6 of 11

৩২.০৫ ঈশ্বর অভিভাবক — শ্রীরামকৃষ্ণের মাতৃভক্তি — সংকীর্তনানন্দে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৯শে সেপ্টেম্বর

ঈশ্বর অভিভাবক — শ্রীরামকৃষ্ণের মাতৃভক্তি — সংকীর্তনানন্দে

ভক্তেরা ঘরে বসিয়াছেন। হাজরা বারান্দাতেই বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাজরা কি চাইছে জান? কিছু টাকা চায়, বাড়িতে কষ্ট। দেনা কর্জ। তা, জপ-ধ্যান করে বলে, তিনি টাকা দেবেন!

একজন ভক্ত — তিনি কি বাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারেন না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর ইচ্ছা! তবে প্রেমোন্মাদ না হলে তিনি সমস্ত ভার লন না। ছোট ছেলেকেই হাত ধরে খেতে বসিয়ে দেয়। বুড়োদের কে দেয়? তাঁর চিন্তা ক’রে যখন নিজের ভার নিতে পারে না, তখনই ঈশ্বর ভার লন।

“নিজে বাড়ির খবর লবে না! হাজরার ছেলে রামলালের কাছে বলেছে ‘বাবাকে আসতে বলো; আমরা কিছু চাইবো না!’আমার কথাগুলি শুনে কান্না পেল।”

[শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত — শ্রীবৃন্দাবন-দর্শন ]

“হাজরার মা বলেছে রামলালকে, ‘প্রতাপকে একবার আসতে বলো, আর তোমার খুড়োমশায়কে আমার নাম করে বলো, যেন তিনি প্রতাপকে আসতে বলেন।’ আমি বললুম — তা শুনলে না।

“মা কি কম জিনিস গা? চৈতন্যদেব কত বুঝিয়ে তবে মার কাছ থেকে চলে আসতে পাল্লেন। শচী বলেছিল, কেশব ভারতীকে কাটব। চৈতন্যদেব অনেক করে বোঝালেন। বললেন, ‘মা, তুমি না অনুমতি দিললে আমি যাব না। তবে সংসারে যদি আমায় রাখ, আমার শরীর থাকবে না। আর মা, যখন তুমি মনে করবে, আমাকে দেখতে পাবে। আমি কাছেই থাকব, মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যাব।’ তবে শচী অনুমতি দিলেন।

“মা যতদিন ছিল, নারদ ততদিন তপস্যায় যেতে পারেননি। মার সেবা করতে হয়েছিল কিনা! মার দেহত্যাগ হলে তবে হরিসাধন করতে বেরুলেন।

“বৃন্দাবনে গিয়ে আর আমার ফিরে আসতে ইচ্ছা হল না। গঙ্গামার কাছে থাকবার কথা হল। সব ঠিকঠাক! এদিকে আমার বিছানা হবে, ওদিকে গঙ্গামার বিছানা হবে, আর কলকাতায় যাব না, কৈবর্তর ভাত আর কতদিন খাব? তখন হৃদে বললে, না তুমি কলকাতায় চল। সে একদিকে টানে, গঙ্গামা আর-একটিকে টানে। আমার খুব থাকবার ইচ্ছা। এমন সময়ে মাকে মনে পড়ল। অমনি সব বদলে গেল। মা বুড়ো হয়েছেন। ভা বলুম মার চিন্তা থাকলে ঈশ্বর-ফীশ্বর সব ঘুরে যাবে। তার চেয়ে তাঁর কাছে যাই। গিয়ে সেইখানে ঈশ্বরচিন্তা করব, নিশ্চিন্ত হয়ে।

(নরেন্দ্রের প্রতি) — “তুমি একটু তাকে বলো না। আমায় সেদিন বললে, হাঁ দেশে যাব, তিনদিন গিয়ে থাকব। তারপর যে সেই।

(ভক্তদের প্রতি) — “আজ ঘোষপাড়া-ফোষপাড়া কি কথা হল। গোবিন্দ, গোবিন্দ, গোবিন্দ! এখন হরিনাম একটু বল। কড়ার ডাল টড়ার ডালের পর পায়েস মুণ্ডি হয়ে যাক্‌।”

নরেন্দ্র গাহিতেছেন:

এক পুরাতন পুরুষ নিরঞ্জনে, চিত্ত সমাধান কর রে,
আদি সত্য তিনি কারণ-কারণ, প্রাণরূপে ব্যাপ্ত চরাচরে,
জীবন্ত জ্যোতির্ময়, সকলের আশ্রয়, দেখে সেই যে জন বিশ্বাস করে।
অতীন্দ্রিয় নিত্য চৈতন্যস্বরূপ, বিরাজিত হৃদিকন্দরে;
জ্ঞানপ্রেম পুণ্যে, ভূষিত নানাগুনে, যাহার চিন্তনে সন্তাপ হরে।
অনন্ত গুণাধার প্রশান্ত-মূরতি, ধারণা করিতে কেহ নাহি পারে,
পদাশ্রিত জনে, দেখা দেন নিজ গুণে, দীন হীন ব’লে দয়া করে।
চির ক্ষমাশীল কল্যাণদাতা, নিকট সহায় দুঃখসাগরে;
পরম ন্যায়বান্‌ করেন ফলদান, পাপপুণ্য কর্ম অনুসারে।
প্রেমময় দয়াসিন্ধু, কৃপানিধি, শ্রবণে যাঁর গুণ আঁখি ঝরে,
তাঁর মুখ দেখি, সবে হও রে সুখী, তৃষিত মন প্রাণ যাঁর তরে।
বিচিত্র শোভাময় নির্মল প্রকৃতি, বর্ণিতে সে অপরূপ বচন হারে;
ভজন সাধন তাঁর, কর হে নিরন্তর, চির ভিখারী হয়ে তাঁর দ্বারে।

(২) – চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে।

ঠাকুর নাচিতেছেন। বেড়িয়া বেড়িয়া নাচিতেছেন, সকলে কীর্তন করিতেছেন আর নাচিতেছেন। খুব আনন্দ। গান হইয়া গেলে ঠাকুর নিজে আবার গান ধরিলেন:

শিব সঙ্গে সদা রঙ্গে আনন্দে মগনা,

মাস্টার সঙ্গে গাহিয়াছিলেন দেখিয়া ঠাকুর বড় খুশি! গান হইয়া গেলে ঠাকুর মাস্টারকে সহাস্যে বলিতেছেন, বেশ খুলি হত, তাহলে আরও জমাট হত। তাক তাক তা ধিনা, দাক দাক দা ধিনা; এই সব বোল বাজবে!

কীর্তন হইতে হইতে সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে।


অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্‌ ৷৷ [গীতা ৯।২২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *