1 of 3

৩২. মোহিনী অনেকদিন ধরে তাকে বলছে

৩২

মোহিনী অনেকদিন ধরে তাকে বলছে, চয়নদা আপনি বাবাকে একবার বলুন না, বাবা হয়তো আপনাকে একটা চাকরি দিতে পারে।

সে কখনও মোহিনীকে বা আর কাউকে মুখ ফুটে চাকরির কথা বলতে পারেনি আজও। কিন্তু তার দীনতা, দারিদ্র্য সবই বোধ হয় বিজ্ঞাপিত হয় তার পোশাকে, চেহারায়, আচরণে, চরিত্রে। তার খিদে পেলে মোহিনী ঠিক টের পায়, দৌড়ে গিয়ে মাকে বলে আসে। মোহিনীর মা এক মহান মহিলা। এ বাড়ি থেকে সে কদাচিৎ উপোসি ফিরে গেছে। এদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় সে নুয়ে থাকে।

মোহিনীর বাবা কৃষ্ণজীবনকে সামান্যমাত্ৰ চেনে সে। ভদ্রলোেক কলকাতায় কমই থাকেন। বছরে দু’বার তিনবার বিদেশে যান। তার ওপর আছে ভারতবর্ষের নানা জায়গায় কনফারেন্স। সরকার এঁকে পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন। বিদেশে বড় চাকরির লোভনীয় প্রস্তাব আসছে। তিনি যেতে চাইছেন না। কিন্তু কতদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন বিদেশের আকর্ষণীয় আমন্ত্রণ? না, মোহিনীর বাবা হয়তো টাকার লোভে যাবেন না। কিন্তু মস্তিষ্কবান মানুষদের এদেশ ধরে রাখতে পারে কই? টাকার জন্য নয়, কাজের স্বাধীনতা, গবেষণার সুবিধা, অত্যাধুনিক সাজসরঞ্জাম ছাড়া উন্নত গবেষণা তো সম্ভব নয়। আর গবেষণার পিছনে অঢেল টাকা খরচ করার মতো তহবিলও তো এদেশের নেই। সুতরাং মোহিনীর বাবা কতদিন ঠেকিয়ে রাখবেন নিজেকে? চয়ন শুনেছে, তার বাবা সরকারকে যেসব প্রস্তাব দেন তার কোনওটাই কার্যকরী হয় না। কৃষ্ণজীবনবাবু সেই কারণেই কিছু ক্ষুব্ধ।

একদিন চয়ন মোহিনীকে বলেছিল, তোমার বাবা যদি বিদেশে চলে যান, তোমরাও তো তাঁর সঙ্গে চলে যাবে?

আমার তো যেতে একদম ইচ্ছে করে না। কিন্তু যেতে তো হবেই।

তোমাদের খুব মিস করব তাহলে। এত ভাল তোমরা!

মাস্টারমশাই, আপনার অঙ্কে যা মাথা, আর ইংরিজি যা ভাল জানেন, আপনি ইচ্ছে করলেই তো অনেক ডিগ্রি পেতে পারতেন।

মোহিনীর কিছু ঠিক নেই। কখনও ডাকে চয়নদা, কখনও মাস্টারমশাই। চয়ন ম্লান মুখ করে বলে, সকলের সব কিছু হয়ে ওঠে না। ওর জন্য দুঃখ করে লাভ নেই।

শরীরটা সারিয়ে নেন না কেন?

এপিলেপসি কি সারে?

তেমন করে চিকিৎসা করালে নিশ্চয়ই সারে।

তুমি জীবনের ভাল দিকগুলোকেই দেখতে পাও। এ খুব ভাল।

আপনি সবসময়ে কেন একটা হতাশার মধ্যে ডুবে থাকেন, মাস্টারমশাই?

চয়ন মাথা নেড়ে বলে, ঠিক হতাশা নয়। সম্পূর্ণ হতাশ হলে তো বেঁচে থাকাই কঠিন হত। মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা কোনও অঘটন ঘটে আমার জীবনটা পাল্টে যাবে। বুঝেছো? অঘটনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় খুঁজে পাই না। কিন্তু মানুষের তো চান্স আর প্রোবাবিলিটি ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। তার দাঁড়ানো উচিত পৌরুষ, আত্মবিশ্বাস আর কঠিন শ্রমের ওপর।

ওসব বড় শক্ত শক্ত কথা।

কাজটা আরও শক্ত। আমি পেরে উঠি না। যেন একটা গর্তের মধ্যে আছি, বেরোতে পারছি না। বেরোলেই পৃথিবীর আলো, হাওয়া, আনন্দকে ছোঁয়া যাবে। কেবল হাঁচোড়-পাঁচোড় করি।

হাঁচোড়-পাঁচোড় কথাটায় খুব হাসল মোহিনী। বলল, এমন ভাব করছেন যেন আপনি প্রতিবন্ধী।

অনেকটা তাই মোহিনী। হাত পা মগজ সব থেকেও কত মানুষ যে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে এদেশে!

মাস্টারমশাই, আপনার কনফিডেন্স ভীষণ কম। একটা চাকরি-টাকরি যদি হয়, দেখবেন, আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে।

চাকরির ব্যাপারে মাঝে মাঝে তাকে খোঁচায় মোহিনী, বাবাকে বলুন। আমার বাবার অনেক ক্ষমতা।

কিন্তু ভয় পায় চয়ন। উনি যদি বিরক্ত হন। খুব গম্ভীর চিন্তাশীল মানুষ। ওসব মানুষের সঙ্গে আজেবাজে স্বার্থ নিয়ে কথা বলতে যাওয়া মানেই সিরিয়াস চিন্তার সূত্রকে ছিন্ন করে দেওয়া।

মোহিনী নিজেও তার বাবাকে একটু সমীহ করে চলে। তাই সে একদিন বোধ হয় তার মাকে বলেছিল। পরদিন মোহিনীর মা এসে বললেন, চয়ন, সত্যিই তো, তুমি একবার ওঁকে বললেই তো পারো।

চয়ন সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, যে আজ্ঞে।

আমি ওঁকে একটু বুঝিয়ে বলে রাখবখন। এবার উনি বিদেশ থেকে ফিরলেই একবার বোলো। ওঁকে তো অনেক প্রোজেক্ট থেকে ডাকছে আজকাল। আর শোনো, সামনের মাস থেকে তুমি জিতুটাকেও পড়াও। এতদিন ওর স্কুল থেকে বলেছে যে, প্রাইভেট টিউশন যেন না নেয়। কিন্তু ক্লাস এইট থেকে এত পড়ার চাপ, অঙ্কে তেমন ভাল নম্বর পাচ্ছে না।

এই বদান্যতায় আরও বিনীত হয়ে পড়ে চয়ন। ভদ্রমহিলা অধ্যাপিকা, স্বামী অধ্যাপক। এঁদের ছেলেমেয়েদের ইচ্ছে করলে এঁরা নিজেরাই হয়তো পড়াতে পারেন। চয়নকে রাখা হয়েছে, চয়নের ধারণা, একজন গরীব মানুষকে সাহায্য করার জন্যই।

অবশেষে অবশ্য কৃষ্ণজীবনের মুখোমুখি একদিন হতেই হল তাকে। পড়াতে যেতেই মোহিনী বলল, চয়নদা আজ বাবার সঙ্গে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট। বাবা বেরিয়ে যাবেন, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। আসুন।

বিদ্বান ও যশস্বী মানুষটির মুখোমুখি হতে সঙ্কোচে মরে যাচ্ছিল চয়ন। গিয়ে দেখল, আদুর গা, লুঙ্গি পরা উদাসীন মুখের মানুষটি, যতটা না গম্ভীর, তার চেয়েও যেন বেশী বিষণ্ণ।

বোসো।

চয়ন সঙ্কোচে বসল। প্রাথমিক পরিচয়ের দরকার ছিল না। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে এই টিউশনির জন্য দরখাস্ত করেছিল চয়ন। তখন ইনি তার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন।

তার দিকে একটু চেয়ে থেকে কৃষ্ণজীবন একটু হাসলেন, চাকরি চাও?

চমৎকার পেটানো স্বাস্থ্য আর সুদর্শন চেহারার মানুষটিকে হাসলে আরও চমৎকার দেখায়। বয়সের কোনও ছাপই পড়েনি চেহারায়।

চয়ন মৃদুস্বরে বলল, আপনাকে বিরক্ত করার ইচ্ছে ছিল না।

জানি। তুমি খুব লাজুক। আমিও তাই।

চয়ন মাথা নিচু করে থাকল।

কৃষ্ণজীবন তাঁর গম্ভীর গলায় বললেন, বাড়িতে কে কে আছে তোমার?

মা, দাদা আর বউদি।

বাবা নেই?

না।

মাকে কিরকম ভালবাসো? খুব?

একটু অবাক হয়ে চয়ন বলে, বাসি। ভালই বাসি।

কতটা ভালবাসো?

চয়ন অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলে, মা ছাড়া কেই বা আছে!

ওটা জবাব হল না। মা কারও কাছে বোঝা, কারও কাছে মাথার মণি। আজকাল মা-বাপকে ছেলেমেয়েরা তেমন ভালবাসতে পারে না। ফলে কাউকেই পারে না। এটা হল একটা পিকিউলিয়ার লাভলেসনেসের যুগ। লক্ষ করেছো ব্যাপারটা?

আজ্ঞে, আমি আর কতটুকু দেখেছি!

আজকাল মা বাপ মরলেও ছেলে তেমন কাঁদে না, কেন বলো তো!

চয়ন একটু ভেবে সংকোচের সঙ্গে বলল, আপনি বোধ হয় ঠিকই বলেছেন। আজকাল সেন্টিমেন্টটা যেন কিছু কমে গেছে।

সেটা কি ভাল?

না বোধ হয়। আমার মা কয়েকদিন আগে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমার তখন মনে হয়েছিল, মায়ের আর বেঁচে থাকার দরকার কী?

কেন ওরকম মনে হল তোমার?

মা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে। শরীরে, মনে।

তোমার সংসারটা বোধ হয় সুখের নয়, না?

চয়ন মাথা নিচু করে রইল।

কৃষ্ণজীবন নামক জ্ঞানী মানুষটি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, সব সংসারই একটা অন্যটার কারবন কপি। কোনও সংসারই কেন পিসফুল নয় বলো তো! আন্ডারকারেন্ট, পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ, ঘেন্না, জেলাসি। পরিবার থেকে ওটা ধীরে ধীরে সমাজেও সংক্রামিত হয়ে যায়, তাই না?

চয়ন চুপ করে থাকে। জ্ঞানী মানুষটি তাকে একটা চাকরি দিলেও দিতে পারেন, কিন্তু তার জন্য এই ভালবাসার ধাঁধা কেন? চয়ন বুঝে উঠতে পারল না।

তোমার দাদা মানুষটি কেমন?

ভাল।

বউদি?

ভাল।

জ্ঞানী মানুষটি হাসলেন। হেসে বললেন, ভাল হলে তো ভালই। কিন্তু তোমার মুখ দেখে মনে হয় তুমি খুব মানসিক প্রেশারে আছো। সত্যি বলছি?

চয়ন মৃদু মাথা নেড়ে জানাল, সত্যি।

কৃষ্ণজীবনবাবু আচমকা তাকে আর একটা বিপদে ফেলে দিয়ে বললেন, চাকরি চাও, না সাকসেসফুল হতে চাও?

চয়ন বুঝতে না পেরে বলে, আজ্ঞে?

অনেকে চাকরি পাওয়াটাকেই সাকসেস বলে মনে করে। তুমিও কি তাই মনে করো?

চয়ন খুব অপ্রতিভ হয়ে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারি না। একটা চাকরি হলে আপাতত বেঁচে যাই।

সাকসেস কাকে বলে জানো?

ঠিক বুঝতে পারি না।

জ্ঞানী মানুষটি হঠাৎ যেন কেমন বিষণ্ণ আর গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ইউনিভার্সিটির ভাল ভাল সব ছেলেও আজকাল চাকরির পরিধির বাইরে আর কিছু বুঝতে চায় না। চাকরি ছাড়াও যে সাকসেস বলে আর একটা ব্যাপার আছে, তা তারা বুঝতেই পারে না।

যে আজ্ঞে।

ধরো চাকরি হল না, খুব সামান্য আয়ে তোমার চলে, কিন্তু তোমার নৈতিক চরিত্র ভীষণ ভাল, চোর ছ্যাঁচোড় নও, নেশা ভাঙ করো না, পাঁচজনের দায়ে দফায় গিয়ে বুক দিয়ে সাহায্য করো এবং সবচেয়ে বড় কথা, যদি তুমি তোমার চারপাশের লোকজনকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে পারো, সেটা কি সাকসেস নয়?

আজ্ঞে তা তো বটেই।

চাকরি করাটাও একটা কাজ। প্রয়োজনীয় কাজ। রুজি-রোজগারের জন্যই এর দরকার। কিন্তু আরও একধরনের কাজ আছে। সেটা হল ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। এমন কিছু লোককে দরকার, যারা রুজি-রোজগারের জন্য নয়, দুনিয়ার জন্য আদাজল খেয়ে লেগে যাবে। তুমি আরণ্যক উপন্যাসটা পড়েছো?

আজ্ঞে পড়েছিলাম।

ওতে কে যেন একটা মানুষের কথা ছিল, যে-লোকটা জঙ্গলে নতুন নতুন গাছ লাগিয়ে বেড়াত। জঙ্গলটা তার নিজের নয়, গাছ লাগালে তা থেকে কোনও লাভও হত না। তবু কেন লাগাত জানো? জঙ্গলটাকে সুন্দর দেখাবে বলে। ওইটেই হল ভালবাসা।

যে আজ্ঞে।

পারবে পৃথিবীটাকে ওরকম ভালবাসতে?

চয়ন এই জ্ঞানী মানুষটিকে কি করে বোঝাবে যে, পৃথিবীর সঙ্গে তার কোনও পরিচয়ই নেই। ভূগোলের ম্যাপ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনও চেহারা তার জানা নেই। কলকাতার বাইরে সে কদাচিৎ গেছে। তাও বাড়ি আর টিউশনির বাড়ি, নির্দিষ্ট প্রতিদিনকার যাতায়াতের পথের বাইরে এই কলকাতা শহরকেই বা সে কতটুকু চেনে? এই বিদ্বান, ভ্রমণশীল, বহুদর্শী মানুষটিকে সে কী করে বলবে যে, তার পরনির্ভর পরাবলম্বী জীবনে সে কেবলই গ্রহীতা মাত্র, দাতা নয়। প্রতিদিনকার লাঞ্ছনা, আত্মাবমাননা, নিজেকে নিয়ে হাজারো সমস্যায় জর্জরিত, তার পৃথিবীর জন্য কিছু করার সাধ্যই নেই। রাস্তার যে কোনও মানুষ, একজন ঠেলাওলা কি রিকশাওলাকেও সে হিংসে করে।

কিন্তু সে একথা বলতে পারল না। চুপ করে রইল।

জ্ঞানী মানুষটি তাঁর প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, কমপিউটার হ্যান্ডেল করতে পারো?

চয়ন সভয়ে বলল, আজ্ঞে না।

শিখে নিতে পারবে?

চয়ন দ্রুত মনে মনে হিসেব করে নিল। কমপিউটার শিখতে যে টাকা লাগে, তা কি তার টিউশনি থেকে বাঁচানো টাকায় সম্ভব? না। কোনও আশাই নেই।

দুঃখিতভাবে সে চুপ করে রইল।

জ্ঞানী মানুষটি বললেন, আমাকে একটা পি সি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কমপিউটারে ডাটা ভরবার জন্য একজন মানুষ চাই। একটু সায়েন্স জানা লোক। আমার তো সময় হয় না।

চয়ন ভাঙা বুক নিয়ে চোখ নামিয়ে রাখল। জবাব দিল না।

জ্ঞানী মানুষটি তার দিকে চেয়ে বললেন, শেখোনি, না?

আজ্ঞে না।

তোমার অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন কী তা জানি না। তবে শুনেছি তুমি অঙ্ক আর ইংরিজিতে খুবই ভাল। তাই কি?

কাজ চালিয়ে নিতে পারি।

যদি কলকাতা ছেড়ে বাইরে যেতে হয়, পারবে?

পারব।

মাকে কে দেখবে?

মা? বলে চয়ন চোখ তুলে জ্ঞানী মানুষটির দিকে তাকায়। উনি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন? উনি কি তার সংসারের ভাগাভাগির কথা জানেন?

হ্যাঁ, মা। তাঁকে দাদা বউদি দেখবে?

হয়তো তা দেখবে।

হয়তো কেন? তুমি কি নিশ্চিত নও?

চয়ন আবার চুপ করে থাকে।

তোমাদের কি ভাগের মা?

চয়ন প্রমাদ গোনে।

জ্ঞানী মানুষটি হেসে ওঠেন, আরে লজ্জা কিসের? লজ্জা পাওয়ার দরকার নেই। গল্পটা মোটামুটি একই রকমের। তোমার মা, আমার মা, সব মা এখন ভাগের মা। এখন দেশও ভাগের মা, পৃথিবীও ভাগের মা। এ হল ভাগের যুগ।

যে আজ্ঞে।

টাইপ করতে পারো?

শিখেছিলাম। এখন বোধ হয় স্পীড কমে গেছে।

আর কী জানো?

আর! আর তো কিছু জানি না।

বয়স কত?

ঠিক হিসেব নেই। আঠাশ হতে পারে।

সার্টিফিকেট এজ কত? ওটাই দরকার।

ছাব্বিশ প্লাস।

টিউশনি করে কত পাও?

ছ’সাতশো টাকা হয়।

আরও বেশী হওয়ার কথা ছিল।

শরীরের জন্য বেশী পেরে উঠি না।

ওঃ, তোমার তো আবার ক্রনিক একটা ট্রাবল আছে।

যে আজ্ঞে।

তুমি আপাতত আমার মেয়েকে আর ছেলেকে পড়াতে থাকো। আমি শুনেছি তুমি ভাল টিউটর। কিন্তু আমার আরও কিন্তু জানবার আছে।

আজ্ঞে, বলুন।

জ্ঞানী মানুষটি হাসলেন। বললেন, প্রশ্ন করে সেটা হয়তো জানা যাবে না। কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই লুকোনো, অব্যবহৃত কিছু গুণ থেকে যায়। সে হয়তো সারা জীবন নিজের সেই গুণটার কথা জানতেই পারে না। গুণটা থেকেও নষ্ট হয়। তোমার ভিতর সেরকম কিছু আছে কিনা দেখতে হবে। তুমি জানো, তোমার সেরকম কিছু আছে কিনা?

আজ্ঞে না।

তুমি কি কথাটা বিশ্বাস করো?

আপনি যখন বলছেন তখন—

জ্ঞানী মানুষটি প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন, আমার একটা ছোট ভাই আছে, সে খুব মদ খায়, লেখাপড়া শেখেনি, খারাপ খারাপ কথা বলে। কিন্তু তার একটা সাঙ্ঘাতিক গুণ আছে। সে মা-বাবাকে ভীষণ ভালবাসে। বাবাকে পাকা বাড়িতে রাখবে বলে ধারকর্জ করে ঘর তুলছে। বাবা-মায়ের যা খেতে ইচ্ছে করে, এনে দেয়। তার অনেক বড় দোষ থাকলেও, ওই একটা গুণে এখনও সে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি। ওই ভালবাসা তাকে টগবগে চনমনে রাখে। ভালবাসার এই প্র্যাকটিক্যাল দিকটার কথা কেউ আজকাল ভাবে না, না?

চয়ন আবার চুপ।

জ্ঞানী মানুষটি তাঁর গ্রগাঢ় গলায় বললেন, লোকে কত ভালবাসার কথা বলে, কিন্তু ভালবাসা কাকে বলে তা তার জানাই নেই। প্রেমিক প্রেমিকারা কত ভালবাসার কথাটথা বলে ঘর বাঁধে, তারপর তাদের ঝগড়ার জ্বালায় বাড়িতে কাকপক্ষী বসতে পারে না। ভালবাসার গভীরতায় যেতেই পারে না তারা। বাবা-মা ছেলেমেয়েদের কত ভালবাসে বলো তো! ভাল করে অবজার্ভ কোরো, ওই ভালবাসার মধ্যে কতখানি স্বার্থপরতার ভেজাল মিশে আছে। ভালবাসতে গিয়ে সন্তানের মনুষ্যত্বটাকেই পঙ্গু করে দেয় তারা। যদি সত্যিই ছেলেকে কেউ ভালবাসে, তাহলে সেই ভালবাসার সূত্র ধরেই দুনিয়ার সব শিশুকেই সে ভালবাসতে বাধ্য।

যে আজ্ঞে।

শুধু আমাকে অন্ধভাবে সমর্থন করে যেও না। ব্যাপারটা আর একটু তলিয়ে বুঝবার চেষ্টা করো। ধরো, আমি আমার বাচ্চা ছেলেটাকে খুব ভালবাসি। সাধারণত আমরা সেই ভালবাসার জন্য কী করি? ছেলেকে এডুকেশন দিই, ক্যারিয়ার তৈরি করি, বিপদ-আপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করি, খারাপ সংসর্গে যাতে না পড়ে নজর রাখি, তাকে অঢেল খেলনা দিই, পোশাক দিই, প্রশ্রয় আর আদর দিই, তাই না?

ঠিকই তো!

অথচ ছেলেকে রেখে যাবো এমন একটা পৃথিবীতে যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে ড্রাগ পেডলার, খুনে, ছিনতাইকারী থেকে শুরু করে আরও নানা বিপদ। ছেলেকে যদি সত্যিই ভালবাসি তাহলে দুনিয়াটাকেই সাফসুতরো করে রেখে যেতে পারলে নিশ্চিন্তে চোখ বোজা যেত। তাই না?

যে আজ্ঞে।

ছেলের মুখের হাসি অনাবিল করে তুলতে প্রকৃত ভালবাসে যে বাপ সে অন্য ছেলেদেরও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলবে। নইলে কেবল আমার ছেলে, আমার ছেলে বলে হেঁদিয়ে মরলে তো হবে না।

যে আজ্ঞে।

জ্ঞানী মানুষটি মৃদু হেসে বললেন, আমি আগে খুব কম কথা বলতাম। অনেকে আমাকে বোবা বলে ভাবত। কিন্তু আজকাল এত কথা চলে আসে, যে মাঝে মাঝে আমি লজ্জিত হয়ে পড়ি।

চয়ন মৃদুস্বরে বলল, আপনি যা বলছেন তা অতি সত্য।

ব্যাপার কী, জানো, আজকাল আমার মনে হয়, কিছু কথা বলে না গেলে এগুলো অকথিতই থেকে যাবে। আমার কথা লোকে মানুক বা না-মানুক, উচ্চারণ করাটা দরকার ছিল।

যে আজ্ঞে।

তুমি ভালবাসার কথাটা মনে রেখো। যা কিছু দেখবে, যাকে দেখবে, তাকেই ভালবাসবার চেষ্টা কোরো। ভালবাসা মানেই কিন্তু ভাল করা। তার ভালর জন্য কিছু যদি না-ই করলে, তাহলে ভালবাসা বন্ধ্যা হয়ে গেল, মিথ্যে হয়ে গেল।

চয়ন জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ মানুষটির দিকে খানিকটা উদ্বেগ, খানিকটা বিস্ময় নিয়ে চেয়েছিল। ইনি বিজ্ঞানী, ইনি সারা দুনিয়ার বিশিষ্ট জ্ঞানীদের শ্রদ্ধার পাত্র, ইনি এসব নিয়ে ভাবেন কখন?

জ্ঞানী মানুষটি কিছু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, চাকরির জন্য ভেবো না। কিছু একটা হয়ে যাবে। তোমার ঘুমন্ত অভ্যন্তরে কী আছে তা খুঁজে দেখো। যদি কিছু পাও, আমাকে নিঃসঙ্কোচে বোলো। নিজেকে খুব কম মানুষই বুঝতে পারে।

যে আজ্ঞে।

মানুষের একটা অনাবিষ্কৃত গুণ হঠাৎ আবিষ্কৃত হয়ে তাকে চোখের পলকে বিশ্ববিখ্যাতও করে তুলতে পারে। কিন্তু আবিষ্কার হওয়াটাই হচ্ছে প্রথম কথা।

যে আজ্ঞে।

যখন টাকার দরকার হবে, আমাকে বা মোহিনীর মাকে বোলো। লজ্জা কোরো না। আমরা বড়লোক নই, কিন্তু তোমার কাছের মানুষ।

আজ্ঞে, মনে থাকবে।

জ্ঞানী মানুষটি একটি বড় শ্বাস ফেলে উঠলেন। উনি এখন বেরোবেন।

বিদায় নিয়ে মোহিনীকে এসে পড়াতে বসল সে।

মোহিনী চাপা গলায় বলল, কথা হল মাস্টারমশাই?

হল। মোহিনী, তোমার বাবা একজন গ্রেট ম্যান।

পিতৃগর্বে উজ্জ্বল হল মোহিনীর মুখ। সে বলল, কিসে বুঝলেন?

উনি একজন গভীর মানুষ। কত ভাবেন!

বাবাকে আমি খুব ভয় পাই। দূরের মানুষ তো! কিন্তু আমার বাবা যে ভীষণ ভাল তা আমি জানি।

ভাল বললে কিছুই বলা হয় না। ভালর চেয়েও অনেক বেশী কিছু।

চাকরির কথা কী হল?

চয়ন একটু হেসে বলে, ওঁর কথা শুনে আমার চাকরি করতেই আর ইচ্ছে হচ্ছে না।

ওমা! সে কী চয়নদা? এত বলে-কয়ে মাকে পটিয়ে বাবার সঙ্গে বসালাম যে আপনাকে!

চয়ন লজ্জার হাসি হেসে বলে, ভয় নেই। একটা চাকরি জুটিয়ে দেওয়া ওঁর পক্ষে শক্ত কাজ নয়। উনি সেটুকু করবেন। কিন্তু আমাকে উনি খুব প্রভাবিত করেছেন আজ।

তাই বলুন! বলে মোহিনী নিশ্চিন্ত হল।

তুমি তোমার বাবাকে কতটা চেনো মোহিনী?

সত্যি কথা বলব? মোহিনী মৃদু হেসে বলে।

বলো।

বাবাকে একদম চিনি না। বাবা এত ব্যস্ত! কাজে, চিন্তায় আর দুশ্চিন্তায় যে, বাবার কাছে ঘেঁষতেই পারি না। কখনো-সখনো একমাস দেড়মাসেও একটাও কথা হয় না।

বাবার কাছে চুপটি করে কখনও বসতে ইচ্ছে হয় না?

মাঝে মাঝে হয়। সাহস পাই না। সবসময়ে দেখি, বাবা কী নিয়ে যেন খুব টেনশনে আছেন। রাত জেগে বসে ভাবেন, পায়চারি করেন। মাঝে মাঝে ছাদে চলে যান। কখনও চুপ করে চোখ বুজে অনেকক্ষণ স্থির বসে থাকেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চয়ন বলে, ওরকমই হওয়ার কথা।

বাবা আমাদের কথা ভাবেন না। ভাবেন পৃথিবীর কথা, মহাকাশের কথা, ইনফিনিটির কথা।

তার মধ্যে তোমরাও আছো মোহিনী। সেই ভাবনার মধ্যে আমরা সবাই আছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *