান করেছে। দানপত্রে আজই বাদ জুম্মা সে দস্তখত করবে। আপনারা সবাই সাক্ষী। তার দানপত্ৰ মতে এই অঞ্চলের মানুষের কল্যাণে তার সবকিছু ব্যয় হবে। স্কুল, কলেজ, দাতব্য চিকিৎসালয়। আপনারা সবাই বলেন, মারহাবা। অন্তর থেকে বলেন।
সবাই মারহাবা বলল। ধনু শেখও বললেন।
এরপর দোয়া পাঠ হলো এবং ইমাম নিয়ামত হোসেন আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করলেন যেন বান্ধবপুরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না হয়।
ধনু শেখ বাড়ি ফিরছেন। হিসাবমতো তাঁর লোকজনের কর্মকাণ্ড শুরু হবার কথা। তা হচ্ছে না, কারণ লঞ্চঘাটে নমশূদ্রদের একটা বিশাল দল লাঠি, সড়কি, রামুদা নিয়ে দাঁড়িয়ে। তাদের সঙ্গে আছেন মুনিশংকর। তাঁর নির্দেশে এমএল আড়িয়াল খাঁ লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে। লঞ্চের কেবিনে ধনু শেখের লোকজন বসা। তারা হতভম্ব।
মনিশংকর ধনু শেখের বাড়িতে এসেছেন। ঘরে ঢুকেছেন একা। তাঁর লোকজন সব বাইরে।,
ধনু শেখ বললেন, আমার কাছে কী চান?
মনিশংকর বললেন, কিছু চাই না। খবর কি জানেন?
কী খবর?
দেশ ভাগাভাগির সব ঠিকঠাক হয়েছে। সীমানা নির্ধারণ হয়েছে। বান্ধবপুরে বড়গাঙ বরাবর সীমানা। আপনি পড়েছেন হিন্দুস্থানে।
ধনু শেখ তাকিয়ে আছেন।
আমার বাড়িতে ব্যাটারিতে রেডিও বাজে। খবর শুনে আপনাকে বললাম। যাই, নমস্কার।
হিন্দু বাড়িতে শাঁখ বাজছে। ঘণ্টা বাজছে। বড়ই আনন্দময় সময়।
রাত অনেক। আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে।
ফাকফকা জোছনা।
লাবুস পুকুরপাড়ে পাটির ওপর শুয়ে আছে। সে একা, আর কেউ নেই। সবাইকে সে কিছুক্ষণ আগে সরিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে একা থাকতে ইচ্ছা করে। আজ যেমন করছে। লাবুসের শরীর খুবই খারাপ করেছে। জুলুনি অনেক বেড়েছে। তারপরেও জোছনা দেখতে ভালো লাগছে। এই সুন্দর চাঁদের আলো সে আর বেশিদিন দেখবে না। নিস্তব্ধ রাতে ঝিঝিপোকার ডাক শুনবে না। হঠাৎ লেবু ফুলের ঘাণে শরীর মন অবশ হবে না। ভাবতেই কী অদ্ভুত লাগে। দীর্ঘদিন পর হঠাৎ আজ তার মা’কে দেখতে ইচ্ছা হলো।
বাবা জহির!
লাবুস চমকে তাকালো। এটা কি কোনো ভ্ৰান্তি? মন চাইছে বলে সে মায়ের গলা শুনতে পাচ্ছে? সারা শরীর চাদরে ঢাকা একজন মহিলা পুসকুনির সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ নামলেন।
বাবা, তোমার কী হয়েছে?
লাবুস জবাব দিল না। মহিলা বললেন, বাবা, তোমার কপালে একটু হাত রাখবি?
লাবুস বলল, রাখ।
জুলেখা লাবুসের কপাল স্পর্শ করে ফুঁপিয়ে উঠল। বাবাগো, তোমার কী হয়েছে? আমার বাবার সোনার অঙ্গ কীভাবে জ্বলে গেছে?
লাবুস বলল, মা, যন্ত্রণায় অনেকদিন ঘুমাতে পারি না। একটু ঘুম পাড়ায়ে দাও।
ছোটবেলায় গুনগুন করতে করতে জুলেখা দুষ্ট জহিরকে ঘুম পাড়াত। আশ্চৰ্য, একটা সুরও মনে আসছে না।
মীরা বারান্দায় এসেছিল। সে পুকুরঘাটের দিকে তাকাল এবং দৌড়ে ঘাটের কাছে এসে দাঁড়াল। রিনারিনে গলায় বলল, তুমি কে?
জুলেখা তাকাল।
ছোট মীরা বলল, তুমি কি আমার আর লাবুসের মা?
জুলেখা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। তাঁর মাথায় সুর এসেছে— আমার দুষ্ট ঘুমায়রে। আমার ন্যাওলা ঘুমায়রে। আমার ভুটু ঘুমায়রে।
মওলানা ইদরিস ঘর থেকে বের হয়েছেন, হাদিস উদ্দিন বের হয়েছে।
পুকুরঘাট থেকে যে সুরধ্বনি বের হয়ে আসছে তার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়, অন্য কোনোখানে।
[দ্বিতীয় খণ্ড সমাপ্ত]