৩২. শওকত সাহেব চোখ মেললেন

শওকত সাহেবের মনে হল কে যেন এসে তার বুকে বসেছে। যে বসেছে সে মানুষ নয়। বিশাল কোন একটি জন্তু যার গায়ে বোটকা গন্ধ। জন্তুটি শুধু বসেই নেই, প্রকাণ্ড থাবা বাড়িয়ে তাঁর গলা চেপে ধরতে চাইছে। তিনি বুঝতে পারছেন গলা চেপে ধরা মানেই মৃত্যু। কাজেই তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন যাতে জন্তুটি তার গলা চেপে ধরতে না পারে। শওকত সাহেবের মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে লাগল। তিনি গোঙানির মত শব্দ করতে লাগলেন। ঠিক তখন মুনা ডাকল, মামা দরজা খোল কি হয়েছে? চিৎকার করছে কেন?

শওকত সাহেব চোখ মেললেন। জম্ভটি নেই। স্বপ্নই দেখছিলেন। কিন্তু ঠিক স্বপ্নও বোধ হয় নয়। সমস্ত ঘরাময় বোটিকা গন্ধ কোথেকে এল?

মামা দরজা খোল। কী হয়েছে তোমার?

তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন। ঘড়ি দেখলেন দু’টা দশ। অনেকখানি রাত সামনে পড়ে আছে। জেগে বসে কাটাতে হবে। বাকি রাতটা এক ফোঁটা ঘুম আসবে না। তিনি ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন।

স্বপ্ন দেখছিলে নাকি মামা?

হুঁ।

নাও পানি খাও।

শওকত সাহেব পানি খেয়ে বিড়বিড় করে বললেন, তুই কি এই ঘরে কোন বোটিকা গন্ধ পাচ্ছিস?

না তো।

আমি পাচ্ছি। ইঁদুর মরে পড়ে থাকেল যে রকম গন্ধ হয় সে রকম গন্ধ।

বলেই শওকত সাহেবের মনে হল এই গন্ধের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর আগে এই জাতীয় গন্ধ ছিল এই ঘরে। এত তীব্র ছিল না। কিন্তু ছিল।

মুনা, কোনো রকম গন্ধ পাচ্ছিস না?

উঁহু। তুমি কী বারান্দায় ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে বসবে?

শওকত সাহেব হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। বারান্দায় ইজিচেয়ারে এসে বসলেন। উঠোনে জ্যোৎস্না হয়েছে। দিনের মতো আলো। ফাকফািক করছে চারদিক।

মামা, এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসি দুধ খাও। ঘুম আসবে।

কিছু আনতে হবে না। তুই আমার পাশে বসে থাক।

মুনা তার পাশে বসতেই তিনি নরম গলায় বললেন, বেশিদিন বাঁচব না। ডাক এসে গেছে।

মুনা তরল গলায় বলল, এটা তো তুমি গত পাঁচ বছর ধরে বলছি।

আজ নিশ্চিত হয়েছি।

তাহলে তো ভালই হল। কবে মারা যাচ্ছে জেনে গেলে। আমরা যারা জানি না তাদের হচ্ছে অসুবিধা। সব সময় একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হয়।

শওকত সাহেব মৃদু গলায় বললেন, সব সময় ঠাট্টা করিস না মা। তিনি মুনার হাত ধরলেন। মুনা লক্ষ্য করল, মামার হাত অস্বাভাবিক শীতল। তিনি অল্প অল্প কাঁপছেন।

কি স্বপ্ন দেখেছি বল তো শুনি।

একটা জন্তু বুকের ওপর বসেছিল।

এই থেকেই তোমার ধারণা হয়ে গেল তুমি আর বাঁচবে না?

তিনি কিছুই বললেন না! মুনা সহজ ভঙ্গিতে বলল, ধর তুমি যদি মরেই যাও তাতে খুব আফসোস থাকার কথা নয়। বড় সমস্যার সমাধান করেছ। মেয়ের ভাল বিয়ে দিয়েছ। কারো কাছে তোমার কোন ধার-দেনা নেই। তাছাড়া–

শওকত সাহেব মুনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুই একটা বিয়ে করলে আমি খুব সহজে মরতে পারব।

বলতে চাচ্ছি। আমি তোমাকে মরতে দিচ্ছি না?

তিনি কিছু বললেন না। মুনা বলল, আমাকে নিয়ে কোনো রকম চিন্তা করবে না মামা। আমি বেশ আছি। তুমি মরে গেলেও আমার কোনো অসুবিধা হবে না।

শওকত সাহেব থেমে থেমে বললেন, আমি মামুনকে একটা চিঠি লিখেছি। ওকে আসতে লিখেছি।

এই কাণ্ড আবার কবে করবে?

পরশু দিন। ও এলে আমি তোর কোনো কথা শুনব না।

মুনা মাথা নিচু করে বসে রইল। শওকত সাহেব বললেন–ঝগড়াঝাটি ঝামেলা এইসব হয়। এটাকে এত বড় করে দেখলে পৃথিবী চলে? চলে না। কমপ্রমাইজ করতে হয়।

তুমি ব্যাপারটা জান না বলে এসব বলছ। জানলে এ রকম করতে না। শোন তোমাকে আমি বলি। এর পরও যদি তুমি ওকে বিয়ে করতে বল আমি করব। মন দিয়ে আমার কথাটা শোন মামা।

আমি মামুনকে নিয়ে বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম কল্যাণপুরে। একটা বাড়ি পছন্দ হল আমাদের। ও বাড়ি ভাড়া করল। এক’দিন বিকেলে ঐ বাড়িতে গিয়েছি। জিনিসপত্র সাজাচ্ছি। ও হঠাৎ দরজা বন্ধ করে ফেলল। বাকিটা তোমাকে তো আর বলতে হবে না মামা। খুবই সহজ গল্প। এ ধরনের একটা ঘটনা আমার ছেলবেলাতেও ঘটেছিল। তখন আমার বয়স তের। তোমাদের কাউকে কিছু বলিনি। আমার মনটা অসাড় হয়ে গেছে মামা। ঘেন্না ধরে গেছে।

মুনার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। শওকত সাহেব কোন কথা বললেন না। উঠোনের জ্যোৎস্নার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। মুনা নিজেকে চট করে সামলে নিল। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলল, একটা কাজ করা যাক মামা। আমি বরং বকুলকে লিখে দেই এখানে আসবার জন্যে। হঠাৎ ঘর খালি হয়ে গেছে তো তাই তোমার এ রকম লাগছে। ওরা এলে ভাল লাগবে। এখন আর তোমার মনে হবে না কোনো জন্তু তোমার বুকে বসে আছে।

মুনা খিলখিল করে হেসে ফেলল। পরমুহুর্তেই হাসি বন্ধ করে গম্ভীর মুখে বলল, বকুল বোধ হয়

এ কথা কেন বলছিস?

বিয়ের পর আমাকে একটি চিঠিও দেয়নি।

শওকত সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোনো চিঠি লিখেনি?

না। কেউ আমাকে পছন্দ করে না মামা। আমার মধ্যে কিছু একটা বোধ হয় আছে যা মানুষকে

আজেবাজে কথা বলিস না।

আজেবাজে কথা না মামা, খুব সত্যি কথা।

মুনা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। হালকা গলায় বলল, যখন ছোট ছিলাম। তখন খারাপ লাগত এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। মামা, যাও শুয়ে পড়।

আমি আর শোক না।

সারারাত বসে থাকবে এখানে?

হ্যাঁ।

বেশ থাক। আমি ঘুমুতে গেলাম। সকালে অফিস।

বিছানায় গিয়েও ঘুম এল না। মুনা এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। মর্নিং অফিস হয়েছে। সাতটার আগে ঘর থেকে বেরুতে হয়। কাল নিৰ্ঘাৎ অফিস কামাই হবে।

সত্যি সত্যি তাই হল, ঘুম ভাঙল নটায়। তার বিরক্তির সীমা রইল না। শওকত সাহেব এখনো বারান্দায় চেয়ারে।

মামা, আমাকে ডাকলে না কেন?

আরাম করে ঘুমুচ্ছিলি তাই ডাকিনি? তোর কাছে একটা ছেলে এসেছে।

কে এসেছে?

চিনি না, গিয়ে দেখ। বসার ঘরে আছে।

মুনাও ছেলেটিকে চিনল না। লুঙ্গী পরা খালি পায়ের একটি ছেলে জড়সড় হয়ে চেয়ারে বসে ছিল মুনাকে দেখে লাফিয়ে উঠল। তোর-চৌদ্দ বছর বয়স। সবে গোঁফ উঠতে শুরু করছে।

কে তুমি?

আপা আমার নাম গোবিন্দ। জলিল মিয়ার চায়ের স্টলে কাম করি।

আমার কাছে কী?

বাকের ভাই আপনারে যাইতে কইছে।

বাকের ভাই আমাকে যেতে বলেছে মানে? সে তো জেলখানায়।

জি না থানা হাজতে।

থানা হাজতে আমাকে যেতে বলেছে?

জি।

সখ তো কম না দেখি। থানা হাজতে আমি কি জন্যে যাব? খবরটা তোমাকে দিয়ে পাঠিয়েছে?

জি। আমি গেছিলাম। বাকের ভাই কষ্টের মধ্যে আছেন।

কষ্টের মধ্যে তো থাকবেই, থানা হাজতে কে আর তাকে কোলে করে বসে থাকবে?

বিরক্তিতে মুনা ভ্রূ কুঁচকাল। গোবিন্দ বলল, আমি যাই আপা?

আচ্ছা যাও।

মুনা স্বপ্নেও ভাবেনি সে বাকেরকে দেখতে যাবে। অসুখ-বিসুখ হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকলে দেখতে যাওয়া যায়। কিন্তু চোর-ডাকাতের সঙ্গে বাস করছে এমন একজনের কাছে যাওয়া যায় না। বাবু এখানে থাকলে একটা কথা হত। তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যেত। বাবু নেই। গেলে তাকে একা যেতে হয়। থানার লোকজনদের গিয়ে বলা আমি একজন আসামীকে দেখতে এসেছি।-সেও একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার। তারা নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে–আসামি আপনার কে? তখন যদি সে বলে–কেউ না তাহলেও ঝামেলা। ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে। নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে কথা বলার চেষ্টা করবে। জঘন্য। মুনা ঠিক করল যাবে না। কিন্তু তবুও বিকেলে চলে গেল। ওসি সাহেবকে সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, আমি বাকের সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আপনাদের হাজতে আছেন। দেখা করা কী সম্ভব হবে?

 

বাকের ভাই কেমন আছেন?

ভাল।

দাড়ি রেখেছেন কেন?

রোজ রোজ শেভ করা মুশকিল। তুমি ভাল আছ?

আমি খারাপ থাকব কেন? আমি তো আপনার মতো গুণ্ডামিও করিনি, বন্দুক–বোমা নিয়ে লাফ-ঝাঁপও দেইনি।

তা ঠিক।

আমি তো দেখেছি। ধরা পড়লেই ছাড়া পেয়ে যান। এবার পাচ্ছেন না কেন?

কেউ ছাড়াবার চেষ্টা করছে না। তুমি কি একটু দেখবে?

আমি দেখব?

কেউ কিছু করছে না। মুনা। আমার ভয় ধরে গেছে।

বাকেরের গলা কেঁপে গেল। মুনা বলল, মামা যখন ঝামেলায় পড়ল তখন আপনি অনেক কিছু করেছিলেন। আমার পাশে আপনি ছাড়া কেউ ছিল না। কাজেই এবার তো সেই উপকারের শোধ দিতেই হবে।

সে সব কিছু না মুনা।

কিছু না হবে কেন? এটা আপনার প্রাপ্য। আপনি এ রকম রোগা হয়ে গেছেন কেন? অসুখ-বিসুখ?

না অসুখ-বিসুখ না। এখানে খাওয়া খুব খারাপ। হোটেলের খাওয়া তো সহ্য হয় না।

আপনার ভাই আপনার কোন খোঁজখবর করছে না?

বাকের জবাব দিল না। মুনা বলল, আজ উঠি, আমি কাল আবার আসব।

বাকের বলল, তোমার সঙ্গে কোনো টাকা-পয়সা থাকলে দিয়ে যাও, খুব কষ্টে আছি। টাকার অভাবে সিগারেট খেতে পারি না।

মুনা দীর্ঘ সময় বাকেরের দিকে তাকিয়ে রইল। ছোট সেল ঘরে বাকের ছাড়াও আরো চারজন মানুষ। এদের একজনের জন্যে টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার এসেছে। ভাত গোসত। এই সন্ধ্যাবেলায় সে গপগপ করে খাচ্ছে। ঝোলে তার হাত-মুখ মাখামাখি হয়ে গেছে। সেদিকে তার ভ্রক্ষেপ নেই। একজন অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে সঙ্গীর খাওয়া দেখছে। অন্য সবাই তাকিয়ে আছে মুনার দিকে।

মুনা তার হাত ব্যাগ খুলল। টাকা-পয়সা কিছু নিয়ে আসেনি। ফিরে যাবার রিকশা ভাড়াটা শুধু আছে। মুনার অসম্ভব মন খারাপ হয়ে গেল। সে লক্ষ্য করল তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। কেন এ রকম হবে? সে চাপা গলায় বলল, কাল আমি আপনার জন্যে টাকা নিয়ে আসব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *