৩২. মাশুল কর্তাদের জিম্মাদারি

মাশুল কর্তাদের জিম্মাদারি

বন্দোবস্তের কাম খতম, পাট্টাদারি দস্তাবেজ তৈয়ার। তখনও একটা বহুত জরুরি কারবার বাকি ছিল, জমাবন্দির কাজটা করা। বন্দোবস্তের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ যদি কিছু হয় তা হচ্ছে জমাবন্দি। এটা হল লাচার কিষানদের সেই “কিতাব” যার উপর ভরসা করে ফয়সালা হবে মামলার। জমির মালিক আর কিরায়াদারদের রাজস্ব কী হবে, তা বাড়বে না কমবে সব ঠিক হবে এর বুনিয়াদের উপর। সেই সময় উত্তর পশ্চিম সুবার হুকুমত যে সব বিশিষ্ট আর দরদি ব্যক্তিদের হাতে ছিল তাঁরা খুব ভাল রকম জানতেন এর কতটা প্রয়োজন। জনাব জান বার্ড সাহিব (Junab Jan Burd Saheb) বার বার তাঁদের হুঁশিয়ার করেছেন। কিন্তু সাহিবানদের খুব বড় ভুল ছিল ভেবে নেওয়া যে তাঁদের হুকুম হুবহু তামিল হবে আর শয়তান ঠিক এই মওকা পেয়ে চড়ে বসল বন্দোবস্তের কাঁধে। কাজ খতম করতে হবে ধরা বাঁধা সময়ে। ডেপুটিরা নোটিশ পাঠালেন জমিদারদের। যতদিন জমাবন্দি না হচ্ছে হুকুম হল ততদিন তাদের তলবানা (tullubana) দিতে হবে। পাটোয়ারিদের সব ধরে বেঁধে দাখিল করা হল ছাউনিতে। জবরদস্তি এমন ধাঁচের দলিল দস্তাবেজ তাদের দিয়ে লেখানো হল যেমনটা আগে তারা কখনও করেনি। পুরোটাই হল কর্তাদের খেয়াল মাফিক। জবরদস্তির হাত থেকে রেহাই পেতে তারা যেমন পারল তেমন লিখে দিল। কিছু কিছু চেষ্টা ছিল যাতে সুবিধা মেলে। কর্তারা হুকুম দিলেন হরেক গ্রামের জমাবন্দির খতিয়ান ঢোল-শোহরত করতে হবে। তারপর সেই কাগজ কোনও খোলা জায়গায় ১৫ দিনের জন্য টাঙিয়ে রাখতে হবে যাতে কোনও ভুল থাকলে সবার নজরে পড়ে। লিখতে পড়তে পারে এমন কিষান আর কটা! যারা পড়তে পারত তারাও দেখল ওই লেখা পড়ে তারা কিছু বুঝতে পারছে না। কেউ গিয়ে দেখল কাগজে তার নামের বদলে লেখা আছে নম্বর। সবাই বেবাক, কী করে ওই নম্বর থেকে জমি চেনা যাবে। নারাজ হয়ে সেই লোক স্ট্যাম্প কাগজে একটা নালিশ রুজু করল ডেপুটিকে। জমাবন্দি নিয়ে ছিল তার ফরিয়াদ। পাটোয়ারিকে হুকুম করা হল মামলা সুলঝে দাও। সে নিজেই জানে না তো সুলঝাবে কী? সেই আদমিকে সওয়াল করা হল— তোর জোত লম্বর দশ বা? জবাব মিলল, গোঁসাই জানে! আরে লম্বর দশ পখোরপর বা ইয়া নেহি? রায়ত এবার খাপ্পা হয়ে উঠল, ক্যায়সে! আবার সওয়াল, লম্বর পাঁচ তোর জোত মে বা? ভগবান জানে! তা হলে কী পশ্চিমে ১০০ নম্বরের পাশে তোর জোত? নেহি; কিন্তু পাটোয়ারি হলফ করে বলতে বসল, সেই জোত তারই, আর শুরুতে যা লেখা হয়েছিল খাতায় সেটাই থেকে গেল।

আমার সেই এক্তিয়ার নেই যে রাজস্ব কর্তাদের বলি, আপনারা জমাবন্দির ভুলচুকের দিকে জরুর নজর রাখবেন। আসলে কাজটা ঠিক করে করতে চাইলে অনেক মেহনত করতে হত। হরেক পরগনায় বসাতে হত ছাউনি। খেয়াল মাফিক কাজগুলো না করে উচিত ছিল ধরে ধরে আদমিদের সওয়াল জবাব করা, তারপর ঝাড়াই বাছাই। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যাবে অবস্থা এই রকম চললে কোনও কাজ হবে না। ইশাদিদের যাচাই পরখ করে করতে হবে ফয়সালা। আমি তো বলেইছি যে জমাবন্দির দস্তাবেজ বানাতে হত একটা আলাদা রকমের ধাঁচায়। যাদের জিম্মাদারি ছিল কাজটা করার তাদের খোদ মালুম ছিল না এই ধাঁচাটা কেমন। তাদের জবানে এই কাজটার নাম হয়েছিল নকশা-ই-প্যারাগ্রাফ (nuksha-i-paragraff)। কারণ সেটেলমেন্ট অফিসারেরা হুকুম দিয়েছিলেন বোর্ডের সারকুলার অর্ডারের একটা প্যারাগ্রাফ মোতাবেক এই নকশা তৈরি হবে। হুকুম মোতাবেক বলা হয়েছিল আসামিদের কার কতটা জমি আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলো নম্বর দিয়ে দিয়ে দাগাতে হবে তারপর জরিপ আর সেটেলমেন্টের দস্তাবেজের সঙ্গে মিলিয়ে করতে হবে যাচাই পরখ। কিন্তু দস্তাবেজে যে গাফিলতি ছিল সে সব শুধরানোর কথা তাঁদের খেয়ালই হল না।

খোদ বেনারসের সরকার যখন এই কাজটাই দশ বছর আগে করে তখন নতিজা কী হয় সে কথাই এবার আমি বলব। কোনও এক গ্রামের জমিদার নালিশ করল তার তিনশো বিঘা খাস জমি গঙ্গার পেটে চলে গেছে আর এই ঘটনাটা হয়েছে জরিপ যখন চালু। এখন তার আর্জি, ওই জমি তার হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হোক। তল্লাশি চালাল কানুনগো আর পাটোয়ারি। হলফ করে তারা বয়ান করল, সত্যিই জমিটা নদীর গর্ভে। হুজুর ফয়সালা করলেন, তহ হুকুম শানে (tah hookoom sanee)। হুজুরের কাছে আরও একটা আর্জি জমা পড়ল। আর্জি জানাচ্ছে কয়েকজন জমিদার আর তাদের রায়ত। তাদের দরখাস্ত, ১৫০ বিঘা জমির খাজনা মকুব করা হোক, কারণ বালুয়া বুর্দ। এবারও আর্জি মঞ্জুর, তা মুলাইজা হুজুর (tah moolaiza Huzoor)। পাঠক একটু হয়রান হয়ে জানতে চাইতে পারেন যে বালুয়া বুর্দ মানে কী? এই দেহাতি বুলির তর্জমা করলে দাঁড়ায় বালির তলায় চাপা পড়া। আর্জি ছিল ১৫০ বিঘা জমি নদীর বালিতে ঢেকে গেছে। সেখানে চাষ করাটা নামুমকিন। আচমকাই সে মামলা গিয়ে পড়ল এমন এক সাহিবের হাতে যিনি জানতেন জরিপের নকশা কেমন করে পরখ করতে হয়। আর্জির সঙ্গে যে কাগজই দাখিল করা হোক না কেন সে সব তাঁর কাছে বেবুনিয়াদ। তাই ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তিনি গেলেন সরেজমিনে। যে জমি বলা হয়েছিল নদীতে তলিয়ে গেছে তা সুজরার (shujarh) সঙ্গে মিলিয়ে পরখ করতে গিয়ে তিনি তো তাজ্জব। জমি হামেহাল। জমিটা হল নদীর উঁচু কিনারায়, তাই তলিয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগই ছিল না আর যে জমিটা বালিতে ঢেকে গেছে বলে দরখাস্ত করা হয়েছিল, নকশায় পরখ করে দেখা গেল আশপাশের যে কোনও জমির থেকে সেটা খাসা। ফয়সালার পাশাপাশি পাটোয়ারির হল সাজা। তাকে বরখাস্ত করা হল নোকরি থেকে। আমি এখন একটাই সওয়াল করতে চাই। সরেজমিনে হাজির না থেকে স্রেফ কাগজ-পত্র যাচাই করেই কি কোনও মামলার ফয়সালা অফিসার লোক করতে পারেন?

জমাবন্দি তৈরির সময় কোনও সেটেলমেন্ট ডেপুটি হাজির ছিলেন না। তাই জমিদারেরা তাদের মর্জি মাফিক বজ্জাতি করার সুয়োগ পেয়েছিল। যার কোনও সাবুদ নেই। কোনও কোনও গ্রামের মাফি (maufee) মিলেছিল। সেটেলমেন্ট অফিসারদের কাছে সার্কুলার গেল আবার করে সেই সব মহলের হিসাব নিতে হবে। পুরোটা নয়, যে জায়দাদের হিসাব নেওয়া হয়েছিল তার আধা হলেই চলবে। নজরে এল যাদের মাফি মিলেছিল তারা সব জাল রসিদ দাখিল করেছে। আসামিদের কাছ থেকে যে মালগুজারি আদায় হয় হিসাবে দেখান হয়েছে তার অর্ধেক। তাই ঠিক হল সরকারকে জমা বাবদ দিতে হবে জায়দাদের চার ভাগের এক ভাগ যেটা দু’ভাগের এক ভাগ হবে ঠিক ছিল। জমাবন্দির নকশা ঠিকঠাক লেখা হল আবার। এক-দু’ বছর যেতে না যেতেই জমিদারেরা দরখাস্ত করল হাকিমকে, খাজনা বাড়াতে হবে। কারণ কর্তারা খেয়াল করেছে পাটোয়োরিরা জেনে বুঝে মোহতিমিনদের নকশায় ভুল হদিশ দর্জ করেছিল। তাদের আর্জি নাকচ হল। কারণটা সাফ, তাদের খিলাফ জোচ্চুরির ইলজাম আর পাটোয়ারিদের নাকি তারাই জুগিয়েছিল ভুল হদিশ। তাই ফল ভুগতে হবে তাদের। সরকারের সমান খাজনা দেখানো হয়েছিল বেশ কিছু জমিদারের জমাবন্দিতে, তারা ভেবেছিল এই করে যদি খাজনা কিছুটা মকুব হয়। ইস্তিমারি বন্দোবস্ত চালু হয়ে গেলে আর কিছু এধার-ওধার খুব সহজ ছিল না। তাই নিজেদের বানানো ফাঁদে জমিদারেরা নিজেরাই পড়ল আর ফয়দা মিলল রায়তের।

সেটেলমেন্ট অফিসে জমাবন্দি দর্জ হওয়ার পর কী সেসব ঠিক করার কোনও চেষ্টা হয়নি? আমি বলব না, হয়নি। কর্মচারীদের ফিকির ছিল কী করে আগের আগের বছরের প্যারাগ্রাফ স্রেফ গুটিয়ে আনা যায় যাতে বন্দোবস্তের কাগজের সঙ্গে যাচাই করলে কোনও গরমিল নজরে না পড়ে। এমন সব মনগড়া লোকেদের নাম ফর্দে লেখা হল যাদের আসলে কোনও অস্তিত্ব নেই। বলা হল তারাই হচ্ছে জমির আসামি। গ্রাম থেকে খাজনা আদায়ের গরমিল থাকলেও কোনও কিছু না পালটে সেটাই হুবহু বজায় রাখা হল। কিন্তু এর কী কোনওই ইলাজ নেই? হরেক জেলায় কেন স্রেফ একজন করে ডেপুটিকে বহাল করা হবে, কেনই বা শুধু তার একার জিম্মাদারি হবে জমাবন্দি আর তাই নিয়ে মামলা মোকদ্দমা হলে তার ফয়সালা করা। গাফিলতি নজরে এলে কেন তাকে বরখাস্ত করা যাবে না? আসলে হালফিল কাজের বহর সামাল দেওয়ার মতো মজবুতি সরকারের ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *