৩২. মির্জাসাব, এই দোজখে

মেহ্ নহ্ থী হমারী কিসমৎ কেহ্ বিলাস-এ য়ার হোতা,
অগর অওর জীতে রহেত য়হী ইন্তজার হোতা।
(বন্ধুর সাথে মিলন ভাগ্য ছিল না;
যদি আরও বাঁচতাম, এই প্রতীক্ষাই চলত।)

মির্জাসাব, এই দোজখে, আপনাদের সামনে আজ স্বীকার করছি, ইসমতকে আমি ভালবেসেছিলাম। কখনও ওকে বলার প্রয়োজন হয়নি, কেননা, আমরা দুজনেই তা জানতাম। ইসমতের সঙ্গে বিবাহিত জীবনের কথা আমি কখনও ভাবিইনি; বিয়ে নারী-পুরুষের সম্পর্ককে কতগুলো অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে ফেলে, আর তারপর সম্পর্কটা বিবর্ণ হতে হতে একেবারে ধূসর হয়ে যায়। ইসমতকে আমি দেখেছিলাম একটা তসবির মহলের মতো; সে মহলে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কত নতুন নতুন ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠত, কত যে দৃশ্যের জন্ম হত। ইসমত আহামরি কিছু সুন্দরী ছিল না, কিন্তু একই সঙ্গে স্নিগ্ধ ও প্রখর। চশমার কাচের ওপারে ওর চোখ দুটো যেন সবসময় বিস্মিত হওয়ার অপেক্ষায় মুখর হয়ে আছে। গালে যখন টোল পড়ত তখন সত্যিই চোখ ফেরানো যেত না। আর ওর আইসক্রিম খাওয়া দেখতে এত মজা লাগত আমার; আইসক্রিম পেলে ইসমত একেবারে বাচ্চা মেয়ে হয়ে যেত।

আমার চোখ দেখলেই নাকি ওর ময়ূরের পেখমের কথা মনে পড়ত। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এইরকম মনে হয়, ইসমত?

-জানি না। মনে হয়।

-গল্প লিখতে লিখতে বানিয়ে কথা বলার অভ্যাস রপ্ত করেছ বেশ।

-আমি মিথ্যা বলি না মান্টোভাই।

-কেন বলো না? মিথ্যে ছাড়া জীবনে কোনও রং থাকে?

-তুমি তো বলো। সেখান থেকে রং চুরি করি।

-মাশাল্লা।

-আর একটা কথা শুনে রাখো মান্টোভাই। তোমার চোখের দিকে তাকালে আমি হার্টের একটা বিট মিস করি।

-আরিব্বাস। শফিয়াকে বলতে হবে। তার কখনও এমনটা হয় বলে শুনিনি।

-নিজের প্রশংসা শুনতে খুব ভাল লাগে, না?

-কার না লাগে?

-তোমার সবচেয়ে বেশী লগে। তোমার মত নার্সিসাস আমি দেখিনি।

যেন একটা খেলার মতই গড়ে উঠেছিল আমাদের সম্পর্কটা। কথায় কথায় তর্ক বেধে যেত। ইসমত তো কোনও কিছুতেই কাউকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। আমার কাজ ছিল ওকে রাগিয়ে দেওয়া। রাগী ইসমতের সৌন্দর্য যে কত আদিম, তা আমার মতো কেউ জানে না, মির্জাসাব। ঝগড়া একেক দিন এমন জায়গায় পৌঁছত, মনে হত, এর পর থেকে আর আমাদের দেখা হবে না। একবার ঝগড়া হতে হতে আমি হঠাৎ বলে ফেললাম, তুমি মেয়ে না হলে এমন কথা বলতাম, আর কথা বলার মুরোদ রাখতে না।

-যা মনে হয় বলো না। আমাকে ছাড় দেওয়ার দরকার নেই। ইসমত গম্ভীর হয়ে বলল।

-তাই? তুমি ছেলে হলে–

-আরে বলো না। কোন খিস্তিটা দেবে আমায়? কী করবে?

-লজ্জা পাবে ইসমত।

-একেবারেই না।

-তা হলে তুমি মেয়ে নও। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম।

-কেন? লজ্জা না পেলে শুধু মেয়ে বলে আমাকে লজ্জা দেখাতে হবে কেন? মান্টোভাই, তুমিও তা হলে এভাবে নারী-পুরুষকে আলাদা করে দ্যাখো? আমি ভেবেছিলাম, তুমি আম আদমির চেয়ে আলাদা।

ইসমতের জিভ এইসব কথা বলার সময় একেবারে ছুরির ফলা হয়ে যায়।

আমি আমতা-আমতা করে বললাম, একেবারেই না…ছেলে আর মেয়েদের আমি একেবারেই আলাদা করে দেখি না।

-তা হলে কথাটা বলছ না কেন?

আমি চুপ করে গেলাম। ইসমত এবার খোঁচাতে লাগল, বলো মান্টোভাই, বলো, কথাটা শুনি। তারপর না হয় মেয়েদের মতো লজ্জা পেয়ে ছুটে পালাই। বাচ্চা মেয়ের মতো আমাকে খ্যাপাতে লাগল। আমি হেসে ফেললাম, না ইসমত, আমার রাগ জল হয়ে গেছে।

এভাবেই, ইসমতের কাছে হেরে যেতেই হবে। একেবারে একা-নিজে নিজে-ইসমত তার নিজস্ব দুনিয়াটা তৈরি করেছিল। ওর বাবা কাসিম বেগ চুঘতাই ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট; বদলির কত জায়গাতেই না থাকতে হয়েছে। আলিগড়ে ইসমত যখন ক্লাস নাইনে পড়ে, ওর বাবা বদলি হয়ে গেলেন রাজস্থানের সম্ভরে। ইসমত হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে চেয়েছিল; ওর বাবা-মা রাজি হননি। সম্ভরে এসে ইসমতের দমবন্ধ হওয়ার অবস্থা। পড়াশোনার কোনও সুযোগই সেখানে নেই। একদিন সকালে নাস্তার পর ওর বাবা বসে আখবার পড়ছেন; পাশেই একটা চৌকিতে বসে মা সুপুরি কাটছিলেন। ইসমত ঘরে ঢুকে মায়ের পাশে গিয়ে বসল। তারপর খুব শান্তভাবে বলল, পড়াশোনা করতে সে আলিগড়ে যেতে চায়। মা তো চোখ বড় – বড় করে ইসমতের দিকে তাকিয়ে আছে। কাসিম বেগ চুঘতাই দেখলেন, মেয়ে তাঁর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছে। কোনও ছেলেমেয়েই এভাবে তাঁর চোখের ওপর চোখ রাখতে পারেনি কখনও।

ইসমত সোজাসুজি আবারও বলল, পড়াশোনা করতে আমি আলিগড়ে যাব।

-এখানে তো বড় আব্বার কাছে পড়ছ।

-আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে চাই।

-কেন? জুগনুর আর দুবছর পড়া বাকি। তারপরই তো তোমাদের শাদি হবে।

-আমি ম্যাট্রিক দেব।

-কোনও দরকার নেই।

-তা হলে আমি পালাব।

-পালাবে? কোথায় যাবে?

-যেখানে খুশি।

ইসমতের মা খুব রেগে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাসিম বেগ চুঘতাই মেয়ের এই সমানে সমানে কথায় হয়তো কিছু আঁচ করেছিলেন। তিনি ইসমতকে আলিগড়ে পাঠিয়ে দিলেন। ইসমতের জীবনের প্রথম জয়। অন্যান্য বোনের মত ও ছোটবেলায় পুতুল খেলেনি, ছেলেদের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নেমেছে; ইসমত কখনও চায়নি, বোনেদের মতো তারও কুড়ি বছরের মধ্যে নিকে হয়ে যাক। ছবছর ধরে ইসমতের সঙ্গে সম্পর্কটা যেন একটা জল রং-এ আঁকা ছবির মতো। ছবিটা কীভাবে আঁকা শুরু হয়েছিল, কবে শেষ হয়েছিল, কিছু আর মনে নেই। তার ওপর, মদ খেতে খেতে, বুঝতেই পারছেন ভাইজানেরা, আমার মাথার হালত খুব খারাপ, কোনটা আগে, কোনটা পরে, কিছুতেই খেই খুঁজে পাই না। একটা মজার রাতের কথা মনে পড়ছে, ভাইজানেরা। শহিদ আর ইসমত তখন মালাদে থাকে। আমরা রাত বারোটার পর গিয়ে ওদের বাড়িতে হানা দিলাম। আমি, শফিয়া, নন্দাজি আর খুরশিদ আনোয়ার। শফিয়া তো এসবে অভ্যস্ত নয়, কিন্তু আমাকে একা ছাড়বে না বলেই ওর আসা। দরজা খুলতেই শফিয়া ইসমতের হাত চেপে ধরে বলতে লাগল, কত করে বোঝালাম, এত রাতে ওদের বিরক্ত করো না। তোমার মান্টোভাই। আসবেই।

-তুমি আমাকে ঠেকাবে শফিয়া? আমার যখন যেখানে খুশি যাব।

শাহিদ এসে আমার পিঠে হাত রেখে বলল, রাতটা জমে যাবে মান্টো, এসো-এসো–।

আমাদের তো খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু সব হোটেল তখন বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বললাম, ইসমত, আজ নিজেরাই বেঁধে খাব। আটা, ডাল আর আলু থাকলেই চলবে।

শফিয়া তো কিছুতেই আমাদের রান্নাঘরে যেতে দেবে না। ছেলেরা রান্না করে খাবে, তা কখনও হয় নাকি? কিন্তু আমরা রান্নাঘরেই বসে গেলাম বোতল আর গ্লাস নিয়ে। আমি আটা মাখছি, নন্দাজি স্টোভ ঠিক করছে, আর খুরশীদ আলুর খোসা ছাড়াচ্ছে। একসময় খুরশিদ বলে উঠল, এ শালা আলুর খোসা ছাড়ানো আমার কম্ম নয়। মান্টোভাই, কাঁচা খেতে পারবে না? আমি রুটি বানালাম, তবে আধপোড়া, আর পুদিনার চাটনি। খেয়েদেয়ে আমরা কজন রান্নাঘরেই শুয়ে পড়লাম। এইরকম কত রাতে ইসমত আর শহিদ আমার অত্যাচার সহ্য করেছে। মদের মাত্রা যত বাড়ত, আমি ইসমতকে বোঝাতে চেষ্টা করতাম, আল্লার কসম ইসমত, আমি মাতাল হইনি। দেখতে চাও? বাজি লড়। কালই আমি মদ খাওয়া ছেড়ে দেব। মদ ছেড়ে দেওয়া কোনও ব্যাপারই না আমার কাছে।

-বাজি লড়ো না মান্টোভাই, তুমি হেরে যাবে। এখন তুমি মাতাল।

মজা লাগে, মির্জাসাব, খুব মজা লাগে, আপনার-আমার গায়ে কেমন মাতালের ছাপ্পাটা লেগে। গেল। আপনি যদি সবসময় মাতালই থাকতেন, তা হলে এত গজল লিখলেন কখন? এত চিঠি লেখা সম্ভব হত আপনার পক্ষে? আমিই বা এত-এত গল্প লিখলাম কী করে? এলোমেলো, ছন্নছাড়া একটা জীবন, পেটের ভাত জোগাড় করতেই সকাল থেকে রাত্তির কত নোংরামিতে ডুবে থাকা, মদ খাওয়ার পর ঠিকঠাক ফোকাস করতে পারতাম, আমার লেখার ঘরটা খুঁজে পেতাম। সে-ঘরে শব্দরা হাঁটাচলা করে, উড়ে বেড়ায়, গুনগুন করে গান গায়, কী যে বেদনায় গুমরে গুমরে ওঠে, শব্দের ভেতরেই তো খুঁজে পেতাম কত গোপন অশ্রু, মুচকি হাসি, খেটে খাওয়া মানুষদের অট্টহাসি আর খিস্তি, কত ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন, হতাশ্বাস, শব্দের ভেতরেই জ্বলে উঠত সে নীল আলো যার গভীরে লুকিয়ে থাকে কামনার লাল শিখা। আমি তো কখনও নিজের কথা লিখতে চাই নি মির্জাসাব। কোনও লেখকই কি সে দৈনন্দিনে কীভাবে বেঁচে আছে, তার সুখ-দুঃখ, পছন্দ-অপছন্দের কথা লেখে? সে তো শব্দের ভেতরে খুঁজে বেড়ায় চেনা-অচেনা মানুষদেরই সেইসব ছবি, যে ছবিগুলো তারা লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল, যে সব ছবির স্মৃতি তাদের গভীর দহনের পথে নিয়ে গেছে। সারাদিন কঠিন পরিশ্রম করে যে নারী রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে, সে কখনও আমার গল্পের নায়িকা হতে পারে নি, ভাইজানেরা। যে-মেয়েটা সারারাত বাতি জ্বেলে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করে, তারপর দিনের বেলা ঘুমিয়ে পড়ে আর হঠাৎই একটা স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে জেগে ওঠে, আমি তার কথাই ভেবেছি। কি স্বপ্ন দ্যাখে সে? তার বৃদ্ধ, লোলচর্ম শরীর তারই দরজায় এসে কড়া নাড়ছে।

ইসমত সব সময় বলত, এই যে আমি নানা কোঠা আর বেশ্যাদের গল্প বলি, এসবই নাকি আমার বানানো। আমার দোস্তদের সম্পর্কেও যা বলতাম, তা-ও বিশ্বাস করত না। এই ধরুন রফিক গজনভি। ও তো একটা লোফার ছিল, একেবারে লোচ্চা। এক বাড়ির চার বোনকে পর পর বিয়ে করেছিল, লাহোরের কোঠার এমন কোনও মেয়ে ছিল না, যার সঙ্গে শোয়নি।

রফিককে আমার সত্যিই ভাল লাগত। জীবনটা যেন একটা খেলার মতো ওর কাছে। একদিন ইসমতকে বললাম, চলো, রফিকভাইয়ের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই।

-আমার তাতে লাভ? তুমি তো বলো, ও একটা লোচ্চা।

-সেইজন্যই তো আলাপ করবে। তোমাকে কে বলেছে, লোচ্চা মানেই সে খারাপ মানুষ? রফিকের মতো শরিফ আদমি খুব কম দেখা যায়।

-মান্টোসাব, তোমার কথার মানে কিছু বুঝছি না। আমি হয়ত ততটা বুদ্ধিমান নই।

-ভান করো না তো। একবার দেখা করোই না। রফিকভাই খুব মজার মানুষ। ওকে দেখলে প্রেমে পড়েনি এমন কোনও মেয়ে নেই, বুঝলে?

-আমিও তো মেয়ে।

-আরে তুমি তো আমার ইসমত বহিন।

-আবার বহিন। তোমার এই ভাঁড়ামো আমার ভাল লাগে না, মান্টোভাই। ইসমত আমার পাঞ্জাবির কাঁধ খামচে ধরে।

-তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকে এভাবে বহিন বলি না, ইসমত। ইকবালকেও না।

-কেন বলো?

এর যে কোন উত্তর নেই, মির্জাসাব। ইসমতই তো একদিন বলেছিল, জীবনে একটা কথাও তুমি মুখ ফুটে বলতে পারলে না? ইসমত জানত, মান্টোর মতো শয়তানেরও মুখোশের দরকার হয়।

রফিকভাইয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম ইসমতের। ইসমত স্বীকার করেছিল, সত্যিই ও শরিফ আদমি। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কী করে এমনটা হয় মান্টোভাই?

-জানি না। আমি কখনও রফিকভাইকে বোঝবার চেষ্টা করিনি। ও যেমন, তেমন ভাবেই মেনে নিয়েছি।

-মান্টোভাই—

-হুকুম করো।

-পাঁক খুঁড়ে খুঁড়ে এইসব মুক্তো তুমি কীভাবে বার করো?

-খোদাকে সালাম জানাও।

-আর কোঠার গল্পগুলো? ওগুলোও সত্যি? আমি বিশ্বাস করি না। মিথ্যে বলায় তো তোমার সঙ্গে কেউ পেরে উঠবে না।

-মিথ্যের কী আছে? পকেটে পয়সা থাকলে যে কেউ কোঠায় যেতে পারে।

-তোমার দুনম্বরি বন্ধুগুলোর সে-সাহস নেই মান্টোভাই। হ্যাঁ, মুজরো শুনতে যেতে পারে, তার বেশী কিছু করার সাধ্য ওদের নেই।

-আরে, আমিও তো গেছি।

-মুজরো শুনতে? ইসমত বাঁকা হাসে।

-কেন?কেন? শুধু মুজরো কেন? কোঠায় গিয়ে যে-জন্য টাকা খরচ করে মানুষ, সেজন্যই গেছি।

-চুপ করো। বেহায়া কোথাকার! ইসমত চিৎকার করে ওঠে। মিথ্যে বলার একটা সীমা আছে

-কেন? অসুবিধে কোথায়?

-হতে পারে না। নিজের এইরকম ইমেজ তুমি ইচ্ছে করে তৈরি করো।

-খোদা কসম, ইসমত, আমি কোঠায় গেছি।

-খোদার নাম মুখে এনো না। তুমি তাঁকে বিশ্বাস করো।

-আমার মরা ছেলের কসম।

-মান্টোভাই। সে দুহাতে আমার চুল খামচে ধরে।-তুমি কি মানুষ? মরা ছেলের নামে কসম খাচ্ছ?

দেখতে পেলাম, ইসমতের দুই চোখ ঝাপসা। আমি হাসতে লাগলাম।

-তুমি বিশ্বাস করছ না কেন, ইসমত বহিন, আমি মেয়ে পটাতে ওস্তাদ।

-মান্টোসাব, এই কিন্তু আমাদের শেষ দেখা বলে দিচ্ছি। ইসমত ফুসতে থাকে। ওর গালে টোল পড়েছে। এইরকম সময়ে ওকে আরো রাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করে আমার। বলি, দাঁড়াও, শফিয়াকে ডাকি। ও কি বলে শোনো।

শফিয়া আসতেই ইসমত ফেটে পড়ে, মান্টোভাই তোমাকে বলেছে, ও কোঠার মেয়েদের কাছে গেছে?

-কতবারই তো বলেছেন।

-হতে পারে না। ইসমত রাগে গরগর করতে করতে পায়চারি করতে থাকে।-আচ্ছা, না হয় গেছে, গেলেও ওদের সঙ্গে দুটো একটা কথা বলে চলে এসেছে, মান্টোভাই। ঠিক কি না। শফিয়া?

-কি জানি। মান্টোসাবই বলতে পারবেন।

আমি হা-হা করে হাসতে থাকি। আর ইসমত তত চেঁচাতে থাকে, হতে পারে না, কিছুতেই হতে পারে না। মান্টোভাই কোরান ছুঁয়ে বললেও আমি বিশ্বাস করব না।

কী শিশুর মত বিশ্বাস! মনেই হয় না, এই ইসমত মৃত দাদা আজিম বেগকে নিয়ে দোজখি-র মত গল্প লিখতে পারে। ইসমত লিখেছিল, আজিম বেগের লেখা-বলা সব গল্পই মিথ্যে। আজিম বেগ কথা বলতে শুরু করলেই নাকি ওদের বাবা বলতেন, আবার তুমি হাওয়া মহল তৈরি করতে শুরু করলে? আজিম বেগ বলতেন, আব্বাজান, জীবনে যেটুকু রং, তা তো মিথ্যের জন্যই। সত্যের সঙ্গে মিথ্যে না মেশালে, শুনতে মজাদার হয় না। আজিম বেগের। পাগলামিটা ইসমতের মধ্যেও ছিল। অদ্ভুত সব খেয়াল চাপত ওর মাথায়। একবার বলল, মোরগ-মুরগিদের ইশ্য নিয়ে একটা কিস্সা লিখবে। একদিন মনে হল, লেখা ছেড়ে দিয়ে। সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে উড়োজাহাজ চালাবে। জানেন, মির্জাসাব, ও এমনই একটা মেয়ে, হয়তো আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, কিন্তু আপনাকেই সবচেয়ে বেশী আক্রমণ করবে বা আপনার সঙ্গে কথাই বলবে না। হয়তো খুব চুমু খেতে ইচ্ছে করছে ওর, তার বদলে গালে সূচ ফুটিয়ে তামাশা করবে। শফিয়াও ইসমতের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সে-কথা একদিন বলায়। ইসমত শফিয়াকে বলেছিল, বাব্বা, প্রেমে পড়ার আদিখ্যেতা তো তোমার কম নয়! তোমার বয়েসের মেয়েদের বাপেরা আমার প্রেমে হাবুডুবু খায়, আর তুমি এসেছ-। একজন লেখক তো ইসমতের প্রেমে একেবারে দিবানা হয়ে গিয়েছিল; পরেরপর চিঠি লিখত। ইসমতও চিঠি লিখে যেত। শেষে এমন ল্যাং মারল, ভাইজানেরা, লেখকের তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। ইসমত এইরকম, একখণ্ড উড়ো মেঘের মতো। যখন লিখত না, মাসের পর মাস। কেটে যেত, জোর করেও ওকে লিখতে বসানো যেত না। আর লিখতে বসলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যাবে, নাওয়া-খাওয়া-ঘুম ভুলে যেত। শুধু আইসক্রিম রেখে দিতে হবে তার সামনে।

আচ্ছা, মির্জসাব, এই যে ইসমতকে নিয়ে এত কথা বলছি, ওকে আপনি চিনতে পারছেন? যেন নানা রংয়ের-সবুজ, লাল, হলুদ, গোলাপি আবির আনা হয়েছে উঠোনে আর কোথা থেকে হাওয়া আসছে, রংগুলো মিলেমিশে যাচ্ছে, কাউকে আর আলাদা করে ছোঁয়া যাচ্ছে না। ঠিক সেইরকম না? দাদা আজিম বেগকে নিয়ে লেখা ওর দোজখি-র সেই জায়গাটা মনে পড়ছে, মির্জাসাব। একদিন ভোরে শামিম এসে ইসমতকে ডাকল, বলল, তৈরি হয়ে নাও, আজিমভাই মারা যাচ্ছে। ইসমত বলল, আজিমভাই কখনও মরবে না। শুধু শুধু ঘুম থেকে তুললে কেন?

শামিম ওকে ঠেলতে লাগল, ওঠো ইসমত। আজিমভাই তোমাকে খুঁজছে।

-বলো কেয়ামতের দিন দেখা হবে। বলছি না, আজিম ভাই মরতে পারে না।

ইসমত লিখেছিল, জন্নত বা জাহান্নাম, মুন্নাভাই যেখানেই থাকুক, আমি তাঁকে দেখতে চাই। আমি জানি, সে এখনো হাসছে। পোকারা তার শরীর খুঁটে-খুঁটে খাচ্ছে। হাড়গুলো ধুলো হয়ে গেছে, মোল্লাদের ফতোয়ায় তার ঘাড় ভেঙে গেছে। তবু সে হাসছে। দুষ্টু চোখ দুটো নাচছে। বিষে নীল হয়ে গেছে তার দুই ঠোঁট, তবু তার চোখে কেউ জল দেখতে পাবে না। আসলে সে তো এক দোজখ থেকে অন্য দোজখে গেছে।

আজিম বেগের পর আর একজন দোজখি-কে ইসমত খুঁজে পেয়েছিল, আমার মধ্যে। হয়তো পাঁচ মিনিট দেখা হওয়ার কথা, কিন্তু কোথা থেকে পার হয়ে যেত পাঁচ ঘণ্টা। শুধু তর্ক আর তর্ক। আমাকে ও হারাবেই। ওর হারানো মুন্নাভাইয়ের ওপর শোধটা কি আমার উপর দিয়েই তুলতে চাইছিল? মদ খেতে খেতে আমার খুব কাশি হত। ছোটবেলা থেকেই তো কফের ব্যারাম। আমার এই কাশি ইসমত একেবারে সহ্য করতে পারত না। একদিন বলল, এত কাশির অসুখ তোমার, চিকিৎসা করাও না কেন মান্টোভাই?

-চিকিৎসা! ডাক্তার মানেই গাধা। কয়েক বছর আগে ওরা বলেছিল আমি বছর খানেকের মধ্যে টিবি-তে মারা যাব। দেখতেই পাচ্ছ, আমি কেমন বহাল তবিয়তে আছি। ডাক্তারদের চেয়ে জাদুকররা অনেক ভাল।

-তোমার আগে আরেকজনের মুখেও আমি কথাটা শুনেছি। ইসমত গম্ভীর হয়ে বলে।

-কে সেই ফরিস্তা?

-আমার দাদা, আজিম বেগ। এখন কবরে নাক ডাকছে।

হ্যাঁ, মির্জাসাব, আমি একদিকে ওর মান্টোভাই, কখনও মান্টোসাব, অন্যদিকে ওর মুন্নাভাই আজিম বেগ চুঘতাই। দাদার সঙ্গে যে খেলাটা ও খেলতে পারেনি, আমাকে সেই খেলার টার্গেট করে নিয়েছিল। আর ওর বর শহিদ খেলাটা খুব উপভোগ করত; শহিদ জানত, একমাত্র মান্টোকে ছিন্নভিন্ন করেই শান্ত হবে ইসমত; ইসমতের সব দরাজদস্তি মেনে নেবে মান্টো নামের একটা ভাঁড়।

দরাজদস্তি নিয়ে ইসমতের সঙ্গে তর্ক হয়েছিল খুব। একবার শহিদ আর ইসমত আমাদের নেমন্তন্ন করেছে ওদের মালাদের বাড়িতে। খেতে খেতে শহিদ বলল, মান্টো তোমার উর্দুতে এখনও ভুল থাকে কেন?

-বাজে কথা বোলো না।

কথার চাপানউতোর চলল। রাত দেড়টা বেজে গিয়েছে। শহিদ ক্লান্ত হয়ে বলল, ছাড়ো তো এখন, ঘুম পাচ্ছে।

ইসমত কিছুতেই ছাড়বে না। ও তর্ক চালিয়ে যেতেই লাগল। কী একটা কথা প্রসঙ্গে ও দস্তদরাজি শব্দটা বলে ফেলল। আমিও মওকা পেয়ে গেলাম। বললাম, অনেক বড়-বড় কথা বলছ তখন থেকে। দস্তদরাজি বলে কোনও শব্দ হয় না ইসমত। ওটা দরাজদস্তি।

-কিছুতেই না।

-অভিধান দ্যাখো।

-দরকার নেই। আমি বলছি, দস্তদরাজি।

-ফালতু তর্ক করো না।

-তুমি নিজেকে কী মনে করো, মান্টোভাই? উর্দু সাহিত্যের শাহেনশা?

শেষে শহিদ পাশের ঘর থেকে অভিধান নিয়ে এল। দস্তদরাজি বলে কোনও শব্দই নেই। লেখা আছে দরাজদস্তি। শহিদ বলল, ইসমত, তুমি হেরে গেছ, মেনে নিতেই হবে।

কিন্তু ইসমত কিছুতেই মানবে না। এবার শুরু হল স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া। আমি ঠ্যাং-এর উপর ঠ্যাং তুলে বসে মিটিমিটি হাসতে লাগলাম। ততক্ষণে ভোর হয়ে এসেছে; চারপাশে মোরগরা ডাকাডাকি শুরু করেছে। ইসমত অভিধানটা ছুঁড়ে ফেলে বলল, আমি যখন অভিধান তৈরি করব, সেখানে দস্তদরাজি শব্দটাই থাকবে। দরাজদস্তি কোনও কথা হল! যত্তসব।

ইসমত-ও একটা খেপি, সত্যিকারের খেপি। কেউ যদি কখনও সত্যিই আমাদের প্রশ্ন করত, কেন এত টান-ভালবাসা তোমাদের, বলো তো মান্টো, ইসমতের কী তোমার ভাল লাগে? মান্টোর ভেতরের কী তোমাকে টানে ইসমত, জানো? আমি জানি, আমরা দুজনেই কয়েক মুহূর্ত অন্ধকারে ডুবে যেতাম। সেই অন্ধকারে ইসমত আর আমি, পরস্পরের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। কারও জন্যই একটা জীবন যথেষ্ট নয়, মির্জাসাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *